চলচ্চিত্র সমালোচনা – মেট্রোপলিস্ (১৯২৭)
লেখক: সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: অন্তর্জাল
মেট্রোপলিস্ – ছায়ার আয়নায় ভাবীকালের ছবি
মহৎ কল্পবিজ্ঞানের উপস্থাপনা শুধুমাত্র তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপরে নয় বরং অন্তর্নিহিত সমাজ–সচেতন, মানবিক বক্তব্যে ফুটে ওঠে। তা সে সাহিত্য, সিনেমা যে মাধ্যমই ধরি না কেন। কালের গর্ভেই এই সৃষ্টির উপাদান মজুদ থাকে। বিংশ শতাব্দীর সূচনাটা ছিল এমন এক ক্রান্তিকাল। সেই সময় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যার সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে এই জগত সম্বন্ধে নতুন দিনের প্রজ্ঞা প্রকাশিত হচ্ছিল আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রভৃতির গাণিতিক বিবৃতির মধ্যে দিয়ে। এই আবহেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মূল্যবোধের চরম অবনমন আর তারই অনুষঙ্গে এসে যায় এক নতুন দার্শনিক বীক্ষা। সময়ের অভিঘাতে এখন আমরা তাকে ‘জার্মান এক্সপ্রেশনিজম্’ নামে অভিহিত করেছি। পরের বেশ কয়েক দশক ধরে এই মতবাদ সাহিত্য, অঙ্কনচিত্র, সংগীত এমনকি নতুন মাধ্যম চলচ্চিত্রেও ক্রমাগত এক অন্যধারার প্রকাশভঙ্গী তৈরি করে গেছে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত, অর্থনৈতিক ভাবে প্রায় দেউলিয়া জার্মানির রাজনৈতিক অচলাবস্থায় নড়বড়ে সমাজবাদ ধরে রাখার ক্ষীণ চেষ্টা তখন করে যাচ্ছে ভাইমার রিপাবলিক্। ঠিক এমনই একটা সময়ে ১৯২৭ সালে তৈরি হয়েছিল ‘Metropolis’ নামে একটা এক্সপ্রেশনিস্ট্ সিনেমা যাকে বলা যেতে পারে পৃথিবীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্র।
ছবির মূল জার্মান পোষ্টার
১৯২৫ সালে প্রকাশিত টেয়া ফন্ গাব্রিয়েলে হারব্যুর (Thea Gabriele von Harbou) এই একই নামের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করেই মেট্রোপলিস্ ছবির চিত্রনাট্য লেখা হয়। টেয়া ফন্ হারব্যু ঘটনাচক্রে এই ছবির পরিচালক ফ্রিৎজ্ ল্যাঙের (Fritz Lang) স্ত্রী ছিলেন সেই সময়। ডিস্টোপিয়ান ভূয়োদর্শনের রূপ সেই সময় ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছিল সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক অস্ত্রে বলীয়ান সমাজে বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগের বীভৎসতা সম্পর্কে মানুষ ততদিনে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। যন্ত্র-সভ্যতার চূড়ায় থাকা এমনই একটা নিরাশাবাদী ভবিষ্যৎ সমাজের ছবিই দেখান হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
ভবিষ্যতের ‘টাওয়ার অফ্ ব্যাবেলকে ঘিরে থাকা মেট্রোপলিস্ শহর
গল্পের সময়কাল ২০২৭ সালের পৃথিবী। বিপুল বিত্তের মালিক শিল্পপতি জোহ্ ফ্রেডেরসেন মেট্রোপলিস্ শহরের উঁচু টাওয়ার অফ্ ব্যাবেলকে কেন্দ্র করে তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। অনেক বড়ো বড়ো যন্ত্রের সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত হয় সেই শহরের প্রাণস্পন্দন অর্থাৎ আধুনিক সভ্যতার সব আমোদ প্রমোদের যান্ত্রিক উপকরণ। সেই শহরের অধিবাসীরাও তারই মতো ধনী। সেখানকার তরুণ, তরুণীরা সারাদিন বিলাস ব্যসনে ডুবে থাকে অথবা শিল্পচর্চা, শরীরচর্চার মধ্যে দিয়ে নিজেদের জীবন গড়ে তোলে। এমন এক বিলাসবহুল জীবনে আর সবার সাথেই মেতে থাকে জোহ্ ফ্রেডেরসেনের ছেলে ফ্রেডের। সাধারণ মানুষের জীবন সম্বন্ধে কিছু না জেনেও সুখে তার দিন কাটতে থাকে শহরের মাঝখানে সাজানো প্রমোদকাননে। কিন্তু মেট্রোপলিসের মাটির নীচের বিশেষভাবে নির্মিত শহরে লুকিয়ে আছে এক অন্য জীবনের গল্প। সেই জীবন নিরন্ন সাধারণ শ্রমিকের যাদের অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে মেট্রোপলিসের যন্ত্রদানবেরা জেগে থাকে আর ধনিক শ্রেণীর আরাম আয়েসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে যায়। এই শ্রমিকদেরই একজন তরুণী মারিয়া যে ছোট ছোট গরীব বাচ্চাদের দেখাতে নিয়ে আসে মাটির ওপরে থাকা ধনীদের শহরটাকে। যে জীবনের কোন স্বাদই তারা পায় না তারই একটা ঝাঁকি দর্শন করতে এসে মারিয়ার চোখাচোখি হয়ে যায় ফ্রেডেরের সাথে। মারিয়ার চোখের তারায় একটা না জানা জীবনের ভাষা খুঁজে পায় ফ্রেডের। তাকে পাগলের মতো খুঁজতে খুঁজতে সে পৌঁছে যায় মেট্রোপলিসের মূল মেশিনঘরে। আর তখনই সেখানে ঘটে যায় এক বিরাট বিস্ফোরণ যাতে প্রচুর শ্রমিক হতাহত হয় ফ্রেডেরের চোখের সামনে। চোখের সামনে দেখা মৃত্যুর এই কষ্ট সম্পূর্ণ অজানা ফ্রেডেরের। সে ছুটে যায় তার বাবার কাছে। পরে গ্রেগরী নামে শ্রমিকের সাথে নিজের জায়গা বদল করে ফ্রেডের, নিজে নেয় মেশিনের দায়িত্ব। ইতিমধ্যে গ্রট নামে এক ফোরম্যানের কাছ থেকে বেশ কিছু ম্যাপ পেয়ে যান ফ্রেডেরসেন যেগুলো ওই মৃত শ্রমিকদের কাছ থেকে পাওয়া গেছিল। ম্যাপে লুকিয়ে থাকা সংকেতের মানে উদ্ধারের জন্য ফ্রেডেরসেন চলে আসেন রোটাং এর কাছে। রোটাং মেট্রোপলিসের এক তুখোড় গবেষক যে আবার ফ্রেডেরসেনের মৃতা স্ত্রী ‘হেল’ এর প্রাক্তন প্রেমিক। হেলের স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য রোটাং এর মধ্যেই তৈরি করে ফেলেছিলেন এক যন্ত্র-মানবী (মূল জার্মানে Maschinenmensch)।
নিজের তৈরী যন্ত্র-মানবীর পাশে রোটাং
রোটাং এর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে ওই ম্যাপগুলো থেকে হদিশ পাওয়া যায় মাটির একদম নীচের স্তরে লুকিয়ে থাকা এক গোলকধাঁধার যার মধ্যে অনেকগুলো প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র পড়ছে। সংকেত থেকে জানা যায় যে সেখানে একটা গোপন জমায়েত হতে চলেছে। ফ্রেডেরসেনকে সাথে নিয়ে অনেক গুপ্ত সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে রোটাং পৌঁছে যান সেই গোপন জায়গায়। সেই জমায়েতে তখন মারিয়ার বক্তৃতা শুনতে এসেছে শ্রমিকেরা যার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে ফ্রেডের। মারিয়া ওই ক্ষুধার্ত লোকগুলোকে দেখায় এক নতুন ভবিষ্যতের আশা যেখানে হাত আর মস্তিষ্কের মধ্যে যোগসূত্র হবে হৃদয়। এই রূপকের মধ্যে দিয়ে এক সাম্যবাদী সমাজের ছবি খুঁজে পাই আমরা যেখানে শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে সমাজের চালিকাশক্তির এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকবে বা শ্রমিকেরা নিজেরাই হয়তো হয়ে উঠবে সমাজ গঠনের নিয়ামক। এর ঠিক পরে ফ্রেডেরসেনের পরামর্শ অনুযায়ী ওই যন্ত্র মানবীকে সম্পূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয় মারিয়ার আদলে। রোটাং দাবী করেন যে মানুষের মুখের অভিব্যক্তির মত অবিকল মুখভঙ্গি হবে এই ‘নকল’ মারিয়ার যা থেকে কেউ তাকে মানুষ নয় বলে বুঝতে পারবে না। এই নকল মারিয়া বা যন্ত্র-মানবীকে দিয়ে শ্রমিকদের একতা ভেঙে তাদের মধ্যে ভুল বার্তা পৌঁছে দেয়ার এক চেষ্টা করা হবে এরপর, যার চূড়ান্ত পরিণতি … সেটা না হয় তোলাই থাক। এই লেখা পড়ে যদি কারো এই ছবিটা দেখার আগ্রহ বেড়ে যায় তবেই এই প্রতিবেদন সার্থক।
যন্ত্র থেকে কৃত্রিম মারিয়াতে রূপান্তর
শুধু গল্পের কাঠামোতেই নয় আরও নানাভাবে এই ছবি প্রভাবিত করেছে ভবিষ্যতের অনেক সৃষ্টিকে। ছবিতে দেখানো স্কাইস্ক্র্যাপারগুলোতে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর যে স্থাপত্যরীতি দেখানো হয়েছিল তা থেকে বাস্তবের বিশেষত: পরবর্তীকালে লেখিকা আয়ান র্যাণ্ড বর্ণিত ‘অব্জেক্টিভিসম্’ বিশেষভাবে প্রভাবিত। বহু বিখ্যাত সিনেমা সরাসরিভাবে প্রভাবিত এই ছবিতে ব্যবহৃত স্পেশাল্ এফেক্ট এবং ফটোগ্রাফি টেকনিক্ থেকে। যার মধ্যে দুবছর পরে তৈরি আলফ্রেড্ হিচককের ছবি ‘ব্ল্যাক্মেল’ বা ৮০ দশকের বিখ্যাত ‘ব্লেড রানার’ কে রাখা যায়। এমনকি চার্লস চ্যাপলিনের কালজয়ী ‘মডার্ন টাইমস’ এর বিখ্যাত দৃশ্য যেখানে একপাল ভেড়ার সাথে নিত্যকার যন্ত্র-সভ্যতার জাঁতাকলে পিষতে থাকা মানুষের রূপক টানা হয়েছিল তার সাথেও এই ছবিতে দেখানো প্রায় যন্ত্র-সদৃশ শ্রমিকদের হাঁটা-চলার ফ্রেমগুলো প্রায় এক দর্শনে অনুরণিত হয়। চ্যাপলিন নিজেও তার ঋণস্বীকার করেছিলেন এই ছবির কাছে। এই ছবি তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম মিনিয়েচার সেটে অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে তার দৃশ্যগ্রহণের জন্য এক বিশেষ অপটিক্যাল টেকনিক ব্যবহৃত হয় যাতে সেটটা বিশাল বড়ো বলে ভ্রম হবে। এই পদ্ধতিকে এখন আবিষ্কারক এবং এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ইউজিন স্যুফটানের নামে ‘স্যুফটান পদ্ধতি’ (Schüfftan Process) বলা হয়।
দুঃখের বিষয় সমালোচকদের কাছে সমকালে এই ছবির বিরূপ সমালোচনা জোটে তার প্রবল সমাজতান্ত্রিক বক্তব্যের জন্য। প্রবল চাপের মুখে প্রযোজকেরা এই ছবির প্রায় এক চতুর্থাংশ কেটে বাদ দিয়ে দেন। পরবর্তীকালে যখন এই ছবি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলে বিবেচ্য হয় তখন থেকে ওই বাদ পরে যাওয়া অংশকে খুঁজে পাওয়ার জন্য বহু আর্কাইভ আর ফিল্ম ল্যাবরেটরিতে সন্ধান চালান হয়েছিল। ইতিমধ্যে নানা জায়গা থেকে পাওয়া অংশগুলোকে জুড়ে বেশ কয়েকটা সংস্করণ বেড়িয়েছিল যার মধ্যে ১৯৮৪ তে প্রকাশিত ‘জিওর্জিও মোরোদা’ এবং ১৯৮৬ তে প্রকাশিত ‘এন্নো পেটালস্’ এর কাট্ খুবই বিখ্যাত। মেট্রোপলিসের কপিরাইটের নিয়ন্ত্রক ‘এফ.ডব্ল্যু.মূর্ণাও ফাউণ্ডেশন্’ ২০০১ সালে প্রথম একটা ডিজিটাল কপি বার যেটাকে তারা প্রামাণ্য সংস্করণ (Restored Authorized Edition) বলে দাবী করেছিল। কিন্তু আর্কাইভ থেকে পাওয়া স্টিল শটস্, চিত্রনাট্যের কপি সব কিছু মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছিল আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ফ্রেম এই সংস্করণগুলোতে নেই। এরপর প্রায় খ্রিস্টধর্মের সেই কিংবদন্তী ‘হোলি গ্রেইল’কে খোঁজার মতই খোঁজ চলেছিল মেট্রোপলিসের আদি কপির। অবশেষে ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ারেস এর এক ফিল্ম ল্যাব ‘ম্যুজিও ডেল সিনে’ থেকে একটা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত নাইট্রেট প্রিন্ট উদ্ধার হয় যাতে ওই বাদ পরে যাওয়া অংশের অনেকটাই পাওয়া যায়। ডিজিটাল রেস্টোরেসনের মাধ্যমে অবশেষে ২০১০ সালে মূল ছবির একটা প্রায় অবিকৃত সংস্করণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এমনকি আর্জেন্টিনার প্রিন্টের স্প্যানিশ সাব-টাইটেল থেকে অন্যান্য প্রিন্টের শট্গুলোকে সঠিক ক্রমে সাজিয়ে ফেলা গেছে। এই নতুন কপিতে ‘থিন ম্যান বলে একটা চরিত্রের সন্ধান পাওয়া গেল যেটা পুরনো সংস্করণগুলোতে ছিল না। এছাড়া বিভিন্ন কপির ফ্রেমগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল যে একই সটের জন্য ফ্রিৎজ্ ল্যাঙ বিভিন্ন ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল ব্যাবহার করেছিলেন এবং তার ফলে ছবির মূল সংস্করণ ছাড়াও প্রাথমিক অবস্থাতেও তার আরো দুএকটা কাট্ মজুদ ছিল। বহু সিনে-রসিক, সিনে-ঐতিহাসিক, টেকনিশিয়ানের অক্লান্ত পরিশ্রমে উদ্ধার করা কপি থেকে অবশেষে পরিচালকের মূল দৃষ্টিভঙ্গির অনেকটাই আজ অনেকটাই ফুটে উঠেছে। যে দৃষ্টির মধ্যে যন্ত্রের আড়ম্বরকে ছাপিয়েও শেষে মানবিক বোধে উত্তরণের ছাড়পত্র রাখা আছে। আশা করা হয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে ছাড়িয়ে শেষমেশ বিজ্ঞান মানুষের শুভবুদ্ধির উদ্বোধনকেই ত্বরান্বিত করবে। আর এখানেই কালের আখরে মেট্রোপলিস্ তার শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়ে গেছে।
আধুনিক জার্মানির ব্যাবেলসবার্গ শহরে যান্ত্রিক মারিয়ার স্ট্যাচু
Tags: চলচ্চিত্র সমালোচনা, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, মেট্রোপলিস্ (১৯২৭), সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়