কর্নেল এবং…
লেখক: রনিন
শিল্পী: সুমিত রায়
কর্নেল এবং…
লেখক – রনিন
অলংকরণ – সুমিত রায়
১
পথে হলো দেরি
সেদিন ছিল রবিবার। একটা ছিমছাম ভালো লাগার অলস অখন্ড রবিবার। খবরের কাগজে কাজ করার সূত্রে ততদিনে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর সঙ্গে শনি-রবির পার্থক্য ভুলেছিলাম প্রায়, কিন্তু ডাকবাংলোর খুনের কেসটা সমাধান হওয়ার পর থেকে পুরো এক সপ্তাহের ছুটি মনজুর হয়েছে অফিস থেকে। তাই আমার হাতে তখন এক ফালি অবসর। দেরি না করে জর্জ অরওয়েলের লেখা ১৯৮৪ বইখানা পড়ে শেষ করে ফেললাম মাত্র দু-দিনে। সোফায় হেলান দিয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে আমি সেই প্লটটা নিয়েই খেলা করছিলাম, মগজকে অকারণ খাটিয়ে। বেশ লাগছিলো ভাবনা-চিন্তার জাবর কেটে। যদিও মনের কোণে একটা অস্বস্তি বারবার বুড়বুড়ি কাটছিলো এবং আমি প্রায়ই আড়চোখে টেবিলে রাখা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছিলাম নিজের অজান্তেই। একটা কল অথবা একটা টেক্সট মেসেজ? কিন্তু, না। ‘বুড়ো ভাম’ আমার সবরকম আশায় জল ঢেলে নিরুত্তর আছেন বিগত তিন দিন। আমিও ঠোঁট ফুলিয়ে আশ্রয় নিয়েছি বইয়ের দু’মলাটের পৃথিবীতে। এদিকে আমার পড়ে পাওয়া ছুটিটায় কোনও রোমাঞ্চকর জায়গায় রুদ্ধশ্বাস কোনও অভিযানে কাটাবার সমস্ত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হতে চলেছে প্রায়। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি, খানিক অধৈর্য হয়ে হাত বাড়িয়ে ফোনটাকে তুলে নিই। অফিসের নম্বরটা কললিস্ট থেকে বার করে সবজে বোতাম টেপার আগে খানিক ভাবি। ছুটি ক্যান্সেল করে আবার কাজে ফিরতে গেলে বস নিশ্চয় কারণ জিজ্ঞাসা করবেন, কী উত্তর দেব তার?
…when I find myself in times of troubles… mother merry comes to me… speaking words of wisdom, let it be….
ফোনটা হঠাৎ জন লেননের সুরে বেজে উঠলো। ‘বুড়োঘুঘু কলিং’। বুড়ো আঙ্গুলটাকে আশ্বস্ত করলেও মনকে বোঝানো মুশকিল হয়ে যায়। বুড়োকে একটু না জ্বালালে আমার ‘ম্যান’ সম্মানের দফারফা হয়ে যাবে না? তৎক্ষনাৎ আবার একটা নতুন দুশ্চিন্তা মনের কোণে নড়েচড়ে উঠলো। কর্নেল হয়তো কোনও দরকারে ফোন করেছেন আমাকে? ব্যাপারটা জরুরিও হতে পারে? মনের মধ্যে যুক্তি তর্কের চাপানউতোর চলছিল বেশ জোরের সঙ্গে। এমন সময় ফোনটা সহসা নির্বাক হয়ে পড়লো। এত বছরের ইতিহাসে এরকম কোনওদিন হয়নি। বুড়ো হয়তো রেগে আগুন হবেন অথবা একেবারেই পাত্তা দেবেন না ব্যাপারটাকে। কী যে করি! কপাল চাপড়ে অবশেষে যে কাজ করতে চাইছিলাম না সেটাই করতে উদ্যত হই। সবুজ বোতামটা টেপার আগেই আবার ফোন ডেকে ওঠে, কর্নেলের বার্তা স্ক্রিনে শোভা পাচ্ছে – ‘নিজের চোখকে সার্থক করতে চাইলে তাড়াতাড়ি চলে এস’। এরপর আর রাগ করে বসে থাকা যায়? হেলমেট হাতে দ্রুত ছুটলাম বাইকের দিকে। বাইক ছুটলো আমাকে নিয়ে, কর্নেলের বাড়ির দিকে। মনের মধ্যে যদিও শ’খানেক প্রশ্নের গুঁতোগুতি।
বুড়ো নিশ্চয় কোনও কাজে ব্যস্ত ছিলেন এ ক’দিন, সেজন্যই বোধহয় আমার ফোনের উত্তর দেননি। কিন্তু কী এমন কাজ? কোনও ভয়ানক কেস নাকি? খবরের কাগজে তো সেরকম সাড়া জাগানো কোনও খবরও চোখে পড়লো না সকাল থেকে? তবে কী কোথাও যাবার আমন্ত্রণ? ‘নিজের চোখকে সার্থক’ কথাটা যখন লিখেছেন, নিশ্চয় এমন কিছু আমাকে দেখতে চাইছেন যা দেখে আমি ব্যোমকে যাবো, এরকমটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন। পেশার সূত্রে আমি ‘দেখেছি’ বিস্তর কিছু। বুড়োর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে ‘অনুভব’ করেছি মারাত্মক সব অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চও। তাহলে কী এমন জিনিস দেখিয়ে ঘুঘু আমাকে অবাক করতে চাইছেন?
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম উত্তেজনার বশে কর্নেলের বাড়ি ছেড়ে এগিয়ে এসেছ বেশ খানিকটা। নিজেকে গালমন্দ করে আবার মারলাম ইউ-টার্ন।
বাইকটাকে স্ট্যান্ড করেই সবুজ গেটটা খুলে ছুট মারলাম দরজার উদ্দেশ্যে। বেল বাজাতে সবেমাত্র আঙ্গুল বাড়িয়েছি এমন সময় সহসা দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং ‘তিনি’।
‘তিনি’, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার!
২
জাল
‘এতো দেরি?’ কর্নেলের মুখ থমথমে।
‘দেরি?’ আমি তাড়াতাড়ি কর্নেলের মেজাজ ঠিক করতে পথ ভোলার গল্পটা বেমালুম গিলে নিয়ে হাসি মুখে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করি, ‘মেসেজ পেতেই একেবারে বাইক উড়িয়ে এসে পড়লাম তো!’
‘জয়ন্ত, আমার কল পাবার সঙ্গে সঙ্গে যদি বাইকে চেপে থাকো তাহলে আমার বাড়িতে পৌঁছতে সাধারণত তোমার সময় লাগে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট, আজ লেগেছে ঘড়ির ধরে বাহান্ন মিনিট। এক্সপ্লেইন প্লিজ।’
কর্নেলের প্রশ্ন থেকে বাঁচতে আমি অজস্র অজুহাত খাড়া করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই এবং দুহাত ওপরে তুলে কাঁধ ঝাঁকাই, ‘উত্তেজনার চোটে খেয়াল করিনি, একটু বেশিদূর চলে গেছি। গাড়ি ঘুরিয়ে দুখানা সিগন্যাল খেয়ে…’ আমি সত্যি ঘটনাকে আরেকটু দীর্ঘ এবং করুণ করার চেষ্টায় কথা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কর্নেল হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ান। হাঁফ ছেড়ে ঘরে ঢুকে সোফায় শরীর টান করে দিই। ষষ্ঠীদা হাতে কফির কাপ নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘বাবামশাই পাগল হয়ে গেছেন,’ ফিসফিস করে কথাগুলো বলেই চোরা চোখে একবার বুড়োকে দেখে নিয়ে ভিতর ঘরে যাবার উদ্যোগ করে কর্নেলের অনুগত ষষ্ঠীচরণ। আমিও হাতের তালু দিয়ে মুখ লুকিয়ে চাপা স্বরে বলে উঠি, ‘ঠিক তাই, বদ্ধ উন্মাদ…’
কর্নেল এতক্ষণ বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা প্রজাপতি-সজ্জিত কাচের খাঁচাখানা তদারক করছিলেন গালের সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে।
‘উন্মাদ তারা যারা প্রকৃতির রূপ-রং-ঐশ্বর্য সম্পর্কে অজ্ঞ। বুঝলে?’
অবাক হয়ে মাথা ঘোরাতেই নজরে পড়লো বুড়োর হাসি মুখখানা। আমার কথাটা তাহলে তাঁর কানে ঢুকেছে? স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আমাকে না ধমকে, যথারীতি তিনি এখন আমাকে জ্ঞান দিতে উৎসাহ হয়ে পড়েছেন। মনে মনে প্রমাদ গণেও আমি মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বুড়োর উদ্দেশ্যে উত্তেজিত প্রশ্ন ছুড়ি, ‘এক্সপ্লেইন প্লিজ!’
এদিকে এস।’ হাতছানি দিয়ে তিনি ডাকছেন আমায়, অগত্যা কফির কাপ হাতে খাঁচার সামনে এসে দাঁড়াই।
‘ওরে বাবা, এতো সুন্দর প্রজাপতি কোথায় পেলেন?’
এবার আমার বিস্ময় কিন্তু একদম মেকি নয়। একটা সবুজ প্রজাপতির ঠিক পাশে ফুলের মতো নিষ্পাপ আর ছবির মতো সুন্দর প্রজাপতি উড়ছে অলস ডানা মেলে। কি আশ্চর্য নরম হলুদ রঙের বাহার তার শরীর জুড়ে। যেন প্রাণীটার শরীর থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে মায়াময় ফুলের রেণু।
আমি চোখ বড় বড় করে তার রূপ গিলতে থাকি তৃষ্ণার্তের মতো।
‘তিব্বতি ব্রিমস্টোন, দুর্লভ প্রজাতি-’
আমার মস্তিষ্ককে ঘায়েল করে বুড়ো ঘোষণা করেন, ‘দেখেছ, কেমন পাতার মতো দেখতে ওর পাখনা দুটো? খেয়াল করে দেখ, ডানার গায়ে কেমন শিরা উপশিরা দেখা যাচ্ছে? ওটা দেখেই সবাই গাছের পাতা বা ফুলের পাপড়ি ভেবে বসে। বলতে পারো এই ফুলের সাজটা ওদের আত্মরক্ষার উপায়।’
‘তাহলে এটাই সেই চক্ষু সার্থক করা দর্শনীয় বস্তু?’
আমি রঙিন ওড়াউড়ি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করে উঠি।
‘উঁহু, এতো একটা চমক মাত্র,’ বুড়ো ঘুঘু এবার নিজে সোফায় এলিয়ে বসলেন আরাম করে, আয়েশ করে চুরুটে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন চোখ বন্ধ করে, ‘আসল ‘দর্শনীয়’ ঘটনা ঘটছে আমার ল্যাবে, বুঝলে?’
‘তা সে অসাধারণ ঘটনা চর্মচক্ষুতে দেখতে কী করতে হবে আমাকে? টিকিট কাটতে হবে নাকি?’ আমি একটু ঠাট্টা করেই বললাম কথাটা।
‘ওই তো মুশকিল তোমাদের, সব কিছুতেই টাকার জোর খাটাতে চাও। এদিকে দেখো চোখ খুললেই দেখবে প্রকৃতি কী যত্নে এসব মণিমুক্ত সাজিয়ে রেখেছে আমাদের জন্য-’
কর্নেল আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর যেতেই উঠে পড়লেন ঝটপট। আমাকে ঘরের কোণায় ঝুলতে থাকা প্রজাপতি ধরার জাল দেখিয়ে বললেন, ‘তোমার হাতে পাক্কা আধঘন্টা আছে, এর মধ্যে বেশ কয়েকশো মশা, পোকা অথবা মাছি ধরে নিয়ে এস তো।’
‘মানে?’ আমার মুখের হাঁ আর বন্ধ হতে চায় না, ‘কেন?’ আমি আবার প্রশ্ন করি।
‘ভালো জিনিস দেখতে হলে একটু গা ঘামাতে হবে বুঝলে?’ কর্নেল রহস্যের হাসি হাসলেন।
‘তা, এগুলো পাবো কোথায়? মানে মশা, পোকা মাকড় এসব?’ আমি দেয়ালে ঝোলানো প্রজাপতি ধরার জালখানা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাই।
‘যেখানে আমি প্রজাপতিগুলোকে খুঁজে পাই- আমার বাগানে!’ কর্নেল এবার অধৈর্য এবং বিরক্ত।
আমাকে চোখের আগুনে ভস্ম করে কর্নেল তড়িঘড়ি ল্যাবের দিকে পা বাড়ালেন, আমি পরিষ্কার শুনতে পেলাম ওনার স্বগতোক্তি, ‘উফ, কুলফির খাবার সময় হয়ে গেলো আবার, একদম খেয়াল করিনি, এহে-’
‘কুলফি?’ আমার মুখ থেকে বেরোনো প্রশ্নটাকে পাত্তা না দিয়ে বুড়ো পর্দার ওপারে বিলীন হলেন। আমি দৌড়ালাম বাগানে পোকা ধরতে।
৩
কদাকার
আমি যখন হামাগুড়ি দিয়ে গাছের পাতা খুঁটে খুঁটে ছোট্ট ছোট্ট পোকা মাকড় ধরে কাচের জারে পুরছি, ঠিক তখনি একটা খ্যাকখ্যাক করে হাসি শুনতে পেলাম পাশের দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে।
‘বুড়ো আর তার চ্যালা, দুটোই সমান পাগল-’ একজন বয়স্ক পুরুষ গলা শুনতে পেলাম।
‘বুড়োর নাহয় মাথা খারাপ বুঝি, এটার এবার কি হলো?’ এবার একজন বৃদ্ধার গলা।
আমি লজ্জায় মাথা তুলতে পারি না। কোনওরকমে সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে বেশ জোরেই দরজা বন্ধ করি। তারপর ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাই ল্যাবের দিকে, বুড়ো তখন চশমা চোখে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের ঢাকনা নিরীক্ষণ করছিলেন। দেরি না করে তার নাকের সামনে পোকামাকড় ভর্তি জারখানা ধরলাম।
‘আধঘন্টায় এইটুকু!’
‘দুঃখিত! আমি আপনার মতো পোকাধরায় বিশেষজ্ঞ নই-’ আমার উত্তর শুনে বুড়ো কাচের জারটা ছিনিয়ে নিলেন হাত থেকে, ‘তুমি কিছুই পারো না আসলে-’ হুলটাকে এড়িয়ে আমি তাড়াতাড়ি প্লাস্টিকের ঢাকনার দিকে চোখ রাখলাম।
‘এ-এ-এ ক-ক-ক-ই-ই-’ আমি চিৎকার করে পিছিয়ে আসি।
‘আস্তে জয়ন্ত-’ কর্নেল আমায় চাপা ধমক দেন, ‘তোমার চিৎকারে কুলফির হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। যাচ্ছেতাই একবারে!’
‘এটা কি কর্নেল?’ আমি তখনও কাঁপছি, ‘কি বিচ্ছিরি দেখতে!’
কর্নেল যেন আহত হলেন রীতিমত, ‘মুখ সামলে কথা বোলো জয়ন্ত! কুলফি শুধু চার্মিং-ই নয়, ও প্রচন্ড ভদ্র। আর তাছাড়া ও তোমার কোনও ক্ষতি করেনি!’ ঠোঁট ফুলিয়ে বুড়ো আমাকে মুখ ঝামটা দিলেন।
‘দুঃখিত কর্নেল, কিছু না জেনেই আজেবাজে কথা বলে ফেলেছি,’ আমি অবস্থা নিয়ন্ত্রণে ঝটপট নেমে পড়ি, ‘আসলে এতদূর ঠেঙিয়ে এসে, এরকম একটা ইয়ে পোকা দেখবো সেটা ভাবিনি-’ আমি বুঝতে পারলাম আগুন নেভাবার বদলে ঘি ছড়াচ্ছি মাত্র।
‘ওটাই তো দেখার মতো জিনিস জয়ন্ত-’ পোকা মানে ‘কুলফি’-র দিকে আঙ্গুল তুলে বুড়ো বলে উঠলেন, ‘আর ওটা ‘পোকা’ নয়, ও হল ‘পাখি’!’
আমি হাসি চাপতে গিয়েও ব্যর্থ হই। কর্নেল আমাকে আবার দৃষ্টিতে ভস্ম করে ছোট্ট একটা চিমটে দিয়ে কুলফির মুখে একটা মরা মশা ঠুসে দেন। সে এক নিমেষে প্রাণীটাকে গিলে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ঝিম মেরে থাকে। সেই ফাঁকে বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন, ‘বাড়ন্ত বাচ্চা বুঝলে, এই সময় ওদের নিয়মিত খাওয়াতে হয়। আহা, কি সুন্দর দেখতে হবে কুলফি একদিন-’
‘কর্নেল, আমি দেখতে পাচ্ছি একটা আরশোলা সাইজের হাড়গিলে প্রাণী। যার গায়ের রং একদম ছাইয়ের মতো। ডানা তো দূরে থাক শরীরে একটাও লোম নেই। শুধু দুটো ইয়াব্বড় কালো স্পট দেখছি মাথায়, কি কদাকার!’
আমার কথা শেষ হবার আগেই কর্নেল মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘এটা পাখির বাচ্চা, কালো স্পট দুটো ওর চোখ যেটা এখনও ফোটেনি। ডানা এখনও গজায়নি তাই ওর পালকের বাহার তুমি দেখতে পাচ্ছ না। একটা কথা জেনে নাও, এই কদাকার কুলফি হল ট্রপিক্যাল এলাকায় উড়ে বেড়ানো ‘আনা রোজা’ পাখি, যাকে আমরা বলি ময়না। তবে এ ময়না সে ময়না নয়। এরা অপরূপ সুন্দর। মাথায় রক্তলাল টুপি, সাদা ধপধপে ডানার শেষে গাঢ় কালোর ছোপ। সেই সঙ্গে কালো রঙের ছোট্ট ল্যাজ বুঝলে? আহা-’ বুড়ো আবার কুলফির মুখের সামনে একটা লম্বা পোকা ধরেছেন কারণ সে আবার মাথা তুলে ঠোঁট ফাঁক করে তার দাবি জাহির করেছে।
‘কি খিদে রে বাবা!’ আমি চমকে উঠি।
‘ওকে প্রত্যেক দশ মিনিট অন্তর খাওয়াতে হয়। বুঝতে পারছো তো কেন আমি এই ক’দিন কারোর ফোনের উত্তর দিতে পারিনি?’
আমি মাথা নাড়ি। ‘এটাকে কোথা থেকে জোগাড় করলেন কর্নেল?’ প্রশ্নটা করতেই চশমার ফাঁক দিয়ে বুড়ো আমাকে আবার দৃষ্টি দিয়ে গলা ধাক্কা দিলেন যেন, ‘‘এটাকে’ আমি কুলফি বলে ডাকি জয়ন্ত!’ কড়কড়ে গলা শুনে আমি অপ্রস্তুত হাসি মুখে ঝোলাই।
‘আচ্ছা বেশ, কুলফিকে কোথা থেকে জোগাড় করলেন?’
‘আমার বন্ধু রাধানাথ বাঁড়ুজ্জের কড়িকাঠ থেকে একটা পাখির পরিত্যক্ত বাসা উদ্ধার হয়েছে। যেটাকে ফেলে দিতে গিয়ে উনি দেখেন খড়কুটোর মধ্যে মার্বেলের সাইজের দুটো ডিম পড়ে আছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তিনি আমাকে ফোন করেন। রাধানাথের ধারণা ছিল ডিমগুলো বোধহয় এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি সম্পূর্ণভাবে। আমি দুটো ডিমকে বাড়ি নিয়ে এসে তা দিয়ে নিশ্চিত হই যে একটি ডিম নষ্ট হলেও, আরেকটি সম্পূর্ণ সুস্থ আছে।’
‘আপনি তা দিলেন মানে… আপনি নিজে?’ বুড়ো ঘুঘু ডিমে তা দিচ্ছেন দৃশ্যটা ভাবতেই আমি মুখ ফস্কে বলে ফেললাম, অবশ্যই হাসি চেপে।
‘তুমি বোধহয় জানো না, আমার কাছে ইনকিউবেটর যন্ত্রটা আছে? সত্যি তোমার অজ্ঞতা আমাকে অবাক করে জয়ন্ত!’
বুড়োর গলায় তীব্র ধিক্কার।
‘দুঃখিত কর্নেল, তারপর? কী করে বুঝলেন ডিমটা ঠিকঠাক আছে?’
‘সহজ উপায়, ঘর অন্ধকার করে মোবাইল ফোনের টর্চের সামনে ধরলাম। দেখলাম ডিমের কুসুমে একটা লম্বা কালো দাগ। ওটাই এই ডিমে লুকিয়ে থাকা প্রাণের প্রমাণ। তারপর অপেক্ষা, ঠিক দু’দিন পরেই ডিম ভেঙে বেরিয়ে এলো- কুলফি।’ কর্নেলের গলায় মায়া জড়ানো ভাবালুতা।
‘আমিও কুলফিকে বড় হতে দেখতে চাই। বলুন আমাকে কি করতে হবে?’
বাচ্চারা যেমন লজেন্স হাতে পেলে খুশি হয় তেমনি কর্নেলের মুখেও হাজার ওয়াট আলোর রোশনাই জ্বলে উঠলো, ‘এই তো চাই! ষষ্ঠীকে বলে দিচ্ছি এখানেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করতে, ‘বুড়ো হঠাৎ দাড়ি চুলকে থমকে গেলেন, ‘ কিন্তু তোমার ছাপাখানা? সেটার কি হবে?’
‘আজ্ঞে, সংবাদপত্র- ছাপাখানা নয় ! আমি ছুটি নিয়েছি সেখান থেকে, এক সপ্তাহের জন্য।’
‘বেশ বেশ-’ বুড়োর গলায় খুশির ছোঁয়া, ‘যাও তো, কুলফির জন্য খাবার নিয়ে এস তো!’ বুড়ো আমার হাতে আবার কাচের জারটা ধরিয়ে দিলেন।
৪
অতিথি এবং….
‘এ কি! এতো এখনও প্রায় ভর্তি আছে, আবার কেন-’
কর্নেল লাজুক হাসেন, ‘আহা, কুলফির খিদে মারাত্মক। ওতে যতটুকু আছে তাতে ওর একবেলাও চলবে না-’ তারপর একটু মিইয়ে যাওয়া গলায় বললেন, ‘ষষ্ঠীকেই বলতাম কাজটা করতে, কিন্তু ওর মতো আহাম্মককে দিয়ে কি আর ওসব কাজ হয় না কি?’
কাজ হল, আমি গলে জল হয়ে গেলাম। অগত্যা জারখানা হাতে নিয়ে বিরস বদনে হাঁটা লাগালাম বাগানের দিকে।
এইভাবেই কেটেছিল পরবর্তী তিনটে দিন। কুলফির সঙ্গে আমার বন্ধুত্বও জমে গেছিলো বিস্তর। কখন তার খিদে পাচ্ছে, কখন তার গরম লাগছে, কখন তার তেষ্টা পাচ্ছে, সেসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতে করতে ভুলতে চলেছিলাম যে দরজার বাইরে অন্য একটা পৃথিবী আছে। প্রথম সে কথাটা টের পেলাম শনিবার সকালবেলায় ডোরবেলটা পাখির ডাকে বেজে ওঠায়। আমরা তিনজন তখন শশব্যস্ত হয়ে ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছিলাম ছোট্ট পাখিটার জন্য একখানা যুৎসই ঘর বানানোর প্রচেষ্টায়। কুলফি আকারে বড় হয়েছে, কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াতে শিখেছে একটু। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে তার বিশ্বভ্রমণের তীব্র তাগিদও। তাই তার একটা বড় ঘর চাই। কর্নেল হাতে একটা থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি তুলো জোগাড় করার চেষ্টায় আলমারি হাটকে যাচ্ছিলাম এবং ষষ্ঠীদা ভাতের দলা জলে মেখে কুলফির জলযোগের ব্যবস্থা করছিল।
ডোরবেলের শব্দটা আমাদের সব্বাইকে যেন একেবারে দিশেহারা করে তুললো।
‘দরজাটা খোল না হতচ্ছাড়া-’ ল্যাব থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন বদরাগী বুড়ো। উত্তরে ষষ্ঠীর একটা ঝোড়ো দৌড় এবং তারপরে ‘আজ্ঞে, কাকে চাই?’ বলা ছাড়া আর কোনও আওয়াজ না পাওয়াতে একটু আশ্চর্য হয়েই আমি দরজার দিকে পা বাড়াই।
‘কে ষষ্ঠীদা?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে একটা ফাঁকা চাহনি এবং বিশাল হাঁ মুখ নিয়ে ষষ্ঠীদা আমার দিকে ফিরে তাকালো। আমি দরজার ওধারে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুকের দিকে চোখ ফেরালাম এবং আমি নিশ্চিত আমার মুখের হাঁ-টা ষষ্ঠীদার থেকেও বেশ বড় আকার নিলো।
‘তোরা সবাই আমায় একলা ফেলে কোথায় গেলি? এদিকে কুলফি তো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করছে,’ কর্নেলের অধৈর্য বকুনি ল্যাব থেকে ভেসে আসছে, ‘কে এসেছে রে?’
আগন্তুক রিণরিণে মহিলা কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘হাই, আমি আনাবেলা-’।
‘একদম ভুলে গেছিলাম আজ ষোলোই অক্টোবর, কুলফি আমার সব চিন্তাভাবনাকে একদম অবশ করে দিয়েছে আনা-’ বিদেশী মেয়েটাকে হাতের ইশারায় সামনের সোফায় বসার অনুরোধ করে কর্নেল দুঃখিত গলায় বললেন।
‘কুলফি? ওটা একটা খাবারের নাম না?’ আনা একরাশ হাসি ছড়িয়ে প্রশ্নটা কর্নেলের দিকে ছুঁড়ে দিলো।
হাসির দমকে ঘর কাঁপিয়ে কর্নেল থামলেন একসময়, তারপর মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘ওই নামটাই প্রথম মাথায় এসেছিলো, তাই আর কি-’
আমি অবাঞ্ছিতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং বড় বড় চোখে দু’জনের বাক্যালাপ গিলতে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ কর্নেলের নজর আমার ওপর পড়লো এবং তিনি আগুন্তুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এস আলাপ করিয়ে দিই। আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আনস্মার্ট ছেলেটার নাম জয়ন্ত। এর কথা তুমি শুনেছ নিশ্চয়-’ মেয়েটি মাথা নাড়ে।
গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে।
‘এর নাম আনাবেলা বেসলাভিচ। আমার মতোই ওরও প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতূহল খুব বেশি। তবে আনা আমার মতো শখের প্রকৃতিবিদ নয়। পাখিদের ওপর অসাধারণ বই লিখে বিখ্যাত ‘মার্শ’ পুরস্কার জিতে নিয়েছে মাত্র বাইশ বছর বয়সে-’ কর্নেল স্মিত হাসি ছড়িয়ে আগন্তুকের পরিচয় দিচ্ছিলেন আর আমি আনমনে শুনছিলাম, ‘পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে আমিও একখানা বই লিখেছিলাম। আনা সেটার কথা জানতে পেরে মাস ছয়েক আগে মেইল আইডি জোগাড় করে আমার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করে। সেই থেকে আনা আমার গার্লফ্রেন্ড!’ কথাটা বলে বুড়ো মুচকি হাসেন। মেয়েটি ইংরেজিতে যা বললো তার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় খানিক এরকম, ‘আমি আপ্লুত-’ কেন জানি না আমার কানদুটো লাল হয়ে উঠলো। আনন্দে নয় নিশ্চয়।
‘জয়ন্ত তোমাকে কেউ দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি দেয়নি-’ কথাটা শুনতেই চমকে উঠে দ্রুত সোফায় আসন গ্রহণ করলাম কলের পুতুলের মতো।
কর্নেল কাঁধ নাচালেন, ‘বলেছিলাম, জয়ন্ত আনস্মার্ট!’ উত্তরে একটা খিল খিল হাসি ঘরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেল জানালার দিকে।
আমিও দেঁতো হাসি হাসলাম।
‘তোমার মেইলে পড়েছিলাম-’ এটুকু বলেই হঠাৎ কান খাড়া করে কর্নেল লাফিয়ে উঠলেন, ‘কুলফি ডাকছে! এহ, ওকে খেতে দিতে হবে তো-’ হাহাকার করে এবং আগন্তুকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তিনি বিলীন হলেন তার ল্যাবের দিকে, যাবার আগে আগন্তুকের দিকে মুচকি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘জয়ন্তকে একবার তোমার আসার কারণটা একটু বলে দিও সংক্ষেপে, আশা করি ও খুশি হবে।’
ঘরের মধ্যে রইলাম আমি, আনা এবং ষষ্ঠীদার দিয়ে যাওয়া ঠান্ডা সিঙ্গাড়া এবং কফির কাপখানা। বাগান থেকে ভেসে আসা পাখপাখালির ডাক ছাড়া বসার ঘরে তীব্র নৈঃশব্দ। অগত্যা ব্যস্তসমস্ত হয়ে আমি ভদ্রমহিলাকে সিঙ্গাড়ার জন্ম পরিচয় এবং তার স্বাদের বহর বোঝাবার চেষ্টায় হাত পা ছুঁড়লাম কিছুক্ষণ। তারপর শুনলাম তার সমুদ্র পেরিয়ে এতদূর আসার কাহিনীও। শুনলাম এবং আশ্চর্য হলাম। মুগ্ধ হলামও বলা যায়। একটা সুন্দর কিন্তু রহস্যময় দ্বীপের কাহিনী চোখের সামনে ফুটে উঠলো ক্রমশ। কে আমাকে বেশি ভাবিয়েছে! গল্পটা, নাকি গানের সুরে গল্প বলা কথিকা? জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি আমি গল্পের জাদুতে জগৎসংসার ভুলতে বসেছিলাম… প্রায়।
৫
হোমারের মহানায়ক…
ট্রয়ের যুদ্ধ শেষ। ওডেসিয়াস ফিরছেন ইথাকার মাটিতে। মনে ঘরে ফেরার আনন্দ যেমন, তেমনি শরীরে যুদ্ধজয়ের ক্লান্তিও অপার। স্ত্রী ও পুত্রের স্মৃতিতে হৃদয় যেমন তাঁর ভারাক্রান্ত, তেমনি সমুদ্রের দেবতা পোসেইডনের অনাগত আক্রমণের আশঙ্কায় তিনি দিশেহারা। হাজার হোক পোসেইডনের পুত্র একচক্ষু সিক্লোপসকে তিনি যুদ্ধে হারিয়ে হত্যা করেছেন। ক্রূদ্ধ দেবতা নিশ্চয় তার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বেন না। এমন সময় হঠাৎ আকাশ কালো করে মেঘ জমলো। সমুদ্রজুড়ে উন্মত্ত হাওয়ার দাপাদাপি দেখে তার সহযোদ্ধাদের মতো ওডেসিয়াস নিজেও বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝলেন দৈব আক্রোশ ঝড় হয়ে নেমে এসেছে তাঁকে ধ্বংস করতে। দেখতে দেখতে বীর যোদ্ধা ওডেসিয়াসের সমস্ত নৌবাহিনী ঝড়ের তোড়ে ভেসে গেল। তার নিজের জাহাজটিকে গিলে নিলো অতল সমুদ্র।
ওডেসিয়াস এক মহাযুদ্ধের নায়ক। তিনিও হার মানবেন না সহজে। দীর্ঘ ন’দিনের সংগ্রামের পর তিনি সাঁতরে পৌঁছলেন একখানি নির্জন দ্বীপে। ক্লান্ত ও আহত শরীরটাকে কোনওরকমে টেনে হিঁচড়ে তিনি যখন বালিয়াড়ি পেরিয়ে এলেন, দেখলেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন বাকরুদ্ধ হয়ে।
ওডেসিয়াসের চোখের সামনে তখন একখানি পাথুরে গুহা দাঁড়িয়ে আছে। গুহার মধ্যে এক অসামান্যা সুন্দরী যুবতী আনমনে গান গাইতে গাইতে পরম যত্নে পরিধানের কাপড় বুনছিলেন। তাঁর মাথায় বেড় দিয়ে ছিল সোনালী বিনুনি। তাঁর পরণের কাপড় থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল স্বর্গীয় আলো। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল অগুরু এবং চন্দনের সুগন্ধ। আঙুরের লতা গুহাকে ঘিরে তৈরী করছে শান্ত উপবন। ওডেসিয়াস বুঝলেন ইনি কোনও সাধারণ মানবী নন, তিনি নিশ্চয় দেবী ক্যালিপসো। তাঁর আন্দাজ সঠিক ছিল। আশ্চর্য ব্যাপার দেবী ক্যালিপসো ক্লান্ত ওডেসিয়াসকে আশ্রয় দিলেন, খাদ্য এবং সেবা দিয়ে তাঁর ক্লান্তি দূর করলেন। অবশেষে প্রেমেও পড়লেন তিনি। ওডেসিয়াসকেই দিয়ে বসলেন তাঁর হৃদয়। একজন মানুষকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখলেন নিঃসঙ্গ দেবী ক্যালিপসো।
এদিকে চারিদিকে তার রূপের বদনাম যথেচ্ছ। সকলের ধারণা দেবী তাঁর রূপের জাদুতে ভুলিয়ে ভালিয়ে অভিযাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছতে দেন না। তাদের দিকভ্রষ্ট করেই নাকি তাঁর আনন্দ। ওডেসিয়াসও জানতেন সে কথা। তাই তাঁর মনেও একদিন সন্দেহের বীজ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো অবিশ্বাসের বিষাক্ত চারা। তিনি যদিও অসহায়। কোনও ভাবেই ইথাকায় ফেরার উপায় নেই। দিনভর তিনি তাই সমুদ্রের অশান্ত ঢেউগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন আর স্ত্রী পেনেলোপের কথা ভেবে চোখের জল ফেলেন। সন্তানের হাতটা ধরার জন্য তার অন্তর কাতর হয়ে ওঠে। এভাবেই কেটে গেছে সাতটা বছর।
দেবী প্রেমিককে ভালোবেসেছেন, আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন তাঁকে, অনুরোধ করেছেন তাঁর সঙ্গে এই দ্বীপে ঘর বাঁধার জন্য।
‘চির তরুণ থাকবে তুমি, কেউ তোমাকে স্পর্শ করার সাহস দেখাবে না, এমনকি জরা কিংবা মৃত্যুও না-’
প্রেমিকের কানে কানে অজস্রবার এই কথাগুলো বলেছেন দেবী ক্যালিপসো। তবুও ওডেসিয়াসের মন মানেনি। এদিকে একদিন হার্মিস এসে হাজির হলেন দেবরাজ জুপিটারের বার্তা নিয়ে, ওডেসিয়াসকে অনুরোধ করলেন ক্যালিপসোর মায়া ছাড়িয়ে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিতে। বীর যোদ্ধার মনে দ্বিধা দ্বন্দ্বের ঝড় বইছে তখন এলেমেলো। দেবী যদি কুপিত হন তার আবেদন শুনে? যদি তিনি রুষ্টা হন তার দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার অভিসন্ধি জানতে পেরে? একে তো পোসেইডন তাঁকে ধ্বংস করতে উন্মুখ, তার ওপর যদি ক্যালিপসোর রোষের শিকার হন তিনি?
দেবী রুষ্টা হলেন না। ক্রোধে উন্মাদ হলেন না। শান্তভাবে প্রেমিকের হাতে ধরিয়ে দিলেন ব্রোঞ্জের বিশাল কুঠার, বললেন, ‘কাঠ কেটে বানাও তোমার ঘরে ফেরার জলযান-’
ওডেসিয়াস ভাবলেন নিশ্চয় কোনও পরিকল্পনা আঁটছেন দেবী। ক্যালিপসো বিষণ্ণ হেসে যোদ্ধাকে আশ্বস্ত করলেন, ‘আমার হৃদয় ঠিক তোমারই মতো স্বজন হারানোর বেদনায় পরিপূর্ণ, আমার বদনাম থাকতে পারে বটে তবে আমার মনটা পাথরে তৈরী নয়-’
দেবীর কথা বিশ্বাস করে ওডেসিয়াস সেই জাদু কুঠার দিয়ে গাছ কাটলেন, বানালেন একখানা ছোট্ট জাহাজ। ক্যালিপসো সে জাহাজে খাবারের রসদ দিলেন, আঙ্গুর ফলের পানীয় দিলেন, আকাশের নক্ষত্র দেখিয়ে দিকের হদিশ দিলেন, তারপর সমুদ্রের বুকে হালকা হাওয়ার ঢেউ তুলে দিলেন এক নিমেষে। ওডেসিয়াসের জাহাজ সেই হাওয়ায় পাল ভাসিয়ে যাত্রা শুরু করলো ঘরের পথে। একলা নির্জন দ্বীপের বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখলেন দেবী ক্যালিপসো আর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আনমনে।
যাত্রা শুরু করলেও কিন্তু ওডেসিয়াস আবার পড়লেন পোসেইডনের খপ্পরে। আবার ঝড় ধেয়ে এলো, আবার সমুদ্র কাঁপিয়ে উপস্থিত হল মহাতুফান। তার ধাক্কায় আবার ভাঙলো ওডেসিয়াসের জাহাজ। আকাশ জুড়ে তখন কালো মেঘের আবরণ। ঢেউ এর পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে বীর যোদ্ধার অসহায় শরীরের ওপর। তিনি যখন জাহাজের ভাঙা টুকরো আঁকড়ে ধরে পোসেইডনের পাঠানো ঝড়ের সঙ্গে যুঝছেন এমন সময় ঢেউয়ের বুক চিরে এক বিশাল শুভ্র গাংচিলের রূপ নিয়ে উদয় হলেন দেবী ক্যালিপসো। প্রেমিককে নিজের মাথার উড়নি দিয়ে বললেন, ‘নিজেকে এই উড়নিতে ঢেকে নাও, তারপর কাঠের টুকরো ছেড়ে দিয়ে সাঁতরে পার হও এই সমুদ্র। আমার দান তোমাকে বাঁচাবে সমস্ত বিপদ থেকে। নিরাপদে ঘরে ফিরে গেলে ফিরিয়ে দিয়ো আমার দান-’ তারপর বিদায় নিলেন তিনি।
দেবীর কথায় এখনও বিশ্বাস জন্মায়নি ওডেসিয়াসের। কিন্তু উপায় না দেখে তিনি নিজেকে জড়িয়ে নিলেন প্রেমিকার দেওয়া কাপড়খানায়, তারপর শুধু বিশ্বাসে ভর করে হাত থেকে মুক্তি দিলেন কাঠের টুকরোটাকে, শরীরের সমস্ত শক্তি জোগাড় করে শুরু করলেন সমুদ্রের বুকে সাঁতার কাটা। তারপরেও অজস্র বিপদ এসেছে, ওডেসিয়াস থেমে থাকেননি। এরপরেও মৃত্যু এসে পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে তাঁর, তিনি ভয় পাননি। দেবী এথেনার সাহায্যে এবং ক্যালিপসোর দেওয়া মায়া কাপড়ের দৌলতে একের পর এক বিপদ কাটিয়ে তিনি একসময় পা রাখলেন ইথাকার মাটিতে, ফিরে পেলেন হারানো পরিবারকে। তরপর কৃতজ্ঞচিত্তে সাদা কাপড়ের টুকরোটাকে নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। উড়নিটা জলের কোলে ভাসতে ভাসতে যখন সমুদ্রের দিকে চলেছে ঠিক তখনি জল ফুঁড়ে আবার উদয় হলেন দেবী ক্যালিপসো, কাপড়ের টুকরোটা হাতে নিয়ে মিলিয়ে গেলেন ঢেউয়ের আড়ালে। বিপন্ন প্রেমিককে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলেন তাঁর নির্জন দ্বীপে।
মহানায়ককে নিয়ে লেখা হল মহাকাব্য ‘ওডেসি’। কিন্তু দেবীর প্রেমের আখ্যান সবাই ভুলে গেল একদিন, ভুলে গেল সেই দ্বীপটাকেও। সেই দ্বীপ যা কিনা নায়ককে দিয়েছিলো নিরাপদ আশ্রয়, ভালোবাসা, বেঁচে থাকার আকাঙ্খা।
মানুষ ভুলতে পারে, কিন্তু সময় না। তাই সবরকম ভয়ানক খবর নিয়ে আবার হাজির হল দ্বীপটা, কয়েক হাজার বছর পরে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে। দ্বীপটার বর্তমান নাম, ‘গোজো আইল্যান্ড’। মাল্টার লাগোয়া একখানা ছোট্ট পাথরের ঢিবি, মাত্র কয়েক লক্ষ মানুষের বাস সেখানে। সেই দ্বীপে এখন আর দেবীর বাস নেই, শুধু পড়ে আছে একখানা পাথুরে গুহা। আর সেই গুহাকে ঘিরে শুরু হয়েছে দেশ বিদেশের পর্যটকদের মেলা। পর্যটক মানেই পয়সার ঝনঝনানি। তাই তাদের ঘিরে পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা, নির্জন দ্বীপটা এখন তাই ভ্রমণার্থীদের স্বর্গ হয়ে সেজে উঠেছে।
স্বর্গে লেগেছে অশান্তির আগুন। জানুয়ারি মাসে প্রথম ঘটলো ঘটনাটা। যেখানে একসময় এজিওর উইন্ডো ছিল সেখানে একদিন সকালে একদল জেলে অবাক হয়ে দেখলো সমুদ্র জুড়ে বিশাল উথালি পাথালি। ঢেউ ভেঙে লাফিয়ে উঠছে হিংস্র হাঙ্গরের একটা দল। তাদের দলবদ্ধ আক্রমণের শিকার একখানা অতিকায় জলজ প্রাণী। বীর বিক্রমে ঘাতক হাঙ্গরদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গেল প্রাণীটা, একভাবে তিনঘন্টা ধরে সে লড়াই করলো একাই। তারপর আবার হারিয়ে গেল সমুদ্রের অতলে। ক্ষতবিক্ষত কয়েকটা হাঙ্গরের আধখাওয়া শরীর ঢেউয়ের দোলায় এসে পৌঁছালো বালিয়াড়িতে। জেলেদের দাবি মৃত হাঙ্গরদের দৈর্ঘ ছিল প্রায় এগারো থেকে পনেরো ফুটের মতো। এরকম আট দশটা হাঙ্গরকে যে একাই শেষ করতে পারে তার দৈর্ঘ কিছু না হোক সত্তর ফুটের কাছাকাছি হতেই হবে।
সেই থেকে জল্পনা শুরু। সেই থেকে গোজো দ্বীপে অশান্তির সূত্রপাত।
এরপর নিয়ম করেই একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা। কয়েক সপ্তাহ পরেই আবার রাতের অন্ধকারে শোনা গেল হাড় হিম করা তীব্র চিৎকার। সকলের দাবি স্বয়ং শয়তানের ডাক ছিল সেটা। পরের দিন সকালেই আবার সবার চোখে পড়লো একদল হাঙ্গরের মৃতদেহ। বাতাসে কানাকানি চলতে শুরু করলো, পর্যটকরা প্রাণের ভয়ে দ্বীপ ছাড়লেন, বিজ্ঞানীরা যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হলেন দ্বীপে। কিন্তু আবার সবকিছু চুপচাপ। সবাই হতাশ। এমন সময় একদল দুঃসাহসী ডুবুরি জলের গভীরে উঁকি মারতে নামলেন, ফিরলেন না একজনও। মিললো না তাদের দেহাবশেষও। এতদিন সরকার খবরটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল, এবার বদনামের ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো তারা। কয়েক মাসের বিরতি কাটিয়ে আবার গোজো দ্বীপের বিভীষিকা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
ভূখণ্ডের দক্ষিণ দিকে একখানা হেলিকপ্টারে মাল্টা থেকে গোজো দ্বীপে ঘুরতে যাচ্ছিলেন চারজন পর্যটক। তাদের একজনের চোখে পড়লো সমুদ্রের নীল জলের নিচে সাঁতরে বেড়ানো এক অতিকায় প্রাণীর চেহারা। লাল নীল সবুজ রঙের ছাপ দেওয়া এক আশ্চর্য জীব, ঢেউয়ের তলায় সে অবাধে সাঁতার কাটছে নিশ্চিন্ত হয়ে। কাঁপা কাঁপা হাতে তার ছবি তুলতে গিয়ে পর্যটক আবিষ্কার করলেন প্রাণীটা জলের অতলে ডুব দিয়েছে আবার। ক্যামেরায় রয়ে গেছে শুধু একটা অস্পষ্ট রঙিন প্রাণীর প্রতিচ্ছবি। প্রাণীটার দৈর্ঘ কম করেও একশো ফুট হবেই, ভীত পর্যটকদের দাবি। অস্পষ্ট ছবিটা দেখে কেউ হেসেছে, বলেছে কম্পিউটারের কারসাজি। কেউ গম্ভীর হয়ে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুদের নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন, কেউ বা ভয়ের চোটে দেশের পথে পা বাড়িয়েছেন।
এই কাহিনীর সঙ্গে আনাবেলার কি সম্পর্ক?
বেশ কয়েক বছর আগে গ্রাজুয়েশন শেষ করে আনা বন্ধুদের সঙ্গে গোজো আইল্যান্ডে বেড়াতে আসে এক সপ্তাহের জন্য। নিছক ভ্রমণই উদ্দেশ্য। সে প্রকৃতিপ্রেমী, বাইনোকুলার হাতে চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে একদিন সহসা তার বাইনোকুলারের লেন্স ধরা পড়লো একজন অতি পরিচিত মানুষের মুখের অবয়ব। সেই মানুষটি যিনি কিনা একসময় তাদের ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলেন ডাইনোসরদের নিয়ে লেকচার দিতে।
বছর চল্লিশের সুপুরুষ বিজ্ঞানীর সঙ্গে যেচে আলাপ করেছিল সে। বেশ কয়েকদিন ধরে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে অবাক হয়ে শুনেছিল কিভাবে ডাইনোসর রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ডি. আর. আই) দিনের পর দিন গোটা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অতিকায় প্রাণীদের দেহাবশেষ খুঁজে চলেছে নিরলস অধ্যবসায়ে।
বিজ্ঞানী জানিয়েছিলেন, প্রাগৌতিহাসিক প্রাণীদের হাড়-মজ্জা থেকে পাওয়া গেছে তাদের ডিএনএ-ও। চমকে উঠেছিল আনা। শুনেছিল অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার কথাও। লেকচার দিয়ে বিজ্ঞানী একদিন ফিরে গেলেন কানাডায়, তার কয়েক বছর পরে খবরের কাগজে বেরোল এক আশ্চর্য সংবাদ, ‘ডি আর আই থেকে চুরি গেছে ডাইনোসরদের দেহাবশেষ’ ।
তারও বছর কয়েক পরে আবার খবরে এলো সংস্থাটি। আনার পরিচিত বিজ্ঞানী নাকি রাগে দুঃখে প্রতিষ্ঠান ছাড়ছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ডি আর আই একদম বিলুপ্তির পথে। কষ্ট পেয়েছিল আনা, বিজ্ঞানের সব শাখায় অর্থাভাব সবচেয়ে বড় বাধা, সেই সঙ্গে জড়িত নানা রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বেড়াজাল। সেসব কাটিয়েও বিজ্ঞানীরা যা কিছু আবিষ্কার করছেন সেটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব কেউই নিচ্ছেন না। মার খাচ্ছে বিজ্ঞান, ঝিমিয়ে পড়ছে মানুষের নিজেকে জানার তাগিদ। সেই প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর চেহারাই একদিন বিশাল প্রশ্নচিহ্ন নিয়েই হাজির হল আনার সামনে, গোজো ভূখণ্ডে, একদল পর্যটকের ভিড়ে। পুরানো আলাপ ঝালিয়ে নিতে বিজ্ঞানীকে হাত নাড়িয়ে ডেকেছিল আনা, কিন্তু তিনি শুনতে পাননি। দেশি বিদেশি মানুষের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা পেরিয়ে সে যখন পৌঁছলো বিজ্ঞানীর কাছে, তিনি তখন অদৃশ্য হয়েছেন। চঅনেক খুঁজেও পাওয়া গেলো না জ্ঞানী মানুষটিকে। সরকারি দপ্তরে হানা দিয়েও মিললো না সঠিক তথ্য। অবশেষে বাধ্য হয়ে ডি আর আই এর অফিস ফোন করে জানা গেলো নতুন তথ্য, ‘ভদ্রলোক গত এক বছর ধরে সম্পূর্ণ নিখোঁজ-’।
আনা এখানেই হাল ছেড়ে দিতে পারতো, কিন্তু তাহলে গোজো দ্বীপের সমুদ্রের ঢেউ কর্নেলের বসার ঘরে আছড়ে পড়তো না হয়তো। আনা ততদিনে মার্কিন বিজ্ঞান মহলে বেশ খানিকটা পরিচিতি পেয়েছে পুরস্কার পাবার দৌলতে। তার ধারণা হয়েছিল মৃতপ্রায় ডি আর আই কে সে কিছুটা অর্থসাহায্য করার চেষ্টা করতে পারে, যদি তাঁর কর্ণধারকে বিস্মৃতির হাত থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ভাগ্য বিমুখ। অনেক চেষ্টাতেও তাঁকে গোটা ভূখণ্ডে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেলো না। আনা দেশে ফিরলো একদিন তবে চেষ্টাটা জারি রাখলো বিলক্ষণ। এর মধ্যেই কর্নেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার, কর্নেল জানিয়েছেন ডি আর আইয়ের এই বিজ্ঞানী তাঁরও বন্ধু। সেই সূত্র ধরে আনা তিনখানা মহাসমুদ্র পেরিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে আমাদের সামনে, কর্নেলের সাহায্যে সে খুঁজে বার করবে বিজ্ঞানীকে, জীবন ফিরিয়ে দেবে প্রাগৌতিহাসিক জীবদের নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার একমাত্র প্রতিষ্ঠানকে।
আনার ধারণা কর্নেলই পারবেন বিজ্ঞানীকে খুঁজে বার করতে।
৬
ছোটাছুটি
‘কিন্তু কে এই বিজ্ঞানী?’ আমি গল্পের শেষে প্রশ্ন করি।
‘হার্লান এলিসন,’ গার্ডেনিং গাউনটাকে গুছিয়ে সোফায় বসতে বসতে উত্তর দেন কর্নেল।
‘প্যালেন্টোলজি বিভাগে একজন পথিকৃৎ-’ আনা বলে ওঠে।
‘আমি নিশ্চিত, জয়ন্ত কোনওদিন ভদ্রলোকের নাম শোনেনি,’ কর্নেল চশমা মুছতে মুছতে ঠাট্টা করেন, ‘তোমার অজ্ঞতা আমাকে সত্যি আশ্চর্য করে-’ এবার ঠাট্টা নয়, ধমক।
আমি হাঁ মুখ বন্ধ করে স্মার্ট হবার চেষ্টা করি।
‘ওর একার দোষ নয় কর্নেল, পৃথিবীর মানুষ এঁদের সবার সম্পৰ্কে আশ্চর্য রকমের অনুভূতিহীন-’ আনার গলাটা বিষণ্ণ শোনায়।
‘আনা, তাহলে আমাদের যাবার ব্যবস্থা কি হবে?’ কর্নেল দাড়ি চুলকে টাকমাথায় হাত বোলান। আমি কৌতূহল নিয়ে আনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আমরা দুজনে কালকের ফ্লাইটেই বেরিয়ে পড়বো, টিকিট থেকে হোটেল সবকিছুর ব্যবস্থা হয়ে গেছে-’ আনা দুহাত ছড়িয়ে হাসিমুখে বললো।
আমার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, ‘আ-আ-আ-ম-মি–?’
‘তুমি তো এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েই ফেলেছো, এরপর কি আর তোমার ছাপাখানা তোমায় ছাড়বে?’ পাইপে টান মেরে নিশ্চিন্তে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন ঘুঘু। আমার চোখ ফেটে জল আসার জোগাড়, কর্নেলের একটাও অভিযান ছাড়িনি আমি এ ক’বছরে। আর সেই আমাকেই কিনা এরকম ভাবে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া?
‘আহা মুখ ফোলাচ্ছ কেন, যদি চাকরি না খুইয়ে আমাদের সঙ্গে যেতে পারো তাহলে চলো-’ কর্নেল হাসলেন।
‘আমি ব্যাগ গোচ্ছাছি-’ দ্রুত সোফা ছেড়ে উঠে পড়ি, আনা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, ‘আমরা টুরিস্ট কিন্তু, সুতরাং ব্যাগের সাইজ এবং সংখ্যা দুটোই বেশি হতে হবে কিন্তু-’ তার দাবি।
‘জয়ন্ত, হালদার মশাইকেও ফোন করতে ভুলো না-’ আমি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে দরজার দিকে যাই, মাথায় হেলমেট গলিয়ে বাইকে স্টার্ট মারি।
গাড়ির ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে, আমি কিন্তু কানে ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ের গোমরানি শুনতে পাই।
পুরোদস্তুর লটবহর সাজিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকলাম কর্নেলের বাড়িতে পরের দিন সকালে। হালদারবাবু ফোনে কড়া নির্দেশ জারি করেছেন, তাঁকে ছাড়া যেন আমরা এক পাও যেন বাড়ির বাইরে না ফেলি। তবে কিনা তিনি ব্যস্ত মানুষ তাই গিন্নিকে সামলে আর দায়িত্ব অন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমাদের দলে ভিড়তে তার একটু সময় প্রয়োজন। আনা দেরি না করে ফ্লাইটের টিকিটের একটা কপি সরকারি গোয়েন্দাকে পাঠিয়ে দিয়েছে ইমেল মারফত।
উড়ান ছাড়তে তখনও কিছুক্ষণ বাকি, তাই কর্নেল আমাকে পাঠিয়েছেন কুলফির জন্য বরাদ্দ খাবার জোগাড় করতে। তাঁর নিজের নিঃস্ব বাগান ছেড়ে আমাকে তাই আশ্রয় নিতে হয়েছে কর্নেলের প্রতিবেশীর বাগানে।
‘কে?’ কলিং বেল বাজাবার শব্দ শুনতেই বুড়ির খেঁচানি শুনতে পেলাম। মুখে গলে যাওয়া হাসি ঝুলিয়ে দোতলার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে হাতের জারটা তুলে দেখালাম, ‘কর্নেল পাঠালেন, একটু পোকা দরকার ছিল কিনা-’
বুড়ির মুখ উধাও হল, দরজা খুলে মাথা বার করে তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘রসিকতা পেয়েচ?’
‘ইয়ে…মানে…কর্নেলের বাগান একদম পরিষ্কার… দেখলাম আপনাদের বাগানটা… যদি একটু… আসলে বাঁধাকপির গায়ে লেগে থাকা পোকাগুলো তো খেতে খুব সুস্বাদু… তাই….’ আমি অনুমতি পাবার আসায় বুড়ির ঝুলে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘তুমি পোকা খাও?’ এরপরের প্রশ্ন।
‘না-আ-আ-আ-’ আমি আঁতকে উঠি।
‘ওই বুড়ো খায়?’ তারপরের প্রশ্ন।
‘না-আ-আ-’ আমি মাথা নাড়াই জোরে জোরে, ‘এটা তো কুলফির জন্য-’ আমি উত্তর দিই।
‘সে যাকগে, যা করার কর আমাকে আর বিরক্ত করো না-’ বুড়ি উধাও হলেন। আমি বাগানের এককোণে যত্নে ফলানো বাঁধাকপির বাগানের দিকে পা বাড়াই।
একঘন্টা সেখানে কাটিয়ে এক জার পোকামাকড় নিয়ে কর্নেলের সামনে দাঁড়াই, বুড়ো এবং আনা দুজনের মুখেই হাসি ফুটে ওঠে। কুলফি চেঁচিয়ে ওঠে, তার এখনই খাবার চাই।
আমি ঘড়ির দিকে তাকাই, এখনও হালদারবাবুর দেখা নেই যে? আর মাত্র ঘন্টা তিনেক সময় বাকি যে ফ্লাইট ধরার জন্য।
ত্রস্তভাবে ভদ্রলোককে ফোন করতেই দেখলাম সেটা বন্ধ। ‘চিন্তা কোরো না জয়ন্ত, উনি ঠিক চলে আসবেন-’ কর্নেলের বরাভয়েও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি না।
‘আমাদের গাড়ি এসে গেছে-’ আনা বিপন্ন হয়ে ঘড়ি দেখে, কর্নেল তখনও পিঠে ব্যাগ আর হাতে ট্রলি ব্যাগ নিয়েও ষষ্ঠীকে ‘পাখিপড়া’ করে কুলফির খাওয়া-পরার নিয়মাবলী শিখিয়ে যাচ্ছেন। আমি জানালা দিয়ে মুন্ড বার করে হালদারবাবুকে খুঁজতে থাকি।
নিশ্চয় কোনও কাজে ফেঁসেছেন ভদ্রলোক। অগত্যা ব্যাগগুলোকে একত্রে নিয়ে গাড়িতে ওঠার উদ্যোগ নিই আমরা তিনজন। ওদিকে ল্যাব থেকে কুলফির চেঁচানি শোনা যাচ্ছে রীতিমত। ওর চোখ ফুটেছে, ডানার রেখাও দেখা দিয়েছে, কিন্তু ও কি বুঝতে শিখেছে ওর পালক পিতা ওর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে? কয়েক দিনের জন্য? ওরা বোঝে?
গাড়িতে উঠে বুড়ো ঘুঘু একবার জানলা দিয়ে করুণ ভাবে ষষ্ঠীদার দিকে তাকান। সে মাথা নাড়িয়ে শান্তভাবে বরাভয় দেয়, প্রভু-ভৃত্যের মধ্যে না বলা ভাষায় কথোপকথন হয়।
‘দুগ্গা-দুগ্গা’ ষষ্ঠীদা আমাদের যাত্রার মঙ্গল কামনা করে। গাড়ি নেমে পড়ে পথে। পুজোর সাজে সেজে ওঠা কলকাতা গাড়ির দুপাশ দিয়ে পিছলে যায়। ‘দুগ্গা-দুগ্গা’ ষষ্ঠীদার কথাটা মনে পড়ে গেল, আমিও উচ্চারণ করি দেবীর নাম, তবে নিঃশব্দে।’দশটা মিনিট দেখে নিই-’ আমি এখনও তাকিয়ে আছি বিমানবন্দরের দিকে আসা গাড়িগুলোর দিকে, আনা বারবার ঘড়ি দেখছে। কর্নেল নির্বাক। ‘নাহ, এবার যেতেই হবে-’ আনা ব্যাগ হাতে তুলে নেয়। তার দেখাদেখি আমরাও নিজেদের গছিয়ে দিই নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে।
মনটা বেশ খারাপ। একে তো পুজোর আমেজটাই মাটি হয়ে গেল। তারপর ছোট্ট পাখিটাকেও বেশ কয়েকদিনের জন্য দেখতে পাবো না। সেসব যদিও বা পাশ কাটানো যায় তবুও হালদার মশাইয়ের অনুপস্থিতি একদমই মেনে নেওয়া যায় না। মুখ ভার করে তাই তিনজনে বসেছিলাম জানালার ধারের সিটগুলোতে।
‘ডিটেক্টিভ কে. কে. হালদার রিপোর্টিং স্যার!’একদম মিলিটারি কায়দায় স্যালুট ঠুকে আমাদের সামনে হাজির হালদারমশাই।তার এহেন আলাদিনের জিনের মতো হঠাৎ আবির্ভাবে হতচকিত আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়াই। কর্নেলের বিষণ্ণ মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আনার চোখে শুধু কৌতূহল। ‘যাক এইবার আমাদের টিম সম্পূর্ণ -’ কর্নেল মুচকি হাসেন। আমরা আকাশে উড়ি।
প্রথমে দুবাই, তারপর রোমে বিরতি নিয়ে যখন মাল্টা বিমানবন্দরে পৌঁছলাম, তখন আমাদের হাত থেকে দেড়দিন খরচ হয়ে গেছে। মাটিতে পা দিতেই যেন হাঁটুগুলো টনটন করে উঠলো। হালদারবাবু জোরে জোরে হাওয়ায় পা ছুঁড়লেন। দুহাত ঝাঁকিয়ে তিনি নিজেকে যেন একটা লম্বা দৌড়ের জন্য প্রস্তুত করে নিলেন। আনাকে দেখে বোঝাই গেল এসব তার কাছে জলভাত। হবে নাই বা কেন, যুগোস্লাভিয়ায় জন্ম, সেখান থেকে আমেরিকায় পাড়ি কম বয়সে, কথায় কথায় সে কানাডা, ব্রাজিল কিংবা ইউরোপে দৌড়ঝাঁপ করেই থাকে। কর্নেলের কাছেও ব্যাপারটা সহজ, কারণ তিনি ‘কর্নেল’। আমি আর হালদারবাবু সেদিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে পড়া মানুষ।
‘আচ্ছা, আমাদের এই অনুসন্ধান অভিযানের খরচ খরচা কি তুমিই যোগাচ্ছ নাকি?’ কনভেয়র বেল্টের ধারে ব্যাগের জন্য হাপিত্যেশ করে যখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি ঠিক তক্ষুনি কর্নেল ওনার ধপধপে সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে প্রশ্নটা করে বসলেন।
আনা মুচকি হাসে। ‘আসলে যে সংস্থা ডি আর আই-কে আর্থিক সাহায্য করতে চায় তারাই এসবের খরচা যোগাচ্ছে। আমার স্ট্রাইপেন্ডের পয়সায় এতটা বাড়াবাড়ি সম্ভব হতো না নিশ্চয়। ওমেগা কোম্পানির ডেস্ক থেকে আমায় জানিয়েছে ওদের একজন প্রতিনিধি আমাদের সঙ্গে থাকবেন সারাক্ষণ-’ কথা শেষ করতেই হালদারবাবুর চিক্কুর শোনা যায়, ‘ওই যে আমার লাল ব্যাগটা দেখা গেছে!’ আমরা সবাই মিলে ব্যাগ গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
‘বুয়েনস দিয়াস -’ দুহাত তুলে যে ভদ্রলোক আমাদের দিকে দৌড়ে এলেন তাকে দেখে শুধু আমি নয় হাসি ফুটলো বাকি সবার মুখেও।
রোগা লম্বা মানুষটা সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটেন, মাথার চুল কদমফুলের ছাঁটে প্রায় অদৃশ্য। এদিকে ঠোঁটের ঠিক ওপরে একজোড়া লম্বা খয়েরি গোঁফের রেখা হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে উপরের দিকে উঠে গেছে। চোখদুটো অসাধারণ রকমের চকচকে, হাবভাবে খানিক ইঁদুরের মতো ছটফটানি।
‘এলাইন?’ আনা হাত বাড়িয়ে ধরে। লোকটা করমর্দন শেষ করে চোখ নাচিয়ে বলেন, ‘আমার নামের উচ্চারণ কিন্তু আলাইম-’ তারপর হাত নাড়িয়ে আবার বলেন, ‘অবশ্য এলাইন বলে ডাকলে আমি রাগ করবো না!’
অনেক সময় মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখে আমরা বিভ্রান্ত হই। পরিচয়ের গভীরতা বাড়লে ভ্রম কাটে। দূরের মানুষ খানিক কাছের হয়ে ওঠেন। এলাইনের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। কথার তুফানে আমাদের হাসিয়ে তিনি ব্যস্ত ছিলেন গাড়ি চালাতে। এ দ্বীপদেশের সব রাস্তাঘাট তাঁর নাকি হাতের তালুর মতো চেনা। পঞ্চাশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও এলাইন দস্তুরমত যুবক। এর মধ্যেই নাকি তিনি আঠেরো বার পেশা বদলেছেন, কোনও এক কালে তিনি নাকি আমার মতোই সাংবাদিক ছিলেন। কথাটা শোনামাত্র প্রৌঢ় লোকটা আমার বন্ধু হয়ে উঠলেন অতি সহজেই। তারপর শুরু হল তাঁর সাংবাদিক জীবনের অজস্র হাস্যকর গল্পের ফুলঝুরি। আমি, আনা আর হালদার মশাই হাসির ফোয়ারায় ভাসতে ভাসতে এখানে আসার প্রকৃত কারণটা বোধহয় ভুলতে চলেছিলাম। তার ওপরে পথের ফাঁকে ফাঁকে জেগে ওঠা নীল সমুদ্রের ছায়াছবি দেখেও চিত্ত বিকল হবার জোগাড়। যেখানে সমুদ্র দেখতে পাচ্ছি না সেখানে উজ্জ্বল নীল আকাশ। সমুদ্রে যেমন সাদা ঢেউ তেমনি আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। মাঝে মাঝে তো বুঝতেই পারছিলাম না কোনটা আকাশ আর কোনটা সমুদ্র।
পথের একদিকে যদি সমুদ্র থাকে অন্যদিকে তখন ছোট ছোট বাজার, ঘরবাড়ি, হোটেল রেস্তোঁরা। কর্নেলের নজর সেদিকেই নিবদ্ধ বেশির ভাগ সময়ে, যদিও একটা মুচকি হাসি দাঁড়িগোফের ফাঁকে উঁকি মারছে বিলক্ষণ। সেটা বোধহয় আমাদের রসিক গাইডের বদান্যতায়। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি, বুড়ো তাহলে শেষ অব্দি কুলফির বিরহ বেদনা ভুলেছেন।
‘সমুদ্র অনেক দেখেছি মশাই, কিন্তু এরকম রূপ কোত্থাও নেই-’ হালদারমশায় জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে যেন বিশুদ্ধ ভেজা বাতাস নিজের ফুসফুসে জমিয়ে নিতে চাইছিলেন।
‘ভূমধ্যসাগরের কথা আলাদা হালদার মশাই, এই অঞ্চলটার চারপাশে কতগুলো সভ্যতা গড়ে উঠেছে বলুন তো- ‘এই প্রথম কর্নেল মুখ খুললেন।
‘একদিকে গ্রিক অন্যদিকে ফিনিসিয়ানরা নিজেদের মেলে ধরেছিলো এর চারপাশে, ভাবলেই অবাক লাগে-’ আনা স্বগতোক্তি করে।
‘মারামারি আর রক্তারক্তিও কিছু কম হয়নি বটে, ‘এলাইন নিজের মতামত জানায় ছোট্ট একটা টিপ্পনি সহকারে, ‘আর যাই হোক, আমরা মানুষ তো, রক্তের দোষ আর যাবে কোথায়!’
এবার হাসি পেলো না। ঠাট্টাটা কেমন যেন সত্যি কথা হয়ে গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ ফেলে গেল।
এলাইন বেশিক্ষণ গম্ভীর থাকতে পারে না বলেই বোধহয় নাটকীয়ভাবে সে ঘোষণা করে, ‘এই যে, এসে গেছে আমাদের হোটেল-’
হোটেলের নাম ভিক্টোরিয়া প্যালেস।
৭
ঘুরতে ঘুরতে
‘এর নাম প্যালেস?’ হালদার মশাই বলেই ফেলেন।
কথাটা সত্যি বটে। সাদা বালি পাথরের তৈরী দোতলা বাড়ি। সাজানো ছোট্ট রিসেপশনেই ঠিক সামনেই ডাইনিং রুম। সেটার পাশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দুই সারি থাকার ঘর। সবকিছুই নিখুঁত পরিচ্ছন্নতায় পরিপাটি সাজানো। একটাই অসুবিধে যদিও, রাস্তাঘাটের মতোই হোটেলও জনশূন্যপ্রায়। তবে বারান্দায় দাঁড়ালেই মন ভালো করা সমুদ্দুর। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আরো চমক, জানলার ওপাশেও নীল সমুদ্রের শান্ত উপস্থিতি। জানালার পাল্লা খুলতেই একরাশ ভিজে ঠান্ডা হাওয়া ঘরটাকে যেন এলেমেলো করে দিতে চায়। অনেকক্ষণ হয়তো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম কিন্তু হাতে আর মাত্র আধঘন্টা বাকি, তারপরেই দিনের আলো থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়তে হবে ‘পর্যটনে’ ।
খাওয়াদাওয়া সেরে আবার আমরা এলেইনের হাতে নিজেদের সপেঁ দিই। তিনি আমাদের নিয়ে গল্পের মায়াজাল বুনতে বসেছেন। গাড়ি হুড়মুড়িয়ে ছুটতে থাকে গন্তব্যের দিকে। ভালেত্তা, মারসখ্যালাক দেখে পৌঁছলাম মদিনা। চারদিকে ভিনটেজ বাড়ির ছড়াছড়ি। জনশূন্য পথঘাটে মাঝেমধ্যেই নজরে পড়ছে বিশাল দেওয়াল জুড়ে রঙিন ছবি। শিল্পীরা মনের আনন্দে সাজিয়েছেন পথের দুধার। কোথাও বাড়ির সামনে রাখা সাদা লাল স্কুটার, কোথাও কারোর বাড়ির সামনে ঝুলছে শিকল দিয়ে ঝোলানো ঘন্টা, কোথাও বা ফাঁকা রেস্তোরাঁর সামনে পড়ে রয়েছে শূন্য চেয়ার টেবিলের সারি। কোথাও এক ঝাঁক পায়রা আমাদের পায়ের শব্দে চমকে উঠে ডানা ঝাপ্টে উঠছে উত্তেজিত হয়ে।
‘‘সমুদ্রের আতংক’ খুব ক্ষতি করেছে এদের-’ এলেইন বিড়বিড় করে বলে ওঠেন, ‘অবশ্য এমনিতেও আমি লোকের ভিড়ভাড় বেশি একটা পছন্দ করি না।’ মুখ কুঁচকে তিনি আমাদের জানিয়ে দেন তাঁর পছন্দ অপছন্দের কথা। আমাদের ক্যামেরা ঝলকে ওঠে মুহুর্মুহু।
মারসখ্যালাকে পা দিয়ে আনন্দে শিস দিয়ে উঠলাম আমি। একটা উঁচু ঢিবির ওপরে উঠে দাঁড়াতেই ছোট্ট একফালি নীল উপসাগর চোখের সামনে ফুটে উঠলো। শান্ত ঢেউয়ে কেমন এলেমেলো দুলছে সেখানে ভাসমান মাছধরার বোটগুলো। ‘কাল একটায় চাপতেই হবে-’ হালদার মশায় শিশুর মতো আবদার করে ওঠেন।
‘সেটা হচ্ছে না,’ আমাদের পথপ্রদর্শক মাথা নাড়ে সেই সঙ্গে লম্বা তর্জনীর নেতিবাচক ইশারা, ‘সমুদ্রে পর্যটকদের নিয়ে যাবার অনুমতি পাওয়া যাবে না মশায়।’
আমাদের আশার বেলুন চুপসে যায়। কর্নেল মৃদু স্বরে বলে ওঠেন, ‘জায়গাটা স্বর্গের মতো সুন্দর বটে, তবে কিনা আমাদের আসল উদ্দেশ্য ভুললে চলবে না জয়ন্ত-’
এরপর আর কোনও কথা চলে?
‘বুঝলেন না, সেবার হল কি,’ এলেইন গাড়ি চালাতে চালাতে গল্প শোনাতে মশগুল, ‘প্রেসিডেন্ট বুশ পোটোম্যাক নদীর দিকে পায়ে হেঁটে ঘুরতে গেছেন। সেটা দেখে একজন সংবাদিক লিখলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পায়ে হেঁটে নদী পার হলেন’ অন্য একজন লিখলেন, প্রেসিডেন্টের বুদ্ধিতে করদাতাদের নৌকাভাড়ার খরচ বাঁচলো, আরেকজন কী লিখলো বলুন তো?’
আমরা দুদিকে মুন্ড নাড়াই, এলেইন দেরি না করে তার চুটকি শেষ করে, ‘সে লিখলো, বুশ সাঁতার কাটতে পারেন না-’
আমরা সবাই হেসে উঠি। আমি বোধহয় একটু বেশিই হাসছিলাম, সাংবাদিকরা যে খানিকটা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন সেটা আমার থেকে ভালো কে আর জানে।
‘এলেইন, দাঁড়াও-’ কর্নেলের ঝটিতি চিৎকারে এলেইন আচমকা ব্রেক কষেন। বুড়ো ঘুঘু ততক্ষণে দরজা খুলে দৌড় মেরেছেন পাশের সবুজ মাঠের দিকে। কিছু বোঝার আগে আবিষ্কার করলাম তার পিছুপিছু ছুটে চলেছে আনা। তাদের দুজনের হাতেই বাইনোকুলার। আমি আর হালদারমশাই একে অপরের দিকে তাকাই বেকুবের মতো, এলেইন আমাদের দিকে তাকিয়ে নির্বাক প্রশ্ন ছোঁড়েন।
‘প্রকৃতিবিদ তো-’ আমি কাঁধ ঝাঁকাই, আমাদের পথপ্রদর্শক হেসে ওঠে।
‘উফ, ভাবতেই পারিনি এভাবে দেখতে পাবো পাখিটাকে,’ কর্নেল ফিরলেন অবশেষে, তাঁর সঙ্গে আনাও।
‘বুঝলে জয়ন্ত, এখানে যে কোনওদিন আলেন্স গলিনিউয়েলের দেখা পাবো ভাবতেই পারিনি – ‘ গাড়িতে উঠে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন কর্নেল।
‘প্রচন্ড রকমের দুর্লভ পাখি ওরা। কি সৌন্দর্য!’ এবার আনার সঙ্গত।
‘গাড়ি স্টার্ট করি?’ এলাইনের প্রশ্ন। কর্নেলের অনুমতি পেতেই গাড়ি ছোটে, এদিকে বুড়ো ঘুঘু আর আনার মধ্যে পাখি নিয়ে কলকাকলি যেন আর থামতেই চায় না।
‘এটা পুরুষ ছিল, তাই না?’ আনা প্রশ্ন করে। কর্নেল উত্তেজিত হয়ে মাথা নাড়েন, ‘বিলক্ষণ, ঐটুকু সময়ের মধ্যে মাথার সামনের দিকে নীল টিকাটা আমি দেখতে ভুলিনি- ‘
আনাও নাছোড়বান্দা, ‘শুনেছি, সাহারার আশেপাশেও ওদের দেখা পাওয়া যায়। খুব লাজুক পাখি তো, ওদের ডাক শোনা গেলেও চর্মচক্ষে দেখতে পাওয়া নেহাতই ভাগ্যের ব্যাপার- ‘
দুই জ্ঞানীর মধ্যে বাক্যালাপ চলতেই থাকে অনর্গল। আমি আর হালদারবাবু বিরস মুখে জানলার কাচে উত্তেজনা খুঁজি।
৮
অনুসন্ধান
দ্বীপের দেশে রাত নেমেছে। দক্ষিণ দিক থেকে সামুদ্রিক হাওয়া আমাদের বসার ঘরে হুড়মুড়িয়ে বয়ে চলেছে। লাঞ্চে আমি মোটা রুটি দিয়ে ভেড়ার মাংসের ঝাল খেয়েছিলাম, সেই সঙ্গে প্রায় জোর করেই আঞ্চলিক ‘লামপুনিক পাই’ খেয়েছিলাম। ইংরেজি খবরের কাগজটা পড়তে পড়তে বেশ টের পাচ্ছিলাম পেটের মধ্যেটা কেমন যেন গোলাচ্ছে। হালদার মশাইও বেশ মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়তে ব্যস্ত। এইলেন আমাদের ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছেন অনেকক্ষণ। কর্নেলও ‘একটু আসছি’ বলে বেরিয়েছেন কিছুক্ষণ হল।
‘আপনারা বেরোবেন নাকি একটু?’ আনার প্রশ্নটা খাবার টেবিল বসা আমাদের দুজনকেই তবে চোখটা আমার ওপরে নিবদ্ধ।
‘নিশ্চয়-’ আমি লাফিয়ে উঠি। পাশ থেকে খবরের কাগজের আড়ালে হালদারবাবুর খুকখুক কাশিটা আমার কান এড়ায় না। কাশি ছিল নাকি হাসি?
‘পায়ে হেঁটেই একবার ওদিকটা ঢুঁ মেরে আসি, চলুন-’ আনা হাসিমুখে দাবি জানায়, আমিও অগত্যা সঙ্গী হই তার।
‘কর্নেল এলে ওনাকে বলবেন আমরা একটু বেরিয়েছি, আমি হালদারবাবুর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলি।
‘তুমি পেট খারাপের ওষুধটা সঙ্গে নিয়েছো তো? বলা যায় না কখন কি হয়-’ উত্তরে তাঁর বেয়াড়া ঠাট্টা। চোখ কটমটিয়ে তাকে চুপ করার অনুরোধ জানিয়ে আমরা হাঁটা লাগাই ‘ওদিকটায়’।
অলস আলাপে সময় কাটছিলো বেশ। য়ুগোস্লাভিয়া থেকে কিভাবে সে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিল, কিভাবে দোকানে কাজ করে পড়াশোনা চালিয়ে সে ডিগ্রি জোগাড় করেছিল, এসব নিয়েই কথা চলছিল বেশির ভাগ। আমি কি করি, কিভাবে কর্নেলের সঙ্গে আলাপ, সেসব নিয়েও কিছু খুচরো আলোচনা চালাতে চালাতে অনেকগুলো গলিপথ পেরিয়ে আমরা এসে পড়েছিলাম আলদো মোরোর রাস্তায়। একটা দোকানে ঢুকে আনা একখানা টুপি কিনে আমার হাতে তুলে দিলো, ‘একটা ছোট্ট উপহার-’ হাসিমুখে আনা বলে ওঠে। লজ্জায় মাটিতে মিশে উপহার হাতে নিই।
‘এইবার চলো আইসক্রিম খাই-’ দাবি মানতে আবার তাকে অনুসরণ করি। ‘আইসক্রিম খাবে তো?’ প্রশ্নটা শুনে অজান্তে পেটে হাত বোলাই একবার, আনা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই দুটো আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে বসলো। অগত্যা আইসক্রিমের স্বাদে গন্ধে ডুবতে ডুবতে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম বালিয়াড়ির ধারে। এদিকে হাওয়ার উথালিপাথালিতে আমি দিশেহারা। সমুদ্রের গজরানি কানে আসছে এতদূর থেকেও, মনটা কেমন যেন উড়ু উড়ু হতে চায় এসব মুহূর্তে।
‘ভাবা যায়, এসব পথে একসময় সার বেঁধে গ্রিকদের নৌকো ভাসতো? সাদা পালতোলা নৌকো নিয়ে ভাসতো রোমানরাও। ওদিকে প্রাচ্য থেকে আসতো ব্যবসায়ীরা-’ আনা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নালু চোখে বলে।
আমি আমার সীমিত জ্ঞান এবং তার থেকেও কম কল্পনাশক্তিকে হাতিয়ার করে বহুযুগ আগের ওই পালতোলা জাহাজগুলোকে মনের খাতায় আঁকার চেষ্টা করছিলাম। মনোযোগ বাড়াতে চোখদুটোকে বন্ধ করেছিলাম বোধহয়।
‘ডার্লিং, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’
প্রশ্নটা শুনেই চমকে উঠে পিছন ঘুরি, কর্নেল কখন চুপিসাড়ে আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি।
‘না, মানে…ইয়ে ..একটু ভাবছিলাম…’ আমি দুহাত তুলে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হতেই কর্নেল হাসেন, ‘তুমি ভাবছিলে? এটা তো খবরের কাগজে বের হওয়া উচিত-’
আনার হাসির শব্দে দু একজন পথচারী চমকে উঠে আমাদের দিকে তাকায়। আমি মনে মনে ধরণীকে দ্বিধা হবার জন্য অনুরোধ করি।
‘ওল্ড ম্যান, এত রাতে কোথায় গেছিলেন বলুন তো?’ আমি কর্নেলকে প্রশ্ন করতেই ঠোঁটের কোণে হাসিটা ফিরে এলো বুড়ো ঘুঘুর। বেশ নাটকীয়ভাবে বললেন, ‘কেউ যদি আত্মগোপন করে থাকেন তাহলে তাঁকে খোঁজার সব থেকে ভালো জায়গা কি বলতো?’
আনা এবং আমি পরস্পরের দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে মাথা নাড়াই নেতিবাচকভাবে।
‘দেখো জয়ন্ত তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তোমাকে খাওয়া দাওয়ার মতো দরকারি কাজগুলো করতেই হবে কিন্তু, তাই না?’
‘ঠিক তাই-’
‘সেই জন্যই খোঁজ লাগাতে গেছিলাম নিকটস্থ বাজারে-’ কর্নেল বলে চলেন আমরা তাঁর কথা শুনতে শুনতে তাঁকে অনুসরণ করি, ‘ওখানে সব্বাইকে হার্লানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনও যথাযথ উত্তর পাওয়া গেলো না। শেষে বাধ্য হয়ে ঢুঁ মারলাম এখানকার সব থেকে বড় কনভেনিয়েন্স স্টোরে, একটু আলাপ পরিচয় করার পর কাউন্টারের ছেলেটাকে হার্লানের ছবি দেখালাম,’ কর্নেল থামেন। চুরুটের ডগায় আগুন ধরিয়ে আরামের টান দেন।
‘কিছু বললো লোকটা?’ আনা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে ওঠে।
‘না, সে কিছু দেখেনি। তবে কিনা-’ আবার চুরুটে একটা লম্বা এবং বিরক্তিকর টান দিয়ে বুড়ো অনুসন্ধানের গল্প জারি রাখেন, ‘এক ভদ্রলোক আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন মনোযোগ দিয়ে। একসময় প্রায় থাকতে না পেরেই গায়ে পড়া হাবভাব নিয়ে আলাপ করলেন এবং ছবিটি দেখার অনুমতি চাইলেন। অনেকক্ষণ দেখে এবং আরও অনেকখানি ভেবে শেষে আমাকে বললেন যে এরকম দেখতে একজনকে তিনি দেখেছেন এখানকার মিউজিক স্টোরে। সেটাও প্রায় মাস ছয়েক আগে। তারপর এও বললেন যে হয়তো ভদ্রলোককে তিনি ভুলে যেতে পারতেন এতদিনে কিন্তু অজান্তে ধাক্কা লেগে যাওয়ায় হার্লান নাকি ওর দিকে তাকিয়েছিলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য। সেটা ওর এখনও মনে আছে। তার দাবি ওরকম ঠান্ডা এবং প্রাণহীন চাহনি নাকি তিনি জীবনে আর কখনো দেখেননি।’
‘ধুস, গপ্প ছাড়ছে লোকটা-’ আমি হাত নাড়িয়ে কর্নেলের দাবি উড়িয়ে দিই।
‘আমিও তাই ভাবতাম হয়তো,’ কর্নেল মুচকি হাসেন, ‘কিন্তু, ভদ্রলোক তারপরেই বললেন যে লোকটার জামা কাপড়ও নাকি দেখবার মতো ছিল। চারিদিকের রঙিন ফুরফুরে মেজাজে উড়ে বেড়ানো পর্যটকদের সঙ্গে নাকি তার কালো কোট আর কালো টাইখানা নাকি একদম খাপ খাচ্ছিল না। সেই সঙ্গে একটা পারফিউমের সূক্ষ সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল বাতাসে।’
‘এতো পুরো সিনেমার নায়ক!’ আমি না বলে পারি না।
‘ভদ্রলোকও ঠিক সেই কথা বলেছিলেন,’ এবার তিনি তাকান আনার দিকে, সে মাথা নাড়ে।
‘কিন্তু পারফিউম? এখানে তো মোটামুটি যে কজনকে রাস্তায় দেখলাম সব্বাই পারফিউম মাখে মনে হয়-’ আমি তবুও মানতে নারাজ।
‘এ যে সে পারফিউম নয়, হার্লান আমাদের মতো ‘রেগুলার জো’ নয় জয়ন্ত,’ কর্নেল হাসেন।
আনা কর্নেলের বাক্যটাকে শেষ করে, ‘ফ্রান্স, ইতালি কিম্বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে দামি এবং দুষ্প্রাপ্য পারফিউম কিনে ব্যবহার করতো হার্লান। সেই সঙ্গে ছিল মিউজিক নিয়ে অসম্ভব আগ্রহ।’
কর্নেল হাসেন, ‘আনা ঠিক দিকেই যাচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন এখানকার সবথেকে পুরানো গ্রামাফোন রেকর্ড বেচে যে দোকান সেখানে ওর বন্ধু কাজ করেন। তার সঙ্গে আড্ডা মেরে বেরোতে গিয়েই হার্লানের সঙ্গে ধাক্কা লাগে ভদ্রলোকের। তিনি বন্ধুর কাছে শুনেছিলেন যে হার্লান কচ্চিৎ কদাচিৎ সে দোকানে ঢুঁ মারে একদম পুরানো রেকর্ডের খোঁজে-’
‘হার্লান! এ হার্লান এলিসন না হয়েই যায় না-’ আনার চোখদুটো জ্বলে ওঠে, ‘চলুন কর্নেল, এক্ষুণি মিউজিক স্টোরে যাই।’
কর্নেল দুহাত তুলে তাকে নিরস্ত করেন, ‘উঁহু, দশটায় দোকান বন্ধ হয়ে যায়। এখন বাজে বারোটা। কাল সকালে ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে তবেই দোকানে হানা দেওয়া যাবে।’
অগত্যা আমরা ‘প্যালেসের’ দিকে রওনা হই। এদিকে আমার ফোনে টুং করে শব্দ হতেই দেখলাম হোয়াটস অ্যাপে হালদার মশাইয়ের রাগী মেসেজ, ‘কোথায়?’ তার পাশে দুটো লাল ইমোটিকন।
‘কর্নেল, হালদারবাবুকে একা ফেলে এসেছি, ভদ্রলোক রেগে খাপ্পা-’
‘ভুল তোমার ডার্লিং, তোমরা সব্বাই ঘুরতে বেরোবে আর ওনাকে হোটেলে একা ফেলে রাখবে সেটা তো ভালো দেখায় না, তাই না?’ কর্নেলের মুখে রাগ আর ঠাট্টার আলোআঁধারি।
‘ইয়ে…মানে… আমি আসলে-’ কথা খুঁজতে নাকাল হয়ে পড়ি আমি।
‘ইয়ে…মানে… আসলে… তুমি কোনও ভুল কাজ করোনি।’ এবার বুড়ো আমার দিকে একচোখ বন্ধ করে মুচকি হাসেন। আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাই।
‘ওই তো ভদ্রলোক…’ আনা হাত তুলে হালদারবাবুর পায়চারি করা মূর্তিটাকে দেখান।
‘ওহ, সেই কখন থেকে-’ হালদারবাবুকে থামিয়ে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার গম্ভীরভাবে বলে উঠলেন, ‘এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়লে কাল সকাল সকাল উঠে পড়তে পারবেন, উঠতে না পারলে কিন্তু একটা বড় সূত্র হাতছাড়া হয়ে যাবে আপনার।’
আমিও গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ি, হালদারবাবু দ্রুত সিঁড়ি ধরে উপরতলায় হারিয়ে যান।
কর্নেল হাসেন, ‘নাও জয়ন্ত, তুমি আর বকা খেলে না,’ তারপর চোখ কটমটিয়ে বললেন, ‘কাল সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে কিন্তু তোমাকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাবে না, বুঝলে?’
‘গুডনাইট-’ আনা আর কর্নেলকে বিদায় জানিয়ে আমিও শান্ত ছেলের মতো নিজের কামরার দিকে পা বাড়াই।
ভূমধ্যসাগরের বুকে একটা সুন্দর রাত নেমে আসে।
৯
দ্য বেসমেন্ট
গাড়ি চলছে। চলছে না বলে উড়ছে বলা ভালো। এলাইন আজ শান্ত, কেন কে জানে। নির্বাক মোটামুটি সকলেই।হার্লান এলিসনের ছবির একটা করে কপি আনা আমাদের সবাইকে দিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে। আমি সেই থেকে ভদ্রলোকের ছবিখানা দেখেই যাচ্ছি। কালো সানগ্লাসে ঢাকা চোখের উপরে এসে পড়ছে লম্বা লম্বা একগোছা খয়েরি চুলের রাশি। ধারালো মুখের মধ্যে ঘৃণা আর বিষণ্ণতা মেশানো আশ্চর্য শীতলতা। জ্ঞান নয়, তীব্র ব্যক্তিত্বের ছটাই হার্লানের পরিচয়।
‘ভদ্রলোকের নাম রামগরুড়ের ছানা দেওয়া উচিত-’ হালদারবাবু আমার কানের কাছে ফিসফিস করেন। হাসতে গিয়েও হাসতে পারি না। জানতে ইচ্ছে করে বিজ্ঞানীকে হাসিমুখে কেমন দেখায়? আনা স্বগতোক্তি করে, ‘টোনি বরাবরই একটু বেশি অন্তর্মুখী- ‘
‘টোনি?’ আমি প্রশ্ন করি। কর্নেল উত্তর দেন, ‘বন্ধুমহলে হার্লান টোনি নামেই বেশি পরিচিত ছিল-’
এলেইন গাড়ি থামান, একজন বেঁটেখাটো টাকমাথা যুবক হাসিমুখে আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে হাত নাড়াচ্ছে।
‘সুপ্রভাত, আমার নাম পেদ্রো-’ লোকটা আমাদের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে নিজের পরিচয় দেয়, হাতের তালু ঘুরিয়ে পিছনের দিকে ইঙ্গিত করে একটি অতি পুরাতন দোকানের দিকে, ‘আমার বন্ধুর মিউজিক স্টোর-’
আমরা দল বেঁধে সেদিকে এগোই, দোকানের মালিক রীতিমত সমাদরে আমাদের অভ্যর্থনা জানায়।
পেদ্রো বন্ধুকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘এর নাম অলিভার-’ তারপর শুরু হয় তার দোকানের গুণগান, ‘হেন কোনও গ্রামাফোন রেকর্ড নেই যা অলিভারের কাছে পাওয়া যায় না, বুঝলেন? তিনখানা দ্বীপে বেসমেন্ট বিখ্যাত শুধু দুষ্প্রাপ্য পুরানো রেকর্ডের জন্য!’ রোগাভোগা চালাকচতুর অলিভার কান এঁটো করা গর্বিত হাসি দিয়ে বন্ধুর প্রশংসা উপভোগ করে।
বলতে ভুলে গেছিলাম, রাস্তার ওপরে দাঁড় করানো সুন্দর অভিজাত দোকানটার নাম ‘দ্য বেসমেন্ট’।
আমি চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাই, আনা উচ্ছল হাসি নিয়ে ছুটে যায় একটা স্ট্যান্ডের দিকে, সার বেঁধে পুরানো রেকর্ড রাখা আছে সেখানে। একটা প্লাকার্ডের গায়ে নাম লেখা রয়েছে সংগ্রহের, ‘ব্রোকেন মেমোরিস’। আমিও তার পিছু নিই। একটা রেকর্ডের গায়ে আঙ্গুল বুলিয়ে সে হাসে। আমি নামটা টুক করে দেখে নিই। আনা যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলে, ‘আমার মায়ের খুব পছন্দ ছিল-’ ।
‘কি নাম বললেন? হার্লান?’ অলিভারের মাথা নড়ে দুদিকে, ‘এ নাম তো শুনিনি আগে-’
কর্নেল ছবি বার করে তার মুখের সামনে ধরেন, এবার দোকানের মালিক মাথা নাড়ে ওপর নিচে, ‘ভদ্রলোককে আমি চিনি, আমার নিয়মিত খদ্দের। তবে নামটা রেজিস্টার দেখে বলতে হবে-’ সে একটা পুরানো ছেঁড়া খাতা টেনে নামায় দেয়াল আলমারি থেকে। হ্যাঁ, খাতা, বুঝলাম মাল্টা এখনও কাজকর্মের ব্যাপারে পুরাতনী পথের পথিক। একটা নামের নিচে আঙ্গুল বুলিয়ে সে বলে ওঠে, ‘প্যাট্রিক রিভেরা-’ আমরা একে অপরের দিকে তাকাই। ‘হুম্ম, নাম ভাড়িয়েছেন ভদ্রলোক!’ হালদার মশাই ভ্রূ কুঁচকে বলেন। কর্নেল গভীর চিন্তায় ডুবে যান। আনা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, ‘প্যাট্রিক রিভেরা, নামটা চেনা চেনা ঠেকছে-’ তারপর অবশ্য হাল ছেড়ে দেয়, ‘নামটা অবশ্য বহু ব্যবহৃত।’ আমরা আশাহত হয়ে পড়ি।
‘আচ্ছা, ভদ্রলোক কদ্দিন পর পর আসেন এখানে? কোথায় থাকেন প্যাট্রিক, আপনি জানেন?’ কর্নেল অলিভারকে প্রশ্ন করেন।
‘কোথায় থাকেন জানি না, তবে প্রায় মাস ছয়েক পর পর একবার আসেন। এ পর্যন্ত বার চারেক এসেছেন। ভদ্রলোকের পুরানো মিউজিক নিয়ে জ্ঞান চমকে দেবার মতো।’ অলিভার দামি খদ্দেরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।
‘প্রথম কবে এসেছিলেন? আর শেষ কবেই বা এসেছিলেন?’ কর্নেল আবার জিজ্ঞাসা করেন।
‘অক্টোবর, ২০১৪ প্রথমবার। শেষবার এসেছেন ডিসেম্বর, ২০১৭-’ অনেক দেখেশুনে অলিভার বলে।
‘যদি ভদ্রলোককে এবার দেখতে পান তাহলে আমাদের এই নম্বরে একটু ফোন করতে পারবেন?’ কর্নেল কাগজে হোটেলের ফোন নম্বর লিখে লোকটার হাতে গুঁজে দেন।
‘দুঃখিত, কিন্তু কেন বলুন তো?’ অলিভার অবিশ্বাসী চোখে আমাদের মুখের দিকে বারবার দৃষ্টি বোলায়। কিছু বলার আগেই এলাইন এগিয়ে আসে, নিজের গগনচুম্বী গোঁফের প্রান্তদুটোকে মুচড়ে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘ভদ্রলোক ভয়ানক অপরাধী, ইন্টারপোল ওঁর মাথার ওপর পুরস্কার ধার্য করেছে। ওকে জিনিস বেচার অভিযোগে তুমি কিন্তু দোকানের লাইসেন্স হারাতে পারো-’
‘আমি প্যাট্রিককে দেখতে পেলেই আপনাদের ফোন করে জানাবো-’ অলিভার এবার বাধ্য ছেলে।
ফেরার পথে গাড়ি জুড়ে আমাদের হাসির হল্লা আর থামে না। নিপাট নিরীহ বিজ্ঞানী এখন আপাতত কুখ্যাত অপরাধী। এলাইন কিন্তু এর আগেই ঘাড় নাচিয়ে আনার কাছে দুঃখ জানিয়েছে, ‘যস্মিন দেশে যদাচার-’ গোছের একটা আপ্তবাক্য ঝেড়ে নিজের পক্ষে সওয়ালও করেছে। আনা যদিও মুখ গোমড়া করে রাগ দেখিয়েছে।
কর্নেলও হাসছেন না। তাঁর দৃষ্টি জানালার দিকে। বুড়ো ঘুঘুর নজরে এমন কিছু এসেছে কি যা আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে? কে জানে!
১০
মাল্টা উল্টোপাল্টা
বার্নিশ করা মেহগনি কাঠের খাবার টেবিল। তার চারদিকে কয়েকটা ছড়ানো ছেটানো চেয়ার। কর্নেল সেখানে বসে মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমি পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন ছুঁড়লাম, ‘ওল্ড ম্যান, এইবার কী কর্তব্য?’ চশমার কাচের মধ্যে দিয়ে বুড়োর গম্ভীর সন্ধানী দৃষ্টি আমার মুখের ওপর এসে পড়লো। যেন ধ্যান ভঙ্গ করে উঠলেন তিনি কিংবা শীতঘুম সেরে এইমাত্র জেগে উঠলেন। কাগজখানা গুছিয়ে আমাকেই প্রশ্ন করলেন, ‘তুমিই বোলো দেখি এবার আমাদের কী করা উচিত?’ আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক ওদিক তাকাই।
‘ঘুঘু নিজেই জাল ফেলেছে-’
কথাটা বলেই হালদার মশাই মাথা নিচু করে প্রাতরাশ গিলতে থাকেন। আনা হাসি চেপে অন্যদিকে তাকায়। আমি দ্রুত নিজেকে বুদ্ধিমান প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় নেমে পড়ি।
‘এখন আমরা অপেক্ষা করতে পারি অলিভারের ফোনের জন্য, অথবা ওর দোকানের ওপর নজর রাখতে পারি।’
‘তার মানে আমরা একটা বিদেশী দ্বীপে এসে বছরের পর বছর বসে থাকবো কবে হার্লান এসে আমাদের হাতে ধরা দেবে, তাই না?’
কর্নেলের প্রশ্নে আমি কুপোকাৎ।
বুড়ো দাড়ি চুলকান, ‘মনে রেখ জয়ন্ত, আমাদের হাতে আছে আর মাত্র আট দিন, এর মধ্যে ওঁকে খুঁজে না পেলে খালি হাতেই আমাদের দেশে ফিরতে হবে কিন্তু। সুতরাং শুধু অলিভারের খবরের ভিত্তিতে বসে থাকলে চলবে না-’
‘প্যাট্রিক রিভেরা,’ আনা হঠাৎ আমাদের সবাইকে থামিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হার্লানের সৎ ভাইয়ের নাম-’
কর্নেলের চোখ দুটো স্থির হয়ে যায় আনার দিকে। ‘ঠিক বলছো?’ তিনি প্রশ্ন করেন, আনা মাথা নাড়ে।
‘ভাইকে খুব ভালোবাসতেন টোনি, খুব ছোটবেলাতেই তাঁকে হারিয়েছিলেন উনি-’ আনা স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বলে ওঠে।
‘তাহলে নিশ্চিত হওয়া গেল, এই ভদ্রলোক হার্লানই বটে-’ আমি স্বগতোক্তি করি, হালদার মশাই মাথা নাড়েন।
‘কিন্তু তারপর?’ কর্নেল যেন নিজেকেই প্রশ্ন করেন। আমরাও মনে মনে উত্তর হাতড়াতে থাকি।
‘তারপর- ‘মেডিনা-’’ এলাইন চিক্কুর ছেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসেন। আমরাও হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়ি।
উঁচু প্রাচীরে ঘেরা একখানা গ্রাম, নাম মেডিনা। বলা যায় দুর্গের মতো সুরক্ষিত। সংকীর্ণ গলিপথ চারদিকে। ঘুরে দেখতে অবশ্য ঘন্টাখানেকের বেশি লাগে না।
‘সাইলেন্ট সিটি-’ আমাদের পথপ্রদশর্ক হাত নাড়িয়ে নাটকীয় ভাবে বলেন, ‘মেডিনার আরেক নাম, বুঝলে?’
‘সে তো দেখেই মালুম হচ্ছে,’ হালদারমশাই বিড়বিড় করেন। এলেইন ব্যাখ্যা করে, ‘প্রায় চার হাজার বছর আগে এই শহরের প্রতিষ্ঠা হয়, সাদা মার্বেল পাথরে মোড়া একটার পর একটা বিশাল প্রাসাদ তৈরী হয় গোটা শহর জুড়ে। একসময় এটাই মাল্টার রাজধানী ছিল, পরে যখন মাল্টার নাইটরা মেডিনা থেকে ভালেত্তা শহরে রাজধানীকে সরিয়ে নেয়, এই শহরটা সম্পূর্ণভাবে যেন জনশূন্য হয়ে পড়ে। সেই থেকে এটা একটা পরিত্যক্ত জনপদ, সব মিলিয়ে বোধহয় শ’তিনেক লোকের বাস এখানে- ‘
কর্নেল একটা সাইনবোর্ড দেখিয়ে আমাকে বলেন, ‘দেখ জয়ন্ত, এখনও এখানকার মানুষ কিরকম নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন-’
আমি একটা বাড়ির দেওয়ালে ঠোঁটে আঙ্গুল দেওয়া ছবি দেখি, নিচে লেখা, ‘সাইলেন্স প্লিজ-’
‘সত্যি, এখানকার মানুষ রীতিমত নৈঃশব্দ প্রেমী, খুব কম গাড়ি বা মানুষকে এশহরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়-’ এলাইন জ্ঞান জাহির করেন।
শহরটাকে দেখে আশ্চর্যরকম একটা শিহরণ জাগছিল শরীরে। এতো পুরানো সুসজ্জিত জনপদ কি আশ্চর্য অভিমান নিয়ে নির্বাক হয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
‘চলো এবার ফেরা যাক,’ এলাইন আমাদের তাড়া মারেন। আমি মাথা নাড়ি, এতো তাড়াতাড়ি আমি ‘প্রাসাদে’ ফিরতে নারাজ।
যথারীতি আমাকে ফেরার পথের আতাপাতা দিয়ে এলাইন গাড়ি ঘোরান। আমি শান্ত গলিপথে নিজেকে হারাই।
১১
একলা নয়
মনের সুখে শুধু ক্যামেরা দিয়েই মেডিনাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম তখন। প্রতিটা বাড়ির দরজায় আশ্চর্য সুন্দর কারুকার্য। কোথাও সমুদ্র ঘোড়া, কোথাও ডলফিনের প্রতিকৃতি, কোথাও সিংহের মুখ খোদাই করা আছে দরজার হাতলে। শ্বেত মর্মরের সৌন্দর্যে আমি তখন দিশেহারা। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম জনশূন্য রাজপথে পদশব্দ। ফাঁপা প্রতিধ্বনি আসছে আমার পিছন থেকেই। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে যেটা প্রথমে বুঝলাম সেটা হল মুখের ওপর একটা ঘুসির আছড়ে পড়া। আমি যখন রাস্তায় ছিটকে পড়লাম, সবুজ পুলোভার পরা একজন লম্বা মানুষ তাড়াতাড়ি ছুটে এসে আমার ক্যামেরায় লাথি কষালো। লাল শার্ট পরা একজন বেঁটে ষন্ডামার্কা ছোকরা আমাকে জামার কলার ধরে টেনে তুললো। আমি সেই অবস্থাতেও দেওয়ালে লেগে ভেঙে ছত্রখান হয়ে যাওয়া ক্যামেরাটার দিকে তাকিয়ে আছি। আরেকটা ঘুসি। এবার আবার সবুজ জামা।
‘কি জন্য এসেছো এখানে খোকা?’
চিবিয়ে চিবিয়ে বেঁটে লোকটা প্রশ্ন করলো। কথায় স্প্যানিশ টান। ‘ঘুরতে-’ আমি হাঁফাতে হাঁফাতে উত্তর দিতেই আরেকটা ঘুসি। সত্যি কথা বলতে এটা কানের ওপরে এসে পড়েছে। কি জানি কেন, এবার আমার প্রতিবর্তক্রিয়া কাজ করতে শুরু করলো। আমার হাতের মুঠো সবুজ জামার থুতনিতে লাগতেই লাল জামা আমাকে নিয়ে পড়লো রাস্তায় গড়িয়ে। সেই ফাঁকে আমি ছুট দিলাম।
প্রথমে পাথুরে রাজপথ ধরে, তারপর একটা সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দ শহরের দেওয়ালের ওপর দিয়ে। আমার পিছনে ছুটলো ওরাও। সবুজ জামা পাঁচিলে উঠে পড়েছে, লাল জামা নিচের রাজপথে ছুটছে উর্দ্ধশ্বাসে। ডান দিকে মাথা ঘোরালেই নীল সমুদ্রের সৌন্দর্য, অথচ সেদিকে তাকাবার ফুরসৎ নেই আমার। কতক্ষণ এভাবে ছুটে পালাবো?
‘বে-নি-তো-’ লাল জামা চেঁচিয়ে ডাকে কাউকে। আমি প্রাণপনে দৌড়োতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার উল্টো দিকে পাঁচিলের ওপর উদয় হচ্ছে একজন দৈত্যের চেহারা। আমি বুঝলাম, ফাঁদে পড়েছি।
ধাক্কা এড়াতে আমি লাফ মারলাম ডানদিকে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে। হাঁটু ছড়ে গিয়ে টনটন করে উঠলো গোড়ালিটা। ওদিকে দৈত্যটা লাফিয়ে নেমেছে নিঁখুতভাবে, পিছনে সবুজ জামারও ঝাঁপ মারার শব্দ শুনেছি। পাঁচিলের ওপর থেকে লাল জামাও এতক্ষণে নিচে নামার উদ্যোগ করছে।
ধরা পড়তেই হবে, তবুও সহজে না। এবার ওদের কাটিয়ে ছুটলাম সমুদ্রের ধারের একটা ছোট্ট পাথুরে খাঁজের দিকে। যার পর আর কোথাও যাবার নেই। উঁচু নিচু পাথরের উপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেলাম বেশ কয়েকবার। অবশেষে কেউ একটা ঠেলা মারলো আমার পিঠে, এবড়ো খেবড়ো পাথুরে দেওয়ালের ওপর মুখ থুবড়ে পড়লাম। যদিও শেষ মুহূর্তে হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়েছিলাম, মাথাটা বাঁচলো তাই। তিনজন ষণ্ডা এবার আমাকে ঘিরে ধরলো।
‘তাড়াতাড়ি-’ লাল জামা আকাশের দিকে এক নজর তাকিয়ে সঙ্গীদের সাবধান করে। আকাশের বুকে যেন কেউ কালি ঢেলে দিয়েছে ।
‘কেন এসেছিস এখানে? কি দরকার?’ সবুজ জামা আমার কলার ধরে ঝাঁকায়।
‘ঘুরতে-’ আমি আরেকটা ঘুসির অপেক্ষা করি, কিন্তু তার বদলে দৈত্য, যার নাম কিনা বেনিতো, তার হাতের মুঠো আমার গলার চারপাশে বেড় দিয়ে ওঠে। নিশ্বাস বন্ধ হবার ভয়ে আমি হাঁকপাঁক করে উঠি, আমার শরীর পাথরের দেয়াল বেয়ে উপরের দিকে উঠছে।
‘মিথ্যে কথা,’ সবুজ জামা চিৎকার করে ওঠে, ‘কেন গিয়েছিলি বেসমেন্টে?’ আমি মাথা নাড়ি, ‘ভিন্টেজ রেকর্ড কিনতে-’ আবার ঘুসি। মাথা দেওয়ালে ঠুকে গেছে।
‘টর্নেডো আসছে-’ লালা জামা চিৎকার করে ওঠে। আমি কোনওরকমে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাই। মেঘের আড়ালে বিদ্যুৎ চমক, সেই সঙ্গে বাতাসে ঝড়ের পূর্বাভাস।
দৈত্য এবার আঁতকে ওঠে, ‘শয়তানের দিব্যি-’ তার তর্জনী সমুদ্রের দিকে তুলে ধরা। লাল জামা ঢেউয়ের কাছে ছুটে যায়। দৈত্য চোখের ওপরে হাত রেখে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে। সবুজ জামা আমাকে তবুও ছাড়েনি।
‘পালাও, ওটা আমাদের দিকেই আসছে-’ লাল জামা এবার সঙ্গীদের ছেড়ে পিঠটান দিয়েছে পাঁচিলের দিকে। তার পিছনে দৈত্য। ‘পালাও-’ এরপরের অংশটা এলেমেলো হাওয়ায় হারিয়ে গেল। সবুজ জামার ঘাড়ের পাশ দিয়ে যেটুকু দেখলাম তাতে আমার জ্ঞান হারাবার উপক্রম, নীল জল কেটে একটা ঢেউয়ের তরঙ্গ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। গুণ্ডাটা আমাকে এক ধাক্কায় আছড়ে ফেলল দেয়ালের ওপরে, আগুন জ্বলা চোখে আমাকে ভস্ম করে দিতে দিতে সে গজরালো, ‘দেখ কিভাবে মরণ হয় তোর-’
আমাকে পাথুরে ছোট্ট চাতালে ফেলে রেখে সেও সঙ্গীদের অনুসরণ করে।
আমিও পালাতে চেষ্টা করি। কিন্তু শরীর অবসন্ন। এদিকে ঠিক আমার সমানেই জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ঝড়ের ফল? নাকি-
প্রথমে একখানা লম্বা চোয়াল, তারপর দুটো সবুজ গনগনে চোখ, তারপর একখানা লম্বা খসখসে শরীর এবং সবশেষে দুটো পা জলতরঙ্গ কেটে আমার সামনে এগিয়ে এলো। সামনের পায়ের সঙ্গে যুক্ত ডানা। বাদুড়ের মতো। দুপাশে পনেরো ফুট ছড়িয়ে আছে ডানা দুটো। কাঁপছে থির থির করে। সরীসৃপটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমাগত।
বিহ্বল আমি যেন মন্ত্রের বাঁধনে পড়েছি, এক পা-ও এগোতেই পারছি না। সাক্ষাৎ মৃত্যু আমার দিকে গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে একটু একটু করে।
কাছেই কোথাও যেন বাজ পড়লো। অন্ধকার দিক চরাচর ফুঁড়ে আকাশ থেকে নামলো নীল আলোর ঝলকানি।
ভয়ে চোখ বন্ধ করি আমি।
এহেন ভয়াল অবস্থাতেও কর্নেলের মুখখানা মনে পড়লো। মনে হল আর বোধহয় কোনওদিন বুড়ো ঘুঘুর বসার ঘরে আমার আড্ডা দেওয়া হল না। কুলফিকেও দেখতে পাবো না বোধকরি। কেমন আছে ছোট্ট পাখিটা? এরপর থেকে বোধহয় আমাকে ছাড়াই চলবে কর্নেলের সব অভিযান। এরপরেই মনে পড়লো আনার মুখখানা। লাল টুপিটা কোথায় গেল? এই জীবনে আর আনাকে উপহার দেওয়া হল না বোধহয়। জীবন বড় প্রিয়।
ঘড়…ঘড়…ঘড়…
জন্তুটার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ এগিয়ে আসছে আমার দিকে। মনে হচ্ছে কোনও এক প্রাগৌতিহাসিক যুগে খাদ্য খাদকের মধ্যেকার নাটক অভিনীত হচ্ছে এই নিঃশব্দ শহরে।
আমি আড় চোখে নিঃশব্দে ডান দিকে মাথা ঘোরাই। খাড়া প্রাচীর। বাঁ দিকে পাথুরে দেওয়ালের পাশে একটা চওড়া পাথর, তার ওপর ঝাপটে পড়ছে সমুদ্রের জল। দেয়ালের ওপাশে কি আছে?
মরিয়া চেষ্টায় পাথরের টুকরোর ওপরে পা রেখে দেওয়ালের পিছনে ঝাঁপ মারি। এপাশেও উঁচু দেওয়াল। আমার পালাবার পথ শেষ।
ঘড়…ঘড়…ঘড়…
শব্দটা এদিকেও আসছে, কিন্তু কোথা দিয়ে? মাথা তুলে দেখি পাথুরে দেওয়ালের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জন্তুটা। তার অতিকায় ডানা দুটো দুপাশে মেলে সে আমাকে দেখছে কৌতূহলী হয়ে। দেখেছে, নাকি আমার ওপর ঝাঁপাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে?
আর কোথাও পালাবার পথ নেই। তবুও আমি পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করি।
প্রাণীটার লম্বা ঠোঁট আমার দিকে নেমে আসছে আর ঠিক সেই সময়েই আমি পাথরের পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম পিছন দিকে।
সব শেষ তাহলে?
১২
ডাক এসেছে
…when I find myself in times of trouble… Mother Mary comes to me… Speaking words of wisdom, let it be…
নীল স্বচ্ছ জলে ধপাস করে আমার পতন… বুড়বুড়ি কেটে শরীর তলিয়ে যাচ্ছে… অক্সিজেনের অভাবে আমি হাত পা ছুঁড়ছি… কেউ একজন চেঁচাচ্ছে… ‘দেখ কিভাবে মরণ হয় তোর’…
…and in my hour of darkness… She is standing right in front of me… speaking words of wisdom, let it be…
…কেউ হাসছে… একটা গিরগিটির মতো প্রাণী জল কেটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে… ‘বেনিতো’… দৈত্যটাও আসছে আমার দিকে, জলে হাত পা ছুঁড়ে…’ধর ওকে’… লাল জামাও জলের মধ্যে সাঁতরে আসছে… আমি অসহায় হয়ে হাত পা ছুঁড়ি…
…and when the night is cloudy…. there is still a light that shines on me… shine on until tomorrow, let it be…
মাথাটা ঝিম ঝিম করছে… নীল জলের স্বচ্ছতা ধীরে ধীরে কালো অন্ধকারে রূপান্তরিত হচ্ছে… সুঁড়িপথ বেয়ে আমি গড়িয়ে পড়ছি… আলোর গর্তটা থেকে এগিয়ে আসছে বিকট মুখটা… সাপের মতো লম্বা জিভ আমার দিকে এগিয়ে আসছে… কোথাও ধাক্কা খেল শরীর… মাথায় ঠোক্কর লাগলো আবার… তারপর অন্ধকার…
…I wake up to the sound of music… Mother Mary comes to me… speaking words of wisdom, let it be…
গান থেমে গেল।
‘জ-য়-ন্ত-’ একখানা চেনা গলার চিৎকার অন্ধকার ফুঁড়ে কানের কাছে এসে বাজলো। আমি চোখ খুলে তাকালাম।
‘জয়ন্ত, কথা বলো-’ কর্নেলের মরিয়া ডাক।
‘উত্তর দাও-’ আবার তিনি। বুড়ো ঘুঘু কি আমার জন্য চিন্তিত?
‘উত্তর দাও……হাত বাড়াও…’ কর্নেলের চিৎকার এই অন্ধকূপের মধ্যে গমগম করে বাজছে।
কাঁপাকাঁপা পায়ে পাথরের গুড়ি পথ বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করি আমি, হাতখানা তুলে একটা অবলম্বন খুঁজি।
কিন্তু অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই হাতের মুঠোয় ধরা পড়ে না। এমন সময় হঠাৎ একটা বলিষ্ঠ হাত আমার কব্জি ধরে ফেলে খপ করে, তারপর এক জীবনমুখী টান। আমার শরীর হ্যাঁচর পাঁচোড় করে এগিয়ে যায়।
‘আমাকে একটু ধরুন-’ কর্নেল কাউকে নির্দেশ দিলেন তারপর সমবেত আকর্ষণে পাথরের খোঁদল থেকে বেরিয়ে এলো আমার শরীরটা।
‘ডার্লিং, তোমার ওজন কিন্তু লাগামছাড়া হচ্ছে দিনকে দিন…’ কর্নেল মাটিতে বসে হাঁফাতে থাকেন। হালদারমশাই ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আনা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে প্রার্থনা করে।
আমি হাঁটু মুড়ে বসে পড়ি ক্লান্তিতে। মুক্তি অবশেষে।
১৩
সুতো
‘আমাকে কিভাবে খুঁজে পেলেন কর্নেল?’
প্রাসাদের মালকিন মিস ভিত্তো ব্যাজার মুখে জানিয়েছেন খাবার শেষ, শুধু পড়ে আছে ‘ফিশ পাই’। অগত্যা সবাই মিলে সেই অখাদ্য খেয়ে চলেছি। ঘড়িতে বারোটা বাজে। এতো রাতে আর কিই বা পাওয়া যাবে! তিনি সন্দিগ্ধ চোখে কাউন্টার থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, নিঃশব্দে টিভি চলছে তার পাশেই। আমরা আলোচনা করে চলেছি নিজেদের মধ্যে, খুব নিচু স্বরে। আর সেখানেই কর্নেলকে প্রশ্ন করলাম আমি।
কর্নেল আনার দিকে আঙ্গুল দেখান, ‘ওর জন্যই প্রাণে বাঁচলে আজ জয়ন্ত-’। এলাইন এরপরের গল্পটা বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলেন।
‘তোমাকে মেডিনায় রেখে আমরা যখন ফিরছিলাম রেডিওতে আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষণা হল যে টর্নেডো আসছে… প্রবল বর্ষণ হতে পারে… এখানকার বর্ষা মানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ভোগান্তি। ঘন্টার পর ঘন্টা চলতে থাকে। সেই সঙ্গে প্রবল ঝড়। আমরা তখন প্রায় হোটেলে ফিরে গেছি, আনা জোর করে গাড়ি ফেরায়। ওর ধারণা হয়েছিল যে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে তুমি নিশ্চয় গাড়ি ঘোড়া কিছু পাবে না, তাই তোমাকে উদ্ধার করতেই আমরা ফিরতি পথ ধরি। এদিকে তুফান, বারবার বাজ পড়ছে চারদিকে, অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না… ঝড় বৃষ্টির শেষে যখন মেডিনায় পৌঁছলাম তখন ফোন করে কিংবা অনেক খুঁজেও তোমার দেখা পাওয়া গেলো না। এমন সময় একটা গলির ধারে তোমার ভেঙে যাওয়া ক্যামেরাটা উদ্ধার করলেন কর্নেল। বোঝা গেল তোমার বিপদ ঘটেছে কোনও, তারপর আবার খোঁজাখুঁজি। এদিকে রাতের আলো জ্বলে উঠেছে রাস্তার ধারে, আনা সমুদ্রের ধারে পাঁচিলের ওপর উঠে চারদিকে চোখ বোলাচ্ছিল। তখনই তার চোখে পড়ে ছোট্ট পাথুরে চাতালের ওপর পড়ে থাকা তোমার লাল টুপিটা… তারপর কর্নেল বারবার ফোন করে তোমার ফোনের রিংটোন শুনতে শুনতে তোমাকে খুঁজতে থাকেন… সেখানেই আবিষ্কার হয় ছোট্ট গুহাটা… ওর মধ্যে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল তোমার ফোন বাজার শব্দ। তারপরের গল্প তো জানোই সব…’
‘আপনাদের সব্বাইকে ধন্যবাদ। খুব খারাপ লাগছে এভাবে আমার জন্য আপনাদের সবার অসুবিধা হবার জন্য,’ আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেলি।
কর্নেল ভ্রূ কোঁচকান, ‘ন্যাকামির জন্য একটা পুরস্কার তোমার প্রাপ্য বটে,’ আমি বাক্যহারা হয়ে তাকাই, সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে।
কর্নেল থামেন না, ‘তুমি গোয়ার্তুমি করেছিলে বলে আজ তিনটে জিনিস জানা গেল যদিও,’ খাওয়া শেষে তিনি চুরুট জ্বালান।
এলেইন মাথা নাড়িয়ে বলেন, ‘এক, তোমায় তাড়া করেছিল যারা তাদের মধ্যে একজনের নাম বেনিতো, যাকে আমি খুঁজে পেতে পারি খুব সহজেই-’
‘দুই, মাল্টার সামুদ্রিক দানবের গল্প সত্যি, জয়ন্ত নিজের চোখে সেটা দেখেছে-’ এবার আনা বলে ওঠে।
‘আর তিন?’ হালদার মশাই প্রশ্ন করেন।
আমরা সবাই কর্নেলের মুখের দিকে তাকাই, বুড়ো ঘুঘুর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা।
ঝাঁপি থেকে বেড়াল বার করার মতন পকেট থেকে একটা কালো জিনিস বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
আমরা হুড়মুড় করে জিনিসটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
ফোন। গায়ে একটা নামি চাইনিজ কোম্পানির লোগো। স্ক্রিন ভেঙে গেছে। ব্যাটারি খুলে ছিটকে পড়েছিল কোথাও, সেটার গায়ে হাত দিতেই বোঝা গেল সমুদ্রের জলে ভেজা ভাবটা।
‘তোমরা যখন জয়ন্তকে গাড়িতে তুলছিলে ঠিক তখনই পাথরের খাঁজে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম এটা। রাস্তার আলোয় চকচক করছিলো ভাঙা স্ক্রিনটা…’ কর্নেল বললেন।
এলাইন ততক্ষণে ফোনটা চালু করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে পড়েছে। না, স্ক্রিন অন্ধকার। ফোনটা চলবে না আর। কর্নেল মাথা নাড়লেন।
ভাঙা টুকরোসুদ্ধ যন্ত্রটাকে পকেটে চালান করে দিয়ে ভদ্রলোক হাসেন, ‘চিন্তা নেই, সিম খুলে দোকানে দিলেই ফোনের সব তথ্য হাতে পাওয়া যাবে এক দুদিনের মধ্যে-’
কর্নেল ভ্রূ কোঁচকালেন এবং সম্মতি দিলেন। হোটেল ছাড়ার আগে এলাইন গর্বিতভাবে বলে গেলন, ‘কিচ্ছুটি চিন্তা করতে হবে না, কাল বিকেলের মধ্যে বেনিতোর বংশ পরিচয় আর ফোনের ভিতরকার খবরাখবর নিয়ে আমি হাজির হচ্ছি-’
রাত একটায় সে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফিরে গেল তার গোপন ডেরায়।
‘একজন বিজ্ঞানীকে খুঁজতে এসে কাদের সঙ্গে শত্রূতা করে বসলাম বলুন তো?’ আনা দিশেহারা হয়ে বলে ওঠে, ‘আপনারা দেশে ফিরে যান কর্নেল। আপনাদের জীবন বিপন্ন হোক আমি চাই না- ‘ এলাইন চলে যেতে, চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে আনা।
কর্নেল চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন, তার কাঁধে হাত রাখেন, ‘এখন তো ফেরার পথ বন্ধ, আনা। জয়ন্তর গায়ে যারা হাত তুলেছে তাদের সঙ্গে অনেক হিসেব নিকেশ বাকি। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো সবাই-’ বুড়োর নির্দেশ মেনে আমরা গুটি গুটি পায়ে ঘরের দিকে পা বাড়াই।
‘ধন্যবাদ, টুপিটার জন্য-’ আমি ঠাট্টা করে বলি আনাকে। ‘মাই প্লেজার,’ আনা বিষণ্ণ হাসে।
১৪
আরও সুতো
ভোর রাত্রে হঠাৎ পাশের ঘরে ধস্তাধস্তির শব্দ। হালদার মশায়ের একটা চিক্কুর এবং সেই সঙ্গে, ‘হালার পো-’, তারপরেই দরজার ধড়াম শব্দ।
আমি যে কখন বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে সামনের বারান্দায় এসে দঁড়িয়েছি তা নিজেই জানি না।
আনাও বারান্দায়, তার হাত সুইচ বোর্ডের ওপর। আলো জ্বলে উঠেছে এবং কর্নেল হাঁফাচ্ছেন রীতিমত। হালদার মশাইয়ের পাঁজরটাও হাঁপরের মতো উঠছে নামছে। কর্নেলের চোখ সামনের রাস্তাটার দিকে। এই অন্ধকারেও সেখানে একটা সিড়িঙে গোছের লোকের দৌড়ে যাওয়াটা আমাদের চোখ এড়ালো না। অন্ধকারেই দুটো তীব্র আলো জ্বলে উঠল। একটা গাড়ি এগিয়ে এসে পলাতককে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেল অন্ধকার চিরে।
‘ধুস পালালো-’ হালদার মশাই বিরক্ত হয়ে বললেন। কর্নেল হাসলেন, ‘কিছু নিতে এসেছিলো, কিন্তু কিছু দিয়ে গেছে।’
আমরা কর্নেলের সামনে এসে দাঁড়াই, ‘ঘুম আসছিলো না বলে ঘরে পায়চারি করছিলাম, এমন সময় হালদার মশাইয়ের ঘরে শব্দ হতেই দৌড়ে গিয়ে বাইরে অপেক্ষা করি, লোকটার জামা ধরে টেনেছিলাম… কিন্তু শুধু ওর পকেটটা ছিঁড়ে আমার হাতে চলে এসেছে- ‘ কর্নেল হাতের মুঠো খুলে আমাদের চোখের সামনে ধরেন।
‘একটা লাল ছেঁড়া পকেটের কাপড়-’ হালদার মশাই হতাশভাবে বলেন।
আমি কাপড় সরাই, একটা কাগজের টুকরো বেরিয়ে আসে তার আড়াল থেকে। আলোর সামনে তুলে সেটাকে ধরতেই ছোট্ট একখানা ম্যাপ দেখা যায় তার একপাশে। অন্যপাশে লেখা সবুজ হরফে লেখা ‘আই’ আর তার নিচে দুখানা শব্দ, ‘ইনোভিটা কর্প’।
‘শয়তান-’ আনা চাপা স্বরে বলে ওঠে। কর্নেল ভ্রূ কুঁচকে তাকান তার দিকে, ‘এর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক আনা?’
‘সম্পর্ক আমার নয়, সম্পর্ক হার্লানের সঙ্গে কর্নেল। বছর কয়েক আগে যখন ভদ্রলোক নিজের বাড়ি থেকে উবে যান তখন পুলিশ তার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়েছিল। যেটুকু তাদের মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছিল তার মধ্যে এই কম্পানির নামও আছে।’ আনা থামে।
আমরা অপেক্ষা করি। মেয়েটা দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বাকি অংশটা শোনায়, ‘কিউবা বিগত কয়েক বছরে চিকিৎসাবিদ্যায় দুর্দান্ত বেগে উন্নতি করেছে। এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে বেশ কয়েকটি উচ্চাকাঙ্খী প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায়। ইনোভিটা তাদের মধ্যে সব থেকে নামি এবং অর্থবান কম্পানি। শুধু অর্থবল খাটিয়ে দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানীদের লোভ দেখিয়ে নিজেদের গবেষণায় নিযুক্ত করেছেন ওদের কর্তৃপক্ষ। হার্লানের সঙ্গেও নাকি ওরা যোগাযোগ করেছিল, ওদের অপমান করে হার্লান। ওর ইমেইল থেকে সে তথ্য পেয়েছিল পুলিশ আধিকারিকরা। এমনকি যেদিন শেষবারের মতো তাকে দেখা যায় সেদিনও নাকি হার্লানের বাড়ির বাইরে একটি গাড়িকে ঘন্টা সাতেক অপেক্ষা করতে দেখা যায়। প্রতিবেশীদের কারও সিসি টিভির ক্যামেরায় গাড়ির নাম্বারও ধরা পড়ে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে পুলিশ জানতে পারে ওই গাড়ির মালিককে টাকা পাঠিয়েছিলেন ইনোভিটার একজন কর্মচারী। এদিকে কিন্তু সে গাড়িতে হার্লানকে উঠতে বা নামতে দেখা যায়নি। কয়েক ঘন্টা পরে গাড়িটা বাড়ির সামনে থেকে চলে যায়, যার ঘন্টা খানেক পরে বিজ্ঞানীকে বাড়ির দরজা পেরিয়ে বাইরে আসতে দেখা যায়। খুশি মনে তিনি পায়ে হেঁটে বেশ কিছুদূর যান। আর তারপর থেকেই- ‘ আনা থামে।
‘ভদ্রলোক নিঁখোজ-’ কর্নেল কাহিনী শেষ করেন।
‘পুলিশ ইনোভিটার সেই কর্মীকে ধরেনি?’ হালদার মশাই পুলিশ বিভাগে কাজ করেন সেটা প্রশ্ন শুনেই মালুম হল।
‘ইনভেস্টিগেশন শুরু হবার কয়েকদিনের মধ্যেই ভদ্রলোকের চাকরি চলে যায়। পুলিশকে সে নাকি জানিয়েছে যে অন্য একটা কাজে সে ওখানে দাঁড়িয়েছিল। দুজন সাক্ষীও তার হয়ে সওয়াল করেছে। সুতরাং ইনোভিটাকে আর বাগে আনা যায় নি-’ আনা থামে।
‘প্রমান ছাড়া পুলিশ অন্ধ,’ হালদারমশাই স্বগতোক্তি করেন।
‘কিন্তু নকশাটা কিসের?’ আনা কর্নেলকে প্রশ্ন করে।
‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,’ কর্নেল দু’হাত তুলে হাসেন, ‘আজ রাতে একদম ঘুম হয়নি। এবার সুতোর ছেঁড়া প্রান্তগুলো এক এক করে হাতে আসছে, তাই ঘুমটাও আসছে জব্বর। সকালে আমাকে ডেকে লজ্জা দিও না যেন। বেলায় নকশাখানা নিয়ে মাথা খাটানো যাবে, কেমন?’
হালদার মশাই আনমনে বলে ওঠেন, ‘ভাগ্যিস, ফোনটা এলাইন নিয়ে গেছে, নাহলে আজ নিশ্চয় ওটা আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যেত-’
কর্নেল মুচকি হেসে বলে ওঠেন, ‘গুড নাইট -’
আমরাও সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠি, ‘স্লিপ টাইট-’
পরের দিন জুড়ে এলেইনের জন্য অধীর অপেক্ষা। কিন্তু সে কোথায়?
১৫
পালিয়েছে
আনা বারবার তাকে ফোন করে যাচ্ছে, সেটা কিন্তু বন্ধ। হালদার মশাই এবার ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করছেন, ‘লোকটাকে বিশ্বাস করা কী ঠিক হল?’
‘ভদ্রলোকের বাড়ি কোথায় যেন?’ আমার প্রশ্নে আনা মুখ ঢেকে মাথা নাড়ে।
‘ওর সঙ্গে পরিচয় শুধু ওমেগার সূত্রে-’ তার গলায় ত্রাসের ছোঁয়া। এদিকে কর্নেলের দেখা নেই। সেই যে ঘুমোতে গিয়েছেন আর ওঠার নাম নেই।
দেখতে দেখতে তিনটে বেজে গেল। আমরা তিনজন এলোমেলো আলাপচারিতায় নিজেদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছি কিন্তু সব কথাই আমাদের পলাতক পথপ্রদর্শকের দিকে ছুটে যাচ্ছে। লোকটা কি সিমটা নিয়ে পালালো? হার্লানের অন্তর্ধানের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? ইনোভিটা কেনই বা ভাড়াটে গুন্ডা পাঠিয়ে আমাদের ঘর থেকে ফোনটা লোপাট করার চক্রান্ত করছে? না কি কোম্পানির নামটা আমাদের সঙ্গে বার বার কাকতালীয়ভাবে জুড়ে যাচ্ছে?
‘ডার্লিং, আমি যদি একটু পাখি দেখতে বেরোই তোমরা কি কিছু মনে করবে?’ এক মুখ হাসি নিয়ে বৃদ্ধ গোয়েন্দা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন রীতিমত সুসজ্জিত হয়ে।
‘এলাইন পলাতক!’ আনা মরিয়া হয়ে বলে ওঠে।
‘ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক নির্ঘাৎ!’ হালদার মশাই যোগ করেন।
‘বিশ্বাসঘাতক তাকেই বলা যায়, যাকে বিশ্বাস করা যায়-’ কর্নেল হাসিমুখে বলেন।
‘মানে, আপনি প্রথম থেকেই জানতেন?’ আমি আঁতকে উঠি।
‘ডার্লিং, তুমি সহজেই ঘাবড়ে যাও-’ আমাকে হুল ফুটিয়ে কর্নেল আনার দিকে হাত বাড়ান, ‘এই বুড়োর সঙ্গে একটু বেরোবার কষ্ট করবে নাকি?’
আনা অবাক হয়, ‘কিন্তু…’
তাকে নিরস্ত করেন কর্নেল, ‘বিশ্বাস যখন করেছ তখন এতো সহজে বিশ্বাস হারিও না। ওকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চলো আমরা একটু প্রকৃতি দর্শন করে আসি-’
‘আমরাও যাচ্ছি-’ হালদার মশাই এবং আমি একযোগে বলে উঠি।
‘তথাস্তু,’ কর্নেল বরাভয় দেন।
একখানা ভাড়ার গাড়ি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মাল্টার গ্রামগঞ্জের খোঁজে। বিশেষ কিছুই নজরে পড়লো না যদিও কর্নেল সারাদিন নানারকম পাখপাখালি দেখে নিরন্তর জ্ঞান ঝাড়লেন এবং আনা বিজ্ঞ ছাত্রীর মতো সব আলোচনাতে যোগ্য সঙ্গত করে গেল।
‘আপনার জন্য একটা চমক আছে কর্নেল,’ আনা একটা ছোট্ট বালিয়াড়ির কাছে গাড়ি থামাতে বলে।
‘দয়াময় ঈশ্বর-’ কর্নেল একছুটে গাড়ি থেকে নেমে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় শুরু করেন, ‘এই সেই বিখ্যাত রুবি টাইগার মথ!’ তার পিছন পিছন ছোটে আনা।
‘ধুস, এই হল ঝামেলা,’ হালদার মশাই কাঁধ ঝাঁকান বিরক্ত হয়ে, আমিও মুখ ব্যাজার করি।
‘এগুলো কি?’ হালদারমশাই একদিকে আঙ্গুল তুলে দেখান।
ড্রাইভার হাসে, ‘এ কি, মাল্টায় এসেছেন আর ‘সল্ট পেন’ দেখেননি?’
তার কথামতো বালিয়াড়ির ধারে জোয়ারের সময় জল জমলে সেই জলকে জমিয়ে রেখে সূর্যের তাপে তাকে ফেলে রাখলেই নুনের দানা থিতিয়ে পড়ে। মাল্টার বিভিন্ন প্রান্তে এখনও এই প্রাচীন উপায়ে নুন বানানোর চল আছে, আজও।
দিনভর এখানে ওখানে দিকভ্রষ্ট হয়ে ঘোরাঘুরি করে যখন শেষ বিকেলে হোটেলে পৌঁছোলাম তখন আমরা রীতিমত ক্লান্ত।
কিন্তু এ কি? খোদ এলাইন আমাদের অপেক্ষায় বসে আছেন খাবার টেবিলে।
‘ওই দেখো, তুমি এখানে, আর…’ কর্নেল আমাকে চোখ মেরে বলে উঠলেন, ‘জয়ন্ত দিনভর ভেবে মরছে যে তুমি বোধহয় সিমটা নিয়ে ভেগেছ। কী বলি বলোতো!’
এলেইন আমার সামনে এসে করুণ মুখে বলেন, ‘সত্যি?’
আমার এদিকে বিপন্ন অবস্থা। ‘কর্নেল ঠাট্টার একটা সীমা পরিসীমা থাকা উচিৎ!’ আমি চোখ কটমটিয়ে কর্নেলকে শাসাই।
এলাইন হাসেন, ‘আমি তো ঠাট্টা করছিলাম হে, সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক-’ কর্নেলও অনুযোগ করেন, ‘জয়ন্ত, তুমি ঠাট্টা বোঝ না-’
‘কিন্তু তোমাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না কেন?’ আনা কিন্তু গম্ভীর।
‘ফোন পাওয়া যাচ্ছিল না কারণ আমার ফোনে আমার সিমের বদলে কুড়িয়ে পাওয়া সিমটা লাগানো ছিল তো!’ এলাইন কৈফিয়ৎ দেন, ‘আমি গরিব মানুষ, তাই আদ্যিকালের ফোন ব্যবহার করি। ওতে একবারে একটাই সিম ব্যবহার করা যায় কিনা-’
আমরা আশ্বস্ত হই।
‘কিছু পাওয়া গেল ওটা থেকে?’ কর্নেল দাড়ি চুলকে প্রশ্ন করেন।
এলাইন গোঁফের প্রান্তদুটোতে তা দিতে দিতে চোখ বন্ধ করে খাবার টেবিল ও তার পাশে ছড়িয়ে থাকা চেয়ারগুলোর দিকে আমাদের ইঙ্গিত করেন, যার মানে, ‘আগে সবাই শান্ত হয়ে বসুন, তারপর বলছি-’ গোছের কিছু একটা।
আমরা দ্রুত হুকুম তামিল করি। তিনি বেশ ভারিক্কি চালে স্বভাবসিদ্ধ ঝুঁকে পড়া ভঙ্গিতে পায়চারি করতে করতে ব্যাখ্যা করেন, ‘প্রথমে আসি বেনিতোর কথায়। জয়ন্তর দেখা ছোটখাটো দৈত্যটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই জানা গেলো সে এই শহরের সবথেকে ক্ষমতাশালী এবং ভয়ানক গ্যাঙের একজন সদস্য। দলের নাম ‘এগুইলা’। বেনিতো এদের দলের পেশিশক্তি, তবে তার সঙ্গে আছে আরো কয়েকজন খুনে অপরাধীও। লাল জামা পরা আলেহান্দ্রো হচ্ছে ওদের মাথা এবং সবুজ জামা পরা ডেঞ্জেল হল দলের সবথেকে বেপরোয়া আর সাহসী গুন্ডা। চোরাচালান থেকে শুরু করে খুন সবকিছুতেই ওদের হাত আছে। সব থেকে বড় ব্যাপার হল,’ এলেইনের গলার স্বর এবার একটু নিচুর দিকে নামে, ‘এগুইলা দলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এখানকার সরকারের। তাই ওদের অধিকাংশ অপরাধই অপরাধ বলে মানতে নারাজ এখানকার পুলিশ।’
‘এগুইলা মানে ঈগল না?’ কর্নেল প্রশ্ন করেন। এলেইন ইতিবাচক নাড়ে।
‘এবার আসি ফোনের কথায়, সিম থেকে তথ্য বার করতে ওটাকে নিয়ে যাই আমার এক বন্ধুর কাছে, যার নাম প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় একদম। তা, সেই বন্ধু ফোনের কল রেকর্ড দেখে তিনটে নম্বর উদ্ধার করে দিয়েছে যেগুলোতে সব থেকে বেশি ফোন হয়েছে গত কয়েক মাসে। সেই সঙ্গে ফোনের মেমরি থেকে উদ্ধার করা গেছে একটা বিদেশী কম্পানির নাম ও একখানা কম্পিউটারে ডিজাইন করা লে-আউট-’
‘ইনোভিটা, কম্পানির নাম?’ আমরা একযোগে প্রশ্ন করি, এলাইন বিস্মিত চোখে আমাদের দিকে তাকান, ‘আপনারা কী করে জানলেন?’ তার প্রশ্ন শেষ হতেই কর্নেল আগের রাতে ঘটে যাওয়া চুরির চেষ্টা আর পালানোর গল্পটা শোনান। পকেট থেকে বার করে তাঁর সামনে ধরেন কাগজের টুকরোটা।
‘হুমম, হুবহু এক ছবি!’ তিনি মাথা দোলান।
‘তবে কিনা এরকম দেখতে কোনও বাড়ি কিন্তু মালটা গোজো বা কমিনোর চারধারে কোত্থাও নেই, এ আমি হলফ করে বলতে পারি-’ তিনি খানিক উদ্ভ্রান্ত, ‘এরকম বাড়ি তো বেশ আধুনিক, কেমন যেন হাসপাতাল কিংবা ..’।
‘রিসার্চ ল্যাব?’ কর্নেলের কথা শুনে লাফিয়ে ওঠেন এলাইন, ‘ঠিক তাই -’
এরপর শুধু নীরবতা।
১৬
দর্শন
আমরা মাল্টাদ্বীপ ছেড়ে এবার চলেছি কমিনোর দিকে। জলকেলি করা ছাড়া এই দ্বীপটাতে কিছুই করার নেই বিশেষ। এদিকে আমাদের হাতে সময় খুব কম, তাই জলে দাপাদাপি করার বিশেষ সুযোগও নেই। তবুও এতদূর এসে এখানকার ‘নীল লেগুন’ দেখবো না? তাছাড়া এখানে আছে আরও দুটো সুন্দর বিচ। দ্বীপে গাড়ি নিয়ে ঢোকা বারণ, হোটেল আছে মাত্র একটাই। কোথাও বিশেষ কোনও জনবসতিও নেই। এলেইন গাড়ি বাইরে রেখে আমাদের সঙ্গেই বিচে নেমে পড়লো সোজা।
আমার চক্ষু ছানাবড়া। এরকম স্বচ্ছ নীল জল এর আগে দেখিনি, জলের নিচে সাদা বালি পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। যেন একখানা বিশাল নীল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। হালদার মশাইয়ের মুখেও কোনও কথা নেই। তিনি শুধু একবার চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করেছিলেন, ‘আহ, শান্তি-’।
আনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘এইখানে একসময় অজস্র বোট আর প্রমোদতরণী ভেসে বেড়াত। ‘সামুদ্রিক বিভীষিকার’ ভয়ে এখন সব শূন্য। এইখানে দ্বিতীয়বার জন্তুটাকে দেখা যায়। সেই থেকে দ্বীপখানা পুরোপুরি খালি।’
আমার মস্তিষ্কে হঠাৎ প্রাণীটার ভয়াল চেহারা যেন উঁকি মেরে গেল। সেই সঙ্গে কানে ভেসে এলো সেই ঘড়-ঘড়-ঘড় শব্দখানাও।
কর্নেল হঠাৎ আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে বাইনোকুলার নিয়ে দৌড় মারলেন দ্বীপের দক্ষিণপূর্ব দিকে। ‘ও মশাই, আবার কোথায় চললেন-’ হালদারবাবু চিৎকার করে জানতে চাইলেন। কর্নেল উত্তরে হাত নাড়লেন এবং একটা পাথরের ঢিবির আড়ালে অন্তর্ধান করলেন।
আমরা বুঝলাম বুড়ো ঘুঘু নিশ্চয় কোনও পশুপাখির সন্ধান পেয়েছেন এই পরিত্যক্ত দ্বীপে। আমরা উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম।
বেশ কিছুক্ষণ কেটেছিল এভাবেই। আনা একখানা উঁচু ঢিবির উপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে সে নাকি সমুদ্রটাকে দু’চোখ ভরে দেখতে চায়। আমি অলস, তাই এতখানি চড়াই ভাঙার কষ্ট করাটা আমার কাছে বাহুল্য বলেই মনে হল। হালদারমশাই আর এ লাইনের সঙ্গে আষাঢ়ে গল্প করতে করতে আমরা এলেমেলো হাঁটাহাঁটি করছিলাম পাথুরে পাদদেশে।
এমন সময় হঠাৎ আনার চিৎকার কানে এলো, ‘জয়ন্ত-’
আমরা তিনজনেই দৌড় মারলাম সমতল বেয়ে, তারপর চড়াই ভেঙে উপরে উঠতেই আনাকে নিরাপদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধড়ে প্রাণ এলো আমাদের।
আনা নিরাপদ, কিন্তু তার তর্জনী সামনের সমুদ্রে বিচ্ছিন্নভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রস্তরখন্ডের দিকে উদ্যত। আমরা সমবেতভাবে সে দিকে চোখ ফেরাই।
এতদূর থেকে একজন একলা মানুষকে দেখা যাচ্ছে সেখানে। মানুষটা রাজকীয় অভিব্যক্তি নিয়ে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
সমুদ্রের হাওয়ায় তার মাথার চুল উড়ছে, চোখে কালো রোদচশমা, পরনে কালো স্যুট সেইসঙ্গে মানানসই কালো প্যান্ট, গলায় পরিপাটিভাবে ঝোলানো রয়েছে সাদা কালোয় মেশানো টাই। চামড়ার কালো দস্তানায় ঢাকা হাতদুখানা মুঠো করে ধরে আছে একখানা সুদৃশ্য কাঠের ছড়িকে। কি শান্ত বিষণ্ণ মুখের অভিব্যক্তি, কি আভিজাত্য তাঁর থমকে থাকা দৃষ্টিতে।
‘প্রফেসর হার্লান এলিসন-’ আনা থেমে থেমে উচ্চারণ করে।
সে ব্যাপারে আমরাও নিশ্চিত।
ভদ্রলোক এবার যেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন, ভাবলেশহীন মুখে শান্ত পদক্ষেপে ফিরে চললেন। কোথায়?
‘ওহ, তোমরা কোথায় গেলে সব-’ কর্নেলের গলা শুনতেই আমরা একযোগে মাথা ঘোরাই। একছুটে নিচে নেমে তাকে বিজ্ঞানীর হঠাৎ আবির্ভাবের কাহিনী শোনাতেই বুড়ো আমার সঙ্গেই ঢিবিতে উঠে দাঁড়ালেন।
‘কোথায় গেল দেখলে?’ কর্নেল বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে সমুদ্রের দিকে তাক করেন।
আনা, এলাইন এবং হালদার মশাই নির্বাক।
‘কি হল? ওই পাথরের টিলা থেকে অন্য কোথাও তো যাবার জায়গা নেই তাই না?’ কর্নেল প্রশ্ন করেন।
‘নেই, কিন্তু-’ আনা থেমে যায়।
‘কিন্তু ভদ্রলোক আমাদের চোখের সামনেই ওই আলগা পাথরের আড়ালে হারিয়ে গেলেন-’ এলাইন মাথা চুলকে বলেন।
‘ইস, একটা যদি বোট থাকতো তাহলে নিশ্চয় এতক্ষণে ওখানে পৌঁছে যেতে পারতাম-’ হালদারমশাই উত্তর দেন।
‘আমি নিশ্চিত টোনি এখানেই কোথাও বন্দি হয়ে আছে-’ আনা মাথা ঝাঁকায় উত্তেজিত হয়ে।
কর্নেল হাসেন।
‘যাক, কমিনো দ্বীপে এসে পাওয়া গেলো আরও দুটো সূত্র।’ সামনের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তিনি ঘোষণা করেন।
‘বিজ্ঞানী এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছেন কিংবা কেউ তাকে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করছে, এটা তো একটা সূত্র। আরেকটা?’ আমি কর্নেলকে প্রশ্ন করি।
‘এই দ্বীপে আছে এমন কোনও মূল্যবান বস্তু যার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দু’খানা বোট এখনও জলের ওপর চরকি কেটে বেড়াচ্ছে-’ কর্নেল ধীরেসুস্থে বলেন।
‘বোট? হতেই পারে না। মাছ ধরার এবং পর্যটকদের ঘোরানোর সমস্ত নৌযানকে সমুদ্রে নামার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না বেশ কিছুদিন ধরেই-’ এলাইন কর্নেলের কথা মানতে চান না।
‘দুটো বোট, দুটোর গায়েই খুব ছোট্ট করে লেখা সবুজ রঙের আলফাবেট আই,’ কর্নেল আমাদের বেকুব বনে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসেন, ‘কিছু মনে পড়ছে জয়ন্ত?’
‘ইনোভিটা-’ আমি বলে উঠি।
‘ঠিক তাই,’ কর্নেল আমার কাঁধে চাপ্পড় মেরে ঘোষণা করেন, ‘তোমার স্মৃতিশক্তি প্রখর, ডার্লিং!’
‘ও আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম, এই ছোট্ট দ্বীপটার একধারে একখানা পরিত্যক্ত ইঁটকাঠের বিশাল বাড়ি দেখলাম, ওটা কিসের বলতে পারো?’ কর্নেলের প্রশ্ন এলাইনকে।
‘ওটা একটা জাদুঘর, বছর কয়েক আগে একটা বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটা মেরিন মিউজিয়াম বানাতে শুরু করে, পরে কোনও কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। সেই থেকে বিল্ডিংটা পরিত্যক্ত-’
‘আবার ইনোভিটা-’ কর্নেল চশমা খুলে রুমালে মোছেন। আমরা এলাইনের দিকে তাকাই, সে মাথা দোলায়, ‘ঠিক ধরেছেন, বিদেশী প্রতিষ্ঠানটা ইনোভিটা।’
‘এবার আমাদের ফিরতে হবে,’ কর্নেল মৃদু স্বরে বলেন।
আনা উত্তেজিত হয়ে কর্নেলের হাতদুটো ধরে ঝাঁকায়, ‘কিন্তু কর্নেল, হার্লান এখানেই কোথাও আছেন। তাঁকে উদ্ধার না করেই কি আমাদের ফেরা উচিত?’
‘আনা, যুদ্ধে আবেগ নয় পরিকল্পনার প্রয়োজন। শত্রূর হাত থেকে বাঁচতে দরকার নিজেদের অবস্থান ও পরিকল্পনা সম্পর্কে তাদের সন্দিহান করে তোলা। সেই সুযোগের সদ্বব্যবহার করে তাদের আক্রমণ করা,’ কর্নেল বলেন।
‘যুদ্ধ? শত্রু? কর্নেল আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না-’ আনার দিশেহারা অবস্থা।
‘জয়ন্তর ওপর আক্রমণ, ইনোভিটার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, এদিকে হার্লানের সশরীরে আবির্ভাব- এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সুন্দর করে সাজানো একটা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে আমাদের অজান্তেই। সেটা প্রস্তুত করছে আমাদের শত্রূরা। আমাদের ওপর আক্রমণ হবার আগে, ওদের ওপর আক্রমণ হানতে হবে।’ কর্নেলকে এরকম গম্ভীর হতে আমি খুব কমই দেখেছি।
‘মাথার ওপর দিয়ে গেল-’ হালদারমশাই আমার কানে ফিসফিস করে বললেন।
আমারও,’ আমিও জানাই মনের অবস্থা। এলাইনের মুখে কিন্তু একটা মজার হাসি লক্ষ করলাম।
মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করলো।
১৭
দেবী কোথায়?
আমরা এবার এসেছি গোজো দ্বীপে। মাল্টা থেকে ফেরিতে করে আমাদের গাড়ি পৌঁছে গেছে মাত্র কয়েক মিনিটে। হবে নাই বা কেন, দুটো দ্বীপের মধ্যে দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। পথটা পেরোবার জন্য যেমন আছে ফেরি, তেমনি আছে ওয়াটার ট্যাক্সি এবং হেলিকপ্টারও। জলপথ বিপজ্জনক বলে ওয়াটার ট্যাক্সি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফেরির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে দিনে তিনটে। এখানে আমাদের ঠাঁই আরেকটা ‘প্রাসাদ’। ঠিক আগেরটার মতোই দোতলা বাড়ি, নাম- ‘গ্র্যান্ড প্যালেস’। এখানে হোটেলের মালিক এবং মালকিন আসলে স্বামী-স্ত্রী। এলাইন লাজুকভাবে জানিয়েছেন গোপনীয়তার জন্যই এরকম অনাড়ম্বর সস্তার ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের। অবশ্য আমাদের তা নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই।
কর্নেল গোটা পথটা আত্মগতভাবে কাটিয়েছেন। আনা বিজ্ঞানীকে নিজের চোখে দেখার পর থেকেই বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। এলাইনের কৌতুক করার প্রবণতা ভয়ানকভাবে কমে গেছে। আমি আর হালদারবাবু অবস্থা বিপাকে চুপ মেরে গেছি প্রায়।
আকাশে ভয়ানক দুর্যোগের আভাস ঘনিয়ে উঠছে, সেটা কেউ না বলে দিলেও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই।
‘আজকের বিকেলটা সবার ছুটি, শুধু আমি আর এলাইন ছাড়া,’ কর্নেল দ্বিপ্রাহরিক উদরপূর্তির পর ঘোষণা করলেন। এলাইন সায় দেয়।
‘আমি একটু ঘুমোতে চাই,’ হালদারবাবুর দাবী। আমাদের জিজ্ঞাসু চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন তিনি, ‘আসলে, একটা বড়সড় অপারেশনের আগে একটু বিশ্রাম চাই-’
‘আমি একটু ক্যালিপসোর গুহাটা দেখতে চাই। জানি না আর কোনওদিন সুযোগ হবে কিনা-’ আমি স্বগতোক্তি করি। ‘আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে,’ আনা বলে ওঠে, ‘তোমাকে একা ছাড়া বিপজ্জনক হতে পারে, তাছাড়া জায়গাটা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণাও আছে-’
কর্নেল দাড়ি চুলকে বলেন, ‘আমার আপত্তি নেই, তবে আজ সন্ধ্যায় আমাদের একটা ছোট্ট আলোচনা বসবে, সেখানে সবার উপস্থিতি দরকার।’
আমরা সবাই মাথা নাড়ি একযোগে।
গুহা দেখে ফিরলাম সন্ধ্যা নামার একটু আগে।
‘চল, খাবার টেবিলে বোধহয় কর্নেল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন,’ আনা আমাকে মনে করিয়ে দেয়।
আমি দেবী ক্যালিপসোর নামাঙ্কিত গুহাখানা দেখে এমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যে আমাদের আসন্ন অভিযানের কথা ভুলতে বসেছিলাম প্রায়। যদিও নিঃশব্দে আনাকে অনুসরণ করি তবুও আমার মনটা পড়ে থাকে ছোট্ট অন্ধকার গুহার মধ্যে, যেখানে একসময় সুন্দরী দেবী একলা বসে বীণা বাজাতেন আপনমনে। তখন এই দ্বীপে মানুষ থাকতো না। পর্যটকদের ভিড় থাকতো না। শুধু একখানা সুন্দর সমুদ্রের মাঝখানে ছোট্ট একটুকরো পাথুরে গুহায় দেবী থাকতেন জগৎ সংসার থেকে বহুদূরে। তারপর একদিন সেখানে পা ফেললেন বীর যোদ্ধা ওডেসিয়াস। দেবী তাঁর প্রেমে পড়লেন। সম্পর্ক ভাঙলো একদিন, ওডেসিয়াস ফিরলেন তাঁর মাতৃভূমিতে। তারপর? কীভাবে দিন কাটত বিরহিনী ক্যালিপসোর? একাকিত্বের তাড়নাতেই কি দ্বীপ ছেড়ে হারিয়ে গেলেন তিনি? কোথায় গেলেন? মনটা কেমন যেন দেবীর দুঃখে হাহাকার করে ওঠে।
‘এই তোমার আসার সময় হল, জয়ন্ত?’
কর্নেলের বকুনি খেয়ে আমার চিন্তার চটকা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। আমি ভয়ে ভয়ে হালদারমশাইয়ের দিকে চোখ ফেরাতেই তার তটস্থ ভাবটা চোখে পড়লো, তাঁর পাশে বসা এলাইনের মুখও গম্ভীর।
‘না…মানে….আমি…আসলে..’
সব্বাই হেসে উঠলো। বুঝলাম আমাকে নিয়ে আরেক প্রস্থ মজা করলেন বুড়ো ঘুঘু। কর্নেলের ওপর যথেচ্ছ রাগ হলেও আমি নিরুপায়।
‘প্ল্যানটা কি?’ আমি চেয়ারে টেনে বসতে বসতে প্রশ্ন করলাম।
কর্নেল গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, পকেট থেকে বার করলেন একটা প্রমান সাইজের কাগজের টুকরো। সেটাকে টেবিলের উপর পেতে আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কি দেখছো?’
‘বুক পকেট থেকে উদ্ধার হওয়া লে-আউট, যদিও আসলটার থেকে অনেক বড়-’ আমি বিজ্ঞের মতো বলি।
‘ঠিক তাই, এইবার দেখো,’ কর্নেল ছকটার ঠিক মধ্যিখানে আঁকা চারকোনা জায়গাটা দেখিয়ে বলেন, ‘কী দেখতে পাচ্ছ এবার?’
আমরা সবাই মাথা নিচু করে খুদে লেখাগুলো উদ্ধার করি।
‘মূল ঘর,’ আনা ফিসফিস করে, তার আঙ্গুল চারকোনা আয়তক্ষেত্রের মাঝখানে আঁকা বৃত্তের কাছে এসে থেমে যায়, ‘কেবিন-’ সে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে।
‘কর্নেল, আয়তক্ষেত্রের দুপাশে তেরচা করে আরো দুটো সংকীর্ণ কিন্তু সুদীর্ঘ আয়তক্ষেত্র আঁকা আছে। এ দুটো কী?’ হালদার মশাই ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করেন।
কর্নেলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, ‘পুলিশের চোখ, আসল জায়গাটা ধরে ফেলেছেন দেখছি-’ তিনি এবার এলাইনকে ইশারা করেন।
তিনি পকেট থেকে একটা সেলোফিন কাগজ বার করে সযত্নে সেটাকে আমাদের সামনে পেতে ধরেন। কর্নেল আবার প্রশ্ন করেন, ‘এটা কী বল তো? ‘
‘মাল্টা, গোজো আর কোমিনোর ‘বার্ড’স আই’ ভিউ,’ আমি অধৈর্য হয়ে উত্তর দিই, ‘এতো এখানেই লেখা আছে, কিন্তু তাতে কিছুই তো পরিষ্কার হচ্ছে না!’
‘ধৈর্য ধর ডার্লিং, দুটো ছবি আলাদা আলাদা ভাবে দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য দেয়, কিন্তু দুটোকে যদি এক করি?’ কর্নেল এবার সেলোফিনটাকে আগের কাগজের ওপর স্থাপন করেন।
একটা সমবেত আশ্চর্যবোধক শব্দ আমাদের তিনজনের মুখ থেকে বেরিয়ে যায়।
কমিনোদ্বীপের ওপর স্থাপিত হয়েছে আগের নকশাটায় আঁকা আয়তক্ষেত্রখানা, সেখান থেকে বেরোনো লম্বা বাহুদুটো একদিকে গোজো ও অন্যদিকে মাল্টাকে ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে।
‘কি বুঝলে?’ আবার কর্নেলের প্রশ্ন।
‘দুটো দ্বীপের মধ্যে দিয়ে গেছে দুখানা বাহু, আর আসল ঘরখানা আছে কোমিনোর মাটিতে,’ আমি দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে ভুগতে বলি।
‘একশোয় একশো,’ কর্নেল আমাকে উৎসাহিত করেন।
‘কিন্তু ওখানে কোথাও তো এরকম ঘরবাড়ি দেখিনি, আর তাছাড়া দুটো দ্বীপে যোগাযোগ করার মতো কোনও পথঘাটও তো চোখে পড়লো না।’ হালদারমশাই মাথা চুলকে প্রশ্ন করেন।
কর্নেলের সঙ্গে এলাইনের ইঙ্গিতবহ চোখাচোখি হয়। আমাদের এতদিনের পথপ্রদর্শক এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, ‘চতুর্ভুজটার অবস্থান, ঠিক পরিত্যক্ত মেরিন মিউজিয়ামের ওপর-’
‘বুঝলাম যে ওখানেই কেউ বা কারা লুকিয়ে আছেন। হতে পারে পরিত্যক্ত জাদুঘরেই পাওয়া যেতে পারে হারানো বিজ্ঞানীকে। কিন্তু এখনও আমার কাছে এটা পরিষ্কার নয় যে এই যোগাযোগের পথটা কী করে সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে আছে?’ আমি প্রশ্ন না করে পারি না।
‘জলের নিচে?’ আনার সম্ভাব্য উত্তর।
‘একশোয় একশো দশ, আনা-’ কর্নেল হাততালি দিয়ে ওঠেন। আমার মুখে মাছি আর হালদার মশাইয়ের শরীর চেয়ারে এলিয়ে পড়েছে।
‘হার্লান অর্থবান কিন্তু এতবড় একটা পরিকল্পনা তাঁর পক্ষেও রূপায়িত করা কী কখনও সম্ভব?’ আনার গলাটা যেন আমাদের সকলের মনের প্রশ্নকে ভাষা দিল।
‘সম্ভব, যদি ইনোভিটার পেশিশক্তি আর পয়সার জোর খাটে-’ কর্নেল ব্যাখ্যা করেন।
‘আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না একজন বিজ্ঞানী হয়ে টোনি ওদের সঙ্গে হাত মেলাবে,’ আনা কাঁধ ঝাকিয়ে নিজের হতাশা প্রকাশ করে।
‘আমিও করি না। তবে ওরা হয়তো হার্লানকে ব্যবহার করছে নিজেদের প্রয়োজনে। সত্যি জানার প্রয়োজন, আর সেটা জানতে আমাদের মাটি ছেড়ে নামতে হবে জলে।’ কর্নেল ঘোষণা করেন।
‘ইইইক-’ হালদার মশাই একটা হেঁচকি তুলে থেমে যান। ‘ইয়ে… মানে… জলে যদি…’ আমিও কথা হাতড়াতে থাকি।
কর্নেল বরাভয় দেন, ‘জলে নামতে হবে তবে বোটে করে। তাতেও যথেষ্ট বিপদ আছে বটে, তবে রহস্যের শেষ দেখতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হবে।’
আনা ঘাড় সোজা করে পরিষ্কার উচ্চারণ করে, ‘আমি রাজি।’
আমি আর হালদারমশাই চোখাচুখি করি এবং হাত তুলি, ‘রাজি।’
কর্নেল উঠে পড়েন, ‘আমাদের পৌঁছতে হবে সন্ধ্যার আগে, জোয়ার আসার আগে,’ তাঁর ইশারায় এলাইন তাড়াতাড়ি হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
‘কর্নেল, বোট জোগাড় হবে কী করে? সমুদ্রে নামার অনুমতি…’ আমাকে থামিয়ে দেন কর্নেল, ‘আমাদের পথপ্রদর্শক চৌকশ লোক, ওর ‘বন্ধুরা’ এক্ষেত্রেও আমাদের সাহায্য করবে।’
আমার দৃষ্টি কর্নেলের দৃষ্টির সঙ্গে নির্বাক বাক্যালাপ করে, কর্নেল মুচকি হাসেন।
১৮
এইবার
রাত নামার আগেই আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম। আজ আর পর্যটকের সাজ নয়। কর্নেলের পরনে একটা টিশার্ট আর খাকি মিলিটারি প্যান্ট, পায়ে ভারী চামড়ার জুতো, মাথায় আর্মি ক্যাপ। আমি আর হালদার মশাইও একদম পরিপাটি হয়েই বেরিয়েছি। আনার পরনে সাদা শার্ট এবং নীল জিন্স। আমাদের যুদ্ধসাজের একদম বিপরীত তার হাবভাব।
একটা গলিপথ ধরে অপেক্ষাকৃত নির্জন বিচে এসে দাঁড়ালাম আমরা। আনা জানালো এটা গোজো দ্বীপের সবথেকে নির্জন বিচ, নাম- দাহলেট করোট। বালিয়াড়ি নেই, শুধু রুক্ষ পাথর সর্বত্র। এককোণে দু’খানা ছোট্ট হাতে টানা নৌকো অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তাদের একটা থেকে উঁকি দিচ্ছে এলাইনের হাসিখুশি মুখখানা।
‘আমি এলাইন আর হালদার মশাই এক বোটে। জয়ন্ত তুমি থাকবে আনার সঙ্গে, যাই হোক না কেন ওকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়বে না কিন্তু।’ কর্নেল কড়া গলায় ঘোষণা জারি করেন আমার উদ্দেশ্যে।
‘কোনও চিন্তা নেই কর্নেল, আমি থাকতে ওর কোনও বিপদ হতে দেব না।’ আমি জানি না ঠিক কতটা জোরে বলেছিলাম কথাটা, সবাই নৌকায় চাপতে গিয়ে আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো।
‘ওর সঙ্গে থাকতে বলেছি কারণ আনা জুডো জানে। একটা স্কুলে ও পার্টটাইম জুডো প্রশিক্ষণ দেয় বাচ্চাদের-’ কর্নেলের কথায় চারদিকে হাসি এবং কাশির সমবেত কোরাস ওঠে। আমি মাথা নিচু করে বোটে চাপি।
আমাদের নিয়ে বোট এগোয় নিঃশব্দে, শান্ত জল কেটে। প্রতিটা নৌকায় চারজন সক্ষম যুবক, তাদের বৈঠার ধাক্কায় বোট চলেছে তরতরিয়ে। জলের নিচে সাদা বালিয়াড়ি চকচক করছে, একধারে সুউচ্চ প্রবালপ্রাচীর, অন্যদিকে আদিগন্ত সমুদ্দুর। মনটা উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। হালদারবাবুকে দেখলাম হাসিমুখে জলে হাত ডোবাতে, তারপর যেন কিছু মনে পড়েছে এমন ভাবে ঝটপট হাতটা জল থেকে তুলে নিলেন।
মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে অজস্র, উত্তর পাচ্ছি না কিছুতেই। হয়তো কর্নেল সবকিছুর শেষে ব্যাখ্যাগুলো দিয়ে দেবেন প্রতিবারের মতো। অথবা আজকের এই অভিযানেই সমস্ত রহস্য নগ্ন সত্যি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে। কে জানে!
‘ঝড় উঠবে,’ সামনের বোট থেকে সাবধানবাণী ভেসে এলো। আতঙ্ক দেখা দিল আমাদের বোটেও। আমি যদিও আকাশের কোথাও বিন্দুমাত্র মেঘের রেখা দেখতে পেলাম না তবুও মনের অন্ধকার কোনে সেই বিকৃতদর্শন জন্তুটার নড়াচড়ার শব্দ পেলাম যেন। ভয়ার্ত চোখে জলের দিকে তাকালাম, আনা আমার কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে নির্বাক ভরসা যোগায়। বোট দুটো নিঃশব্দে এগিয়ে যায়।
কর্নেলের বোট থেকে এলাইন হাত তুলে আমাদের থামার ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাত্রির তরল অন্ধকারের মধ্যেও একটা গাঢ় কালো ছোপ দেখা যাচ্ছে পাথরের স্তুপের গায়ে, আমাদের বোট থেকে প্রায় মিটার কুড়ি দূরে।
‘আরিব্বাস, এটা তো আগে দেখিনি-’ আমাদের বোটের একজন মাঝি চাপা স্বরে বলে ওঠে। ‘তিনখানা দ্বীপে এরকম কয়েক’শো ছোট ছোট প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ আছে। স্থানীয় মানুষরাও এদের খবর রাখে না।’ আরেকজন চাপাস্বরে উত্তর দেয়।
এলেইনের নির্দেশে বোটগুলো আমাদের এবড়োখেবড়ো পাথুরে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে একটা ছোট্ট পাথরের স্তুপের আড়ালে হারিয়ে যায়।
‘আমরা আছি গোজো দ্বীপে, এই গোপন সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে আশা করি ইনোভিটার বানানো লুকোনো গবেষণাগারে ঢোকা যাবে। আমি নিশ্চিত এ পথে ওদের নজরদারি কম থাকলেও একদম নিষ্কন্টক হবে না আমাদের যাত্রা। সুতরাং চোখ কান খোলা রাখা খুব জরুরি। সেই সঙ্গে এটাও সবাইকে বলে রাখি, এটা উদ্ধার অভিযান নয়, বরং অনুসন্ধান অভিযান। তাই বিপদে অযথা বাহাদুরি দেখাবার বিশেষ প্রয়োজন নেই-’ তাঁর চোখদুটো আমার দিকে নিবদ্ধ। আমি অকারণে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠি।
‘তৈরী?’ কর্নেলের প্রশ্নে সবাই নিঃশব্দে মাথা দোলাই আমরা। এলাইন মাথা নিচু করে হাতের ঘড়িতে একটা বোতাম চাপেন। কর্নেল কড়া চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘ওটা কি?’
তিনি কান এঁটো করা হাসি ছোড়েন, ‘সতর্কতা-’
বুড়ো ঘুঘু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন এলাইনের দিকে। সে কাঁধ ঝাঁকায়, ‘দয়া করে আমাকে অবিশ্বাস করবেন না কর্নেল-’
কর্নেল আর এলাইনের কুঁজো চেহারাটাকে অনুসরণ করে আমরা সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করি।
‘দেখেছ?’ কর্নেল সুড়ঙ্গের মাঝখানের ভেজা পাথরগুলোকে দেখিয়ে বলেন,’জোয়ারের জল এখানেও ঢুকে পড়ে।’
‘ওহ, এইখানে তোমরা?’ একটা সম্পূর্ণ অন্য গলা শুনতে পাই। মাথা ঘোরাতেই একটা ছায়ামূর্তি আর তার হাতে ধরা লম্বামুখ বন্দুকের নলটা
আমার চোখের সামনে চকচক করে ওঠে।
টিক-টিক-টিক-টিক-
পর পর মৃদু ধাতব শব্দ।
‘ওরে বাবা-’ কথাটা বলেই হালদার মশাই মাটিতে পড়ে যান। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি, এরপর আমার পালা নিশ্চয়।
‘ধূর শালা-’ লোকটা এবার আবার বন্দুকের ঘোড়া চাপে, শব্দ বেরোয় সেখান থেকে, টিক-টিক-টিক-
‘গুলি নেই-’ কথাটা বোধহয় আনাই বলেছিল, আমি প্রাণ বাঁচার আনন্দে কিংবা আত্মরক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টায় লোকটাকে ধাওয়া করি।
১৯
শব্দের উৎস
কর্নেল বলেন যাদের কথায় কথায় বন্দুক চালাবার অভ্যেস তারা হাতের যন্ত্রটা না থাকলে খুব ভয় পেয়ে যান। এ লোকটার ক্ষেত্রেও তাই হল। দুচারটে ঘুসি আর একটা লাথিতেই লোকটা জ্ঞান হারালো। ঘুসি আমি চালিয়েছিলাম, লাথি কষিয়েছেন হালদার মশাই, সঙ্গে জুড়েছেন দুটো শব্দ, ‘হালার পো-’
কর্নেলের মুখ থমথমে গম্ভীর। আনার মুখে ত্রাসের ছায়া।
‘আর এগোনো যাবে না। এরা রীতিমত সশস্ত্র।’ কর্নেল ঘোষণা করেন।
‘এতো কাছ থেকে ফিরে যাবো?’ আমি হতাশ গলায় জানতে চাই।
‘ওর বন্দুকে গুলি থাকলে এতক্ষণে কিন্তু আমরা সবাই মৃতদেহে রূপান্তরিত হতাম, তাই না?’ কর্নেলের গলায় ধমকের ছাপ।
‘ইয়ে… মানে…’ এলাইন এগিয়ে আসেন, ‘লোকটার বন্দুকে গুলি নিশ্চয় ছিল, তবে কি না ওর সেফটি লকটা খোলেনি-’
আমরা হতচকিত হয়ে তার মুখের দিকে তাকাই। কর্নেলের ভ্রূকুটির উত্তরে এলাইন কব্জিতে বাঁধা ঘড়ি তুলে দেখান, ‘এর নাম ‘জিরো’, এটা একটা এন্টিব্যালিস্টিক যন্ত্রের প্রোটোটাইপ-’ তিনি কান এঁটো করা হাসি উপহার দেন, ‘এটার পাঁচশো মিটারের মধ্যে কোনওরকম বন্দুক থেকে কোনও গুলি বেরোবে না-’
‘তুমি এ জিনিস কোথা থেকে পেলে?’’ আনা জিজ্ঞাসা করে।
এলাইন হাসেন, ‘আমার ‘বন্ধু’ দিয়েছে। তবে জেনে খুশি হলাম, বস্তুটা ঠিকঠাক কাজ করে। আসলে এই প্রথম পরীক্ষার সুযোগ ঘটলো কিনা–’
আমি দেখলাম হালদারমশাই ঢোক গিললেন।
‘তোমার যন্ত্রকে ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি বোঝাপড়া করবো সবকিছুর শেষে।’ কর্নেলের ধমক খেয়ে আমাদের গাইড বিড়বিড় করেন, ‘আমি সবকিছু ব্যাখ্যা করবো, আগে বিজ্ঞানীকে উদ্ধার করা যাক?’
অগত্যা আবার শুরু আমাদের অভিযান, শুধু ‘জিরো’-র কল্যানে আমার সাহস বেড়েছে বেশ খানিকটা।
অন্ধকার গলিপথে একটা বাঁকের আড়াল সরতেই নজরে এলো আরও দুটো ছায়ামূর্তি। তাদেরও পেড়ে ফেলতে বেশিক্ষণ লাগলো না আমাদের।
‘পাহারা বাড়ছে, আমরা নিশ্চয় গন্তব্যের কাছে পৌঁছে গেছি-’ কর্নেল ফিসফিস করলেন।
‘পায়ের শব্দ শুনলি?’ একটা গলা শোনা গেল। একটা মেয়েলি গলার উত্তর এলো, ‘তুই বেজায় ভীতু-’, দুটো লোকের হাসির শব্দও শুনতে পেলাম আমরা।
‘এবার কে যাবে?’ কর্নেল আমাদের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলেন।
‘সত্যিকারের গুন্ডা পেটানোর অভিজ্ঞতা খুব কম পাই, তাই এবার আমিই হাত লাগাবো-’ অগত্যা আনা আর কর্নেল গেলেন পাহারাদারদের শায়েস্তা করতে।
‘ওহ, সত্যিকারের গুন্ডা পেটানোতে কি মজা!’ আনার উল্লাস আমাদেরও কানে পৌঁছলো। এরপর আবার নিঃশব্দে অন্ধকার গলিপথ পেরোনোর গা ছমছমে অভিজ্ঞতা।
এরপরেও আরও দু রাউন্ড চলেছে গোপন ঝাড়পিট। শেষ বারে সবাই হাত লাগিয়েছে একমাত্র এলাইন ছাড়া। তিনি বয়স্ক মানুষ, তার ওপর একটু কুঁজো। সুতরাং তাঁকে ছাড়াই আমরা লড়াই চালিয়েছি।
এরপর সুড়ঙ্গ হঠাৎ শেষ, যদিও একটা লোহার সিঁড়ি সেখান থেকে উঠে গেছে সোজা ওপরে। হালকা সাদা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে।
আমরা ধীরে সুস্থে একে একে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠি। একটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিশাল ঘর। যদিও আলোর সংখ্যা এতো কম যে চারদিকটা পরিষ্কার দেখা যায় না। কয়েকটা কাচের ঘর, তাদের মধ্যেকার চওড়া পথ পেরিয়ে আমাদের দলটা এগোচ্ছে অতি সাবধানে। হঠাৎ কর্নেল থেমে যান। আমরাও।
পিয়ানোর সুর ভেসে আসছে। অনেক দূর থেকে। খুব মৃদু আর মিহি শব্দ। আমরা আবার সেই শব্দের উৎস লক্ষ্য করে এগিয়ে যাই।
সুরের মূর্ছনা ক্রমে বাড়ছে, পিয়ানোর সঙ্গে জুটেছে বেহালা, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে সেলো, ড্রাম, ক্ল্যারিনেট, বাঁশি, ফ্রেঞ্চ হর্ন- একটা গোটা অর্কেস্ট্রা। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো যেন একেবারে সজাগ হয়ে উঠছে প্রতিটা প্ৰদক্ষেপে।
২০
একলা তিনি
ঝপাৎ-
একটা কাচের ঘরে ঢুকতেই পিছনের দরজাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। সেই সঙ্গে জ্বলে উঠলো হালকা মায়াবী সাদা আলো। সিম্ফনির শব্দটা এখানেই সবথেকে বেশি পরিষ্কার, কিন্তু কান ফাটানো তীব্রতা নেই তাতে। বরং একটা মন ভালো করা অনুভূতি আছে শব্দের ঢেউয়ে।
‘‘…I watch the waves grow high against the horizon in the night
The storm swells, I lose my will to fight
Lightning crashes and the wind wraps me up so cold and tight
I turn my head, I’m blinded by the sight
And oh
Here comes the light
Like an angel falling from the the sky….’
আমাদের সবার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, সিম্ফনির সুরমূর্ছনা ভেদ করে একটা কণ্ঠ বেজে উঠলো।
‘হার্লান….?’ এবার আনার গলা।
শুধু যন্ত্রসংগীতের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই যেন বিশ্বচরাচরে।
‘..এই অন্ধকার গুহায় কোনও আলো নেই আনা… কোনও আশা নেই… কোনও ভবিষ্যৎ নেই…’
আমরা উৎকর্ণ হয়ে শুনি অদৃশ্য কথকের স্বর। সামনের দিকে একটা দরজা খুলে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে এসে অন্ধকারে এসে দাঁড়িয়েছেন একজন মানুষ।
‘…যদি কিছু থাকে… সেটা হল আমার একাকিত্ব আর… একটা দমবন্ধ করা উচ্চাকাঙ্ক্ষার অন্ধকার…’
লোকটা বলে চলে, আমরা শুনি।
‘হার্লান-’ এবার কর্নেলের গলা।
‘…অন্ধকার চিরে একদিন সূর্যের আলো ঢুকলো সবার অজান্তে… সমস্ত তমসা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে। অথচ আমি আলো চাইনি, আমি চাইনি একাকিত্ব থেকে মুক্তি। আমি চেয়েছি শুধু একটু নির্জনতা… যেখানে আমি খেয়াল খুশির দুনিয়া সাজিয়ে ব্যস্ত থাকবো, ধ্যান করবো, আবিষ্কারের খেলায় মাতবো… কিন্তু…. একদিন সবকিছু এলেমেলো করে আলোর রেখা পৌঁছে গেল আমার খোঁজে…’
লোকটা যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে।
এবার সত্যিই আলো জ্বলে উঠলো ঘরে। আমরা চমকে উঠে দেখলাম লোকটাকে। দুদিকে ঝুলে পড়া পরিপাটি চুলের আড়ালে দুটো উজ্জ্বল কিন্তু দুঃখী চোখের ঠান্ডা এবং ক্লান্ত চাহনি। ধারালো চিবুক আর চামড়ায় সূক্ষ্ম বলিরেখা। বার্ধক্য নেই, দামি স্যুট-টাই আর একজোড়া চেরি রঙের ধারালো জুতো থেকে রাজকীয় আভিজাত্য ছিটকে পড়ছে যেন। কালো দস্তানায় ঢাকা হাতদুটোর মুঠোয় ধরা লাঠিখানাও যেন পরম যত্নে বানিয়ে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে কেউ। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন উঁচু বেদিটার ওপরে, তার পিছনে একটা দামি চেয়ার।
‘হার্লান, আমরা এসেছি তোমাকে নিয়ে যেতে,’ আনা বিজ্ঞানীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে অধৈর্য হয়ে।
মানুষটা নিস্পৃহ চোখে তাকায় আনার দিকে, ‘আমি আলো চাইনি আনা, আমি মুক্তি চাইনি।’
কি আশ্চর্য রকম শান্ত অথচ শীতল গলা।
‘আমাকে তো কেউ মুক্ত করতে পারবে না, কারণ…’ লোকটা যার নাম হার্লান সামান্য বিরতি নিয়ে চালু রাখেন তাঁর স্বগতোক্তি, ‘নিজের থেকে পালিয়ে আর কোথায় যাব বলতে পারো?’
ভদ্রলোক শান্তভাবে চেয়ারে বসেন, পায়ের ওপর পা তুলে। শরীর এলিয়ে দিয়ে নিজেকে যেন কোনও অদৃশ্য শক্তির হাত থেকে মুক্ত করেন। হাতের লাঠিটা এখন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিজ্ঞানীর চোখদুটো বন্ধ। ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল ধীরে সুস্থে ভ্রূর ওপরে বুলিয়ে যাচ্ছেন আত্মগতভাবে, যেন তাঁর সামান্য মাথা ধরেছে।
‘সত্যিই নিজের কাছ থেকে পালানোর উপায় নেই হার্লান,’ কর্নেল একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘আমি জানি, ইনোভিটা তোমাকে জোর করেনি, বরং তুমিই ওদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেছ। নিজেকে পৃথিবীর চোখে অদৃশ্য করে এই নির্জন ছোট্ট দ্বীপটায় মাটির নিচে এই ল্যাবেরটরি সাজিয়ে বসেছ তুমি, তাই না?’ কর্নেলের গলাও বিজ্ঞানীর মতোই শীতল আর নিচু তারে বাঁধা।
‘কর্নেল-’ আনা এবার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আপনার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না!’
‘আনা, কর্নেলকে বলতে দাও-’ বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কাল্পনিক মাথা ধরাকে যেন দূর করছেন বিজ্ঞানী, চোখ দুটো এখনও বন্ধ। মুখের ভাব নৈর্ব্যক্তিক।
‘গল্পের শুরু ১৯৯৭ সালে,’ কর্নেল বলে চলেন, ‘কোনও এক শীতের সকালে সান ব্লাস-এর বালিয়াড়িতে আবিষ্কার হল এক অতিকায় সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ। প্রাণীটার শরীর প্রায় অক্ষত। দৈর্ঘে সে প্রায় পঞ্চাশ ফুট, প্রস্থে প্রায় পনেরো ফুট। শরীরের এক তৃতীয়ংশ সরু ল্যাজের আকার নিয়েছে। ভোর সকালে মাছ ধরতে যাবার আগে তিনজন জেলে প্রাণীটাকে আবিষ্কার করে। আশ্চর্যভাবে ঘটনাটার কথা কেউ জানতে পারে না। সামান্য যেটুকু কানাঘুসো শোনা গেলো সেটুকু ঢাকতে তিনজনকেই খুব শিগগিরই লোপাট করে দেওয়া হল একে একে মাস তিনেকের ব্যবধানে-’
‘এ কথাটা আপনি জানলেন কি করে কর্নেল?’ আনার গলায় অবিশ্বাসের সুর।
‘জানতাম না যদি ইন্টারনেটে ঘটনাটার কথা না পড়তাম বছর কয়েক আগে, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এমন নাকি অনেক ঘটনা ঘটেছে বা ঘটে চলেছে আজও। সব খবর আমাদের কানে এসে পৌঁছায় না। কিন্তু পাপ যেমন চেপে রাখা যায় না, তেমনি এই সংবাদগুলো আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে লুকিয়ে থাকে ইথারের কোনও এক তরঙ্গে গা ঢাকা দিয়ে। অন্তর্জালের রহস্য আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছে জয়ন্ত। এর জন্য অবশ্যই তার ধন্যবাদ প্রাপ্য-’ কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন।
‘এর সঙ্গে হার্লানের কি সম্পর্ক?’ আনার গলায় এবার অবিশ্বাস মেশানো দ্বিধা।
উপন্যাসের শেষাংশ পড়ুন নিচের লিঙ্কে
Tags: কর্নেল এবং..., কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, রনিন, সুমিত রায়
অসাধারণ, অপূর্ব! কর্ণেলের স্রষ্টা বেঁচে থাকলে ভীষণ খুশি হতেন এরকম একটা প্যাস্টিশ দেখে। লেখার স্টাইল নিখুঁত, প্লট অনন্যসাধারণ এবং চমকে দেওয়ার মত। রনিনের লেখা আগে পড়িনি এবং সেজন্য আফসোস হচ্ছে। প্রচন্ড শক্তিশালী কল্পনা শক্তি এবং গল্প বলার ক্ষমতা না থাকলে এই জিনিস আসে না। লেখককে অনেক অভিনন্দন।
Dhonybad Snadipanbabu, apnader utsaho notunder udyog jogay 🙂
idaning kale ekta boro maper lekha ektana pathok k porano boro soja katha noy… se kaje manonio lekhok 100 te 100…osadharon …. tobe kichu truti ache naam ebong typing khetre segulo ekbaar dekhe nile valo hoy…. professor shonku r kornel k mukhomukhi dekhte pacchi tahole agami dine?
Dhonybad Pratimbabu, apni je purota porechen seta jene khusi holum . dujoner dekha sakkhater ingit ache bote tobe kobe hobe seta bola mushkil 🙂
Khub valo hoyeche. Dubar Bose ses korlam. Sanku ar cornel ekasthe Kemon jome tar opekhay thaklam.
sotyi apni cornel er srostar proti jotha jogya samman dekhiechen,opurbo lekha.opurbo.
prosenjit
durdanto lekha. ak niswase pore fellam.tobe golpota te haldar mosai er bhumika khub ekta pelam na.asakori next lekha te pawa jabe. aro kornel er lekha chai. apnar lekha porle sayud mustafa siraj o khushi hoten.arek bar obhinondon
Nice এরকম আরো গল্প দিলে ভালো হয়