কৃষ্ণপুর আদর্শ বালিকা বিদ্যাপীঠ
লেখক: নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী
শিল্পী: সুমন দাস
কালিদাস যে ঠিক কী কাজ করে তা কাউকে বোঝান ভারী মুস্কিল। অথচ সে সবরকম কাজ করে। এই যেমন আজ ক’দিন ধরে তার দিন শুরু হচ্ছে ভারা ভারা জল বয়ে দিয়ে। তার কাঁধে থাকে একটা বাঁশ, বেশ মোলায়েম করে কাটা। তার দু’দিকে দুটো ভারা বাঁধা থাকে। সকালবেলার মধ্যে সে প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ভারা জল তুলে দিচ্ছে।
তার পরেই তার ছোট ঠেলাগাড়িটা নিয়ে সে বাজারে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে রাজ্যের সবজি তরকারি আনছে। এনেই তাকে রান্নার ঠাকুরদের সঙ্গে জোগাড়যন্ত্রে হাত লাগাতে হচ্ছে। তারপর সে খাওয়াদাওয়া করতে পারছে। তা বলতে নেই, খাওয়াদাওয়া ভালোই জুটছে। রোজই ভাত পাওয়া যাচ্ছে। যত চাও তত। সে এক-একবারে দু’তিন থালা ভাত উড়িয়ে দিচ্ছে। যখন যা পাওয়া যায়। যার বছরে সব দিন খাওয়াদাওয়া জোটাই ঝামেলা, তার কাছে ওই ভাত পরমান্নের সমান। যদিও পরমান্ন সে কখনও খায়নি। তবে যা শুনেছে, তাতে পরমান্ন এক দস্তুরমতো জিনিসই হবে।
ভাতের সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে ডাল। সেও যত চাও তত। সকলের শেষে সে খাবার দাবার খায় বলে তরি তরকারি যদিও একটু কম পড়ে। তবে সেটা পুষিয়ে যাচ্ছে মাছের ঝোলে। ঝোলে অবশ্য গোটা মাছ থাকছে না। তবে ওই টুকরো-টাকরা, কাঁটাটা, মাথাটা, পেটির ছিঁটেফোঁটা, কানকো-ফানকো দিয়ে যেটা হচ্ছে সেটাও নেহাত ফেলনা নয়। হদ্দ গ্রামের মুনিশের এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাও অন্যায়।
কলকাতা থেকে বহু দূরে এই গ্রাম। মার্টিনের রেলগাড়িতে করে দমদমা থেকে আসা যায় বাগুইহাটি অবধি। সেখান থেকে ধু-ধু মেঠো রাস্তা পেরিয়ে জগতপুর। জগতপুরের পর শিমুলতলা। শিমুলতলা থেকে একটা ছোট খাল পেরোতে হয়। তারপর গৌরাঙ্গনগর, মধ্যমপুর ঘোষপাড়া, তালবাগান। তারপর আসে কেষ্টপুর। কেষ্টপুরের একদিকে বিদ্যেধরী খাল। এই খাল চলে গেছে হারোয়া থেকে মালঞ্চ অবধি। সেখান থেকে সোজা সোঁদরবন। খালের ওপারে ধু-ধু বালিয়াড়ি। ছোট ছোট জলাশয়। লোকে বলে লবণদহ। বিদ্যেধরীর অসংখ্য ছোট ছোট খাল এ জায়গাকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে।
কালিদাস আবছা আবছা খবর পায়, কলকাতায় এখন অনেক কিছু হচ্ছে। মাসে দু’একবার একখানা খবরের কাগজ বলে জিনিস এ অঞ্চলে আসে। ধীরেন কবিরাজের বৈঠকখানায় বসে মাতব্বর মানুষেরা সেসব পড়ে। কলকাতায় নাকি মাঝে মাঝে একদল লোক খেপে ওঠে। কিছুদিন আগে নাকি একটা বড় যুদ্ধ হয়েছিল—ইংরেজ বলে কিছু লোককে ঠেঙিয়ে বিদেয় করার চেষ্টায়। কিছু মানুষ আবার সমাজটাকে উল্টে দেবার চেষ্টায় আছে। বিদ্যাসাগর নামে একটা একগুঁয়ে বামুন, বিধবাদের বিয়ের চেষ্টা করতে করতে শেষ অবধি মরে গিয়েছে। সেও হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক বছর।
অবশ্য মরার আগে অনেকগুলো বেপট কাজ করে গিয়েছে। যার মধ্যে একটা হল সমাজের জ্ঞানীগুণী মানুষদের একটার বেশি বিয়ে বন্ধ করা। এর জন্যে নাকি সে আইন নামের একটা ব্যাপার করে দিয়েছে। আবার মাঝে মাঝেই সে শোনে, ধীরেন কবরেজের বৈঠকখানায় লোকজন বলছে—দেশে আইনকানুন নেই নাকি? কালিদাসের খুব ইচ্ছে আছে এই আইন নামে জিনিসটাকে দেখার।
বেথুন নামে একটা গোরা সাহেবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই বামুনটা মেয়েদের পড়াশোনার ক’টা ইস্কুলও খুলে গিয়েছে এখানে সেখানে। এই গাঁয়ের কাছাকাছিও তার স্থাপন করা একটা সেরকম মেয়েদের ইস্কুল আছে। সেখানে এক মাস্টারনীও আছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। শুধু ওইটুকুই। চেষ্টাটাই সার হয়। কেউই মেয়েদের সেই ইস্কুলে বেশিদিন পড়ায় না। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। কলকাতার আর কোনও আঁচই এই গ্রামের গায়ে লাগে না। লাগার সম্ভাবনাই নেই।
ধীরেন কবরেজ কালিদাসকে বেশ পছন্দই করেন। বাড়ির যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে জোগাড়ের কাজ করতে ডাকেন। ছেলেটা বড্ড সৎ আর পরিশ্রমী। ঠিক ওর বাবার মতো। শুধু দোষের মধ্যে একটাই, ছেলেটার একটু ওর বাবার মতোই মাথাখারাপ। সামান্য একটু সময় পেলেই মাটিতে বসে কী সব আঁকিবুকি কাটে। তারপর জ্বলজ্বলে চোখে তাকায়। যেন বিরাট কিছু আঁক করে ফেলেছে।
এই পাগলামি এর বংশগত। ওর বাবারও একই রোগ ছিল। সেও ধীরেন চক্কোত্তির চাষের জমিতে সামান্য মুনিষ খাটত। দুপুরবেলা বিশ্রামের সময় সবাই হয়তো গাছের তলায় গড়িয়ে নিচ্ছে, সেসময় সে ব্যাটা বসে বসে মাটিতে এইসব ছক কেটে বিড়বিড় করত। তা খাটিয়ে-মানুষের এইটুকু পাগলামি অগ্রাহ্য করলেও চলে।
ধীরেন কবরেজের ইচ্ছে আছে কালিদাসকে সবসময়ের কাজের লোক হিসেবে রাখবেন। তাঁর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করবে। বাড়িতেই থাকবে। হাতে হাতে কাজ করে দেবে। কিন্তু সেটা এখনই করা যাচ্ছে না। তার মাথায় হাজার ঝামেলা। তার মধ্যে একটা হল তাঁর মেয়ের বিয়ে। বিয়েটা একবার ভালোয় ভালোয় উতরে গেলে এসব ভেবে দেখবেন।
ধীরেন কবরেজের একটাই মেয়ে। পড়াশোনায় বড় ভালো। বিদ্যেসাগর মশায়ের ইস্কুল থেকে আট কেলাস পাশ দিয়েছে। মেয়েমানুষের জন্যে প্রচুর পড়ালেখা হয়েছে। আর নয়। বেশি পড়ালেখা শিখলে আর দেখতে হবে না। সবচেয়ে সমস্যা, পাত্র পাওয়া মুশকিল হবে। ধীরেন চক্কোত্তি অনেকদিন ধরেই পাত্র খুঁজছিলেন। শেষ অবধি পছন্দ হয়ে গিয়েছে। ছেলে সরকারি চাকরি করে। মাল খালাসের কেরানির চাকরি। তিরিশ টাকা মাস মাইনে। এ ছাড়া উপরিও আছে। বয়েসটা অবশ্য একটু বেশি। ওটা কোনও সমস্যা নয়। বয়েসের পার্থক্যটা একটু বেশি হলেই ভালো। অল্পবয়েসি ছোকরা হলেই সমস্যা হত। তাঁর মেয়ের আরও লেখাপড়া করার ইচ্ছে ছিল। অল্পবয়েসী ছেলে হলে হয়তো বউকে কলেজে ভর্তি করে দিত, কিছুই বলা যায় না। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতিগতি কিছুই বোঝা যায় না। এই যে পাত্র, তাকে ধীরেন চক্কোত্তির বেশ পছন্দ হয়েছে। বেশ ডাঁটিয়াল ধরনের। পুরুষমানুষ কড়া না হলে স্ত্রীর সম্মান, ভালোবাসা পায় না।
পাত্র প্রথমেই বলে দিয়েছে, না না, ওসব কী! ঘরের বউ ঘরে থাকবে। রান্নাবান্না করবে। ছেলেমেয়ে মানুষ করবে। যা কিছু পড়াশোনা বিয়ের আগে পড়াই যথেষ্ট।
ধীরেনবাবু বিষয়টা নিয়ে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেছেন। তার স্ত্রী হতভম্ব হয়ে বলেছে, আপনি এই পাত্রের সঙ্গে রানুর বিয়ে দিচ্ছেন? কী বলছেন কী আপনি?
কেন? খারাপ কী? বড় সরকারি চাকরি করে। কত রোজগার জানো?
হোক রোজগার। আমার মেয়ে কি ফেলনা?
ফেলনা কে বলল? ফেলনা হলে কি এত ভালো ছেলে খুঁজে বার করতাম?
আপনি এই ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। দিলে সারাজীবন মেয়েটা কষ্ট পাবে।
ধীরেন চক্কোত্তির জীবনে একটা দুঃখ আছে। যদিও এখন তিনি অনেক বড় ব্যবসায়ী। কবিরাজি ওষুধের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা রোজগার করেছেন। অনেক জমি জিরেতও করেছেন। কালিদাসের বাবার মতো অনেক লোক তাঁর জমিগুলোতে মুনিষ খাটে। এ ছাড়া তেজারতির কারবারে টাকা ধার দেওয়ার ব্যবসাও করেন। আশেপাশের দশটা গাঁয়ের মানুষ তাঁকে মহাজন হিসেবে একডাকে চেনে।
কিন্তু প্রথম জীবনে তিনি সরকারি চাকরি পাওয়ার খুব চেষ্টা করেছিলেন। শুনেছিলেন সরকারি চাকরি করলে নাকি আপিসে এলে আর গেলেই মাইনে পাওয়া যায়। কাজ করে আবার উপরি পাওয়া যায়। তাই তিনি অনেককে ধরে খুব তদ্বির করেছিলেন। যাতে একটা সরকারি চাকরি পাওয়া যায়। অনেকে তাঁকে বলেছিল, ধুর মশাই, সরকারি চাকরি পাওয়া কি অত সোজা!
তাঁর আর এ জীবনে আর সরকারি চাকরি করা হয়নি। ব্যবসা, তেজারতি, কবিরাজি করে টাকাপয়সা হয়তো রোজগার করা যায়, কিন্তু সরকারি চাকরির ইজ্জতই আলাদা। সে কেরানির চাকরিই হোক বা আইসিএস। তাই মেয়ের বিয়ের সময় তিনি ঠিক করেই রেখেছিলেন, জাঁদরেল সরকারি চাকুরের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। মাইনে বা টাকাপয়সাটা কোনও সমস্যা হয়। তাঁর যা কিছু আছে সব মেয়ে-জামাইয়েরই থাকবে।
আজ সেই মেয়ের বিয়ে। বর্ষাকাল। দিনটা বেশ ঝকঝকে ছিল। যদিও আগে কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হয়েছে, তবে আজ সকাল থেকে পরিষ্কার ছিল। বিকেল থেকে টিপটিপে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সন্ধেবেলা এল তুমুল বৃষ্টি। ধীরেন চক্কোত্তি পাড়ার আর পাঁচজন মাতব্বর মানুষের সঙ্গে উদ্বিগ্ন মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। বর এসে কখন পৌঁছবে এই তার চিন্তা। গ্রামে ঢোকার মুখে ছোট খালটায় গরমের সময় তেমন জল থাকে না, বর্ষা হলেই বিদ্যেধরী নদীর সঙ্গে যোগ থাকায় তুমুল স্রোত হয়ে যায়।
কালিদাস উঠোনে চুপচাপ বসে আনমনে মাটিতে আঁকিবুকি কাটছিল। ধীরেন চক্কোত্তি কালিদাসকে ডেকে বললেন, উঠোনের সামনেটা একটা ম্যারাপ বেঁধে ফেল। জল যেন না ঢোকে।
কালিদাস মিনমিন করে বলল, আমি নদীটার ধারে গিয়ে এট্টু দাঁড়াব ভাবছিলাম। যদি কারোর পার হতে অসুবিদে হয়।
ধীরেন চক্কোত্তি ভাবলেন, কালিদাস বলছে, যদি বরযাত্রীর আসতে অসুবিধা হয় তাই সে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে চায় তাদের সাহায্য করার জন্যে।
কিন্তু একটা কাজের লোককে কি বরযাত্রীকে আনতে পাঠানো যায়!
তিনি কালিদাসকে শক্ত গলায় বললেন, বরযাত্রীর আসা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। যা বলছি তাই কর।
কালিদাস একা হাতেই চটপট একটা মোটা তাঁবুর কাপড় আর বাঁশ দিয়ে ম্যারাপ বেঁধে দিল। উঠোনে এখন আর জল ঢুকছে না। বৃষ্টি হলেও বিয়েবাড়ি বলে সারা বাড়ি গমগম করছে। প্রচুর মানুষজন। চারিদিকে হ্যাজাক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চারা উঠোনে নেমে ছুটোছুটি করছে। মহিলারা অপেক্ষা করছেন কখন বর এসে পৌঁছবে আর তারা উলু দেবেন, বরণ করবেন। বাইরে গ্যাঁয়োর গ্যাং করে ব্যাং ডাকছে। ধীরেনবাবু তৃপ্ত হয়ে সব ব্যবস্থা দেখলেন। আশেপাশের গ্রামের বড়মানুষেরা এসে গিয়েছেন। তিনি বারান্দায় বসে তাঁদের সঙ্গে পান তামাক খেতে লাগলেন। ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগলেন, বর কখন এসে পৌঁছবে এই আশায়।
কালিদাস ম্যারাপ বাঁধার কাজ শেষ করে আবার মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়ল। সে এখন একটা আঁক কষছে। এটা একটা অঙ্ক। ছোটবেলায় সে বাবার কাছ থেকে শিখেছিল। তার বাবা মাঠে হাড়ভাঙা কাজ করে সারাদিন পর বাড়িতে ফিরে রাতের বেলা মাটির উঠোনে বসে এই অঙ্কগুলো কষতো।
সে জিজ্ঞেস করত, ও বাবু তুমি কী কর?
তার বাবা বলত, আঁক কষি রে বাবা, আঁক কষি।
কী আঁক, বাবু?
এটারে বলে সময়ের আঁক।
সময়ের আঁক কষলে কী হয়, বাবু?
অনেক কিছু জানতি পারা যায়।
কী জানা যায়, বাবু?
অনেক কিছু। এই ধর, এই দ্যাশ থেকে একদিন ইংরেজ চলি যাবে।
ইংরেজ কারা, বাবু?
যারা এই দ্যাশটারে শাসন করে। এই দ্যাশের রাজা।
তারপর কী হবে?
তারপর অনেক কিছু হবে। এই দ্যাশটা বদলি যাবে। কত্ত কিছু হবেনে। এই পিথিবি ক্ষণে ক্ষণে বদলি যাবে। দুনিয়া জুড়ে বড় বড় গাড়িঘোড়া চলবেনে, আকাশ দি উড়বে লোহার পাকি। বিদেশে একখান যুদ্দু হবে। সে কী যুদ্দু! মারামারি, কাটাকাটি। ব্যাঙের ছাতার মতো একখান আগুন দুনিয়ার বুকে তৈরি হবেনে। পুবদিকের এট্টা দেশে তা আছড়ে পরবে। কত্তো মানুষ তাতে ঝলসি যাবে। সেই যুদ্দু এই দ্যাশে পেরায় আসতি আসতি মাজখানে আটকি যাবে। এই দ্যাশখানা টুগরো টুগরো হয়ি ভাঙবেনে। মানুষে মানুষে পাগলের মতো খুনোখুনি করবে। কুকুর বিড়ালের মতো মানুষ মরবে। এই গেরামখানাও এগদিন বদলি যাবে।
গেরাম কেমন করে বদলি যাবে বাবু?
এই গেরামে ঘরে ঘরে আকাশের বিজলি আলো হয়ে জ্বলবেনে। তাতে ফটফটে আলো জ্বলবে, আরও অনেক কিছু হবে। এগদিন এই গেরাম আর এরম থাকবে না। এর পাশ দে বড়, অনেক বড় একখান রাস্তা যাবেনে। এই মাঠঘাট জুড়ে বড় বড় বাড়ি হবেনে। সেই বাড়ির সঙ্গে লম্বা লোহার নল লাগানো থাকবে। তার ভিতর দিয়ে ধকধকে ধুঁয়ো বেরোবে। চারদিক ধুলো আর ধুঁয়োয় ভরি যাবেনে।
তোমার এই আঁকরে কী বলে বাবু?
এটারে যন্তর বলে রে বেটা! যন্তর। এই যন্তর আঁক কষি বার কত্তি হয়।
এই যন্তর দিয়ে সব জানা যায় বাবু?
স-ও-ব। স-ও-ব জানতি পারা যায়।
ও বাবু, এই যন্তররে বলো-না, আমাদের ট্যাকা দিতে। আমরা কবে পেট ভত্তি খাতি পাব তা-ও এ যন্তর দে জানা যায় বাবু?
কালিদাসের বাবা হাঃ হাঃ করে হাসত। বলত, ওরে না রে পাগলা, না। নিজেদের কতা এই যন্তরে জানা যায় না। আর ট্যাকা হলি পরে এই আঁকও আর কষা যায় না, আর কিচ্ছু দেকা যায় না রে!
সেই থেকে কালিদাস আর টাকার চেষ্টা করেনি। তার বাপের কাছে এই অঙ্ক শিখে তার আঁক কষার নেশা লেগে গিয়েছে। মরার আগে তার বাপ নিজের সব বিদ্যা উজাড় করে এই আঁক তাকে শিখিয়ে গিয়েছে। বলেছে, এই আঁকের কতা কাউরে বলবিনি বেটা। মরে গেলেও বলবিনি। সারা জেবন মুক্যুর ভান করি থাকবি। বললেই এ বিদ্যে শ্যাষ।
কালিদাস জিজ্ঞেস করেছিল, এ বিদ্দে তোমারে কে শেকায়ছিল বাবু?
ওরে সে অনেকদিনের আগের কতা। আমার বাপ, তার বাপ, তার বাপের আগে একখান গোল চাকতি আকাশ থে নেমেছিল। তার থে নেমেছিল একজন ভগমান। তার মাত্থাটা এত্তো বড়। সরু সরু হাত পা। সেই ভগমানই আমার ঠাকুদ্দার ঠাকুদ্দারে এই আঁক শেকায়ছিল। সেই থাকে চলতেছে এই যন্তরের আঁক।
কালিদাস এই আঁক কষা থেকে নিজেকে থামাতে পারে না। তার বাবা মরে যাওয়ার আগে সে এই বিদ্যার সবকিছু শিখেছে। সে সময় পেলেই মাটিতে বসে বসে অঙ্ক কষে যন্ত্র বানায়।
এই যন্ত্র তাকে বলছে, রানুদিদির এই বিয়ে হবে না। রানু, ধীরেনবাবুর মেয়ে ঠিক এই সময়ে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যাচ্ছে। তার মা, তার ইস্কুলের দিদিমনির সঙ্গে ব্যবস্থা করেছেন। সে কলকাতা চলে যাচ্ছে। তার ইস্কুলের দিদিমনি সেখানে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেখানে থেকে সে কলেজে পড়বে। পড়ে একদিন খুব শিক্ষিত হবে। তারপর রানুদিদি গ্রামে ফিরে এই ইস্কুলটায় পড়াবে। সেই ছোট্ট স্কুলটায় একদিন দলে দলে ছোট ছোট মেয়েরা পড়তে যাবে। ছোট্ট ইস্কুলটা মহীরূহের মতো ছড়িয়ে পড়বে।
কালিদাস আস্তে আস্তে বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তার সবজি আনার ঠেলা গাড়িটা নিয়ে ছুটতে লাগল। বৃষ্টি আস্তে আস্তে কমে আসছে। দূর থেকে অনেকগুলো গরুর গাড়িতে প্রচুর লোকজন আসছে। বরযাত্রী পৌঁছে গিয়েছে। এক্ষুনি রানুদিদির খোঁজ শুরু হবে। তার আগেই কালিদাসকে রানুদিদিকে আর দিদিমনিকে ছোট খালটা পার করিয়ে দিতেই হবে। এত স্রোতের জলে রানুদিদি একা একা পার হতে পারবে না। তারপরও ট্রেন ধরতে বাগুইহাটি অবধি অনেকটা রাস্তা যেতে হবে। ছোট্ট মেয়েটা কী অতটা রাস্তা যেতে পারে! কালিদাস এই ঠেলাগাড়িতে করে তাকে এক্কেবারে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে আসবে।
ধীরেন কবরেজের জন্যে তার একটু খারাপই লাগছে। লোকটা তার অন্নদাতা। বিয়ের রাতে মেয়ে চলে গিয়ে তাঁর খুব অপমান হবে। তবু একদিন যখন এই হদ্দ গ্রামে একটা বড় স্কুল তৈরি হবে তখন তার পিছনে কালিদাসেরও একটু অবদান থাকবে, এটা ভেবে তার ভালো লাগছে। কেউ কিচ্ছু জানবে না অবশ্য। তাতে আর কী? সে তো কোন ছাড়। এই বিদ্যাসাগরের নামটাও এই মানুষেরা একসময় ভুলে যাবে। তাঁর মূর্তি-টুরতি সব ভেঙেচুরে ফেলা হবে। জানলেও একসময় কেউ কিচ্ছু মনে রাখবে না। না রাখুক, জীবনে সবাই কী তার মতো সবকিছু পারে!
তবু ইস্কুলটা তো থেকেই যাবে। কালিদাস বিদ্যাসাগরমশাইকে কোনওদিন দেখেনি। দেখবেও না। তবু সে দেখতে পায়, তাঁর মতো মানুষ এ পৃথিবী বেশি তৈরি করবে না। বিদ্যেসাগরমশায়ের হাতে তৈরি ইস্কুল বলে কথা। তাকে রক্ষা করার জন্যে তো কালিদাস না হয় অন্নদাতার সঙ্গে এটুকু বেইমানি করলই।
কালিদাস তার ঠেলাগাড়ি নিয়ে ছোটার গতি বাড়াল।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী, পূজাবার্ষিকী, সুমন দাস
Opurbo laglo ei galpoti. Chotogolper boisisto somet SES HOYE HOILONA SES ar seitai
E golper soundorjo
একটি অসাধারণ গল্প। আমি নিজেও সামান্য লেখালিখি করি। আমার মতে ভালো গল্প দুরকম। এক, যা পড়তে ভালো লাগে। একবারের বেশি পড়া যায়, অন্যদের বলা যায়। আর ২য়, যে গল্প পড়লেই লেখক রূপে frustration এর শিকার হতে হয়। মনে হয়, ইশ্ কি লিখেছেন !! আমি কেন এমনটা পারি না?
এটি সেই ২য় প্রকারের গল্প।
ভালো থাকবেন এবং এমন frustrated আরও করবেন।