গ্রন্থ সমালোচনা – সেরা কল্পবিশ্ব ২০১৬
লেখক: শিল্পী রয় বসু
শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ
সেরা কল্পবিশ্ব প্রকাশের দিনকয়েকের মধ্যেই রাত জেগে দম বন্ধ করা গল্প, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, অণুগল্প, কবিতা প্রায় গিলে খেলাম বলা যায়। আগে থেকেই মুদ্রিত সংস্করণ হাতে আসবে, এই উত্তেজনাতে টগ্বগ্ করে ফুটছিলাম আমরা সবাই। বইমেলা ২০১৭–র প্রায় প্রথম দিকেই দীপ আর সুপ্রিয়দার সঙ্গে পৌঁছে গেলাম সেই কাঙ্খিত প্রতিশ্রুতি প্রকাশনের স্টলে। কেনা হয়ে গেল সেই বহু প্রতীক্ষিত বই। এবার পালা পড়ার। তাও একসময় শেষ হল।
এই গল্পগুলোর সবই আগে অর্ন্তজালে পড়া, কিন্তু এই কিন্ডলের যুগেও ছাপার অক্ষরে বই পড়াটা কিছু মানুষ এখন ভুলতে পারেননি বলেই বোধহয় বইমেলা বলে একটা উৎসব এখনো টিকে আছে। এই আর্ন্তজাল ছিন্ন করে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য এই অবহেলিত ধারার বই প্রকাশের সাহসী পদক্ষেপ যারা নিয়েছে তাদের আমার অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমই আজ আমাজনের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের কাছে বইটি পৌঁছে দিতে পেরেছে। এবার পর্যালোচনার পালা।
প্রচ্ছদটি খুবই সুচিন্তিত উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় বহন করে। বিশ্বদীপের লেখনীতে ভূমিকাটি মুখবন্ধের থেকে বেশী গল্পের মতো লেগেছে। যেসব পাঠক বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে বই পড়া শুরু করেন তাঁরা এই অংশটি পড়ে আর্কষিত হতে বাধ্য। তবে বাংলা কল্পবিজ্ঞানে আরেকজনের নাম এখানে উল্লেখ করলে ভালো লাগত, তিনি হলেন সুকুমার রায়। তাঁর হাত ধরেই বাংলার কল্পবিজ্ঞান এই জায়গায় এসেছে। তিনি এই ধারার একজন অগ্রণী। তাঁর আবোল তাবোল আমাদের বহু কবিতায় কল্পের দেশে নিয়ে গেছে, একবার নয়, বারবার। ওনার নামের অভাব অনুভূত হচ্ছিল।
গল্পগুলো প্রতিটি ভিন্নস্বাদের হওয়ায় পর্যালোচনা করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
কৃত্রিম–বুদ্ধিমত্তা, মনো–কল্পবিজ্ঞান, সময়–ভ্রমণ, সমান্তরাল–মহাবিশ্ব, কল্পবিজ্ঞানে ৪২ সংখ্যাটির গুরুত্ব এরকম বহু উপধারার (sub-genre) এর লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হলাম।
ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দের তালিকায় প্রথম হল সুমিত বর্ধনের লেখা “বাঙ্ময়”। এই গল্পে অনেকগুলি কল্পিত বিষয়ের স্বাদ একইসাথে পেলাম এবং প্রতিটি স্বাদই নিজ গুণে অমলিন। কল্পবিজ্ঞান তো আছেই, তার সাথে প্রাগৈতিহাসিক নৃবিদ্যা, মনস্তত্ব, প্রযুক্তি, স্নায়ুবিজ্ঞানের অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে এই গল্পে। এখনও ভুলতে পারিনি লেখাটি।
যশোধরা রায়চৌধুরীর “টিট্টিভ” গল্পটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক অপূর্ব চিত্রায়ন রয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির এই পাহাড়–চূড়ায় বসেও এই গল্পে আমরা এক অভূতপূর্ব বার্তা পাই। বিজ্ঞান ও আবেগ এই যুগেও পরস্পরের পরিপূরক।
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের “হরেনবাবু ও ব্ল্যাকহোল” পড়তে গিয়ে একবারও মনে হয় না যে কৃষ্ণগহ্বর ও সমান্তরাল মহাবিশ্বের মতো জটিল বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করা হচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে দিয়ে যে কতো সহজ সরল ভাবে কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলিকেও উপস্থাপন করা যায় এইসব লেখনী বারংবার তারই প্রমাণ দিয়ে যায়।
অধরা বসুমল্লিকের “সবুজ পৃথিবীর জন্য” একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী লেখা। আমাদের এই পৃথিবী থেকে যখন অত্যন্ত দুরন্ত গতিতে গাছেরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তখন অন্ধের মতো প্রযুক্তির পিছনে ছোটা যে নিতান্তই অবিবেচনা সেটা এই প্রযুক্তিই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। গল্পের এই বার্তাটি সত্যিই চিন্তার বিষয় বটে।
সোহম গুহ–র “লিমেরেন্স” এমন একটি কল্পিত বিষয়ের উপর লেখা যা প্রথমে খুব সাধারণ ও পরিচিত বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু গল্পের অভিনবত্ব গল্পের বিস্ময়কর প্রতিস্থাপনায়। জিন, হরমোন, স্নায়ুবিজ্ঞানের সঙ্গে লেখক ভালোবাসার এক অদ্ভুত আঙ্গিকে তার লেখনীকে রাঙিয়েছেন। এই সমস্ত রঙে যে ছবি আমরা পেয়েছি তা এক কথায় অনবদ্য।
অঙ্কিতা মাইতির “জিন মহাপুরাণ” পড়ে পুরাণ সম্পর্কিত অনেক অজানা তথ্য জানলাম। এই রচনাটিতে আমাদের পৌরাণিক গল্পগুলিকে দুর্দান্তভাবে প্রজননশাস্ত্রের সাথে সমাপতিত করা হয়েছে। প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত–র “টাইম লকার” একটি অত্যন্ত চিত্তব্যঞ্জক অথচ যুগোপযোগী গল্প। অদূর ভবিষ্যৎ–এ আমাদের এই পথেই নিয়ে যাচ্ছে।
দিগন্ত ভট্টাচার্যের কলম–প্রসূত “অন্তিম হিসাব” আরো একটি অনন্য কল্পকাহিনী। শুরুটা যথারীতি অভিনব। অসাধারণ নয় অভিনব কারণ তার লেখায় সুচিন্তিত হাস্যরসের ছোঁয়া আমরা পেয়ে থাকি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে গল্পের মাঝে ৪২ এর চক্কর যখন বিজ্ঞানের পরিধিতে গিয়ে ঢুকল তখন হাস্যরসের সমাধি হয়ে কঠিন এক অঙ্কের জালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের টানে গল্পের প্রধান চরিত্র আমাদেরও টেনে নামালেন সেই স্থান ও কালের অসীম জালে।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের লাভক্রাফটের জীবনী অনুবাদ বাংলায় এই অবহেলিত অথচ অসম্ভব প্রতিভাধর মার্কিন বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞান–সাধকের জীবন আলেখ্য আমাদের অন্তরের গভীরে গিয়ে নাড়া দেবার উপাদান যুগিয়েছে। বহু মানুষ এর আগে হয়তো তাঁর নামই শোনেননি। কল্পবিশ্বের উদ্যোগ ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কলম তাদের এক অন্য দিগন্তের সন্ধান দিল।
অনুবাদ করা গল্পগুলি উল্লেখ না থাকলে সম্পূর্ণ মৌলিক বলেই মনে হত। এমন সব জটিল বিষয়ের এমন স্বচ্ছ অনুবাদ আগে পড়েছি বলে তো মনে পড়ে না। দীপ ঘোষ, সুপ্রিয় দাস আর সন্দীপন গাঙ্গুলীর লেখার সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার নেই। অনুগল্প, লিমেরিক, সাক্ষাৎকার, সিদ্ধার্থ ঘোষকে নিয়ে লেখা সন্তু বাগের প্রবন্ধ খুবই মনোগ্রাহী।
আরো অনেকেই হয়তো নামে উহ্য থেকে গেল বা গেলেন, কিন্তু প্রতিটি লেখাই পড়তে খুব ভালো লেগেছে। এটাই মনে হয়েছে প্রতিটির পেছনে রয়েছে চিন্তা, চেষ্টা, পরিশ্রম ও অবশ্যই সময়।
এই প্রজন্মের ছেলে–মেয়েরা এই ব্যস্ততার যুগেও যে তাদের দৈনন্দিন কাজের সাথে শুধু লেখার আনন্দে লিখছে, এটাই আমাদের অনেক বড়ো একটা পাওয়া ও ভবিষ্যৎ–এর আশার কথা। আর এটা ভেবে আরো ভালো লাগে যে তারা লিখছে এমন একটা ধারার জন্য যেখানে বাঙালীরাই ভাবতে পারেন না বা ভাবতে হলে দুবার ভাবেন, -“পরিণত মনস্ক কল্পবিজ্ঞান, আবার বাংলায়?”। এই “কিন্ডল” এর যুগেও যে বই হারিয়ে যাচ্ছে না, “সেরা কল্পবিজ্ঞান” এর মুদ্রিত সংস্করণ আবার তার প্রমাণ দিল।
দীপ ঘোষ, সুপ্রিয় দাস, সন্তু বাগ, বিশ্বদীপ দে ও আরো অনেকেই শুধু সম্পাদনার কাজ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তাদের কলমও এই কাজে তাদের অংশীদার হয়েছে। এটাই এই পত্রিকার সাফল্যের মূল পাথেয় – নিষ্ঠা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ।
Tags: গ্রন্থ সমালোচনা, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, শিল্পী রয় বসু, সমালোচনা, সেরা কল্পবিশ্ব-২০১৬