এস. এফ.-এর রূপান্তর: বাংলায় কল্পবিজ্ঞান এবং সাম্রাজ্যিক টেকনো-সায়েন্স
লেখক: বোধিসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায়, গবেষক, উসলো বিশ্ববিদ্যালয়
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
Abstract in English
In this paper, I look at current theories on global science fiction (sf) that are alert to the role of imperialism in sf literature. Examining the work of Istvan Csicsery-Ronay, Jr., John Rieder, and Patricia Kerslake, among others, I describe how these theories, which deal primarily with sf produced by former colonial powers, may be extended in the context of sf produced by writers from the colonies during the colonial period and after independence. While little attention had been paid to sf produced by countries outside the Anglo-American and European world in early sf historiography, current sf criticism is investigating these in a larger global context (for instance Eastern European, Latin American, African, West and South Asian). In this paper, I do not attempt a historical telling, as has been done in most of these approaches (some of which I have reviewed). Instead, using the lens of genre studies and select Bangla texts from 1890-1990 as case study, I explore thematic nodes that could have wider applicability for global sf. I identify three such nodes: one, a tendency towards self-reflexive parody that consistently mocks the appropriation of “Western” science from a nationalist perspective while being open to it as a tool for progress of the underdeveloped colonised native; two, imagining utopian alternative histories of universalism while being fully saturated with nationalist images for purposes of cultural pride, and; three, the tendency to continually appropriate pre-colonial myths for their supposed scientific content in order to create a sense of self-worth. For Bangla sf or kalpabigyan, specifically, I argue that its characteristics are the result of a resistance to the general homogenising tendency of techno-scientific modernity in colonial Bengal. That is, sf in Bengal during its emergence phase was not an entity that represented the unquestioned triumph of the modern sciences and technology, or of post-Enlightenment technoscientific rationalism, but as a liminal site where the synchronistic impulse of European colonial knowledge could be entangled with multiple, conflicting subaltern histories as a method for historical revisionism and a rationale for political anti-colonial nationalism. I argue that this also affects sf produced in Bengal and India in the present and explore several of these connections.
বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশন (এস.এফ.) সাধারণত কল্পবিজ্ঞান নামে অভিহিত। কল্পবিজ্ঞানের উৎপত্তির বিশ্লেষণ সাধারণতঃ দু ভাবে করা হয়। প্রথমত: ধরেই নেওয়া হয় যে এস.এফ. নামক বিশ্বব্যাপী ফেনোমেননের প্রতিনিধি-মূলক লেখার উৎপত্তি অ্যাংলো-আমেরিকান বা ফরাসী ভাষায় এবং বাংলা কল্পবিজ্ঞান সেই ধরনের লেখার একটি ছোট উপধারা। দ্বিতীয়ত: বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের উৎপত্তির কোনো প্রনালীবদ্ধ বিশ্লেষণাত্মক লেখার/আলোচনার অভাব এবং সেই জন্যেই একথা সত্যি বলে মেনে নেওয়া যে বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক জনপ্রিয় রচনার ধারাই কল্পবিজ্ঞানের উৎস। এই দু’ ধরনের বিশ্লেষণ জন্ম দিয়েছে এই এক-মাত্রিক ধারণার যে উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক উৎস থেকেই কল্পবিজ্ঞানের শুরু হয়েছে যার সমান্তরাল উদাহরণ অন্যান্য ভাষাতেও আছে। এ বিষয়ে লেখাও হয়েছে অতি সামান্য। তাৎপর্যমূলক লেখা বলতে বাংলায় লিখেছেন সিদ্ধার্থ ঘোষ (১৯৮৮) এবং রবীন বল (১৯৯৭) এবং ইংরাজিতে দেবযানী সেনগুপ্ত (২০০৩), ভট্টাচার্য ও হিরাধর (২০১৪), এবং চট্টোপাধ্যায় (২০১৩এ, ২০১৩বি)। সেনগুপ্ত এবং ভট্টাচার্য ও হিরাধরের লেখা প্রধানত ঐতিহাসিক। জন রিডারের (২০০৮) যুক্তি অনুসরণ করলে এস.এফ.-কে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখাটা সহজ হয়। রিডারের পরবর্তী লেখা (২০১০) এস.এফ.-এর শ্রেণীগত (জনার) উৎপত্তির প্রশ্নটি জটিল করে দেয়। অন্যান্য সমালোচকরা যেমন ইস্ত্ভান চ্সিচ্সেরি-রনে, জুনিয়র যেসব দেশে টেকনো-সায়েন্টিফিক উন্নয়ন হয়েছে এবং যেখানেই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ (ঔপনিবেশিক, উত্তর-ঔপনিবেশিক, নব্য-ঔপনিবেশিক, এবং নব্য-সাম্রাজ্যবাদী) কায়েম হয়েছে, সেখানেই এস.এফ.-এর উত্থান এবং গুরুত্বের বিষয়টি সমীক্ষা করেছেন (চ্সিচ্সেরি রনে ২০০২, ২০০৩; কার্স্লেক ২০০৭)। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের উৎপত্তির বিকল্প গতিপথ অনুসন্ধান করতে গেলে এই দু’ ধরনের গৃহীত-বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে । এই প্রবন্ধে আমি কোনো ইতিহাস-সিদ্ধ তথ্য আলোচনা করব না। আমি চাইছি রিডার এবং চ্সিচ্সেরি-রনে এবং আমার আগের প্রবন্ধের (২০১৩সি) যুক্তিগুলোকে এগিয়ে নিয়ে কল্পবিজ্ঞানকে বিশ্লেষণ করার এক পরিবর্তিত শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতির কথা । আমার যুক্তি হল ঔপনিবেশিক বাংলায় টেকনো-সায়েন্টিফিক আধুনিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে সব কিছুকেই সমগোত্রীয় ধাঁচে ফেলার প্রবনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফলশ্রুতিই কল্পবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ, বাংলায় এস.এফ.-কে আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তি বা পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট টেকনো-সায়েন্টিফিক যুক্তিবাদের জয়যাত্রার কোনো নতুন সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়নি। বাংলায় এস.এফ.-এর অস্তিত্ব আগে থেকেই দুঃসাহসিক অভিযান এবং ফ্যান্টাসির মধ্যে নিহিত ছিল। কল্পবিজ্ঞান এমন একটি ধরনের সাহিত্য যেখানে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং তার সমন্বয় করার আবেগকে বহূধাবিভক্ত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত করে ঐতিহাসিক সংশোধনবাদ এবং উপনিবেশ-বিরোধী রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে-বিপক্ষে ব্যবহার করা যায়।
এস.এফ. এবং কল্পবিজ্ঞানের সাম্রাজ্যে
এস.এফ. এবং কল্পবিজ্ঞানের জনার ইতিহাসের আলোচনার ক্ষেত্রে একথা স্বীকৃত যে সায়েন্স এবং উপনিবেশবাদের মধ্যে যোগসূত্রটি এস.এফ. নামক সাহিত্যের ধারার জনক। এই যোগসূত্রটি এই ধারার প্রথম দিকের লেখাগুলোর থেকেই প্রকট। উদাহরণ হিসেবে বুলওয়ার-লিটন, এচ.জি.ওয়েল্স, জুল ভার্ন এবং আলবার্ট রবিদা-র গল্পগুলির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কাহিনীগুলোর অন্তর্নিহিত সংঘাত সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে, আবার এরকম যুক্তিও দেত্তয়া যায় যে এই ধরনের সাহিত্যের প্রতি পাঠকসকলের আগ্রহের কারণ ছিল কিছুটা ঔপনিবেশিক দেশগুলির এক সমগোত্রীয় সার্বভৌম কল্পনা-ভিত্তিক ভবিষ্যতের প্রতি মুগ্ধতা আর কিছুটা গল্পগুলোর অন্তর্নিহিত সংঘাত যা গড়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনাকে বানচাল করার প্রচেষ্টায়। সে কারণেই বুলওয়ার-লিটন-এর আর্য ভ্রিলরা অবক্ষয়িত প্রজাতিদের ধ্বংস করে ফাঁপা ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে ওপরের পৃথিবীর লোকজনকে ধ্বংস করার জন্যে উঠে আসে এবং নিজেদের ন্যায়সঙ্গত জায়গা করে নেয়, আর এচ.জি.ওয়েল্স-এর মঙ্গলগ্রহের প্রাণীরা ব্রিটেন-এর অন্ত:স্থল বিনাশ করে দেয়। সাহিত্যের এই ধারার শুরু থেকেই প্রচুর পরিমানে ভবিষ্যতের কাল্পনিক যুদ্ধের বিবরণ দেখা যায় (ক্লার্ক ১৯৭৯) । এই যোগসূত্রটির প্রথম তাত্ত্বিক উপস্থাপনা করেন চ্সিচ্সেরি-রনে (২০০৩)। উনি বলেন:
“এস.এফ. সাহিত্যের ধারার উত্পত্তির তিনটি কারণ: প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যা সাম্রাজ্যবাদকে পরিচালনা করেছে; সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যে উপনিবেশগুলির অধিবাসীদের মধ্যে সাহিত্য সংক্রান্ত সাংস্কৃতিক যোগাযোগ নিবিড় হওয়া; এবং টেকনো-সায়েন্টিফিক সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের কাল্পনিক মডেল।” (২০০৩, ৩১; আমার অনুবাদ)
চ্সিচ্সেরি-রনের মতে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার ফলে এস.এফ.-এর উদ্ভব হয়েছিল। এই পরিকল্পনার চালিকাশক্তি শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয় বরং ক্রমাগত উন্নয়নশীল প্রযুক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ এবং শাসন করবার সাম্রাজ্যবাদী স্বপ্ন। অর্থাৎ, অন্যত্র আমি যাকে প্রযুক্তিগত ভবিষ্যতবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছি তা সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার দ্বারা প্রভাবিত (২০১৩এ )। উদাহরণ হিসেবে জাপানের মতো দেশগুলিতে ঠিকঠাক এস.এফ. ধারার লেখার আবির্ভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে। চ্সিচ্সেরি-রনে একে বলেছেন এস.এফ.-এর বিশ্বজনীন-মডেল।
গ্লোবালাইজেশনের দৃষ্টিভঙ্গিতে কাল্পনিক ভবিষ্যতের কথা ভেবেও চ্সিচ্সেরি-রনে মনে করেন যে শুরু থেকেই এস.এফ. কোনরকম সীমানার ধারণার প্রতিরোধী এবং সে কারণেই সাম্রাজ্যবাদের মডেল-টির নানারকম অসঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও এস.এফ. তাকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। চ্সিচ্সেরি-রনের মতে এস.এফ.-এ পাঁচ ধরনের স্থান-চ্যুতি দেখা যায়: ১.) ট্রান্স-গ্যালাকটিসিজম, যেখানে সাম্রাজ্যগুলির অবস্থান মহাশূন্যে এবং যেখানে সাংস্কৃতিক বা জাতিগত পার্থক্য অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক অথবা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়; ২) কর্পোরেট গ্লোবালাইজেশান, অর্থাৎ বাজারের গ্লোবালাইজেশান যেখানে সব জায়গাই একই ধরনের দেখতে হয়ে গেছে এবং যেখানে একই ধরনের জিনিস কেনা-বেচা হয়; ৩) অ্যাপোক্যালিপটিক উইন্নোইং, যেখানে এক প্রলয়ংকর দুর্বিপাক জনসংখ্যাকে ঐকিক পোস্ট-কালচারাল সত্ত্বায় পরিণত করেছে; ৪) বায়োলজিকাল ডিসপ্লেসমেন্ট, যেখানে কোনো ভিনগ্রহের প্রাণীকে কল্পনা করে মানুষের সাথে তার জাতিগত পার্থক্য ও সেই সঙ্গে মানবজাতির বিভিন্ন রূপের সূচক হিসেবে দেখানো গেছে; ৫) আর্কাইকাইজেসন যা ব্যবহার করা হয় কোনো এক কল্পিত অটুট সমাজব্যবস্থার গল্পে তাদের খেয়ালিপনা দেখাবার জন্যে। উনি এও বলেছেন, যেমনটি মার্কসবাদী সমালোচকরা দেখিয়েছেন যে এস.এফ. লেখকরা যে শুধুই সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে লিখেছেন তা নয় (এ বিষয়ে নিয়ে লিখেছেন কার্ল ফ্রিদমান, ২০০০ ও ফ্রেদ্রিক জেমসন ২০০৫)। তাদের লেখা প্রায়শ:ই সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী কল্পনার বিরুদ্ধে। আবার এস.এফ. ধারার মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রূপান্তর এবং পরিবর্তন, তাই এস.এফ. সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার বিরোধী (সুভিন ১৯৭৯)। তবে চ্সিচ্সেরি-রনের মতে এস.এফ. ধারার প্রযুক্তিনির্ভরতার সবচাইতে বড় প্রমাণ হলো প্রযুক্তি এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের মধ্যে মোক্ষম যোগসূত্রটি। উনি সেই কারণে মনে করেন যে “ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সোভিয়েত-রাশিয়া, জাপান, এবং আমেরিকার” মতো টেকনো-কালচারাল ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে ঐতিহ্যময় এবং প্রভাবশালী এস.এফ. ধারা তৈরী হয়েছে।
প্যাট্রিশিয়া কার্স্লেক “সায়েন্স ফিকশন এন্ড এম্পায়ার” (২০০৭) বইটিতে চ্সিচ্সেরি-রনের মতো এস.এফ.-এ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা করেন নি। উনি গবেষনাটিকে সীমিত রেখেছেন এস.এফ.ধারার কিছু নির্বাচিত প্রতিনিধিমূলক লেখাতে এবং এস.এফ বহির্পাতনের জন্যে সাম্রাজ্যের প্রেক্ষাপটের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কার্স্লেকের মতে সাম্রাজ্যের বিষয়বস্তু একটি দিগন্ত বা প্রেক্ষাপট, সাম্রাজ্যবাদের কল্পনার ক্রমাগত বিবর্তনের কোনো বিশেষ পশ্চিমী পরিকল্পনা নয়। চ্সিচ্সেরি-রনের যুক্তি সম্প্রসারিত করে উনি দেখিয়েছেন কিভাবে যে কোনো এস.এফ. ধারা, ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক নির্দিষ্টতা নির্বিশেষে সাম্রাজ্যের ধারণা নিয়ে চলে:
“এস.এফ.-এ সাম্রাজ্যের ধারনাটি কিভাবে ব্যবহার হয়েছে তা বুঝতে গেলে মনে করতে হবে যে এটি কোনো পশ্চিমী সাংস্কৃতিক পক্ষপাতপূর্ন প্রবণতা নয় যেমনটা সাধারণতঃ ধরে নেওয়া হয়। বরং এর প্রেরণা বহুবিধ, যার কোন একটির প্রবণতা যে কোনো মানুষের মধ্যে থাকতে পারে। শেষ বিচারে, বিশ্বজোড়া ক্রমবিস্তৃত বাজার এবং মানুষের বিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এস.এফ.-এ সাম্রাজ্যের অবস্থানের আলোচনা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির এক ইতিবাচক হাতিয়ার। সাংস্কৃতিক সৃষ্টির জন্যে সাম্রাজ্যের কিছু ভূমিকা আছে বলেই আমরা এখনো সাম্রাজ্যের বিষয়টিকে বাদ দিইনি। এবং যতদিন না আমরা এক বিশ্বজনীন অস্তিত্ব অর্জন করতে পারব যখন ক্ষমতা অভীষ্ট বা প্রশংসনীয় থাকবে না ততদিন আমরা ঐ কল্পিত সাম্রাজ্যবাদের সমস্যাসঙ্কুল দিকগুলো নির্ধারণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাব। জল খাই কিন্তু জলের স্বাদহীনতার কথাও বলতে ছাড়ি না। তেমনি অজস্র এস.এফ. কাহিনীর মূল উপজীব্য সাম্রাজ্যের বিষয়টি। সাম্রাজ্যের ইন্টেলেকচুয়াল উপস্থিতি ভালমন্দের বাইরে এক নিরপেক্ষ বিষয়। কাহিনীগুলোর কাল্পনিক বৈশিষ্ট্য এতে বর্ণিত স্থান, নীতির দ্বারা পরিচালিত ঘটনাবলির ওপর নির্ভরশীল।এই অবিরত প্রকৃতি নির্ধারণ এস.এফ.-কে বুদ্ধিমত্তার সক্রিয়তা ও আশা জাগানোর ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে।” (১৯১; আমার অনুবাদ)
কার্স্লেক যেভাবে সাম্রাজ্যের এই নিরপেক্ষ উপস্থাপনা করেছেন তা অনেকটাই ইউটোপিয়ান। কারণ একদিকে যেমন সর্বগ্রাসী একচ্ছত্র ক্ষমতার জন্যে সাম্রাজ্যের সমালোচনা করা হয়েছে, অন্যভাবে আবার সংকীর্ণ ও সম্ভাব্য ফ্যাসিস্ট জাতীয়তাবাদের নিন্দা বা সমালোচনা করবার জন্যও সাম্রাজ্যকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই দ্বৈততার ধারাবাহিক অস্তিত্ব এস.এফ.-এ শুধুমাত্র এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে না বরং এস.এফ.-এর প্রকৃতিগত বৈপরীত্যের ওপর আলোকপাত করে। এই বৈপরীত্যের কারণে এস.এফ.-কে সাম্রাজ্যবাদের প্রসঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্প্রসারণের প্রতি সতর্ক থাকার সাথে তার ইউটোপিয়ান সম্ভাবনার দিকেও দৃষ্টি রাখতে হয়। চ্সিচ্সেরি-রনের গবেষণার আরো একটি সমস্যার দিক যেখানে যে এস.এফ.-এর কর্তৃত্বের ধারনাকে মনে হয় যেন একপেশে সাম্রাজ্যবাদী ধারণা যা এস.এফ.-এর অন্য ধরনের চমৎকার ভালো রচনাগুলিকে নস্যাৎ করে দেয়। কার্স্লেক এই সমস্যার দিকটি এড়িয়ে গেছেন। এ রকম যুক্তি দেওয়া যায় যে সিচ্সেরি-রনের দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্পর্কে এক বিশেষ ধারণা প্রসূত যা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি প্রস্তাবিত বিজ্ঞানই এস.এফ. ধারা শুরুর কারণ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং উন্নয়ন ও প্রগতি, কলোনাইজার (উৎপাদক) থেকে কলোনাইজড (ভোক্তা) পর্যন্ত একটি রৈখিক প্রক্রিয়া, এরকম ধারণার সৃষ্টি করে। অথচ সাম্রাজ্যবাদী বিজ্ঞান অন্যান্য কলোনাইজড দেশের বিজ্ঞানের সাথে প্রতিযোগিতা করেছিল, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল যার ফল স্বরূপ এস.এফ. ধারার বা অনেক রকমের বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যের উত্পত্তি হয়েছিল কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা এই ধরনের প্রচেষ্টাকে অবদমন করেনি। চ্সিচ্সেরি-রনের গবেষণায় এই দিকটিও অনুপস্থিত।
এই যোগসূত্রটির ঐতিহাসিক বিচারে জন রিডারের গবেষণা সবচাইতে উল্লেখযোগ্য। তার কারণ রিডার গবেষণা শুরু করেছেন এস.এফ.-এর সূত্রপাতের মুহূর্ত থেকে অর্থাৎ ঔপনিবেশিক যুগ থেকে এবং গবেষণাটি সেই যুগটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন – যেমনটি চ্সিচ্সেরি-রনে বা কার্স্লেক করেন নি। সাইদিয়ান কাঠামো ব্যবহার করে এস.এফ.ধারার প্রথম দিকের লেখাগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত করেছেন। প্রত্যেকটি শ্রেণী অ্যাংলো-আমেরিকান কল্পিত দৃষ্টিভঙ্গিতে ঔপনিবেশিক ব্যবহারের সূচক। অবলুপ্ত জাতির মোটিফ, দো-আঁশলা মানুষ-জন্তু, অন্যভাবে উদ্ভব মানুষ এবং পোস্টহিউম্যান, আকস্মিক বিপর্যয়কারী ঘটনা, যন্ত্রের মতো প্রাণী – এ সবই রিডারের শ্রেণী-বিন্যাসের অন্তর্ভুক্ত যেমনটি ঔপনিবেশিক কল্পবিজ্ঞানেও আছে। এস.এফ.-এর উদ্ভবের মুহূর্ত চিহ্নিতকরণকে এই এস.এফ. ধারাটি সম্পর্কে শ্রেনীবিন্যাস নিশ্চিত ভাবে স্পষ্ট করে। এই ছোট অথচ তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি রিডার স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার পরবর্তী লেখায় (২০১০)। রিডার পাঁচটি যুক্তি দেখিয়েছেন:
“১) এস.এফ. ধারা ঐতিহাসিক এবং পরিবর্তনশীল;
২) এস.এফ.এর কোনো একমাত্রিক মূল বৈশিষ্ট্য নেই এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট উদ্ভবের মুহূর্ত নেই;
৩) এস.এফ. বিভিন্ন ধরনের গল্পের অন্তর্গত পারস্পরিক প্রক্রিয়াকে সংকেত করার জন্যে ব্যবহার করা হয়;
৪) ঐতিহাসিক এবং পরিবর্তনশীল সাহিত্যিক ধারাগুলির সাথে এস.এফ.এর বিশেষত্বের প্রভেদ আছে;
৫) কোনো লেখাকে তার কোনো একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য এস.এফ. হিসেবে সংকেত করাটা পাঠকের গ্রহনক্ষমতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য।” (১৯৩; আমার অনুবাদ)
রিডারের মতে সাহিত্যের কোনো ধারা তখনই স্পষ্ট হয় যখন ধারাটির কোন সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। রিডার যাকে ওয়েব অব রেসেম্বল্যান্স বা সাদৃশ্যের জাল বলেছেন, উদ্ভবের মুহূর্ত তার থেকে গৌন। সাদৃশ্যের জাল হলো সেই প্রতীকি মুহূর্ত যেখানে কোনো ধরনের রচনার বিষয়বস্তুগুলির মধ্যে মিল থাকার ফলে সাহিত্যিক ধারা হিসেবে তার নামকরণ হয় এবং নামকরণ করেন সেই গোষ্ঠী যারা এস.এফ.-কে চিহ্নিত করবার সক্রিয় চেষ্টা করেছেন। সাহিত্যের কোনো ধারার উদ্ভব ইতিহাসের আলোচনায় নি:সন্দেহে এই পদ্ধতিটি একটি সূক্ষ্ম তাত্পর্য বহন করে, বিশেষ করে এস.এফ. স্টাডিস এবং জনার স্টাডিসের ক্ষেত্রে। পদ্ধতিটির সুবিধা অনেক। প্রথমত:, উদ্ভবের ধারণাটাই বাদ দিয়ে হায়ারারকিকাল এবং ভারটিকাল সিম্পল ইন্ফ্লুয়েন্স মডেলকে ছেড়ে একটা হরাইজন্টাল আবণ্টিত মডেলের দিকে এগোতে পারা যায় যেখানে একেই ধারার লেখার উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন রচনা যে কোনো সাহিত্য বা বিষয়বস্তুর অন্তর্গত হতে পারে। যেমন জনারকে কোনো স্থির অস্তিত্ববিহীন “ম্যুটেবাল মোবাইল” সত্তা হিসেবে ভাবা যায় না (লাটুর ১৯৮৭), তেমনি সাহিত্য/শিল্প কোনো স্থির সত্তা নয়। তা চারপাশের বিভিন্ন শিল্পকর্ম ক্রমাগত: আহরণ করে এবং বদলে দেয়। সেই পরিবর্তন যে কোন ঐতিহাসিক সংবেদনশীলতা থেকে আসছে তা নাও হতে পারে, সাধারণত: অভিনব কিছু করার অনুপ্রেরণাই তার উৎস। বৌল্ড এবং ভিন্টের যুক্তি একটু বদল করে বলা যায় যে এস.এফ. নামক একটা জনার আছে বটে, কারণ সেই ধরনের আমরা কিছু একটা উদ্ভব করি, কিন্তু আমরা যেই জিনিসটাকে এস.এফ. বলি তার কোনো বৈশিষ্ট্য কোনো এক লেখাতে পাওয়া যাবে না, কারণ সেই বৈশিষ্ট্যগুলো অনেক ধরনের লেখার মধ্যে থেকে তৈরী হয়। কারণ, যেমন রিডারের মতকে আরো এগিয়ে আমি অন্য জায়গায় বলেছি, এস.এফ.-এর সায়েন্স বিষয়টিকে আমাদের আরো সূক্ষ্ম ভাবে ভাবতে হবে। বিজ্ঞানচর্চার অনুশীলনের ঐতিহাসিক দিক এবং পদ্ধতিগত দিক, দু’ভাবেই – বিভিন্ন রকমের জ্ঞান-কে পদ্ধতিগত ভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করাই বিজ্ঞান (চট্টোপাধ্যায় ২০১৩বি )। দ্বিতীয়ত, যুক্তিটিকে আরো এগিয়ে নিয়ে বলা যায় যে যদি সাম্রাজ্যবাদী টেকনো-সায়েন্স এস.এফ-কে পরিচালনা করে, তবে সেই টেকনো-সায়েন্স প্রভাবিত উপনিবেশিত (কলোনাইজড)/ নব্য-উপনিবেশিত এলাকার লেখকরা স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদী এস.এফ-এর বিপরীতধর্মী রচনা সৃষ্টি করবে এবং প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে আচরণ করে তাকে বদলে দেবে। এই পদ্ধতিতে বিচার করলে সাম্রাজ্যবাদী এস.এফ. এবং কলোনাইজড এস.এফ. ধারা দুটিকেই এস.এফ.-এর ঐতিহ্যের অংশীদার হিসেবে ভাবা যেতে পারে বিশেষ করে গ্লোবালাইজড্ পৃথিবী আর জিওপলিটিক্যাল ইমব্যালান্সের পরিপেক্ষিতে। এই কারণেই একবিংশ শতকে গ্লোবাল এস.এফ. নিয়ে গবেষণা খুব বেশি করে হচ্ছে।
বাংলা কল্পবিজ্ঞানেও উদ্ভবের প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। সিদ্ধার্থ ঘোষ (১৯৮৮) সম্ভবতঃ প্রথম যিনি এই বিষয়ে লিখেছিলেন। ওনার প্রবন্ধটিতে পুরো বিশ্বের এস.এফ.-এর সাংস্কৃতিক ধারার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা কল্পবিজ্ঞানকে তুলনামূলক ভাবে দেখা হয়েছে। সে কারণে উনি শুধু বাংলা কল্পবিজ্ঞানকে নিয়ে না লিখে সব ধরনের এস.এফ.-কে নিয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখেছেন। শুধু তাই নয়, ওনার মতে কল্পবিজ্ঞান বাংলা এস.এফ.-এর জন্যে সঠিক শব্দ নয়। তার জায়গায়, উনি বলেছেন যে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু যে “বৈজ্ঞানিক রহস্য” শব্দবন্ধটি ওনার প্রথম গল্পতে ব্যবহার করেছিলেন, সেটাই সঠিক নাম। প্রথম দিকের বাংলা ম্যাগাজিনে বিদেশী এস.এফ.-এর অনুবাদ নিয়ে আলোচনার পরে উনি উপনিবেশক সময়ে লেখা কল্পবিজ্ঞানের কথা বলেছেন। তারপর এস.এফ.-এর স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস, বিশেষ করে সত্যজিত রায়ের বাংলা এস.এফ. এবং সিনে ক্লাব নিয়ে আলোচনা করেন। ঘোষ এও বলেন যে ওনার লেখার আগে পর্যন্ত বাংলা এস.এফ.- কে নিয়ে কোনো ভালো স্টাডি হয়নি, এবং এই নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। ১৯৮৮ একটা অদ্ভুত সময়। সত্তর এবং আশির দশকের সরগরম ম্যাগাজিনগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তার আগের বছর প্রাকস্বাধীনতা এবং পরবর্তী সময়ের প্রধান কল্পবিজ্ঞান লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র গত হয়েছেন। সত্যজিত রায় গুরুতর অসুস্থ (চার বছর পরে তিনিও গত হন)। আর যেসব উল্লেখযোগ্য লেখক, যেমন অদ্রীশ বর্ধন, লীলা মজুমদার ইত্যাদি লিখছিলেন কেউ মিত্র বা রায়ের মত খ্যাতি ও সমীহ তখনও পাননি। এস.এফ. ম্যাগাজিনগুলো বন্ধ হবার পর কল্পবিজ্ঞান ছোটদের এবং তরুণদের নিয়ে লেখার উপধারায় পরিণত হয়েছিল।
এর পরে রবীন বল কল্পবিজ্ঞান নিয়ে একটি ছোট ইতিহাস লেখেন: “বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা” (১৯৯৬)। বইটির বিশেষত্ব এই যে বাংলায় বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য নিয়ে উপলব্ধির ভিত্তিতে উনি বাংলা ভাষায় এস.এফ.-এর উদ্ভবের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেছেন। ঘোষের পরিতাপ থেকে বেরিয়ে রবীন বল বোঝাবার চেষ্টা করেছেন কিভাবে জনার (genre) নিয়ে বিতর্ক বাংলা এস.এফ.-এর জগৎকেও উজ্জীবিত করেছিল। রচনাটি খুব উঁচুদরের নয় এবং রবীন বল কোনো একটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর বিশদ বিশ্লেষণও করেননি। তবুও, উনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে লেখাকে, কল্পবিজ্ঞান যার অন্যতম একটি ধারা, কিভাবে শ্রেণী-বিন্যাস করা যায় এবং বোঝা যায়, তার একটি পথ নির্দেশ করেছেন। রবীন বল বিজ্ঞাননির্ভর এবং বিজ্ঞানভিত্তিক রচনার মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করার চেষ্টা করেছেন। উনি বলতে চেয়েছেন যে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা অ্যাংলো-আমেরিকান ভাবনার এস.এফ.-কে বোঝায়। আর বিজ্ঞাননির্ভর লেখা বলতে বোঝায় সেই সব উপাখ্যানকে যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক তথ্য অন্তর্নিহিত। রবীন বলের মতে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং কল্পবিজ্ঞান এই দুটি ধারাই বিজ্ঞাননির্ভর রচনার অন্তর্ভুক্ত। উনি বিজ্ঞানভিত্তিক রচনার তিন রকম শ্রেণীবিন্যাস করেছেন: ১) বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞানের গল্প (এস.এফ. এবং ফ্যান্টাসি); ২) বিজ্ঞানভিত্তিক সরস প্রবন্ধ; এবং ৩) বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞানের ছড়া-কবিতা। বিশেষ ভাবে উল্লেখনীয় সেই পরিচ্ছেদটি যেখানে রবীন বল বাংলা কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছেন। একটি সাক্ষাত্কারে এইচ.জি.ওয়েল্স এবং জুল ভার্ন নিয়ে সত্যজিত রায় বলেছিলেন ওনার পছন্দ সেই ধরণের লেখা যা কল্পনার সুদূর মহাকাশে বিচরণ করলেও বৈজ্ঞানিক তথ্যবিচ্যুত হয় না। সত্যজিত রায়ের মতামত উল্লেখ করার পরেই রবীন বল অদ্রীশ বর্ধনের বিপরীত মতামতের কথা মনে করিয়ে দেন। বর্ধন সম্ভবত মিত্র এবং রায়ের পরে কল্পবিজ্ঞানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখক। বর্ধন বলেন:
“আসলে এ জাতীয় লেখা যারা লেখেন, তাঁরা কল্পনার জগৎটাকে খুব বেশি ভালবাসেন। বাস্তবের বাঁধাধরা গণ্ডী থেকে পালিয়ে যেতে চান এমন একটা দুনিয়ায় সেখানে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী থেকে ব্যাকরণের তর্জনী শাসনে আড়ষ্ট হয়ে থাকার কোনো প্রয়োজন হয় না। এরা লেখেন কল্পনার মনপবনের ঝোড়ো হাওয়ায় অস্থির হয়ে। কোনো রীতিনীতির দিকে ভ্রুক্ষেপ করেন না।” (৩৭)
এর পর রবীন বল ক্ষিতীন্দ্রনারায়ন ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধ অভিমতের কথা উল্লেখ করেন:
“কল্পবিজ্ঞান লিখতে গেলেই অজানা গ্রহলোকের বা অনুরূপ কাল্পনিক পরিবেশের বা অসম্ভব রকমের কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে পাঠককে নিয়ে যেতে হবে এ আমি বিশ্বাস করি না বরঞ্চ অনুচিত বলেই মনে করি, কারণ যা বিজ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয় তাকে বড় জোর ফ্যান্টাসি বলা যেতে পারে বিজ্ঞাননির্ভর বলা যায় না.” (৩৮)
ভট্টাচার্যের মতে কল্পবিজ্ঞান বিজ্ঞাননির্ভর হতেই হবে এবং তাকেই এই ধারার শ্রেণীভুক্ত গণ্য হবে, অন্যথা তা হবে ফ্যান্টাসি। ভট্টাচার্যের মতে ধারা দুটি আলাদা এবং এদের একসাথে কল্পবিজ্ঞান আখ্যা দেওয়া ভুল। ফলে প্রশ্ন ওঠে যে বর্ধন এবং ভট্টাচার্য কি একই ধরনের সাহিত্যের কথা বলছেন? অথবা উপনিবেশক সময়ে এস.এফ.-এর উত্সই কি ভট্টাচার্যের ধারণা কে প্রভাবিত করছে? স্বাধীন ভারতের অবক্ষয়িত বাংলা থেকে মুক্তিলাভের ইচ্ছেটাই কি বর্ধনের এবং এ ধরনের সাহিত্যের মূল?
এর পরে রবীন বল সরাসরি প্রাক-স্বাধীনতা যুগের এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনা ও কল্পবিজ্ঞানের ধারাবাহিকতার প্রসঙ্গ আনেন। রবীন বল ঔপনিবেশকালের ইতিহাসের বাংলায় বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা সম্পর্কে বেশি আগ্রহী। তাই তার লেখায় অন্তর্নিহিত এবং কখনো স্পষ্টভাবে থাকে এই উপলব্ধি যে টেকনো-সায়েন্টিফিক সংস্কৃতিটি সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার ফল, এবং বাঙালির সৃষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ তা দেশের বৈজ্ঞানিক এবং লেখকদের (যাঁদের অনেকেই স্বাধীনতার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে কাজ করেছেন) উত্থানের প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধরনের প্রসঙ্গে শতদ্রু সেন (২০০৪) বলেছেন যে সাহিত্য জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে জুড়ে ছিল এবং এস.এফ.-এর শিক্ষামূলক সম্ভাবনার কথা এই ধারার প্রথম দিকের লেখকদের নজর এড়ায়নি। এও উল্লেখনীয় যে অ্যাডভেঞ্চার ফিকশন আর কল্পবিজ্ঞানের পুরুষালী দিকটি নিয়ে “রিয়ালিজম এন্ড রোমান্স” এর মতো বিতর্ক না হলেও ছেলেদের এবং মেয়েদের নিয়ে লেখালেখিতেও প্রকাশ হয়েছিল এবং সাধারণত এ ধরনের লেখায় স্ত্রী-চরিত্র কম থাকা সত্তেও যথেষ্ট পাঠিকা ছিল। এ ক্ষেত্রেও বিংশ শতকের প্রথম দশকের জাতীয়তাবাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বাংলা কল্পবিজ্ঞান এবং অন্যান্য ভাষায় এই ধারার লেখার সংযোগের বিষয়টি বিবেচনা করতে গেলে তিনটি সংযোগস্থলের কথা আসে যেগুলো একই সাথে সাদৃশ্য ও বৈপরীত্যগুলি প্রকাশ করে দেয়। যদিও জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, আমার যুক্তি হলো এগুলো শুধুই যে কল্পবিজ্ঞানের উদ্ভবের সাথে জড়িত তা নয়, বরং জনার-টির বৈশিষ্ট্যেরও নির্ধারক এবং সাম্রাজ্যের বিষয়বস্তুটি এখনো এই জনারের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। পরবর্তী অধ্যায়ে তিনটি সংযোগস্থল: মিথ ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক, ডিলোকালাইজড্ লোকেল (delocalised locale), এবং প্যারডি ও স্যাটায়ারের আধিপত্য নিয়ে আলোচনা করবো। এটা খুবই সম্ভব যে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য অন্যান্য উপনিবেশিত দেশের এস.এফ. লেখার মধ্যেও দেখা যেতে পারে।
ডিলোকালাইজড্ লোকেল
ডিলোকালাইজড্ লোকেলকে চ্সিচ্সেরি-রনে এক ধরনের ডিসপ্লেসমেন্ট হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এস.এফ. এবং ফ্যান্টাসির একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য লেখকের এবং গল্পের চরিত্রগুলোর কাছে সম্পূর্ণ অজানা, এক ভিন্ন জায়গায় জাতীয় ও সাংস্কৃতিক নির্দেশকগুলির প্রতিস্থাপন। ডিলোকালাইজেসন মানে গ্লোকালাইজেসন নয়। গ্লোকালাইজেসনের অর্থ একটি লোকাল অথচ গ্লোবাল অর্ডার অথবা গ্লোবালিটারিয়ানিজমের (ভিরিলীয় ১৯৯৮) সাবসেট অর্থাৎ লোকাল হলো গ্লোবালের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বদলে দেওয়া জায়গায় প্রতিস্থাপনের ফলে লেখক এবং গল্পের চরিত্রের জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো বেশি করে স্পষ্ট হয়। এটি একটি সাধারণ লক্ষণ এবং প্রথম দিকের এস.এফ.-এর. প্রথম দিকের প্রায় সব লেখাতেই তা প্রকট। লক্ষণটি এস.এফ.-এর সাম্রাজ্যবাদী কল্পনাতেও নিশ্চিত ভাবে উপস্থিত। সাম্রাজ্যবাদী কল্পনায় পরিবর্তিত ল্যান্ডস্কেপ (যা উপনিবেশিত সংস্কৃতির সূচক) ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকগুলো দেখাবার সুযোগ করে দেয়। উপনিবেশিত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ডিলোকালাইজড্ লোকেল, উপনিবেশিকতা বিরোধী জাতীয়তাবাদের কারণে উপনিবেশিত হিসেবে সহানুভুতির পাত্র হয় না, সে সমর্থন এবং সম্মান আদায় করে নেয় উপনিবেশিত থেকে ঔপনিবেশিক উত্তরণের মাধ্যমে। যদি ঔপনিবেশিক দেশের লেখকদের লেখাতে আত্মসমালোচনার সম্ভাবনা দেখা যায়, তবে সেই লেখাকে উপনিবেশিত দেশের লেখকের লেখাকে নকল হিসেবে জ্ঞাত হয়। একই মোটিফের পুনরাবৃত্তি দুরকম ভাবে দেখা যায়: একটিতে জাতীয়তাবাদী অথবা ঔপনিবেশিক আত্মসমালোচনা আর অন্যটিতে অনুকরণ এবং ভণ্ডামি – ঠিক হোমি ভাভার যুক্তির অর্থাৎ অনুকরণ ইতিবাচক এবং ফলদায়ক তেমনটা ভেবে নয় বরং নেতিবাচক যেখানে অনুকরণ, সাহিত্যের কোনো মূল বা প্রভাবশালী ধারার নিছক প্রতিফলন হিসেবে গণ্য হয় (ভাভা ১৯৯৪)।
ডিলোকালাইজড্ লোকেল সাধারণত তিন ধরনের সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অথচ আলাদা কাল্পনিক তাত্পর্য বহন করে: ১) অ্যানালগ (analog), যেখানে কোনো কাল্পনিক স্থান বাস্তবের প্রতিফলন (যেমন সমুদ্রের নিচে কোনো মহাদেশ, বা কোনো অন্য অজানা গ্রহ); ২) কাল্পনিক বাস্তব, যেখানে কোনো এলাকার অবস্থান বাস্তব জয়গায় কিন্তু তার প্রতিবেশ ও পারিপার্শিক কাল্পনিক (যেমন মঙ্গল গ্রহ বা চাঁদ, এমনকি আমাজনের রেনফরেস্ট বা এই পৃথিবীর কোনো অনাবিষ্কৃত জায়গা); এবং ৩) রি-ক্রিয়েশন, যেখানে কোনো বাস্তব এলাকাকে (যেমন লন্ডন বা কলকাতা বা গিরিডি) এস.এফ.-এ দেখানো হয়; এটা বলা বাহুল্য যে এলাকাগুলো আমাদের চেনা কলকাতা বা লন্ডন বা গিরিডি নয়, এস.এফ.-এ ব্যবহার করার ফলে আমূলভাবে পরিবর্তিত, কিন্তু এখানে অমিলগুলি একই নামের কাল্পনিক জায়গাটিকে আপাত সত্যি প্রতীয়মান করে।
এই বিভিন্ন জায়গাগুলো কিভাবে সময় বা কালের ধারণার সাথে যুক্ত এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে কাহিনীর বিষয়বস্তু কাল্পনিক অতীত নিয়ে, সেখানে এটি বর্তমান কালকে কল্পিত ঐতিহাসিক সময়ে প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা। ঔপনিবেশিক দেশের লেখকের গল্প অতীতকে দূরে সরিয়ে রাখার অথবা কাল্পনিক অতীত ঐতিহ্যকে বর্তমান গরিমার কারণ হিসেবে দেখাবার প্রবণতা থাকার সম্ভাবনা যেহেতু সেই সব দেশের সাফল্য বর্তমান সময়ে। আবার উপনিবেশিত দেশের লেখকের গল্পে অতীতকে, তা যদি উপনিবেশ-কালের অতীত হয়, ইতিবাচকভাবে দেখানোর সম্ভাবনা বেশি এবং সেখানে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টার কথাও থাকবে।
কাহিনীটি যদি কোনো কাল্পনিক ভবিষ্যতে বা পরিবর্তিত বর্তমান কালের হয়, তবে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির লেখকের কল্পনায় সেটি সংঘাতপূর্ণ হবার সম্ভাবনা বেশি, যে সংঘাতের ফলে সাম্রাজ্য আরো সুদৃঢ় হবে নতুবা পুরোপুরি ধ্বংস হবে। ভিন্ন সম্প্রদায় বা জনজাতির অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে, বিশেষ করে উপনিবেশক সময়ে, নিরুৎসাহী থাকবে; নীতিগতভাবে বৈচিত্র্য সহজে মেনে নিতে পারবে না আর যদি বা নেয় তা হবে সাম্রাজ্যের বিস্তারের প্রয়োজনে। উপনিবেশিত দেশের লেখকের কাল্পনিক ভবিষ্যতেও সাম্রাজ্যের মডেলটি আসতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সাম্রাজ্যের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বৈচিত্রকে দেখানোর সম্ভাবনা বেশি থাকবে। এই দুরকম দৃষ্টিকোণ থেকে লেখার মূল তফাতগুলো প্রোটাগনিস্টের চরিত্রায়ান থেকে পরিষ্কার হয়। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির মুখপাত্র সমস্ত মানবজাতির হয়ে বলবেন যেমন কোনো ভিন্নগ্রহের (এলিয়েন) আক্রমণের গল্পে, কিন্তু তা বলবেন এক অসীম ক্ষমতাবানের ঐতিহাসিক অধিকারের সুবিধাজনক অবস্থান থেকে। উপনিবেশিত সংস্কৃতির গল্পতেও তার মুখপাত্র মানবজাতির হয়ে বলবেন কারণ সাম্রাজ্যের প্রেক্ষাপটটিই তাই, কিন্তু সেক্ষেত্রে আখ্যানটিতে জাতিগত পার্থক্য নিয়ে বিশেষ কোনো ঘটনা থাকবে যাতে তাকে ঔপনিবেশিক দেশের জনমানবের সাথে তুলনা করা হয়। এ কারণেই উপনিবেশিত দেশে লেখা অ্যাডভেঞ্চার, বিশেষ করে যা উপনিবেশকালে লেখা, কাল্পনিক ভবিষ্যত বা পরিবর্তিত বর্তমানে প্রতিস্থাপিত, তা হয় অ্যানালগ পৃথিবীতে বা কাল্পনিক বর্তমানে হবে, কারণ এই স্পেস-গুলিতে স্বাধীনতার কল্পনা করা যায় আর কল্পিত ভবিষ্যতে আজকের উপনিবেশিত হবে কালকের অধিকর্তা। এবং বিপরীতে, ঔপনিবেশিক দেশের লেখায় সব ধরনের আপাত সত্যি আখ্যান দেখা যায় কারণ রাজনৈতিক ভাবে লন্ডন থেকে কলকাতার ওপর তার শাসন।
গোড়ার দিকের কল্পবিজ্ঞানে ডিলোকালাইজড্ লোকেল, উপনিবেশ যুগে সাম্রাজ্য এবং টেকনো-সায়েন্স নিয়ে ভাবনার তফাতটা সূচিত করে। যদি আমরা প্রথম দিকের একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প – জগদানন্দ রায়ের লেখা “শুক্র ভ্রমন” (যা ১৮৯২ সালে লেখা হয়েছিল এবং ১৯১৪ সালে প্রাকৃতিকি নামক প্রবন্ধ সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল), নিয়ে আলোচনা করি, তাতে দেখতে পাই যে আখ্যানটির ডিলোকালাইজড্ লোকেল শুক্রগ্রহ জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা অক্ষুন্ন রেখেও সাম্রাজ্য-কে কো-অপ্ট করেছে। শুক্রগ্রহের দুটি ভাগের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেখানকার সভ্যতা কতখানি উন্নত তা বোঝাবার জন্যে। আলোকিত ভাগটি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পরিচায়ক আর অন্ধকার দিকটি তার অভাব সূচিত করে। লেখাটি গোড়ার দিকের, এচ.জি.ওয়েল্সের লেখাসহ, এস.এফ.-এর একটি উদাহরণ। আপাতদৃষ্টিতে এই কাহিনীটিতে এই ধরনের লেখার সবরকম উপাদান বর্তমান, অ্যান্থ্রোপলোজিকাল পক্ষপাত ও রেসিস্ট ইঙ্গিত সহ। কিন্তু কাহিনীর কথক,যিনি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অধিকারী বলে দাবি করছেন,তিনি আবার ওই অজানা ল্যান্ডস্কেপে নিজের হিন্দু পরিচয়টিও বজায় রেখেছেন।
জগদানন্দ পুরাণের থেকে নেওয়া দৃষ্টান্ত দুই জাতি সম্পর্কেই ব্যবহার করেছেন। বিজ্ঞানের ভাষা দিয়েছে বিশ্বজনীনতা, আবার বাংলা এবং “হিন্দু” সংস্কৃতি ওনাকে দিয়েছে তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ। এই রকম উদাহরণ আরো অন্যান্য গল্পতেও দেখা যেতে পারে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের “পৃথিবী ছাড়িয়ে” (১৯৩৭), “পিঁপড়ে পুরান” (১৯৩১), বা “ভয়ংকর” (১৯২৮) গল্পেও এর নজির দেখা যেতে পারে। অ্যানালগ বা কাল্পনিক বাস্তব এই দুই গল্পতেও ব্যবহার করা হয়েছে এবং বাংলা সংস্কৃতি এবং ভাষা দুটিকেই উনি হাইলাইট করেছেন। পৃথিবী ছাড়িয়ে-তে দুই জার্মান বৈজ্ঞানিক এবং তাদের দুই বাঙালী সহায়ক বুধ-গ্রহে যাত্রা করে, এবং বাংলা ভাষা গল্পটিতে একটা সংকেতলিপি: দুই সহায়ক গল্পটির এক প্রধান সময়ে বাংলা ভাষাকে কোড হিসেবে ব্যবহার করে। আবার “পাতালে পাঁচ বছর” নামক অ্যানালগ মোডের গল্পতে আবার সেই দুই ভিন্ন জাতির চরিত্র দেখা যায় জগদানান্দের গল্পের মতো, কিন্তু এবারে সেই গল্প উপনিবেশবাদের ওপর সোজাসুজি টিপ্পনি করে লাল (প্রযুক্তিতে নিকৃষ্ট) এবং সাদা-দের (প্রযুক্তিতে উচ্চতর) মধ্যে যুদ্ধ দেখিয়ে। এখানে দুই বাঙালি সেই সমুদ্রতলের সাম্রাজ্যের যুদ্ধের মধ্যে ফেঁসে যায়: একজন সাদা-দের রাজা হয় এবং অন্যজন লাল-দের সাথে যোগ দেয়। গল্পটি শেষ হয় শান্তি এবং সম্প্রীতির সুরে। এই গল্পটিতেও বাংলা ভাষা ব্যবহার হয়, এবং মিত্র, ভাষার মাহাত্ম্যর ওপর বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখেন। যদিও এখানেও দুই বাঙালী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয়, গল্পটির প্রধান চরিত্র যে বাঙালী ইঞ্জিনিয়ার সে লাল-দের সাথে থাকে, তাদের ভাষা শেখে, তাদের সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করে, এবং তারপর তাদের যুদ্ধে যোগ দেয়। এও বোঝানো হয় যে লাল আর সাদা-দের কোনো বিশেষ পার্থক্য নেই, কিন্তু সাদারা শুধু মাত্র যুদ্ধের প্রযুক্তি নিয়ে ভাবে। “সেকালের কথা” (১৯২৭) বা পিঁপড়ে পুরাণে (ছোটগল্পটির ভিত্তিতে লেখা উপন্যাস) মিত্র এচ.জি.ওয়েল্সের “এম্পায়ার অব দি অ্যানটস্” (১৯০৫) কে সম্পূর্ণ নতুন চোখে দেখেন। মিত্রের লেখায় এই বৃহৎ পিঁপড়ের আবিষ্কার করেন এক বাঙালি এক্সপ্লোরার এবং এক কালো বৈজ্ঞানিক, এবং জাতির কারণেই বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় তাদের কথার গুরুত্ব দেন না । পিঁপড়েদের আক্রমণ শুরু হয় তাঁদের মৃত্যুর অনেক দিন পরে। দুটি গল্পই শুরু হয় ব্রাজিল থেকে, কিন্তু ওয়েল্সের লেখায় পিঁপড়েদের রাজত্ব হলো ল্যাটিন আমেরিকাতে ইউরোপীয় উপনিবেশের বিরুদ্ধে, আর মিত্রের লেখায় পুরো পৃথিবীর ধ্বংস হবার সম্ভাবনা। “পিঁপড়ে পুরান” উপন্যাসে মিত্র একটা সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায় যোগ করেন, যেখানে আবার এক নতুন বাঙালী বৈজ্ঞানিক পিঁপড়েদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর লেখেন এবং তাদের ভাষা শেখেন। পিঁপড়েদের প্রতি একটা সম্মানের দৃষ্টিকোণ নিয়ে এই অধ্যায়টি লেখা হয়েছে, কারণ তারা শুধু প্রযুক্তিতে মানুষদের থেকে এগিয়ে নয়, তারা আরো অনেক বুদ্ধিমান। এটা তাই ওয়েল্সের “ওয়ার অব দি ওয়ার্ল্ডস” এর মতন নয়, যেটা সম্পর্কে রিডার লিখেছেন। গোড়া থেকেই মিত্র পুরো পৃথিবীর কথা ভেবেছেন, শুধু ইংল্যান্ড বা লন্ডনের কথা নয়।
মিথ ও বিজ্ঞান
মিথ, বিজ্ঞান, জাদু, এবং ধর্ম নিয়ে আলোচনা, যেটার তাত্ত্বিক উত্পত্তি সামাজিক বিবর্তন নিয়ে উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে লেখালেখি (মালিনাঅস্কি বা ফ্র্রেজারের লেখা এখানে বিশেষ ভাবে উদাহরণ স্বরূপ নেওয়া যায়), এস.এফ.-এর উত্পত্তির সাথে তার অনেক যোগ আছে। কারণ কোন লেখা বিজ্ঞাননির্ভর বলে এস.এফ. হয় আবার কোন লেখাটা জাদুনির্ভর বলে ফ্যান্টাসি হয়, এটা বুঝতে গেলে প্রত্যেকটি আলাদা সভ্যতা কোন ধরনের জিনিসকে মানে বিজ্ঞান আর কোনটাকে জাদু, এই সবের পার্থক্যও দেখতে হয় । বিজ্ঞানের সাথে সাম্রাজ্যের যোগের কথা আগেই বলা হয়েছে, এবং তার উন্নয়নের সাথেও যে উপনিবেশের যোগ আছে তাও দেখা গেছে। সেই কারণেই এস.এফ.-এর উত্পত্তি সবরকম জায়গাতেই পাওয়া যাবে, অন্তত ধর্ম নিরপেক্ষ আলোচনায়, এটাও দেখা গেছে। কিন্তু এখানে বিজ্ঞানের সাথে উপনিবেশের সংযোগটা উপনিবেশিত দেশের লেখকদের কাছে একটা বিশেষ সমস্যা। সেই কারণে, এক দিকে তারা বিদেশী বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন একটি দেশের পুরাতন দেশীয় বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির কথা, যেটাকে বলা হয়ে নেটিভ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান নামক বিষয়টিকে আবার নতুন ভাবে তৈরী করার প্রচেষ্টা করেন যাতে তাদের নিজেদের দেশের সংস্কৃতিক শক্তির প্রদর্শন করতে পারেন। যেমন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যাকে প্রাক-স্বাধীনতা সময়ের পৃথিবীর প্রমুখ বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ধরা হয়, “কেমিকাল নলেজ অব দি হিন্দুস অব ওল্ড”-এর মতন লেখা লেখেন আর সেই সময়কার বিখ্যাত জার্নাল ইসিস-এ সেটা ছাপানো হয়। রায় পুরাতন ভারতের প্রযুক্তির কথা বিদেশীদের নতুন সায়েন্টিফিক সিস্টেম এবং ভাষায় রূপান্তর করেন – যেটা দিয়ে ভারতের গৌরব দেখানো যায় আবার বিজ্ঞানের বৃদ্ধিও হয়। একটি প্রধানত মৌখিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান, যেটা অনেক সময়ে একটি সাম্প্রদায়িক বানিজ্যিক গোপনীয়তার অবলম্বন করে পুরাতন ভারত থেকে এসে থাকে, সেই ধরনের জ্ঞান এখন হস্তান্তরযোগ্য হয়ে যায় এই নতুন সায়েন্টিফিক সিস্টেম-এ। কিন্তু এই ধরনের প্রবনতা অনেক সময় সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের দিকেও বাঁক নেয়, কারণ সেটি রাজনৈতিক দিক থেকে সুবিধাজনক মনে হয়। অনেক সময় এই পুরাতন জ্ঞানের প্রভাব আসল বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বাধা দেয়। এবং এই ধরনের প্রবনতার কারণেই মিথ জিনিসটির এস.এফ.-এ আবির্ভাব হয়, বিশেষত উপনিবেশিত দেশের এস.এফ.-এ। চরম ক্ষেত্রে, মিথ বিজ্ঞানকে গ্রাস করে এবং বিজ্ঞান-মিথের পার্থক্য ভুলে যাওয়া হয়, যেমন মহাভারত বা রামায়ণের গল্পকে বিজ্ঞানের রূপে দেখা, স্পেস-শিপ যেটা এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে চলে যেতে পারে এ ধরনের প্রযুক্তিকে পুরাতন ভারতের ঋষি-মুনিদের আবিষ্কার বলা, বা গনেশের মাথার কথা প্রাচীন ভারতে অস্ত্রচিকিত্সার উন্নতির নজির হিসেবে ভাবা। এ ধরনের চিন্তা শুধু যে উপনিবেশিত দেশের লোকেরা করেন তা নয়, তবে এটার একটা বিশেষ স্থান এই ধরনের দেশের লেখায় পাওয়া যাবে।
এই ধরনের প্রবণতা কে আমি নাম দিয়েছি “মিথোলোজার্ম” যেটা আজকেও কল্পবিজ্ঞানে পাওয়া যাবে, এবং পুরো ভারতের এস.এফ.-এও প্রতিফলিত হবে। যদিও আমি এ নিয়ে বিশেষ কিছু এখানে লিখব না, এটাকে বলা যেতে পারে মিথ-কে অবলম্বন করে এক বিকল্প দেশীয় বিজ্ঞানের ইতিহাস তৈরী করার একটা প্রবণতা। এটা উপনিবেশ এবং তার পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদের কারণে হয়। এখানে ভূতপূর্ব সময়ের বিজ্ঞানকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার চাবি হিসেবে ভাবা হয়, রাজনৈতিক ভাবে পুরো দেশের উন্নয়নের জন্য, শুধু বিজ্ঞানের বা প্রযুক্তির নয়। কিন্তু এই ধরনের চিন্তা এস.এফ.-এর ইতিহাসেও পাওয়া যাবে, যেগুলো এদেশে লেখা হয়নি। সেই সব ইতিহাসে সব সময় এস.এফ.-এর উত্পত্তি দেখানো হবে উপনিবেশ কালের গোড়া থেকে, (আল্দিস ২০০১, ক্লুট ২০১১) কারণ সেই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত বিষয়ে নিয়ে তারা এখনো আটকে আছেন, এবং এই সময় থেকেই ইউরোপ অন্যান্য দেশের থেকে অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে যায়। এ কারণে ইউরোপের লেখায় মিথ ফ্যান্টাসি হয়ে বেরোয়, আর উপনিবেশিত দেশের লেখায় মিথ এস.এফ.-এর সাথে মিশে যায়। এবং এই কারণে কল্পবিজ্ঞান, এস.এফ.-এর মতন হলেও, একটা আলাদা বিশ্লেষণ দাবি করে।
কল্পবিজ্ঞানে মিথোলোজার্ম প্রায় বেশির ভাগ লেখাতেই আছে। কল্পবিজ্ঞানের বিজ্ঞান তাই খুব তরল প্রকৃতির। কিন্তু সেই কারণে এই লেখা ফ্যান্টাসি নয়, কারণ যা বোঝানো যায় না সেটা বোঝানো যাবে না তা নয়, কিন্তু এই বিজ্ঞান শুধু নেটিভ সায়েন্স-এর মাধ্যমে দেখতে হবে: একটি এমন জ্ঞান যেটা এখনো বিদেশী জ্ঞানের সিস্টেম-এ পরিবর্তিত হয়নি। নেটিভ বৈজ্ঞানিক সাধু বা জাদুকরের মতই একজন ব্যক্তি, কিন্তু তিনি সব সময়ে চেষ্টা করবেন এই অদ্ভূত রহস্যময় বিজ্ঞানকে নতুন ভাষায় রূপান্তর করার। বিজ্ঞান এবং জ্ঞানের যে দ্বন্দ্ব সেটা রয়ে যাবে, কারণ বিজ্ঞান জ্ঞানের একটা ছোট অংশ। আমি আগে যেই গল্পের কথা বলেছি সেই সবে তো তা দেখা যাবেই। আমি অন্য জায়গায় হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখায় এই সম্বন্ধে লিখেছি (২০১৪), বিশেষ করে আর্য্য মিথের কথা। আবার আমরা অন্য লেখাও দেখতে পারি, যেমন গোড়ার দিকে লেখা জগদীশ বোসের “পলাতক তুফান” বা নগন্য লেখা যেমন ননীগোপাল মজুমদারের “দানব রহস্য” (১৯৩২), বা উত্তর স্বাধীনতা সময়ে লেখা সত্যজিত রায়ের “প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়” (১৯৬৩) অথবা অদ্রীশ বর্ধনের “ত্রিভুজ রহস্য” (১৯৮৫)। সত্যজিত রায়ের গল্পটিতে, নোভাম হলো একটা সাধুর রহস্যময় মন্ত্র যেটা অস্থি থেকে পুরো জীবন্ত শরীর তৈরী করতে পারে। কিন্তু এই জ্ঞান সাধু-কে কোনো বিশেষ নৈতিক দৃষ্টিকোণ দেয় না, প্রকৃতপক্ষে শঙ্কুই এখানে মানবকল্যাণের কারণে এই জ্ঞানকে বিজ্ঞানে রূপান্তরণ করতে চান। যখন সাধু শঙ্কু-কে মারার জন্য ডায়নোসর-কে জীবন্ত করে, কারণ শঙ্কু তার জ্ঞানের রহস্যভেদ করতে চায়, সেই ডায়নোসর নিরামিষাশী বলে সাধু যেই গাছটিতে ঝুলছিলেন সেটাই খেয়ে নেয়। শঙ্কু নিজের বিজ্ঞানের কারণে বেঁচে যান, আর সাধু নিজের অহংকারের কারণে মারা পড়ে। আর যদিও এই গল্পে শঙ্কু রহস্যভেদ করতে পারেন-না, তিনি জীবিত থাকেন বলে ভবিষ্যতে সেই রহস্যভেদ হবার সম্ভাভনা থেকে যায়।
প্যারডি ও স্যাটায়ারের আধিপত্য
কল্পবিজ্ঞানে প্যারডি ও স্যাটায়ারের আধিপত্য নিয়ে খুব কম লেখা হয়েছে, এবং এটিকে স্ব-আত্মবাচক প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। প্যারডি যে লেখে এবং যার ওপর লেখা হয়, দুটিকেই ব্যঙ্গ করে। বাংলায়, এই প্যারডি ও স্যাটায়ারের আধিপত্যের কারণ হলো সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের আর আধুনিকতার বিরুদ্ধে সমালোচনা। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি প্রাক-স্বাধীনতা সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক, তিনিও নিজের জাতীয়তাবাদের ওপর লেখায় পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ এবং টেকনো-সায়েন্টিফিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন:
“নিছক বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে জীবন কোনো কোনো মানুষের কাছে খুব আকর্ষনীয়, তার কারণ এতে একটা নকল গাম্ভীর্য আছে। যখন শিকারী শিকার করতে যায়, তখন তার যত কম করুণা থাকে ততই ভালো। তার কাজ হলো একটা জন্তুকে মারা, এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা কারণ তার মারার যন্ত্রপাতি সব বৈজ্ঞানিক। এবং বিজ্ঞানের জীবন হলো এই ধরনের জীবন। সেটা সাফল্যের পেছনে দক্ষতার সাথে ধাওয়া করে, এবং মানবজাতির উচ্চতর প্রকৃতির কথা ভাবে না।” (ন্যাশনালিজম্ ইন জাপান, আমার অনুবাদ)
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান ও প্রুযুক্তি কে আত্মাহীন বস্তুবাদ হিসেবে দেখেন, যেটা শুধু ধংসাত্মক উপনিবেশবাদকে জন্ম দিয়েছে এবং সব প্রাচীন সভ্যতাগুলোর আত্মা শুষে নিয়েছে, যেমন ভারত, জাপান, বা চীন-দেশ। বিজ্ঞানের বর্ধন সেই কারণেই হিউম্যানিস্ট হিসেবে দেখতে হবে, যেটা প্রাচ্য সভ্যতা পৃথিবীকে দিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ছিলেন না, কিন্তু বিজ্ঞানকে সভ্যতার নজির হিসেবে দেখার বিরুদ্ধে ছিলেন। উপনিবেশ যুগে, এটা ছিল ইস্ট-ওয়েস্ট সিনক্রোনাইজেসন, যেখানে একদিক দিয়েছে সভ্যতা, আর অন্যদিক দিয়েছে অগ্রগতি। প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধের পর এই ধরনের লেখা আরো অনেক প্রকট হয়। ইউরোপ-এ স্পেনগ্লার ইত্যাদি যখন ফাউসটিয়ান স্পিরিটের মৃত্যু হয়েছে বলে দুঃখপ্রকাশ করছিলেন (স্পেনগ্লার ১৯৭৬) এটা বুঝতে পেরে যে উপনিবেশিত দেশগুলো এখন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দিকে অনেক এগিয়ে গেছে, তখন রবীন্দ্রনাথ এবং ইউরোপেরও অনেক লেখক ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে সেই ধরনের স্পিরিটের সমালোচনা করেছিলেন। তাই ভারতে বিজ্ঞানের শোষণক্রিয়াতে শুরু থেকেই দ্বন্দ্ব আছে: এক দিকে বিজ্ঞান হলো আধুনিকতা এবং উন্নতির প্রতীক, আবার অন্যদিকে ভারতে ইউরোপের মতন উপনিবেশবাদ বা জাতীয়তাবাদের প্রচলনের চিহ্ন। সেই কারণে নেটিভ সায়েন্স নিয়েও যথেষ্ট চিন্তা ছিল: সেটা দেশের বৈজ্ঞানিকদের জন্য এক সাথে বর এবং অভিশাপ, বিষ এবং ওষুধ ছিল। তাই প্যারডি এবং স্যাটায়ার দিয়ে তারা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লেখা শুরু করেছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি একদিকে কমতে-র লেখার প্রচলনের জন্য বঙ্গদর্শন শুরু করেছিলেন, এবং এটাও বুঝেছিলেন যে ভারত থেকে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস দূর করতে বিজ্ঞান-মনস্কতার প্রয়োজন, তিনিও বিজ্ঞান কে নিয়ে যথেষ্ট ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন।
প্যারডি নিয়ে অন্য ধরনের বাংলা সাহিত্যের কথা অনেকে আলোচনা করেছেন, কিন্তু কল্পবিজ্ঞান-এ এই নিয়ে খুব কম লেখা হয়েছে। স্বাধীনতার পরে লেখা মিত্রের ঘনাদার কথা স্বাধীনতার পরে অনেকেই জানেন, কিন্তু কল্পবিজ্ঞান-এ এর অনেক আগে থেকেই এই ধরনের লেখার প্রচলন আছে, যেমন হেমলাল দত্তের “রহস্য” (১৮৮২), বেগম রোকেয়ার “সুলতানা’স ড্রিম” (১৯০৫), সুকুমার রায়ের বেশ কিছু ছড়া-কবিতা, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের “মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন” (১৯২৫), অথবা যাকে সায়েন্স-ফ্যান্টাসি টল-টেল্স বলা হয়ে যেমন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনেক লেখা। সত্যজিত রায় বা অদ্রীশ বর্ধনের লেখাতেও এর অনেক নজির পাওয়া যাবে, এবং পরশুরামের অনেক ছোট গল্প-কেও এই কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে আনা যায়। এ ছাড়া বাচ্চাদের এবং তরুনদের অনেক লেখাতেও প্যারডি বা স্যাটায়ারের আধিপত্য আছে।
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের “মঙ্গল পুরান” (১৯৩১) গল্পতে এখনো পর্যন্ত যে সব থীম নিয়ে বিশ্লেষণ হয়েছে সে সব এক জায়গায় দেখা যাবে। “পিঁপড়ে পুরান” এবং এই গল্পটি একই বছরে বেরোয়, কিন্তু ভট্টাচার্যের বিজ্ঞানভিত্তিক লেখার কোনো ইচ্ছে নেই। উনি এখানে পুরাণ-দের ব্যঙ্গ করে একটা ছোট গল্প লিখেছেন, যেটা আপাতদৃষ্টিতে মহাভারত-রামায়ণের গল্পের পরবর্তী অধ্যায়, আধুনিক যুগ এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-সহ ভারত এর প্রথম ডিলোকালাইজড্ লোকেল, আর অন্যটি মঙ্গল গ্রহ। এই গল্পতে সব ধরনের সময়ের কথা আছে, পুরাতন ভারত (যে কারণে এটা “পুরান”), সমসাময়িক ভারতের অল্টারনেট হিস্ট্রি, এবং ভবিষ্যতের দিক থেকে মঙ্গলগ্রহ। যদিও গল্পের চরিত্ররা মহামানব বা ভগবান, যাদের সব পুরাতন শক্তি এখনো অব্যাহত আছে, কিন্তু সাধারণ দৈনন্দিন প্রেক্ষাপটে বসানোর ফলে তাদেরকে সাধারণ মানুষের মতই লাগছে, যেটা এস.এফ.-এর বৈশিষ্ট। গল্পের চরিত্ররা রোলস্-রয়েসে বিচরণ করেন, তাদের পৃথিবীতে রকেট এবং টেলিফোন আছে, নিজেদের অসুখ সারান পাশ্চাত্য ওষুধ দিয়ে, এবং মঙ্গলগ্রহের এলিয়েন-দের থেকে তারা অনেক কম শক্তিশালী। আবার অনেক কল্পবিজ্ঞানে এই পুরাতন বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির কথা রহস্যময় বলেই গণ্য করা হয়, যেমন পরশুরামের “পরশ পাথর” (১৯৪৮) গল্পটিতে। অনেক গল্পতে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ দিয়ে জাতীয়তাবাদকে সরাসরি সমালোচনা করা হয়েছে, যেমন চারুচন্দ্র চক্রবর্তীর “বৈজ্ঞানিক” (১৯২৯), যেখানে এক পাগল জাতীয়তাবাদী বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করার চেষ্টা করে, বা সুশীলচন্দ্র মিত্রের “বৈজ্ঞানিক বরযাত্রী সম্বর্ধনা” (১৯২৯) যেখানে টেকনো-সায়েন্টিফিক উপায়ে বরযাত্রীদের সম্বর্ধনা করার পরিকল্পনা কে নিয়ে বিদ্রুপ করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরে লেখা উত্কৃষ্ট কল্পবিজ্ঞানে এই ধারা দেখা যায়, যেমন সত্যজিত রায়ের লেখায়, মিত্রের ঘনাদা, এবং গৌরকিশোর ঘোষের ব্রজদার গুল্পতে (১৯৬৭)।
আগেও বলেছি যে কল্পবিজ্ঞান তার ম্যাগাজিন যুগের পর ছোটদের এবং তরুনদের লেখাতেই স্থান পেয়েছে। যারা বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ পেয়ে লিখেছেন তাদের কথা আলাদা, কিন্তু বেশির ভাগ এই ধরনের লেখা সব দেশেই ভাসা-ভাসা বিজ্ঞান ব্যবহার করেই লেখা হয়েছে, এবং তার প্রধান ভোক্তা শিশু-কিশোর শ্রেণী। এটাও বলা যেতে পারে যে এস.এফ.-এর একটা শিক্ষার সাথে যে সংযোগ আছে সে কারণেই এটা এই শ্রেনীর পাঠকদের কাছে তুলে দেওয়া হয়, এবং এটা কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। লীলা মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এদের সবার লেখা কল্পবিজ্ঞানে এই ধরনের রস পাওয়া যায়। ছোটদের লেখা বলেই, এই ধরনের অনেক গল্পতে প্যারডি আছে, যদিও সব জায়গায় স্যাটায়ার পাওয়া যাবেনা। প্যারডি এবং স্যাটায়ারের পার্থক্য এই যে প্যারডি-তে অনেক কম সূক্ষ্মতার প্রয়োজন, এবং সে কারণে লেখকেরা ছোটদের মধ্যে সামাজিক বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন, যেমন বয়স্কদের জন্যে ঐতিহাসিক বা রিয়ালিস্ট/বাস্তববাদী গল্প লিখেছেন। এই ধরনের লেখার একটা নিখুঁত উদাহরণ হলো মুখোপাধ্যায়ের লেখা “ভূতুড়ে ঘড়ি” (১৯৮৪)। এই গল্পতে একটা ঘড়ি যেটা আসলে জীবন্ত এলিয়েন টেকনোলজি, দুই এলিয়েনের যুদ্ধের মধ্যে ফেঁসে গিয়ে পৃথিবীতে এসে পড়ে। এই জিনিসটাকে বুঝতে পারেন না কেউই: জটাই তান্ত্রিক, যিনি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক, এবং গর্ডন সাহেব, যিনি বিদেশী বিজ্ঞানের প্রতিনিধি, দুজনেই এটাকে খোলার চেষ্টা করেন এবং সেই কারণে দণ্ডিত হন।
উপসংহার
এই প্রবন্ধে আমি এস.এফ.-এর ইতিহাস লেখায় যে ইউরোসেন্ট্রিক প্রভাব আছে সেই নিয়ে লিখেছি এবং বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে একবিংশ শতাব্দীতে সেটা কি ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের কারণ নিয়ে বিশেষ ভাবে কেউ লেখেন নি, তাই আমি বাংলা ভাষায় লেখা কল্পবিজ্ঞানের মাধ্যমে এই ধরনের লেখার কি বিশেষত্ব থাকতে পারে তাত্ত্বিক মতে সেই নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি চ্সিচ্সেরি-রনে এবং অন্য সমালোচকদের সাথে একমত যে টেকনো-সায়েন্স, উপনিবেশবাদ, এবং জাতীয়তাবাদের একটা যোগ আছে এবং এস.এফ. লেখাতে সেই যোগের বিশেষ রূপে প্রদর্শন হয়। কিন্তু আমি এটাও মানি যে এই যোগটির পরিবর্তন থেকেই বোঝা যাবে অন্যান্য ভাষায় এই ধরনের বিজ্ঞান প্রসূত লেখার বৈশিষ্ট্য এবং তাদের উদ্ভবের ইতিহাস। আমি কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে তিনটি সংযোগস্থলের কথা বলেছি, আমার মতে অন্য উপনিবেশিত দেশে লেখা কল্পবিজ্ঞানেও সেই ধরনের সংযোগস্থলের আভাস পাওয়া যাবে: অর্থাৎ এই নেটিভ সায়েন্স তৈরী করার প্রচেষ্টা এবং তার ফলস্বরূপ বিজ্ঞানভিত্তিক কথাসাহিত্য যেখানে মিথ এবং বিজ্ঞানকে এক সাথে দেখা যাবে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্যারডি এবং স্যাটায়ার রসের এস.এফ., এবং একটা ডিলোকালাইজড্ লোকেল যেটা দেশের ভবিষ্যতকে উন্নতির দিকে যাওয়ার পথ নিদর্শন করবে। যেখানে ইউটোপিয়া, সেখানে এস.এফ. একটা সুদূর সুন্দর স্বপ্ন দেখাবে যেখানে টেকনো-সায়েন্স এবং সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে। যেখানে ডিস্টোপিয়া, সেখানে নিজের সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ভুলে যাওয়া সম্প্রদায়ের ধ্বংস দেখাবে এমন ভবিষ্যতে যেখানে উপনিবেশবাদের কোনো শেষ নেই।
গ্রন্থ–পঁঞ্জী
বাংলা
ঘোষ, গৌরকিশোর। ব্রজদার গুল্প সমগ্র। কলকাতা: আনন্দ, ২০০৭।
ঘোষ, সিদ্ধার্থ। “সাইন্স-ফিকশন”। এক্ষণ শারদীয়া সংখ্যা, ১৯৯৮।
বল, রবীন। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা। কলকাতা: সমিলা প্রেস, ১৯৯৬।
বর্ধন, অদ্রীশ। প্রফেসর নাটবল্টু চক্র সংগ্রহ। কলকাতা: আনন্দ ২০১৩।
বসু, জগদীশ চন্দ্র। অব্যক্ত। কলকাতা:দে’স, ২০০৭।
ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন। “মঙ্গল পুরান”। রামধনু জৈষ্ঠ্য, ১৩৩৯।
চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম। বঙ্কিম রচনাবলী। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৯৯৪।
মজুমদার, ননীগপাল। “দানব রহস্য”। রামধনু অগ্রহায়ন, ১৩৩৯।
মিত্র, প্রেমেন্দ্র। ঘনাদা সমগ্র। কলকাতা: আনন্দ, ২০০১।
মিত্র, প্রেমেন্দ্র। কল্পবিজ্ঞান সমগ্র। কলকাতা: দে’স, ২০১০।
মিত্র, সুশীলচন্দ্র। “বৈজ্ঞানিক বরযাত্রী সম্বর্ধনা”। রামধনু পৌষ-মাঘ, ১৩৩৭।
মুখোপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ। রচনাবলী। কলকাতা: পাত্র’জ, ১৯৫৭।
মুখোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু। ভুতুড়ে ঘড়ি। কলকাতা: আনন্দ ১৯৮৪।
পরশুরাম। পরশুরাম গ্রন্থাবলী। কলকাতা: আনন্দ ১৯৮৭।
রায়, হেমেন্দ্রকুমার। রচনাবলী ১, ৫, ১২। কলকাতা: এশিয়া, ১৯৭৪।
রায়, জগদানন্দ। “শুক্র ভ্রমণ”। প্রাকৃতিকি। এলাহাবাদ: ইন্ডিয়ান প্রেস, ১৯২৩।
ইংরেজি
Aldiss, Brian and David Wingrove. Trillion Year Spree. North Yorkshire: House of Stratus, 2001.
Bhabha, Homi. The Location of Culture. London: Routledge, 1994.
Bhattacharya, A., & Hiradhar, P. “Own Maps/Imagined Terrain. The Emergence of Science Fiction in India.” Extrapolation 55(3), 2014. 277-297.
Bulwer-Lytton, Edward. The Coming Race. Ed. Peter W. Sinnema. Ontario: Broadview Editions, 2008.
Chattopadhyay, Bodhisattva. “Bengal.” The Encyclopedia of Science Fiction. Third Edition.
Eds. John Clute, David Langford, Peter Nicholls and Graham Sleight. Gollancz, 2013a.
—. Bangla Kalpabigyan: Science Fiction in a Transcultural Context. PhD Dissertation. Oslo: 07 Gruppen-University of Oslo, 2013b.
—. “Recentering Science Fiction and Fantasy.” Strange Horizons, September 2013, bonus issue. http://strangehorizons.com/2013/20130923/1chattopadhyay-a.shtml. 2013c.
—. “Hemendrakumar Ray and the Birth of Adventure Kalpabigyan.”Jadavpur University Essays and Studies XXVII, 2013-2014. 35-54.
Clarke, I. F. The Pattern of Expectation 1644-2001. London: Book Club Associates, 1979.
Clute, John. Pardon This Intrusion: Fantastika in the World Storm. Essex: Beccon Publications, 2011.
Csicsery-Ronay Jr., Istvan. “Dis-Imagined Communities: Science Fiction and the Future of
Nations.” http://dpuadweb.depauw.edu/icronay_web/dis.htm.
—. “Science Fiction and Empire.” Science Fiction Studies 90, Volume 30, Part 2 (July 2003). 231-245
Freedman, Carl. Critical Theory and Science Fiction. Middletown, CT: Wesleyan University Press, 2000.
Jameson, Fredric. Archaeologies of the Future. London and New York: Verso, 2005.
Kerslake, Patricia. Science Fiction and Empire. Liverpool: Liverpool University Press, 2007
Latour, Bruno. Science in Action: How to follow Scientists and Engineers through Society. Cambridge, MA: Harvard University Press, 1987.
Luckhurst, Roger. The Cultural History of Science Fiction. Cambridge: Polity Press, 2005.
Ray, Praphulla Chandra. “Chemical Knowledge of the Hindus of Old”, Isis, Vol. 2, No. 2 (September 1919). 322-325
Rieder, John. Colonialism and the Emergence of Science Fiction. Middletown, CT: Wesleyan University Press, 2008.
—. “On Defining SF, or not: Genre Theory, SF and History”. Science Fiction Studies, Vol. 37, No. 2 (July 2010). 191-209.
Roberts, Adam. The History of Science Fiction. New York: Palgrave Macmillan, 2005.
Said, Edward. Orientalism: Western Conceptions of the Orient. Delhi: Penguin, 2001.
Sen, Satadru. “A Juvenile Periphery: The Geographies Of Literary Childhood In Colonial
Bengal”. Journal of Colonialism and Colonial History, Volume 5, Number 1, (Spring 2004).
Sengupta, Debjani. “Sadhanbabu’s friends: Science Fiction in Bengal from 1882-1961.”
Sarai Reader 2003 “Shaping Technologies,” ed. Jeebesh Bagchi et al. Delhi /
Amsterdam: The Sarai Programme and The Waag Society / For Old and New Media, (2003). 76-82.
Spengler, Oswald. Man and Technics: A Contribution to a Philosophy of Life. Trans. Charles
Francis Atkinson. New York: Alfred A. Knopf, 1976.
Suvin, Darko. Metamorphoses of Science Fiction. New Haven and London: Yale University Press, 1979.
Tagore, Rabindranath. Nationalism. San Francisco: The Book Club of California, 1917.
Vint, Sherryl and Mark Bould. “There is no such thing as science fiction.” Reading Science
Fiction. James Gunn, Marleen S. Barr and Matthew Candelaria, eds.New York: Palgrave Macmillan, 2009. 43-51.
Virilio, Paul. The Information Bomb. Trans Chris Turner. London and New York: Verso, 1998.
Wells, H. G. Early Writings in Science and Science Fiction. Ed. Robert M. Philmus and
David Y Hughes. Berkeley and Los Angeles: University of California Press, 1975.
—. The Country of the Blind and Other Stories. London and Edinburgh: T. Nelson and Sons, 1913.
—. The War of the Worlds and The Time Machine. London: Chancellor Press, 1983.
Tags: এস. এফ.-এর রূপান্তর, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, প্রবন্ধ, বাংলায় কল্পবিজ্ঞান, বোধিসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায়, সাম্রাজ্যিক টেকনো-সায়েন্স