কালচক্র
লেখক: সন্দীপ চৌধুরী
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
একটু দেরি হয়ে গেল মার্কের। তবে বেশি নয়, সকালে রাস্তা খালি থাকার কথা; তাহলেই মেক আপ হয়ে যাবে। অ্যাপে ম্যাপটা আরেকবার দেখে নিল সে। আরও সাতাশ কিলোমিটার, মানে প্রায় চল্লিশ মিনিট। এক ঘণ্টা লাগলেও ঠিক আছে। ওখানে গিয়ে মিঃ দত্তর সঙ্গে কাজ সাকুল্যে দশ মিনিটের, যদিও আধ ঘণ্টা ধরেছে সে। ভারতে কিছুই বলা যায়না, বরং সে যদি তাড়াতাড়ি পৌঁচে যায় এয়ারপোর্টে, অতিরিক্ত সময়টা বই হাতে কাটিয়ে দেবে সে।
অর্ডারটা পেয়েই যাবে মনে হচ্ছে তারা। তাহলেই এত দূর উড়ে আসা সার্থক। তারপর মাসখানেক ছুটি নিয়ে একটু কোথাও ঘুরে আসবে সে।
গাড়িটা উড়ে চলেছে প্রায়। ড্রাইভার বলেছে সে এলাকাটা চেনে তবুও মাঝে মাঝে গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ল্যান্ডমার্কগুলো দেখার চেষ্টা করছে মার্ক। কিন্তু কলকাতাও বেশ ভালই বদলেছে গত দশকে, সে খূব একটা কিছু বুঝতে পারছিল না।
‘আর কতক্ষণ লাগবে?’ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল মার্ক।
‘প্রায় ঢুকে পড়েছি স্যার! আর ধরে নিন সাত-আট মিনিট।’ চালাতে চালাতেই জবাব দিল সে। ছেলেটার চালাবার হাত ভাল, অহেতুক কথাও বলে না। নাম সৌম্য। কথাবার্তা, পোশাক পরিচ্ছেদ দেখে ভদ্র ঘরের ছেলেই মনে হয়।
একটু পরেই বাড়িটার নাম জিজ্ঞেস করে করে সঠিক গন্তব্যস্থলে পোঁছে গেল ওরা। রাস্তার পাশে পুরনো দোতলা বাড়ি। গত রাত্রে বৃষ্টি হয়েছে বলে রাস্তাতে একটু জলও জমেছে।
গাড়ি থেকে বেরিয়েই থমকে দাঁড়াল মার্ক। অবাক হয়ে তাকাল চারিদিকে, সামনের চায়ের দোকানটার দিকে, একপাশে দাঁড়ান পুরনো ফিয়াটটার দিকে।
‘স্যার, ঐ সামনের বাড়িটা!’ ড্রাইভার বলল।
কথা না বলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে সে।
এই রাস্তা! ঐ সামনের সিঁড়ি!
‘মর্নিং মিঃ রে, দিস ইস সুধাকর দত্ত!’
চারিদিকে তাকাচ্ছিল বলে মানুষটাকে সামনের দিক থেকে আসতেই দেখেনি মার্ক। সামনে সম্প্রসারিত হাতটা দেখে খেয়াল হল তার।
‘হাউ ডু ইউ ডু, মিঃ দত্ত!’ বলে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়েই বিহ্বল হয়ে গেল সে। এই মুখটাও তার ভীষণই চেনা।
কিন্তু কি করে হয় এটা! সে সিওর যে আজ পর্যন্ত সে এই জায়গায় পা দেয়নি। তবুও আজ প্রথম পা দিয়েই কেন মনে হচ্ছে যে যেন কতদিনের চেনা সবকিছু?
‘আপনি কি ঠিক আছেন? ইউ লুক পেল!’
‘ওহ, আই আম ফাইন।’ বলে ভদ্রলোকের পিছু পিছু বাড়িটার ড্রয়িং রুমে ঢুকল সে।
ঢুকেই সে যে ছবিটার সম্মুখীন হল সেটার জন্য যেন তার অবচেতন মন অপেক্ষাই করছিল – একটা বাচ্চা রেড পাণ্ডার ছবি প্রায় দেওয়ালের অর্ধেকটা জুড়ে।
‘আর বলবেন না। আমার ছেলে, দিবাকর। ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে পাগল! চব্বিশ ঘণ্টা ন্যাশনাল জিওগ্রাফী আর আনিম্যাল প্ল্যানেট নিয়ে পড়ে আছে। ওর জন্যই সব রুমেরই প্রায় একই অবস্থা।’ হাসতে হাসতে বললেন ভদ্রলোক।
‘এক গ্লাস জল পাওয়া যাবে?’ প্রশ্নটা করেই মার্ক লক্ষ করল সামনের টেবিলেই কাঁচের গ্লাসে জল অলরেডি রাখা রয়েছে। উঠিয়ে এক চুমুকে পুরোটা খেয়ে ফেলল সে।
কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? সামনের রাস্তা, চায়ের দোকানটা, ভদ্রলোক, বাড়িটা, এই ছবিটা – সবকিছুই এত পরিচিত হয় কি করে? অথচ ও নিশ্চিত যে এ পাড়ায় সে জ্ঞানত পা রাখেনি। তবে কি খুব ছোটবেলার কোনও স্মৃতি? কিন্তু তাও কি করে হবে? যতদূর সে জানে, তার জন্মের পর কখনোই এক সপ্তাহের বেশি সময় ভারতে কাটায়নি তাদের পরিবার।
‘আপনাদের প্রোডাক্ট লিস্ট দেখেছি আমি। আমাদের প্রয়োজন মিটে যাওয়ার কথা, তবে দাম নিয়ে একটু আলোচনার দরকার আছে।’ সোফায় বসতে বসতে বললেন মিঃ দত্ত।
‘বলুন।’ বেশী দামাদামি করার অবস্থায় নেই সে এখন। ভদ্রলোকের অফারটা যদি ওর গ্রহণযোগ্য মনে হয়, এক্ষুনি হ্যাঁ বলে দেওয়া যেতে পারে।
দুজন প্রতিযোগী সংস্থার রেট কোট করে ভদ্রলোক নিজের অফার জানালেন। মার্ক কিছু বলার আগেই একটা মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
‘এক্সকিউজ মি, দিস ইস আর্জেন্ট!’ বলে কলটা নিলেন মিঃ দত্ত।
‘হ্যাঁ, বল!’
ওপাশের কথা শুনেই ভ্রু কুঁচকে গেল ওনার। দু তিনবার হু – হাঁ ছাড়া কথা বললেন না এরপর। বেশ বোঝা যাচ্ছে উনি বিরক্ত, একটু চিন্তিতও।
‘তুই একটা অ্যাপ্লিকেশন দে, আজই। আমি কাল যাব তোর কলেজে। ইয়েস, আই উইল সি দ্য প্রিন্সিপ্যাল। এখন ছাড়!’ কথাগুলো বলে ফোনটা টেবিলে রাখলেন তিনি।
‘দুঃখিত! আসলে আমার ছেলের রেজাল্ট বেরনোর কথা ছিল আজ। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না সে এত কম মার্ক্স পেয়েছে।’
‘সেভেন্টি সিক্স!’ কথাটা প্রায় নিজের অজান্তেই মার্কের মুখ থেকে বেরিয়ে এল। ভদ্রলোক যে বেশ চমকে গেছেন কথাটায় সে বুঝতে পারল।
‘আপনি কি……?’
প্রশ্নটার তাৎপর্য বুঝে বেশ লজ্জায় পড়ে গেল মার্ক। না, সে ওনার ছেলের কথা শুনতে পায়নি এবং শোনার চেষ্টাও করেনি। করলে সেটা অভদ্রতা হত। কিন্তু তবুও সে জানে যে মিঃ দত্তর ছেলে ফিজিক্সে ছিয়াত্তর পেয়েছে এবং সেটা ওর ক্লাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
‘কিছু মনে করবেন না, আপনার ছেলে কি যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ছে?’
‘হ্যাঁ, বাট…’
‘আই কাণ্ট এক্সপ্লেন দিস কিন্তু আমার এই জায়গাটা, আপনাকে, এই পরিবেশকে – সবকিছুই ভীষণ পরিচিত মনে হচ্ছে। অথচ আমি শিওর যে জ্ঞান হওয়ার পর আমি এই এলাকায় পা দিইনি।’ একটু অপ্রস্তুত হয়েই মার্ক কথাগুলো বলল। কে জানে কি মনে করবেন ভদ্রলোক।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ গুম হয়ে কি সব ভাবলেন। এরই মধ্যে একজন পরিচারিকা ওদের সামনে মিষ্টি আর চানাচুর দিয়ে গেছে, সঙ্গে ধূমায়িত চায়ের কাপ।
‘আপনার কি কোনরকম মানসিক রোগের ইতিহাস আছে? আশাকরি প্রশ্নটায় কিছু মনে করবেন না?’ মার্কের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন সুধাকর দত্ত।
‘মনে করার কিছু নেই। কিন্তু না, আমার কোনও মানসিক অসুখ নেই বলেই জানি।’
‘আপনি কি মানসিক ভাবে খুব পরিশ্রান্ত ফিল করছেন? মানে, রাত্রে ঘুম-টুম ঠিক ঠাক হচ্ছে? নতুন জায়গায় অনেকের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।’
‘দেখুন, কর্মসূত্রে আমাকে দেশে বিদেশে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতে হয়। প্রথম প্রথম টাইম জোনের পার্থক্যের জন্য ঘুমে প্রচণ্ড ব্যাঘাত ঘটত ঠিকই তবে ব্যাপারটা এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। সুতরাং, না, আমি অত্যধিক পরিশ্রান্তও নই আর ঘুমও মোটামুটি স্বাভাবিক হচ্ছে ইদানিং।’ মার্ক বলল।
‘নানান ধরণের বই এবং প্রবন্ধ পড়াটা আমার সখের মধ্যে পড়ে। সেই সূত্রেই কোথাও পড়েছি ‘প্যারা অ্যামনেসিয়া’ বলে একটা মানসিক অবস্থার কথা। এক্ষেত্রে কোনও এক ঘটনাকে মনে হয় যেন আগেও হুবহু একই ভাবে ঘটতে দেখেছি। প্রায় এরকমই আরও একটা অভিজ্ঞতা যেটা কমবয়সী ও কল্পনাপ্রবণ মানুষদের হয়ে থাকে, শেলী বা টলস্টয়দের মধ্যেও এরকম অনেক অভিজ্ঞতা দেখা গেছে, সেটার নাম ‘দেজা ভূ’।’ চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন ভদ্রলোক।
‘দেজা ভূ এর বিষয়ে অনেক বইয়ে আমিও পড়েছি।’ মার্ক বলল।
‘তবে আমি যতদূর জানি, এর প্রভাব কয়েক মিনিটের বেশি সুস্থ মানুষের মধ্যে থাকে না। সাইকোলজির মতে এই স্মৃতিগুলি নয় কোনও ছোটবেলাকার বিস্মৃত ঘটনার অংশ, অথবা স্বপ্ন কিংবা কল্পনার থেকে জন্ম। তবে আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা মনে হচ্ছে। বিশেষ করে আমার ছেলের নাম্বার আপনার জানার কথা নয়।’
মার্ক ঘড়ির দিকে তাকাল। হাতে আর বেশি সময় নেই। ডিলটা ফাইনাল করে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি। প্রসঙ্গ পাল্টে সে কাজের কথায় এল, ‘দেখুন, আপনার দেওয়া রেটটা একটু কম হয়ে যাচ্ছে। আপনি সেটাকে প্রতি ইউনিট দু ডলার বাড়ালেই আমরা ডিলটা ক্লোজ করে ফেলতে পারি এক্ষুনি। আসলে, আমার হাতে আর বেশি সময় নেই, আই হ্যাভ টু ক্যাচ আ ফ্লাইট।’
যা আশা করেছিল তাই হল, ভদ্রলোক রেটটা মেনে নিলেন। কালকের মধ্যেই অর্ডার মেল করে দেবেন তিনি। মনে হয় রেট নিয়ে দরাদরি করার অবস্থায় উনিও এখন নেই।
‘কিন্তু আপনার ব্যাপারটা আমাকে আগ্রহী করেছে। আপনার ঠিক কি কি স্পষ্ট মনে পড়ছে সংক্ষেপে জানাবেন?’
‘অনেক কিছুই মনে পড়ছে, তবে আমি আমার চিন্তাটাকে একটু সাজিয়ে নিতে চাই। আপনার কার্ড আমার কাছেই আছে, দু এক দিনের মধ্যেই আমি কল করব। ইতিমধ্যে দেখুন যদি আপনার বই থেকে এ প্রসঙ্গে আরও কিছু বের করতে পারেন।’ কথাটা বলেই উঠে দাঁড়াল মার্ক। দু ঘণ্টা পনের মিনিট পরই ফ্লাইট, এর পর বেরোলে ও কিছুতেই টাইমলি পৌঁছতে পারবে না।
সুধাকর দত্তও উঠে দাঁড়ালেন। এক পুরনো বন্ধুর কথা মনে পড়েছে ওনার, সাইকোলজি নিয়ে এম এস সি করেছিল। এখন কোনও সম্পর্ক নেই, তবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
‘কিছু মনে করবেন না, আমি কি আপনাদের রান্নাঘরের ওপরের লফটটা একটু দেখতে পারি? আমার একটা চেয়ার নিয়ে যেতে লাগবে মনে হয় এখান থেকে।’ বলেই মিঃ দত্তের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ডাইনিং টেবিলের সংলগ্ন একটা চেয়ার টেনে ভেতরের দিকে হেঁটে গেল মার্ক।
‘আপনি ঠিক কি খুঁজতে ……’ বলতে বলতে পিছু নিলেন মিঃ দত্ত।
রান্নাঘরে মিসেস দত্তকে প্রায় কোণঠাসা করে চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়াল সে। লফটটা খুলতে একটু বেগ পেতে হল কারণ অনেকদিন খোলা হয়নি সেটা। অন্ধকারের মধ্যে হাত বাড়িয়েই সে পেয়ে গেল তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটিকে। পলিথিনে মোড়া একটা ছোট্ট বই।
‘বাবুর অটোগ্রাফের বই!’ বইটাকে দেখেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন মিসেস দত্ত।
‘কোনটা, সেই ফিল্ম স্টারদের সই আছে যেটাতে?’ প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
‘হ্যাঁ! আপনার ভয়ে আপনার ছেলে এটাকে এখানে লুকিয়ে রেখেছিল বেশ কয়েক বছর যাবত। এখন আর তার মনেই নেই। আমি জানি, এখন আর আপনার মনেও ওটার জন্য রাগ নেই। ওকে দেবেন, খুব খুশী হবে সে।’ বলেই প্যাকেটটা ভদ্রলোককে ধরিয়ে আর ওনাদের দুজনকে প্রচণ্ড অপ্রস্তুত রেখেই দ্রুতগতিতে বাইরের দিকে পা বাড়াল মার্ক।
আরও অনেক স্মৃতি বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত ওর মনে ধাক্কা দিচ্ছে, একটা ডাইরি কিনতে হবে যেখানে সে সবকিছু লিখে রাখবে। কে জানে আবার কখন সবকিছু যেমন এসেছে সেভাবেই মন থেকে উধাও হয়ে যাবে।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মনে তার একটাই চিন্তা – এটা কি করে হয়?
গাড়িতে বসেই চোখ বন্ধ করল সে। এটা নিশ্চই একটা স্বপ্ন। এরকম কখনও সে পড়েওনি, শোনেওনি। সে পড়েছে অনেক বাচ্চারা নিজেদের পূর্ব জন্মের কথা মনে করে বলতে পারে। বেশ কয়েকটা ক্ষেত্রে ওদের স্মৃতির সঙ্গে বাস্তবের এমন মিলও খুঁজে পাওয়া গেছে যার সুত্র ধরে পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই এই বিষয়ে গবেষণা আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু, এটা তো তার থেকেও বিচিত্র; সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং লজিকের বাইরে।
তার মনে হচ্ছে সুধাকর দত্তের ছেলে দিবাকর, ডাকনাম দেব, আর সে একই ব্যক্তি! ঐ বাড়িতে গিয়ে তার মনে হয়েছে যেন কোনও বহু পরিচিত অথচ অনেককাল আগের কোনও স্মৃতির মাঝখানে পৌঁছে গেছে সে। বহু পুরাতন শৈশব তার কেটেছে ঐ বাড়িতে, ঐ ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার কোলে পিঠে। পাশের বাড়িতেই থাকে তার প্রিয় বন্ধু সুদীপ, একটু দুরের দেশবন্ধু পাঠাগার থেকে সে নিয়ে আসে রাশি রাশি বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত বই, সপ্তাহান্তে প্রাচী হলে দেখে আসে নানান দেশি বিদেশি ছায়াছবি।
একবার তো মিঃ দত্তকে প্রায় ‘বাপি’ বলে ডেকেই ফেলেছিল। তবে সবচেয়ে বেশি সংযমের পরিচয় সে দিয়েছে মিসেস দত্ত, মিসেস অপর্ণাদত্ত, ওর অর্থাৎ দেবের মাকে সে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।
‘জাতিস্মর’ – এতক্ষণে বাংলা শব্দটা মনে পড়েছে। এর কোনও ইংরাজি প্রতিশব্দ আছে কি? তবে এখানে ত ব্যাপারটা নিছক পূর্ব জন্ম মনে পড়ার নয়। সে যেন একই শরীরে, একই সঙ্গে মার্ক আর দেব। এবং আরও একজন দেব ঠিক এই মুহূর্তেই সশরীরে বর্তমান। তার বয়স এখন উনিশ, আরও পাঁচ বছর পর সে বিদেশ যাত্রা করবে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়ার জন্য। ওখানে সাত বছর কাটিয়ে ব্যাঙ্গালরে অধ্যাপনা। তার পরের জীবনআর এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তবে যেন চেষ্টা করলেই পড়বে। কিন্তু চেষ্টা করে লাভ? তার কাছে যেটা অতীত মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে, দেবের পৃথিবীতে, তা ভবিষ্যৎ।
অথচ পাশাপাশি তার অর্থাৎ মার্কের এই জীবনের স্মৃতিও স্পষ্ট, অনেক বেশি স্পষ্ট। ছোটবেলা, বাবা মা এবং দিদির আদরে বেড়ে ওঠা, স্কুল-কলেজের শিক্ষা, ইউনিভার্সিটির বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন হওয়া – সে সবও দিব্যি মনে আছে।
‘স্যার, আমরা এয়ারপোর্ট এসে গেছি।’
গাড়িটা কখন দাঁড়িয়ে পড়েছে খেয়াল করেনি সে। সৌম্যর গলার আওয়াজে সে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল। ঘড়ির দিকে তাকাল; সঠিক সময়েই এসে গেছে সে।
কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে সেই বাড়িতে আবার। আচ্ছা, সে দেব হিসেবে কোন সালে মাধ্যমিক পাশ করেছিল? বা বিদেশ গেছিল? আর এটা কোন সাল? নিশ্চই বছরগুলো মিলবে না!
কিন্তু মিলল! দেবের জন্ম ১৯৯৭, মাধ্যমিক পাশ ২০১৩। বিদেশ যাবে সে ২০২৩ এ। এটা ২০১৮।
অর্থাৎ, সে এই পৃথিবীতেই আরও একটা জীবন কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছে অতীতকালে। নাঃ, নির্ঘাত স্বপ্ন এটা অথবা তার মস্তিস্ক নিশ্চই তাকে ভুল তথ্য দিচ্ছে। কাউকে সে ব্যাপারটা বোঝাতেই পারবে না, সত্যি হওয়া তো দুরের কথা।
যন্ত্রচালিতের মত এয়ারপোর্টে ঢুকল মার্ক। একটা ফোন করা দরকার তার বস রিচকে জানানোর জন্য যে তারা অর্ডারটা পেয়ে গেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা একদমই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না। বরং ডায়েরিটা কেনা দরকার। কেন জানি তার মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে ওর স্মৃতি থেকে দিবাকর হারিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু তা ঘটল না। আমেরিকায় ফিরেও মানসিক ভাবে অশান্ত রইল সে। সঙ্গে ইন্টারনেটে খোঁজ করতে লাগল এরকম আর কোনও ঘটনার রেফারেন্সের জন্য। যেটা পাওয়া গেল সেটা হচ্ছে বেশ কয়েকটা পূর্ব জন্মের কথা মনে রাখার ঘটনা – জাতিস্মরদের জীবন কাহিনি। পৃথিবীতে এত বেশি জাতিস্মরদের খোঁজ পাওয়া গেছে সে বিষয়ে কোনও ধারণাই ছিল না তার – প্রায় তিন হাজার। আরও হয়ত অনেক আছে যাদের বাবা মা-রা ব্যাপারটাকে প্রচার করেন নি। বেশির ভাগ জাতিস্মরই বালক, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পূর্ব জন্মের স্মৃতি আস্তে আস্তে মুছে যেতে থাকে। তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। পরিচিত জায়গাটাই ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে পূর্ব স্মৃতি জাগাতে। আবার স্মৃতিটাকে টেকনিক্যালি পূর্ব স্মৃতিও বলা যায় না, বেশ কিছু ঘটনাই তো ভবিষ্যতে ঘটবে। ভবিষ্যতের স্মৃতি – শুনতে খারাপ লাগছে না, কিন্তু কোনও যুক্তি নেই।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যেটা সে পেল এই খোঁজাখুঁজিতে সেটা হচ্ছে দু জন মানসিক চিকিৎসকের নাম যারা জাতিস্মর সংক্রান্ত বিষয়ে রিসার্চ করছেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে -ইতালির ডক্টর আলবার্তো কোস্তা আর আমেরিকার ডক্টর জর্জ স্লভেক। আরও অনেক আছে তবে এই দুজনের খ্যাতি যেন বেশি মনে হল তার, অনেকগুলি পেপারও লিখেছেন তারা এই বিষয়ে। কয়েকজন বিস্ময় বালকদের সঙ্গে সরাসরি কাজও করেছেন রিসার্চের ব্যাপারে। হয়ত এরকম কোনও কেসের সম্মুখীনও হয়েছেন তারা।
প্রথমে সে ভাবল শুধুমাত্র ডঃ স্লভেকের সঙ্গেই সে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল যে কোন কারণে এই ভদ্রলোক এই সময়ে ব্যাস্ত বা অসুস্থ থাকলে তার ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যাবে। দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই যে তাড়াতাড়ি দেখা করা যাবে তার কোনও মানে নেই, ওনারা নিশ্চই অনেক মানসিক রোগী এবং অসৎ মানুষদের কাছ থেকে জাতিস্মর সংক্রান্ত দাবি পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে মার্কও যে ওদের মতই একজন নয় তার নিশ্চয়তা কি?
অনেক ভেবেচিন্তে সে দুজনকেই একই বয়ানের মেল লিখল যার মুল বক্তব্য ভারতে গিয়ে একটা পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তার পূর্ব স্মৃতি জেগে উঠেছে। তবে দিবাকর বলে ছেলেটা যে এখনও বেঁচে আছে সেই ব্যাপারটা সে চেপে গেল। এ প্রসঙ্গটা সামনা সামনিই উত্থাপন করা ভাল। নিজের মোবাইল নাম্বারও দিল, তাতে যোগাযোগ তাড়াতাড়ি হবে।
উত্তর এল আশাতীত তাড়াতাড়ি, মেল লেখার তৃতীয় দিনে ডঃ কোস্তার কাছ থেকে। উনি যত শিঘ্র সম্ভব মার্কের সঙ্গে কথা বলতে চান, তারপর মুখোমুখি দেখার ব্যাবস্থা করা যাবে। প্রয়োজন হলে দুজনে ভারতেও একসঙ্গে যাবেন। ডঃ স্লভেকের কাছ থেকে যে উত্তর এল সেটা অনেকটা রুটিন মাফিক – উনি ‘ব্যক্তিগত’ কারণে এই মুহূর্তে ঘটনাটায় মনোযোগ দিতে পারছেন না, ভবিষ্যতে সম্ভব হলে যোগাযোগ করবেন। মার্ক একটু আশাহত হল কারণ সে আশা করেছিল তাকে দেশের বাইরে এক্ষুনি যেতে হবে না। তবে এই ভেবে সে নিজেকে সান্ত্বনা দিল যে সে একটা ছুটির প্ল্যান করছিলই, ছুটি কাটানোর পক্ষে ইতালি খুব একটা খারাপ হবে না। বরং সম্ভব হলে প্যারিসটাও ছুঁয়ে আসা যাবে।
মোবাইলে কল এল সেদিন সন্ধেতেই – এক মহিলার গলা জানাল যে ডক্টর কোস্তা ওর সঙ্গে কথা বলতে চান, মার্কের কি হাতে কিছু মিনিট সময় আছে? একটু উত্তেজনার সঙ্গেই সম্মতি জানাল মার্ক।
‘মার্ক?’ একটা ভারি গলার প্রশ্ন ভেষে এল অন্য প্রান্ত থেকে।
‘শুভ সন্ধ্যা, ডক্টর! হ্যাঁ, আমি মার্ক বলছি। আপনাকে মেলটা আমিই করেছিলাম।’
‘তোমার বয়স কত?’
‘বত্রিশ। বত্রিশ বছর চার মাস সঠিক ভাবে বলতে গেলে।’
কিছুক্ষণ কোনও কথা বললেন না ডঃ কোস্তা। তারপর বললেন, ‘তোমার কেসটা একটু অস্বাভাবিক। সাধারণত দু-তিন বছর বয়স থেকে বাচ্চারা আগের জন্মের কথা বলা শুরু করে। এবং, দশ বছর বয়সের মধ্যে তারা সেটা ভুলেও যায়।’
‘আমার ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। ভারতে যাওয়ার আগে আমার কখনও কিছু অস্বাভাবিক মনে হয় নি।’
‘তোমার পেশা কি?’
‘আমি একটা অটোমোবাইল ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচারিং ফার্মের মার্কেটিং হেড। ম্যানেজমেন্ট আর ইঞ্জিনিয়ারিং এ আমার ডিগ্রি আছে।’
‘পরিবারে আর কে কে আছে? তাদের পেশা কি?’
ওর সমস্যাটার সঙ্গে এই প্রশ্নগুলোর সম্পর্ক ঠিক বুঝতে না পারলেও ডঃ কোস্তার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল সে। তবুও সে একটু আশ্বস্ত হল কারণ একবারও ডঃ কোস্তা জিজ্ঞেস করলেন না দেবের সম্বন্ধে। এই বিষয়ে সে সামনা সামনিই কথা বলতে চায়। সে চায় না যে তার দাবিকে অবিশ্বাস্য মনে করে উড়িয়ে দেওয়া হোক। যদিও ওকে শেষ পর্যন্ত পুরো কথাটা খুলে জানাতেই হবে, সে সেটাকে মুখোমুখি বলতে চায় যাতে সে নিজের দাবির সমর্থনে যুক্তি রাখতে পারে ডাক্তারের সামনে।
শেষে ডঃ কোস্তা জানতে চাইলেন কত তাড়াতাড়ি সে ইতালি আসতে পারবে। সঙ্গে এটাও জানালেন যে প্রয়োজন হলে তিনি নিজেও আসতে পারেন মার্কের কাছে তবে সেক্ষেত্রে একটু অপেক্ষা করতে হবে মার্ককে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মার্ক। এক সপ্তাহের মত সময় চাইল সে ডাক্তারের কাছ থেকে। অফিসে বলাই আছে, ছুটি পেতে সমস্যা হবে না তবে সে নিজেই সবকিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময় চায়। নিজের পরিবারকে এখনও কিছু জানায় নি সে, এ ব্যাপারেও তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবারে।
সবকিছু ব্যবস্থাই হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। বাইশ দিনের ছুটি নিল সে অফিস থেকে; বসকে আগে থেকেই ঘুরতে যাওয়ার কথা বলা ছিল বলে ছুটি পেতে অসুবিধে হয়নি। বাড়িতে বাবা-মাকে কিছু জানায় নি সে, শুধু দিদি বেলাকে একটু হিন্ট দিল। পুনর্জন্ম সম্বন্ধে কিছু না বলে শুধু বলল ঘোরার মাঝে একটা ডাক্তারের সঙ্গেও দেখা করবে সে ইতালিতে, কিছু মানসিক সমস্যা হচ্ছে ইদানীং। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই, দেখা হলে বিস্তৃত ভাবে জানাবে সে নিজের সমস্যার কথা ওকেও। দিদি যেন বাবা-মা কে কিছু না জানায়, তারা অহেতুক চিন্তা করবে। বেলা শক্ত মেয়ে, বেশি ঘাঁটাল না মার্ককে। শুধু আরও একবার কনফার্ম হয়ে নিল, কোনও সিরিয়াস ব্যাপার নয় তো? প্রয়োজন হলে সে মার্কের সঙ্গে যেতে পারে ইতালিতে, এখন সে মোটামুটি ফ্রি। মার্ক যখন জানাল যে তার কোনও প্রয়োজন নেই, সে চুপ করে গেল।
যাওয়ার আগে নিজের ডাইরিতে যতটা সম্ভব নোট করে নিল মার্ক দিবাকর সম্বন্ধে। তবে, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া এর পরের জীবন সম্বন্ধে স্পষ্ট করে আর বিশেষ কিছু মনে পড়ে নি তার। ত্রিশ বছর বয়সের কাছাকাছি বিয়ে হবে দেবের, তারপর এক মেয়ের জন্ম হবে আরও তিন বছর পর। আর মনে পড়েছে এক বিধ্বংসী বন্যার কথা। ২০৩৭ সালে। কয়েক লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া, দু হাজারের ওপর মৃত। বরং ছোটবেলাকার ঘটনাগুলি অনেক বেশি স্পষ্ট।
মার্ক লিখে রাখল তার স্কুলের কথা, বন্ধুদের নাম, কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছিল তার বর্ণনা। এমন কিছু কথা যা দেব আর তার খুব ঘনিষ্ঠ মানুষেরা ছাড়া জানবে না। যেমন দশম জন্মদিনে দুচাকার সাইকেল উপহার পাওয়ার কথা বা মেলায় গিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে হারিয়ে যাওয়ার কথা। বা হারিয়ে যাওয়া অটোগ্রাফ খাতাটা হঠাৎ ফিরে পাওয়ার ঘটনাটা।
সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ পাতা ভরিয়ে ফেলল সে ডাইরিটার। এটাই যথেষ্ট, মনে হল মার্কের। তবে তার এও মনে হল যে সে ভারতে গেলে আরও অনেক ঘটনার কথা মনে পড়বে। এখনও পর্যন্ত যেখানে সে গেছে সেই জায়গার সঙ্গে যুক্ত ঘটনাই বেশি মনে পড়েছে, ওর জীবনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য জায়গায় গেলে নিশ্চই আরও অনেক কিছু মনে পড়বে তার।
অবশেষে ডাক্তার কোস্তাকে নিজের জার্নির প্ল্যান জানিয়ে মেল পাঠাল সে। উত্তর এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই – ফ্লরেন্স এয়ারপোর্টে তিনি নিজেই অপেক্ষা করবেন গাড়ি নিয়ে। নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে হল মার্কের, বিশ্ববিখ্যাত এক ডাক্তার তাকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন যখন! নিশ্চই তাঁর প্রতি ঘণ্টার মুল্য হাজার ডলারের ওপর।
ডাক্তার কোস্তাকে দেখে কিন্তু বেশ হতাশই হল সে। ওনার গুরুগম্ভীর গলা আর ইন্টারনেটে ছবি দেখে সে নিজের মনে ওনার যে ছবি এঁকেছিল সে, তার তুলনায় ওনার ব্যক্তিত্ব অনেকটাই নিষ্প্রভ। বয়স ষাটের কাছাকাছি, উচ্চতা বড়জোর পাঁচ সাত, মার্কের থেকে অনেকটাই কম; হাঁটাচলার ভাবেও কেমন যেন পরিশ্রান্ত ভাব। তবে চোখদুটি অসম্ভব তীক্ষ্ণ, শুরু থেকেই খুব মনোযোগ দিয়ে তিনি লক্ষ করছিলেন মার্ককে। তবে পথে মূল বিষয় নিয়ে কোনও কথা হল না, বেশির ভাগ কথাই হল মার্কের জার্নি সংক্রান্ত এবং ইতালি আর আমেরিকার তুলনামুলক আবহাওয়া বিষয়ক। গাড়িতেই সে জানতে পারল তারা এখন চলেছে সিয়েনা বলে এক শহরে যেখানে ডাক্তারের নিজস্ব বাড়ি প্লাস ক্লিনিক আছে। ওনার বাড়ির লাগোয়া গেস্ট হাউসে মার্কের থাকার ব্যাবস্থা।
‘কতদিন আছ তুমি এই দেশে?’ এক সময় মাথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘ফেরার টিকিট এখনও কাটি নি। একটু ঘোরাঘুরিরও ইচ্ছে আছে ফেরার আগে।’ জানাল সে।
মাথা নাড়লেন ডঃ কোস্তা। তারপর জানালেন যে এখন প্রায় বারটা, ফ্রেশ হয়ে, লাঞ্চ করে, চারটে নাগাদ উনি বসবেন মার্কের সঙ্গে ফর্মাল সেশনে। সম্মতি জানাল মার্ক। সামান্য একটু টেনশান হচ্ছে, কেউ একজন সঙ্গী থাকলে ভাল হত। কিন্তু ব্যাপারটা এতই অদ্ভুত যে কাউকে এই মুহূর্তে জড়াতেও ইচ্ছে করছে না।
জায়গাটার আবহাওয়া চমৎকার। জানা গেল ইচ্ছে করলে হাতে ঘণ্টা দুয়েক সময় নিয়ে সমুদ্র সৈকতেও ঘুরে আসা যায়। দেখা যাক কখন সেই সময় পাওয়া যায়। আগে যে জন্য সে এসেছে সেটা তো শুরু হোক, তারপর ঘোরাঘুরির কথা।
চারটে বাজার মিনিট দশেক আগেই রুমে ফোন এল, ডঃ কোস্তা অপেক্ষা করছেন তার জন্য।
ছোট্ট ক্লিনিক, বড়জোর জনা দশেক লোকের বসার ব্যবস্থা কিন্তু এই মুহূর্তে পুরো ফাঁকা। একজন বয়স্কা মহিলা মার্ক কে বসিয়ে ভেতরে ঢুকলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এসে মার্ককে ভেতরে যেতে বললেন উনি। এনার গলাই সম্ভবত সে শুনেছিল ফোনে, আমেরিকা থেকে।
ভেতরটা বেশ বড় এবং রুচিসম্মত ভাবে সাজান। আসবাব পত্র সমস্তই কাঠের, দেওয়ালের রং-ও কাঠের রং এর সঙ্গে মানানসই, শুধু এক পোঁচ হাল্কা। দেওয়ালে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি – পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, জঙ্গল। ডঃ কোস্তা নিজের সামনের চেয়ারে মার্ককে বসতে অনুরোধ করলেন। এই মুহূর্তে তিনি স্যুট পরে আছেন, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা – দুপুরে দেখা মানুষটির সঙ্গে এনাকে মেলাতে অসুবিধে হচ্ছিল মার্কের।
‘শুরু থেকে সমস্ত ঘটনা বল। কোনও ঘটনা ছোট বা গুরুত্বহীন ভেবে ছেড়ে যাবে না। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে, কোন তাড়া নেই। আজ আর কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই আমার।’
ভদ্রলোকের কথার ভঙ্গিতে আশ্বস্ত বোধ করল মার্ক। তারপর সে একে একে যা ঘটেছে বলতে শুরু করল। ডঃ কোস্তা মাথা নিচু করে শুনছিলেন, হাতে কলম ধরা রয়েছে, টেবিলের ওপর রাইটিং প্যাডও খোলা আছে তবে তাতে এখনও কোনও আঁচড় পড়েনি।
‘একটু দাঁড়াও, ব্যাপারটা আমাকে ঠিকমত বুঝতে নিতে দাও। মানে তুমি বলতে চাইছ যে তুমি পূর্বজন্মে দিবাকর ছিলে যে এই মুহূর্তে বেঁচে রয়েছে? আমি কি ঠিক বুঝেছি?’ কথার মধ্যে সামান্য একটু বিভ্রান্তির লক্ষণ যেন খুঁজে পেল সে, ভ্রুও কোঁচকান ডঃ কোস্তার।
‘ঠিক তাই। আমি জানি ব্যাপারটা যুক্তিযুক্ত নয় কিন্তু…’
‘তুমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। পুনর্জন্মের ব্যাপারটাকেই পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ যুক্তিযুক্ত মনে করে না, কিন্তু আমার প্রশ্ন সেটা নয়।’ কথাটা সহজ ভাবেই বললেন ডক্টর।
ডাক্তারের কথাটা ঠিক নয়, এই কদিন পড়াশোনা করে মার্ক জেনেছে যে পঞ্চাশ শতাংশের ওপর মানুষ যারা বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী তারা পুনর্জন্মেও বিশ্বাস করে। তবে এই বিষয়ে কথা বাড়াল না সে। মার্ক আরেক বার ওনাকে আশ্বস্ত করল যে ওনার বুঝতে কোনও ভুল হয়নি।
‘এখনও পর্যন্ত যা শুনলাম তাতে মনে হয় তুমি এখনও পর্যন্ত দিবাকরের সঙ্গে দেখাও কর নি, ছবিও দেখ নি।’
‘ঠিক।’
‘অথচ ওর বাবা-মা আর বাড়ি দেখেই তোমার মনে হয়েছে যে তুমিই গতজন্মে দিবাকর ছিলে? এমন নয় তো যে ওর কোনও ভাই বা বোন ছিল যে মারা গেছে?’
কথাটা আগেও চিন্তা করেছে মার্ক, তাই ওর উত্তর তৈরিই ছিল, ‘না, আমার কোনও ভাই বা বোন ছিল না।’
কথাটা বলেই মার্কের মনে হল ‘আমার’ বলা হয়ত উচিত হয় নি, কিন্তু ডঃ কোস্তা মনে হল না ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন।
‘ছোটবেলাকার কত ঘটনা মনে আছে তোমার?’ এবার ওনার কলম লেখার জন্য তৈরি।
সে কয়েকটা ঘটনার উল্লেখ করল। এমনকি যা এখনও ঘটে নি কিন্তু ঘটতে যাচ্ছে তার বিষয়েও বলল।
‘তুমি কি যেগুলো এখনও ঘটে গেছে সেগুলো মিলিয়ে নিয়েছ বাস্তবের সঙ্গে? মানে, লফটের ব্যাপারটা ছাড়া আর কিছু প্রমাণ আছে?’
‘দেবের ফিজিক্সে ছিয়াত্তর পাওয়ার ঘটনাটা যেটা আমি এক্সিডেন্টলি দেবের বাবার সামনেই বলে ফেলি।’
‘তুমি তো বললে মি ডাঁট …’
‘মিঃ দত্ত!’
‘হ্যাঁ, মিঃ দত্ত তোমার ক্লায়েন্ট; ওনার ফোন নাম্বার নিশ্চই তোমার সঙ্গেই আছে?’
ডায়েরিটা খুলল মার্ক। নাম্বারটা সেখানেই নোট করা আছে।
‘আমি যদি তোমার সম্পর্কে ওনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলি তাতে তোমার আপত্তি আছে?’
একটু চিন্তা করল সে। ভদ্রলোক নিজের ছেলের জীবন নিয়ে এত কাটাছেঁড়া পছন্দ নাও করতে পারেন। তা ছাড়া সম্পূর্ণ ঘটনাটা শুনলে কিরকম রিয়াকশন হবে সেটাও আন্দাজ করা মুশকিল।
‘বলতে পারেন তবে আমার মনে হয় পুরো ব্যাপারটা খোলাখুলি জানাবার এই মুহূর্তে দরকার নেই। আর আপনি কথা বলার আগে আমি নিজেও ওনার সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে চাই।’
কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন ভদ্রলোক। মার্কের শেষের কথাটা শুনেছেন কিনা তাও বোঝা গেল না। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সামনের কাগজে নানান আঁকিবুঁকি কাটলেন তিনি, যেন মার্কের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণই উদাসীন এ মুহূর্তে।
‘আচ্ছা, কখনও মানুষের ভবিষ্যৎ বলার আগ্রহ ছিল কম বয়সে? মানে পামিস্ট্রি বা গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছ কখনও?’
‘না, আমি এসব ব্যাপারে বিশ্বাস করি না।’
মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। মার্ক বুঝতে পারছিল না উনি তার কথায় বিশ্বাস করেছেন কি না। তবে পুরোপুরি অবিশ্বাস করেন নি বলেই মনে হচ্ছে।
‘দেখো, পুনর্জন্ম বলতে আমি যা এতদিন বুঝে এসেছি সেটা হল, একজন মানুষের মৃত্যুতেই তার সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। তার কোনও একটা অংশ, যেটাকে আত্মা বলা যেতে পারে, অনেক সময় আগের জন্মের স্মৃতির সঙ্গে অন্য দেহ ধারন করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এও দেখা গেছে যে পরবর্তী জন্মে শারীরিক এবং মানসিক ভাবেও সেই সব মানুষদের নিজের আগের জন্মের ব্যাক্তিত্বের সঙ্গে অনেক মিল আছে। দেখা গেছে কিছু বাচ্চা যাদের মাথায় বা বুকে কোনও জন্মগত দাগ আছে সেটা তাদের আগের জন্মের কোনও আঘাতের চিহ্ন। একজনকে আমি নিজেই দেখেছিলাম যার জন্ম থেকেই ছোট আঙ্গুলটা অর্ধেক নেই, পরে জানা গেল সেটা তার আগের জন্মে এক মেশিনে কাজ করার সময় কাটা গেছিল।
কিন্তু তোমার ব্যাপারটা সবার চেয়ে আলাদা। এ পর্যন্ত আমি প্রায় তিন হাজার পুনর্জন্মের কেসের বিষয়ে বেশ ডিটেলে পড়েছি, নিজে প্রত্যক্ষ করেছি প্রায় ষাটখানা কেস – কিন্তু এরকম ইন্সিডেন্ট ফেস করি নি। তোমার দাবি যদি ঠিক প্রমাণিত হয় তবে প্রত্যেক মানুষের যে একটা নিজস্ব আত্মা আছে সেই বিশ্বাসের গোড়াতেই ঘা পড়বে। আমাদের পুরো ব্যাপারটা আবার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে হবে।’
কথাটা মার্ক নিজেও ভেবেছে। এক সে তো পুনর্জন্ম ব্যাপারটা নিয়েই কোনদিন মাথা ঘামায় নি, তার ওপর তার নিজের ক্ষেত্রে ঘটনাটা আরও অনেক বেশি বিভ্রান্তিকর।
‘তবে তোমার কথা শুনে আমার এক সায়েন্টিস্টের কথা খুব মনে পড়ছে। তার সঙ্গে একবার আমার আলোচনা হয়েছিল, আরও অনেকে ছিল সেখানে; সে পুনর্জন্ম ব্যাপারটার একটা কোয়াণ্টাম থিয়োরি দিয়ে ব্যাখা দিয়েছিল। আমি বিশেষ বুঝিনি সে সময়, বোঝার চেষ্টাও করিনি, তবে এখন মনে হচ্ছে ওনার কিছু ধারণার সঙ্গে তোমার ঘটনাটা যেন মিলে যাচ্ছে। বিশেষ করে একটা কথা উনি বলেছিলেন যেটা আমার মনে কোনও কারণে দাগ কেটেছিল – মৃত্যুর পর একজন মানুষ পরের জন্মে তার অতীতেও ফিরে যেতে পারে। তবে ওনার নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। সেটা সমস্যা নয়, আমার পুরনো ডায়েরি ঘাঁটলেই ওনার নাম-ধাম হয়ত পাওয়া যাবে; সেক্ষেত্রে যোগাযোগ করাও মনে হয় অসম্ভব হবে না।’
ডায়েরির কথাতে মার্কেরও নিজের হাতের ডায়েরির কথা মনে পড়ে গেল। সে সেটা ডঃ কোস্তার হাতে তুলে দিয়ে জানাল যে, এতে তার এখনও পর্যন্ত যা মনে পড়েছে বিস্তৃত ভাবেই লেখা আছে। ওনার হাতে সময় থাকলে পড়তে পারেন।
‘অনেক ধন্যবাদ! আজ রাত্রেই খুব আগ্রহের সঙ্গেই পড়ব আমি এটা। তারপর, তোমার কথামত একবার মিঃ ডাঁটের সঙ্গেও কথা বলব তুমি কথা বলার পর।’ এই প্রথম ডঃ কোস্তার মুখে হাসি দেখল মার্ক। মানুষকে হাসতে দেখলেই অনেক কাছের মানুষ মনে হয়।
এরপর আর কোনও কথা হল না। নিজের ঘরে গিয়ে পোশাক পাল্টে একটু আশে পাশে হেঁটে এল সে। মনটা এখন বেশ হাল্কা লাগছে। ডঃ কোস্তা ওর কথা বিশ্বাস করবেন কি না সে সম্বন্ধে মনে যে উদ্বেগ ছিল সেটা আর নেই। এরপর উনি খোঁজখবর করলে ওর কোনও আপত্তি নেই, কারণ সে জানে যে তার স্মৃতিতে কোনও ভুল নেই। তবে মিঃ সুধাকর দত্তর সঙ্গে একবার কথা বললে হয়; ওর কিছু স্মৃতির কনফারমেশানও হয়ে যাবে আবার ওনাকে সে জানিয়েও দিতে পারবে যে ডঃ কোস্তা ওনাকে ফোন করতে পারেন। তবে তারপরই তার মনে হল এ সম্বন্ধে ডঃ কোস্তার সঙ্গে আলোচনা করেই এগোন উচিৎ। দেখাই যাক না উনি কি সিদ্ধান্তে পৌঁছন।
পরদিন বেশ ভোরেই ডঃ কোস্তার কাছ থেকে ফোন এল। উনি একসঙ্গে মার্কের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে চান; কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা হবে সে সময়ে। সে যেন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ রেডি থাকে, উনি এখানেই আসবেন ব্রেকফাস্টের জন্য। গতকালের থেকে ওনার গলা বেশ তরতাজা মনে হল মার্কের, আবার সেটা মনের ভুলও হতে পারে। হয়ত রাত্রে ভাল ঘুম হওায় তার নিজেরই ফ্রেশ লাগছে বলে এমনটা মনে হচ্ছে।
ডঃ কোস্তা এলেন ডট সাড়ে সাতটায়। হলুদ রঙের টি শার্ট আর সাদা শর্টস পরে ওনাকে বেশ দেখাচ্ছে কম বয়েসি আর হাসিখুশিও দেখাচ্ছে। ওর ডায়েরিটা কি উনি পড়েছেন?
‘কালকের সন্ধেটা দারুণ কেটেছে! অনেক কথা আছে, খেতে খেতে আলোচনা করা যাবে, এস।’ বলে ডাইনিং টেবিলে মার্ককে ডাকলেন উনি। মার্ক বুঝতে পারল না ‘দারুণ’ বলতে উনি কি বোঝাতে চাইছেন। কোনও কথা না বলে সে চেয়ারে নিজের স্থান গ্রহন করল; দেখা যাক উনি কি খবর দেন।
‘প্রথমেই তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তোমার অনুরোধ উপেক্ষা করেই আমি গত রাত্রে মিঃ ডাটা কে ফোন করি। আসলে তোমার ডায়রিটা পড়তে পড়তে খুব উত্তেজিত হয়ে পরেছিলাম আমি। এত ডিটেলে নিজের আগের জন্মের কথা খুব কম জনই এর আগে বলতে পেরেছে। প্রধান কারণ হয়ত এই যে তাদের প্রায় সবাই বাচ্চা ছিল, ছয় সাত বছরের মধ্যে যাদের বয়স। এই বয়সে ভাষা বা চিন্তা – কোনওটারই ম্যাচুরিটি আসে না। যাই হোক, আমি যে এগারটা ঘটনার উল্লেখ করলাম তোমার ডাইরি থেকে, তার সব কটাই তিনি কনফার্ম করলেন। চার পাঁচটার বিষয়ে নিজের ছেলেকে আর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে আজ রাত্রে জানাবেন বললেন। ওগুলোও মিলে গেলে তোমার দাবির সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকবে না। তবু আমি তোমাকে নিয়ে ভারতে একবার যেতে চাই আরও কিছু বিষয় ক্লিয়ার করার জন্য।’ এতটা কথা একনাগারে বলে উনি কয়েকটা ফলের টুকরো মুখে তুলে নিলেন।
‘ভদ্রলোক কিছু জিজ্ঞেস করেন নি আপনাকে? মানে, এই সব ঘটনা আপনি কি করে জানলেন সেই বিষয়ে ওনার প্রশ্ন ছিল নিশ্চই?’
‘অফ কোর্স ছিল! সোর্স হিসেবে আমি তোমার নামই বললাম তবে উনি বোধহয় আঁচও করেছিলেন। আমি ওঁকে জানালাম যে তোমার মধ্যে কিছু অদ্ভুত মানসিক শক্তির প্রকাশ দেখা গেছে যার জোরে তুমি কিছু মানুষের অতীত দেখতে পাও। এছাড়া উপায় ছিল না, আশাকরি তুমি কিছু মনে কর নি আমার এ অসত্য ভাষণে?’
‘না, ঠিকই আছে। তারপর?’ এই খবরেই কি ডঃ কোস্তা এতটা উত্তেজিত? নাকি আরও কিছু আছে। মার্ক উত্তরটা কিছু পরেই পেল।
‘তারপর আমি খুঁজে বের করলাম রন সেবাস্তান কে। রন মানে, যার কথা গতকাল বলেছিলাম, যে পুনর্জন্মের কোয়াণ্টাম থিয়োরির সাহায্যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল আমাকে কয়েক বছর আগে। সে তো আমাকে চিনতেই পারে না প্রথমে, বোধহয় ঘুমচ্ছিল বা মদ্যপান করছিল বলে ব্রেনও একটু মন্থর গতিতে কাজ করছিল তার। যাই হোক, অবশেষে যখন চিনতে পারল তখন অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করলাম আমরা নিজেদের মধ্যে তোমার কেসটা নিয়ে। উনি ত ভীষণই এক্সাইটেড, ওনার ধারণা এটা টাইমের অন্য ডাইমেনশানে প্রবেশ করার ঘটনা। ব্যাপারটা খুব ক্লিয়ারলি বুঝি নি আমি তবে দেখি যতটা বুঝেছি তোমাকে বোঝাতে পারি কি না।’ বলে উঠে গিয়ে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে এলেন তিনি। তার পর শুরু করলেন তার ওপর ছবি আঁকতে।
‘আগে আমরা ঝালিয়ে নিই স্পেসের ডাইমেনশান বলতে কি বুঝি সে বিষয়টা। মনে কর আমরা, মানে তুমি আর আমি খুব ছোট একটা পোকার প্রজাতি যারা মাত্র একটা ডাইমেনশানই দেখতে এবং অনুভব করতে পারে। একটা ডাইমেনশান মানে হচ্ছে শুধুমাত্র একটা সরলরেখা, তার শুধুই দৈর্ঘ আছে, প্রস্থ বা উচ্চতা কিছুই নেই। অর্থাৎ আমরা ডাইনে-বাঁয়ে বা ওপর-নিচ দেখতে পাই না। এবার মনে কর এই টেবিলটার ওপর আমি তোমার সামনে সরলরেখা ধরে হেঁটে যাচ্ছি, তুমি পেছন থেকে আমার ওপর লক্ষ রাখছ। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর যে কোন ভাবেই হোক আমার মধ্যে দ্বিতীয় ডাইমেনশান সমন্ধে উপলব্ধি এল, আমি দেখতে পেলাম যে শুধু সরলরেখা ধরেই নয় আমি ইচ্ছে করলে ডাইনে বা বাঁয়েও হেঁটে যেতে পারি। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি সরলরেখার রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে বা বাঁ দিকে বাঁক নিলাম, তুমি কি আর আমাকে দেখতে পাবে?’
কিছুক্ষণ চিন্তা করল মার্ক। না, সে নিজে যেহেতু এখনও একটা মাত্র ডাইমেনশান দেখতে পাচ্ছে অর্থাৎ সোজাসুজি, অন্য পোকাটা যদি দ্বিতীয় ডাইমেনশানে হাঁটতে শুরু করে, তাকে সে দেখতে পাবে না। তার মনে হবে সে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘বা মনে কর আমার মধ্যে ওড়ার শক্তি এসে গেল, অর্থাৎ তৃতীয় ডাইমেনশানে ভ্রমণ করার শক্তি, তখন?’ বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে ডঃ কোস্তা ওকে ব্যাপারটা বোঝাতে খুব আনন্দ পাচ্ছেন, মুখে একটু হাসি হাসি ভাব।
‘তখনও আমি আপনাকে আর দেখতে পাব না।’ মার্ক জানাল।
‘এবার মনে কর আমি তোমার দৃষ্টিপথ থেকে গায়েব হয়ে গিয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডাইমেনশান ধরে তোমার ঠিক পেছনটিতে চলে এসে তোমাকে পেছন থেকে টোকা দিলাম, তোমার অনুভব কি রকম হবে?’
ঘটনাটা ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করল মার্ক। যে বস্তুটি এতক্ষন চোখের সামনে হেঁটে যাচ্ছিল, সে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল আর কিছুক্ষণ পর তার আবির্ভাব ঘটল তার ঠিক পেছনে। ঘটনাটা তার কাছে, অর্থাৎ যে পোকাটি অন্য পোকাটিকে এতক্ষন ধরে নজরে রাখছিল তার কাছে অলৌকিক মনে হবে যেহেতু তার অন্য ডাইমেনশান সম্বন্ধে কোনও ধারণা নেই। কথাটা ডঃ কোস্তাকে জানাল সে। কিন্তু এটার সঙ্গে তার জীবনে যা ঘটছে সেটার কি সম্পর্ক?
‘এইবার চলে এস সময়ের ক্ষেত্রে। আমরা সময়কে একটা মাত্র ডাইমেনশানেই অনুভব করতে অভ্যস্ত, অন্য কোনও ডাইমেনশানে সময়কে প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতাও নেই আমাদের। ধরে নাও এই সরলরেখাটি সেই প্রবাহমান সময় কে রিপ্রেসেন্ট করছে। বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত স্পেসের বিভিন্ন ডাইমেনশান নিয়েই গবেষণায় ব্যাস্ত, সময়েরও যে আরেকটা বা একাধিক ডাইমেনশান থাকতে পারে তা আমাদের ধারণাতেই নেই। কিন্তু যদি স্পেসের মত সময়েরও দুটি বা তিনটি ডাইমেনশান থাকে?’
ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল মার্ক। সে বিজ্ঞানের একটু আধটু খবর রাখে বলে জানে যে স্ট্রিং থিয়োরি অনুযায়ী স্পেসের দশটা কি এগারটা ডাইমেনশান আছে। কিন্তু এখনও সময়ের একাধিক ডাইমেনশানের কথা সে কোথাও পড়েছে বলে মনে করতে পারল না। ডঃ কোস্তা ঠিক কি বলতে চাইছেন?
‘যেহেতু আমাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই, সময়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডাইমেনশানে জীবন কাটান জিনিসটা কি সে সম্বন্ধে আমাদের কোনও ধারণাও নেই। তবে এটা কি নিতান্তই অসম্ভব যে মৃত্যুর পর স্পেসে বাঁক নেওয়া বা ওড়ার মত, সময়েও আমরা অন্য ডাইমেনশানে প্রবেশ করি? আমরা যেহেতু এর একটা ডাইমেনশান অনুভব করতেই অভ্যস্ত, অন্য ডাইমেনশান সম্বন্ধে কোনও অভিজ্ঞতা নেই আমাদের। এবার, ঠিক স্পেসের অন্য ডাইমেনশানে ট্র্যাভেল করার মত, আত্মাও কি অন্য ডাইমেনশানে ট্রাভেল করে আমাদের ঠিক পেছনে, অর্থাৎ অতীতে ফিরে যেতে পারে না?’
ব্যাপারটা বেশ জটিল মনে হল মার্কের। ডঃ কোস্তার আঁকা তির চিহ্ন গুলির দিকে ভাল করে মনোযোগ দিল সে। স্পেসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে পরিস্কার বুঝতে পেরেছিল, এবার সেইগুলিকে সে টাইমের ডাইরেকশান হিসেবে কল্পনা করল। সোজা এগিয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যতের দিকে এগোন, সেই সরলরেখা ধরে পেছিয়ে আসা মানে অতীতে ফিরে যাওয়া। ডান দিক, বাঁ দিক বা ওপর নিচ মানে যথাক্রমে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডাইমেনশানে ট্র্যাভেল। ইনি বলতে চাইছেন মৃত্যুর পর আমরা সময়ের অন্য ডাইমেনশানে চলে যাই আমাদের পরিচিত প্রথম ডাইমেনশান অর্থাৎ সরলরেখা ছেড়ে। এই অন্য ডাইমেনশানে ট্র্যাভেল করে আত্মার পক্ষে অতীতেও ফিরে আসা সম্ভব। কিন্তু কল্পনা হিসেবে এটা হয়ত চলতে পারে, বাস্তবে কি এটা সম্ভব? কিন্তু তার জীবনে যা ঘটছে তাও তো শুনে অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।
‘কিছুটা বুঝলাম। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা ধারণা আপনার, বাস্তবে যে এটাই ঘটে তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ আছে কি?’
‘না, নেই।’ কফিতে চুমুক দিতে দিতে ডঃ কোস্তা বললেন। ‘শুধু তাই নয়, এতে একই সময়ে এক আত্মার দুই দেহের ভেতর থাকার সমস্যাটা মিটল কি? বোধহয় না। অর্থাৎ, এই ব্যাখ্যার মধ্যেও একটা বড়সড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে আমার কাছে এর থেকে ভাল কোনও এক্সপ্লেনেশান নেই তোমার ব্যাপারটার।’
ডঃ কোস্তার দৃষ্টি সামনের লনের দিকে, উনি বিশেষ কিছু দেখছেন না সেটা বোঝা যাচ্ছে তবে গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছেন সেটা স্পষ্ট।
‘এবার তাহলে আমাদের করণীয় কি? ভারত যাত্রা?’ প্রশ্ন করল মার্ক।
‘আমিও তাই প্ল্যান করেছিলাম প্রথমে কিন্তু কাল প্রায় মাঝরাতে আরও একটা ফোন পেয়েছি আমি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। সে আবার পুনর্জন্মের ব্যাপার ছাড়াও মানুষের অতিন্দ্রিয় ক্ষমতা সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখে বলে তোমার ব্যাপারটা ওকে জানিয়েছিলাম। সে জানাল তুমিই প্রথম নও, এরকম আরও একটা ঘটনার রেকর্ড ওর কাছে আছে যেটা প্রায় পনের ষোল বছর আগে ঘটেছিল।’ ডঃ কোস্তার গলার স্বর প্রায় শোনাই যাচ্ছে না এখন, যেন নিজের সঙ্গেই বিড়বিড় করে কথা বলছেন উনি।
কথাটা শুনে মার্কের প্রায় উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে গেল। এরকম আরও ঘটেছে? সেই ঘটনার কি কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে? তবে ডঃ কোস্তার প্রায় সমাধিস্থ ভাব লক্ষ করে কোনও কথা বলল না সে। যা বলার উনি নিশ্চই নিজের থেকেই বলবেন।
‘দুর্ভাগ্যের বিষয় যে মেয়েটির এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল সে ব্যাপারটা ধরা পড়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়।তার ঘটনাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যে ডাক্তার তিনিও মৃত এবং যে কোন কারণেই হোক উনি কেসটার ডিটেল কাউকে জানান নি। তবে মেক্সিকোতে এক সাইকিক ভদ্রমহিলা এখনও বেঁচে আছেন যিনি ঘটনাটার সঙ্গে কিছুদিন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। এখন তার বয়স প্রায় পঁচাত্তর এবং তিনি শুনলাম অসুস্থও। আমার মনে হয় আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ভারত না হয়ে মেক্সিকো হওয়া উচিৎ। দুটো সিমিলার কেস স্টাডি করলে আমরা একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে হয়ত আসতে পারব। এবং বলা তো যায় না, এই মহিলাও কতদিন বেঁচে থাকবেন তার নিশ্চয়তা নেই। তোমার কি কোনও আপত্তি আছে প্ল্যানটায়? একটা ব্যাপার এখানে ক্লিয়ার করে দিতে চাই যে এরপর থেকে খরচ সম্পূর্ণ আমার; সুতরাং সে বিষয়ে চিন্তা কোর না। তুমি তো এখানে কিছুদিন ঘুরবে বলেছিলে যার মানে হাতে নিশ্চই কিছুটা সময় আছে?’
মার্ক কিছুক্ষণ চিন্তা করল। এতে ওর ইতালি ঘোরার প্ল্যানটা নষ্ট হয়ে যাবে তবে এই মানসিক অবস্থায় সে ভালভাবে ভ্রমণ উপভোগও করতে পারবে না। তবে সাইকিক ভদ্রমহিলার কাছে যেতে হবে শুনে তার ভাল লাগল না। যতদূর সে জানে সাইকিক মানে যারা মানুষের মনের কথা বা তার অতীত বা ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে অতিন্দ্রিয় ক্ষমতার সাহাহ্যে। এই ধরনের মানুষের সম্বন্ধে তার ধারণা খুব একটা ভাল নয়, এদেরকে সে ফ্রডই মনে করে। কিন্তু অপরদিকে, ডঃ কোস্তা সম্বন্ধে তার মনে শ্রদ্ধা জন্মেছে। তিনি যখন এই মহিলার কাছে যেতে আগ্রহী তখন তার আপত্তি করা উচিৎ হবে কি? হয়ত ওনার মুল উদ্দেশ্য তাঁর কাছ থেকে জাস্ট পুরনো কেসটার রেকর্ড সংগ্রহ করা। তবে সে ক্ষেত্রে হয়ত উনি একাই যেতে পারতেন বা নিজের কোনও সহকারি বা ছাত্রকেও পাঠাতে পারতেন, মার্ককে যখন নিয়ে যেতে চাইছেন তখন ওনার যে আরও কোনও উদ্দেশ্য আছে সেটা ধরেই নেওয়া যায়।
‘ঠিক আছে। প্রয়োজনে মেক্সিকো যেতে আমার আপত্তি নেই।’ সে জানাল।
ভদ্রলোকের মুখে হাসি ফুটল তবে তা অল্পক্ষণের জন্য। আবার যেন কোনও গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন তিনি। উনি কি আরও কিছু জানতে পেরেছেন যা তিনি মার্কের কাছ থেকে লুকচ্ছেন? তবে মাত্র এক রাত্রে একজন মানুষের পক্ষে কত কাজ বা চিন্তা করা সম্ভব? দেখে বেশ ফ্রেশই মনে হচ্ছে ওনাকে এখন, রাত্রে নিশ্চই ঘুম কম হয়েছে কারণ তিনি ওর ডায়েরিটাও পড়েছেন গতরাত্রেই কিন্তু তার কোনও আঁচ ওনার শরীরে বা ব্যবহারে পড়েনি।
‘দেখি কত তাড়াতাড়ি ম্যাডাম আমান্দা গারসিয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়। অবশ্য না পাওয়া গেলেও আমরা অপেক্ষা করব না। এখন উঠি, তুমি একটু আধটু ঘুরে আসতে পার, গাড়ির ব্যাবস্থা রিসেপশনে বললেই করে দেবে। তবে সন্ধের মধ্যে ফিরে এস। হয়ত তার মধ্যে আরও কিছু খবর পাওয়া যাবে।’ এই বলে প্রস্থান করলেন ডঃ কোস্তা।
যা আশংকা করা গেছিল সেটাই হল, একটু পরেই ডঃ কোস্তা ফোন করে জানালেন যে আমান্দা গারসিয়া গত তিনবছর যাবত নিজের পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন তিনি একা নিজের বাড়িতে ব্যক্তিগত জীবন যাপন করেন, সঙ্গী শুধুমাত্র এক পরিচারিকা এবং একটা কুকুর। তবে ডঃ কোস্তা খবরটায় কিছুমাত্র না দমে মেক্সিকো যাওয়ার পরিকল্পনা পাকা করে ফেললেন। ওনার বিশ্বাস ওখানে গিয়ে আমান্দার সঙ্গে দেখা করার কোনও না কোনও উপায় ঠিকই বেরিয়ে যাবে। ওখানেই সরাসরি পৌছবেন বৈজ্ঞানিক রন সেবাস্তান কানাডা থেকে, ওনার মনেও নাকি এই ব্যাপারটায় প্রচুর কৌতূহল দেখা গেছে। ঘটনাটার আরও কোনও কোয়াণ্টাম মেকানিক্যাল ব্যাখ্যা আছে কিনা সেটা জানতেও উনি আগ্রহী।
আমান্দা গারসিয়া সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিয়েছিলেন ডঃ কোস্তা, আর কিছু মার্ক নিজেই বের করল ইন্টারনেট ঘেঁটে। একটা বইও আনিয়ে পড়ে ফেলল সে অনলাইনে ক্লারভয়েন্স, টেলিপ্যাথি এবং অন্যান্য রিলেটেড বিষয়ে।
আমান্দা গারসিয়া রিতিমত শিক্ষিতা, একসময় ওদেশের সবচেয়ে নামকরা কলেজের বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। ওনার মধ্যে কিছু অতি ইন্দ্রিয় শক্তি নাকি ছোটবেলার থেকেই ছিল যদিও সেটার প্রচার করতে দেন নি ওনার বাবা-মা। ওনার নিকট আত্মীয় এবং বন্ধুরা ওনার শক্তির সম্বন্ধে জানতে পারেন বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তবে সে সম্বন্ধে তারা স্বীকার করে আমান্দা চাকরী ছেড়ে নিজেকে পুরোপুরি এই লাইনে সমর্পিত করার পর। তবে তিনি নাকি কেস নিতেন খুবই বাছ-বিচার করে, অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তিদেরও উনি পত্রপাঠ বিদেয় করেছিলেন প্রভুত অর্থের প্রলোভন সত্বেও, আবার কখনও দেখা যেত তিনি পাড়ার বাচ্চাদের চুরি যাওয়া সাইকেল বা ফুটবল খুঁজতে সাহাহ্য করছেন নিজের শক্তির দ্বারা। থট রিডিং এবং সম্মোহন বিদ্যায় তাঁর খ্যাতি বেশ ছড়িয়ে পড়লেও ওনার আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি ঘটে নি ওনার অপেশাদার মনোভাবের কারণে। বিয়ে করেন নি, আর্থিক স্বাতন্ত্র পাওয়ার পর বাবা-মা বা ভাইদের সঙ্গেও তিনি সম্পর্ক খুব একটা রাখতেন না। বন্ধুও ছিল হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।
ভদ্রমহিলার বিভিন্ন বয়সের কয়েকটা ছবিও পেল মার্ক ইন্টারনেট থেকে। লম্বা, মেদবর্জিত দোহারা শরীর, কোঁকড়ান একঝাক অগোছাল চুল মাথায়, গায়ের রঙ হাল্কা বাদামি, চোখের মনির রঙও তাই। কম বয়সে দেখতে বেশ সুন্দরীই ছিলেন, বয়েস বাড়ার সঙ্গে সৌন্দর্যের জায়গায় যেন একটা আভিজাত্য এসেছে চেহারায়। তবে কোনও ছবিতেই ওনার বয়স পঁচাত্তর মনে হল না, অর্থাৎ ছবিগুল সবই বেশ পুরোনো।
সব মিলিয়ে মহিলাকে বেশ পছন্দ হল মার্কের। বেশ একখানা আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্ব, জীবনটাও কম আকর্ষণীয় নয়। তবে উনি ঠিক কি ধরনের সমস্যার সমাধান করতেন তার কোনও স্বচ্ছ ধারণা পেল না সে ইন্টারনেটের প্রবন্ধগুল থেকে। বিশেষ করে উনি যে পুনর্জন্ম বিষয়টা নিয়ে যে কখনও কোনও নাড়া চড়া করেছেন তারও কোনও প্রমাণ নেই। তবে ডঃ কোস্তা নিশ্চই পাকা খবর নিয়েই ওখানে যাচ্ছেন।
মেক্সিকো এয়ারপোর্টের কাছেই একটা মাঝারি মানের হোটেলে উঠল ওরা। তিনটে রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল, দুটো ওদের আর তৃতীয়টা রন সেবাস্তানের নামে। রিসেপসানে জানাল সেবাস্তান ঘণ্টা দুই আগেই হোটেলে চেক ইন করেছেন এবং ওরা এলেই যাতে ওনাকে কল করে খবর দেওয়া হয় সেই নির্দেশ আছে।
‘আসলে রন টাইম ট্র্যাভেলারের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য মুখিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে ফ্রেশ ট্রেস হয়ে নাও, এর পর সে যে কখন তোমায় ছাড়বে তার কোনও ঠিক নেই।’ হাতে চাবি নিয়ে অল্প হেসে বললেন ডঃ কোস্তা।
এখানে এখন শীতকাল তবে তাপমাত্রা স্টেটসের শীতের চেয়ে অনেকটাই বেশি। তবে মার্ক বেশ পরিশ্রান্ত বোধ করছিল এতটা জার্নি করে। পেট ভরে খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দেওয়ার গোপন পরিকল্পনা ছিল তার কিন্তু সেবাস্তানের উৎসাহের কথা শুনে বুঝতে পারল যে ঘুমের আশা আপাতত ছেড়ে দেওয়াই ভাল। আবার বিকেলের দিকেই একবার ম্যাডাম গারসিয়ার ওখানে যাওয়ার কথা।
রন সেবাস্তানের বয়স যা ভেবেছিল তার থেকে অনেকটাই কম, বড়জোর চল্লিশ হবে। লম্বা, প্যাকাটি শরীর, অসম্ভব দ্রুত কথা বলেন বলে প্রায়ই কথা রিপিট করতে হয় দুবার, কখনও বা তিনবার। ব্যাবহার খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ, দেখলে বোঝার উপায় নেই যে উনি কোয়াণ্টাম ফিজিক্সের একজন নামকরা এক্সপার্ট।
‘তা হলে এই সে মানুষ যে সময়ের গতিপথকে উল্টো করতে সক্ষম হয়েছে। আমেজিং! বললে বিশ্বাস করবেন না, আপনার বিষয়ে জানার পর থেকে আমার মাথায় একের পর এক আইডিয়া খেলছে, সবগুলই শুনতে একদম পাগলের প্রলাপের মত অথচ আপনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। এক কোয়াণ্টাম থিয়োরিই আমাকে এতদিন অভিভুত করে রেখেছে, এখন আবার তার ওপর পুনর্জন্ম, ক্ল্যারভয়েন্স, টাইম ট্র্যাভেল, টেলিপ্যাথি – সত্যি বলছি, নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। যেন আমরা ব্রহ্মাণ্ডের নানান রহস্যের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে আছি। আমি জানি আপনারা দুজনেই প্রচণ্ড ক্লান্ত কিন্তু কোস্তা, মার্ক যদি আমাকে লাঞ্চের পরই অন্তত আধ ঘণ্টা সময় না দেয়, তাহলে……’ কথাটা আর শেষ করলেন না উনি।
মার্ক অল্প অল্প হাসছিল এই অত্যুৎসাহী বৈজ্ঞানিকের কথা শুনে। মানুষটার মনটা যে ভীষণ পরিস্কার এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। এখন মনে হচ্ছে এনার সঙ্গে দুপুরবেলা আধ ঘণ্টা কেন, দু ঘণ্টা কাটাতেও কোনও ক্লান্তি আসবে না তার। তা ছাড়া ওনার উদ্ভট আইডিয়া গুলো শোনা যাবে। সেটা সে জানাল সেবাস্তান কে। ভদ্রলোক খুব খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকালেন।
‘ঠিক আছে, দুপুরে তাহলে তোমরা দুজনে আলোচনা করে কাটাও, আমি একাই একটু ঘুরে আসি।’ ডঃ কোস্তা বললেন, ‘দেখি মহিলার সঙ্গে একটা সেশনের ব্যাবস্থা করা যায় কি না দু এক দিনের মধ্যে।’
‘সেই সেশনে কিন্তু আমিও থাকব কোস্তা, সেভাবেই কথা বলবে।’ সেবাস্তান বললেন। উত্তরে শুধু মাথা নাড়লেন ডঃ কোস্তা, ওনাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল।
দুপুরটা ভাল কাটল মার্কের। ভদ্রলোক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে ওর পূর্বজন্মের স্মৃতির কথা জেনে নিচ্ছিলেন। তবে কিছু নোট করেননি, সেটা নাকি কোস্তার সঙ্গে ওনার চুক্তি; রিসার্চ যা করার আপাতত কোস্তাই করবে। ওর কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পরই সেবাস্তান বা অন্য কেও মার্কের ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে।
‘আমি একটা ব্যাপার নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি। ধর, ভারতের ঐ ছেলেটার, মানে দেবের, যে ভবিষ্যৎ তোমার মনে আছে সেই ভবিষ্যৎ আমরা যদি পালটাবার চেষ্টা করি, সে ক্ষেত্রে কি হবে? ধর আমি তাকে ম্যানেজমেন্ট পড়ার জন্য বেশ কিছু টাকা স্কলারশিপ হিসেবে দিলাম বা মনে কর আমি তার জীবনে একটা এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে, প্লিজ এটাকে সিরিয়াসলি নিও না, এটা একটা থট এক্সপেরিমেন্টের মত, তার ক্যারিয়র শেষ করে দিলাম, তাহলে তো তোমার স্মৃতি ভুল প্রমাণিত হবে, তাই না?’
এটা মার্কও ভেবেছে। কিন্তু শেষে তার মনে হয়েছে যে কোন কারণেই হোক এমন কিছু ঘটবে না। সে একবার ভাবছিল সে যদি দেবের সঙ্গে দেখা করে সব জানায়, তাহলে কি হবে? কিন্তু সে এটাও জানে যে দেবের জীবনে মার্ক বলে কোনও মানুষের অস্তিত্ব নেই।
‘এর একটা ব্যাখ্যা আছে কোয়াণ্টাম থিয়োরিতে; তুমি তো বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছ, ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্টের কথা মনে আছে? না থাকলেও ক্ষতি নেই, আমি তার মুল কঙ্কলুশান এক্সপ্লেন করে দিচ্ছি। আসলে আমাদের এডুকেশন সিস্টেমটাই এমন যে স্টুডেন্টদের মনে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য বা রহস্য সমন্ধে আগ্রহ, কোনওটাই ঠিক মত জাগাতে পারে না। ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্টে যেটা দেখা গেল যে একটা সাব-এটমিক কনা যেমন ইলেকট্রন, তরঙ্গ এবং কনা, দুভাবেই আচরন করে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। এটাকে বলা হয় ডুয়াল নেচার। ধর একটা ইলেকট্রন – যতক্ষণ না তুমি তার গতিপথকে মাপছ বা লক্ষ করছ, ততক্ষন তার গতিপথ একটা প্রব্যাবিলিটি ওয়েভ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থাৎ সে একটু পরেই ঠিক কোথায় থাকবে তা নিশ্চিত ভাবে কখনই বলা যাবে না। কিন্তু যে মুহূর্তে তুমি একটা যন্ত্র বসালে ওর ওপর নজর রাখার জন্য, সে একটা পার্টিকেলের মত একটা নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে চলতে শুরু করবে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম – ধর পাশের ঘরে একটা দুরন্ত বাচ্চা আছে, তুমি এখান থেকে শব্দ শুনে বুঝতে পারছ যে সে কখনও এটা ছুঁড়ছে, কখনও সেটা ভাঙছে, একবার টি ভি চালাচ্ছে, পরবর্তী কালেই বাথরুমে গিয়ে কল খুলে দিচ্ছে – মোটকথা সারা ঘর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তুমি কিছুক্ষণ পর পাশের রুমে গিয়ে পরিক্ষা করলেও ওর দুরন্তপনার সবরকম চিহ্ন দেখতে পাবে কিন্তু যে মুহূর্তে তুমি ঐ ঘরে পা দিচ্ছ বা যদি কোনও ফুটো বা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে ওর কাণ্ড কারখানা দেখার চেষ্টা করছ, তুমি দেখবে যে সে একমনে লেখাপড়া করছে। অর্থাৎ সে জানে তুমি কখন তার ওপর নজর রাখছ, তখন সে ভদ্র বাচ্চার মত ব্যবহার করবে, আর কখন তুমি নজর রাখছ না, তখন সে নিজের খেয়ালে দুরন্তপানা করে বেড়াবে। যখন সে পড়বে, তখন তার ব্যবহার প্রেডিক্ট করা সহজ, কিন্তু যখন সে দুরন্তপানা করবে তখন অসম্ভব। ইলেকট্রনের মত কণাদেরও ব্যবহার অনেকটা সেরকম। বোঝাতে পারলাম?’
‘আপনি বলতে চাইছেন একটা ইলেকট্রনও ঐ বাচ্চাটার মত বুঝতে পারে আমরা কখন তার ওপর নজর রাখছি?’ কিন্তু ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, ইলেকট্রনের মত একটা নির্জীব কণার মধ্যে কি করে চেতনা থাকতে পারে?
‘একজ্যাক্টলি! শুধু তাই নয়, ওকে বোকা বানাবার সবরকম কৌশল করে দেখেছে বিজ্ঞানীরা, স্বয়ং আইনস্টাইন পর্যন্ত, কিন্তু প্রত্যেকবারই ইলেকট্রন বিজয়ী হয়েছে। এর বিষয়ে বহু সুন্দর সুন্দর বই বা প্রবন্ধ আছে, পড়ে দেখতে পার।যাই হোক, আমি এটা তোমাকে বোঝালাম এইজন্য যে আমাদের জীবনও অনেকটা ঐ ইলেকট্রনের গতিপথের মতই – ভবিষ্যৎ নির্ভর করে প্রব্যাবিলিটির ওপর, অনেক সম্ভাবনা মধ্যে কোনটা ঘটবে আমরা সঠিক ভাবে বলতে পারি না কিন্তু অতীত, যেহেতু তা আমরা অলরেডি প্রত্যক্ষ করেছি, একটা নির্দিষ্ট রাস্তা মেনেই ঘটেছে। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে, তোমার এই জীবন, অর্থাৎ মার্কের জীবন আমাদের অন্য সকলের মতই অনিশ্চিত কিন্তু ভারতে দেব বলে ছেলেটার জীবনে প্রব্যাবিলিটি ওয়েভ কোল্যাপ্স করে গেছে অর্থাৎ তার জীবন প্রব্যাবিলিটি দ্বারা আরনির্ধারিত হচ্ছে না যেহেতু তুমি সেটার ভবিষ্যৎ জান। অর্থাৎ, এখন ওর জীবন আমরা কিছুতেই পালটাতে পারব না, সেই চেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হবেইহবে। আমরা আমাদের অতীত পরিবর্তন কিছুতেই করতে পারব না।’
কথাটা কিছুক্ষণ চিন্তা করল মার্ক। কিন্তু সত্যিই কি সেবাস্তিয়ান যা বলছেন তা হতে পারে? থিয়োরিতে সে বা অন্য যে কেওই তো এখন গিয়ে দিবাকর বা ওর পরিবারের জীবনে এমন কোনও পরিবর্তন ঘটাতে পারে যা তার স্মৃতির সঙ্গে মিলবে না। কিন্তু অন্যদিকে তার এই ধারণাও প্রবল যে সেটা ঘটবে না। দুই বিপরীত চিন্তার মধ্যে কোনটা ঠিক?
‘আর একটা ব্যাপার আমার মাথায় এসেছে। অবশ্য আমার মাথায় এসেছে বলা ভুল হবে, এই ধরনের চিন্তা অলরেডি ইস্টার্ন ধর্ম এবং দর্শনের অঙ্গ। এই মতে, আমাদের সবার আত্মা একটা আরও বড় আত্মার অংশ বিশেষ, সবকিছুর পেছনে একটা ইউনিটি আছে। সেই মতবাদের পরিপেক্ষিতে আমি, তুমি, দেব, রাস্তার কুকুর, কোস্তা, একটা গাছ – সবকিছুই একটা মাত্র শক্তিরই নানান অভিব্যাক্তি মাত্র। সেক্ষেত্রে আমার আর তোমার আলাদা অস্তিত্ব একটা ভ্রম, বাস্তবে আমরা কেউই একে অপরের থেকে আলাদা নই। সময়, স্থান – এসবেরও কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, এটা আমাদের মস্তিস্ক বা মনের সৃষ্ট ছায়া মাত্র। সুতরাং, এই মত ধরলে, তোমার আর দেবের এক হওয়ায় কোনও বাধা নেই তা আমাদের কাছে যতই অবাস্তব মনে হোক না কেন।’
দর্শন কোনওদিনই মার্কের প্রিয় বিষয় নয়, সে সেবাস্তানের কথার মানে খুব একটা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারল না। এখনও তার মাথায় খেলছিল একটু আগে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেটা – এমন কিছু কি করা সম্ভব যেটা দেবের জীবনের গতিপথ বদলে দেবে? যাতে তার স্মৃতির দেব আর এই জীবনের বাস্তব দেব পুরোপুরি আলাদা হয়ে যাবে?
ওদের আলোচনা আর বেশিক্ষন চলল না। নিজের রুমে যখন ফিরে এল মার্ক তখন প্রায় চারটে, অর্থাৎ দেড় ঘণ্টার বেশি সময় সে কাটিয়েছে সেবাস্তানের সঙ্গে। সে একটু শুয়ে ঘুমনোর চেষ্টা করল কিন্তু মস্তিষ্ক নানা চিন্তায় উত্তেজিত থাকায় কিছুতেই ঘুম এল না।
বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে শেষে উঠে পড়ল সে। এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে সেটায় মনযোগদিল। খুব ভারি কিছু নয়, একটা হাল্কা মার্ডার মিস্ট্রী। নতুন লেখক, আগে এর কোনও লেখা পড়ে নি তবে লেখায় গতি আছে, ভাষাও বেশ স্বচ্ছন্দ।
কতক্ষণ বই পড়ছিল সে জানে না, সম্বিত ফিরল টেলিফোনের রিঙের শব্দে। ডঃ কোস্তা।
‘ঘুমচ্ছিলে?’
‘না, জেগেই ছিলাম। আপনার অভিজান সফল?’
‘মোটামুটি। ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছি এবং অল্প একটু কথাও হয়েছে, তবে তিনি তোমার সঙ্গে সেশনে বসতে কিছুতেই রাজি নন। আগের কেস সম্বন্ধেও বিশেষ কিছু বলতে নারাজ। তবে চিন্তা কোরো না, আমি খালি হাতে ফিরে যাওয়ার জন্য তোমাকে নিয়ে এতদুর আসি নি। ঠিক আছে, এখন বিশ্রাম নাও, রাত্রে ডিনারের পর কথা হবে।’ মার্ককে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ডঃ কোস্তা ফোনটা কেটে দিলেন। গলার স্বরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, একটু হতাশার ছাপও কি ছিল?
না, ওটা ক্লান্তিই, নিজেকে বোঝাল মার্ক। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় ওনার দ্বিগুণ, তার ওপর অতটা জার্নি করে এসেই আবার বেরিয়েছিলেন। হয়ত মহিলার কাছে ছাড়াও অন্য কয়েকটা জায়গায় গেছিলেন। সুতরাং উনি যে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়বেন সেটাই স্বাবাভিক। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। প্রায় সাড়ে সাতটা। সে এতক্ষন বই পড়েছে?
টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। এটা হোটেলের রিসেপশান থেকে।
‘স্যার, আপনার জন্য একটা কল আছে।’
‘আমার জন্য? আপনি কি নিশ্চিত?’ অবাক হয়ে গেল মার্ক, এখানে আবার তাকে কে কল করবে?
‘হ্যাঁ স্যার, উনি আপনার নাম বলেছেন।’
‘ঠিক আছে, দিন।’
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটার পর এক ভদ্রমহিলার গলা শুনতে পেল মার্ক। খুব ধিরে কথা বলছেন তিনি কিন্তু উচ্চারন স্পষ্ট। গলায় বয়সের ছাপও আছে।
‘এটা কি মার্ক? আমি আমান্দা! আমান্দা গারসিয়া।’
কিছুক্ষণ কথাটার মানে বুঝতে সময় লাগল মার্কের। আমান্দা গারসিয়ার ফোন!
‘হ্যাঁ বলুন। আপনার সঙ্গে দেখা করতেই ……’ কথাটা ওকে শেষ করতে দিলেন না তিনি।
‘আমি জানি। ডক্টর এসেছিলেন আমার কাছে। কিন্তু আমি ওনার সামনে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না অথচ তোমার সঙে আমার দেখা হওয়াটা খুব জরুরী। এক কাজ কোর,আজ রাত্রি সাড়ে এগারোটায় হোটেলের উল্টো দিকে যে পেট্রোল পাম্প আছে তার সামনে তুমি দাঁড়িও। কি রঙের শার্ট আছে তোমার? হ্যাঁ, সাদা পরাই ভাল, রাত্রে বুঝতে সুবিধে হবে। গাড়িটা তোমাকে সরাসরি আমার বাড়িতে নিয়ে আসবে।’
‘কিন্তু ডঃ কোস্তাকে না জানিয়ে…’
‘মার্ক, প্লিজ তুমি আমার একটা কথা বিশ্বাস কর। তোমার জীবন এই মুহূর্তে প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে রয়েছে। আজ রাত্রের কথা তুমি কাউকে জানাবে না। ডক্টরকে না, তার বন্ধুকে না, এমনকি হোটেলেও না। হোটেলের লোকেরা জিজ্ঞেস করলে বলবে সিগারেট বা অন্য কিছু কিনতে যাচ্ছ, একটু পরেই ফিরবে। বুঝতে পারা গেছে?’ মহিলার গলায় একই সঙ্গে আদেশ এবং অনুরোধের ছাপ।
কি উত্তর দেবে মার্ক বুঝতে পারছিল না। ডঃ কোস্তা ওকে নিয়ে এত দূর এসেছেন, নিজের এতটা সময় এবং অর্থ ব্যয় করেছেন ওর পেছনে, তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করাটা ঠিক হবে এক অপরিচিত মহিলার কথায়?
‘শোন, ডক্টর তাঁর রিসার্চের জন্য সরকার থেকে গ্রান্ট পান। তাছাড়া তুমি ওনাকে অলরেডি অনেক তথ্য দিয়েছ যা ওনার রিসার্চে কাজে লাগবে। সুতরাং এই সম্বন্ধে নিজের মনে কোনও অপরাধবোধ রেখ না।’
চমকে উঠল মার্ক। মহিলা তার মনের প্রত্যেকটা কথাই যেন শুনতে পেয়েছেন।
‘আর একটা কথা, এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমার একটা ডায়েরি আছে ডক্টরের কাছে। সেটা তুমি আসার আগে ওনার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে নেবে। বলবে তোমার আরও কিছু ঘটনা মনে পড়েছে ছেলেটার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যা তুমি আজ রাত্রে লিখে রাখতে চাও তাতে। মনে রেখ, ভবিষ্যৎ বলবে, অতীত নয়। উনি এখন আর ওর অতীত সম্বন্ধে তেমন আগ্রহী নন। বুঝতে পারা গেছে?’
‘ঠিক আছে।’ কোনরকমে বলল মার্ক। তার গলা কাঁপছিল। যে মহিলা টেলিফোনের ওপার থেকে ওর মনের প্রত্যেকটা কথা বুঝতে পারেন, তিনি ওর সামনে এলেআর কি কি করতে পারেন?
‘রাত্রে দেখা হচ্ছে তাহলে তোমার সঙ্গে। মনে শুধু একটা বিশ্বাস রেখো, আমি তোমার ক্ষতি চাই না। আমার বয়স এখন ছিয়াত্তর, এই জীবনে আমার পাওয়ার কিছুই নেই। শুধু যাওয়ার আগে একটা কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে চাই।’
কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবল মার্ক। তাকে একখানা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এক্ষুনি। কিন্তু সে তো এনার সঙ্গে দেখা করতেই এসেছে, সঙ্গে শুধু ডঃ কোস্তা থাকবেন না এই যা। মহিলার কি অভিসন্ধি থাকতে পারে তাকে একা ডাকার? তাছাড়া এই রহস্যময় মহিলার প্রতি একটা দুর্নিবার আকর্ষণও বোধ করছিল সে।
‘ঠিক আছে, আমি আসব। সাড়ে এগারোটায়, পেট্রোল পাম্পের সামনে।’
‘শুভ রাত্রি!’ ফোনটা কেটে গেল।
ডিনারের সময় দেখা গেল অত্যন্ত অন্যমনস্ক ডঃ কোস্তা। সেবাস্তানও কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল না ওনার আজকের অভিজান সম্বন্ধে। মার্ক তো চাইছিলই কথা কম বলতে কারণ তার ভয় ছিল যে তার গলার স্বরেই হয়ত ওরা, বিশেষ করে ডঃ কোস্তা ওর মনের উত্তেজনার আঁচ পেয়ে যাবেন। যতই হোক উনি একজন বিশ্ব বিখ্যাত মনস্তাত্বিক। কিন্তু ডিনার শেষে ওকে কথা বলতেই হল।
‘ডঃ কোস্তা, আজ রাত্রের জন্য আমার ডায়েরিটা একটু পেতে পারি?’
কথাটায় একটু চমকে উঠলেন তিনি; তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’
‘আজ রাত্রে কিছু নোট করব। দিবাকরের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য মাথায় আসছে। আগেও দেখেছি লেখবার সময় অনেক স্মৃতি পরিস্কার হয়ে যায়।’ যতটা সম্ভব উত্তেজনা চেপে কথাগুল বলল মার্ক।
‘ঠিক আছে, আমি রুমে গিয়ে পাঠিয়ে দেব।’
‘আমি ডিনার থেকে ফেরার পথেই তো আপনার কাছ থেকে কালেক্ট করে নিতে পারি।’
কিছু বললেন না ডঃ কোস্তা, চুপচাপ প্লেটে রাখা বাকি খাবারটুকু শেষ করলেন। উনি কি কিছু আন্দাজ করেছেন? একসময় মার্কের মনে হল সে এত ভয়ই বা পাচ্ছে কেন; ডায়েরিটা তো তারই, এর ওপর তো ডঃ কোস্তার কোনও অধিকার থাকার কথা নয়!
সেবাস্তানকেও একটু চুপচাপ মনে হল, তবে সেটা হতে পারে ডঃ কোস্তার আর মার্কের কম কথা বলার কারণে। বা হয়ত ওনার মাথায় আবার কোনও নতুন আইডিয়া চাড়া দিয়েছে যেটা নিয়ে উনি ব্যস্ত আছেন। আসলে ওনার সম্বন্ধে কোনও খারাপ কথা ভাবতেই পারছে না মার্ক।
‘চল, তোমাকে ডায়েরিটা দিয়ে দি। কিন্তু তুমিও তো বিশেষ ঘুমোও নি, এ অবস্থায় আরও রাত জাগবে? কালকে সকাল সকাল বেরতে হতে পারে কিন্তু।’ ডঃ কোস্তা বললেন ডিনার টেবিল থেকে উঠে।
‘আমি তো তাও একটু শুয়েছিলাম, আপনি তো এসেই আবার বেরিয়েছিলেন। তাছাড়া একটু ঘুমলেই আমার চলে যাবে, সকালে বেরোতে কোনও অসুবিধে হবে না।’ মার্ক বলল।
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে সে যখন রুমে ঢুকল তখন ঘড়িতে দশটা কুড়ি বাজে। আরও প্রায় এক ঘণ্টা পরে বেরোবে সে, হাতে মিনিট পাঁচ সাত সময় থাকাই ভাল। বইটা আবার পড়ার চেষ্টা করল কিন্তু মন বসল না।
কিছুক্ষণ পর আবার ফোনটা বেজে উঠল। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল মার্কের, এ সময় আবার কে?
‘হ্যালো, রন বলছি। লিখছিলে না তো?’
গলাটা শুনে আস্বস্ত হল সে।
‘না, না, এমনি একটা বই পড়ছিলাম। বলুন!’ সে বলল।
‘আজকে ঠিক কি ঘটেছে বল তো, কোস্তা তোমায় কিছু বলেছে? ফিরে থেকেই গুম মেরে গেছে। কিছু বলছেও না, শুনছেও না। ভদ্রমহিলা যে দেখা করতে না চাইতে পারেন তা তো আমরা আগেই জানতাম, তাই না?’
‘আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে কোনও কথাই হয় নি ওনার।’ সত্যি কথাটাই বলল মার্ক।
‘হুম! ঠিক আছে, হয়ত কাল সকালেই দেখব মেঘ কেটে গেছে। মানুষের মন মেজাজ তো সব সময় এক রকম থাকে না। ঠিক আছে, শুভ রাত্রি! কালকে সকালে আবার দেখা হবে, কিছু প্ল্যান এসেছে মাথায়।’
সেবাস্তেয়ানকেও শুভ রাত্রি জানিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখল মার্ক। একটা বড় করে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল তারপর, এখন প্রায় এগারটা।
নির্দিষ্ট সময়ে পেট্রোল পাম্পের সামনে দাড়াতেই একটা নীল রঙের ট্যাক্সি এসে থামল ওর পাশে। বোধহয় কাছাকাছিই কোথাও দাঁড়িয়ে জায়গাটার ওপর নজর রাখছিল।
‘মার্ক? ম্যাডাম গাড়ি পাঠিয়েছেন।’ জানালার কাঁচটা নাবিয়ে ভাঙা ইংরাজিতে বলল ড্রাইভার।
মার্ক ভেতরে বসতেই সোজা এগিয়ে চলল গাড়ি। নেহাতই সাধারণ গাড়ি এবং অনেক পুরনোও, আমেরিকাতে এই বয়সী গাড়িতে রাস্তায় চলার অনুমতিই দেওয়া হয় না। ড্রাইভারের দিকে লক্ষ করল মার্ক। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, গায়ের রঙ বেশ ময়লা। তারদু একটা প্রশ্নের কোনও উত্তর না পেয়ে সে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল গন্তব্যস্থলে পৌঁছোবার। গাড়িটা শহরের ভিড় ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে এগিয়ে চলল, রাস্তাও এবড়ো খেবড়ো এখানকার। জানালা দিয়ে দোকানের ব্যানার দেখে ঠিকানা বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না। তার মনে উত্তেজনা অনেকটাই কম এখন। হয়ত শরীর যখন কোনও কাজে ব্যাস্ত থাকে তখন মন উত্তেজিত হওয়ার সময় পায় না।
অবশেষে তারা যখন একটা নিঝুম গলির সামনে দাঁড়াল তখন সময় বারোটা বেজে পঁচিশ। ড্রাইভার নেবে ওকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল প্রায় পঞ্চাশ মিটারের মত। শেষে এক কোনায় অবস্থিত একটা ছোট একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়াল তারা। একটা কুকুরের ডাক শোনা গেল ভেতর থেকে।
‘ধন্যবাদ এরিক, তুমি এখন যাও। পরে আমি ডেকে নেব তোমাকে সময় হলেই।’ ভেতর থেকেই এক মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল তবে এই গলাই সে টেলিফোনে শুনেছিল কিনা সে সমন্ধে মার্ক নিশ্চিত হতে পারল না।
একটা কথাও না বলে ড্রাইভারটি দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। রাস্তার আবছা আলোয় মার্ক অপেক্ষা করতে লাগল গেটের সামনে।
একটু পরেই দরজা খুলে যে মহিলা বেরিয়ে এলেন তিনিই যে আমান্দা গারসিয়া সে সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ ছিল না। ইন্টারনেটে ছবিতে যা দেখেছিল তার থেকে অনেকটা বয়স্কা মনে হলেও ওনার যে ছিয়াত্তর বছর বয়স সেটা বিশ্বাস করা শক্ত।
‘এস মার্ক।’ ওকে নিজের ঘরের ভেতর নিয়ে বসালেন তিনি। ‘তোমাকে এভাবে অপেক্ষা করালাম বলে দুঃখিত, আসলে আমার কুকুর বব কে ওর ঘরে রেখে এলাম। এমনিতে সে খুবই ভদ্র তবে গভীর রাত্রে এ বাড়িতে মানুষের আসা যাওয়া সে পছন্দ করে না। একটু বস, আমাদের জন্য কফি নিয়ে আসি, আমার রেডি করাই আছে।’
মহিলার কথাবার্তায় বেশ একটা সহজ ভাব, ফোনে যেরকম রহস্যময় মনে হয়েছিল ওনাকে এখন আর তা হচ্ছে না। কিন্তু এত রাত্রে এইভাবে ডেকে পাঠানোর কি উদ্দেশ্য থাকে পারে ওনার?
দুটো মগে দুজনের জন্য কফি নিয়ে এসে বসলেন আমান্দা। বেশ কড়া করে তৈরি তবে মার্কের খারাপ লাগছিল না।
‘ডক্টর তোমাকে কিছু বলেছে এখান থেকে ফিরে?’ জিজ্ঞেস করলেন আমান্দা।
‘তেমন কিছু নয়, শুধু বললেন আপনি আমার সঙ্গে সেশনে বসতে আগ্রহী নন।’
‘আমি জানতাম উনি তোমাকে সব কথা জানাবেন না। তোমার সম্বন্ধে আমি সবই মোটামুটি শুনেছি ওনার কাছ থেকে। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন আছে, তুমি কি সত্যিই ছেলেটার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বেশি কিছু বলতে পারছ না? তোমার এমন কিছু মনে পড়েনি যেটা তুমি লুকোতে চাইছ?’
‘না, আমি যতটা মনে করতে পেরেছি তার সবই প্রায় ডঃ কোস্তাকে জানিয়েছি।’
‘ডায়রিটা এনেছ?’
মার্ক সেটা এগিয়ে দিতেই উনি সেটা নিয়ে একটা তাকের ওপর রেখে দিলেন। পরে পড়বেন কি? কিন্তু কখন? কাল সকালেই তো আবার ডক্টর কোস্তা ওটার খোঁজ করবেন।
‘তোমার কেসটা যতই অস্বাভাবিক মনে হোক, এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। ষোল বছর আগে একটা ফুটফুটে মেয়ে, এলিনাকে নিয়ে এসেছিলেন এক চিকিৎসক। তখন মেয়েটির মাত্র তেরো বছর বয়স। মেয়েটি খুব গরিব ঘরের ছিল বলে মনে হয় তার বাবা তাকে একরকম বিক্রিই করে দিয়েছিল সেই চিকিৎসকের কাছে অর্থের বিনিময়ে। সেই মেয়েটি বলত সে তার আগের জন্মে এক শিক্ষিকা ছিল এখানেরই ছোট্ট এক শহরে, নাম কেটা। তোমারই মত সে একবার এক আত্মীয়র বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে সেই শিক্ষিকার বাড়ি দেখতে পায় দূর থেকে, তার পরই তার পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। সেই মেয়েটি কিন্তু সেই শিক্ষিকার বাকি জীবনের প্রায় সব প্রধান ঘটনাই জানত। এখানেই আমার একটা খটকা লাগছে।’
‘তারপর, সেই মেয়েটির কি হল?’ জিজ্ঞেস করল মার্ক। সেই তের বছরের মেয়েটির সঙ্গে সে যেন আত্মীয়তা অনুভব করতে পারছিল।
মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন আমান্দা কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, ‘একটা বিশাল ভুল করে বসলাম আমি। আমার কাছে যখন এলিনাকে নিয়ে আসা হয়েছিল কারণ সেই চিকিৎসক ঐ শিক্ষিকাকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সে সেই সময় নিজের বাড়ি ছেড়ে কোনও একটা জায়গায় গিয়েছিল কয়েকমাসের জন্য। ওদিকে এলিনা জায়গাটার নাম কিছুতেই মনে করতে না পারায় ওকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের প্ল্যান ছিল এলিনার সঙ্গে সেই শিক্ষিকার দেখা করানোর। আমি এলিনাকে সম্মোহিত করে ওর অবচেতন মন থেকে যায়গাটার নাম বের করে সেই চিকিৎসক কে জানাই।’
‘জায়গাটা এখান থেকে কাছেই, মাত্র চার সাড়ে চার ঘণ্টার পথ। পরদিন সকালে এলিনাকে নিয়ে ওর পূর্বজন্মের ব্যক্তিত্বের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এলিনার জীবনে পরদিনটা এল না, সেই রাত্রেই কোনও প্রত্যক্ষ কারণ ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে সে।’
কিছুক্ষণ কেউই কোনও কথা বলল না। নিঝুম রাত্রের নিঃশব্দতাটা যেন আরও গভীর ভাবে চেপে বসেছে সেই ঘরে।
‘কিন্তু ওর মৃত্যু তো একটা নিছক দুর্ঘটনাও হতে পারে।’ অবশেষে বলল মার্ক।
মাথা নাড়লেন আমান্দা। ‘না, সেটা দুর্ঘটনা ছিল না। এর আগেরও এরকম একটা ঘটনার কথা জানতাম আমি। সেটা আমার আধ্যাত্মিক শিক্ষক বলেছিলেন আমায় – সেখানেও দুজনের মধ্যে দেখা হওয়ার ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে যার পূর্বজন্মের কথা মনে পড়েছিল তার মৃত্যু ঘটে অস্বাভাবিকভাবে। তোমারই মত সেদিন আমিও ঘটনাটাকে কাকতালীয় মনে করে যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি। আর সেজন্যই আমি নিশ্চিত যে এলিনার মৃত্যুর জন্য আমিই প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী।’
তার মানে সে যদি সেদিন ভারতে দিবাকরের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করত, তার মৃত্যু ঘটত? প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার আগেই উত্তর দিলেন তিনি, ‘আমার মনে হয় তোমার সঙ্গে ছেলেটার এমনিতে দেখাই হত না যদি না তুমি ইচ্ছাকৃত ভাবে সেটা করার চেষ্টা করতে। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয় তোমার মৃত্যু ঘটতে পারত।’
‘কিন্তু আমারই কেন? দিবাকরের বা সেই শিক্ষিকার মৃত্যুও তো ঘটতে পারত? আর তা ছাড়া কারোই বা মৃত্যু হবে কেন?’ সে যে একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তা সে বুঝতে পারছিল কিন্তু এরকম যুক্তিহীন কথা মেনেই বা সে নেবে কেন?
‘কারণ দিবাকর বা সেই শিক্ষিকার জীবন যে শেষ হবে না আচমকা তার প্রমাণ তোমাদের স্মৃতি। এলিনাও জানত সেই শিক্ষিকার ভবিষ্যতের কথা, তুমিও জান ছেলেটির সামনের জীবনের কথা। সুতরাং তাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা আর নেই, কিন্তু এলিনা বা তোমার জীবনের ভবিষ্যৎ এখনও কেও দেখে নি, সেটা এই মুহূর্তে অনেক সম্ভাবনার একটি। তার মধ্যেই মৃত্যুও একটি সম্ভাবনা।’
সম্ভাবনা মানে প্রবাবিলিটি! এরই কথা তো বলছিলেন সেবাস্তিয়ান আজ দুপুরে। আমাদের ভবিষ্যৎ থাকে ওয়েভ ফর্মে, সেই ভবিষ্যৎ কে জানা মানেই সেই ওয়েভের অবলুপ্তি, পার্টিকেলের জন্ম।
‘আপনি কি এলিনার কথা ডঃ কোস্তাকে জানিয়েছিলেন?’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন তিনি। ‘আমি ওনাকে অনুরোধ করেছিলাম তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আর না এগতে। এগোলে শুধু তোমারই নয়, ওনারও বিপদের সম্ভাবনা কম নয়। তোমাকে এখনও যেটা বলি নি, এলিনার সে চিকিৎসকও কিন্তু এলিনার মৃত্যুতেই তার রিসার্চ শেষ করে নি। তার কাছে বিস্তৃত নোটস ছিল এলিনার বলা ভবিষ্যতবাণীর, সেই পুঁজি করে সে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারও যাত্রাপথেই স্ট্রোক হল, চিরজীবনের মত অকেজো হয়ে গেল শরীরের বাঁ দিকটা। আর কোনদিন একটা কথাও বলতে পারেন নি তিনি, শেষ জীবনটা তিনি শয্যাতেই কাটিয়েছেন।’
‘ডক্টর আমাকে কথাও দিয়েছেন যে তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আর এগবেন না কিন্তু আমি ওনার কথা বিশ্বাস করি নি বলেই আজ তোমাকে এভাবে ডেকেছি। বিশ্বাস করি নি কারণ আমি ওদের ধাঁচ চিনি। ওরা নিজের জীবনও তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে চান জ্ঞানের খোঁজে, প্রকৃতির রহস্যের সন্ধানে। নিউটন নিজেকে প্রায় অন্ধ করে ফেলেছিলেন আলোর ওপর পরিক্ষা করতে গিয়ে, ক্রমাগত রেডিয়েশনের প্রভাবে মাদাম ক্যুরি ক্যান্সারগ্রস্ত হয়ে মারা গেছিলেন, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন বা টেসলা বিদ্যুৎ নিয়ে যে পরিক্ষা করতেন তাতে তাদের জীবন যে কোন সময় যেতে পারত। কিন্তু ঐ যে বললাম, ওদের ধাঁচটাই এরকম।’
মার্ক বুঝল এই জন্যই ডঃ কোস্তা এতটা অন্যমনস্ক ছিলেন ফিরে থেকেই, উনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না কি করবেন। হয়ত ইনি ঠিকই বলছেন বা হয়ত ডঃ কোস্তা শেষ পর্যন্ত ওনার কথামতই সিদ্ধান্ত নিতেন। কে বলতে পারে কি হত কালকে?
‘প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা প্রায় সবকিছুই পেয়েছি। প্রকৃতির রহস্য জেনেই আজ মানুষের এই উন্নতি। কিন্তু প্রকৃতি অনেকসময় আমাদের সতর্কও করে, বলে – এই পথে আর এগিও না। আমার মনে হয় এটাও সেরকমই একটা পথ।’
‘কিন্তু এই যে আমার জীবনে বা আরও দু জনের জীবনে যে ঘটনাগুলি ঘটেছে তার কি কোনও ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে? এটা কি করে হয় যে একই সময়ে এক আত্মা দুটি দেহে বাস করছে?’
‘তুমি তো ভারতীয়, হিন্দু। তোমাদের ধর্মগ্রন্থেও তো এরকম ঘটনার উল্লেখ আছে, তুমি পড় নি?’ এবার যেন আমান্দার গলায় একটু কৌতুকের ছোঁয়া।
‘না, আসলে আমি রামায়ন আর মহাভারত ছাড়া আমাদের আর কোনও ধর্মগ্রন্থ সেভাবে…’ একটু লজ্জিত হয়েই স্বীকার করল সে।
‘ওতেও আছে। বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম আর রাম দুজনেই, আবার দুজনকে একই সময়ে দেখা গেছে। তেমনই গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আর নিজেকে নিজের আরেক রুপ বলে বর্ণনা করেছেন।শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালেও এমন ঘটনার উল্লেখ অনেক আছে যেখানে তিনি একই সঙ্গে অনেক রুপ ধারণ করেছেন – কখনও রাখালদের, আর কখনও নিজেরই, গোপিনীদের সঙ্গে।’
কিন্তু এ সব তো মহাকাব্যের অংশ, এই ঘটনাগুলি যে বাস্তবে ঘটেছে তার তো কোনও প্রমাণ নেই। সে তো নিজে এগুলিকে লেখকদের কল্পনা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। তা ছাড়া রাম বা কৃষ্ণকে ভগবান হিসেবে পুজো করে মানুষে, তাদের জীবনে অলৌকিক ঘটনা বা তাদের মধ্যে অতিপ্রাকৃত শক্তি থাকাটা আশ্চর্যের নয়। তাছাড়া এ সব ক্ষেত্রেও কারও মৃত্যু ঘটেছিল কী?
উত্তরে আমান্দা বললেন, ‘হয়ত তুমি ঠিক বলছ, এগুলি লেখকদের কল্পনাও হতে পারে। কিন্তু আবার, এর মধ্যে ওনাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকারও সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে এলিনার ব্যাপারটা ঘটার পর আমি এ বিষয়ে প্রচুর খোঁজ খবর নিয়েছি, অনেক ধর্মগ্রন্থ ঘেঁটেছি, বিভিন্ন জাতির প্রচলিত লোককথাও স্টাডি করেছি। অনেক জায়গাতেই আমি এক আত্মার বহু শরীরে একই সময়ে প্রকাশের ঘটনার উল্লেখ পেয়েছি আমি। আর পুনর্জন্মের উদাহরন তো আরও অনেক বেশি। যেটা খুব রেয়ার সেটা হল একই ক্ষেত্রে দুটো ঘটনার আবির্ভাব। আর মৃত্যুর প্রশ্ন কিন্তু তখনই আসছে যখন আমরা অতীত পরিবর্তনের বা তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছি। আমার উল্লেখিত ঘটনাগুলিতে সেটা নেই।’
সমস্ত ব্যাপারটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না মার্কের। পুনর্জন্মের তো তবু একটা ব্যাখ্যা আছে, একই মানুষের আত্মার আবার নতুন শরীরের ভেতর দিয়ে জন্মগ্রহন করা, কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটাই বেশি জটিল।
‘হয়ত জটিল কিন্তু পুনর্জন্মের ব্যাপারটাতেও কিন্তু আমাদের জ্ঞানে অনেক ফাঁক রয়ে গেছে এতদিন ধরে এত ঘটনার বিশ্লেষণ করা সত্বেও। আমরা এখনও জানি না কী করে আগের জন্মের শারীরিক ক্ষত পরের জন্মের শরীরে দেখা যায়। এক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সেই মানুষের হাতের লেখাও তার পূর্বজন্মের হাতের লেখার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বা, চেহারাতেও দুই জন্মের মধ্যে অস্বাভাবিকসাদৃশ্য দেখা যায় বহু ক্ষেত্রে। এসবের ব্যাখ্যা কিন্তু শুধুমাত্র আত্মার নতুন দেহে প্রকাশ হতে পারে না।’
‘তাছাড়া দেখ, যদিও পদার্থবিদ্যা আমার বিষয় নয়, তবুও আমি কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্বন্ধে যেটুকু বুঝেছি সেটা হল বৈজ্ঞানিকেরা পরমানু বা তার থেকেও ক্ষুদ্র স্তরে খুব কম ব্যাপারেই কিছু সঠিকভাবে পরবর্তীকালে কী ঘটবে সেটা বলতে পারে। আবার অনেক সময় একটা ঘটনার পর কী ঘটবে সেটা তারা জানেন, কিন্তু কেন তা ঘটছে তা জানেন না। বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর মতে প্রকৃতি যেন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমাদের পুরোপুরি জানতে দিতে নারাজ, সে যেন নিজের কাছে স্বাতন্ত্র রাখতে চায় নিজের গতিপথ নিজের ইচ্ছেমত পরিবর্তন করার।’
আবার কোয়ান্টাম থিয়োরি! নাঃ, বিষয়টা সে ফিরে গিয়েই আরও একটু গভীরে পড়বে সে, মার্ক ঠিক করল। কিন্তু এখন আর কী করতে চান ভদ্রমহিলা? তিনি ডঃ কোস্তা আর মার্ক দুজনকেই এই ব্যাপারে আর এগোতে তিনি বারন করে দিয়েছেন। ডঃ কোস্তা যদিও বিষয়টা নিজের বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্তির জন্য যথেষ্ট সিরিয়াসলি না নেন, মার্ক যে আর এ বিষয়ে এগোবে না সেটা নিশ্চিত।
‘আমি কিন্তু ততটা নিশ্চিত হতে পারছি না। এই বৃদ্ধার কথা হয়ত এই গভীর রাত্রে, এই রহস্যময় পরিবেশে তোমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে কিন্তু পরে দিনের আলোয়, যুক্তিবাদী বন্ধু এবং ডঃ কোস্তার মত গবেষকের সামনে কিন্তু তা আর মনে নাও হতে পারে। তখন বিপদের বা মৃত্যুর সম্ভাবনাটাকে হয়ত তোমাদের আজগুবি মনে হবে, বা বিজ্ঞানের অগ্রগতির স্বার্থে এটাও মনে হতে পারে যে একটা জীবনের খুব একটা মুল্য নেই। তাছাড়া খ্যাতির জন্য মানুষ কোনও ঝুঁকিই বা না নেয় এই দুনিয়ায়।’
আমান্দা গারসিয়ার দিকে তাকাল মার্ক। তাহলে এই মহিলা আর কী করতে চান? তিনি কী জোর করে মার্ক বা ডঃ কোস্তাকে থামাতে পারবেন? প্রশ্নটা এবার করতে হল না তাকে, আমান্দা উত্তর দিতে শুরু করলেন ধিরে কিন্তু স্পষ্ট গলায়, এই গলাটাই সে টেলিফোনের মাধ্যমে শুনেছিল।
‘আমি একটা বিশেষ ধরনের সম্মোহন শিখেছিলাম আর তা নিয়মিত অভ্যাসও করতাম একটা সময়। এই বিশেষ পদ্ধতির দ্বারা আমি একজন মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করে তার স্মৃতির পরিবর্তন ঘটাতে পারি। আমার ইচ্ছে, অবশ্য যদি তুমি সহমত হও তবেই, কারণ তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কাজটা চাইলেও করতে পারব না, আমি তোমার পূর্বজন্মের অর্থাৎ দিবাকরের জীবনের স্মৃতি তোমার মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে। এটাই একমাত্র উপায় তোমার জীবন সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত করার।’
কিছুক্ষণ ভদ্রমহিলার বক্তব্যকে নিজের মস্তিস্কে সেটল করার সময় দিল মার্ক। কিন্তু এটা কী সম্ভব? একজন মানুষের মনের ভেতর ঢুকে আরও একজন মানুষ তার স্মৃতি পরিবর্তন করতে পারে? আর ফল যদি আশানুরূপ না হয়, যদি এর ফলে তার এ জন্মের স্মৃতিও নষ্ট হয়ে যায়?
‘সে ব্যাপারে তোমাকে আমার ওপর বিশ্বাস করতে হবে। আমার মনে হয় এতে তোমার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, যদিও একেবারে নেই সেটা বলা যাবে না। তবে এটুকু রিস্ক আমাদের নিতে হবে। দেখ, আমি কিন্তু চাইলে আমার মানসিক শক্তির সাহাহ্যেই তোমাকে রাজি করাতে পারি, কিন্তু সেটা তোমাকে প্রতারনা করা হবে। যেহেতু জীবনটা তোমার, আমি চাই সিদ্ধান্তটা তুমিই নাও।’
কী স্বার্থ থাকতে পারে এই বিদেশি, অজানা, অচেনা মহিলার তার জীবন বাঁচানোর জন্য এত ব্যস্ত হওয়ার? ডাক্তাররা তো সাধারনত রোগীর রোগ নির্ণয় করে তাকে ওষুধ দিয়েই নিজের দায়িত্ব মিটিয়ে ফেলে, তবে ইনি কেন এত উতলা হচ্ছেন ওর জন্য? নাকি অন্য কোনও অভিপ্রায় আছে এনার মনে?
এবারও উত্তর এল বিনা প্রশ্নতেই, সেই স্বরে, ‘তুমি ঠিক ধরেছ। একটা স্বার্থ আছে আমারও, টেলিফোনে আমি সেটা জানিয়েছিলাম তোমায় কিন্তু হয়ত তোমার মনে নেই। দীর্ঘ ষোল বছর ধরে একটা যন্ত্রণা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে – সেটা এই যে এলিনার মৃত্যুর জন্য আমি নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারি নি। ধরেই নিয়েছিলাম যে ঐ অপরাধবোধ সঙ্গে নিয়েই আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু গতকাল যখন ডক্টর আমার কাছে তোমার বিষয়ে বললেন, আমার মনে হল ঈশ্বর হয়ত আমাকে আরও একটা সুযোগ দিচ্ছেন নিজের ভুল শোধরানোর।’
‘কিন্তু ডঃ কোস্তাও তো সব জানেন দিবাকরের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। আমাকে ছাড়াও উনি চালিয়ে যেতে পারেন নিজের রিসার্চ।’ মার্ক বলল।
‘উনি সেটা করবেন না কারণ তুমি অস্বিকার করলে কেউই ওনার কথা বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া, দেবের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও ওনার হাতে যথেষ্ট তত্ব এই মুহূর্তে নেই। তবে তিনি নিশ্চই এ বিষয়ে চিন্তা করে এর ব্যাখ্যা খাঁড়া করবার চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু এতে কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই কারো।’
কিছুক্ষণ সম্পূর্ণ নিঃশব্দে কাটল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল মার্ক। দিবাকরের মুখ একবার ভেসে উঠল তার বন্ধ চোখের সামনে, তারপর তার মায়ের মুখ – অপর্ণা, ডাকনাম অপা। তার বাপী, শ্রী সুধাকর দত্ত। কিন্ত এই সব সম্পর্ক আর এখন তার নয়, এদের বিদায় জানাবার সময় এসে গেছে।
‘ঠিক আছে, আমি তৈরি।’
আমান্দা গারসিয়া মাথা নাড়লেন শুধু। কিন্তু যে আনন্দের ছাপ সে তার মুখে আশা করেছিল তা সে দেখতে পেল না। এমনকি স্বস্তিরও নয়। কেন? প্রশ্নটা আর করল না সে।
‘আমরা একটা অন্য রুমে যাব। আমি এখন একটা পোশাক দিচ্ছি তোমায় যেটা তুমি তোমার বর্তমান পোশাক পাল্টে পরে নাও। আমারও তৈরি হতে মিনিট পনের সময় লাগবে।’ আমান্দা উঠে গেলেন।
অন্য ঘরটাতে ঢুকেই মার্কের ছোটবেলায় দেখা ঠাকুরমার পুজোর ঘরের কথা মনে পড়ে গেল। পরিষ্কার, তকতক করছে চারিদিক, ড্রয়িং রুমটা এর তুলনায় অনেকটাই অগোছাল ছিল। হাল্কা ফুলের সুবাস আসছে, সেটা অবশ্য ফুল না হয়ে কোনও পারফিউম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি কারণ এই সময়ে ফুল আর কোথা থেকে পাওয়া যাবে! ঘরের আলোও হাল্কা, চোখে লাগে না অথচ দেখতেও কোনও অসুবিধে হয় না একবার চোখ সয়ে যাওয়ার পর। একপাশে একটা ছোট্ট বিছানা পরিপাটি করে গোছানো।
পোশাকটা বেশ ঢিলে ঢালা, আরামদায়ক। এরকম পোশাক পরে সে কলেজে ক্যারাটের ক্লাস করেছে। ভদ্রমহিলা এলেন একটা ঘিয়ে রঙের গাউন পরে। চুল গোছা করে মাথার পেছনে বাঁধা, দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র স্নান করে এসেছেন। হঠাৎ ওনার ব্যক্তিত্বের যেন অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে, এই আমান্দা অনেক বেশি গম্ভির, দুরের মানুষ; এনার সঙ্গে সহজে কথা বলা যায় না।
ঘরটার মাঝামাঝি দু খানা চেয়ার রাখা, মুখোমুখি। দুটো চেয়ারের মধ্যে দুরত্ব প্রায় মিটার তিনেক হবে, ঠিক মাঝখানে একখানা পেতলের প্রদীপ প্রজ্বলিত।একখানা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করলেন আমান্দা। মার্ক সেটায় আসন গ্রহন করল। চারিদিকে ভয়ঙ্কর, অস্বস্তিদায়ক নিঃশব্দতা।
‘তোমার মনে কোনওরকম প্রশ্ন থাকলে এই মুহূর্তে জিজ্ঞেস করতে পার।’ বলে কিছুক্ষণ থামলেন তিনি। মার্কের কাছে উত্তরের জন্য কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললেন, ‘আমি তোমার কাছে সম্পূর্ণ সাহাহ্য চাই এই কাজে। কোনও রকম দ্বিধা ছাড়াই আমার কাছে তোমাকে নিজের মনে আমাকে ঢুকতে দিতে হবে, আমার ইচ্ছাশক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। আর আমার ওপর বিশ্বাস রেখো যে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না। মনকে শান্ত করার চেষ্টা কর, লম্বা নিঃশ্বাসনাও আর আলোর শিখার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ কর।’
এইবার আমান্দা নিজেও সামনের চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করলেন। মার্ক প্রদীপের শিখার দিকে দৃষ্টি স্থির করল। ঘরের মধ্যে কোনও বায়ু না থাকায় শিখা প্রায় নিস্কম্প এখন।
‘নিজের চোখ খুব ধিরে ধিরে বন্ধ কর, আর আমি যা বলছি সেই কথার দিকে মনোযোগ দাও। আমরা এখন ধিরে ধিরে প্রবেশ করব তোমার মনের সেই স্থানে যেখানে দিবাকরের স্মৃতি রয়েছে।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া মার্ক কোনও শব্দই শুনতে পাচ্ছিল না। তবে মন পুরোপুরি শান্ত হয় নি তার, চোখের সামনে বিক্ষিপ্ত কিছু দৃশ্যের ছবি ভেসে আসছিল।
‘চোখ খোল, মার্ক।’
চোখ খুলে মার্ক সামনে আমান্দার চোখের দিকে তাকাল। এত তাড়াতাড়ি নিশ্চই প্রক্রিয়াটা শেষ হয়ে যায় নি?
‘তুমি কোনও স্মৃতিকে জোর করে আটকে রেখেছ। নয় পূর্বজন্মের কোনও বিশেষ ঘটনা বা কোনও এক মানুষের স্মৃতি। এরকম করলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। আমাকে বল, কোনও স্মৃতি তোমাকে সবচেয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছে? সেটাকেও আসতে দিতে হবে, সব দরজা খুলে দিতে হবে মনের।’
মার্ক চুপ করে রইল। কি বলবে সে? তার মনের আবেগ কি ইনি বুঝতে পারবেন?
‘আমার মনে হচ্ছে কোনও ঘটনা নয়, কোনও মানুষের স্মৃতি কে তুমি জোর করে আটকে রেখেছ। সেইজন্যই তুমি দিবাকরের ভবিষ্যতও স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছ না। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য আমি অনুরোধ করছি, সেই মানুষকে তুমি তোমার মনে আসতে দাও।’
মাথা নেড়ে আবার চোখ বন্ধ করল মার্ক। একটু পরই চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা মুখ, তার মায়ের মুখ। এখন আর সে মার্ক নয়, সে এই মুহূর্তে দেব, দেবু, দিবাকর। সে এখন একটা দোলনায় দুলছে, মা দূর থেকে হাসছে; এখন তার মুখে সে খাবার তুলে দিচ্ছে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে; এবার সে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল গেটের বাইরে, উদ্বিগ্ন চাহনি তার দুই চোখে – মুহূর্তকাল পরেই সেই চোখ বেয়ে নেবে এল জলের ধারা। এবার সে বৃদ্ধা, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন স্বল্পকেশ দিবাকরের মাথায়, বলছে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, বাবা! আমি তো কাছেই আছি। তোর অত চিন্তা কিসের?’ আবার যেন সে দেখতে পেল নিজেকে তার মায়ের কোলে, কাঁদছে সে আঘাত পেয়ে আর চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে তার মা।
যেন একটা বাঁধ ভেঙ্গে গেল মার্কের মনের ভেতর। এখন শুধুই জলের তরঙ্গ, সেই জলে হাবুডুবু খাচ্ছে সে, তার একটা অংশ উপচে পড়ছে তার চোখ বেয়ে। সেই বাড়িতে প্রবেশের পর থেকেই তার ইচ্ছে করেছে মায়ের কাছে ছুটে যেতে, জানাতে নিজের পরিচয় কিন্তু আটকেছে নিজেকে এই ভেবে যে তিনি কি ভাববেন? তিনি নিশ্চই তার দেবুর স্থান তাকে দেবেন না কিন্তু কি ভাবে সে সহ্য করবে তার প্রত্যাখান; মায়ের প্রত্যাখান?
মার্ক যদি চোখ খুলত সেই সময় তাহলে সে দেখতে পেত যে শুধু তার চোখেই নয়, ধারা গড়িয়ে পড়ছে আমান্দা গারসিয়ার চোখ বেয়েও। এক ছেলেকে তাকে টেনে নিয়ে আসতে হবে তার মায়ের কোল থেকে, কাজটা আর এখন আর শক্ত নয় তার পক্ষে তবে তাকে নিষ্ঠুর হতে হবে। হলই বা শুধুমাত্র স্মৃতি কিন্তু আমরা বেশির ভাগ জীবনই কি স্মৃতির ওপর নির্ভর করে কাটাই না? শেষ পর্যন্ত মানুষের মনে তো শুধুমাত্র স্মৃতিই থাকে, জীবনটাই তো শুধুমাত্র স্মৃতির প্রাসাদ একটা।
কিন্তু আর আবেগ নয়, এবার তার কর্তব্যের সময়। এই মায়ের প্রতি দুর্নিবার টানই মার্ককে নিয়ে যেতে পারে নিজের সর্বনাশের দিকে। আমান্দা এইবার নিজের কর্তব্য পালন শুরু করলেন। প্রথমে ধিরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই ঠেলে দিলেন দিবাকরকে গভীর ঘুমে, মার্ক তো অনেক আগেই ঘুমের কোলে ঢুলে পড়েছিল। এবার একে একে ওর মনের প্রত্যেকটি ঘরের ভেতর গিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজলেন দিবাকরের চিহ্ন, সেগুলকে সজত্নে টেনে বের করে তার জায়গায় বসালেন অন্য স্মৃতি, যা কোনও ফাঁক রাখবে না মার্কের জীবনেও। কাজ শেষ হওয়ার পর আবার একবার ঘুরলেন ঘরগুলিতে, খুঁজলেন অসাবধানে ফেলে আসা কিছু স্মৃতির টুকরো যা পরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে মার্কের জীবনে।
না, নেই! এবার তিনি বেরিয়ে আসতে পারেন, এবার বিশ্রাম দিতে পারেন নিজের মনকে। এবং বিবেককে। আপাতত কাজ শেষ, আবার হয়ত অন্য শরীরে নতুন করে শুরু হবে তার নতুন অভিযান। হয়ত কেন, হবেই!
চোখ খুলে আমান্দা দেখলেন মার্ক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এবার সে শুধুই মার্ক। দিবাকরের ভবিষ্যতও এবার মুক্ত মার্কের স্মৃতি থেকে, হয়ত তার ভবিষ্যৎ এবার অন্য কোনও দিকে মোড় নিতে পারবে কারণ আর ওকে মার্কের স্মৃতির বেঁধে দেওয়া রাস্তা মেনে চলতে হবে না। আবার হয়ত তার জীবনে ফিরে আসবে অনন্ত সম্ভাবনা।
কিন্তু না, একটা বাঁধন এখনও রয়ে গেছে!
অবসন্ন শরীরে প্রায় জোর করেই উঠলেন চেয়ার ছেড়ে আমান্দা। বাইরের ঘরে গিয়ে তাক থেকে ডায়েরিটা তুলে নিলেন। নিজের বেডরুমে দরজা খুলে ঢুকলেন, পায়ের কাছে লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল বব। তার পাশ দিয়ে জ্বলন্ত ফায়ার প্লেসটার দিকে এগিয়ে গেলেন আমান্দা, ছুঁড়ে দিলেন ডায়েরিটা আগুনের মধ্যে। ধিরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই পুড়ে গেল ডায়েরিটা। এবার কাজ শেষ!
একটা শব্দে ঘুম ভাঙল মার্কের। তার মোবাইলের রিং টোন, কেও তাকে ফোন করেছে। ফোনটা তুলল সে, ডক্টর কোস্তার ফোন।
‘হ্যালো!’
‘হ্যালো, মার্ক? আমি কোস্তা, আলবার্তো কোস্তা।’
‘হ্যাঁ, ডঃ কোস্তা, বলুন।’
‘তুমি কোথায়? গতরাত্রেই বা কোথায় ছিলে? আমরা সকাল থেকেই খুঁজছি তোমাকে।’
চারিদিকে একবার তাকাল মার্ক। সে একটা বিছানায় শুয়ে আছে। ঘরের মাঝে দুটো চেয়ার রাখা। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে শুধু দিনের আলোই নয়, বেশ কড়া রোদ্দুরেরও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ধিরে ধিরে গতকাল রাত্রের ঘটনা মনে পড়ল তার।
‘ওঃ, দুঃখিত, বেরোবার আগে আপনাকে বলে আসতে পারিনি। গতরাত্রে আমি মাদাম গারসিয়ার এখানে ছিলাম। এখনও ওখানেই আছি।’
‘ম্যাডাম গারসিয়া? তুমি কি করে পৌঁছলে ওনার কাছে?’
‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন ডক্টর, আপনিই তো গতসন্ধ্যায় আমার ওনার সঙ্গে সেশন ঠিক করে গেছিলেন। ওনার পাঠানো গাড়িতেই আমি এখানে এসেছি। আর, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমার সমস্যা মিটে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।’
‘তুমি কি বলছ? আমান্দার সঙ্গে তোমার সেশন হয়েছে? কি সমস্যা মিটে গেছে তোমার? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ ডঃ কোস্তার গলায় এবার বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
‘ঐ যে আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম যে আমি আজকাল প্রায়ই এক দুঃস্বপ্ন দেখি, সেই সমস্যাটা। আমি হোটেলে ফিরে সব জানাচ্ছি আপনাকে।’
‘ওহ গড!’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলেন তিনি, ’আচ্ছা, তোমার ডায়েরিটা কোথায়?’
‘ডায়েরি?’
‘হ্যাঁ, ডায়েরি, যেটা তুমি গতরাত্রে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলে। মেরুন রঙের কভার।’ এবার যেন হতাশার ছাপ ওনার গলায়, সঙ্গে প্যানিকেরও। ভদ্রলোকের হলটা কি? গতকাল অব্দিই তো বেশ স্বাবাভিক ছিলেন।
‘আমি কোনও ডায়েরি লিখি না, ডক্টর! আপনার নিশ্চই কিছু একটা ভুল হচ্ছে।’ যতটা সম্ভব নিজের গলাকে স্বাভাবিক রেখে বলল মার্ক, কিন্তু সে জানে না যে কতক্ষণ সে সেটা রাখতে পারবে। ডঃ কোস্তার নিশ্চই কোনও সমস্যা হচ্ছে, এখন মনে পড়ল মার্কের যে গতরাত্রেও সে ওনাকে বেশ আনমনা দেখেছিল।
‘আচ্ছা, আমান্দা কোথায়? ওকে লাইনে দাও, আমি কথা বলব।’ ডঃ কোস্তা বললেন।
মার্ক কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে আমান্দার গলা ভেসে এল, ‘ওনাকে বলো যে আমি এই মুহূর্তে ওনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। সময় করে আমি নিজেই ফোন করব ওনাকে, ওনার কার্ড আমার কাছে আছে।’
‘ডঃ কোস্তা, …’
‘ঠিক আছে, আমি শুনতে পেয়েছি!’ বলেই ফোনটা কেটে দিলেন ভদ্রলোক, সঙ্গে যেন একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দও শুনতে পেল মার্ক।
Tags: উপন্যাস, কালচক্র, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সন্দীপ চৌধুরী, সুপ্রিয় দাস
aha ki jinis porlam! mon bhore gelo! bhobisyot er anonto samvabana ar ateet er ekmukhinata satyi rahosyomoy…………ar particle/wave er probabilistic theory nie recent 1ta boi porlam……….asadharan laglo apnar lekha ta…….
অনেক ধন্যবাদ, শাশ্বত বাবু! তা, আপনার পড়া বইটির নাম জানতে পারি কি?
Dada uponyas ti besh bhalo laglo..
Ekta chotto anurodh kore jai,Jodi GOD PARTICLE niye kono lekha lekhen to khub anondo pabo..
Subheccha janai..