কল্পবিশ্ব ইভেন্ট – ১০০ বছর পরের কলকাতা!
লেখক: রূপসা ব্যানার্জী, শিল্পী রয় বসু, ঋজু গাঙ্গুলী, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সৌম্যজিৎ দেবনাথ, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়, সুবীর মণ্ডল, দিগন্ত ভট্টাচার্য
শিল্পী: অন্তর্জাল
১০০ বছর পরের কলকাতা
রূপসা ব্যানার্জী
“তার মানে তোরা শেষ পর্যন্ত যাচ্ছিস? অত বারণ করলাম, কিন্তু শুনলি না। এইটুকু মেয়ে সবাই… গার্জেন ছাড়াই গোয়া বেড়াতে চললি? আর তোদের মা বাবাও যে কেন ছেড়ে দিচ্ছে, বুঝিনা বাপু।“…. বেশ রাগ রাগ মুখে কথাটা বললেন অতিবৃদ্ধা জয়িতা দেবী।
তাঁকে জড়িয়ে ধরে বড় নাতির মেয়ে দিয়া বলে উঠল– “আমাদের তো আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেছে বড়দিদু! আমরা তো আর ‘এইটুকু‘ নই। বন্ধুরা মিলে একটু আনন্দ করে আসি….”
জয়িতা দেবী বললেন – “তোদের ভয়ডর নেই? দুনিয়াটা যে খারাপ লোকে ভর্তি!”
খিলখিল করে হেসে ওঠে দিয়া– “তুমি তো আর নিউজ আপডেট দেখো না, তাহলে আর জানবে কি করে?”
“না বাপু…আমি ওসব দেখিনা। আগে খবরের কাগজ পড়তাম, ভালো লাগত। কিন্তু এখন ওসবের তো আর চল নেই। স্মার্টফোনেই খবর পড়ে সবাই। আমার ওসব পোষায় না।“….আরো রেগে গেছেন জয়িতা দেবী।
“আচ্ছা, আমি বলছি শোনো…. আমরা, মানে এই যুগের মেয়েরা পোষাকের ভিতরে প্রোটেকশন চিপ ব্যবহার করি। কারো স্পর্শ যদি আমাদের মনে তীব্র বিরক্তি ও ঘৃণার সৃষ্টি করে, তাহলে নিজে থেকেই ঐ চিপ অ্যাক্টিভেটেড হয়ে যাবে। তারপর? হাই ভোল্টের ইলেকট্রিক শক্ খেয়ে সেই রাবণ বা দুঃশাসন একেবারে ….হাঃ হাঃ হাঃ“… আবার হেসে ওঠে দিয়া।
এবার জয়িতা দেবীর মুখেও হাসি ফোটে। ছেলেমানুষের মতো বলে ওঠেন – “ইস্… আমরা যদি এমন জিনিস পেতাম! তাহলে আর এমন করে ভয়ে ভয়ে চলতে হত না। কিন্তু তোরা যখন পেয়েছিস…. তখন প্রাণ খুলে আনন্দ কর… তোদের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের না পাওয়া গুলিকে পেয়ে যাব।“
কলকাতা ২১১৭
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য
“বন্ধুরা। বেটেলজুসের প্রতিটি শহরে যে নারকীয় শ্রেণীবৈষম্যের স্বাক্ষর রেখেছেন সেখানকার স্বৈরাচারী সরকার আমরা এইমহামিছিলে তার প্রতিবাদ করছি। কলকাতার হিউবট ছাত্রসমাজ সেখানকার অত্যাচারিতদের প্রতি নিবিড় সমর্থন জানিয়ে আজ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে কলরব তুলেছে একদিন তা এই কোয়াড্রান্টের সমস্ত বসতিতে গর্জন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। যতদিন না এর প্রতিকার হচ্ছে ততদিন, ভিসির চক্রান্তকে ব্যর্থ করে ক্লাশ বয়কট করুন। হাজারো আলোকবর্ষ দূর থেকে আমরা আমাদের অত্যাচারিত কমরেডদের সাহস জুগিয়ে বলতে চাই-‘বন্ধু, পাশে আছি।’”
*****
“যতসব ননসেন্স। আমরাও একসময় ছাত্র ছিলাম। কিন্তু এরকম ইমপ্র্যাকটিকাল, সুইসাইডাল বস্তু ছিলাম না। আর তোদেরও বলিহারি যাই। একটা প্যাংলা মেয়ে দলবল নিয়ে স্কাইওয়ে বন্ধ করে চিল্লিয়ে গেল, তুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিতে পারলি না? কি যে পুলিশে চাকরি করিস!”
“ধীরে বন্ধু। ওটা কে জানিস? জ্যোতিবটুর নাতনী। ওর বাপ গ্লোবাল কাউন্সিল থেকে এবার হিউবটদের রিজার্ভ সিটে শিওর সোলার কাউন্সিলে যাচ্ছে। মেয়েকে পলিটিক্সে হাতেখড়ি দিচ্ছে। আমাদের ওপর ক্লিয়ার অর্ডার ছিল— যাক গে ও কথা। ডেমনস্ট্রেশানটাকে ফলো করবার সময় একটা পোস্টমডার্ন কবিতা লিখেছি। পড়ি শোন-”
“তোমার হরিণসাদা চুলে
প্লাজমাচাবুক—স্মৃতিকথা খসে পড়ে
কলকাতার কালাতীত সিংগুলারিটিতে—
কবিতার পংক্তিরা রাত্রের বাতাসে ভেসে যায়। পুলিশের গাড়িটা অটোপাইলটে রাত্রের বাতাসে ভেসে যায়।
নীচে অন্ধকারে কেউ একটা চেল্লাচ্ছে। মেয়েছেলের গলা। স্ক্যানারে লাইফসাইনটাকে ঘিরে তিনটে মেল রোবট। ড্রামিক কবিতা পড়তেপড়তেই সেনসর অ্যারে অফ করে দিল। মরুক গে যাক। এত রাতে মেয়েছেলে একা রাস্তায় ঘুরবে আর সব দায় বুঝি পুলিশের, অ্যাঁ?
১০০ বছর পরের কলকাতা
ঋজু গাঙ্গুলী
কৃত্রিম আলো আর ভারী ধাতুর ধুলোয় কমলা রঙা আকাশ থেকে একটা ডাইভ দিয়ে নিচে নেমে দরজার সামনে পৌঁছলেন অমিতবাবু। খয়েরি ডানাটা সযত্নে গুটিয়ে শরীরে লেপ্টে নিলেন তিনি।
হাত–পা‘র যা অবস্থা তাই দিয়ে কিছুই করা যায় না, তাই দরজা খোলার জন্য স্ক্যানারে চোখটা লাগাতেই হল। চিন্তার সঙ্গে এদিক–ওদিক দেখছিলেন অমিতবাবু। আজকাল মাটিতে নামলেই চিন্তা হয়, কে কোত্থেকে এসে কী করে দেয়…
দরজাটা খুলে গেল। ভেতরটা বেশ মোলায়েম অন্ধকার, ভেজা–ভেজা, ঠিক যেমনটা এখন চান অমিতবাবু।
ঠিক তখনই একটা রোমশ হাতের ছোঁয়া পেলেন অমিতবাবু। প্রায় আর্তনাদ করেই উঠেছিলেন তিনি আর একটু হলে, কিন্তু তারপরেই ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল।
লাবণ্য হাসি–হাসি মুখে লেটেস্ট ফ্যশনের লালচে–কালো পোশাকটা জড়িয়ে চোখ নাচালেন অমিতবাবুর উদ্দেশে।
পলিউশনে রাস্তার যা অবস্থা, তাতে বারমুখো পুরুষদের আরশোলা না হয়ে উপায় কি?
আর এত প্রগতি–অগ্রগতির মধ্যেও দশভুজা হয়ে কাজ করতে হলে মহিলারাই বা মাকড়সা না হয়ে যান কোথায়?
১০০ বছর পরের কলকাতা
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
বেশ খানিকক্ষণ ধরে বিপনির নিয়ন লাইটের নীচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল অর্পন। মরমী কখন আসবে – তার দীর্ঘ প্রতীক্ষা। গরমটা বড্ড বেড়েছে আজকাল। সমুদ্র আগের থেকে এগিয়ে আসায় আদ্রতা হয়ে পড়েছে মাত্রাছাড়া। বার বার রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছিল অর্পন। উফফফ – মেয়েটা কি যে করছে!
কখন বেরিয়েছে – আসতে এত সময় লাগার তো কথা নয়। এতো ঠাকুরদার মুখে শোনা গলিঘুঁজি সর্বস্ব কলকাতা নয় – এ রীতিমতো শহরের মধ্যে দিয়ে থ্রি লেনের মসৃন রাস্তায় মোড়া কলকাতা।
অর্পন শুনেছে, যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে এক সময় কলেজ স্ট্রীট বলে বই এর একটা আড়ত ছিল। এখন সে সব গল্পকথা। প্রিন্টেড বই মোটমাট উঠেই গেছে প্রায়। সমস্ত প্রকাশনী লাটে উঠে গিয়ে এখন আছে একটাই – ফেসবুক প্রকাশনী। এটি কালে কালে এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, যে বাপের আমলের পত্রভারতী, আনন্দ সবাইকে গ্রাস করে নিয়েছে পুরোপুরি। আর হবে নাই বা কেন – এককালে লোকে ফেসবুকে লিখে লিখে এমন হাত পাকিয়েছিল যে লেখক কবিরাও ফেসবুকেই তাদের সাহিত্যের ফুল ফোটাতে থাকল। লেখা লেখি সব নাকি ফেসবুকেই প্রকাশিত হত – সেই সব দেখে ফেসবুকের বর্তমান সি ই ও, র্যাচেল জুকেরবার্গ নাকি একটা প্রকাশনী সংস্থাই খুলে ফেললেন! এখন সব অনলাইন। বইমেলা গেছে উঠে – এখন সেখানে আধুনিক গ্যাজেট মেলা হয়ে থাকে। বই টই তো এখন লোকে অনলাইনই পড়ে – অজস্ব অজ পাড়াগাঁয়েও নাকি ১ জিবিপিএস এর নেট কানেকশন! কিন্তু অর্পন খেয়াল করেছে, তার দাদু আজকাল বড়ই উদাস হয়ে থাকে – বাইরে নিয়ে বেরোলে ইতিউতি তাকিয়ে খালি কি যেন খোঁজে। হয়ত ঝাঁ চকচকে অট্টালিকার কোনের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া কোনো পুরোনো স্মৃতিকে হঠাত ফিরে পাবার অদম্য ইচ্ছেতেই।
সেই ফেসবুক বিপনীর বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে সে এখন। ঘন নীল রঙের লোগোটির তলায় একটা বইপাঠরত মানুষের ছবি। হাসি পেল অর্পনের – দুমলাটের বই কতদিন কেউ হাতে নেয়নি কে জানে। আজ বাসের টিকিট থেকে মুদির দোকানের ফর্দ সবই পেপারলেস। গত ত্রিশ বছরে কাগজ জিনিটাই লোপাট হয়ে গেছে। এতে গাছ হয়ত কিছু বেঁচেছে – কিন্তু দাদুর আমলের কিছু বই হাতে নিয়ে পড়ার যে আনন্দ সেটা অর্পন এই ই–বুকে কিছুতেই পায়না।
“কি ভাবছ এত?”
সম্বিত ফিরে পেল অর্পন। “কিছু না, একটু অতীত রোমন্থন করছিলাম!”
মিষ্টি হেসে মরমী দীঘল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাগ করেছ!”
অর্পন হেসে ফেলল – “একটু করেছি বটে। তবে ছাড় – যেটা আনতে বলেছিলাম এনেছ?”
মরমী এদিক ওদিক চেয়ে বলল, “হুম। তবে এখানে বার করা যাবে না। লোক দেখবে। কলেজ স্কোয়ারে গিয়ে বসি চল।“
কলেজ স্কোয়ার এখন একটা ছোট্ট পার্ক। দাদুর কাছে শোনা এখানে নাকি আগে একটা বড় জলাশয় ছিল, সেটি এখন এক পুঁচকে কৃত্রিম পুকুরে পর্যবসিত হয়েছে। সেই পার্কের এক কোনে বসে মরমী ব্যাগ থেকে বের করল সেই মহার্ঘ্য বস্তু – একফালি সাদা কাগজ। না না, টিস্যু পেপার নয় – বকের পালকের মত সফেদ কাগজ।
“নাও এবার কি করবে বল দেখি এটা নিয়ে?” মরমীর আয়ত চোখে জিজ্ঞাসা।
“একটা কবিতা লিখে তোমায় দেব।“
খিল খিল করে হেসে উঠম মরমী -“সে তো অনলাইনেও করতে পারতে, আর সেটা অনেক টেঁকসই হত! এ কাগজ তো নষ্ট হয়ে যাবে!”
“হোক নষ্ট – পৃথিবীতে সব কিছুরই ক্ষয় আছে। জানো মরমী, আমার প্রপিতামহের বহু পুরানো কিছু আসবাব বাবা বের করেছিল। তাতে দেখেছিলাম, তাঁর হাতে লেখা একটা চিঠি, মনে হয় আমার প্রপিতামহী কে লেখা। সেটা হাতে নিতেই কেমন ঝুরঝুরে হয়ে গেল। কিন্তু এমন একটা অনুভুতি দিয়ে গেল সেটা, যার তুলনা নেই। তাই তোমাকে এটা আনতে বলেছিলাম।“
এই বলে অর্পন লিখতে লাগল, তার দাদুর থেকে নিয়ে আসা পেন দিয়ে, গোটা গোটা অক্ষরে। সে জানে এ লেখা মুছে যাবে, কিন্তু অন্তরের অনুভুতিকে হাতের স্নায়বিক উত্তেজনায় পরিনত করে, কলমের ডগা থেকে বেরিয়ে আসা কিছু আঁচড় কাগজের ওপর ফুটে ওঠার অকৃত্রিম অভিজ্ঞতা থেকে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চায় না।
১০০ বছর পরের কলকাতা
সৌম্যজিৎ দেবনাথ
১
আজ বহুদিন পর ফের আমাদের বংশকুলজীটা খুলে বসেছিলাম। এক অদ্ভুত টান অনুভূত হয় এই অচেনা, অজানা অথচ স্বজন নামগুলির দিকে তাকালে। বাবার স্টাডিরুম থেকে আমার পূর্বপুরুষদের যা কিছু সৃষ্টিকর্মের খোঁজ পেয়েছি তার মধ্যে আমার প্রপিতামহের অবদান অতুলনীয়। শুনেছি তিনিও আমারই মতো অল্পবয়সে পিতৃমাতৃহারা হয়েছিলেন। আমাদের দুজনের নামের মধ্যেও বেশ মিল। এক তিনি বাদে আমাদের বংশের কেউ সাহিত্যচর্চা করেননি। আজ তাঁরই একটি লেখা পড়তে পড়তে মনটা কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। এই গল্পটি আমি আজই প্রথম পড়লাম। অবশ্য এটি ছাড়াও তাঁর লেখা আরও বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ স্টকে রয়েছে যেগুলি আমার এখনো পড়ে ওঠা হয়নি।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলা সাহিত্যে ‘ভবিষ্যতের কল্পজগত’ থিম নিয়ে লেখার চল ছিল বেশি। সমসাময়িক প্রযুক্তির অত্যাধুনিকতার স্রোতে মন ভাসিয়ে আমার প্রপিতামহও দ্বাবিংশ শতকের ভারত তথা বিশ্ব নিয়ে এই বড়গল্পটি লিখে গিয়েছেন। গল্পে বর্ণিত হয়েছে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং সেই কেমিক্যাল ও মডার্ণ নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ারের সমাপ্তিতে ভারতের অবিশ্বাস্য পরিত্রাণের কাহিনী। গল্পের ভাষা অতিমাত্রায় সরল, তাই বক্তব্যও বেশ সহজবোধ্য। কুলজীতে তাঁর নামের পাশে সাঁটানো রঙিন ছবিটার দিকে তাকালাম। আমাদের দুজনের মুখের আদলেও বড্ড বেশি মিল, সেটা আগেও আমাকে অবাক করেছে।
আমি গত পরশু অরুনাচল আইএএফ বেস থেকে কলকাতা ফিরেছি। আনন্দনগরীর তিলোত্তমারূপ প্রায় সর্বাংশে লুপ্ত। সরকারীভাবে যুদ্ধ থেমেছে তেরোদিন হল। সন্ধ্যায় এয়ারফোর্স কোয়ার্টারে বসে টেলিভিশনে রাজনৈতিক খবর দেখতে দেখতে মনের ধোঁয়াশা আরও যেন ঘনীভূত হল। বড়দাদুর দূরদর্শিতা আশ্চর্য তীক্ষ্ণ। শতাধিক বছর আগে লিখে যাওয়া কাহিনীর সঙ্গে আজকের বাস্তবের অদ্ভুত মিল। সেটা অবশ্য অবিশ্বাস্য হলেও অসম্ভব কিছুই নয়। কিন্তু যা চূড়ান্ত অসম্ভব ঠেকেছে তা হল গল্পে এস.এস.ডব্লিউ.সি–টেন ফাইটার জেটের উল্লেখ এবং এক ভারতীয় পাইলটের নেওয়া কিছু সিক্রেট ট্যাক্টিক্যাল সিদ্ধান্ত।
পুনর্জন্মের থিওরিকে অকাট্য যুক্তিতে চ্যালেঞ্জ করে আজ আমি আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে রাখছি। তবু এবিষয় বন্ধুমহলে জানাজানি হলেও হয়তো সত্যিটা উপযুক্ত প্রমাণ স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না। কারণ বড়দাদুর লেখাটি খাতায় কলমে লিখিতভাবে নেই আমার কাছে। সেটি সেসময়েই ডকুমেন্ট ফাইলে টাইপ করে লেখা হয়েছিল, কোনপ্রকার রেজিস্টার্ড সিগনেচার ছাড়াই।
২
কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে একটা জিঞ্জারেট বা জিঞ্জার স্টীক ধরালো সৃজন। গতকাল থেকেই গলাটা খুসখুস করছিলো ওর। এখন ঘড়িতে সোয়া বারোটা। বাড়ি ফিরে গিয়ে ভোট–টা দিয়ে ফেলতে হবে। এই প্রথমবার ভোট দেবে সৃজন। ইলেকশান কমিশনের থেকে বায়োমেট্রিক পাঞ্চিং কার্ড আর হাইপার–স্যাট্ ভোটিং মেশিন চলে এসেছে বাড়িতে। জিঞ্জারেটের ধোঁয়া টানতে টানতে মমতা ব্যানার্জী স্টেশানের বাইরে এসে দাঁড়াতেই সামনের স্ক্রিনে সে দেখল সুপারসনিক গ্যালোপিং–এ তিরিশ শতাংশ ছাড়ে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। আজকাল সৃজন সরকারি মেলগুলি খুব একটা মনোযোগ সহকারে পড়ে দেখে না। তাই এই অফারের মেলগুলিও নজর এড়িয়ে যায়। সময় নষ্ট না করে পে–ক্রেডিট–এ ঝটপট টিকিট কেটে নিল সৃজন।
মিনিট ছয়েক পর নারায়ণ দেবনাথ স্টেশানে এসে নামতেই শ্রাবন্তীর সঙ্গে দেখা হল সৃজনের। দুজনের বাড়ি একই ব্লকে। তাই একই সঙ্গে তারা তাদের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। শ্রাবন্তীও আজ প্রথমবার ভোট দেবে। সৃজন জিজ্ঞেস করলো –
– “তুই কোন পার্টিকে ভোট দিবি?”
শ্রাবন্তী গম্ভীরভাবে জবাব দিল –
– “তুই বুলেটিনগুলো খেয়াল করিস না?? একটু আগে পাপার সঙ্গে কথা হল। আজ সকালেই আমাদের ডিস্ট্রিক্টের ভোট পোস্টপন্ করা হয়েছে। অন্য কোন দিন হবে।”
– “হঠাৎ? কেন??”
– “কিছু পলিটিক্যাল গুন্ডা নাকি বেশ কিছু ফ্যামিলির বাড়িতে ঢুকে ভয় দেখিয়ে তাদের ভোটিং মেশিন নিয়ে নিয়েছে। তা নিয়ে বিরাট ঝামেলা, মারামারি, টি.এফ. ইত্যাদি। জাস্ট লাইক ওল্ড টাইমস্!!”
সৃজন একটু হেসে জিজ্ঞেস করলো –
– “কোন পার্টির গুন্ডা রে?”
– “রুলিং এর কিছু, অপোজিশানের কিছু!! অলয়েজ ব্যালান্সড্!!”
দুজনেই হেসে উঠলো। ফিফথ্ ব্লকে ঢোকার মুখেই শ্রী শ্রী ক্যারিশ্মানন্দ মহারাজের এক অমোঘ বানী বড় সাইনবোর্ডে টাঙানো রয়েছে।
“পরিধান বদল করো, সত্ত্বাকে পরিবর্তন কোরো না!!”
শতবর্ষ পরে…
সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
কলম –৩ সিরিজের অথরোবটটা অবেশেষে কিনেছে স্বপ্নিল। নিউরো – ফাজি ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল নিয়ে ওর আলগোরিদমগুলো সিম্যুলেট করে নিতে চাইছে এই বট কে দিয়ে। কাল – ২১১৭, খ্রীষ্টাব্দের নিরিখে, স্থান – বায়োস্ফিয়র ২ এর সাতাশ নম্বর ক্যাপসুল জনশ্রুতি আগে নাকি এই পুরো স্ফিয়র পরিচিত ছিল ‘ময়দান‘ নামে। তবে সেসব আগেকার দিনের কথা, মানে এই ৩ পি এইচ ওলা বৃষ্টি যখন পড়ত না আর মানুষজন খোলা আকাশের নিচে হেঁটে চলে বেড়াতে পারত। কলম কে একটা রচনা লিখতে দিল স্বপ্নিল। বিষয় : কলকাতা – আজি হতে শতবর্ষ আগে। কলমের ডাটা সেটে ফিড করা হয়েছে সেই সময়ের সাহিত্য, নিউজ ফিড, সিনেমা ফুটেজ যার সাইজ প্রায় ১০ এক্সা বাইট। মোটামুটি ১০০ টা হিডেন লেয়ারে ওয়েটগুলো ক্যালকুলেট হতে হতে এই ১ টিবি র্যাম এ আশা করা যায় ৫ ঘন্টায় লেখা শুরু হয়ে যাবে। গভীর রাতে কলম ৩ এর রাইটিং পেরিফেরালটা যখন প্রিন্ট শুরু করে স্বপ্নিল তখন স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে। এদিকে ধীরে ধীরে প্রাচীন বাংলা হরফে প্রিন্ট হয়ে যাচ্ছে।
‘আজব শহর ছিল একশো বছর আগের কলকাতা। তখনও ওদের ভাষায় প্রেম, মমতা এই আজব সব শব্দের প্রচলন ছিল। ………………………. ‘
১০০ বছর পরের কলকাতা
সুবীর মণ্ডল
উড়ুক্কু যানের গতি কমিয়ে নদির উপরে নিয়ে এলেন অমিয় বাবু। অমিয় বাবু যেখানে তার যান থামিয়েছেন তার পাশেই একটা কালো ডানাভাঙ্গা পরির মূর্তি। তিনি তারপর জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে নাতিকে বললেন, “এই দেখ এখানেই প্রথম দেখেছিলাম তোর ঠাকুমা কে। আর তারপর এইখানেই দেখা হত আমাদের। আর এই পরি ছিল আমাদের সেই স্বপ্নের দিনগুলোর সাক্ষী।”
বর্তমান শিক্ষায় শিক্ষিত নাতি বলল, “বার বার এখানে আসতে? সেতো অনেক সময়ের অপচয়। তোমরা খুব সময়ের অপচয় করতে দাদাই। সেই সময়টা যদি কাজে লাগাতে তাহলে কলকাতা আজ নদি হত না।”
ছোট করে একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে অমিয়বাবু আবার আকাশপথে পাড়ি দিলেন। শেষবারের মত জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, “ভাল থেকো ভিক্টোরিয়া। ভাল থেকো পরীরানি।” তারপর যানের গতি বাড়িয়ে দিলেন উপরের ভাসমান শহরের উদ্দেশ্যে। উপরে অপেক্ষা করছে এক অন্য কোলকাতা।
১০০ বছর পরের কলকাতা
দিগন্ত ভট্টাচার্য্য
শেমুর তার হলদেটে, বিবর্ণ তেরপলের থলে থেকে একটা মোটা কাগজের বাক্সমতো বের করল। তার চোখদুটো জ্বলছিল। একটা পিঁপড়ের বাসা পাওয়া গেছে ভেঙ্গে–পড়া মোটা–মোটা থামের মাঝখানের মাটি বেরিয়ে পড়া মেঝেতে। খাবার হিসেবে এগুলো অত্যন্ত দুর্মূল্য এবং দুর্লভ। ধরার সময় অবশ্য প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা পোকাগুলো একবার মুখ বসাতে পারলে আর রক্ষে নেই, আট–দশটার মিলিত কামড়ে তার পরিচিত কয়েকজন মরেও গেছে, কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। খেতে তো হবে!
মাটি খোঁচাতে– খোঁচাতে তার চোখ চলে গেল প্রাগৈতিহাসিক কঙ্কালের মত দৈত্যাকৃতি একটা ধাতব ধবংসাবশেষের দিকে যেটা একটা চওড়া শুকনো নীচু জায়গার ওপরে ওপরে দুমড়ে–মুচড়ে পড়ে আছে।
তার ঠাকুদ্দার মুখে সে শুনেছিল এখান দিয়ে নাকি অনে–ক জল বয়ে যেত অনেককাল আগে। জল। কয়েকবোতল জল চুরি করার জন্য গত মাসেই রিয়াদ দের বেস–এ চারজনকে মেরে ফেলা হল। সেই জল নাকি বয়ে যেত! আর তাতে মানুষ অব্দি নাকি ডুবে যেত!
ধুস্স, ঠাকুদ্দা মরার আগে ওসব ভুলভাল কত কথা বলেছে! তবে বুড়ো এটাও বলত যে সেটা ছিল এই জায়গাটার ওপরে সূর্য ফেটে পড়ারও আগে। তখন নাকি সবকিছুই আলাদা ছিল! তার মনে পড়ে, ঠাকুদ্দা বলেছিল এখানে যখন অনে–ক জল ছিল, শেমুরের আদৌ বিশ্বাস হয়না যদিও, লোকে নাকি সেটাকে ‘গঙ্গা’ বলে ডাকত। কি অদ্ভুত নাম! ঠাকুদ্দা ভেবে–ভেবে বেরও করত বটে!
সে অন্যমনস্কভাবে একটা পিঁপড়ে মুখে পুরে চিবোতে লাগল।
১০০ বছর পরের কলকাতা
শিল্পী রয় বসু
প্রথম তরঙ্গ
আজ সাইট্রোর ১০ বছরের জন্মতিথি উদ্যাপন হল। ল্যাক্টক মলে সকলের সামনে সে উপহার হিসেবে নিজেকে মানুষ থেকে অ্যান্ড্রয়েডে রূপান্তরিত করল।
দ্বিতীয় তরঙ্গ
লেলিহান তার মায়ের সাথে দূর্গাপুজোতে ঠাকুর দেখার জন্যে তাদের গড়িয়াহাটার বাড়ীর এলিকোদ্রোমিও থেকে হেলিক্সে চেপে বসল। সেটা উড়তে শুরু করা মাত্র আকাশের তারাগুলোর চারদিকে একেকটা করে মহাকাশযান থেকে একেকটা দেবীপ্রতিমা ও মহিষাসুর বেরতেই তারা মহিষাসুরমর্দিনীকে দেখতে পেতে লাগল।
তৃতীয় তরঙ্গ
প্রায় চার দশক পরে সারা কলকাতা জুড়ে অসময়ে এরকম ইলিশে–গুঁড়ি বৃষ্টি নেমেছে। প্রভূত ও প্রভৃতি ইলেক্ট্রোপের কাছে খিচুড়ি – ইলিশ মাছ ভাজার বায়না ধরল। ইলেক্ট্রোপ তাদের বাড়ীর সহায়ক–সাইবর্গ।
তাদের রসনায় এইসব স্বাদ অতৃপ্ত রয়ে গেছে। প্রভৃতি কয়েক হপ্তা আগে তার এক বন্ধুর বাড়ির স্পেস–টাইম পুঁথিভাষে এমন এক খাবারের পাক–প্রণালীর চলচ্চিত্র দেখে এসেছে।
ইলেক্ট্রোপ পড়ল মহা মুস্কিলে! সে ইতিমধ্যেই তার সমস্ত এক্সটার্নাল এবং ইন্টারনাল মেমরী ঘাঁটা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কই, কিছুই তো খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে সমস্যাটা হচ্ছে উপাদানগুলোই তো লুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষের পাচনতন্ত্রের হঠাৎ এমন এক বির্বতন ঘটে গেছে যে কলকাতার মানুষের সেই প্রিয় ইলিশই এখন তাদের জন্য গরলসম। খিচুড়িটা কোনো রকমে নেমে যাবে এখনকার কিছু উপাদানের মিলমিশে। কিন্তু বাচ্ছাগুলো তো “ইলিশ মাছ ভাজা – ইলিশ মাছ ভাজা” করেই মাথা খারাপ করে দিচ্ছে প্রধানত।
“কি করা যায়” ভাবতে ভাবতে হঠাৎই প্রচণ্ড জোর একটা ‘ঘটাং‘ আওয়াজে ইলেক্ট্রোপের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আরে মাসখানেক ধরে তো সে একটা যন্ত্র নিয়ে কাজ করছে। নাম দিয়েছে “ভারলিয়েডে“। নেহাতই রাতে জেগে সময় কাটানো আর কি! তবে সেটা এখন মোটামুটি কাজ করছে বলেই মনে হয় – সেটা সম্পূর্ণ তত্ত্বভিত্তিক ধারণা কোনো ব্যবহারিক কাজে প্রয়োগ করে দেখার সুযোগ বা প্রয়োজন কোনোটাই আসেনি। ইলেক্ট্রোপ বুঝল এটাই পরীক্ষার সবচেয়ে অনুকূল সময়।
যন্ত্রটা একটা আয়তাকার পরাবৃত্তাকৃতি যার খোলা মুখটায় একটা উত্তল ডিজিটাল পর্দা বসানো আছে। একটা বেশ বড়ো ও অদ্ভুত খাঁজ আছে নীচের দিকে যেখানে দুটি সীমারেখ মিশেছে। পর্দায় শুধু একের পর এক বেগুনী আলোর রেখা চলছে সমান্তরালে। পুরো যন্ত্রটাকে ঘিরে রয়েছে শনির বলয়ের মতো পাত্লা–চ্যাপ্টা কিছু আলোর বৃত্ত একে অন্যের সাথে বিভিন্ন কোণে আন্ত হয়ে। পরাবৃত্তাকৃতি খোলটা প্ল্যাটিনাম–ইরিডিয়মের তৈরী। আর ভেতরটা অপটিক্যাল ফাইবারের জটিল – জটলা। রিমোট বা ম্যানুয়াল, দুভাবেই চালিত। কিন্তু প্রথম ব্যবহারে সে রিমোটটার কার্যকারিতা নিরীক্ষ্ণ করতে চাইল, না চললে ম্যানুয়াল তো আছেই।
বোতামগুলো আস্তে আস্তে থেমে থেমে বানান মিলিয়ে টেপা শুরু করল। পর্দায় সব অদ্ভুত ডিজিটাল সঙ্কেতের সাথে পোড়ো বাড়ীর সারি ও উত্তাল ফেনিল জলরাশি দেখা দিল। বদলাতে লাগল যন্ত্রের আলোর বলয়ের রঙ, ও ঘূর্ণণ কোণ – খুব দ্রুত।
অদ্ভুত শব্দ ও কম্পনের সাথে প্রায় মিনিট দুয়েক ধরে যন্ত্রটা ০ – ৩৬০ র মধ্যে বিভিন্ন কোণে ঘুরে যখন থামল তখন ইলেক্ট্রোপের ছোট্ট গবেষণাগার জলে থই–থই করছে, আর সেখানে অসহায় ভাবে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে কিছু অদ্ভুত রূপোলী রঙের মাকুর আকৃতি জীব যেরকমটা সে আগে কখনো দেখেনি।
সেদিন অবশ্য প্রভূত–প্রভৃতির মধ্যাহ্নভোজটা বেশ ভালোই হয়েছিলঃ দিনের শেষে প্রভৃতি ই–ডায়েরীতে লিখতে ভোলেনি যে যদিও তাকে এর জন্যে বেশ কয়েকটা ইন্জেক্শন নিতে হয়েছিল আর ছুঁচে তার প্রচণ্ড ভয়, কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও জীবনের সবচেয়ে ভালো খাওয়াটা সে সেদিনই খেয়েছিল।
Tags: অন্তর্জাল, ঋজু গাঙ্গুলী, কল্পবিশ্ব ইভেন্ট, দিগন্ত ভট্টাচার্য, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, বিশেষ আকর্ষণ, রূপসা ব্যানার্জী, শিল্পী রয় বসু, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবীর মণ্ডল, সৌম্যজিৎ দেবনাথ
সব কটি লেখা তে পরিনত মুন্সিয়ানার লেখচিত্র দেখতে পেলাম । কিন্তু একশো বছর পরে উষ্ণায়নের দরুন জলোচ্ছ্বাসের ফলে কলকাতার কি হতে পারে সেই বাস্তব চিত্র তা নিয়ে কেউ কিছু লেখেন নি এটা দেখে আশ্চর্য লাগলো ।
Correct