গ্রীন কার
লেখক: নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
শিল্পী: তৃষা আঢ্য
কাহিনি সূত্র
স্বার্থলোলুপ মানুষগুলোর হাত এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অপর্ণা। যে করেই হোক তাকে রক্ষা করতে হবে বিজ্ঞানী আশিস বসুর অবিস্মরনীয় আবিষ্কার ‘গ্রীন কার’। গ্রীন কার একটি নতুন ধরনের গাড়ির মডেল। যে গাড়ি পেট্রোলে নয়, চলবে হাইড্রোজেন গ্যাসে। হাইড্রোজেন-কার যদিও নতুন কোনও আবিষ্কার নয়, তবে আশিসের আবিষ্কারের অভিনব বিষয় হল, হাইড্রোজেন পেতে আশিস ব্যবহার করেছে জল আর এক ধরণের অদ্ভুত লতার রস। পরিবেশ বান্ধব ওয়াটার ফুয়েলড্ এই গাড়ির নাম দেওয়া হয়েছে তাই গ্রীন কার। ওয়াটার ফুয়েলড্ কার বাস্তবে সম্ভব নয়, এবং একে সমস্ত বিশ্বে এতদিন বলা হত সিউডোসায়েন্স, কিন্ত সেই সিউডোসয়েন্সকেই বাস্তবে পরিণত করে ফেলেছে আশিস। এই আবিষ্কারকে কব্জা করতে মাঠে নেমে পড়েছে দেশি বিদেশি নানা ধরনের শত্রু। শেষ পর্যন্ত কি জয়ী হতে পারবে সত্য, মানবতা আর বন্ধুত্ব?
(১)
গভীর রাত। ঘরের ভেতরের তরল অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল সুইচবোর্ডের উপর ইন্ডিকেটরের মৃদু লাল আলো একচোখো দৈত্যের মতো ঘরের বিছানার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। বিছানায় যে শুয়ে আছে তার নাম অপর্ণা। দরজার বাইরে ঠকঠক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অপর্ণার। অবশ্য হোটেল সংলগ্ন বার থেকে মাতালদের চীৎকার আর ডিজের তীব্র আওয়াজে আজ সারা রাত ভালো ঘুমই হয়নি তার। সবেমাত্র ঘুমটা গাঢ় হয়েছিল অপর্ণার। এমন সময়ই ঘরের দরজায় শব্দ তাকে হঠাৎ সচকিত করে তুলল।
রোড সাইড এই হোটেলটির নাম দিশা। যতটা জঘন্য পরিবেশ হতে পারে, এখানকার পরিবেশ তাই। দু একটা ঘরে যে রীতিমতো অসাধু কাজকর্ম চলে, তাও এখানে এসে চোখে পড়েছে অপর্ণার। তবুও রাতটুকু তাকে বাধ্য হয়ে এখানেই থাকতে হচ্ছে। ভোর হলে একটা কিছু ব্যবস্থা দেখে নিতে হবে তাকে। কিন্তু রাতটুকু ভালোভাবে কাটবে কি? অপর্ণার কেমন একটা অস্বস্তির অনুভূতি হচ্ছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সংকেত দিচ্ছে এখানে তার ভয়ানক বিপদ হতে পারে। এত রাতে তার রুমের দরজায় এখন কে এসেছে? অপর্ণা বিছানার উপর উঠে বসল, শুনতে পেল আবার দরজায় মৃদু খুট খুট। কাল সকালে এই হোটেলে এসেছে অপর্ণা। কাল রাত থেকে একটা নতুন দল এসেছে অপর্ণার উল্টোদিকের ঘরে। দুটো অবাঙালি ছেলে আর একটি নেপালি মেয়ে। রাতে এই হোটেলে নানারকম অসামাজিক কাজকর্ম হয়, এটা মনে করে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ আবার বিছানায় পড়ে রইল।
এই হোটেলে অপর্ণার যে বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নেই তা আজ বিকেলেই ভালোভাবে বুঝেছে সে। ঘটনাটা এত আকস্মিক যে অপর্ণা প্রথমটা বুঝতেই পারেনি। হোটেলের সামনে রাস্তায় একটু হাঁটছিল অপর্ণা। কতক্ষণ আর একা একা হোটেলের ঘরে বসে থাকা যায়? টিভি দেখতে সে পছন্দ করে না। সেদিনটার পর থেকে টেনশানে অনেকদিন আর বই পড়তেও ইচ্ছে করছে না তার। যে করেই হোক একবার দিল্লীতে পৌঁছে জিনিসটা আশিষের বোনকে দিয়ে দিতে পারলে তবেই সে কিছুটা নিশ্চিন্ত হবে। তারপর তার যা হওয়ার হোক, অপর্ণা নিজের আর পরোয়া করে না।
বিকেলবেলা যখন অপর্ণা রাস্তায় হাঁটছিল হঠাৎ সামনে একটা দুধ সাদা আইনোভা তার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় আর সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে গাড়ির ভেতর তুলে নিতে নেমে আসে দুজন লোক। তাদের পরনে শেরওয়ানী, মাথায় পাগড়ি, আর মুখে রুমাল বাঁধা। তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে কোথা থেকে ওখানে ছুটে এল উল্টোদিকের ঘরের সেই নেপালি মেয়েটা। তারপর ওর চীৎকারে আর রুখে দাঁড়ানোয় লোকগুলো অপর্ণাকে ছেড়ে হঠাৎ গাড়ি নিয়ে চম্পট দেয়। মেয়েটা সেই সময় এগিয়ে না এলে তার যে কী হত, ভাবতেও গায়ে এখনও কাঁটা দিচ্ছে অপর্ণার। আবার শব্দ! নাঃ এবার একবার উঠে দেখতেই হচ্ছে। অপর্ণা নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে দরজার চুলমাত্র ফাঁক থেকে দরজার বাইরেটা দেখতে চেষ্টা করল।
দরজার বাইরে করিডরে কম পাওয়ারের বালবের ঘোলাটে আলোয় অপর্ণা দেখতে পেল মেয়েটাকে। তার উল্টোদিকের রুমের সেই নেপালি মেয়েটা। যে কাল বিকেলে তার পরিত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু এত রাতে ও কেন এসেছে তার কাছে? মেয়েটা দরজায় শব্দ করছে আর বার বার চারিদিকে তাকাচ্ছে। অপর্ণা শেষমেশ দরজাটা খুলেই ফেলল। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে মেয়েটা তার ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলল,
‘এখান থেকে এখুনি ভাগো। নাহলে প্রাণে বাঁচবে না।’
বিস্মিত অপর্ণা কিছু বলার আগেই মেয়েটা বলল,
‘মন দিয়ে শোনো আমি যা যা বলছি। এখান থেকে বেরনোর আগে আমার জ্যাকেটটা পরে নিও। আমার জ্যাকেটে মাথা ঢাকা যায়। মাথাটা ঢেকে তাড়াতাড়ি এই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যাও। আর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করলে তোমার জীবনের ক্ষতি হতে পারে।’
‘তুমি কে? আমার জীবনের যে ঝুঁকি আছে জানলে কী করে?’
‘মনে করো আমি তোমার একজন শুভার্থী। ব্যস্ এখন এইটুকুই জানো। বড় রাস্তার উপর গিয়ে দাঁড়াও। আমার গাড়ি ওখানে আসছে। আমি তোমাকে যেখানে যাবে পৌঁছে দেব।’
রাত দুটো বেজে দশ মিনিট। অপর্ণার মাথা আর কাজ করছে না। কতদিন ধরে সে কেবল পালিয়ে চলেছে। মেয়েটার কথা হয়ত সত্যি। হয়ত নয়! তবে সে আর পারছে না। অপর্ণা মেয়েটার কথা মতো ওর জ্যাকেটটা পরে নিল। তারপর দরজার কাছে আসতেই মেয়েটা ওর পিঠে হাত রাখল। নরম গলায় বলল,
‘আমার নাম ইভা। আমার সঙ্গে পাশের ঘরে যারা আছেন তারা দুজনেই ভাড়াটে গুণ্ডা। ওরা তিন লাখ করে পাবে, তোমার লাশ দেখাতে পারলে। সো ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম, হারি আপ।’
ইভা অপর্ণার কাঁধে চাপ দিল। বলল,
‘ওদের দুজনকেই ঘুমের কড়া ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। কাল সকাল পর্যন্ত মোটামুটি নিশ্চিন্ত। তবুও কথায় বলে সাবধানের মার নেই।’
অপর্ণা তার কালো সাফারি ব্যাগটা এখন সব সময় গুছিয়েই রাখে। এখন বিনা নোটিশে তাকে যখন তখন বেরোতে হচ্ছে। ব্যাগটা হাতে করে আবার খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াল সে। এভাবে আর কতদিন যে আশিষের আবিষ্কারকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে, জানে না অপর্ণা। শত্রুপক্ষের হাত বিশাল লম্বা। পৃথিবীর এমন কোনও স্থান নেই যেখানে ওদের হাত এড়িয়ে সে থাকতে পারবে। দিল্লির সিবিআই অফিসে একবার পৌঁছে গেলে হয়ত কিছুটা নিরাপত্তা পেতে পারত সে কিন্তু দিল্লি পৌঁছনোর পথটা মোটেই নিরাপদ নয়। এক্সপ্রেস ট্রেনে বা প্লেনে উঠতে গেলেই তল্লাশির নাম করে সরকারি লোকজন সহজেই তার কাছ থেকে গাড়ির মডেলের যাবতীয় ডিটেলস্ হাতিয়ে নেবে। যদিও মোবাইলে পাসওয়ার্ড সেট করে পেপারস্ এর পিডিএফগুলো সে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। কিন্তু যে কোনও পাসওয়ার্ডই তো সহজেই ডিকোড করা যায়। আসানসোল পর্যন্ত যখন কোনওরকমে পৌঁছে গেছে সে, তখন দিল্লিও নিশ্চয় পৌঁছবে।
এমন সময় একটা কালো ফিয়াট গাড়ি এসে থামল অপর্ণার পাশে। অপর্ণা দেখল, গাড়ির ভেতরে ইভা বসে আছে। এরই মধ্যে ইভা সামান্য প্রসাধনও সেরে নিয়েছে। পরনে পোলকা ডট নীল টপ আর বডি হাগিং জিনস্। আদলটা নেপালি হলেও ইভা বেশ সুন্দরী। অপর্ণার মনে আবার সন্দেহ জট পাকাতে থাকে। ইভার কোনও বদ মতলব নেই তো? হয়ত হাইওয়েতে নিয়ে গিয়ে তাকে খুন করবে। যাতে অপর্ণা হোটেলের ঘরের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে আসে, সেইজন্যই হয়ত মিথ্যে গল্প সাজিয়েছে সে। হতেও পারে, সবটাই ওর একটা ফাঁদ। এখন বিশ্বাস অবিশ্বাস সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে অপর্ণার। ইভা গাড়ির দরজা খুলে দিল এবং অপর্ণা বাঁদিকে উঠে পড়তেই ড্রাইভার গাড়ি চালু করে দিল। স্বয়ংক্রিয় লক্ সিস্টেমে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। শীত-তাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতর অপূর্ব সুন্দর কার সেন্টের গন্ধ। অপর্ণা মোহিত হয়ে গেল। তার ভীষণ ঘুম পেতে লাগল। ইভা বোধহয় বুঝতে পারল অপর্ণার অবস্থা। আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে হেসে সে বলল,
‘একটু ঘুমিয়ে নাও। অনেকদিন তোমার ভালো ঘুম হয়নি।’
অবসন্ন আর ক্লান্ত অপর্ণা কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ির সিটে ঘাড় হেলিয়ে গাঢ় ঘুমের অতলে ডুবে গেল।
(২)
আশিস আর অপর্ণা ছোট থেকে এক স্কুলে পড়েছে। দুজনের তখন বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আশিস ছোট থেকেই ছিল অসম্ভব প্রতিভাবান। শুধু ভালো রেজাল্ট করার মধ্যেই ওর প্রতিভা সীমাবদ্ধ ছিল না, আশিষের এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। সে খুব ছোট থেকেই যে কোনও যন্ত্র নাড়াচাড়া করে খুলে আবার নতুন করে জুড়ে ফেলতে পারত। বড় হবার পর আশিস কানপুর আইআইটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে জার্মানি চলে গেল। অপর্ণা যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সল্টলেকের একটা আইটি কোম্পানিতে ঢুকল।
অপর্ণা অনেকদিন পর আশিষের খবর প্রথম পেল মনিদীপাদির কাছ থেকে। মনিদীপাদি এখন সল্টলেকে ওর অফিস কলিগ।
‘অপু, জানিস! পরশু তোদের ব্যাচের সেই আইআইটিয়ান ছেলেটাকে দেখলাম। মনে হল কেমন পাগল টাইপের হয়ে গেছে। আই ফিল ভেরি পিটি ফর হিম। ও মাই গড! ক্যান ইউ ইমাজিন! আই স হিম ক্রাইং লাউডলি। ইয়েস! হাউ হাউ করে কাঁদছিল! আর একা একা একটা নির্জন পার্কে বসেছিল। আমি ওর কাছে গিয়ে জানতে পারলাম, ওর মা মারা গেছেন। ও নাকি তাই জন্য চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছে। দেশই নাকি এখন ওর মা! আমার দেশ, আমার মাটি অ্যান্ড অল– অল দিস বোগাস টাইপ অফ সেন্টিমেন্ট। এখন শুনেছি কোথাও নাকি চাকরিও করে না। মে বি হি হ্যাস গন ম্যাড।’
‘ধুর! কী যা তা বলছো! ছোটবেলা থেকে জানি আশিস ওর মাকে খুব ভালোবাসত। হয়ত সেদিন ও কোনও কারণে আপসেট ছিল। ও ছোট থেকেই একটু ইমোশনাল টাইপ। এখন কোনও চাকরি সত্যিই করছে না? তুমি দেখছি আমাকে আশিষের জন্য ভাবিয়ে তুললে। আচ্ছা আমরা দুজনে একদিন ওর বাড়ি যাই চলো।’
‘ও হ্যাঁ, আমি আর তুই একই অফিসে আছি শোনার পর আশিস বারবার তোর ফোন নম্বর চাইছিল। ও তোকে বিরক্ত করতে পারে ভেবে আমি খালি তোর ল্যন্ডলাইন নম্বরটা ওকে দিয়েছি। আই গেস হি ইস ডায়িং ফর ইউ।’
বাড়ি ফিরে অপর্ণা মায়ের কাছে শুনল, আশিস বসু নামের একজন নাকি ল্যাণ্ডলাইনে সারাদিনে বার কুড়ি ফোন করে ফেলেছে।
তার মা ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। মা বলল,
‘কী ব্যাপার অপু? ছেলেটা কে? তোমার চেনা কেউ? এতবার তোমাকে ফোন করছে কেন?’
অপর্ণা বুঝল, মা খুব রেগে গেছে। রেগে গেলে মা তুমি সম্বোধন করে কথা বলে। অপর্ণা কিছু না বলে হাত মুখ ধুয়ে ডিনার করতে বসল। আজ অফিসে একটা ইমপর্টেন্ট প্রেসেন্টেশন ছিল। তাই বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে তার। ঘড়িতে রাত দশটা। ল্যাণ্ডফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠতেই অপর্ণা উঠে গিয়ে ধরল। ও প্রান্ত থেকে আশিস বলল,
‘আশিস বলছি।’
‘বল রে’
‘এতক্ষণে বাড়ি ফিরলি?’
‘আমার ফিরতে প্রায়ই দেরি হয়। মাসিমার কথা শুনলাম। খুব খারাপ লাগছে।’
‘হ্যাঁ। মা মারা গেছেন, একমাস হল। মারা যাওয়ার আগে তোকে খুব দেখতে চাইছিলেন।’
‘আমাকে? কেন? মানে মাসিমা কি আমাকে চেনেন?’
‘আমি এর আগে মাকে তোর ছবি দেখিয়েছিলাম।’
‘আমার ছবি কোথায় পেলি তুই?’
‘কেন! সোশাল মিডিয়ায় খুঁজে পেয়েছি। আমি তোর অ্যাকাউন্ট সার্চ করে ছবি বের করে মাকে দেখিয়েছিলাম।’
অপর্ণা সামান্য গম্ভীর হয়ে গেল। আশিস কি সত্যিই একটু পাগলাটে? তার মনে পড়ে গেল আশিস তাকে প্রায়ই মেইল করত। জার্মানি গিয়ে বহুবার ওকে মেইল করেছিল আশিস। ওর ল্যাব, ওর রিসার্চের বিষয়, সবই মোটামুটি জানিয়েছিল অপর্ণাকে। অপর্ণা ব্যাপারটাকে এতদিন পাত্তাই দেয়নি। এখন তার মনে হল, সত্যিই তো! তাকেই কেন মেইল করত আশিস? অপর্ণা তো আশিসকে ভুলেই গেছিল এতদিন। অপর্ণা গম্ভীর গলায় বলল,
‘আজ এতবার ফোন করেছিলি কেন?’
‘তোকে আমার কিছু বলার আছে। দেখানোরও আছে। খুব জরুরি দরকার। কাল একবার আমার বাড়ি আসবি?’
‘আচ্ছা অফিস ব্রেকে আমি আর মনিদীপাদি তোর বাড়ি আসব। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। অফিস কেটে আসব তো, তাই।’
‘ওই মহিলাকে সঙ্গে আনিস না। প্রতিটা কথা উচ্চারণ করার সময় এমন করে টানে না! শুনলেই গা জ্বলে যায়। তুই একাই আসিস, প্লিজ।’
দুপুরবেলা অপর্ণা আশিষের বাড়িতে এসে একেবারে তাজ্জব হয়ে গেল। আশিস প্রায় অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে। আশিস কার টেকনোলজি নিয়ে কাজ করছিল সেটা অপর্ণা জানত। আশিষের গোটা বাড়িময় অজস্র ছোট বড় গাড়ির মডেল আর কাগজপত্রের স্তুপ। আশিস অপর্ণাকে ওর ছাদের উপর ডেকে একটা মাঝারি আকারের গাড়ি চালিয়ে দেখাল।
‘গাড়িটা কেমন চলছে?’
‘ভালোই তো। বেশ ভালো খেলনা বানিয়েছিস দেখছি!’
‘এটা খেলনা নয়, একটা গাড়ির মডেল। গাড়িটা কীসে চলছে বলত?’
‘ব্যাটারিতে নিশ্চয়।’
‘না। এটা চলছে জলে। বেসিক্যালি এটা একটা হাইড্রোজেন কার। ফুয়েলের হাইড্রোজেন আসছে জলের অণু থেকে। জলকে কারেন্টের সাহায্যে অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন এ ভেঙে, সেই হাইড্রোজেন দিয়ে গাড়ি চলছে। ফুয়েল ট্যাঙ্কে আছে জল। জল ভাঙছে ব্যাটারির কারেন্ট থেকে। এমন একটা টেকনোলজি আবিষ্কার করেছি যাত, খুবই নমিনাল ইলেক্ট্রিসিটি লাগছে।’
‘হা হা হা জলে? সেই সিউডোসায়েন্স নিয়ে তুইও মাথা ঘামাচ্ছিস নাকি আজকাল।’
‘কেন? এমন বলছিস কেন?
‘প্রথমত, জলের এনথ্যাল্পি হল মাইনাস সিক্সটি এইট পয়েন্ট থ্রি কিলো ক্যালরি পার মোল। তার মানে হল জলকে তীব্র উত্তাপ না দিলে জলকে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন এ ভাঙা যায় না। জলের অণু খুবই স্টেবল। জলের অণুর বণ্ডিং হল কোভ্যালেন্ট বণ্ড। মানে খুবই স্থিতিশীল। তাই তীব্র তাপ দিয়ে জল ভেঙে হাইড্রোজেন নিয়ে গাড়ি চালানোর আগেই হাইড্রোজেন আবার পরিবেশের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে জলে পরিণত হয়, তাই এটা একটা অসম্ভব চেষ্টা।’
‘আর দ্বিতীয়ত?’
‘ধুর! এটাও তোকে বলতে হবে? তাহলে বলি শোন। জল ছাড়া যদি তুই গ্যাসোলিন থেকে পাইরেলেটিং প্রসেসে হাইড্রোজেন সংগ্রহ করিস কিংবা ইলেক্ট্রিক পাওয়ারে গ্যাসোলিন পুড়িয়ে হাইড্রোজেন সংগ্রহ করিস সেটা ভয়ানক খরচ সাপেক্ষ। তাহলে তো গ্যাসোলিন বা পেট্রোলেই গাড়ি চলতে পারে। সেটা বরং সস্তা হবে। তাছাড়া সেক্ষেত্রে হাইড্রোজেন পেতে হলে পেট্রোল পাম্পের মতো হাইড্রোজেন ফিলিং স্টেশানও রাস্তায় একটু দূরে দূরে থাকতে হবে। যেটা একটা বিরাট ইনভেস্টমেন্ট। আরও একটা ড্র ব্যাক হল গ্যাসোলিন থেকে পাওয়া হাইড্রোজেন এ অনেক হাইড্রোকার্বন এমিশান হবে এবং তাতে পরিবেশের ক্ষতি হবে।
এখনও পর্যন্ত বাজারে তিনটে হাইড্রোজেন কার এসেছে। কোটি টাকা দামের সেই গাড়িগুলো হল, টয়োটা মিরাই, হুণ্ডাই নেক্সো এবং হোণ্ডা ক্ল্যারিটি। এগুলোতে সাধারণত রিনিউয়েবল্ ফিডস্টক ব্যবহার হচ্ছে। এই ফিডস্টক এর উৎস যা কিছু হতে পারে— মানে সেটা বায়োডিগ্রেডেবল্ গারবেজও হতে পারে। তার থেকে পাইরোলাইটিক পদ্ধতিতে এই হাইড্রোজেন পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এখন যাতে গ্যাসোলিন ব্যবহার করতে না হয়। সেই ফিডস্টক পেতে সোলার এনার্জিও ব্যবহার হচ্ছে। সম্পূর্ণ পদ্ধতিটি এখনও খুবই ব্যয় সাপেক্ষ, তাই এইসব গাড়ির দামও আকাশ ছোঁওয়া। সারা বিশ্বেই এখন এই ধরণের গবেষণা চলছে।’
‘আমি কিন্তু প্লেন ওয়াটার মানে এইচ-টু-ও থেকেই এনার্জি পাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। এর মধ্যে কোনও ছলছুতো নেই। তুই আমার গাড়ির মডেলটা খুলে দেখতে পারিস। গাড়িটাতে আমার নিজস্ব ইনভেনশানে বানানো একটা মেশিন মডেল আছে। তোর কি খানিকটা সময় হবে? তাহলে কয়েকটা কথা বলতে পারি।’
‘বলতে পারিস, তবে খুব একটা বেশি সময় নেই হাতে। অফিস থেকে টিফিন ব্রেক এ এসেছি, আমাকে এখুনি যেতে হবে। তবে ব্যাপারটা জানতেও ইচ্ছে করছে।’
‘আমি কিছু বলার আগে গাড়ির মডেলটা আগে তুই খুলে দেখ।’
অপর্ণা গাড়িটা খুলে দেখল। ইঞ্জিনটা একটু অন্যরকম হলেও এনার্জি ট্যাঙ্কের ভেতর জলীয় একরকম দ্রবণ আছে। দ্রবণের রঙ সাদা। সে অবাক হয়ে বলল,
‘এটা কী রে? দইয়ের মতো দেখতে?’
‘সব বলছি।’
‘শিগগির বল। খুব কৌতূহল হচ্ছে।’
‘এটা জলই। আমি শুধু এরমধ্যে একটা জিনিস যোগ করেছি। তার আগে বলি, আমি যে কাজটা করেছি এর আগে খানিকটা এমন কাজই করেছিলেন একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী। তার নাম হল স্ট্যানলি অ্যালেন মেয়ার। তুই নেট ঘেটে দেখে নিস। নব্বই সাল নাগাদ তিনি একটি অটোমোবাইল ইঞ্জিন বানান, যার নাম হল পারপেটুয়াল মোশান মেশিন। এর মাধ্যমে খুব কম খরচে জল থেকে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। অবশ্যই জলকে ইলেক্ট্রিক্যাল চার্জ দিয়ে বিশ্লিষ্ট করা হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ওহিও কোর্ট তাকে জালিয়াত বলে অভিযুক্ত করেছিল।
ভদ্রলোক নিজের কাজটা কাউকে বিশ্বাস করাতেই পারেননি। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। প্রচুর দৌড়ঝাঁপ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন যে সরকার এবং কিছু কর্পোরেট সংস্থা একেবারেই চায় না যে সাধারণ মানুষ কম খরচের মেয়ারের এই মেশিনের নাগাল পাক। তিনি সংবাদপত্রে এই নিয়ে একটি রিপোর্টও লেখেন। তাতে লেখেন তার এই আবিষ্কার কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত করছে। তার মধ্যে বিরাট বিরাট গাড়ি নির্মাতা কোম্পানির ব্যক্তিবর্গও আছেন।
এরপরই প্রকাশ্য দিবালোকে মেয়ারকে খুন করা হয়। যেদিন তিনি খুন হন সেদিন তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বেলজিয়ামের বিখ্যাত গাড়ি নির্মাণ কোম্পানির দুজন আধিকারিক। যদি মেয়ার ফ্রডই হবেন তাহলে তার সঙ্গে অতবড় কোম্পানির ম্যানেজিং বডির লোকজন কেন দেখা করতে আসবেন? দিনটা ছিল ১৯৯৮ সালের ২০শে মার্চের এক সকাল। মেয়ার ও সেই গাড়ি কোম্পানির লোকদুটি শহরের একটি রেস্তোরায় খেতে বসেছিলেন। কথার মাঝখানে মেয়ার হঠাৎ ছুটে বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। সাহায্যের জন্য চিৎকার করেন। তাকে সাহায্য করতে পুলিশ ছুটে আসলে মেয়ার তাদের জানান, তাকে এইমাত্র তীব্র বিষযুক্ত খাবার খাওয়ানো হয়েছে। কথা বলতে বলতে তিনি সেখানেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
মেয়ারের ভাই তদন্ত দাবি করেন। ময়না তদন্তে মৃতের শরীরের রক্তে বা সিরামে টক্সিক এলিমেন্ট বা কোনও বিষ পাওয়া যায়নি। বলা হয়, হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গিয়েই নাকি মেয়ারের মৃত্যু হয়েছে। যদি তাই হবে তাহলে মেয়ার কী করে বুঝলেন তার মৃত্যু আসন্ন? একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের হঠাৎ এমন মৃত্যুতেও সরকারের তরফ থেকে অদ্ভুত উদাসীনত দেখা যায়। তবে শুনেছি এমন অনেক টক্সিক এলিমেন্ট আছে যা থেকে মৃত্যু হলে পরে শরীরে আর তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।
এর কিছুদিন পরে আমেরিকার আরও একজন বিজ্ঞানী, যিনি রিনিউবেল্ এনার্জি নিয়ে কাজ করছিলেন, তারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। তার নাম ফ্র্যাঙ্কলিন ম্যালভ। ম্যালভ ছিলেন একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী, সম্পাদক এবং একজন লেখক। তার লেখা একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম হল, ‘ফায়ার ফ্রম আইস’। ম্যালভ কাগজে এবং রেডিওতে মেয়ারের মৃত্যুর তদন্তের দাবি তুলেছিলেন এবং আর্টিকল্ এ লিখেছিলেন যে সরকার এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা চান না সুলভ এবং নতুন কোনও শক্তির উৎস আবিষ্কার হোক।
এরপরেই ২০০৪ সালে, তিনজন ভাড়াটে গুণ্ডা অতর্কিতে ম্যালভ এর পুরনো বাড়িতে এসে তাকে খুন করে যায়। তার গবেষণার সব কাগজপত্রও চুরি যায়। তদন্তে অনেকে ধরা পড়লেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। পাশের বাড়ির প্রতিবেশী সম্পূর্ণ ব্যাপারটি দেখতে পেয়ে থানায় অভিযোগ জানান। পুলিশ অভিযুক্তদের না পেয়ে তাকেই অভিযুক্ত হিসেবে তখন গ্রেফতার করে। তার খুনের নির্দিষ্ট মোটিভ খুঁজে না পেয়ে পুলিশের তরফ থেকে বলা হয় ম্যালভ ঘর পরিষ্কার করার সময় তার ঘরের কিছু আবর্জনা রাস্তায় ফেলেছিলেন এবং সেইজন্য হয়ত প্রতিবেশী ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে তাকে খুন করেছেন। এই যুক্তি একেবারেই হাস্যকর এবং এর সাপেক্ষে কোনও প্রমাণও পুলিশের হাতে না থাকায় ম্যালভের খুনের কোনও কিনারা হয়নি।
এই কথাগুলো বললাম কারণ আমিও এই গবেষণা করতে গিয়ে দেশে ও বিদেশে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়েছি। আজ তোর তাড়া আছে পরে না হয় একদিন তোকে সব বলবো।’
‘না না এখনই বল। এ কথা সবটা না শুনে আমি যাচ্ছি না। তুই এতবড় একটা কাজ করে ফেলেছিস! আমাকে তো শুনতেই হবে।’
‘না, আমার সামনে এখনও অনেকগুলো সমস্যা চলে এসেছে। সবটা আমি সমাধান করতে পারিনি। গবেষণাও পুরোটাই প্রাথমিক স্তরে আছে। ভেবেছিলাম তোকে সব বলবো কিন্তু এখন ভাবছি এর ফলে তোরও জীবনের ঝুঁকি থেকে যাবে। সবটা তোকে এখনই বলবো কিনা তাও ভাবছি।’
কথার মাঝখানেই অপর্ণার অফিস থেকে একটা ফোন চলে এল। আর অপর্ণা ছটফট করে প্রায় দৌড়ে অফিসে বেরিয়ে গেল।
অফিসে গিয়ে কাজে মন বসল না অপর্ণার। বাড়িতে ফিরতে যথারীতি রাত হল তার। সারাদিন তার মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকল। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, কী আশ্চর্য! আশিস কেন তাকেই এমন ভরসা করছে? তবে কি ও সত্যিই বরাবর তাকে মনে মনে পছন্দ করে? তাই কি সপ্তাহে সপ্তাহে তাকে এমন মেইল করে নিজের যাবতীয় কথা শেয়ার করত ও? আশিস একটা আশ্চর্য পাগলাটে ছেলে। বিদেশের রিসার্চ ছেড়ে দেশে ফিরে এসে নিজের রিসার্চ নিয়ে মেতে আছে। সত্যিই আশিষের এই বিশ্বসংসারে নিজের বলতে কেউ নেই। মা ছিলেন, তিনিও তো আর নেই! বাড়িতে গিয়েই অপর্ণা বুঝেছে, আশিষের খাওয়া শোওয়ারও কোনও ঠিক নেই। আশিষের বাড়ির ডাস্টবিনে অসংখ্য দোকানের চায়ের ভাড় আর হোটেলের খাবারের প্লাস্টিকের কৌটো চোখে পড়েছে অপর্ণার। অগোছালো আর পাগলাটে মানুষটার জন্য অপর্ণার মনের গভীরে কেমন একটা কষ্ট হয়। সে ভাবে আশিস তো আর সারাদিন কোনও ফোন করল না। নিশ্চয় তার উপর মনে মনে বিরক্ত হয়েছে। ওর কথাও পুরোটা শোনা হয়নি সেদিন। অপর্ণা ভাবে কাল সকালে অফিস গিয়ে একবার আশিসকে ফোন করবে সে। রাতে অপর্ণার ভালো ঘুম হয়নি তাই ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হঠাৎ ফোনের কর্কশ শব্দে তাড়াতাড়ি উঠে ফোন ধরল সে। ও প্রান্তে আশিষের গলা।
‘আমার বাড়িতে এখন একবার আসবি?’ অপর্ণা অবাক।
‘কেন রে? কি হয়েছে? কোনও দরকার?’
‘না, তেমন দরকার নয়। একটা বিষয় কাল সারারাত ধরে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম। বল্ না! পারবি আসতে?’
‘আজ তো অফিস আছে। এখুনি বেরোতে হবে।’
‘আচ্ছা, তাহলে আমি কি তোর অফিসে যাব?’
অপর্ণা একমুহূর্ত ভাবল। অফিসে আশিস তার সঙ্গে দেখা করতে এলে মনিদীপাদি এটা নিয়ে নানারকম গসিপ করতে পারে। অফিসে তাকে নিয়ে কোনও চাপা গুঞ্জন হোক অপর্ণা একদমই তা চায় না। তাই সে বলল,
‘তুই বরং অফিসের পর কোথাও চলে আয়, বসে কথা বলা যাবে। কোনও কাছাকাছি কফিশপে– কেমন?’
ও প্রান্তে আশিস কিছুক্ষণ নীরব। তারপর শ্বাস ফেলে বলল,
‘বেশ তাই হোক তাহলে। আমি পাঁচটায় তোদের অফিস বিল্ডিংয়ের নিচে থাকব। তুই চলে আসিস।’
ঠিক পাঁচটায় মোবাইলে আশিষের কল,
‘চলে আয়, দাঁড়িয়ে আছি।’
অপর্ণা তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ শাট ডাউন করে একছুটে গিয়ে লিফ্টে উঠল। দেরি করলে আশিসই হয়ত অফিসে এসে উপস্থিত হবে।
অপর্ণা নিয়োগী। বয়স পঁচিশ। পরনে কাশ্মিরী কাজ করা সাদা ফুল হাতা কুর্তি আর নেভি ব্লু জিনস্। চুলে শর্ট ব্লান্ট কাট। হেয়ার কাটে বেশ স্মার্ট আর ঝকঝকে লাগছে ওকে। চোখে ব্লু ফ্রেমের চশমা। শ্যামলা ছিপছিপে চেহারা, উচ্চতা বেশ কম, মাত্র পাঁচ ফুট।
বাসস্টপে দাঁড়িয়েছিল আশিস বসু। লম্বায় পুরো ছয় ফুট। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। ব্যায়াম করা টানটান ঋজু শরীর। চুল এত ছোট করে কাটা যে দূর থেকে মাথা ন্যাড়া বলে মনে হয়। আশিষের কথা হল যাতে কেউ তার চুলের মুঠি ধরে টানতে না পারে তাই তার এই স্পেশাল হেয়ার কাট। চোখে হাই পাওয়ারের মোটা কাচের চশমা। তবুও তার ভেতর থেকে চোখে পড়ে ওর উজ্জ্বল দুটো চোখ। আশিস আজ পরেছে অফ হোয়াইট টি শার্ট আর ফেডেড জিন্স। অপর্ণাকে দেখতে পেয়ে আশিস হেসে হাত নাড়ল। একটু পরে ওরা দুজন সিটি সেন্টারের একটা বিদেশি স্ন্যাকস্ বার এ এসে বসল।
অপর্ণা দুটো কফির কুপন কেটে বিল মিটিয়ে দু কাপ কফি নিয়ে এল দুজনের জন্য। আশিস নিবিষ্ট মনে ওর ফোনে কি একটা দেখছিল। তাড়াতাড়ি কফির কাপে চুমুক দিয়ে অন্যমনষ্কভাবে বলল,
‘আজ সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি রে। কিছু খাওয়া না! আমার এখন শুধু একটা স্যাণ্ডউউচ হলেই হবে।’
অপর্ণা আবার গিয়ে একটা লার্জ চিকেন স্যাণ্ডউইচ নিয়ে এল। আশিস ওটা দ্রুত খেতে খেতে বলল,
‘তুই কিছু খাবি না?’
‘না। আজ দুপুরে অফিসে একজন ট্রিট দিয়েছিল, বেশ দেরি করে খেয়েছিলাম। এখন আর কিছু খাব না। তুই কী যেন বলবি বলছিলি? আমার কিন্তু ফেরার তাড়া আছে। মাকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরবো বলে এসেছি। দেরি হলে মা আবার চিন্তা করবে’
‘হ্যাঁ বলবো। তাই তো তোকে ডাকলাম।’
‘কী বলবি তাড়াতাড়ি বল্।’ অপর্ণা কবজিতে ঘড়ি দেখল একবার।
‘বলছি যে তুই আমাকে বিয়ে করবি? আমি জানি এই মাসে বিয়ে করা যায়। আমার খুব তাড়া আছে রে। তুই কি রাজি?’
কথাটা শুনে অপর্ণা শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে টেবিলে মাথা রাখল সে। আশিস অসহায়ের মতো অপর্ণাকে হাসতে দেখতে লাগল। অপর্ণার জোরে হাসি শুনে কয়েকজন পাশাপাশি টেবিল থেকে তাদের দিকে তাকাতে লাগল। অপর্ণা বলল,
‘ওরে! তুই পাগল জানতাম, এখন দেখছি তোর মাথাটা পুরো গেছে।’
আশিস কিন্তু একটুও হাসল না। গম্ভীরভাবে বলল,
‘এখন অনেক কিছু আমি একা মনে রাখতে পারছি না। আমার তোর মতো একজন বিশ্বস্ত, বুদ্ধিমতী সর্বক্ষণের সঙ্গী দরকার। বিয়ে না হলে তো তোকে রাত বিরেতে কাছে পাব না! অবশ্য ছোট থেকে আমি মনে মনে বরাবর তোকেই বিয়ে করব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু তুই রাজি না থাকলে তো আর এটা হবে না!’
অপর্ণা কিছু বলার আগেই বিশ্রী কাণ্ডটা ঘটে গেল এক নিমেষে। অপর্ণাদের পাশের টেবিলের দুজন অল্পবয়সী জাপানি ছেলের একজন হঠাৎ আশিষের মোবাইল ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে সোজা দরজার দিকে ছুটে গেল। আশিস উটে দাঁড়াতেই ওকে থামাতে অপর জাপানি ছেলেটা এসে একটা ছুরি আশিষের বাঁ হাতে বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আশিষের বাঁ হাতটা রক্তে ভেসে যেতে লাগল। ঘটনাটা যেন পলক ফেলার মধ্যে ঘটে গেল। এরপর যেটা ঘটল সেটা আরও অদ্ভুত। আশিষের ডান হাতে একটা ছোট রিমোটের মতো দেখতে জিনিস ছিল। আশিস ওর লাল রং এর বোতামটাতে চাপ দিল। কী যে হল ঠিক বোঝা গেল না। তবে যে ছেলেটা সবে দোকানের বাইরে মোবাইল ফোন হাতে বেরিয়েছিল– কাটা তালগাছের মতো পড়ে গেল সে। অপর্ণা ছুটে গিয়ে ছেলেটার হাত থেকে আশিষের ফোনটা তুলে নিল। অপর্ণা দেখল, ছেলেটার যে হাতে ফোনটা ছিল তাতে যেন কী একটা হয়েছে। তীব্র শারীরিক যন্ত্রনায় ছেলেটা প্রায় হতচেতন হয়ে গেছে। আশিসকে ছুরি মেরেছিল যে ছেলেটি, আশিস তাকে একা হাতেই কব্জা করে ফেলল। আশিষের পেশীবহুল হাতের দু একটা ঘুসি খেয়ে ছেলেটার আর ওঠার ক্ষমতা থাকল না।
অপর্ণা একটা রুমাল আশিষের কাটা জায়গায় চেপে ধরল। বলল,
‘মনে হচ্ছে স্টিচ করতে হবে।’
চারপাশটা ক্রমশঃ লোকজনে ভরে যাচ্ছে দেখে ওরা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। নার্সিংহোম থেকে ড্রেসিং করিয়ে অপর্ণা আর আশিস একটা ক্যাব বুক করে তাতে উঠল। অপর্ণা বলল,
‘কীরে! খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?’
‘খুব একটা না। পেইনকিলার ওষুধ আর ইঞ্জেকশান দিয়েছে।’
অপর্ণা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্লান্ত লাগছে?’
‘হ্যাঁ রে! কদিন ধরে বড্ড ঝামেলা যাচ্ছে। তোর কাঁধে একটু মাথা রাখব? আমার না কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে।’
অপর্ণা বাধা দিল না। আশিস মাথা নামিয়ে আনল। একটু পরেই আশিস বিরক্তভাবে বলল,
‘ধুর! তুই এত বেঁটে না! আমার ঘাড়ে পুরো ব্যথা হয়ে গেল।’
অপর্ণা কপট রাগে আশিসকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘যা তো যা! আমি বেঁটে। আমি কি তোকে আমার কাঁধে মাথা রাখতে বলেছিলাম? সোজা হয়ে বোস। বাড়ি এসে গেছে।’
অপর্ণা আশিষের বাড়ি পৌঁছে দেখল আশিষের রাতের খাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই। আশিষের ছন্নছাড়া রান্নাঘর দেখে অপর্ণার মন খারাপ হয়ে গেল। সে রান্নাঘরে ঢুকে চা বসাল। যদিও সারাদিন অফিসের পর ওর ও ক্লান্ত লাগছিল। অপর্ণাকে কিচেনে দেখে আশিস হাসিমুখে বলল,
‘চা করছিস? বাহঃ ভেরী গুড। রাতের জন্যও কিছু করে দিস প্লিজ। কিছুদিন আগেও মা-ই এসব দেখত। মা চলে যাওয়ার পর আমার এখনও ঠিক অভ্যেস হয়নি। আমার না খুব হাতে ব্যথা করছে এখন।’
‘খুব আবদার হয়েছে না তোর! আমি এতসব পারব না যা! চা রেডি। এখন খেয়ে আমাকে উদ্ধার করা হোক। ফ্রিজে বাদাম আছে দেখলাম। বারান্দার টবে মাসিমর লাগানো কারি পাতার গাছ থেকে পাতা নিয়ে বাদাম আর কারি পাতা দিয়ে চিড়ে ভেজেছি। চা এর সঙ্গে টা। আর শোন, ফ্রিজে দুধ ছিল না তাই লাল চা বানিয়েছি।’
‘ওয়াও! সো নাইস অফ ইউ! দে দে শিগগির দে! আমার খুব খিদে পেয়েছে।’
‘তোর সারাদিন খালি খিদে! রান্না যে করবো, তোর ফ্রিজে আনাজ পাতি কিছু আছে?’
‘ফ্রিজে মনে হয় আনাজ আছে। আমি কয়েকদিন আগে একবার রান্না করার চেষ্টা করেছিলাম। ওসব আমার ধৈর্য্যে কুলায়নি বলে কিছু সবজি ফ্রিজে এখনও আছে।
অপর্ণা তাড়াতাড়ি ফ্রিজ খুলে রান্নার উপকরণের খোঁজে চোখ বুলিয়ে নিল। ফ্রিজে আছে শুধু বেগুন, পেঁপে আর টমেটো। অপর্ণা আলু, পেঁপে, টমেটো, চাল আর মুগ ডাল ধুয়ে কুকারে চাপিয়ে ওভেনে বসিয়ে দিল। বেগুনটা নুন হলুদ মাখিয়ে অন্যদিকে চটপট ভেজে নিল। কুকারে সিটি পড়লে ভেন্ট ওয়েট তুলে একটু মাখন দিয়ে রাখল। বাড়িতে ঘি নেই। পুরো কাজটা ঠিক আধ ঘন্টার মধ্যে করে ফেলল অপর্ণা। বলল,
‘তোর রাতের খাবার করে দিলাম। এতে তোর কাল দুপুর পর্যন্ত মোটামুটি চলে যাবে। কাল দুপুরে যখন খাবি শুধু একটা ডিম ভেজে নিস।’
আশিস কয়েকবার বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আরে! দারুণ গন্ধ বেরোচ্ছে, মনে হচ্ছে একেবারে একঘর রেঁধেছিস– ব্যাপক! এত তাড়াতাড়ি কী চমৎকার রান্না করলি রে বাবা!’
‘খেয়ে বলিস। তখন নুন বেশি হলে খেতে খেতে আমাকে গাল দিবি! আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি, অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
‘একবার শোন!’ আশিস অপর্ণাকে ডাকল।
‘তাড়াতাড়ি বল্। আমার কিন্তু রাত হচ্ছে!’
‘আজ রাতটা আমার কাছে থেকে যা। খেতে বসে তোকে গাল দিলে তোর সামনেই দেব।’
‘তার মানে?’
‘আরে! আমি খারাপ মানুষ নই। তোর কোনও ভয় নেই। কপালে সিঁদুর না ছুঁইয়ে আমি তোকে ছোব না।’
‘বাড়িতে মা আছেন! মাকে কী বলব?’ বিপন্ন গলায় অপর্ণা বলল।
‘বলবি তোর মুণ্ডু। পঁচিশ বছরের একটা মেয়ে সারাক্ষণ মা-মা করছে! আমি যখন জার্মানিতে ছিলাম কত মেয়ের সঙ্গে রাত থেকেছি, এরকম তো আমাকে কেউ বলেনি।’
‘কী বললি? তুই রাতে মেয়ে নিয়ে থাকতিস?’
‘আই মিন এক্স্যাক্টলি হোয়াট আয়াম সেইড। হ্যাঁ থাকতাম। তোর তাতে হিংসে হচ্ছে? তুই তো আমাকে বিয়ের জন্য এখনও হ্যাঁ বলিসনি। তোকে এত কিছু বলব কেন?’
অপর্ণা যেন ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ঘরের বাইরের প্যাসেজে গিয়ে জুতোয় পা গলাতে গলাতে বলল, ‘আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি চলে যাচ্ছি।’
‘ওরে বাবা! এত দেরি দেরি করিস না। আসলে তুই হিংসে করে আর রাগ করে চলে যাচ্ছিস সেইটা বল্।’ আশিস হো হো করে হাসতে থাকে। হাসি দেখে অপর্ণার সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে। সে বলে,
‘দেখ! এইসব ছেলেমানুষির বয়সটা না আমার আর নেই। তবে চরিত্রহীন মানুষ আমার একদম ভালো লাগে না।’
‘হ্যাঁ। তোর রাগই হচ্ছে। তার মানে তুইও আমাকে ভালোবাসিস। শোন, আমার হাতে না খুব ব্যথা করছে। প্লিজ চলে যাস না। আর একটা কথা শুনে যা, সেটা হল তুই একটা স্টুপিড।’
‘কী বললি?’ অপর্ণা চিৎকার করে উঠল।
আশিস অপর্ণার সামনে ছুটে এসে ওর হাতটা ধরতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওরে, আমার সঙ্গে কোনওকালে কোনও মেয়ে রাতে থাকেনি। আমার প্রাণমন জুড়ে ছোট থেকে শুধু তুইই ছিলিস। বিশ্বাস করতে পারিস, আমি মিথ্যে বলছি না।’
আশিষের কথা শুনে অপর্ণার মুখটা হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল আর ওর লজ্জা পাওয়া মুখটা মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে আশিস বলে উঠল, ‘তাহলে কি ধরে নেব তুই আমাকে বিয়ে করতে রাজি?’
‘আচ্ছা বিয়েপাগলা বুড়োর পাল্লায় পড়া গেল তো! চুপ কর্।’
‘আচ্ছা! মেয়েরা এত দাম যে কেন বাড়ায় বুঝি না! সোজাসুজি বল্ না যে তুই রাজি!’
ওদের কথার মাঝখানে ল্যাবের জানলার কাছে খুব জোরে হুড়মুড় করে কী যেন একটা জিনিস পড়ে গেল মনে হল। ওরা তখন দুজনেই ঘরের বাইরের প্যাসেজে দাঁড়িয়েছিল। দুজনেই তীব্র ক্ষিপ্রতায় একসঙ্গে ছুটে গেল। ঘরের ভেতরে এইমুহূর্তে জানলার কাচের শার্সি ভেঙে একজন ঢুকে পড়েছে। মঙ্গলয়েড ফেস। দেখে চাইনিস বা জাপানিস মনে হচ্ছে। লোকটার হাতে স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক একটা আগ্নেয়াস্ত্র। সে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বলল,
‘স্টপ! ডোন্ট মুভ। হ্যাণ্ডওভার অল দ্য পেপার্স ইউ হ্যাভ মেড। উইদ দ্যাট ইওর ওয়াটার সলিউশান ফর্মুলা। কুইক! অর এলস্ আই উইল স্পট ইউ বোথ।’
‘কী সাংঘাতিক!’ অপর্ণা তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠল।
সে ভয়ে আশিষের কাঁধ জোরে খামচে ধরল। আশিস কিন্তু সুপার কুল। শান্ত স্বরে উত্তর দিল, ‘ওকে। বাট ইউ হ্যাভ টু ওয়েট– আই নিড সাম টাইম টু গ্যাদার অল দিস– আদারওয়াইজ ইউ উইল নট আণ্ডারস্ট্যাণ্ড দ্য ফর্মূলা।’
আশিস অপর্ণাকে চোখ টিপে ইশারা করল নিচে বসে পড়তে। অপর্ণা টেবিলের নিচে বসে পড়ল। দুজনেই টেবিলের নিচের ক্যাবিনেট থেকে থেকে রাশি রাশি কাগজের স্তূপ বের করতে শুরু করল। আশিস অপর্ণাকে বলল,
‘ভয় পাবি না। যা বলছি করে যা। তুই হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের একদম নিচের দিকে ঢুকে যা। এই মালটাকে আমি দেখে নিচ্ছি।’
লোকটা বলে উঠল, ‘হোয়াট ডিড ইউ সে? ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভার স্মার্ট ওকে! হু ইস শী? ইওর গার্লফ্রেণ্ড?’
আশিস বিরক্ত স্বরে বলল, ‘দ্যাটস্ নান অফ ইওর বিসনেস। ক্যাচ ইট।’
একটা মোটা ফাইল লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারল সে। একহাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জাবদা ফাইলটা লুফে নিতে পারল না লোকটা। নিচু হল ফাইলটা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য। এবার লোকটার মুখ আশিষের ডান হাতের খুব কাছে। অপর্ণা কিছু বোঝার আগেই লোকটা আশিষের ডানহাতের প্রচণ্ড একখানা ঘুষি খেয়ে উল্টোদিকে ছিটকে পড়ল। লোকটার হাতে তখনও মেশিনগানটা ধরা। শুয়ে পড়েই উঠে বসার মধ্যে যে কয়েক সেকেণ্ডের গ্যাপ ছিল। তার মধ্যেই আশিস ওর ইলাস্টিকের মতো অসম্ভব নমনীয় শরীরটা লোকটার বুকের উপর তুলে দিল। মেশিনগান ধরা লোকটার ডানহাতটা মুচড়ে ধরে পকেট থেকে একটা ছোট্ট অস্ত্র বের করল সে। অস্ত্রটা একটা ছোট টর্চের মতো দেখতে। অস্ত্রটা লোকটার ঘাড়ের পেছনে রেখে বোতাম টিপল আশিস। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেল লোকটা। আশিস মেশিনগানটা নিজের হাতে নিয়ে নিল অনায়াসে। লোকটা এবার ভয় পেয়েছে। আশিস লোকটাকে ঠেলে তুলল। তারপর অপর্ণার দিকে তাকিয়ে শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল,
‘খুনোখুনি, মারপিট আশিস বসু ঘৃণা করে। ওকে ছেড়ে দিচ্ছি।’
লোকটাকে একটা ধাক্কা মেরে বলল, ‘লিভ দিস প্লেস অ্যাট ওয়ানস্– গেট আউট!’
ঘাড়ের পেছনে বারবার হাত বুলাতে বুলাতে লোকটা জানলার কার্নিশ বেয়ে নিচে নেমে গেল।
অপর্ণা ভয়ে বিস্ময়ে একেবারে হতবাক। একটু পরে বলল, ‘আশিস তুই ঠিক আছিস তো?’
‘আরে একদম ফার্স্টক্লাস!’
‘আবার ইয়ার্কি! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ সব খুলে বল্। এরা কারা? এরা তোকে বারবার অ্যাটাক করছেই বা কেন? এদের উদ্দেশ্য কী? তুই তো দেখছি হিন্দি সিনেমার নায়কের মতো সবটা দারুণ ম্যানেজ করলি!’
‘তুই পাশে থাকলে এমনিতেই আমার নার্ভ একদম টানটান থাকে। তাই পেরে গেলাম।’
‘না, না আমাকে সব বল্, আর ইয়ার্কি করিস না।’
‘আচ্ছা সব বলছি। আজ থাকছিস তো?’
‘হ্যাঁ থাকব। থাকতেই হবে, কারণ তোকে একলা ছাড়তে এবার আমার ভয় করছে।’
(৩)
আশিষের কথা
“আমি এমটেক করিনি। কানপুর আইআইটি থেকে বিটেক করে আমি জার্মানির AACHEN এ একটা প্রোজেক্টে কাজ করার চান্স পেয়ে চলে গেছিলাম। প্রোজেক্টটা ছিল ইকোফ্রেণ্ডলি কার এর উপর গবেষণা সংক্রান্ত প্রোজেক্ট। ইকো ফ্রেণ্ডলি কার মানে হল পরিবেশ বান্ধব গাড়ি। মানে যে গাড়ি পরিবেশের কোনও ক্ষতি করবে না। সোজা ভাষায় যে গাড়ির ইঞ্জিন চললে কোনও পরিবেশ দূষণ হবে না, এই আর কি।
জার্মানিতে লিকুইড হাইড্রোজেনের সাহায্যে বিদ্যুত তৈরির মাধ্যমে গাড়ি চলানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। আমি ওখানে ছিলাম একজন নগণ্য টেকনিক্যাল অ্যাসিট্যান্ট। যেহেতু পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন নেই আমার কোনও মন্তব্য ওরা পাত্তাই দিত না। আমার মাথায় তখনই একটা চিন্তা আসে। সেটা ওদের বলতেও চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু লাভ হল না। তখন ভাবলাম দেশে ফিরে যাব। মা-ও একা একা থাকে। ফিরে এসে বাড়িতে একটা ছোটখাটো গবেষণাগার বানিয়ে নিজের মতো কাজ শুরু করলাম। ব্যাঙ্কে বাবার কিছু জমানো ফিক্সড ডিপোসিট আর সুদের টাকায় আমার আর মায়ের মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। আমার কাজও একটু এগিয়েছিল। এরপরই মায়ের শরীর খারাপ হল এবং মা হঠাৎই একদিন না ফেরার দেশে চলে গেল। আমি তখন খুব ভেঙে পড়েছিলাম। খাওয়া দাওয়া করতাম না ভালো করে। সবসময় মাকে দেখতে ইচ্ছে করত, তোকেও খুব দেখতে ইচ্ছে করত। মানসিকভাবে দুর্বল মানুষ নানারকম স্বপ্ন দেখে। আমিও স্বপ্ন দেখতাম। এক একদিন এক এক রকম গাড়ির ইঞ্জিনের নকশা, আরও কত কিছু। কখনও মা আসত স্বপ্নে। আমাকে খেতে বলত, কাজ করতে বলত। আসলে এগুলো সব আমারই অপর একটা মনের কথা, স্বপ্নের মাধ্যমে শুনতাম। ভেবেছিলাম যদি কোনওদিন সফল হই তোকে ঠিক খুঁজে বের করবো একদিন, তা সে যেভাবেই হোক!
ছোট ছোট যন্ত্রাংশ জুড়ে দু-একটা গাড়ির মডেল বানালাম। তাতে আমার বানানো পারপেটুয়াল মোশান মেশিন জুড়লাম। এবার আসল কাজ করতে হবে। জল থেকে অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন বানাতে চাইছিলাম। এর জন্য প্রচুর তাপমাত্রা দরকার। কাজ এগোচ্ছিল না। জলের বণ্ডিংটা যদি কিছু মিশিয়ে একটু দুর্বল করা যায় তাহলে জল কম তাপমাত্রায় বিয়োজিত হতে পারে। সেটা যে ঠিক কী হতে পারে, কিছুতেই মাথাতেই আসছিল না। বহু রাসায়নিক মিশিয়ে দেখলাম কাজের কাজ কিছুই হল না। হঠাৎ মাথায় এল একটা কথা। ছোটবেলায় মাকে দেখেছিলাম আমাদের বাগানের একটা লতানো গাছ থেকে পাতা নিয়ে জলে চটকে গরমের সময় খেত। আশ্চর্য হল, দু একটা পাতা নিয়ে জলে চটকালেই জল জমে সাদা হয়ে দইয়ের মতো জমে যেত। মা গাছটার নাম বলত জলজমানী বা ছিলিঘন্ট। অনেকে একে দইখই লতাও বলেন। কিন্তু গাছটা তো চিনি না। কোথায় পাব এই গাছ? বাগান থেকে যাবতীয় লতার পাতা তুলে নিয়ে জলে চটকে দেখলাম হচ্ছে না। তখন আয়ুর্বেদিক উদ্যানের কথা মনে পড়ল। নরেন্দ্রপুরে এমন একটা আয়ুর্বেদিক উদ্যান আছে শুনেছিলাম। একদিন সকালে ওখানে চলে গেলাম। দেখলাম ওখানে একটা আয়ুর্বেদিক হাসপাতালও আছে। পরিবেশটা খুব সুন্দর, শান্ত আর নিরিবিলি। জল দইয়ের মতো জমে যাওয়ার কথা শুনে ওখানকার একজন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার বললেন,
‘এ তো আয়ুর্বেদিক গুণসম্পন্ন দইখই লতাই মনে হচ্ছে। এ লতার দই গরমের সময় শরীর স্নিগ্ধ রাখে, ত্বক উজ্জ্বল করে। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম হল Cocculus hirsutus। এর গায়ে ছোট ছোট রোম বা রোঁয়া আছে, তাই স্পিসিস এর নাম হিরসুটাস। এ লতা এই উদ্যানেই আছে।’
তারপর তিনি আমাকে বাগানে নিয়ে গিয়ে লতাটা চিনিয়ে দিলেন।
আমি অনুমতি নিয়ে ওখানকার মালিদের কাছ থেকে একটু বীজও চেয়ে আনলাম। বীজ থেকে নিজের বাগানে ওই গাছের অনেক চারাও পেলাম। ব্যস্! তারপর আমি জলে ওই পাতার রস মিশিয়ে দিতেই একটা ঘন থকথকে দ্রবণ পেলাম। সেই দ্রবণে সামান্য চার্জ দিতেই জল বিয়েজিত হয়ে সহজেই অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন এ ভেঙে গেল। আমি ইঞ্জিন ট্যাঙ্ক এ সেটা রাখলাম। অক্সিজেন এক্সিট পাইপ দিয়ে বাইরে বাতাসে মিশে যাবে।
হাইড্রোজেন হল একটি অসাধারণ গ্যাস এর ক্যালরিফিক ভ্যালু সবচেয়ে বেশি। তাই ফুয়েল হিসেবে হাইড্রোজেন যদি ব্যবহার করা হয় তাহলে গাড়ির এফিসিয়েন্সি অনেকগুণ বেড়ে যায়। খুব অল্প পরিমান গ্যাসে গাড়ি বহুদূর পথ যেতে পারে এবং এই গাড়ি চললে জল বিয়োজিত হয়ে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পরিবেশে মিশবে অক্সিজেন। আমি সাধারণ জলেই কোকোলাসের পাতা মিশিয়েছিলাম। তাই দইখই পাতাই হল হাইড্রোজেন পাওয়ার মূল উৎস যা একধরণের অনুঘটকের কাজ করছে। যখন জলকে মৃদু ইলেক্ট্রিক চার্জ দেওয়া হচ্ছে তা জলকে সহজেই অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন এ ভেঙে দিচ্ছে।
আমার পরীক্ষামূলক গাড়ির মডেল ও আমার বানানো ফুয়েল দুটো নিয়ে তৈরি গ্রীন কার আমার ছাদে বেশ ভালোই চলল। এরপর যোগাযোগ করলাম হরিয়ানার মারুতি উদ্যোগে। আমার আবিষ্কার সফলভাবে ভারতের রাস্তায় চললে কী হবে একবার ভাবতে পারছিস? ভারতের অর্থনীতির চেহারাটাই বদলে যাবে। সেদিন ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন পাবে। বিদেশ থেকে আর কোটি কোটি টাকার তেল আমদানি করতে হবে না। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ হবে। আরও কত যে সুফল হবে তা আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। তবে এটুকু বলতে পারি, সেদিন মাকে খুব পাশে চাইছিলাম।
আমি যাবতীয় ডিটেলস্ নিয়ে হরিয়ানা চলে গেলাম। মারুতি উদ্যোগের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ কে আদবানী আমার সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু তিনি আমার কাগজপত্র না দেখেই আমাকে আমার গোটা কাজটা সংক্ষেপে ওঁকে বলতে বললেন। উনি যেই জলের মধ্যে গাছের রস মেশানোর কথা শুনলেন ওমনি আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। আমার মডেলটা ভালো করে না দেখেই আমাকে চরম বিদ্রূপ করলেন। একেই আমার এমটেক বা মাস্টার্স বা পিএইচডি নেই তার উপর গাছপালার কথা শুনে উনি আমাকে একজন প্রতারকই মনে করলেন। বললেন, গাড়ি চালানোর চেষ্টা না করে আমি যেন জলে ওই পাতার রস মিশিয়ে আয়ুর্বেদিক কোনও ওষুধ বানাই। সুতরাং ওখান থেকে আমাকে খালি হাতেই ফিরতে হল।
কোনও বিজ্ঞান বিষয়ক বড় ম্যাগাজিনে আমার আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করতেই পারবো না কারণ আমার নূন্যতম যোগ্যতা পিএইডি ডিগ্রি নেই। আমার খুব হতাশ লাগল। কী করব? কীভাবে এগোবো বুঝতে পারছিলাম না। জাপানের নামকরা দুটো গাড়ি আমাদের দেশে খুব ভালো চলে। এরপর আমি ঠিক করলাম তাদের সঙ্গেই একবার যোগাযোগ করে দেখি। আমি তাদের ডিরেক্টরকে মেইল করলাম। একজন উত্তর দিলেন। ওঁদের একজন এজেন্ট দিল্লিতে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। এমনকী আমার দিল্লি যাওয়ার খরচও ওঁরাই দেবে বললেন। আমিও খুব উৎসাহ পেয়ে দিল্লি ছুটে গেলাম। ওখানে গিয়ে শুনলাম, আমার পুরো কাজটা ওরা মোটা টাকায় কিনে নিতে এসেছে। আমি জলে ঠিক কী মিশিয়েছি সেইটাই ওরা বিশেষত জানতে চাইছিলেন। ওরা দ্রবণটাকে ফর্মূলা বলছিলেন। কথা বলে জানতে পারলাম, ওরা আমাকে কোনও পেটেন্ট তো দেবেই না, তার উপর আমার আবিষ্কারে আমারই কোনও নাম থাকবে না। সব থেকে বড় কথা হল এই আবিষ্কারে আমার দেশের কোনও নাম থাকবে না। আমি কী করে ওদের প্রস্তাবে রাজি হব! ওখান থেকেও তাই ফিরে এলাম এবং অবশ্যই ওদের সব শর্ত নাকচ করে দিলাম।
এরপর থেকেই শুরু হয়েছে হুমকি দিয়ে ফোন করা– আর এখন তো দেখছি সরাসরি ফিল্ডে নেমে পড়েছে ওরা। এই অবস্থায় আমার যে কী করা উচিৎ কিছুই বুঝতে পারছি না।’
অনেকক্ষণ ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আশিষের কথা শুনছিল অপর্ণা। সে এবার কথা বলল,
‘এখন মনে হয় আমাদের পুলিশের সাহায্য নেওয়া উচিৎ। তোর গাড়ির মডেলের স্কেচ এবং যাবতীয় পেপার ওয়ার্কস পিডিএফ করে ফোনেও একটা কপি সেভ করে রাখ। আমার কাছেও, মানে আমার ফোনেও একটা কপি দিয়ে রাখ। দুজনেই পাসওয়ার্ড দিয়ে ফোন লক্ করে রাখব। যদি তোর সব ডক্যুমেন্ট কখনও চুরিও যায় আমারটা অন্তত থাকবে। এটা আমি এখনই করে রাখছি।’
(৪)
তীব্র একটা ঝাঁকুনিতে অপর্ণার ঘুম ভেঙে গেল। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। রাতে সে গাড়ির সিটে বসা মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছিল। অপর্ণা তাকিয়ে দেখল বাইরের অন্ধকার এখন খানিকটা পাতলা হয়ে গেছে। ভোর হতে চলেছে। তবে কি তারও সব বিপদ কেটে গেল? ভগবান তাকে সাহায্য করতেই কি ইভাকে পাঠিয়েছেন? ইভা তাকে দিল্লিতে পৌঁছে দেবে বলেছে। এখন তারা কোথায় এসেছে? গাড়িও বা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল কেন? গাড়ি ব্রেক টানাতে অপর্ণার শরীর সহসা অনেকটা সামনে এগিয়ে এসেছে। অপর্ণার বুক এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। কী হল? আধো অন্ধকার এক নির্জন রাস্তায় গাড়িটা থেমে গেল কেন? এখন তার কী করা উচিৎ? সাহায্যের জন্য পুলিশ ডাকা উচিৎ? চিৎকার করবে সে? কিন্তু পুলিশকে কি ডাকা ঠিক হবে? একবার পুলিশের সাহায্য চাইতে গিয়ে যে কী হয়েছিল, তা অপর্ণার ভালো করেই মনে আছে।
অপর্ণা আর আশিস পরেরদিন সকাল হতেই পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিল। আশিসের উপর হামলা হচ্ছে বলায় পুলিশ অফিসার ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
‘হঠাৎ আপনার উপরেই এমন হামলা হচ্ছে কেন? তারা কে? বা কারা? আপনি কাকে কাকে সন্দেহ করছেন? তাদের উদ্দেশ্য কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? আপনার সঙ্গে যিনি এসেছেন তিনি আপনার কে হন? ওঁর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?’
ভদ্রলোকের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ওরা দুজনেই যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সেই সময় লোকাল পার্টির একজন বিধায়ক সুখময় গোস্বামী থানায় কী এক দরকারে এলেন। তিনি আশিসকে চিনতেন। আশিসের আবিষ্কারের কথা শুনে উনি অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখাতে লাগলেন। সেই সঙ্গে তিনিও আশিসকে অজস্র প্রশ্ন করতে লাগলেন। আশিস অপর্ণার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল। অপর্ণা ওর কষ্টটা অনুভব করল। তার মনে হতে লাগল, থানায় বোধহয় না এলেই ভালো হত।
পরদিন অপর্ণা অফিসে এসে আশিষের ফোন পেল। দুপুরের দিকে কাজ কম থাকায় সে সোজা ওর বাড়ি চলে গেল। গিয়ে দেখল সেই বিধায়ক সুখময়বাবু এসেছেন। আশিষের গাড়ির মডেল ও কাগজপত্র দেখছেন এবং অসংখ্য আশ্বাস দিচ্ছেন। উনি যাওয়ার আগে আশিসকে বলে গেলেন সমস্ত পেপারস্ এবং গাড়ির মডেলটা আগামীকাল ওঁর অফিসে এসে জমা দিতে। বললেন,
‘যদি সবকিছু ঠিক থাকে রাজ্য সরকার প্রাথমিকভাবে এই গাড়ি তৈরি করবে।’
আশিস হাসিমুখে মন্ত্রীর প্রতিটা কথায় মাথা নাড়ছে দেখে অপর্ণা চরম বিরক্ত হল। লোকটা চলে যেতেই সে বলল, ‘তুই ওই লোকটাকে তোর সবকিছু জমা দিবি? আর যদি লোকটা তোর পেপারস্ কাউকে দিয়ে দে তখন? আমার এইসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের একদম বিশ্বাস হয় না।’
‘দেখ লেখকও তো নিজের সৃষ্টি সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দেন? কখনও কি তাঁর আইডিয়া সেখান থেকে চুরি যায় না? অনেক সময় যেতেও পারে। আবার নাও যেতে পারে। লেখকের লেখাটা প্রকাশিতও হতে পারে এবং লেখক তাঁর প্রাপ্য সম্মানও পেতে পারেন। তাই এই একটা ঝুঁকি তো আমাকেও নিতেই হবে। নাহলে এগোব কী করে? এছাড়া আমার আর কিছু করারও নেই।’
আশিষের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অপর্ণা বাসবদত্তাকে ফোন করল। বাসবদত্তা আশিস আর অপর্ণার স্কুলের বান্ধবী। সে একজন সাংবাদিক। দিল্লিতে থাকে এবং একটি প্রথম সারির নিউজ চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত। অপর্ণার সঙ্গে ফোনে আর ফেসবুকে বাসবদত্তার বেশ ভালো কন্ট্যাক্ট আছে। অপর্ণা ফোন করতেই ও প্রান্তে বাসবদত্তার উচ্ছ্বসিত গলা শুনতে পেল।
‘হ্যাঁ রে? কেমন আছিস?’
‘আমি ভালো আছি। তোকে একটা দরকারে স্মরণ করেছি। সাহায্যে প্রয়োজন।’
‘বলে ফেল! আয়াম অল টাইম অ্যাট ইওর সার্ভিস ম্যাম!’
‘আশিসকে মনে আছে তোর? আশিস মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল আইআইটি থেকে।’
‘হ্যাঁ, খবরটা জানি’
‘ও একটা নতুন ধরণের কার ইঞ্জিন আবিষ্কার করেছে। তাই নিয়ে অনেক ঝামেলা চলছে। ব্যাপারটা কমপ্লিকেটেড বেশ।’
‘এই অপু! আমি না এখন কলকাতায় এসেছি। তোর সঙ্গে চাইলে দেখাও করতে পারি আমি। আমি একটু ব্রেক নিয়েছি অফিস থেকে। আমার এক দাদার বিয়ে।’
অপর্ণা বলল, ‘তাহলে খুব ভালো হয়। তুই এখন কোথায় আছিস বল্? আমি আশিসের বাড়ির কাছাকাছি আছি।’
‘এখন হবে না রে। আমার সন্ধ্যে সাতটার পর হবে।’
‘ওকে! আমি অফিসের পর তোর সঙ্গে দেখা করে নেব।’
‘আমি গাড়ি নিয়ে তোকে তোর অফিস থেকে পিক আপ করে আশিসের বাড়ি যাব।’
বাসবদত্তাকে সঙ্গে নিয়ে অপর্ণা যখন আশিষের বাড়িতে এল, তখন ঘড়িতে রাত আটটা। অপর্ণা অবাক হয়ে দেখল সদর দরজা হা করে খোলা। আশিসের সমস্ত ঘরদোর লণ্ডভণ্ড। গাড়ির অনেকগুলো মডেলের একটাও নেই। কাগজপত্র, ল্যাপটপ কিচ্ছু নেই– পুরো ল্যাব তছনছ এবং আশিস কোথাও নেই। ওর ফোনও সুইচড্ অফ।
তারপর থেকে প্রায় তিনমাস আশিস নিখোঁজ। ওকে ফোনে আর কখনও পাওয়া যায়নি। কোনও ক্লু কিছুই না। একটা মানুষ যেন ভোজবাজির মতো তার বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। অপর্ণার অনুরোধে বাসবদত্তাদের সেই বিখ্যাত নিউজ চ্যানেলে বারবার আশিসকে নিয়ে প্রতিবেদন দেখানো হতে লাগল। এবং ওদের নিউজ পেপার এ খবরও ছাপা হল।
দেশজুড়ে আইআইটি স্কলার আশিস বসুর জন্য হাহাকার পড়ে গেল। এরই মধ্যে একমাত্র ভালো খবর হল মারুতি উদ্যোগ থেকে অপর্ণার ফোনে যোগাযোগ করেছে। ওরা টিভি চ্যানেল থেকে অপর্ণার ফোন নম্বর নিয়েছে। ফোনে বলা হল অপর্ণা যেন আশিসের কাগজপত্র নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি তাদের সঙ্গে দেখা করে। খবরটা পেয়েই অপর্ণা লম্বা ছুটির দরখাস্ত করে ফেলল। সে শুনেছিল আশিসের মাসতুতো বোন দিল্লিতে থাকে এবং সে একজন সিবিআই অফিসার। অপর্ণা মনে করে ওর সঙ্গে দেখা করা গেলে আশিসকে খুঁজে পেতেও সুবিধা হবে। তবে মুশকিল হল আশিসের সেই বোনের কোনও ঠিকানা বা ফোন নম্বর অপর্ণার কাছে নেই। এখন যে করেই হোক আশিসের খোঁজ করা আর ওর আবিষ্কারকে রক্ষা করা দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ অপর্ণার কাছে।
প্রতিটা দিন আশিসের ফেরার প্রতীক্ষা করে অপর্ণা। তার নিশ্চিত মনে হয় আশিসের কিছু হয়নি। তুচ্ছ টাকার জন্য ঘোরা কিছু সাধারণ মানুষের কাছে বুদ্ধিমান আশিস বসু কিছুতেই পরাস্ত হতে পারে না। ওর আবার এটাও মনে হয়, ওইসব লোকেদের কাছে নানারকম আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকে। আশিস ওর ছোটোখাটো ‘ধানীলঙ্কা’ নিয়ে সবসময় ওদের মোকাবিলা করতে নাও পারে। আশিসের সেই টর্চের মতো দেখতে অদ্ভুত যন্ত্রটার নাম অপর্ণা রেখেছে ‘ধানীলঙ্কা’। যন্ত্রটা হল আদতে একধরণের টর্চ। আলো জ্বলবে। এর দুটো সুইচ। একটাতে আলো জ্বলে অন্যটাতে ইলেক্ট্রিক শক বের হয়। সেই ওয়েভ বেশ শক্তিশালী। টর্চের মাথাটা বোতাম টিপে আক্রমণকারীর শরীরের যেখানে ঠেকানো হবে সেখানে সে প্রবল জোরে শক্ খাবে। মানুষ এতে মরবে না ঠিকই, তবে বেশ আহত হবে। প্রত্যেকবার শকের জন্য ব্যবহারের পর এই ব্যাটারিকে চার্জ করে নেওয়া যায়। আশিস এরকম বেশ কয়েকটা টর্চ তৈরি করে রেখেছে বাড়িতে। এখন সেগুলো সবই অপর্ণার জিম্মায় আছে।
টর্চগুলো দেখলেই অপর্ণার আশিসের কথা খুব মনে পড়ে। আশিস অসম্ভব প্রতিভাবান। প্রতিভার বিকাশের জন্য সব সময় গালভরা ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। এই সামান্য কয়েকদিনে কাছ থেকে দেখে অপর্ণা আশিসকে ভালোবেসে ফেলেছে। এমন একজন পুরুষকেই বোধহয় পৃথিবীর প্রতিটা মেয়ে পছন্দ করে যে সরল, সত্যবাদী আর নির্ভরযোগ্য।
(৫)
সামনে আধো অন্ধকার। অপর্ণাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে অনেক লোক দেখতে পেল অপর্ণা। হাইওয়ের উপর এত মানুষের জমায়েত কেন? ইভা গাড়ির কাচ সামান্য নামালো। সামনে একজন বাঙালি পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক বললেন,
‘আমরা বর্ডারের সব গাড়িকেই রুটিন তল্লাশি করছি। তিনদিন হয়েছে মিস অপর্ণা নিয়োগী তার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছেন। আশিস বসু তো আগে থেকেই মিসিং। মিস নিয়োগীর কাছে বিজ্ঞানী আশিস বসুর ‘গ্রীন কার’ এর মডেলের সম্পূর্ণ ডিটেলস্ আছে। রাজ্য সরকারের তরফে স্টেটের সব বর্ডার সিল করে দেওয়া হয়েছে।’
অপর্ণা ঘাবড়ে যায়। এই পুলিশ অফিসারের কাছে নিশ্চয়ই তার ছবি আছে। এখন কী হবে? সে কী আর সাধে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? তার মনে পড়ে গেল বিগত কয়েকদিনের কথা।
কয়েকটি দিন আগে হঠাৎ একটা অজানা নম্বর থেকে অপর্ণার ফোনে একটা কল আসে। অপর্ণা আশিসের খোঁজ পাওয়ার আশায় তড়িঘড়ি ফোনটা ধরে।
‘হ্যালো মিস নিয়োগী বলছেন?’
‘হ্যাঁ বলছি।’
‘আপনাকে কয়েকটা কথা বলার আছে। আমরা জানতে পেরেছি আপনার কাছে আশিস বসুর গ্রীন কার এর মডেলের ডিটেলস্ আছে? সেটা কি সত্যি?’
‘এইসব ফালতু কথা কোথা থেকে জানতে পারেন বলুন তো আপনারা? আর আমাকেই বা এসব কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?’
‘খবরটা কিন্তু সঠিক বলেই আমরা জানি। আমরা কেন? এই খবরটা এখন সবাই জানে। আরে! খবরটা তো কাগজেই বেরিয়েছে আর সেইজন্যই তো মারুতি উদ্যোগ আপনাকে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে।’
‘সবই যদি জানেন, তাহলে খামোখা আমাকে প্রশ্ন করছেন কেন?’
‘করছি, কারণ আপনাকে একটু সাবধান করে দেওয়া আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি। কলকাতাতেও আপনি কিন্তু এখন আর নিরাপদ নন। অফিস ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকলেও, বাড়িতেও আপনি একদমই নিরাপদ নন।’
‘মানে?’
‘মানে, একটু পরেই আপনি একটা ফোন পাবেন। সরকারের উচ্চশিক্ষা দফতর থেকে ফোন। আপনাকে ‘গ্রীন কার’ এর যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলা হবে। যাদবপুরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিভাগীয় প্রধানও আসবেন ওখানে। এ কথাও আপনাকে বলা হবে। উনি সম্ভবত আপনারও পরিচিত কারণ আপনিও ওখান থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন। যাইহোক তারপর আপনি যখন ডিটেলস্ জমা দিয়ে বাড়ি ফিরবেন ঠিক তখনই পথে আপনার একটা প্রাণঘাতী অ্যাক্সিডেন্ট হবে। সবকিছু একটি বিশেষ জায়গায় সঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে কিন্তু আপনি কখনও আর বাড়ি পৌঁছবেন না। কোথাও কোনও প্রমাণ থাকবে না। আপনাকে যে ডেকে পাঠানো হয়েছিল তা কোথাও প্রমাণ করা যাবে না কারণ ওরা আপনাকে আনঅফিসিয়ালি ডেকে পাঠাবেন। তারপর জাপানের সেই বিখ্যাত গাড়ি তৈরির কোম্পানি সগৌরবে ‘গ্রীন কার’ তাদের নামে বাজারে বের করবে।
আমাদের হাতটা অনেক লম্বা। যতটা ভাবতে পারছেন তার থেকেও অনেক অনেক লম্বা। তাই বলছি, আমাদের সঙ্গে সন্ধি করে নিন।টাকাটাও নেহাত কম দিচ্ছি না আমরা। আপনাদের দেশের অঙ্কে প্রায় কয়েক কোটি টাকা। টাকাটা নিয়ে চুপচাপ কাগজপত্র যা আপনার কাছে আছে আমাদের দিয়ে দিন। আশিস বসু তো আর বেঁচে নেই! এত কীসের মাথা ব্যথা আপনার? তাছাড়া আপনাদের বিয়েটাও তো এখনও হয়নি!’
অপর্ণা বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা আমাকে বলুন, আপনি কে মশাই? একজন বাঙালি, জাপানের কোম্পানির হয়ে গাড়ির দালালি করছেন, আমার ভাবতেও বাঙালি হিসেবে কষ্ট হচ্ছে। আর আমার মাথাব্যথা নিয়ে দয়া করে আপনি মাথা ঘামাবেন না। একটা কথা জেনে রাখুন, অপর্ণা নিয়োগী টাকার কাঙাল নয়। কারণ প্রচুর অর্থ সে নিজেই উপার্জন করে। কালো টাকাকে আমি ঘেন্না করি। নিজের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেওয়া এই টাকা শুধু কালো নয়, একেবারে নোংরা।’
‘আমাদের কোম্পানির সারা পৃথিবী জুড়ে এজেন্ট ছড়িয়ে আছে। আমি তেমনই একজন বাঙালি এজেন্ট। আমি আপনার ফোনের জন্য অপেক্ষা করবো। সাবধানে থাকবেন। সামনে আপনার খুব বড় বিপদ।’
এরপরই সত্যিই অপর্ণার সঙ্গে উচ্চশিক্ষা দফতরের আধিকারিক ফোনে যোগাযোগ করলেন এবং তিনি বললেন অপর্ণার সঙ্গে আগামিকাল দুপুরে একটি মিটিং করতে চান। উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিভাগীয় প্রধান। ফোন রেখে অপর্ণা স্থাণুর মতো বসে রইল। সব কিছুই কি তাহলে গটআপ? এখন কী করবে সে? খুব অসহায় লাগল তার। এমন সময় আশিসও পাশে নেই। অপর্ণা ঠিক করল যেভাবেই হোক তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। নাহলে সামনে ভয়ানক বিপদে পড়ে যাবে সে। সে একমুহূর্তও দেরি না করে কালো সাফারি ব্যাগটাতে নিজের টুকিটাকি সরঞ্জাম গুছিয়ে নিল সে। সঙ্গে কিছু টাকা নিল সে। তারপর মাকে বলল,
‘সাবধানে থেকো। আমি আশিসের খোঁজে কয়েকদিনের জন্য একজায়গায় যাব। খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো। তোমার আশীর্বাদ আমাকে রক্ষা করবে।’
অপর্ণা যেতে চায় দিল্লিতে। সে আশিসের বোনকে খুঁজে বের করতে চায়। তারপর ওর কাছেই আশিসের কাগজপত্র গচ্ছিত রাখতে চায় সে। সে প্লেনে বা এক্সপ্রেস ট্রেনে না উঠে লোকাল ট্রেনে বর্ধমান চলে গেল। ওখান থেকে ভাড়া গাড়িতে দিল্লি যাওয়ার প্ল্যান ছিল অপর্ণার। পুলিশের ভয়ে রোড সাইড সস্তা হোটেলে উঠেছিল সে। সেইসঙ্গে ফোনও সবসময় সুইচ অফ করে ব্যাগের ভেতর রেখে দিয়েছিল সে। এবার শেষে কি ধরা পড়তে হবে তাকে? সেই পুলিশ এবার তার সামনে। এখন উপায়?
(৬)
ইভা গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল। অপর্ণা গাড়ির ভেতর ভয়ে কাঁটা হয়ে বসে রইল। ইভা আর পুলিশ অফিসারের কী কথা হল অপর্ণা বুঝতে পারল না। অন্ধকারে দুজনকে ভালো দেখা যাচ্ছিল না। তবে কিছুক্ষণ পরে ইভা ফিরে এল এবং তাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করল।
অপর্ণা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাদের গাড়ি যেতে দিল? চেক করতে চাইল না?’
‘না। একরকম ম্যানেজ করা গেছে।’
‘কী রকম? টাকার বিনিময়ে?’
ইভা এই কথার উত্তর দিল না। কেবল নীরবে হাসল।
তবুও অপর্ণার সন্দেহ যাচ্ছে না। ইভা কেন এমন অযাচিত সাহায্য করছে তাকে? নিঃশংসয় হতে অপর্ণা ইভার সঙ্গে আলাপ জমাতে চাইল। ইভাকে বলল, ‘তুমি কি বাঙালি?’
‘না, জন্মসূত্রে নেপালি। আমার বাবা দীবানাথ শ নেপালি ছিলেন। আমার মা অবশ্য বাঙালি। বাবা মারা গেছেন অনেকদিন। আমি মাকে নিয়ে দিল্লিতেই থাকি। আমার বাড়ি দিল্লির করোলবাগের কাছে। আমি তোমাকে চিনি মানে টিভিতে তোমাদের প্রতিবেদন দেখেছি। আমার মতে টিভিতে তোমাকে দেখিয়ে কিংবা কথা বলিয়ে ভালো কাজ করেনি। খারাপ লোকেরা তোমার পিছু নিতে পারে। গতকাল হোটেলের বাইরে ছেলে দুটো ফোনে কথা বলছিল শুনেছি। ওরা গুজরাটিতে কথা বলছিল, ভেবেছিল বুঝতে পারবে না কেউ। আমি ভালো গুজরাটি জানি। ওদের কথা শুনে বুঝতে পারি যে তোমার জীবনের ঝুঁকি আছে। ওদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তারপর ওদের ড্রিঙ্ক এ ঘুমের বড়ি মিশিয়ে দিয়েছিলাম।’
‘তুমি কি কাজ করো ইভা?’
‘এই ট্রেডিং করি। ওরকম বড়ি আমার কাছে থাকে। ওগুলো আমার আত্মরক্ষার উপায়। তোমার যেমন টর্চ।’
অপর্ণা শুনে অবাক!
‘তুমি জানো?’
‘বুঝতে পারছি।’
‘কী ভাবে?’
‘গাড়ি দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তুমি সজাগ হয়ে প্রথমেই ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে আনলে। কোনও অ্যাপস্ লোড করা আছে নাকি ওই টর্চে?’
অপর্ণা হাসল। ‘মামুলি জিনিস। তেমন কিছু ভয়ানক অস্ত্র নয়।’
‘তুমি দিল্লির সিবিআই অফিসে যাবে?’
‘হ্যাঁ, ওখানে শুনেছি আশিসের বোন আছে। নাম জানি না। খুঁজে দেখতে হবে।’
‘ওকে! আমিও খুঁজবো। মানে তোমাকে সাহায্য করবো।’
‘আশিসকে খোঁজার ভার সিবিআইকে দেওয়ার ইচ্ছা আছে। দেখি কী হয়!’
‘আশিস কি তোমার শুধুই বন্ধু?’ ইভার মুখে দুষ্টুমির হাসি।
‘ও আগে তো অবশ্যই আমার বন্ধু কিন্তু ওর এই হঠাৎ এমন চলে যাওয়াতে আমার সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। ওকে এত ভীষণ মিস করছি যে কী বলব। হয়তো ওকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি। আসলে ওকে না ভালোবেসে থাকা যায় না।’
অপর্ণারা বেনারসে পৌঁছাল। গাড়ি থেকে নেমে ওরা একটু হাত পা ছাড়িয়ে নিল। তারপর স্টেশান সংলগ্ন চায়ের দোকানে অপর্ণা আর ইভা চা খেতে ঢুকল। দুজনে সবে চায়ের কাপ হাতে নিয়েছে। এমন সময় কোথা থেকে ছুটে এল একটা বাইক। আরোহীর মুখ কালো হেলমেটে পুরো ঢাকা। এক পলকের মধ্যে বাইক আরোহী অপর্ণার কালো সাফারি ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক অপর্ণা। ইভাও কম অবাক হয়নি।
ইভা জিজ্ঞাসা করল, ‘ব্যাগে কী ছিল?’
অপর্ণা জলভরা চোখে বলল, ‘কিছু টাকা ছিল, সেটা বড় নয়। সর্বনাশ হয়ে গেল– ব্যাগে আমার মোবাইলটা ছিল। ওখানেই মডেলের ডিজাইনটা প্রোগ্রাম করে লোড করা ছিল। পেপারস্ও সব ছিল। এখন সব শেষ। আমি হেরে গেছি। শত্রুপক্ষই যেতে গেল শেষ পর্যন্ত। এত চেষ্টা করেও আশিসের গাড়ির মডেলটা বাঁচাতে পারলাম না। ইভা শান্তভাবে ওর পকেট থেকে অপর্ণার মোবাইলটা বের করে আনল। হাসতে হাসতে বলল, ‘এটা আমি আগেই তোমার ব্যাগ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম।’
‘কিন্তু তুমি কী করে জানলে যে, মডেলটা ওখানেই আছে?’
‘কারণ আমাকে ভাইয়া বলেছে।’
‘কে ভাইয়া?’
‘বিজ্ঞানী আশিস বসু।’
‘মানে? তুমি কে?’
সিবিআই অফিসার ইভা শ। আমার উপর ভাইয়ার নির্দেশ ছিল, তোমাকে সাবধানে দিল্লিতে নিয়ে আসার জন্য।’
অপর্ণা খুশিতে ঝলমল করে ওঠে।
‘আশিস? কোথায় আছে ও এখন?’
‘আমার বাড়িতে। ইচ্ছা করেই আড়ালে আছে ও।’
‘কিন্তু কেন?’
‘কারণ না হলে পাবলিকের সিমপ্যাথি পাবে না। কাগজে টিভিতে ভাইয়াকে নিয়ে গসিপ না হলে কি আর মারুতি উদ্যোগের মতি ফিরত? আসলে সবকিছুই এখন বিক্রয়যোগ্য পণ্য আর তার বিপণনের জন্য দরকার বিজ্ঞাপন আর জনপ্রিয়তা। আমিই বলেছিলাম ওকে,
‘তোর উপর যখন হামলা হচ্ছে ভাইয়া তুই একটা গল্প সাজিয়ে সবকিছু নিয়ে এখানে চলে আয়। আমি তোকে ফুলপ্রুফ সিকিউরিটি দেব। যখন সবাই তোর খোঁজ করবে, তুই সামনে আসবি।’
‘আর আমি? আমার কথা আশিস ভাবল না একবারও?’
‘হ্যাঁ, তোমার জন্য ভাইয়ার চিন্তা ছিল সবসময়। তাই তো তোমার মোবাইলের গায়ে যে জিপিএস ট্র্যাকারটা লাগানো ছিল। তাই ধরে তোমার খোঁজ পেলাম।’
অপর্ণা অবাক!
‘আমার মোবাইল তো বন্ধ? আমার মোবাইলে ট্র্যাকার কোথায়?’
‘আছে। তোমার মনে আছে? ভাইয়া তোমাকে একবার মোবাইলে লাগানোর একটা স্টিকার দিয়েছিল? একটু উঁচু আর অদ্ভুত দেখতে?’
‘ও মা তাই? ওটা তো আশিস জোর করে একদিন আমার ফোনে লাগিয়ে দিয়েছিল। ওটা জিপিএস ট্র্যাকার?’
‘হ্যাঁ, নাহলে আমরা তোমার খোঁজ পেতাম কী করে বলো? আমি আর ভাইয়া দুজনে এই প্ল্যানটা করি। একদিন ল্যাবে অ্যাটাক হয়েছিল। তুমিও তো সেদিন ছিলে ওখানে তাই না?’
‘হ্যাঁ আমরা দুজনেই ছিলাম।’
‘পরেরদিনই সকালে তুমি অফিসে চলে যাওয়ার পর ভাইয়া আমাকে ফোন করে আর আমরা প্ল্যান করি। তুমি বাসবদত্তার কথা ভাইয়াকে বলেছিলে, যে এখন টাইমস্ এর জার্নালিস্ট। শুনেই আমি বলেছিলাম, এবার তোর খবর কাগজে বের হবে। তখন যদি দেশের বড়কর্তাদের টনক নড়ে! তবে এরজন্য তোকে একটু হাইজ্যাক হয়েছিস এমন নাটক করতে হবে।’
দিল্লিতে ইভার ড্রয়িংরুমে বসে আছে চারজন। ইভা, বাসবদত্তা, অপর্ণা আর আশিস। আজ একটা বিশেষ দিন। ইভার মা কিচেনে স্পেশাল ডিনার তৈরিতে ব্যস্ত। আশিস আর অপর্ণা দুজনেরই গলায় মোটা রজনীগন্ধার মালা। একটু আগেই ওদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ শেষ হয়েছে।
একটু রাতে খাওয়ার পর্ব শেষ হতে আশিস অপর্ণাকে ইভাদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় ডাকল। বারান্দায় দু একটা ফুল গাছের টব আছে। বারান্দায় খুব সুন্দর হাওয়া বইছে আর বেল ফুলের গাছ থেকে অপূর্ব সুগন্ধ আসছে। সুন্দর পূর্ণিমার রাত। আলোকিত আকাশের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে অপর্ণা। ছ-তলার উপর থেকে পরিষ্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে। সে আশিসের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তাহলে অবশেষে ‘গ্রীন কার’ পরীক্ষা মূলকভাবে তৈরি করছে মারুতি উদ্যোগ! অনেক অনেক অভিনন্দন তোর আগামী দিনগুলোর জন্য!’
আশিস আবিষ্টের মতো অপর্ণার হাতটা ধরে গাঢ় গলায় বলল,
‘সত্যিই! আমার ছোটবেলার আরও একটা স্বপ্নও এতদিনে পূর্ণ হল।’
অপর্ণা লজ্জা পেয়ে হেসে উঠতেই আশিস ওর আরও খানিকটা কাছে এগিয়ে এল। তারপর পরম ভালোবাসায় দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরল ওরা। সমস্ত পরিবেশটা অপর্ণার কেমন স্বপ্নের মতো সুন্দর মনে হল। আশিসের হাতে ধরা ছিল একটা টাটকা গোলাপের কুঁড়ি। দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। সময়ও যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল খানিকক্ষণ। দূর আকাশ থেকে চাঁদ মুগ্ধ চোখে চুপিচুপি ওদের ভালোবাসা দেখতে লাগল আর হাওয়া ফুলের সুগন্ধ নিয়ে ওদের আশীর্বাদ করে যেতে লাগল।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, তৃষা আঢ্য, নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী