কর্কটকাল
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: জটায়ু
“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।”
সেই কোনকালে জীবনানন্দ ‘সুচেতনা’ কবিতায় এই কথাগুলো বলে গেছিলেন! কথাটা কিন্তু খুব সত্যি। যতবারই ধ্বংসের মুখোমুখি হই না কেন আমরা— বেঁচে থাকার মতো প্রাণশক্তি ঠিক পেয়ে যাই কোনও না কোনও সূত্র থেকে। এই অক্সিজেনের জোগান দেওয়ার কাজে মস্ত ভূমিকা নেয় বইপত্রও। ঘরবন্দি অবস্থায় গত কয়েকমাসে পাঠকেরা যে চুটিয়ে বই পড়েছেন— তার প্রমাণ রয়েছে সর্বত্র। কিন্তু অবাক করার মতো আর একটি তথ্যও উঠে এসেছে এইসব প্রমাণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে।
দুনিয়া জুড়ে ঘরবন্দি মানুষেরা এই সময়টাকে কাজে লাগিয়েছেন প্রচুর বই পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই এমন বেশ কিছু থ্রিলার বা কাহিনি এই সময় পঠিত হয়েছে, যাদের বিষয়বস্তু হল অতিমারী এবং তার ফলাফল! সেই বিশাল লম্বা লিস্ট থেকে আমার পছন্দের ক’টা বইয়ের নামোল্লেখ করি এই সুযোগে। এদের মধ্যে অনেকেই ক্লাসিক তথা বহুপঠিত। তবু এদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় করিয়ে দিলে বোধহয় পাঠকেরা রাগ করবেন না।
১) আই অ্যাম লিজেন্ড~ রিচার্ড ম্যাথেসন: ১৯৫৪ সালে প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাসের বিষয় হল অতিমারীর ফলে প্রায় জনশূন্য হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতের পৃথিবী। সেখানে টিকে আছে রবার্ট নেভিল নামের একজন মানুষ এবং এমন একদল প্রাণী— যারা এমনিতে মানুষের মতো দেখতে হলেও নিশাচর, ফ্যাকাশে চামড়ার ও রক্তপায়ী! বুঝতেই পারছেন, স্পেকুলেটিভ ফিকশনের একটি বিশেষ ঘরানায় এই উপন্যাসটি কোহিনূর না হলেও ‘স্টার অফ আফ্রিকা’ গোছের সম্মান পায়।
তবে ভয় বা রোমাঞ্চ ছাপিয়ে এই উপন্যাস চিরসবুজ সাহিত্যের সম্মান পেয়েছে অন্য কারণে। এটি আসলে দুটি বিপ্রতীপ ভাবনার চিরন্তন লড়াইয়ের এক প্রতীকী আখ্যান— যেখানে উভয়েই অন্যকে নিশ্চিহ্ন করতে, বা নিজের দলে টানতে বদ্ধপরিকর। সহাবস্থান যেখানে একেবারেই অসম্ভব— তেমন এক পৃথিবীতে ‘ঠিক’ রাস্তা বেছে নেওয়ার সিসিফীয় সংগ্রামের আখ্যান শোনায় এই উপন্যাস।
২) দ্য অ্যান্ড্রোমিডা স্টেইন~ মাইকেল ক্রিকটন: আমাদের প্রজন্মের কাছে টেকনো থ্রিলার লেখার ব্যাপারে গোল্ডেন স্ট্যান্ডার্ড ছিলেন এই লেখক। রবার্ট ব্লক যেমন শুধুই ‘সাইকো’-র লেখক হয়ে গেছেন, ক্রিকটনও তেমন জুড়ে গেছেন ‘জুরাসিক পার্ক’-এর সঙ্গে। কিন্তু ১৯৬৯ সালে লেখা এই শ্বাসরোধী থ্রিলারে তিনি এমন এক অতিমারীর আভাস দিয়েছিলেন, যার সামনে আমরা একান্তই অসহায়।
এই কাহিনির শুরুতে দেখি, জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য সংগৃহীত এক অতি-পার্থিব জীবাণু একটি কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে নেমে আসে একটি মোটামুটি নির্জন জায়গায়। কিন্তু কাছেপিঠের সামান্য জনবসতি অতি দ্রুত জনশূন্য হয়ে পড়ে তারপরই। বোঝা যায়, এই জীবাণুর সান্নিধ্যে আসামাত্র মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য তৈরি বিশেষ দলটির সদস্যদের আন্তঃক্রিয়া, পরিস্থিতি ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাওয়া, শেষে ‘অড ম্যান আউট’-এর ভূমিকায় সংকটের নিষ্পত্তি— এগুলোই এই উপন্যাসের উপজীব্য।
স্রেফ বিনোদন মূল্যের বাইরেও এই উপন্যাসের কিন্তু মস্ত বড় একটা আবেদন আছে। সংকটের মুহূর্তে যে কোনও রক্তমাংসের মানুষ কেমন আচরণ করে— তাকেই অতিমারীর পটভূমিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটিই এর কালোত্তীর্ণ আবেদনের রহস্য।
৩) দ্য স্ট্যান্ড~ স্টিফেন কিং: ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এই সুবিশাল, মহাকাব্যিক উপন্যাসটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যের অন্যতম বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু এর গভীরেও আছে এক অতিমারী। জৈব অস্ত্র হিসেবে তৈরি হওয়া এক বিশেষ রোগজীবাণু ছড়িয়ে যায় নানা ঘটনা আর দুর্ঘটনার মাধ্যমে। ‘সুপার ফ্লু’ বা ‘ক্যাপ্টেন ট্রিপস্’ নামে কুখ্যাত হওয়া এই অপ্রতিরোধ্য জীবাণুর সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অধিকাংশ মানুষ। যারা বেঁচে থাকে, তারা বিভাজিত হয় দুই ‘নেতা’-র অনুগামী শিবিরে। আপাতভাবে অলৌকিক নানা আখ্যান, অজস্র উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এই আখ্যান তার শেষে এই পুড়ে যাওয়া পরিবেশেও নতুন প্রাণের সম্ভাবনা দেখায়।
এই রচনার পেছনে কিং-এর মনে একদিকে যেমন ছিল ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’-এর প্রভাব, তেমনই ছিল একটা প্রশ্ন— বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা (রাষ্ট্র, ধর্ম, সেনাবাহিনী) যখন সরে যায়, তখন মানুষ কেমন আচরণ করে? সংশয়ে দীর্ণ মানুষের কাছে আলো আর কালো-র সেই দুই সম্ভাব্য রাস্তাকে আমাদের সামনে ফুটিয়ে তোলাতেই এই উপন্যাসের সার্থকতা।
৪) দ্য আইজ অফ ডার্কনেস~ ডিন কুনৎজ: হরর তথা থ্রিলার সাহিত্যের মহাকায় ব্যক্তিত্ব কুনৎজ ১৯৮১ সালে ‘লে নিকলস’ ছদ্মনামে এই বইটি লেখেন। প্রায় চল্লিশ বছর পর বইটা হঠাৎ সংবাদ শিরোনামে আসে, যখন আবিষ্কৃত হয় যে ওই বইয়ে (আসলে শেষের সাত পাতায়) উহান-৪০০ নামের একটি কৃত্রিম জীবাণুর কথা বলা হয়েছে। সেই জীবাণু হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পর অত্যন্ত দ্রুত দক্ষিণ চিনের ওই শহরের মানুষেরা মারা পড়েন। তাঁদের মধ্যে দেখা দেওয়া রোগের লক্ষণ ছিল কাশি আর শ্বাসকষ্ট!
প্রায় রাতারাতি একের পর এক কনস্পিরেসি থিওরি তৈরি হয় এই ‘পূর্বাভাস’ নিয়ে। তবে বইটা পড়ে অধিকাংশ পাঠকই দারুণ হতাশ হয়ে আবিষ্কার করেন, সেটি আদৌ করোনা-বৃত্তান্ত নিয়ে লেখা হয়নি। এক মা হঠাৎই একদিন তাঁর ছেলেকে দেখেন— যে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তিনি কি ভুল দেখেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে তাঁর একক অনুসন্ধান খুব শিগগিরই অন্য অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। তারপর কী হয়, সেই নিয়ে হরর থেকে কল্পবিজ্ঞানে সরে যাওয়া এই উপন্যাসটি গত মাসতিনেকে বহুল পঠিত হলেও ঠিক অতিমারী বিষয়ক নয়।
৫) দ্য ব্লাইন্ডনেস~ হোসে সারামাগো: পর্তুগিজ ভাষায় ‘এনসাইও সোব্রে এ সেগিরা’ নামে ১৯৯৫ সালে লেখা এই উপন্যাস আসলে রোগের আড়ালে মনুষ্যত্বের বিনাশ ও তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টার এক আধুনিক মহাকাব্য।
সহসা মানুষের চোখের সামনে নেমে আসে উজ্জ্বল সাদা কুয়াশার মতো এক আবরণ। সে আশায় থাকে সেই কুয়াশা কেটে যাওয়ার। কিন্তু তা হয় না। বরং সাদা অন্ধত্বের এই ঢেউয়ের তলায় ডুবে যায় জনপদ, শহর, দেশ! সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টায় এই অন্ধদের কোনোরকমে ঠেসে দেওয়া হয় একটি হাসপাতালে। অবধারিতভাবেই সেখানে দেখা দেয় নানা দুর্নীতি, অনাচার ও অপরাধ। কিন্তু এই সাদা অন্ধকারের মধ্যেও কীভাবে টিকে থাকে মনুষ্যত্ব— তাই নিয়েই লেখা হয়েছে উপন্যাসটি।
৬) ডারউইন’স রেডিও~ গ্রেগ এগান: ১৯৯৯ সালের এই উপন্যাসটি পড়তে গেলে বোঝা যায়, হাড়হিম করা লেখা কাকে বলে। এর উপজীব্যও একটি সংক্রমণ— যা প্রথমে দেখা দেয় এক প্রাণঘাতী রোগ হয়ে। তবে পরে যা চিহ্নিত হয় বিবর্তন হিসেবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সংক্রমণ অপ্রতিরোধ্য, কারণ এর ভেক্টর তথা বাহক রয়েছে আমার-আপনার সবার শরীরে! ডিএনএ-র যে অংশগুলো কোনও কাজে লাগে না, যুগ যুগ আগের স্মৃতিবাহী সেই ‘ইনট্রন’-এর কিছু অংশ কাজ করতে শুরু করে ‘সংক্রমিত’ মানুষটির শরীরে। আর তারপর…!
যথারীতি, এক রুদ্ধশ্বাস বায়ো থ্রিলারের অন্তরালে এই উপন্যাস আদতে সেই প্রশ্নগুলোর সামনে আমাদের দাঁড় করাতে চেয়েছে, যেগুলোকে মিডিয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, সমাজ থেকে রাষ্ট্র— সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। তাদের মধ্যে আছে সমাজে নারীর স্থান, গর্ভপাত নিয়ে সংশয়, সংক্রমণ প্রতিরোধের নামে কোনো এক কাল্পনিক শত্রুকে খোঁজার চেষ্টা… এমন আরও অনেক কিছু। নেবুলা এবং আরও একগুচ্ছ পুরস্কার বলে দিয়েছে, পাঠকেরা সেই প্রশ্নগুলোকে চিনে নিতে পেরেছেন ওই ন্যারেটিভের মধ্য থেকেও।
৭) অরিক্স অ্যান্ড ক্রেক~ মার্গারেট অ্যাটউড: ডিস্টোপিক সাহিত্যের সম্রাজ্ঞী হিসেবে এই সাহিত্যিককে চিহ্নিত করা হলে বোধহয় কেউই অবাক হবেন না। ২০০৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু হল জিন নিয়ে সীমাহীন পরীক্ষানিরীক্ষা, সবকিছু ও সবার ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে ওঠার ব্যবসায়িক লোভ, ক্রূরতা এবং আর্থ-সামাজিক বণ্টন একেবারে ভেঙে নতুন এক পৃথিবী গড়ে ওঠা। আপাতভাবে এতে বিগত সময়ের প্রতিনিধি এক মানুষ আর নতুন প্রজন্মের এক মানুষের আন্তঃক্রিয়া দেখানো হয়। কিন্তু সেই আস্তরণের আড়াল সরিয়ে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে এমন এক পৃথিবী, যার কাছে ‘ব্ল্যাক মিরর’ নিতান্তই সহজপাচ্য!
অতিমারী-পরবর্তী এই ভয়াবহ পৃথিবীর ছবি ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে রচয়িতা কী বার্তা দিয়েছেন, তা প্রত্যেক পাঠক নিজের মতো করে বুঝতে চেয়েছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই কাহিনি এক অর্থে অন্ধকারের মতোই অনিঃশেষ। ঠিক এই কারণেই উপন্যাসটি আমাদের ভীত ও চিন্তিত করেই রেখে দেয়— বরাবরের মতো।
৮) ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড: অ্যান ওরাল হিস্ট্রি অফ দ্য জোম্বি ওয়ার~ ম্যাক্স ব্রুকস: ২০০৬ সালে প্রকাশিত এই বইটির অভিঘাত এখন এই বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে বসে আন্দাজ করা কঠিন। এমনকী তারকায় ঠাসা সিনেমাটিও এই উপন্যাসের মূল শিকড় কতটা অনুসন্ধান করেছেন, তাই নিয়ে সন্দেহ আছে। আপাতভাবে এর উপজীব্য হল চিনের (আর কোত্থেকে হবে?) এক গ্রাম থেকে দ্রুত সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়া জোম্বি-আউটব্রেক। কিন্তু তার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি বাঁধন জীর্ণ বসনের মতো কীভাবে খসে পড়ে মানুষের চেতনা থেকে— তারও এক ভয়াবহ ছবি ফুটে উঠেছে বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী তথা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বেঁচে থাকা মানুষদের কথায়।
এই বই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, দুনিয়া জুড়ে ছড়াতে থাকা এক ভয়াবহ রোগের সঙ্গে লড়তে গেলে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল মানবিকতা। ছোট্ট-ছোট্ট ‘মানবিক’ আচরণের অভাব কীভাবে একটা সংকটকে নাগালের বাইরে নিয়ে যায়, তারপর মানবিক সংহতির মাধ্যমেই কীভাবে তার সঙ্গে লড়া যায়— দুটোই দেখিয়েছেন ব্রুক্স। একে ডার্ক কমেডি হিসেবে পড়তেই পারেন। কিন্তু মানবতার ভেতরে ফাটলগুলো দেখিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বাঘা-বাঘা সাহিত্যের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না এই উপন্যাস।
৯) মেডুসা~ ক্লাইভ কাসলার: থ্রিলার জগতের সম্রাট বলে কিছু হয় না, কারণ প্রতিবছর পাঠক, সমালোচক ও প্রকাশকেরা আলাদা লেখককে এই উপাধি দিয়ে থাকেন। তবু, মাত্র কয়েকমাস আগে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত কাসলার-এর সম্বন্ধে ওইরকম কোনও বিশেষণ ব্যবহার করলে অত্যুক্তি হবে না।
২০০৯ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু হল প্রশান্ত মহাসাগর থেকে এক মার্কিন গবেষণাগারের রহস্যময় অন্তর্ধান। সেখানে ‘ব্লু মেডুসা’ নামক একটি দুর্লভ জেলিফিশকে নিয়ে গবেষণা চলছিল। প্রায় একইসঙ্গে জামাইকার কাছে একটি জাহাজ সহসা আক্রান্ত হয়ে ডুবতে থাকে। দুটি ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে বেরিয়ে আসে সারস/ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারীর সম্ভাবনা এবং একটি বিশেষ দেশের কিছু মানুষের ভূমিকা। কোন দেশ? সেও কি বলা প্রয়োজন?
বিনোদনমূল্যের পাশাপাশি এই বইয়ে যে সম্ভাবনা তথা তাদের বাস্তবায়নের সম্ভাব্য ফলাফল দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে আজকের পৃথিবীর ছায়া খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়।
১০) দ্য ইয়ার অফ দ্য র্যাবিড ড্রাগন~ এল.এইচ. ড্রাকেন: মাত্র দু’বছর আগে, ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এই বিশাল উপন্যাসটি। নাম শুনে বুঝতেই পারছেন কেন এই উপন্যাসটির উল্লেখ করেই কর্কটকালের পাঠ-কে আমি নিয়ে আসছি একেবারে হালের সময়ে। নাথান ট্রয় নামের এক মার্কিন ফ্রিলান্স জার্নালিস্ট বেজিংয়ের পথে-পথে ঘুরছিলেন ‘খবর’-এর সন্ধানে। একরকম কাকতালীয়ভাবেই তিনি মুখোমুখি হন জলাতঙ্কের শিকার এক রোগীর। তাঁর অনুসন্ধানের সূত্রে একটু-একটু করে আত্মপ্রকাশ করে শহরে নেমে আসা করাল মৃত্যুর ছায়া আর তাকে লুকিয়ে রাখার জন্য শাসকদের নির্মম প্রয়াস। চিনের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘সমস্যা’-কে বরাবরের মতো সমাধান করার জন্য কিছু বিজ্ঞানীর চেষ্টার ফল হিসেবে এক অন্ধকের জন্ম— এই নিয়েই লেখা হয়েছে এই বিশাল বই। বায়ো থ্রিলার নয়, বরং ক্রাইম থ্রিলার হিসেবেই বইটা পড়া উচিত। জেনে-বুঝে চিনের মহিমাকীর্তনে ব্যস্ত মানুষ হলে আলাদা কথা। তবে সচেতন পাঠক এই উপন্যাসে আমাদের উত্তরের পড়শিটির বাস্তবের আচরণ ও পরিকল্পনার প্রতিচ্ছবিই দেখবেন।
প্রায় সব রিডার্স পোলে এই বইগুলির সগর্ব উপস্থিতি থেকে তিনটে সিদ্ধান্ত সহজেই নেওয়া চলে।
প্রথমত, মায়া ক্যালেন্ডারের গুলগল্প, মহাশূন্য থেকে ধেয়ে আসা উল্কাখণ্ড ইত্যাদি ভুলে মানবসমাজের একটি বড় অংশ মেনে নিয়েছে যে সভ্যতা হিসেবে আমাদের ভিত আপাতভাবে যত মজবুতই দেখাক না কেন, তাকে নিয়ে প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে অনেকের মনেই। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে জিগির তোলার পাশাপাশি স্বেচ্ছায় কিছু-কিছু স্বাধীনতা ও প্রাইভেসি ছাড়তে তাঁরা প্রস্তুত হয়ে পড়ছেন হয়তো মনে-মনেই। এর থেকেই পরবর্তীকালে আবার অন্য এক ডিস্টোপিয়া সৃজনের সম্ভাবনা তাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, বেশ কিছু বিজ্ঞানী দাবি করে থাকেন, সচরাচর প্রকৃতির মাধ্যমে (ভয়ংকর অগ্নুৎপাত থেকে শুরু করে সহসা শৈত্যপ্রবাহ) ঘটলেও পৃথিবীতে প্রাণের ‘সিক্সথ এক্সটিংশন’ বা ষষ্ঠ বিলয় ঘটবে মানুষের মাধ্যমে। উষ্ণায়ন এবং জৈববৈচিত্র্যের ক্ষয়ের মাধ্যমে তার যে সূচনাও হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই— এও তাঁরা বলে থাকেন। অতিমারী-জনিত লকডাউন এবং সেই সময়ে পঠিত বইপত্র থেকে বোঝাই যায়, বহু পাঠক মানসিকভাবে এই কথাটা মেনে নিয়েছেন যে শুধু পরিবেশ দূষণে নয়, মানুষের বানানো কোনও জীবাণুর মাধ্যমে সভ্যতার বিনাশও ঘটতেই পারে।
তৃতীয়ত, সিজিন ল্যু’র ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ ট্রিলজি-তে মানবসভ্যতা তথা পৃথিবীকে বিপন্ন করে তুলেছিল যে বিজ্ঞানী’র সিদ্ধান্ত, তাঁর কাজ তথা ভাবনার পেছনে সবচেয়ে বড় চালিকা ছিল কালচারাল রেভলিউশনের অংশ হয়ে আসা কিছু কার্য-কারণ প্রক্রিয়া ও তাদের ফলাফল। মাও-এর সেই ভয়াবহ ‘বিপ্লবের’ পরেই চিনে “যা-পাই-তাই-খাই” সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল ক্ষুধার্ত মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদে। তার ফলে ওই দেশের ‘ওয়েট মার্কেট’-এ বেচাকেনা হওয়া যেকোনো প্রাণীর রোগজীবাণুই চিনের নাগরিকদের শরীরে চলে আসতে পারে। অর্থনীতির বলে গোটা দুনিয়ার সম্ভ্রম ও ঈর্ষার পাত্র দেশটি থেকে প্রতিদিন উড়ে যাওয়া অজস্র বিমানের সওয়ারিদের মাধ্যমে সেই রোগ পৃথিবীর প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। এই বিষয় নিয়ে ভাবা অধিকাংশ লেখক তথা তাঁদের রচনার অনুরাগী পাঠকেরা এটা বুঝে ফেলেছেন— সেটা রাজনীতিজ্ঞরা মানুন বা না-মানুন!
এই কর্কটকাল কবে শেষ হবে জানি না। তবে অতিমারী-র সামাজিক প্রকোপ ইত্যাদি মাথায় রেখেও আমাদের বিশেষভাবে সচেতন হওয়া উচিত, যাতে ‘একদিন তারে নেবে চিনে’ দশা আমাদেরও না হয়। ইতিমধ্যে সুস্থ থাকুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন, বাইরে বেরোলে মাস্ক পরুন, হাত-মুখ এবং এক্সপোজড অংশগুলো পরিষ্কার রাখুন, বই (কাগজের বা বৈদ্যুতিন— যেমনটি চান) পড়া চালিয়ে যান।
ভালো থাকুন। আমাদের সব্বার তরফে শুভেচ্ছা রইল।
Tags: ঋজু গাঙ্গুলী, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, বিশেষ আকর্ষণ
এই লিস্টের অর্ধেক এখনো পড়া হয়নি। জানলাম। এইবার পড়বই। এই তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
রত্নের সন্ধান দিলেন লেখক৷ কয়েকটি পড়লেও অনেককটি পড়িনি ৷অসম্ভব ভালো তথ্যবহুল লেখা৷
লেখাটিতে আমাদের অনেক বই এর সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য লেখকের ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে অতিমারীর এই কল্প বিজ্ঞান বই গুলির সমস্যা হল এগুলো ভিলেনের বিষয়ে ভীষণ ভাবে একপেশে। আগে ভিলেন দেশ ছিল রাশিয়া এবং বর্তমানে চীন। জল বায়ুর বিষয়ে আমেরিকার ভূমিকা বা জিন পরিবর্তনের ব্যাপারে তো কম গবেষণা আমেরিকায় হচ্ছে না। তা যে কোন দিন খারাপ কাজে সে দেশ ব্যবহার করবে না বা সেখানে কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? পরমাণু বোমা ব্যবহারের ইতিহাস কিন্তু আমেরিকার আছে। বিজ্ঞানকে সঠিক আলোকে দেখাটা উচিত। বর্তমান পৃথিবীর সব দেশ ই নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে এতটাই ব্যস্ত যে পৃথিবীর ভালো দেখার সময় তাদের নেই। আপনার লেখা পড়ে মনে হল কল্প বিজ্ঞান ও তার প্রভাব মুক্ত নয়।