জলমানুষ
লেখক: সাগরিকা রায়
শিল্পী: অন্তর্জাল
পিনাকের দিকে তাকিয়ে ভারি অবাক হয় সোহম। পিনাক বরাবরই রোগাপাতলার অপোজিট। খুব ফর্সা; উচ্ছ্বল শরীর। ইদানীং মাসলম্যান টাইপ শরীরের রক্তমাংসের পিনাককে কেন যেন জল টলমল চৌবাচ্চা বলে মনে হয় ওর। শীতে যে ঝড়টা হল, তারপর থেকেই এরকম মনে হয়। ডুয়ার্সে বেড়াতে গিয়েছিল ওরা দুজনে। গিয়ে তো যাকে বলে মোহিত পিনাক। ক্লোরোফিলের গন্ধে মাতোয়ারা বনভূমি ওকে আবিষ্ট করে ফেলেছিল। সোহমের পড়াশোনার অভ্যেস। বেড়াতে গিয়েও বই হাতে রেখেছে। পিনাক একাই বন-বাংলোর সামনে পায়চারি করে। সূক্ষ্ম নেট ঘেরা বারান্দায় বসে রাতের বন দেখে। মাঝে কখনও কেয়ারটেকারের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। বাধ্য ছাত্রের মত বন নিয়ে, বনের পশুপাখি নিয়ে, বনের চরিত্র নিয়ে আলোচনা করে। কেয়ারটেকার স্থানীয় লোক। রাজবংশী। ভারি সুন্দর বাঁশি বাজাতে জানে। ভাওয়াইয়া গান জানে। সোহম ঘরে বসে গভীর মনোযোগে পরীক্ষার জন্য প্রিপেয়ার্ড হতে থাকে। ফিরে গিয়ে কিছু ইম্পরট্যান্ট ক্লাস করতে হবে ইউনিভার্সিটিতে। পিনাক আর কেয়ারটেকারের কথাবার্তার আওয়াজ শোনে ও। মাঝে মাঝে বই রেখে উঠে যায় পিনাককে সঙ্গ দিতে। পিনাক হাসতে থাকে ওকে দেখে-
“যা। বই নিয়ে থাক। আসতে হবে না।”
সোহম বোঝে এখানে আসার আগে পিনাক কত স্বপ্ন-মুহূর্ত রচনা করেছিল। পূর্ণিমার রাতে দুজনে চাঁদে মাখামাখি বন দেখবে ঘুরে ঘুরে। হরিণের দল জল খেতে যেতে যেতে পেছন ফিরে দেখে নেবে ওদের। কিন্তু মোটে ভয় পাবেনা। আসলে জিম করুক আর যাই করুক, মনে মনে পিনাক আস্ত কবি। জীবনানন্দের ফ্যান।
সোহম চেইন স্মোকার। তবু পিনাক বলেছে, “তুই বন দেখতে গিয়ে স্মোক করবি না। বন বিরক্ত হয়।”
ওর মনটা বুঝেই সোহম স্মোক করাই ছেড়ে দিয়েছে। বাজে অভ্যাস গেলেই ভাল। তাছাড়া পিনাক খুব মেইনটেন করে চলে। একসঙ্গে বেড়াতে গিয়ে মন কষাকষি না হয়, সেদিকে নজর রাখে সোহম। সেদিন ঝকঝকে দিন ছিল। আগাম আভাস কিছুই ছিলনা। অন্ততঃ ভবিষ্যৎ ঘটনার সিরিয়াসনেসটা ওরা কেউ বোঝেনি। রোজের ঝলমলে রঙে ভরা দিনই তো ছিল! ওরা ঠিক করেছিল চুকচুকি টাওয়ারে যাবে। কিন্তু হল না।
সেদিনই বিকেলে এল ঝড়। পিনাক যথারীতি বাইরে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধের সাজে সাজুগুজু করার সময় পৃথিবীর। তখন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই ঝড় এল। ঝড় উঠতেই প্রবল শোঁ শোঁ শব্দে জঙ্গলের উন্মত্ততা প্রকট হয়ে উঠেছিল।
সোহম ডেকেছিল পিনাককে, “ভেতরে আয়! গাছের ডাল ভেঙে পড়তে পারে!”
পিনাক জোরে চেঁচিয়ে বলেছিল, “কি অসাধারণ দৃশ্য! বন যেন নেচে উঠেছে। মনে হচ্ছে রিং-এ দাঁড়িয়ে অপোনেন্টের সামনে।”
পিনাকের জোর গলার হাসির শব্দ ভারী পাত্রের ভেঙে পড়ার মত টুকরো টুকরো হয়ে পড়ল যেন। সেই শেষবার। তারপর আর পিনাকের সাড়াশব্দই পায়নি সোহম। তারপর থেকেই পিনাককে আর দেখা যায়নি। হাসি তো দূরের কথা। যেন ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। পাগলের মতই খুঁজেছিল সোহম। কেয়ারটেকার কিছু বলতে পারেনি। ঝড় উঠতেই সে তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে নাকবাবুকে দেখেছিল তাড়াতাড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে। ভেবেছিল বাবুটা ঝড় দেখতে নামছে। আর সে কিছু দেখেনি! তবে হ্যাঁ, ব্যাপারটা তার ভাল লাগেনি। শহরের বাবুদের এই এক কাণ্ড! শহর ছেড়ে বাইরে এলে পাগলা পাগলা হয়ে যায়। কি যে করবে, কি যে করবেনা ‘বুঝিবার না পারে’।
যাকে বলে হাপিশ হয়ে যাওয়া, তাই হয়ে গেল পিনাক। খোঁজাখুঁজি কম হল না। থানা পুলিশ হল। তোলপাড় করে ফেলল সোহম। স্বজন মহলে খবর নিয়ে জানতে চেয়েছে পিনাক কি ওকে চমকে দিতে লুকিয়ে আছে? এই প্রশ্নও এসেছে, কোন বন্য জন্তু কি…? না। এদিকে বার বার ফোন আসছে। পিনাকের বাবা বাইরে থাকেন। ওর মা বারবার ফোন করছেন। আত্মীয়মহল, ওদের বন্ধু বান্ধব স্বজন-গুষ্ঠি আরও পাগল করে দিল। “পিনাক কি ফিরেছে?” “তোদের বুঝি ঝগড়া হয়েছিল?” সোহমের তখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল দশা। পিনাক কি বনের দিকে গিয়েছিল? তাহলে কি সত্যি কোনও জন্তু …? তাহলে ওর পরিচ্ছদের অংশ বিশেষের সঙ্গে বডি পার্ট কি কিছু পাওয়া যেত না? এই অবস্থা চলছে যখন, ঠিক পাঁচদিনের মাথায় এল পিনাক। যেন এতক্ষণ বারান্দায় বসেছিল। চোখে কেবল সদ্য ঘুম ভাঙার রেশ। যে পোশাক পরেছিল, সেটাই পরে আছে। কোথাও ছিঁড়ে খুঁড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই! বস্তুত পিনাক যেন নতুন হয়েই এসেছে। ওর চোখে সবই যেন নতুন! অবাক অবাক দৃষ্টি। মানুষের শরীরের সত্তর ভাগ জলে পূর্ণ। বাকি ত্রিশ ভাগ জল কোথা থেকে নিয়ে এল পিনাক? চলাফেরা করার সময় টলমল টলমল করতে থাকে। কথাও খুব কম বলছে। যখন বলে, সোহম তটস্থ হয়ে থাকে। এই বুঝি মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে জল বেরিয়ে এল পিনাকের! ওকে দেখে অমনটা মনে হয় সোহমের। যেন প্রাণের সমস্ত উপাদানে পূর্ণ তরলে তৈরি হয়ে এসেছে পিনাক।! যেন… জলভরা বেলুন। কোথায় ছিল এতদিন মনে নেই ওর। ঠিকঠাক কিছু বলতে পারেনা। কখনও বলে বনের ভেতরে গিয়ে শুয়ে ছিল, কখনও কি বলবে ভাবতে থাকে। বেশি জিজ্ঞাসা করলে থমথমে হয়ে যায়। আগের মতো স্বভাবটাও নেই। যে পিনাক এত হাসিখুশি ছিল, সে এখন মোটে হাসে না। কতরকম মজা করতে জানতো। একদিন মুখ কাঁচুমাচু করে এসে বলল– “ব্যাড নিউজ! মোবাইল হারিয়েছি।”
শুনে স্বভাবত সোহম হতাশ হয়ে যাচ্ছে দেখে আশ্বস্ত করেছে- “গুড নিউজ। সেটা খুঁজে পেয়েছেন শাহরুখ খান।”
জানা জোক না জানার ভান করে ওর সঙ্গে তাল মেরে সোহম জানতে চেয়েছে, “বেটার নিউজ কী?”
– “কাল তাঁর সঙ্গে ডিনারে ইনভাইট করেছেন। দুজনে হাসিতে ফেটে পড়েছে।”
সেই পিনাককে এখনও খুঁজে পায়নি সোহম। ওর বেস্টফ্রেন্ড চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে সেই ঝড়ের দিন থেকে। যে ফিরে এসেছে তাকে চেনে না সোহম। এই পিনাককে তার ভয় হয়। বস্তুত পাশাপাশি বসে আড্ডা দিতেও অস্বস্তি হয়। অথচ ঝড়ের আগের পিনাক কেমন আড্ডাবাজ ছিল। কথায় কথায় কবিতা বলে উঠত। বাইসেপ ট্রাইসেপ নিয়ে মোক্ষম লেকচার দিত। নিজেই একটা সাইক্লোন ছিল যেন। জীবনের স্বাদ চেটেপুটে খেতে জানতো ও। এ কে ফিরে এল? এখন ডুয়ার্স থেকে ফিরে এসে ও নাকি ওয়ার্ক আউট করেনা! সদ্য শেখা ডাম্বেল ফ্লাই নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস নেই। সব ভুলেই গেছে ও। কেন পিনাক এমন হয়ে গেল! এক রক্তমাংসের তরতাজা ছেলে কী করে এক চৌবাচ্চা জল হয়ে গেল! ওদের বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পিনাককে অবজার্ভ করে সোহম। মাঝে দুদিন দিল্লি যেতে হয়েছিল একটি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। ফিরে আসার দিন এয়ারপোর্টে পৌঁছে লাউঞ্জের ভিড় এড়িয়ে একধারে বসেছিল। একমনে পিনাককে নিয়ে ভেবে যাচ্ছিল।
এই পরীক্ষাটা পিনাকেরও দেওয়ার কথা। ফর্ম ফিল আপ করেছিল দুজনেই একই সাথে। কী হয়ে গেল! সেদিনের ঝড়ই কি এর জন্য দায়ী? এমন কী ছিল সেদিনের হাওয়ায়, যা উড়ে এসে পিনাককে টেনে নিয়ে পুরো পালটে দিয়েছে! সেই মারাত্মক ঝড় কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল পিনাককে! চৌম্বকীয় ঝড়ের কথা শুনেছে। সেদিন কি তেমনই অদ্ভুত কিছু হয়েছিল? কেবল শরীরে নয়, পিনাক স্বভাবেও পালটে গেল? ইচ্ছে করেই পিনাকের কাজিন রাঘবকে আসতে বলেছিল সোহম। যা ভেবেছিল তাই হল। পিনাক রাঘবকে চিনতে পারেনি। রাঘব ভীষণ আপসেট। বারবার বলছিল– “তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? আক্টিং নাকি?” বারবার বলাতে হালকা অভিনয় করে দিল পিনাক। ঘক ঘক শব্দে হাসল– “মজা! মজা!” মানে এতক্ষণ তিনি রাঘবের সঙ্গে মজা করছিলেন! রাঘব চলে যাওয়ার সময় করুণ চোখে পিনাককে দেখেছিল। সেদিন পিনাকের মা সোহমকে ছাড়লেন না– “আজ থেকে যাও। আমি খুব আনবিয়ারেবল অবস্থায় আছি। ওর বাবা ফিরে এলে বাঁচি। স্কাইপে কথা বলছি। ওকে দেখিয়েছি। কিন্তু তাতে কী?”
কথা ফেলতে পারল না সোহম। রাতের খাওয়া সেরে নিল ওরা। সোহম বা পিনাকের মা কিছুই প্রায় খেল না। পিনাক অভ্যাসের বিপরীতে গিয়ে গাপ গাপ করে খেল। মাঝরাতে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে সোহম। পিনাক হয়তো ঘুমিয়ে পড়ে! ঠিক জানেনা ও। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঘাড় উঁচু করে পিনাককে অবজার্ভ করে। থ্যালথেলে ঢ্যালঢেলে পদার্থটা পিনাক? যে কিনা ডব্লিউ ডব্লিউ ই-র জন সিনার মতো শরীর বানাতে চেয়েছিল? ও কি সত্যি ঘুমাচ্ছে? নাকি ভান? এখন একথাও মাথায় আসছে সোহম ঘুমলে ও কি কোন ক্ষতি করে দেবে? মেরে ফেলবে কি? সত্যি বলতে এই পিনাকের মধ্যে মানুষের মতো আচরণ দেখেনি সোহম। কেমন বিশ্রী ভাবে খায়। প্রচুর পরিমাণে খায়। যেন হাজার বছর ধরে কিছু খায়নি! লাস্ট সানডেতে ইচ্ছে করেই সোহম পিনাককে বলেছিল– “মেগা চ্যানেলে সিনেমা দেখব রাতে।” পিনাক অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। যেন ওর অজ্ঞতাটা লু্কাচ্ছিল। সোহম বুঝেছিল পিনাক মেগা চ্যানেলের সিনেমা ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়! অথচ পিনাকের কী ভীষণ সিনেমার শখ!
শুভমকে জানাতে বাধ্য হয়েছে সোহম পুরো অকারেন্স। শুভম ওদের ফ্রেন্ড। ক্লোজ ফ্রেন্ড। শুভম বলেছিল পিনাককে কাউন্সেলিং করা দরকার। কাল মিট করছি। এসেছিল শুভম। কথা বলেছে পিনাকের সঙ্গে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছে। বলেছে– “তুই আরেকবার ডুয়ার্সে যা পিনাককে নিয়ে। আমার তো খুব একটা ভাল ঠেকছে না। সঙ্গে পিনাকের বাবা মা গেলে ভাল হয় তোর পক্ষে। আবার কী কান্ড করে বসে ও!”
এয়ারপোর্টে লাউঞ্জে বসে সোহম ডিসিশন নিয়ে নিল। যেতে হবে। ফের সেখানে যেতে হবে। পিনাকের কিছু পরিবর্তন হবে কিনা জানেনা ও। কিন্তু সেখানে গেলে পিনাকের হাবভাবে কিছু কি পরিবর্তন আসতে পারে? দেখা যাক। দুপুর দুটোতে কলকাতায় নেমে গেল ও। পিনাকের মাকে বুঝিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারলে ভাল। কিন্তু পিনাকের বাবা চলে এসেছেন শুনে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সোহমের। ওর পক্ষে পুরো সিচুয়েশনটা সামলানো ইজি হল এতে।
পরের দিন ডুয়ার্স। পিনাক কোনও প্রশ্নই করেনি। আলাভোলা ভাবে সঙ্গী হয়েছে। কয়েক লিটার জল নিয়ে ভ্রমণে যাচ্ছে যেন সোহমরা। কোটি কোটি কোষের সমন্বয়ে মানব দেহ গঠিত। এটি একটি জৈবিক যন্ত্র মাত্র। মানুষের মন কি এই জৈবিক যন্ত্রের মাধ্যমে কাজ করে? তাহলে পিনাকের মন কার মাধ্যমে কাজ করে? ওর শরীরে কোষ আছে? স্নায়ুতন্ত্র, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি? হার্ট, কিডনি, লিভার? অমনভাবে হাঁটে কেন পিনাক? ওর পায়ে হাড় নেই? ফিমার? একটি অক্সিজেন পরমাণু, দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে একসাথে বাসা বেঁধে আছে পিনাকের শরীরে?…
ঝিপ ঝিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। এরকম বৃষ্টি দেখলেই পম্পাদিদের বাড়ির কথা মনে পড়ে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইত পম্পাদি– এ গানের প্রজাপতির পাখায় পাখায় রঙ ছড়ায়…! ছড়ায় নাকি ঝরায়? ভুল হয়ে যাচ্ছে আজকাল! সোহম শ্বাস ফেলে!
অবশেষে সেই পুরনো বাংলো। বন বাংলো। পর্যটক এখানে খুব বেশি আসেনা বলেই বাংলো পেতে অসুবিধে হয়নি। তাছাড়া পিনাকের বাবা আগের দিন খোঁজখবর করেছিলেন বাংলো বুক করার জন্য। তাতেও কাজ হয়েছে। এখানে এসে পিনাক আরও থুমথুমে। নড়ে না, চড়ে না। কেয়ারটেকার জানতে চেয়েছে নাকবাবু অসুস্থ কিনা। কেয়ারটেকার পিনাককে চিনেছে। পিনাক কিন্তু কেয়ারটেকারকে চিনতেই পারেনি।
সেই রাতেই এল ঝড়টা। যেন ওদের এখানে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। তুমুল ঝড়ে আকাশ মাটি বনভূমি উথাল পাথাল! পিনাক ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। তিনজনে মিলে এক মুহূর্ত চোখের বাইরে রাখেনি পিনাককে। কী করবে পিনাক আজ? দেখতে হবে। পিনাক ঝড়ের দিকে চেয়ে থেকে থেকে বিভোর। সোহম দেখল সমস্ত পৃথিবী মদমত্ত মাতালের মতো চিৎকার করে যাচ্ছে! ঘোর অন্ধকারে ছুটে যাচ্ছে কালো বাতাসের স্রোত। খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সোহম। সেই অবকাশে ঝড়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল পিনাক। ঘোর অন্ধকার লুফে নিল ওকে। ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন পিনাকের মা। সোহম কি করবে বুঝতে না পেরে ছুটে যেতে চাইল পিনাকের পেছনে। অমানিশার অতলে পিনাককে খুঁজে পেল না সোহম। আগের মতো পিনাক হাপিশ হয়ে গেছে!
থরথর করে কাঁপছেন পিনাকের মা। ওর বাবা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো ছেলের ফিরে আসার প্রতীক্ষা করছেন।
পরের দিন পিনাক ফিরে এল। টলমল করতে করতে। স্থির চোখ। এবারেও বলতে পারল না কোথায় গিয়েছিল। কেন ঝড়ের বুকে ওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। একটা বিষয় লক্ষ্য করে চমকে গেল সোহম। পিনাক আজ খেতে বসে কেয়ারটেকারকে ডেকে রান্নার সুখ্যাতি করেছে। আগের পিনাকের মতো। এর বেশি আর কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। পরদিন ফিরে এল ওরা কলকাতায়।
পিনাককে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কোনও লাভ হয়নি। বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা চলছে।
আজ একমাস পরে ফের আকাশ কালো করে মেঘ থমকে আছে। ঝড় উঠেছে। জানালা দিয়ে ভেজা ভেজা হাওয়া আসছিল। সঙ্গে ঝড়ের বুনো গন্ধ।
– “এই গ্রহটা আমার খুব ভাল লাগে। বেশ পছন্দ। পিনাক জানালার সামনে দাঁড়িয়ে।”
– “কিছু বললি পিনাক?”
– “উঁহু। কিচ্ছু বলিনি। উফ, আমার কেমন লাগছে রে। দম আটকে আসছে মনে হয়।” পিনাক হাঁসফাঁস করে, “এই গ্রহে শ্বাস নিতে মাঝে মাঝে একটু অসুবিধে হচ্ছে। তরলে থাকি আমরা। মাছের মতো শ্বাসযন্ত্র কিনা…” পিনাক ছটফট করে।
জানালার থেকে মুখ ফিরিয়ে পিনাক সোহমকে আঁকড়ে ধরল। পাঁচ বছর ধরে ওদের বন্ধুত্ব, তবু আজ পিনাককে অচেনা মনে হল সোহমের। ওর বাবা মাকে ডাকতে গিয়ে সোহমের অস্বস্তি হচ্ছিল কেন কে জানে! ও শিহরিত হচ্ছিল ত্রাসে। পিনাক কাদের কথা বলছে? কারা তরলে থাকে! মাছের মতো শ্বাসযন্ত্র? তাহলে কি তরলময় কোনও গ্রহ থেকে কেউ এসেছে পিনাক হয়ে? রক্ত মাংসের পিনাক চলে গেছে তাদের জগতে? এভাবে কি আর কেউ এসেছে? ‘আমরা’ শব্দটা বলল কেন পিনাক?
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। পিনাককে আর ধরে রাখতে পারছে না সোহম। পিনাক টলমল করছে। সোহম অবাক হয়, পিনাকের শরীরে একটু চাপ পড়লে সেখানকার তরল শরীরের অন্য অংশে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে। পিনাক তরল হয়ে ফিরে এসেছে! আবদ্ধ জায়গায় একরাশ প্রাণময় তরল। সেদিনের ঝড় মাংস মজ্জা সমন্বিত পিনাককে তরলীকৃত করে দিয়েছে! অথবা একরাশ তরল পিনাক হয়ে ফিরে এসেছে। সত্যি কি জলভরা বেলুনটি পিনাক? পৃথিবী গ্রহকে দেখে চমৎকার গ্রহ বলল কেন পিনাক? এই গ্রহ ওর চেনা। একে দেখে গ্রহ শব্দটাই বা বলবে কেন? ও কি এই গ্রহের নয়? তাহলে কে এ? কে ফিরে এল পিনাক হয়ে? নাকি এ পিনাকই! এক অবিশ্বাস্য ঝড় পালটে দিয়েছে পিনাককে? পিনাকের বদলে তরল থেকে উঠে এসেছে এক চৌবাচ্চা তরল! হুবহু পিনাক হয়ে!
পিনাক আঁকড়ে ধরেছে সোহমকে। অদ্ভুতভাবে ধরেছে। যেন নখ বসে যাচ্ছে সোহমের শরীরে। ভিজে যাচ্ছে সোহম।
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। প্রাণের উপাদানে পূর্ণ তরলে কিছুটা ‘পিনাককে’ ভরে দিয়েছে কেউ। খানিকটা রিপেয়ার্ড হয়ে ফিরে এসেছে পিনাক।
Tags: অন্তর্জাল, গল্প, জলমানুষ, প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সাগরিকা রায়