গিফ্টকার্ড
লেখক: পরীক্ষিৎ দাস
শিল্পী: সূর্যোদয় দে
উত্তমবাবু এবং ক্লাস এইটের ভূগোল
সবুজ রঙের গোল্লাটার ভিতর একটা টেলিফোন রিসিভারের ছবি। গোল্লাটার বাইরেটাও সবুজ। শুভজিৎ তার মোবাইল ফোনের সবজে হয়ে থাকা স্ক্রীনটা মেলে ধরল উত্তম হালদারের চোখের সামনে। তারপর বুঝিয়ে বলল, “এটাকে বলে হোয়াটসঅ্যাপ। আর এর আগে নীল রঙের ইংরিজি অক্ষরের ‘এফ’ যেটা দেখালাম, ওটা হচ্ছে ফেসবুক। কী বুঝলে?”
উত্তম হালদার গোমড়া মুখে শুকিয়ে যাওয়া শশা চিবুচ্ছিলেন। ব্লাডপ্রেশার বেড়েছে বলে ডাক্তারের আদেশ – দুপুরে ভাত-রুটি বন্ধ করে শুধু শশা। নীল, সবুজ নানা রঙে চোখ ধাঁধিয়ে, মাথা গুলিয়ে শেষ মেশ তিনি বলে উঠলেন, “ভাই, শশা খাবি?”
শুভজিৎ নিরাশ হয়ে ফোনটাকে পকেটে পুরে নিজের টিফিন কৌটো বের করলো। তাতে রয়েছে শুভজিতের নতুন বউয়ের হাতে যত্ন সহকারে রান্না করা পরোটা আর কালো জিরে দেওয়া ভাজা-ভাজা আলুর তরকারি। এক টুকরো পরোটায় আলু ভরে মুখে চালান করে চিবোতে চিবোতে বলল, “তোমাকে আর আমাকে বাদ দিলে এখানে উনিশ জন মেয়ে টিচার। তাদের মধ্যে পনেরো জনের বয়েস তোমার চেয়ে কম। তার মধ্যে আবার সাত জন আনম্যারিড। কলেজের প্রেম তো কত লোকের ভাঙে। তা বলে আর একটা চান্স নেবে না? সুযোগ যে তোমার চারপাশে আঁচল উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!”
স্ট্যাটিসটিক্স-এ মাস্টার দেখছি! আসলে কি বল তো, স্বপ্না আমার কনফিডেন্সের দফারফা করে দিয়ে গেছে। “তুই বুঝবি না। তোর বয়েস কম। রক্ত গরম। আর আমার মত দুর্দশাও তোর কোনো দিন হয়নি।”
“কত কম? আমি আঠাশ, তুমি আটত্রিশ। দশ বছরে কী এমন বদলায়?”
“ওটা সাঁইত্রিশ হবে। ওরকম হাতের কর গুনে কিছু হয় না রে। আমার একুশ থেকে বাইশ আমাকে বুড়িয়ে দিয়েছে। আমার চেয়ে ভাল আর কেউ তা জানে না।”
“মরে তো যাওনি উত্তমদা। বিএড করেছ। চাকরি পেয়েছ। মহানন্দে ভূগোল পড়িয়েছ তেরো বছর ধরে। নিজের বাড়ি হয়েছে। এবার একটা প্রেম তুমি করো। তারপর বিয়ে। আটত্রিশটা আজকাল কোনও বয়সই না।”
“সাঁইত্রিশ। কাল আটত্রিশ হবে।” ফের ভুল ধরলেন উত্তমবাবু।
“ধুর, বুলশিট তোমার সাঁইত্রিশ। তোমার ওই সাধের দোতলা বাড়িটায় জীবনটা তাহলে একা একা কাটাবে ঠিক করেছ?”
ম্লান হাসির সাথে শশাশূন্য টিফিনকৌটোটা ঝোলা ব্যাগে পুরতে পুরতে উত্তম হালদার ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, “হয় তো তাই! আমার ইচ্ছে মত তো কোনও দিন কিছু হয়নি।”
টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়তেই উঠে পড়লেন তিনি। শুভজিতের সাথে আর কথায় না গিয়ে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালেন।
ক্লাস এইটের ছেলে মেয়েদের চিল চিৎকারে ভালোই অভ্যর্থনা পেলেন সবার প্রিয় ভূগোলের টিচার – উত্তম স্যার। ক্লাসরুমে ঢুকতেই চোখ গিয়ে পড়ল অঙ্কুশের ওপর। ছেলেটাকে দেখেই অভিব্যক্তি বদলে গেল তাঁর। ভুরু কুঁচকে গলা চড়ালেন, “ছেলেরা একদিকে, মেয়েরা আরেক দিকে বসছে এক মাস ধরে, তুই রিয়ার পিছনের বেঞ্চে বসেছিস কেন পাজী?”
অঙ্কুশ উঠে দাঁড়িয়ে অভিযোগের সুর ধরল, “রিয়াই তো টিফিনের আগে আমাকে হোয়াটসআপ-এ বলল ওর পিছনে এসে বসতে। বলল কথা আছে আমার সাথে।”
নতমস্তক শুকনো মুখের রিয়াকে দেখে উত্তম স্যারের কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। ভাবলেন, গা থেকে এখনও বেবি পাউডারের গন্ধ যায়নি, তারাও হোয়াটসআপ বুঝে গেল। বুঝে গেল ছল-চাতুরী। তিনিই কেবল পিছিয়ে রইলেন। ক্যাবলার মত চেয়ে রইলেন স্বপ্নার চলে যাওয়ার দিকে। শুভজিতের জোরাজুরিতে স্মার্টফোনটাই শুধু কেনা হল। ফেসবুক, হোয়াটসআপটা আর শেখা হল না।
অঙ্কুশকে নিজের জায়গায় ফিরে যেতে বলে ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন উত্তম স্যার। টানা এক ঘন্টা ধরে ছেলে মেয়েদের ভাল করে বোঝালেন যে এই ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবীর মত গ্রহ একটাই। তার আকৃতিও ভারী অদ্ভুত। কারও সাথে তার তুলনা চলে না। যাকে বলে, পৃথিবীর আকৃতি পৃথিবীর মতই!
ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়লে পরে ভূগোল বইটা বগলদাবা করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলেন। লক্ষ করলেন ক্লাস চলাকালীন তাঁকে টের না পেতে দিয়ে অঙ্কুশ আবার রিয়ার পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসেছে। অবশ্য তাতে এবার বিশেষ আমল দিলেন না। তিনি ভাল করেই জানেন, পৃথিবী একটা হতে পারে, তবে তা আগের চেয়ে বদলে গিয়েছে অনেকখানি। পৃথিবীর আকৃতি বোধ হয় আজ আর পৃথিবীর মত নেই।
টিচার্স রুমে ফিরে এসে নিজের ঝোলা ব্যাগটা কাঁধে চাপালেন। বাকি টিচাররা ক্লাস থেকে ফেরেনি এখনও। সেখানে অপেক্ষা না করে স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়লেন ছুটি হওয়ার অনেকটা আগেই। আজ আর কোনও ক্লাস নেই তাঁর।
উত্তমবাবু এবং দেবকন্যা
খুব গরম পড়েছে ক’দিন ধরে। বৃষ্টিও বেপাত্তা। চাতক হয়ে বাড়ি ঢুকলেন উত্তমবাবু। উপরে ওঠার আগে মায়ের ঘরে উঁকি দিলেন একবার। বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙে বৃদ্ধা এখন সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। বারো ঘন্টার দুটো শিফটে চব্বিশ ঘন্টা আয়ার বন্দোবস্ত আছে। আয়ার সাথে পড়ন্ত বিকেলে হাবিজাবি গল্প করছিলেন উত্তমবাবুর মা। নিজের ছেলেকে দেখতে পেয়ে জবুথুবু ভাবটা খানিক কাটিয়ে উজ্জ্বল হয়ে বলে উঠলেন, “দেবকন্যা এসেছে রে অনেকক্ষণ। ওপরে অপেক্ষা করছে তোর জন্য। এক গাদা ফল আর মিষ্টি দিয়ে গেল আমাকে। বড় ভাল রে মেয়েটা।”
“তুমি কি ভাবছ দেবকন্যাকে আমি বিয়ে করবো?”
আদুরে গলায় উত্তমবাবুর মা বললেন, “ভাবলে ক্ষতিটা কোথায়?”
কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগলেন উত্তমবাবু। যেমন ভাবে পনেরো বছর বয়েসে বাবাকে হারানোর পর নির্বাক উত্তম তরতর করে বয়েসের সিঁড়ি চড়ে বেড়ে উঠেছিল, ঠিক তেমন ভাবে। তবে তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, যে বয়েসটা বাড়লেও তিনি এখনও বাইশেই আটকে রয়েছেন। ওই সেই দিনটায়। স্বপ্নার চলে যাওয়ার সেই দিনটায়।
এমনিতে উত্তমবাবু ফিট। শরীরের খাঁজে ভাঁজে এখনও মেদ জমতে শুরু করেনি। তাও হাঁপাচ্ছেন অল্প। আর গরমের চোটে বেজায় তেষ্টাও পেয়েছে। এক গেলাস জল এক চুমুকে শেষ করে শোয়ার ঘরে ঢুকে দেবকন্যাকে দেখতে পেলেন। খাটের ওপর সে এখন সম্পূর্ণ নিরাভরণ। এলো চুল বালিশে বিছিয়ে অন্তহীনে চেয়ে রয়েছে। চোখে মুখে লজ্জার ভাব নেই এত টুকুও। ভীষণ রকম সাবলীল দেবকন্যার এই ভঙ্গি।
উত্তমবাবুর ভুরু কুঁচকে উঠল সে দৃশ্য দেখে – “আরে! কেউ যদি চলে আসে?”
শান্ত গলায় দেবকন্যা জবাব দিল, “কে আসবে? তোমার মা? নাকী তার আয়া? তোমার মায়ের পক্ষে তো সিঁড়ি ভাঙা সম্ভব নয়। আর আয়াকে আমি হাবে ভাবে যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিয়েছি। না ডাকলে ওপরে ওঠার সাহস করবে না।”
উত্তমবাবু পোশাক বদলে নিলেন ঢোলা পাজামা আর আকাশী রঙের গোল গলা সুতির গেঞ্জি দিয়ে। দক্ষিণ দিকের জানলাটা খুলে দিতেই আপত্তি জানালো দেবকন্যা। পাল্টা যুক্তি দিলেন উত্তমবাবুও।
“এদিকটায় পার্ক, তারপর লেক। দোতলার বিছানায় কি ঘটছে তা কারও চোখে পড়বার উপায় নেই।”
দেবকন্যা আশ্বস্ত হয়ে অনন্তে ফিরে তাকালো ফের। বিকেলের মরা আলো এসে তার শরীর স্পর্শ করছে। আলোর যেন ঘরে ফেরার ইচ্ছেই নেই আজ।
দেবকন্যা জানে এরপর কী ঘটবে। আগেও ঘটেছে একাধিকবার। এক একবার এক এক পজিশনে। সে জানতে চাইল, “আজ কিভাবে?”
উত্তমবাবু ক্রিম রঙের অ্যাপ্রনটা গায়ে চাপিয়ে প্যালেট আর ইজেল রেডি করলেন। তারপর বললেন, “ঠিক যে ভাবে রয়েছ, সেই ভাবে।”
জলরঙে ব্রাশ ভিজিয়ে সাদা ক্যানভাসে দিনের প্রথম আঁচড়টা টানলেন উত্তমবাবু। এটা তাঁর বহুদিনের পুরনো শখ। শখ না বলে অভ্যাস বা নেশা বলা সাজে। একমনে এঁকে চললেন তিনি। গম্ভীর চোখে কখনও দেবকন্যার দিকে তাকাচ্ছেন, কখনও দক্ষিণের জানলা দিয়ে বাইরে। ছোট ছোট নিঃশ্বাস আর তুলির টানে দেবকন্যার অপরূপ রূপের রহস্য ক্রমশ উন্মোচিত হয়ে চলল ক্যানভাসের ওপর।
উত্তমবাবু কোনওদিন আঁকার স্কুলে যাননি। ছবি আঁকাটা তাঁর ভিতর থেকে আসে। ছোটবেলায় আবিষ্কার করেন যে তিনি যাই দেখেন তাই হুবহু এঁকে ফেলতে পারেন। কলেজে স্বপ্নার সাথে পরিচয় হওয়ার পর আরও গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন নিজের এই অদ্ভুত গুণটা। কলেজ শেষ হতে স্বপ্না তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকে এই অভ্যাসটাকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেন তিনি। স্বপ্নাকে ভুলতে, কষ্টটাকে ভুলতে সাহায্য করে এই রং আর তুলি। আর আজকাল তো দিনে অন্তত একবার রং-তুলি স্পর্শ না করলে রাতে ঘুমই আসতে চায় না তাঁর।
ক্যানভাসে নিজেকে ঢেলে দিতে দিতে উত্তমবাবু উদাস কন্ঠে বললেন, “জানো দেবকন্যা, মা ভাবে আমি তোমাকে বিয়ে করবো।”
নিজের ভঙ্গি একটুও না বদলিয়ে দেবকন্যা ভাসিয়ে দেয়, “করতেই পারো!”
অল্প হাসেন উত্তমবাবু। বলেন, “রাতে থাকবে? বর তো বাইরে!”
দেবকন্যা বলে, “দেখা যাক। কোন দিকে গড়ায় জল।”
কিছুক্ষণ পর উত্তমবাবুর আঁকা শেষ হয়। ঘরে এখন দুটো দেবকন্যা।
ইজেলটাকে দেবকন্যার দিকে ফিরিয়ে উত্তমবাবু বিছানায় এসে বসেন। সন্ধ্যে নামবো নামবো করছে। ঘরে কোনও আলোও জ্বলছে না। অথচ ছবিটা থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। দেবকন্যা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে নিজের দিকে। উঠে বসে উত্তমবাবুর গালে ছোঁয়ায় তার নরম আঙুলগুলো। বিভোর গলায় বলে, “প্রত্যেক বার কী ভাবে পারো বলো তো? কী করে তুমি এত ভাল আঁকো উত্তম?”
উত্তমবাবু আরও খানিকক্ষণ ছবিটার দিকে চেয়ে থেকে সরে আসেন দেবকন্যার পাশ থেকে। জানলার সামনে এসে দাঁড়ান। মিঠে হাওয়ায় গরমটা কমছে আস্তে আস্তে। বাইরের সদ্যজাত অন্ধকারের চোখে চোখ রেখে তিনি বলেন, “তুমি বোধ হয় আমাকে ভালোবেসে ফেলেছ দেবকন্যা। বাট আই অ্যাম ভেরি সরি। আমার পক্ষে আসলে সম্ভব নয়। তুমি আবার কোনও মিথ্যে আশায় ভর করে নিজের ঘর ভাঙতে যেও না। হয়তো আমি একটুও রোম্যান্টিক নই। হয়তো কোনো দিন ছিলামও না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে স্বপ্না আমার জীবনে একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল। একটু বেশিই গভীর হয়ে গিয়েছিল আঘাতটা, এই যা।”
দেবকন্যা অবুঝ। সে বলে, “কিংবা, তুমি খুব বেশিই রোম্যান্টিক ছিলে। আজও আছো। বোকা এবং রোম্যান্টিক। তাই স্বপ্না তোমাকে ছাড়লেও তুমি তাকে ছেড়ে উঠতে পারো নি।”
এরপর চুপ করে কিছু ভাবেন উত্তমবাবু। তারপর বলেন, “তুমি তাহলে কী?”
আবেগে ভাসতে থাকা নৌকো পাল তুলে দেয় – “মনে করো আমি তোমার দক্ষিণ খোলা জানলা!” উত্তর দেয় দেবকন্যা।
উত্তমবাবুর যে কোনো কারণেই হোক কথাটা পছন্দ হয় না। কে যেন বহু বছর আগে ঠিক এমনই একটা কথা তাঁকে বলেছিল। শব্দগুলোর লাশ আজও ভাসে তাঁর চোখের সামনে।
দেবকন্যাকে নিরাশ করে তিনি দক্ষিণের জানলাটা এক টানে বন্ধ করে ফেলেন। মুহূর্তে গুমোট হয়ে ওঠে ঘরের ভিতরটা।
দেবকন্যা বুঝতে পারে, যে তার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে এবার। তাও অকারণ অপেক্ষায় সায় জানায় মন। তাই আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা সে করে। আর সন্ধ্যের কালো রং ক্রমে গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হয় – ঘরে এবং বাইরে।
উত্তমবাবু এবং জন্মদিনের গিফ্টকার্ড
টিভির স্ক্রীনে দেশের পঙ্গু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ভোগের কালচার, তেলা মাথায় তেল দেওয়ার সংস্কৃতি নিয়ে কঠিন বক্তব্য রাখছেন এক রাজনীতিবিদ। সেটা দেখতে দেখতে ভারী মজা লাগল উত্তমবাবুর। কারণ ফুটেজটা মাস কয়েক পুরনো। ভোটের আগে এই ফুটেজের দরুন বেজায় বিখ্যাত হয়েছিলেন ভদ্রলোক। তবে ক’দিন আগে সেই বিখ্যাত রাজনীতিবিদ কুখ্যাত হয়েছেন। মানে ঘুষ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার অপরাধে জেল হয়েছে তাঁর। তাই আবার খবরের শিরোনামে সেই ফুটেজ। তবে এবার ব্যাপারটা হিপোক্রিটিকাল।
টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। মোবাইলে এসএমএস আসার শব্দে পাতলা ঘুমটা ভাঙল হুট করে। এই নতুন স্মার্ট ফোনে স্কুলের শুভজিৎ ছাড়া আর কেউ মেসেজ পাঠায় না। আর ফেসবুক, হোয়াটসআপ-এ তাঁর এলার্জি। বেশ সন্দেহের চোখেই মেসেজটা খুললেন। মোবাইলের ঘড়িতে তখন রাত বারোটা বেজে তিন মিনিট।
লক্ষ করলেন তেরো ডিজিটের একটা অদ্ভুত ফোন নম্বর থেকে এসএমএসটা এসেছে। তাতে ইংরিজিতে যা লেখা তার বাংলা করলে দাঁড়ায় – শুভ জন্মদিন! স্বপ্না রায় হালদার গিফ্ট.কম ওয়েবসাইটে আপনাকে একটি গিফ্টকার্ড পাঠিয়েছে। লিংকে ক্লিক করে গিফ্টকার্ডটি খুঁজে পান। ধন্যবাদ।
আধ শোয়া অবস্থায় মাথাটা ঘুরে উঠল উত্তমবাবুর। সাঁইত্রিশের বাতিক পেরিয়ে আটত্রিশে পড়লেন বলে নয়, স্বপ্না রায় হালদার নামটা দেখে। স্বপ্না রায় বলে কাউকে তিনি খুব ভাল করে চিনতেন এককালে। আর তিনি হালদার।
তবে অবাক হওয়ার বিশেষ সময় পেলেন না। হুড়মুড় করে তাঁর দোতলার শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়ল দুটো লোক। উত্তমবাবুকে তারা অনায়াসে পাঁজাকোলা করে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে এসে বাইরে রাখা সোফার ওপর ফেলে দিল। সুইচ খুঁজে আলোও জ্বালিয়ে ফেলল চোখের পলকে।
হতচকিত উত্তমবাবু ঘামতে শুরু করেছেন। শুকিয়ে যাওয়া জিভের আড় ভেঙে কোনও ক্রমে বললেন, “আপনারা ঢুকলেন কী করে?”
লোক দুটোর বিশাল বপু। পরণে কালচে নীল রঙের শার্ট-প্যান্ট। দুজনেরই বুকপকেটের বাইরে আটকানো রয়েছে অদ্ভুত আকারের ব্যাজ। বয়েস তাদের তিরিশের কোঠায়।
তাদের একজন উত্তমবাবুর মুখোমুখি সোফায় বসে পড়ে বলল, “অ্যাক্সেস আছে।”
উত্তমবাবুর প্যানিক কাটছে না কিছুতেই। অস্থির গলায় তিনি বললেন, “তালা ভাঙলেন কী করে?”
“ধুর মশাই, বলছি অ্যাক্সেস আছে। আমরা যেখানে খুশি, যখন খুশি চলে যেতে পারি। তালা ভাঙতে যাব কোন দুঃখে?”
পাশে দাঁড়ানো লোকটা ঘর থেকে উত্তমবাবুর মোবাইল ফোনটা নিয়ে এল। ঘাড় গুঁজে একমনে যন্ত্রটা খানিক ঘাঁটাঘাঁটি করে তার সাগরেদকে বলল, “কন্ট্যাক্ট কনফার্ম! কিছু করার নেই।”
উত্তমবাবু উঠে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, “কী? কন্ট্যাক্ট কী? কী চাই কী আপনাদের?”
বসে থাকা নীলজামা হুশ করে একটা পিস্তল বের করল কোত্থেকে। সেটাকে উত্তমবাবুর দিকে তাক করে বলে উঠল, “প্লিজ স্যার। আপনার কোনও দোষ নেই। একটা মেজর সিস্টেম ফেলিওরের জন্য আজ অনেকগুলো রং-রুটের কেস আছে। আমাদের হাতে সময় খুব কম। প্লিজ বসে পড়ুন।”
অদ্ভুত দর্শন কমলা রঙের পিস্তলের সামনে মিইয়ে গিয়ে বসে পড়তে বাধ্য হলেন উত্তমবাবু।
পিস্তল নামিয়ে লোকটা ঠাণ্ডা গলায় বলল, “একটা ক্যাপসুল দেবো। আপনি খেয়ে নেবেন। তারপর শুয়ে পড়বেন।”
“কেন? কেন খাবো আমি ক্যাপসুল?” রাগ আর ভয় মিশে থাকে উত্তমবাবুর কন্ঠে।
“আরে বাবা, কারণ বলতেই পারি। এক, সময় নেই। দুই, কাল সকালে সেই কারণ আপনার মনে থাকবে না।”
মুহূর্তে মত বদলিয়ে লোকটা বলল, “আচ্ছা, সংক্ষেপে বলেই নি। ওয়ার্ক এথিক্সের প্রশ্ন চলে আসছে। আপনি হয় তো জানবেন না, এই ইউনিভার্স ছাড়াও আরও কয়েক লক্ষ ইউনিভার্স আছে আর তাতে আপনার পৃথিবীর মত আরও কয়েক লক্ষ গ্রহ। গিফ্টকার্ডটা অন্য এক পৃথিবীতে স্বপ্না রায় হালদার তার হাজব্যান্ড উত্তম হালদারকে পাঠিয়েছিল। এসএমএসটা ভুল করে আপনার কাছে চলে এসেছে। ওয়ারলেস কমিউনিকেশনের হাজারো ঝক্কি, বুঝলেন তো! ওদিকে ইন্টার ইউনিভার্স ল অনুযায়ী এক ইউনিভার্সের সাথে অন্য ইউনিভার্সের যে কোনও রকম কন্ট্যাক্ট নিষিদ্ধ। যদিও এমনটা সচরাচর ঘটে না। ন’ মাসে ছ’ মাসে সিস্টেমের ফল্ট হয়। তাও এই ধরণের সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য আমরা আছি। আমরা আই.ইউ.এস.এফ। ইন্টার ইউনিভার্স সিকিউরিটি ফোর্স। সাধারণত কন্ট্যাক্ট হওয়ার আগেই আমরা চেষ্টা করি সমস্যার সমাধান করতে। তবে আপনি এসএমএসটা দেখে ফেলেছেন। মানে কন্ট্যাক্ট হয়ে গিয়েছে। তাই এখন আপনাকে একটা ইলেকট্রনিক ক্যাপসুল খেতে হবে। যাতে আমরা ইনপুট দিয়ে দেবো, যে কোন সময় থেকে কোন সময়ের স্মৃতি মুছে দেওয়া হবে, যাতে করে এই কন্ট্যাক্টের কোনও স্মৃতি আপনার মস্তিষ্কে আর না থাকে। আপনার আর আমার এই কথোপকথনও মুছে যাবে। এমনটাই ইন্টার-ইউনিভার্স আইনে লেখা আছে। আপনি চাইলে দেখতে পারেন। ই-কপি একটা আছে আমাদের কাছে।”
“অন্য পৃথিবীতে স্বপ্না উত্তমকে বিয়ে করেছে?” উত্তমবাবুর স্বরে ঝরে পড়ল বিস্ময়।
সোফার পাশে দন্ডায়মান নীলজামা ছটফট করে উঠল। খানিকটা বিরক্তি নিয়েই সে বলল, “এতক্ষণ ধরে ও আপনাকে যা যা বলল, তার থেকে ঐটুকু সারমর্ম উদ্ধার করলেন আপনি? আশ্চর্য!”
মাথা নিচু করলেন উত্তমবাবু। তাঁর সব অস্থিরতা কেটে গিয়েছে। আগের চেয়ে অনেক সহজ গলায় বললেন, “একটা কথা বলব? ওই ক্যাপসুলে আজকের দিনটার সাথে আরও একটা দিন যোগ করে দেবেন?”
এবার নীলজামাদের অবাক হওয়ার পালা। তাদের একজন বলল, “এমন কথা কাউকে বলতে শুনিনি কখনও। তাও বলুন। কোন দিন?”
উত্তমবাবু বললেন, “দু-হাজার সালের দোসরা সেপ্টেম্বর।”
“কেন? কি ঘটেছিল ওইদিন?”
উত্তমবাবু বললেন, “দোসরা সেপ্টেম্বর মানে আজ আমার জন্মদিন। দুহাজার সালের এই দিনটায় আমার পৃথিবীতে স্বপ্না আমাকে জানিয়েছিল, যে সে তার বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে যেতে চায়। জন্মদিনে কি দারুণ গিফট, তাই না?”
একটু থেমে তিনি আবার বলেন, “আমার ভাবতে ভাল লাগে না ওই দিনটার কথা। হতভাগা দিনটা ছেড়েও যায় না আমাকে। প্রত্যেক বছর মনে করিয়ে দেয় স্বপ্নার কথা। মনে করিয়ে দেয়, যে স্বপ্না নেই। আর কোনও দিন আসবেও না সে আমার কাছে। আমি অনুরোধ করছি আপনাদের। দিনটাকে মুছে দিন প্লিজ। ওই দিনটা আমি ভুলে যেতে চাই।” কথাগুলো বলতে কষ্ট হয় উত্তমবাবুর। মনে হয় যেন পর্বত ভাঙছেন ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে। বুকের ভিতরটা বড্ড ভারী হয়ে আসে।
নীল জামা লোক দুটো অর্থহীন চোখে একে অপরের দিকে তাকায়। আসলে ইউনিভার্স বোঝা আছে তাদের। প্রেমটা তাদের ঠিক বোঝা নেই।
Tags: গল্প, গিফ্টকার্ড, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পরীক্ষিৎ দাস, সূর্যোদয় দে