কাঁঠালতলা
লেখক: যশোধরা রায়চৌধুরী
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
২০৬৫ সালে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধর তৃতীয় দিন ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হল। অতীতে। ১৮৬৫ তে।
ওরা চার ছেলেমেয়ে। মিস্টার ও, মিসেস ও, দুজনেই ঘন্টাখানেকব্যাপী হাইড্রোজেন বিস্ফোরণে অক্কা পেয়েছেন। প্রাচীন যুগের ভাষায় বললে, ওঁদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল।
চার বাচ্চা, ক খ গ ঘ। কমলকলি, খগেন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ আর ঘৃতকুমারী। এমন নাম এই প্রথম শুনে হেসে কুটিপাটি হল ক খ গ ঘ। নিজেদের নাম নিজদেরই মুখস্ত করতে বলেছে হাইকমান্ড।
বাবা মায়ের মৃত্যুতে দুঃখ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এরকম হচ্ছে, ওরা আগেও দেখেছে। জ্যান্ত মানুষকে একদিন ক্যাপসুলের মত বাক্সে ভরে নম্বর লাগিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তবে ওদের মাথায় তখন নতুন অনেক কিছু ঘুরছে। প্রথমতঃ, নতুন জায়গায়, থুড়ি – নতুন সময়ে যাওয়ার কৌতূহল। তার ওপর বিটকেল সব নাম পাওয়ার উৎসাহে ওদের সব দুঃখ হাওয়া। কেননা শিশুদের কাছে তাৎক্ষণিক বাস্তবটাই সত্যি। তারা বেশিক্ষণ মনমরা হয়ে থাকতে পারে না। তাছাড়া হাইকমান্ড তো ছোট থেকেই বাবা মায়ের থেকে শিশুদের আলাদা করে বড় করে তুলেছেন। আর, কে না জানত যে বিশ্বযুদ্ধ লাগবে। তাই প্রস্তুতিও ছিলই।
নতুন জামাকাপড়, নতুন নাম, নতুন কিছু জিনিসের সঙ্গে পরিচয়। সবচেয়ে বড় কথা ভাষা। কত যে নতুন শব্দ!! শেমিজ শিখল, শেজবাতিও। দেরাজ শিখল, তাকিয়া শিখল। একটা দুটো অদ্ভুত খেলাও শিখল। ঘুড়ি ওড়ানো। দোলনা দোলা। এগুলো সব বইতে পড়া। এবার সত্যি সত্যি করে দেখার সুযোগ পাবে।
সব চেয়ে বড় কথা, পাবে ট্রান্সপোর্টার, মানে সময় সারণীতে চাপার সুযোগ। দিব্য!!
বাবা আর মা ও সেদিন ওপরে হাওয়া খাচ্ছিলেন কেন কে জানে। হাইকমান্ড বলেই দিয়েছিল মাটির তলার বাংকারে সবাইকে চলে যেতে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসছে তা গত তিন বছর ধরে সবাই জানে। মাটির তলার বাংকারে আগামী দশ বছরের উপযোগী খাবার, জল, খাবারের বিকল্প নানা ধরণের ট্যাবলেট থেকে শুরু করে, কী নেই! সব জোগাড় করে হাইকমান্ড যুদ্ধ লাগার জন্য অপেক্ষায় ছিল। কাজেই দিন কতক আগে থেকেই সবাই জড়ো হয়েছিল শহরের নিচের ওই দ্বিতীয় শহরে।
বাচ্চারা ওপরের ইশকুল ছেড়ে নিচের ইশকুলে যাচ্ছিল মাসখানেক ধরেই। শিক্ষকরা পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিরোধী জামাকাপড় পরে, ওপরের ইশকুল থেকে বাচ্চাদের ঘেঁটি ধরে ধরে নিচের ইশকুলে টেনে আনছিলেন।
আর, হাইকমান্ডের নির্দেশ মত, ১৮৬৫ সালের ভাষা শিক্ষা দিচ্ছিলেন। ঠিক করাই ছিল, যে, সব শিশুদের সময়সারণী নামক সুবিশাল সময়যানে চাপিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ১৮৬৫ তে। শ্রীযুক্ত ও তাঁর স্ত্রীর ডি এন এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে, শ্রীমতী ও–র দুই পিসিমার বাড়ি পাঠান হল ওঁদের। বেশি দূর নয়। মাত্র দুশো বছর দূর। স্থান ভেবে দেখলে এপাড়া ওপাড়া।
মস্ত বড় বাগানঘেরা বাড়ি। জমিদার বলে কথা। খগেন্দ্র গগনেন্দ্র ধুতি পরতে গিয়ে নাকাল হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চোগা চাপকান পরতে দিতে রাজি হয়েছিলেন হাইকমান্ড। দুই মেয়েকে লম্বা ঝুলের গাউন বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বড় জন শেষ মেশ পৌঁছেই শাড়ি পরে ফেলল দিদাদের দেখাদেখি।
বাড়িটা কী অপূর্ব। লাল শানবাঁধানো মেঝে। ঘরের সংখ্যা অগণ্য। ম্যাপ আগেই মুখস্ত করানো হয়েছিল। সার সার ঘরের মধ্যে এক একটায় ভারি সুন্দর সব আসবাব দিয়ে সাজানো।
এই ত সেই বইতে পড়া পালংক। এই ত সেই বালিশ। এই ত সেই ঝালর দেওয়া পাখা।
দুই পিসিমার বয়স হয়েছে। একজনের চুলে পাক ধরেছে, অন্যজনের নাকের ডগায় চশমা।
ওঁদের যাতে বেশি চমক না লাগে, হাইকমান্ড হলদেটে পুরু তুলোট কাগজে খাগের কলমে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিল। “ইহারা বহুদূর হইতে আসিয়াছে, অনাথ শিশুদিগকে ভালবাসিয়া আপন করিয়া লইবেন। পিতৃমাতৃহীন। ইহাদের আর আপনাদের শরীরে একই রক্ত। ইতি হতভাগিনী অং বং চং”। হাতের লেখা পড়তে পারেননি বিধুমুখী। হেমনলিনী বললেন, “আহা রে, বাছাদের মুখ একেবারে শুকিয়ে গেচে গো। আয় বাছারা, আয়। আগে মুখে কিছু দে।”
তারপর লোভনীয় খাবার আসতে শুরু করল একের পর এক। শুনতে পেল পুকুরে নাকি জাল ফেলা হয়েছে। দৌড়ে দেখতে গেল সে কান্ড। আহা। ওই ত সেই বইতে পড়া মাছেরা। কেমন জ্যান্ত। ছটফট করে লাফিয়ে উঠছে।
এত সুখাদ্য ত ওরা খায়ইনি কোনদিন। এক থালায় সব ভাত মেখে গোল গোল গরাস ভাগ করে রেখে ওদের দিচ্ছিলেন হেমনলিনী। কত আদর করে, যত্ন করে।
ওদের মনে হচ্ছিল, গত তিন সপ্তাহ শুধু ট্যাবলেট আর লিকুইড নিউট্রিয়েন্ট খেয়ে থাকার পর, এই গোল গোল খাবারের দলাগুলোয় কত যেন আরাম।
বাগানটা মস্ত বড়। ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে গাছ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন হেমনলিনী। বিধুমুখী ওদের সঙ্গে আসেন নি। ঘরের কোণে চোখে চশমা এঁটে বসে পড়ছেন ত পড়ছেনই। কেন যেন একদম বন্ধুত্ব করলেন না ওদের সঙ্গে। চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন। চাউনি যেন কেমন।
হেমনলিনী ঘর থেকে ওদের বের করে নিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় বললেন, শোন তোরা। বিধু পিসিমাকে জ্বালাসনি যেন। উনি একটু অন্যরকম কিনা?
তারপর আমগাছ দেখালেন। আম ডালে দোলনা বাঁধতে পারে ওরা। বললেন, আয় কমল আয় ঘৃত, এই যে শিউলিতলা। দেখ কত শিউলি ফুটে আছে। এইখানে তোরা পুতুলের বিয়েও দিতে পারিস।
পুতুল খেলেনি কখনো ওরা। ওদের হাতে এক বাক্স পুতুল ধরিয়ে দিলেন। বললেন এসব আমার ছোটবেলার পুতুল। কড়ির পুতুল। আর এই যে তার কাপড় চোপড়।
অনেক রঙিন কাপড়ের টুকরো, অনেক জরির কাজ করা সরু পাড়। সেসব নিয়ে কী করবে ভাবছিল কমল আর ঘৃত। একটু ঘাবড়ে গেছিল বইকি। তারপর কী মনে পড়তে, ঘৃতর লম্বা ঘের দেওয়া ফুল ছাপ জামার ভেতরের লুকনো পকেট থেকে ছোট ট্যাব বার করে একটু সার্চ করে দেখে নিল। পুতুলখেলা কাকে বলে।
অনেক ছবি পেল, মজার মজার নিয়মকানুন পেল। ও মা, ওদের কেউ বলে দেয়নি কেন, খেলাটা এমন মজার? ইশ। তাহলে আগেই খেলত।
পুতুল আর কোথায় পেত, তবে ছোট রোবটগুলোকে দিয়ে কাজ চলে যেত ঠিক।
বাগানের ঘোরাতে ঘোরাতে শুধু একটা দিকে নিয়েই গেল না পিসি। হঠাৎ কেমন যেন থমকে গেল। তারপর বলল, “ওদিকটায় কখনো যাস না কিন্তু। ওদিকে, ওই কাঁঠাল তলায়, বেম্মদত্যি থাকে। গেলেই ঘাড় মটকে দেবে।”
ঘুড়ি ওড়াতে, মাছ ধরতে, আম ডালে দোলনা বাঁধতে, মজাই লাগছিল খগেন গগনের। নিজেদের খগা গগা বলে ডাকাডাকিও করছিল। পিসির সামনে বেশি মুখ খুলতে চায়না অবিশ্যি। সেদিন আরেকটু হলেই ধরা পড়ে গিয়েছিল আর কী ওরা। ওরা যে ভবিষ্যত থেকে এসেছে তা ত আর পিসি বুঝবেন না। শেষে পাগল না ভেবে বসে।
এত করে শিখিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, পিসির পুষিবেড়ালকে চুষিবেড়াল বলে ফেলেছিল খগেন। ওমনি উল্টোদিক থেকে চোখ কটমট করে সাবধান করে দিয়েছিল কমলকলি। দিদি এখন ওদের দেখভাল করছে। ওরা ভুল বললে ঠিক করে দিচ্ছে। চালাক বলে চালাক ঘৃতকুমারী। কথায় কথায় আড়ালে গেলেই ট্যাব বার করে দেখে নেয়, ঠিক করে নেয় ভুল।
চট করে ভুল বলাটা ধরতে পারে না যে পিসি, সেটা বোধ হয় কানে কম শোনার জন্য। হেমনলিনী বলেই পার পেল। বিধুমুখীর চোখ দুটো বড্ড খরখরে। তাকানোটা বড্ড যেন হুল বেঁধার মতন।
সেদিন সবাই মিলে হেমনলিনীর সঙ্গে বিধুমুখীর ঘরেই ঢুকেছিল। একটা ছবির বই খুঁজছিলেন হেমনলিনী ওদের জন্য। বললেন, এ বই নাকি বিলেত থেকে আনা।
বইটা দেরাজ থেকে টানতে গিয়ে সঙ্গে হুড়মুড় করে আরো অনেক বই পড়ল। একটা বইয়ের ভাঁজে একটা লম্বা রঙিন কী যেন। সেটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল চার ছেলেমেয়ে। কী সুন্দর, কী সুন্দর। উফ বাবা। নীল আর সবুজের ঝিলিক দিচ্ছে। ঝালর ঝালর ওটা। মধ্যে চোখের মতন।
ও আচ্ছা। হেমনলিনী হাসিমুখে তুলে ধরলেন জিনিসটা। আগে দেখিস নি, না? এটা হচ্ছে ময়ূরের পালক। আমাদের বাড়িতে আসলে পোষা ময়ূর ছিল, বুঝলি ত!
শোনামাত্র ওপাশে বিধুমুখী বই পড়তে পড়তে হঠাৎ দুম করে বই বন্ধ করে তাকালেন। চোখ দুটো যেন ঝলসে উঠল। চশমা নামিয়ে রাখলেন, ছুট্টে এসে হেমনলিনীর হাত থেকে ময়ূরের পালকটা কেড়ে নিয়ে দুম দুম করে পা ফেলে বাইরে গেলেন। তারপর যতদূর পারা যায় ছুঁড়ে দিলেন। হাওয়ায় উড়ে গেল পালকটা।
হেমনলিনী বেজায় থতোমতো খেয়ে গেলেন অমনি। মুখ কালো হয়ে গেল ওঁর।
“ওরে চল চল, আজ গোবিন্দকে গরম গরম লুচি ভাজতে বলেছি। বেগুনভাজা আর আলুরদম দিয়ে জলখাবার করবি চল।”
বলে ওদের তাড়াতে তাড়াতে খাবার ঘরের দিকে চললেন। বাচ্চারা এ ওর মুখ তাকাতাকি করতে লাগল। ওরে বাবা। কী হয়ে গেল কে জানে।
সেই থেকে ময়ূরের পালকটা ওদের মাথার মধ্যে ঘুরছে।
আর ঘুরছে কাঁঠালতলা।
কাঁঠালতলায় কী আছে? কেন খালি খালি যেতে বারণ করে ওদের হেমনলিনী পিসি? কেন মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার?
ময়ূর নামের পাখির কথা ভাল করে ট্যাবে পড়ে নিয়েছে রাত্তিরে ওরা। সবাই মিলে ঝুঁকে পড়ে দেখেছে। ২০৩০ নাগাদ নাকি ময়ূর নামের পাখি অদৃশ্য হয়ে গেছে ভারতের বুক থেকে। পাখির অস্তিত্ব ছবিতে ছাড়া কোত্থাও নেই।
কাঁঠালতলার সঙ্গে ময়ূরের যেন একটা সম্পর্ক আছে। আছেই।
কাঁঠাল কাকে বলে সেটাও ভাল করে পড়ে নিয়েছে ওরা। কিন্তু ওই ফলটা উধাও হয়নি। আছে। তবে কম পাওয়া যায়। ফলটা রাখার কোন উপায় নেই শুকিয়ে ল্যাবেঞ্চুশ বানানো ছাড়া। এইটুকু জানে। কাঁঠাল ফ্লেভারের আইসক্রিম হয় না, এমনকি পুডিং বা জেলিও না। তাই ওই ফলটা ক্রমশ চাষ করাই কমে গেছে। এই কারণেই আজকাল আর দেখা যায় না।
কিন্তু ১৮৬৫ তে ত দিব্যি সকালবেলা কচি কাঁঠালের তরকারি খাওয়াল হেমনলিনী পিসি। তাহলে কাঁঠালতলার মধ্যে অত ভয় কিসের?
সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর, এক গাদা ইলিশ মাছ আর ভাত খেয়ে, হেম পিসি ঘুমিয়েই পড়ল। বিধুপিসিও দরজা বন্ধ করে কী যেন করছে। ওরা বাগানে ঘুর ঘুর করতে করতে টের পাচ্ছে, কাঁঠালতলাটা ওদের যেন টানছে। টানছে। টানছে।
পায়ে পায়ে ওরা কাঁঠালতলার দিকে চলল।
“ওরে কমল, ওরে খগেন গগন, ওরে ঘিতু মা! কোথায় গেলি রে তোরা?”
সন্ধের মুখে মুখে ঘরে ঘরে ধুনো দিয়ে, তুলসি তলায় প্রদীপ দেখিয়ে, হেমপিসি সারা বাড়ির কোত্থাও যখন ওদের খুঁজে পাচ্ছে না, তখনই তার বুকটা ধ্বক করে উঠল।
অনেক ডাকাডাকির পর, কী মনে হওয়াতে বিধুর ঘরে গিয়ে দেখল, বিধু নেই।
শুধু নেই নয়, বিধুর শাড়ি, শেমিজ পড়ে আছে মেঝেতে। কী সর্বনাশ। বিধু কি তবে ফিরে গেল!
গোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে, লন্ঠন আর বর্শা হাতে, ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে কাঁঠাল তলার দিকে চললেন হেম। হে ঈশ্বর, হে রাধামাধব, রক্ষা কর। বিপদ যেন না হয়। পই পই করে বারণ করা সত্ত্বেও ওরা যদি কাঁঠালতলায় গিয়ে থাকে। কী যে হবে!
দূর থেকে আসা শিশুগুলো বড় অবোধ, ওদের যেন ময়ূরগুলোর দশা না হয়।
পড়ি মরি করে কাঁঠালতলায় পৌঁছে দেখলেন… সার দিয়ে বসে আছে চারজন। কী যে করুণ সেই মুখ, সেই চেহারা। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বাস্তব ওরা যেন আজ দেখে ফেলেছে।
মাথায় হাত বুলিয়ে বাড়ি নিয়ে এলেন সযত্নে। কত বাবু বাছা করলেন, এক ফোঁটা দুধ কলা খই মাখা খাওয়াতে পারলেন না।
অনেক প্রশ্ন করার পর, টপ করে এক ফোঁটা জল পড়ল কমলকলির। সে বলল, “মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন হয় পিসি! ময়ূরগুলো ত কিচ্ছু করেনি, তাহলে কেন বিধুপিসি ওদের…”
ফোঁপাতে লাগল সে। আর কিছু বলতে পারল না।
হেমের চোখ বিস্ফারিত হল। তিনি বললেন, “ওরে তোরা যা দেখেছিস কাউকে বলিস না। কাঁঠালতলায় আসলে একটা ফাঁক আছে। ২০৩০ সালে, পরীক্ষা করতে করতে, একটা মারণ ওষুধ বানিয়ে ফেলে বিজ্ঞানী মিস বিছুটি বি বম্ব, আর সেই ওষুধ প্রয়োগ করতে গিয়ে একটা বোতামের চাপে গোটা দেশের সব ময়ূরকে নাশ করে। ওর এই কুকীর্তি যখন সব লোকের কাছে ধরা পড়ে গেল, তখন বিজ্ঞানীদের একটা মস্ত মিটিং হল। তাঁরা বললেন, আবার অতীতে ফিরে তোমাকে ময়ূর নিয়ে আসতে হবে। সেই জন্যে নিজের পূর্বপুরুষের ভিটেতে এসেছিল বিছুটি। বিধুমুখী নাম নিয়ে আমাদের বাড়িতে থাকতে থাকতে ময়ূরদের সঙ্গে ভাব করছিল। মতলব ছিল ওই কাঁঠালতলার ফাঁক দিয়ে আবার ফিরে যাবে। সংগে নিয়ে যাবে দু তিনটে ময়ূর। নিয়ে গেছিলও। কিন্তু তারপর আবার ফেরত আসে। কারণ জানতে পেরেছে ততদিনে ওর নামে শাস্তি ঘোষণা হয়েছে। প্রাণীদের বিলুপ্ত করার শাস্তি। কয়েদে থাকতে হবে।”
-“তাই এখানে এসে সব ময়ূরদের মেরে বিধুমুখী সেজে থাকত?”
-“থাকত মানে? এখন সে কোথায়? সেই ত, অনেক ক্ষণ দেখিনি তাকে। তোরা কখন, কী অবস্থায় দেখেছিস?”
-“আমরা ত তাকে ময়ূরের গলা পেঁচিয়ে মারতে দেখলাম, খুব ভয় পেয়ে গিয়ে চীৎকার করে ফেলেছিলাম, তাইতে বিধুপিসি হুশ করে দৌড়ে কোথায় যে গেল!”
– “হায় ভগবান, সে তবে আবার তার সময়ে ফিরে গেল বোধ হয়। কাঁঠালতলায় গিয়ে বার বার একই ঘটনা ঘটায় সে। ময়ূর ফিরে আসে আর সে ময়ূর মারে। সময়টা ওখানে আটকে গেছে কিনা। তার পাশেই ফাঁক, সেটা গলে ওদিকে যাওয়া যায়।”
-“ও তাই? আমরাও তাহলে ফিরে যেতে পারব?”
বলেই মুখ বন্ধ করে ফেলে ঘৃতকুমারী। কমলকলি চোখ পাকিয়ে আছে তার দিকে।
হেমনলিনী হেসে বলে, “তোদের সময়ের যুদ্ধ থেমে গেলে ওরা আমায় খবর দেবে। খবর পেলে আমিই নিয়ে যাব তোদের। আমার সময়যানটা ও ঘরে আছে।”
ঘরে এসে এই প্রথম হেমনলিনীর পুজোঘরে ঢোকে ওরা। পুজোর আসনটার দিকে দেখিয়ে হেমনলিনী বলেন, “এটাই ত সময়যান। আর ওইটা, ট্রান্সমিটার।”
একটা কালো গোল পাথরের মত জিনিস। ওরা ভেবেছিল ওটা সেই বইতে পড়া শালগ্রাম শিলা বুঝি! এখন ত চমকে অস্থির!
হেমনলিনী চোখ টিপে বলেন, আরে, আমিও ত তোদের সময় থেকে একবার ঘুরে এসেছি। হাইকমান্ড আমাকে ডেকেছিল। ট্রেনিং নিয়েছিলাম, “তোদের লুকিয়ে রাখব বলে। অ্যাক্টিং টা কেমন করলাম বল?”
লেখকের কথাঃ এই গল্পটি জেন রাইস এর গল্প দ্য উইলো ট্রি–র ছায়া অবলম্বনে রচিত।
Tags: অনুবাদ, অনুবাদ গল্প, কাঁঠালতলা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, যশোধরা রায়চৌধুরী
পুরো লীলা মজুমদারের স্বাদ পেলাম যেন। কে বলবে এই গল্প অনুবাদ!
besh laglo