ছাল
লেখক: অর্ঘ্যজিৎ গুহ
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
এখন কেমন লাগছে বলুন তো?
মনীষার হাতের উপর নখ দিয়ে হালকা আঁচড় দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর অমিতাভ সেন। কলকাতা তথা ভারতের অন্যতম সেরা ডার্মাটোলজিস্ট। সাদা বাংলায় যাকে বলে স্কিনের ডাক্তার।
না স্যার, কোনও সেন্স পাচ্ছি না তো!— বলল মনীষা।
স্ট্রেঞ্জ! এরকম কেস তো দেখিনি আমি আগে! স্কিন তো নর্মাল লাগছে। তাও সেন্স কেন আসছে না?— অনেকটা যেন নিজেরই সঙ্গে কথা বলে উঠলেন ডাক্তার সেন। তারপর গলাটা হালকা কেশে একটু পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, কবে থেকে হচ্ছে আপনার এরকম?
— এই ধরুন গত দু-তিন সপ্তাহ ধরে! চিন্তার কোনও কারণ নেই তো স্যার?
— সেরকম তো কিছু বুঝছি না, তবে কয়েকটা টেস্ট করতে দিচ্ছি, একবার দেখে নেবেন। আর একটা অয়েনমেন্ট দিচ্ছি। ইউজ করে দেখতে পারেন।
ফিজটা দিয়ে চেয়ারটা ছেড়ে উঠে পড়ে মনীষা আর প্রতীক।
ওদের বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় পাঁচ বছর হল। দু’জনেই সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রতীক ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় যোগ দেয় ব্যাঙ্গালোরে। ওখানেই আলাপ দু’জনের। তারপর বিয়ে। এখন একমাত্র ছেলে তিন বছরের রাহুলকে নিয়ে কলকাতায় ওদের সুখের সংসার।
দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পল্লিতে ৩বিএইচকে ফ্ল্যাট। বারোতলা ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে শহরটা খুব সুন্দর লাগে। এটাই তো চেয়েছিল প্রতীক। ওরা আসলে জামসেদপুরের প্রবাসী বাঙালি। কর্মসূত্রে ও কলকাতায় আছে আজ প্রায় সাত বছর। ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেই এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল ও।
তবে শেষ কয়েক সপ্তাহ একদম কাজে মন বসছে না ওদের দু’জনের কারোরই। মনীষার হাতে পায়ে এক অদ্ভুত সমস্যা দেখা যাচ্ছে। চামড়ায় টান ধরছে। মনীষার কথামতো মাঝে মাঝেই কোনও অনুভূতি হচ্ছে না হাত-পায়ের কিছু কিছু জায়গায়। জিনিসপত্র পড়ে যাচ্ছে হাত থেকে। জুতো পরলে পা লাল হয়ে যাচ্ছে। রক্ত পড়ছে। কিন্তু ব্যথা নেই কোনও!
শুরুতে ভেবেছিল শীতকাল বলে হয়তো এরকম হচ্ছে। অনেক ক্রিম, লোশন মেখেও কোনও কাজ হয়নি। আজ শেষমেশ আসতেই হল ড: সেনের কাছে। কিন্তু বাকিদের মতো উনিও কোনও আশার কথা শোনাতে পারলেন না!
সব চিন্তাভাবনা ছেড়ে পাশের পড়ার টেবিলটায় ল্যাপটপটা খুলে বসল প্রতীক। কাজে বসলে হয়তো টেনশনটা কমবে একটু। তার উপর কাল একটা জরুরি ক্লায়েন্ট মিটিংও আছে অফিসে। যতটা সম্ভব কাজটা এগিয়ে রাখা আর কী।
এই একটা সমস্যা অনলাইন আসার। এক গাদা চ্যাটহেড খুলে যায়, শান্তিতে রেফারেন্সও চেক করা যায় না এগুলোর জ্বালায়! এক এক করে সব ক’টা চ্যাট হেড বন্ধ করতে করতে পাশের থেকে আবার একটা চ্যাট হেড পপ করে উঠল। বন্ধ করতে গিয়ে নামটা দেখে আর বন্ধ করা হল না।
মাইকেল। ওদের প্রোজেক্টের ইউকে হেড। অসাধারণ কোডার। ক’টা প্ল্যাটফর্ম যে জানে, তা ও নিজেও জানে না হয়তো। কিন্তু একদম মাটির মানুষ। কাজ ছাড়াও ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করাই যায় যে কোনও বিষয় নিয়ে। সেটা খেলাধুলোই হোক বা রাজনীতি। এমনকী দেশ-বিদেশের কত উপকথা-রূপকথা যে ও জানে ভাবলেও অবাক হয়ে যেতে হয়। কথায় কথায় মনীষার স্কিনের প্রবলেমটা নিয়েও কথা হচ্ছিল কয়েকদিন আগেই। রিপোর্টগুলিও চেয়েছিল মাইকেল। আজ হয়তো সেই বিষয়েই কথা বলার জন্যে পিং করেছে!
অনেক কথা হল আজকের ভিজিটটা নিয়েও। মাইকেল সবই শুনল মন দিয়ে। বলল ওর বাবার সঙ্গেও একবার কনসাল্ট করবে, ওর বাবা ওখানকার একজন বেশ নামী ডাক্তার। কথা চলছিল বেশ অনেকক্ষণ। হঠাৎ একটা আওয়াজে তাল কাটল যেন। ঘরের দরজাটায় একটা হালকা খুট করে আওয়াজ শুনলাম মনে হল। কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। মালতিদি-ই হবে হয়তো। ল্যাপটপটা থেকে নজর সরিয়ে একটা আওয়াজ দিল প্রতীক।
— কে মালতিদি? ভেতরে এসো গো। বাবু ঘুমায়নি নাকি?
না কোনও আওয়াজ নেই। কিন্তু দরজার নীচ দিয়ে আসা ডাইনিং প্লেসের হালকা আলোটা আবার একবার কেঁপে উঠল একটু। বাইরে তো আছে কেউ একজন! বিরক্তি সহ ল্যাপটপটা সরিয়ে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো প্রতীক, দরজাটা খুলল।
কই মালতিদি নেই তো! এই ফ্ল্যাটে বড় লোক বলতে তো ওরা তিনজনই। রাহুলকে ধরলে চারজন। মালতিদি রাহুলের সারাদিনের দেখাশোনা করে। পাশের ঘরেই শোয় ওর সঙ্গে। পায়ে স্লিপারটা গলিয়ে বেরিয়ে এল প্রতীক। পাশের ঘরে একবার উঁকি দিল। কই দু’জনেই তো ঘুমোচ্ছে, কাছে গিয়ে একবার ডাকল প্রতীক।
— ও মালতিদি, তুমি ডাকছিলে একটু আগে?
কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আরও দু-একবার ডাকল, মালতিদি উঠে বসে ঘুম জড়ানো গলায় বলল।
— কী হয়েছে দাদাবাবু?
— তুমি ডাকছিলে একটু আগে আমাদের?
— কই না তো দাদাবাবু! আমি তো উঠিনি। সেই থেকেই তো…
আর কিছু বলল না প্রতীক, শুধু রাহুলের গায়ের কম্বলটা একটু ঠিক করে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
তাহলে কী? বিড়াল নয়তো ইঁদুর হবে হয়তো!
না, আজকাল বড়ই ভুলভাল ভাবছে ও। কিন্তু… এই ক’দিন ধরেই এরকম কেন হচ্ছে ওর সঙ্গে?
একটা ভয় যেন কিছুতেই ওর পিছু ছাড়ছে না বেশ কয়েকদিন হল। ঠিক ভয়ও বলা যায় না। তবু রাতে আজকাল ঘুমটাও ঠিকঠাক হচ্ছে না। খালি মনে হয় একজোড়া চোখ যেন ওকে দেখে যাচ্ছে অদৃশ্য কোনও আড়াল থেকে। মনীষাকেও বলতে পারেনি অনেক ভেবে। রাতে ওকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছেও করে মাঝেমাঝেই। ঠিক সেভাবে নয়, শুধু মনে হয় একটু জড়িয়ে থাকলে হয়তো হালকা লাগত। কিন্তু নিজের চিন্তাতেই বেচারি কেমন যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে দিন দিন। কেমন যেন ক্লান্ত অবসন্ন থাকে সারাটা দিন। তাই ওকে বলে আর চিন্তা বাড়াতে চায়নি। ভূত দেখার ভয় বা ভগবান দেখার আশা কোনওটাই ওর নেই ছোটবেলা থেকে। নাস্তিক হিসাবে সুনাম এবং বদনাম দুটোই ও ভালোই অর্জন করেছে। তাও কীসের যেন একটা অজানা অচেনা ভয় ওকে ঘিরে ধরেছে… তা ঠিক বলতে পারে না। হতেই পারে তেমন কিছু নয় হয়তো। মনীষার এই অদ্ভুত রোগটাকে নিয়ে চিন্তা করতে করতেই হয়তো এরকম মনে হচ্ছে।
আবার কাজের টেবিলে এসে বসে প্রতীক। আসার সময় মনীষার দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। ঘুমোচ্ছে বেচারি। প্রতীক আবার কথা বলতে শুরু করল মাইকেলের সঙ্গে। মাইকেলের খুব ইচ্ছে একবার ও ভারতে আসবে। বিশেষ করে পাহাড় জঙ্গলে ঘুরবে ভালো কোনও সঙ্গী পেলে।
ঘুরতে বেশ ভালো লাগে প্রতীকেরও। কলেজে থাকতে প্রতি বছর কম করে একটা ট্রেকিং ছিল ওর বাঁধাধরা। এখন ট্রেকিং না হলেও পুজোয় বা শীতে একটা ছোট পাহাড় বা সমুদ্র ট্রিপ হয়েই থাকে। সেই নিয়েই কথা হচ্ছিল মাইকেলের সঙ্গে। আইটি ফার্মে থেকে লম্বা ছুটির আশা ওরা কেউই করে না। ওই একটা বড়জোর সাত দিনের ট্যুরও যদি হয়, সেটাই অনেক। কথায় কথায় উঠে এল উত্তরবঙ্গের কথাও। মাইকেল রাজিও হল। সামনের বছরের শুরুতে ঠান্ডা থাকতে থাকতেই আসবে কলকাতায়। কাজও হবে, ঘোরাও হবে।
টেবিলে রাখা ঘড়িটা একবার দেখল প্রতীক। রাত ২:৩৫। না, এবার ঘুমোতে যেতে হবে। কাল আবার অফিস। মাইকেলের থেকে বিদায় নিয়ে লগ আউট করে উঠতেই যাচ্ছিল হঠাৎ এক জোড়া হাত এসে কাঁধের কাছ থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল! মনীষা!
কাজের ফাঁকে প্রতীক খেয়ালই করেনি, কখন ও পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখে মনীষা বলল, কী গো ঘুমোওনি? যাও শুয়ে পড়ো। কাল তো আবার বেরোতে হবে।
— হুমম ওই আর কী। মাইকেল অনলাইন ছিল। প্রোজেক্টটা নিয়েও কথা হল। আর শোনো না, ও বলছিল নতুন বছরে কলকাতায় আসবে…
— ওয়াও হেব্বি মজা হবে কিন্তু! কোথাও ঘুরে আসব চলো সবাই মিলে!
— আরে সেইজন্যেই তো বললাম ওকে, ছোট্ট করে একটা নর্থ-বেঙ্গল বা সিকিম… উত্তেজনায় যেন ফুটছে প্রতীক, যেন পারলে এখনই চলে যায়।
— আচ্ছা আচ্ছা সব হবে খ’ন, এখন শুতে এসো তো, বলল মনীষা।
— হুমম তুমি যাও আসছি।
বাথরুম থেকে একটু চোখে মুখে জল দিয়ে এল প্রতীক। নাহ, এবার ঘুমোতেই হবে।
বালিশটা একটু গুছিয়ে নিয়ে কম্বলটা বেশ করে গায়ে টেনে নিল, সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যে চোখের পাতাটা ভারী হয়ে এসেছিল খেয়াল নেই আর।
ঘুমটা ভাঙল একটা অস্বস্তিকর অবস্থায়, কীসের একটা ঠান্ডা স্পর্শ যেন এসে লাগল ওর বুকের কাছটায়। স্যাতসেঁতে ঠান্ডা কিছু একটা যেন দলা পাকিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইছে ওকে, গরম কম্বলের নীচেও শীতের কামড়ে ঘুম ভেঙে গেল ওর! হাতের পাশের বেড-সুইচটা টিপে দিল। আলো জ্বলে উঠল। কম্বলটা সরাতেই দেখল মনীষাই শুয়ে ছিল ওর পাশে। হয়তো অভ্যেসমতো জড়িয়ে শুতে এসেছিল ঠান্ডা লাগছে বলে। কিন্তু ওর শরীর কি এত ঠান্ডা হবে?
চোখে আলো পড়ায় ঘুম ভেঙে গেছে মনীষার, প্রতীক ওভাবে তাকিয়ে আছে দেখে ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কী গো আবার কী হল? আলো জ্বালালে কেন?
কী বলবে বুঝে পেল না প্রতীক। আমতা আমতা করে বলতে লাগল, নাহ, কিছু না। জলের বোতলটা খুঁজছিলাম।
লাইটটা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ল প্রতীক, কাছে টেনে নিয়ে মনীষার মাথায় হাত রাখল একবার, ওকে কাছে পেয়ে মনীষাও যেন আরও কিছুটা গা ঘেঁষে এল। কই সব তো ঠিকই আছে, তাহলে কি কম্বলের নীচে ছিল বলে ঘেমে গেছে? তাই হবে হয়তো!
আসলে ছোটবেলা থেকেই এরকম ঠান্ডা স্যাঁতসেতে একটা প্রাণীতে খুব ভয় ওর।
সাপ!
এখনও মনে আছে ছোটবেলায় স্কুলে ওর বন্ধুরা ওর পিছন থেকে এসে কাঁধে দড়ি বা রবারের খেলনা সাপ ছেড়ে দিত। একবার ভয় পেয়ে বেঞ্চ থেকে পড়ে গিয়ে চোটও পেয়েছিল। কাঁধের কাছে কাটা দাগটা এখনও আছে। হেডস্যারের বকুনি খেয়ে বন্ধুরা কোনদিন আর বিরক্ত করেনি বটে তবে ভয়টা এখনও যায়নি ওর। ভয়ের থেকেও বেশি ওর মনে যেটা আসে সেটা হল ঘেন্না। কেমন যেন প্রাণীটা। ঠান্ডা, ভেজা আর ধূর্ত!
ডিসকভারি চ্যানেলে প্রতীক দেখেছে কয়েকটা সাপ কেমন ভাবে বিষ ঢেলে দিয়ে অপেক্ষা করে শিকার কখন মরবে, তারপর খাবে। এ যেন এক অদ্ভুত শিকার রীতি। চোখের সামনে শিকার কষ্ট পেতে পেতে মরবে। আর সাপটা সেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে, উফফ কী বীভৎস!
ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে উঠত ওর। হাতের সামনে কিছু পেলেই মাথা থেঁতলে দিতে ইচ্ছে হত। তবুও মারতে পারেনি কোনদিনও। একটা চাপা ভয় বা ঘেন্না ওকে সাপের কাছে যাওয়া থেকে আটকে রাখত।
মনীষার এসব ভয় কোনওদিনই ছিল না, এই তো কিছু মাসের আগের কথাই। পুজোর সময়ই ঘুরতে গেছিল ওরা সবাই মিলে, সিকিমে। রোলেপ আরিতার হয়ে নাথাং ভ্যালি। খুব মজা হয়েছিল ওই ট্রিপটায়। রাস্তার ধারে ধারে কত যে ঝর্না নেমে এসেছে তার কোনও ঠিক নেই। কী অদ্ভুত অদ্ভুত নাম এক একটার। ওদের গাইড কাম ড্রাইভার যে ছেলেটা ছিল দীনেশ বলে, ওই বলছিল সব এক এক করে দেখিয়ে দেখিয়ে। খুব হাসিখুশি ছিল ছেলেটা। কত আর বয়েস হবে বাইশ কি তেইশ, কিন্তু কী পাকা হাত! কিন্তু ওই একটা ঘটনাটা একদম পাল্টে দিল যেন ছেলেটাকে। নাথাং যাওয়ার পথেই ঘটেছিল ঘটনাটা। একটা ঝর্না দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি প্রতীকও, নেমে এসেছিল ছবি তুলতে।
নিজের ডিএসএলআরটা দিয়ে একের পর এক তুলে গেছে পাহাড়ের ছবি, ঝর্নার ছবি, রাস্তার পাশে ফুটে থাকা রংবেরঙের নাম না জানা ফুলের ছবি!
নিজের ভেতরের চার-পাঁচ বছর আগের কলেজ পড়ুয়া প্রতীককে খুঁজে পেল যেন অনেকদিন পর। মনে হচ্ছিল ঘর সংসার আর এই সো-কলড কর্পোরেট চাকরিটা না থাকলে এখানেই থেকে যেত একটা কাঠের বাড়ি ভাড়া নিয়ে। সংবিৎ ফিরল মনীষার হঠাৎ একটা চীৎকারে। আর একটু হলে হয়তো পা পিছলেই যেত। অনেক কষ্টে সামলে নিল। কিন্তু চোখ আটকে গেল প্রাণীটার দিকে!
সবজে রঙের শরীর, মাথাটা অনেকটা বড় ত্রিকোণাকার, রাস্তার পাশের গাছের ডালটা থেকে ঝুলে আছে। লম্বা লিকলিকে শরীরটা অনেকটা ভেসে আছে বাতাসে। চোখের দৃষ্টি প্রতীকের দিকে। যেন চোখে চোখ মিলিয়ে মেপে নিচ্ছে আগন্তুককে। কতটাই বা দূরে ছিল আর? দূরে না বলে কাছে বলাই ভালো। সরীসৃপটার নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে প্রতীক পরিষ্কার। সবজে শরীরটা একবার ফুলছে, একবার চুপসে যাচ্ছে নিশ্বাস নেওয়ার সময়!
মাঝে মাঝে সরু লিকলিকে দু’ভাগ করা জিভটা বের করে অনুভব করতে চাইছে হয়তো ওর উপস্থিতির প্রতিটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঙ্কেত! কী সম্মোহনী দৃষ্টি! যেন অবশ করে দিল ওর পুরো শরীরটা। হাত থেকে কখন যে ক্যমেরাটা পড়ে গেছিল খেয়ালই হয়নি।
হঠাৎ একটা ঝুপ করে শব্দ হওয়ায় হুঁশ ফিরল। দেখল মনীষা ছুটে এসে একটা বড় ডাল দিয়ে বাড়ি মেরে সাপটাকে ফেলে দিয়েছে গাছ থেকে! ছিটকে সরে এসেছিল প্রতীক। সাপটা কিন্তু ওদের দেখে তেড়ে আসেনি। বরং রাস্তার পাশ দিয়ে চলেই যাচ্ছিল, মনীষাই ছুটে গেল লাঠিটা নিয়ে। প্রতীক চিৎকার করে থামাতে গেল, আরে যেও না মণি, ও তো চলেই যাচ্ছে!
মনীষাও থামার পাত্রী নয়, ওর যেন জেদ চেপে গেছে। সাপটার পিছন পিছন দৌড়ে চলে গেল, পিছন থেকে রাহুলকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসছিল দীনেশও।
— উসে মত মারিয়ে দিদি। মত মারিয়ে। উও কুছ নেহি কারতা……
সবার সব বারণ অনুরোধ ভুলে একের পর এক আঘাত করতে লাগল সাপটাকে। বারবার কেঁপে উঠতে লাগল ঝোপটা।
— নোংরা জানোয়ার, এই নে এবার মর…..
শেষবারের মতো কেঁপে উঠল রাস্তার পাশের ঝোপটা। এটাই মনে হয় শেষ আঘাত ছিল ওর। লাঠির আগায় করে থেঁতলে যাওয়া সবজে মসৃণ শরীরটা নিয়ে এল প্রতীকের সামনে। চোখে-মুখে বিজয়িনীর গর্ব, পায়ের সামনে সাপটাকে ফেলে দিয়ে বলল, দেখো দেখো, এটাকে দেখে তুমি ভয় পাচ্ছিলে? এই পাতি একটা সাপ দেখে? এখন দেখো কেমন মরে পড়ে আছে… দেখো… একবার দেখো…!
মনীষার ঠোঁটের কোনায় একটা নারকীয় আনন্দের হাসি ফুটে উঠতে এই প্রথমবার দেখল যেন প্রতীক। আর কোন কথা বলেনি ও। মনীষাই বলে চলল,
— দাও এবার লাথি মেরে ফেলে দাও খাদটায়। দেখো… দেখো কোনও ভয় নেই। দাও দাও… দূর করে দাও জানোয়ারটাকে! বলে এক দলা থুতু ফেলল চরম ঘেন্নায়।
কথাগুলি বলতে বলতে আনন্দ আর একটা চাপা উত্তেজনা মিশে কেঁপে উঠতে লাগল মনীষার গলা!
— কী গো দাও দাও… ফেলে দাও নিজের হাতে!
কথাটা শুনে কি একটু সাহস জাগল ওর মনে? কোথায় যেন শুনেছিল আদিম মানুষ যখন জন্তু শিকার করে আনত, সেই শিকার করে আনা পশুর কাঁচা মাংস আর টাটকা রক্ত দলের সবচেয়ে ছোট সদস্যটাকে দিত। যাতে হিংস্র জন্তুর মৃতদেহ ও রক্ত দেখে ওর মনেও সাহস আসে। যাতে বাচ্চাটাও বুঝতে পারে ওই সেরা প্রাণী এই জগতের। জন্তু যতই বড় আর হিংস্র হোক না কেন ও সকলের শিকার করতে পারে। এই ভেবে একটা নকল বীরত্বের নেশায় ভেসে যেত বাকি সবার সঙ্গে!
সেরকমই একটা খুশির স্রোত বয়ে গেল যেন প্রতীকের মনেও। ছোটবেলা থেকে যে প্রাণীটাকে ভয় পেয়ে আসছিল সেটাই আজ ওর সামনে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সাহস আর গর্বে ডালটা নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল খাদের পাশটাতে, ঝুপ করে একটা শব্দ হয়ে মিলিয়ে গেল… সব শেষ!
গাড়িতে ওঠার পর থেকে লক্ষ করল দীনেশ কোনও কথা বলছে না ওদের সঙ্গে। হাসিখুশি ছেলেটা কেমন যেন কুঁকড়ে গেছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু হ্যাঁ আর না-তেই জবাব দিচ্ছে। মনীষা ইশারায় প্রতীককে বলল, ছাড়ো তো, পাহাড়ি গেঁয়ো ভূত যত, বাদ দাও!
সত্যিই দীনেশ কোনও কথা বলেনি বাকি রাস্তাটা। সন্ধে নাগাদ নাথাং পৌঁছে হোমস্টেটায় মাল তুলে দিয়ে গাড়িতেই থেকে গেছিল। কফি স্ন্যাক্স খেতেও আসেনি ওদের সঙ্গে। হোমস্টেটার মালকিন সুবলা আন্টিই খাবার পৌঁছে দিয়েছিল গাড়িতে, ওর কাছে।
রাতে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেলল প্রতীক, আন্টি দীনেশ ওরকম করছে কেন গো? শুরু থেকে তো ভালোই হাসিখুশি ছিল বেশ, হঠাৎ কি হল বলো তো আন্টি?
পাহাড়ের এই অংশে কম বাঙালি তো আসে না, ঠিক মতো বলতে না পারলেও বাংলা পরিষ্কার বুঝতে পারেন এই সুবলা তামাং!
মাঝবয়সি মহিলা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বলেছিল, কিসি কো জান হাম দে নেহি সাকতে, তো জান লেনা ভি তো নেহি চাহিয়ে, হ্যায় না বেটা?
কথাটার মানে বুঝেছিল প্রতীক। আসলে এরা খুব সরল-সিধে। এই পাহাড়, জঙ্গল আর এখানকার প্রতিটা জানোয়ারকে মন থেকে খুব ভালোবাসে এরা। একমাত্র খাওয়ার তাগিদ ছাড়া অকারণে বুনো জন্তুদের কোনও রকম আঘাত করে না। সেই প্রথম ট্রেকিংয়ের সময় থেকেই এই জিনিসটা দেখে আসছে ও। আজ কি চাইলে আটকাতে পারত না মনীষাকে? নাকি মনের গভীরে ও-ও চেয়েছিল সাপটাকেমেরে ফেলতে?
একটু সামলে নিয়ে প্রতীক বলল, কোনও উপায় নেই আন্টি?
— হ্যায় বেটা। কাল একবার নাহাকে উস মন্দির মে পূজা দে কে আনা, উসকে বাদ এক চিজ দুঙ্গা, বেটি কো দে দেনা, তু ভি পেহেন লেনা।
পুজো-আচ্চা তাবিজ-কবজে বিশ্বাস ওর কোনওকালেই ছিল না, তাও এই গ্রাম্য মহিলাটিকে কষ্ট দিতে মন চাইল না।
পরের দিন মনীষাকে একটা কবজ বানিয়ে দিয়েছিল সুবলা আন্টি। ওকেও দিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল না, তাও পরেছিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রতীক বুঝতে পারল আজ লেট মার্ক কেউ আটকাতে পারবে না। ধাক্কা দিয়ে মনীষাকে ডাকল একবার। না, উঠল না মনীষা। আবার ডাকল। ক্লান্ত গলায় জবাব এল, আজ আর পারছি না গো, খুব জ্বর জ্বর লাগছে, পার্থদাকে বলে দিও পারলে।
কপালে একবার হাত রাখল প্রতীক। কই জ্বর তো নেই, বরং ঠান্ডাই। থাক, হয়তো দুর্বল লাগছে। আর কিছু বলল না ও। নিজেই রেডি হতে চলে গেল।
আজ সকালেও সেই অস্বস্তিটাই রয়ে গেছে। খালি মনে হচ্ছে পিছনের কিউবিকল থেকে কিছু একটা উঁকি মারছে। মাথা উঁচিয়ে দেখল একবার। কই না তো, সুনন্দাই তো বসে কাজ করছে! ওকে আরও ওভাবে উঁকি মারতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কী রে মনীষা কেমন আছে রে? কাল যাবি বলছিলি স্কিনের ডাক্তারের কাছে, গেছিলি?
কোনওরকমে হুঁ হ্যাঁ করে উত্তর দিয়ে আবার বসে পড়ল সিটে। সত্যিই কি রাতে ঘুমটা ঠিক হচ্ছে না? কিন্তু স্পষ্ট যেন মনে হল এক জোড়া চোখ, মনে হচ্ছিল যেন ঘাড়ের কাছেই চলে এসেছিল শরীরটা!
সব মনের ভুল হয়তো। প্রেশারটা চেক করাতে হবে সন্ধেবেলায়। এখন একবার ফোন করা উচিত মনীষাকে, হ্যালো মণি?
ওপার থেকে ভেসে এল একটা ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠস্বর, হুম বলো।
— শরীর কেমন লাগছে এখন? জ্বর এসেছে নাকি?
— না গো, মালতিদি দেখে বলল জ্বর নেই। কিন্তু খুব শীত করছে গো, শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে খালি।
— ঠিক আছে, রেস্ট নাও, আমি পারলে তাড়াতাড়ি ফিরব আজ।
— হ্যাঁ চলে এসো। পার্থদা কিছু বলল নাকি?
— আরে ওসব ছাড়ো, ম্যানেজ হয়ে যাবে আমি বলে দিয়েছি…
— ঠিক আছে সাবধানে এসো, রাখলাম।
ফোনটা কেটে দিল প্রতীক। আজ কাজ একটু তাড়াতাড়িই গুছিয়ে নিতে হবে। প্রেজেন্টেশনটাও রেডি আছে। কোন রকমে অনির্বাণকে গছিয়ে দিতে হবে। অনির্বাণ এই প্রজেক্টের খুব ভালো রিসোর্স। একটু মাখন লাগালে ঠিক করে দেবে। এখন ভালো লাগছে না ভিডিও কনফারেন্স করে বকবক করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
কাজ মিটিয়ে ৮.৩০-তেই লগ আউট হয়ে গেল প্রতীক। নিজের ফোর হুইলারটা নিয়েই আসে। পার্কিং লট থেকে গাড়িটা বের করতে গিয়েই খেয়াল হল ব্যাপারটা।
গাড়ির ভেতরটা কেমন যেন স্যাঁতসেতে। কার ফ্রেশনারটা কি ফুরিয়ে এল? কই না তো? এখনও তো অনেকটা জেল বাকি আছে! যাই হোক একটু ফ্রেশ হোক ভেতরটা। এসিটা চালানো থাক। ভেজা ভেজা ভাবটা কেটে যাক। তারপর না হয় রওনা দেবে। গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল প্রতীক। সিগারেটটা শেষ করে নেভানোর সময় আওয়াজটা পরিষ্কার কানে এল। পাচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরেই, এখন আরও স্পষ্ট হল!
আওয়াজটা একদম পরিষ্কার। কোনও গোলমাল নেই। আওয়াজটা আসছে ওর গাড়ির ভেতর থেকেই। কেউ যেন টোকা দিচ্ছে গাড়ির সামনের কাচটায়। প্রতিটা ফাঁকা পার্কিং লটটায় যেন গমগম করে বাজছে—
টক… টক… টক… টক
একটা চাপা ভয় গ্রাস করে নিল যেন ওকে। তার সঙ্গে যোগ হল আরও একটা আওয়াজ। পরিষ্কার নয়, চাপা। কান পাতলে শোনা যাবে হয়তো কেউ যেন নিশ্বাস নিচ্ছে গাড়ির ভেতরটায়। কতক্ষণ ওরকম পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল জানে না প্রতীক। মনের সমস্ত জোর এক করে মাথাটা তুলে ঘুরল নিজের গাড়ির দিকে।
কই কেউ নেই তো! কিন্তু গাড়ির ভেতরের ফ্রেশনারের গন্ধ ছাপিয়েও নাকে ভেসে এল একটা জংলি গন্ধ। কোনও ঝোপঝাড় কেটে ফেললে বা মাড়িয়ে গেলে যেমন গন্ধ আসে, ঠিক যেন সেরকম। কিছু তো একটা ছিল ভেতরে! কিন্তু কী?
আর ভাবতে পারে না প্রতীক। স্টিয়ারিংটা ধরে কয়েকটা লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। মনে মনে ভাবে আসলে আজকাল বড় বেশি ভাবছে ও। একটু ছুটি লাগবে। সবাই মিলে একবার জামশেদপুর গেলে কেমন হয়? বাবা মায়ের সঙ্গেও দেখা হয়নি পুজোর পর থেকে। আর এই সময়টা শীত জাঁকিয়ে পড়লেও খুব সুন্দর একটা পরিবেশ থাকে শহরটাতে। ছুটি লাগবে একটা। ছুটি, কম করে সাত-আট দিনের। কালকেই একটা মেইল করে দিতে হবে। মনীষা যদিও অন্য প্রজেক্টে, যাই হোক পার্থদা মাইডিয়ার লোক। একটা ভ্যাট ৬৯ গছাতে হবে এই যা, সে ম্যানেজ হয়েই যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়িটা স্টার্ট দিল। কিছু গান শোনা যাক। কিন্তু ফোনটা কোথায় গেল? এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্যহাতে ব্যাগটা হাতড়াতে থাকল প্রতীক।
পাওয়া গেছে। কিন্তু এ কী! চার্জ তো ৫%-এ নেমে এসেছে, ধুস… নিশ্চয়ই কাল রাতে চার্জে বসাতে ভুলে গেছিল। ফোনটাকে চার্জিং পোর্টে বসিয়ে গ্লাভস বক্সটা খুঁজতে লাগল। এখানে একটা পুরনো পেন ড্রাইভ আছে ওর। আগে খুব শুনত ড্রাইভিং করতে করতে। সবই ওই একটা রেডিও পোডকাস্টের এমপিথ্রি, ‘সানডে হরর’ বলে। খুব সুন্দর করে এরা! যদিও এখন তেমন আর শোনা হয় না। তবে ফোনটা চার্জ হতে হতে এটাই সবচেয়ে ভালো অপশন।
উফফফ… এই তো পাওয়া গেল। ইউএসবি পোর্টে লাগিয়ে দিল পেন ড্রাইভটা। এদের গল্পের শুরুর থিম মিউজিকটাই হেব্বি ক্যাচি! ড্রাইভিং সিটে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিল প্রতীক। এসিটা বন্ধ করে জানলার কাচটা হালকা নামিয়ে দিল। একটা গল্প শুরু হয়েছে ‘মণিকান্তপুরের মুক্তো রহস্য’।
গল্পটা খুব বড় নয়। যাই হোক চলুক না। এই ভেবে স্টিয়ারিংয়ে মন দিল প্রতীক।
এই সবে শেষ হল গল্পটা। কতটা সময় যে কেটে গেছে বুঝতেই পারেনি প্রতীক। যে যাই বলুক এরকম একটা থ্রিলার গল্পের সঙ্গে লং ড্রাইভ, উফফফ…! সব টেনশন যেন কোথায় উবে গেছিল ওর, পরের গল্পটা সবে শুরু হয়েছে।
হঠাৎ ক্যাঁচ করে একটা ব্রেক কষে গাড়িটা থামিয়ে দিল প্রতীক। হাঁপাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে ওর… এই গল্পটা বাজছে কেন? এটা তো থাকার কথা নয় পেন ড্রাইভটায়। তাহলে নিশ্চয়ই মনীষার কাজ, স্পিকারে ভেসে আসছে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর!
“পেট্রোম্যাক্সের আলোতে বসে ডিনার খাচ্ছি, সবেমাত্র ডিমের ডালনায় একটা কামড় দিয়েছি…”
বাকি গল্পটা আর চলতেই দিল না প্রতীক, কোনওমতে পজ করে দিল গল্পটা। নাহ, এই গল্প শোনা যাবে না। কিছুতেই না। গল্পটার কথা ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে। ছোটবেলায় মাত্র একবারই পড়েছিল। দু’রাত ঘুমোতে পারেনি!
এখনও সেই কথাগুলি মনে পড়লেই শিরদাঁড়া দিয়ে হালকা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় ওর!
‘‘সাপের ভাষা সাপের শিস,
ফিস ফিস… ফিস ফিস…’’
পাশ থেকে একটা গাড়ি কাচ নামিয়ে গালাগাল দিয়ে চলে গেল ওকে, খেয়ালও করলো না। কোনও মতে বাঁদিক ঘেঁষে রেখে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করল প্রতীক।
উফফ আবার… আবার সেই ভয়টা ঘিরে ধরছে ওকে। নিজের হাতে ধরা হালকা ঘামে ভেজা স্টিয়ারিংটাকেই কেমন যেন ঘেন্না করতে ইচ্ছে করছে। সেই ভেজা ভেজা, ঠান্ডা ভাবটা যেন পুরো স্টিয়ারিংটার গায়ে। গাড়ির ভেতরের হালকা আলোয় স্টিয়ারিংয়ের হলদে চামড়ার কভারটাই কেমন যেন ভয় ধরাচ্ছে মনের ভেতরে।
কোনওমতে গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরাল প্রতীক। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা রিং ছেড়ে একটু যেন শান্ত হল।
ধুর! নিজের মনেই যেন একটা গালাগাল দিয়ে উঠল প্রতীক। একটু জোরেই দিয়ে ফেলল কি? রাস্তার পাশের পানবিড়ির দোকানের লোকটা তাকাল মনে হল যেন। নিজেকে একটু সামলে নিল। উফফ কী ভাবছে, কীসব করছে ও সারাদিন? খালি একটাই চিন্তা ঘুরে ফিরে আসছে কেন কে জানে?
একটা আওয়াজে চটকা ভাঙল। আওয়াজটা আসছে ওর গাড়ির ভেতর থেকেই। না আগের মতো সেই আওয়াজটা নয়। ফোন বাজছে ওর। সিগারেটটা হাতে নিয়েই বাঁদিকের দরজাটা খুলল ও। এই রিংটোনটা ওর চেনা। স্কাইপ কল একটা। অনেকদিন ব্যবহার হয় না। তাও আনইন্সটল করেনি।
মাইকেল! ভিডিও কল করেছে!
— হ্যালো ভায়া গাড়ি চালাচ্ছ নাকি? তাহলে সাইড করে নাও, অনেক কথা আছে।
গাড়ির সিটে এসে বসে প্রতীক। ও জানে অকারণে কল করার লোক মাইকেল নয়।
— না ভাই। বলতে পারো, গাড়িটা রাস্তার পাশেই দাঁড় করানো, প্রবলেম নেই। বলো।
প্রায় আধঘণ্টা কথা হল ওর সঙ্গে। মনীষার স্কিন প্রবলেমটা নিয়েই। কী একটা দাঁতভাঙা নাম বলল মাইকেল। hypekeratotic malassezia dermatotis না কী যেন! ওর বাবা নাকি কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন। লক্ষণগুলি নাকি সেদিকেই ইশারা করছে। রোগটা একটু প্যাঁচালো। কষ্ট দেয় বটে, তবে সেরে যায়। চিন্তার কিছু নেই!
প্রতীক জিজ্ঞেস করেছিল দরকারে আরও সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা ওর থেকে। একবারও ভাবেনি মাইকেল। ওর বাবার হাসপাতালের ই-মেইল, প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধের নাম, কিছু রোগীর কেস স্টাডির পুরো ফাইল প্রতীককে মেইল করে দিয়েছিল। আর বলেছিল কলকাতার ফিজিশিয়ানকে ফরোয়ার্ড করে দিতে। তাছাড়াও যদি কোনও সাহায্য লাগে যেন ইমেলে যোগাযোগ করা হয়। সবরকম সাহায্য করা হবে। যতই হোক উনিই তো রোগীকে দেখছেন সামনে থেকে।
প্রতীক জিজ্ঞেস করেছিল, তাতেও যদি কিওর না হয়?
মাইকেল হেসে বলেছিল, মনে রেখো ব্রাদার। আমিই এই প্রোজেক্ট ইউনিটের হেড। তোমার বা মনীষার মতো রিসোর্সকে অনসাইটের নামে লন্ডন অফিসে নিয়ে আসা আমার কাছে কোনও ব্যপারই না। এখানে এসেই না হয় ট্রিটমেন্ট করো দরকার হলে।
অনেকদিন পর আজ মন খুলে হাসছিল প্রতীক। সত্যিই তো, এরকম বন্ধু থাকলে আর চিন্তা কী?
দু’জন দু’জনকে শুভরাত্রি জানিয়ে কলটা কাটল। মনটা অনেক হালকা লাগছে যেন! মনীষাকে কি এখনই ফোন করবে একবার? নাকি সারপ্রাইজ দেবে?
একটা স্কিনের রোগ, তার জন্যে এত রাত ওদের নষ্ট হল, কোনও মানে হয়? নিজের মনে মনেই যেন হাসল প্রতীক!
কলটার জন্য আগের সিগারেটটা খেতেই পারেনি ঠিক করে। এবার বেশ আয়েস করে আর একটা সিগারেট ধরাল। একটা অদ্ভুত শান্তি যেন। আজ রাতের ঘুমটা খুব ভালো হবে। যাওয়ার সময় একটু মাটন কিনে নিয়ে যাবে নাকি? বেশ জমবে কিন্তু!
এক কিলো মাটন আর রাহুলের জন্যে একটা বড় চকোলেট, খেলনা গাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকল আজ প্রতীক। বিল্ডিংয়ের পার্কিং লটে গাড়িটা বন্ধ করে নেমে আসার সময়ও আওয়াজটা শুনেছিল প্রতীক।
টক… টক… টক… টক!
না ভয় পায়নি একটুও। বরং কাছে গিয়ে বনেটের একটু উপরে কান রেখে শুনেছিল। হ্যাঁ, যা ভেবেছে ঠিক তাই। আওয়াজটা আসছে ইঞ্জিন থেকেই। কোনও একটা ছোট পার্টস হয়তো লুজ হয়েছে। ওটা থেকেই আসছে। এরকম আওয়াজ বাইক থেকেও হয়।
আস্তে আস্তে সব ঘটনা যেন পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে… আওয়াজটা গাড়ির ভেতর থেকেই আসছিল। অফিসের পার্কিং লটটা ফাঁকা ছিল বলে অত জোরে শোনা যাচ্ছিল। আর গাড়িটার ভেন্টিলেশনের গোলমাল হয়েছিল। তাই ওরকম স্যাঁতসেতে হয়ে ছিল। আর ওই জংলি গন্ধটা… পার্কিং লটে তো আরও গাড়ি ছিল। কেউ নিশ্চয়ই চাকা দিয়ে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে এসেছে। ব্যাস… সেই গন্ধটাই হাওয়ায় এসে নাকে লেগেছে। নিজের বোকামির জন্যে নিজের উপরেই হাসি পেল ওর!
— শালা দিন দিন গাধা হয়ে যাচ্ছি ভুলভাল চিন্তা করতে করতে।
নিজেই নিজেকে গালাগাল দিতে দিতে লিফটের দিকে পা বাড়াল প্রতীক। আজ অনেকদিন পরে নীচের ফ্ল্যাটের ব্যানার্জিদার সঙ্গে দেখা হল। হেব্বি পরশ্রীকাতর লোক। প্রতীক গাড়ি কেনার পর থেকেই কেমন একটা ভাবে তাকায় যেন। এমনিতে প্রতীকও কথা বলে না। কিন্তু আজ যেন কিছুতেই আর রাগ হল না লোকটার উপর।
— কী গো বাবু কই? ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই এ ঘর ও ঘর খুঁজতে লাগল প্রতীক।
— আরে মালতিদি ওই জেনারেল স্টোরটায় গেছে। যাওয়ার সময় ওকে নিয়ে গেল!
— ঠিক আছে এটা লুকিয়ে রাখো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। টেবিলে খেলনা গাড়িটা রাখতে রাখতে বলল প্রতীক।
প্রতীকের হাবভাব দেখে আজ যেন চমকে গেল মনীষাও। বলা ভালো আনন্দই পেয়েছে বেশি। আজ প্রায় দু’সপ্তাহ পরে মানুষটা এত খুশি! বেশি কিছু জিজ্ঞেস করল না। জানে ঠিক খাবার টেবিলে বা রাতে শোবার সময় একটা ভালো খবর শোনাবেই প্রতীক। মনীষা জানে ওর এই ট্রিকটা। তাও বুঝতে দেয় না। ওকে সারপ্রাইজ দিচ্ছে ভেবে প্রতীক আনন্দ পায় তো পাক না।
বহুদিন পর শাওয়ার নিতে নিতে গলা ছেড়ে গান গাইছে প্রতীক, মনীষা দেখল মালতিদিও মুচকি মুচকি হাসছে রান্না করতে করতে। একবার আওয়াজ দিল মনীষা। না থামার কোনও নামগন্ধ নেই বাবুর।
ফ্রেশ হতে হতে প্রতীক ভাবল, সব ওই ব্যাটা মাইকেলের দোষ। কোন দুঃখে যে ওর থেকে ইবুকগুলি নিয়েছিল কে জানে? অনেক শখের মধ্যে মাইকেলের আর একটা শখ হল পুরনো রেয়ার বই সংগ্রহ করা। যেসব বই আর ছাপা হয় না এখন, সেগুলো ও দাম দিয়ে কিনে স্ক্যান করে ডিজিটালি স্টোর করে রাখে। কাউকে দেয় না। আসলে ওদের দেশে অ্যান্টি পাইরেসি রুল খুব কড়া, আমাদের দেশের মতো নয়। এখানে তো ফেসবুকে কবিতা লিখলেও চুরি হয়ে যায়। ঘুরে ফিরে দেখা যাবে যার লেখা কবিতা, তাকেই কেউ হোয়াটসঅ্যাপে ফরোয়ার্ড করে দিয়েছে। মাইকেলের সার্ভার থেকেই পড়েছিল বইগুলি। মাইকেল বলেছিল, এই ধরনের বইগুলিকে নাকি বলা হত পাল্প ফিকশন। ১৯২০-র দশকে আমেরিকায় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কোনও জ্ঞানগর্ভ সাহিত্য নয়, একদম সস্তা কাগজে ছাপানো চটুল গল্প। খুন হচ্ছে, চুরি হচ্ছে, হিরো এক রাতের মধ্যে আমেরিকা থেকে আফ্রিকা গিয়ে খুনি ধরছে, রানির হার উদ্ধার করে আনছে!
মাইকেল বলেছিল, গল্পগুলো খাজা হতে পারে ভায়া, কিন্তু একটা সময় খেটে খাওয়া অশিক্ষিত মানুষগুলি পড়ত আর হট কেকের মতো বিকোত এই বইগুলি। এমনকী অনেক নামী লেখক-লেখিকাও লিখেছিলেন নাম বদলে… বুঝলে? এখন এক একটা ভালো আর রেয়ার ইস্যুর দাম কয়েকশো থকে কয়েক হাজার পাউন্ড বা ডলার।
গল্পগুলি সত্যিই অদ্ভুত। অনেকটা মিল পাওয়া যায় বাংলার স্বপন কুমারের গল্পের সঙ্গেও। এরকমই একটা বইয়ের ডিজিটাল কপি পড়তে গিয়ে পেয়েছিল গল্পটা। কী যেন নাম ছিল বইটার?
মনে পড়েছে ‘ওয়্যার্ড টেলস’ না কী যেন। বইটার উপরে তারিখটা দেখে চমকে গেছিল। নভেম্বর ১৯২৯। ওটাতেই পড়েছিল গল্পটা। কী জানি নাম ছিল এখন আর মনেও নেই। আসলে মনে রাখতেই চায়নি প্রতীক! ভেবে দেখল ওটা পড়ার পর থেকেই ওর এই সব উদ্ভট চিন্তা ঘুরছে মাথায়, যত্তসব!
গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আর মাটন, উফফ! পাতের প্রতিটা কোনা যেন চেটে সাফ করে দিয়েছে প্রতীক। আঙুল চাটতে চাটতে উঠল টেবিল থেকে!
ব্যালকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট টানতে টানতে খোলা আকাশের নীচে শহরটার দিকে তাকালো একবার। সত্যি কতদিন পর এল আজ ব্যালকনিটায়। মনীষা কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি। সংবিৎ ফিরল ওর ডাকেই।
— বাবুর মনে হচ্ছে মুড আজ খুব ভালো, কী ব্যাপার? পাশের কিউবিকলের অনিন্দিতা ঝারি মেরেছে মনে হচ্ছে যেন!
এরপরের ঘটনাটা এতই আচমকা হল, মনীষা বুঝতেও পারেনি। মাথার পেছনে হাত দুটো দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়েছে প্রতীক। ঠোঁটে ঠোঁট আজ যেন কতদিন পর। ঘাড়ের কাছে, গালের কাছে প্রতীকের গরম নিশ্বাসটা পড়ছে যেন বারবার। পিঠে ঘাড়ে বুঝতে পারছে প্রতীকের আঙুলের নড়াচড়া। সত্যি আজ অনেক অনেকদিন পর… নিজেকে আলগা করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল মনীষা, কী হয়েছে বলো তো আজ তোমার? এসে থেকেই পাগলামি করছ!
সন্ধের পর থেকে হওয়া সব কথা মনীষাকে বলল প্রতীক। মাইকেল কী বলেছে, কী কী স্টেপ নিতে হবে সব এক এক করে। এও বলল, তেমন হলে লন্ডন! অনসাইট আর ট্রিটমেন্ট দুটোই চলতে পারে। সব মাইকেল ব্যবস্থা করে দেবে। কথায় কথায় এতদিন ধরে পেয়ে আসা ভয়টার কথাটাও বলে ফেলল। এমনকী আজকে সন্ধের ঘটনাটাও। মনীষা ওর পেটে একটা আলতো করে ঘুষি মেরে বলল, ভীতুর ডিম একটা, অনেক রাত হয়েছে চলো এবার!
— হুম। যাবো তো। শোনো না একটা কথা। বাবুকে নিয়ে এসো না আজ। আমাদের মাঝে নিয়ে শুই একটু। খুব ইচ্ছে করছে গো, কতদিন নিয়ে শুই না!
— আচ্ছা ঠিক আছে। দাঁড়াও দেখি মালতিদি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি!
— ওসব জানি না। নিয়ে এসো যাও।
— আচ্ছা বাবা, যাচ্ছি।
মালতিদি ঘুমিয়েই পড়েছিল, দু-তিনবার ডাকার পর উঠল। কোলে কোলে রাহুলকে নিয়ে এল মনীষা। দরজাটা ভেজিয়ে আসার সময় একবার মালতিদির সঙ্গে চোখে চোখ পড়ল ওর। তাকানোটা একটু অন্য রকম লাগল কি? চোখের মণিটা?
না না, বেচারির কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে বলে ওরকম ভাবে তাকিয়ে আছে হয়তো। এই ভেবে একবার হাত নেড়ে ঘুমিয়ে পড়ার ইশারা করে দরজাটা ভেজিয়ে দিল মনীষা। মালতিদি ঘাড় নেড়ে একটু হাসল যেন।
প্রতীক দেখল রাহুল নতুন আনা গাড়িটা নিয়েই ঘুমিয়েছিল। এখনও ঘুমের চোখে আঁকড়ে ধরে আছে। আর ছাড়াল না প্রতীক। ওইভাবেই শুইয়ে দিল, সত্যি নিজের সন্তানকে কাছে নিয়ে শোয়ার যেন এক অন্য অনুভূতি। কখন যে ঘুম চলে এসেছিল রাহুলের গায়ে আঙুল বোলাতে বোলাতে খেয়াল নেই আর।
কিন্তু এটা কী? কীসের একটা শব্দ হচ্ছে যেন ডাইনিং প্লেসে! কিছু একটা মাটিতে ঘষে ঘষে আসছে বা কেউ নিয়ে যাচ্ছে যেন। মালতিদি কি? লন্ড্রির ঝুড়িটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে কি তাহলে? সাইড টেবিলে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল প্রতীক। রাত ১:২১! মালতিদি পাগল হয়ে গেল নাকি?
শব্দটা কানে গেছে মনীষারও। অসুস্থ শরীরে ও উঠে বসেছে। একবার প্রতীকের দিকে তাকাল। সত্যিই আসছে আওয়াজটা বাইরে থেকেই। কিছু একটা ঘষে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। দরজার বাইরের আলোটা কেঁপে উঠল একবার। বাইরে এসেই দাঁড়িয়েছে যেন মালতিদি। তাহলে কি কাপড় কাচতে বসল নাকি এত রাতে? পাশেই তো কমন বাথরুমটা। বেড সুইচটা টিপে লাইটটা জ্বালাতে গেল প্রতীক। টিউবটা দপদপ করে উঠল। জ্বলল ঠিক করে, কী যে হয়েছে কে জানে!
ওই আলো-আঁধারিতেই যে জিনিসটা ওর নখের ডগায় আর হাতে লেগে থাকতে দেখল তাতে সমস্ত ঘুম ছুটে গেল প্রতীকের। হ্যাঁ এই আঙুল বুলিয়েই তো ঘুম পারাচ্ছিল রাহুলকে। কী লেগে আছে এগুলো?
আলোটা এবার জ্বলল স্থির হয়ে। আঙুলগুলো চোখের সামনে এনে দেখতে গেল প্রতীক। আবার টিউবটা দপদপ করে নিভে গেল… বাইরে শব্দটা আবার শুরু হয়েছে! এবার টোকা পড়ল যেন দরজায়। শীতের রাতের ফাঁকা ঘরে আওয়াজটা হাতুড়ি পেটার মতো লাগল যেন।
হয়েই যাচ্ছে আওয়াজটা… একবার… দু’বার… তিনবার… এবার থামল! না থামল কোথায়? আবার… আবার… আবার হচ্ছে!
মনীষা আওয়াজ দিল, কে? মালতিদি?
প্রতীক পরিষ্কার বুঝল মনীষার গলা কাঁপছে। একটা অজানা ভয়ে। দরজার ওপাশ থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল। কী আওয়াজ ওটা?
কেউ কি নিশ্বাস নিচ্ছে দরজার ওপারে? একটা তীব্র শ্বাসের শব্দ যেন!
মনীষা নেমেছে খাট থেকে। আটকাতে গেল প্রতীক। পারল না। কেউ যেন ওকে বোবা করে দিয়েছে।
ঠিক তখনই ওর নিজের কম্বলের তলাতেই কী একটা যেন নড়ে উঠল! ওর পায়ের কাছ থেকে ক্রমে উপরে উঠে আসছে প্রাণীটা! নরম ঠান্ডা ভেজা শরীরটা ওর শরীর বেয়ে উপরে উঠছে। প্রথমে পায়জামা পরে টি-শার্টের উপর দিয়েও বুঝতে পারল মরার মতো ঠান্ডা তেলতেলে শরীরটা ওর নিজের শরীরটায় ঘষে ঘষে উপরে উঠছে, যেন ওকে ডিঙিয়ে মাটিতে নামতে চাইছে প্রাণীটা!
নিজের সমস্ত মনের শক্তি জড়ো করে একটা ঝটকায় বিছানা থেকে নেমে পড়ল প্রতীক। কিছু না দেখেই কম্বলের তলার প্রাণীটাকে একহাতে টান মেরে নামিয়ে ছুড়ে মারল। সেটা ছিটকে গিয়ে পড়ল দরজার পাশে দাঁড়ানো মনীষার পায়ের কাছে। দেখে চমকে গেল প্রতীক। মনীষা খেয়াল করেনি। ওকে কিছু একটা বলতে গিয়েও কথা আটকে গেল আবার। কিন্তু ততক্ষণে দরজাটা খুলে গেছে! ঘরে যে প্রাণীটা ঢুকল সেটার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে প্রতীক!
উফফ! সেই চোখ! সবজে নীল রঙের, মণিটা লম্বালম্বি ভাবে চেরা! কী সাংঘাতিক দৃষ্টি চোখ দুটোয়। একরাশ ঘেন্না নিয়ে তাকিয়ে আছে মনীষার দিকে। তারপর নীচের দিকে তাকাল একবার। ছুড়ে ফেলে দেওয়া প্রাণীটার দিকে। প্রাণীটা নড়ছে, প্রতীক দেখল। দু’হাত দিয়ে কোলে তুলে নিল মাটিতে পড়ে থাকা প্রায় ওরই মতো দেখতে ছোট্ট জীবটাকে। প্রতীকের গলার কাছে কী একটা এসে যেন দলা পাকিয়ে গেল। নাম ধরে ডাকতে গেল কাউকে। পারল না। কোলের প্রাণীটার দিকে নজর গেছে মনীষারও। আর যেন কিছু করার নেই। অসহায় ভাবে মাটিতে বসে পড়ল মনীষা। ঘরের আলো আঁধারির খেলাতেই প্রাণীটা একবার ভেসে উঠছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা উল্টো দিকের রাস্তার গ্লো-সাইনের ভেসে আসা লাল নীল সবজে আলোয় যেন একটা অদ্ভুত খেলা চলছে ঘরটায়!
সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে প্রাণীটা প্রায় দশ ফুট লম্বা! হালকা সবজে রঙের আঁশে ঢাকা পুরো শরীরটা মানুষ আর সাপের মাঝামাঝি। সামানের দুটো হাতে বুকের কাছে জড়িয়ে আছে সেই ছোট্ট প্রাণীটাকে। দু’পা ফেলে এগিয়ে এল মনীষার কাছে। লম্বা লিকলিকে দু’ভাগ করা জিভটা বুলিয়ে নিল ওর মুখে, ঘাড়ে কাঁধে। ভয়ে ঘেন্নায় কুঁকড়ে আছে মনীষা। প্রাণীটা হাসল কি?
সাপ হাসে কিনা জানে না প্রতীক, তবু মনে হল যেন হেসে উঠল প্রাণীটা কিছু একটা ছিনিয়ে নেওয়ার আনন্দে!
ফোঁস ফোঁস শব্দ যেন গমগম করছে পুরো ঘরটায়। প্রাণীটা এগিয়ে আসছে প্রতীকের দিকে পা ফেলে, আবার সেই চোখটা…। হ্যাঁ সেই চোখটাই… এতদিন স্বপ্নে দেখছিল… প্রথমবার দেখেছিল সেই সিকিমের রাস্তায়… সেই শরীর… সেই নেশা ধরানো চোখ!
দুটো হাত একবার সামনে আনল প্রতীক। কোলে ধরে রাখা বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিল ওর দিকে!
প্রতীক কোলে তুলে নিতে গেল যেন… প্রাণীটা হাতটা সরিয়ে নিল চরম ব্যঙ্গভরে। যেন কত মজা পেয়েছে। ওর সারা শরীরে জিভটা বুলিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। মনীষা পা জড়িয়ে ধরতে গেল। ওকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল প্রাণীটা। শেষে দরজার কাছে এসে পা-টা একটা ঝাড়া দিয়ে মনীষার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে ডাইনিং প্লেসের বড় জানলাটার দিকে চলে গেল!
নিজের সব শক্তি দিয়ে একবার চিৎকার করতে গেল প্রতীক। না পারল না!
জানলা দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় শুধু দেখল কোলে শুয়ে থাকা বাচ্চাটা ওর দিকেই যেন তাকাল এক বার… শেষ বারের মতো!
না, এ হতে পারে না… ঘরে ফিরে এসে আর একবার কম্বলটা সরিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকল প্রতীক!
মনীষাও ফিরে এসেছে।
না নেই। রাহুল নেই। খেলনা গাড়িটা পড়ে আছে। আর আছে বিছানায় পড়ে থাকা এবং প্রতীকের নখের ডগায় লেগে থাকা… ছাল! হ্যাঁ সাপের শরীরের পরিত্যক্ত ছাল!
[এইচপি লাভক্র্যাফট ও জিলিয়া বিশপের ‘দ্য কার্স অফ ইগ’-এর ছায়া অবলম্বনে।
উৎসর্গ: এইচপি লাভক্র্যাফট ও জিলিয়া বিশপ, ওয়্যার্ড টেলস পত্রিকা, স্বপন কুমার এবং সত্যজিৎ রায়কে]
Tags: অর্ঘ্যজিৎ গুহ, গল্প, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সৌরভ ঘোষ, হরর গল্প
বই এবং ওয়েবপেজের একটা সমস্যা আছে৷ পৃষ্ঠা এবং স্ক্রলবার দেখে বোঝা যায় যে গল্পের শেষে পৌঁছে যাচ্ছি৷ এমন সাবলীল ভাষার ন্যারেশান এবং অনন্য প্লটের গল্পের জন্য সেটা আগে থেকে জেনে যাওয়া খুবই অন্যায়৷
দারুণ লাগলো।
দারুন হয়েছে ❤️ভালো লাগলো।
Asadharon
ধন্যবাদ আপনাকে
চমৎকার। লাভক্র্যাফট আর সত্যজিৎ— দু’জনের উদ্দেশেই বেশ ভালো শ্রদ্ধার্ঘ্য হয়েছে লেখাটা।
তোমাদের মত মানুষজন যখন কিছু বলে বা লেখে সেগুলি আমাদের মনের জোর দেয়, অনেক ধন্যবাদ দাদা!
অনবদ্য একটি লেখা। দুর্দান্ত প্লট।
অসাধারণ ❤️❤️.. অপেক্ষা থাকলো এরকম আরো লেখার..
ধন্যবাদ দিদিভাই
খুব সুন্দর। পড়তে পড়তে এক সময় মনে হচ্ছিল যেনো দৃশ্য গুলো চোখের সামনে ঘটছে। এরম আরো অনেক গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।☺️☺️
Pingback: ছাল – arghajitguha
ভয়ানক ভালো গল্প৷ গা শিউরে উঠছিল পড়তে পড়তে৷
ভয়াবহতায় আচ্ছন্ন হলাম। অসাধারণ লিখেছেন। এমন উপহার আরো পেতে চাই থ্রিলার প্রেমী পাঠক হিসেবে। শুভকামনা অপার ।।