কনসোল
লেখক: সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত
শিল্পী: অঙ্কিতা
বৃষ্টি পড়ছে সেই সকাল থেকে। ছ’টায় একবার ঘুম ভেঙেছিল সায়ন এর। কারন মা এসে গায়ে চাদরটা দিয়ে গেছে, ঠান্ডায় কুঁকড়ে ছিলাম বলে হয়তো। এই না হলে মা।
আরও একঘণ্টা ঘুমোনোর টাইম আছে হাতে। সাতটা বাজলেই বাবা এসে নাক টিপে ঘুম ভাঙিয়ে দেবে। এরকম অঝোর বৃষ্টির মধ্যে কারই বা স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে! আজকে নিশ্চিত স্কুলে কেউ যাবে না। কিন্তু বাবা ডাকবেই। ঘুম থেকে না উঠলে হয় টিভি চালিয়ে দেবে নয়তো রেডিয়ো চালিয়ে দেবে যাতে আমাকে বাধ্য হয়ে উঠে পড়তে হয়।
ঠিক তাই! যেই সাতটা পাঁচ বেজেছে অঞ্জন দত্ত-র ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’ চালিয়ে দিয়েছে দেখি। কিন্তু সকাল সকাল বিকেলের বৃষ্টির প্রেমের গান শুনতে একদম ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু হঠাৎ দেখি নিশ্বাস নিতে পারছি না। বাবা নাক টিপে ধরেছে। বলছে দেখ দেখ পুরো রাস্তায় জল জমে গেছে আজকে স্কুলে যেতে পারবি না।
বাস আমার মাথাটা চট করে গরম হয়ে গেল।
‘বাবা!! তুমি তাহলে ঘুম থেকে তুলে দিলে কেন? আরেকটু ঘুমোতে পারতাম তো!!’
বাবা বলল, ‘আর কত ঘুমবি। তোর প্রিয় অঞ্জন এর গান চলছে শোন।‘
এরপরে আর কোনও তর্কাতর্কি করা যায় না। সুন্দর ঘুমটা ভেঙে গেল। অগত্যা উঠতে হল। ব্রাশ করতে করতে নীচ থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে আসলাম। ওমা ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে এসছি দেখি বাবা নিজেই কাগজ পড়া স্টার্ট করে দিয়েছে। এই হল সমস্যা। যাই হোক, কম্পিউটারটা খুলে বসলাম, ফার ক্রাই এর নতুন গেমটার মাঝামাঝি আছি এখন।
একটু পরেই মা চেঁচিয়ে উঠল।
“সকাল সকাল কম্পিউটার গেম? মানে একটা লিমিট আছে সবকিছুর। এখুনি খেতে বস! আর তোর বাবাকেও ডাক। লুচি ভেজেছি, সব ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
উফ লুচি! আর আমায় রাখে কে। বৃষ্টির মধ্যে লুচি আলুরদমের ব্যাপারই আলাদা। আমি আর বাবা গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম। বাবা বলল মাকে, “তুমিও বসে পড়ো না।” মা ও বসে গেল আমাদের সঙ্গে।
আজকে তথাকথিত বৃষ্টি ছুটি পালন করার দিন আমার। খবরের কাগজ তো পড়া হল না বাবা পড়ছে বলে তাই আবার কম্পিউটার গেমটাই খেলা স্টার্ট করে দিলাম। একটু খেলে ইমেইলটা চেক করে দেখলাম। সুনন্দা কোনও মেইল পাঠিয়েছে কি না চেক করার জন্য। নাহ! কিছুই আসেনি। এতবার চিঠি লিখলাম কোনও পাত্তাই দিল না। ধুর আর ট্রাই করব না, যদি ভালো লাগে আমাকে নিজে থেকেই বলবে। অত পেছন পেছন ঘুরতে পারছি না আমি। অগত্যা আবার গেম।
আমি অপেক্ষা করেই ছিলাম কখন মা চিল্লাবে যে এখনও পড়তে বসলি না? ফেল করবি তুই এবারে। ঠিক তাই, পাঁচ মিনিট খেলেছি গেমটা, ব্যাস স্টার্ট হয়ে গেল।
“এবারেও ফেল তোর, কোনও লাভ নেই, স্কুলে যাবি না মানলাম কিন্তু কম্পিউটার গেম সকাল থেকে? লিমিট ক্রস করে গেছে তোর, যা ইচ্ছে করে বেড়া, তোর বাবা তো কিছু বলবেই না। সারাদিন খবরের কাগজ। ছেলে কি করল না করল কোনও কিছুতেই কিছু এসে যায় না তার। আমি লিখে রেখে দিলাম আজকে, তুই এবারে ফেল করবি।“
সুতরাং এবারে বই খুলিয়া বসিলাম। যদিও মা জানে না এই টেবিল এর তলাতেই আমার গল্পের বইটা রাখা। এবং মা রান্না করতে ঢুকলেই আমি ‘পড়াশোনা’ স্টার্ট করে দিই। বাবা এসব দেখেও দেখে না। আমারই লাভ।
এই হল আমার ছুটির দিনের রোজকার গল্প। ভালো খারাপের মধ্যে দিয়ে চলে যায় দিনগুলো। আমি, বাবা, মা। ছোট সংসার কিন্তু খুব ভালো। ঝামেলা তো আছেই আমাদের, কিন্তু ভালোবাসাটা অনেক বেশি বেশি আছে, এবং থাকবেও। অবশ্য মাঝে মধ্যে দুর্ভাবনা হয় একটু। জানি না কতদিন এই একসঙ্গে থাকতে পারব, পড়াশোনার জন্য হয়তো বাইরে যেতে হতেই পারে আমাকে। তখন মা-বাবা আমাকে ছেড়ে কি থাকতে পারবে? আমি নিজেই কি পারব? ভাবতে ভয় লাগে, হয়তো জীবনটাই পালটে যাবে তখন। মা-বাবা হয়তো আরও একা হয়ে পড়বে আমাকে ছাড়া। আমি তো কলেজে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে থাকব অতটা একা লাগবে না। কিন্তু মা বাবা…। কে জানে কি হবে?
দিনটা শেষ হল দারুণভাবে। আমরা তিনজন একটা সিনেমা দেখতে গেছিলাম বিকেলে। হঠাৎ করেই প্ল্যান হল। বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছিল বিকেলের দিকে।
বাবা বলল, “যাবি নাকি?”
আমি বললাম, “কোথায়?”
“ওই যে হ্যারি পটার এর নতুনটা এসেছে তো আগের সপ্তাহে।”
আমি বলি, “সত্যি বাবা নিয়ে যাবে?” আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।”
বাবা বলে, “চল চল, রেডি হয়ে নে।”
মা অমনি, “তাহলে রাতে ডিনারটা কিন্তু বাইরেই করছি আমরা।”
আমরা বেরিয়ে পড়লাম। অনেকদিন পর এরকম আনন্দ করলাম আজকে। মুভি হল থেকে বেরিয়ে ‘হং কং চাইনীজ রেস্তরা’ তে ভরপেট গ্রেভি নুডলস আর গারলিক চিকেন খেয়ে ব্যাক টু বাড়ি। হলুদ ট্যাক্সিতে ফিরতে ফিরতে বৃষ্টিটা জোরে স্টার্ট হল আবার। একটা অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতি তৈরি হল। কিন্তু কেন জানি না মনে হল এই মুহূর্তটা হয়তো কোনওদিন ভুলতে পারব না। সামনে বাবা সিগারেট ধরিয়েছে, বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর আমার পাশে মা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। কেন জানি না সকালের ওই চলে যাওয়ার কথাটা ভেবে আমার ঠিক এই মুহূর্তটা ধরে রাখতে খুব ইচ্ছে করল।
ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি কনসোলটা চোখ থেকে খুলে রেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সায়ন। সেই বাবার সিগারেট এর ধোঁয়ার গন্ধ আর বৃষ্টির গন্ধটা পুরো স্পষ্ট টের পেল সায়ন। এমনও কি সম্ভব?
টানা চার ঘণ্টা ধরে খেলেছে আজকে। অফিস থেকে ফিরে আটটা নাগাদ খেলা স্টার্ট করেছিল, ডিনার পরে করবে এই ভেবে। ব্যাস, খেলাটা খেলতে স্টার্ট করলেই তো সব ভুলে যায় সায়ন। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি যে এতটাই ‘রিয়্যাল’ তা না খেললে হয়তো ও কোনওদিনও বুঝতে পারত না। ১৪০০০ টাকায় ইন্টারনেট থেকে পেয়েছে জিনিসটা। সফটওয়্যারটা ডেভেলপ যারা করেছে তারা দাবি করেছে যে, এরকম অভিজ্ঞতা নাকি প্লেয়ারদের হবে যে ওরা কোনটা সত্যি আর কোনটা গেম কিছুই বুঝতে পারবে না। আর সত্যি তাই।
এখনও সেই ছোটবেলার মতোই নতুন কোনও ভালো গেম দেখলেই ওর মনের মধ্যে কীরকম যেন একটা করে ‘ঈশশ্ এই গেমটা যদি খেলতে পারতাম বেশ হত’।
তাই ডার্ক ওয়েবে যখন লিঙ্কটা খুজে পেল যে অর্ডার করে ১৪০০০ টাকা দিলে ও এই অদ্ভুত গেমটা পেয়ে যাবে, তখন আর সাত-পাঁচ না-ভেবে অর্ডার করে দেয়। কনসোল সুদ্ধু প্রিলোডেড গেমটা চলেও এল কিছুদিনের মধ্যে।
তারপর থেকেই পাগল হয়ে গেছে সায়ন।
এরকম গেম জীবনে খেলেনি। এই গেমটা ডিরেক্ট মস্তিষ্কের সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন করে নিজের কোনও শৈশব এর স্মৃতি যদি মনে থাকে, মানে চেতনার মধ্যে থাকে তাহলে হুবহু সেই সময়টা রিক্রিয়েট করতে পারবে এই ডিভাইসটা। দু’দিন খেলে সায়নের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। সারাক্ষণ ধরে খেলছে অফিস থেকে ফিরেই। হুঁশ ভাঙল এইবার ওর, দূর থেকে মা এর দুর্বল গলার আওয়াজটা পেল।
“বাবা, খেতে আয়। আমার ইন্সুলিনটা দিয়ে দিস।”
বাবার ফটোটার দিকে তাকাল, তিন বছর হল বাবা আর নেই, লাং ক্যানসার।
শুধু মা আর সায়ন। আর ওই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি কনসোল।
Tags: অঙ্কিতা, অনুগল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত
অসাধারন লাগল, স্যার ।
Darun legeche!