এন্ড্রামেডার ভাইরাস
লেখক: পুষ্পেন মন্ডল
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
রহস্যটা নিশিগন্ধার মনে প্রথম দানা বাঁধে সেলি নামে এক জার্মান সাংবাদিকের সাথে আলাপ হওয়ার পর। সেদিন বিকালে শিকাগোতে তার নতুন অফিস থেকে ফিরে পার্কের এক কোণে বসে ছবি আঁকার সরঞ্জাম বের করে সবে কাগজে আঁচড় কাটতে শুরু করেছিল। কানে হেড-ফোন লাগিয়ে মৃদু যন্ত্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে ছবি আঁকা তার বহু দিনের অভ্যাস। এতে কর্মক্ষেত্রের মানসিক চাপ অনেকটা কমে। হঠাৎ ঘাসের উপরে ছায়ার নড়াচড়ায় মনে হল পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে এক অচেনা মহিলা হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন করল, “তুমি কি প্রতিদিন আসো এখানে?”
সোনালী চুলের ইউরোপিয়ান মহিলাটি প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা, টানটান চেহারা, বয়েস আন্দাজ করা মুশকিল, হয়ত চল্লিশের আশেপাশে হবে। খানিকটা থতমত খেয়ে নিশিগন্ধা জবাব দিল, “না, রোজ আসার সময় পাই না। তবে মাঝে মাঝে আসি। ছবি আঁকাটা আমার হবি। কিন্তু তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না? তুমি কি আমার পরিচিত?”
“না, মনে হয় না। আমি একজন রিপোর্টার, নাম সেলি জোম। বিশেষ প্রয়োজনে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। এই আমার কার্ড। তোমার সাথে কি কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে?”
কার্ডে চোখটা বুলিয়ে ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল। এখন যে সংস্থায় সে কাজ করছে সেখান থেকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া আছে, গবেষণা সংক্রান্ত কোন তথ্য কোন মিডিয়াকে দেওয়া যাবে না। প্রমাণ হলে চাকরি তো যাবেই আবার বিশাল অংকের জরিমানা।
“তুমি যেটা ভাবছ তা নয়। আমি তোমার বর্তমান কাজের বিষয়ে কোন প্রশ্ন করব না। আমার জিজ্ঞাস্য বিষয় ২০৯৯ সালে টেম্পেয়ারের ‘ইউনিভার্সাল’ ল্যাবের বিস্ফোরণ আর ডঃ সেভাল্কারকে নিয়ে।”
নিশিগন্ধা কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল, “তাঁকে নিয়ে কি জানার থাকতে পারে? তিনি তো দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। সবাই জানে।”
“সবাই যা জানে না, আমি তা জানি।” বেশ দৃঢ় গলায় বললেন মহিলা।
“কী জানেন আপনি?”
“ডঃ সেভাল্কার এখনও বেঁচে আছেন।”
“অবিশ্বাস্য! পুরো ল্যাবরেটরিটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিস্ফোরণটা যখন হয় তখন সবাই মাটির অনেক নিচে। কেউ বের হবার সুযোগ পায়নি।”
দুদিকে মাথা নেড়ে সেলি বলল, “চলো আমরা একটু হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। …. আমার কথা মন দিয়ে শোন। তারপর তোমার মতামত দেবে। ‘জেড ইলেভেন’ নামের যে ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা চলছিল, সেটার অস্তিত্ব প্রথম কে খুঁজে পায় সেটা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে?”
নিশিগন্ধা উত্তর দিল, “ডঃ ফেরিন।”
“ডঃ ফেরিন কিভাবে মারা গিয়েছিলেন?”
“মহাকাশযানে করে ফেরার সময়ে ওনার হার্ট এ্যটাক হয়।”
“সেই যানে ডঃ সেভাল্কারও ছিলেন?”
নিশিগন্ধা উপর নীচে মাথা নেড়ে বলল, “মোট তিন জন লোক ছিলেন। বৃহস্পতি অভিযান শেষ করে ফিরছিলেন।”
“ফেরিন, সেভাল্কার আর জু। এদের মধ্যে ফেরিন মহাকাশেই মারা গেলেন। আর জু এখনও বেঁচে আছেন, তবে পুরো প্যারালিসিস অবস্থায়। বর্তমানে এই ‘জেড ইলেভেন’ ভাইরাসটির যাবতীয় তথ্য আছে একমাত্র ডঃ সেভাল্কারের কাছে।”
“এই বিষয় নিয়েই আমাদের পরীক্ষা চলছিল।”
“তুমি কি জানো, এত বছর পরে ঠিক সেই জায়গায় নতুন করে আবার গবেষণাগারটি তৈরি করা হয়েছে? আর আশ্চর্যজনক ভাবে সেটা পুনর্নির্মাণের সময় একটা গোপন সুড়ঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়। তার অন্য মুখটা বেরিয়েছে তিন কিলোমিটার দূরে একটা হ্রদের মধ্যে। এই সুড়ঙ্গের কোন হদিস আগের ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যানে ছিল না। তখন ডঃ সেভাল্কারই ছিলেন পুরো কর্মকাণ্ডের মাথা। সে জন্য সন্দেহের তীরটা তাঁর দিকেই প্রথম যায়। আর এর পরেই যে প্রশ্নগুলি আসে, তা হল, ডঃ সেভাল্কার কি বেঁচে আছেন? বিস্ফোরণের ঠিক আগের মুহূর্তে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে কি বেরিয়ে গিয়েছিলেন? এই দুর্ঘটনার জন্য কি তাহলে তিনিই দায়ী?”
নিশিগন্ধা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবাক গলায় বলল, “কিন্তু তিনি এরকম করবেন কেন?”
“হয়ত এর পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। অন্য একটি সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি যে ‘জেড ইলেভেন’ ভাইরাসটি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময়ে ডঃ সেভাল্কার বুঝতে পেরেছিলেন এর সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারলে মানব জিনের মধ্যে এমন পরিবর্তন করা সম্ভব যাতে যে কোন সাধারণ মানুষের শক্তি, বুদ্ধি আর আয়ু অনেক গুন বেড়ে যাবে। ফলে সে পরিণত হবে এক অতিমানবে।”
নিশিগন্ধা তাকে থামিয়ে, কথার মাঝে বলে উঠল, “আবার উলটোটাও হতে পারত। মানব জাতি মুছে যেত মহাবিশ্ব থেকে। ‘এক্সপিডিশন ডায়নিমেড’, অর্থাৎ বৃহস্পতির সব থেকে বড় উপগ্রহ ডায়নিমেডের নর্থ পোলে যে অভিযান হয়েছিল, সেখানে লবণ হ্রদের মধ্যে থেকে এই ভাইরাস পাওয়া যায়। হয়ত মানব জাতির মৃত্যু অবধারিত জেনে ডঃ সেভাল্কার এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।”
“কিম্বা তাঁর অন্য কোন স্বার্থ ছিল?” সেলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করল, “আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? তুমি যে বেঁচে গেলে, এটা কি শুধুই কাকতালীয়?”
নিশিগন্ধা চোখ বন্ধ করে বলল, “হ্যাঁ, আমার মনে হয় বাই চান্স আমি বেঁচে গেছি।” মুখে এই কথা বললেও মনের মধ্যে একটা সন্দেহ তার আগে থেকেই ছিল।
“তুমি কি এই কথাটা মন থেকে পুরোপুরি বিশ্বাস কর?”
নিশিগন্ধা সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “আমি শুনেছি ইউনিভার্সাল নামে যে সংস্থা বৃহস্পতি অভিযান আর ঐ ল্যাবরেটরির জন্য অর্থ দিয়েছিল, তারাই ডঃ সেভাল্কারকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কারণ ভাইরাস ‘জেড ইলেভেন’ কোন মানব দেহে প্রয়োগ করার তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল ‘জেড ইলেভেন’ মানব শরীরে প্রয়োগ করলে এমন একটা জিনগত বিবর্তন হবে যে মানুষ নিজেদের মধ্যে মারামারি করে গোটা বিশ্ব থেকে মুছে যাবে।”
সেলি বলল, “আর যদি এরকম হয় যে, ডঃ সেভাল্কার ঐ ভাইরাস প্রথমে নিজের শরীরেই পরীক্ষা করতে চান। কারণ তিনি জানতেন ঐ ভাইরাসের প্রভাবে মৃত্যুকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য দূরে সরিয়ে দিতে পারবেন। আর নিজে হয়ে উঠবেন এক মহাশক্তিশালী অতিমানব। বাকি আমাদের মত সাধারণ মানুষরা তখন তাঁর কাছে হয়ে যাব যন্ত্রের মত।”
“এ আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া তিনি যে জীবিত আছেন এটাই তো প্রমাণিত নয়।”
“আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অজানা কোন দ্বীপে তিনি আত্মগোপন করে আছেন।”
নিশিগন্ধা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ডঃ সেভাল্কার বিয়ে করেননি, নিজের বলে কোন দিনই তাঁর কেউ ছিল না। শুধু এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম কয়েক বার শুনেছি তাঁর মুখে। শুভঙ্কর সান্যাল। সেভাল্কারের সিনিয়র। আগে এক সাথে ‘নাসা’য় কাজ করতেন। গবেষণার বিষয় নিয়ে তাঁর সাথে সব সময়েই যোগাযোগ ছিল।”
সেলি মাথা দুলিয়ে বলল, “আমি তাঁর সাথে আগেই কলকাতায় গিয়ে দেখা করেছি। সব কথা শুনে তিনি বললেন, ‘এক্সপিডিশন ডায়নিমেড’ যারা প্ল্যান করেছিল, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ২০৪৯ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে সঙ্কেত পাওয়া যায় বৃহস্পতির সব চেয়ে বড় উপগ্রহ ‘ডায়নিমেড’এ নিশ্চিত প্রাণের চিহ্ন পাওয়া গেছে। পৃথিবীর এত কাছ থেকে প্রাণের স্পন্দন পাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে আমরা যান পাঠানোর পরিকল্পনা করি। সেটা পৌঁছাতেই সময় লাগল পাঁচ থেকে ছ বছর। মোট অভিযানের সময় তের থেকে চোদ্দ বছর। বিশ্বের বাছাই করা দশজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে একটা টিম তৈরি করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বেছে নেওয়া হয় সেরা পাঁচজনকে। যাদের কম বয়েস, শারীরিক সক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি সব থেকে বেশী আর পিছুটান নেই। সবাই জানত বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। এই প্রথম মানুষ মহাকাশযানে করে এতদূর পাড়ি দিল। সেখানে গিয়ে ওরা অন্য গ্যালাক্সির কোন জীবের দেখা পেয়েছিল। তবে তারা কেউ জীবিত ছিল না। একটা ধ্বংস হয়ে যাওয়া মহাকাশযানের ভিতরে মৃত দেহাবশেষ খুঁজে পেয়েছিল ওরা। ভাইরাস ‘জেড ইলেভেন’কে খুঁজে পাওয়া একটা আকস্মিক ব্যাপার। হয়ত এই ভাইরাসের প্রভাবেই সেই এলিয়েনরা মারা গিয়েছিল। আমাদের দুজন বিজ্ঞানীও সেখানে মর্মান্তিক ভাবে মারা যায়। সেই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে ফেরার সময়ে হার্ট এ্যাটাক হয় ফেরিনের। আর জু-এর প্যারালিসিস হয় পৃথিবীতে ফিরে আসার পর। মনের জোরে বেঁচে গিয়েছিল সেভাল্কার।’ এরপর আরও কিছু বলতে গিয়ে চেপে গেলেন ডঃ সান্যাল। আমি বারংবার জিজ্ঞাসা করায় বললেন, ‘পৃথিবীতে ফিরে আসার পর… সেভাল্কারের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখেছি।’ তবে কি পরিবর্তন দেখেছেন সেটা আর খোলসা করে বললেন না।”
“তা এখন তুমি আমার কাছে কি চাও?” সরাসরি সেলির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল নিশিগন্ধা।
“আমরা দুদিন পরেই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অভিযানে বের হচ্ছি। ডঃ সেভাল্কারের উদ্দেশ্য ভালো বা খারাপ যাই হোক, মানব জাতির মঙ্গলের জন্য তাঁকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। তুমি যেহেতু ওনাকে কাছ থেকে দেখেছ আর এই গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলে, তাই তোমাকে আমরা সঙ্গে চাই।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিশিগন্ধা বলল, “আমাকে ভাবার কিছুটা সময় দাও।”
সেলির সাথে সেদিনের কথা এর বেশি আর এগোয়নি। হঠাৎ একটা জরুরি ফোন আসতে তড়িঘড়ি ল্যাবরেটরিতে ফিরে আসতে হয়েছিল নিশিগন্ধাকে। এদিকে তার বর্তমান ল্যাবরেটরি চীফ প্রঃ হেনরি শিফটনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই নিয়ে বিস্তর জল ঘোলা হচ্ছে।
রাতে আবার মনে পড়ল ডঃ সেভাল্কারের কথা। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি থেকে ১৮৫ কিলোমিটার উত্তরে, টেম্পেয়ারে ‘ইউনিভার্সাল’ ল্যাবে শীর্ষ পদে কাজ করতেন ডঃ সেভাল্কার। বছর পাঁচেক আগে এক দুর্ঘটনায় পুরো ল্যাবরেটরি পুড়ে যায়। বলা ভালো ধ্বংস হয়ে যায়। মোট সাত জন বিজ্ঞানী সমেত প্রায় উনিশ জন মারা যান। নিশিগন্ধা তখন জুনিয়ার সাইন্টিস্ট পোষ্টে সদ্য জয়েন করেছে ডঃ সেভাল্কারের অধীনে। দুর্ঘটনাটা যেদিন ঘটে সে সৌভাগ্য বসত বাইরে ছিল। দু কিলোমিটার দূরে একটা শপিং মলে আনাজ কিনছিল। ডঃ সেভাল্কারই পাঠিয়ে ছিলেন তাকে। অথচ এই সামান্য কাজের জন্য তাকে না পাঠালেও চলত। পরে এটা নিয়ে অনেক বার ভেবেছে সে। অ্যাস্ট্রোবায়োফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করতে করতেই ঐ সংস্থায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল। তার ছ মাসের মধ্যেই এই দুর্ঘটনা। ল্যাবরেটরিতে মহাকাশের নতুন কিছু ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময়ে গণ্ডগোল হওয়াতে এই সাংঘাতিক কাণ্ড। নিশিগন্ধার ধারণা হয়েছি ঐ রকম কিছুর আভাস ডঃ সেভাল্কার আগে থেকেই পেয়েছিলেন। তাই নিশিগন্ধাকে কৌশলে সরিয়ে দিয়েছিলেন ওখান থেকে। কিন্তু এখন সেলির কথা শুনে মনে হচ্ছে বিস্ফোরণটা তিনি নিজেই ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু কেন?
**********
উপরের ঘটনার প্রায় মাস খানেক পর শেষ পর্যন্ত নির্জন জঙ্গলের মধ্যে একটা টিলার মাথায় কুঁড়ে ঘরটা খুঁজে পেল নিশিগন্ধা আর সেলি। চারপাশে বড়ো বড়ো গাছে ঘেরা। কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি মাচার উপরে ছোট্ট একটা ঘর। এক ঝলক দেখলে ওয়াচ টাওয়ার মনে হবে। ওরা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। দরজায় তালা নেই শুধু ছিটকিনি আটকানো। অর্থাৎ যিনি থাকেন তিনি এখন বাইরে। ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢুকে দেখল মেঝের উপরেই পাতা একটা অতি সাধারণ বিছানা, পানীয় জলের পাত্র আর রান্নার কিছু সরঞ্জাম। কিন্তু অনেক খুঁজেও এমন কিছুই পেল না যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এখানে বিজ্ঞানী ডঃ সেভাল্কার থাকতে পারেন।
দুজনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুলে রাখল পিঠের রুকস্যাকটা। আজকে ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েছিল ‘রিকিতা’ দ্বীপ থেকে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ ‘ফ্রেঞ্চ পলিনেসিয়া’র রাজধানী পাপিটে থেকে জাহাজে করে ‘রিকিতা’ আসতেই লেগে গেল এক সপ্তাহ। এখানে কাছাকাছি আর কোন বিমানবন্দর নেই। তারপর সেখান থেকে ছোট একটা মোটর বোট ভাড়া করে আশেপাশে যে কটা দ্বীপ আছে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে দু সপ্তাহ ধরে। শেষে ‘তারাভাই’ নামে দ্বীপটির দক্ষিণে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে নেমেছিল আজ। ম্যাপে এর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এই দ্বীপে পা রেখেই নিশিগন্ধার কেন জানি মনে হয়েছিল আজ হয়ত সাফল্য আসবে। কিন্তু এখানেও তেমন কিছু পাওয়া গেল না। ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে বাজে। তার মানে প্রায় আট ঘণ্টার উপর হল ঘুরছে এই অচেনা, নির্জন দ্বীপের পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে। কাঠের মেঝেতে বসে জলের বোতলটা বের করে গলা ভিজিয়ে নিলো। এ যেন খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা। মনের মধ্যে হতাশা দানা বাঁধছে ক্রমশ।
সেলি মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু উপগ্রহচিত্র থেকে এই অঞ্চলে কিছু প্রাণীর নড়া চড়ার সঙ্কেত পাওয়া গিয়েছিল।”
নিশিগন্ধা ক্লান্ত হয়ে মেঝের উপর শুয়ে পড়ে বলল, “আমার মনে হয় না এখানে তিনি আছেন। তবে এই জায়গাটা খুব সুন্দর। একটু জিরিয়ে নিই।”
আকস্মিক ভাবে লক্ষ্য পড়ল মেঝের কাঠের পাটা গুলির উপর। অমসৃণ কাঠের উপর সূক্ষ্ম কিছু আঁকি বুকি করা আছে মনে হচ্ছে! কি আছে তা খালি চোখে বোঝা সম্ভব নয়। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ব্যাগ থেকে চশমাটা বের করে পরে নিল নিশিগন্ধা। এই চশমার ডিজিটাল লেন্সের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াও বড় আকারে দেখা যায়। কাঠের পাটা গুলির দিকে চোখ দিতেই অবাক হয়ে গেল সে। এর মধ্যে অসংখ্য ফরমুলা আর অঙ্ক খোদাই করা আছে। গভীর ভাবে লক্ষ্য করেই বুঝতে পারল এগুলি তার কিছুটা পূর্ব পরিচিত, ভাইরাস ‘জেড ইলেভেন’ সংক্রান্ত। আনন্দের চোটে চিৎকার করে সেলিকে জড়িয়ে ধরল সে। “ডঃ সেভাল্কার এখানেই আছেন। এটাই তাঁর আস্তানা।”
সেলি সব কিছু দেখে বলল, “সাবাস!”
এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! এত বড় নাম করা বিজ্ঞানী, এরকম একটা অজানা, অচেনা দ্বীপে অজ্ঞাতবাসে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন। সারা পৃথিবীর কাছে তিনি মৃত। ভাবলে অবাক লাগে! নিশিগন্ধা বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত ঘন জঙ্গল। লম্বা লম্বা গাছেদের সারি সারি মাথা। টিলার উপর থেকে বহু দূরে নীল সমুদ্রের রেখা দেখা যাচ্ছে। পূর্ব দিকে সূর্যের আলো কমে মেঘ গুলি লাল হয়ে গেছে। ঘরে ফেরা পাখীদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে গেল আকাশ, বন, পাহাড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামবে।
সেলি বলল, “তুমি এখানেই অপেক্ষা কর। আমি চারপাশটা একটু ঘুরে দেখে আসি।”
নিশিগন্ধা মাথা নাড়ল। সেলি চলে যেতে সে আবার কাঠের উপর লেখা ফরমুলা গুলির উপরে ঝুঁকে পড়েছে। একটা জিনিস তার মাথায় আসছে না, ডঃ সেভাল্কার এগুলি কাঠের উপর কেন লিখে রেখেছেন? এতো যে কোন লোকের চোখে পড়তে পারে। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেছে খেয়াল নেই। এখানে মনে হয় কোন আলোর ব্যবস্থা নেই। ব্যাগ থেকে ব্যাটারির আলোটা বের করে জ্বেলে নিল। উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল কাঠের ঘরটা। হঠাৎ বাইরে থেকে একটা চিৎকার কানে এলো। কিন্তু সেটা মানুষের আওয়াজ নয়। অচেনা ভয় যেন চেপে ধরছে মনের মধ্যে। তবে কি আরও সাংঘাতিক কিছু হতে চলেছে?
“আলোটা বন্ধ করো তাড়াতাড়ি।” চমকে উঠে পিছন ফিরে দেখল অন্ধকারের মধ্যে থেকে কখন নিঃশব্দে সেলি এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেই বন্ধ করে দিল ব্যাটারিটা। চাপা আতঙ্কিত গলায় বলল, “ওরা যেকোনো সময় এসে পড়বে।”
“ওরা মানে? কারা আসবে এখানে।”
“জঙ্গলের মধ্যে কিছু অদ্ভুত প্রাণীর পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। মনে হয় এটা এলিয়েনদের আস্তানা।”
“তাহলে স্যার কোথায়?”
“জানি না, তবে জায়গাটা খুব একটা সুবিধের নয়। এখানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো।”
হঠাৎ পশ্চিম দিকের জঙ্গলের মধ্যে গাছপালার ভিতরে একটা সাইক্লোনের মত তোলপাড় চোখে পড়ল। যেন এক দল পাগলা হাতি ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসছে এদিকে। মড়মড় করে আওয়াজ হচ্ছে। সেলি চাপা গলায় বলল, “পালাতে হবে। না হলে মারা পড়ব।”
নিশিগন্ধা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কী ব্যাপার? কিসের শব্দ ওটা?”
“জানি না, এখন দৌড়ও।” সেলি হাত ধরে টান দিল।
ব্যাগটা নিয়ে দুড়দাড় করে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো ওরা। তারপর সেলির পিছন পিছন ছুট। জঙ্গলে গাছপালা, ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পড়িমরি করে দৌড়। টিলার উপর থেকে নিচে নামার সময়ে মনে হল যে কোন মুহূর্তে পড়ে যাবে সে। সেলি ছুটতে ছুটতে ফোনে বলল, “বোট স্টার্ট দাও, আমরা আসছি। ওরা আমাদের তাড়া করছে।”
কাঁটা ঝোপঝাড়ের উপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে হাত-পা ছড়ে যাচ্ছে। নিশিগন্ধা একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল খাঁজের মধ্যে। উঠতে গিয়ে যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল। পাটা হয় ভেঙেছে, না হয় মচকে গেছে। দৌড়ানোর ক্ষমতা আর নেই। সেলির নাম ধরে চিৎকার করেও কোন লাভ হল না। উলটে ফল হল বিপরীত, অন্ধকার ফুঁড়ে দুড়দাড় করে অদ্ভুত দর্শন কিছু প্রাণী এসে ঘিরে ধরল ওকে।
অক্টোপাসের মত লম্বা একটা শুঁড়, চটচটে আঠালো রবারের মত জড়িয়ে ধরল নিশিগন্ধাকে। বিচ্ছিরি গন্ধে নাক ঝাঁঝাঁ করছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে যাবে। তীক্ষ্ণ একটা রিরি শব্দে দপদপ করতে শুরু করল মাথার ভিতরটা। তারপরেই শুঁড়ে জড়িয়ে মাটি থেকে শূন্যে তুলে নিলো ওকে একটা প্রাণী। চোখের সামনে তখন ঘন অন্ধকার। আর কিছুই মনে নেই।
***********
মাথাটা যেন প্রচণ্ড ভারি হয়ে আছে। খুব কষ্ট করে চেয়ে দেখল অন্ধকারের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে বন্দী। আরও কিছুক্ষণ পর চোখটা অল্প আলোয় সয়ে যেতে লক্ষ্য করল সেটা একটা মোটা কাঁচের জার। ভিতরে কোন রকমে সোজা হয়ে দাঁড়ানো বা কষ্ট করে বসা যাচ্ছে। উপরের দিক থেকে হালকা নীলচে আলো এসে পড়ছে। নিচে ঘন কালো অন্ধকার। একটা নলের সাহায্যে মাথার দিক থেকে অক্সিজেন সাপ্লাই হচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারল স্থানটা সমুদ্রের গভীরে। আশেপাশে দু-একটা সামুদ্রিক প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপরের নীল আলোটা নিশ্চয়ই সূর্যের রশ্মি সমুদ্রের জল ভেদ করে আসছে।
কিছুক্ষণ পর খেয়াল হল আরও এরকম অনেক জার রয়েছে চারপাশে। তার মধ্যেও বহু মানুষ বন্দী। কেউ নড়াচড়া করছে, কেউ একেবারে ঝিমিয়ে আছে। কিন্তু ওদের এরকম দশা হল কি করে? মনে পড়ল অক্টোপাসের মত চটচটে শুঁড়ওলা প্রাণীগুলির কথা। এরা তো পৃথিবীর প্রাণী বলে মনে হয় না। তারাই কি ওদের জারে বন্দী করে রেখেছে? এখানে ওরা এলো কীভাবে? গতকাল সন্ধ্যার পরে ওকে ধরেছিল, আর এখন উপরে সূর্যের আলো। তারমানে প্রায় বারো ঘণ্টার উপরে এখানে বন্দী সে। কিন্তু পায়ে চোট লাগা ব্যথাটা আর মালুম হচ্ছে না। নিশিগন্ধা খেয়াল করল পিঠের রুকস্যাকটা নেই। প্যান্টের পকেট হাতড়ে একটা সরু পেনসিল টর্চ পেল। সেটা জ্বেলে অন্য জার গুলির দিকে ফেলল। পাশের জারেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন। বেঁচে আছেন না মারা গেছেন বোঝার কোন উপায় নেই। খুব চেনা চেনা লাগল মুখটা। তারপর বিদ্যুতের ঝলকের মত মনে পড়ল, সাইন্স জার্নালে বহুবার ওনার ছবি সে দেখেছে। একবার পেড্রুতে লেকচার শোনার সুযোগও হয়েছিল। নাম প্রফেসার স্টিফেন গ্রেগ, মহাকাশ-বিজ্ঞানী। তার ডানদিকে লম্বা লম্বা ঘাড় পর্যন্ত চুল, এনাকেও চেনে, ডঃ ইকবাল, জেনিভার মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের চীফ। এনার চোখ খোলা আছে। কিন্তু মনে হয় না কিছু দেখতে পাচ্ছেন। কি রকম নেশার ঘোরের মত দৃষ্টি। তার পাশে দু একজন অচেনা মানুষ। পরে আবার কয়েকজন চেনা। যেমন মিসেস বেলমন্ট, ডঃ জেকভ। এনারা সবাই কোন না কোন ভাবে মহাকাশ গবেষণার সাথে যুক্ত। কিন্তু এক সাথে সবাই এখানে জড়ো হলেন কিভাবে? সমুদ্রের নিচে জলের স্রোতের সাথে জার গুলি মৃদু আন্দোলিত হচ্ছে। বেশ কিছুটা দূরের একটা জার সেই আন্দোলনে ধীরে ধীরে সামনে এসে হাজির হল। নিশিগন্ধা আঁতকে উঠল দেখে। প্রঃ হেনরি শিফটন!! তাদের শিকাগোর ল্যাবরেটরির হেড, যাকে বেশ কিছুদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁর চোখে আলো পড়তেই খুব কষ্ট করে চাইলেন। কিন্তু মুখের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হল না। আবার জারটা স্রোতের টানে আস্তে আস্তে দূরে সরে গেল। নিশিগন্ধার মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড ভয় চেপে ধরছে। চিন্তা করার মত মানসিক অবস্থা আর নেই।
সে লক্ষ করল শয়ে শয়ে অক্সিজেনের নল নেমেছে উপরের একটা বড়ো ভাসমান যান থেকে। আরও কিছুটা পরে দেখল অক্টোপাসের মত চারটে প্রাণী সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে এদিকেই। দেখেই সে অজ্ঞানের মত ভান করে বসে পড়ল হাঁটু মুড়ে। অনেকক্ষণ ধরে প্রত্যেকটা জার খুঁটিয়ে লক্ষ করে শেষে গোটা চারেক জার খুলে নিয়ে ফিরে গেল তারা। ভয়ে মৃতের মত পড়েছিল ও। কাদের নিয়ে গেল? কি করবে ওদের সাথে? ভাবতে ভাবতে চিন্তাশক্তি আবার কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছে। অক্সিজেনের সাথে কি অন্য কোন গ্যাস ঢুকছে ভিতরে? তাই হবে। না হলে চোখ এরকম বন্ধ হয়ে আসছে কেন? হাজার চেষ্টা করেও আর চোখ খুলে থাকতে পারছে না। যেন ক্লান্ত শরীর গভীর ঘুমে ঢলে পড়ছে। চেতনা গুলি লোপ পাচ্ছে আবার।
কতক্ষণ এরকম তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কাটল জানা নেই। সময়ের ধরনাটাই চলে গেছে তখন। কখনও মনে হচ্ছে সারা জীবন সে এ ভাবেই আছে। হঠাৎ মনে হল জারের গায়ে কে যেন টোকা দিচ্ছে। প্রথমে স্বপ্নের মতো লাগলেও, একটু সজাগ হতে খেয়াল করল ঠকঠক করে একটা মৃদু কম্পন। মনের সব শক্তি জড়ো করে চোখ খুলে তাকাল নিশিগন্ধা। জারের বাইরে মুখোস পরা একটা ডুবুরী। চোখগুলি কাঁচের জারের গায়ে ঠেকাতে চিনতে পারল, সেলি! সে কী করে এলো এখানে? ও কি নিশিগন্ধা কে উদ্ধার করতে এসেছে?
হ্যাঁ, ওর হাব ভাব দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে। জারের উপরে নলের সাথে একটা যন্ত্র লাগিয়ে বড় ছুরি বের করে কেটে দিল নলটা। তারপর অন্য একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের মুখে নলটা ঢুকিয়ে দিয়ে এঁটে দিল সেলি। টাটকা অক্সিজেন ঢুকতে লাগল ভিতরে। ও বুঝতে পারল ইন্দ্রিয় গুলি আবার সজাগ হয়ে উঠছে। সেই অবস্থাতেই জার সমেত সেলি তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। সেলির হাতে একটা আন্ডার ওয়াটার হ্যান্ড স্কুটার। বেশ অনেক দূর ঐ ভাবে যাবার পর নিশিগন্ধা দেখল সমুদ্রের মধ্যে একটা লম্বাটে কালো বস্তু ধীরে ধীরে কাছে আসছে। একটা সাবমেরিন। ওরা এগিয়ে আসতেই নিচের দিকে একটা দরজা খুলে গেল। তার ভিতরে প্রবেশ করতে আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়ে জল বেরিয়ে ভর্তি হয়ে গেল অক্সিজেন।
সেলি ডুবুরির পোশাক খুলে ফেলে একটা যন্ত্রের সাহায্যে জারের ঢাকনাটা খুলে বের করে আনল ওকে।
“কেমন আছো? শরীর ঠিক আছে?”
সেলির প্রশ্ন শুনে নিশিগন্ধা ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিল ঠিক আছে সে।
“চলো আমার সাথে। তোমার বডি স্ক্যান করতে হবে। তারপর জীবাণুনাশক ভ্যাকসিন পুষ করা হবে। যাদের খপ্পরে পড়েছিলে, তারা তো এ গ্রহের জীব নয়। অতএব আগে থেকেই সতর্ক হওয়া ভালো। তবে চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকত না। তোমার দশাও অন্যদের মত হত।”
আরও কিছুক্ষণ লাগল তার শরীর পরীক্ষা করতে। নিশিগন্ধা দেখল সাবমেরিনটা বেশ বড়ো এবং আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত। লোকজনও কম নেই। তারাও সবাই সামরিক পোশাক পরা।
তার মাথার মধ্যে এখনও অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে। কথাটা বুঝতে পেরে সেলি বলল, “তোমাকে সব বলছি। একটু ধৈর্য ধরো। প্রথমে পরিচয় করিয়ে দিই, এ হল আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন লিন জু, এলিয়েন স্পেশালিষ্ট। ডঃ জুয়ের ছেলে। বর্তমানে বিশ্ব-রক্ষা প্রকল্পের কর্মকর্তা। বহুদিন থেকেই বাইরের জগতের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করছে।”
লিন ওদের কন্ট্রোল রুমে নিয়ে গেল। চারিদিকের দেয়ালে মনিটর। ফুটে উঠছে কত রকমের গ্রাফ আর ছবি। সে বলল, “বুঝতে পারছি পুরো ঘটনাটা তোমার কাছে এখনও ধোঁয়াশার মত। আপাতত সংক্ষেপে বলছি, পৃথিবী থেকে আড়াই লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে ‘এন্ড্রোমিডা’ নামে যে গ্যালাক্সি আছে মহাকাশে, তার বেশ কয়েকটি গ্রহ কয়েক হাজার বছর আগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সভ্যতার বিচারে তারা বর্তমান মানুষের থেকে এগিয়ে ছিল অনেক। হয়ত বিনাশের কারণ এই ভাইরাস ‘জেড ইলেভেন’। কি আছে এর মধ্যে তা সঠিক ভাবে এখনও কেউ জানে না। মহাবিশ্বের কোথায় এর উৎস তাও অজানা। এই ভাইরাসের প্রভাবে কোন প্রাণীর জিনে অনেক রকম পরিবর্তন হতে পারে। হয় তারা এত উন্নত হয়ে যাবে যে গোটা ব্রহ্মাণ্ডে উপনিবেশ স্থাপন করতে পারবে। না হলে, এমনও হতে পারে তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে সবাই মারা যাবে। গোটা গ্রহটাই ধ্বংস করে ফেলবে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ‘স্পাইরাল’ গ্যালাক্সির ‘এস.এম.৪৫’ নামে গ্রহ থেকে মহাকাশযানে করে কয়েকটা প্রাণী এসে পৌঁছায় বৃহস্পতির উপগ্রহ ডায়নিমেডে। ওরা মানুষের মত বায়বীয় পরিবেশের প্রাণী নয়। বিশেষ কিছু সুবিধা যুক্ত তরল পরিবেশের গ্রহ খুঁজছিল। ডায়নিমেডের উপরের ত্বকের ভিতরে রয়েছে সেই রকমই লবণাক্ত তরল পদার্থ। কিন্তু অজানা কোন কারণে তারা সবাই মারা যায়। এই ভাইরাসটি সম্ভবত ওদের মৃত্যুর জন্য দায়ী। হয়ত মহাকাশের সুদূর যাত্রাপথে কোথাও ওদের মহাকাশযানের সাথে আটকে গিয়েছিল। মৃত শরীর গুলি নিয়ে বহু বছর পড়েছিল মহাকাশযানটি। তারপর ডঃ সেভাল্কারের দলটি গিয়ে পৌঁছায় সেখানে। মানসিক ভাবে দুর্বল প্রাণীকে এই ভাইরাস দ্রুত আক্রমণ করে। দুজন বিজ্ঞানী সেখানেই মারা যান। জানা যায় তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে একটি বিশেষ ধরনের জারের মধ্যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আর চাপে ভাইরাসটির নমুনা সংগ্রহ করে সেভাল্কার শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই ভাইরাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিশাল সম্ভাবনা।”
“তারপর?” নিশিগন্ধা প্রশ্ন করল।
“সেভাল্কারের কাছ থেকে ‘ইউনিভার্সাল’ নামে কোম্পানিটি ভাইরাসটিকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। সেজন্য তিনি ফিনল্যান্ডের গবেষণাগারটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। গোপনে ভাইরাসটিকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের এই ছোট্ট অজানা দ্বীপে।”
“সে সব তো বুঝলাম। কিন্তু এই অদ্ভুত প্রাণী গুলি এখানে কি করছে? এতজন মহাকাশ বিজ্ঞানীকে মৃতপ্রায় অবস্থায় বন্দী করে রেখেছে কেন?”
লিন বলল, “ভাইরাস ‘জেড ইলেভেনে’র পিছনে ধাওয়া করে ‘স্পাইরাল’ গ্যালাক্সি থেকে আর একদল এলিয়েন এসে এখানে সমুদ্রের নিচে ঘাঁটি গেড়েছে। ওদের মহাকাশযানের চারপাশে একটা অদৃশ্য তরঙ্গের বলয় ঘিরে আছে। এই জন্য পৃথিবীর রাডারে ধরা পড়েনি। এরাও পৃথিবীর দখল নিতে চায়। দেখতে অনেকটা অক্টোপাসের মত, উভচর প্রাণী। পৃথিবীতে যত বড় বড় মহাকাশ বিজ্ঞানী আছেন তাদের বিভিন্ন ভাবে সঙ্কেত পাঠিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে টেনে আনছে ঐ দ্বীপটিতে। তুমি কাঠের পাটার উপরে যে ফরমুলা গুলি পড়তে পেরেছ, ওটা বিজ্ঞানীদের কাছে এক রকমের টোপ। তাঁদের মস্তিষ্কের সমস্ত তথ্য শুষে নিচ্ছে এই এলিয়েনরা। পরে এই তথ্য গুলিই মানুষের বিনাশের কাজে লাগাবে।”
কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে নিশিগন্ধা বলল, “তোমরা কি করছ? এখনও হাত গুটিয়ে বসে আছ কেন? ধ্বংস করে দাও ঐ মহাকাশযানকে।”
“অতটা সহজ নয়। আমরা আণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করলে, ওরাও ছেড়ে কথা বলবে না। অস্ত্রের ভাণ্ডার ওদেরও কিছু কম নেই। এত দূর থেকে ওরা যথেষ্ট তৈরি হয়েই এসেছে পৃথিবীর দখল নিতে। আমাদের সাবমেরিন কাছাকাছি গেলে এটাকেও উড়িয়ে দিতে পারে ওরা। আমার ধারণা আরও কিছু মহাকাশযান স্পাইরাল গ্যালাক্সি থেকে পৃথিবীতে আসছে। ওরা এসে গেলে এক সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।”
“তাহলে এখন আমাদের করণীয় কি?”
সেলি বলল, “লিন একটা পথ বের করেছে। ওর তৈরি বায়োসিন্থেটিক জীবাণু প্রয়োগ করতে হবে, ওদের ডেরায় ঢুকে। বাইরে থেকে চার্জ করলে ওরা প্রতিহত করে ফেলবে। তখন পৃথিবীর প্রাণীরাই মারা যাবে।”
“কিন্তু ওদের যানের মধ্যে ঢোকা কি সম্ভব?”
“সম্ভব। যাদেরকে ওরা জারে পুরে রাখছে, তাদের মস্তিষ্কের তথ্য বের করার জন্য যানের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে একবার করে। যদিও বেহুঁশ করে দিচ্ছে আগে থেকে। আমাদের একজনকে ঐ জারের মধ্যে পুরে আবার রেখে আসা হবে সেখানে। সে যাতে জ্ঞান না হারায় তার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তাকে শুধু ঠিক সময় মত ভিতরে ঢুকে ভাইরাল বমটা ফায়ার করতে হবে। ব্যাস। মহাবিশ্বের কোন প্রাণীর ক্ষমতা নেই এর প্রভাব থেকে বেঁচে ফিরবে। যানের মধ্যে সব কটা প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারলে ওদের বাইরের যোগাযোগ ধ্বংস হয়ে যাবে।”
এক মুহূর্তে চিন্তা করেই নিশিগন্ধা বলল, “আমি প্রস্তুত।”
“তুমি আবার যাবে? ভালো করে ভেবে দেখ। ওখানে গেলে কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যু।”
“ভাবা আমার হয়ে গেছে।”
এরপরে আরও কিছুটা সময় লাগল যন্ত্রপাতি গুলি নিশিগন্ধার শরীরের মধ্যে সেট করতে। তারপর আবার তাকে সেই জারের মধ্যে ঢুকিয়ে এঁটে দেওয়া হল মুখ। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সেলি তাকে নিয়ে গিয়ে আগের জায়গায় পৌঁছে দিল। সেই কাটা নলটা খুঁজতে যদিও সময় লাগল কিছুটা। তারপর সেই অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে কয়েকশো জারের সাথে মিশে গেল নিশিগন্ধা। এবার শুরু হল প্রতীক্ষা। তবে আগের মত আর কষ্ট হচ্ছে না। অক্সিজেনটা জারের মুখ দিয়ে পিউরিফাই হয়ে নামছে। মনের মধ্যে একটা জেদ চেপে বসেছে। পৃথিবীতে মানুষের প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার বিনিময়ে তার নিজের জীবন কিছুই নয়।
কিছুক্ষণ পর নিশিগন্ধা দেখল সেই প্রাণীগুলি এদিকে আসছে। এবারে ওর পালা। দম বন্ধ করে চুপ করে পড়ে থাকল। চোখের কোন দিয়ে দেখল আরও বেশ কয়েকটা জার সমেত তাকেও টেনে নিয়ে একটা ডিম্বাকৃতি যানের মধ্যে গিয়ে ঢুকল ওরা। যানের ভিতরটাও ঘন তরল ভর্তি। একটা লম্বা মত ঘর। বিচ্ছিরি দেখতে প্রাণীগুলি কিলবিল করছে সেখানে। জারের মুখ গুলি একে একে মস্ত একটা স্বচ্ছ যন্ত্রের গায়ে চেপে ধরছে। মানুষ গুলি তার মধ্যে চলে যাচ্ছে জার থেকে। ভিতরটা মনে হয় বায়বীয়। সেখানে ট্রেতে শুইয়ে, মাথায় একটা বাটির মত টুপি লাগিয়ে ইলেকট্রিকের মত শক দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীর গুলি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে থরথর করে কেঁপে উঠে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! চোখের সামনে এসব দেখে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তার।
নিশিগন্ধাকেও নিয়ে গিয়ে সেই যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে একই ভাবে শুইয়ে দেওয়া হল ট্রেতে। একটা যান্ত্রিক হাত মাথাতে বাটিটা পরানোর জন্য এগিয়ে আসছে। সে নিজেও তৈরি। চোখ বন্ধ। একবার মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। হাতে শক্ত করে ধরা বায়োসিন্থেটিক বম্বের ট্রিগার। একবার চেপে ধরলেই এদের ভবলীলা সাঙ্গ।
“স্টপ….” একটা চিৎকার শুনে চোখটা আপনা থেকেই খুলে গেল। বুড়ো আঙুলটা ধরা রইল ট্রিগারের মাথায়। এখানে পৃথিবীর ভাষা শুনে সে খুবই অবাক হয়েছে। কিছুক্ষণ অদ্ভুত একটা ভাষায় কথা বলল ওরা নিজেদের মধ্যে। তারপর একজন আপাদমস্তক সাদা পোষাকে ঢাকা মানুষ এগিয়ে এলো নিশিগন্ধার দিকে। মাথার উপরেও হেলমেট। কাছে এসে বলল, “তুমি এখানে এলে কীভাবে?” গলাটা শুনেই চিনতে পারল। ডঃ সেভাল্কার।
কি উত্তর দেবে ভেবে ওঠার আগেই তাকে ট্রে থেকে হাত ধরে নিচে নামিয়ে নিলেন তিনি। অন্য গ্রহের প্রাণী গুলি এগিয়ে আসতে হাত তুলে বাধা দিলেন তাদের। আশ্চর্য! তারা সেভাল্কারের কথা শুনছে?
নিশিগন্ধা কোন রকমে আড়ষ্ট গলায় বলল, “আপনি এখানে স্যার? এই প্রাণী গুলির সাথে? এরা তো পৃথিবীকে দখল করতে এসেছে।”
হেলমেটটা খুলে ফেলে হেসে বললেন, “না, না। এরা পৃথিবী দখল করতে আসেনি। পৃথিবীর মানব সভ্যতাকে আরও হাজার বছর এগিয়ে দিতে এসেছে। দেখতে খারাপ হলেও এদের মত ভালো মনের প্রাণী সারা ব্রহ্মাণ্ডে আর নেই। আমার এদের সাথে প্রথম যোগাযোগ হয় বৃহস্পতির উপগ্রহ ‘ডায়নিমেড’ থেকে। সেখানে পরিত্যক্ত মহাকাশযানটির যন্ত্রপাতি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে এদের সাথে সাংকেতিক ভাষায় কথা হয়েছিল। পরে পৃথিবীতে ফিরে বুঝতে পারি ভাইরাস ‘জেড ইলেভেন’এর মধ্যে জিনগত কিছু পরিবর্তন করে মানব শরীরে দেওয়া যাবে। কিন্তু এই কাজের জন্য আমাদের পৃথিবীর কোন ল্যাবরেটরি যথেষ্ট নয়। আবার যোগাযোগ করি এদের সাথে। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে আস্ত একটা ল্যাবরেটরি মহাকাশযানে করে পাঠিয়ে দিল এখানে। সঙ্গে এসেছে ওদের গ্রহের কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী।”
নিশিগন্ধা অবাক গলায় বলল, “তাহলে এরা আমাদের বিজ্ঞানীদের ধরে এনে কী করছে?”
“এদের পদ্ধতিটা একটু অদ্ভুত। তবে তাতে কাজ হয় তাড়াতাড়ি। বিজ্ঞানীদের এখানে এনে মস্তিষ্কের ভিতরে বিশেষ পদ্ধতিতে পরিবর্তিত ‘জেড ইলেভেন’ ভাইরাস ঢোকানো হচ্ছে। এর ফলে মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বেড়ে যাবে অনেক গুন আর পদার্থ বিজ্ঞানের মূল থিওরি গুলির ধারণা আমূল বদলে যাবে। এদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। দু-এক দিনের মধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে এরা। আর আগামী দশ বছরের মধ্যে মানব সভ্যতার বিজ্ঞানে যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। তারপর মানুষ ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।”
এরপর আরো বিস্তারিত ভাবে সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন ডঃ সেভাল্কার। কিভাবে ‘ইউনিভার্সাল’ তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল বললেন সে কথাও। সেলি আর লিন আসলে ওদের হয়েই কাজ করছিল। তাই ওকে ভুল বুঝিয়েছে তারা।
**********
ছপাস ছপাস করে শুভ্র ফেনিল ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে পা। সেই ঘটনার দুদিন পরে স্পাইরাল গ্যালাক্সির মহাকাশযানটি ফিরে গেছে। নিশিগন্ধা ছোট্ট দ্বীপটির সাদা বালির তটে অন্ধকারের মধ্যে চিত হয়ে শুয়ে উপরের জ্বলজ্বলে তারায় ভরা আকাশগঙ্গার দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে ভাবছিল এই ঘটনাগুলি। মানুষ হয়ত কয়েক দশকের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়বে ব্রহ্মাণ্ডের গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। সেভাল্কার তার মস্তিষ্কেও ভাইরাসটি প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। সে রাজি হয়নি। তার কাছে এখনও এই সুন্দর পৃথিবীই সব থেকে বেশি প্রিয়।
**********
Tags: এন্ড্রামেডার ভাইরাস, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, পুষ্পেন মন্ডল, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা