ঘুমের দেয়াল পেরিয়ে
লেখক: এইচ পি লাভক্র্যাফট, অনুবাদ: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: সুমন দাস
মাঝেমাঝেই স্বপ্নেরা যে কত গভীর অর্থ বয়ে আনে সে-নিয়ে বোধ হয় বেশির ভাগ লোকই কখনও ভেবে দেখে না। কোন অজ্ঞাত দুনিয়ায় স্বপ্নের জন্ম হয় তা নিয়েও কৌতূহল খুব বেশি মানুষের হয়তো নেই। যদিও ফ্রয়েড অন্য কথা বলবেন, তবু এটা ঠিক যে জাগ্রত দুনিয়ায় আমাদের যে-সব অভিজ্ঞতা প্রতিমুহূর্তে হয়ে চলেছে, বেশির ভাগ স্বপ্নই তার একটা হালকা, কাল্পনিক রূপ।
তবু, কিছু কিছু স্বপ্ন আসে, আমাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যারা একেবারেই মেলে না। এই স্বপ্নদের মধ্যে ব্যাখ্যাতীত কিছু ইঙ্গিত ধরা থাকে, যা মানুষের একটা দ্বিতীয় মনোজাগতিক অস্তিত্বের দিকে ইঙ্গিত করে; যা হয়তো ইট-কাঠ-মাটির বাস্তবজীবনটার বাইরে, কিন্তু তবুও অন্য কোনও স্তরে একান্তই বাস্তব। অস্তিত্বের অন্য কোনও স্তর তা, দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবের তাকে ছোঁবার সাধ্য নেই।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মানুষ যখন ঘুমের ভেতর পার্থিব চেতনা হারায়, সে-সময়টা সে এক অচেনা, অশরীরি দুনিয়ার বাসিন্দা হিসেবে জেগে ওঠে। সে-দুনিয়ার রীতিরেওয়াজ আলাদা। জীবনের যে-সংজ্ঞায় আমরা অভ্যস্ত, তার কোনও নিয়মই খাটে না সেখানে। জেগে ওঠবার পর সে-দুনিয়ার সামান্যই কিছু স্মৃতির টুকরো অবশিষ্ট থাকে আমাদের চেতনায়। সেই টুকরোটাকরা স্মৃতি থেকে আমরা অনুমান করতে পারি অনেক কিছু, কিন্তু তার কোনও প্রমাণ দিতে পারি না। অনুমান করতে পারি, প্রাণ, বস্তু, জীবনীশক্তি, এগুলোকে আমাদের বিজ্ঞান যেভাবে জানে, স্বপ্নের জগতে তাদের চরিত্র একেবারেই সে-রকম নয়। স্থান-কালের সংজ্ঞাও সে দুনিয়ায় একেবারে আলাদা।
কখনও কখনও মনে হয় এই অন্য জগতটাই বোধ হয় আমাদের আসল জগত। জেগে থাকবার সময় যে বস্তুজগতটা দেখি সেইটেই আসলে একটা অলীক কল্পনা।
১৯০০-১৯০১-এর এক শীতের বিকেলে এহেন কিছু দিবাস্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমায় বাস্তবের জগতে ফিরে আসতে হয়েছিল। ফিরে আসতে হয়েছিল, কারণ যে মানসিক হাসপাতালে আমি ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করি সেখানে একজন নতুন রোগীকে নিয়ে আসা হয়েছে।
রেকর্ড মোতাবেক তার নাম জো স্লেটার। চেহারাপত্রে ক্যাটস্কিলের পাহাড়ি এলাকার স্পষ্ট ছাপ। খানিকটা বুনো ধরণের। শ’তিনেক বছর আগে এই চত্বরে বসত করতে আসা চাষী সম্প্রদায়ের ছোট একটা দল গিয়ে উঠেছিল ওই দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। এখানকার অন্যান্য এলাকায় তাদের যে ভাই-বেরাদররা ঘাঁটি গেড়েছিল, তাদের সঙ্গে এই দলটার যোগাযোগ এরপর বিশেষ ছিল না। ফল হয়েছে এই, তাদের ভাই-বেরাদররা যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিব্যি সভ্যভব্য হয়ে উঠলেও ক্যাটস্কিলের পাহাড়ে গিয়ে বসত-করা এই দলটা আগের মতোই বুনো ধরনের রয়ে গেছে।
কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে হাবভাব এদের। কাছে এলে অস্বস্তি হয়। সভ্য দুনিয়ার ন্যায়নীতির ধার এরা একেবারেই ধারে না। স্থানীয় অন্যান্য ইন্ডিয়ানদের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধিও যথেষ্ট নীচুস্তরের।
চার-চারজন কনস্টেবল মিলে ধরে এনেছিল জো স্লেটারকে। তাদের কথায়, এ অতি সাঙ্ঘাতিক মানুষ। তবে প্রথম দর্শনে আমার তাকে মোটেই তেমন ভয়ঙ্কর কিছু বলে ঠেকেনি। বড়সড়ো চেহারা। মোটা হাড়ের কাঠামো। কিন্তু তার ফ্যাকাশে নীল, ভেজা ভেজা চোখ, গালের আ-কাটা হলদেটে দাড়ি, ঝুলে পড়া নীচের ঠোঁট, এইসব দেখলে হঠাৎ করে একেবারে নিরীহ বোকাসোকা একটা মানুষ বলেই ঠেকবে।
তার বয়স জানা যায়নি। এদের সমাজে কোনও স্থায়ী পরিবার কিংবা পারিবারিক নথিপত্রের চলই নেই। তবে তার চওড়া কপাল আর ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত দেখে ডাক্তার লিখে দিলেন, “বয়স আনুমানিক চল্লিশ।”
মেডিক্যাল আর আইনি কাগজপত্র দেখে অবশেষে তার ব্যাপারে বিশদে জানা গেল। লোকটা ভবঘুরে। জঙ্গলে ফাঁদ পেতে শিকার ধরে তার দিন চলে। এমনকী তার নিজের দেশগাঁয়েও লোকজন তাকে খানিক অদ্ভুত বলেই মনে করে। রাতে সে ঘুমোতে যেত অনেক দেরি করে। তারপর ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রায়শই অজানা সব বিষয়ে গল্প করত। উদ্ভট, ভয়ধরানো সে-সব গল্প শুনে তার জাতের মতো কল্পনাশক্তিহীন বুনো মানুষজনও ভয়ে কেঁপে উঠত একেকবার।
ও-এলাকার বুলিতে সিধেসাদা কাঠখোট্টা ভাষাতেই কথা বলত জো। কিন্তু গল্পগুলো বলবার সময় তার গলার স্বর, বলার ভঙ্গী এইগুলোতে এমন কিছু রহস্যময়, বুনো ব্যাপার ফুটে উঠত যে, তা শুনলে অতিবড় সাহসীরও বুক কেঁপে উঠবে।
জো নিজেও গল্পগুলো বলবার সময় তার শ্রোতাদের মতোই ভয় পেত। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। সাধারণত ঘুম ভাঙবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে স্বপ্নটপ্নের কথা বেবাক ভুলে গিয়ে সে একেবারে স্বাভাবিক। তার গ্রামের আর দশজন সাদাসিধে চাষার সঙ্গে তখন তার হাবভাবে আর কোনও পার্থক্যই থাকত না।
বয়েস বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে জো-র এই স্বপ্ন দেখা আর অস্বাভাবিক চালচলনের মাত্রা ক্রমশই বাড়ছিল। শেষমেশ মাসখানেক আগে ওই থেকেই সে যে ভয়ানক কাণ্ডটা বাধিয়ে বসে, তার পরিণামেই তার গ্রেফতারি, বিচার ও অবশেষে এই হাসপাতালে আগমন।
ঘটনার আগের দিন বিকেলে পাঁচটা নাগাদ প্রচুর মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল জো স্লেটার। সে বাড়ি একটা শুয়োরের খোঁয়ারের মতো নোংরা। বাড়ির লোকজনও তথৈবচ। তা, পরদিন দুপুরবেলা হঠাৎ তার ঘর থেকে হঠাৎ ভয় ধরানো কিছু চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে দেখে স্লেটার ঘর ছেড়ে বাইরে বরফের ওপর ছুটে বের হয়ে এসেছে আর উদ্বাহু হয়ে ওপরের দিকে বড় বড় লাফ দিয়ে চলেছে। আর সেইসঙ্গে চলেছে চিৎকার। বলে, “ওই যে… মাথার ওপর… কতবড় বাড়ি! ছাদে আলো, দেয়ালে আলো, মেঝেয় আলো, বাজনা বাজছে দূরে, শুনতে পাচ্ছ না? আমি ওখানে উঠব… উঠবই…”
তাকে ধরতে এসেছিল যে লোকদুটো, তাদের চেহারা খুব বড়সড়ো নয়। যে রাক্ষুসে শক্তি তখন স্লেটারের গায়ে ভর করেছে, তার সঙ্গে যুঝবার ক্ষমতা তাদের বেশিক্ষণ হল না। প্রাণপণে তাদের হাত ছাড়াবার জন্য লড়াই করছিল জো আর সেইসঙ্গে অবোধ্য চিৎকার, “জ্বলজ্বল করছে… কাঁপছে… হাসছে… ওই দেখো তাকিয়ে… ওকে আমি ছাড়ব না…”
খানিক বাদেই তাদের একজনকে একটা মোক্ষম ঘুষিতে ঝেড়ে ফেলে অন্যজনের ওপর একটা রাক্ষসের মতো লাফিয়ে পড়ল সে। মারে, আর দাঁতে দাঁত ঘষে চিৎকার করে, “আমায় ধরে রাখবি? অ্যাঁ? আমি হাওয়া কেটে, সামনে যা পাব পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে উড়ে যাব।”
দেখেশুনে তো লোকজন ভয় পেয়ে পালাল। খানিক বাদে তাদের মধ্যে খানিক সাহসী দু’একজন ফিরে এসে দেখে, স্লেটার সেখানে নেই। সেখানে তার শিকার সেই লোকটার রক্তাক্ত দলাপাকানো মাংসপিণ্ডের মতো মৃতদেহটা পড়ে আছে। শরীরটাকে তখন মানুষের বলে চেনা যায় না আর।
গ্রামের একজন মানুষেরও আর স্লেটারকে খুঁজতে যাবার সাহস ছিল না। সম্ভবত তারা আশা করেছিল বরফের রাজ্যের ভয়ানক ঠান্ডা ও আপদকে নিকেশ করে দেবে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হল না। দিনকয়েক বাদে একদিন সকালে তারা দূরে, পাহাড়ের একটা খাঁজের ভেতর থেকে ফের তার হুঙ্কারের শব্দ শুনে বুঝতে পারল কোনওভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে স্লেটার। সেইসঙ্গে এ-ও বুঝতে পারল, এর কিছু একটা গতি তাদেরকেই করতে হবে। ফলে খানিক বাদে লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের একটা বড় দল পাহাড়ের দিকে রওনা দিল স্লেটারের খোঁজে। খানিক দূর যাবার পর পুলিশের এক কনস্টেবলের সঙ্গে তাদের দেখা। বৃত্তান্ত শুনে সে-ও চলল দলের সঙ্গে। ফলে এইবার তল্লাশিটা সরকারি তল্লাশির চেহারা নিল।
দিনতিনেক খোঁজাখুঁজির পর স্লেটারকে একটা গাছের গুঁড়ির খোঁদলের ভেতর অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ইতিমধ্যে তার সেই ‘আকাশে আলোর বাড়ি’ ইত্যাদি খবরটবর চারপাশে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। ফলে, তাকে কাছাকাছি এক জেলখানাতে ধরে আনবার পর আলবানি থেকে ভিনগ্রহী-সংক্রান্ত গবেষকদের একটা দল তাকে পরীক্ষা করে।
জ্ঞান ফেরবার পর তাদের যে গল্পটা স্লেটার শোনায় সেটা বেশ সোজা-সাপটা কাহিনি। সে জানায়, একদিন বিকেলে নেশাটেশা করে সে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতে দেখে, সে নিজের বাড়ির সামনে রক্তমাখা হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পায়ের কাছে প্রতিবেশী পিটার স্ল্যাডারের দলাপাকানো শরীরটা পড়ে। তাইতে বেজায় ভয় পেয়ে জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যায়। এর বাইরে সে আর কিছু জানে না।
সে রাতটা স্লেটার বেশ শান্তিতেই ঘুমুলো। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙবার পর তাকে পরীক্ষা করতে এসে ডক্টর বার্নার্ড খেয়াল করলেন, এমনিতে বিশেষ কোনও বদল না এলেও তার দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত ঝলক এসেছে। তার ঝুলে পড়া নীচের ঠোঁটটাও সামান্য টানটান। যেন কোনও চালাকির ফন্দি আঁটছে।
তবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হতেই দেখা গেল স্লেটার ফের যে কে সে-ই। ফাঁকা দৃষ্টি। ঝুলে পড়া ঠোঁট। কথাবার্তায় পাহাড়ি কাঠখোট্টা সারল্য।
ধরা পড়বার পর তৃতীয় দিন সকালে স্লেটারের প্রথম মানসিক বিকারটা দেখা দেয়। আগেরদিন রাতে ঘুমের মধ্যে খানিক ছটফট করেছিল সে। তারপর ভোরের দিকে হঠাৎ খেপা মোষের মতো লাফিয়ে উঠে এমন তাণ্ডব বাধাল যে শেষমেষ চারজন ষণ্ডা কনস্টেবল লেগে গেল তাকে কাবু করে দড়িদড়া দিয়ে বাঁধতে।
ইতিমধ্যে ভিনগ্রহী-সংক্রান্ত গবেষকদের দলটা স্লেটারের পাড়া-প্রতিবেশী আর তার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। সেই করতে গিয়ে তার দীর্ঘদিনের আচরণের যেসব টুকরো টাকরা তাঁদের কানে এসেছে তাতে কৌতূহল তখন তাঁদের তুঙ্গে। অতএব ফের একবার স্লেটারের পাগলামি দেখা দেয়ায় তাঁরা মহা উৎসাহে তার চ্যাঁচামেচি শুনতে চলে এলেন জেলখানায়।
প্রায় মিনিট পনেরো ধরে চলেছিল স্লেটারের প্রলাপ। তাতে পাহাড়িদের প্রায় অবধ্য জড়ানো ভাষার সেই প্রলাপে উঠে আসছিল আলোয় গড়া বিরাট অতিকায় সব প্রাসাদ, শূন্যতার সমুদ্র, ছায়াঘেরা পর্বত আর উপত্যকা, বিচিত্র সব সুর আর জ্বলন্ত এক রহস্যময় অস্তিত্বের কথা। সে অস্তিত্ব থরথর করে কাঁপে আর অট্টহাসি হেসে পরিহাস করে স্লেটারকে নিয়ে।
স্লেটারের গালাগাল থেকে অনুমান করা যাচ্ছিল, অতিকায় সেই অস্তিত্ব তার চরম কিছু একটা ক্ষতি করেছে। আর তাই, তাকে নিকেশ করে প্রতিশোধ নেয়াই তার জীবনের একমাত্র সাধ। আর সেটা করবার জন্য শূন্যতার মহাসাগর বেয়ে অনেক উঁচুতে উড়ে যাবে সে। যাবার পথে যা কিছু বাধা আসবে, তাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে সে এগিয়ে যাবে।
আর তারপর সেই প্রলাপ চলতে চলতেই, একেবারে হঠাৎ করেই একেবারে ঠান্ডা মেরে গেল স্লেটার। হঠাৎ, যেন দপ করে নিভে গেল তার চোখের উন্মাদ দীপ্তি। নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকে ঘিরে থাকা লোকজনের দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল, “আমায় বেঁধে রেখেছে কেন?”
ডক্টর বার্নার্ড তখন স্লেটারের হাত-পা থেকে চামড়ার তৈরি শক্তপোক্ত বাঁধনগুলো খুলে নিলেন। একেবারে রাতে, সে শুতে যাবার আগে, তাকে বুঝিয়েসুজিয়ে বাঁধনগুলো ফের পরিয়ে দেওয়া হল সেদিন। দেখা যাচ্ছিল এইবার স্লেটার ধীরে ধীরে স্বীকার করছে, মাঝেমধ্যে সে খানিক অদ্ভুত কথাবার্তা বলে থাকে বটে, তবে কেন যে সে তেমনটা করে তা সে বোঝে না।
এর পরের এক সপ্তাহের ভেতর দু-দুবার পাগলামোটা ফিরে এল স্লেটারের। তবে, তা থেকে ডাক্তারবাবুরা নতুন বিশেষ কিছু আর বুঝতে পারলেন না। স্লেটারের স্বপ্নগুলোর উৎস কী হতে পারে সে নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা হল। বেচারা লিখতে পড়তে শেখেনি। আধুনিক কল্পবিজ্ঞান দূরস্থান, সাধারণ রূপকথাটথাও শোনেনি কখনও। এহেন এক চাষা কেমন করে এমন অসামান্য স্বপ্ন দেখে ফেলে তার ব্যাখ্যা দেয়ার সাধ্য এই বিশেষজ্ঞদের ছিল না।
অতএব, নিয়মকানুন মেনে নরহত্যার দায়ে স্লেটারের বিচার হল। বিচারে অপরাধ প্রমাণ হল, স্লেটার উন্মাদ বলে প্রমাণিত হল এবং শেষমেষ আদালতের রায়ে তাকে আমাদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হল।
আগেই বলেছি, স্বপ্নজীবনের ব্যাপারে আমার গভীর কৌতূহল আছে। স্বাভাবিকভাবেই স্লেটারের বিষয়টা জানবার পর আমি তার দিকে কিঞ্চিত নজর দিয়েছিলাম। সে-ও দেখা গেল কিছুদিনের মধ্যে আমার সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহার করতে শুরু করেছে। আসলে আমি তার সঙ্গে ভারী নরমভাবে মিশতাম। পাশাপাশি, কথাবার্তা বলবার সময় স্বপ্নগুলো নিয়ে টিটকিরি দেওয়া বা ভয় পাবার বদলে আমার বিশুদ্ধ কৌতূহলটাও বোধ হয় তাকে খানিক টেনেছিল।
তবে যখন এই পাগলামোগুলো ঘটত, সেই সময়টুকু সে আমাকে চিনতেও পারত না। আমিও তখন তার কাছাকাছি চুপ করে অপেক্ষা করে তার কথাগুলো গিলতাম, চোখের সামনে গড়ে নিতাম ওতে বলা অকল্পনীয় দৃশ্যগুলোর ছবি।
তবে শান্ত অবস্থায়, যখন সে তার গরাদঘেরা জানালার পাশে বসে উইলোর ডাল আর খড় দিয়ে বাস্কেট বুনত, হয়তো বা পাহাড়ের খোলামেলা জীবনটার কথা ভেবে মনে মনে দুঃখও করত, সেই তখন আমার সঙ্গে কথা হত তার। বাড়ির লোকজন কখনও তাকে দেখতে আসেনি। সম্ভবত সে পরিবারে ততদিনে নতুন কোনও পুরুষ এসে দখল নিয়েছে। সেইটেই ওই পাহাড়ি এলাকার রেওয়াজ।
(২)
আস্তে আস্তে আমি জো স্লেটারের এই উন্মাদ ধ্যানধারণাগুলোতে মজে যাচ্ছিলাম। আপাতদৃষ্টিতে বেচারা এক সাধারণ বুনো চাষা। অথচ যে স্বপ্নগুলো সে দেখে তেমন স্বপ্ন একমাত্র কোনও অমিত শক্তিমান, উন্নততর মস্তিষ্কের দ্বারাই তৈরি হওয়া সম্ভব। আস্তে আস্তে একটা ধারণা দানা বাধছিল আমার মনে। গরাদের আড়ালে বসে থাকা ওই মনুষ্যেতরটার ব্যক্তিত্বের ভেতরে এমন কোনও একটা অস্তিত্বের অবিন্যস্ত উপস্থিতি রয়েছে যা আমার মতো অপেক্ষাকৃত কম কল্পনাশক্তিওয়ালা ডাক্তারির ছাত্রের বুদ্ধির বাইরে।
কিন্তু তবু, লোকটার থেকে এ বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য আমি বের করতে পারিনি। বহু চেষ্টায় একটা ছবি শুধু তৈরি করতে পেরেছিলাম। তার অ-শরীরি স্বপ্নে স্লেটার ঘুরে কিংবা ভেসে বেড়াত কোনও আলোয় গড়া দুনিয়ার উপত্যকায়, মাঠ, ঘাট, বাগানে, তার আলোয় গড়া নগরীর প্রাসাদদের ফাঁকে ফাঁকে। সে-জায়গা মানুষের কল্পনার সীমার থেকে অনেক দূরে। সেই স্বপ্নজীবনে সে কোনও জড়বুদ্ধি চাষা থাকত না। সেখানে সে ছিল শক্তিমান, বুদ্ধিদীপ্ত একজন জীব। গর্বিত পদক্ষেপে সে ঘুরে বেড়াত তার আলোকোজ্জ্বল দুনিয়ায়।
শুধু অন্য এক অন্ধকার, শক্তিমান অস্তিত্ব ছিল সে দুনিয়ায় তার পরম শত্রু। তার পতনের কারিগর সেই অস্তিত্বকে দেখা যায়, কিন্তু তার জড়দেহ নেই কোনও। সেই অন্ধকার অস্তিত্ব সেই আলোকজ্জ্বল দুনিয়ায় ঢুকে এসে স্লেটারের কোনও চরম ক্ষতি করে গিয়েছিল। পাগল মানুষটা (যদি সে সত্যিই পাগল হয়ে থাকে) তার জাগ্রত অবস্থায় তাই তার প্রতিশোধ নিতে চাইত বারংবার।
তার কথাবার্তা থেকে আমার সিদ্ধান্ত ছিল, সে আর তার অন্ধকার শত্রু আসলে একই প্রজাতির জীবের দুই আলোকিত ও অন্ধকার সদস্য। শক্তিতে তারা সমান সমান। অনুমানটার কারণ ছিল স্লেটারের প্রলাপে বারংবার তার মহাশূন্য বেয়ে উড়ে যাওয়া আর পথে যা কিছু বাধা আসবে তাকে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেবার দম্ভ।
অথচ এহেন অকল্পনীয় ছবিগুলো গড়ে উঠত তার অসংস্কৃত, অসম্বদ্ধ গেঁয়ো শব্দগুলো গেঁথে গেঁথে। আচ্ছা এমন কি হতে পারে, যে ওই বুনো, অশিক্ষিত শরীরটা অনুন্নত মস্তিষ্কে বন্দি একটা অতি উন্নত চেতনা, ওর সীমাবদ্ধ প্রকাশভঙ্গীকে আশ্রয় করে নিজের কথাগুলো বলতে চাইছে? এমন কি হতে পারে, যে আসলে আমি একটা অতি উন্নত চেতনার মুখোমুখি বসে আছি? শুধু তার বক্তব্যটাকে ঠিকঠাক ধরতে পারলেই এ-রহস্যের কিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে?
মাঝবয়েসি সিনিয়র ডাক্তারদের অবশ্য আমি কখনও এসব তত্ত্ব শোনাতে যাইনি। মাঝবয়েসটা অবিশ্বাসের বয়েস। নতুন ধ্যানধারণা মেনে নেওয়া তাদের সাধ্যের বাইরে। তা ছাড়া হাসপাতালের সুপার মধ্যে একদিন আমাকে কিঞ্চিত সাবধানবাণীও শুনিয়ে গিয়েছিলেন ওর মধ্যেই। আমি নাকি এই রোগীকে নিয়ে একটু বেশি পরিশ্রম করছি, আমার খানিক বিশ্রাম দরকার।
আসলে, বিষয়টা নিয়ে তখন অন্য একটা পরিকল্পনা আমার মাথায় গড়ে উঠছিল। ছাত্রজীবন থেকেই একটা ধারণা আমার মধ্যে কাজ করে এসেছে। ধারণাটা হল, মানুষের চিন্তা আসলে একধরণের পারমাণবিক স্তরের শক্তি চলাচল। সে চলাচলকে ইথার তরঙ্গ কিংবা আলো, তাপ বা বিদ্যুতের মতো শক্তিতে বদলে নেওয়া সম্ভব। এই থেকেই একটা দ্বিতীয় ধারণার জন্ম হচ্ছিল আমার মাথায়। চিন্তাস্রোতকে অন্য শক্তিতে বদলে নেওয়া যদি সম্ভব হয় তাহলে, উপযুক্ত একটা যন্ত্র বানালে তাই দিয়ে টেলিপ্যাথি বা মানসিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে নেওয়া মোটেই অসম্ভব হবে না।
এই চিন্তাটা থেকেই ছাত্রজীবনে আমি কিছু যন্ত্রপাতিও গড়েছিলাম। সে সময়কার বেতার টেলিগ্রাফির যন্ত্রপাতির আদলে তা তৈরি। কয়েকজন সহপাঠীর ওপর এগুলোর প্রয়োগ করে কোনও ফল পাইনি বলা বাহুল্য। কাজেই সেগুলোকে পুঁটুলি বেঁধে তুলে রেখে দিয়েছিলাম।
এই যন্ত্রগুলো নিয়ে নতুন করে একবার স্লেটারের ওপরে প্রয়োগ করার ইচ্ছেটা তখন জেগে উঠেছে আমার মধ্যে। দেখাই যাক না। একদিন বাড়ি ফিরে যন্ত্রগুলোকে ফের একবার নামিয়ে এনে তার ধুলো ঝেড়ে আমি তাদের সারাই করতে বসলাম।
যন্ত্রগুলো ঠিকঠাক করে নেবার পর শুরু হল স্লেটারের ওপরে তাদের প্রয়োগের চেষ্টা। যখনই তার মধ্যে সেই পাগলামির লক্ষণ দেখা যেত, আমি যন্ত্রের ট্রান্সমিটারটা তার কপালে লাগিয়ে দিয়ে তার রিসিভারটা আমার কপালে লাগিয়ে নিতাম। তারপর পাগলামি চলাকালিন চলত যন্ত্রের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে সঠিক কম্পাঙ্কে টিউন করবার চেষ্টা।
স্লেটারের চিন্তাতরঙ্গ আমার মস্তিষ্ক পড়তে পারলে সে তা ঠিক কীভাবে অনুভব করবে সে বিষয়ে আমার কোনও ধারণা ছিল না। তবে একটা বিষয়ে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, আজ নয়তো কাল, সে চিন্তাকে পড়তে আমি পারবই।
ব্যাপারটা শেষ অবধি ঘটল ১৯০১-এর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। আজ এতদিন বাদে সে দিনটার দিকে নজর ফেরালে, বড় অবাস্তব ঠেকে গোটা ব্যাপারটাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, ডক্টর ফেলটনই হয়তো ঠিক বলেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, যা দেখেছি, সবই আমার উত্তেজিত কল্পনার ফসল। মনে পড়ে, আমি যখন তাঁকে সবটা ব্যাপার খুলে বললাম, তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে, সহানুভূতির সঙ্গে সেটা শুনেছিলেন। আর তারপর একটা নার্ভের ওষুধ লিখে দিয়ে আমার জন্য ছ’মাসের ছুটির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তার পরের সপ্তাহে আমি সেই ছুটি কাটাতে রওনা হয়ে যাই।
ঘটনার দিন রাতে আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। কারণ, শত চেষ্টা আর যত্ন-আত্তি সত্ত্বেও স্লেটার তখন মারা যাবার পথে। শরীরে তার সেই আসন্ন মৃত্যুর চিহ্ন জেগে উঠেছে তখন। হয়তো পাহাড়ের স্বাধীন জীবনটাকে হারিয়ে তার বাঁচার ইচ্ছে চলে গিয়েছিল। অথবা… হয়তো মস্তিষ্কের উত্তেজনা তার এত তীব্র জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে তাকে বইবার সাধ্য দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল তার শরীরের।
কিন্তু কারণটা যা-ই হোক না কেন, তার ফল একটাই দেখা যাচ্ছিল। স্লেটারের বিধ্বস্ত শরীর থেকে প্রাণশক্তির চিহ্ন মুছে যাচ্ছিল দ্রুত। সবসময় সে তখন ঝিমোয় বসে বসে। সেদিনও সারাটা দিন বসে বসে ঝিমোবার পর, অন্ধকার নামতেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। এত দুর্বল দেখাচ্ছিল তাকে যে, অন্যান্য দিনের মতো সেদিন আর তাকে বেঁধে রাখবার কথা মনে হয়নি আমার।
কিন্তু তার কপালে সে-রাত্রে ট্রান্সমিটারটা আমি বেঁধে রেখেছিলাম। নিজের কপালেও পরে নিয়েছিলাম যন্ত্রের রিসিভার। একটা ক্ষীণ আশা কাজ করছিল আমার মনে। মরবার আগে যদি শেষ একবারের মতো সে সেই স্বপ্নের দুনিয়ায় গিয়ে ঢোকে তবে তার চিন্তাগুলোকে ধরবার একটা অন্তিম চেষ্টা করতে পারব আমি।
তার ঘরে তখন আমি ছাড়া ছিল একজন নার্স। সে বেচারা সাধারণ মানুষ। বুদ্ধিশুদ্ধি তেমন নেই। এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে আমি কী করছি, সে নিয়ে তার না ছিল কোনও কৌতূহল, না কোনও চিন্তা।
মাঝরাতের কাছাকাছি হঠাৎ খেয়াল করলাম, স্লেটারের মাথাটা ঘুমের মধ্যেই কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বেঁকে উঠছে। আমি তাকে বিরক্ত করলাম না। খানিক বাদে আমারও চোখদুটো জুড়ে এসেছিল হয়তো।
হঠাৎ উদ্ভট একটা বাজনার শব্দে ঘুম ভেঙে চমকে উঠলাম আমি। ঝমঝম করে বেজে উঠেছে তা মাঝরাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে। জেগে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজনার শব্দের পাশাপাশি আমার চেতনায় ধরা দিল একটা অকল্পনীয় সুন্দর ছবি। আমি যেন বাতাসে ভাসছি। আমাকে ঘিরে বিশুদ্ধ লকলকে অগ্নিশিখায় গড়া অজস্র প্রাসাদ, স্তম্ভের সার। তাদের চূড়াগুলো অকল্পনীয় উচ্চতায় ঝুলে থাকা একটা ঝলমলে ছাদের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
সেই অসামান্য সুন্দর স্থাপত্যের সঙ্গে মিশে ছিল বিস্তীর্ণ সব প্রান্তর, ফুল ছাওয়া উপত্যকা। তার চারপাশে আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সারের বুকে জেগে আছে রূপবান প্রকৃতি। বস্তু দিয়ে গড়া নয়। খুঁটিয়ে দেখলে অনুভব করা যায়, তাদের গড়ে তুলেছে বহুবর্ণ, পুঞ্জ পুঞ্জ জ্যোতির্ময় শক্তির দল।
তাদের দিকে দেখতে দেখতে, দ্বিতীয় একটা অনুভূতি এইবার আমার মনের দখল নিচ্ছিল। এই দৃশ্যেরা আমার চিরপরিচিত। এই বিশ্বে আমি কোনও আগন্তুক নই। অনন্ত অতীত থেকে অনাগত অনন্ত ভবিষ্যৎ অবধি বিস্তৃত কোনও এক জীবনে আমিও এই বিশ্বের নাগরিক।
তারপর, আমার আলোয় গড়া বন্ধুটির অস্তিত্ব আমার কাছে এগিয়ে এল। কথা বলে উঠল সে আমায় লক্ষ করে। দুই চেতনার মধ্যে শব্দহীন চিন্তার নিখুঁত বিনিময়।
তার চিন্তায় আনন্দের স্পষ্ট ছাপ ছিল। কারণ, আমার বন্ধু এইবার তার ক্ষণস্থায়ী নীচুস্তরের এক বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেতে চলেছে। এইবার সে ছাড়া পাবে। তারপর, তার মহাশত্রু সেই অন্ধকার অস্তিত্বকে অনুসরণ করে যুদ্ধে যাবে সে। প্রয়োজনে বিশ্বের শেষপ্রান্তে পৌঁছে হলেও তাকে খুঁজে বের করবে সে। তারপর, তার প্রতিশোধের আঘাতে কেঁপে উঠবে ব্রহ্মাণ্ডজোড়া গ্রহতারার দল।
কিছুক্ষণ এইভাবে ভেসে বেড়াবার পর হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম আমাদের চারপাশের ছবিগুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। যেন বস্তুজগত থেকে কোনও অমোঘ আকর্ষণ আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়… সেই দুনিয়ায়… যেখানে আমি আর ফিরে যেতে চাই না…
আমার বন্ধুচেতনাও দেখা গেল সেই টান টের পেয়েছে। সেটা অনুভব করেই সে তার কথাবার্তায় ছেদ টানল এবার। দ্রুত সবকিছু আবছা হয়ে আসছিল আমাদের চারপাশে। বুঝতে পারছিলাম আমাদের জড়দেহের বন্দিশালায় ডাক পড়েছে আমাদের। মিলিয়ে যেতে যেতেই দু-একটি চিন্তার আদান-প্রদান থেকে জানতে পারছিলাম, আমার বন্ধুর সেখানে আটকে থাকবার মেয়াদ আর বেশিক্ষণের নয়। তার বিধ্বস্ত জড়দেহের খোলসটার আয়ু প্রায় শেষ। আর বড়োজোর এক ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি পাবে সে। তখন আকাশগঙ্গার পথ ধরে অগণিত নক্ষত্র পার হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে আর কোনও বাধা থাকবে না তার।
হঠাৎ একটা ঝটকা মেরে আমার চেয়ারে জেগে উঠলাম আমি। তাকিয়ে দেখলাম, সামনের বিছানায় জো স্লেটারের শরীরটাও একটু অস্বস্তিভরে নড়াচড়া করছে। জেগে উঠছে সে-ও। তবে হয়তো তা শেষবারেরই জন্য।
তাড়াতাড়ি তার কাছাকাছি মুখটা নিয়ে যেতে চোখে পড়ল, এতগুলো দিনের মধ্যে এই প্রথমবার, তার গালে হালকা একটুখানি রক্তিম ছোঁয়া লেগেছে। তার ঠোঁটদুটি একেবারে চাপা, যেন স্লেটারের জড়বুদ্ধি ব্যক্তিত্বের চাইতে বহুগুণে উন্নততর কোন অস্তিত্বের মানসিক দৃঢ়তা এসে ভর করেছে তাতে।
আসে আস্তে তার গোটা মুখটা টকটকে লাল হয়ে উঠছিল। চোখবন্ধ করে থাকা মাথাটা তার এলোমেলোভাবে এপাশ ওপাশ করছে।
আমি ঘুমন্ত নার্সকে জাগালাম না। বরং ফের একবার কপালে রিসিভিং হেডব্যান্ডটা পরে নিলাম, যদি যাবার সময় শেষ কোনও কথা বলে যায় আমার বন্ধু! প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্লেটারের মাথাটা সটান ঘুরে গেল আমার দিকে। বন্ধ চোখদুটি খুলে গেছে তার।
সে চোখের দিকে তাকিয়ে আমি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলাম সেই মুহূর্তে। খোলা অক্ষিপল্লবের ভেতর থেকে একজোড়া উজ্জ্বল, ঘননীল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ চেয়ে আছে আমার দিকে। সে-দৃষ্টি ক্যাটস্কিল পাহাড়ের মনুষ্যেতর চাষা স্লেটারের নয়। সে দৃষ্টিতে পাগলামোর চিহ্ন ছিল না। কোনও দুঃখেরও ছাপ ছিল না। অনুভব করছিলাম, সুগভীর ধীশক্তিসম্পন্ন একটি মন আমার দিকে দেখছে সেই চোখজোড়াটি দিয়ে।
বাইরের দুনিয়ার হাজারো অতিতুচ্ছ শব্দ-দৃশ্য-গন্ধ আমার মনোযোগকে সরিয়ে নিতে চাইছিল বারবার। আস্তে আস্তে চোখ বুজলাম আমি। বন্ধ করে দিলাম ইন্দ্রিয়ের দরজাগুলোকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টের পেলাম, তার যে বার্তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তা এসে পৌঁছেছে আমার মনের দরজায়। কোনও ভাষার ব্যবহার হয়নি তাকে পৌঁছে দিতে। কতগুলো ভাব, কতগুলো ধারণা… সরাসরি তার চেতনা থেকে বয়ে এসে আমার চেতনায় একেবারে সহজবোধ্য রূপ নিচ্ছিল তারা। এতই সহজবোধ্য, যে মনে হচ্ছিল, আজন্ম পরিচিত মাতৃভাষাতেই আমি যেন শুনতে পাচ্ছি তার কথা,
“জো স্লেটার মারা গেছে,” নিদ্রাপ্রাচীরের ওপার থেকে আমার চেতন দুনিয়ার ইন্দ্রিয়ে ভেসে আসছিল কথাগুলো।
চমকে চোখ খুলে ফেললাম আমি। নীল চোখদুটো তখনও শান্তভাবে আমার দিকে দেখছে, তখনও তা যেন পরিপূর্ণভাবে জীবন্ত, “ভালোই হয়েছে সে মারা গেছে। তার শরীর আমার মতো মহাজাগতিক চেতনাকে ধারণ করবার যোগ্য ছিল না। বস্তুজীবন ও চেতনাজীবনের মধ্যে স্বচ্ছন্দ যাতায়াতের জন্য যে অদলবদলগুলো জরুরি, তা সহ্য করতে পারেনি তার ওই মোটা দাগের শরীর। তার মনের বেশির ভাগটা ছিল পাশবিক, অতি সামান্যই মানবিক। তবু তাকেই মাধ্যম করে তুমি আমাকে খুঁজে পেয়েছ। কিন্তু জেনে রেখো, আমায় খোঁজা তোমার উচিত হয়নি। দুটি আলাদা জগৎ। তাদের আলাদা থাকাই নিরাপদ।
“স্লেটার নামের এই শরীরটা তোমাদের হিসেবের বিয়াল্লিশটা বছর আমার দিনের বেলার কারাগার ছিল। স্বপ্নহীন নিদ্রার স্বাধীন ভুবনে তুমিও আমার মতোই এক চেতনাজীব। আমি তোমার এক ভাই। একসঙ্গে আমরা অগ্নি উপত্যকায় বহুবার উড়ান দিয়েছি।
তোমার এই জড় চেতনাকে তোমার আসল চেতনার সংবাদ খুব বেশি না জানানোই শুভ। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, আমরা দেশ ও কালসমুদ্রের মহাপথিকের দল। আজ আমি এখানে রয়েছি। হয়তো আগামীকাল আমার ঠিকানা হবে তোমাদের সুদূর অতীতের মিশরদেশে, কিংবা তিন পার্থিব সহস্রাব্দ ভবিষ্যতের হিংস্র সম্রাট সান-চেন-এর রাজত্বে।
তুমি ও আমি মিলে লোহিত নক্ষত্র আর্কটিউরাসের কক্ষপথে ভ্রাম্যমান গ্রহদের দেখেছি, বৃহস্পতির চতুর্থ উপগ্রহের বাসিন্দা অহঙ্কারী পতঙ্গ দার্শনিকদের শরীরেও বসবাস করেছি বহুকাল। আমাদের চিরশত্রুর বিষয়েও খানিক আভাস তুমি পেয়েছ ভাই আমার। অন্য চেতন অস্তিত্ত্বে তার কথা তোমার অজানা নয়। পার্থব জড় অস্তিত্বে, মহাশূন্যে তার যে নিশান তোমাদের চোখে পড়ে তার নাম তাই তোমরা রেখেছ আলগল, দানব নক্ষত্র।
বহুযুগ ধরে বারংবার জড়দেহের কারাগারে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া হয়নি আমার। এইবার সেই আরব্ধ ব্রত আমি উদযাপন করব। আকাশের দিকে চোখ রেখ। আলগল-এর কাছে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। দেখতে পাবে সেই প্রতিশোধের বিশ্বগ্রাসী অগ্নি-বিচ্ছুরণ।
“তবে আর দেরি নয়। এই স্লেটার নামের জড়পিণ্ডের আয়ু শেষ হয়েছে। তার নিঃসাড় মস্তিষ্ক আর আমার আদেশ মেনে কম্পিত হচ্ছে না। তুমি মহাবিশ্বজোড়া চেতনাজগতে আমার চিরসঙ্গী। এই সীমাবদ্ধ জড়জগতেও সেই তুমিই আমার ক্ষণস্থায়ী বন্ধু হয়েছিলে। তুমিই একমাত্র, যে এই ঘৃণ্য, মলিন জড়দেহটিকে অতিক্রম করে আমার সন্ধান করে গিয়েছ অবিশ্রাম।
“আবার দেখা হবে আমাদের বন্ধু। কালপুরুষের তরবারির উজ্জ্বল মহাজাগতিক কুয়াশায় অথবা, হয়তো-বা এই গ্রহেরই এশিয়া ভুখণ্ডের কোনও অন্ধকার মালভূমির বুকে, হয়তো আজ রাত্রির কোনও ভুলে যাওয়া স্বপ্নজীবনে, কিংবা… অন্য কোনও কালের অন্য কোন জীবনে, যখন সৌরজগত ভেসে গেছে কালের দুরন্ত স্রোতে।”
কথাগুলো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই চেতনাতরঙ্গের স্রোত থেমে গেল একেবারে হঠাৎ করেই। তাকিয়ে দেখলাম, স্লেটারের আধখোলা চোখদুটি প্রাণহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। তার ঠোঁট আবার পরিচিত জড়বুদ্ধি মানুষটির মতো রূপে ফিরে গেছে।
কোনওমতে উঠে এগিয়ে এসে আমি তার নাড়ি ধরে দেখলাম একবার। সেখানে প্রাণের স্পন্দন ছিল না। হাঁ করা মুখটার থেকে তার ক্ষয়া দাঁতের দুর্গন্ধ উঠে আসছিল। তার শরীর মৃত মাছের মতোই ঠান্ডা। আমি তাড়াতাড়ি শিউরে উঠে তার শরীরটা একটা চাদরের তলায় চাপা দিলাম।
তারপর সেই ঘর ছেড়ে আমি ফিরে গেলাম আমার নিজের ঘরে। ঘুমিয়ে পড়বার একটা তীব্র আকাঙ্খা জেগে উঠেছে তখন আমার মধ্যে। দীর্ঘ একটা নিদ্রা, যার স্বপ্নগুলো আমি মনে করতে পারব না জাগরণের দুনিয়ায়।
স্লেটারের মৃত্যুর সেই দিনটায় অনেক রাতে ঘুম ভেঙে উঠে আমি আকাশে আলগল-এর দিকে চোখ রেখেছিলাম। শিউরে উঠে লক্ষ করেছিলাম, তার পাশে দ্বিতীয় একটা আলোকবিন্দু এসে হাজির হয়েছে তখন।
কল্পনা? বেশ। তাহলে একজন সাক্ষীকে ডাকা যাক। সে সাক্ষী, এর কয়েকদিন বাদে প্রকাশিত সংবাদপত্রের একটা একঘেয়ে সাধারণ রিপোর্ট
তারার নামঃ নোভা পার্সিভার্বাটিম
প্রফেসর গ্যারেট পি সার্ভিস
এডিনবরা মানমন্দিরের ড. অ্যান্ডারসন আলগল নক্ষত্রের একেবারে গা ঘেঁষে একটি উজ্জ্বল নতুন নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯০১ তারিখে। নতুন এই তারাটিকে এর আগে কোনও মানমন্দির থেকেই দেখা যায়নি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তারাটি অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠে কাপেলার ঔজ্জ্বল্যকেও ছাপিয়ে যায়। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে ধীরে ধীরে তা ফের মিলিয়ে গেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের দুনিয়ায় এই আবিষ্কার…
Tags: অনুবাদ গল্প, এইচ পি লাভক্র্যাফট, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, পূজাবার্ষিকী, সুমন দাস
সাংঘাতিক
এই আম’রি ভাষায় লাভক্রাফটিয়ান আবহকে তুলে আনা লিরিক্যাল শুদ্ধতার দাবী রাখে। ভয়ের সোপান পেরিয়েও যে গদ্য মহাকাশের অসীমের গূঢ় কোন শ্রুতিকে মনে করায়। অনুবাদক সেই দুরূহ কাজটি করেছেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে।