কলাবতী
লেখক: আইভি চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: অঙ্কিতা
পর্ব এক
অনেকক্ষণ ধরে বাড়ির সামনে পায়চারি করছে একটা লোক। তিনবার কলিং বেল বাজিয়েছে। ভেতরে আওয়াজ গেছে কি না বোঝার উপায় নেই। বাইরে এত হাওয়া চলছে যে কান-মাথা সব মোটা টুপিতে বন্ধ। কিন্তু ওপাশের বাড়ির জানলা দিয়ে ইতিমধ্যেই উঁকি দিয়েছে একটা মুখ। এদিকের বাড়ির ঝোলানো বারান্দায় এসে ভৌ ভৌ ডাকে বিরক্তি প্রকাশ করেছে আর্নল্ডের টেরিয়ারটা। কি যেন নাম ছিল, টিয়া বলেছিল। টিয়ার কাছে ছিল পিক্সি। একটা বীগল। অত বড় টেরিয়ারের সঙ্গে বেশ ভাব ছিল ছোট্ট বীগল পিক্সির। সুহানা বলত, ‘মানুষের মধ্যেই যত ভাগাভাগি। ওদের অত ক্লাস-কনশাসনেস নেই।’ ক্লাস-কনশাসনেস। শ্রেণী-সচেতনতা। সুহানার মধ্যে সেটা ভালোই ছিল। সেইজন্যেই তো দূর দেশে থাকা শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে পছন্দ করতে পারে না। জোরে মাথা ঝাঁকালো লোকটা। আবার যত উলটোপালটা ভাবনা।
গতকাল রাতে ফ্লাইটে চড়ার আগে ফোনে কথা হয়েছে টিয়ার সঙ্গে। টিয়া তো জানে আসার কথা। অবশ্য আজই যে ব্রাইটন আসা হবে তা টিয়া জানে না। কিন্তু মাত্র পঁচাত্তর কিলোমিটার দূরে পেপার পড়তে এসে লোকটা বাড়ি না এসে লন্ডনের হোটেলে থাকবে? সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। কার্ল বলেছিল, ‘কাল সকালেই যেও।’
মন মানেনি। এই আবহাওয়ায় তেমন ট্রাফিক থাকবে না। দেড় থেকে দু’ ঘন্টার মধ্যে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যাবে। এমনিতে সমুদ্র সৈকতের শহর ব্রাইটনে আবহাওয়া শান্ত, মোটামুটি উজ্জ্বল রোদ্দুর, সামুদ্রিক মৃদুমন্দ স্বাস্থ্যকর বাতাস। এই ঝোড়ো অবস্থাটা সাময়িক। কাল সকালেই কেটে যাবার কথা। কিন্তু অপেক্ষা করতে মন চায়নি। ছ’মাসে একবার বাড়ি আসার সময়। তার বেশি দিতে চায়নি সুহানা। চাইলে টিয়ার সঙ্গে বাইরে দেখা হতেই পারে। ইচ্ছে হলে টিয়াকে নিজের বাড়িও নিয়ে যেতে পারে কোনও উইকেণ্ডে।। কিন্তু এ বাড়িতে দেখা করতে আসতে হলে ওই নিয়ম। ছ’মাসে একবার।
এতক্ষণে দরজা খুলেছে। ছোট্ট মেয়েটার মতো এসে জড়িয়ে ধরেছে টিয়া, ‘তুমি? আজই?’
‘কখন থেকে বেল দিচ্ছি। আমি তো ভাবছিলাম…’
‘কলিংবেল খারাপ হয়ে আছে। তাই শুনতে পাইনি। এসো, ভেতরে এসো।’
আধখোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে উইন্ডচাইমের সিলভারের পাখিরা হাওয়ায় দুলছে জোরে জোরে, যেন বলছে, ‘এসো এসো।’
‘ও আছে বাড়িতে? আমি আসছি বলেছ তো?’ একটু থেমে, একটু ইতস্তত করে বলল এবার।
টিয়াও থমকে দাঁড়াল, ‘কাল তোমার ফোন এল যখন, শুনেছে।’
ঘরের কোনায় ফায়ারপ্লেসটা একইরকম ঠান্ডা। ‘এত ঠান্ডা, তবু আগুন জ্বালনি?’
‘নিচে আসি না। ওপরটা সেন্ট্রাল হিটিং আছে।’
সাদা লেসের পর্দাগুলো একটু ধুলো পড়ে ধূসর। মোটা ভেলভেটের নীল পর্দাটা একইরকম ডানদিকে টানা। হাওয়া আটকাবার জন্যে যে ভালো করে টেনে দেওয়া দরকার, আর এখন যে সেটা মনে করিয়ে দেবার কেউ নেই, সেটা যেন মনেই নেই এ বাড়ির কারওর। ঘরটা ঠান্ডা হয়ে আছে। নির্জন। বরাবরের মতোই।
‘কফি আনি? বাবা?’
‘তুমি আনবে? আমিই করি।’
‘না না, তুমি বসো। আমি আনছি।’
ধুলোমাখা পিয়ানোর পাশের ছোট্ট বসার জায়গাটায় আলো জ্বেলে দিল টিয়া। পিয়ানোর ডালাটা খোলা। ‘আমি পরিষ্কার করেছি সকালে’, রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে হাসল টিয়া।
একটু হেসে ফেলল লোকটাও। পুরানো অভ্যেসমতো হাত বাড়িয়ে পাশের ছোট্ট ক্যাবিনেট থেকে লাল রুমালটা টেনে নিল। আলতো ধুলো ঝেড়ে নিয়ে অভ্যস্ত হাতে বাজিয়ে ফেলল খানিক।
স গ প ণ ধ র্স
র্স ণ ধ প গ স
রান্নাঘর থেকে হাসিমুখে উঁকি দিল ছোট্ট মেয়েটা। যেন জানত, বাবা এই সুরটাই বাজাবে।
তারপর একটা গানের সুর। ‘কোই সাগর দিল যো বহলাতা নহি…’
রাগ কলাবতী। ছোট থেকে কতবার যে শোনা গল্পটা। এই সুরটা বাজলেই ওপরের সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াবে মম। আনমনে নিজের অতিপ্রিয় পিয়ানোয় গানের সুরে হাত বুলিয়ে চলেছে লোকটা। অতি যত্নে। ভালোবেসে। প্রতি ছ’মাসে একবার এই বাড়িটায় আসার টান, যতটা টিয়ার জন্যে, প্রায় ততটাই এই গ্র্যান্ড পিয়ানোর জন্যেও।
প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে প্রিয়াকে দেওয়া উপহার। তখন অবশ্য প্রতিমুহূর্তে নিজেকে প্রমাণ করার সময় চলছিল। তৃতীয় বিশ্বের দূর দেশের একটা সাধারণ ছেলেকে বিয়ে করে ভুল করেনি সুহানা, তার প্রমাণ। প্রতি পল, অনুপলে সুহানার যোগ্য হয়ে উঠতে চেয়েছে অবিনাশ।
ক্যাভেণ্ডিসের বিজ্ঞানী, জেনেটিক্স নিয়ে কাজ করছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব নামকরা ল্যাবরেটরির নাম ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরি। তবু সুহানার চোখে নিজেকে প্রমাণ করার দায়। নামটাই তো পছন্দ ছিল না সুহানার। এমন একটা নাম যে ছোট করে ডাকার উপায় নেই।
চণ্ডীগড়ের ছেলেটা পরিবারের কাছে গর্বের নাম। তখনই ডিএনএ নিউক্লিওটাইড নিয়ে নানা দেশে পেপার প্রকাশ হচ্ছে। ডিএনএ-র একটি বেস, একটি শর্করা এবং একটি ফসফেট নিয়ে গঠিত একক নিউক্লিওটাইড। বংশগতি নিয়ে গবেষণার সুদর্শন, প্রায়-বিখ্যাত বিজ্ঞানীর মন পেতে অনেক সুন্দরীই ব্যাকুল হয়েছিল।
অন্যমনস্ক বিজ্ঞানী কিন্তু পছন্দ করেছিল সুহানাকে, কারণ ওই কলাবতী।
ততদিনে ক্যাভেণ্ডিস ছেড়ে কেমব্রিজেরই কিংস কলেজে। পদার্থবিজ্ঞানী রেনডেল পদার্থ, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি টিম গঠন করেছেন ডিএনএ’র গঠন আবিষ্কার করার কাজে, সেই টিমে যুক্ত হয়েছে অবিনাশ।
কোথায় বিজ্ঞানের বংশগতি নিয়ে গবেষণা আর কোথায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত!। বিধির বিধান বুঝি একেই বলে। ভালোবাসার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। বিদেশেই নিজের পৃথিবী গড়ে উঠেছে, বিয়ে থেকে সংসার গড়ে ওঠায় পরিবারের কোনও ভূমিকাই ছিল না। তবু কেন কে জানে, প্রথম থেকেই অবিনাশের পঞ্জাবের শিকড় নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছে সুহানা। সুহানাকে সেখানে খুব ভালোবেসেছে সবাই, তবুও। অবিনাশ যে একজন ভারতীয় মেয়েকেই বিয়ে করেছে, মেমসাহেব বিয়ে না করে, তাতেই খুশি সবাই।
অবশ্য সুহানাকে ঠিক ভারতীয় বলা যায় না। সুহানার জন্ম এদেশেই, সুহানার মায়েরও। মায়ের বাবা ভারত ছেড়ে অনাবাসী হয়েছিলেন। দাদাজির প্রভাবেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম। বেশ নামী শিল্পী তখনই। দেশ থেকে সেলিব্রিটি শিল্পীরা এ দেশে এলে একই স্টেজে পারফর্ম করে সুহানাও। ভারতে অনুষ্ঠান করতে না গেলেও পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ঘুরে এসেছে গান গাইবার সূত্রে।
একবারই দেশে গিয়েছিল, টিয়া জন্মাবার পর। এবং তারপরই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত।
আনমনেই হাত ঘুরছিল পিয়ানোয়। ‘কোই সাগর দিল যো বহলাতা নহি’… ‘দিল দিয়া দর্দ লিয়া’ ছায়াছবিতে মহম্মদ রফির গান। ভারী সুন্দর গেয়েছিল সুহানা, লরেন্সের বাগদান ছিল সেদিন। ন্যান্সি কেট ক্রিক, সবাই ছিল। ন্যান্সির সঙ্গে অবিনাশের একটু মন দেওয়া-নেওয়া পর্ব শুরু হয়েছিল ল্যাবেই। ন্যান্সির বন্ধু হয়ে এসেছিল সুহানা। অবিনাশ ছাড়াও প্রোফেসর বিশ্বনাথ ছিলেন দেশের লোক। গায়িকা শিল্পী শুনে অনুরোধ করেছিলেন সুহানাকে, দেশোয়ালি ভাষায় গান গাইবার। সেই গান শুনে, সুহানার প্রেমে নাকি কলাবতীর প্রেমে, হেড ওভার হীলস পড়ে গেছিলেন তরুণ বিজ্ঞানী। কলাবতী রাগেই আরও একটা গান গাইত সুহানা। ‘ঝনন ঝনন বাজে’…
অ্যাবির কলাবতী প্রীতি দেখে, ততদিনে অবিনাশ অ্যাবি হয়ে উঠেছে, খুব হাসত সুহানা। লতা মঙ্গেশকরের একটা গান, ‘এ সখী রাখিকে….’ তুলে নিয়েছিল গলায় অ্যাবির ভালো লাগবে বলে। বোধহয় ‘জুরমানা’ ছায়াছবির গান।
টিয়া এসে কফির মগ রাখল পাশের ছোট কফি টেবিলে। আলতো হাত রাখল কাঁধে। একটু ফিকে হাসল লোকটা। সিঁড়ির কাছে কেউ এসে দাঁড়ায়নি আজ।
‘ও বাড়িতে নেই?’
‘আছে। শী ডাজন’ট ওয়ান্ট টু মীট ইউ।’
মুখ নিচু করল টিয়া। মম যে ক’দিনের মধ্যেই পলের বাড়িতে চলে যাবে, বাবাকে বলে দিতে ইচ্ছে হল। কিন্তু টিয়া বলবে না। টিয়া বরং বলবে, আর চার বছর পর টিয়া যখন ‘বড়’ হয়ে যাবে, তখন টিয়া একবার বাবার বাড়ি যেতে চায়। চণ্ডীগড়, আর জয়পালগড় গ্রাম। বাবার ময়ের হাতের ফুলকারি কাজ, ভাংরা নাচ। একবার দেখতে চায় টিয়া।
বাবা হাসল এবার, ‘তোমার সেশন কবে শুরু হচ্ছে? আমি আসব ডাবলিনে, তোমার সঙ্গে দেখা করতে।’
এইসময় ওপর থেকে একটা আওয়াজ হল জোরে। কাচের গ্লাস বা কাপ ভাঙার শব্দ। টিয়ার মুখটা শুকিয়ে গেল। ভয়ে, লজ্জায়। পিয়ানোর দিকে তাকালো একবার। ফিকে হেসে পিয়ানোর ডালা বন্ধ করে দিল বাবা।
‘এরপর তো আর এখানে আসব না। তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব ডাবলিনে, তোমার ইউনিভার্সিটিতে। কি জানি… পিয়ানোটা আর বাজানো হবে কি না…! তাই…’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল, ‘আই অ্যাম সরি।’
দ্রুত এগিয়ে এল টিয়া, হাতে একটা কাগজ, ‘ড্যাড, আমি তোমার জন্যে ফেরার বাসের টিকিট কেটে রেখেছি।’ বলতে বলতে চোখে জল এলো টিয়ার, ছ’মাসে একরাত এ বাড়িতে কাটাবার কথা বাবার। হয় না। মম মুখ দেখতে চায় না ‘লোকটা’র।
‘ওই লোকটা’ আসবে শুনলেই মমের হিস্টিরিয়া হয়, জোরে জোরে কাঁদে, জিনিসপত্র ভাঙে। ইন্ডিয়া থেকে যত গিফট এসেছে, ফুলকারি টেবলক্লথ, বিছানার চাদর, মসলিনের শাড়ি, পশমিনার চাদর, রেশমী চুড়ি, সোনার হার, টিয়ার জন্যে আনা কাঠের সেপাই, মোমের পুতুল…. সব একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা আছে।
‘ওই লোকটা যেন এবার ব্যাগটা এ বাড়ি থেকে নিয়ে যায়’, মম বলে প্রতিবার।
টিয়া বলতে পারেনি। এই বাড়িটা মমকে গিফট করেছিল বাবা। মম হয়ত একদিন এই বাড়িটাও ফেরত দিয়ে দেবে। সেদিনই না হয় ব্যাগটা দেখবে বাবা।
বাইরে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি। ব্রাইটনে আজ অস্বাভাবিক নির্জনতা। শুকনো মুখে একবার দোতলার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে ঝড়ের মধ্যেই বেরিয়ে গেল বাবা।
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল টিয়া। একলা একলা।
পর্ব দুই
পাঁচ বছর পর
অনেকক্ষণ ধরে বাড়ির সামনে পায়চারি করছে একটা মেয়ে। তিনবার কলিংবেল বাজিয়েছে। ভেতরে আওয়াজ গেছে কি না বোঝার উপায় নেই। ভেতরে পিয়ানো বাজছে। বাইরে উজ্জ্বল সকাল, রোদ উঠেছে। বাড়ির সামনে ছোট্ট সবুজ লনের ধার ঘেঁষে রঙিন ছোট ছোট ফুল, অনেকদিন আগের মতো বাবা আবার বাগান করা শুরু করেছে।
বাঁদিকে আর্নল্ডের বাড়ি ছাড়িয়ে মাইকের ছোট্ট পাখির দোকান। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা পাইপ হাতে রাস্তা পরিষ্কার করছে মাইক, টিয়াকে দেখে হাসিমুখে হাত নেড়ে দিল। পরিচিত ছবি, চেনা মুখ। ভালো হয়ে গেল মনটা।
মাইকের বার্ড-শপের পাশ দিয়ে ডানদিকের রাস্তায় ঘুরে গেলে এ বাড়ির পেছনের বাগিচায় পৌঁছনো যায়। কিন্তু ওদিকে চার্চ। চার্চের সামনে দিয়ে যাবে না টিয়া। যদিও ছোটবেলায় মমের সঙ্গে চার্চে যেতে খুব ভালো লাগত। ভারী সুন্দর আঁকা সব জানলা, নীল টালির ছাদ, চারদিকে মায়াবী আলো। প্রতিটা অলঙ্করণ তুলনাহীন, যিশুর জীবনের বারোটি প্রধান দৃশ্যের বর্ণনা। ওক কাঠের চার্চের বেদী, তাতে খোদিত দুশো মূর্তি। ওই বেদীর সামনেই মমের সঙ্গে শেষ দেখা। পলের সঙ্গে মমের বিয়ের দিন।
আজ আকাশ পরিষ্কার। ব্রাইটনের আকাশে রঙিন ঘুড়ি উড়ছে। ডানদিকে মিসেস ক্যাথরিনের ভিলার পাস দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘন নীল জলের উন্মুক্ত ইংলিশ চ্যানেল, তাতে ভেসে বেড়াচ্ছে রংবেরঙের সৌখিন পালতোলা নৌকো, আকাশে একঝাঁক সীগাল উড়ছে আপনমনে, দিগন্তে জাহাজের অস্পষ্ট রেখা… এ বাড়ির পেছনের ছোট বাগিচায় দাঁড়ালেও এই ছবিটা চোখে পড়বে। বাবা বোধহয় ওখানেই আছে, তাই কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে না। না, বাবা বাগিচায় থাকলে এদিকের হলে পিয়ানো বাজাচ্ছে কে? বাবা অবশ্য জানে না, আজ টিয়া আসছে। বাবাকে একটা প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ দিতে চায় মেয়ে। মম যেদিন ফোনে বলল, বাবাকে এ বাড়ির চাবি পাঠিয়ে দিয়েছে, সেদিন থেকেই ভেবে রেখেছে। বাবা যেদিন ফোনে বলল, আবার এ বাড়িতে এসে থাকবে, সেদিন ঠিক করেছে এই সারপ্রাইজ দেবার কথা।
ডাবলিন চলে যাবার পর আর আসতে ইচ্ছে করেনি। ছুটিতে বেড়াতে গেছে ইউরোপ, বালি, দুবাই। বাড়ি আসতে ইচ্ছে হয়নি। মম পলের সঙ্গে ছুটি কাটাতে গেছে, ডেকেছে টিয়াকে। যেতে ইচ্ছে হয়নি। বাবা ইন্ডিয়া গেছে হয়তো, টিয়াকে ডাকেনি। তাই যাওয়া হয়নি। আর এখন তো অনেকদিন হয়ে গেল, বাবা ব্রাইটনে এসে নিজের বাড়িতেই আছে। আজকাল ফোনেও কথা হয় না, সেই থ্যাঙ্কসগিভিং-এর দিন শেষ কথা হয়েছে। আর এই এতদিন পর সামারে বাড়ি এসে বাবাকে অবাক করে দেবে টিয়া।
পিয়ানোয় একটা চেনা সুর বাজছে। কলাবতী নয়, কলাবতী চেনে টিয়া। কলাবতীর মতো অনেকটা। দরজা খুলে গেল। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বাবা। দু’হাত ছড়িয়ে। সেই ছোট্টবেলায় স্কুলের বাইরে এমনি করে দাঁড়িয়ে থাকত বাবা। আর টিয়া এক ছুটে এসে উঠে পড়ত কোলে।
দরজায় এসে দাঁড়াতে চমক। পিয়ানোর উঁচু টুলে বসে… কে ও? মম ?
আকাশনীল লম্বা গাউন, মাথায় চুলের বল… না না, বল না… জুড়া। খোঁপা। বাবা খুব ভালবাসত, মা লম্বা চুল পাকিয়ে নিয়ে মাথার ওপর অমন জুড়া খোঁপা বেঁধে রাখুক।
কিন্তু মমের চুল তো ঘাড় পর্যন্ত… পরশুই তো ইন্সটাগ্রামে ছবি পোস্ট করেছে সেন্ট অ্যান্টোনে থেকে। অস্ট্রিয়ার হলস্ট্যাট আল্পসে বসন্তের সময় গিয়ে থেকে অস্ট্রিয়ার প্রেমে পড়েছে মম। এবার অস্ট্রিয়ার সামার, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। স্বরভস্কি ক্রিস্ট্যালওয়েলটন থেকে একটা লকেট কিনেছে টিয়ার জন্যে, তার ছবিও পোস্ট করেছে।
‘রাগ গঙ্গা। যোগেশ্বরী আর কলাবতী রাগের মিশ্রণে এই নতুন রাগ সৃষ্টি করা হয়েছে ইন্ডিয়ায়। কি সুন্দর, না?’
হৃদয়ের গভীর হতে উত্সারিত সৃষ্টি, যে সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টা নাড়ির টান অনুভব করেন, যেখানে সৃষ্টি-স্রষ্টা মিলেমিশে একাকার হয় আত্মিক বন্ধনে, তেমন এক সৃষ্টি। ইন্ডিয়ার সন্তুর-সুলতান পণ্ডিত তরুণ ভট্টাচার্যের তৈরি নতুন রাগ ‘গঙ্গা’।
কথার আওয়াজে বাজনা থামিয়ে মুখ ফেরালো আকাশনীল গাউন। হাসিমুখ। ভেতর থেকে চমক! মম! এখনকার মম নয়, টিয়ার ছোটবেলার মম। সেইরকমই গলায় একটা লম্বা স্কার্ফ। না না, স্কার্ফ নয়, চুনরী। ওড়না। গাউন নয়, এই ড্রেসটাকে ঘাঘরা বলে বোধহয়।
‘হেল্লো টি, কাম ইন সুইটহার্ট।’ হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো মম।
দু’পা পিছিয়ে গেল টিয়া। মম, কিন্তু মম নয়। মমের মতো, কিন্তু…!!
ঝটিতি বাবার দিকে চোখ পড়ল। দু’চোখে ভালোবাসা, চিকচিকে আবেগ, এই দুটো চোখ খুব চেনা টিয়ার। পলকে সবটা পরিষ্কার।
নাইনটি সিক্স। পৃথিবীর প্রথম ক্লোনিং, ডলি। প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে ডলি নামের একটি ভেড়াকে ক্লোন করা হয়েছিল। তোলপাড় হয়েছিল বিজ্ঞান গবেষণায়। সাত বছর পর ফুসফুসজনিত অসুখে মারা গেছিল ডলি।
সেদিন বাবার চোখে এই আবেগ দেখেছিল ছোট্ট টিয়া।
ডলি দিয়ে শুরু। ভেড়ার পর কুকুর, বিড়াল হয়ে একে একে এগিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে প্রাইমেট অর্থাৎ দুই হাত-পা ও দু’টি চোখবিশিষ্ট প্রাণীর ক্লোন তৈরি সম্ভব হল। জন্ম নিয়েছে ঝোং ঝোং আর হুয়া হুয়া। মিষ্টি চেহারার খুদে বাঁদরদের চেহারা ভাইরাল হয়েছে। ইন্টারনেটে দেখেছে টিয়া, টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনা শুনেছে কত।
ক্লোন, একজন মানুষের কপি করা আরেকজন মানুষ। পৃথিবীর প্রথম মানব-ক্লোন একটি মেয়ে। তার নাম ইভ। রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় জন্ম হয়েছিল এই মানবশিশুর।
মানব ক্লোনি। মম, বাবার ভালোবাসার সুহানা। পাগল প্রেমিক নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রেমে পাগল লোকটা একজন প্রতিভাধর জেনেটিক্স-বিজ্ঞানীও বটে।
ক্লোন প্রাণী কি জন্ম থেকেই বুড়ো? তাদের বয়স কি অন্যদের মতো স্বাভাবিকভাবে বাড়ে না? এই প্রশ্নগুলো বিজ্ঞানীদের ধাঁধায় ফেলেছে। ছয় সাড়ে ছয় বছরের মাথায় ডলি এক ধরনের ফুসফুসের রোগে মারা যায়। আরও জানা যায় যে ডলির অস্টিও আর্থ্রাইটিস হয়েছিল, যে রোগ ছয় সাত বছরের ভেড়াদের হওয়ার কথা নয়। হয়ত ডলি যে ডিএনএ থেকে তৈরি, সেই ভেড়াটির এই অসুখ ছিল। তার মানে, কিছু কিছু বয়সঘটিত স্মৃতি কোষের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হয়ে যেতে পারে।।
ঠিক যেমন হয়েছে এই মম, ক্লোনি-মম সুহানার। সেই ছোট্টবেলার টিয়ার মম। কে জানে এই মমের বয়স বাড়বে কি না। বয়স বাড়লে বাবার পছন্দ না হলেও চিন্তা নেই। আবার একটা সুহানা তৈরি করে নেবে বাবা।
মমের ডিএনএ কেমন করে নিল বাবা? তাহলে কি টিয়ার অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে এসেছিল বাবা? এ বাড়ির চাবি দেবার সময় কিংবা বাড়ির সেল-ডীড দেবার সময় কিংবা এমনিই? তখন হয়তো বা কাছাকাছি এসেছিল দুজনে। হয়তো মায়ের একটা হেলথ চেক-আপ করাতে নিয়ে গেছিল বাবার চেনা ল্যাবে। ডাবলিনে টিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসে যেমন টিয়াকে হেলথ চেক-আপে নিয়ে গেছিল বাবা, খুব কাশি হচ্ছিল সেদিন যখন।
হঠাৎ ভেতর থেকে শিউরে উঠল টিয়া। কে জানে ওপরের ঘরে, ছোট্ট টিয়ার ঘরে আরেকটা ছোট্ট টিয়া বার্বি ডল নিয়ে খেলা করছে কি না। সব হারানো বিজ্ঞানী নিজের ভালোবাসার সংসার গড়ে নিয়েছে এইভাবেই। প্রেয়সীর কাঁধে হাত রেখে এদিকেই চেয়ে আছে বাবা। হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে হারিয়ে যাওয়া মম।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ ভরে জল এল টিয়ার। পা দুটো ভারী হয়ে আছে, এক পা ফেলে এগোবার ক্ষমতা নেই যেন।
দরজা ধরে দাঁড়িয়েই রইল টিয়া। একলা একলা।
Tags: অঙ্কিতা, আইভি চট্টোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা
বাহ, খুব সুন্দর মানবিক গল্প।