এ অনন্ত চরাচরে
লেখক: সুমন দাস
শিল্পী:
“নাহং মনো সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।
যো নস্তদ্বেদ তদ্বেদ নো ন বেদেতি বেদ চ।।”
সম্যক জেনেছি এমন কথা মনে করি না। জানি না তাও নয়, আবার জানি – তাও বলতে পারি না। উপরিউক্ত বাক্যের অর্থ যিনি জানেন তিনিই সঠিক জানেন।
– কেনোপনিষদ (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় শ্লোক)
এই অনন্ত চরাচরে, স্বর্গ মর্ত্য ছেয়ে কোন অমৃতের বরপুত্র এ মহাবিশ্বকে প্রত্যক্ষ করেছে? কেউ না। অতএব অন্তর্জগৎ খুলে যাক। কল্পবিশ্বে আমরা প্রবেশ করি। মনের জগৎ দিয়ে নিরীক্ষণ করি এই মহাবিশ্বকে। যে বিরাট শিশু এ বিশ্বকে নিয়ে খেলছে, তাকে দেখব সকলের শেষে, সকলের মাঝে, সকলের সাথে। এ অসীম চরাচরে ভুবন ভেসে চলেছে। কোন মহাকালের রথের আরোহী সে? কেউ জানে না। এই মহাকালের ক্ষণকালে এই পৃথিবী। ততোধিক ক্ষণকালে রয়েছে মানব প্রজাতি। তার কিয়দংশের ইতিহাস দিয়ে সে সেই চিরকালকে বুঝতে চাইছে। হায় বুদ্ধিহীন মানব হৃদয়! ছোট্ট দুই হাতে তুমি গ্যালাক্সিকে বুকের মাঝে ধরতে চাও? পারো, তবে বাইরে নয় ভিতরে। তার আগে তোমাকে হতে হবে অমৃতের বরপুত্র। তোমাকে জানতে হবে কী এই বিশ্ব। আর্যভট্টেরও বহু হাজার বছর আগে গুহার মধ্যে বসবাসকারী যে মানুষের রক্তে জন্মে গিয়েছিল কৌতূহলের কণিকা – তাই তোমার পাথেয়। সেই কৌতূহল আর কল্পনার মাত্রা বাড়াও, দেখতে পাবে কী করে তৈরি হল গ্যালাক্সি, তৈরি হল নক্ষত্ররাজি, গ্রহ-উপগ্রহ। আবার কালের খেয়ালে হল ধ্বংস। যেন এক চক্র। আবর্তের পর আবর্ত হয়েই চলেছে। যেন এর শেষ নেই। এ অনন্ত। তবুও এদের মাঝে রয়েছে সীমানা। অনেক রকম কল্পদিগন্তে একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে রয়েছে। এস, তাই দেখি। দেখি, সময় কীভাবে ধারাপাতের মতন না বয়ে গিয়ে চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে চলেছে। হে মানব, হে কালের আরোহী, প্রত্যক্ষ করো দু’হাজার বছরের ক্ষণিকজন্মা মানব প্রজাতি কোন অসীম বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে। আর কী প্রত্যক্ষ করার উদগ্র বাসনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে অসীম রহস্যময় ভবিষ্যতের দিকে।
(১)
বিশ্বের অধিকাংশই হচ্ছে অতিশীতল, অর্থাৎ প্রায় -২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড; অন্ধকার, এবং শূন্য পরিসর, যাকে বলে Empty Space. তার মাঝে দূরে দূরে ভাসছে অসংখ্য গ্যালাক্সি। এই গ্যালাক্সির মধ্যে রয়েছে কোটি কোটি নক্ষত্র, তাদের চারপাশে আবর্তনকারী গ্রহ, তাদের চারপাশে আবর্তনরত উপগ্রহ ইত্যাদি ইত্যাদি। শুন্যে ইতস্তত ভাসমান উল্কা, ধুমকেতু এবং আরও অনেক অজানা কিছু – সেলেস্টিয়াল বডি। এখন এই নক্ষত্র কী? কেমনভাবে এর উৎপত্তি ও ধ্বংস হয়? একটু জানা যাক।
গ্যালাক্সির মধ্যে থাকে গ্যাসপুঞ্জ। কেমন এর আকার? কোটি কোটি আলোকবর্ষ জুড়ে থাকে। আলোকবর্ষ কী? আলো এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ততটা এক আলোকবর্ষ। এক সেকেন্ডে আলো যায় প্রতি সেকেন্ডে ৩×১০৮ মিটার, এখন এক বছরে কতটা পথ যায়? কী দরকার হিসেব করার। কারণ তারপর আবার কোটি কোটি গুণ করতে হবে। মোট কথা আমাদের বিমানে করে এই ধূলিপুঞ্জের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে যেতে গেলে বেশ কয়েক প্রজন্ম কেটে যাবে।
তো এই ধূলিপুঞ্জ যখন আকর্ষণ বলের প্রভাবে কাছাকাছি আসে তখন সৃষ্টি হয় প্রাক-নক্ষত্র (Pro Star)। বাড়তে থাকে তাপ। পৌঁছোয় গিয়ে প্রায় এক কোটি মিলিয়ান ডিগ্রিতে। তখন এর মধ্যস্থিত হাইড্রোজেন গ্যাসের পরমাণু হিলিয়ামে পরিণত হতে থাকে। আর এই প্রক্রিয়ায় প্রায় লক্ষ কোটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের সমান বিস্ফোরণ হতে থাকে ক্রমাগত। উজ্জ্বল আলো আর তাপ বিকিরণ করতে করতে সেটি পরিণত হয় মুখ্যপর্বের নক্ষত্রে (Main sequence star)।
চলে যায় কয়েক হাজার যুগ। আস্তে আস্তে জ্বালানি অর্থাৎ হাইড্রোজেনের পরিমাণ কমতে থাকে। জ্বালানি কমতে থাকলে শক্তি বিকিরণের হার কমে। আর বাড়ে কেন্দ্রাভিমুখী আকর্ষণ বল। ফলে তারাটি আবার সংকুচিত হতে থাকে। এই সঙ্কোচনের ফলে আবার তাপমাত্রা বেড়ে ওঠে। ফলে অবশিষ্ট হাইড্রোজেনের আবার হিলিয়ামে পরিণত হওয়া শুরু হতেই বহির্মুখী শক্তির চাপে তারাটি আবার ফুলতে থাকে, তৈরি হয় লাল দানব (Red Giant)। অর্থাৎ তারাটির ভিতরের স্তরের সংকোচন আর বাইরের স্তরের প্রসারণ হতে থাকে। এর ফলে হিলিয়াম জুড়ে গিয়ে কার্বন উৎপন্ন হতে থাকে। এরকমভাবে আস্তে আস্তে তারাটি ছোটো হতে থাকে। আর গ্যাসের স্রোত মহাকাশে বিচ্ছুরিত করতে থাকে। মহাশূন্যে বিক্ষিপ্ত হতে হতে পড়ে থাকে শুধু কেন্দ্রকটি। একে বলে শ্বেত বামন তারা (White Dwarf)।
এইরকমভাবেই আস্তে আস্তে দীপ্তি এবং আকার দুটোই কমতে কমতে তা একদিন পরিণত হয় কৃষ্ণবস্তুতে (Black Dwarf), আর খুব বড়ো আকারের তারার ক্ষেত্রে ব্ল্যাক হোলে। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে কত সময় লাগে? কয়েক লক্ষ কোটি বছর। যে তারা যত বড়, তার তত বেশি সময় লাগে।
(২)
আগের ছবিটাকে লক্ষ করলে দেখা যাবে জায়ান্ট স্টার ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়। কৃষ্ণগহ্বর – ব্ল্যাক হোল। মহাবিশ্বের এমন নক্ষত্র, যে মৃত কিন্তু বুভুক্ষু, পিপাসার্ত। গিলে ফেলে সব কিছুকে, এমনকি আলোকেও ছাড় দেয় না। মহাকাশের এমন এক ভারী বস্তু যার সামনে এসে স্থান বক্রগামী হয়, সময় থেমে যায়। কী এই ব্ল্যাক হোল, থুড়ি – কৃষ্ণগহ্বর?
ভারতের অসাধারণ মেধাসম্পন্ন বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সুব্রহ্মমনিয়ম কোন তারা ব্ল্যাক হোল হতে পারে তার একটা সীমা ঠিক করে দিয়েছেন। তা হল, সূর্যের ভরের ১.৫ ভাগ বেশি ভরের সব তারা নিজেদের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে নিজেদের ভরে নিজেরাই সঙ্কুচিত হয়ে সসীম আয়তন কিন্তু অসীম ঘনত্বের ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে।
ব্ল্যাক হোলের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে এর চারপাশে যখন আকর্ষিত গ্যালাক্সি এসে পড়ে তখন এটি গ্যালাক্সি বা যে কোনও মহাজাগতিক বস্তুকে সর্পিলাকারে শুষে নিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গোটা গ্যালাক্সিকে গিলে নিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়।
মহাবিশ্বের সবচাইতে রহস্যময় বস্তু হল ব্ল্যাক হোল। মহাবিশ্বের কিছু স্থান আছে যা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরি করে যে এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যে কোনও বস্তুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়, হোক তা কোনও গ্রহ, ধূমকেতু বা স্পেসক্র্যাফট – তাই কৃষ্ণগহ্বর। পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার এর নাম দেন ব্ল্যাক হোল। কেন? কারণ ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষ বল এতই বেশি যে এর আকর্ষণ থেকে এমনকি আলোও (ফোটন) বের হয়ে আসতে পারে না। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব দিয়ে ধারণা করেন ব্ল্যাক হোল থাকা সম্ভব। আর মাত্র ১৯৯৪ সালে এসে নভোচারীরা প্রমাণ করেন সত্যি সত্যি ব্ল্যাক হোল আছে। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড ১৯১৬ সালেই দেখান যে কোনও তারকা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতে পারে। সূর্যের ব্যাসার্ধ (৮৬৪,৯৫০মাইল) যদি কমতে কমতে সঙ্কুচিত হয়ে ১.৯ মাইলে পরিণত হয় তাহলে সূর্যও ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে।
প্রতিটি গ্যালাক্সির স্থানে স্থানে কম-বেশি ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সাধারণত বেশিরভাগ গ্যালাক্সিই তার মধ্যস্থ কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান।
ব্রহ্মাণ্ডে যদি এমন নক্ষত্র থাকে যে আলো গিলে নেবে, তাহলে এর উলটোটাও তো থাকতে পারে! সময়-কাল প্রদেশে এমন বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে, যেখান থেকে আলো এবং কণা নির্গত হতে পারে! অর্থাৎ, কৃষ্ণবিবর সবকিছু নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করে নেয়, আর শ্বেতবিবর সবকিছু বাইরে বের করে দেয়। এজন্য এটি খুব উজ্জ্বল। তাই বলা যায়, সময়কে বিপরীতদিকে চালালে কৃষ্ণবিবরকে শ্বেতবিবর বলে মনে হবে।
মাথা ঘুরছে? কল্পনার ক্ষমতাকে একটু বাড়িয়ে ভাবা যাক। একটি তারা, যে মৃত – সবকিছুকে গিলে নিচ্ছে, সে কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। আমি ভাবতে বলছি বর্তমানে যদি একটা কৃষ্ণগহ্বর আমার চোখের সামনে থেকে থাকে তাহলে তার অতীত কী? অর্থাৎ, Time Reversal Of Black Hole হলে কী হবে? প্রথমে হবে একটা তারা, যে আলো এবং তাপ বিকিরণ করে জাজ্বল্যমান ছিল, আমাদের সূর্য যেমন। আরও অতীতে যদি যাওয়া যায়? তাহলে কী? অর্থাৎ কৃষ্ণবিবরের ঠিক উলটোরকম কিছু একটা পাওয়া যাবে যার ব্যবহার কৃষ্ণবিবরের বিপরীত। সে আলো বিকিরণ করবে। নিজের মধ্যে যে সমস্ত কণিকা আছে সব উগড়ে বের করে দেবে মহাশূন্যে ইত্যাদি ইত্যাদি।
মজার ব্যাপার কী জানেন? আজ পর্যন্ত এই শ্বেতবিবর তত্ত্বেই রয়েছে, দেখা কিন্তু যায়নি। কেন? কারণ এটি একটি উপপ্রমেয়মূলক তারা, Hypothetical Star; অর্থাৎ, যা আছে, সব খাতায় কলমে, চাক্ষুষ নেই…
(৩)
সমুদ্রের সামনে কে না দাঁড়িয়েছে? অনন্ত নীলিমা অসীম জলরাশির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন মিশে গেছে। অথবা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছি মেঘসমুদ্রের মধ্যে আকাশ দিগন্তে লীন হয়েছে। কিংবা ফাঁকা সবুজ মাঠে? নীল অনন্ত সুখে আকাশ ভূমিকে ঘিরে নিয়েছে দিগন্তের আলিঙ্গনে। আর তাই অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের মাঝে থাকা দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই, বাক্রুদ্ধ হয়ে যাই।
কাব্য হয়ে গেল? না করে উপায় নেই। কেননা, এমন কাব্যিক সুষমায় সুষমান্বিত দিগন্ত একজন বিজ্ঞানীর কাছে কিন্তু নিয়ে আসে বিস্ময়ের ডালি। দিগন্তের বাস্তব অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারে না। নেই, কিন্তু আছে – আমাদের চোখে; ঠিক তেমনি একজন সাধারণ আপেক্ষিক পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে দিগন্ত আছে, অন্যভাবে – অন্য স্থান-কাল-পাত্রে। থুড়ি, একটা দিগন্ত নয়, অনেক দিগন্ত… দিগন্তের দিগন্ত।
প্রলাপের মতন লাগছে? প্রথমেই বলে নিই, কল্পনা ছাড়া এই ভৌত-দিগন্ত বোঝার অন্য কোনও উপায় নেই। সেই কল্পনাও আবার যুক্তিগ্রাহ্য কল্পনা। সুতরাং একটু ধৈর্য, একটু স্বীকার্য আর একটু মনোযোগই যথেষ্ট।
যখন একজন পর্যবেক্ষক মহাকাশের মধ্যে ভ্রমণ করে, তখন স্থান আর কালের এক বিচিত্র সমন্বয়তায় সৃষ্টি হয় দিগন্তের, যা পর্যবেক্ষকের উপর প্রভাবরহিত। বিভিন্ন রকমের দিগন্ত স্থানে স্থানে সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন হল কেন? কোথায়? কীভাবে? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে কৃষ্ণগহ্বরের কাছে। আমরা জানি, কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সময় স্থির। এবং এর মধ্যে থেকে আলো ফিরে আসতে পারে না। অর্থাৎ পর্যবেক্ষকের কাছে দেখা-না দেখার মাঝে সৃষ্টি হয় দিগন্তের। একে ঘটনা-দিগন্ত (Event Horizon) বলে।
সাধারণ আপেক্ষিকতা মতে, ঘটনা-দিগন্ত হচ্ছে কোনও একটি ঘটনার স্থান-কাল-এর সীমানা যার বাইরে অবস্থিত কোনও পর্যবেক্ষকের উপর এর কোনও প্রভাব পড়ে না। সাধারণ কথায় একে বলা যায় ‘প্রত্যাবর্তনের শেষ বিন্দু’ যেখানে মাধ্যাকর্ষণ টান এতই শক্তিশালী হয় যে, কোনও কণার পক্ষে আর দূরে যাওয়া সম্ভব হয় না। ঘটনা-দিগন্তের ভেতর থেকে নিক্ষিপ্ত আলো, বা রেডিয়েশন বা কণা বাইরের পর্যবেক্ষকের কাছে পৌঁছোতে পারে না। একইভাবে, এর বাইরে থেকে আসা কণার গতিও ধীর হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় এবং তা দিগন্তকে পুরোপুরি অতিক্রম করে না।
এবার মনে করা যাক, একজন মানুষ এমন একটা করিডর ধরে দৌড়োচ্ছে, যার অনেক দরজা আছে। মানুষটা বাইরে বেরোতে চাইছে, কিন্তু দরজাগুলো এমনভাবে খুলেছে এবং বন্ধ হয়ে তাকে রাস্তা করে দিচ্ছে, ঠিক যেন আরও ভিতরের দিকে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সে বাইরে আসতে গিয়ে আরোও ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হল, প্রতিটা দরজা পার করার সময় তার মনে হচ্ছে এইটাই যেন সেই শেষ দরজাটা, যেটা তাকে বাইরে বের করে দেব। ঠিক এমনই হয় কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে। আলো বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের বাইরে এমনভাবে এই দিগন্তজাল রয়েছে যে আলো পর্যন্ত এই দিগন্তজালে আটকা পড়ে উলটে আরও কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে চলে যায়। যে দিগন্ত তাকে এই ট্র্যাপে ফেলে তাকে আপাত-দিগন্ত (Apparent Horizon) বলে। আপাত-দিগন্ত সর্বদা ঘটনা-দিগন্তের মধ্যে থাকে, বা তার মধ্যে মিশে থাকে।
বিশ্বের মধ্যে শিশু মহাবিশ্বের কথা এসেই পড়ে, কৃষ্ণগহ্বর থেকে যার উৎপত্তি। এমন হিসাবে ধরলে একটা ব্যাপার বোঝা যায় যে, একটা এমন সীমানা সম্ভব, যে বহির্বিশ্ব এবং অন্তঃবিশ্বের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। এমনকি বহির্বিশ্বে অবস্থিত পর্যবেক্ষকের চোখে এই অন্তর্বিশ্বের অন্তরস্থিত কোনওরকম আলোই এসে পৌঁছোয় না। তার মানে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই, পর্যবেক্ষক এমতাবস্থায় যদি একটি বল ওই অন্তর্বিশ্বের দিকে টিপ করে ছোড়ে তাহলে যে মুহূর্তে ওই সীমানা, এখন আমরা তাকে বলব দিগন্ত, পেরোবে সেই মুহূর্তেই তার চোখে অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই দিগন্তকে পরম দিগন্ত (Absolute Horizon) বলে। প্রকৃতপক্ষে এই পরম দিগন্তই কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা নির্দেশ করে। পরম দিগন্তকে ব্যাখ্যা করা যায় কেবলমাত্র অসীম সমতল স্থান–কালের মাধ্যমে – এমন একটি স্থান–কাল যেখানে যেকোনো বৃহদায়তন বস্তুর থেকে দূরে যেতে থাকলে স্থানকে সমতল মনে হয়। মজার ব্যাপার হল ঘটনা দিগন্তকে ভালো করে লক্ষ করলে মনে হবে এই দুই দিগন্ত কোথাও যেন একই – কৃষ্ণগহ্বরের আঙ্গিকে দেখলে এক তো বটেই। কিন্তু মহাবিশ্ব-শিশু মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে বা অন্যান্য বেশ কিছু ব্যাপারে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ, সাধারণভাবে একে পরম দিগন্ত বললেও, কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে এটাই ঘটনা দিগন্ত।
মূল তিনটি দিগন্তের কথা বললাম। এবার পড়ে রইল ছোটোখাটো কিছু দিগন্ত। যেমন – কাউচি দিগন্ত (couchy horaizon)। এই দিগন্তের একদিকে থাকে স্থান-জনিত তল (space-like geodesics) এবং অপর দিকে থাকে কাল-জনিত তল (time-like geodesics)। আবার আমাদের এই মহাবিশ্বের যতখানি সীমানা পর্যন্ত আমরা জ্ঞাত বা যতখানির মধ্যে থেকে আমরা আমাদের বিশ্ব সম্বন্ধে জানতে পারি, সেই বিশ্ব এবং তার বহির্বিশ্বের মধ্যবর্তী সীমানাকে বলে ‘কসমোলজিকাল দিগন্ত’ (Cosmological Horizon)। আর পর্যবেক্ষক যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টিপাত করতে পারে ততদূর পর্যন্ত এবং তার বাইরের জগতের মধ্যের দিগন্তকে বলে কণিকা দিগন্ত (Particle Horizon)। অর্থাৎ দর্শকের দৃষ্টির মধ্যে একটা কণা যতদূর যেতে পারে এই মহাবিশ্বে ঠিক ততটাই তার দিগন্ত। তার বাইরে গেলে? ভ্যানিশ।
তো এই হল মোটামুটি সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদজনিত ভৌতদিগন্ত। এই সমস্ত দিগন্তকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম যুক্তি-কল্পনার মাধ্যমে। বাস্তবে কল্পনা করতে বসলে কিন্তু ঠকতে হবে। কল্পনা করতে হবে এমনভাবে, যা যুক্তিগ্রাহ্য। কোন যুক্তি? আপেক্ষিক পদার্থবিদ্যার যুক্তি। মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যার সূচনা করে গিয়েছেন।
উপসংহার
যা আমরা জানলাম, তা খুব অল্প, বলা বাহুল্য খুব জটিল। এযাবৎ মহাবিশ্ব নিয়ে যে বিজ্ঞানে আমরা এগিয়ে চলেছি, তা ক্রমাগতই জটিল এবং রহস্যসংকুল। এই প্রবন্ধ পড়ে কেউ যদি কৌতূহলী হয়ে আরও পড়তে চায় তাহলেই আমার লেখা সার্থক। অর্থাৎ এই উপসংহার মহাকাশ বিশ্ববিজ্ঞানের সূচনামাত্র। পাঠক কেবল মনে রেখো ভগবান বুদ্ধের সেই অমোঘ প্রজ্ঞাপারমিতা বাণী,
“গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে, বোধি স্বাহা”
“go, go, go beyond; go thoroughly beyond. Perfect realization!”
Tags: এ অনন্ত চরাচরে, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রবন্ধ, সুমন দাস