কামিনী, তুমি কি মানবী?
লেখক: রণেন ঘোষ
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
চমকে উঠলাম। এ হাতের লেখা তো আমার অপরিচিত নয়। আমার নিজের লেখার মত একান্ত পরিচিত এর প্রতিটি অক্ষর। এতো আমার নিজের হাত ধরে শেখানো। আর তাঁর সইলো না। ছিঁড়ে ফেললাম খামটা। ধবধবে সাদা কাগজে ছোট্ট একটা চিঠি।
চণ্ডীপুর–অন–সী
উড়িষ্যা
কাকু,
অনেকদিন পরে তোমাকে লিখছি। ভেবেছিলাম আমি নিজে গিয়ে তোমাকে সব বলবো। ধরে নিয়ে আসবো। কিন্তু এ অবস্থায় এখান থেকে যাওয়া আমার উচিত হবে না। সুসান বারবার বলেছে তোমাকে আসার জন্যে। তোমাকে আমাদের বিশেষ প্রয়োজন। এক দারুণ রহস্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। তোমার সাহায্য ছাড়া আর কোন পথ নেই। কবে আসবে বলো। বালেশ্বর স্টেশনে আমার জীপ থাকবে। লাল রংয়ের। প্রণাম শেষে—
তোমার
মহাদেব
মহাদেব! মহাদেব বালম! পুরো পাঁচ বছর পরে চিঠি লিখছে মহাদেব! ওৱ শেষ চিঠি পেয়েছিলাম ইন্সমাউথ পোর্ট থেকে। সঙ্গে ছিল সুসান আর মহাদেবের এক যুগল ছবি। ওদের বিয়ের ছবি। একই সঙ্গে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছে ওরা মিস্কাটোনিক ইউনিভার্সসিটি থেকে। ম্যানাটী, ডুগং আর ডলফিন নিয়ে এক নতুন গবেষণা করছিল ওরা। সেখান থেকেই পরিচয়। ইন্সমাউথের মেয়ে সুসান। বাবা জাহাজের ক্যাপ্টেন। মা মারা যায় ছোটবেলায়। তাই বাবার কাছে মানুষ সুসান হেওয়ার্ড। গোল গোল চোখ। এক উজ্জল দীপ্তি ওর দু চোখ জুড়ে। ছবির মধ্যেও বেশ বোঝা যায় ওর চোখের দীপ্তি। পত্র মারফৎ আমিও আশীৰ্বাদ করেছিলাম ওদের। বলেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে। না, ওদের পাগলামি তখনও শেষ হয় নি। H. P. Lovecraft বর্ণিত পৃথিবীর সব সাগর পারেই পাগলের মত ঘুরেছে মহাদেব। সাগর দেবতা বা দানব থুল্হুর খোঁজে। শুনেছিলাম অনেক রহস্যময় কালো পাথরে আঁকা ছবির বর্ণমালা পেয়েছেও। বিস্ময়কর সাগর জীবের অনেক অজানা ছবিও তুলেছে মহাদেব।
একে একে সব কথা ছবির মত ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। বছর পাঁচেকের সেই ফুটফুটে ছেলে মহাদেব। বালমের হাত ধরে বেরিয়ে এল গ্রেট নিকোবরের সেই বিরাট বাড়ী থেকে। তারপর আমার হাতে মহাদেবকে তুলে দিলেন বালম। প্রাকৃতিক ঘন ঘোর দুৰ্যোগের মাঝে বালমের ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় থুলহুর মন্ত্রোচ্চারণ। উঃ বালমের সমস্ত দেহ জুড়ে আবের মতো উঁচু উঁচু মাংস ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। এক একটা আব এক একটা মোটা সাপের মত ল্যাম্প্রিতে পরিণত হবে। মুখে লাগান থাকবে গোলাকার এক সাকার। লাল টক্টকে মুখটা হাঁ হবে আর বন্ধ হবে। ঠিক বালমের নাভির উপর থেকে বেরুলো ফুটখানেক লম্বা বীভৎস সেই উপাঙ্গটার মত! ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল আমার দিকে। কাল চশমা খোলা বালমের চোখ দুটো কি ভুলতে পারবো আমি কোনদিনও। কাঁকড়ার চোখের মত লম্বা সরু এক মাংস দণ্ডের মাথায় রয়েছে বালমের চোখের মণি দুটো। চোখের গর্ত থেকে ইঞ্চিখানেক বাইরে ঠেলে বেরুনো। দরদর ধারায় জল পড়ছে দুচোখ বেয়ে! উঃ কি বীভৎস! ভয়ঙ্কর! তারপর এক সময় সেই অশ্রান্ত সমুদ্রের মাঝে কোথায় তলিয়ে গেলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী বালম লাভক্র্যাফ্টের সেই অপার্থিব সাগর দেবতা থুলহুর খোঁজে। জানি না, সাগরের কোন গভীরে আছেন বালম? পরমারাধ্য দেবতা থুলহুর খোঁজ কি পেয়েছেন তিনি? কে বলবে সে কথা আমায়। নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুক চিরে।
মহাদেবকে নিয়ে হতবাক আমি ফিরে এসেছিলাম কলকাতায়। তারপর একে একে অনেক বছর কেটে গেছে। ছোট্ট মহাদেব স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছে। কলেজের পড়া সাঙ্গ করে ওসানোগ্রাফি আর জুওলজি বিষয়ে আরো পড়ার জন্যে বিলেতে চলে গেল মহাদেব। ছোটবেলা থেকে সাগর আর তার বিচিত্র সব প্ৰাণীদের সম্বন্ধে অসীম কৌতুহল ওর। বাবার মত থুলহুর অস্তিত্বে ওর প্রচণ্ড বিশ্বাস। আর তারই খোঁজে সে ছুটে বেড়াচ্ছে সাগরের কূলে কূলে। বাবার খোঁজে সাগরের গভীরে অভিযান চালাবার জন্যে বারবার সে চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্ৰতিবারে একটা না একটা কারণে মাঝপথেই বাতিল হয়ে গেছে সেসব পরিকল্পনা। কিন্তু হাল ছাড়ে নি মহাদেব! আমি তো ওকে চিনি! হার মানার ছেলে নয় মহাদেব। সাময়িক পরাজয় দুর্জয় দুর্মদ শক্তি জোগায় ওর মনে। মহাদেব এক বিস্ময় আমার কাছে ৷
ঢং ঢং করে রাত ৯টা বাজল। ঘড়ির আওয়াজে আমার স্মৃতির জোয়ারে ভাঁটা পড়ল। বাস্তবে ফিরে এলাম আবার। উল্টে পালটে দেখলাম চিঠিটা। না আর কোন কিছু নেই। চণ্ডীপুর–অন–সী টা আবার কোথায়? উড়িষ্যায় চণ্ডীপুর? ঠিক মনে করতে পারলাম না। হাতের কাছেই ছিল উইকি এণ্ড টুরিষ্ট গাইড। পাতা ওন্টাতেই বেরিয়ে পড়ল চণ্ডীপুর–অন–সী। আসল নাম চাঁদিপুর। গোপালপুর–অন–সীর নামে নাম রাখা হয়েছে চাঁদিপুরের। বালেশ্বর ষ্টেশান থেকে ১৬ কিলোমিটারে মাত্র।
সকালে পৌঁছালাম বালেশ্বরে। ঝকঝকে সকাল। সারবন্দী সাইকেল রিক্সা আর বাস। বাসষ্ট্যাণ্ডের পাশে লাল রংয়ের একটা জীপ। চিনতে অসুবিধা হল না। লাল রংয়ের গাড়ী দেখা যায় না সচরাচর। লাল রং এর জীপ আমিও দেখিনি এর আগে। VIP ব্যাগটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম জীপের দিকে।
—আপনি রণেনবাবু? স্যালুট ঠুকে নেপালী ড্রাইভার প্রশ্ন করল আমাকে।
—হ্যাঁ! মহাদেবের গাড়ী এটা?
—আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ী পাঠিছেন সাহেব।
জীপে উঠে বসলাম। শহর ছাড়িয়ে জীপ ছুটে চলল সাগরের দিকে। লোকালয় ক্রমে পাতলা হয়ে এল। এবারে খালি মাঠ দুধারে। সাগরের টাটকা হাওয়ার ঝলক আসছে মাঝে মাঝে। কী সতেজ হাওয়া। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। হঠাৎ সজোরে ব্রেক করল ড্রাইভার। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলে থেমে গেল গাড়ী। একজন ঝাঁকড়া চুল ওলা লম্বা পাঞ্জাবী পরা চব্বিশ পাঁচিশ বছরের এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ভাল করে দেখলাম গলায় ঝুলছে মস্ত বড়ো এক মাদুলী। সকালের হাওয়ায় উড়ছে লম্বা লম্বা চুলগুলো। চোখদুটো টক্ টকে লাল।
—কে আপনি? কোখেকে আসছেন? গলার স্বরে রুক্ষ ঝাঁঝ।
আমার বলার আগেই ড্রাইভার বলে উঠল—
—তোমার কিসের দরকার তাতে? আবার গাড়ী দাঁড় করানোর চেষ্টা করলে চাপা দেব নির্ঘাত।
—চাপা দেবে? ইচ্ছে করলেই কি চাপা দিতে পার তোমরা? আমার ভাগ্য কি তোমার হাতে?
—যাও….সরে যাও এখান থেকে! ধমকে উঠল ড্রাইভার।
জীপের পাশে আমার কাছে সরে এল যুবকটি। খুব ভাল করে দেখল আমাকে! মাদুলির দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। এ কার মনোগ্রাম ওর মাদুলিতে? এ তো সেই বীভৎস ভয়ঙ্কর থুলহুর ছবি। লাভক্র্যাফটের হুবহু বৰ্ণনা যেন!
আমার চোখ মুখের ভাব দেখে হা হা করে হেসে উঠল যুবকটি।
—কি… কি দেখছেন? চেনেন নাকি? থুলহু?………আমাদের পরম দেবতা………সকলের বিচার করবেন থুলহু……আপনি…আপনাকেও একদিন যেতে হবে থুলহুর কাছে! তারপর…
আর শুনতে পেলাম না। ততক্ষণে গাড়ী ছুটে চললো সামনের দিকে। আমাকে অবাক দেখে ড্রাইভার বলে উঠল—ওসব কিছু নয় সাহেব! হিপি…হিপি ওৱা। কয়েকদিন হল ডেরা বেঁধেছে সাগর তীরে। ওদের সঙ্গে কথা বার্তা বলাও দুষ্কর। রাস্তার মাংস চামড় ওঠে যেন হাড় পাঁজরা বেরিয়ে পড়েছে। তরাং তরাং করে লাফাচ্ছে জীপটা ৷
হঠাৎ যেন এক পর্দা সরে গেল চোখের সামনে। বিশাল অনন্তে যেন লুপ্ত হয়ে গেল আমার অস্তিত্ব। আকাশ পাতাল জোড়া নীল আর নীল। দূরে বহুদূরে সাগর আর আকাশ মিলে মিশে একাকার। কেন জানিনা সাগর দেখলেই আনন্দে নেচে ওঠে আমার মন। মনে হয় দুরন্ত অশান্ত সাগর একমাত্র সত্য বাস্তব। আর সব মায়া মরীচিকা।
গাড়ীর স্পীড কমে এল! সামনে আর রাস্তা নেই। মনে হয় এবার সমুদ্রের তীরের উপর দিয়ে যাবে জীপ। বড় বড় রোলার তীরের কাছে এসে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কি প্ৰচণ্ড তার গর্জন! হু–হু করে জলজ হাওয়া লাগছে চোখে মুখে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভীড় করেছে আকাশ। সূৰ্য মেঘের সঙ্গে লুকোচুরী খেলছে। মনের মধ্যে অনেক কথাই ভীড় করে আসছে। দূরে কোথাও মিলিটারী ঘাটি আছে। কট্কট্ গুড়ুম গুডুম শব্দ ভেসে আসছে সাগরের গর্জন ছাপিয়ে।
ডলফিন নিয়ে রিসার্চে যথেষ্ট নাম হয়েছে মহাদেবের। ডক্টরেট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর রিসার্চের বিষয় বস্তু নিয়েও অনেক লেখা হয়েছে কাগজে। ডলফিনের সংখ্যা নাকি কমে আসছে সাগরে। তাই নিয়ে দুর্ভাবনার শেষ নেই। ডলফিন সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে দারুণ ভাবে। কোন সেই সুদূর অতীতেও ডলফিন নিয়ে নানান গল্পে রূপকথা উপকথা গড়ে উঠেছিল। প্ৰাচীন কালের নাবিকরা জ্যোৎস্না রাতে এই ডলফিনকে দেখেই মৎস্য কন্যা ভেবে কত রোমাঞ্চিত হয়েছে। তারপর সাগরের গভীরের এই সব অবিশ্বাস্য সত্য জলকন্যাদের নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা চলেছে যুগে যুগে। সত্যি কি এইসব রূপকথা শুধুই রূপকথা?
সেই প্ৰাচীন যুগ থেকে নানা রকম প্ৰাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানতে পারা গেল যে আমাদের জাতভাই ডলফিনরা দারুণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এবং শুধু তাই নয় এরা পরস্পরের মধ্যে বিভিন্ন কোডের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে সক্ষম। কিন্তু সাগরের গভীরে বাস করার জন্যে এদের এই বুদ্ধিমত্তার কোন খোঁজ রাখিনা আমরা। শুধু তাই নয়, হাত না থাকার জন্য কোন রকম artifact বা শিল্প নিদর্শন তৈরী করতেও পারে না এরা। আর artifact গুলোকেই তো বুদ্ধিমত্তার প্রধান লক্ষণ বলে গণ্য করে সভ্য সমাজ। মহাদেবের রিসার্চ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। ডলফিন এবং এদের প্রখর বুদ্ধিমত্তাকে নানা প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগাবার এক অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ডলফিন নিয়ে মহাদেব পদ্ধতিতে রিসার্চ সুরু করেছে রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স। আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। মনে হয় মহাদেবের এই গবেষণার পেছনে ভারত সরকারের টাকা এবং উৎসাহ রয়েছে। কেন জানিনা মহাদেবের ডলফিন নিয়ে রিসার্চের পেছনে আসল উদ্দেশ্য ৰোধহয় কেউ বোঝেনি বলে মনে হল আমার। ওর বাবার সেই বিস্ময়কর বীভৎস পরিবর্তন—থুলহুর ডাকে সাগরের গভীরে আত্মদান। কিন্তু আত্মদান বলা বোধ হয় ঠিক হবে না? বালম কি এখন ও ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাগরের গভীর থেকে গভীরতম প্রদেশে! সারা শরীরে হয়তো দেখা দিয়েছে অজস্য ল্যাম্প্রি… গোল গোল লাল সাকার গুলো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে… না না আর ভাবতে চাই না…কি করে তাড়াই এসব ভাবনা আমার মন থেকে!
সমুদ্রের পাড় ধরে এখনও ছুটে চলেছে জীপ। নেপালী ড্রাইভার দেশোয়ালী ভাষায় গান ধরেছে গুণ–গুণ করে। জীপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে নীল সাগরের বড় বড় ঢেউগুলো।
একটা কথা কিন্তু বুঝতে পারছি না। আমি তো এক্সট্রা সেন্সরী পারসেপসান বা ESP নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। ESP র উপরে বেশ কয়েকটা paperও উচ্চ প্ৰশংসিত হয়েছে বাইরের কয়েকটা ইউনিভারসিটিতে। নিজের কথা ভাবতে বেশ ভাল লাগে আমার! সেই গ্রেট নিকোবর দ্বীপে বালমের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখন সবেমাত্র টেলিপ্যাথি নিয়ে অল্পস্বল্প নাড়াচাড়া করছি। তারপর…ভারতের সব ইউনিভারসিটিতে বিশেষ বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়েছে একে একে৷ খ্যাতি বা সুখ্যাতিও হয়েছে। নিজের সুখ্যাতির কথা নিজের মনে ভাবতেও রোমাঞ্চ লাগে। তারিয়ে তারিয়ে নির্জনে বেশ উপভোগ করা যায়।
কেন জানি না নীল সাগরের জল দেখলেই আমার বালমের কথা মনে পড়ে যায়। বেশ কজন বড় বড় বিজ্ঞানীকে বলেছিলাম বালমের কথা। “গভীর দুঃখের বিষয়” “খুবই পরিতাপের ব্যাপার” বলেই অনুসন্ধানের কর্তব্য শেষ করেছিলেন ওরা। যে কোন বড় বিজ্ঞানী যদি একটু চেষ্টা করত তাহলে… না আর ভাবতেও পারা যায় না। চাঁদে যাবার জন্যে, মঙ্গলের সঠিক পরিচয়ের জন্য বা মহাকাশের দুজ্ঞেয় রহস্যের আবরণ উন্মোচন করার জন্যে কোটী কোটী টাকা খরচ করছে পৃথিবীর সব দেশগুলো। কিন্তু হাতের কাছে যে অজানা রহস্য হাতছানি দিচ্ছে বারবার তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না। সাগর গভীরের কতটুকু জানি আমরা। কতখানি গভীরে নাবতে পেরেছে মানুষ। অথচ পৃথিবীর তিনভাগ তো জলে ঢাকা। নানা অজানা রহস্যময় জীবেরা নিৰ্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অতল সাগরের নিতল আলয়ে। কোথায় আছে বালম…
সাগরতীরে কয়েকটা ছোটবড় টেণ্ট চোখে পড়ল। কোনটার রঙ লাল কোনটা রঙ নীল। বুঝতে পারলাম হিপিদের আড্ডা ওটা। সংখ্যায় ওরা অনেকজন। কি অদ্ভুত ওদের আচার আচরণ। পরণে কারুর লুঙ্গি বা দোপাট্টা কাপড়ে জড়ানো নয় তো ঢোলা ফুলপ্যাণ্ট। খালি গায়ে বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালা দুলছে গলায়। বিদেশীদের সঙ্গে আমাদের দেশেরও কয়েকজন ছেলে রয়েছে বলে মনে হল আমার। প্ৰচলিত ধ্যান–ধারণা আচার–আচরণকে নস্যাৎ করাই ওদের কাজ। ওরা বিদ্রোহী। পরিত্যক্ত সব অতীতের সংস্কার বা বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করাই কি ওদের কাজ? কে জানে।
সামনেই একটানা বেশ কয়েকটা সাদা বাড়ী ভেসে উঠল গাড়ীর সামনে। সাগরের গা ঘেঁসে উঠেছে বাড়ীগুলো। জীপ এসে দাঁড়াল একটা গেটের সামনে। উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা—Research Centre for unknown Sea–animals বা অজানা সামুদ্রিক জীব–গবেষণাগার। জীপ থেকে নাবতে দু–জোড়া হাত এসে ঠেকােল আমার পায়ে। দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরলাম মহাদেবকে। সামনে দাঁড়িয়ে সুসান। অদ্ভুত চক্চকে উজ্জ্বল ওর চোখ দুটো। নীল সাগরের মায়া জড়ানো চাউনি!
—কাকু, ডলফিন সম্বন্ধে কতটুকু জানি আমরা? কতটুকুই বা কাজ হয়েছে সাগরের নানান জীব সম্বন্ধে? সাগরের গভীরের রহস্য অজানা গ্রহের রহস্যের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বরঞ্চ অনেক অনেক বেশী রোমাঞ্চকর বিপদসঙ্কুল। তবুও সাগর আমাদের টানে না কেন বলতো কাকু? বড় বড় চোখ মেলে প্রশ্ন করল মহাদেব। পুরু লেন্সের চশমায় চোখদুটো ঢাকা। পাওয়ারফুল লেন্সের মধ্যে দিয়ে চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড়ো বলে মনে হয়। বিকেলের পড়ন্ত রোদ লুটিয়ে পড়েছে সামনের বাঁধানো উঠানে। চায়ের টেবিলে আমি আর মহাদেব। সামনে সমুদ্র। একনাগাড়ে ঢেউ ওঠা আর পড়ার খেলা। জেলেদের দুএকটা ডিঙ্গি নাচছে দূর সাগরের জলে।
সাগরের জলে এখনও চান করছে হিপিরা। দু–এক টুকরো আনন্দোল্লাস ভেসে আসছে হাওয়ায় ভর করে।
আসার পরই একটু জিরিয়ে সমস্ত রিসার্চ সেণ্টারটা মোটামুটিভাবে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে মহাদেব। যতই দেখছি ততই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছি। কি গভীর নিষ্ঠা থাকলে একলার পক্ষে এত সবকিছু করা সম্ভব। প্ৰায় জনা–পঞ্চাশেক বিজ্ঞানী কাজ করছেন এখানে। কত সব আধুনিক সাজসরঞ্জাম।
সবকিছু দেখে মহাদেবকেই আমার অপরিচিত মনে হচ্ছিল বারে বারে। এ কী আমার সেই পাঁচ বছরের মহাদেব? সমুদ্রের জল ঘেঁসে সাদা লম্বা একটানা বড় বড় বাড়ী। কোনটাতে নানান আধুনিক আলোর সরঞ্জাম, কোনটাতে বা শব্দ বা আওয়াজ রেকর্ডিং–এর বিচিত্ৰ সব যন্ত্রপাতি। নানান আকারের ফটো তোলার আর ডেভেলাপ করার জটিল ক্যামেরা আর তার জটিল সরঞ্জাম। শুধু একটা ঘরেই রয়েছে আধুনিক এক কম্পুটার। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে রয়েছে বড় বড় জলভর্তি এক্যুরিয়াম। নানানরকম অচেনা অজানা সামুদ্রিক প্রাণীরা কি বিচিত্র ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে জলজ গাছপালার মধ্যে।
অনেক পাণ্টে গেছে মহাদেব। কিসের নেশায় যেন বুঁদ হয়ে রয়েছে। ছটফট করে বেড়াচ্ছে চার ধারে। অনর্গল কথার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক এক্যুরিয়াম সাজসরঞ্জাম দেখিয়ে দিল আমাকে। কোন কোন সামুদ্রিক প্রাণীর বর্ণনা প্রসঙ্গে আনন্দে উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিল সে বারে বারে। বাচ্চা ছেলের মত কি উচ্ছ্বাস। অথচ প্রতিটি বর্ণনাই বিজ্ঞানের চুলচেরা বিচারে ভরা।
ঘুরতে ঘুরতে একটা বিরাট হলঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল মহাদেব। কয়েক মুহুর্ত কি যেন ভাবল। তারপর বলেছিল—না, কালকে দেখাবো ডলফিন পুলটা। অনেক সময় লাগবে। আজকে আর সময় হবে না। সুসানই কাজ করে এখানে সবসময়?
সূর্য ঢলে পড়ছে সাগরের বুকে। হলদে আভায় ভরে উঠেছে চারপাশ! আমাদের চায়ের টেবিলেও সূর্যাস্তের শেষ আলোর রেশ ছড়িয়ে পড়েছে। নিখুঁতভাবে কামানো মহাদেবের মুখখানা দৃঢ়তায় ভরা। বাইরে সাগর জল রক্তরাঙা আবিরে রাঙানো। রক্তলাল সমুদ্রের কি অপূর্ব এই রূপ! অপলক দৃষ্টিতে বাইরে চেয়ে আছে মহাদেব।
—হ্যাঁ যা বলছিলাম, ডলফিন সম্বন্ধে কতটুকু জান বলতো কাকু?
মহাদেবের প্রশ্নে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল আমার। পুরু লেন্সে ঢাকা বড় বড় চোখদুটো চেয়ে রয়েছে আমার দিকে।
একটু ইতস্ততঃ করলাম! সত্যি তো কতটুকু জানি আমি!
—না, বিশেষ কিছুই জানি না। তবে সাধারণ লোক যেটুকু জানে তার চেয়ে হয়তো সামান্য কিছু বেশী জানি। তুমি তো জান মহাদেব, সাগর আমাকে আকর্ষণ করে প্রচণ্ডভাবে। সাগরের অজানা সব জীবদের কথা জানার আগ্ৰহ আমার প্রবল। তোমার বাবার ঐ মর্মান্তিক পরিণতি আমাকে আরো কৌতুহলী করে তুলেছে! কোথায় আছে থুলহু—যার টানে…
—থুলহু! থুলহু! থুলহুর খোঁজেই তো এক সাগর থেকে আরেক সাগরে ঘুরে বেড়িয়েছি পাগলের মত। শুধু একবার দুচোখ ভরে দেখতাম ওকে। জিজ্ঞাসা করতাম কোথায়—কোথায় আছে আমার বাবা! একটা সুদীর্ঘ দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুক চিরে —কাকু, তুমি তো জান সেই কোন ছেলেবেলা থেকে থুলহু আর আমার বাবাকে খুঁজছি আমি। এখানকার এত সব এ্যারেঞ্জমেণ্ট সেই একই কারণে। তবে এবার বোধহয় সঠিক রাস্তার খোঁজ পেয়েছি! কোন প্ৰাচীনকাল থেকে ডলফিনের নানান আশ্চৰ্য বুদ্ধিমত্তার কথা লেখা আছে সব পুঁথিতে। সাগর জীবদের মধ্যে ডলফিনরাই একমাত্র ইনটেলিজেণ্ট প্ৰাণী। আর সেই ডলফিন বলে দেবে কোথায় আছে সৃষ্টির সেই আদি দেবতা থুলহু। যার খোঁজে যুগে যুগে লোক তলিয়ে গেছে সাগরের গভীর অতলে। পাগল হয়ে গেছেন থুলহুর প্রবক্তা স্বয়ং লাভক্র্যাফট!
এক অস্বাভাবিক নিঃস্তব্ধতা নেবে এল আমাদের চারপাশে। দূর–সাগরের দু’একটা পাখীর ডাক কেমন যেন রোমাঞ্চকর শোনালো অপরাহ্নের বিষন্ন আলোয়। মনে হল বালমের মত অস্থির ভাবপ্রবণ হয়ে উঠেছে মহাদেব।
—কাকু, থুলহু আর বাবার কথা মনে হলেই কেমন যেন হয়ে পড়ি আজকাল। যাক, কাজের কথায় ফিরে আসি। ডলফিন… ডলফিন সম্বন্ধে আর কি জান বলোতো?
—বোধ হয় ১৯৫০ সালের কিছু আগে ডলফিন নিয়ে যথার্থ সায়েন্টিফিক রিসার্চ সুরু হয়। ডলফিনের মাথার আকার এবং স্পেশালাইজড এডাপ্টেশানের বা অভিযোজনের আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে মনে হয় এরা দারুণ বুদ্ধিমান জীব। ওদের সেন্সরি ইক্যুপমেন্ট জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের অস্তিত্ব আমাদের এই বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করে তোলে। শুধু তাই নয় এসব দেখে মনে হয় যে মানুষের মানে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ওরা সক্ষম। অবশ্য যতটুকু আমি জানি, অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালালেও সঠিক করে এ সবের কোন কিছু প্রমাণ করা সম্ভব হয় নি। ভার্জিন দ্বীপে ডঃ লীর বিস্ময়কর রিসার্চের বইগুলো নিয়ে এসেছি আমি। বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছি একবার। তাড়াতাড়ি চলে আসার জন্যে ভাল করে পড়া হয় নি বইগুলো। এ ছাড়া সব দেশেই ডলফিন নিয়ে গবেষণা চলছে খুব জোর কদমে।
—না না কাকু, লী এখন বেশ পুরানো হয়ে গেছে। তাছাড়া এমন অনেক প্রমাণ পেয়েছি—যা সত্যি অবিশ্বাস্য। ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিল মহাদেব। কি অদ্ভুত চায়ের কাপ। অর্ডার দিয়ে তৈরী করানো। কাপের একপাশে ডলফিন আর অন্য পাশে ল্যাম্প্রি বা মুখে গোলাকার সাকার লাগানো বান মাছের মত পরজীবি সামুদ্রিক জীবের ছবি। ল্যাম্প্রির ছবি চোখে পড়া মাত্র চমকে উঠলাম। মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল বালমের জীবন্ত উপাঙ্গটা। রক্ত লাল সাকারটা হাঁ হচ্ছে আর খুলছে। ক্রমেই এগিয়ে আসছিল আমার দিকে। উঃ কী বীভৎস! ভয়ঙ্কর?
—আরো কি জান কাকু, এখানে এমন অনেক রিসার্চ চলছে যা দেখলে ডঃ লী–ও চমকে উঠতেন। একটু হেসে বললো মহাদেব।
—যাই হোক মহাদেব, এবার বলোতে আমাকে হঠাৎ কেন প্রয়োজন হল তোমার? তোমার কোন খবরই পাইনি অনেক দিন। তাই চিঠি পেয়ে চমকে উঠলাম। তুমি কি ডলফিনকে হিপ্লোটাইজ করতে অথবা ডলফিনের চিন্তাধারা জানতে বলবে আমাকে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না, মহাদেব?
—যা ভেবেছে অনেকটা ঠিক তাই। তবে একটু হেরফের আছে। শেষকালে হয় তো… যাক, সে কথা। শেষের কথা শেষেই থাক। প্ৰথমে কাকু, আমাদের মত এক মানুষকেই হিপ্লোটাইজ করতে হবে। মনে হয় সেই মানে ওর মন হয় তো ডলফিনের থট্–প্যাটার্নস–এর সঙ্গে খুবই সেন্সিটিভ বা সংবেদনশীল।
তবে হ্যা, ডঃ লী–কে অস্বীকার করি না আমি। তারই পথ অনুসরণ করে ডলফিনদের প্রচুর আওয়াজ রেকর্ড করেছি। সেই সব শব্দগুলো সায়েণ্টিফিক ভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ডলফিনের শব্দ বলতে জলের ভেতর বা জলের উপরের সব রকম আওয়াজ যেমন Clicks, bleats, whistles এমন এমন শব্দও ওরা করে যা মানুষের সাউণ্ড স্পেকট্রাম বা শোনার ক্ষমতার বাইরে। আমরা সেই সব বিচিত্র শব্দগুলোকে টেপ করেছি… সঙ্গতি অনুসারে সাজিয়েছি। কিন্তু আশ্চৰ্য ব্যাপার কি জান কাকু, কম্পুটারের মধ্যে দিয়ে প্রসেস করার পরও কোন নির্দিষ্ট ভাষায় সাজাতে পারা যায় নি সেগুলোকে।
তবে কোন কোন শব্দ বা সংকেত ব্যাখ্যা, উল্লাস, মিলনের সময়ের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু এগুলোকে তো ভাষা বলা উচিত হবে না। ভাষার তো অনেক রকম বৈশিষ্ট্য আছে। ডলফিনরা অবশ্য অনেক সময় মানুষের গলা নকল করে কথা বলে। সেগুলো টিয়া বা ময়নার মতো প্যারোটিং ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ মানে বুঝে কোন কিছু করে না ওরা।
কোন কিছু বোঝে না বলা বোধহয় ঠিক হলো না। কারণ এনকেফালোগ্রাফ নিয়ে দেখা গেছে যে কথা বলার সময় ঠিক যে ধরনের বিদ্যুততরঙ্গের সৃষ্টি হয় আমাদের ব্ৰেনে অবিকল একই ধরনের Electrical output–এর পাটার্ন পাওয়া গেছে ডলফিনের ব্ৰেন থেকে। অথচ জলের মধ্যে বা বাইরে সাবসনিক বা সুপারসনিক কোন রকম ভোকালাইজেসান বা স্বর সংযোগের হদিশ পাওয়া যায় নি আজ পর্যন্ত।
এই সমস্ত পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং এদের ফলের উপর নির্ভর করে একটা সিদ্ধান্তে এসেছি যে ডলফিনরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে।
এবার সত্যি চমকে উঠলাম। বলে কি মহাদেব? টেলিপ্যাথি? তাও ডলফিনদের মধ্যে? তবুও প্রশ্ন করলাম।
—তাহলে টেলিপ্যাথিকালি সেন্সিটিভ কোন লোক আছে নাকি এখানে? না, বাইরে থেকে ভাড়া করবে?
—না না, বাইরে থেকে আনবো কেন। এখানেই আছে। মনে তো হয় দারুণ সেন্সিটিভ। শুধু তাই নয় অনেক বছরের অভিজ্ঞতাও আছে ওর। ডলফিনদের আচার–আচরণ হাব–ভাব সমস্ত কিছু ওর পরিচিত। আর কেউ বোধহয় এতদিন বসবাস করে নি ডলফিনের সঙ্গে। সত্যি কথা কি আমারই মাঝে মাঝে মনে হয় ডলফিনই বোধহয় হয়ে গেছে ও।
—তাই নাকি? কে সে? কি নাম তার?
—নাম তার সুসান—সুসান বালম। নারীকণ্ঠে চমকে উঠলাম! ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম পেছনে। কখন যে সুসান এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে টের পাই নি আমি। গোল গোল জল ভরা চোখ দুটো ঝিকিয়ে উঠল পড়ন্ত সূর্যের ম্লান আলোয়।
চেয়ার টেনে আমার সামনে বসল সুসান। গাঢ় সমুদ্রের রঙের গাউন রয়েছে ওর পরণে। কাদার ছাপ লেগে রয়েছে গাউনের নানা জায়গায়। দেখতে সুন্দর না হলেও কেমন একটা মিষ্টি ভাব রয়েছে ওর গড়নে। অথচ হাত–পা মুখ সব যেন খস্খসে বালির মত। ঘাম–ঘাম ভাব রয়েছে সৰ্বক্ষণ। কেমন যেন থস্খসে।
মহাদেবের মত আর এক পাগল সুসান। দুজনে মিলেছে ভাল। সাগরের অজানা জীব আর তার অপার রহস্যে উন্মত্ত ভরা। অজানা গ্রহের সেই জিলেটিন দানব বা দেবতা থুলহুর উপাসনা করে সুসান। থুলহু—প্ৰাণ স্বষ্টির প্রারম্ভে পৃথিবী যার করায়ত্ত ছিল। অনাদিকাল ধরে যে শাসন করেছে পৃথিবীকে। এখন সাগরে যার একাধিপত্য।
আমার সামনে বসে আছে সুসান। মিটি–মিটি করে হাসছে। কেমন যেন জলজ গন্ধে ভরে উঠছে ঘরটা।
—যাই বলুন না। কাকু, ডলফিনই হচ্ছে একমাত্ৰ বুদ্ধিমান জীব যার নখদৰ্পণে রয়েছে সাগরের প্রতিটি রহস্য। গ্ৰীক আর রোমানদের বহু গল্পে ডলফিনদের গুনগান করা হয়েছে। মাছেদের রক্ষা করে তারা। ডুবন্ত নাবিকদের জীবন রক্ষাও করে ডলফিনরা। তাছাড়া সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েদের খুব ভালবাসে ওরা। সুযোগ সুবিধে পেলে ছোট ছেলেমেয়ে ভুলিয়ে পিঠে করে দূর–সাগরের বুকে নিয়ে যায় বলেও শোনা যায় দেশবিদেশের লোক পাঠায়। এ ছাড়াও মানুষের সঙ্গে ডলফিনদের একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বহুদিন থেকে। ভুল করে মাঝে মাঝে ডলফিন হত্যা করলেও ওরা কিন্তু কোনদিন মানুষ মেরেছে বলে শোনা যায় নি।
—সুসান, কিছু কিছু শুনেছি বা পড়েওছি। তবে প্রচলিত ধ্যান–ধারণারও বদল হচ্ছে। তারা কি এই সব প্ৰাচীন গল্প কথা বিশ্বাস করবে। বর্তমানের ছেলে–ছোকরা তো পুরানো সব কিছুকেই ভাঙতে চায়। সে ক্ষেত্রে জানি না তোমাদের বিশ্বাস আর রিসার্চ নিয়ে কতদূর কাজ হবে ভবিষ্যতে।
মহাদেব বলে উঠল—কাকু, তুমি যা ভাবছো তা বোধহয় ঠিক নয়। চিরকালই একদল ছেলেছোকরা আছে যারা পুরানো সব কিছু ভেঙে চুরমার করতে চায়। কিন্তু তাই বলে তো প্ৰাচীন গল্প–কথা ধর্মগ্রন্থ কোন কিছু পাল্টায় নি। আমাদের যুগে হিপিরা কিছু মানতে চায় না। ভাল কথা, জান কাকু, একদল হিপি তাঁবু গেড়েছে এখানে! কি যে ওরা বলতে চায় কিছুই বুঝি না আমি। এরা নাকি থুলহুর উপাসনা সুরু করেছে এখন। আমি কিন্তু মোটেই বিশ্বাস করি না ওদের। থুলহুর কি বোঝে ওরা! সাংঘাতিক বা রোমাঞ্চকর বলেই নিশ্চয় থুলহু নিয়ে মাতামাতি করছে ওরা। তবে আমার রিসার্চ যদি শেষ হয়…যদি একবার প্রমাণ করতে পারি তাহলে যুগান্তকারী এক তত্ত্বের সুত্রপাত হবে। ডলফিন—ডলফিনরাও দেবে সে পথের হদিশ। আজও আমরা চিনতে পারি নি ওদের। একেবারে চিনতে পারি না বললে বোধহয় ভুল বলা হবে। এই পৃথিবীতেই কিছু কিছু লোক আছে যারা ডলফিনদের ভাষা বোঝে। আর ডলফিনরাও তার কথা শোনে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি সে সব লোককে আমি। কিন্তু দুভাগ্য কি জান কাকু, একজনেরও খোঁজ পাই নি আজ পর্যন্ত। সবাই বলেছে ওসব বুজরুকি। কিন্তু আমি জানি ও বুজরুকি নয়—সব সত্যি!
একবার মহাদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে কপির কাপে চুমুক দিল সুসান। বাইরে অন্ধকার জমতে সুরু করেছে একটু একটু করে। দূরে ফেণার মুকুটপর ঢেউগুলো আরো বড় হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তীরের উপর। কেমন যেন বিষন্নতার ছাপ চারপাশে।
—সত্যি কি এমন লোক আছে? ডলফিনদের ভাষা বোঝা কি সত্যি সম্ভব? প্রশ্ন করলাম আমি।
—হ্যাঁ কাকু, সত্যি ছিল এককালে। এখনও বোধহয় আছে। তবে খুঁজতে হবে। সুসান, সেই বইগুলো কোথায় রেখেছি বলোতো? সেই পোকায় খাওয়া বইগুলো…আদিবাসীর কাছ থেকে ওজন দরে কিনেছিলাম।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে। দেখো তো ঐ তাকের পেছনটা।
এক রকম ছুটেই তাক থেকে ময়লা দুটো বই পেড়ে নিয়ে এল মহাদেব। চশমার মধ্যে দিয়ে চোখের কালো মণিদুটো আরো বড় বড় দেখাচ্ছে। কোন কিছু খুঁজে পাবার আশায় অধীর হয়ে উঠেছে ও।
—এ্যাই তো, এ্যাই তো পেয়েছি। খুব বেশীদিনের কথা নয়। গিলবার্ট দ্বীপের গর্ভনর ছিলেন স্যার আর্থার গ্রিম্বল। একবার তিনি এক প্রবাল দ্বীপ পরিদর্শনে যান—কি যেন নাম সেই প্রবাল দ্বীপের… ঠিক পড়তে পারছি না।…পোকায় কেটে দিয়েছে অক্ষরটা…
সুসান উঠে ঝুঁকে পড়ল। মহাদেবের ঘাড়ের উপর দিয়ে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলে কয়েক মিনিট।
…Buta…ri…tari…বুটা রি টারী…
…হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। সুসান…বুটারিটারী নামে এক এটলে গেছলেন স্যার আর্থার গ্রিম্বল। আর সেখানে এক আদিবাসীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। দুর সাগর থেকে ডলফিনদের ডেকে জড়ো করতে পারতো। খোলা বইটা হাতে করে চেয়ারে বসে পড়লো মহাদেব। পুরু কাচের লেন্স দুটো গভীর আগ্রহে পুরানো খাতাগুলো খুঁজে চলেছে এক নাগাড়ে।
এ্যাই তো পেয়েছি সেই জায়গাটা… গ্রিম্বলের ভাষায় বলি—“স্বপ্নের মধ্যে ওর আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যেত বাইরে। গভীর দূর সমুদ্রের পশ্চিম দিগন্তে ডলফিনদের ঘাঁটিগুলো খুঁজে বার করতো ওর বিদেহী আত্মা। তারপর কুমা গ্রামে নাচের আসরে যোগ দেবার জন্যে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হতো ডলফিনদের। ডলফিনরাও দলে দলে সেই আত্মাকে অনুসরণ করে আনন্দে উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে জড়ো হতে কুমা গ্রামের প্রান্তে সাগর তীরে।”
গ্রিম্বল নিজে গেছলেন সেই জায়গায়। সারি সারি তাল গাছের ছায়া নির্জন নিসঙ্গ সেই সাগর তীরে। দূরে গাছের ছায়ায় ছেলেরা খেলা করছে। স্ত্রীলোকেরা নিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজে ব্যস্ত আর পুরুষেরা তখন উৎসবের অঙ্গ শাঁখের গহনাগুলো পরিষ্কারে মত্ত। ঝুড়ি ভরা থরে থরে নানারকম খাবার। এবারে আবার গ্রিম্বলের ভাষায় বলি—“এক বিকট চীৎকার শোনা গেল ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা লোকটির ঘর থেকে। পরক্ষণেই টলতে টলতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল লোকটি। তারপর কোন রকমে হাওয়া আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রইল আমাদের সামনে। হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সম্পূর্ণ অজানা ভাষায় কাউকে যেন ডাকতে সুরু করল ঘুমন্ত লোকটি। Teiralici! Teiralici! এর মানে হল জাগো! ওঠো!… পশ্চিম সাগরের আমার বন্ধুরা শোন… চল চল সকলে চলো আমাদের বন্ধুদের সাদর আমন্ত্রণ জানাই!
সমস্ত গ্রাম চমকে ওঠে সেই প্ৰচণ্ড চীৎকারে। পরক্ষণেই আবাল বৃদ্ধবনিতা ছুটে চলে সাগর তীরে। অগভীর জলে নেবে জল ছিটিয়ে খেলা সুরু করে দেয় সকলে। সকলের গলায় দোলে এক একটা ফুলের মালা। হঠাৎ বুক সমান সাগর জলে ভুস্ করে ভেসে উঠে ডলফিন। এক… দুই… অনেক… অজস্র। আনন্দে উল্লাসে চীৎকার করে ওঠে সকলে। সুরু হয়ে যায় এক আশ্চৰ্য উৎসব। মানুষদের ঘিরে ডলফিন সুরু করে দেয় বিচিত্র নাচ। কেউ কেউ লাফিয়ে ওঠে ওপরে। তালে তালে দুলতে থাকে মানুষেরা। মুখে তাদের বিচিত্র গান। ক্রমেই প্রবাল দ্বীপের দিকে সরে আসতে থাকে নৃত্যরত দল। তারপর একে একে বিদায় নেয় সাগর বন্ধু ডলফিনরা। অবশেষে দূর সাগরের বুকে মিলিয়ে যায় ওরা।
পড়া থামিয়ে ঠাণ্ডা কফির কাপে চুমুক লাগায় মহাদেব। বিস্ময়ে হতবাক আমি। দূর সাগরের দিকে বড় বড় চোখ মেলে সুসানও নিস্তব্দ।
— গ্রিম্বল মনে করে ছিল সত্যি বোধ হয় চলে গেল ডলফিনরা। পরক্ষণেই স্বপ্নরত লোকটি পশ্চিম সাগরের দিকে আঙুল দেখিয়ে চীৎকার করে উঠল—“পশ্চিম সাগরের বুক চিরে রাজা আসছে আমাকে দেখতে।” কিছু দূরেই দেখা দেয় বিশালকায় এক কালো দেহ। বিরাটাকার এক ডলফিন। রাজার পেছনে অজস্র ডলফিন সার বেঁধে আসতে সুরু করে তীরের দিকে।
তীর থেকে একটু দূরে থমকে দাড়ায় সমস্ত দলটা। বিশালাকায় ডলফিনটা এগিয়ে আসে তীরের কাছে। একেবারে স্বপ্নরত লোকটি পায়ের সামনে আসে রাজা। সবাই তখন এগিয়ে আসে জলের ধারে। মুখে করে বালি তুলে নেয় ডলফিনেরা। ডানা ঝাপাটাতে সুরু করে। মনে হয় সাহায্য চায় ওরা। মানুষেরা সকলে ঝুঁকে পড়ে ডলফিনগুলোর উপরে। বুকে পিঠে সাদরে হাত বুলিয়ে ভালবাসা জানায় ওরা। স্থির হয়ে আদর উপভোগ করে সাগর বন্ধুরা। ভয়ের কোন চিহ্ন নেই কোনখানে।
উজ্জ্বল আলোয় চক্চক্ করে উঠছে মহাদেবের চোখ দুটো। আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত। এও কি সম্ভব? টেলিপ্যাথি যোগাযোগ কি সম্ভব মানুষ আর ডলফিনের মধ্যে? নাকি, এ কোন পাগলের প্রলাপ! অথচ মহাদেবের চোখেমুখে কি অপার বিশ্বাস।
—কাকু, এবার কি বলবে তুমি? বই বন্ধ করে প্রশ্ন করুল মহাদেব।
শুনলাম সব। অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। তবে মনে হয় দ্বীপের আদিবাসীদের কাছে ডলফিনেরা বোধহয় ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানের প্রতীক। আর অভ্যাসের বসে ডলফিনদের এমন আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেই আদিবাসীরা কি তখনকার দিনে হিপি ছিল?
—আবার ভুল করলে কাকু। এত হাল্কাভাবে দেখো না কিন্তু সমস্ত বিষয়টাকে। আর হিপিদের কথা তুলো না এর মধ্যে। ডলফিনকে কখনোই পছন্দ করে না হিপিরা। কেন জানি না ভয় পায় ওরা ডলফিনকে। বিশেষতঃ আমাদের এখানকার হিপিরা! খুব গম্ভীরভাবে কথাগুলো বললো সুসান।
সারারাত ভাল ঘুম হল না। একে নতুন জায়গা, তার ওপর সমস্ত পরিবেশটাও কেমন দুর্বোধ্য। প্রবাল প্রাচীর… বুটারিটারী এটলের ছবিটা বার বার স্বপ্নের মধ্যে প্ৰত্যক্ষ হয়ে উঠল আমার চোখের সামনে। কালো দীর্ঘাকৃতি উস্কোখুস্কো চুল এক আদিবাসী দাঁড়িয়ে আছে সাগর পারে। চােখ দুটাে আধবোজা… ঠোঁট দুটো বিড়বিড় করে কি যেন উচ্চারণে ব্যস্ত।
পেছনে দাঁড়িয়ে অগণিত দ্বীপবাসী। দূর সমুদ্রে অজস্র ডলফিনের মেলা। রাজা আছে সামনে। তার পেছনে কি যেন অস্পষ্ট বিশালাকার… হ্যাঁ হ্যাঁ… ঠিক থুলহুর মতো দেখতে… কি ওটা… পলকের জন্য বিকৃত চেহারা ভেসে উঠল চোখের সামনে… থুলহুর (?) আগে বালম… কাঁকড়ার মত চোখের মণি দুটো টর্চ লাইটের মতো জ্বলজ্বলে… সাকার লাগানো অজস্র ল্যাম্পি হিল হিল করছে বালমের সারা দেহে… থেকে থেকে অপার্থিব থুলহুর আবাহন মন্ত্রে ভরে উঠছে নিঃসঙ্গ বিচ্ছিন্ন সেই এটল… ক্রমেই এগিয়ে আসছে তীরের দিকে… আমার দিকে কিলবিল করছে জ্যান্ত প্ৰত্যঙ্গগুলো… চীৎকার করে উঠলাম…
ঘুম ভেঙ্গে গেল। পূবের আকাশ ফরসা হতে সুরু হয়েছে। সামুদ্রিক চিলের কর্কশ চীৎকার শান্ত নিঃস্তব্ধতাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। একটানা ঢেউয়ের গর্জন ভেসে আসছে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। আকাশে ছেঁড়া মেঘের আনাগোনার বিরাম নেই। ঠিক মেঘলা নয় অথচ কেমন যেন আকাশ ভারী হয়ে নেবে এসেছে অনেকটা।
একটা ছোট ছেলে বেড্টি দিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই জানলা দিয়ে নজর গেল সামনের চওড়া সমুদ্রের তীরের দিকে। দূর সমুদ্র এখনো আবছা অন্ধকারে ঢাকা। বালির চড়ায় পায়চারী করছে মহাদেব। পরণে লম্বা ঢোলা এক ওভারকোট৷ হঠাৎ একটু দূরে নজর পড়ল। একটা মূর্তি এগিয়ে আসছে মহাদেবের দিকে। অদ্ভুত বিচিত্র ওর আকার। পরণে আলখাল্লা, লম্বা লম্বা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে, পায়ে রয়েছে বুট। একমুখ ঘন দাড়ি।
পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে এলাম সাগর তীরে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে।
—এত ভোরে উঠে পড়েছো কাকু? যাক ভালই হয়েছে। পরিচয় করিয়ে দি—আমার কাকু রণেন ঘোষ আর ইনি মি. বার্ট। এখানকার হিপিদলের প্রধাননেতা। কি বলুন মিঃ বাৰ্ট?
—গুড মর্নিং, মিঃ ঘোষ। আলাপ করে খুসী হলাম। আপনি তো কাল জীপে এলেন তাই না? তবে মিঃ বালম যা বললেন আমি কিন্তু তা বলি না। বা মনে করি না। আমার শিষ্যরা মানে দলের সবাই গুরু বলে ডাকে আমাকে। দর্শন আর আধ্যাত্মিক বিষয়ে সাধনাই আমাদের প্রাচীন কাজ।
—অধ্যাত্মা! দর্শন! বাঃ! আমিও দারুণ উৎসাহী এ–সম্বন্ধে। কিন্তু এখানে কি করছেন আপনারা?
—বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সাধনা সুরু করেছি আমরা। Mystic Exercise ও Metayhysics আমাদের সাধনার এক বিশেষ অঙ্গ সত্যকে উপলব্দি করার জন্যে প্ৰাণপাত করতেও প্ৰস্তুত আমরা। ভোরের সাগর তীরে গম্ভীর গলায় বার্ট এর কথাগুলো কেমন যেন মায়াময় বলে মনে হল। দূরে সাগরের মধ্যে থেকে আবীরে রাঙানো সূৰ্য উঠছে। মনে হল সূৰ্যই একমাত্র সবকিছুর প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা। সূৰ্যই জানে সব। সেই সূৰ্য যদি একবার কথা বলতে পারতো। একবার যদি বলতে পারতো সৃষ্টির আদিরহস্য… কে আমরা? কোথা থেকে সৃষ্টি হল জগৎ? কোথায় আমাদের সুরু? দেবতা বা দানব থুলহু আসল স্বরূপ কি…..মুঠো মুঠো রক্তলাল আবীর কেউ গুলে দিল সাগর জলে। রক্তলাল রঙে ধাঁধিয়ে যায় চোখ। দূর সাগরের বুকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে জ্বলন্ত এক আগুনের থালা।
মহাদেবের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ল।
—খুব ভালো কথা বলছেন মিঃ বাট। আপনাদের সাধনার সাফল্য কামনা করি। কিন্তু আপনাদের সাধনা যে আমার কাজে বাধা দিচ্ছে, সে বিষয়ে ভেবেছেন কিছু?
হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল বার্ট। তারপর আরও কাছে এগিয়ে এল। বলল—ভাবনার তো কিছু নেই আমার। আমরা জেনে শুনেই তো বাধা দিচ্ছি আপনার কাজে। ভালই হল কথা তুলে। আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি—ডলফিন নিয়ে যে খেলা সুরু করেছেন তা খুবই বিপজ্জনক। শুধু আপনারই যে বিপদ তাই নয় সমস্ত পৃথিবীর বিপদকে ডেকে আনছেন আপনি। শুনুন, ডলফিন নিয়ে আর রিসার্চ করবেন না আপনি। আর বন্দী ডলফিনগুলোকে মুক্তি দিন এক্ষুনি।
—বাঃ সুন্দর কথা বলেছেন বাট। তবে আপনার ভবিষ্যদ্বাণীর আসল উদ্দেশ্য কি বলতে পারেন একবার? বা কার উপর নির্ভর করে এমন সিদ্ধান্তে পৌছালেন আপনি? গলার স্বরে মহাদেবের ব্যঙ্গের আভাষ।—যাক, কাকুকে সবিনয়ে বলুন তো এসব। আমার মাথায় এসব ঢোকে না আবার।
উজ্জ্বল শাণিত দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। সত্যি, কি চক্চকে ওর চোখ। তারপর আমার দিকে এগিয়ে এল বার্ট।
—আপনি বোধহয় জানেন না Devotees of the Ancient god বা প্ৰাচীন দেবতার অনুরাগী বলে এক আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে। সব ধর্মশাস্ত্রের লিখিত দেবতাদের অনুসন্ধান চালাচ্ছি আমরা। অবশ্য আধ্যাত্মিকভাবে। কিন্তু সবসময় শুধু একজন মাত্র আদি দেবতার স্পর্শ বা অনুভূতি পেয়েছি এ পর্যন্ত। অবশ্য দেবতা বা দানব সে বিষয়ে স্থির নিশ্চয় নই। আমরা। তবে আমাদের ধ্যানের জগতে সবসময় দেখা দিচ্ছেন সেই আদি অবাঙমনসাগোচর রূপ। কখনও বা কোটী সূৰ্য আদিত্য বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের স্রষ্টা সেই আদি শক্তি একবার কখনও অতল জলের নিভৃত গুহায় স্বইচ্ছায় বন্দী বিকটাকৃতি ভয়ংকর সেই বিশাল পুরুষ। সৃষ্টির আদি মুহুর্ত হতে সুনীল জলরাশির একমাত্র অধীশ্বর। এই দেবতা বা দানবের সর্বপ্রথম প্ৰবক্তা হচ্ছেন আমাদের গুরু Mr. H. P. Lovecraft—একজন আমেরিকাবাসী। অথচ আশ্চর্য কি জানেন ভারতবর্ষ প্ৰাচীন সভ্যতা অধাত্ম সাধনার পীঠস্থান হলেও সেই আদি দেবতা বা দানব থুলহুর অনুভূতি ধরা পড়ল না এখানে। তা সত্ত্বেও বিশেষ মনঃসংযোগ করে জানতে পেরেছি যে ভারতবর্ষেই হবে থুলহুর আবির্ভাব।
—কিন্তু এইসব জানতে পারছেন কেমন করে? নিজের অজ্ঞাতে প্ৰশ্ন বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে।
—এটা বুঝতে পারছেন না মিঃ ঘোষ? ধ্যানের মাধ্যমে গভীর মনঃসংযোগ করি আমরা… তার ফলে আমাদের মন বা আত্মা ক্ৰমেই বৃদ্ধি পেয়ে সেই আদিপুরুষের সংস্পৰ্শ লাভ করে। অর্থাৎ একাত্ম হয়ে যায়। অবশ্য এই ধ্যান বা মন-সম্প্রসারণের প্রথম ধাপ হিসাবে সামান্য এক ওষুধ খেতে হয় আমাদের। তারপরই সুরু হয় থুলহুর সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ।
—কিছু বুঝতে পারলে কাকু। গাঁজা, চরস খেয়ে ধ্যান করার মাহাত্মা কিছু বুঝি না আমি। তবে মন নিয়ে ব্যাপার যখন তখন তোমার রিসার্চের বিষয় হলেও হয়তো হতে পারে। E.S.P. নিয়েই তো তোমার কারবার! আমাকে উদ্দেশ করে একটু হাল্কাভাবে বলল মহাদেব।
—কিছু কিছু বুঝলাম মি: বার্ট। তবে এ বিষয়ে তর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু এইসব ধ্যান সাধনার সঙ্গে ডলফিনের কি সম্পর্ক তা তো বুঝলাম না?
—সম্পর্ক নিশ্চয় আছে… অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। আমাদের ধ্যান বা অধ্যাত্মদৃষ্টি বারে বারে বাধা পাচ্ছে বিরাট এক সাদা বিশালাকৃতি জলবাসী জীবের মস্তিষ্ক নিৰ্গত প্ৰচণ্ড চিন্তাশক্তির বিচ্ছুরণের জন্য। কাল মহাকাল বিশ্বচরাচরে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে সেই ভয়ঙ্কর বিচ্ছুরণ। সম্পূর্ণ ব্যাক আউট করে দিচ্ছে আমাদের মন–সম্প্রসারণের সমস্ত প্ৰচেষ্টা। বারে বারে আত্মা আমাদের দেহের খোলসের মধ্যে শামুকের মত গুটিয়ে নিজীব হয়ে পড়েছে। অবশেষে সেই বিচ্ছুরণের সঙ্গে একদিন মিলিয়ে দিলাম আমাদের সমবেত দেহ-বিচূতি আত্মিক শক্তিকে। তারপরেই জানতে পারলাম যে পৃথিবী এক ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে। সাগরের কয়েকটি বিশেষ প্ৰাণী থুলহুর
চিন্তাশক্তির বাহন। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ডলফিনরা। এদের ব্রেন অনেক উন্নত এবং এরা চিন্তাশক্তির অধিকারী। এদের বন্দী করে রিসার্চের নামে অত্যাচার করা মানে থুলহুর যুগযুগান্তরের ধ্যানরত চিন্তাশক্তিকে বাধা দেওয়া। ফলে ডলফিনের মস্তিষ্ক নিৰ্গত চিন্তার ভাইব্রেসান আলোড়িত করে তুলবে ধ্যানমগ্ন ভয়ঙ্কর সেই থুলহুকে। যুগযুগান্তের ধ্যান বাধাপ্ৰাপ্ত হলেই অবিশ্বাস্য অমোঘ বিপদ নেবে আসবে পৃথিবীর উপর। দুলে উঠবে আমাদের সৌরমণ্ডল। এক দারুণ বিপৰ্যয় ঘনিয়ে আসবে সমস্ত সৌরজগতে। তাই… তাই বলছি ছেড়ে দিন আপনাদের ভয়ঙ্কর রিসার্চ। মুক্তি দিন বন্দী ডলফিনদের। ইতিমধ্যেই বাধাপ্ৰাপ্ত হয়েছে থুলহুর ধ্যান। আর নয়… নিজেদের… সারা সৌরজগতের বিপদ ডেকে আনবেন না আর…
—থাক্ থাক্ অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু রিসার্চ আমার চলবে। সৌরজগতের বিপদ সামলাবার ভার দেখছি আপনাদের উপর।. তা ভারতবর্ষে সাগর তীরের তো অভাব নেই। অন্য কোন সাগর পারে সাধনা করে পৃথিবীকে বাঁচান না আপনারা?
চুপ করে নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল বার্ট। অন্তৰ্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে বারে বারে তাকালে আমাদের দিকে। তারপর এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো—না আর কোথাও যাব না আমরা। এখানেই সাধনা করবো। মনঃসংযোগ করবো সেই অমিত বিক্রম শক্তির সঙ্গে। চেষ্টা করবো আমাদের সন্মিলিত আত্মিক শক্তি দিয়ে ধ্যানমগ্ন থুলহুর চিন্তার চারপাশের দুৰ্ভেদ্য এক আবরণ সৃষ্টি করতে। আমাদের আত্মিক শক্তি দিয়ে আপনার মনের পরিবর্তন আসতেও চেষ্টা করবো আমরা। আমরা পৃথিবীর—মহাবিশ্বের যাবতীয় প্ৰাণ তো অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা মালার মত। সেই অদৃশ্য সুতোই তো অব্যয় অন্যায় অনন্ত মন বা আত্মা। যাক এসব কথা হয়তো বুঝলেও বুঝতে চেষ্টা করবেন না আপনারা। তবে আজ রাতেই আমাদের সন্মিলিত চেষ্টা হবে। আবার বলি ছেড়ে দিন আপনাদের রিসার্চ। নয়তো থুলহুর জাগরণে…
নাটকীয় ভাবে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল বার্ট। দুহাত বাড়িয়ে দিল সামনের সাগরের দিকে। বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরের উপর। দুএকটা জেলে নৌকা চলেছে দূর সমুদ্রে মাছের সন্ধানে। ভোরের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে পড়ছে বার্টের মাথায় লম্বা লম্বা চুলগুলো। হঠাৎ বার্টের গলায় জেগে উঠল গম্ভীর দুর্বোধ্য এক মন্ত্রঃ Ia! la! I thagua! I thagua cf ayak vulgtmm. Ia! uug! cthulhu fhtagu! Shub—Niggurath! I thagua uaftfhtagn!
—কি জানে ওরা থুলহুর? শুধু বড়ো বড়ো কথা? ডলফিনদের কাছ থেকেই তো পাব থুলহুর হদিশ! বুঝলে কাকু, শুধু নাম জেনেছে ওরা। দু একটা মন্ত্র আউড়ে তাক লাগিয়ে দিতে চাইছে সাধারণ লোকদের…
পাগল গ্যাঁজাখোর… লম্বা করিভোর দিয়ে বড় বড় পা ফেলে যেতে যেতে গজ গজ করতে লাগিল মহাদেব। ভোরের সাগর বেলার ঘটনা গুলো কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছে না।
—ওসব চিন্তা ছেড়ে দাও মহাদেব। কে কী বললো না বললো তাই নিয়ে মাথা ঘামালে চলে? মহাদেবকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম।
—থাক, কাকু, তুমি তো জলের ওপরে এবং নীচে সাউণ্ড রেকর্ডিং এর যাবতীয় সাজ সরঞ্জাম দেখেছে। যত ক্ষীণ অস্পষ্ট শব্দ হোক না কেন জলের গভীরে আমার রেকর্ডিং সিস্টেমে ধরা পড়তে সে বাধ্য।
—এসব তো দেখলাম মহাদেব। কিন্তু এগুলো ব্যবহার কর কোথায়? কোথায় বা সেই ডলফিন পুল?
—সেখানেই তো নিয়ে যাচ্ছি তোমায়। ডলফিন পুলেই সাধারণতঃ সাউণ্ড রেকর্ডিংগুলো করা হয়। তবে গভীর সমুদ্রেও আমার সাউণ্ড রেকর্ডিং সিস্টেম খুব ভাল কাজ দেয়। কাকু, ঐ ডলফিন পুলে তোমাকে কাজে লাগতে হবে। কারণ সাউণ্ড রেকর্ডিং—এ তো আর চিন্তার রেকর্ডিং সম্ভব নয়।
একটা বিশাল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। বন্ধ দরজা। ঠিক যেন রাজারাজারাদের বাড়ীর দরজার মতন। এখানকার মধ্যে সবচেয়ে বড় ল্যাবরেটারী এটাই। ল্যাবের পেছনে গভীর সমুদ্র। বলতে গেলে সমুদ্রের মধ্যে’ থেকে গাঁথা হয়েছে ল্যাবের দেওয়ালটা। তিন পাশের দেওয়ালে কোন জানলা নেই।
পকেট থেকে চাবি বার করে বন্ধ দরজা দুটো খুলে ফেললো মহাদেব। প্ৰথমে কিছু দেখতে পেলাম না। সব অন্ধকার। তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে দেখতে পেলাম ভেতরে আলো আছে। তবে ঘরের তুলনায় খুবই কম। ঘরের তিনভাগ জুড়ে প্ৰকাণ্ড এক জলাধার। সুইমিং পুলের মত। ঘরের তিন কোণে উজ্জ্বল সবুজ আলো। উজ্জ্বল হলেও অতবড় ঘর জুড়ে কেমন যেন চোখ ধাঁধানো নীলাভা। চোখ রগড়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। জলের চার পাশে নানান রকম আলোর সরঞ্জাম। সাউণ্ড রেকর্ডিং এর জন্যে অনেকগুলো মোটা মোটা তার কাণ্ডুইট পাইপের মধ্যে দিয়ে নেবে গেছে জলের মধ্যে। সেখান থেকে অনেকগুলো তার মোটা হয়ে চলে গেছে ঘরের বাইরে। কম্পুটার ঘরের দিকে।
পুলের মধ্যে কতটা জল আছে হদিশ করতে পারলাম না। ঠিক মাঝখানে ধূসর কালচে রঙের বিশাল একটা পিঠ ভেসে আছে। ফটাফট করে কয়েকটা সুইচ টিপে দিল মহাদেব। মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল ঘরটা। আর সব দেখতে পেলাম। জলের মধ্যে দিয়ে হাল্কা হলদে মেশানো সাদা রঙের বেশ চওড়া পিঠটা দেখা যাচ্ছে। ক্লিপার বা ডানা দুটো দিয়ে মৃদু মৃদু আঘাত করছে জলে। লম্বা মুখের মধ্যে ধারালো দাঁত ঝক ঝক করে উঠছে হাঁ করার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু আশ্চৰ্য! কি প্ৰকাণ্ড গোলাকার চোখ দুটাে। জ্বলজ্বল করছে। কি অদ্ভুত রেস্পন্সিভ চোখ। বুদ্ধিমত্তার ছাপ ওর দৃষ্টিতে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেমন যেন অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলাম আমি। একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে।
ঘরের এক প্ৰান্তে মাঝারী আকারে লোহার এক লকগেট। বাইরের সমুদ্রের সঙ্গে ঘরের জলাশয়ের একমাত্ৰ যোগাযোগ মাধ্যম। মোটরের সাহায্যে লকগোটটা ওপরে তুলে নিলেই বাইরের সাগর জল ঢুকবে হুহু করে।
এতক্ষণ নজরে পড়েনি। সুইমিং কস্ট্যুম পড়ে সুসানও জলের মধ্যে ডুবে রয়েছে ডলফিনের পাশে। চোখে চোখ পড়তে মৃদু হাসিতে ভরে উঠল সুসানের মুখ।
—কাকু, সারা দিনরাতের মধ্যে বেশীর ভাগ সময় এখানেই থাকে সুসান। উদ্দেশ্য শুধু ডলফিনের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। Better understanding আর কি! শুধু তাই নয়। আমার সারা জীবনের চেষ্টাকে বাস্তব রূপ দেবারও চেষ্টা করছে সুসান।
জল ছেড়ে উঠে এল সুসান। উজ্জল আলোয় সুসানকে কেমন যেন জলচর জীব বলেই মনে হল। গোল গোল চোখ দুটো ঠেলে যেন বাইরে ঝুলে পড়েছে। সুইমিং কস্ট্যুম পড়া সুসানকে সম্পূর্ণ অপার্থিব ঠেকল আমার।
পুলের পাশে কয়েকটা ছোট ছোট চেয়ার আর টেবিল। মহাদেব, আমি আর সুসান টেবিল ঘিরে বসলাম সেখানে। পুলের মধ্যে ডলফিনটা চোখ ঘুরিয়ে দেখছিল এতক্ষণ আমাদের। সুসানকে আমাদের সঙ্গে বসতে দেখেই কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল সে। ঘনঘন ক্লিপার আছড়াতে লাগিল জলের উপর। সমস্ত পুলটায় বারে বারে ঘুরতে সুরু করল।
—কাকু, এই ডলফিনটা Tursiops truncata জাতের এক ভালো স্পেশিমেন। তবে সাধারণ সাইজের চেয়ে একটু ছোট। মোটে সাড়ে ছ’ফুট লম্বা। ব্রেন বা মস্তিষ্কের ওজন ১৭০০ গ্রাম। মানুষের চেয়ে ৩৫০ গ্রাম বেশী। শুধু তাই নয় ব্রেন সেলের ঘনত্বও অনেক বেশী।
প্ৰায় একবছর হলো ও আমাদের বন্দী। ওর প্রতিটি শব্দ বারে বারে রেকর্ড করে নিয়েছি। বার্ক, গ্ৰাণ্টস ক্লিক্স, স্ক্রাপ এবং হুইসিল সব। শুধু তাই নয়। আমাদের স্বর নকল করা ওর সমস্ত উচ্চারণও তুলে নিয়েছি রেকর্ডে। সব শুনে দেখে কি মনে হয় জান—নিজেদের মধ্যে নিশ্চয় ওরা কথা বলে। কথা বলার নির্দিষ্ট কোন কোড আছে ওদের। দক্ষিণ প্ৰশান্ত মহাসাগরের পোনাপের কাছে কতকগুলো নেভী বােট সোনার (Sonar) চাৰ্ট তৈরী করেছিল। সেই চার্টে স্পষ্ট দেখা যায় যে বেশ কয়েক মাইল তফাতেও ডলফিনদের চালচলনে অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। এখানেই শেষ নয়। এত সূক্ষ্ম এবং গাণিতিক এদের নড়াচড়া বা চালচলন যে মনে হয় এরা যেন রিহার্সাল দিচ্ছে বা ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠান পালন করছে একযোগে।
—তাই নাকি? এতো সত্যি বিস্ময়কর ৷ সাগরের ডলফিনরাও তাহলে…
—শুধু তাই নয় কাকু, আমার স্থির বিশ্বাস টেলিপ্যাথির মাধ্যমে এরা কথা বলে নিজেদের মধ্যে। টেলিপ্যাথির সেই ওয়েভলেংথটাই খুঁজে বার করতে হবে আমাদের। হিপ্নোটিজমের মাধ্যমেই খোঁজ করতে হবে ওদের ভাবনা চিন্তার আসল স্বরূপকে। আর এবিষয়ে আপনার সঙ্গে পূর্ণসহযোগীতা করবো আমি। আমি আর মহাদেব একমত এবিষয়ে। জলে ভেজা হাত দুটো পুঁছতে পুঁছতে বলল সুসান।
ডঃ লী–র বইয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার। প্রশ্ন করলাম—মহাদেব, ডলফিনের ব্রেনে মিনি ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে প্লেজার স্টিমুলাস সম্বন্ধে পরীক্ষা করেছো কখনও?
একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ল মহাদেব। অসহিষ্ণুভাবে বললো—এতো অনেক পুরানো কথা। আমরা সবাই জানি যে কোন জটিল অনুভূতি মুহুর্তের মধ্যে শিখে নিয়ে স্টিমুলাস (stimulus) উপভোগ করতে পারে ডলফিনরা। জীবেদের মধ্যে আর কেউ কিন্তু এমনটি করতে পারে না। এটাকে প্রায় Electrical Masterfutin বা LSD বলা যেতে পারে। ঠিক যেমন ঐ সাগরতীরের হিপিরা চরস ভাঙ খেয়ে স্টিমুলেটেড হয়। তবে যে যাই বলুক—একমাত্র এই গুণে কিন্তু ডলফিনদের আমাদের সমকক্ষ করে তোলেনি। সুতরাং ডঃ লী এখন অনেক পেছনে পড়ে গেছেন।
মহাদেবের কথা শুনতে শুনতে বার বার আমি তাকাচ্ছিলাম জলের দিকে। জলের একেবারে কিনারে এসে ভাসছে বিশাল ডলফিনটা। লম্বা ঠোঁট দুটো তুলে দিয়েছে পাড়ের উপর। কিন্তু কি আশ্চর্য! ডান চোখের মণিটা জ্বলছে যেন ধকধক করে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বারবার করে দেখছে আমাদের। আমাদের দেখছে ডলফিন? কেন জানি না মনে হল সুসানকেই দেখছে ও ৷ স্পষ্ট যেন মানুষের চোখের চাউনি। ঈর্ষায় জ্বলে জ্বলে উঠছে চোখ দুটাে। সত্যি কি ডলফিন এতটা অনুভূতি প্ৰবণ? থেকে থেকে ঘনঘন আছড়াচ্ছে দুপাশের ডানা বা ক্লিপার দুটোকে৷ ছিটকে উঠছে জল চারপাশে। কি অদ্ভুত আকর্ষণ ঐ চোখের? বারবার চেষ্টা করেও দৃষ্টি ফেরাতে পারছি না। কি বলতে চায় জলচর প্রাণীটা?
হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে পড়ল সুসান। কেমন যেন ছটফট করে উঠছে ওর সর্বাঙ্গ। ঘনঘন কয়েকবার তাকাল অস্থির সেই ডলফিনটার দিকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল – কাকু, কবে থেকে সুরু করবেন পরীক্ষা? বহুদিন চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি ডলফিনের চিন্তাধারা। কেমন যেন ধরা দিয়েও ধরা পড়ছে না। সেই সময় দারুণ অস্বস্তি হয় আমার। সবকিছু ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় সামান্য এক কঠিন আড়াল রয়েছে আমাদের মধ্যে। যদি একবার… একবার সরে যায় সেটা… কাকু আর দেরী করতে পারছি না। দেখছেন না কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। ও। ছটফট করছে। যাই আমি… পরে কথা বলবো ঝপাং করে লাফিয়ে পড়ল সুসান জলের মধ্যে। মুহুর্তের মধ্যে জল ছেড়ে শূন্যে ডিগবাজী খেয়ে নিল ডলফিনটা। তীক্ষ্ণ হুইসিলে ভরে গোল ঘরটা। সুসানকে ফিরে পেয়ে উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে ডলফিন। সুসানও যেন মানুষ নয়। ও ডলফিনের সঙ্গে মাতামাতি সুরু করে দিল পুলের মধ্যে। অবাক আমি। এও কি সম্ভব!
সারাদিন কেটে গেল নানান কাজে। রাতের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে দিয়ে আমি আর সুসান বেরিয়ে এলাম সাগর পারে। চারদিক নিস্তব্ধ নিথর। ঢেউ ভাঙ্গার একটা না আওয়াজ ভেসে আসছে। দশমীর চাঁদ মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে মাঝেমাঝে। আবছা আলোয় মায়াময় বলে মনে হয় সাগরতীর। মহাদেব আসেনি আমাদের সঙ্গে! সারাদিনের নানান পরীক্ষার ফলাফল নির্ণয়ে ব্যস্ত।
আমার পাশে পাশে হাঁটছে সুসান। আমার মহাদেবের বউ। ডলফিন–পুলের মধ্যে ওকে অদ্ভুত সুন্দর লেগেছিল আমার। মনে হয়েছিল সত্যি সুন্দরী হয়েছে আমার মহাদেবের বউ। কিন্তু রাতে খাবার টেবিলে সুসান যেন একেবারে অন্য। কেমন যেন খস্খসে গায়ের চামড়া। কোন লাবণ্য নেই কোনখানে। গোল গোল চোখ দুটো জলে ভর্তি। ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে। চোখের সেই উজ্জ্বলতা কোথায় গেল সুসনের? কেমন যেন। নিম্প্রভ মরা চোখের চাউনির মত।
—কাল থেকে হিপ্নোসিস কোর্স সুরু করবো। সত্যি কি তুমি রাজী আছ সুসান? ভেবে দেখ একবার।
একেবারে জলের ধারে চলে এসেছি আমরা। সাদা ফেনার মুকুটপরা ঢেউগুলো একনাগাড়ে আছড়ে পড়ছে তীরের উপর।
—হ্যাঁ কাকু, আমি রাজী। এ–ছাড়া তো কোন পথ নেই। এটা যদি সত্যি বলে প্ৰমাণিত হয় তাহলে এতদিনের সাধনা সার্থক হবে মহাদেবের। আর মহাদেবের জন্যে সবকিছু করতে রাজী আমি। আপনি তো জানেন কাকু, বিয়ের আগে থেকে এই নিয়ে রিসার্চ করছি দুজনে। আমাদের বিয়ে করার উদ্দেশ্যও তো এক।
—না না সুসান, সেভাবে বলিনি আমি। আমি বলছিলাম হিপ্নোসিসের তো রিস্ক আছে, তাই…
—জীবনটাই তো একটা রিস্ক। কোন পথ নেই এছাড়া। মহাদেবকে খুশী করার জন্যে সবকিছু করতে প্ৰস্তুত আমি। তাছাড়া সাগরের এই অদ্ভুত জীবকে জানতে হবে আমায়। জানতে হবে ওদের রহস্য। তাইতো সারাদিন পুলের জলে পড়ে থাকি আমি। খেলা করি ডলফিনটার সংগে।
—সুসান, এত বিষয় থাকতে হঠাৎ Dolphinology নিয়ে রিসার্চ সুরু করলে কেন? কথার মোড় ঘোরাতে চেষ্টা করলাম আমি। মহাদেব আর সুসনের ব্যক্তিগত জীবনের কথা জানতে কেমন লজ্জা লাগে। একটা বড় ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল পায়ের পাতা। সর সর করে সরে যাচ্ছে পায়ের তলা থেকে বালিগুলো। মনে হয় এগিয়ে যাচ্ছি চলন্ত বালির সঙ্গে সঙ্গে সাগরের দিকে। চলন্ত বালির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। কি একটা সর সর করে উঠল পায়ের তলায়। তাড়াতাড়ি সরে এলাম খানিকটা। ছোট একটা কাঁকড়া আটপায়ে ভর করে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। কি আশ্চর্য। সামনের বড় দাঁড়া মাত্র একটা। বেশ বড় আর মোটা দেহের অনুপাতে। টকটকে লাল। এসব দেখতে দারুণ ভাল লাগে আমার।
—কেন জানি না সেই ছোটবেলা থেকে সমুদ্র আর তার নানান অজানা জীবরা প্ৰচণ্ডভাবে আকর্ষণ করে আমাকে। আমার বাড়ীতে ইন্সমাউথে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকঘণ্টা কেটে যেত আমার এক্যুরিয়ামের দিকে চেয়ে চেয়ে।
—ইন্সমাউথেই বরাবর বসবাস করেছো তুমি?
—ইন্সমাউথ আমার দেশ না হলেও এখানেই বাড়ীঘর করে বসবাস সুরু করে ছিলেন বাবা। আমার মা মারা যায় এখানেই। বাবার প্রধান কাজ ছিল তিনি শিকার। বড় বড় কোম্পানীর জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তো বাবা দূর সমুদ্রে তিমি শিকারে। সঙ্গে থাকতো লোকজন সাজসরঞ্জাম। তিমি শিকারে দারুণ সুনাম ছিল বাবার। হয়তো বাবার দৌলতেই সাগরের প্ৰতি প্ৰবল আকর্ষণ জন্মেছে আমার। কিন্তু সেই সাগরেই হারালাম বাবাকে। এই তো কয়েকবছর আগের কথা। শুনেছি বিশাল এক তিমির পেছনে ছুটেছিল বাবার জাহাজ। অতবড় তিমি নাকি কেউ দেখেনি কখনো। তারপর কোন এক উত্তেজনা মুহুর্তে জাহাজ থেকে পড়ে যান আমার বাবা। লাইফ বেল্ট ফেলা সত্ত্বেও দারুণ স্রোতে ভেসে যান। তারপরে অবশ্য আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। তবে ঐ জাহাজের এক বুড়ো নাবিক বলেছিল সে নাকি ঐ বিশাল তিমির পিঠে চড়ে থাকতে দেখেছিল বাবাকে। বাবাকে নিয়েই তিমিটা ডুব দিয়েছিল গভীর সাগরের তলায়। তবে শেষবার সমুদ্র যাত্রার আগে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল বাবা। আজও তার মানে খুঁজে পাই নি।
—কি কথা সুসান? কি বলেছিলেন বাবা তোমাকে?
—খুব তাড়াতাড়ি ইন্সমাউথ ছাড়তে বলেছিলেন আমাকে। না হলে আমার নাকি দারুণ বিপদ। কিন্তু কি বিপদ সে কথা বলেন নি আমাকে। সেইদিন সকালেই ভীষণ এক আগুন লেগেছিল আমাদের শহরের সবচেয়ে পুরানো লাইব্রেরীতে। সেই আগুনের কথা বলতে বলতে হঠাৎ ঐ কথাটা বলেছিলেন। আমাকে।
—তারপর…তারপর কি করলে তুমি?
—কেন জানিনা কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল আমার। আগুনের সংগে কি কোন সম্পর্ক আছে বাবার কথার? তাই আগুন লাগার পরের দিন থেকে যাবতীয় সব খবরের কাগজ জোগাড় করলাম। যদি কিছু হদিশ পাওয়া যায়। প্রায় সব কাগজে মামুলী সব খবর। কিন্তু পুরানো এক ছোট খবরের কাগজে অদ্ভুত এক সংবাদ পড়লাম। ঐ লাইব্রেরীতে অতি প্ৰাচীন কয়েকটা পুঁথি আছে। যার মধ্যে আটলান্টিস, প্রভৃতির অতল সাগরে তলিয়ে যাওয়া কয়েকটি শহরের যথাৰ্থ বৰ্ণনা দেওয়া আছে। আর আছে থুলহুর সম্ভাব্য আর্বিভাব রহস্য, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, স্ব–ইচ্ছায় বন্দী ধ্যানরত থুলহুর উদ্দেশ্য আর আবাহন মন্ত্র। এমন সময় অদ্ভুত এক লোকের আবির্ভাব হয় ইন্সমাউথে। সাগর জলে পড়ে থাকত সে সারাদিন। ঠিক মাছের মত। অদ্ভুত ভেজা ভেজা ছিল ওর দেহ। সবসময় যেন জল গড়াচ্ছে। চোখ দুটো ঠিক মাছের মত। গোল গোল। ঠেলে বেরিয়ে আসছে বাইরে। লোকে বলতে সাগরের মানুষ ও। ওর জন্মরহস্য কেউ জানে না। ও নিজেও বলতে পারে না। সেই সুরু করে দিয়েছিল থুলহুর বন্দনা। বিচিত্র এক গোষ্ঠী তৈরী হয়ে উঠেছিল ওর দেখাদেখি। লাইব্রেরীর সেই পুরাতন পুঁথিগুলো চেয়েছিল ওরা। বলেছিল পুঁথিগুলো বিশেষ প্রয়োজন ওদের। না হলে থুলহুর জাগরণে ধ্বংস হবে গোটা ইন্সমাউথ। আরও অদ্ভুত কথা বলেছিল ওরা। বলেছিল সাগরের এক বিচিত্র জীব আর মানুষের মিলনের ফলে জন্ম পৃথিবীর অনেক লোকের। তাদের সকলকে জড়ো করতে হবে। সকলে এক হয়ে আত্মিক শক্তির জোরে ধ্যানভঙ্গ করাতে হবে যুগ যুগান্ত ধরে স্বইচ্ছায় বন্দী থুলুকে। এক অপার্থিব আনন্দে জেগে উঠবে বিশ্বচরাচর। কিন্তু সেই রাতে বিধ্বংসী আগুনে ধ্বংস হয়ে যায় লাইব্রেরী। আর সম্পূর্ণ নিপাত্তা হয়ে যায় অদ্ভুত সেই লোকটা।
গম্ভীর অথচ ফ্যাঁস ফ্যাঁসে গলায় বলছিল সুসান বিচিত্র সেই কাহিনী। অবাক হয়ে শুনছিলাম আমি। আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিলাম সুসানের দিকে। সুসানের হাত–পা সব যেন কেমন খস্খসে অথচ ভেজা ভেজা। চোখ দুটো কেমন গোল গোল। ঝুঁকে পড়েছে বাইরের দিকে।
পায়ে পায়ে অনেক দূর এসে পড়েছি আমরা। বোধহয় মাইলখানেক হবে। মেঘের বুকে মুখ লুকিয়েছে চাঁদ। একটা তারাও নেই আকাশের বুকে। ঢেউ ভাঙার শব্দ উঠছে অনবরত! সামনে বিস্তৃত সাগর বেলা। হলদে বালির সমুদ্র। হাওয়া পড়ে গেছে। থম্ থম্ করছে চারদিক। কেন জানিনা হঠাৎ মনে হল সুসানের গল্পের সঙ্গে কি কোন যোগাযোগ আছে এই থমথমে পরিস্থিতির? এ কি আমার মনের ভুল! সুসানও একেবারে চুপচাপ। অকারণেই অন্ধকার সাগরের দিকে তাকালাম বারবার। ফেনার মুকুটগুলো অন্ধকারের মধ্যে প্রবল আক্ৰোশে ছুটে আসছে আমাদের দিকে।
বেশ কিছু দূরে তীরের উপরও দাউ দাউ করে জ্বলছে একটা আগুন। কালো কালো মূৰ্তি কয়েকটা নেচে নেচে ঘুরছে আগুনের চার পাশে। ঠিক যেন সিল্যুট ছবি। অস্পষ্ট এক শব্দ ভেসে আসছে ঐ দিক থেকে। সমবেত কণ্ঠে দূর্বোধ্য কোন কিছু উচ্চারণ। তালে তালে বিচিত্র ছন্দে আওয়াজ জোর হচ্ছে আর কমছে। একটা শব্দ আমার পরিচিত। থেকে থেকে থেকে ছন্দের শেষে উচ্চারিত হচ্ছে থুলহুর নাম। হঠাৎ সম্মিলিত গলায় থম্থমে নিস্তব্দতা ছিন্ন–ভিন্ন করে আওয়াজ উঠল… Cthulhu fhtgan। শিরা–উপশিরার মধ্যে রক্তস্রোত যেন হিম হয়ে এল। এই নিকষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন সাগর থেকে দেখা দেবে বুঝি ভিন্ গ্রহের দেবতা (?) থুলহুর বিশাল ভয়ঙ্কর দেহ। সারা আকাশ–বাতাস বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেই পরম মুহুর্তের অপেক্ষায় ধ্যানমগ্ন। আমার চোখের সামনে আকাশ–বাতাস সাগর সব একাকার হয়ে গেল। অন্ধকারে আবৃত আকাশের বুকে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের অনন্ত অগণিত সৌরজগত বুঝি ভেসে উঠল। এ কি বিশালত্বের আভাষ। কল্পনা করা যায় না। শুধু মন–প্ৰাণ দিয়ে অনুভব করতে হয়। কোটী কোটী ছায়া পথ জুড়ে চলেছে সেই পরম বিস্ময় আদি–অনন্ত অব্যয় থুলহুর ধ্যাণারাতি। মনে হল কোথায় চলেছি আমি আমি কে… থুলহুর স্বরূপ যে জানতে হবে আমাকে।
—কাকু… কাকু কি হলো আপনার কাকু? একটু উত্তেজিত হয়ে আমার হাত ধরে ঝাকুনি দিল সুসান।
কোথায় মিলিয়ে গেল কোটী সুৰ্য গ্ৰহ ছায়াপথ। বাস্তবে ফিরে এলাম আবার। মনে পড়ল হিপি বার্টের কথা। থুলহু আরাধনায় মগ্ন হিপিরা। সারারাত চলবে ওদের নাচ–গান।
—একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম সুসান। চলো ফিরে যাই। রাত হয়েছে অনেক।
পর পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। কাজের চাপে দারুণ ব্যস্ত থাকতে হলে আমাকে। একদিনের ঘটনা খুব যত্ন করে ডাইরীতে লিখলাম আমি। টেলিপ্যাথির মাধ্যমে ডলফিন পুলের বিশালে ঐ ডলফিনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করলাম। এ জন্য হিপ্লোটাইজড্ করতে হল আমাকে সুসানকে।
২০শে এপ্রিল—ভোর বেলা। সুসান ডলফিন পুলে। পরণে গাঢ় নীল রঙের সুইমিং কষ্টুম। সত্যি সুসান আদর্শ সম্মোহন সাধ্য (Suggestible) মেয়ে। হাল্কা ভাবে সন্মোহিত করলাম ওকে। Post–hypnotic আদেশ সঞ্চারিত করলাম সুসানের মধ্যে। ফলে ও সতর্ক থাকবে। তার ফলেই ডলফিনের মনের ভাব বা তরঙ্গ ধরা পড়বে সুসানের মধ্যে। প্ৰথমবারে হল না কিছু। তন্দ্রা থেকে জাগাবার পরেও পুল ছেড়ে উঠল না সুসান। নানানরকম খেলায় মেতে গেল ডলফিনের সঙ্গে।
সুসান জল ছেড়ে উঠে আসার চেষ্টা করলেই বিরক্তিতে ফেটে পড়ে রাজা। বাঁশির মত তীক্ষ্ণ চীৎকারে ভরিয়ে তোলে ল্যাবটা। হ্যাঁ, আরো একটা কথা লিখতে ভুলে গেছিলাম। এ কদিন সুসানের হাত থেকেই খাবার খাচ্ছে রাজা। জ্যান্ত মাছ, মাংস আর কিছু সমুদ্র–জাত জলজ শ্যাওলা।
অজস্র ধারালো দাঁতওলা সরু চোয়াল দিয়ে যখন রাজা জ্যান্ত মাছগুলো ধরছিল তখন সত্যি আমার ভয় হচ্ছিল। ভয় হচ্ছিল যদি একবার কামড়ে ধরে সুসানের হাতটা! আমার সন্দেহের কথা জানালাম মহাদেবকে। মহাদেব হেসে উড়িয়ে দিল আমায় কথা। বললো সম্পূর্ণ অমূলক আমার সন্দেহ। নানান বই দেখিয়ে বলল যে ভুলক্রমেও ডলফিন মানুষের ক্ষতি করেছে বা আক্রমণ করেছে বলে কোন নজীর নেই রূপকথা বা ইতিহাসে। তারপর পুঁটার্ক থেকে পড়ে শোনাল কিছুটা।
—“প্ৰকৃতিদত্ত দার্শনিকের সবচেয়ে বড় যে গুণ প্ৰত্যাশবিহীন নির্মল বন্ধুত্ব সেই গুণের সম্পূর্ণ বিকাশ দেখতে পাওয়া যায় ডলফিনদের মধ্যে। পৃথিবীর আর কোন প্ৰাণীর এই গুণ নেই।” এর পর মহাদেব বললো যে যুগ–যুগান্ত ধরে মানুষকে ভালবেসে এসেছে ডলফিন। প্রয়োজন–অপ্রয়োজনে মানুষ হত্যা করেছে ডলফিনদের। কিন্তু সামান্যতম কোন ক্ষতি করে নি ওরা মানুষের।
২২শে এপ্রিল—না, আজও কোন রেজাল্ট পাওয়া গেল না। মহাদেব তো আরও Deeper মানে গভীর হিপ্নোসিস আর জোরালো Suggestion-এর জন্যে চাপ দিচ্ছে আমাকে। শুধু তাই নয়, সন্মোহিত করার পর আবিষ্ট অবস্থা বা Trance–এর মধ্যে সুসানকে দু–একদিন ডলফিন পুলে রেখে দেবার কথাও বলছে মহাদেব। তবে মাথা যাতে জলের মধ্যে ডুবে না যায় সেজন্য প্ৰবল ইচ্ছাশক্তিকেও কাজে লাগাতে হবে আমাকে। আমি আপত্তি জানালাম। বললাম হাজার ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগালেও কোন দুর্বল মুহুর্তে জলে ডুবে কোন বিপদ ঘটতে পারে সুসানের। চুপ করে শুনেলো মহাদেব। তারপর দৃঢ়তার সঙ্গে বলল—না না তা হবে না। রাজা ওকে ডুবতে দেবে না। ঠিক জল থেকে তুলে ধরবে ওকে।
৩০শে এপ্রিল—মহাদেবের কথায় রাজী হইনি তখন। এতদিন চেষ্টা করলাম। না আমার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল। অবশেষে রাজী হতে হল মহাদেবের কথায়। সব জানালাম সুসানকে। অদ্ভুতভাবে আগ্ৰহী সুসান। ওর চোখে কেমন যেন অস্বাভাবিক দীপ্তি। চোখের মণি দুটো কি যেন খুঁজছে সব সময়ে। হিপ্লোটাইজ করার পর এ রকম তো দেখিনি কখনো। এ কিসের আভাষ।
১লা মে—ভোরবেলা চলে এলাম ডলফিন পুলে। আশ্চর্য! রাতেও কি ঘুমোয় না মেয়েটা। একমনে ডলফিনের সঙ্গে সাঁতার কেটে চলেছে সুসান। থেকে থেকে সুসানের বব-ছাঁট চুলের মধ্যে সরু ঠোঁট ঢুকিয়ে মৃদু শব্দ করে উঠছে রাজা। অবাক হয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। আমার উপস্থিতিকে গ্ৰাহাই করল না ওরা। সুসানও রাজাকে জড়িয়ে ধরছে মাঝে মাঝে। গলা খাঁকারি দিলাম। কয়েকবার ফিরে তাকাল সুসান। তারপর ফিরে এল ও। পুলের ধারে গভীরভাবে সন্মোহিত করলাম। ওকে। ঠিক পুলের মাঝে স্থির হয়ে ভাসছে রাজা। একভাবে চেয়ে আছে সুসানের দিকে। গোল গোল চোখ দুটো মাঝে মাঝে ঘুরছে আমার দিকে। দৃষ্টিতে কি ওর ঈর্ষা না রাগ না। অন্য কিছু? মানুষ ছাড়া অন্য কোন জীবের চোখের ভাষা কি এত স্পষ্ট! বাঙময়! রাজা কি আমাকে পছন্দ করছে না। অথচ এখনও পর্যন্ত শত্ৰু তো কেউ নেই আমার। অন্য ডলফিন পুলের ডলফিনদের সঙ্গে তো ভালই বন্ধুত্ব হয়েছে এতদিনে। কেবল রাজার সঙ্গে কেন দোস্তি হচ্ছে না। জল থেকে সাবধান থাকবার Suggestion খুব দৃঢ়ভাবে সঞ্চারিত করে দিলাম সুসনের অধসচেতন মনের মধ্যে। তারপর কয়েক ঘণ্টা পরে ছেড়ে দিলাম ওকে জলের গভীরে। রাজার সঙ্গে। সুসানের অবস্থা ঠিক Sleepwalker এর মত। আবিষ্টতায় আচ্ছন্ন সুসান। পুলের মাঝে ভাসছে। রাজা বোধহয় হতভম্ব। সুসান তো আগের মত খেলছে না।
ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেল এমন করে। কোন সময়ে তন্দ্ৰাচ্ছন্ন সুসান জলের কিনারে বসছে নয় তো আপন মনে সাঁতার কেটে চলেছে। নানান রকম আওয়াজ করে দৃষ্টি ফেরাতে চেষ্টা করছে রাজা। ডানা দুটো দিয়ে মাঝে মাঝে অ্যালতো করে চাপড় মারছে সুসানের দেহের উপর। বিরক্তিতে থেকে থেকে অস্থির হয়ে উঠছে। অস্থির হয়ে সরু ঠোঁট দিয়ে সুসানের মাথায় মুখে মৃদু মৃদু আঘাত করছে। আমি যতই দেখছি ততই বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছি। সত্যি কি এ সম্ভব! তাহলে টেলিপ্যাথিতে কেন ধরা পড়ছে না রাজার চিন্তার ছবি।
জল থেকে সুসানকে তুলে আনলাম। এবার এক আশ্চৰ্য ব্যাপার ঘটল। জলের ধারে ছিল রাজা। তন্দ্রাচ্ছন্ন সুসানকে তুলে নিয়ে আসার সময় এক তীক্ষ্ণ চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গে তীরের মত তীরবেগে ছুটে এল রাজা। চকিতের মধ্যে ডাঙায় উঠে পড়লাম। একটু দেরী হলে নির্ঘাৎ কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিত আমার সর্বাঙ্গ। আর তার ফলে বিশ্বের ইতিহাসে আমিই ডলফিন আক্রমণে প্রথম মানব-শিকার হতাম। সমস্ত ডলফিন পুল জুড়ে অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াল রাজা। বড় বড় চোখ দুটো মেলে আমার দিকে তাকাল একবার। কি কুটিল নিষ্ঠুর ওর চাউনি।
২রা মে—জলের মধ্যে আরো বেশীক্ষণ সম্মোহিত অবস্থায় রাখার জন্য বলল মহাদেব। কারণ আবিষ্ট অবস্থা কেটে যাবার পর সুসান বলেছিল যে আবছা আবছা কোন কিছু যেন ওর মনে পড়ছে। মহাদেবের মতে এগুলোই টেলিপ্যাথির প্রাথমিক অবস্থা। কিন্তু আমি তো জানি এগুলো নিছক Pseudo memories ছাড়া কিছু নয়। Subconcious অবস্থায় মহাদেবকে খুশী করার চিন্তার ফসল এসব। মহাদেবের কথায় রাজী হলাম না আমি।
সাগর তীরে সারারাত ধরে থুলহুর আরাধনা করে হিপিরা। বিচিত্র মন্ত্রপাঠ আর চীৎকারে রাতের ঘুম ভেঙে যায় আমাদের। বিশেষতঃ সুসানের খুব অসুবিধে হয়। ক্লান্ত শরীরে বিশ্ৰাম হয় না ওর।
৬ই মে — আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম। হুবহু কতকগুলো বিচিত্র দৃশ্য বা ছবির কথা বলল সুসান। আজকে বিকেলে আবিষ্টতা কাটবার পরেই বলতে সুরু করেছিল সুসান। মহাদেবের কথাতে পরক্ষণেই আবার সন্মোহিত করলাম ওকে। যদি এগুলো আরো স্পষ্ট হয়। আরো বেশী করে মনে পড়ে সুসানের। আবিষ্ট থাকাকালীন বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করলাম ওকে। কিছু কিছু উত্তর দিল সুসান। প্রশ্ন আর উত্তরগুলো টেপে ধরে রাখলাম। সাগরতলায় কয়েকটা ভাঙা চোরা সহরের কথা বললে সুসান। বড় বড় জানলা দরজা খিল প্রভৃতি সবকিছুতেই পুরু হয়ে জমে আছে শ্যাওলা। জানা অজানা সব সামুদ্রিক প্রাণীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে। আমার তো মনে হল এ সমস্ত কাল্পনিক। বারবার করে পীড়াপীড়ি সুরু করলো সুসান! কেমন যেন নেশায় পেয়েছে ওকে। আবিষ্ট অবস্থায় চব্বিশ ঘণ্টা ডলফিন জলে রেখে দেবার জন্য বেশ চাপ দিল ওরা দুজন। এবারেও রাজী হলাম না আমি।
৭ই মে— ভোর ৪টের সময় আমার ঘরে এল মহাদেব। তখনও দিনের আলো ফোটে নি বাইরে; সাগরের গর্জন এক ছন্দোময় রূপ নিয়ে ভেসে আসছে ঘরের মধ্যে। চোখে মুখে ওর রাত জাগা ক্লান্তি। বার বার করে জোর করল আমাকে, শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলাম — ফলাফলের জন্যে আমি কিন্তু দায়ী হবো না মহাদেব। মহাদেব বললো — না না কেউ দায়ী হবে না। সব দায়িত্ব আমার। আমার ইনষ্টিটিউটের সব দায়দায়িত্ব আমার। তারপর আমাকে নিয়ে গেল ওর অফিস ঘরে। মোটা পলিথিনের শক্ত এক বয়ার মত জিনিস তৈরী করেছে মহাদেব। হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে ডলফিন পুলের মধ্যে ভাসিয়ে দেবে। আর সন্মোহিত সুসানকে আলগা করে বেঁধে দেবে বয়ার সঙ্গে। ফলে আর জলে ডুববে না ও। বিস্ময়ে অবাক হচ্ছি মহাদেবের সংকল্প দেখে। শেষ পর্যন্ত রাজী হতে হল আমাকে।
৮ই মে— সব ঠিক হলো। সুসান আর মহাদেব দুজনেই দারুণ উত্তেজিত। Light hypnosis এর সময় যে সমস্ত আবছা আবছা স্মৃতি মনে পড়েছিল সুসানের তাতেই ভবিষ্যত সম্ভাবনায় উৎসাহিত ওরা, কিন্তু আমি তো জানি ওগুলো সুসানের বাবার বিচিত্ৰ কথা, মৃত্যু, শ্বশুরের বিচিত্র পরিবর্তন এবং আত্মদান আর মহাদেবের পাগলামী সব মিলিয়ে সুসানের সাব কনসাস মনের উপর বিচিত্ৰ প্ৰতিক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়। নিছক কাল্পনিক। কিন্তু ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজী নয় আমার কথায়। আরও কয়েকদিন পরীক্ষা করতে চায়। এমনিতে কোন ক্ষতি নেই দেখে আমিও মত দিলাম ওদের কথায়। দেখাই যাক না কি হয়। বিপদ তো কিছু হয়নি!
বিপদ কিছু হয়নি যখন লিখেছিলাম তখন কল্পনাতেও আসে নি যে কি ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি আমরা। এ বিষয়ে এক বিন্দু জানতে পারলে সেই মুহুর্তে কলকাতায় চলে আসতাম আমি। সুসান আর মহাদেবকে এই ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়তে হত না আর। কেউ কি ভাবতে পেরেছিল সামান্য সাগর জীব ডলফিন গবেষণায় ভয়াল ভয়ঙ্কর এক বিপদ এসে দাঁড়াবে সামনে। বস্তুতান্ত্রিক জগতে বাস করি আমরা। বস্তুতান্ত্রিক জগতেই আমাদের আগ্রহ আর সেই বস্তুতান্ত্রিক বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে বিশ্ব সংসার যে অদৃশ্য শক্তিতে চলছে সেই শক্তিকেই অবিশ্বাস করি আমরা। সাধারণ লোকের হয়তো কোন ক্ষতি হয় না, কিন্তু সেই শক্তিকে নিয়ে যারা ছেলেখেলা সুরু করে, নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জগতের বিপদকে ডেকে আনে তারা। এই বিশ্বচরাচরের কতটুকু জানি আমরা! নতুবা সামুদ্রিক সেই ভয়ঙ্কর বিপদকে কেউ কি ডেকে আনতো মানব সমাজের বুকে? অশুভ শক্তির ভয়াবহ কপাট যেন উন্মুক্ত হয়ে গেল আমার সন্মোহন বিদ্যার প্রয়োগের ফলে। এখনও বুঝতে পারলাম না থুলহু দেবতা না দানব। নাকি সব দেবতারই দুটো রূপ ভয়ঙ্কর আর সুন্দর। এই বিপর্যয়ে আমার দায়ীত্ব অনেক খানি। তাই আমি নিজেও অপরাধী।
৮ই মের ভোরে আমি আর মহাদেব এলাম ডলফিন পুলে। ভোরের নিষ্পাপ আলোয় ভেসে উঠছে সাগর তীর। ডলফিন পুলের উপরে ছাদের মাথায় ঝুঁকে পড়েছে কচিকচি রোদের মেলা। সকালে উঠেই কেন জানিনা খুব ভাল লাগছে। লোহার বড় দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। প্ৰথমে আমি, মহাদেব পেছনে। সুসান রাজার সঙ্গে খেলেছে জল ছিটিয়ে। সরু ঠোঁট দিয়ে রাজা আদর করছে বার বার সুসানকে। সুসানও মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে আদর করছে রাজাকে। যাই হোক, গভীর ভাবে সন্মোহিত করলাম সুসানকে। Strong Suggestion দিলাম প্রয়োজনে বয়াকে জড়িয়ে ধরার জন্যে। সেই আবিষ্ট অবস্থায় রাজা ওকে নিয়ে গেল পুলের মাঝখানে। খুব খুশী খুশী ভাব ডলফিনের। রাজা তো রাজাই। সুসানের চার পাশে সশব্দে ঘুরপাক খাচ্ছে। ডানাদুটো দিয়ে বার বার করে আঘাত করছে জলে। মহাদেবকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি।
মহাদেবের অফিস ঘরে বসে আলোচনা করছিলাম। আমাদের রিসার্চের ভবিষ্যত নিয়ে। বোধহয় ঘণ্টাখানেক কেটেছে। এমন সময়ে ভয়ঙ্কর আর্তনাদে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সমস্ত নিস্তব্দতা। চমকে ঠিক নয় বরং আঁতকে উঠলাম আমরা। প্ৰথমে ঠিক করতে পারলাম কোথা থেকে এল আওয়াজটা। তারপর আবার… আবার সেই তীক্ষ্ণ চীৎকার। ছুটে ডলফিন পুলের দিকে গেল মহাদেব। পরক্ষণেই অমানবিক অপার্থিব চীৎকারে ফেটে পড়ল সমস্ত রিসার্চ সেন্টার। হলফ করে বলতে পারি কোন মানুষ বা জীবের পক্ষে সম্ভব নয় এমন রক্ত জল করা চীৎকার করা। এ যেন কোন ভয়ঙ্কর দানবের দানবিক উল্লাস।
কোন রকমে চাবী দিয়ে ডলফিন পুলের ভারী দরজাটা খুলে ফেললো মহাদেব। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। চাপ চাপ ধোঁয়া ভাসছে ডলফিন পুলের উপর। কেমন যেন Solid ধোঁয়া। ধোঁয়ার ঠিক মাঝখানে টক্টকে লাল দুটো গোলাকার বৃত্ত। কী ভয়ঙ্কর উজ্জ্বল সেই লাল রঙ। নরকের আগুন জ্বলছে গোল গোল… কি বলবো ও দুটোকে…ওগুলো কি কারুর চোখ… চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে হাত পা সব সীসের মত ভারী হয়ে এল। একি দেখছি ধোঁয়ার চোখ ধক্ ধক্ করে জ্বলছে—আরো আরো বড় হচ্ছে লাল চোখ দুটো… কি প্ৰবল আকর্ষণ ও চোখের… সব ধোঁয়া জুড়ে বড় হয়ে উঠল নরকের চিতা জ্বলা লাল লাল গোলা দুটো। আরো আরো বড়… কি ভয়ঙ্কর ভয়াল ঐ চোখ দুটোর আকর্ষণ! না না দুহাতে মুহূর্তের মধ্যে চোখ ঢাকলাম আমরা। চোখ খুলতেই দেখি সব পরিষ্কার। সামান্য কিছু ধোঁয়া বেরিয়ে যাচ্ছে খোলা দরজা দিয়ে। একছুটে এগিয়ে গেলাম জলের ধারে।
সামনেই ভাসছে পলিথিনের বয়াটা। বয়ার গায়ে লটকে আছে সুসান। চোখ দুটো বিস্ফারিত। ভয়ার্ত। চোখের সাদা অংশে বিন্দু বিন্দু রক্ত ফোঁটা জড়ো হয়েছে। পলকহীন রক্তময় চোখ দুটো কী ভয়ানক! অসাড় ঠোঁট দুটো বিড় বিড় করে চলেছে এক নাগাড়ে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে ওর দেহের সমস্ত আবরণ। কেউ যেন ক্রুদ্ধ হাতে মুক্ত করে নিতে চেয়েছে আবিষ্ট সুসানকে। ফরসা দেহে কালো কালী ঢেলে দিয়েছে। পুলের এক কোনে ভাসছে রাজা। গোল গোল চোখ দুটো কী প্ৰচণ্ড জ্বলজ্বলে। কিসের আকাঙ্খায় ওৎ পেতে বসে আছে ও?
পাগলের মত দুহাতে জড়িয়ে সুসনের অচেতন দেহটা একেবারে নিজের ঘরে নিয়ে এল মহাদেব। সুরু হয়ে গেল চিকিৎসা। পালা করে আমরা দুজন সেবা শুশ্রূষা করলাম ওর। সারা দিনরাত কেটে ফেল জ্ঞান ফিরলো না সুসানের। পরের দিন একটু উন্নতি হল ওর। তবুও তন্দ্রাচ্ছন্ন। রাতে সুসান নিজেই আমাদের বিশ্রাম করতে বললো। সুসানকে একলা রেখে দুজনে খেতে এলাম বাইরে।
সবেমাত্র খাওয়া শেষ হয়েছে এমন সময়ে আবার সেই ভয়ার্ত চীৎকার। এক দৌড়ে সুসানের ঘরে ঢুকলাম আমরা। আশ্চৰ্য ব্যাপার। আবার সন্মোহিত হয়ে পড়েছে সুসান। অস্পষ্ট অসংলগ্ন কথা বলছে মাঝে মাঝে।
—মহাদেব ডাক্তার ডাকি…বললাম আমি।
—না… না। ডাকতে হবে না ডাক্তার। জুলজিষ্ট হলেও ডাক্তারী জানি আমি। সে বিষয়ে ভেবো না কাকু। তাড়াতাড়ি তোমার টেপরেকর্ডারটা নিয়ে এস একবার। এক্ষুনি। মনে হয় হিপ্নোসিসের প্রভাব রয়েছে পুরো মাত্রায়। তাহলে হয়তো কিছু জানতে পারা যাবে ওর কাছ থেকে।
—কি বলছো মহাদেব… এই অবস্থায়…
—কাকু প্লীজ কোন প্রশ্ন করো না এখন, তাড়াতাড়ি শুধু টেপরেকর্ডার…
মন্ত্রমুগ্ধের মত টেপরেকর্ডার নিয়ে এলাম। খুব গভীর নিশ্বাস পড়ছে সুসানের। চোখ দুটো বোজা। কিন্তু কথা বলে চলেছে একনাগাড়ে।
—কাকু, সুসান কি হিপ্নোসিস শক্ পেয়েছে?
—ঠিক বলতে পারবো না। হলেও হতে পারে শক্।
—কাকু, টেপরেকর্ডারটা চালু কর এবার।
গভীর মেসমেরিক অবস্থায় রয়েছে সুসান। কতক গুলো Key word নির্দিষ্ট কথায় আদেশ করে ওকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সন্মোহিত করার পর এমন করেই কথা বলতে হয় সকলকে।
—সুসান… সুসান শুনতে পাচ্ছে আমার কথা? বলো… বলো কি হয়েছিল তোমার? দৃঢ়তার সঙ্গে বার বার কথাগুলো বললাম ওকে। মুখের রঙ স্বাভাবিক হয়ে এল। পার পর কয়েকটা গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো সুসান। চাদরের মধ্যে নড়ে চড়ে উঠল ওর দেহটা৷ এর পর যে কী ঘটল সে কথা মনে করলেও অজানা আতঙ্কে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে সর্বাঙ্গ। জোর করে ভুলে থাকতে চাই সেদিনের সুসানের কথাগুলো। শুনতে শুনতে বোধহয় পাথর হয়ে গেছিল সর্বাঙ্গ। পরের দিন রেকর্ড করা কথাগুলো টাইপ করে পড়তে হয়েছিল আমাদের। টেপ রেকর্ডারটা মহাদেবের বালিশের পাশেই থাকে সবসময়। বারবার করে শোনে সেই অপার্থিব কথাগুলো। যদি একবার কিছু হদিশ পাওয়া যায়। বা কথাগুলোর সঙ্গে যদি থুলহুর অনুগ্ৰহে একবার সে দেখতে পায় প্রাগৈতিহাসিক দৃশ্যগুলো।
বেরিয়ে আসতে হবে… যেমন করেই হোক বেরুতে হবে জাগতিক সমস্ত বাঁধা ভেদ করে… সেই অনন্ত আদি শক্তি ডাকছে… চলে এস তোমরা… জেগে ওঠো সাগরের অন্ধকারের সমস্ত জীব… এক যোগে উঠে এস অনন্ত জলরাশি ভেদ করে… তোমাদের যৌথ মানসিক শক্তির কাছে হার মানবে পৃথিবীর মানুষের ক্ষুদ্র শক্তি….. সাগরের উপরে মানুষের মধ্যেও আমাদের প্রাণ রয়েছে ছড়িয়ে… আরো ছড়িয়ে দাও সারা বিশ্বের সব প্ৰাণের মধ্যে… দখল করো মহাবিশ্বের প্রতিটি প্ৰাণকণা থুলহুর আদেশ পালন করে তোমরা আর ঘুমিয়ে থেকো না আটলান্টিসের যুগযুগান্তের বন্দীপ্রাণ… সাগরের তলায় থাকার দিন শেষ হয়েছে তোমাদের… এক হও জগতের সমস্ত অশুভ শক্তি…
…আমাকে সাহায্য করো হে পরম পুরুষ থুলহু… আকাশ বাতাস সাগরের সবাই দাঁড়াও আমার পাশে… রাতের অন্ধকারে অসহায় আত্মারা এস আমার সঙ্গে… শ্মশানে শ্মশানে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা প্ৰাণ তোমরা ভয় পেয়ে না… ধ্যান ভেঙ্গেছে থুলহুর… সেই আদি অনন্ত যুগ ধরে পৈশাচিক হত্যার উল্লাসে মেতে ওঠো তোমরা… অধীর উপ্পাসে কল্পান্ত ধরে অপেক্ষা করছে সেই পরমপুরুষ থুলহু… নিযুত কোটী অনুচররা তাদের হাজার হাজার কোটী পায়ে ভর করে নাচছে তাথৈ তাথৈ তাথৈ… নাচের তালে তালে কেঁপে উঠছে সমস্ত ধরাতল… ভূমিকম্প ঝড় বৃষ্টি বন্যা জলপ্রপাত আমাদের সহরে… বিশ্বজোড়া লেলিহান অগ্নিশিখা থেকে জয়যাত্রার বিজয় বৈজয়ন্তী… কল্পকল্পান্তের সমস্ত প্ৰেতাত্মা তোমরা আর থেকে না অন্ধকারের কোটরে লুকিয়ে… থুলহু ডাকছে তোমাদের… আয়… আয়… আয়…
হাঁপাতে সুরু করলে সুসান। চাদরের মধ্যে সমস্ত দেহটা দুমড়ে মুচড়ে উঠছে ওর। সারা মুখ জুড়ে কী উল্লাস… বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠছে ওর কপালে…
—মহাদেব… মহাদেব… ভুল বকছে সুসান…
—না না, কাকু ভুল বকা নয়, টেলিপ্যাথিতে ধরা পড়ছে অনন্ত রহস্য… যার জন্যে বাবাকে হারিয়েছি আমি… সেই থুলহুর চিন্তার বিচ্ছুরণ ঘটছে সুসনের মধ্যে… দেখতে পাচ্ছো না…দেখতে পাচ্ছো না কাকু… কি রকম ভাবে বলছে সুসান… ওর মনের মধ্যে যা যা ছবি ধরা পড়ছে সেগুলোই বলছে ও… তুমি কি এখনো সন্দেহ করছো… কল্প কল্পান্তের পরম পুরুষ থুলহুর ধ্যানের সম্পূর্ণ ছবি ধরা পড়ছে সুসানের সন্মোহিত মস্তিষ্কের মধ্যে… কাকু এ এক সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা… বিস্ময়কর উন্নত বুদ্ধিমান এক প্ৰাণের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছে আমাদের অজানা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে…
কয়েকদিন কেটে গেল। একটু সুস্থ হয়ে উঠল সুসান। কিন্তু কথায় বার্তায় চাল চলনে সম্পূর্ণ পাণ্টে গেছে ও। কয়েকদিন আগেও তো কথার ফুলঝুরি ফুটতে ওর মুখে। এখন চুপচাপ। সব সময় চিন্তিত। সেদিন সকালে সমুদ্রের ধারে সনিক র্যাডার নিয়ে কাজ করতে করতে হঠাৎ যেন কেমন হয়ে গেল সুসান। ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল দূর সাগরের দিকে। চোখের সামনে হাত নাড়লাম কয়েকবার। কিন্তু চোখের পাতার চাহনির কোন পরিবর্তন ধরা পড়ল না আমার চোখে। আবিষ্ট হয়ে পড়েছে সুসান। আপনা আপনি সন্মোহিত হয়ে পড়েছে। বিড় বিড় করে কি যেন বলতে সুরু করল। হাত বাড়িয়ে ধরলাম ওকে। স্পষ্ট শুনলাম ওর কথাগুলো।
…যাচ্ছি যাচ্ছি… আর দেরী নেই… সবাই আসবে আমার সঙ্গে… রাজা
আসবে… আসবে সব ডলফিনেরা ম্যানাটী আঢ় ডুগংরা…রাজা রাজা পথ দেখাও আমায়… উঃ কী অসহ্য কষ্ট… মুক্তি দাও… মুক্তি দাও অনেক চেষ্টা করেও জাগাতে পারলাম না সুসানকে। ধরাধরি করে ঘরে এনে শুইয়ে দিলাম।
পরের দিন সকাল বেলায় আবার সন্মোহিত হয়ে পড়ল সুসান। মুখে সেই এক কথা… রাজা… ডলফিন আর থুলহুর আবাহন। সমস্ত পরিবেশটা কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠল। মহাদেবও চুপচাপ। বুঝতে পারছি চিন্তায় আর দুর্ভাবনায় পাগল হয়ে উঠেছে মহাদেব। অনেক সাস্তুনা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হল না কিছুই। ইদানীং সুসানও মনে হয় সহ্য করতে পারছে না মহাদেবকে। একদিন তো আমার সামনে দারুণ ঝগড়া হয়ে গেল। ওদের মধ্যে বুঝতে পারছি না কি হবে শেষ পর্যন্ত।
সেদিন রাত তখন সাতটা। কিছুক্ষণ আগেও সন্মোহিত হয়ে পড়েছিল সুসান। মুখে সেই এক কথা। ওকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এসে বসলাম। ক্রমেই ব্যাপারটা গুরুতর হচ্ছে। সন্মাহিত না করলে তো এমনটি হতো না সুসানের… এই চিন্তাই আমাকে পাগল করে তুলেছে। চাঁদের আলো উঁকি দিয়েছে ঘরের মধ্যে। সমস্ত সাগর তীর আবছা চাঁদের আলোয় মায়াময় হয়ে উঠছে। সাগরের গর্জন আর হাওয়ার উচ্ছাস যেন মেতে উঠেছে চাঁদের আলোর বন্যায়। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল যেন ধোঁয়া ধোয়া ভাব। সাগরের কোন অতলে বন্দী রয়েছে থুলহু… কোথায় আছে মানব জন্মের আগের শহর রিলে… সেদিনের সেই ডলফিন পুলে ধোয়ার মধ্যে ধক্ধকে আগুনের ভাঁটা দুটোর সঙ্গে কি কোন যোগ আছে থুলহুর… উত্তরের আশায় অস্থির হয়ে উঠেছি মনে মনে।
ঠক্ ঠক্ ঠক্… দরজায় আওয়াজ হলো।
ভেতরে ঢুকে আসুন… বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলো বার্ট। হিপির গুরু বার্ট। পরণে সেই একই পোষাক। এক মুখ দাড়ি। মাথা ভর্তি চুল। অবাক হলাম। এমন রাতে বার্ট আমার ঘরে।
সামনে চেয়ার টেনে বসতে বললাম ওকে। খোলা দরজা দিয়ে চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে। মনে হল চোখ বুজে বসে আছে বার্ট। গলায় ঝুলছে থুলহুর ছবি দেওয়া মাদুলি।
—মিঃ ঘোষ, আমি জানি না আমাদের সম্বন্ধে, কি ধারণা আপনার। আমার সাঙ্গাপাঙ্গদের দেখে খারাপ ধারণা করা খুবই সহজ। প্ৰচলিত নিয়ম রীতি কিছুই জানিনা আমরা। তাহলেও অতীন্দ্ৰিয় কোন কিছুর খোঁজে উন্মত্ত আমরা। কিন্তু মন নিয়েই কাজ তো আপনার। মনের গভীরে কত রহস্য আছে সেতো নিশ্চয় আপনার অজানা নয়। আর সেইজন্য আমার কথাগুলো একটু শুনুন মন দিয়ে।
আমিও একজন সায়েন্টিস্ট। হ্যাঁ আমি মিঃ ঘোষ, আমি অ্যাসিস্ট্যাণ্ট প্রফেসার ছিলাম মিসকাটোনিক ইউনিৰ্ভাসিটির ছোট এক কলেজে। ক্লিনিকাল সাইকোলজি ছিল আমার বিষয়।
জানিনা ভবিতব্য কিনা—বা হলেও হতে পারে—সেখান থেকেই চিনি সুসানকে। তখন পড়ত সুসান। আমাকে অবশ্য চিনতে পারবে না। ও। পারাও সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার চেহারা তো এখন বাড়ীর লোকও দেখে চিনতে পারবে না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। একটা কটু গন্ধে ভরে উঠেছে ঘরের চাপা হাওয়া। ঘরের জানালাগুলো খুলে দিলাম আমি।
—বেশী দিন ইউনিভারসিটিতে থাকতে পারিনি আমি। কারণ ওখান থেকে Mind Expanding বা মন সম্প্রসারণের এক ওষুধ আবিষ্কার করি। বুঝতে পেরেছিলাম মন সম্প্রসারের ওষুধ বিরাট এক সম্ভাবনার সুযোগ এনে দেবে আমাদের। সুদূর অতীতে আর রহস্যময় ভবিষ্যতের সকল কথাই জানতে পারা যাবে এর মাধ্যমে। অবশ্য এই ইউনিভারসিটিতে না আসলে এসব বিষয়ে কিছুই জানতে পারতাম না আমি। বহু প্ৰাচীন পুথি শিলালিপির এক বিরাট লাইব্রেরী আছে এখানে। প্রাচীন এক হাতে লেখা বই থেকে এই ওষুধের ব্যবহার সম্বন্ধে নানান বিস্ময়কর তথ্য জানতে পারি। আর তারপরই জীবন সম্বন্ধে ধারণা পাল্টে যায় আমার।
এই বইতে লেখা ছিল যে কোন এক সুদূর অতীতে এই পৃথিবীর এক গোপন সংস্থা প্ৰাগৈতিহাসিক যুগের এক অবিশ্বাস্য ঘটনাকে বিশ্বাস করত। শুধু বিশ্বাস করত না, দারুণ ভক্তিভাবে পুজাও করত।
অনেক অনেক যুগ আগে অজানা কোন এক বুদ্ধিমান জীবের দখলে ছিল সমস্ত সৌরজগত। এমনকি সৌরজগতের বাইরে অজস্র ছায়াপথের লক্ষকোটী সৌরজগত জুড়ে চলেছিল সেই আবিশ্বাস্য শক্তির আধিপত্য। মানুষের আবির্ভাব তখনও হয়নি আমাদের এই পৃথিবীতে। সেই অজানা জীবের মলিকিউলার স্ট্রাকচার আর প্রোটোপ্লাজমের গঠনতন্ত্র এমনই বিচিত্র যে সৌরজগতের জানা শোনা কোন জীবনের সঙ্গে সামান্যতমও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সেই অজানা অপরাজেয় শক্তি শুধু অপ্রাকৃতিক – অপ্ৰাকৃতিক আর অশুভ শক্তির প্রতীক।
কল্প কল্পান্ত ধরে রাজত্ব করেছিল সেই অজানা বিস্ময়কর জীবেরা। তারপর চিন্তাতীত কোন এক সুদূর দূর নক্ষত্র জগতের আর এক অমিত শক্তিশালী জীবনের সঙ্গে সংঘাত বাধলো এদের। সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের কল্পনাও করতে পারবো না আমরা। যুগ যুগান্ত ধরে যুদ্ধের পরেও হার জিতের কোন মীমাংসা হলো না। যুদ্ধের ফলে বহু সৌরজগত সূৰ্যহারা হয়ে গেল। বহু সুৰ্য গ্ৰহ হারিয়ে ভারসাম্য হারালো আর। ভারসাম্য নষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে সেই সব জ্বলন্ত আগুনের পিণ্ড–দৈত্যাকার সূৰ্যগুলো ছুটে বেরিয়ে গেল দূর ছায়াপথের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্ত মহাবিশ্বের সীমাহীন অঞ্চলে। দারুণ এক বিপৰ্যয় সুরু হলো অবশিষ্ট সৌরজগতের মধ্যে। এদিকে বহিঃশত্রুর আক্রমণের আশংকায় শংকিত সেই অপ্ৰাকৃতিক শক্তি। প্রয়োজন হয়ে পড়ল অন্তর্নিহিত সমস্ত মনঃশক্তিকে একত্রিত করে অপরিমেয় দুর্জয় অশুভ শক্তির জাগরণ ঘটানোর। সেই সাধনায় তখন মগ্ন হয়ে গেল অসংখ্য সৌরজগতের অধীশ্বর সেই অজানা জীব। অতল সাগরের নিতল আলয়ে চির অন্ধকারময় গভীরে সুরু হল অবিশ্বাস্য সাধনা। নিজের কারাগারে নিজেই বন্দী হলেন সেই পরম শক্তি মহাশক্তির আরাধনায়। স্থান কাল সময়ের অতীত সেই অশুভ শক্তির জাগরণ ঘটবে যে কোন দিন। গভীর রাতে মানুষের ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের দেশে বারবার হানা দেয় ধ্যানমগ্ন শক্তির চিন্তার বিচ্ছুরণ। ঘুমের দেশে মানুষের মন তখন সম্প্রসারিত হয়ে যায়। আর তার ফলেই ধরা পড়ে অনিবৰ্চনীয়ের ছাপ। সময় সিন্ধুর পারাবারে ধ্যানমগ্ন সেই শক্তিই আমাদের উপাস্য থুলহু অশুভ শক্তির পরাজয়ে অশুভ শক্তির আরাধনা।…
এত দূর্বোধ্য ঘোরালো কথা জীবনে শুনিনি। আমি। অনেক কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না নিস্তব্দ চাঁদনীরাতে অবিশ্বাস্য কাহিনী শোনার এক মাদকতায় আচ্ছন্ন আমি।
…মিঃ বাৰ্ট, সুসানের সঙ্গে সম্পর্ক কি এ–সবের? নিজের অজান্তে প্রশ্ন করলাম আমি।
—সে কথাতেই তো আসতে চাইছি মিঃ ঘোষ। ধৈৰ্য ধরে শুনুন একটু। এই থুলহুর সাধনা করেছে লোকে যুগ যুগান্ত ধরে। থুলহুর ইচ্ছার ফলে লোক অদৃশ্য হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। অনেকে পাগল হয়েছে একেবার। অনেকে ঝাঁপ দিয়েছে সাগরের গভীরে। তবে থুলহুর সাধনায় সেই অজানা শক্তির প্রভাবে দৈহিক পরিবর্তন আসে অনেকের। আর তারাই সেই শক্তির স্পর্শ পায় সকলের আগে। থুলহুর আদেশে সাগরের বুদ্ধিমান জীব আর মানুষের মিলনে এক অদ্ভুত জীবের সৃষ্টি হয় পৃথিবীর বুকে। তারাও আমাদের মত মানুষ। মানুষ হলেও রহস্য সন্ধানীর চোখ এড়াতে পারে না তারা। অদ্ভুত কতকগুলো দৈহিক লক্ষণ থাকে এদের। এরাই পৃথিবীর সকল মানুষের মিলেমিশে নিজেদের জাতি রূপান্তরিত করে সকলকে। তারপর সারা সৌরজগত জুড়ে চলবে থুলহুর বিজয় অভিযান। তার খোঁজেই তো চাকরি সংসার ছেড়ে এখানে এসেছি আমি।
সুসানের টেপরেকর্ড করা কথাগুলো মনে পড়ল আমার। থুলহুর আকর্ষণের স্বরূপ বােঝা যায় ওর মধ্যে থেকে।
—থুলহু কোথায় সেটা জানাই আমার প্রধান কাজ। আমরা তো জানি মানব সৃষ্টির বহু যুগ আগের রিলে শহরের দুর্গে বন্দী হয়ে রয়েছেন মহান থুলহু। সেই অজানা রহস্যময় শহর ডুবে গেছে সাগরের কোন অঞ্চলে কে জানে। স্বইচ্ছায় বন্দী থুলহু আপন অন্তস্থিত মহাশক্তির ধ্যানে মগ্ন। আর সেই ধ্যানস্থ মহাশক্তির রক্ষণাবেক্ষণের ভার রয়েছে সাগরের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণীর উপর। তারাই টেলিপ্যাথির অদৃশ্য শক্তির দুৰ্ভেদ্য বলয় স্বষ্টি করেছে থুলহুর চারপাশে। সামান্যতম বিঘ্নও যেন না ঘটে কল্পকল্পান্তর ধ্যানে। সেই বুদ্ধিমান জীবরা কে জানেন মিঃ ঘোষ?
— কারা তারা? তারাই কি…
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ডলফিন… ডলফিনদের ওপর ভার রয়েছে থুলহুকে পাহারা দেবার। আর ডলফিনদের সাহায্য করে পরজীবী ল্যাম্প্রি আর ভয়ঙ্কর সব সাগরজীবরা। সেইজন্যেই তো বার বার করে সাবধান করেছি মিঃ বালামকে। ডলফিনকে নিয়ে টেলিপ্যাথিক রিসার্চ করলে দুৰ্ভেদ্য টেলিপ্যাথিক বলয়ে ফাটল ধরবে। মুহুর্তে থুলহুর ধ্যানভঙ্গ হবে। জ্বলে উঠবে। আগুন। বজ্ৰপাত ঝড়ঝঞ্চা জলোচ্ছাসে ভূমিকম্পে মহাপ্ৰলয় হবে পৃথিবীর। লক্ষ কোটী সৌরজগৎ দুলতে থাকবে মহাশূন্যের বুকে। কোটী কোটী জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের চারপাশে অচ্ছেদ্য বন্ধনে ঘুরপাক খাওয়া গ্রহগুলো একে একে ছিটকে পড়বে কোন অনন্ত অন্ধকারে কে জানে। অগণ্য ছায়াপথের অসংখ্য সৌরজগৎ সব একে একে হারিয়ে যাবে বিস্মৃতি অতলে। উঃ সেদিনের কথা ভাবলেও কেঁপে ওঠে সর্বাঙ্গ। শুধু সকলের মঙ্গলের জন্যে থামান আপনার আপনাদের রিসার্চ। মুক্ত করে দিন ডলফিনদের। আর সুসানকেও আটকে রাখতে পারবেন না আপনারা। সুসানের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলবো আমরা থুলহুর এক বিশাল সংস্থা। সুসান হবে তার মধ্যমণি। সুসানের আদেশে বিশ্বজোড়া থুলহু সংস্থায় ধ্যানারতি চলবে দিনরাত।
—মিঃ বাৰ্ট, সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন আপনি। ভুলে যাবেন না। সুসান আমার মহাদেবের স্ত্রী। তার সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে সম্মানের সঙ্গে কথা বলবেন।
লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল বার্ট। চেয়ার ছেড়ে আমার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
—মিঃ ঘোষ…একী বলছেন আপনি—কোন অপমান করিনি সুসানকে। সুসান যে মহান থুলহুর মহান দূত। ওকে চিনতে তো আমার ভুল হয় নি।
—কিভাবে চিনলেন মিঃ বাৰ্ট? গলার স্বরে আমার ব্যঙ্গের ভাব।
—ধ্যানের মধ্যে জানতে পেরেছি লক্ষণগুলো! এ চিহ্ন কি কেউ ভুলতে পারে? গোল গোল ড্যাব ড্যাব চোখ। জলে ভরা সব সময়। মণিদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে। গায়ের চামড়া খসখসে…জলে ভেজা সৰ্বাঙ্গ ৷ সাগর জল ওদের বড় প্ৰিয়। আর ডলফিনের সঙ্গে তো অচ্ছেদ্য বন্ধন ওদের। সুসানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন এবার। আরও আছে। তবে সে লক্ষণ বোধহয় এখনও পরিস্ফুট হয়নি। ওর দেহে। লক্ষ্য করেছেন। আপনি সুসানের গলাটা কি লম্বা। সেই লম্বা গলায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠবে… নানা সে বলতে চাই না। আমি। বলতে চাই না। হে মহান দেবতা থুলহু… এ আমি কি করলাম। গুপ্ত কথা বলে দিলাম আমি। আমায় ক্ষমা করো ক্ষমা করো আমায়। এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবো আমি।
আজ এক্ষুনি করবো এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত… গলায় ঝোলানো বড় মাদুলির উপর বীভৎস থুলহুর ছবিটা সামনে এনে বার বার করে মাথায় ঠেকালো বার্ট।
পরক্ষণেই ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। চাঁদনীরাতে বালির চড়ার উপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হারিয়ে গেল হিপির গুরু বার্ট। সাগরের বুকে মেঘ জমেছে নিকষ কালো মেঘ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বার বার। সারা আকাশে ঢেকে যাবে মেঘে। ঝড় উঠবে।
রাত তখন কটা জানি না। দারুণ অস্বস্তিতে ঘুম গেল। এ কি স্বপ্ন দেখলাম। রাজার মুক্তির জন্যে হাজারে হাজারে ডলফিন ভীড় করেছে রিসার্চ সেণ্টারের সামনে সাগরের অগভীর জলে। নানান রকম আওয়াজে আকাশ–বাতাস ভরে উঠছে। ডলফিন পুলে দাপাদাপি মাতামাতি করছে রাজা।। ঘরের ছাদ পৰ্যন্ত প্ৰায় লাফিয়ে উঠছে বারে বারে। গোল গোল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে আমার চোখের সামনে। জলের মধ্যে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল রাজা। ডানা দুটোকে হাত জড়ো করার ভঙ্গিতে সামনে এসে বললো তুমি তো পড়তে পার সকলের মনের কথা। তুমি কি জান না কি অসহ্য কষ্টে দিন কাটাচ্ছি আমি। মহান দেবতা থুলহুর বিঘ্ন ঘটছে বার বার। দোহাই তোমাদের, ছেড়ে দাও আমাকে। বাধা দিয়ে বিপদ ডেকে এনে না তোমরা। আমায় ডাকছে আমার প্রভু… ঐ ঐ ডাকছে ছেড়ে দাও… দিক–দিগন্তহীন বিশাল সমুদ্রে আকাশ ছুই ছুই ঢেউ উঠছে। নিকষ কালো সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠছে কিসের অপেক্ষায়। ও কি… ও কি… বিশাল কালো অন্ধকার তালগোল পাকিয়ে মূর্ত হয়ে উঠছে সাগরের বুক থেকে… ছোট্ট দুটো উজ্জ্বল লাল আলো গোলাকার অগ্নিপিণ্ড দুটো… আরো বড়… আরো বিশাল… দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে উঠছে লেলিহান অগ্নিশিখা বৃত্তাকার দুই গোলকের মধ্যে… এগিয়ে আসছে, অগ্নিময় দুটো চোখ এগিয়ে আসছে আমার দিকে নিরেট কালো অন্ধকারের মধ্যে থেকে কিলবিল করছে হাজার ল্যাম্প্রি… সাকারগুলো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে… উঃ কি ভয়ঙ্কর…
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘোমে ভিজে গেছে সর্বাঙ্গ। এ কি দেখলাম আমিও কি সন্মোহিত হয়ে পড়ছি…
—কাকু… কাকু… বন্ধ দরজায় দুম দুম করে ঘা পড়ল কয়েক বার।
দরজা খুলে দিলাম। ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো মহাদেব। চুল এলোমেলো। বিস্ফারিত দুটো চোখ।
—মহাদেব… মহাদেব… কি হয়েছে মহাদেব?
—কাকু এ কি করলাম আমি। সুসান… সুসানকে বাঁচাও তুমি… সেই সন্ধ্যে বেলা থেকে গভীর সন্মোহনের মধ্যে রয়েছে ও। থেকে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুখে ওর এক বুলি রাজা রাজা… মুক্ত করে নিয়ে যাও আমাকে… থুলহু ডাকছে আমাকে… রাজা… আমার রাজা… উঃ কি অসহ্য কষ্ট… হাওয়ার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে আসছে—নিয়ে যাও আমাকে রাজা—সাগরের গভীর অন্ধকারের বুকে—থুলহু ডাকছে—
—মহাদেব—এ সব খেলা ছেড়ে দাও মহাদেব। অজানা বিপদকে টেনে এনেছি আমরা। আমারই হিপ্নোসিসের ফলে—
—কাকু—সব দোষ আমার—নয় তো সুসানকে নিয়ে—সে সব থাক আজ। স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি ভয়ঙ্কর এক বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি আমি। কাকু—তুমি—তুমিই বাঁচাতে পার আমার সুসানকে।
—ব্যস্ত হয়ে না মহাদেব। এখন কি ঘুমিয়েছে সুসান? নয় তো সিডেটিভ কোন কিছু দিয়ে—
—চার চারটে স্লিপিং পিল খাইয়েছি ওকে। কিন্তু ঘুমের কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে উন্মত্তের মত অস্থির হয়ে উঠছে। দু হাতের নখ দিয়ে নিজের গলাটা আঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। নখের আঘাতে ফালা ফালা হয়ে গেছে গলার দু–পাশ। মনে হয় শ্বাসনালীটাই বোধহয় টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলতে চায় ও। গলা বুক ওর রক্তে মাখামাখি। এ আমার কি হল কাকু—
—এ তো নতুন উপসর্গ। আগে তো এমন কিছু করে নি সুসান। তবে কি সত্যি উন্মাদ হয়ে উঠলো—
—আমার তাই মনে হয় কাকু। একবার তুমি—
কথা শেষ হল না। এক অমানুষিক বিকট আর্তনাদে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা। আবার সেই আর্তনাদ—সাগরের ঢেউয়ের গর্জন ছাপিয়ে অপার্থিব সেই শব্দ ভেসে আসছে নীলসাগরের বুক চিরে।
আমি আর মহাদেব দৌড়ে এলাম সুসানের ঘরে। নিস্তব্ধ ঘর। মৃদু নীল আলোয় কেমন যেন আবছা আবছা ভাব।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সুসান। বড় আলোটা জালাতে বললাম। এটা ঘুম না গভীর সন্মোহন দেখতে হবে ভালো করে। পালস নর্মাল—নিঃশ্বাস একটু ঘন ঘন পড়ছে। ঠিক বুঝতে পারা গেল না। বুকের কাপড়টা রক্ত মাখামাখি। মহাদেবকে তুলো আর ডেটল আনতে বলে গলা পর্যন্ত ঢাকা চাদরটা সরিয়ে দিলাম আলতো করে।
এ কী? রক্তে জব জব করছে সমস্ত গলা। হাতের টর্চটা জ্বালালাম। আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? চোখ দুটো ভাল করে রগড়ে নিলাম। একবার। “আরো ঝুকে পড়লাম। কণ্ঠনালীর দুপাশে গলার দুধারে লম্বা লম্বা চারটে করে রক্তাক্ত দাগ। মাংস কেটে গভীর হয়ে বসেছে। সেই ক্ষতগুলোর মধ্যে ওটা কী! মাছের ফুলকোর মত কোন কিছু নড়ছে যেন। এও কি সম্ভব। নাকি ঘুমের রেশ রয়েছে এখনও চোখে! ভাবনা–চিন্তা সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। এ রকমই হয় বোধহয় সকলের। ডেটল আর তুলো দিয়ে চাপা দিয়ে দিলাম। গলার দুপাশের ক্ষত চিহ্নগুলো।
নিঃসাড় সুসান। চাদরটা আবার টেনে দিলাম গলা পর্যন্ত। দুটো ইজিচেয়ার টেনে মহাদেব আর আমি বসলাম ঘরের সামনের বারান্দায়। আজকের রাতটা কেমন এক অস্বস্তি ভরা। দূরের সমুদ্র থেকে এখনও অস্বাভাবিক শব্দ উঠছে বারবার। রাতের অন্ধকারে দেখার উপায় নেই। ঘরে সুসান গঙার ঘুমে অচেতন। কালো মেঘের কোলে ঢাকা পড়েছে চাঁদ আর তারারা। আকাশও যেন এক নিরেট অন্ধকারের বিশাল সাগর। নানান চিন্তায় ভারাক্রান্ত আমি। সাগরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় মহাদেব ঘুমিয়ে পড়ল। সমস্ত ঘটনাগুলো একসঙ্গে পর পর সাজাবার চেষ্টা করলাম। আমারও বোধ হয়। ঘুম এলো দুচোখ জুড়ে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় বার্টের কথাগুলো স্বপ্নের মতো ভেসে এল আমার মনে।। থুলহুর দূত—বিশেষ লক্ষণ—সাগর জলে থাকতে ভালোবাসে ওরা—সুসানের লম্বা গলা — সেই গলায়—কি… কি সেই গলায় সুসান দাঁড়িয়ে আমার সামনে—কি মধুর হাসি ওর মুখে—একি—ওর গলার দুপাশে সরি সারি টক্টকে লাল ফুলকো—জলের অভাবে ছট্ফট করছে করছে ফুলকোগুলো— কি ভয়ঙ্কর—সাগর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুসান—
—কাকু—কাকু—কাকু—
ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। ঘরের দিকে চেয়ে দেখি বিছানা খালি। সুসান নেই।
—কোথায়—কোথায় সুসান—
—সুসান—সু—সা—ন—
প্ৰবল জলোচ্ছ্বাস উঠেছে সাগরে। গগন বিদারী কলরব উঠছে সাগরের দিক থেকে। আকাশের বুকেও উঠেছে ঝড়ের তাণ্ডব। লক্লকে্ বিদ্যুতের অ্যালোয় খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেল নিরেট অন্ধকার। কড় কড় শব্দে প্ৰচণ্ড বাজ পড়ল কোথায়। সাগরের ঢেউগুলো পাহাড় প্রমাণ হয়ে ছুটে আসছে তীরের দিকে। রিসার্চ সেণ্টারের উপর প্রবল আক্ৰোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ক্রুদ্ধ ঢেউগুলো।
কি মনে হতে আমার হাত ধরে ছুটে গেল মহাদেব ডলফিন পুলের দিকে। বিরাট দরজাটা হা হা করছে খোলা। ভেতরে ঢুকেই লাইটটা জেলে দিল মহাদেব। একি! সুসান দাঁড়িয়ে পুলের জলের মধ্যে। ক্রুদ্ধ আক্রোশে বার বার ধাক্কা মারছে রাজা সাগরের লক্ গেটের গায়ে। লক্ গেটের ওপাশে চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন উঠছে বারে বারে।
—সুসান—সুসান—আর্তনাদ করে উঠল মহাদেব।
পুতুলের মত ফিরে দাঁড়াল সুসান। গোল গোল চোখ দুটো বিস্ফারিত। পলকহীন। গলার দুপাশের ক্ষত চিহ্নগুলো লাল লাল ফুলকোতে পরিণত হয়েছে। পুলের ধারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো সুসান। গভীর সম্মোহনে আবিষ্ট ও। লাল লাল ফুলকোগুলো খপ্ খপ্ করছে, কী বীভৎস পৈশাচিক। ভয়ঙ্কর। দুহাতে চোখ ঢাকা দিল মহাদেব। বিস্ময়ে হতবাক ‘আমি। আঘাতের পর আঘাত আসছে লকগেটে। দাপাদাপি লাফালাফি করছে রাজা! কি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে ওকে। পরক্ষণে প্ৰবল জলোচ্ছাসে ভেঙে পড়ল লক্গেট। হুড়মুড় করে সাগর জল ঢুকতে সুরু করল ডলফিন পুলের মধ্যে। পুলের কিনারা ছাপিয়ে উপচে ঘরের মধ্যে চলে এল নোনা জল। চারপাশের ইলেকট্রিক তারগুলো শর্টসার্কিট হয়ে জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। জল উঠল আমাদের কোমর ছাপিয়ে। বিকটভাবে ডেকে উঠল রাজা। পরক্ষণেই সুসান ঝাঁপিয়ে ওর পিঠে উঠে বসল। সুসানকে পিঠে নিয়ে তীরের বেগে বাইরের গভীর সাগরে বেরিয়ে গেল বিশাল ডলফিনটা।
…সুসান…সু…সা…ন…
পাগলের মতো সেই প্ৰচণ্ড ঢেউয়ের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মহাদেব। স্থান কাল পাত্ৰ সব ভুলে গেলাম। মহাদেবকে ধরার জন্যে আমি ঝাঁপ দিলাম সাগর জলে। পেছনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল রিসার্চ সেন্টার। আগুনের লাল আলোয় দূরে বহু দূরে ডলফিনের পিঠে সুসানকে দেখাচ্ছে ছোট্ট পুতুলের মত। আরো ছোট… আরো… আরো… তারপর এক সময়ে অন্ধকার সাগরের বুকে মিলিয়ে গেল সুসান…
…মহাদেবের জ্ঞানহীন দেহটাকে টানতে টানতে যখন আমি তীরে উঠলাম। তখন সবেমাত্র লাল হতে সুরু করেছে ভোরের আকাশ। দূরে থুলহুর আরাধনায় ব্যস্ত হিপিরা। কেন জানিনা অজানা সেই মহান থুলহুর উদ্দেশ্য আমিও প্রণাম জানালাম বারবার।
সম্পাদকের কথাঃ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালের ফ্যান্টাসটিক পূজাবার্ষিকীতে। পুনঃপ্রকাশে বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
Tags: উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, কামিনী তুমি কি মানবী?, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, রণেন ঘোষ
Osadharon. Lovecraft ghorana ke bharotiyo ghorana e sarthok bhabe enechen lekhok. Onake janai kurnish
রণেন বাবুর কলমে অসাধারণ উপন্যাস। এরকম আরও কিছু খুঁজে পাওয়া গেলে মন্দ হয় না।
Khub bhalo laglo… Olonkoron darun… Suspense, horror about unknown, climax .. Ekkothai onoboddo..
কী অসামান্য দক্ষতায় লেখক গোটা উপন্যাসটিকে লিখেছেন! অনবদ্য, অসাধারণ।