চব্বিশ ঘন্টার জন্য খোলা – এডওয়ার্ড ম্যাকিওয়েন
লেখক: বাংলা অনুবাদঃ প্রতিম দাস
শিল্পী: প্রতিম দাস
মেডাকালা মিউজিয়াম অফ অ্যান্টিক্স–এর ধুলো জমে থাকা বারান্দা দিয়ে কিউরেটরের অফিসের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলো টারস বোকারা। রোগা এই তরুণটির ভাগ্য শুধু এই কারনেই বিচ্ছিরী নয় যে সে কোল ট্র্যাকসিস তিন নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত হাজারেরও বেশী মিউজিয়ামের একটিতে কাজ পেয়েছে। তার চেয়েও খারাপ ব্যাপার হল ওর ওপরওয়ালার নাম আরন পাউন্ডস্টোন। যাকে একসময় জিনিয়াস বলে বিবেচনা করা হতো। হাই কমিটি দ্বারা একদা প্রচুর পুরস্কারে ভূষিত মানুষটির সম্বন্ধে এক নক্কারজনক তথ্য সামনে এসে যায়। জানা যায় উনি সেই সময় অবধি যা যা পেশ করেছেন নিজের বলে, সব তার এক সহকর্মীর কাজ। যিনি মারা গিয়েছিলেন এক অভিযানে। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু করা গেল না। কারন প্রমান করার জন্য সেরকম কোন তথ্য এতোদিন বাদে কারোর হাতে ছিল না। কোনও রকম বিতর্ক এড়াতে পাউন্ডস্টোনকে বদলী করে দেওয়া হল এমন জায়গায় যেখানে করার মতো বিশেষ কিছু নেই। কেবল মাত্র ইতিহাসের ধুলো ঘাঁটা ছাড়া।
এরপর থেকে হাই কমিটি পাউন্ডস্টোনের কোন রকম আবেদনেই কান দিত না। তা সত্বেও হাল না ছেড়ে উনি একের পর আবেদন পাঠিয়ে গেছেন নতুন কিছু করার। সম্মানহানি হওয়ার আঁচ লেগেছিল কিনা সেটা বোঝা না গেলেও হঠাৎ করে আবার কিছু একটা আবিষ্কার করে নিজের হৃত সম্মান উদ্ধার করার একটা মানসিকতা হয়তো মনে মনে কাজ করতো পাউন্ডস্টোনের। আর তার জন্য কমিটি সাহায্য না করায় ফল ভুগতে হতো পাউন্ডস্টোনের অধস্তনদের। ঠি্কঠাক মাল–মশলা আর যন্ত্রপাতি ছাড়াই দূর দূরান্তের গ্রহে–উপগ্রহে অভিযানে পাঠিয়ে দিয়েছেন পাউন্ডস্টোন কত শত জনকে। ভালো ভালো তরুণ আরকিওলজিস্ট এই কারনে অকালে নিজেদের প্রান হারিয়েছে ভিনগ্রহী দানব বা হিংস্র উপজাতির হাতে। অথবা সেই সব গ্রহের সূর্যের তাপ সহ্য করতে না পেরে অভিযাত্রীদের হাড়গোড় শুকিয়ে গেছে। থেকে গেছে ওখানেই অদূর ভবিষ্যতের গবেষকদের চিন্তার রসদ যোগানোর জন্য।
রিগেলিয়ান মমি আর আরকচুরিয়ানদের ছাড়ানো চামড়া দেখে শিউরে উঠতেই বোকারার ভাবনার জগতে লাগাম পড়লো। ইতিহাসবিদ হওয়ার ইচ্ছে ওর কোন দিনই ছিল না। কিন্তু করার কিছু ছিল না। কোল ট্র্যাক্সিসে ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য পদ খালি আছে, সেটা ওর মতো গরীব যুবক জানতোও না। স্নাতক হওয়ার পর অ্যাসাইনমেন্ট পুল কমপিউটার ওকে মেডাকালা মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেয়। যতদিন কিছু ভালো না জুটছে ততদিন ওখানেই থাকো এরকম একটা ভাবনা নিয়ে।
কিউরেটরের অফিসে পৌছে স্বয়ংক্রিয় দরজা পার হয়ে ভেতরে উঁকি মারলো বোকারা। ডিপারটমেন্ট সেক্রেটারী, মেরিণ্ডা ওখানে বসে ছিলেন। মধ্যবয়সী এবং সৌম্য দর্শনা। পাউন্ডস্টোনের কাছে যেতে হলে এর সাথে দেখা করতেই হবে। বোকারা সাথে নিয়ে আসা চকলেট আর কিছু ফুল ডেস্কের ওপর রেখে তোষামোদের একটা চেষ্টা করলো। মহিলাটি ওগুলো নিলেন। মুখের ভাবে বোঝা গেল কথা গুলো উপভোগও করছেন। কিন্তু তারপর এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন।
বোকারা বুঝে গেল কিছুই করার নেই। যা হওয়ার সেটাই হবে। বধ্যভুমিতে জল্লাদ চকচকে খড়্গ নিয়ে ওর জন্যে অপেক্ষমান।
গলায় অনেকটা দুঃখ মিশিয়ে মেরিন্ডা বললেন, ‘সোজা চলে যাও টারস। উনি অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য।’
‘কোন ভাবেই কি এটাকে এড়ানো যায় না?’
মেরিন্ডা হতাশাসূচক একটা শব্দ করলেন।
অগত্যা বোকারা ভাগ্যের সাথে একহাত দাবা খেলার সংকল্পে মনস্থির করে, কাঁধ শক্ত করে এগিয়ে চললো পাঊন্ডস্টোনের সাথে দেখা করার জন্য।
প্রধান অফিস ঘরটায় ঢুকে ও দেখতে পেলো একটা বিরাট ডেস্ক। যার ওপরটা দেখে বোঝাই যায় কোনও রকম কাজ কর্ম এখানে হয় না। মনেই হচ্ছে না এটা কোন সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এর অফিস ঘর। পেছনের কারুকার্যময় চত্বরটা পেরিয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলেন পাউন্ডস্টোন। বোকারার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন। ওনার মনে হল এই রকম লম্বা, রোদে পোড়া, গভীর কালো চোখ এবং চওড়া ঢালু কপাল যুক্ত যুবকেরাই মানব প্রজাতিতে সম্রাট হওয়ার যোগ্য। এরাই পারে সৈন্যদের আদেশ দিতে যে কোন শহরকে ছারখার করে দেওয়ার জন্য।
‘আদেশ অনুসারে, হিস্ট্রি টেকনিশিয়ান লেভেল ফাইভ টারস বোকারা রিপোরটিং স্যার।’
গম্ভীর শান্ত স্বরে পাউন্ডস্টোন বললেন, ‘খুব খুব ভালো। দারুন ব্যাপার। বুঝলে কিনা। তোমায় দেখে খুশীই হলাম। তা তোমার বাবা কেমন আছেন?’
‘মরে বেঁচে গেছেন স্যার।’
‘ওঃ! যাকগে ছাড়ো ওসব কথা। আজকের দিনটা বুঝলে কিনা, তোমার জীবনের একটা চিহ্নিত করে রাখার মতো দিন বলে বিবেচনা করতে পারো। বুঝলে কিনা, ফিল্ড ওয়ার্কই হল একমাত্র কাজ যা এক জন মহান ইতিহাসবিদের জন্ম দেয়। আমিও সেটাই করতে চাই, কিন্তু কমিটি আমাকে এই অফিসের বাঁধনে বেঁধে দিয়েছে। এ আমার একদম পছন্দ নয়।’
‘যা বলেছেন স্যার।’
‘শোনো তুমি একটা অভিযানের নেতৃত্ব দেবে,’ চোখে এক কুটিল ঝলক ফুটিয়ে পাউন্ডস্টোন বললেন। ‘এমন এক অভিযান যেখানে তুমি খুঁজে বার করবে পুরাতন পৃথিবীকে। মানব সভ্যতার সেই উৎস স্রোতকে। পঞ্চাশ হাজার বছর আগে যা হারিয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে। ক্লাস্টার ওয়ারের সেই সাংঘাতিক ধ্বংস কান্ডের পর।’
বোকারা হতবাকের মতো কিছুটা সময় চেয়ে থেকে বললো, ‘পুরাতন পৃথিবী! সে তো এক কল্প কাহিনী স্যার?’
‘মোটেই না,’ হাওয়ায় হাত ঝেড়ে বললেন পাউন্ডস্টোন। ‘১০ হাজার বছর আগের একটা বেটা সেঞ্চুয়ারী যুদ্ধ জাহাজ খুঁজে পেয়েছিল হিস্ট–টেকনাসীয়া। তারই গানারি কমপিউটারের রেকর্ড থেকে যে তথ্য উদ্ধার হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে ওটা সম্ভবত পুরাতন পৃথিবীর জিনিষ। শোনো ছোকরা, তোমার সামনে এটা একটা বিরাট সুযোগ।’
বোকারার মনে হল ঘরটায় বিন্দুমাত্র বাতাস নেই। দম আটকানো স্বরে বললো, ‘আমি কি করে অভিযানে নেতৃত্ব দেবো স্যার? আমার তো কোন অভিজ্ঞতাই নেই !’
পাউন্ডস্টোন হাসলেন, ‘হ্যাঁ তুমিই দেবে এই অভিযানের নেতৃত্ব। আরে বাবা বুঝলে কিনা, অভিযাত্রীর কাছে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়াটা খুব একটা সাধারন ব্যাপার। তা ছাড়া আমাদের এখন লোক বলও খুব কম। বিশেষ করে ভেগান আর ডেল্টার ঘটনা দুটো ঘটে যাওয়ার পর। প্রাইম মিউজিয়ামের ওই চেয়ারে বসে থাকা জিনিয়াসগুলো আমাকে তো এই অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদী এবং আনুষাঙ্গিক খরচ খরচা বিশেষ কিছুই দেবে না। তাই আপাতত যা দাঁড়াচ্ছে বুঝলে কিনা। এটা হবে একটা একক অভিযান আর তার নেতৃত্ব দেবে তুমি।’
‘আমি তোমার জন্য এ–আই [কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা] ফ্রেটারে একটা প্যাসেজ বুক করে দিচ্ছি, যেটা কোঅরডিনেট করে যাওয়ার সময় তোমাকে তুলে নেবে। লোয়ার স্টোরেজ লেভেল ঘুরে দেখার সময় একটা মানবরুপী যুদ্ধবাজ রোবট খুঁজে পেয়েছি। গত চারশো বছরে ও জিনিষ কেউ দেখেছে বলে আমার মনে হয় না। যদি ওটাকে চালু করতে পারি, সফর সাথী হিসাবে ওটাকে তোমার সাথে দিয়ে দেব।’
পাউন্ডস্টোন আরো কত কিছু বক বক করে গেলেন, কিন্তু তার বিন্দু বিসর্গ বোকারার মগজে ঢুকলো বলে মনে হয় না। ওর মন এখন আচ্ছন্ন আগামী অনিশ্চিত অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের ভাবনায়।
দুমাস পর।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যান গাম্পিনার ছোট্ট কেবিনে বসে আছে বোকারা। যানটি এগিয়ে চলেছে এক বিস্মরণের তালিকায় থাকা জি ক্লাস তারার দিকে। ইতিহাসের তথ্য অনুসারে যেখানে একটা প্রাচীন বেটা সেঞ্চুরাই যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়েছিল।
গাম্পিনার এ–আই আপাতত আর বক বক করছে না। এই অভিযানের প্রথম দুটো সপ্তাহ বিষাক্ত আচ্ছন্নতায় কেটে গেছে বোকারার। ভুল করে অ্যানোডাইন বেশী মাত্রায় খেয়ে ফেলেছিল। আর তার ফলে নরক যন্ত্রনা কাকে বলে সেটা ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার কারনে সে এবং এই গাম্পিনা এখনও টিঁকে আছে।
সহসাই বোকারার ঠিক মাথার ওপরে থাকা স্পীকারে ভেসে এলো এক অনুভূতিহীন যান্ত্রিক মহিলা কন্ঠস্বর– ‘গাম্পিনার যাত্রীদের উদ্দেশ্যে জানানো হচ্ছে আমরা ক্লাস ৪৩বি২ টাইপ গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ করছি। আপনার ব্যক্তিগত এ আই রোবট এখন সক্রিয় এবং যে কোন রকম যোগাযোগ নিয়ন্ত্রনে সক্ষম।’
ভেসে আসা শব্দগুলোর কাঠ কাঠ উচ্চারন বুঝিয়ে দিলো যে কেবলমাত্রই শব্দ ছাড়া ওর আর কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নেই।
বোকারা কোন হুঁ–হ্যাঁ করলো না।
কেবিনের ছোট্ট দরজাটা এবার খুলে গেল। বোকারা কৌতূহলী চোখে তাকালো। একটা রোবটের আবির্ভাব হয়েছে ওখানে। মোটেই ওর চেনা শিপ–বটদের মতো দেখতে নয় এটা। আদলে মহিলা। পাতলা গড়ন এবং কমনীয় ভাব। রঙবিহীন তারের মতো কিছু চুল ছড়িয়ে আছে কাঁধের ওপর। অ্যান্টেনা বা হিট সিঙ্ক হবে বলেই মনে হচ্ছে। মানুষের মতো ডিটেল না থাকলেও মুখটা বেশ ভালোই। দুটো চোখ এদিক ওদিক দেখছে ঘুরে ঘুরে। বোকারোর কেমন যেন মনে হলো ডিজাইনার এটাকে নিজের গার্ল ফ্রেন্ডের আদলে বানিয়েছিল। রুপোলী শরীর জানান দিচ্ছে অস্ত্র শক্তির পরিমাণ। তবে পালিশের প্রয়োজন। সারা দেহের চটে যাওয়া রঙ এবং ঘষটে যাওয়ার দাগ প্রমান দিচ্ছে একসময় এর ভালোই ব্যবহার হয়েছে। পরনে কালো রঙের ফাইবারে বোনা এক পোশাক। যার ওপর রুপোলী রঙ দিয়ে লেখা আছে এ এন ১৫৮৯০৯।
আরও খানিকটা এগিয়ে এসে রোবটটা থামলো। ভেসে এলো শব্দ, ‘এইচ সি আর ইউনিট এ এন ১৫৮৯০৯। রাজকীয় যোদ্ধা বাহিনী, ৭১ ব্যাচের ফারস্ট ওয়ান। রিপোরটিং।’
‘বাহ! বেশ ভালো!’ বোকারা বললো, ‘তোমায় বলে যদিও কোন লাভ নেই, তবুও জানাই প্রায় ৬০০ বছর আগে তোমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।’
‘জানি। কিন্তু এই ইউনিট এর আপাতত কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’
‘হুম, বেশ। এই মুহূর্ত থেকে তুমি… অ্যান ওয়ান, মেডাকাল্লা অভিযানের অংশ বলে ঘোষিত হলে।’
রোবটটি একটু কেঁপে উঠলো; ওর চকচকে রুপোলী মানবসম চোখে তাকালো বোকারার দিকে, উত্তর দিলো, ‘বুঝলাম, আপনার অবগতির জন্য জানাই, এই যানের এ আই আমাকে জানিয়েছে আমরা একটি স্থায়ী কক্ষপথে অবস্থান করছি। সে এটাও জানিয়েছে সম্ভব হলে আমরা যেন আমাদের লক্ষ্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।’
‘অ্যান ওয়ান আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আমরা আর বেশিক্ষণ এখানে থাকি এটা কেউ চায় না। চলো তাহলে সেটাই করা যাক।’
অ্যান ওয়ান এগিয়ে গিয়ে যানটাকে নিয়ন্ত্রন করার আসনে বসলো। সামনের কিছু বোতাম এবং হাতল টিপলো টানলো, এগোলো পিছালো। কয়েকটা নোড জুড়ে দিলো কম্পিউটারে। বোকারা এসে বসলো পেছনের আসনটায়। অ্যান আর একটা ইঞ্জিন চালু করলো। গাম্পিনার শাটলটা মুক্ত হলো আর প্রায় ধুমকেতুর মতো এগিয়ে চললো সামনের দিকে, একটি বিশেষ গ্রহের সন্ধানে; অজানার পথে।
কিছুটা সময় বাদে বোকারা একটা বড় মাপের শ্বাস ছেড়ে অ্যান ওয়ানের ধাতব কাঁধের ওপর দিয়ে মনিটারে চোখ রাখলো। এক মৃত জগত দেখতে পাবে বলে ভেবেছিল। অথবা চোখে আসবে এক আদিম বন্য রূপ। কিন্তু চমকে গেল গ্রহটির রাত্রিকালিন দিকটা এক স্নিগ্ধ আলোয় ঝকঝক করছে দেখে।
‘অ্যান ওয়ান, স্ক্যানার রিডিং কি বলছে এই গ্রহ সম্পর্কে?’
‘বলছি স্যার। রিডিং জানাচ্ছে বেশ কিছু কৃত্রিম শক্তির উৎস আছে এ গ্রহে। কৃত্রিম আলোর বিচ্ছুরণও দেখা যাচ্ছে। ইনফ্রারেড সেন্সর জানান দিচ্ছে বিভিন্ন তাপ মাত্রার অনেক কিছু আছে এই গ্রহে। মেরুপ্রদেশ ও সমুদ্র অঞ্চল বাদ দিলে সমস্ত স্থল ভাগটাই মনে হচ্ছে ঢাকা আছে একটা বিরাট মাপের কাঠামো দ্বারা। ১০–২০ মিটার উচ্চতা সেগুলোর স্থান ভেদে। না, কিছু উন্মুক্ত স্থানও আছে। সে সব স্থানে পুরানো প্রযুক্তির যানবাহনে ভর্তি বলেই প্রতিভাত হচ্ছে। সব কিছুই তৈরী জ্যামিতিক আকার মেনে। আর সব কিছুই ঝকমক করছে।’
বোকারা অবাক হয়ে বললো, ‘যা বলছো তাতে তো মনে হচ্ছে গোটা গ্রহটা একটা বিশাল বাড়ী? অ্যান, উত্তর দিকের কোন ফাঁকা জায়গায় আমাদের ল্যান্ডিং এর ব্যবস্থা করো; যেখানে আলোর পরিমাণ বেশ ভালো। তার আগে দেখে নাও কোনও জীবের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে কিনা? কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে কি এখানে?’
‘স্ক্যানার রিডিং দুটোর ক্ষেত্রেই নেতিবাচক সংকেত দিচ্ছে স্যার।’
ওরা এমন একটা জায়গা বেছে নিয়ে নামলো যার চার দিকে স্তূপাকৃতি হয়ে পড়ে আছে যন্ত্রপাতি। বোঝাই যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে ওগুলো অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে।
ওদের চোখে পড়লো এক বিশাল মাপের নিওন ইলেকট্রিক সাইন। ‘ধ্যাত তেরে কি!’ বোকারো বললো, ‘ভুলেই গিয়েছি আমার ইমপ্ল্যান্টটাকে সক্রিয় করতে।’ নির্দিষ্ট মানসিক সূত্রটা খুঁজে নিয়ে গাম্পিনার সাথে সাইক্রোটনিক কম্পিউটার লিঙ্কটা জুড়ে নিতে অবশ্য বেশি সময় লাগলো না।
‘ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোটোকল আপলোড হলো।’ কথাটা শুনতে পেয়ে বোকারা গাম্পিনার এ আই–কে বললো ‘ট্রান্সলেট করো।’
ফিস ফিস শব্দ আবার শুনতে পেলো সে মনের মধ্যে, ‘কোনোরকম মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চেষ্টা চলছে প্রসেসিং করার।’
অ্যান ওয়ান ছোট্ট যানটার সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করলো। ওদিকে বায়ুমন্ডলের সেন্সর পরীক্ষা করে বোকারা মনে মনে বললো, মানবতার প্রাচীন বাসস্থান। যদি এটা সেটাই হয়! এখনো শান্তভাবেই তার থে্কে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সন্তানদের স্বাগত জানাচ্ছে! রোমাঞ্চের একটা শিহরন খেলে গেল ওর শরীরে।
প্রাচীন পৃথিবী অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল তাহলে। বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার লকটা ঘুরিয়ে ধাতব ভারী পাল্লাটা ঠেললো সে।
ভিজে ঠান্ডা একটা বাতাসের ঝলক এসে ধাক্কা মারলো বোকারার গায়ে। সাথে সাথেই বোকারা দেখতে পেল একটা মিটার দুয়েক উঁচু নীল, হলুদ ও সবুজ রঙের আতঙ্ক উদ্রেককারী প্রানী ওর দিকে দুটো হাতের মতো কিছু বাড়িয়ে দিয়েছে। ওটার মাথায় দুটো বড় বড় অ্যান্টেনার মত শুঁড় নড়ছে। গা শিউড়ে উঠলো বোকারার। সহজাত প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে পিছাতে গেল কয়েক পা আর হাত চলে গেল স্টানারটায়। কিন্তু শরীরটা নিয়ন্ত্রনে থাকলো না। ফলে পড়ে গেল বোকারা আর আগ্নেয়াস্ত্রটা ছিটকে গেল হাত থেকে। গড়িয়ে গেল অ্যান ওয়ানের কাছে। আক্রমণের ভঙ্গীতে নিজের রূপোলী হাতটা এগালো অ্যান আতঙ্কটার দিকে।
অদ্ভুতদর্শন প্রাণীটা এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। জটীল পুঞ্জাক্ষী দ্বারা গঠিত দুটো চোখ ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো মহাকাশযানটার সব কিছু। তারপর ঘর ঘরে শব্দ করে বললো, ‘ওয়েল কাম টু আর্থ মারট। ওপেন টোয়েন্টি ফর আওয়ারস। চব্বিশ ঘন্টার জন্য খোলা।’
বোকারা তোতলানোর মতো করে বললো, ‘ক–ক–কি–ই?’
‘আর্থ মারটে আপনাকে স্বাগত। যেখানে ক্রেতাই সর্বেসর্বা। আপনার কেনা কাটার জন্য এ বিপণী ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে।’
ভাষা রূপান্তরের যন্ত্রটা মনে হচ্ছে কিছু গণ্ডগোল করছে, মনে হলো বোকারার।
প্রাণীটার দিক থেকে আক্রমণের কোন লক্ষণ না দেখে জানতে চাইলো সে, ‘তুমি… আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন?’
‘আর্থ মারট সব সময় ক্রেতাদের চাহিদা ও প্রয়োজন বোঝে। আপনার কথা বলার ভঙ্গীটা খুব মজাদার। অবশ্য এসব কথা বলার আমি কে? জানিয়ে রাখি দীর্ঘ পাঁচ বছর বাদে আপনিই প্রথম কাস্টমার যাকে আমরা পেলাম।’
‘তার মানে এটা বোধহয় আমাকে অন্ততঃ খেয়ে ফেলতে চায় না,’ বিড় বিড় করে বললো বোকারা।
অ্যান ওয়ান ভেবে নিলো ওকে প্রশ্নটা করা হয়েছে। বললো, ‘পর্যাপ্ত ডাটা আমাদের হাতে নেই। তবে আচরণে আক্রমনাত্বক মনে হচ্ছে না।’
প্রাণীটা বলে উঠলো, ‘অবশ্যই না স্যার। গ্রাহকেরা হলো আর্থ মারটের সম্রাট। মোটেই হেলাফেলা করার ব্যাপার নয়।’
প্রাণীটা আসলে কী সেটা এবার বোকারার মানসপটে এক ঝলকের জন্য ভেসে উঠলো। পেরিপ্ল্যানেটা আমেরিকানা ওরফে আমেরিকান আরশোলা। স্টানারের দিকে হাত বাড়িয়ে প্রশ্নটা করলো বোকারা, ‘মাফ করবেন, একটা প্রশ্ন ছিল। জানতে চাওয়ার জন্য দুঃখিত। আপনি কি আরশোলা?’
‘হ্যাঁ স্যার। আমাকে তুমি করে বলুন। আমি পৃথিবীর আসল প্রাণী প্রজাতির শেষ চারজনের একজন যে বেঁচে আছে। আপাতত অবশ্য পাঁচ জন। কারন আপনিও উপস্থিত এখানে। আমি স্বাগতক, এই বিশাল উত্তর পূর্ব এলাকার। আপানার সাথে দেখা করতে পেরে আমি নিজেকে গর্বিত ও সম্মানিত মনে করছি। আহা কি সৌভাগ্য আমার। দয়া করে বিপণীর ভেতরে প্রবেশ করুন।’
বোকারা ভালো করে পোকাটার দিকে তাকালো। সামান্য স্বস্তি অনুভব করছে এই ভেবে যে ওটা ওকে মেরে খেয়ে ফেলতে চায় না। কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে ভালো করে এবার দেখতে শুরু করলো স্বাগতককে। চকচকে বাদামী রঙ। নীল আর হলুদ রঙের পোশাক পরে আছে। সাথে সবুজ রঙের চারপাওয়ালা ট্রাউজার।
‘বলছিলাম কি, মানে, আমার জানাটা হয়তো ভুলও হতে পারে। আরশোলা কি এতো বড় হয়?’
‘আপনি যাদের কথা ভাবছেন সে সব আদ্দিকালের ব্যাপার,’ স্বাগতক বললো। ‘আপনারা মানুষেরা এই গ্রহ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর প্রকৃতির অজানা নিয়মে আমাদের বিশেষ বিবর্তন ঘটলো। প্রকৃতিতে কেমন একটা শূন্যতা তৈরী হয়ে গিয়েছিল আপনারা চলে যাওয়ার পর। সেটাকেই ভরাট করার জন্য আমরা মাপে বড় হয়ে গেলাম।’
স্টানারটা খাপে ঢুকিয়ে রেখে বোকারা জানতে চাইলো, ‘তোমার কোনো নাম আছে?’ উত্তরে পোকাটা কিছু খ্যার খ্যার ক্যাট ক্যাট কিঁচ কিঁচ শব্দ করলো।
বোকারা বললো, ‘হুম বুঝলাম। আমার ট্রান্সলেটর মেশিন কিছুই বুঝতে পারলো না। আমি বরং তোমাকে স্বাগতক বলেই ডাকবো। অসুবিধা নেই তো?’
‘আর্থ মারটে গ্রাহক যা বলেন সেটাই ঠিক।’
বোকারা এটাকে সম্মতিসূচক বলেই ধরে নিলো।
‘আপনি কি আমাদের বিপণীর কোন বিশেষ বিভাগে যেতে চান ?’ তারপর অ্যানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এটাকে কোন বিভাগ থেকে সংগ্রহ করলেন? খেলনা নাকি হোম ইলেকট্রনিক্স?’
অ্যান ওয়ান নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে উত্তর দিলো, ‘আমি নেগাল সিক্স ওমেগা র্যাম প্রযুক্তিতে তৈরী একজন হিউম্যান ফর্ম কমব্যাট রোবট। আমাকে বানানো হয়েছিল এক হাজার সাতশো আটত্রিশ বছর আগে। তারপর উন্নতির চাকায় আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল চারশো ছিয়ানব্বই বছর আগে।’
‘এই ব্যাপারগুলো খুব খারাপ,’ স্বাগতক বললো। ‘তবে আপনি যদি চান আমরা ওকে নিয়ে তার বদলে অন্য ভালো কিছু দিতে পারি স্যার।’
‘না তার দরকার নেই। অ্যান ওয়ান আমার কাছেই থাকবে। ও আমার সহকর্মী।’
‘আরে তাহলে তো দারুন ব্যাপার! দুজন গ্রাহক। আমি ইতিহাসের পাতায় জায়গা পেয়ে যাবো,’ স্বাগতক বলে উঠলো উৎফুল্ল স্বরে।
‘কোন ইতিহাসের কথা বলছো তুমি?’ বোকারা জানতে চাইলো। ‘আমিও একজন হিস্ট্রি টেকনিশিয়ান। মহাজাগতিক ইতিহাস অনুসারে প্রাচীন পৃথিবী লক্ষ লক্ষ বছর আগে হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজে বার করতেই আমি এসেছি। এতদিনের ইতিহাস জানতে হবে আমাকে। তোমাদের নেতা বা নেত্রীর কাছে আমাকে নিয়ে চলো স্বাগতক।’
‘আপনি কি স্টোর ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চান? ওরকম করে তাকাচ্ছেন কেন? আমি কি কিছু ভুল বললাম?’
‘না না,’ দ্রুত উত্তর দিলো বোকারা। আমি এই দোকানের ইতিহাস জানতে আগ্রহী। এখানে কি বিক্রি হয়? এটা কিভাবে চালানো হয়? ইত্যাদি।’
‘ঠিক আছে স্যার। কিন্তু তার জন্য তো আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে। ম্যানেজারের অফিস বেশ কিছুটা দূরে। আপনি যেতে চাইলে অবশ্যই আমি নিয়ে যাবো। আমাদের স্টোরের ট্রানজিট ব্যবহার করতে হবে। আমি আবার কোনও দিন এয়ার ক্র্যাফটে চাপিনি। তাই জানিনা ওটা কি করে ব্যবহার করতে হয়।’
‘অ্যান ওয়ান আমাদের শাটল এই বায়ুমণ্ডলে ব্যবহার করা যাবে কি?’ বোকারা জানতে চাইলো, গ্রহটি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভবনগুলোর কথা ভেবে।
‘ঠিকঠাক জানি না স্যার। তবে এই মডেলের শাটল বড় ধরনের বায়ুমণ্ডলে ঘোরা ফেরার উপযুক্ত নয় বলেই আমার ধারনা। তা ছাড়া জ্বালানি ও নির্দিষ্ট মাপে আছে। যা খরচ করাটা ঠিক নয়।’
বিশাল আরশোলাটা শাটলটার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল এবং বললো, ‘আমাদের এমনি হেঁটে যাওয়াই ভালো।’
বোকারা নিজের মনকে অজানা আগামী পরিস্থিতির কথা ভেবে দৃঢ় করে নিয়ে বললো, ‘চলো অ্যান, রওনা দেওয়া যাক।’
‘আমার মনে হয় আমার এখানে থাকাই ভালো। শাটলটা পাহারা দেওয়ার জন্য।’
‘না। তার বদলে দরকার হোক বা না হোক, তোমার আমার সাথে যাওয়াটা বেশি প্রয়োজন। একটা যুদ্ধবাজ রোবট আমার সাথে আছে এটা আমাকে অনেকটা স্বস্তি দেবে। তা তোমার অস্ত্রশস্ত্রগুলো সব সাথে আছে তো?’
‘অবশ্যই। দু হাতের তর্জনীতে আছে থ্রি মিলিমিটার লেজার। অনামিকায় স্টানার। আর দুহাতেই আছে পাম ব্লেড।‘
‘অ্যান আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর এলো, ‘এইচ সি আর ইউনিট এ এন ১৫৮৯০৯ উপভোগের জন্য বানানো মডেল নয় স্যার।’
পোকাটা বলে উঠলো, ‘হেই, তুমি আমাকে গুলি করবে নাতো?’
যান্ত্রিক কণ্ঠ বললো, ‘চিন্তা নেই, সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সুরক্ষিত আছে।’
‘ধুর বাবা। আমার উচিত ছিলো, তোমাকে সাথে নেওয়ার আগে তোমার ব্যবহার বিধিটা পড়ে নেওয়া। আচ্ছা তুমি স্বাগতককে প্রথম দেখায় ঝলসে দাওনি কেন?’
‘লক্ষ্যবস্তুর ওপর কিছু করার জন্য আপনার অনুমতি দরকার।’
আবহাওয়া অনুকূল এটা বুঝে নিয়ে বোকারা জানতে চাইলো, ‘ এই পোশাকটার লক কি করে খোলে জানা আছে?’
অ্যান এগিয়ে এসে পোশাকের কলারটায় চাপ দিয়ে ঠেলে দিলো পেছন দিকে। একটা অ্যাকসেস প্যানেল খুলে গেল বোকারার সামনে। ‘ওই লাল বোতামটা তিনবার টিপুন।’
সেটা করতেই স্বয়ংক্রিয় পোশাক খুলে গেল বোকারার শরীর থেকে। ‘এবার চলো। আর হ্যাঁ, না বললে কাউকে মেরো না।’
‘বুঝলাম।’
শাটল থেকে বেরিয়ে এসে বোকারা চারপাশ দেখলো। সূর্য মাথার ওপর, ঝকঝকে নীল আকাশ। আবহাওয়া ঠান্ডা। চারদিকে বিজ্ঞাপণের ছড়াছড়ি। যদিও ওগুলোর আলোয় দিনের বেলায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছেনা। বোকারা লেখাগুলো পড়তে পারলেও বুঝতে কিছুই পারছিল না। “এ টি এম ইন বিল্ডিং”, “ইজি টার্মস – ইনভেন্টরি ডিডাকসন অন রেড ডট”। কিছু দূরে একটা দাঁড়িয়ে থাকা আকাশযানের ওপর দিয়ে চোখে পড়লো কাঁচের জানালার সারি। স্বাগতক ওদের ছাড়িয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ওরা দ্রুত এগিয়ে গেল পোকাটার কাছে। বোকারার হাঁটার সময় যথেষ্টই শব্দ হচ্ছিল কিন্তু অ্যান ওয়ানের পদচারনা শব্দহীন। বোকারা বুঝলো প্রয়োজন অনুসারে যুদ্ধবাজ রোবটদের এভাবেই শব্দহীন ভাবে হাঁটার জন্য বানানো হয়।
স্বাগতকের পিছু পিছু ওরা এক স্বয়ংক্রিয় দরজা পেরিয়ে একটা বড় ভবনের ভেতর ঢুকলো। ভেতরটা আলোয় আলোময়। বাইরের চেয়ে ঠান্ডাও অনেক বেশী।
এখানকার সব বাড়িগুলোই কি এই রকম, ভাবলো বোকারা। চারদিকে শুধু জিনিষপত্রে ভর্তি তাকের সারি। অনন্ত সারি। ‘গোটা গ্রহটাই একটা দোকান?!!!’ বলে উঠলো বোকারা।
স্বাগতক ওদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ সেটাই বলা যেতে পারে। আমি যতদূর জানি প্রাচীন যুগের কিছু সৃষ্টিশীল যন্ত্র আর জিনিষপত্র বিক্রির রসিদ প্রমান দেয় এখানে একটা সময়ে অনেক অনেক বিপণী ছিল। দি ওয়াল, দি পেটস, দি কে , দি স্টেইন – এরকম সব নামের অনেক অনেক বিপণী। সরকার নামের কিছু একটা ছিল মানুষদের। এই বিপণীর মালিকেরা তাদের কিনে নেয় এবং সরকার ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সময় একটা বিপণী থেকে অন্য বিপণীতে যাতায়াত করতে হতো। এরপর এলো এক যুগান্তকারী সংযুক্তিকরন ব্যবস্থা। আর জন্ম নিলো আর্থ মারট।’
‘একটা গ্রহ বদলে গেল একটা দোকানে। একটা দোকানের মতো গ্রহ।’ বোকারা বিড়বিড় করলো।
‘সত্যি কথা বলতে কি,’ স্বাগতক আবার বলা শুরু করলো, ‘শেষ কয়েক বছরে বিপণীগুলোতে এক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রাচীন ধরনের বিক্রয় পদ্ধতি উঠে যাওয়ার পর কমে গিয়েছিল ব্যবসা। মানুষেরা বলতে শুরু করেছিল “এভাবে কিছু খুঁজে পাওয়া বড়ই মুস্কিল”, “কে কি বিক্রি করছে বোঝা যাচ্ছে না। সব জায়গায় একই রকম জিনিষ। একই ধরনের কর্মী।” এটাও শুনেছি মানুষেরা সেই পুরাতন লেবেল লাগিয়ে জিনিষপত্র বিক্রি করার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে চাইছিল। ভাবনাটা খারাপ ছিল না। কি বলেন? শুধু কিছু প্রাচীনপন্থী ধৈর্য রাখতে না পেরে ঝামেলা পাকালো। এক অভাগা স্টোর ক্লার্ক মারা গেল। ব্যাস সব ঘেঁটে গেল। ব্লু লাইট স্পেশ্যালদের জন্যই যত গণ্ডগোল হয়েছিল।’
কথা থামিয়ে স্বাগতক এবার খড়মড়ড় করে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ইঙ্গিত করে দেখালো সেইসব জিনিষ যা বিক্রি হবে। বোকারা জিনিষগুলো দেখে চমকে গেল বললে কম বলা হবে। হাজার হাজার বাক্সের লেবেল জানান দিচ্ছে ওগুলো ওর পক্ষে গুপ্তধনের মতো। এসবের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
ওরা হেঁটে চললো সব দেখতে দেখতে। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার ওরা উপস্থিত হলো এমন একটা জায়গায় যেখানে স্বাগতকের চেয়ে কিছু ছোটো মাপের অনেকগুলো আরশোলা, “রক্ত বন্ধ করার প্যাড” লেখা কিছু বাক্স, ওপরের সারি থেকে নামিয়ে আনছিলো। আর কিছু আবার সেই বাক্সগুলোকেই ওপরে নিয়ে যাচ্ছিল। কাজ থামিয়ে ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো হতবাক বোকারা আর কৌতুহলী অ্যান ওয়ান এর দিকে।
‘রি–স্টকিং কর্মচারী এরা,’ স্বাগতক জানালো। ‘আমার মতো জিনগত উন্নতির চরমধাপে এখনো পৌছায়নি। এদেরকে আমরা গ্রাহকদের থেকে দূরেই রাখি। অবশ্য শেষ পাঁচ হাজার বছরে তার দরকার পড়েনি।
ওদের কে এগিয়ে আসতে দেখেই স্বাগতক চেঁচিয়ে বললো, ‘সব পিছু হঠো! পিছু হঠো! গ্রাহকদের বিরক্ত কোরোনা। আমরা স্টোর ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’ ছোট আরশোলাগুলো নত হয়ে পিছিয়ে গেল যতটা পারলো।
‘বাল্যখিল্যের দল বুঝলেন কিনা। বোকার হদ্দ। ওদেরকে কোনো মজুরী–টজুরী দেওয়া হয় না।’
ওদের পেছনে ফেলে বোকারারা এগিয়ে চললো সামনের দিকে। একের পর এক বড় বড় ঘর পেরিয়ে ওরা এলো একটা খোলা জায়গায়। যেখানে দেওয়ালে নিচের দিকে অনেক আলোর ব্যবস্থা থাকলেও সবগুলো জ্বালানো নেই। কাছেই কিছু মনোরেল গাড়ি দাঁড় করানো আছে। স্বাগতক একটার পর একটা পরখ করে দেখতে শুরু করলো এবং একটা পেয়েও গেল ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায়। চড়ে বসলো ওরা ওটাতে। বিভিন্ন কক্ষ কাঁপিয়ে মনোলাইন ধরে গাড়িটা শুরু করলো এগিয়ে যাওয়া।
‘আর্থ মারট সমস্ত রকম আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে, ‘জানালো স্বাগতক। বলাটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না তবু না জানিয়ে থাকতে পারছি না। আর্থ মারটের ডিপার্টমেন্ট গুলোর মধ্যে একটা বিরোধিতার হাওয়া বয়ে বেড়ায়। শেষ গ্রাহক এখানে যে এসেছিল সে ছিল এক আর্কচুরিয়ান। উফস! কি সাংঘাতিক মানসিকতার ক্রেতা যে কি বলবো। এমন ভাব দেখাচ্ছিল যেন ও যা চায় তার কোনটাই এখানে নেই। আমিও তিতিবিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। একের পর জিনিষ আনতে আনতে আমাদের কর্মীরা ঘেমে গিয়েছিল। সবাই চাইছিল কিছু না কিছু বিক্রি হোক। অবশেষে ও একটা আরশোলার কাছে, যে আমারই পূর্ব পুরুষ ছিল, চাইলো একটা পিঠ চুলকানোর দণ্ড। কিন্তু কেন ওটা কিনলো তা বুঝতে পারলাম না জানেন। কারন আর্কচুরিয়ানদের তো পিঠ বলেই কিছুই নেই।
‘এই ঘটনাতে আর্থ মারটের বাকি দুই গোষ্ঠী পায়রা আর ইদুরেরা ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। কারন এটাতে প্রমানিত হয়েছে আরশোলারা হলো প্রকৃত সেলস ম্যান। আমাদের সম্মানটাও বেড়ে গেছে অনেক। আর স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রফেশন্যাল জেলাসীর সৃষ্টি হয়েছে।’
সহসা ওদের মনোরেল গাড়ীটার গতিবেগ অনেকটা কমে গেল।
স্বাগতক বলে উঠলো উৎকণ্ঠার সাথে, ‘এই রে! আমরা মনে হয় মহিলাদের অন্তর্বাস বিভাগের ভেতর দিয়ে চলে এসেছি!’
বোকারা বিপদের আশঙ্কা করে স্টানারে হাত রেখে জানতে চাইলো, ‘তাতে কি হয়েছে?’
স্বাগতক শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকলো। ‘নাহ! যা বুঝছি আমরা ফিসিং অ্যান্ড ক্যাম্পিং বিভাগের কাছে চলে এসেছি।’
গাড়ীটা নিজে নিজে পাশে একটা জায়গায় ঢুকে থেমে গেল। বোকারা তাকিয়ে দেখলো এখানকার তাকগুলো মাছ ধরার বিভিন্ন রকম দন্ড, রান্নার যন্ত্রাদি, স্লিপিং ব্যাগ জাতীয় জিনিষ দিয়ে সাজানো। আর সে সবের দেখা শোনা করছে ইঁদুরেরা। আকারে মানুষের সমান। প্রত্যেকের পড়নে কমলা রঙের জামা, চকরাবকরা প্যান্ট আর ফারের টুপি। কয়েকজনের কাছে অস্ত্র জাতীয় কিছু জিনিষও আছে বলেই মনে হলো।
স্বাগতক সামনের আসনটার মধ্যে যতটা সম্ভব নিজেকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে বললো, ‘উপস্থিত সকলে মন দিয়ে শুনুন। আমারা কোন রকম গণ্ডগোল হোক এটা চাই না। এরা হলেন গ্রাহক। আমি এদের স্টোর ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘এই ব্যাটা আরশোলা তোর বুকনি বাজি থামা!’ একটা বড়সড় ইঁদুর চেঁচিয়ে বললো। পড়ে আছে চকচকে জামা আর টুপি। সাথেই রাবার জাতীয় কিছুর একটা ট্রাঊজার যা ওর বুক পর্যন্ত ওঠানো। ‘আমরা ইঁদুররা জানতে পারবো না, এমন কিছু আর্থ মারটে ঘটতে পারে না। বর্তমান শতাব্দীর সর্বপ্রথম গ্রাহকদের তোরা বদমায়েশি করে হাইজ্যাক করেছিস।’
এবার বোকারাদের দিকে তাকিয়ে ইঁদুরটা বললো, ‘স্বাগতম জানাই গ্রাহকদের আমাদের সুন্দর আর্থ মারটে। ওই জঘন্য পোকাটা নিশ্চিত বকে বকে আপনাদের কান পচিয়ে দিয়েছে। আমরা ইঁদুরেরা আপনাদের দেখা পেয়ে খুবই খুশী হয়েছি। আপনাদের সবরকম বাহ্যিক চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা তৈরী।’
‘আচ্ছা এই বিভাগের বাইরে যাওয়ার দরজাটা কোন দিকে?’
বোকারার প্রশ্নটা ইঁদুরটাকে একটু থমকে দিলো।
‘আপনি কি আমাদের আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে …’ বোকারা হাতটা বাড়ালো নিজের স্টানারের দিকে।
একটা ইঁদুর একটা কাঠের সাথে ধাতুর নল লাগানো বস্তু আলোয় আনলো। আঙুল দিয়ে চাপ দিলো মাঝখানে একটা কিছুটে। সাথে সাথেই একটা কান ফাটানো আওয়াজে চমকে উঠলো সকলেই। কিছু ঝোলানো ল্যাম্প ভেঙে গেল। বোকারার হতভম্বিত ভাব দেখে অ্যান ওয়ান লাফিয়ে উঠে আঙুল তুললো ইঁদুর তার দিকে।
বড়সড় ইঁদুরটা অ্যানকে দেখে স্বাগতকের মতোই জানতে চাইলো, ‘আরে আপনি কি খেলনার বিভাগে ঢুকেছিলেন নাকি?’
বোকারা যতটা পারলো জোরের সাথে বললো, ‘না! ও আমার সাথেই আছে। ও একজন খরিদ্দার।’
‘হ্যাঁ ঠিক তাই, আমি একজন ক্রেতা,’ অ্যান ওয়ান সায় দেওয়ার স্বরে বললো।
ইঁদুরটা হেসে বললো, ‘দারুন একটা ঝলমলে নাইটি আছে, নেবেন নাকি ছোট্ট ম্যাডাম?’
হঠাৎ একটা জোরালো দপ দপ শব্দের ঢেউ এসে ধাক্কা মারলো ওদেরকে।
‘স– র–বো– না –শ!’ একটা ইঁদুর চেঁচিয়ে বললো। ‘ব্লু লাইট স্পেশ্যাল!’
বোকারা ঘুরে তাকালো। মেঝের ওপর দিয়ে কিছু একটা এগিয়ে আসছে। ইঁদুর আর আরশোলার সম্মিলিত একটা দল। প্রত্যেকের পিঠে একটা করে লাঠির মতো আটকানো। তাতে নীল আলো জ্বলছে। নিচের দিকে একটা করে স্পিকার লাগানো। ওগুলো থেকেই ওই দপ দপ শব্দটা বার হচ্ছে। জীবগুলো চেঁচিয়ে বললো, ‘ দি কে!… দি কে!! শুধু মাত্র দি কে!!!’
চকচকে পোশাক পড়া ইঁদুরটা থতমত খেয়ে পড়ে গেল ধপাস করে। হাতের অস্ত্রটা থেকে ছিটকে গেল এক ঝলক উজ্জ্বল আলোক বস্তুর ফোয়ারা।
নেতা ইঁদুরটা চিৎকার করে বললো, ‘সাবধান! কোল ম্যান ল্যান্টারন অ্যাটাক!’
অ্যান ওয়ান লাফিয়ে পড়লো বোকারার ওপর। দুজনেই পড়ে গেল মেঝেতে। একটা বুলেট অ্যানের ধাতব শরীরে লেগে ছিটকে গেল। একই সঙ্গে ওপর থেকে একটা ঝাড় লণ্ঠন ভেঙে পড়লো ওদের ওপরে। বোকারার শরীর আঘাতের হাত থেকে বেঁচে গেল অ্যানের আড়ালে থাকার জন্য। অ্যান চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল বাড়ালো সামনের দিকে। বেরিয়ে এলো লেজার রশ্মি। তার ঝলকে থমকে গেল প্রথমে ওদিকের দুটি দলই। লুকিয়ে পড়লো এদিকে ওদিকে। আর কিছুক্ষন চললো বন্দুকের বজ্রনির্ঘোষ। স্পিকার থেকে দপ দপ করতে থাকা শব্দে কেঁপে কেঁপে গেল পুরো এলাকাটা। নীল আলোর ঝলক ঠিকরে পড়ছে চারপাশে।
বোকারা স্বাগতককে বললো, ‘এখান থেকে আমাদের যেভাবেই হোক পালাতে হবে।’
আরশোলাটা একটা দিক দেখিয়ে দ্রুত ছয় পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল সেইদিকে, ‘এই দিকে আসুন।’ বোকারা দেখলো একটা ইঁদুর স্বাগতকের দিকে লাফ দিতে যাচ্ছে। স্টানারটা দিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলো চার পেয়েটার। ওদিকে ক্রমশঃ লেজার চালানোর কারনে ওভারহিটিং হয়ে কমে আসছিল অ্যানের গতি।
সেটা লক্ষ্য করে বোকারা চেঁচিয়ে বললো, ‘অ্যান লেজার চালানো বন্ধ করো। কেবলমাত্র কেউ তাড়া করলে তাকে খতম করে দাও।’ মনে মনে বললো, আমি চাইনা তোমাকে এখানে ফেলে যেতে।
স্বাগতকের দেখান পথে অনেকটা সময় ধরে ছুটে চলার পর ওরা এসে পৌছালো ছেলেদের পোশাকের বিভাগে। অ্যানের গতি কমে গেছে আরো। দৌড়ানোর সাথে সাথে আবার বেড়েছে তাপমাত্রা।
‘স্যার!’ অ্যান ওয়ান বললো, ‘আমার ওভারহিটিং এর মাত্রা সীমা লঙ্ঘন করেছে। আমার শীতলতা যন্ত্রের চার্জ তলানিতে ঠেকেছে। আমার চার্জ দরকার।’
‘সেকি, এতো তাড়াতাড়ি চার্জ শেষ হয়ে গেল?’
‘শেষ ফুলচার্জ করা হয়েছিল যখন আমাকে শেষবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছিল। তারপর থেকেতো ঠিকমতো কেউ নজরই রাখেনি আমার দিকে।’
‘ওহ মাই গড!’ বোকারা গুঙিয়ে উঠলো। ‘তার মানে সেতো কয়েকশো বছর আগের কথা। আমার সত্যিই উচিত ছিল তোমার ম্যানুয়ালটা পড়া।’
অ্যান ওয়ান একরাশ হতাশার স্বরে বললো, ‘একজন সদাসতর্ক মালিক সেটাই করে থাকেন, স্যার।’
‘আমি দুঃখিত অ্যান।’
‘আমরা অটোমোটিভে থামলে কাজটা হবে,’ জানালো স্বাগতক। ‘কিন্তু সেটা হেবার ড্যাসারীর উল্টোদিকে অবস্থিত। আমি সেখানে যেতে চাই না।’
‘কিন্তু আমাদের যেতেই হবে স্বাগতক। অ্যান ওয়ানের জন্যই যেতে হবে।’
‘ওকে স্যার। গ্রাহকের কথাই শেষ কথা আর্থ মারটে,’ হতাশ ভাবে বললো স্বাগতক।
চারদিকে ডাঁই করে রাখা স্যুট কোট এর স্তুপের পাশ কাটিয়ে এগোতে থাকলো তারা। একটু ধাক্কা লাগলেই ধুলোর চাদর ঢেকে দিচ্ছিলো ওদেরকে। বোকারা বেশ কয়েক বার জোরে হেঁচে উঠলো। স্বাগতক সেটা লক্ষ্য করে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো আপন জনের মতো।
‘এই যে! থামো থামো। তোমরা কি চাও না ভালো …’
স্বাগতকের মাথার ওপরে একটা সাদা বস্তার মতো কিছু একটা পড়লো। যেটা দেখে একটা অস্বস্তিকর শব্দ বেরিয়ে এলো স্বাগতকের গলা থেকে।
‘ওহ মাফ করবেন দুঃখিত,’ গুরগুরে ধরনের শব্দটা ভেসে এলো সাদা বস্তুটা থেকেই। ভালো করে তাকাতে বোঝা গেল প্রায় ২৪–২৫ কেজি ওজনের একটা পোশাক পড়া পায়রা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
স্বাগতক কাছের একটা তাক থেকে একটা প্যান্ট বার করে ঘাড়ের কাছের ধুসর জিনিষটা মুছতে মুছতে তেড়ে মেরে বললো, ‘এই নোংরা কাজটা তুমি ইচ্ছে করে করলে!!’
পাখা ঝাপ্টে পায়রাটা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলো, তুমি তো মোটেই ভালো পোকা নও দেখছি। ওই ইটালিয়ান সিল্কের প্যান্টটা তুমি নষ্ট করে দিলে। এর জন্য যাতে তোমাকে আন্তঃ বিপণী গত ফাইন করা হয় তার জন্য আবেদন করবো আমি।’
নিজের পশ্চাৎ দিকটা দেখিয়ে স্বাগতক বললো, ‘কাঁচকলা করবে তুমি!’
পায়রাটা রেগে মেগে পাখা ঝাপ্টে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘বয়েজ! এই এলাকা থেকে স্প্রে করে এই পোকাটাকে তাড়াও!’
‘না!’ ভীত স্বরে বলে ঊঠলো স্বাগতক।
বোকারা স্টানার ফায়ার করলো পাখিটার দিকে। নিচে সোয়েটারের স্তুপে ধুপ করে পড়ে গেল পায়রাটা।
প্রায় তৎক্ষণাৎ বকম বকম শব্দের ঢেউ তুলে স্পোর্টস জ্যাকেটের তাকটার ওপর হাজির হল একদল পায়রা। প্রত্যেকের গলায় ঝুলছে চকচকে ধারাল মাপের ফিতে। এক পায়ে ধরে আছে প্রায় একফুট লম্বা ছূঁচ।
‘অ্যান,’ বোকারা আর্ত চিৎকার করে বললো, ‘ওদের তাড়াও!’ অনুগত এইচ সি আর সে কাজটাই করলো। আর সাথে সাথেই অ্যানের মাথা থেকে শুরু হল ধোঁয়া বার হওয়া। ওদিকে ঝপ ঝপ করে একের পর এক পায়রা পড়ছিল নিচে। বাকিগুলো উড়ে পালালো।
কাঁপতে থাকা কন্ঠস্বরে স্বাগতক বলো, ‘ধন্যবাদ স্যার। পোকা তাড়ান স্প্রে নিষিদ্ধ হয়েছে এক হাজার বছর আগে আন্তঃ বিপণী যুদ্ধের পর। ওটা ব্যবহার হলে আজ আমি খতম হয়ে যেতাম।’
‘নো প্রবলেম। সব ঠিক আছে,’ কথাগুলো বললেও খাপে স্টানারটা রাখতে গিয়ে বোকারা বুঝল ওর হাত কাঁপছে। ‘ম্যানেজারের অফিস কি আরো দূরে?’
‘আর বেশি না। ওই অটোমোভিকের উলটো দিকটায়।’
ওরা এগোলো অটোমোভিক লক্ষ্য করে।
অ্যান ওয়ানকে ওর দরকারি জিনিষগুলো খুঁজে এনে হাতে দিয়ে স্বাগতক কিছুটা উল্লসিত স্বরে বললো, ‘এখানেও আমাদের জয় হলো। মানে আরশোলা জিতলো। এটাকেও আমার কৃতিত্বের খাতাতেই ধরবে আশা করছি। মানে বিক্রি বলেই ধরা হবে।’
জিনিষগুলো দেখে ধাতব আবেগ হীন মুখে অ্যান জানালো আপাতত কাজ চলে যাবে। এদিকে বোকারার মুখে ফুটে উঠেছে চিন্তার ছাপ।
‘ওহে স্বাগতক, মনে হচ্ছে একটা গণ্ডগোল পাকবে। আমি তো তাড়াহুড়োতে মানিব্যাগটা শাটল এই ফেলে এসেছি।’
‘ওটা কোনও সমস্যাই না স্যার। আমি আপনাকে স্টোর ক্রেডিট কার্ডের অন্তভুক্ত করে দেবো। আর তার জন্য আপনি অতিরিক্ত দশ শতাংশ ছাড় ও পাবেন।’
অ্যানের গায়ে একটা আলতো চাপড় মেরে বোকারা বললো, ‘ধন্যবাদ স্বাগতক। অ্যানকে বাদ দিয়ে আমি এখান থেকে ফিরে যেতেই পারবো না।’
প্রায় সাথে সাথেই অ্যান বললো, ‘আমি আপনাকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি স্যার, আমি সেই ধরনের রোবট নই যে আপনার সঙ্গিনী হতে পারে।’
‘আরে অ্যান ওসব আজে বাজে কথা থামাও দেখি। কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পর আমার নিজেকে বেশ চনমনে মনে হচ্ছে। দারুন উৎসাহিত লাগছে নিজেকে। আর একটা মেয়েকে কি করে খুশি করতে হয় সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে।’
‘আমি একটা রোবট, মেয়ে নই। আমার কোনও আবেগ অনুভুতি নেই।’
‘আবার বাজে কথা। আমি দেখেছি তুমি ছেলেদের পোশাক বিভাগে হাসছিলে।’
‘স্যার আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন হাসার জন্য যা দরকার, সেই ঠোঁট, তাই আমার নেই।’
বোকারা অ্যানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওহো তাইতো, সরি অ্যান… আমি দুঃখিত।’
‘ইটস ওকে স্যার। যদি আমরা এখান থেকে বেঁচে ফিরি তাহলে আপনি আমাকে কিনে নেবেন। তারপর মাল্টি ফাংশন আপগ্রেড করে নেবেন দরকার মতো।’
‘ডিয়ার অ্যান, তুমি আমাকে এখান থেকে যদি শাটলে জ্যান্ত ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারো, তাহলে আমিও কথা দিলাম…’
‘শাটলে ফিরে যাওয়ার তো দরকারই নেই স্যার। ওটাকে রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে আমি এখানেই নিয়ে চলে আসতে পারি।’
বোকারা জানতে চাইলো, ‘অ্যান তুমি রান্না করতে পারো? আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’
‘স্যার আমি কিন্তু দেখেছি। মানুষের কথার কোন দাম নেই। বিশেষ করে পুরুষদের। যখনই উন্নত সিপিইউ বা অতিরিক্ত র্যাম ক্ষমতা সম্পন্ন কিছু মডেল বাজারে আসে, সব প্রতিশ্রুতি ওরা ভুলে যায়। নতুন কোন প্রযুক্তি চোখে পড়লেই আগের প্রযুক্তি আর ওদের ব্যবহারের রুচি থাকে না। গুরুত্বই দেয় না, যেন আগেরগুলো সব জঞ্জাল।’
বোকারা ব্যথিত স্বরে বললো, ‘ঠিক, প্রত্যেক কমপিউটার তার ব্যবহারকারীর জন্য নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়। অ্যান আমি কিন্তু ওরকম মানুষ নই।’
রোবটটা ইতিমধ্যে নিজের সমস্ত খামতি মিটিয়ে নিয়েছে অনেকটাই, সে উত্তর দিলো, ‘ঠিক আছে স্যার, সময়েই সেটা দেখা যাবে।’
এবার স্বাগতক বললো, ‘স্যার আপনারা কি যাওয়ার জন্য তৈরী? তাহলে খেলনা বিভাগের পাশ দিয়ে একটা পথ আছে, তাড়াতাড়ি ম্যানেজারের অফিসে পৌছানোর জন্য।’
আবার শুরু হলো ওদের চলা। স্বাগতককে অনুসরণ করে এগোতে এগোতে বোকারা লক্ষ্য করলো বিপণীগুলোর চেহারা অনেকটাই আলাদা এদিকে। বেশ সাজানো গোছানো।
স্বাগতক জানালো, ‘এটা পরিচালকের নিজস্ব এলাকা।’ ওর শুঁড়গুলোর অতি দ্রুত নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে একটু যেন অস্বস্তিতে ভুগছে। ‘এসব এলাকায় সচরচর সাধারন কর্মীদের আসার সুযোগ হয় না। বলছিলাম কি আমাদের এখানেই থামতে হবে।’
পায়ে চলা পথ ছেড়ে এবার ওরা উঠে এলো কার্পেট পাতা মেঝের ওপর। এখান থেকেই অফিসের শুরু।
স্বাগতক চারদিকের ফাঁকা ডেস্কগুলো দেখতে দেখতে বললো, ‘মনে হচ্ছে আমাদের আগমনবার্তা ইতিমধ্যেই ম্যানেজারের কাছে পৌঁছে গেছে।’
সামনেই একটা কাঠ আর পেতলের নকসা করা দরজা। যার ওপর একটা প্লেট লাগানো। লেখা আছে “স্টোর ম্যানেজার”।
স্বাগতক একটু ভীত স্বরেই জানালো যে ওরা এসে গেছে। ‘বলছিলাম কি, মানে কিছু যদি মনে না করেন, তাহলে আমি ভেতরে যেতে চাই না আপনাদের সাথে। আমি এখানেই অপেক্ষা করবো।’
স্টানারের ওপর হাতটা রেখে বোকারা বললো, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ স্বাগতক। ঠিক আছে তুমি এখানেই থাকো। চলো অ্যান।’
আস্তে করে দরজাটা ঠেলতেই ভেতর থেকে ভেসে এলো কন্ঠস্বর, ‘আসুন, ভেতরে আসুন।’
বোকারা আর অ্যান ওয়ান অতি সতর্কভাবে ঢুকলো ভেতরে। একটা অদ্ভুত ধরনের অনুভুতি বোকারার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে ধাক্কা মারলো। দারুন অফিস ঘরটা। একটা বিরাট টেবিল ওদের সামনে। যেটা দেখে ওর পাউন্ড স্টোনের টেবিলের কথা মনে পড়ে গেল। কাজকর্ম কিছু না হওয়ার চিহ্ন এখানেও একই রকমের। তার মানে এটাও ওই উচ্চস্তরীয় কর্তা ব্যক্তির অফিস। বিশাল টেবিলটার উলটো দিকে একটি সুদৃশ্য চামড়ায় মোড়ানো রিভলভিং চেয়ারের পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ওটা ঘুরতেই দেখা গেল ওটায় বসে আছে একটা ছোট খাটো বাঘের আকৃতির বিড়াল।
‘মিয়াআআও!!’
বোকারা চমকে উঠে বললো, ‘আ…আ… মানে…’
‘হে হে ! খুব চমকে গেছেন দেখছি। মজা করছিলাম। ওটা আমার করতে সব সময় ভালো লাগে।’ হলুদ চোখে বিন্দু মাত্র বন্ধুত্ব বা মজার চিহ্ন মাত্র নেই। ‘আর্থ মারটে আপনাদের স্বাগত জানাই। মাই নেম ইজ বব। আমি আর্থ মারটের সিনিয়র স্টোর ম্যানেজার। হে মানব আসন গ্রহন করুন।’ সামনের চেয়ার দেখিয়ে থাবা নাড়ালো বব।
বোকারা দ্রুত একটা চেয়ারে বসলো। অ্যান দাঁড়িয়েই থাকলো।
‘আমি মেডাকালা মিউজিয়াম অফ অ্যান্টিক এর হিস্ট্রি টেকনিশিয়ান টারস বোকারা। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রাচীন পৃথিবী খুঁজে বার করার এবং তার ইতিহাস বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার। মনে হয় আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি।’
‘ও তাই বুঝি! তাহলে এতোদিনে মানুষদের মনে পড়েছে এই জগতটার কথা। একদিনতো সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল অন্য তারার জগতে। সাথে নিয়ে গিয়েছিল ওদের অতি বিশ্বস্ত কুকুরদের। আর ফেলে গিয়েছিল আমাদের। এই বিড়ালদের। বাড়ী ঘর দেখাশোনা করার জন্য।’
বোকারা কিছু না বোঝার মতো স্বরে বললো, ‘মানে …কি…’
‘মানে আবার কি? তারা কারা শুনি ? যারা এই জগতটাকে একটা বড় বাড়ীতে বদলে দিলো। ইঁদুর, আরশোলা আর পায়রাদের নিয়ে এলো? এটা যদি না করতাম, এই যাকে প্রাচীন পৃথিবী বলছেন সেটা থাকতো? না থাকতো না, সব ধ্বংস হয়ে যেত।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে তার জন্য,’ বোকারা বললো বিড়ালটার ডিনার প্লেটের সাইজের থাবার ভেতর থেকে নখের ঢোকা বেড়ানো দেখতে দেখতে।
‘কিন্তু তার জন্য আমরা বিড়ালরা কি পেলাম শুনি? একটা গাছ ও আস্ত রেখে যায়নি সেই মানুষগুলো যে আঁচড়াবো। অর্ধেকের বেশী সমুদ্রকে ঢেকে ফেলেছিল নিজেদের দরকারে। দারুন সব কাজ করে ছিল মানুষের দল।’ লেজ ঝাপ্টে চেয়ারে নিচু হলো এমন একটা ভঙ্গীতে যে মনে হচ্ছে ঝাঁপিয়ে পড়বে বোকারার ওপর।
বোকারা আঁতকে উঠে হাত তুলে বললো, ‘আরে কি করছেন! আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানিনা।’ পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে ধরে নিয়ে অ্যান ওয়ান নিজের হাতের ভেতর থেকে ধারাল চাকু বের করে টেবিলের সামনের দিকে এগিয়ে এলো।
অ্যানের দিকে তাকিয়ে বব হিসহিসিয়ে বললো, ‘বিড়ালেরা পোকামাকড়, ইঁদুর বা পায়রা নয়। নিজেদের প্রয়োজনের সমাজ বানানোর জন্য তো চলে গেলে সব ছেড়ে। তারপর থেকে আমরা চেষ্টা করেছি একটা সংগঠন বানিয়ে সব টিকিয়ে রাখার। কিন্তু কিই বা ছিল করার মতো? কিই বা রেখে গিয়েছিলে আমাদের জন্য? এই একটাই জিনিষ মাত্র। আর্থ মারট। সেটাকেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। একটা বিপণী যেখানে পাঁচ হাজার বছর ধরে কেউ আসেনি কিছু কেনার জন্য। এই শূন্যতা অনুভব করার মতো ক্ষমতা আছে? এতো আসলে শাস্তি!!’
ঘরঘর–গরগর শব্দ করে বব বললো, ‘এতো দিন পর আবার মানুষ ফিরে এসেছে তাদের পুরোনো ঘরে। আর আমি সুযোগ পেয়েছি। আমাদের পূর্ব পুরুষদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার। বলো মানুষ কি চাও? কি করতে চাও?’
বোকারা খানিকক্ষণ ভাবলো। যে চাকরীতে সে ঢুকেছে, সেখানে ফিরে গিয়ে ম্যানেজমেন্ট এর চাবুক খেয়ে জীবন অতিবাহিত করা ছাড়া আর কোনো কিছু পাওয়ার উপায় নেই। একটু অন্যভাবে ভাবলে কেমন হয়?
‘আমি পুরো আর্থ মারটটাই কিনে নিতে চাই,’ বোকারা উত্তর দিলো এবং সাথে সাথেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সটান পা দুটো তুলে দিলো টেবিলটার ওপর।
এবার চমকে গেল বব, কথার বদলে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা অস্ফুট মিয়াও শব্দ।
বোকারা গলাটা একবার ঝেড়ে নিয়ে বললো, ‘ঐতিহাসিক বস্তুআদির এক বিশাল ভান্ডার এখানে আছে তোমার দায়িত্বে। গোটা গ্রহটা একটা মিউজিয়ামের থেকেও বেশী কিছু। আমি ফিরে গিয়ে যদি এখানে যা দেখলাম তার রিপোর্ট পেশ করি তাহলে এসবের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, অ্যান্টিরিয়ান পিরামিডের মতো। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। লুঠপাঠ হবে সীমাহীন ভাবে। এটাই মানব ইতিহাসে মানুষের আচরণ। মাঝখান থেকে তোমার ভাগ্যে কিছুই জুটবে না।’
বব একরাশ হতাশা নিয়ে বললো, ‘তার মানে তোমাদের মানসিক পরিবর্তন কিছুই ঘটেনি। মানুষ এখনো আগের মতই আছে।’
‘মানি বা না মানি উত্তরটা হল হ্যাঁ,’ বোকারা বললো।‘আর সে জন্যই এই সব ঐতিহাসিক জিনিষ পত্রের এক্সক্লুসিভ এজেন্ট করে নাও আমাকে। আমি ফিরে গিয়ে রিপোর্ট দেব, প্রাচীন পৃথিবীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর্থ মারট নামে যে কিছু আছে, সেটা কেউ জানতেই পারবে না।’
‘তাতে হবে টা কি?’
‘আমি অভি্যান করার ভান করবো। তোমাকে খবর পাঠাবো। তুমি একটু একটু করে জিনিষ পত্র পাঠাবে আমার কাছে। আর বিনিময়ে তুমি ভেসে যাবে দুধের স্রোতে।’
বিস্ফারিত চোখে বব বললো, ‘কি বল–লে তুমি? দুধ!’
‘আমি দুধ বলেছি বুঝি,’ বোকারা একটু অপ্রস্তুতের ভান করে বললো, ‘আমি আসলে মাখন বলতে চেয়েছিলাম।’
‘মাখন!!’ এক স্বপ্নময় বিষয়ের চিন্তায় বাঘের মতো বড়, গৃহপালিত গোত্রের বিড়ালটার চোখ দুটো বুঁজে এলো। একটা মৃদু ঘরঘর শব্দ ধ্বনিত হলো কক্ষটিতে।
‘আরো আছে বব,’ বোকারা বললো।
‘কি আছে ? কি আছে?’ বব চেঁচিয়ে উঠলো।
‘ক্যাট নিপ, কুচো মাছ …’
ববের ঘর ঘরে শব্দটা এবার দশ গুন বেড়ে গেল। চালু হোভারক্র্যাফট ইঞ্জিনের মতো। ‘ওহো ওহো … আহা… চুক্তি পাকা। তুমি আর্থ মারটের এক্সক্লুসিভ এজেন্ট।’
বোকারা হাত বাড়িয়ে বললো, ‘তাহলে ভদ্রলোকের করমর্দন হয়ে যাক।’
বব আব্দারের স্বরে বললো, ‘করমর্দন বাদ দাও স্পেশাল এজেন্ট বোকারা। তার বদলে আমার কানের পাশ দুটোয় একটু হাত বুলিয়ে দিতে কি তোমার আপত্তি আছে ?’
মিউজিয়াম প্রাইম এর মেন টাওয়ারের একেবারে ওপরে নিজের অফিসে বসে পা দুটো ডেস্কের ওপর তুলে টারস বোকারা চেয়ে আছে সুন্দর ঝলমলে একটা আকাশের দিকে। গোলাপী রঙের আকাশে হাল্কা বাতাসে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। কাজের কোন চাপ নেই। ভেসে এলো একটা ঘণ্টা ধ্বনি। কেউ অফিস কক্ষে আসতে চাইছে। কন্ট্রোল প্যানলে হাত বাড়ালো সে। দরজা খুলে গেল। বাইরে দেখা গেল বিভিন্ন ডেস্কে ওর অধস্তন কর্মীরা কাজে মগ্ন। সবচেয়ে কাছের ডেস্কটায় বসে আছে একটা দৈত্যাকার আরশোলা। স্বাগতক। বোকারার দিকে তাকিয়ে শুঁড় দুটো নাড়ালো।
এক সুন্দরী মহিলা খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। কোমর পর্যন্ত খোলা একঢাল চুল নেমে এসেছে কাঁধের ওপর দিয়ে। দেখে চেনার উপায় নেই এই সেই অ্যান ওয়ান। ওর কমব্যাট চ্যাসিস আর সিপি ইউ এর প্রত্যেকটি পার্টসকে সবচেয়ে অত্যাধুনিক আপগ্রেড করা হয়েছে। ওর এখন এক জোড়া মনোলোভা ঠোঁট রয়েছে। স্নিগ্ধ সবুজ রঙের চোখ আর কৃত্রিম চামড়া সম্বলিত অ্যানের দেহবল্লরীর তুলনা করতে প্রাচীন পৃথিবীর কবিদের দরকার।
‘স্যার গ্যালাক্টিক আর্ম দ্বারা বিক্রি হওয়া প্রত্নবস্তুর শেষ রিপোর্টটা এখানে রাখলাম,’ অ্যান বললো। ‘আর গ্যাল সেন্ট্রাল এর ইম্পিরিয়াল মিয়জিয়াম থেকেও ঐতিহাসিক বস্তু কেনার আবেদনপত্র এসে গেছে।’
‘এক্সিলেন্ট অ্যান! দারুন! পুরোনো চ্যাসিস এর কি খবর?’
‘তার জন্য আপনাকে ভালো মানুষের মতো আজ রাত অবধি অপেক্ষা করতে হবে,’ অ্যান মুচকি হেসে জানালো।
বোকারা হাসতে হাসতে বললো, ‘আর কিছু?’
“ও হ্যাঁ। বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম। ডঃ পাউন্ডস্টোন ওডিফেরাস স্লাগওয়ারট আর বেনিসিয়া সেভেনের রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঐতিহাসিক কিছু এখনো নাকি পাননি।’
বোকারা মুচকি হেসে বললো, ‘বলো চেষ্টা চালিয়ে যেতে। আর কিছু দিন খোঁড়াখুঁড়ি করলেই আমি নিশ্চিত কিছু একটা আবিস্কার করে ফেলবেন। আরে বাবা শুধু অফিস ঘরে বসে থাকলে হবে। ইতিহাসবিদ হতে হলে অচেনা অজানা জায়গায় অভিযান করতে হয়।’
ডেস্কে রাখা হলোগ্রাম মনিটার জানান দিলো হাইপার লাইট সিগন্যাল এসেছে। বিশেষ বাটনে আঙুল ছোঁয়াতেই ডেস্কের ওপর একটা বড় সড় সঞ্চরনশীল আকৃতির ছবি দেখা গেল।
‘হেই টারস!’ শোনা গেল ববের কন্ঠ। ‘তালিকা অনুসারে মালপত্র প্যাক হয়ে গেছে।’
‘বাহ বেশ বেশ। তা তুমি আছো কেমন, মাই ডিয়ার স্টোর ম্যানেজার?’
‘এইতো কিছুক্ষন আগে একপ্লেট কুচোমাছ আর দু বোতল দুধ দিয়ে ডিনার সারলাম।’
‘আর আর্থ মারট?’
‘খোলা আছে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য। অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস।’
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ গল্পটি এডওয়ার্ড ম্যাকিওয়েন এর লেখা “ওপেন টোয়েন্টি ফোর আওয়ারস্” গল্পের অনুবাদ। মূল গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০১ সালে ডিসেম্বর মাসে প্ল্যানেট ম্যাগাজিনে।
Tags: অনুবাদ, অনুবাদ গল্প, এডওয়ার্ড ম্যাকিওয়েন, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চব্বিশ ঘন্টার জন্য খোলা, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, প্রতিম দাস
ব্যাপক, সুন্দর অনুবাদ !!!
ঐ দিকেই যাচ্ছে।