গ্রন্থ সমালোচনা – অপার্থিব – অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
লেখক: অরুন্ধতী সিনহা রয়
শিল্পী: ইন্টারনেট
অপার্থিব
লেখক – অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
প্রকাশ – ২০১৭
প্রকাশক – বৈভাষিক
মূল্য – ১৮০
সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগগুলোর মধ্যে আমার ব্যক্তিগত পছন্দ হল – থ্রিলার। সে ফিকশন হোক বা নন-ফিকশন, পেলেই গোগ্রাসে গিলি। ‘অপার্থিব’-র ব্লার্বটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল এটা একটা সায়েন্স ফিকশন থ্রিলার – যে বিষয়ে খুব বেশি বই আমি আজ অবধি পড়িনি। এই ব্যাপারটাই আমায় সবচেয়ে বেশি অ্যাট্রাক্ট করেছিল। কিন্তু বইটা পড়তে পড়তে বুঝতে পারি, যে শুধু সায়েন্স ফিকশন থ্রিলার বললে উপন্যাসটার ব্যাপ্তিটা সম্পূর্ণভাবে বোঝান যাবে না – এর একদিকে যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে আবার অন্যদিকে প্রাপ্ত বয়স্ক মননশীলতার সুগভীর ছায়াও প্রতিফলিত হয়েছে।
উপন্যাসটির সূত্রপাত হচ্ছে আজ থেকে প্রায় কয়েক যুগ পরে, যখন পৃথিবী আর দেশ মহাদেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। সমগ্র পৃথিবী কয়েকটি শক্তিশালী কর্পোরেশনের দখলে। যাদের মধ্যে চলছে ক্ষমতা বৃদ্ধির নিরন্তর লড়াই। এমনই এক সময়, এক কর্পোরেশনের পৃষ্ঠপোষকতায়, এক দল বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে চলছে এক interstellar project – প্রজেক্ট করোনা। করোনা হল পৃথিবী থেকে ৪ আলোকবর্ষেরও বেশি দূরত্বে প্রক্সিমা সেন্টরি তারকামণ্ডলে অবস্থিত এক গ্রহ। এই গ্রহে বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন প্রাণের সন্ধান। বিগত দশ মাসে প্রায় ৩০ জন বিজ্ঞানী তেভা ভারাভ ওয়ার্ম হোলের অপর প্রান্তে অবস্থিত এই করোনা গ্রহে গেছেন।
এই ঘটনা জনসাধারণের জানা নেই, কারণ একবার যারা গেছেন, তারা কেউই আর ফিরবেন না। কিন্তু গত আটমাস ধরে ওই গ্রহে দেখা গেছে এক অদ্ভুত রহস্য – তিনজন বিজ্ঞানীর মৃত্যু ঘটেছে এমন ভাবে যা খুব সহজেই এড়ানো যেত বলেই কর্পোরেশন মনে করে। কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়ের ব্যাপার হল প্রায় ১৩ জন বিজ্ঞানী – যারা নিজের নিজের ক্ষেত্রে এক একজন জিনিয়াস হিসেবে পরিগণিত হন, তাঁরা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে একেবারে শিশুতে পরিণত হয়েছেন। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরিক্ষা কোনও অসুস্থতা বা ভাইরাস খুঁজে পায়নি তাদের শরীরে। কিসের প্রভাবে তাহলে এই বিপর্যয়?
দারিয়াস মজুমদার – সে হ্যাকার না গোয়েন্দা? কর্পোরেশনের কাছে anarchist activist। কর্পোরেশনের চিফ কম্যান্ডারের নির্দেশে দারিয়াস আসে করোনায় দুটি উদ্দেশ্যে, এই অদ্ভুত রহস্যের উদঘাটন করা আর পরিস্থিতি বিশেষে কোন একজন বৈজ্ঞানিককে তার সঙ্গে ফেরত নিয়ে আসা। এর সঙ্গে ছিল দারিয়াসের নিজস্ব কিছু প্রশ্ন – কী মূল উদ্দেশ্য প্রোজেক্ট করোনার? দীর্ঘদিন ধরে এই বিজ্ঞানীরা কী করছেন এখানে? কিন্তু দারিয়াস কি আদৌ পারবে রহস্য এর সমাধান করতে? না কি, তারও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে যাবে?
করোনায় এসে দারিয়াসের আলাপ হয় চার বিজ্ঞানীর – ইলানা, ইকিরা, মিশেঙ্কা আর সোহরাব – যারা তখনও শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ। কিন্তু ইলানা, মিশেঙ্কা একে একে জরদ্গবে পরিণত হন। দারিয়াস সিদ্ধান্ত নেয় সে একজনকে নিয়ে না, সবাইকে নিয়েই পৃথিবীতে ফিরে আসবে। কিন্তু হঠাৎ ইকিরা আত্মহত্যা করে। কিন্তু কেন? আজ অবধি যে ক’জন মারা গেছেন তার প্রত্যেকটিই দুর্ঘটনা – কেউ স্বেচ্ছায় মৃত্যু লাভ করেনি। মারা যাবার আগে ইকিরা রেখে যায় এক নোট। কি লেখা আছে তার মৃত্যুর কারণ? এমন কী তার মৃত্যুর পর তার শরীরে বাকি বিজ্ঞানীদের মত স্বাভাবিক ক্ষয় দেখা যায় না – এমন কেন? শেষ অবধি করোনায় থেকে যায় দারিয়াস ও সোহরাব। বেশ অনেকদিন দারিয়াস সেখানকার ল্যাবে কাজ করে জানার চেষ্টা করে কী হতো করোনায়? সোহরাবও একসময় বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। দারিয়াস নিজে বিজ্ঞানী নয়। তাকে যে যন্ত্র করোনায় এনেছিল, তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে ফিরে আসা সম্ভব নয় তার পক্ষে। কী করবে এবার দারিয়াস?
এই উপন্যাসটার যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে লেখার flow। কি সাবলীল ভাবে একটা থেকে আরেকটা স্টোরিলাইনে শিফট করেছেন লেখক। ধীরে ধীরে পুরো উপন্যাসটা তৈরি হয়েছে কোথাও স্পিড বেশী বা কম মনে হয়নি। বিজ্ঞানীদের চোখে মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি – প্রবৃত্তিগুলোর ব্যাখ্যা পড়তেও বেশ অন্য রকম লাগে। তবে মাঝে সাঝে টুকটাক কিছু সায়েন্টিফিক টার্মের জন্য একটু গুগল-এর সাহায্য নিতে হয়েছে বটে, কিন্তু তা লেখার রসভঙ্গ করেনি।
Tags: অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, অরুন্ধতী সিনহা রয়, গ্রন্থ সমালোচনা, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী