চরমজীবী
লেখক: পার্থ দে
শিল্পী: সুমন দাস
প্রিয়দর্শিণী হ্রদকে পিছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে এসেছেন ডঃ বেদ পিল্লাই। একাই এসেছেন। এই আগস্ট মাসের শেষ শীতের -২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কামড় আটকাতে চার স্তরের পোশাক পরে আছেন। গায়ে পোলার পার্কা, ফ্লিস জ্যাকেট, হাতে দস্তানা, মাথা-মুখ ঢাকতে বালাক্লাভা। শারম্যাকার মরুদ্যানের এই বরফহীন উঁচু জায়গাটা বেশ মনোরম। এখান থেকে চারদিকের দিগন্তপ্রসারী বরফের আস্তরণটা দেখলে মনে হয় সৌরজগতের শীতলতম আর নির্জনতম গ্রহটির নাম বুঝি পৃথিবী।
ডঃ পিল্লাই হাতঘড়িটার দিকে তাকালেন। রাত ন’টা বাজে। আজ তুষারঝড়ের কোনও আগাম পূর্বাভাস নেই, রিসার্চ স্টেশনের আবহাওয়াবিদ ডঃ বদ্রীর কাছ থেকে তিনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে এসেছেন। সামনে তাকালেন তিনি। চতুর্দিকে ধূ ধূ বরফের প্রান্তর, কোথাও কোথাও বরফের স্তর শ’খানেক মিটার পুরু! কুইন মড ল্যান্ড যেন এক আস্ত বরফের মরুভূমি। শুধু কুইন মড ল্যান্ড কেন, গোটা অ্যান্টার্কটিকা ভূখন্ড যেন বরফের তৈরি এক নিস্তব্ধ গ্রেভইয়ার্ড! এর তলায় যে সৃষ্টির কোন আদিমতম রহস্য লুকিয়ে রেখেছে তা কেউ জানে না। কিন্তু তিনি বদ্ধপরিকর, একদিন এ রহস্য তিনি খুঁজে বের করবেনই।
একটা মৃদু কনকনে হাওয়া বইতে শুরু করল। শিসের মতো একটা শব্দ উঠছে। আচমকা আকাশের দিকে তাকিয়ে ডঃ পিল্লাই থমকে গেলেন। বিস্ময়ে তাঁর দৃষ্টি স্থির হয়ে এল। একটা সবজেটে আলো সারা আকাশ জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছে। যেন আকাশের গায়ে তিনি এক সঁ আ ল্যুমিয়ের দেখছেন। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন ডঃ পিল্লাই, দিল্লির লাল কেল্লার লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোয়ের চেয়েও মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্য। এ অপূর্ব দৃশ্য যেন ইন্দ্রিয়ের অতীত, যে দৃশ্য রচনা করেছে প্রকৃতি, বিশ্বলোকের সেরা শিল্পী।
তিনি দামী ডিএসএলআর ক্যামেরাটা বের করে অরোরা অস্ট্রালিস বা সাদার্ন লাইটসের অভূতপূর্ব দৃশ্যের ভিডিও তুলতে শুরু করলেন। এসব দুর্লভ ছবি তিনি তাঁর আইআইটিপড়ুয়া কন্যার জন্য তুলছেন। দীর্ঘ ন’মাসের অ্যান্টার্কটিকা যাপনের পর তিনি দিওয়ালির সময় একমাসের ছুটিতে তার দক্ষিণ দিল্লির গ্রেটার কৈলাশের বাড়িতে ফিরবেন। এই ছবিগুলো তাঁর মেয়ের জন্য উপহার।
ডঃ পিল্লাই ভারতের অন্যতম সেরা অনুজীববিজ্ঞানী। গত ডিসেম্বরের গরমের ঋতুতে তিনি অ্যান্টার্কটিকায় ভারতের মৈত্রী গবেষণাকেন্দ্রে যোগ দিয়েছেন। তাঁর টিম মেম্বারদের মধ্যে রয়েছেন প্রফেসর বদ্রীনাথ, ডঃ জ্যোতি রঙ্গরাজন, ডঃ ভুবন শইকিয়া এবং সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আইআইটির গবেষিকা নাওমি বোস। তাঁদের গবেষণার বিষয়টা টপ সিক্রেট, টিম মেম্বাররা ছাড়া কেউ জানে না। মৈত্রীর স্টেট অফ আর্ট গবেষণাগারে চলছে গোপন গবেষণা। সপ্তাহে দু’দিন টিম সদস্যরা মৈত্রী স্টেশন থেকে আশি কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ঘুরে স্পেসিমেন সংগ্রহ করেন। স্পেসিমেন বলতে কিছু আর্কিব্যাকটিরিয়া, গোলকৃমি, অঙ্গুরিমাল আর সামুদ্রিক ক্রিলের মতো জলজ পতঙ্গ। হিমাঙ্কের অনেক নিচে বেঁচে থাকা প্রাণীগুলোকে এক্সট্রিমোফাইল বা চরমজীবী প্রাণী বলে। সংগ্রহের কাজ কাছে হলে হেঁটেই যান, দূরত্ব একটু বেশি হলে তাঁরা টেরা বাস অথবা ফোর্ড ই-সিরিজ ভ্যানটা নেন।
ডঃ পিল্লাই তাঁর ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখলেন। আকাশপটে তখনও ছন্দে ছন্দে দুলে চলেছে সবুজাভ আলো। ইতিমধ্যে ক্যামেরায় প্রায় দু-মিনিটের ভিডিও তুলে ফেলেছেন তিনি। আচমকা ফ্রেমে একটা অন্য ছবি ফুটে উঠল। সাদা ধবধবে বরফের ওপর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে এক ছায়ামূর্তি। প্রায় সোয়া ছ’ফুট উচ্চতার আপাদমস্তক কালো তাপরোধী পোশাকে ঢাকা আগন্তুক যেন এদিকেই আসছে। ডঃ পিল্লাই ঈষৎ জুম করলেন তার ক্যামেরা। আগন্তুকের অবয়ব ক্যামেরার ফ্রেমে আরও বড় হয়ে উঠল। সাদা বরফের ওপর কালো পোশাকে ঢাকা শরীরটার ওপর সবজেটে আলোর হালকা আভা লেগেছে। তবু ছায়ামূর্তির মুখটা যেন চেনা লাগে। বিজ্ঞানী পিল্লাইয়ের মুখেও হালকা হাসি ফুটে ওঠে। তিনি আগুয়ান বন্ধুটির জন্য অপেক্ষা করেন। যাক! আজ রাতের অপরূপ সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করার অনির্বচনীয় অনুভূতিটুকু ভাগ করে নেওয়ার জন্য অন্তত একজন সঙ্গী তিনি পেলেন।
লম্বা লম্বা পা ফেলে মাঝখানের দূরত্বটা কমিয়ে নিচ্ছে সে ছায়ামূর্তি। এতক্ষণে তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেয়ে হেসে উঠলেন তিনি। আকাশের গায়ে নেচে চলা আলোর ঢেউয়ের দিকে আগন্তুকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ডঃ পিল্লাই বললেন, “সি, হোয়াট আ বিউটিফুল সাইট!”
আগন্তুক তার দুটি হাত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে অনু-জীববিজ্ঞানীর পাশে এসে দাঁড়াল। আকাশজুড়ে অপূর্ব আলোর রোশনাইয়ের কাছে চাঁদ যেন আজ কিছুটা ম্লান। বিজ্ঞানী টের পেলেন হাওয়ার বেগ যেন হঠাৎ বেড়ে উঠল, সোঁ সোঁ শব্দের সঙ্গে হাওয়ায় ভেসে আসছে গুঁড়ো গুঁড়ো তুষারের ছিটে। কুইন মড ল্যান্ডের তুষারঝড় বড় মারাত্মক। অল্প সময়ের মধ্যে তার বেগ প্রায় ৮০ নটিক্যাল মাইল প্রতি ঘণ্টা ছুঁয়ে ফেলে।
ডঃ পিল্লাই তাঁর ক্যামেরা গুটিয়ে ক্যাম্পের দিকে ফিরে বললেন, “লেটস মুভ। ঝড়টা ভয়ংকর হয়ে ওঠার আগে ফিরতে হবে।”
তিনি পিছন ফিরতেই দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তির ডানহাত ফ্লিস জ্যাকেটের পকেট থেকে বেরিয়ে আসে। তার দস্তানা পরা হাতের মুঠোয় ঝলসে উঠল একটা ধারালো ইস্পাতের ফলা। ডঃ পিল্লাইয়ের অজান্তেই তাঁর পিছনে দাঁড়ানো আততায়ী হাতে ধরা কসাইয়ের ক্লিভার ছুরিটা একবার শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে এনে এক কোপে তার গলার নলিটা ছিন্ন করে দিল। আচমকা আক্রমণে হতভম্ব ডঃ পিল্লাই গলাটা চেপে ধরে একবার পিছন ফিরে তার আততায়ীর মুখটা দেখলেন, তার চোখেমুখে যন্ত্রণার সঙ্গে ফুটে উঠল গভীর অবিশ্বাস। তিনি বুঝতে পারছেন তার শ্বাস নেওয়ার বাতাস ফুরিয়ে আসছে। তার গলার ছিন্ন অংশ থেকে বেরিয়ে আসা লাল সান্দ্র তরল ভিজিয়ে দিচ্ছে তার হাত। তিনি তুষারঝড়ের মধ্যে টলতে টলতে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। ঠিক তখনই তার ঘাড়ের ওপর আততায়ী ক্লিভারের দ্বিতীয় কোপ মেরে বলে উঠল, “ইনশাল্লাহ্!”
। । ২ । ।
ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি, নিউ দিল্লি
চেয়ারের পিছনদিকে হাতবাঁধা দাড়িওলা লোকটার বুক আর পেটের ঠিক মাঝখানে ডায়াফ্রাম বরাবর সজোরে একটা ঘুঁষি কষাল রীতিন্দর সোধি। চুল খামচে লোকটার সামনে ঝুঁকে পড়া মাথাটা সোজা করে বলল, “সালা ভোঁসরিকে বতাতা কিঁউ নেহি? “
আধো অন্ধকার কনফেশন রুমের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে মনন হাঁ করে দেখছিল রীতিন্দর সিং সোধিকে। ছেলেটা আইপিএস ক্যাডারের জোন-১ থেকে এসেছে। তার চেয়ে দু-ব্যাচ জুনিয়র।
পাঞ্জাব আর হিমাচল প্রদেশ দুটোই সার্ভ করে এসেছে। মনন আর এই রীতিন্দর বলে ছেলেটা একই সরকারী আদেশনামায় বদলি হয়ে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিতে এসেছে মাত্র তিন মাস আগে।
গত দু’মাসে বড় বড় দু’খানা ঘটনা ঘটে গেছে। গত ১৭ জুলাই ২০১৯-এ ভারতের সংসদে এনআইএ (সংশোধনী) বিল ২০১৯ পাস হয়েছে। ঠিক তিন সপ্তাহ পর ৫ আগস্ট, ২০১৯, নতুন বিজেপি সরকার সংসদে ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ৩৭০ এবং ৩৫(ক) -এর বিরুদ্ধে ভোটদান করে ধারা দুটিকে বিলুপ্ত করেছে।
চেয়ারে বসা বিধ্বস্ত চেহারার লোকটাকে গতকালই ওল্ড দিল্লির ফতেপুরী মসজিদের পিছনে খাড়ি বাওলি থেকে তুলে আনা হয়েছে পুছতাছ করার জন্য। তিন সপ্তাহ আগে বারামুলা-অনন্তনাগ হাইওয়ের ওপর বোমা বিস্ফোরণের কেসটায় জঙ্গীসংগঠনের সঙ্গে লোকটার একটা যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
মনন এগিয়ে গিয়ে সোধিকে বলল, “তুমি সরো, আমি দেখছি।”
সোধি সরে যেতে মনন লোকটার সামনে ঝুঁকে বলল, “আসসালাম আলেইকুম।”
লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “আলেইকুম আসসালাম!” সোধির উপর্যুপরি মুষ্ঠি প্রয়োগের পর এতটা ভালো ব্যবহার সে আশা করেনি।
“তোহয় ছিবা বারয়?” এবার আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মনন বলল।
লোকটা আরও অবাক হল, তবে কাশ্মীরি প্রশ্নের প্রত্যুত্তর হিন্দিতেই দিল, “বস্ ঠিক হুঁ সাব।”
“দেখ, ৩৭০ ধারা সরকার উঠিয়ে দিয়েছে। নতুন আইন করে এনআইএ-র হাতেও অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। তোমার বারামুলার দেশের বাড়িতে বুড়িমা আর তোমার চোদ্দ বছরের মেয়ে ফতিমা রয়েছে। আমরা সব জানি। কাশ্মীর স্টেট পুলিশ এখন তাদের বিরক্ত করবে, তাছাড়া ৩৭০ ধারায় যে পুরোনো ইমিউনিটিগুলো তোমরা পেতে সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। তুমি যে এই দিল্লির খাড়ি বাওলির মশলাগলিতে এসে কষ্ট করে কাজ করছ তা তো তোমার মেয়ের জন্য। মেয়েকে পড়াবে, বড় করবে, এখন তোমারই যদি কিছু হয়ে যায়…”
লোকটা একবার বিহ্বল চোখে তাকিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলে উঠল, “স্যর, উনলোগোঁ কো বকশ্ দিজিয়ে। আমি বেশি জানি না, তবে যতটুকু জানি তাই…”
মনন ইশারা করতেই সোধি তার পকেটে রাখা ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারটা অন করে দিল। এখন জাফর নামে লোকটার জবানবন্দি ওতে রেকর্ড হয়ে যাবে।
মনন আগের জায়গায় ফিরে এসে দাঁড়াতেই কনফেশন রুমের বন্ধ দরজার বাইরে থেকে কেউ মৃদু আঘাত করল। দরজা খুলে দাঁড়াতেই সে দেখল এক জুনিয়র অফিসার দাঁড়িয়ে। “বস্ তোমাদের দুজনকে ডেকেছেন,” ছেলেটা বলল।
এনআইএ-তে যোগ দেওয়ার পর এখনও মননের অনেক কিছু গুলিয়ে যায়। বস্ শুনলেই এখনও তার রয়েল বেঙ্গল টাইগার ওরফে কলকাতায় হোম সেক্রেটারির কথা মনে পড়ে। অন্যমনস্ক ডিআইজি মনন শীলের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় মনন শীল আর রীতিন্দর সিং সোধি এনআইএ ডিজি-র চেম্বারে পৌঁছে গেল। রাশভারী চেহারার মানুষটা একটা বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পিছনে বসে আছেন। তার পিছনের দেয়ালে একটা তাম্রফলকের তৈরি ভারতের ম্যাপ এবং এনআইএ-র ইনসিগনিয়া ঝকঝক করছে। ঘরের ভারী পর্দাগুলো টানা, কয়েকটা উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। ডিজি সাহেবের মোটা ঝুপসো গোঁফটি নড়ে উঠল, তিনি সামনে রাখা একটা ফাইল থেকে পড়তে শুরু করলেন, “ডিআইজি মনন শীল, প্রাক্তন ডেপুটি কমিশনার, কলকাতা পুলিশ, সার্ভড বিধান নগর কমিশনারেট। পর্বতারোহী, চৌখাম্বা-১ শৃঙ্গ আরোহণ ২০০৮ সালে, নন্দাঘুন্টি শৃঙ্গ আরোহণ ২০১০। টু ইয়ার্স ট্রেনিং ইন কমব্যাট ফোর্স, মোটামুটি সব আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে জানে। ওরা তোমাকে গিফ্টেড মনে করে কারণ তোমার আইকিউ স্কোর ১৪০!”
ডিজিসাহেব ফাইলটা বন্ধ করে মুচকি হাসলেন। মনন কোনও কথা বলল না। আরেকটা ফাইল খুলে তিনি বললেন, “রীতিন্দর সিং সোধি। এই ফাইলটা আগেই পড়েছি। মননের ফাইলের সঙ্গে অনেক মিল আছে। দুটো বড় পার্থক্য হল, সোধি টু টাইমস বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রম পাঞ্জাব স্টেট, আর ওর আইকিউ স্কোর ১১৮। তবে দুজনের সবচেয়ে বড় মিল হল, দুজনেই অনেক পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করেছে, মাউন্টেনিয়ারিং এক্সপার্ট। সোধিও চৌখাম্বা আর গঙ্গোত্রী-১ চড়েছে। নাউ বয়েজ, হাউ অ্যাবাউট অ্যান এক্সট্রিম অ্যাডভেঞ্চার টুগেদার?”
রীতিন্দর আড়চোখে মননের দিকে তাকিয়ে ভুরুটা নাচাল। এই সার্বজনীন ইঙ্গিতটুকু মনন ঠিকই পড়ে নিতে পারল। “যাচ্চলে! আবার কোথায় ঠেলবে রে?”
“আজ বেলা তিনটের সময়, মানে এখন থেকে ঠিক দেড়ঘণ্টা পরে, লোদী রোডের পৃথ্বীভবনে মিনিস্ট্রি অফ আর্থ সায়েন্সের দপ্তরে সচিবের সঙ্গে তোমরা দুজনে দেখা করবে। হি উইল টেল ইউ অ্যাবাউট ইওর অ্যাসাইনমেন্ট,” বলে ডিজি তার চেয়ার ছেড়ে উঠে চেম্বারলাগোয়া টয়লেটের দিকে পা বাড়ালেন।
মনন আর সোধি দুজনেই বুঝল ‘দিস মিটিং ইজ ওভার’। ওরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। করিডোরে আসতেই সোধি মননের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল, “স্যারজি, এসব কী চলছে। সবেমাত্র তিনমাস আগে পাঞ্জাব পুলিশ থেকে এনআইএ-তে পাঠাল, এখন ফের বলছে… স্যারজি, মুঝে লগতা হ্যায় কি ইয়ে লোগ হমারা গাঁন্ড মারনে কি প্ল্যানিং কর রহা হ্যায়!”
এনআইএ-তে জয়েন করার পর থেকে সোধি মননকে ‘স্যারজি’ বলে ডাকে। কলকাতায় গতবছর ‘আঁখিশ্রী’-র কেসটা সলভ করার ঘটনা সে সংবাদমাধ্যমে শুনে এতটাই ইম্প্রেসড যে মননকে সে একপ্রকার গুরু মেনে নিয়েছে।
কাঁটায় কাঁটায় বেলা তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিটে মনন আর সোধি পৃথ্বীভবনে পৌঁছে গেল। অ্যান্টিচেম্বারে বসা সচিবের পিএ-কে বলতেই সে চেম্বারের ভেতর সচিবকে ফোন করল ইন্টারকমে। দু-মিনিটের মধ্যেই ভেতর থেকে ডাক এল। ঘরে ঢুকেই মননের চোখে পড়ল সচিবের টেবিলের উল্টোদিকে একজন মধ্যবয়সী প্রফেসরগোছের চেহারার মানুষ বসে আছেন।
“ইনি হলেন ন্যশনাল সেন্টার ফর অ্যান্টার্কটিক অ্যান্ড ওশেন রিসার্চ, গোয়া-র ডঃ গিল,” সচিব সামনে বসা ভদ্রলোকের সঙ্গে ওদের আলাপ করিয়ে দিলেন।
সচিবের ইঙ্গিতে ওরা দুজন সামনের চেয়ারে বসে পড়ল।
“সপ্তাহদুয়েক আগে একটা ঘটনা ঘটেছে,” ডঃ গিল বলতে শুরু করলেন। “হয়তো আপনারা শুনেছেন, অ্যান্টার্কটিকার মৈত্রী রিসার্চ স্টেশনে কর্মরত ভারতীয় বিজ্ঞানী ডঃ পিল্লাইয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। স্টেশন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। গত বছর আইআইটি ভুবনেশ্বরের শুভজিৎ সেন নামে এক ছাত্রও অ্যান্টার্কটিকায় এক দুর্ঘটনায় মারা যায়।”
সপ্তাহদুয়েক আগের ঘটনাটা মননের মনে পড়ল। “ডঃ পিল্লাইয়ের কোনও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট…”
মননের কথা শেষ হওয়ার আগেই ডঃ গিল বললেন, “হয়েছে। ওর বডি বিমানে করে কেপটাউনে আনার পরপরই পোস্টমর্টেম হয়েছে। রিপোর্টে অবশ্য এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে পরিষ্কারভাবে খুন বলা হয়েছে।” এক মুহূর্ত থেমে ডঃ গিল একটা ফাইল মননদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই ফাইলে সব ডিটেলে আছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, মৈত্রীর ইনহ্যাবিট্যান্টস-দের ডিটেল, ডঃ পিল্লাইয়ের রিসার্চ টিমের সদস্যদের নামধাম সব। আমরা এই বিষয়টায় তদন্তের জন্য সরাসরি ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কাছে আর্জি জানিয়েছিলাম। সেখান থেকেই আপনাদের দুজনের নাম সাজেস্ট করা হয়েছে। হাউ আর্লি ক্যান ইউ লিভ ফর মৈত্রী?”
মনন ডঃ গিলের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। এবার সে সচিবের নির্দেশের প্রত্যাশায় তার দিকে তাকাল।
“ঠিক দুদিন পর ইউ উইল বি লিভিং ফর কেপ টাউন,” সচিব সিরিয়াস মুখ করে বললেন। “ওখান থেকে বিশেষ বিমানে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার শারম্যাকার ওয়েসিসের মৈত্রী স্টেশন থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ান রিসার্চ স্টেশন নোভোলাজারেভস্কায়া-তে পৌঁছবে তোমরা। নিরেট বরফের ওপর রুশদের ওই বিমানবন্দরটা রাশিয়া আর ভারত যৌথভাবে ব্যবহার করে।”
“ওকে স্যার,” নিপাট ভালোমানুষের মতো মুখ করে সোধি জবাব দিল। একমাত্র মননই জানে সেই মুহূর্তে সোধি মনে মনে পাঞ্জাবী আর হরিয়ানভিতে কী গালাগালিটাই না করে চলেছে!
সচিবের নির্দেশ শুনে নিয়েছে। সোধি চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় জানত কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে বদলি হয় গোটা ভারত জুড়ে। হয়তো দু-চারবার ট্রেনিং নিতে বিদেশ যেতে হবে। তাই বলে দক্ষিণ মেরু! যেখানে জনমনিষ্যি থাকে না! কাঁহা মারওয়া দিয়া ইয়ার!
“অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে দু-চারটে কথা বলে নেওয়া দরকার,” ডঃ গিল বললেন, “১ কোটি ৪২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তন জায়গা নিয়ে একটা মহাদেশ যেখানে গরমকালে সর্বমোট জনসংখ্যা পাঁচ হাজার আর শীতে সাকুল্যে বারোশো লোক থাকে। গরমে ৫ ডিগ্রি থেকে -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আর শীতে গড় উষ্ণতা -৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস…”
“মতলব ওহা মৌসম সির্ফ দো তরহ কে। সর্দি কে মৌসম অউর জ্যাদা সর্দি কে মৌসম!” সোধি ফুট কাটল। পাশে বসে মনন হাসিটা চাপল।
ডঃ গিল শ্লেষটা ধরতে পারলেন না, তিনি বললেন, “অ্যান্টার্কটিক ট্রিটি সিস্টেমের কথা হয়তো আপনারা শুনেছেন। বর্তমানে এই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে আছে ৫৪টা দেশ। এই সন্ধির চুক্তি হয়েছিল ১৯৬১ সালে। চুক্তিতে সই করা সব দেশকে নিয়মগুলো মেনে চলতে হয়। যেমন মূল অ্যান্টার্কটিকা ভূখন্ডের কোনও অংশকে কোনও দেশ তার নিজের বলে দাবী করতে পারবে না, সেখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারবে না, কেবলমাত্র গবেষণার প্রয়োজনে সেখানে অস্থায়ী গবেষণাগার স্থাপন করতে পারবে ইত্যাদি।”
মনন ডঃ গিলের কথাগুলো ধৈর্য নিয়ে শুনছিল, কিন্তু তার বারবার মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক অন্য কিছু বলতে চাইছেন। সে এবার বলল, “ডঃ গিল, আমরা বুঝতে পারছি, এই তথ্যগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি যেন আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমাদের জানাতে চাইছেন কিন্তু একটু দ্বিধা করছেন।”
“হ্যাঁ, ইয়ে মানে, সেটা ঠিকই ধরেছেন,” ডঃ গিল বলতে শুরু করলেন, “এই মুহূর্তে ২৮ জন ভারতীয় মৈত্রী স্টেশনে কাজ করছেন। আর ২০১২ সালে লারসম্যান হিলসে গড়া ভারতী রিসার্চ স্টেশনে কাজ করছেন আরও জনা তিরিশেক কর্মী। শারম্যাকার ওয়েসিস এবং লারসম্যান হিলসের মধ্যে দূরত্ব প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। অতএব বুঝতেই পারছেন দুটো গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে প্রাত্যহিক যোগাযোগ অসম্ভব। অথচ মৈত্রী থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে ডঃ পিল্লাই খুন হয়েছেন। ফলে ওখানে ভারতীয় গবেষকদের সুরক্ষা নিয়ে একটা বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন উঠে গেছে। তাই আমি এখানে উপস্থিত সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করেই আপনাদের প্রস্তাব দিচ্ছি যে আপনারা অ্যান্টার্কটিকায় নিজেদের পরিচয় মানে তদন্তকারী অফিসারের পরিচয়ে যাবেন না, আসল পরিচয় গোপন রেখে আপনারা মৈত্রী স্টেশনের নতুন সদস্য হিসেবেই সেখানে যান, তদন্তের কাজ খুব গোপনে করুন।”
মনন বলে উঠল, “মানে!” সোধির মুখ থেকেও একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো বেরিয়ে এল, “ওয়াহে গুরুজী! “
“আমি চাই, আপনি ওখানে সিসমোলজি অ্যান্ড গ্র্যাভিটেশনাল অ্যানোম্যালি স্পেশালিস্ট হয়ে যাবেন, ওই পদটা এখন ফাঁকা আছে,” মননের দিকে তাকিয়ে ডঃ গিল কথাটা বলে সোধির দিকে ফিরলেন। “আর আপনি ওখানে সিনিয়র লজিস্টিকস ম্যানেজার হয়ে যান।”
আর কোনও অপশন নেই! নো ইফ নো বাট সির্ফ জাঠ! এই জাঠ প্রফেসর যা বলেছেন তার নড়চড় হওয়ার উপায় নেই।
মনন আর সোধি দুজনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে নিতে হবে।
দুজনে সচিবের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছিল। ডঃ গিল বললেন, “আরেকটা কথা। রওনা হওয়ার আগে একবার গ্রেটার কৈলাসে ডঃ পিল্লাইয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারেন। গত পরশুই প্রফেসর পিল্লাইয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে গেছে। এখন ওঁর বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, যদি কোনও ক্লু পান।”
। । ৩ । ।
মৈত্রী রিসার্চ স্টেশন, ৭০ ডিগ্রি ৪৬’ ০০ “ দঃ ১১ ডিগ্রি ৪৩’ ৫৩ “ পূঃ, পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা
মৈত্রীর স্টেট অফ দ্য আর্ট গবেষণাগারের এক কোণে নাওমি বসেছিল। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কয়েকটা স্যাম্পেল ভর্তি এফেনডর্ফ টিউব। টিউবগুলো অন্তত আধঘণ্টা আগে অ্যানালিটিক্যাল সেন্ট্রিফিউজে ঢুকিয়ে ১০,০০০ আরপিএমে ঘোরানোর কথা ছিল। তারপর সেটা থেকে ডিএনএ নিষ্কাশন করে পিসিআর মেশিনে দিয়ে ডিএনএ খন্ডটাকে অ্যামপ্লিফাই করার কথা ছিল।
নাওমির এখন কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার মনে হচ্ছে তার ওপর সর্বক্ষণ কে বা কারা যেন নজর রাখছে। ডঃ পিল্লাইকে যারা খুন করেছে তারা কি তার ওপরেও নজর রাখছে!
ডঃ পিল্লাই যে কাজে হাত দিয়েছিলেন তা যে তিনি প্রায় শেষ করে এনেছিলেন তা নাওমি ভালো করেই বুঝতে পারছে। সে আইআইটি-তে গবেষণার দ্বিতীয় বছরে একটা ছোট পেপার পাবলিশ করেছিল নেচারে। সেটা পড়ে বছর দেড়েক আগে ডঃ পিল্লাই নিজেই তাকে ফোন করেছিলেন। হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করা ডঃ পিল্লাইয়ের মতো স্টলওয়ার্ট বিজ্ঞানী তাকে ফোন করায় সে কিঞ্চিৎ কেঁপে গিয়েছিল। এখনও ডঃ পিল্লাইয়ের সঙ্গে সেই ফোনের কথোপকথন তার আগাগোড়া মনে আছে।
উনি বলেছিলেন, “নাইস পেপার, নাওমি। প্রোক্যারিওট আর ইউক্যারিওট নিয়ে তো কাজ করছ, হোয়াট অ্যাবাউট ওয়ার্কিং উইথ আর্কিব্যাকটিরিয়া?”
“স্যার, আসলে তেমন সুযোগ হয়নি তো তবে বুঝতে পারছি খুব এক্সাইটিং হবে,” নাওমি ইতস্তত করে বলেছিল।
“পলিমারেজ চেন রিঅ্যাকশন আর ট্যাক পলিমারেজ নিয়ে কাজ করতে তো ভালোই জানো, শুধু একটা সমস্যা, তুমি -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকতে পারবে তো?”
“মানে স্যার?” চমকে উঠে নাওমি জানতে চেয়েছিল।
“আমি তোমাকে অ্যান্টার্কটিকার শারম্যাকার ওয়েসিসে আসতে বলছি। আমি এখন ওখানকার মৈত্রী রিসার্চ স্টেশনে কাজ করছি। খুব ইন্টারেস্টিং প্রজেক্ট।”
এপাশে নাওমি কয়েক মুহূর্ত নীরব হয়েছিল। এটা ইউএসএ বা ইউরোপের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নয়। অ্যান্টার্কটিকা!
ফোনের এপাশে দ্বিধাগ্রস্ত নাওমিকে চুপ করে থাকতে দেখে ডঃ পিল্লাই ফের বলেছিলেন, “দেখ নাওমি, আমার মেয়ে অনুষ্কাও তোমারই বয়সী, সেও কানপুর আইআইটি-র ছাত্রী। তুমি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো, তোমার পিএইচডি আর পোস্টডক দুটোই আমি করিয়ে দেব। আমার এমন একজন সহকারী দরকার যে শুধু মলিকিউলার বায়োলজিই নয় বায়ো-ইনফরম্যাটিক্সটাও ভালো জানে। তোমার পেপারটা পড়ে আমি বুঝেছি, তোমার মধ্যে সেই স্পার্কটা আছে। এবার বলো, তুমি রাজি কি না। রাজি থাকলে আমি বম্বে আইআইটি-র সঙ্গে কোলাবোরেট করছি।”
নাওমি আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি। ডঃ পিল্লাইয়ের ফোনটার ঠিক একমাস পর সে কেপ টাউন থেকে অ্যান্টার্কটিকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। তারপর গত সাত মাসে সে কীভাবে যে ডঃ পিল্লাইয়ের এত কাছের হয়ে উঠেছিল সে নিজেও জানে না। পিল্লাইস্যার তাকে নিজের মেয়ে অনুষ্কার মতোই স্নেহ করতে শুরু করেছিলেন।
ভাবতে ভাবতে নাওমির চোখদুটো সজল হয়ে উঠল। প্রায় একমাস হতে চলল ডঃ পিল্লাই মারা গেছেন, কিন্তু এখনও তার মন শোকাচ্ছন্ন হয়ে আছে। এর মধ্যে সে অনেকবার ভেবেছে বম্বে আইআইটি ফিরে যাবে বা কোনও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো গাইড পেলে চলে যাবে, কিন্তু একটা অদ্ভুত পিছুটান যেন এখনও তাকে এই বিজন বরফের রাজ্যে আটকে রেখেছে। আর দুটো অমোঘ ও অস্বস্তিকর প্রশ্ন তাকে সর্বক্ষণ তাড়া করে। কেন ডঃ পিল্লাই খুন হলেন? কে তাকে খুন করল?
“আরে, নাওমি, এখনও তুমি ডিএনএ এক্সট্রাকশনটা করোনি?”
অন্যমনস্কতা ভেঙে নাওমি চমকে তাকায়। জ্যোতি রঙ্গরাজন ল্যাবের ভেতরে এসে ঢুকল। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন ডঃ বদ্রীনাথ। ওঁরা দুজনে আজ স্পেসিমেন কালেকশনে গিয়েছিলেন। সপ্তাহে দুবার তারা স্যাম্পেল কালেকশনে যায়। উদ্ভিদ নমুনা বলতে কিছু শ্যাওলা আর মসজাতীয় উদ্ভিদ। প্রাণীজ নমুনাই বেশি লাগে। ওরা ফোর্ড ই-সিরিজ গাড়ি নিয়ে নমুনা সংগ্রহে বের হয়। তবে বরফে ঢাকা উঁচুনিচু আর ঢালু পথে যেতে হলে পিস্টেনবুলি-৬০০ নেয়। প্রতিবার দুজন করে যায়। কখনও বদ্রীনাথ আর জ্যোতি, কখনও জ্যোতি আর নাওমি। কখনও আবার নাওমি আর ভুবন শইকিয়া। অ্যান্টার্কটিকায় বেশ কিছু তীব্র লবণাক্ত জলের হ্রদ আছে, সেখান থেকে জলজ অনুজীব সংগ্রহ করা হয়। মাঝেমাঝে পিল্লাইস্যারও যেতেন। তবে নাওমিকে নিয়ে ডঃ পিল্লাই এমন কিছু জায়গায় স্যাম্পেল কালেকশনে যেতেন যেটা টিমের অনেকেই জানত না।
“এখনও যদি ডিএনএ স্যাম্পেলগুলো না পাই তবে পিসিআর-এ ডিএনএ অ্যামপ্লিফিকেশনের কাজটা কীভাবে করব,” জ্যোতি ফের গজগজ করে উঠল।
নাওমির কেন যেন মনে হয় এই জ্যোতি রঙ্গরাজন নামে বছর চৌত্রিশের ডিভোর্সি মহিলা তাকে প্রথম দিন থেকেই অপছন্দ করে। হয়তো তার মনের ভুলও হতে পারে। তবু হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণায় পোস্টডক করা এই ভদ্রমহিলা তার চেয়ে অন্তত আট-নয় বছরের ছোট নাওমির প্রতি এত বিরূপ হবেন কেন?
“নাওমি, আয়াম সরি, জানি তুমি ডঃ পিল্লাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুর শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারোনি,” জ্যোতি রঙ্গরাজন এগিয়ে এসে হঠাৎ নাওমির কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল, “ইনফ্যাক্ট, আমরা কেউই ট্রমা-টা ওভারকাম করতে পারিনি। আমি হার্ভার্ডে পোস্টডক শেষ করার পর যে কোনও বড় মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজ নিতে পারতাম, নয়তো কোনও বহুজাতিক বায়োটেক ফার্মে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট উইংয়ের প্রধান হয়ে বসতে পারতাম, তবু এই জনমানবশূন্য বরফের রাজ্যে এলাম কেন? এসেছিলাম শুধু ডঃ পিল্লাইয়ের সঙ্গে কাজ করব বলে, কারণ হি ওয়াজ দ্য বেস্ট!”
ওয়াজ! এত তাড়াতাড়ি ডঃ পিল্লাই পাস্ট টেন্স হয়ে গেলেন! শুনতে শুনতে নাওমির গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে উঠল।
“আমি জানি তুমি আমাকে ভীষণ অপছন্দ করো, তবুও আমি ডঃ পিল্লাইয়ের কথা তোমাকে স্মরণ করিয়ে বলি, উনি কিন্তু বলতেন, ওয়ার্ক ইজ দ্য ফার্স্ট অ্যান্ড ফোরমোস্ট। এভরিথিং এলস টেকস দ্য ব্যাকসিট।”
ইতিমধ্যে ডঃ বদ্রীনাথ এগিয়ে এসে তাঁর কাঁধের পিভিসি ব্যাগটা টেবিলে রেখে তার থেকে কতগুলো নমুণাসহ মুখবন্ধ টেস্টটিউব টেবিলে রেখে বললেন, “এখানে আর্কিব্যাকটিরিয়া, নিমাটোড, অ্যানিলিডা আর আর্থোপোডা স্যাম্পেল আছে। এগুলো আলাদা করে ব্যাকটিরিয়াগুলোকে পেট্রিডিসে ফুড মিডিয়াম ঢেলে ইনকিউবেট করার ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি আপাতত ল্যামিনার এয়ারফ্লো মেশিনের অতিবেগুনী রশ্মিটাকে পাঁচ মিনিট চালিয়ে জীবানুশূন্য করো, আমি ততক্ষণ একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
নাওমির আজ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সে জ্যোতির হাত দুটি ধরে বলল, “জ্যোতিদিদি, আমার মনটা আজ একটুও ভালো নেই, ক্যান ইউ প্লিজ ম্যানেজ অল দিস?”
“বেশ, টেক সাম রেস্ট,” জ্যোতি রঙ্গরাজন বড় দিদির মতো নাওমির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল।
নাওমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল, বেলা এগারোটা বাজে। সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, পিছন ফিরে বলল, “জ্যোতিদি, আমি একটু বেরোব, আই নিড সাম ফ্রেশ এয়ার। ভাবছি, একটু নোভোলাজারেভস্কায়ার রুশ স্টেশনটায় যাব।”
“কেন, ওদিকে কেন?” জ্যোতি রঙ্গরাজন চমকে উঠে বলল, “তোমার একটু রেস্ট নেওয়া উচিত ছিল, স্নায়ুর চাপটা থেকে এবার তো বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু রাশিয়ান স্টেশনে যাচ্ছ কেন?”
“আসলে ওদের গেমিং জোনটা বেশ ভালো। ওদের বোলিং অ্যালে-টায় যাব। একটু খেললে মনে হয় রিল্যাক্সড হব। তাছাড়া তাতিয়ানা আর নাতাশাদের সঙ্গেও একটু আড্ডা দিয়ে আসব।”
দরজাটা বন্ধ করে নাওমি বোস ল্যাব ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
জ্যোতি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে টেবিলের ওপর থেকে ইরিডিয়াম সেটের স্যাটেলাইট ফোনটা তুলে নিল।
। । ৪ । ।
ইলিউশিন ইল-৭৬ স্ট্র্যাটেজিক এয়ারলিফ্টারটা চার ইঞ্জিনের সামরিক বিমান। কেপ টাউন থেকে অ্যান্টার্কটিকার ড্রনিং মড ল্যান্ডে যাতায়াতের এই একটাই বিশেষ বিমান। এই বিমানের বারোজন যাত্রীর মধ্যে সবাই চলেছে মৈত্রী নয়তো নোভোলাজারেভস্কায়ার রিসার্চ স্টেশনে।
মনন একবার চারপাশে চোখ বোলালো। বিমানে মোট পাঁচজন ভারতীয় আর সাতজন রাশিয়ান। সোধি বিমানে উঠেই নাক ডেকে ঘুমোতে শুরু করেছে। অ্যান্টার্কটিকা গিয়ে কী খাবার জুটবে না জুটবে সেই ভেবে গত দুদিন ধরে সে দিল্লির বিখ্যাত ফুড জয়েন্টগুলোতে বাটার চিকেন আর নিহারী খেয়ে বেরিয়েছে। ওরা ছাড়া বাকি তিনজন ভারতীয় যাচ্ছে আগামী তিন-চার মাসের চাল, ডাল, আটা, মশলাপাতি আর সবজি আনাজ নিয়ে। তা ছাড়া বিমানে ওঠার সময় মনন খেয়াল করেছে প্রায় হাফ টন চিকেন, মাটন আর বিফ লোড হচ্ছে বিমানে। মনন আর সোধি ছাড়া বাকি তিনজন ভারতীয়ই আনলোডিং আর গোছগাছের কাজ সেরে সাতদিন পর কেপ টাউন ফিরে আসবে।
বিমানের কাচ-জানলার বাইরে তাকাল মনন। অনেক নিচে গভীর ভারত মহাসাগরের গাঢ় নীল জল। কেপটাউন থেকে ড্রনিং মড ল্যান্ডের নোভোলাজারেভস্কায়ার দূরত্ব সাড়ে চার হাজার কিলোমিটারের সামান্য বেশি। এই চার ইঞ্জিনের ছোট প্লেনে পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়।
তুমুল হাসির শব্দে মনন চমকে তাকাল। যেখানে সাতজনের রুশ দলটা বসেছে সেখান থেকেই হুল্লোড়ের শব্দটা ভেসে এল। মনন ওদের দিকে একটু মনোযোগ নিয়ে তাকাতেই তার নিজের ঠোঁটের কোণেও একটা হাসি ফুটে উঠল। ওদের মধ্যে দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে অভিনয় করছে। বাকি চারজন সেই অভিনয়ের দৃশ্য দেখে হাসিতে ফেটে পড়ছে। ওদের ভাবভঙ্গি আর সংলাপ শুনে মনন দিব্যি বুঝতে পারল ওরা নেটফ্লিক্সে সদ্য মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিরিজ ‘দ্য লাস্ট জারস’ থেকে মজার ছলে অভিনয় করছে। ওদের মধ্যে একটা ছেলে জার দ্বিতীয় নিকোলাসের চরিত্রে অভিনয় করছে, অন্যজন রাসপুটিনের চরিত্রে অভিনয় করছে। আর মেয়েটি সেজেছে নিকোলাসের স্ত্রী রাণী আলেকজান্দ্রা ফিওদরোভ্না। রুশেরা যেমন আড়ষ্ট উচ্চারণে ইংরেজি বলে সেই রকমভাবেই ওরা সিনেমার সংলাপগুলো বলছে। বাকি চারজন ওদের কান্ডকারখানা দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
“কেয়া তামাশা শুরু হুয়া, স্যারজি,” ওদের হুল্লোড়ে আচমকা ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে সোধি।
ফিওদরোভ্নার ভূমিকায় অভিনয় করছিল যে মেয়েটা এদিকে ঘুরে তাকাল। বোধহয় বুঝতে পেরেছে ওদের হইহুল্লোড়ে সোধি বিরক্ত হয়েছে। মেয়েটা সামনে এগিয়ে এসে বলল, “আয়াম সরি… আ’ম… অ্যাকচুয়ালি উই আর সরি!”
“ইটস ওকে,” মনন হেসে বলল। “সত্যি বলতে আমার বেশ মজাই লাগছিল আপনাদের অভিনয় দেখে। দ্য লাস্ট জারস সিজন-১ আমিও দেখেছি।”
“প্রিভেত, আয়াম নাতাশা,” মেয়েটা ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল। “এসো, আমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।”
মননের আগেই সোধি হাত বাড়িয়ে মেয়েটির সঙ্গে করমর্দন করে বলল, “সোধি, রীতিন্দর সিং সোধি।”
সোধির জেমস বন্ডীয় কায়দায় পরিচয় দেওয়া দেখে মনন মনে মনে হাসল। সেও নাতাশাকে নিজের নামটা বলল।
একে একে রুশ দলটার সব ছেলেমেয়েগুলো ওদের দিকে এগিয়ে এল। দলে দুটো মেয়ে আর পাঁচটা ছেলে। সবার বয়সই পঁচিশ থেকে সাঁইত্রিশ-আটত্রিশের মধ্যে। অন্য মেয়েটার নাম তাতিয়ানা। সবাই মননদের সঙ্গে আলাপ জুড়ল। মনন নিজে যথেষ্ট লম্বা হলেও এই ছেলেগুলো সবাই বেশ লম্বা চওড়া। গড়পড়তা রাশিয়ানরা যেমন হয় আর কী। এদের কেউ মননের সমান, কেউ মননকে ছাপিয়ে আরও লম্বা। জার নিকোলাসের ভূমিকায় অভিনয় করছিল যে ছেলেটা তার নাম মিখাইল। রাসপুটিন সেজেছিল যে, তার নাম বরিস। বাকিদের মধ্যে ছিল—ইগর, ভ্যালেরি আর আনাতোলি।
রুশ বিজ্ঞানীদের এই দলটার সবাই আপাতত অ্যান্টার্কটিকায় থাকবে। ওরা সবাই স্বল্পদিনের ছুটিতে নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিল, এখন আবার কর্মক্ষেত্রে ফিরছে।
নাতাশা একটা স্ন্যাক্সের প্যাকেট খুলে ছোট ডোনাটসের মতো দেখতে একটা খাবার এগিয়ে দিয়ে বলল, “ট্রাই সাম সাশলিকি অ্যান্ড বাবলিকি।”
সোধি সাগ্রহে একটা স্ন্যাক্স হাতে তুলে নিল। মননও একটা নিয়ে হেসে বলল, “থ্যাঙ্কস।”
ওরা দু’জনেই ফের নিজের আসনে ফিরে এল।
পাইলট জানাল আর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে বিমান ড্রনিং মড ল্যান্ডে পৌঁছে যাবে। আসনের গদিতে হেলান দিয়ে বসতেই মননের মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো শান্ত হয়ে এল। তার মনে পড়ল গত পরশুর কথা। ডঃ পিল্লাইয়ের গ্রেটার কৈলাসের বাড়িতে গিয়েছিল ওরা। ডঃ পিল্লাইয়ের মেয়ে অনুষ্কার সঙ্গে আগেই ফোনে কথা বলে নিয়েছিল।
বেশ বড় বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি ডঃ পিল্লাইয়ের। অনেকটা বড় সরকারি আমলাদের মতো। তবে বাড়িটা ওদের নিজেদের, কোনও সরকারি আবাসন নয়। বাড়ির সামনের লনে অনুষ্কার সঙ্গে কথা বলতে বসেছিল ওরা। মেয়েটা কানপুর আইআইটির তৃতীয় বর্ষের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের ছাত্রী। একটাই মেয়ে ডঃ পিল্লাইয়ের, তার স্ত্রী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘ দুসপ্তাহ শোকযাপনের পর সেদিনই তিনি হাসপাতালের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কোনও শোকেই যে জীবনের প্রবাহ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় না, সকলকেই কাজে ফিরতে হয়। বাড়িতে সেদিন অনুষ্কা ছিল, আর ছিল দু-চারজন নিকটাত্মীয়। দিন দুয়েক পর তারও কানপুর ফিরে যাওয়ার কথা।
মননের হাতে সময় কম ছিল, তাই যা জানার সরাসরি জিজ্ঞাসা করা উচিত বলেই তার মনে হয়েছিল।
“বাবার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? মানে বলতে চাইছি, উনি কি সব কথা আপনাকে জানাতেন?” মনন প্রশ্ন করেছিল।
“ছোটবেলা থেকেই আমি বাবার প্রাণ ছিলাম। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আইআইটি যাওয়ার পর থেকে সম্পর্কটা আরও সহজ আর বন্ধুর মতো হয়ে গেল।”
“তার মানে বাবা আপনার সঙ্গে অনেক কথা শেয়ার করতেন?”
“হ্যাঁ।”
“উনি যে বিপদে পড়তে পারেন, এমন কোনও আশঙ্কা আপনি করেছিলেন? মানে ওঁর কোনও শত্রুর কথা আপনাকে জানিয়েছিলেন?”
“বাবা ছিলেন অত্যন্ত সুভদ্র মানুষ। দুর্দান্ত কেরিয়ার, আমি ওঁর ধারে কাছেও কখনও যেতে পারব না। ওঁর সিভিতে ছিল ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স আর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি, পোস্টডক। কারও সঙ্গে বাবা কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি, কারও ক্ষতিও করেননি। শিবতুল্য মানুষ ছিলেন,” বলতে বলতে অনুষ্কা রুমাল দিয়ে চোখের কোণ মুছছিল।
“অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন যা হয়তো এখন মনে পড়ছে না? আপনার বাবার কোনও জিনিসপত্র কি ওরা ফেরত পাঠিয়েছে?”
“হ্যাঁ, বাবার জামাকাপড়, জুতো, চশমা—মানে নর্ম্যাল বিলংগিংস তো সবই পাঠিয়েছে,” বলতে বলতে অনুষ্কা উঠে দাঁড়িয়েছিল, “আসুন। বাবার স্টাডিরুমে সব গুছিয়ে রেখেছি। বাবার একটা কাজের ডায়েরি আর একটা নিকনের ডিএসএলআর ক্যামেরা ছিল, সেটাও ওরা ফেরত পাঠিয়েছে।”
মনন আর সোধি লন ছেড়ে অনুষ্কার পিছন পিছন বাংলোর ভেতর ঢুকল। ডঃ বেদ পিল্লাই পড়াশোনার জগতের মানুষ, তার সুবিশাল স্টাডিরুমটাও দেখার মতো। তিনটে দেয়াল জুড়ে কাচের আলমারিতে থরেথরে সাজানো বই। মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রো বায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োইনফরম্যাট্রিক্স, বায়োটেকনোলজি সহ নানা বিষয়ের। ওঁর পড়ার টেবিলটার ক্যাবিনেট ড্রয়ার খুলে অনুষ্কা জিনিসদুটো বের করে এনেছিল। একটা বাদামী রঙের ডায়েরি আর নিকন ডিএসএলআর ক্যামেরা। ক্যামেরাটার মডেল নং নিকন ডি- ৫৬০০। সঙ্গে একটা টেলিফোটো লেন্স লাগানো।
“আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন।” মনন অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে বলেছিল।
মৃদু ঘাড় নেড়ে অনুষ্কা বলেছিল, “হ্যাঁ, ডঃ গিল আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে এনআইএ অফিসারেরা বাবার রহস্যময় মৃত্যুর তদন্ত করছে, আপনাদের ওপরেই সেই ভার পড়েছে।”
“হ্যাঁ, কালকেই আমরা কেপটাউন রওনা দিচ্ছি। সেখান থেকে তার পরদিনই অ্যান্টার্কটিকা যাব সামরিক বিমানে,” বলে মনন সামান্য ইতস্তত করে বলেছিল, “এই ডায়েরিটা আমাদের কাছে রাখতে চাই… বুঝতেই পারছেন তদন্তের যদি কোনও লিড…”
“নিশ্চয়ই, তদন্তের প্রয়োজনে তো লাগবেই,” অনুষ্কা বলেছিল। “তবে এটা বাবার স্মৃতি তো, কাজ ফুরোলে দিয়ে যাবেন, প্লিজ।”
মনন ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বলেছিল, “ছবিগুলো দেখতে পারি?”
অনুষ্কা ঘাড় নেড়ে সায় দিতে সোধি নিকন ডিএসএলআর ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে সিকিওর ডিজিটাল মেমরি কার্ড থেকে একটার পর একটা ছবি বের করে দেখতে শুরু করেছিল। মনন পাশে দাঁড়িয়ে ইমেজগুলো দেখছিল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, ডঃ বেদ পিল্লাই একজন প্রকৃতিপ্রেমীও ছিলেন। দারুণ দারুণ সব ছবি। ড্রনিং মড ল্যান্ডের প্রিয়দর্শিণী লেকের ছবি। পাশে দেখা যাচ্ছে মৈত্রী রিসার্চ স্টেশন। একটা ছবিতে দুজন মহিলা আর দুজন পুরুষের সঙ্গে ডঃ বেদ পিল্লাই দাঁড়িয়ে আছেন, সামনে বরফের ওপর একটা জাতীয় তেরঙা। পিল্লাই ছাড়া অন্য একজন পুরুষও বেশ দীর্ঘকায়। মহিলা দুজনের মধ্যে একজনকে বাঙালি মনে হচ্ছে, তার বয়সও কম, বড়জোর বছর পঁচিশেক। অন্য মহিলাটি মধ্য তিরিশের কোঠায়। সম্ভবত এটাই ডঃ পিল্লাইয়ের নেতৃত্বে ওখানে গবেষণারত টিম। এছাড়া দু-তিন রকমের পেঙ্গুইনের ছবি। সী-লায়ন এবং আরও কিছু দুষ্প্রাপ্য পাখিদের ছবিও ছিল। দু-তিনটে ছবিতে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে রুশ বিজ্ঞানীদের ছবিও দেখা যাচ্ছিল।
মনন ভাবনার স্রোত ছিঁড়ে বেরিয়ে এল। ওই ছবিটায় বিমানযাত্রী রুশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই ছিল। মনন আবার বিমানের ভেতরের রুশ ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, ছবিতে নাতাশা আর তাতিয়ানা তো ছিলই, সম্ভবত আনাতোলি বলে ছেলেটাও ছিল। বরিস আর মিখাইলও সম্ভবত ছিল। চোখ বুজে মনন মনে করার চেষ্টা করল। বেশ বড় গ্রুপের ছবি ছিল, প্রায় জনাবিশেক লোক ছিল ছবিটায়, সবাইকে আইডেন্টিফাই করা যাচ্ছে না। হয়তো অ্যান্টার্কটিকা পৌঁছে সেটা সম্ভব হবে, কারণ ক্যামেরাটা সঙ্গে না আনলেও মনন ওটার মেমরি স্টিকগুলো বের করে নিয়ে এসেছে।
“হাই ফ্রেন্ডস, উই উইল টাচ ডাউন অ্যাট নোভোলাজারেভস্কায়া এয়ারস্ট্রিপ উইদইন টেন মিনিটস।” পাইলট বলে উঠল।
মনন সচকিত হয়ে বিমানের কাচ-জানলার বাইরে তাকিয়ে চমকে উঠল। অপার বিস্ময়, মুগ্ধতা আর একটা অজানা ভয় তাকে গ্রাস করে নিল। ভারত মহাসাগরের গাঢ় নীল বিস্তার পেরিয়ে আদিগন্ত ছড়ানো শুভ্র তুষারে ঢাকা সীমাহীন প্রান্তর।
চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। কোথাও এতটুকু সবুজের আভাস নেই। দেখলেই শরীরে কাঁপুনি ধরে যায়। সেই বরফের প্রাণহীন প্রান্তরের মধ্যে ইতিউতি জেগে আছে প্রস্তরময় নগ্ন বাদামী পাহাড়। কোথাও দু-চারটে বরফে ঢাকা হ্রদ।
মনন পাশের সিটে ঘুমে আচ্ছন্ন সোধিকে কনুই দিয়ে মৃদু গুঁতো মেরে বলল, “সোধি দেখ্, আ গয়া জন্নত!”
ঘুম জড়ানো চোখে সোধি বিমানের জানলার বাইরের দৃশ্যটা দেখেই হি হি করে কেঁপে উঠে বলল, “ওয়াহে গুরুজী, হমে কৌন সা নরক মেঁ ঢাকেল দিয়া?”
। । ৫ । ।
মৈত্রী রিসার্চ স্টেশন, শারম্যাকার ওয়েসিস, কুইন মড ল্যান্ড, পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা
ঘণ্টাপাঁচেক হল মনন আর সোধি রাশিয়ানদের নোভোলাজারেভস্কায়া এয়ার স্ট্রিপে নেমে একটা টেরা বাসে চেপে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মৈত্রী স্টেশনে পৌঁছেছে। ক্যানডিড সামরিক প্লেনটা থেকে শুকনো খাবারদাবার, মশলাপাতি আর কাঁচা মাংস আনলোডিং করতে আধঘণ্টার বেশি সময় লেগেছিল। মৈত্রী থেকে লজিস্টিক সাপোর্টের জন্য ওরা লোক পাঠিয়েছিল। ভ্যালেরি, ইগর, বরিস, মিখাইলরাও নিজেদের মালপত্র আনলোড করছিল। এই সময় রীতিন্দর সিং সোধিকে একটু অভিনয় করতে হয়েছিল। সে এখানে সিনিয়র লজিস্টিকস ম্যানেজার পরিচয়ে এসেছে। সোধি তাই লোকজনকে মালপত্র নামানোর সময় উপযাচক হয়ে যথেষ্ট জ্ঞান দিচ্ছিল। সোধির পরিচয়ে তারা ওর দিকে সম্ভ্রমের চোখে তাকাচ্ছিল। তবে মাঝেমধ্যে সোধির অতিঅভিনয়ে মননের পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে এক-একটা হাসির বুদ্বুদ তৈরি হচ্ছিল। কোনওরকমে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে সে হাসি চাপছিল।
মৈত্রীতে আসার পর মননদের সঙ্গে একে একে পরিচয় হয়েছিল এখানকার ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। প্রয়াত বিজ্ঞানী ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের নেতৃত্বাধীন তিনটি গবেষণার শাখা—বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, পোলার মেডিসিন এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সে সব মিলিয়ে বারোজন কাজ করছেন। তার মধ্যে পোলার মেডিসিন অ্যান্ড এক্সট্রিম ক্লাইমেট অ্যাডাপ্টিবিলিটিতে সরাসরি ওর সঙ্গে কাজ করছিলেন চারজন। জ্যোতি রঙ্গরাজন, কে বদ্রীনাথ, ভুবন শইকিয়া এবং নাওমি বোস।
শীত শেষ হয়ে আসছে। এখন এই সেপ্টেম্বর মাসটা বলা যায় অ্যান্টার্কটিকার বসন্তকাল। কথাটা ভেবেই মনন মনে মনে হাসল। বেলা আড়াইটে নাগাদ এখনই তাপমাত্রা -১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাত নামলে তাপমাত্রা -২৫ ডিগ্রির তলায় চলে যাবে। থাকার জায়গাগুলো পণ্যবাহী জাহাজের কন্টেনার দিয়ে তৈরি। এক একটা কন্টেনারের মধ্যে চারজনের থাকার ব্যবস্থা। তবে সিঙ্গল অকুপ্যান্সি রুমই বেশি আছে। মনন আর সোধির জন্য যে কার্গো কন্টেনারটা বরাদ্দ হয়েছে সেখানে আপাতত তারা দুজনই আছে।
বেলা তিনটে নাগাদ সোধি বের হল মৈত্রী স্টেশনের চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে। হাঁটতে হাঁটতে সে প্রিয়দর্শিনী হ্রদটার কাছে চলে এসেছে। এই বসন্তের শুরুতে প্রিয়দর্শিনী লেকের বেশিরভাগ জায়গাটাই পুরু বরফের আচ্ছাদনে ঢাকা। চারদিকে বরফের মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে এবড়োখেবড়ো পাথুরে মাটি। তার ওপর বাদামী রঙের এক ধরণের শৈবাল ছাড়া অন্য কোনও উদ্ভিদের অস্তিত্ব নেই।
মৈত্রী স্টেশনের সদস্যদের জলের ব্যবস্থা হয় এই প্রিয়দর্শিনী হ্রদ থেকেই। এই জলকেই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পরিশ্রুত করে মৈত্রীর সদস্যেরা পান করে। সোধি তার হাতের ক্যানন ডিএসএলআর ক্যামেরাটায় প্রিয়দর্শিনী হ্রদের কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। যদিও ডঃ পিল্লাইয়ের নিকন ক্যামেরার মেমরি স্টিকগুলো মনন সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তবুও সেগুলো ব্যবহার করার অনুমতি নেই, কারণ মননের মতে ওগুলো ভবিষ্যতে খুনের মামলার একজিবিট হতে পারে।
সোধি প্রশ্ন করেছিল, “আরে স্যারজি, লেকিন ডঃ পিল্লাই কা ক্যামেরা মেঁ তো কুছ মিলা নেহি।”
“ওহি তো খটক রহা হ্যায়,” অন্যমনস্ক হয়ে মনন বলেছিল।
সোধি তার ক্যানন ক্যামেরায় নতুন এসডি মেমরি কার্ড লাগিয়ে হ্রদটার ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে গিয়েছিল। মনন ওকে বলেছিল হ্রদের ধার ঘেঁষে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে এগিয়ে গেলে মৈত্রী থেকে ঠিক দেড় কিলোমিটার দূরে ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। মননের বর্ণনা মতো জায়গাটায় এসে দাঁড়াল সোধি। জায়গাটা একটা পাথুরে উচ্চভূমি। এখান থেকে সামনের ধূ ধূ সাদা বরফের প্রান্তরটার দিকে তাকালে যেন কেমন ভয় ভয় লাগে। এখান থেকে আকাশটাও বেশ উন্মুক্ত আর পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ডঃ পিল্লাই ক্যাম্প ছেড়ে এত দূরে এসেছিলেন কেন?
শীতকালে শারম্যাকার ওয়েসিসে অবস্থানরত ভারতীয়রা তাদের আউটডোরের কাজ বেলা সাড়ে তিনটে-চারটের মধ্যে সেরে কন্টেনারের নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে পড়ে। তবে এখানকার গরমকালে দিন অনেকটা দীর্ঘ, রাত আটটা-ন’টায় সূর্যাস্ত হয়। তখন বাইরের তাপমাত্রা অনুযায়ী অনেকে বেশিক্ষণ আউটডোরের কাজ করেন। তবে শীতের শেষে এই প্রথম বসন্তে অ্যান্টার্কটিকার দিনও এতটা বড় হয়নি যে রাত আটটার সময় বেদ পিল্লাইয়ের তাদের আস্তানার বাইরে থাকার কথা। তবে কি ডঃ পিল্লাই কারও সঙ্গে এখানে দেখা করতে এসেছিলেন?
দামী চামড়ায় বাঁধানো বাদামী রঙের ডায়েরিটা সামনে খুলে মনন বসেছিল। এই হাড়-কাঁপানো শীতের দেশে মননের বেশিদিন থাকার কোনও ইচ্ছা নেই। যত দ্রুত সম্ভব এই কেসটা সলভ করে সোধি আর সে নিজের দেশে ফিরে যেতে চায়। তাই এখানে আসার পরই সবার অলক্ষে তারা দুজন কাজে লেগে পড়েছে। আপাতত সোধিকে সে মৈত্রীর চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করতে পাঠিয়েছে। ডঃ পিল্লাইয়ের টিমে ভুবন শইকিয়া বলে যে বিজ্ঞানীটি রয়েছেন তিনি বেশ অমায়িক মানুষ। এই অসমীয়া ভদ্রলোককে দেখে মননের বেশ মিশুকে মনে হল। তার কাছ থেকেই কথাপ্রসঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় খবর পাওয়া গেছে—যেমন, মৈত্রী থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে প্রিয়দর্শিনী লেকের দক্ষিণ পশ্চিমদিকে একটু উঁচু পাথুরে জায়গায় ডঃ পিল্লাইয়ের বডিটা পাওয়া গিয়েছিল। মনন ভদ্রলোকের বর্ণনা অনুযায়ী জায়গাটার ছবি তুলে আনতে পাঠিয়েছে সোধিকে।
বাদামী রঙের ডায়েরিটার পাতা উল্টে যাচ্ছিল সে। ডঃ বেদ পিল্লাই এই ডায়েরিটা সম্ভবত গত দশ বছর ধরে ব্যবহার করছিলেন। এই ডায়েরির এন্ট্রিগুলো শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে এতে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় নানা কথা লিখে গেছেন তিনি। গোটা ডায়েরিটায় একবার চোখ বুলোনোর পর কয়েকটা পৃষ্ঠাকে সে আলাদা করে ফের মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করল।
ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের ডায়েরি, পৃষ্ঠা নং-১৮
“গত সপ্তাহে বার্কলের ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণার কাজ নিয়ে আমরা মন্টানা-র ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে গিয়েছিলাম। ওখানে কয়েকটা উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে আমরা হ্যালোব্যাকটিরিয়ামের মতো প্রত্ন-অনুজীব পেয়েছিলাম। এরা আর্কিব্যাকটিরিয়াম গোত্রের যারা অতিমাত্রায় লবনাক্ত প্রস্রবণ বা হ্রদের জলে দিব্যি বেঁচে-বর্তে থাকে। এই চরম পরিবেশে এরা কীভাবে বাঁচে সেটাই আমার কাছে আশ্চর্যের। এদের সুরক্ষা কবচের রহস্যটা কোথায় লুকিয়ে আছে? ইদানীং আমার যে কী হয়েছে, হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের মতো ঐতিহাসিক কাজের শরিক হওয়া সত্ত্বেও আমি যেন ইউক্যারিওটদের মতো নব্য প্রাণীদের নিয়ে কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছি। এখন আবার মনোযোগের সবটা টেনে নিচ্ছে এইসব আর্কিব্যাকটিরিয়ার মতো অনু-প্রত্নজীবের দল! কিন্তু কেন? এই বিশেষ ধরণের প্রোক্যারিওটগুলো লড়াকু জীব বলে। ইয়েস, সরল সহজ এককোষী শরীরের গঠন নিয়েও এরা চরম পরিবেশে ঠিক গ্ল্যাডিয়েটরের মতো লড়াই করতে জানে!”
পৃষ্ঠা নং – ৩৪
“মাসছয়েক আগে প্যালেস্টাইনের জেরিকো শহরে গিয়েছিলাম। সেবার আমাদের সঙ্গে ছিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ সিলভারের রিসার্চ টিম। আমি এখন ইয়েলের অনু-জীববিজ্ঞানের প্রধান হলেও আমার সঙ্গে হার্ভার্ডের যেন রক্তের সম্পর্ক, একসময় ওখান থেকেই পিএইচডি আর পোস্টডক্টরাল স্টাডি শেষ করেছিলাম। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জেরিকো শহরের কাছে ডেড সী থেকে এবার অনেক প্রত্ন-জীবের নমুণা সংগ্রহ করেছিলাম। মূলত দুই প্রজাতির আর্কিব্যাকটিরিয়াম পেয়েছিলাম। হ্যালোব্যাকটেরিয়াম স্যালিনেরাম এবং হ্যালোব্যাকটেরিয়াম নরিসেন্স। গত ছ’মাসে কাজটা বেশ কিছু এগিয়েছে। এর মধ্যে হ্যালোব্যাকটিরিয়াম নরিসেন্সের জিনোম বিশ্লেষণ করে দেখেছি প্রায় ৩০ লক্ষ বেস-পেয়ার আছে, আর প্রায় আড়াই হাজার জিন সেগমেন্ট আছে, কিন্তু কোন জিনগুলো তীব্র লবনাক্ত জলে বা উচ্চ তাপমাত্রায় বাঁচতে সাহায্য করে? সেই জিনের এক্সপ্রেশন থেকে কোন ধরণের প্রোটিনই বা ট্রান্সলেটেড হয়?”
পৃষ্ঠা নং- ৫৭
“নাসার একটা কনফারেন্সে আমাকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আজ বহু বছর ধরে ওরা অন্য গ্রহে প্রাণের সন্ধান করছে। সৌরজগতের বাইরেও কোনও এক্সোপ্ল্যানেটে প্রাণ আছে কি না ওরা খতিয়ে দেখছে। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ নিয়মিত মহাকাশে ছবি তুলে চলেছে। তবে অবলোহিত আলোকরশ্মিতে ছবি তুলে আনতে পারে এরকম আরও উন্নতমানের টেলিস্কোপ বানানোর কথাও ওরা ভাবছে। ইতিমধ্যে ২০০২ সাল নাগাদ সেই ভবিষ্যতের টেলিস্কোপের নামও ওরা ঠিক করে ফেলেছে—মস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ! জানি না, অদূর ভবিষ্যতে তেমন টেলিস্কোপ নাসা গড়তে পারবে কি না। তবে আপাতত হাবল টেলিস্কোপ থেকে মেরিল্যান্ডের কন্ট্রোলরুমে এমন কোনও ছবি পাঠাতে পারেনি যাতে অন্য কোনও গ্রহে প্রাণের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। প্রাণের সন্ধান! হ্যাঁ, আমার আজকের সেমিনারের মূল বিষয় ছিল—‘বায়োসিগনেচার ফ্রম স্পেস’! হ্যাঁ, সৌরজগতের কোনও গ্রহে অথবা সৌরজগতের বাইরের কোনও এক্সোপ্ল্যানেটে বায়োসিগনেচার খুঁজতে অনেকগুলো প্যারামিটার বিশ্লেষণ করতে হয়। নাসা-র রাডারে এখনও পর্যন্ত গ্লাইস বা কেপলার ছাড়া এমন কোনও এক্সোপ্ল্যানেটের খবর পাওয়া যায়নি যা পৃথিবীর অনুরূপ গঠন বিশিষ্ট। তবে গ্লাইস পৃথিবী থেকে প্রায় ২৩ আলোকবর্ষ দূরে, আর কেপলারের তো কথাই নেই, তা প্রায় ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে। ওখানে পৃথিবীর অনুরূপ বা কাছাকাছি বায়ুমন্ডল থাকলে প্রাণের অস্তিত্বও থাকা সম্ভব। তবে এগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মাথা ঘামানোর ব্যাপার, আমার নয়। আমার বক্তব্য হল অন্য কোনও গ্রহের বায়োসিগনেচার যদি পজিটিভ হয় তার অর্থ হল সেখানে আর্কিব্যাকটিরিয়ার হদিশ পাওয়া সম্ভব। যেমন ধরা যাক, শনিগ্রহের উপগ্রহ টাইটানের মেরুর দিকে মিথেনের হ্রদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। খুব স্বাভাবিকভাবে সেখানে মিথেন প্রস্তুতকারক আর্কিব্যাকটিরিয়ার অস্তিত্বও পাওয়া সম্ভব। মঙ্গলগ্রহ অথবা বৃহস্পতির উপগ্রহ গ্যানিমিড আর ইউরোপায় যদি সামান্যতম জলের সন্ধান পাওয়া যায় তবে সেই চরমতম পরিবেশে চরমজীবী বা এক্সট্রিমোফাইল প্রত্ন-অনুজীবদের অস্তিত্ব থাকার চান্স বেড়ে যায়। তবে এগুলোও ওই জ্যোতির্বিদদের আগ্রহের বিষয়, অনু-জীববিজ্ঞানী হিসেবে আমার আগ্রহ অন্য জায়গায়, সেটা হল চরম পরিবেশে এই ক্ষুদে জীবদের বেঁচে থাকার মন্ত্রটা কী? বক্তৃতার সময় আমার আগ্রহের কথাটা বলেও ফেললাম।
“সেমিনারের পর ককটেল ডিনারের সময় যখন আমি একটু একা হয়েছি, অমনি এক ভদ্রলোক হাসিমুখে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। নাম মিঃ টার্নার। ভদ্রলোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের অধীন ‘DARPA’-তে (ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি) কাজ করেন।”
পৃষ্ঠা নং- ৮০
“আমি খুব ভালো করেই জানি এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্তত দশটা অন্যতম সেরা গবেষণাকেন্দ্রে এক্সট্রিমোফাইল নিয়ে গবেষণা চলছে। এই গবেষণা প্রচুর খরচসাপেক্ষ। খুব বড় স্পনসর্ড প্রজেক্ট না হলে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভাবছি ইয়েল থেকে হার্ভার্ডে ফিরে যাব। ওখানে অবশ্য ডঃ সিলভারেরাও কাজ করছেন। ওখানে গেলে যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারি? ভাবছি একবার ডারপা-র মিঃ টার্নারের সঙ্গে কথা বলব।”
পৃষ্ঠা নং- ৯৭
“অর্থ, যশ কোনও কিছুর পিছনেই কখনও ছুটিনি। শুধু মানুষের কল্যাণে বৈপ্লবিক কোনও আবিষ্কারের নেশায় মেতে থেকেছি। নাসা-র গবেষণার উদ্দেশ্যটা আমার কাছে পরিষ্কার হলেও ডারপা-র উদ্দেশ্যটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। মিঃ টার্নারের কথাবার্তার মধ্যেও স্বচ্ছতার অভাব মনে হয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এই সংস্থার উদ্দেশ্যটাও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। টার্নারের শর্তগুলোও বড় অদ্ভুত।”
পৃষ্ঠা নং- ১১২
“ডারপা-র স্পনসর্ড প্রজেক্টটা হার্ভার্ডের গবেষকের টিমটা পেয়েছে। ২০০ মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট। প্রকল্পটার সময়সীমা ৭ বছর। ডঃ সিলভারের ল্যাব ওটা পেয়ে গেছে। মিঃ টার্নারদের দেওয়া শর্তগুলো আমি সব মেনে নিতে পারিনি। মানুষের কল্যাণের বাইরে কোনও শর্তই আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। হতাশ হচ্ছি না, ভাবছি নিজের দেশে ফিরে যাব। নতুন করে গবেষকদের টিম বানিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করব।”
একটা বিশ্রী গন্ধ এসে মনন শীলের নাকে ধাক্কা মারতে সে ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের বাদামী ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখল। হাতের ডিজিট্যাল ঘড়িটায় দেখল বিকেল পাঁচটা বাজে। সদ্য কাজ সেরে ফিরে আসার পথে সোধিও গন্ধটা পেয়েছে, সে মননের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে বলল, “স্যারজি, ইতনা বদবু কঁহা সে আ রহা হ্যায়?”
মনন ডায়েরিটা গুছিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
মৈত্রী রিসার্চ স্টেশনটা অনেকটা ইউ আকৃতির। দৈর্ঘ্যে প্রায় দুশো মিটার। থাকার জন্য চব্বিশটা ঘর আছে, ঘর লাগোয়া টয়লেট আছে। তারপর উন্নতমানের বেশ কিছু ল্যাবরেটরি পর পর সাজানো। একটা বড় ফয়্যার বা কমিউনিটি হল আছে, যেখানে এখানকার সদস্যদের জন্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হয়।
গন্ধটা আসছে মূল আবাসনের বাইরে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে রাখা একটা কার্গো কন্টেনার থেকে। মনন আর সোধি একটু এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল কন্টেনারের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক চুল্লি জ্বলছে, সেখান থেকেই বিশ্রী গন্ধটা আসছে। সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, ওরা মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড লজিস্টিকসের দায়িত্বে আছে। ওদের সঙ্গে কথা বলে মনন আর সোধি জানতে পারল মৈত্রীতে প্রতিদিনকার বাথরুমের কঠিন বর্জ্যপদার্থ এখানে ইলেকট্রিক কমবাস্টারে পুড়িয়ে ফেলা হয়, আর তরল রেচনপদার্থ জমিয়ে রেখে কন্টেনারে ভরে জাহাজে করে ভারতে পাঠানো হয়। সেখানে এগুলোর ডিসপোজাল হয়।
শ্বাসরোধী গন্ধটা প্রতিরোধ করতে মনন নাকে একটা রুমাল চাপা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সোধি বলল, “স্যারজি, দেখিয়ে ইয়ে লোগ পটি কো কিতনা মেহেঙ্গা বনা দিয়া!”
“রীতিন্দর, ঘটনাটা অন্য। আসলে অ্যান্টার্কটিক চুক্তির একটা ধারা আছে যে এখানকার পরিবেশ কোনও দেশ দূষিত করতে পারবে না। অ্যান্টার্কটিকাকে দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্ব চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি দেশের। ফলে এইভাবে জায়গাটাকে বর্জ্যপদার্থের দূষণ থেকে মুক্ত রাখতে হচ্ছে।” মনন সোধির দিকে তাকিয়ে বলল।
। । ৬ । ।
নাওমি বোস ফোর্ড ই-সিরিজের ভ্যানটার সামনে এসে দেখল চালকের আসনে নতুন পাঞ্জাবী ছোকরাটা বসে আছে। বিরক্ত হলেও গাড়িতে না বসে তার উপায় নেই। এই রীতিন্দর সিং সোধি নামের নবাগত লোকটা এখানে সিনিয়র ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড লজিস্টিকস ম্যানেজার হয়ে এসেছে, লোকটাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই।
নাওমি গাড়ির আসনে বসে একটু উশখুশ করতে লাগল। তার সঙ্গে আজ স্যাম্পেল কালেকশনে তাদের রিসার্চ টিমের ভুবন শইকিয়ারও যাওয়ার কথা। নাওমি রিস্টওয়াচটার দিকে তাকাল। সকাল সোয়া আটটা বাজে, ইতিমধ্যে শইকিয়ার চলে আসার কথা। বেরোতে দেরি হলে আজ ফিরতেও অনেকটা সময় লেগে যাবে। আজ নাওমি সী-কোস্টের দিকে যাবে। প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ।
তাকে অনেক কাজ করতে হবে। ডঃ পিল্লাইয়ের ড্রিম প্রজেক্ট তাকে শেষ করতে হবে।
ভ্যানের দরজা খুলে আচমকা তার পাশে এসে বসল মনন শীল। নাওমি চমকে উঠল, পরক্ষণে ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি, মিঃ শীল? হোয়্যার ইজ শইকিয়া?”
মনন হাসল, খুব বিনীত গলায় বলল, “মিস বোস, আসলে আমি নিজেই ভুবনজীকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম ওর জায়গায় যদি আজ আমাকে যাওয়ার সুযোগ দেন। উনি সানন্দে রাজি হলেন তাই…”
“কিন্তু আমি আজ নমুণা সংগ্রহ করতে কোনদিকে যাব জানলেন কী করে?”
“প্রিন্সেস অ্যাস্ট্রিড আইস শেলফের দিকে,” মনন বলল, “আমি ভুবনের কাছ থেকে শুনেই তো এলাম। আসলে ওদিকেই আমার জিওফিজিক্যাল সার্ভে করতে যাওয়ার কথা।”
নাওমি সরাসরি মননের চোখের দিকে খরচোখে তাকাল। তারপর চলন্ত গাড়ির বাইরে তাকাল।
“স্যারজি, ইঁহা আপকা কাম কেয়া হ্যায়, মতলব ও জো মাশিন সাথ মেঁ লেকর আয়ে…” চালকের আসন থেকে সোধি মননকে উদ্দেশ্য করে বলল।
মনন তাড়াতাড়ি সোধিকে থামিয়ে বলল, “গ্র্যাভিমিটার, অভিকর্ষজ ত্বরণ মাপার জন্য আর পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র মাপার জন্য টেসলামিটার।”
সোধির ওভারঅ্যাক্টিং দেখে মনন শঙ্কিত হয়ে পড়ল। এ ছেলে আবার না একটা কান্ড ঘটায়! কথার মোড় ঘোরানোর জন্য সে নাওমির দিকে তাকিয়ে বলল, “ডঃ পিল্লাই আর আপনি তো একই প্রজেক্টের কাজ করছিলেন?”
“হ্যাঁ।” নাওমি জানলার বাইরে থেকে চোখ না সরিয়ে বলল।
“ডঃ পিল্লাই বস হিসেবে কেমন ছিলেন?”
“ভালো।” এবারও নাওমি জানলার দিক থেকে মুখ ফেরাল না।
মেয়েটি মনোসিলেবলে কথা বলছে, তার দিকে তাকাচ্ছেও না।
মনন বুঝতে পারল মেয়েটি তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নয়। সোধি আর সে এখানে আসার পর সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। তার মধ্যে মেয়েটির সঙ্গে হাতে গোনা মাত্র কয়েকবার তার কথা হয়েছে। কিন্তু সে লক্ষ করেছে প্রথম দিন থেকে মেয়েটা তাদের দিকে কেমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। মনন চুপ করে জানলার বাইরে তাকাল।
আচমকা গাড়ি চালাতে চালাতে সোধি বলে উঠল, “বহেনজী, ইঁহা মৌজ মস্তি কে লিয়ে কুছ ডিস্কো, নাইটক্লাব হ্যায় কেয়া?”
“হোয়াট ননসেন্স!’ জানলার বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে নাওমি রাগে ফেটে পড়ল, “আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?”
মনন পরিস্থিতি সামাল দিতে সোধির দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকাল। মেয়েটা এবার সরাসরি মননের দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বলল, “এবার মিঃ মনন শীল আপনাদের অভিনয়টা বন্ধ করুন। আমি জানি ইউ পিপল আর স্লুথ। আপনারা এখানে ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের খুনের তদন্ত করতে এসেছেন। কী, তাই তো?”
নাওমির কথাটা শোনামাত্র সোধি ঘাবড়ে গিয়ে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। বরফের ওপর স্কিড করে একটা বিশ্রী শব্দ তুলে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। মনন এতটা আশা করেনি। সে বোবা হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল।
“প্রথম দিন থেকে আপনাকে আমার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না আপনাকে কোথায় দেখেছি,” নাওমি বলতে শুরু করল, “হঠাৎ আজ মনে পড়ল বছরদেড়েক আগে আঁখিশ্রী প্রকল্পের কেলেঙ্কারির কেসটা যখন টিভিতে এসেছিল তখন আপনাকে দেখেছিলাম। খবরের কাগজের প্রতিবেদনেও আপনার নাম আর ছবি ছাপা হয়েছিল।”
গাড়ির ভেতর একটা অস্বস্তিকর স্তব্ধতা নেমে এল। সোধি চুপ করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। মননও জানলার বাইরে চুপ করে তাকিয়েছিল। প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল তারা শারম্যাকার ওয়েসিসে এসেছে কিন্তু যে কাজের জন্য এসেছে তা বিন্দুমাত্র এগোয়নি। এখনও পর্যন্ত সে কোনও লিড পায়নি। অনেকগুলো প্রশ্ন তার মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। ডঃ বেদ পিল্লাই আমেরিকা থেকে ভারতে ফিরে এসে ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যান্টার্কটিক অ্যান্ড ওশেন রিসার্চে যোগ দেন। এই জাতীয় সংস্থার অন্তর্গত অ্যান্টার্কটিক রিসার্চ প্রোগ্রামের প্রধান হয়ে মৈত্রীতে যোগদান করেন। এই তথ্যগুলো ডঃ পিল্লাইয়ের বাদামী ডায়েরি আর দিল্লিতে ডঃ গিলের কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, কিন্তু ডঃ গিলকে হঠাৎ মরতে হল কেন? কে তাকে খুন করল? কেনই বা তাকে খুন করা হল? এতগুলো প্রশ্ন জমে আছে যার সদুত্তর পাওয়ার জন্য একটা ছোট লিডও এখনও পর্যন্ত সে জোগাড় করতে পারেনি। তার ওপর এই নাওমি নামের মেয়েটা তাদের আসল পরিচয় আর উদ্দেশ্য জেনে ফেলেছে। এই অবস্থায় তদন্তের কাজ চালানো আরও জটিল হয়ে উঠবে।
“ডঃ পিল্লাই নিজে আমাকে এই প্রজেক্টে রিক্রুট করেন,” মননকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ নাওমি বলতে শুরু করে। “আমি ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের তীব্র লবণাক্ত জলে বেঁচে থাকা আর্কিব্যাকটিরিয়া নিয়ে কাজ করছিলাম। সেটা নিয়ে নেচার পত্রিকায় আমার একটা ছোট প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সেটা পড়েই উনি আমাকে স্কাইপে একটা ভিডিও কল করে ইন্টারভিউ নেন। PCR-এ 16S rRNA অ্যামপ্লিফিকেশন করেছি কি না, DNA সিকোয়েন্সিং করতে জানি কি না—এসব প্রশ্ন করেন। আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হওয়ার পরেই তিনি প্রস্তাব দেন ওর সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকাতে এসে এক্সট্রিমোফাইল নিয়ে কাজ করার জন্য।”
“দেখুন, নাওমি, আমরা ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও মিনিস্ট্রি অফ আর্থ সায়েন্সের আদেশেই ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির থেকে এসেছি ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের মার্ডারের তদন্ত করতে,” মনন এবার খুব নরম গলায় বলে ওঠে। “আমি জানি, আপনি ডঃ পিল্লাইয়ের রিসার্চ টিমের কোর গ্রুপে ছিলেন। আপনাকে উনি খুবই স্নেহ করতেন।”
“হ্যাঁ, আমি পিতৃহীন জানার পর ডঃ পিল্লাই আমাকে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন,” বিষণ্ণ গলায় নাওমি বলল। “ওঁর আইআইটি-পড়ুয়া মেয়ে অনুষ্কাও আমার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট। আমাকে স্যার নিজের বড় মেয়ের মতোই মনে করতেন। বারদুয়েক স্যাটেলাইট ফোনে অনুষ্কার সঙ্গেও কথা বলিয়েছিলেন।”
“নাওমি, আপনার সাহায্য ছাড়া আমরা এই কেসে একচুলও এগোতে পারব না। প্লিজ, আমাদের আসল পরিচয়টা এখন কাউকে জানাবেন না,” মনন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আর্জি জানানোর ভঙ্গিতে বলল।
“হ্যাঁ, আমি আপনাদের তদন্তে সব রকমের সাহায্য করব,” বিষণ্ণ অথচ প্রত্যয়ের সুরে সে বলল।
সোধি ফের চুপচাপ গাড়ি চালাতে শুরু করেছে। এখন তার মুখে কুলুপ আঁটা। সে যে বেশি বকবক করে একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছে সেটা বোধহয় বুঝতে পেরেছে।
“আমরা এখন প্রিন্সেস অ্যাস্ট্রিড আইস শেলফের দিকে যাচ্ছি,” নাওমি মননের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল। “জায়গাটায় প্রথম নরওয়ের ভূপর্যটকরা পা রেখেছিল বলে নিজেদের দেশের রাজকন্যার নামে রেখেছিল। তবে অ্যান্টার্কটিকার এই অংশের মূল ভূখন্ডটির নাম রাখা হয়েছিল কুইন মড ল্যান্ড। এটা ওদের রানির নাম ছিল। কুইন মড আবার সম্পর্কে রাজকন্যা অ্যাস্ট্রিডের ঠাকুমা।”
“বড্ডে বড্ডে লোগ! আজকাল জমিন কা ভাও কিতনা বাঢ় গিয়া। অউর উনহে, ব্যস্, ইউহিঁ মিল জাতা,” সোধি ফের ফুট কাটল।
“সোধি, অ্যান্টার্কটিক ট্রিটি অনুযায়ী এখানকার এক স্কোয়্যার ফিট জমিও কোনও দেশের সম্পত্তি নয়। সে দাবি কেউ করতেও পারবে না। তবু জায়গাগুলোর তো একটা নাম দেওয়া প্রয়োজন, তাই যে দেশের ভূপর্যটকরা এখানে প্রথম পা রেখেছিল তাদের দেশের রাজা-রানিদের নামেই জায়গাগুলোর নাম রাখা শুরু করেছিল,” মনন তড়িঘড়ি সোধিকে চুপ করানোর জন্য বলল। সবেমাত্র মেয়েটা সহযোগিতা শুরু করেছে, সোধির কথা শুনে বেঁকে বসলেই মুশকিল।
“আর্কিব্যাকটিরিয়া বা আর্কিয়া-কে মনে করা হয় এই গ্রহের প্রথম জীব। এদের ৪০০ কোটি বছরের পুরোনো ফসিল পাওয়া গেছে। মোটামুটি পৃথিবীতে সমুদ্র তৈরির পরই এদের উৎপত্তি। তারপর বহু অভিব্যক্তি ও অভিযোজন পেরিয়ে আজকের জীবজগত তৈরি হয়েছে। তবু আজও প্রকৃতিতে আর্কিয়া-রা তাদের আদি অকৃত্রিম চেহারায় বেঁচে আছে। তারা মূলত উষ্ণপ্রস্রবণ, তীব্র লবনাক্ত হ্রদ, আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তর এবং কয়েকশো মিটার পুরু বরফের স্তরের তলায় লুকিয়ে থাকা হ্রদের চরম ও অস্বাভাবিক পরিবেশে বেঁচে আছে। এমন চরম পরিবেশে বেঁচে থাকে বলেই এদের এক্সট্রিমোফাইল বলে।” নাওমি বুঝিয়ে বলল।
“কিন্তু এই প্রিন্সেস অ্যাস্ট্রিড আইস শেলফ বা বরফের তাকের কাছে কী আছে?”
“দেখুন মিঃ শীল, পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলেই প্রায় চল্লিশটার মতো বড় হ্রদ আছে, যার মধ্যে অনেকগুলো কয়েকশো মিটার বরফের তাকের তলায় চাপা পড়ে আছে। সেই গভীর, তুষার-সমাধিস্থ, অন্ধকার হ্রদগুলির মধ্যেই রয়েছে অনুজীবদের এক অদ্ভুত বাস্তুতন্ত্র। এমনই এক হ্রদের সন্ধান পেয়েছিলেন ডঃ বেদ পিল্লাই। সেই হটস্পটটা এই প্রিন্সেস অ্যাস্ট্রিড আইস শেলফের তলায়।”
চতুর্দিকে শুধু বরফের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। মনন জানলার বাইরে তাকিয়ে ভাবছিল এর মধ্যে হটস্পটটা কোথায় বা কীভাবে আছে ডঃ পিল্লাই কেমন করে বুঝতে পারলেন? পরক্ষণেই সে বুঝল জিওফিজিক্যাল সার্ভে আর হাইড্রোলজি রিপোর্ট থেকেই এই ধরণের সাবগ্লেসিয়াল লেকের অস্তিত্ব জানা সম্ভব।
নাওমির নির্দেশে আচমকা পূর্ব অ্যান্টার্কটিক কোস্টলাইনের থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার ভেতরে গাড়িটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। এই জায়গাটাও প্রিন্সেস অ্যাস্ট্রিড নামাঙ্কিত বরফের তাকের মধ্যে পড়ে। নাওমি তার নমুণা সংগ্রহের গ্যাজেটস নিয়ে নেমে পড়ল। ঢেউখেলানো বরফের প্রান্তরের ডানদিকে একটা বরফ-ঢাকা পাহাড়। সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ আজ এক উজ্জ্বল রোদ উঠেছে। মনন দেখল, উঁচু জায়গাটা থেকে দল বেঁধে খানদশেক পেঙ্গুইন নিচে নেমে এল। পেঙ্গুইনগুলো দুই থেকে আড়াই ফুট লম্বা, শরীরটা সাদা রঙের, মাথা জুড়ে একটা কালো দাগ, দেখে মনে হচ্ছে যেন মাথায় কালো হেলমেট পরেছে। চলাফেরা, হাবভাব মানুষের মতো।
“চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইন,” নাওমি বলল, “এই অঞ্চলে এদের সংখ্যাই বেশি। তবে আরও চার-পাঁচ রকমের পেঙ্গুইন দেখা যায়।”
তিনটে পেঙ্গুইন সোধিকে ঘিরে দাঁড়াতে সে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেয়া ভাইয়া, হাউ ইজ দ্য জোশ?”
ওরা সোধিকে পাত্তা দিল না। নাওমির দিকে এগিয়ে আসতে সে গাড়ি থেকে একটা ছোট বালতি নিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। বালতি থেকে ছোট ছোট মাছ আর ক্রিল বের করে ওদের খাওয়াতে শুরু করল। খাবারদাবার খেয়ে খানিক পরে ওরা তৃপ্ত হয়ে চলে গেল।
বরফের প্রান্তরের মধ্যে একটি জায়গা দেখিয়ে নাওমি বলল, “ডঃ পিল্লাইয়ের নেতৃত্বে এখানে সাতশো মিটার ড্রিল করে আমরা একটা সাবগ্লেসিয়াল লেক পেয়েছিলাম। এখানে স্থায়ীভাবে একটা বোরওয়েল বানিয়ে রেখেছি। এখান থেকেই ডঃ পিল্লাই, ভুবন শইকিয়া আর আমি এসে হ্রদের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যাই। ডঃ জ্যোতি রঙ্গরাজন আর ডঃ বদ্রীনাথ এটার কথা সম্ভবত জানেন না।”
মনন তাকিয়ে দেখল বরফের তাকের মধ্যে দিয়ে এক ফুট ব্যাসের একটা ধাতব নল ড্রিল করে ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। সে নলের শেষ প্রান্ত কোন অতলে পৌঁছেছে তা অন্ধকার থাকার কারণে বোঝার উপায় নেই।
“ড্রিলারের মুখে গরম জলের জেট লাগিয়ে তা দিয়ে বরফ কেটে এই বোরওয়েলটা বানানো হয়েছিল,” বলতে বলতে নাওমি ফোর্ড গাড়ির ডিকি খুলে একটা সরু ধাতব তারে বাঁধা পাত্র সেই অন্ধকার ধাতব বোরওয়েলের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। তারপর ধাতব তারটা একটু একটু করে ছাড়তে লাগল।
“এখানেই আমরা পেয়েছিলাম -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা আর তীব্র লবণাক্ত সাবগ্লেসিয়াল লেকে বেঁচে থাকা আর্কিয়া, যার নাম হ্যালোরুব্রাম ল্যাকাসপ্রোফান্ডি। এই লড়াকু প্রত্ন-অনুজীবের ডিএনএ সিকোয়েন্সিং ছিল আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ, যা আমরা ল্যাবে করে ফেলেছিলাম।”
মনন তাকিয়ে দেখছিল তখনও নাওমি হাতের তার ছেড়ে চলেছে।
“এখানে আমরা শুধু আর্কিব্যাকটিরিয়াই নয়, জলভাল্লুক বা ওয়াটার বিয়ারও পেয়েছিলাম। জল ভাল্লুকরা টার্ডিগ্রেড শ্রেণীভুক্ত, সম্ভবত একমাত্র ক্ষুদ্র বহুকোষী প্রাণী যারা এমন চরম আবহাওয়ায় বেঁচে থাকতে পারে। রামাজোটিয়াস ভ্যারিওর্নেটাস প্রজাতির জলভাল্লুক অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য প্রতিকূল আবহাওয়ার জায়গায় হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু অ্যাকুটুনকাস অ্যান্টার্কটিকাস প্রজাতির জলভাল্লুক একমাত্র অ্যান্টার্কটিকাতেই সম্ভবত পাওয়া যায়। এটার ডিএনএ সিকোয়েন্সিংও ডঃ পিল্লাইয়ের তত্ত্বাবধানে আমরা করে ফেলেছি। তবে জলভাল্লুকের জিন পরীক্ষা করে ডঃ পিল্লাই বলেছিলেন এর জিনটির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন আর্কিব্যাকটিরিয়া ও ইউব্যাকটিরিয়ার থেকে এসেছে ‘হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার’-এর মধ্যে দিয়ে। ফলে জলভালুকের জিন হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা জীবের উৎস থেকে আসা মিশ্র জিন।”
মনন দেখল নাওমির কথা শুনে সোধি মাথা চুলকোচ্ছে। মননও আইপিএস জয়েন করার আগে রসায়নে স্নাতকোত্তর করেছে। নাওমির মাইক্রোবায়োলজির জার্গনগুলোর দু-একটা তার অ্যান্টেনায় ধরা পড়লেও বেশিরভাগটাই ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। সে হঠাৎ প্রশ্ন করল, “ডঃ পিল্লাইয়ের নেতৃত্বে এই টিম ঠিক কী উদ্দেশ্য নিয়ে গবেষণা করছিল। তিনি আলটিমেট কোথায় পৌঁছতে চাইছিলেন বা কী আবিষ্কার করতে চাইছিলেন?”
নাওমি একটু ধন্দে পড়ল। সে যতদূর জানে ডঃ পিল্লাই কোনও খ্যাতি বা অর্থের লোভে গবেষণায় আসেননি। মানুষের কল্যাণই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। মাঝেমধ্যে তিনি কথাগুলো নাওমিকেও বলতেন, তার আদর্শের বীজটা ওর মধ্যে রোপন করে দিতে চাইতেন।
হাতের তারে বাঁধা স্যাম্পেল কন্টেনারটা বোরওয়েলের ভেতর থেকে তুলতে তুলতে অন্যমনস্কভাবে নাওমি মননকে বলল, “ডঃ পিল্লাই এই প্রজেক্টটার একটা নাম দিয়েছিলেন—‘প্রজেক্ট সঞ্জীবনী।’
। । ৭ । ।
ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের ডায়েরি, পৃষ্ঠা নং- ১৩১
“ডঃ গিল ছাড়া এনসিএওআর-এর আর কেউ আমার গবেষণার বিষয়ে জানে না। ডঃ গিলকেও আমি সুস্পষ্টভাবে কিছু জানাইনি। সময়মতো সবটাই জানাবো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডারপা-র কর্তাব্যক্তি মিঃ টার্নারকে জানিয়ে যে ভুলটা আমি করেছিলাম সেটা আর করতে চাই না। আপাতত ডঃ গিল আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন আমার রিসার্চ টিমের জন্য সদস্য চয়ন করার। মেধাবী ও চরম প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে অভ্যস্ত ভারতীয় গবেষকদের নিয়ে আমি টিম গড়ছি।”
পৃষ্ঠা নং- ১৪২
“ডঃ বদ্রীনাথ, ডঃ রঙ্গরাজন মার্কিনদেশে কর্মরত মেধাবী ভারতীয় বিজ্ঞানী। ওদের দুজনকে আমার টিমে নিয়েছি। বাকি দুজনকে ভারত থেকে নিয়েছি। তাদের মধ্যে ডঃ ভুবন শইকিয়া সদ্য পিএইচডি শেষ করেছেন গৌহাটি আইআইটি থেকে। আমার টিমের সর্বকনিষ্ঠ ও সবচেয়ে উদ্যমী সদস্য হল নাওমি বোস। কলকাতার মেয়েটি বম্বে আইআইটিতে পিএইচডি-র জন্য গবেষণা করছে। নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত ওর আর্টিকেলটা পড়ে আমি চমকে যাই। মনে হয় আমার গবেষণার উদ্দেশ্যের সঙ্গে কোথায় যেন ওর চিন্তাভাবনা মিলে যাচ্ছে। ওকে তাই আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আমার প্রজেক্টে কাজ করিয়ে ওর পিএইচডি কমপ্লিট করাব।”
পৃষ্ঠা নং- ১৫৫
“আমার প্রজেক্টের নাম ‘প্রজেক্ট সঞ্জীবনী’। জানি একই বিষয়ে ডারপা-র ২০০ মিলিয়ন ডলারের স্পনসর্ড প্রজেক্টের কাজ করছে ডঃ সিলভারের টিম। ওদের প্রজেক্টের নাম ‘প্রজেক্ট ইনডেস্ট্রাকটিবল’। আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি পৃথিবীর শুরুর দিকের জীব আর্কিব্যাকটিরিয়া থেকে পৃথক হয়ে অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে ইউক্যারিওট জীব তৈরী হলেও তাদের মধ্যে এখনও অনেক জিনগত সাদৃশ্য আছে। এটাই আমার চাবিকাঠি। কাজ অবশ্য আমার ঢের বাকি। যদিও অ্যান্টার্কটিকার চরম আবহাওয়ায় বেঁচে থাকা বিস্ময়কর জীব আর্কিব্যাকটিরিয়া ও জলভাল্লুকের মতো ইউক্যারিওট জীবের প্রায় দশ-বারো রকমের প্রজাতির নমুণা থেকে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং শেষ করে ফেলেছি, ওদের ডিএনএ-র মোট বেস-পেয়ার সংখ্যা আর সর্বোপরি এদের ডিএনএ-তে জিনের সংখ্যাও বের করে ফেলেছি, তবুও আসল কাজটাই তো হয়নি। ডিএনএ-র হাজার জিনের মধ্যে কোনটা এদের চরমভাবাপন্ন পরিবেশে বেঁচে থাকার সংগ্রামে জয়ী করে তুলছে, জীবটিকে সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে অক্ষত রাখছে—সেটাই তো আসল রহস্য! কোন জিন? মনে হয় আমি লক্ষ্যের কত কাছে, অথচ কত দূরে! দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে আমি পরিশ্রম করে চলেছি অথচ আমার গবেষণার পূর্ণতার সেই সোনার মুহূর্তটা এখনও অধরা। হয়তো গন্তব্যের খুব কাছেই এসে আমি পৌঁছেছি, তবুও… কে জানে হয়তো কোনও অলস দুপুরে নিউটনের মতো বাগানের গাছ থেকে আপেল পড়া দেখে আমার টনক নড়বে, আর আমি উল্লাসে লাফিয়ে উঠব…”
পৃষ্ঠা নং- ১৬৩
“সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা ছায়াপথ কৃষ্ণগহ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সব যেমন অপার অনন্ত এক বিস্ময় অথচ ধ্রুবসত্য তেমনই গূঢ়-রহস্যময় জীবজগতও চলছে চারটি সত্যের ওপর। তিনটি সত্য অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে—রেপ্লিকেশন-ট্রান্সক্রিপশন-ট্রান্সলেশন। আর চতুর্থ সত্যটি হল—মিউটেশন! আহা, অনুষ্কা মা, তুই যদি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং না পড়ে মলিকিউলার বায়োলজি পড়তিস তবে জীবনের গভীর গূঢ় রহস্যের আস্বাদ তোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারতাম। হয়তো আমিই তোর মধ্যে বিষয়টা নিয়ে উৎসাহ জাগিয়ে তুলতে পারিনি। এবার দিওয়ালির ছুটিতে যখন বাড়ি যাব তোর জন্য অ্যান্টার্কটিকার অনেক ছবি তুলে নিয়ে যাব, অন্তত ছবিগুলোর মাধ্যমে যদি আমার জীবনদর্শনের খানিকটা ভাগ তোকে দিতে পারি। যখন সী-কোস্টের দিকে গিয়েছিলাম তখন ব্লু-হোয়েলের ছবি তুলেছিলাম। আইস শেলফের ওপর বসে থাকা ক্র্যাবইটার-সীল, এলিফ্যান্ট-সীল আর লেপার্ড-সীলের ছবি তুলেছিলাম। আরও কতরকমের পেঙ্গুইনের ছবি তুলেছি—অ্যাডেল পেঙ্গুইন, চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইন আর এম্পারার পেঙ্গুইন। ওরা দিব্যি মানুষের মতো চলাফেরা করে। তবে একটা ছবি এখনও তুলতে পারিনি। অরোরা অস্ট্রালিস! মানে যাকে বলে সাদার্ন লাইটস। শুনেছি সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য!”
পৃষ্ঠা নং- ১৮৬ (ডায়েরির শেষ এন্ট্রি)
“অবশেষে গতকাল সন্ধে নাগাদ ল্যাবে বসে নিউটনের মতো গাছ থেকে ‘আপেল পড়া’-টা দেখতে পেলাম। মাথার মধ্যে স্পার্কের মতো যেন কী একটা জ্বলে উঠল। রাত তিনটে পর্যন্ত কাজ করে আমার অন্তিম সিদ্ধান্তটি ‘ফাইনাল ইনফারেন্স’ নামে একটা ফাইলে লিখে আমার ল্যাপটপের ‘প্রজেক্ট সঞ্জীবনী’-র ফোল্ডারে সেভ করে রেখেছি। আহ্, গতকালের রাতটা কী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি। অনেকদিন পর আজ ঝলমলে রোদ উঠেছে। শুনলাম রাতেও আকাশ পরিষ্কার থাকবে। আহা, আজ রাতে যদি অরোরা অস্ট্রালিস দেখতে পাই তবে তো সোনায় সোহাগা!”
মনন, সোধি আর নাওমি সবাই বিস্ময়ে একে অপরের দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তিনজনই স্তব্ধবাক হয়ে ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের বাদামী ডায়েরিটার দিকে তাকালো।
“তার মানে ডঃ পিল্লাই শেষ পর্যন্ত সঞ্জীবনী সুধা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন!” প্রচন্ড বিস্ময়ে স্বগতোক্তির মতো নাওমি বলে উঠল।
মননই প্রথম প্রশ্নটা করল, “ডঃ পিল্লাইয়ের ল্যাপটপটা কোথায়? দিল্লিতে অনুষ্কার কাছে পাঠানো হয়েছিল কি? তার কাছ থেকেই আমরা এই বাদামী ডায়েরি আর নিকন ক্যামেরার মেমরি কার্ড সংগ্রহ করেছিলাম, কিন্তু অনুষ্কা আমাদের ডঃ পিল্লাইয়ের ল্যাপটপ নিয়ে কোনও কথা বলেনি তো!”
“তবে কি, স্যারজি, পুলিশ এসে ল্যাপটপ সিজ করে নিয়ে গিয়েছিল?”
“আচ্ছা, নাওমি, ডঃ পিল্লাইয়ের মৃত্যুর পর ঠিক কী কী হয়েছিল একবার বলবেন? ওর মৃত্যুর খবরটা রিসার্চ স্টেশনে এসে পৌঁছল কীভাবে?” মনন প্রশ্ন করল।
খানিক চুপ করে থেকে নাওমি বলতে শুরু করল, “২৭ আগস্ট দিনটা বেশ আলোকোজ্জ্বল ছিল। বেলা এগারোটা নাগাদ ডঃ বেদ পিল্লাই যখন তার সিঙ্গল অকুপ্যান্সি রুম থেকে আমাদের ল্যাবে এলেন তখন তাকে বেশ ঝরঝরে দেখাচ্ছিল। কাজ করতে করতে উনি আমাকে বলেছিলেন, নাওমি, তুমি এখানে আসার পর অরোরা অস্ট্রালিস দেখেছ?
আমি তখন বলেছিলাম, না স্যার, সন্ধের পর এই ঠান্ডায় বেরোনোর সাহস হয় না। তাছাড়া এখানে ব্লিজার্ডগুলো মারাত্মক হয়। রাতে একবার সেই তুষারঝড়ের কবলে পড়লে কী হতে পারে সেই আশঙ্কার কথা ভেবে কখনও বেরোইনি।”
“সেদিন ডঃ পিল্লাই রাত আটটার সময় মৈত্রী স্টেশন থেকে কেন বেরিয়ে ছিলেন? এখানে আগস্টের শেষেও তো অসম্ভব ঠান্ডা থাকে, তবে?” মনন মাঝপথে নাওমিকে থামিয়ে প্রশ্ন করল।
“উনি যে সন্ধের পর স্টেশন থেকে বেরিয়েছিলেন সেটাই জানতাম না। আমি আসলে আটটা নাগাদ ডিনার সেরে ঘরে চলে যাই। সারাদিন ল্যাবে প্রচুর পরিশ্রম করি বলে আমি নিজের সিঙ্গল অকুপ্যান্সি রুমে ঢুকে থার্মোস্ট্যাট অন করে নিজের স্লিপিং ক্লোজেটে ঢুকে শুয়ে পড়ি। আউটডোরে থাকলে আমরা চার স্তরের পোশাক পরি। তবে ইনডোরে আমরা থার্মোস্ট্যাট আর রুমহিটার চালিয়ে নিয়ে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আরামপ্রদ উষ্ণতায় থাকি। রাতে খাওয়ার পর আমি নিজের ঘরে হেডফোনে গান শুনি। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ি। সে রাতে ডঃ পিল্লাই যে স্টেশনে ফেরেননি সেটাই আমি জানতাম না। সকালে ঘুম ভাঙার পর আটটা নাগাদ খবর পাই আমাদের বেস-স্টেশন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আমাদের একটা সার্চ টিম ওর ডেডবডি খুঁজে পেয়েছিল।”
“ক্রাইমসিনে পুলিশ কখন এসেছিল?”
“স্টেশন থেকে আমরা সবাই যখন স্পটে গিয়ে পৌঁছই তখন ওর শরীরের অনেকটা তুষারের তলায় চাপা পড়েছিল। লাল রক্তে বরফ ভিজেছিল। ওর মৃতদেহের পাশেই পড়েছিল ওর নিকনের ডিএসএলআর ক্যামেরা। তখনই ডঃ বদ্রীনাথ অথবা ডঃ জ্যোতি রঙ্গরাজনের মধ্যে কেউ একজন ডঃ পিল্লাইয়ের শরীরে অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল। ওদের মধ্যে কেউ একজন স্যাটেলাইট ফোনে খবর পাঠায় অকল্যান্ড আর কেপ টাউনে। ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে ডুনেডিন থেকে সামরিক বিমানে নিউজিল্যান্ড পুলিশ এখানে পৌঁছয় বিকেল তিনটে নাগাদ। তার একঘণ্টার মধ্যে কেপ টাউন থেকেও আকাশপথে দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ এসেছিল। পরদিন সকালে ডঃ পিল্লাইয়ের মরদেহ আর তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, হ্যাঁ, মনে পড়েছে ল্যাপটপ সহ সবকিছু কেপটাউনের পুলিশ সিজ করে নিয়ে যায়।”
খুব মন দিয়ে মনন শীল কথাগুলো শুনছিল। এবার সে চিন্তিত মুখে বলল, “কিন্তু, নাওমি, ডঃ পিল্লাই সেদিন রাত আটটা নাগাদ স্টেশনের বাইরে বেরিয়েছিলেন কেন? অত রাতে সঙ্গে ক্যামেরাটা নিয়ে বেরোবেনই বা কেন? আচ্ছা, সে রাতে কি অরোরা অস্ট্রালিস দেখা গিয়েছিল?”
“মে বি, হতেই পারে, মনে হচ্ছে সেরকম কিছু শুনেছিলাম, আসলে আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!”
“সোধি,” হঠাৎ নিজের ল্যাপটপটা খুলে মনন বলল, “ডঃ পিল্লাইয়ের নিকন ক্যামেরার মেমরি কার্ড দুটো দাও তো।”
সোধি একটা ব্যাগ খুলে মেমরি কার্ডদুটো মননের হাতে দিতেই সে ল্যাপটপের স্লটে একটা কার্ড ঢুকিয়ে ইমেজের ফোল্ডার থেকে একটার পর একটা ছবি স্ক্রিনে ওপেন করে দেখতে শুরু করল। ছবিগুলোর তলায় ডেট টাইম লেখা আছে। তিনজনে ল্যাপটপের স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমেজগুলোর দিকে তাকিয়ে নাওমি টুকরোটাকরা মন্তব্য করছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে ছবির সিচ্যুয়েশনগুলো। ২১ আগস্টের একটা ছবি দেখে মনন জায়গাটা চিনতে পারল। এক সপ্তাহ আগে প্রিন্সেস অ্যাস্ট্রিড আইস শেলফের যে হটস্পটে ওরা গিয়েছিল সেই জায়গাটা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেই চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনগুলো ডঃ পিল্লাইয়ের হাত থেকে খাবার খাচ্ছে। পরের ছবিটা ২৩ আগস্টের। এই ছবিটায় ডঃ পিল্লাইয়ের গোটা টিমের সঙ্গে রুশ রিসার্চ টিমের অনেকে রয়েছে। মনন আর সোধি এদের অনেককেই চেনে, যদিও সবার নাম মনে নেই। ছবির বাঁদিক থেকে বদ্রীনাথ, শইকিয়া, ডঃ পিল্লাই, নাওমি, জ্যোতি, নাতাশা, তাতিয়ানা, আনাতোলি। ওদের পিছনের সারিতে ডানদিক থেকে বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে আছে ইগর, ভ্যালেরি, বরিস, মিখাইল। মৈত্রী ও নোভোলাজারেভস্কায়ার আরও কয়েকজন সায়েন্টিস্ট ছবিটায় আছে যাদের মনন বা সোধি দুজনের কেউ চেনে না।
“এই ছবিটা কোথায় তোলা?” মনন নাওমির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
“এটা নোভোলাজারেভস্কায়ার রাশিয়ান স্টেশনে তোলা। ওখানে আমরা মাঝেমধ্যে যাই। ওরাও আসে। রুশ স্টেশনের তাতিয়ানা, নাতাশা, ভাসিলিসা আমার বন্ধু। ওদের গেমিং জোনে বোলিং অ্যালে-টা খুব ভালো, আমি তো মাঝেমধ্যেই খেলতে যাই। সেদিন নাতাশার বার্থডে পার্টি ছিল। আমরা সবাই ওখানে গিয়েছিলাম। ছবিটা তখনই তোলা হয়েছিল।” নাওমি বলল।
“কিন্তু ২৩ তারিখের পর আর কোনও ছবি নেই! ২৭ আগস্ট রাতে যদি ডঃ পিল্লাই সাদার্ন লাইটস দেখার জন্য মৈত্রী থেকে বেরিয়ে থাকেন তাহলে সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে ন’টা পর্যন্ত উনি কোথায় ছিলেন আর কী করছিলেন? কেপটাউনে ওর বডি নিয়ে যাওয়ার পর যে পোস্টমর্টেম হয়েছিল তাতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে ওর মৃত্যু ঘটেছিল রাত ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যে। যদি ডঃ পিল্লাই ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলবেন মনস্থ করেই বেরিয়েছিলেন তবে ছবি তুললেন না কেন?”
“হয়তো উনি সাদার্ন লাইটসের ছবি তোলার আগেই খুন হন, অ্যায়সা ভি হো সকতা হ্যায়।” পাশ থেকে সোধি বলল।
মনন অবিশ্বাসের সঙ্গে বারদুয়েক মাথা নাড়াল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ইরিডিয়াম স্যাটেলাইট ফোনের হ্যান্ডসেটটা তুলে একটা বিশেষ প্রাইভেট নম্বর ডায়াল করল।
“ডঃ গিল, আপনারা কি এনসিএওআর থেকে ডঃ পিল্লাইয়ের ল্যাপটপটা নিয়ে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ। ওটা ছাড়া আর সবকিছু আমরা ডঃ পিল্লাইয়ের পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছি,” ফোনের ওপাশ থেকে ডঃ গিলের কন্ঠস্বর ভেসে আসে, “আমাদের প্রজেক্ট সঞ্জীবনীর কাজ ডঃ পিল্লাই শেষ করে যেতে না পারলেও এক্সপেরিমেন্টাল ডেটাগুলো আমাদের প্রয়োজন। তাছাড়া এই সিক্রেট এক্সপেরিমেন্ট সংক্রান্ত কোনও তথ্য বাইরে লিক হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।”
“বুঝতে পারছি, কিন্তু যে জরুরি কথাটা জানার জন্য আপনাকে ফোন করলাম সেটা হল ল্যাপটপে প্রজেক্ট সঞ্জীবনী নামের ফোল্ডারের ভেতর ‘ফাইনাল ইনফারেন্স’ বলে কোনও ১৩০ কেবির টেক্সট ফাইল পেয়েছেন?”
“হ্যাঁ, প্রজেক্ট সঞ্জীবনীর একটা বড় ফোল্ডার আছে,” বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ডঃ গিল বললেন। “ফোল্ডারটার ভেতর প্রায় তিরিশটা ফাইল আছে কিন্তু ‘ফাইনাল ইনফারেন্স’ নামে কোনও ফাইল তো পাইনি, আমি ফোল্ডারটা তিন-চারবার দেখেছি কিন্তু ওই নামে কোনও ফাইল নেই তো!”
কান থেকে ফোনসেটটা নামিয়ে মনন চিন্তিত মুখে ঠৌঁটটা কামড়ে ধরল। তার কপালের ঠিক মাঝখানে একটা ভাঁজ ফুটে উঠল। মনন আর নাওমি দেখতে পেল এই প্রথম মননের চোখদুটো ধক করে জ্বলে উঠল।
। । ৮ । ।
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। ছেলেটার গরম নিঃশ্বাস মেয়েটার কাঁধ, গলা আর বুকের ওপর তুফানের মতো আছড়ে পড়ছে। দুটো পুরুষালি হাত ওর নারীত্বকে ব্যগ্রভাবে ছুঁচ্ছে। লঁজারির ভেতর ঢুকে হানাদার হাতদুটো তাকে দলিত, মথিত করছে। অস্থির হয়ে উঠছে মেয়েটা, তার শরীরের রোমকূপে পদ্মকাঁটা জেগে উঠছে। তার নারী শরীরের গভীরদেশ আকুল হয়ে ভিজতে শুরু করেছে। আঃ কতদিন পর ভিজছে সে। ফিসফিস করে ছেলেটার কানে কানে সে বলে উঠল, “ডু ইট বেবি, ডু ইট!”
ছেলেটার ঠোঁটদুটো দ্রুত নেমে আসছে মেয়েটার ভেজা ঠোঁটের ওপর। অল্প ফাঁক হওয়া ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ছেলেটার জিভ সাপের মতো জড়িয়ে নিল মেয়েটার জিভকে। মেয়েটা তীব্র আশ্লেষে ডুবে যাচ্ছে ছেলেটার চুম্বনে। ছেলেটার মুখের ভেতর পিপারমিন্টের গন্ধ পাচ্ছে কি মেয়েটা? নাহ্ এ তো পিপারমিন্ট নয়! চুম্বনের ভেতরে ডুবতে ডুবতেও মেয়েটার মাথার মধ্যে বিপদসংকেতের মতো টিক্ টিক্ করে কী যেন বেজে উঠল। সে ছেলেটার ঠোঁটের আলিঙ্গন থেকে নিজের ঠোঁটটা বিযুক্ত করে ছিটকে সরে এসে বলল, “হানি, ইজ দ্যাট ক্র্যাঙ্ক? ইউ ডিড ড্রাগ?”
নারী শরীরের ঘোর ছেলেটার নেশাকে তখন বাড়িয়ে দিয়েছে। সে হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে ছুঁতে চাইল। মেয়েটা সরে গিয়ে বলল, “ডোন্ট টাচ মী। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে কখনও মেথ টাচ করবে না, ইউ লায়ার!”
ছেলেটা ঘোরলাগা চোখে মেয়েটাকে দেখছে। মেয়েটার প্রত্যাখ্যানে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। ক্ষোভে রাগে ছেলেটার নাকের পাটা ফুলে উঠল। সে এক ঝটকায় মেয়েটার কাঁধদুটো খামচে ধরল। তারপর মেয়েটাকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করালো। মেয়েটা তীব্র প্রতিবাদ করার আগেই ছেলেটা নিজের বাঁহাত দিয়ে মেয়েটার মুখটা পিছন থেকে চেপে ধরল। আর ডানহাতে মেয়েটার ডানহাত ওর পিঠের দিকে মুচড়ে ধরল। তারপরে চকিতে নিজের জিনসের ফ্লাই খুলে ছেলেটি তার উদ্ধত পুরুষাঙ্গ মেয়েটির গোলাপী জি-স্ট্রিংস সরিয়ে পশ্চাৎদেশ থেকে সজোরে প্রবিষ্ট করল। চাপা গর্জন করে ছেলেটা বলল, “বিচ, ইউ লাইক দিস ডগি স্টাইল, হাঁ?”
মেয়েটার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, সে তার প্রেমিকের আচরণে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। তার মুখের গ্যাগটা সরিয়ে নিলেও সে আর একটা কথাও বলবে না। তার প্রেমিকের দেওয়া যন্ত্রণা সহ্য করে যাবে মুখ বুঁজে। রিসার্চ স্টেশনের ক্লাবরুমের সাউন্ড সিস্টেম থেকে তার কানে ভেসে আসছে টেইলর সুইফ্টের গানের অমোঘ একটা লাইন—‘ও মাই লাভার, হ্যাভ আই নোন ইউ টুয়েন্টি সেকেন্ডস অর টুয়েন্টি ইয়ার্স?’
আজ মনন শীল নামে রিসার্চ স্টেশনের এক সদস্যের জন্মদিনের পার্টি চলছে। মেয়েটি তার প্রেমিককে নিয়ে এক ফাঁকে সবার অলক্ষে ড্যান্সফ্লোর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবু যখন সে তার প্রেমিককে নিয়ে লুকিয়ে চলে আসছিল তখন তার কেমন যেন একটা আনক্যানি ফিলিংস হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল দুটো চোখ যেন তাদের ওপর কড়া নজর রাখছিল, প্রতি মুহূর্তে অনুসরণ করছিল।
মেয়েটির প্রেমিক আজ অনেকদিন পর তার শরীরে প্রবিষ্ট হয়েছে। সে চেয়েছিল এই মুহূর্তটায় সে সুখের সাগরে ডুবে যাক, একটা হালকা পাখির পালকের মতো দুলতে দুলতে ক্লাউড নাইনে পৌঁছে যাক। সেসব কিছুই হচ্ছে না, তার চোখ ফেটে জল আসছে। তার ভালোবাসার মানুষটা তাকে এত কষ্ট দিচ্ছে কেন? কবে তারা মার্কিনদেশে যাবে? তার পুরুষবন্ধুটি কথা দিয়েছিল, ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের গবেষণালব্ধ ফলাফল ডারপা-র হাতে পৌঁছে যাবে। ডঃ সিলভারদের ‘প্রজেক্ট ইনডেস্ট্রাকটিবল’-এর গবেষণার কাজ শেষ হওয়ার অনেক আগেই তারা মানুষের সঞ্জীবনী সুধার মন্ত্র সরাসরি পৌঁছে দেবে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের হাতে। তারপর হয়তো দুজন একসঙ্গে ফিজিওলজি অ্যান্ড মেডিসিনে নোবেল পুরস্কারটা পাবে। অর্থ আর যশ দুটোই আশীর্বাদের মতো ঝরে পড়বে তাদের জীবনে। তারপর অ্যাটলান্টিকের ধারে লং আইল্যান্ডে একটা বিচ হাউজ কিনবে ওরা। পাম গাছে ঘেরা স্প্যানিশ কলোনিয়াল ধাঁচের বাড়িটা হবে। বারো-তেরোটা কামরা থাকবে। শিশুদের কলরবে মুখর হয়ে থাকবে ঘরগুলো। বাড়ির পোর্টিকোয় দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে। তার নিজের গাড়িটা বিএমডব্লু হাই-এন্ড মডেল আর তার ভালোবাসার মানুষটা চালাবে বুগাত্তি ভেরন স্পোর্টসকার। বাড়ির বারান্দায় বসলে দেখা যাবে নীল অতলান্তিক সাগর। সোনালি তটে তার লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে বেড়াবে একদল অ্যাভোসেট। নীল জলের ওপর চক্কর দিয়ে ঘুরে বেড়াবে কয়েকটা সীগাল…
“আহ্… আহ্… আআআআহ্,” মেয়েটির মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে যন্ত্রণা জড়ানো শীৎকার। ছেলেটা ক্রমশ তার পেলভিক থ্রাস্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে, যেন তার পুরুষত্বের সবটুকু উগড়ে দিতে চায়। মেয়েটার চোখের সামনে থেকে পূর্ণাঙ্গ ছবিটা ভেঙে পিকচার পাজলের টুকরোর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক যন্ত্রণাময় সুখানুভূতির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে সে চায় পিকচার পাজলের টুকরোগুলোকে আঁকড়ে ধরতে। মনে মনে ফের জোড়া দিতে চায়। তার জীবনের সব অতৃপ্তি মুছে সে পূর্ণতা চায়। জড়ানো গলায় সে বলে ওঠে, “বেবি, তুমি ইউএস ডিফেন্স সেক্রেটারিকে বলেছ আমাদের কথা, আমাদের দুজনের কথা?”
ছেলেটা তখন সুখসায়রে ভাসছে। হাঁফাতে হাঁফাতে ক্লাউড নাইন থেকে নেমে আসছে। মেয়েটার খোলা পিঠে তার বিজবিজে ঘামে ভেজা কপালটা ছুঁইয়ে একটু দম নিচ্ছে। সেও একটা ছবি দেখছে। মেয়েটার কথা মতো সে সব কথা বলেছে, তবে ইউএস ডিফেন্স সেক্রেটারিকে নয়, তার নিজের গডফাদারকে। তার চোখের সামনেও ভেসে উঠছে গত ২রা সেপ্টেম্বরের একটা ছবি।
। । ৯ । ।
২রা সেপ্টেম্বর, ২০১৯, আল বাঘুজ ফাওকানি, আবু কামাল ডিস্ট্রিক্ট, সিরিয়া
আজকের সভায় আইসিস সুপ্রিমো আবু-বকর আল বাগদাদী আসতে পারেননি কিন্তু রাক্কার আইসিস নেতা আবু ফয়জল এসেছেন। সঙ্গে এসেছেন তাজিকিস্তানের নেতা কম্যান্ডার গুলমাহের খালিমভ। আর এসেছেন সামনের সারিতে বসে থাকা দীর্ঘকায় যুবকটির গডফাদার। গডফাদার মানুষটির কানের পাশে পাকা জুলফি, মাথার সামনের দিকটা কেশবিরল। সোনালি ফ্রেমের চশমার পিছনে দুটি উজ্জ্বল চোখ তার ভাঙাচোরা মুখ আর কপালের বলিরেখাকে ছাপিয়ে উঠেছে।
জিহাদী নেতা আবু ফয়জল বলতে শুরু করলেন, “আমার জিহাদী যোদ্ধারা, ২০১৮ সালের পর থেকে আমরা সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছি। এখন এই মধ্যপূর্ব সিরিয়ার বাঘুজ আর দক্ষিণের সামান্য কিছু প্রদেশ ছাড়া আমরা সিরিয়ার বেশিরভাগ জায়গায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। দামাস্কাস, আলেপ্পো আমাদের হাত থেকে চলে গেছে। আমাদের দুর্জয় ঘাঁটি রাক্কাও এখন হাতছাড়া হওয়ার মুখে। তাই আমাকে রাক্কা ছেড়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে কুর্দিশ ফৌজ আমাদের বাঘুজ থেকে আশি কিলোমিটার দূরের গ্রামে ঢুকে পড়েছে। পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউএস নেভি সিলস গতমাসেই উত্তর সিরিয়ার ইদলিবে আল-কায়দা ঘনিষ্ঠ হুরসা আল-দিনের যোদ্ধাদের ওপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করেছে। এদিকে সরকারবিরোধী সিরিয়ার মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদল ‘আল-জায়েস আস-সুরি আল-হুর’-এর সঙ্গে আল-আসাদ সরকারের সন্ধি করিয়ে যুদ্ধাবসানের জন্য দালালি করছে রাশিয়া। এই সন্ধি প্রস্তাব কার্যকর হলে আইসিস সিরিয়ার মাটিতে আরও জমি হারাবে। দেশে প্রাথমিকভাবে শান্তি ফিরে এলে তখন আল-আসাদ সরকারের আক্রমণের মুখ আমাদের দিকে ঘুরে যাবে। তখন অতীতের তিক্ততা ভুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হয়তো সিরিয়া সরকারের সঙ্গে একজোট হয়ে দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ উৎখাত করতে আমাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালাবে। যেভাবেই হোক রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আল-আসাদ সরকার আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সন্ধিপ্রস্তাব আমাদের ভন্ডুল করতে হবে।”
শেষ কথাগুলো বলে আবু ফয়জল তাজিকিস্তানের নেতা গুলমাহের খালিমভের দিকে তাকালেন।
“তা কোনওদিন হতে দেব না,” আবু ফয়জলকে আশ্বস্ত করে গুলমাহের খালিমভ বললেন, “আজ আমাদের মধ্যে মহান প্রফেসর আছেন, আর আছে এই বিজ্ঞানী যুবক। এক অভূতপূর্ব গবেষণার ফলাফলের জোরে আইসিস গোটা পৃথিবীর বুকে অজেয় হয়ে উঠবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আমাদের প্রতিটি যোদ্ধা হয়ে উঠবে অজেয়, অবিনশ্বর।”
আইসিসের নেতৃত্বে থাকা মানুষগুলি সহ ছোট ঘরটার ভেতর এই মুহূর্তে জনা পঁচিশেক লোক বসে আছে। প্রবল বিস্ময়ে সবার মুখ থেকে চাপা আর্তনাদের মতো শব্দ বেরিয়ে এল।
খালিমভ বললেন, “এটা খোয়াব নয়। সত্যি আগামী দু-বছরের মধ্যে আইসিস অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। হে আমার প্রিয় জিহাদী যোদ্ধারা, আজকের মতো এই সভা এখানেই শেষ করছি। এরপর প্রফেসর আর এই তরুণ বিজ্ঞানীর সঙ্গে আমরা সায়েন্টিফিক প্রজেক্ট নিয়ে বৈঠক করব।”
খানিকক্ষণের মধ্যেই জিহাদি যোদ্ধারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এখন ঘরে চারজন মাত্র মানুষ। আবু ফয়জল, গুলমাহের খালিমভ, দীর্ঘকায় সেই যুবক ও সবার প্রিয়, সবার শ্রদ্ধার মানুষটি— প্রফেসর।
প্রফেসরের মুখখানি আজ নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। আজ তিনি এক অসাধারণ গবেষণালব্ধ ফলের জোরে ঈশ্বর হয়ে উঠবেন। হয়তো ঈশ্বরের থেকেও বড় হয়ে উঠবেন! ঈশ্বর তো কেবল প্রাণ সৃষ্টি করেন, কিন্তু এই পৃথিবীর বুকে সেই প্রাণের লালনপালন প্রকৃতি করে। নশ্বর মানুষের দেহের বিনাশেও তো ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ হাত নেই। আজ প্রফেসর যে শক্তি লাভ করেছেন তা ঈশ্বর আর প্রকৃতির চেয়েও বড়। এ শক্তি ঈশ্বর আর প্রকৃতি উভয়ের থেকেই আহৃত।
এ অনন্ত শক্তি তিনি চৌর্যের মাধ্যমে আহরণ করেছেন। আর এ শক্তি তাকে এনে দিয়েছে তার সামনে বসা এই দীর্ঘদেহী যুবকটি। তিনি এই যুবকটির পিতৃতুল্য, তার জন্য ছেলেটি জীবনের কঠিনতম কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তিনি তার সন্তানতুল্য যুবকটির দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসলেন, স্নেহের হাতটি ছোঁয়ালেন তার মাথায়। ছেলেটির চোখেমুখে ফুটে উঠল কৃতজ্ঞতা।
প্রফেসর দেখলেন দুজন আইসিস নেতা তার দিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে। তারা জানতে চায় অবিনশ্বর আর অজেয় হওয়ার রহস্যটা কী?
প্রফেসর বলতে শুরু করলেন, “যে কোনও জীবই চরম আবহাওয়ায় বেঁচে থাকতে পারে না। আগ্নেয়গিরি বা উষ্ণপ্রস্রবণের উচ্চ তাপমাত্রায় যেমন বেশিরভাগ জীব বাঁচতে পারে না তেমনই অ্যান্টার্কটিকার মতো -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বা তীব্র লবণাক্ত হ্রদের জলেও জীবের বেঁচে থাকা অসম্ভব। তবে অসম্ভব বলেও কিছু নেই। কিছু আনুবীক্ষণীক জীব কিন্তু এমন চরমভাবাপন্ন পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। এদের বলা হয় এক্সট্রিমোফাইল। আর্কিব্যাকটিরিয়া বা জলভাল্লুকের মত কিছু চরমজীবী এখনও পৃথিবীতে আছে। তাহলে প্রশ্ন হল এদের কী আছে যা আমাদের মতো জীবদেহে নেই। কেনই বা ওরা পারে অথচ আমরা পারি না?”
সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে বাইরে, এক জিহাদী এসে ঘরের বাতিদানের সেঁজবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। গত কয়েকদিনের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বিদ্যুৎ পরিষেবা দেওয়ার কেন্দ্রগুলিও রক্ষা পায়নি।
“একই সঙ্গে দু’জায়গায় গবেষণা শুরু হল,” প্রফেসর ফের বলতে শুরু করলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণার জন্য প্রচুর ডলার খরচ করল ডারপা। ডঃ সিলভারের রিসার্চ টিমের সঙ্গে যুক্ত ছিল বেশ কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে কয়েকজন অচিরেই টের পেল ‘প্রজেক্ট ইনডেস্ট্রাকটিবল’ মোটেই সঠিক পথে এগোচ্ছে না। অথচ আমেরিকারই এক মেধাবী বিজ্ঞানী যে গবেষণার কাজটা সঠিকপথে নিয়ে যাচ্ছেন তা তারা খবর পেল। এই বিজ্ঞানীর নাম ডঃ বেদ পিল্লাই। কিন্তু বিজ্ঞানীটি তার আবিষ্কারকে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ডারপা-র হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করল। এই আবিষ্কারকে যদি ডারপা-র হাতে তুলে দেন, তবে তা যে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। ভারতীয় বিজ্ঞানী বেদ পিল্লাই তখন ভারতে ফিরে এলেন। এনসিএওআর-এর অধীনে ভারতের অ্যান্টার্কটিক রিসার্চ প্রজেক্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন। কিন্তু তিনি তার ড্রিম প্রজেক্ট সঞ্জীবনী-র জন্য নিজেই উপযুক্ত সহকারী রিক্রুট করা শুরু করল। সেই সুযোগে কিছু বেনোজল ঢুকে পড়ল।
“তাদেরই একজনের সূত্র ধরেই ডঃ পিল্লাইয়ে প্রজেক্ট সঞ্জীবনীর অন্তিম ফল যা প্রকৃতপক্ষে সঞ্জীবনী সুধা চলে এসেছে আমার হাতে। চরমজীবী আর্কিব্যাকটিরিয়ার জিনের সঙ্গে ইউক্যারিওট জিনের বেশ কিছু অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। সাধারণত আনুবীক্ষনিক প্রোক্যারিওট ব্যাকটিরিয়া যারা চরমজীবী নয় অথচ জল, স্থল, অন্তরীক্ষ সব জায়গায় যারা বিরাজ করে এবং যা আমাদের শরীরে সংক্রমণ থেকে শুরু করে উপকারও করে, তাদের সঙ্গে আমাদের মতো ইউক্যারিওট জিনের তেমন কোনও মিল নেই। বিজ্ঞানীদের ধারণা, অভিব্যক্তিবাদের কোনও পর্যায়ে আর্কিব্যাকটিরিয়ার সঙ্গে ইউব্যাকটেরিয়ার ফিউশনের ফলে নিউক্লিয়ার পর্দাবিশিষ্ট আধুনিক ইউক্যারিওট কোষের সৃষ্টি। আমাদের দেহকোষও ইউক্যারিওট। তা সত্ত্বেও অদ্ভুতভাবে লক্ষ করা গেছে আর্কিয়ার জিন ও ইউক্যারিওট জিনের বেশ কিছু মিল আছে, মিল আছে কিছু বিপাকীয় ক্রিয়ায়। বিশেষত দুক্ষেত্রের ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রান্সলেশনে প্রয়োজনীয় উৎসেচকের।” প্রফেসর বলে চললেন।
ইতিমধ্যে একজন লোক এসে রূপোর রেকাবিতে ফাওয়াকে মুজাফ্ফা রেখে গেল। এগুলো সুস্বাদু শুকনো আরবী ফল।
লোকটির চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফের প্রফেসর বলতে শুরু করলেন, “ডঃ পিল্লাইকে আমি আমেরিকা থাকাকালীনই চিনতাম। হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট নিয়ে দীর্ঘ বারো বছর উনি দারুণ কাজ করেছিলেন। ট্রান্সজেনিক্স নিয়ে উনি কাজ করেছিলেন। ট্রান্সজেনিক্স হল একটি জীবের জিনের অংশ অন্য জীবের কোষে প্রতিস্থাপন করা। ডঃ পিল্লাই চরমজীবী টার্ডেগ্রেড গোত্রের জীব জলভাল্লুকের কোষে চরমআবহাওয়া সহ্য করার জন্য দায়ী একটি জিন খুঁজে পেলেন। এটির নাম dsup জিন। এই জিনের এর অংশটি তিনি মানুষের ইউক্যারিওট কোষের জিনে ইন ভিট্রো পদ্ধতিতে প্রবেশ করিয়ে দেখলেন মানবকোষটি রঞ্জন-রশ্মি প্রতিরোধক ক্ষমতা পেয়েছে। অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ এক্স-রে dsup জিনযুক্ত মানবকোষে আপতিত করলেও কোষটি নষ্ট হয় না।
এর পিছনের কারণ এই জিন যে প্রোটিন তৈরি করে তা জলভাল্লুকের কোষের নিউক্লিক অ্যাসিডকে একটা সুরক্ষা বলয় দেয়। তবে এই পরীক্ষাটি আরও কয়েকজন বৈজ্ঞানিকও করলেন। এই পদ্ধতি থেকে ডঃ পিল্লাই সরে এলেন কারণ উনি বুঝেছিলেন এই পদ্ধতিতে কোনও মানবকে চরমজীবী করে তোলা সম্ভব নয়। সেটা করতে গেলে সেই মানুষের লক্ষ কোটি কোষে একই পদ্ধতিতে জিন প্রাতিস্থাপিত করতে হবে, যেটা অসম্ভবই শুধু নয় অবাস্তবও। যদিও মায়ের শরীরে সদ্য তৈরি হওয়া ভ্রূণের অল্প সংখ্যক কোষে এটা করা সম্ভব। সন্তানটি রঞ্জনরশ্মি প্রতিরোধক ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে। এগুলো CRISPR Cas-9 জিন এডিটিং পদ্ধতিতে করা যায়। আর ডঃ পিল্লাই ছিলেন তার মাস্টার। তিনি নতুন ভাবনা চিন্তা শুরু করলেন। তিনি জলভাল্লুক ছেড়ে আর্কিব্যাকটিরিয়ায় পুনরায় মনোনিবেশ করলেন। তিনি এবার সরাসরি আর্কিয়া-দের কোষের প্রোটিনগুলো ঘেঁটে দেখতে শুরু করলেন। বিশেষত যে প্রোটিনগুলো আর্কিয়াদের চরমজীবী ও অজেয় করে তুলেছে। সাধারণত মানব শরীরের প্রোটিনগুলি ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু এর বাইরে আরও দুই ধরণের দুষ্প্রাপ্য অ্যামাইনো অ্যাসিড আবিষ্কৃত হয়েছে— ২১তম অ্যামাইনো অ্যাসিড পাইরোলাইসিন এবং ২২তম অ্যামাইনো অ্যাসিড সেলেনোসিস্টেইন। মানুষের দেহে প্রায় ২৫,০০০ জিন আছে তার মধ্যে ২০,০০০ জিন প্রোটিন কোডিং করে। হিসেব মতো আনুমানিক বিশ লক্ষের বেশি প্রোটিন আছে মানব শরীরে। তবে তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত মানব শরীরে মাত্র ৫৪টি প্রোটিন পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ওই ২১তম ও ২২তম অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে। অথচ আর্কিব্যাকটিরিয়ার কোষে এই দুই অ্যামাইনো অ্যাসিডবিশিষ্ট প্রোটিনই বেশি। অর্থাৎ, মানেটা যা দাঁড়াচ্ছে তা হল, এই ধরণের প্রোটিনই আর্কিয়া-দের চরমজীবী করে তুলেছে। এখন ডঃ পিল্লাই এই বিশেষ ধরণের পাঁচটি প্রোটিনকে আইসোলেট করেছেন। আমরা জানি ডিএনএ ট্রান্সক্রিপশন করে আরএনএ তৈরি হয়। আবার এই আরএনএ ট্রান্সলেশন করলে অ্যামাইনো অ্যাসিড জুড়ে জুড়ে প্রোটিন হয়। এই ফরোয়ার্ড রুট না নিয়ে উনি পিছনের পথ ধরলেন। অর্থাৎ বেছে নেওয়া পাঁচটি প্রোটিনের অ্যামাইনো অ্যাসিড দেখে তিনি আরএনএ সিকোয়েন্স পেলেন আবার সেখান থেকে পিছনে গিয়ে ডিএনএ সিকোয়েন্স পেলেন। ব্যাস, ডঃ পিল্লাইয়ের সঞ্জীবনী সুধার নকশা এখন আমাদের পকেটে। সেই নকশা থেকে এখন আমরা ইন ভিট্রো প্রোটিন সংশ্লেষ করে এমন তিন ধরণের প্রোটিন পেয়ে যাব যা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করালে আমরা চরমজীবী মানুষ পেয়ে যাব।”
ঘরের ভিতর উপস্থিত বাকি তিনজন রুদ্ধবাক হয়ে প্রফেসরের কথা শুনছিলেন। এ যেন এক ভয়ংকর রূপকথার গল্প শোনাচ্ছেন প্রফেসর। আবু ফয়জলের মুখ দিয়ে অস্ফুটে এক বিস্ময়ের শব্দ বেরিয়ে এল—‘ইনশাল্লাহ্!’
খালিমভ বললেন, “এবার আমরা এক অবিনশ্বর জিহাদী যোদ্ধার দল তৈরি করব। সারা দুনিয়া আইসিসের হাতের মুঠোয় হবে। দুনিয়া জুড়ে বিরাজ করবে একটাই ধর্ম—ইসলাম!”
“অবিনশ্বর হবে কি না জানি না। তবে আমার ধারণা সে মানব যেমন ৬০-৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেঁচে থাকবে দীর্ঘদিন তেমনই -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও স্বল্প পোশাকে দিব্যি থাকতে পারবে। যুদ্ধে চোট-আঘাতে সহজে মরবে না, কাবুও হবে না। বরফ আর মরুভূমির মধ্যে হাঁটতে পারবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শারীরিক সক্ষমতা আর সহ্যশক্তি অনেক গুণ বেড়ে যাবে। তবে একটা সমস্যা আছে?”
“সমস্যা?” দীর্ঘকায় যুবক তার গডফাদারের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
“হ্যাঁ। এই আর্কিব্যাকটিরিয়াল প্রোটিনগুলো মানবদেহে প্রবেশ করার পর এর ইমিউনোলজিক্যাল রেসপন্স কী হবে? শরীরে কোনও অ্যান্টিবডি তৈরি করবে কি না অথবা কোনও অ্যানাফাইলেকটিক শক্ তৈরি করবে কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য হিউম্যান সাবজেক্ট দরকার। এর জন্য প্রথমে কাউকে ভলান্টিয়ার হতে হবে, যার ওপর পরীক্ষা করে দেখব,” প্রফেসর তার ঈষৎ বাঁকানো নাকের ডগার চশমাটা হাত দিয়ে ঠিক করে বললেন। মুহূর্তের জন্য তার উজ্জ্বল চোখদুটিতে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল।
“প্রফেসর, আমি স্বেচ্ছায় এই পরীক্ষার হিউম্যান সাবজেক্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত। আপনি আমাকে অনুমতি দিন।”
“মুবারক, মুবারক।” পাশ থেকে আবু ফয়জল আর গুলমাহের খালিমভ সমস্বরে বলে উঠলেন
প্রফেসর এগিয়ে এসে সস্নেহে তার ডানহাতটি যুবকের কাঁধের ওপর রেখে ঝরঝরে বাংলায় আবৃত্তি করতে শুরু করলেন— “বল বীর/ বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারই নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির…”
। । ১০ । ।
“স্যার, একটা ফেভার চাই,” ইরিডিয়াম স্যাটেলাইট ফোনসেটটা কানে লাগিয়ে মনন শীল বলল।
“বলো, মনন, কী ফেভার চাই,” ফোনের ওপাশ থেকে মিনিস্ট্রি অফ আর্থ সায়েন্সের সচিব বললেন।
তিনজনের হটলাইন নম্বর মননের স্যাটেলাইট ফোনে সেভ করা আছে। এনআইএ-র ডিজি সাহেব, দপ্তরের সচিব আর ডঃ গিলের।
“স্যার, সাতদিনের জন্য আমাকে কেপ টাউন যেতে হবে। সাউথ আফ্রিকার ভিসাটার ব্যবস্থা করুন। পরের সপ্তাহে নোভোলাজারেভস্কায়া থেকে ক্যানডিড বিমানটা কেপ টাউন যাবে তার আগেই আমার সাউথ আফ্রিকার ভিসাটা ব্যবস্থা করুন।”
“ডান। তবে লিড কিছু পেলে কি?”
“হ্যাঁ স্যার, প্রায় গুটিয়ে এনেছি। প্রমাণ জোগাড় করতেই কেপ টাউন যাব। এখন রাখছি স্যার।” বলে মনন ফোনটা রেখে দিল।
মনন ঘুরে দরজার দিকে তাকাতেই দেখল নাওমি দাঁড়িয়ে। সে হেসে বলল, “মনন, আপনি আর সোধি তৈরি তো?”
“কীসের জন্য তৈরি?” বলেই মননের মনে পড়ল আজ নোভোলাজারেভস্কায়ার রাশিয়ান রিসার্চ স্টেশনে ওদের সবার বোলিং গেম পার্টি আছে। নর্ম্যাল টেন ফ্রেম বোলিং গেম হবে। তারপর সন্ধে সাতটায় ডিনার সেরে ওরা মৈত্রীতে ফিরবে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অ্যান্টার্কটিকায় গরমকালে তাপমাত্রা যখন হিমাঙ্কের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে তখন মৈত্রী আর রুশ স্টেশনের সদস্যরা নানা বিনোদনে মেতে থাকে। আরও মজার কথা, গরমকালের মাসগুলোয় সূর্য অস্ত যায় না। চব্বিশ ঘণ্টাই একটা আলো জড়িয়ে থাকে বরফে ঢাকা বিজন মহাদেশটাকে।
“সবাই তৈরি কিন্তু। জ্যোতিদিদি, ভুবন, ডঃ বদ্রীনাথ— সবাই আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মনে রাখবেন এটা কিন্তু ইন্ডিয়া বনাম রাশিয়ার বোলিং ম্যাচ। ইজ্জত কা সওয়াল।” বলে নাওমি হাসল। আজ মনন দেখল হাসলে নাওমির সুন্দর দুটো গজদাঁত ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
দশ মিনিটের মধ্যে ছ’জনের দলটা মৈত্রী থেকে টেরা বাসে চেপে নোভোলাজারেভস্কায়ার উদ্দেশে রওনা দিল। মিনিট পনেরোর মধ্যে ওরা গন্তব্যে পৌঁছে গেল। ওদের দেখে তাতিয়ানা, নাতাশা, ভাসিলিসারা কলকল করে ‘প্রিভেত’ আর ‘হাই’ বলতে বলতে এগিয়ে এল। ভ্যালেরি, বরিস, আনাতোলি, মিখাইলরাও এগিয়ে এসে মননদের সঙ্গে কেউ হ্যান্ডশেক করল, কেউ হাই-ফাইভ করল।
ওরা সবাই মিলে কথা বলতে বলতে বোলিং অ্যালেটায় এল। প্রায় একশো ফুট লম্বা জিমনাশিয়াম, তার মধ্যে ষাট ফুটের বোলিং লেন। এক ধারে একটা বার কাউন্টার। সবার জন্য মকটেল রাখা আছে। মনন লক্ষ করল, নাতাশা আর নাওমি মকটেলের গ্লাস হাতে একদিকে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এই দুটি মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব যেন একটু বেশি। অন্যদিকে তাতিয়ানা, ভাসিলিসাদের সঙ্গে জ্যোতি সোশ্যালাইজ করছে। তবে মাঝেমধ্যে সে আড়চোখে নাতাশা আর নাওমিকে দেখছে। এদিকে সোধি আর মিখাইল বোলিং ম্যাচটা শুরু করল। সোধি ওর প্রথম রাউন্ডে ‘স্পেয়ার’ করল অর্থাৎ দু-চান্সেই দশটা পিন ফেলে দিল। মিখাইল কিন্তু দু-চান্স মিলিয়েও স্প্লিট করল। মনন দেখল মিখাইলের দু-বার সুযোগের পরও শেষ সারির দুটো পিন পড়েনি, খাড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মননের চোখ বারবার মেয়েগুলোর দিকে চলে যাচ্ছিল কারণ তার একটা অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছিল, বারবার মনে হচ্ছিল নাতাশা আর জ্যোতি যেন একে অপরকে অপছন্দ করে। হঠাৎ তার চোখের সামনে ডঃ পিল্লাইয়ের মেমরি কার্ডের গ্রুপ ফটোটা ভেসে উঠল। তার স্পষ্ট মনে পড়ল ছবিটায় সবাই সবার কাঁধে হাত রেখে অথবা একে অপরের হাত ধরে ফটো তুলেছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল এরা দুজনে, নাতাশা আর জ্যোতি সেদিন পাশাপাশি দাঁড়ালেও দুজনের মধ্যে অনেকটা ফাঁক ছিল।
হঠাৎ প্রচন্ড হাততালির শব্দে মনন চমকে উঠল। সোধি আর মিখাইলের প্রথম রাউন্ড শেষ হওয়ার পর বদ্রীনাথ আর বরিস তাদের খেলা শুরু করেছিল। বদ্রীনাথ সোধির মতোই স্পেয়ার করল কিন্তু তারপরেই বরিস বল ছুঁড়ে ‘স্ট্রাইক’ করে দশটা পিনই প্রথম চান্সে ফেলে দিল।
এরপর মনন আর আনাতোলি খেলতে গেল। এখানকার কেউই জানে না কলকাতায় পোস্টিং থাকার সময় মনন নিকো পার্কের সুপার বোল আর সেক্টর ফোরের বোলার্স ডেন-এ নিয়মিত খেলত। পরপর সাতবার ‘স্ট্রাইক’ করার রেকর্ড আছে তার। প্রথম চান্সে আনাতোলি ছ’টা পিন ফেলল, কিন্তু দ্বিতীয় চান্সে বাকি চারটে পিন ফেলে সে ‘স্পেয়ার’ করল। আনাতোলির পর মনন এসে প্রথম চান্সেই দশটা পিন ফেলে স্ট্রাইক করল। ভুবন আর বদ্রীনাথ এগিয়ে এসে ওর সঙ্গে হাই ফাইভ করল।
নিজের জায়গায় ফিরে এল মনন। ফের তার সন্ধানী চোখ ঘরের চারদিকে ঘুরতে লাগল। দেখল জ্যোতি এক পাশে একা দাঁড়িয়ে আছে। জিমনাসিয়ামের ভেতরের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এখানে ইনডোরে সব জায়গার তাপমাত্রাই ২৬ ডিগ্রি করা থাকে। মেয়েরা বেশিরভাগই গায়ের জ্যাকেট খুলে রেখেছে। নাওমি আর নাতাশা দুজনেই জিনস আর টপ পরে আছে। জ্যোতি রঙ্গরাজন আজ একটা গোলাপি ম্যাক্সি বল গাউন পরে এসেছে। ওপরে আলতো করে জড়ানো মিংক জ্যাকেট।
“বার্কলে থেকে হার্ভার্ড চলে এসেছিলেন কেন ম্যাডাম?” মনন জ্যোতি রঙ্গরাজনের খুব কাছে এসে বলল।
জ্যোতি মননের দিকে চমকে তাকায়, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “অ্যাকচুয়ালি, আমি ১.৫ জেনারেশন মার্কিন, খুব ছোটবেলায়, তখন আমার দশ এগারো বছর বয়স, ভারত ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসি। আমার বাবা বড় কর্পোরেট ফার্মে চাকরি করতেন, ট্রান্সফারেবল জব। বার্কলে-তে আমার রিসার্চ শুরু করার বছরখানেক পেরোতে-না পেরোতেই আবার বাবা ম্যাসাচুসেটসে বদলি হয়ে যান। অগত্যা আমাকেও…”
“নাওমি মেয়েটা কিন্তু বেশ ভালো, খুব হাসিখুশি, তাই না?” মনন কথাটা বলে আড়চোখে জ্যোতিকে দেখল।
“বাট ভেরি ইমম্যাচিওর আর বোকা।” কথাটা বলার সময় জ্যোতির ঠোঁটের কোণে একটা বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল, “কুড ইউ প্লিজ ব্রিং মি অ্যানাদার মকটেল, মিঃ শীল?”
মনন বার কাউন্টার থেকে একটা মকটেলের গ্লাস এনে জ্যোতির হাতে দিল।
“বাট, ম্যাডাম, আই মাস্ট সে, শি হ্যাজ গট আ হার্ট অফ গোল্ড,” মনন বলল।
মকটেলের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে জ্যোতি আবেগহীন গলায় বলল, “ইয়েস, বাট অল দ্যাট গ্লিটার্স আর নট গোল্ড।”
হঠাৎ বোলিং অ্যালের ভেতর উপস্থিত সবাই উল্লাস করে উঠল। মনন অন্যমনস্ক ছিল, তার সম্বিত ফিরতেই সে দেখল বরিস নামের ছেলেটা পরপর তিনবার ‘স্ট্রাইক’ করায় একটা কমপ্লিট ‘টার্কি’ হয়েছে। রাশিয়ানদের সবাই তাই ওকে ঘিরে উল্লাস করছে।
সেদিকে তাকিয়ে মনন আবেগহীন গলায় বলল, “বাট, ম্যাডাম, সামটাইমস পিপল স্ট্রাইক গোল্ড!”
। । ১১ । ।
নেলসন ম্যান্ডেলা বুলেভার্ড থেকে সার্ল স্ট্রিটে ঢুকে দোকানটা পড়ে। এটাই কেপ টাউনের উডস্টক সাবার্বে নিকনের একমাত্র সার্ভিসিং সেন্টার। ভারতীয় হাইকমিশন থেকে এখানে আগেই যোগাযোগ করে মননের আসার কথা জানানো রয়েছে।
নিকনের দোকানটা খোলে ঠিক সকাল সাড়ে আটটায়। গতকাল সন্ধেবেলা যখন মনন শারম্যাকার ওয়েসিস থেকে কেপ টাউনে এসে পৌঁছেছিল তখন দোকানটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই আজ সকালে উঠেই একটা ক্যাব নিয়ে সার্ল স্ট্রিটে একটু আগেই পৌঁছে গেছে। উডস্টক জায়গাটা কেপটাউন শহরের বাইরের দিকে একটা ছোট মফস্বল।
এখানে রাস্তার ধারে ধারে স্টিট ফুডের ছোটবড় দোকান। হোটেল থেকে কিছু খেয়ে আসেনি বলে মনন রাস্তার ধারে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকে একপ্লেট বানি চাউ আর ভেটককের প্লেট নিল, সঙ্গে একটা ডায়েট কোক। আপাতত এই জ্বালানিতে বিকেল পর্যন্ত চলে যাবে। সারাদিন আজ অনেক কাজ।
রেস্তোরাঁর কাচ জানলা দিয়ে উল্টোদিকে নিকনের সার্ভিসিং সেন্টারটা নজরে পড়ছে। ঠিক সাড়ে আটটা নাগাদ একজন মাঝবয়সী সাদা-চামড়ার দক্ষিণ-আফ্রিকান লোক এসে নিকনের দোকানের দোকানটা খুলল। তার সঙ্গে একজন ভারতীয়, সম্ভবত গুজরাতি, অন্যজন স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ যুবক দোকানে ঢুকে পড়ল। ওদের দেখে খাবারের বিল মিটিয়ে মনন চলে এল।
কাউন্টারে মাঝবয়সী দক্ষিণ-আফ্রিকান ভদ্রলোক বসে। মনন সামনে গিয়ে ওর পরিচয় দিতেই ভদ্রলোক টেবিলের পাশে রাখা কম্পিউটারে জি-মেল খুলে তার ই-মেল চেক করল। মনন পাশ থেকে দেখল দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় হাই-কমিশনের অফিস থেকে ই-মেলটা এসেছে। ই-মেলে ভারত সরকারের তরফ থেকে অ্যান্টার্কটিকায় কর্মরত মননের কাজটির জন্য সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
ভদ্রলোক মুচকি হাসলেন। নিকন সার্ভিসিং সেন্টারের মালিক এই ভদ্রলোক হেঁড়ে গলায় ‘দীপেশ’ বলে ডাক পাড়তেই ভেতর থেকে ভারতীয় লোকটি হাজির হল। লোকটির নাম দীপেশ শাহ। মনন বুঝল তার কাজটি এই লোকটাই করবে।
“কেম ছো?” বলে হাসল মনন। দীপেশ হেসে জবাব দিল, “সারু ছে। প্লিজ, কাম উইথ মি।”
একটা কম্পিউটারের স্লটে মননের আনা মেমরি কার্ড দুটো ঢুকিয়ে দীপেশ ইমেজের ফোল্ডারগুলো ওপেন করল। পাশ থেকে মনন তারিখ অনুযায়ী ইমেজগুলো ফের দেখতে শুরু করল। ২৩ আগস্টের ইমেজের পর যথারীতি আর কোনও ইমেজ নেই। মনন দীপেশের দিকে তাকিয়ে বলল, “কোনও ডিলিটেড ইমেজ আছে কি না বোঝা কি সম্ভব, অথবা রিট্রিভ করা যাবে?”
“সম্ভব,” দীপেশ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল। “কী ধরণের ইমেজ?”
“সেটা ঠিক জানি না। স্টিল ফটো হতে পারে, আবার ভিডিও ছবিও হতে পারে।” মনন অনিশ্চিত গলায় বলল। তার স্থির বিশ্বাস ডঃ পিল্লাই যখন ২৭ আগস্ট রাতে ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন এবং সেই রাতে যখন আকাশে অরোরা অস্ট্রালিস দেখা গিয়েছিল তখন তিনি ছবি নিশ্চয়ই তুলেছিলেন।
“নিকন ডি-৫৬০০ ভালো ক্যামেরা। এসডি কার্ড কোরাপ্ট যদি না হয় তাহলে ডিলিটেড ছবি ফেরত পেতে পারেন, তবে এই কার্ড ব্যবহার করে ক্যামেরায় পরে আর কোনও ছবি তোলেননি তো? কার্ডে ডিলিটেড ছবির ব্ল্যাঙ্ক স্পেসে নতুন ইমেজ রি-রাইট হলে পুরোনো ছবিটা পাবেন না,” দীপেশ বলল।
“না, এই কার্ডে তার পরে আর কোনও ছবি তোলা হয়নি।” মনন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল।
দীপেশের কম্পিউটারের কার্ড রিডার দিয়ে মেমরি কার্ডটা পড়তে শুরু করল। এবার দীপেশ ফটো রিকভারি সফটওয়্যার নামে একটা অ্যাপ লঞ্চ করল। সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার স্ক্রিনে অনেক ধরণের ইমেজ ফাইল ফুটে উঠল—JPG, NEFও MPEG ফাইল!
“JPG আর NEF হল স্টিল ছবির ফাইল। MPEG-গুলো ভিডিও ফাইলস। আরে, দাঁড়ান, ফটো রিকভারি সফটওয়্যার ইন্টারফেসে একটা নতুন এক-দেড় মিনিটের ভিডিও ফাইল উদ্ধার করেছে। দেখুন তো, এটা কি না?” দীপেশ কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করে বলল।
মনন কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা ভিডিও চলতে শুরু করেছে। অ্যান্টার্কটিকার এক মায়াবী রাত। আকাশ জুড়ে এক স্বর্গীয় সবজে রঙের আলো নেচে বেড়াচ্ছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ডঃ পিল্লাইকে দেখা যাচ্ছে না কারণ এ ছবি তিনিই তুলেছেন, তবে ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তোলা ভিডিওটা দেখে জায়গাটা স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে, এখানেই ডঃ পিল্লাইয়ের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। তবে ব্যাকগ্রাউন্ডে ডঃ পিল্লাইয়ের মৃদু কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে—“সি, অনুষ্কা বেটা, হোয়াট আ বিউটিফুল সাইট। কুদরত কা করিশ্মা!”
মনন হাঁ করে ভিডিওর দৃশ্যটা দেখছে। ছবিতে রাতের ধূ ধূ বরফের প্রান্তরের ওপর আকাশে রেশমের চাঁদোয়ার মতো দুলছে অরোরা অস্ট্রালিস! আচমকা ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে এক দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি বরফের প্রান্তর ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে।
মনন বলল, “পজ।”
দীপেশ ছবিটা পজ করতেই মনন বলল, “ক্যান ইউ জুম ইট?”
দীপেশ জুম করল ছবিটা। ছবিটার দিকে তাকিয়ে মননের ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল। তার মনের মধ্যে দিনকয়েক আগের একটা ছবি ভেসে উঠল। একটি প্রেমদীপ্ত যুগলের অন্তরঙ্গ দৃশ্য। সেদিন নিজের জন্মদিনের পার্টির ফাঁদ পেতেছিল মনন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে মনন হাসিহাসি মুখে বলল, “থ্যাঙ্কস আ লট দীপেশজী। মেরি তরফ সে আপকে লিয়ে ঢাই কিলো ঢোকলা ভেজ দুঙ্গা।”
। । ১২ । ।
“নাতাশা আমাকে বারবার বলছে রাশিয়ান হাইড্রোমিটিওরোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মনিটরিং দপ্তরে ওর পাঠানো মেসেজগুলো বারবার কেউ ইন্টারসেপ্ট করছে। ওর কম্পিউটার থেকে গবেষণাসংক্রান্ত বেশ কিছু ফাইলও লোপাট হয়ে যাচ্ছে। ও কাকে সন্দেহ করবে বুঝতে পারছে না। এখানে যারা কাজ করছে তাদের অনেকেই ওর বন্ধু— আনাতোলি, ইগর, বরিস, মিখাইল। ভ্যালেরিকে অবশ্য ও আগে চিনত না,” নাওমি খুব চিন্তিত মুখ করে বলল, “মনন, আয়াম সরি, আমি বাধ্য হয়ে নাতাশাকে জানিয়েছি… ইয়ে মানে… সোধি আর আপনি… ইউ পিপল আর স্লুথ!”
সোধি আঁতকে উঠে বলল, “আরে ম্যাডাম, আপ তো হমে মারওয়া দিয়া!”
“ইটস ওকে,” মনন চিন্তিত মুখে বলল, “নাতাশা আপনার সঙ্গে এসেছে?”
“হ্যাঁ, ল্যাবের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।”
মিনিট দুয়েকের মধ্যে নাতাশা এসে হাজির হল। মেয়েটাকে দেখে মননের মনে হল বেশ ঘাবড়ে আছে। ওর গাল আর নাকের ডগাটা উত্তেজনায় বেশ লাল হয়ে আছে। সে মননকে দেখে বলল, “প্রিভেত। আমি আপনার সম্বন্ধে নাওমির কাছে সব শুনেছি, আপনি ডঃ পিল্লাইয়ের মার্ডারের কেসটা সলভ করতে এসেছেন। আপনি আমাকে বাঁচান। আই ফিল লাইক সামওয়ান ইজ অলওয়েজ স্টকিং মী।”
“আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে হেল্প করব। আগে ঘটনাটা খুলে বলুন।”
জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে নাতাশা মননের দিকে এগিয়ে দিল। কাগজটার ওপর ইংরেজি ব্লক লেটারে লেখা—‘হোয়েন দ্য হুইসল ব্লোওজ থ্রি টাইমস, ইট উইল অ্যানাউন্স দ্যাট ইউ উইল বি ডেড অ্যান্ড গন।’
চিরকুটটা দেখে সে আপনমনে মাথা নেড়ে বলল, “শব্দবন্ধটা বড় অদ্ভুত তো! তিনবার হুইসলের শব্দ শুনলে বুঝতে হবে তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে!”
“এর মানে কী? কোথায় পেয়েছেন এটা?” মনন খুব চিন্তিত মুখে বলল।
আমার ল্যাবের ড্রয়ারে। আজ সকাল আটটায় ল্যাবে ঢুকে ড্রয়ার খুলে দেখি এই চিরকুটটা।
“আপনাকে কেউ খুন করার চেষ্টা করছে বলছেন?” মনন বলল, “কিন্তু কে আপনাকে খুন করতে চাইবে? আর কেনই বা চাইবে? আপনার কোনও কাজে অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? একটু খুলে বলুন।”
নাতাশার মুখটা থমথমে। সে বলল, “কয়েকদিন আগে রাশিয়ান হাইড্রোমিটিওরোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মনিটরিং দপ্তর থেকে আমাকে জানাল রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস নাকি জানিয়েছে যে আমার ইনমারস্যাট ফোনটা ট্যাপ হচ্ছে। জানি এটা অসম্ভব, কিন্তু তবু ওরা এটাই বলছে।”
“স্যাটেলাইট ফোন ট্যাপ হওয়ার ঘটনা শুনতে অবাস্তব মনে হলেও অসম্ভব নয়। স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল ডাউন-লিংক দিয়ে পৃথিবীর কোনও গ্রাউন্ড স্টেশনে আসে। যদি কেউ স্যাটেলাইটের নানা রকমের তথ্য যেমন কম্পাঙ্ক, মড্যুলেশনের ধরণ, এনক্রিপশন করার পদ্ধতি জেনে নিয়ে নির্ধারিত গ্রাউন্ড স্টেশনের খুব কাছাকাছি কোনও গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করতে পারে তবে স্যাটেলাইট ফোনও ট্যাপ করা সম্ভব। কিন্তু, নাতাশা, আপনার স্যাটফোন কেন কেউ ট্যাপ করবে? এখানে তো অনেকেই আপনার পূর্ব পরিচিত।”
তাতিয়ানা, বরিস, মিখাইল, আনাতোলি, আমি—আমরা সবাই বার্কলি ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছিলাম। একমাত্র ইগর, ভ্যালেরি আর ভাসিলিসা সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছিল। আমরা অবশ্য সবাই পরস্পরকে কলেজজীবন থেকে চিনতাম। সবাই আন্ডার গ্র্যাজুয়েট মস্কো থেকেই পাস করে তারপর কয়েকজন জিআরই পরীক্ষা দিয়ে মার্কিন দেশে চলে গিয়েছিলাম।”
মনন নাতাশার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। আচমকা সে প্রশ্ন করল, “নাতাশা, আপনি কি জ্যোতি রঙ্গরাজনকে আগে থেকে চিনতেন? মানে ইউএসএ থাকার সময় থেকে?”
চমকে তাকাল নাতাশা, খানিক চুপ করে থাকল। তারপর কপালের ওপর পড়ে থাকা কয়েক গাছি সোনালি চুল সরিয়ে কানের পিছনে গুঁজে বলল, “হ্যাঁ, জ্যোতি প্রথমে বার্কলিতে গবেষণা করত তারপর মাঝপথে হার্ভার্ডে চলে গিয়েছিল। তবে আমাদের মধ্যে একটা ব্যক্তিগত বিষয়ে সমস্যা হয়েছিল, সেটা একান্তই ব্যক্তিগত, তাই এখানে আলোচনা করতে চাই না।”
মনন চুপ করে গেল, বুঝতে পারল বিষয়টা স্পর্শকাতর। নাওমি এগিয়ে এসে বলল, “আজ সকালে চিরকুটটা পাওয়ার পর নাতাশা যখন নোভোলাজারেভস্কায়ার ল্যাব থেকে লাঞ্চের সময় ডাইনিং রুমে যাচ্ছিল তখন একবার তীব্র হুইসলের শব্দ শুনতে পেয়েছে। তখন থেকে শি ইজ স্কেয়ার্ড।”
মনন নাতাশার হাত থেকে চিরকুটটা নিল। তার বারবার মনে হচ্ছে শব্দবন্ধটা বড় চেনা। কোথাও কি সে এটা শুনেছে অথবা দেখেছে? নাকি তার মনের ভুল। বাইরে সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। গ্রীষ্মের দিনের ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে ফের হিমাঙ্কের তলায় চলে যাবে। মনন নাতাশার দুটি নীল চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল। মেয়েটা সত্যিই একটু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছে যেন।
“নাতাশা, আপনি আজ রাতটা মৈত্রীতে থেকে যান, আজ রাতে আপনি নোভোলাজারেভস্কায়াতে ফিরলে আপনার প্রাণের আশঙ্কা আছে। নাওমি উইল শেয়ার হার রুম উইথ ইউ।”
“তোমার কোনও ভয় নেই নাতাশা, আমরা আছি, উই উইল প্রোটেক্ট ইউ,” নাওমি অভয় দিয়ে বলে উঠল।
নাওমি তার সঙ্গে নাতাশাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সোধি বলল, “স্যারজি, হমারা কেস অভি তক সলভ নেহি হুয়া অউর আপ দুসরা মুসিবত উঠা লিয়া?”
মনন কেপ টাউন থেকে ফিরে সোধিকে বিশদে কিছু বলেনি, শুধু একবার বলেছিল, “সোধি, বক্সিং গ্লাভসদুটো কি একেবারে তুলে রেখেছ? অগর মুক্কেবাজি করনা হ্যায় তো কর পাওগে?”
সোধি হেসে বলেছিল, “কিসকো পিটাই করনা, স্যারজি?” মনন শুধু হেসেছিল, আর কিছু ভেঙে বলেনি।
রাত আটটা। অবশ্য ডিসেম্বরের গরমে অ্যান্টার্কটিকায় রাত বলে কিছু হয় না। মৈত্রী স্টেশনের বাইরে কার্গো কন্টেনারটার চুল্লিতে শৌচালয়ের কঠিন বর্জ্যপদার্থ পোড়ানো শুরু হয়েছে একটু আগে। উৎকট একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। আচমকা একটা হুইসেলের শব্দে মনন চমকে উঠল। সোধিও শব্দটা শুনেছে। নিজেদের ঘর থেকে দুজনেই দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এল। সলিড ওয়েস্ট কমবাস্টার মেশিনটার কাছে মেইনটেন্যান্সের সেই লোকদুটো ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ল না।
নাওমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, “মনন, আপনি শুনেছেন একটা তীব্র হুইসেলের শব্দ?”
মনন মাথা নেড়ে সায় দিল। সোধি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “নাতাশাজী কাঁহা হ্যায়?”
“আমার সঙ্গেই ছিল,” নাওমি বলল, “একটু আগে ‘আই নিড সাম ফ্রেশ এয়ার’ বলে প্রিয়দর্শিনী লেকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গেল। ও মাই গড! কিলার ওকে একা পেয়ে…”
মৈত্রীর ইউ-আকৃতির বিল্ডিংটার পিছনদিকে প্রিয়দর্শিনী হ্রদে যাওয়ার রাস্তা। নাওমি সেদিকে ছুটল, সোধিও ওর সঙ্গে এগিয়ে গেল। ওদের পিছন থেকে মনন অনুত্তেজিত কন্ঠে বলল, “অত চিন্তা করবেন না, রিল্যাক্স, চিরকুটে তিনবার হুইসেল বাজার কথা বলা হয়েছিল। এটা ছিল দ্বিতীয়বারের হুইসেল।”
“কী বলছেন আপনি! কিলার শুধু শিকারকে অরক্ষিত পেতে চায়। প্লিজ জলদি আসুন। এখন নাতাশার কিছু হলে আমি অপরাধবোধে ভুগব, আমিই ওকে স্তোকবাক্য শুনিয়েছিলাম।” এগিয়ে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে নাওমি বলল।
বেশি দূর যেতে হল না। প্রিয়দর্শিনী হ্রদের দিক থেকে প্রাণ ভয়ে ছুটতে ছুটতে নাতাশা এগিয়ে আসছিল। ওর চোখেমুখে ভয়ের ছায়া পড়েছে। নাওমিদের সামনে এসে প্রচন্ড হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “আমি আবার হুইসেলের শব্দ শুনতে পেয়েছি। আপনারা শোনেননি? নাওমি, আয়াম রিয়েলি স্কেয়ার্ড।”
“শব্দটা কোন দিক থেকে এসেছিল?” মনন জানতে চাইল।
“ঠিক বুঝতে পারিনি,” নাতাশার চোখেমুখে এখনও ভয় লেগে আছে, “মনে হল মৈত্রীর ডানদিকে ওই জায়গাটা থেকে।
মনন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল জায়গাটায় কয়েকটা কার্গো কন্টেনার জুড়ে দুটো বড় গ্যারেজের আকার দেওয়া হয়েছে। ওখানেই টেরা বাস, ফোর্ড ই-সিরিজ গাড়ি আর পিস্টেনবুলি-৬০০ গাড়িটা রাখা থাকে।
মনন সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। একটা মাইন্ডগেম শুরু হয়েছে। তবে সে নিশ্চিত তৃতীয় হুইসেলের আগে কোনও কিছু হবে না।
। । ১৩ । ।
মনন শীলের পুলিশ জীবন অদ্যাবধি সম্পূর্ণ নারীসঙ্গ বর্জিত হলেও তার সবসময়ের দুটি সঙ্গী রয়েছে। এদের সঙ্গ ছাড়া মনন এক মুহূর্তও কাটাতে পারে না। গ্লক-43 পিস্তল আর গার্বার নাইফ। শয়নে-জাগরণে দুটি অস্ত্রই তার খুব কাছেই রাখা থাকে।
গরমকালের সারারাত শারম্যাকার ওয়েসিসের আকাশে সূর্য জেগে থাকলেও মানব শরীরের ভেতর যে বায়োলজিক্যাল ক্লক থাকে তা এখানকার বাসিন্দাদের চোখে রাত হলে ঠিকই ঘুম এনে দেয়। রাত দুটোর সময় গোটা মৈত্রী স্টেশনের বাসিন্দারা ঘুমিয়ে পড়লেও মনন শীলের চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটা নেই। কেপ টাউনের সার্ল রোডে নিকনের সার্ভিসিং সেন্টার থেকে ডঃ পিল্লাইয়ের ডিলিটেড ভিডিও উদ্ধার করার পর মনন আরও একটি কাজে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় হাই কমিশনের সাহায্য নিয়েছিল। একটি বিশেষ মানুষের নামে ২৭ আগস্টের পর কেপ টাউন থেকে কোন কোন গন্তব্যে, কোন কোন তারিখে ফ্লাইট টিকিট কাটা হয়েছিল—সেই তথ্য উদ্ধার করতেও দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় হাই কমিশনার জয়দীপ সরকারের অফিস থেকে তাকে সাহায্য করা হয়েছিল।
রাত ঠিক আড়াইটে নাগাদ তৃতীয়বারের জন্য হুইসেলটা বেজে উঠল। মননের শরীরের স্নায়ুগুলো টানটান হয়ে উঠল, সে তার বালিশের তলা থেকে গ্লক পিস্তলটা নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। গার্বার ছুরিটাও বেঁধে নিল কোমরে। সোধিও বোধহয় ঘুমোয়নি আজ। সেও ফিসফিস করে পাশের বিছানা থেকে বলল, “স্যারজি আওয়াজ পিছে সে আ রহা হ্যায়, মতলব প্রিয়দর্শিনী লেক কি তরফ সে।”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুজনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাইরে তখন সূর্যের আলো থাকলেও কয়েক পরত মেঘ জমেছে। বিষণ্ণ গোধূলির মতো লাগছে আকাশটা। বাইরের তাপমাত্রা আজ -৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। ইতিমধ্যে নাওমিও বাইরে এসে উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হুইসেলের শব্দের উৎস বোঝার চেষ্টা করছে। মৈত্রীর বাকি সদস্যরা তখন অকাতরে ঘুমোচ্ছে। হুইসেলের শব্দ যে ৮০ নট গতির ব্লিজার্ডের মতোই শুনতে লাগে। নাওমি ছাড়া অন্য আরেকজন মৈত্রী-সদস্যও তখন বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে—ডঃ কে বদ্রীনাথ!
মনন অনুচ্চ গলায় বলে উঠল, “ডঃ বদ্রীনাথ, আপনি, নাওমিকে নিয়ে প্রিয়দর্শিনী হ্রদের দিকে যান, হুইসেলের শব্দটা ওদিক থেকেই এসেছে।”
নাওমি হ্রদের দিকে যাওয়ার উদ্যোগই নিচ্ছিল হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে মননদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা যাবেন না, নাতাশাকে বাঁচাতে?”
“নাওমি, আপনার বন্ধু নাতাশার কোনও প্রাণ সংশয় নেই। এই মুহূর্তে যার ভয়ংকর বিপদ আমি তাকেই বাঁচাতে যাচ্ছি,” মনন বলল।
সোধি অবাক চোখে তাকাল তার দিকে। নাওমি আর বদ্রীনাথের চোখেও বিস্ময় ঝরে পড়ছে।
“কে? আপনি কার কথা বলছেন?” নাওমি উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল।
“মিস জ্যোতি রঙ্গরাজন! সময় মতো ওর ঘরে পৌঁছতে না পারলে ওকে হয়তো আর…”
কথাটা অসমাপ্ত রেখেই মনন তীরবেগে ছুটল ইউ-আকৃতি বাড়িটার একেবারে বিপরীত প্রান্তে।
অ্যান্টার্কটিকার অপার অখন্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে সোঁ সোঁ শব্দ তুলে একটা ভুতুড়ে হাওয়া বইতে শুরু করেছে, যেন তিনটে নয় অজস্র হুইসেলের শব্দ শুরু হয়েছে।
মনন আর সোধি ছুটতে ছুটতে জ্যোতি রঙ্গরাজনের সিঙ্গল অকুপ্যান্সি ঘরটার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। ঘরের দরজা খোলা। ঘরে জ্যোতি রঙ্গরাজন নেই। করিডোরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে ভুবন শইকিয়া। মনন স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, “বেচারা শইকিয়া, ভালো মানুষ, জ্যোতির প্রাথমিক সুরক্ষার জন্য ওকেই দায়িত্ব দিয়েছিলাম, কিন্তু ভয়ংকর দৈত্যটার অসীম শক্তির কাছে ওর প্রতিরোধ খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে।”
মনন আর সোধি মিলে ভুবনকে তুলে ঘরের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। ভুবনের মুখ দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরানোর শব্দ বেরিয়ে এল। তবু সে আঙুল তুলে এক দিকে ইশারা করল।
“টেক কেয়ার” বলে মনন ঘর থেকে বেরিয়ে সেদিকে ছুটল।
বাইরের নরম তুষারের ওপর তখন দু-জোড়া পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। পায়ের ছাপগুলো প্রিয়দর্শিনী হ্রদের দক্ষিণদিকে ছোট পাহাড়টার দিকে গেছে। এবড়োখেবড়ো পাথর ছড়ানো চারপাশে। বেশিদূর যেতে হল না, রাত পৌনে তিনটের গোধূলি আলোয় দেখা গেল এক দীর্ঘকায় পুরুষ জ্যোতি রঙ্গরাজনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে।
“বরিস কাদিরভ, ইওর গেম ইজ ওভার!” মনন চেঁচিয়ে বলল, “তুমি বিজ্ঞানের সাধক হয়ে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ, ডঃ বেদ পিল্লাইকে খুন করেছ! ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।”
“ভিকট্রি ফর চেচনিয়া,” বিশাল দৈত্যাকার বরিস কাদিরভ ঘুরে দাঁড়াল, তার হাতের ক্লিভার ছোরাটা শক্ত করে জ্যোতির গলায় চেপে ধরে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “এক পা এগোলে মেয়েটাকে কেটে ফেলব! এখন আমরা অজেয়, ইসলাম উইল রুল দ্য ওয়ার্ল্ড, ইনশাল্লাহ্, আইসিস উইল রুল দ্য ওয়ার্ল্ড।”
জলভরা চোখে জ্যোতি তাকাল তার দীর্ঘদেহী প্রেমিকের দিকে। এই লোকটাকে সে নাকি ভালোবেসেছিল!
মনন ফিসফিস করে সোধিকে বলল, “সর্দার আজ দেখি তোমার মুক্কেবাজি। আমি এখান থেকে শয়তানটার পায়ে ক্লিয়ার শট ভিউ পাচ্ছি, তুমি এগিয়ে যাও।”
ইতিমধ্যে নাওমি আর বদ্রীনাথ নাতাশাকে সঙ্গে নিয়ে অকুস্থলে হাজির হয়েছে। সম্ভবত নাওমি আর বদ্রীনাথ দুজনেই ঘটনার পরম্পরা দেখে আসল পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছে। নাওমি অবিশ্বাসের চোখে তার রুশ-বন্ধু নীল চোখের মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে।
মনন এক ঝলক ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও হল নাতাশা গেলায়েভা, একজন চেচেন সন্ত্রাসবাদী। তবে ও যা করেছে তা ওর বয়ফ্রেন্ড বরিসের নির্দেশে। ডঃ বদ্রীনাথ চট করে মেয়েটার হাতদুটো বেঁধে ফেলুন।”
ইতিমধ্যে রীতিন্দর সিং সোধি, টু টাইমস পাঞ্জাব স্টেট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন, বরিসের থেকে হাতপাঁচেক ব্যবধানে এসে দাঁড়িয়েছে। সোধি ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা তুলতেই বরিস হা হা করে হেসে উঠল, সে ভাবল তাকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে সোধি। মনন বুঝতে পারল সোধির সংকেতটা। সে তার হাতে ধরা গ্লকটা থেকে একটা ক্লিয়ার শট নিল বরিসের ডানদিকের উরু লক্ষ করে।
গুলিটা খেয়ে শুধু এক মুহূর্তের জন্য বরিস ঈষৎ সামনে ঝুঁকে পড়ল, আর সেই সুযোগে সোধি লোকটার চোয়াল লক্ষ করে এক মোক্ষম ঘুঁষি চালাল। সেই ঘুঁষির অভিঘাতে মুহূর্তের জন্য বরিসের অন্য হাতটা শিথিল হয়ে ক্লিভারটা খসে পড়তেই জ্যোতি ছিটকে বেরিয়ে এল তার নাগাল ছেড়ে।
পরক্ষণেই বরিস শিরদাঁড়া টান করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ডানপায়ের উরুতে লাগা গুলিটা যে তাকে বিন্দুমাত্র কাবু করতে পারেনি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। আচমকা সে একটা অমানুষিক হুঙ্কার ছেড়ে তার গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ফেলল। শরীরের উর্দ্ধাঙ্গের ত্রিস্তর পোশাকগুলো একে একে টান দিয়ে খুলে সোধির সামনে এসে দাঁড়াল। শারম্যাকার ওয়েসিসের রাত তিনটের গোধূলি আলো এসে পড়েছে তার শরীরে। সোধি অবাক হয়ে বরিসের বিশাল পেশিবহুল শরীরের দিকে একবার তাকাল। তার মনে পড়ল না শেষবার কবে সে এমন একজন বিশালদেহী শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে বক্সিং রিংয়ে দাঁড়িয়েছে!
সোধি বরিসের থুতনি লক্ষ করে ডানহাতে একটা আপার-কাট পাঞ্চ করল। লোকটা পাথরের মতো অটল আর নিষ্পলক দাঁড়িয়ে রইল। সোধি ডানহাত বাঁহাত মিলিয়ে পরপর আরও দুটো জ্যাব আর হুক করল বরিসের মুখ লক্ষ করে, তাতেও তার শরীর বিন্দুমাত্র টাল খেল না।
মনন, নাওমি, বদ্রীনাথ আর জ্যোতি বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকল অমানুষিক শক্তির বরিসের দিকে। -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কোনও অপার্থিব জীবই পারে কনকনে বরফের প্রান্তরে নগ্নদেহে দাঁড়িয়ে থাকতে।
বদ্রীনাথ ও নাওমির পাশে দাঁড়িয়ে নাতাশা চেঁচিয়ে উঠল, “কাম অন বরিস, কিল দেম।”
বিহ্বলতা কাটতেই সোধি বাঁহাতে আবার একটা ঘুঁষি চালাল। এবার অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় মাথা সরিয়ে নিয়ে বরিস সোধিকে লক্ষ করে প্রচন্ড এক ঘুঁষি চালাল। চার-পাঁচহাত দূরে বরফের ওপর ছিটকে পড়ল সোধি। মনন বুঝতে পারল সোধি নক আউট!
এবার দ্রুত বরিস কাদিরভ, দ্য ইনডেস্ট্রাকটিবল, মননের দিকে এগিয়ে এল। মনন এখন তার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ডঃ পিল্লাইয়ের গবেষণার ফল এই গ্রহের প্রথম চরমজীবী মানুষকে, যাকে প্রবল শৈত্য, বন্দুকের গুলির আঘাত কিছুই যেন স্পর্শ করে না। তাদের দুজনের মাঝে আর আট-দশহাতের ব্যবধান। এই ব্যবধানটা মুছে গেলে গোটা পৃথিবী থেকেই যা কিছু শুভ নিমেষে মুছে গিয়ে গ্রাস করে নেবে অশুভশক্তি।
মুহূর্তরা ভেঙে যাচ্ছে পল অনুপলে। মননের আর ভাবার সময় নেই সে গ্লক-43 থেকে অতিমানব বরিসের পা লক্ষ করে পরপর আরও তিনবার ফায়ার করে। লোকটার মুখে একটুও যন্ত্রণার চিহ্ন না ফুটলেও সে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে বরফের মাঠে। মনন জানে এতেও ওই অতিমানবের কিছু হবে না, এক্ষুণি সে দুপায়ে খাড়া হয়ে ছুটে আসবে। এক মুহূর্তও সে দেরি না করে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ততক্ষণে সোধিও তার সম্বিত ফিরে পেয়ে পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বরিসের ওপর।
ক্রমে ভোরের এক নতুন সূর্য জাগে পূবের আকাশে। মুহুর্মুহু বন্দুকের গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছে বরফের স্তব্ধ প্রান্তর। ঘুম ভেঙে ছুটে এসেছে মৈত্রী আর নোভোলাজারেভস্কায়ার বিজ্ঞানী, কলাকুশলী আর সাপোর্ট স্টাফেরা।
একটা লোহার চেন দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় চেচেন সন্ত্রাসবাদী বরিস কাদিরভকে। তার সঙ্গী নাতাশা গেলায়েভাকেও মৈত্রী স্টেশনে আটক করে রাখা হয়।
জ্যোতি রঙ্গরাজন মাথা নিচু করে এসে দাঁড়ায় মননের সামনে। নাওমি, বদ্রীনাথ, ভ্যালেরি, ইগর, আনাতোলি, তাতিয়ানা, ভাসিলিসা সবাই এসে মননের চারপাশে ভিড় করে দাঁড়ায়।
“আপনার কীভাবে নাতাশাকে সন্দেহ হয়?” নাওমি আগ্রহী গলায় বলে।
“চিরকুটের লেখা হুমকিটা পড়ার পর আমার মনে হয়েছিল কোথায় যেন এই লাইনগুলো পড়েছিলাম নাকি শুনেছিলাম,” মনন বলল, “হোয়েন দ্য হুইসেল ব্লোওজ থ্রি টাইমস, ইট উইল অ্যানাউন্স দ্যাট ইউ উইল বি ডেড অ্যান্ড গন—এই কথাগুলোই লেখা ছিল চিরকুটে। প্রথমে নাতাশাকে কেউ থ্রেট করছে ভেবে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু চিরকুটটা বারবার পড়ে মনে হচ্ছিল ঠিক এই বাক্যটা নয়, তবে এরকমই একটা বাক্য কোথায় যেন শুনেছিলাম। তখন বুঝলাম এটা থ্রেটনোট নয়, আসলে আমার সঙ্গে কেউ মাইন্ড গেম খেলছে।”
“কিন্তু আপনার সঙ্গে কে মাইন্ড গেম খেলবে?” ডঃ বদ্রীনাথ প্রশ্ন করল।
“ডঃ পিল্লাইয়ের ক্যামেরায় একটা গ্রুপ ফটো ছিল। ছবিটায় মৈত্রী আর রাশিয়ান স্টেশনের সব বিজ্ঞানীরাই ছিলেন। নাওমির কাছে শুনেছিলাম ছবিটা নাতাশার বার্থডে পার্টিতে তোলা। সাধারণত কোনও মানুষ তার অপছন্দের মানুষদের এড়িয়ে চলে, কিন্তু কোনও কারণে পরস্পরকে অপছন্দ করে এমন দুটি মানুষ পরিস্থিতিতে পড়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুললে তাদের মুখেচোখে হাবেভাবে সেটা ফুটে ওঠেই। নাতাশার বার্থডে পার্টির ছবিটা যখন আচমকা তোলা হয় তখন নাতাশা আর জ্যোতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। ছবির সবার মধ্যে আন্তরিকতা ও বন্ধুভাব ফুটে উঠলেও নাতাশা আর জ্যোতি নিজেদের মধ্যে ব্যবধান রেখে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছবি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল একে অপরের বিরাগভাজন। তখনই আমার সন্দেহ হয়। নোভোলাজারেভস্কায়ায় বোলিং গেম পার্টির দিন আমার সন্দেহটা আরও দৃঢ় হয়। পরে নাতাশাও সেটা স্বীকার করে নিলেও মূল কারণটা ব্যক্তিগত অজুহাতে এড়িয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি জ্যোতি ও নাতাশা পূর্ব পরিচিত। দুজনেই এক সময় বার্কলেতে গবেষণা করত। অবশ্য এর আগেই মৈত্রীতে যেদিন আমি জন্মদিনের পার্টি থ্রো করেছিলাম সেদিনই পার্টির মাঝখানে আমি মত্ত অবস্থায় এক প্রেমিক যুগলকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় একটা ঘরে ঢুকতে দেখি। জ্যোতি আর বরিস কাদিরভ। বেশ বুঝতে পারি বরিস আর জ্যোতির সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল মার্কিনদেশে বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার সময়। ঘটনাটা বরিসের বাল্যকালের প্রেমিকা ও বন্ধু নাতাশা গেলায়েভের না-পসন্দ হয়। ঝামেলা বাধে, ফলে জ্যোতিকে বার্কলে ছেড়ে হার্ভার্ডে চলে যেতে হয়। তবে সে বরিসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে না। এদিকে জ্যোতি হার্ভার্ডে ডারপা-র স্পনসর্ড ‘প্রজেক্ট ইনডেস্ট্রাকটিবল’-এ কাজ শুরু করে কিন্তু কাজের গতি ও ধারা দেখে সে হতাশ হয়। তার মনে পড়ে ডাঃ পিল্লাইয়ের কথা। বার্কলে আর ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রজেক্ট করতে মন্টানা-র ইয়েলোস্টোন পার্কে গিয়ে জ্যোতির সঙ্গে ডঃ পিল্লাইয়ের আলাপ হয়েছিল। বেদ পিল্লাইয়ের কাজ তাকে ভীষণ প্রভাবিত করেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল এক্সট্রিমোফাইলদের নিয়ে কোনও যুগান্তকারী আবিষ্কার এই প্রৌঢ় বিজ্ঞানী একদিন করবেই। জ্যোতি তখন সেই কথা তার প্রেমিক বরিসকে জানায়। এদিকে বরিস কাদিরভ আর নাতাশা গেলায়েভা সক্রিয় চেচেন সন্ত্রাসবাদী। তাদের সঙ্গে আইসিস, আল কায়দা, আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের জঙ্গীসংগঠন লস্কর-এ-তৈবা, জৈশ-ই-মহম্মদ-এর সন্ত্রাসবাদীদের নিবিড় যোগাযোগ। তারা দুজনে মিলে পরিকল্পনা করে জ্যোতি রঙ্গরাজনকে ডঃ পিল্লাইয়ের অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণার টিমে পাঠায়, যাতে সে ডঃ পিল্লাইয়ের গবেষণার খবরাখবর তাদের দেয় এবং ইনডেস্ট্রাকটিবল বানানোর ফর্মুলা চুরি করতে পারে। অবশ্য জ্যোতি নাতাশার খবর এখানে এসে জানতে পারে। সে বেঁকে বসে। ফলে তখন বরিস জ্যোতিকে বিয়ে করবে বলে আশ্বস্ত করে। জ্যোতিকে সে বলে ডঃ পিল্লাইয়ের প্রজেক্ট সঞ্জীবনীর ‘ফাইনাল ইনফারেন্স’ চুরি করে তার হাতে দিতে, যাতে সে বহু অর্থমূল্যে সেই ফলাফল মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরকে বেচে দুজনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারে। জ্যোতিও সাগ্রহে রাজি হয়।” মনন প্রতিটি ঘটনা পুঙ্খানুখভাবে বলার চেষ্টা করে।
জ্যোতি ধীরে ধীরে মাথা তোলে। “বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না বরিস সন্ত্রাসবাদী। ও ডঃ পিল্লাইকে খুন করবে তাও বুঝতে পারিনি। আমি শুধু ওকে অন্ধের মতো ভালোবেসেছিলাম।”
“কিন্তু মিস জ্যোতি রঙ্গরাজন তাতে আপনার অপরাধ কিছুমাত্র লাঘব হয় না। আপনি ডঃ পিল্লাইয়ের সারা জীবনের গবেষণার ফসল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার চুরি করে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছেন, এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। আপনার জন্যই পরোক্ষভাবে ডঃ পিল্লাইকে মরতে হয়েছে কারণ সন্ত্রাসবাদী বরিস চায়নি বেদ পিল্লাই বেঁচে থেকে তার গবেষণার ফসল মানুষের কল্যাণের কাজে লাগাক।”
জ্যোতি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। নাওমি হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে, “কিন্তু চিরকুটের ব্যাপারটা তো বললেন না। আপনার কেন চেনা মনে হয়েছিল লাইনটা?”
“চিরকুটের লাইনটা একটা বিখ্যাত রুশ মানুষের উক্তিকে নকল করে লেখা। গ্রিগরি রাসপুটিনের বিখ্যাত উক্তি—‘হোয়েন দ্য বেল টলস থ্রি টাইমস, ইট উইল অ্যানাউন্স দ্যাট আই হ্যাভ বিন কিলড’। আমি যখন প্রথমবার ক্যানডিড সামরিক বিমানে চেপে অ্যান্টার্কটিকা আসি তখন প্লেনের ভিতর মিখাইল, বরিস আর নাতাশা তিনজন মিলে মজা করে নেটফ্লিক্সের টিভিসিরিজ ‘দ্য লাস্ট জারস’ থেকে অভিনেতাদের সংলাপগুলো বলছিল। তখনই রাসপুটিনরূপী বরিসের মুখে ওই সংলাপটা প্রথম শুনি। এটা রাসপুটিনের এক বিখ্যাত উক্তি, সেটাকেই বরিস আর নাতাশা মিলে প্যারোডি করে চিরকুটে লিখে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল। ওদের আসল উদ্দেশ্য ছিল হুইসেলের শব্দ শুনিয়ে আমাদের দৃষ্টি নাতাশার দিকে আকর্ষণ করানো, আর সেই সুযোগে বরিস খুন করত জ্যোতি-কে, কারণ ওদের কাছে জ্যোতির প্রয়োজন ফুরিয়েছিল।”
“ও মাই গড! আপনি তো এরাস্ট ফান্দোরিনের থেকেও বড় ডিটেকটিভ, মশাই!” বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে মিখাইল বলে উঠল।
“এরাস্ট ফান্দোরিন কে?” নাওমি জিজ্ঞাসা করল।
“বিখ্যাত রাশিয়ান গোয়েন্দা। বরিস আকুনিনের লেখা চরিত্র।” মনন হেসে উঠে বলল।
। । ১৪ । ।
অ্যান্টার্কটিকা থেকে দিন দশেক হল মনন শীল আর রীতিন্দর সিং সোধি দিল্লিতে এনআইএ হেডকোয়ার্টারে ফিরে এসেছে। আবার কনফেশন রুমে সোধি সন্ত্রাসবাদীদের বক্সিং প্র্যাকটিসের বালির বস্তা ভেবে পেটানো শুরু করেছে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড ওশেন রিসার্চের বড়কর্তা ডঃ গিল জানিয়েছেন ‘প্রজেক্ট সঞ্জীবনী’ অ্যাবোর্ট করা হয়েছে। জ্যোতি রঙ্গরাজনকে এনআইএ গ্রেপ্তার করে ভারতে এনেছিল। সে বর্তমানে তিহাড় জেলে আছে। তার মামলাটা পাটিয়ালা হাউসে এনআইএ-র স্পেশাল কোর্টে একজন অ্যাডিশনাল সেশন জজের কোর্টে আছে। টাডা অ্যাক্টের বিভিন্ন ধারা ও আইপিসি-র সেডিশন সংক্রান্ত কয়েকটি ধারা প্রয়োগ করে পুলিশ চার্জশিট তৈরি করেছে।
বরিস কাদিরভ ও নাতাশা গেলায়েভাকে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনের পুলিশ গ্রেপ্তার করে অ্যান্টার্কটিকার মাটি থেকে কেপ টাউনে নিয়ে এসেছিল। দুজন অপরাধীই যেহেতু রাশিয়ান ফেডারেশনের নাগরিক তাই অ্যান্টার্কটিকা ট্রিটি সিস্টেম অনুযায়ী তাদের দেশ রাশিয়ার সরকারই তাদের বিচার করবে। তবে মনন কথা দিয়ে এসেছে যে সে চার্জশিট তৈরি করতে কেপ টাউন পুলিশ বা পরবর্তীকালে রুশ পুলিশকে সাহায্য করবে।
আজ আবার সকাল থেকে সোধি স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। গত পরশু চাঁদনি চকের পরাঠেওয়ালা গলির কাছ থেকে লালকুঁয়া থানার পুলিশ ইকবাল নামে একটা বছর তিরিশের ছেলেকে এনআইএ-র নির্দেশে গ্রেপ্তার করেছে। ছেলেটার পুলওয়ামা কেসে একটা লিংক পাওয়া গেছে। আজ সকাল থেকে সোধি ছেলেটার জবানবন্দী নেওয়ার নামে জমকে পিটাই শুরু করেছে। মননের মনে হচ্ছিল আর কয়েক মাস সে এনআইএ-তে কাটালে পুরো পাগল হয়ে যাবে। সে কনফেশন রুমের একপ্রান্তে একটা চেয়ারে বসে বড় বড় হাই তুলছিল।
আচমকা কনফেশন রুমের বন্ধ দরজার বাইরে থেকে কেউ মৃদু আঘাত করল। দরজা খুলে দাঁড়াতেই সে দেখল এক জুনিয়র অফিসার দাঁড়িয়ে। “বস তোমাদের দুজনকে ডেকেছেন,” ছেলেটা বলল।
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় মনন শীল আর রীতিন্দর সিং সোধি এনআইএ ডিজি-র চেম্বারে পৌঁছে গেল। মনন আর সোধির গুঁফো বস ডিজিসাহেব গম্ভীর মুখে তার ল্যাপটপের স্ক্রিনটা মননদের দিকে ঘুরিয়ে ধরে বললেন, “এটা দেখো, দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র সানডে টাইমসের খবর।”
মনন আর সোধি ঝুঁকে পড়ে প্রতিবেদনটা পড়তে শুরু করল—‘আন্তর্জাতিক চেচেন সন্ত্রাসবাদী যুগল বরিস কাদিরভ ও তার ফিঁয়াসে নাতাশা গেলায়েভকে কেপ টাউন পুলিশ দিন দশেক আগে অ্যান্টার্কটিকার শারম্যাকার ওয়েসিস থেকে ভারতীয় বিজ্ঞানী ডঃ বেদ পিল্লাইয়ের খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করেছিল। অ্যান্টার্কটিকা ট্রিটি সিস্টেম অনুযায়ী যেহেতু দুই অভিযুক্ত রুশ তাই তাদের রুশ পুলিশের জিম্মায় তুলে দেওয়া হচ্ছিল। কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট কেপ টাউন থেকে মস্কো যায় ভায়া দোহা। দোহা এয়ারপোর্টে আট ঘণ্টা ওয়েটিং টাইম ছিল। বরিস আর নাতাশার পাহারায় যৌথভাবে ছিল কেপ টাউন পুলিশ এবং মস্কো পুলিশ। রাতের এয়ারপোর্টে শৌচালয় থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালায় বরিস কাদিরভ। অবশ্য নাতাশা পালাতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ জানিয়েছে সন্ত্রাসবাদী বরিসকে খুঁজে পেতে তারা রুশ পুলিশকে সব রকমের সাহায্য করবে।’
মনন আর সোধি হতাশ হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। আচমকা মননের নজর পড়ল সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের তলায় একটা আলোকচিত্র ছাপা হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে কেপ টাউন ও মস্কো পুলিশের সঙ্গে হাতকড়া পরে কেপটাউন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে হেঁটে চলেছে দীর্ঘদেহী বরিস কাদিরভ। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল মনন শীল। বরিস কাদিরভ আর পুলিশের ব্যাকগ্রাউন্ডে হেঁটে চলা সাধারণ মানুষের ভিড়ে একটা চেনা মুখ তার চোখে পড়ল। এ মুখ সে কোনওদিন ভুলতে পারবে না। একটা প্রৌঢ় মানুষের মুখ, পাখির মতো তীক্ষ্ণ বাঁকা নাক, সাদা জুলফি, কপালের সামনের দিক কেশবিরল আর সুতীব্র ও উজ্জ্বল অন্তর্ভেদী সে চোখের দৃষ্টি। নাহ্ এ মুখ ভোলার নয়—প্রফেসর এফ এন বোর ওরফে ফণীন্দ্রনাথ ভড়! এ মানুষটা আজও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মতো এক একটা দৈত্য বানিয়ে চলেছে!
মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
———
Tags: উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পার্থ দে, পূজাবার্ষিকী, সুমন দাস
সাস্পেন্স, থ্রিল, সায়েন্সের জমাট কক্টেল! এই শারম্যাকার ওয়েসিসের পটভূমিতেই ২০১৮-র শারদ হাট্টিমাটিমে একটা ছোট সায়েন্স ফিকশন লেখার চেষ্টা করেছিলাম, তাই আবহটা আরো পরিচিত লাগলো। তথ্যসমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও টানটান গতিময়, আর শেষের চমকটা আরেকটা রুদ্ধশ্বাস সিক্যুয়েলের আশা জাগিয়ে রাখল।
Thanks a lot Saptarshi Chatterjee for liking this novella. I’ll find the copy of Hattimatim Pujabarshiki 2018 and will surely read the story of yours.
অসম্ভব টানটান একটি বায়োপাঙ্ক থ্রিলার! মনন শীলের জন্য অপেক্ষা করা গতবার থেকেই পুজোর লিস্টে যুক্ত হয়েছিল। তার আগের বার জানতাম না যে মনন শীলের সিরিজ হবে। এখন তো রীতিমতো ফ্যান হয়ে গেছি তার। অপেক্ষায় আছি প্রথম মনন শীলের ফিজিক্যাল উপস্থিতির জন্য। মানে বই কবে বেরুচ্ছে এগুলো নিয়ে, তার অপেক্ষায়। পুজো দারুণ কাটিও পার্থদা। হ্যাটস অফ টু ইউ।
Thanks a lot Sudip. Lots of love and Puja greetings. Readers loving Manan Shil is a dream come true for me. I’ve lot of plans with this sleuth character. Let’s see how things take shape.
Couldn’t reply in bangla. Something went wrong in my mobile, so am answering in english.
দারুণ উপন্যাস! মনন শীলকে কেন্দ্রে রেখে রহস্য, জীববিদ্যার নানা গূঢ় তত্ত্ব এবং অ্যাকশনের যে সমন্বয়ের নেশা আপনি আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন, তা বড়োই বিপজ্জনক। এখন থেকেই পরবর্তী কল্পবিশ্ব-র জন্য অপেক্ষা শুরু হয়ে গেল।
Thanks a lot Rijubabu. I’m feeling relieved that this time also you liked this Manan Shil Biopunk thriller. I was afraid that I might have cooked some boring stuff with infodumping but as people liked it I felt relaxed.
Having a problem in mobile I couldn’t type here in bangla.
এক নিটোল, ঝরঝরে, গতিময় উপন্যাসিকা পাঠ করলাম। তথ্যসমৃদ্ধ হয়েও নির্মেদ। কুর্নিশ লেখকের কাহিনী বুননের মুনশিয়ানাকে। শেষটুকু রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গিয়েছি। এই কাহিনীটি পড়েই মনন শীলের একজন চরম ভক্ত বনে গেলাম। পরবর্তী সিক্যুয়েলের জন্য অধীর অপেক্ষায় রইলাম।
যারা আগের দুটো লেখা পড়েননি, তাদের অনুরোধ পড়ে ফেলুন। কলবিজ্ঞান নিয়ে এমন আন্তর্জাতিক স্তরের স্মার্ট লেখা বাংলায় খুব কম। কল্পবিশ্ব প্রকাশনী যদি এই সিরিজের তিনটে অথবা পাঁচটা উপন্যাস নিয়ে বই করে, তাহলে সেটা এসময়ের অন্যতম সাই ফাই হয়ে থাকবে। অসাধারণ উপন্যাস।
‘প্রহরণ’ আর ‘আঁখিশ্রী’-র পরে ‘চরমজীবি’-র জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলাম। সেই অপেক্ষা পুরো মাত্রায় সার্থক। মনন শীলের সাথে সাতগে আপনারও ফ্যান হয়ে গেছি।
চরমজীবী পড়ার পর আঁখিশ্রী পড়ছি, ঐটি বাদ হয়ে গেছিল আমার। কুমেরুর পটভূমিতে এক রুদ্ধশ্বাস পাঠ। পরের কোন এই সিরিজের উপন্যাস বেরোলে তার অপেক্ষায় থাকব।
এইটাকে ফিলিম বানাতেই হবে, সৃজিত কে দিয়ে।বাইশে শ্রাবন টাইপ।
দুর্ধর্ষ থ্রিলার ; গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
অসাধারন উপন্যস। যারা এখন বলে বেড়ান যে যে বাংলায় এখন আর কিছু ভালো লেখা হচ্ছে না তাদের অনুরোধ করব বাংলা ভাষাতে লেখা এইরকম বিশ্বমানের লেখাটি পড়ে দেখার জন্য। আপনার প্রতি দিন দিন প্রত্যাশা আরো বেড়ে যাচ্ছে। উপন্যাস টি তে বিজ্ঞানের তথ্য আছে, প্রাকৃতিক বর্ননা আছে প্রেম ভালোভাসা প্রতিহিংসা সর্বপরি আছে টানটান উত্তেজনা – থ্রিলার। বিজ্ঞানের বর্ননা গুলোও এত সুন্দর সাবলীল যে উপন্যাসের গতি কোথাও ব্যাহত হয়নি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এইরকম একটি উপন্যাসের জন্য।
Nissondehe khub valo laglo. Tobe du ekta kotha bolar ache. The 21st amino acid is selenocysteine, not pyrrolysine. Pyrrolysine is the 22nd amino acid. Ar golper suru te dekhi Naomi janache se Archaea niye kaj koreni, kintu pore se Monon ke janache Archaea niye kaj kore Nature e paper ber koreche. Eikhane ektu khotka theke gelo.