চলচ্চিত্র সমালোচনা – মুন (২০০৯)
লেখক: প্রবুদ্ধ দাস
শিল্পী: অন্তর্জাল
ছবি : মুন (২০০৯)
নির্দেশক : ডানকান জোনস্
লেখক গোষ্ঠী : মার্ক বাওডেন , ন্যাথানিয়াল পার্কার , ডানকান জোনস্
জঁর : কল্পবিজ্ঞান
বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় আমরা অনেক মেকি জিনিষে মন দিয়ে ফেলি, যা প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের উন্নত থেকে উন্নততর হতে সাহায্য করে। কিন্তু এই আবিষ্কারের তাগিদে আমরা নিজেদের জীবনের ছোট্ট চাওয়া- পাওয়া গুলোকে বঞ্চিত করতে পিছুপা হইনা, যা পরে আমাদের ভাবায়। এই বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ এতটাই এগিয়ে গেছে যে, পৃথিবীর বুকে যত প্রাকৃতিক সম্পদ নিজেদের অগ্রগতির জন্য আত্মস্মাৎ করছে। সেই দিন আর বেশী দূরে নেই, যখন প্রকৃতির দেওয়ার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
সিনেমায় এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেই এসেছে লুনার নামক বহুজাতিক সংস্থা। ছবিতে এই সংস্থার গবেষণার মূল বিষয় হল চাঁদ থেকে হিলিয়াম শক্তি সংগ্রহ করা এবং সেই শক্তি দিয়েই পৃথিবীর এনার্জি ক্রাসিস লাঘব করা। যেমন ইচ্ছা তেমনি কাজ! ছবিতে দেখানো হয়েছে, এই সংস্থা চন্দ্রপৃষ্ঠে এক বিশালাকৃতি গবেষণাগার বানিয়েছে। এই গবেষণাগারটি চালায় শুধুমাত্র এক মহাকাশচারী , নাম স্যাম বেল ও একটি কথাবলা রোবট, গার্টি। তবে এই কথাবলা রোবট কিন্তু যে সে রোবট নয় , যেমন সে মানুষের আবেগ বুঝতেও সক্ষম তেমনিই প্রোগ্রামিং এও পারদর্শী। এই গবেষণাগারের সব কাজ, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করে এই গার্টি। বাইরের যা কাজ, মানে হিলিয়াম সংগ্রহ করা বা ঐ সংক্রান্ত কাজ করে স্যাম। ছবি শুরু হয়, যখন স্যামের তিন বছরের চন্দ্রপৃষ্ঠে থাকার চুক্তি শেষ হওয়ার আর মাত্র কিছুদিন বাকি আছে।
স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীতে নিজের স্ত্রী-সন্তানের কাছে ফেরার আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে সে। কিন্তু রহস্য ঘনিয়ে ওঠে ঠিক এই সময়ে। থেকে থেকেই স্যাম হ্যালুশিনেশানের শিকার হয়। ঘুমোবার মধ্যে কখনও সে দেখে নিজের স্ত্রীর সাথে রতিক্রিয়ারত, কখনও বা অন্য নারীর দেখা পায় অলীক ভাবনায়। আশ্চর্যভাবে এই মানবিক অনুভূতিগুলো, যা সে এতদিন অনুভব করেনি, অনুভূত হয় ঠিক যখন আর দু সপ্তাহ পর সে পৃথিবীতে ফিরবে। যত দিন এগিয়ে আসছে স্যামের এই অলীক ভাবনা বেড়ে চলে। কেন এরকম হচ্ছে? কিছুই সে ভেবে উঠতে পারে না। এই দমবন্ধ পরিস্থিতিতে ঘটে আরও কিছু চমকপ্রদ ঘটনা। একদিন সে তার চন্দ্রযানে চড়ে হিলিয়াম সংগ্রহ করতে বেড়িয়ে হ্যালুশিনেশানের ফলে দুর্ঘটনায় আহত হয় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়।
এরপর সিনেমার পর্দায় দেখা যায় এক অসুস্থ স্যাম বেল যার চিকিৎসা করছে গার্টি কিন্তু দুর্ঘটনার কথা কিছুই মনে পরে না শ্যামের। যখন অনেকটাই সেরে উঠছে স্যাম, হঠাৎই একটা সময়ে সে শুনতে পেয়ে যায় গার্টির কথপোকথন, লুনার সংস্থার কিছু মানুষের সাথে। সন্দেহের বশে সে শরীর দুর্বল থাকা সত্ত্বেও কাজ করতে চায়। গার্টি স্যামের কথা ফেলতে পারে না এবং তাঁকে অনুমতি দেয় কাজ করবার জন্য। এবার শুরু স্যামের আশ্চর্য হওয়ার পালা। দুর্ঘটনা স্থলে গিয়ে স্যাম খুঁজে পায় একটি আহত মানুষকে। কি আশ্চর্য ! দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষটা দেখতে হুবহু স্যামের মত। দর্শকাসনে বসে মনে হতেই পারে যে তারা যমজ। আসলে কিন্তু তা নয়। দুজনেই গবেষণাগারে পৌঁছে ভাবতে থাকে এটা কীভাবে সম্ভব এবং অবশেষে বুঝতে পারে তারা দুজনেই ক্লোন। গবেষণাগারের নিচে তারা খুঁজে পায় এক অ্যান্টিরুম, যেখানে শ’এ শ’এ শায়িত স্যাম বেল এর ক্লোন, যাদের প্রত্যেকটির জীবনে মেয়াদ তিন বছর!
কীভাবে পুরোনো স্যাম বেলের ক্লোন নতুন স্যাম বেলের ক্লোনকে পৃথিবীতে পাঠায় এবং নিজের জীবন শেষ করে দেয় , কেনই বা এই পরিণতি, সিনেমার শেষাংশে রয়েছে তারই উল্লেখ।
অসাধারণ অভিনয়ে স্যাম বেলের ভূমিকায় স্যাম রকওয়েল এবং গার্টির ভূমিকায় কেভিন স্পেসির কন্ঠাভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করবে সন্ধেহ নেই। সেট নির্মাণ এবং শিল্পনির্দেশনা এই ছবিটিকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছে।
আসলে মানুষের এই সবকিছু আত্মস্মাৎ করার লোভই মানুষকে কোন পথে ঠেলে দিতে পারে, তার কথাই এই ছবির দৃশ্যে দৃশ্যে অনুরণিত হয়েছে। ক্লোন মানে মানুষের জেরক্স। আবেগ অনুভূতি সবকিছুর কপি করতেও মানুষ কুন্ঠিত হবে না, যতদিন না তার স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে। প্রকৃতি যেমন মুক্তহাতে সবকিছুই মানুষের সুখের জন্য বিলিয়ে দেয় কিন্তু মানুষ বোধহয় তা পারে না। সে যে বড়ো স্বার্থপর।
নিজেকে বিকিয়ে দিতেও পিছুপা হয়না সে, কখনও লোভে, কখনও বা চাহিদা মেটাতে!
Tags: চলচ্চিত্র সমালোচনা, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রবুদ্ধ দাস, মুন (২০০৯), সমালোচনা