জিগজ্যাগ ও দুজন রানী
লেখক: নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী
শিল্পী: সৌরভ দে
জিগজ্যাগ ও দুজন রানী
লেখক – নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী
অলংকরণ – সৌরভ দে
রিদমের মাথায় ভূত – ব্যান্ডেল, ২০০৮
ছন্দা নতুন বাড়িটায় এসে বেশ ঘাবড়েছিল। বাড়িটা তার কাছে নতুন হলেও এমনিতে বেশ পুরানো। প্রায় তিনশো বছরের। এক সাহেবের কাছ থেকে কিনেছিলেন ছন্দার ঠাকুর্দার বাবা। মূল কাঠামোটা একই রেখে সংস্কার করেছিলেন। বাড়িটার সামনে একটা রাধাকৃষ্ণের মন্দির আর একটা বিশাল কুয়ো। কুয়োটা শুকনো। দেখলেই বোঝা যায় এটা মন্দিরের থেকেও পুরানো। ছন্দা বাগানের মালি কেষ্টদাকে জিজ্ঞেস করেছে।
কেষ্টদা বলেছে – কুয়োটা নাকি শেরশার আমলের।
সেটা যদি সত্যি হয় তবে কুয়োটা বাড়িটার থেকেও পুরানো। এই বাড়িটা তার বাবা সদ্য হাতে পেয়েছে। বহুদিন শরিকি বিবাদে এ বাড়িতে কেউ থাকত না। ছন্দার বাবা বিশুবাবু বড় ব্যবসায়ী। অনেক কেসটেস লড়ে বাড়িটা পেয়েছেন গতবছর। ছোটখাটো মেরামত করে, রংটং করিয়ে এ বছর মেয়ের গরমের ছুটির সময় বাড়ির সবাইকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে চলে এসেছেন।
ছন্দার প্রবল উৎসাহ দুটো ব্যাপারে। প্রথম উৎসাহ ভয় পেতে। সে খুবই ভয় পাচ্ছে। তার ভয়, যখন তখন সে একটা ভূত দেখে ফেলতে পারে। তার দ্বিতীয় উৎসাহ, সেই ভূত খুঁজে বেড়ানোতে। ভয় পেতে পেতেই সে বিভিন্ন ঘরের দরজা খুলে দেখছে। দুপুরবেলা বিশাল বাগানে গাছের আনাচে-কানাচে উঁকি দিচ্ছে। তার স্থির বিশ্বাস এরকম একটা পুরানো বাড়িতে সে ভূত খুঁজে বার করতে পারবেই।
ভূতটাকে বা ভূতগুলোকে দেখলে সে কী করবে তাও মোটামুটি ভাবা আছে। প্রথমেই সে চোখ বুজে ফেলবে। তারপর একটা বিশাল চিৎকার দেবে। আশা করছে তার মধ্যেই সে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারবে। একবার অজ্ঞান হয়ে যেতে পারলেই আর কোনও চিন্তা নেই। বিভিন্ন ভূতের গল্পের বই পড়ে আর সিনেমা দেখে সে বুঝে গিয়েছে যে, ভূতেরা অনেকটা ভাল্লুকের মতো। খুবই সরল প্রকৃতির। একবার অজ্ঞান হয়ে গেলেই আর তারা কিছু করে না।
কিন্তু আসল মজাটা হবে তখনই। তাদের ক্লাসের কারোরই আসল ভূত দেখার অভিজ্ঞতা নেই। সে এই গল্পটা সারাবছর ধরে বন্ধুদের কাছে করতে পারবে। তার বয়েস এখন বছর তেরো। সে সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছে, এই বয়সেই ভূত দেখে ফেলতে পারলে আর ভাবনা নেই।
সন্ধেবেলা রোজ তার মা মন্দিরে পুজো করে। সে কুয়ো পাড়ে বসে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। হালকা ধুপধুনোর গন্ধ ভেসে আসে। তার খুব ভালো লাগে।
তার মা মিতালি দেবীর এ মুহূর্তে জীবনে দুটোমাত্র শখ। প্রথমটা যেটা, সেটা পুরানো। হিরো চন্দন মালের সিনেমা দেখা। ছন্দার বাবা বিশুবাবুর টাউনে পাশাপাশি দুটো সিনেমা হল আছে। তার অনেক ব্যবসার মধ্যে একটা। সেই হলে ফার্স্টডে ফার্স্টশোতে চন্দন মালের সিনেমা দেখা থেকে মিতালিদেবীকে কেউ আটকাতে পারবে না।
দ্বিতীয়টা প্রায় নতুন। এ বাড়িতে আসা ইস্তক পুজো করা। মন্দিরটিকে মনের মতো সাজিয়েছেন। মিতালির ঘোরতর সন্দেহ এইসব পুরানো বাড়িতে ভূত আছে। থাকতে হবেই। চন্দন মালের অন্তত আটটা এরকম সিনেমা তিনি দেখেছেন। হানাবাড়ির ফিসফাস, ভাঙ্গাবাড়িতে রক্তচোষা, বাবা কেন তুলল পটল? ইত্যাদি ইত্যাদি। সবগুলোর ডিরেক্টর প্রভঞ্জন চৌধুরী। চন্দন মাল আর প্রভঞ্জন চৌধুরীর সিনেমার প্রতিটি সিন, প্রত্যেকটা ডায়লগ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন মিতালি। বাড়িতে ঢোকার সময় ঘটা করে যাগযজ্ঞ করিয়েছেন। তার খুব ইচ্ছে বছরখানেক এ বাড়িতে প্রচুর পুজোআচ্চা হোক। একজন চব্বিশ ঘন্টার ঠাকুরমশাই রাখা হয়েছে। ভূতের সাধ্য নেই তাহলে এ বাড়িতে ঢোকে।
পুজো দেখতে দেখতে একসময়ে হঠাৎ ছন্দার মনে হল তার পিছনে কে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশুবাবু অনেকদিনই এই সময় ফিরে মন্দিরের কাছে চলে আসেন। ছন্দা তার বাবা এসেছে ভেবে পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পেলনা। তার গাটা একটু ছমছম করে উঠল। অনেকটা কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলে যেমন মনে হয়। এখন সবে সন্ধেবেলা। বেশ আলোটালো জ্বলছে। সামনে মন্দিরে তার মায়ের পাশে পূজারী ঠাকুরমশাই, মালি কেষ্টদার বৌ, দু-একজন কাজের লোক এরকম বেশ অনেকে বসে আছে। সে উঠে গিয়ে মন্দিরের চাতালে গিয়ে বসল। মুখ ফিরিয়ে কুয়োটার দিকে তাকিয়ে রইল। কাউকে দেখতে পেল না।
এ বাড়িতে ছন্দাকে আলাদা একটা ঘর দেওয়া হয়েছে। সে নিজেই জোর জবরদস্তি নিয়েছে। সেখানে সে অনেক রাত অবধি জেগে জেগে ভয়ে কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে থাকে। পাশের ঘরেই তার বাবা মা শোয়। রাতে বাবা দুবার তার দরজা ধাক্কিয়ে জিজ্ঞেসও করে যায় – মা, সব ঠিক আছে তো?
সে ঘুমের মধ্যেই হুঁ হাঁ করে উত্তর দেয়।
চাইলেই সে বাবা মায়ের সঙ্গে শুতে পারে। কিন্তু শোবে না। সেখানে শুলেই সে নিজের একটা গোপন শখ পূরণ করতে পারবে না।
সে প্রচুর বই পড়ে। ছোটদের, বড়দের, কিশোর কিশোরীদের, তরুণ তরুনীদের যা পছন্দ হয় তাইই। বই নিয়ে তার কোনও বাছবিচার নেই। সবচেয়ে বেশি মাকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে কবিতার বই। আর সে সব কবিতা বেশিরভাগই বড়দের। বাচ্চাদের জন্যে ছড়া হয়। কবিতা হয় না। কবিতার মধ্যে সে এক অদ্ভূত রহস্য খুঁজে পায়। অল্প কথায় সেখানে কত কিছু যেন বলা হয়ে যায়। একটা কথার কতরকম মানে হয়। পরতের পর পরত থাকে। অনেক কিছুরই মানে সে বোঝে না। তাতে সেসব কবিতার প্রতি আরও যেন আকর্ষণ বেড়ে যায়।
আজও সে শুয়ে শুয়ে বেডল্যাম্প জ্বালিয়ে কবিতা পড়ছিল। এই রাতে সে পড়ছে বিনয় মজুমদার নামে এক কবির কবিতা। দুটো লাইন তার মাথার মধ্যে ঘুরছে, যার মানে সে বোঝার চেষ্টা করছে – হৃদয়, নিঃশব্দে বাজো; তারকা, কুসুম, অঙ্গুরীয়— এদের কখনও আরওো সরব সংগীত শোনাবো না –
হঠাৎ তার মনে হল ঘরের ভিতর কেউ আছে।
সে ঘরের আলো জ্বালিয়ে চারিদিকে দেখল। কিছু দেখতে পেলনা। জল খেল। কিছুক্ষণ বসল। এদিক ওদিক দেখল। তার গা ছমছম করতে লাগল। তারপর সটান বিছানায় আপাদমস্তক চাদরমুড়ি দিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। সে অভিজ্ঞতায় দেখেছে চাদরে মাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লে আর ভূতের ভয় লাগে না। আর একবার যদি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া যায় তাহলে আর কোনও ভয়ের ব্যাপারই নেই। শোয়ার পরেই খুব তাড়াতাড়ি সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে একটা স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নটা বেশ সুন্দর।
দেখল, সে মন্দিরের কাছে বসে আছে। সামনে কুয়োটা দেখা যাচ্ছে। ঠাকুরমশাই বসে বসে পুজো করছে। আর সে বসে বসে একটা কবিতার বই পড়ছে।
ঠাকুর মশাই তাকে জিজ্ঞেস করল – তোমার নাম কী?
সে উত্তর দিল – ছন্দা।
ছ – ন -দা? ছন্দা মানে কী?
রিদম। ছন্দ। ছন্দ থেকে ছন্দা।
রিদম? আমার রিদম খুব ভালো লাগে। সন্ধেবেলাতে ওই টুংটুং ঘন্টাটাতেও একটা রিদম ছিল।
হ্যাঁ ঘন্টার শব্দ আমারও খুব ভালো লাগে।
তুমি কী পড়ছিলে?
এটা। এটা তো কবিতা।
বইয়ে সবই কবিতা?
হ্যাঁ সব কবিতা।
তুমি কবিতা পড় কেন?
আমার কবিতা পড়তে খুব ভালো লাগে।
সকালবেলা ঘুম ভেঙে উঠে ছন্দা একটু আড়ামোড়া ভাঙল। তারপরেই সে হিহি করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে তার পেট ব্যথা হয়ে গেল। স্বপ্নে পূজারী ঠাকুর মশাই তাকে কবিতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন! এই ব্যাপারটাই প্রচন্ড হাস্যকর। ভদ্রলোকের বয়েস প্রায় ষাট বছরের উপর। উপরের পাটির চারটে দাঁত নেই। কোনওরকমে থেমে থেমে মন্ত্রপাঠ করেন। তিনি স্বপ্নে তার সঙ্গে কবিতা নিয়ে আলোচনা করছেন! ছন্দা সারাদিন ফিকফিক করে হাসতে থাকল।
মিতালি তাকে লক্ষ করে বললেন – বোকার মতো খিখি করে হাসছিস কেন?
সে বলল– বা: রে! হাসি পাচ্ছে যে।
তার বাবা বললেন – কিরে মামনি! ভূতটুত কিছু খুঁজে পেলি?
মিতালির এসব কথাবার্তা একদম পছন্দ নয়। তিনি বললেন – এসব কী বলছ তুমি? কোথায় বারণ করবে তা না! মেয়ে সারাদিন ধিঙ্গিপনা করে বেড়াচ্ছে। মাঝরাত অবধি আলো জ্বালিয়ে বই পড়ছেন। বাপ এই বয়সেই যা ইচ্ছে তাই বই কিনে দিচ্ছেন। বলি বয়সের বাছবিচারটা কর। তোমার মেয়ে আর তুমি দেখছি সাপের পাঁচ পা দেখেছ।
ছন্দার বাবা এসব শুনে হা হা করে হাসেন। ছন্দাও বাবার সঙ্গে ফিকফিক করে হাসতে থাকে।
সেদিন সন্ধেবেলা পুজো দেখার সময় আগের দিনের কথাটা মনে পড়ল। ঠাকুর মশাইকে দেখে কী হাসি পাচ্ছিল! পুজোর মধ্যেই তার বাবা বাড়ি ফিরে এল। বাবার সঙ্গে কুয়ো পাড়ে বসে সে পুজো দেখল। আজ সন্ধেবেলা আর কোনও ভয় করল না।
রাতের বেলা সে একটা ফরাসী কবিতার বই পড়ছিল। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ। সে চাইলেই তার বাবা কলকাতা থেকে বই আনিয়ে দেন। বিশুবাবুর খুব গর্ব যে তার মেয়ে পড়ালেখার বাইরেও প্রচুর বইটই পড়ে। মেয়ে যা বই চায় তিনি আনিয়ে দেন। আজ আর ছন্দার ভয় লাগল না। বইটা পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু পরেই স্বপ্নে তার বাবা এসে বলল – আজ কী বই পড়ছিলে?
ছন্দা বলল – আমি বোদল্যেয়ারের কবিতার অনুবাদ পড়ছিলাম।
বাবা বলল – হুম বোদল্যেয়ার। ভালো ভালো।
একটু থেমে ইতস্তত করে বাবা তাকে জিজ্ঞেস করল – আর কার কার কবিতা তুমি পড়েছ?
ছন্দা বলল – আমি অনেকের কবিতা পড়েছি। দেশি বিদেশী অ-নে-ক। বাংলায় বিষ্ণু দে পড়েছি, শামসুর রাহমান পড়েছি। হিন্দিতে রামধারী সিং পড়েছি। মহাদেবী বর্মা পড়েছি। ইংলিশে ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়েছি, বায়রণ পড়েছি।
তার বাবা তাকে জিজ্ঞেস করল – তুমি কবিতা লেখ? লিখতে পার কবিতা?
স্বপ্নের মধ্যেই একটু থেমে গেল ছন্দা। বলল – নাঃ আমি অনেকবার অনেক চেষ্টা করেছি। কখনও কবিতা লিখে উঠতে পারিনি। খাতায় লিখেছি। তারপর কেটে দিয়েছি। মনে হয়েছে এ নয়। ঠিক এটা নয়। এটা আমি লিখতে চাইনি। আমি অন্যকিছু লিখতে চেয়েছি।
বাবা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় অনেকক্ষন চুপচাপ বসে রইল ছন্দা। কিছু একটা ঘটছে। কী ঘটছে সে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে তার বাবার কাছে গেল। বিশুবাবু বাগানের একটা জায়গা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে নিয়েছেন। সেখানে ঝর্ণা টর্ণা বসিয়ে, গোলাপ গাছ লাগিয়ে এলাহি ব্যাপার করেছেন। সেখানে বসে বসে তিনি সকালের চা খান। খবরের কাগজ পড়েন।
ছন্দাকে সেখানে দেখে বললেন – আয় বোস।
ছন্দা তাকে জিজ্ঞেস করল – বাবা, তুমি বোদল্যেয়ারের নাম শুনেছ?
বিশুবাবু কিছুক্ষন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মেয়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন – তোর নতুন কোনও বন্ধু বুঝি?
তিনি শুনেছেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা হামেশাই কম্পিউটারে দেশবিদেশের লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে বেড়ায়। তার ধারণা হল তার মেয়ে রাত জেগে চ্যাট করে বোদলেয়্যার বলে কোনও ফরেনের ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছে।
ছন্দা জানে তার খুব মারাত্মক বুদ্ধি নেই। আবার এও জানে সে একেবারে বোকাও নয়। সাধারণ মেয়েলি ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে বলছে ওই সন্ধের কুয়োর পাড়ের ঘটনার সঙ্গে এই স্বপ্নের কোনও যোগাযোগ আছে। সমস্ত দিন সে গুম মেরে রইল। সেদিন সন্ধেবেলা পুজোর সময় সে মালিকে জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা কেষ্টদা এই কুয়োটায় জল যখন নেই তখন এটা বোজান হয়নি কেন?
কেষ্ট তার কথা শুনে বোকার মতো হাসল। তার মালকিন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে। কিছু একটা উত্তর দিতেই হয়। সে ভেবে টেবে মাথা চুলকে বলল – দিদিমুনি মনে হয় বাবু বসসার জন্যি ওয়েট করতেসেন। এবার বসসায় যদি এতে জল ভরিযায়, তালে আর দেখতে হবি না।
কেষ্ট খুব ইংরেজি বলতে ভালোবাসে। বাড়ির সকলের কথা শুনে শুনে সে ওয়েট, প্লিজ, স্যরি এসব বেশ শিখে গিয়েছে। জায়গামতো কথার মাঝখানে বেশ বসিয়ে দেয়।
ছন্দার ইচ্ছে হল সে কেষ্টকে বলে – ফালতু বকো না তো কেষ্টদা! কুয়োয় জল ভরে গেলে কী এমন কান্ড হবে যে দেখতে হবেনা। মজা একটা কুয়ো। বুজিয়ে দিলেই হয়।
বলল না। তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। কেউ তাকে বোকা বানাচ্ছে এই ব্যাপারটাতেই তার রাগ হচ্ছে। সে ভূত হোক আর যেই হোক। ভূত খোঁজার এই ব্যাপারটাই আর তার ভালো লাগছে না। সবচেয়ে খারাপ লাগছে তার আর কবিতার ব্যাপারটা নিয়ে কোনও একটা ভূতটুত ধরনের কিছু একধরনের ঠাট্টা করছে। এটা তার একটা অত্যন্ত নিজস্ব ব্যাপার। তার বাড়ির লোক ছাড়া এ ব্যাপারটা কেউ জানেনা। কবিতা নিয়ে কেউ ইয়ার্কি করলে তার ভারি বিরক্তি লাগে। তার এখন ভয়টয় একেবারেই করছেনা। এখন সে প্রচন্ড বিরক্ত, তাই চুপ করে রইল। সে ঠিক করল আজ নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত করে একটা শেষ দেখে ছাড়বে।
রাতের বেলা একা ঘরে তার সন্ধেবেলার সাহস উবে গেল। একটু গা শিরশির করতে লাগল। নিজেকে বোঝাল – পাশের ঘরেই বাবা মা আছে। একবার ডাক দিলেই ছুটে আসবে।
বাবাকে একবার ডাক দিল – বাবা।
বাবা তার একডাকেই উত্তর দিল পাশের ঘর থেকে – কীরে, মা! ভয় করছে? আমাদের কাছে শুতে আসবি?
সে বলল – না।
অনেকক্ষন একা একা চুপচাপ বিছানায় বসে থাকল। বোঝার চেষ্টা করল ঘরে কিছু একটা ঘটছে কি না! তারপর বেশ গভীর রাতের দিকে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্বপ্নে কেষ্ট এসে হাজির হল। কেষ্ট এসেই বেশ অমায়িকভাবে পরিস্কার ভাষায় তাকে জিজ্ঞেস করল – আজকে কোনও কবিতা পড়লে না?
ছন্দা একটু চুপ করে রইল। তার মনে হল, আসলে স্বপ্ন দেখছে ভাবলেও এটা স্বপ্ন নয়। এটা স্বপ্নের কাছাকাছি একটা ব্যাপার। আর ব্যাপারটা ঘটছে তার মাথার ভিতর। তার মনের ভিতর। সে আসলে জেগেই আছে। ছন্দা একটু চেষ্টা করে দেখল। সে কেষ্টকে জিজ্ঞেস করল – তুমি কে?
কেষ্ট চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কেষ্টর চোখে একটু অবাক দৃষ্টি। তার মানে সত্যিই ছন্দা আসলে পারছে। সে আবার একটু চেষ্টা করল।
তুমি কে? তুমি আসলে লোকটা কে? তুমি কি কোনও ভূত?
সে দেখল কেষ্ট একটু থতমত খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে সে পেরেছে।
জিগজ্যাগের সমস্যা – হুগলি, ৩৫১১
কেউ কেউ বলে দুনিয়াটা অনেক বদলে গিয়েছে। জিগজ্যাগের তা একেবারেই মনে হয়না। দুনিয়াটা যদি সত্যিই বদলে যেত তাহলে জিগজ্যাগের সঙ্গে এসব ঘটতে পারত না। জিগজ্যাগের বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আরও ভালোভাবে যদি বলা যায়, তবে বলতে হয়, আজকে জিগজ্যাগের জীবনে আবার একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধু সামান্য সন্দেহ আছে। জিগজ্যাগ এখনও ঠিক নিশ্চিত নয় এটা দুর্ঘটনা কি না। তার ধারণা তার বাড়ির লোক ব্যাপারটা নিয়ে বাড়াবাড়ি, করছে যা অত্যন্ত অনুচিত। তার এক্সটেনশানের ব্যাপারটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে গিয়েছে। তার বাবা ইউনিভার্সিটি গিয়ে প্রফেসারদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে। আজকালকার কোনও ছেলেমেয়ের বাবাই একাজ করে না। তার বাবা করে।
জিগজ্যাগের জীবনে তৃতীয় সমস্যা হল তার বোন আপেল। আপেল একজন খুবই ভালো চিত্রশিল্পী। তার ছবি দেখে অন্যদের তাক লেগে যায়। সদ্য তার প্রথম প্রদর্শনী হয়েছে। প্রচুর মানুষ নিজেদের মনে তার আঁকা ছবি দেখেছে। সে অনেক প্রশংসা পেয়েছে। আর তাতেই তার কথাবার্তা মারাত্মক ট্যারাবাঁকা হয়ে গিয়েছে। হাবভাব পাল্টে গিয়েছে। আজকাল সে জিগজ্যাগের সঙ্গে বেশ গলা গম্ভীর করে কথা বলে। দাদা আর বোনের এ ধরনের কথাবার্তা হয়:
বোন – তুই আবার এক্সটেনশান নিয়েছিস? তোর কবিতার কদ্দুর?
দাদা চুপ।
চার বছর তো হতে চলল। দুটো এক্সটেনশন নিলি। এখনও শেষ হল না।
দাদা চুপ।
বোন – কী রে কিছু বল? সবাই আমায় জিজ্ঞেস করে।
দাদা চুপ।
বোন – এভাবে চুপ করে থাকলে তো হবে না। বাবা তোর কথা ভেবে ভেবে…
জিগজ্যাগ মানসিক যোগাযোগ বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এযুগে মানসিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা পুরানো দিনের মোবাইল ফোন অফ করে দেওয়ার মতো।
এমনিতে জিগজ্যাগের দুনিয়াটা ভারি চমৎকার। এখানে সবাই সুখী। সবাই খুশি। প্রায় সকলেই নিজের মন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। শোক, দুঃখ,চোখের জলের মতো অবান্তর ব্যাপার তাদের স্পর্শ করে না। অন্যের ব্যাপার নিয়ে কারোর কোনও মাথাব্যথা নেই।
কিন্তু সব জায়গাতেই কিছু মানুষের ভাগ্য খারাপ থাকে। জিগজ্যাগের ভাগ্য খারাপ। তার প্রথম কারণ তার বাবা। এবং তার বোন। কিছু আনাড়ি মানুষ সবজায়গাতেই থাকে। সাধারণত দেখা যায় যাদের ভাগ্য খারাপ হয় তারা বেশ আনাড়ি ধরনের হয়। জিগজ্যাগ হল সেই আনাড়ি ধরনের মানুষদের মধ্যে একজন। তার জীবনে একেবারেই সুখ নেই, পরিস্থিতি খুব কঠিন।
জিগজ্যাগের জীবনের চতুর্থ সমস্যা হল তার বাবা টিনটিন টু। জিগজ্যাগের ঠাকুর্দার নাম ছিল টিনটিন ওয়ান। কিন্তু তার প্রসঙ্গ এখানে আসবে না। তিনি বহুদিন আগে গত হয়েছেন। টিনটিন নামে বহুদিন আগে একজন মহাপুরুষ ছিলেন। এ নাম তাদের সমাজে খুব জনপ্রিয়।
জিগজ্যাগের বাবা মাঝে মধ্যে সন্ধেবেলা একটু নেশা করেন। নেশা করা মানে ব্রেনের কয়েকটা জিনিস একটু উপর নিচে করে নেওয়া। লিম্বিক সিস্টেমটা, যেটা দিয়ে মানুষের ভয় আর দুঃশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ হয়, সেটাকে বাড়িয়ে দেওয়া। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, যেটা দিয়ে যুক্তি আর বিচার হয় সেটাকে কমিয়ে নেওয়া। নিউরোনগুলোকে দিয়ে হার্টরেটটা একটু বাড়িয়ে নেওয়া। ব্যস হয়ে গেল নেশা। প্রাগৈতিহাসিক যুগে শোনা যায় মানুষ বিড়ি সিগারেট মদ নামের বিভিন্ন জিনিস খেত নেশা করার জন্যে। তার কিছু স্যাম্পল মিউজিয়মে রাখা আছে।
এখন যেদিন টিনটিন টু এর নেশা বেশি হয়ে যায়, সেদিন বউয়ের উপর একটু জোর গলায় কথা বলার সাহস পেয়ে যান। তিনি বেশ জোরে জোরে জড়ানো গলায় তার বউকে শোনান – কী ভাবলাম, আর কী হয়ে গেল। তুমি জোরজার করলে বলেই এসব ভাবতাম। ছেলেকে ছোট থেকে এত কবিতা শোনাতে। ছেলেও ছোট থেকে এত কবিতা পড়ে। ভেবেছিলাম বড় হয়ে একজন মারাত্মক কবি হবে। টগরবীরের মতো কবি। আর এ ছেলে কি না আজ চার বছর ধরে ধ্যাড়াচ্ছে। একটা কাব্য লিখে উঠতে পারল না।
টিনটিন টু এর স্ত্রী এবং আপেলও জিগজ্যাগয়ের মা খুবই শান্ত ধরনের মহিলা। গভীর চোখের অধিকারিনী। ছেলে তার স্বভাব পেয়েছে। তার শান্ত, মায়াময় চোখ তুলে বলেন– করবে, করবে। ওর বয়েস এখন মাত্র আঠেরো। এখনও সময় আছে। তার মধ্যে ঠিকই করবে।
এমনি সময়ে টিনটিন টু বউয়ের চোখের এই শান্ত দৃষ্টিকে বেশ সমীহ করে চলেন। কিন্তু একবার নেশা করে ফেললে আর কোনও পুরুষই বা তার স্ত্রীকে গ্রাহ্য করে!
টিনটিন টু আরও ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন, বেশ রোয়াবের সঙ্গে বলেন – আহ! প্রাচীনার মতো কথা বল না। আর কবে করবে? ওর বয়েসে আমি আমার প্রথম সূত্র বার করে ফেলেছিলাম। উদোম চড়ালে তবে এসব ছেলে ঠিক থাকে। এদের চড় দরকার, চড়…
টিনটিন টু, একজন প্রতিভাশালী দার্শনিক। ভূতল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। কোনও অজানা কারণে বিয়ের পর থেকেই তার মনে হয় তার স্ত্রী অত্যন্ত প্রাচীনা ধরনের। ঠিক যেন এ যুগের সঙ্গে খাপ খায় না। এমনি সময় একথা তিনি চেপে রাখেন। একমাত্র নেশাটেশা করলেই তার মন আর নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। সব কথা হড়হড় করে বেরিয়ে আসতে চায়।
জিগজ্যাগের মা একজন মৃৎশিল্পী। মাটির কাজ যারা করেন তারা অত্যন্ত ধৈর্যশীল মানুষ। দশটা কাজের মধ্যে মাত্র একটা পাত্র তাদের মনপূত হয়। বাকি সব ভেঙে ফেলেন। আবার গড়েন। মাটির কলসি বানাতে তার ভুবন জোড়া খ্যাতি। তার মতো নিখুঁত কলসি বানাতে খুব অল্পমানুষই পারে।
টিনটিন টু আরও কিছু বলতে গিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চেপে যান। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন পুরুষের মতো বউকে একটু ভয় খান। এর কারণ আছে। তার স্ত্রীর মধ্যে এক অদ্ভূত রহস্যময়তা আছে। টিনটিন টুয়ের কোনও কারণে মনে হয় সারাজীবন একসঙ্গে বসবাস করেও তিনি তার বউকে ঠিক চিনতে পারলেন না।
টিনটিন টু যেমন তার বউয়ের সম্পর্কে ভাবেন, ঠিক একই ভাবে জিগজ্যাগও তার বাবাকে নিয়ে ভাবে। তার ধারণা, পৃথিবী আগের থেকে বদলে গিয়েছে এ কথা ঠিক নয়। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তার বাবা। এক জীবন্ত ফসিল। অনেকটা আরশোলার মতো। তার বাবা প্রকৃতির অতি অদ্ভূত সৃষ্টি। ভদ্রলোক এযুগে জন্মগ্রহণ করেও তার হাবভাব হাজার বছরের পুরানো বাবাদের মতো। নইলে কেউ আজকালকার যুগেও তার ছেলের পিছনে এমন আদাজল খেয়ে লেগে থেকে ভ্যাজোর ভ্যাজোর করে! কই তার বন্ধুদের বাবারা তো কেউ এমন নয়!
এই সব মানুষের সংসারে জন্ম নেওয়ায় জিগজ্যাগের জীবন আরও চাপের হয়ে উঠেছে। এত প্রতিভাশালী তার বাড়ির মানুষেরা যে, সে আর নিতে পারছেনা। কিন্তু এর চেয়েও বড় সমস্যা তার জীবনে আছে।
জিগজ্যাগের জীবনের দ্বিতীয় চাপ হল কবিতা লেখা। তবে কবিতা লেখাতেই সব শেষ নয়। এরচেয়েও বড় সমস্যা তার আছে। এবং তা হল তার প্রধান ও প্রথম সমস্যা।
ঘটনা আজ থেকে বছর চারেক আগের। তখন সে সবে ভূতল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে। বন্ধুরা মিলে একদিন ঠিক করল বেড়াতে যাবে। যেদিন সে বেরোচ্ছে সেদিন তার মা কুক্কুরীপা বললেন – যাও ঘুরে এস। সূর্যের আলো দেখে এস। এই পৃথিবীর মাটি মেখে এস।
পৃথিবীর মাটির তলার এই দুনিয়ায় দিনরাতের যদিও খুব একটা ব্যাপার নেই। তবুও লক্ষ লক্ষ বছর ধরে দিন আর রাতের মধ্যে থাকার ফলে মানুষের শরীরের একটা ঘড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে জেগে থাকতে ইচ্ছে করে। বেশি খিদে পায়। আবার আর একটা সময়ে ঘুম পায়। তাই আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে পাকাপাকি মাটির তলায় চলে আসলেও মানুষ একটা সময়কে বলে দিন। আর অন্যটাকে বলে রাত।
সেই রকমই একটা দিনে জিগজ্যাগ আর তার বন্ধুরা বার হল। বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে একটা পাহাড়ের দিকে যাওয়া হল। পাহাড়ের নাম হিমল। সকলে মিলে একটায় পৌঁছল। জঙ্গলের উপর থেকে সূর্যের হালকা আলো আসছে। উর্বর মাটিতে ঘন গাছপালা। বিচিত্র তাদের পাতার রং। বেশিরভাগ পৃথিবীর উপরিভাগের গাছপালা সূর্যের প্রখর তাপে, আবহাওয়ার উত্তাপে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এরকম দু-একটা অরণ্য এই পাহাড়ের পাথরের আড়ালে আড়ালে এখনও বেঁচে আছে।
তার মা বলেছিলেন, সূর্যের আলো অনুসরণ করতে। সেখানে গেলে সে এক আশ্চর্য মাটির দেখা পাবে। আর সেই দেখতে গিয়েই জিগজ্যাগ তার বন্ধুদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
মনে মনে তাদের খুঁজে নেওয়াই যেত। এযুগে মানুষের মনের শক্তি অনেক। মন দিয়েই যোগাযোগ করে। আবার মন দিয়েই সেই যোগাযোগ থামিয়ে দেয়। জিগজ্যাগ কিছুক্ষণ সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিল। এ এক অদ্ভূত মজা। বেশ শান্তির ব্যাপার। এমন করে ঘুরতে ঘুরতেই গর্তটা তার নজরে এল।
গর্তটা একটু ঘুরে ফিরে দেখে জিগজ্যাগ বুঝল এটা একটা টাইম টানেল। এক সময় মানুষের টাইম মেশিন নিয়ে খুব আদেখলামো ছিল। অথচ পৃথিবীতে প্রচুর টাইম টানেল ছড়িয়ে আছে তারা জানতই না। সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সেটার ব্যাপারে তারা জানল। তারপর টাইম মেশিন নিয়ে তাদের হ্যাংলামোও কমল।
টাইম টানেল ব্যবহার করে দেখল অন্য টাইমে তারা যেতে পারে, কিন্তু সেই সময়ের উপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে পৌঁছলে তার নিজেদের উপরও কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। একটা হালকা আবছা আস্তরণ সে জগতের থেকে তাদের আলাদা করে রাখে। প্রকৃতির অদ্ভুত নিয়মে তারা সেই জগৎকে কোনও ভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। আস্তে আস্তে উৎসাহ তাদের কমতে লাগল। টাইম টানেলগুলোর ব্যাপার সবাই ভুলে গেল। দীর্ঘ অব্যবহারের ফলে টাইমহোলগুলো পরিত্যক্ত হয়ে গেল।
জিগজ্যাগ এর আগে কোনও দিন টাইম ট্রাভেল করেনি। অনেকের কাছে শুনে শুনে তার একটা ধারণা ছিল। খুব একটা আগ্রহও বোধ করেনি। টাইম ট্রাভেলের মূল অসুবিধা হল এতে ভবিষ্যতে যাওয়া যায় না। অতীতে গিয়ে কোনও লাভ নেই। অতীতের প্রচুর ঘটনা ফোর ডি এক্সপিরিয়েন্সে এখন বহুজায়গায় অনুভব করা যায়। দেখা যায়, শোনা যায়। কীভাবে আস্তে আস্তে পৃথিবীর উপরের দিকটা উত্তপ্ত হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেল, কেমন করে মানুষ আস্তে আস্তে মাটির তলায় বাস করতে আরম্ভ করতে লাগল এ জিনিস সেই ছোট্ট থেকে সে বাবা মায়ের সঙ্গে মিউজিয়ামে, ইউনিভার্সিটিতে বহুবার দেখেছে।
সবচেয়ে মুশকিল হল টানেলের ওদিকের অতীতের মানুষগুলোকে নিয়ে। তারা একবার যদি এদিককার মানুষদের হালকা অস্তিত্বও টের পায় তখন তারা এদের বিভিন্ন নামে ডাকে। কেউ ডাকে ভূত। কেউ বলে ঘোস্ট। কেউ বলে প্রিজাক্। আবার কেউ বলে তাদের ফ্যান্টোমেহ।
ছোটবেলায় তাদের পরীক্ষায় প্রশ্ন আসত – প্রাচীন মানুষের বিভিন্ন স্বভাব সম্বন্ধে লেখ। সে লিখত –
১. প্রাচীন মানুষের সময়ের ব্যাপারে কোনও শ্রদ্ধা ছিল না। তারা অফিসে, স্কুলে যেতে আসতে প্রচুর সময় নষ্ট করত।
২. প্রাচীন মানুষের ধর্ম বলে একটা ব্যাপার বিশ্বাস করত। তার জন্যে অনেকসময় মারামারি আর খুনোখুনি নামে দুটো অদ্ভুত ব্যাপার ঘটাত।
৩. তারা বিভিন্ন ধরনের ভয় পেত। আর সেই ভয় থেকে বাঁচার জন্যে বিভিন্ন কান্ডকারখানা করত। তাদের মধ্যে আছে মারণ উচাটন, ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র। প্রাচীন মানুষ এশিয়ান, ইউরোপীয়ান, আমেরিকান, আফ্রিকান ইত্যাদি বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও, এই ব্যাপারগুলি প্রায় সকল গোষ্ঠীর মধ্যেই ছিল।
৪. প্রাচীন মানুষ মস্তিস্কের ব্যবহারের দিকে খুবই অলস ছিল। মস্তিস্কের ক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার করতেও তারা অপারগ ছিল… ইত্যাদি ইত্যাদি।
এত কিছু জেনেও সেদিন জিগজ্যাগ সেই টাইম টানেলে গিয়ে ঢুকল। পুরানো দিনের মানুষজন একটা মারাত্মক রোগে ভুগত। যার কারণে মানুষ ধীরে ধীরে আজকের যুগে পৌঁছতে পেরেছে। সেদিন সেও সেই রোগের শিকার হল। রোগটার নাম কৌতূহল।
কথোপকথন – ব্যান্ডেল, ২০০৮
আমি ভূত না।
তবে তুমি কে?
আমি একজন মানুষ। একটু অন্যরকম মানুষ।
কি রকম মানুষ।
আমি বললে ঠিক হয়তো বিশ্বাস করতে পারবে না।
তবু আমি জানতে চাই।
আমি একটা অন্য সময় থেকে এসেছি।
অন্য সময়?
হ্যাঁ। আমি ভবিষ্যত থেকে এসেছি।
আবার বাজে কথা। ভূতেরা যে মিথ্যেও বলতে পারে তা জানতাম না তো!
আমি মিথ্যে বলছি না। আমরা মিথ্যে বলতে পারি না। আমরা হয় সত্যি বলি। আর না হয় কিছু বলি না।
তুমি আমার সঙ্গে কীভাবে কথা বলছ?
এটা আমাদের কথা বলার পদ্ধতি। আমরা খুব কম শব্দ ব্যবহার করি। যা বলতে চাই সেই ভাবটা সরাসরি অন্যের মস্তিস্কে পাঠিয়ে দিই। আমাদের ভাষা অনেক উন্নত। অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে সেখানে অনেক কিছু বোঝান যায়।
এটা তোমরা কীভাবে কর?
আমাদের মস্তিস্ক ব্যবহার করে। আমরা ভবিষ্যতের মানুষেরা বহু বছরের চেষ্টায় আমাদের মস্তিস্ককে অনেক বেশি ব্যবহার করতে পারি।
ভবিষ্যত থেকে কীভাবে আসা যায়?
আসা যায়। এই পৃথিবীতে কিছু টানেল আছে। টাইম টানেল। সেখান থেকে আসা যায়।
কী বলছ? সিনেমায় যেরকম দেখা যায়?
সিনেমা কী?
তুমি তো আমার মনের মধ্যে এসে কথা বলছ। আমার মস্তিস্ক থেকে দেখে নাও সিনেমা কী!
দেখলাম। এখন মনে পড়ল আগেও দেখেছি। একে আমরা বলি ষ্ট্রিম। দু ধরনের ষ্ট্রিম হয়। লাইভষ্ট্রিম আর ড্রামাষ্ট্রিম। সিনেমা হল একধরনের ড্রামাষ্ট্রিম। আমাদের মিউজিয়ামের আর্কাইভে আছে।
টাইম টানেলে করে তুমি আমাদের বাড়ির এখানেই বা পৌঁছলে কী করে?
টাইম টানেল গুলোর কিছু নির্দিষ্ট মুখ আছে, ঢোকা বা বেরনো সেই নির্দিষ্ট পথ দিয়েই করতে হয়। একটা টানেলের একটা বিশেষ জায়গার সঙ্গেই যোগাযোগ থাকে। আমার টানেলটা তোমাদের কুয়োর মধ্যে এসে পৌঁছল।
তার মানে তুমিই সেদিন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলে?
হ্যাঁ। বুঝতে পারছিলাম তুমি আমায় দেখতে পারছ না কিন্তু অনুভব করতে পারছ। তাই রাতে তোমার মস্তিস্কে সিগনালটা পাঠালাম।
বুঝলাম। তোমার নাম কী?
আমার নাম জিগজ্যাগ।
জিগজ্যাগ কারোর নাম হয় নাকি?
জানি জানি, আমার নামটা একটু পুরানো ধরনের। আমার বন্ধুরা বলে। তাদের আরও ট্রেন্ডি নাম।
জিগজ্যাগের থেকেও ট্রেন্ডি? শুনি একটু কীরকম?
বিভিন্ন নাম। কারোর নাম স্টোরি, কারোর নাম হাইফাই, একজনের নাম নগন্য। কারোর আবার দুটো দুটো নাম। আমার এক বন্ধু আছে তার নাম একই সঙ্গে ডেনিম আর জার্নি। আমার বাড়ির সবার নাম পুরানো ধরনের। আমার বাবার নাম টিনটিন টু, মায়ের নাম কুক্কুরীপা আর বোনের নাম আপেল।
হিহিহিহি…
তুমি হাসছ কেন?
স্যরি।
ওঃ বুঝলাম। আমাদের নাম শুনে। টিনটিন আমাদের সময়ের একটা জনপ্রিয় নাম। পুরানো কিন্তু অনেকে এখনও রাখে। আমার দাদুর নাম ছিল টিনটিন ওয়ান।
আমার মাথার ভিতর ঢুকে তুমি আমার অনেক ব্যক্তিগত কথা জেনে যাচ্ছ, আমি কিছু বলার আগেই।
রিদম, তুমি বুদ্ধিমতী।
আমি জানি।
সঙ্গে তুমি অত্যন্ত অনুভূতিশীল একটি মেয়ে। অনেকটা আমার মায়ের মতো।
কেন বলছ?
যদি তুমি অনুভূতিশীল না হতে, তবে আমার অস্তিত্ত্ব এত সহজে বুঝতে পারতে না, আমার সঙ্গে এতক্ষন কথাও চালাতে পারতে না।
তুমি অন্য মানুষের রূপ নিয়ে আসছ। আমি তোমার আসল চেহারা দেখতে চাই।
সম্ভব নয়। তোমার আর আমার মধ্যে একটা সূক্ষজালের মতো ব্যাপার আছে। আমি শুধু ওপাশে তোমায় দেখতে পাব। তোমার কথা ক্ষীণভাবে শুনতে পাব। অনেক চেষ্টা করে এই সামান্য মানসিক যোগাযোগ করতে পারছি। ব্যস। আর কিছু নয়। আর কোনওভাবেই তোমার জগতের কোনও ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারব না।
এ কেমন ব্যাপার? তাহলে টাইম টানেল থেকে লাভ কী?
এ এক প্রকৃতির অদ্ভূত খেয়াল। কেউ একজন সবকিছুর এক্তিয়ার আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। একটা প্রকান্ড প্রাসাদে কিছু ছোট জানলা সে তৈরি করে রেখেছে। সেখান থেকে শুধুমাত্র উঁকি দেওয়া যায়। হয়তো এতেও তার কিছু ইঙ্গিত আছে। যা মানুষ এখনও ভেদ করতে পারেনি।
আমি কী তোমার কোনও কিছু প্রভাবিত করতে পারব?
আমার ঠিক জানা নেই। তবে শুনেছি, তুমি যদি এই টানেলের মুখ থেকে অনেক দূরে চলে যাও, তবে একসময় এই গোটা ব্যাপারটাই তোমার স্বপ্ন বলে মনে হবে। হয়তো ঘটনাটা তুমি ভুলেও যাবে।
তুমি কী আমার মনের মধ্যে চলছে এমন অন্য ব্যাপারও দেখতে পারছ?
কিছু কিছু। যেমন তুমি এখনও ভাবছ এটা একটা স্বপ্ন। যা ঘুম ভাঙলে চলে যাবে। তুমি এখনও আমাকে একধরনের ভূতের দলেই রেখেছ।
হ্যাঁ, দুঃখিত। আসলে ব্যাপারটা এখনও যে ঘটছে তা বিশ্বাস করতে পারছি না। আশা করি তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ পারছি। তোমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি জেনে গিয়েছি।
কী কথা?
তুমি কবিতা খুব ভালোবাস।
তোমার পৃথিবীতে কবিতা আছে?
আমার যুগে শুধু কবিতা আছে তাই নয়, সর্বশ্রেষ্ঠ সন্মান হল কবির। বাবা মায়েরা চায় তাদের সন্তান একজন কবি হোক।
কী বলছ?
যারা খুব সাধারণ মেধার মানুষ তারা সমাজ পরিচালনার কাজে লাগে। যারা তাদের থেকে একটু উঁচু মেধার তারা বিভিন্ন কারিগরি কাজ করে। সবচেয়ে উঁচু মেধার মানুষেরা দার্শনিক হয়, ঐতিহাসিক হয়। এ যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ সন্মান হল কবিদের।
দারুণ ব্যাপার তো?
আমাদের সময়ের প্রায় পাঁচশো বছর আগে জন্ম নিয়েছিলেন দুনিয়ার শেষ কবি টগরবীর। বাবা মায়েরা চায় তাদের সন্তান একজন কবি হোক। টগরবীরের মতো কবি হোক। যারা কবি হতে চায় তাদের সব পড়াশোনার শেষে একটি কবিতা লিখতে হয়। কবিতা না বলে তাকে মহাকাব্য বলাই ভালো।
বেশ শক্ত ব্যাপার!
আমি শুনেছি একসময় পৃথিবীতে খুব সুন্দর নিয়ম ছিল। যারা পড়াশোনায় ভালো হত তাদের যন্ত্রপাতি, কারিগরি বা জীবদেহের শরীর নিয়ে পড়াশোনা করতে হত। বহুদিন হল সে সব বদলে গিয়েছে। এখন ভালো ছেলেমেয়েরা সকলে কবিতা নিয়ে পড়াশোনা করে।
যন্ত্রপাতি? জীবদেহ? মানে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার? কেউ হতে চায় না?
ঠিক তা নয়। যাদের মস্তিস্ক অত্যন্ত সৃষ্টিশীল তারা আমার যুগে সবচেয়ে সন্মানিত। শিল্পী, কবি এদের স্থান সকলের উপরে। কারণ, তারা যা দেখে, তা আর কেউ দেখেনা। তারা যা বোঝে তা অন্যরা বুঝতে পারেনা। তারা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। আগত সময়কে দেখতে পায়।
তবে তো তোমার ওখানে প্রচুর কবি।
না, আমার সমাজে শেষ কবি জন্মেছিলেন পাঁচশো বছর আগে, নাম টগরবীর। তারপর থেকে অনেকে অনেক চেষ্টা করেছে। মহাকাব্যও রচনা করেছে। কবি উপাধিও কয়েকজন পেয়েছে। কিন্তু কবি হতে পারেনি।
টগরবীরের ব্যাপারে কিছু বল শুনি।
উনি শুধু কবি ছিলেন না। তিনি আমাদের একটা ব্যাপার শিখিয়ে গিয়েছিলেন। মনের নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে নিজেকে খুশি রাখতে হয়। আমরা সবসময় নিজেদের খুব খুশিতে রাখি। আনন্দে রাখি। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, তারপর থেকে আমাদের মধ্যে আর কোনও কবি জন্ম নিল না।
কেন?
কারণ জানা যায় না। আমার মা কবিতার একজন খুব বড় বোদ্ধা। পৃথিবী জোড়া তার নাম। তিনি বলেন কবি হতে গেলে একটি বিরাট ত্যাগ করতে হয়। সেটা সবাই পারে না। তাই সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি হয়। বহুযুগ ধরে সেটা কেউ করতে পারছে না। তাই কোনও সত্যিকারের কবির জন্ম হচ্ছে না।
তোমার পৃথিবী কেমন? সেখানে এখনকার মতো দেশ, বিভিন্ন মানুষ. গাছপালা, জীবজন্তু এইসব আছে?
অনেক কিছুই আছে। একটু অন্যরকম ভাবে। পাঁচশো বছর আগে আবহাওয়া এত গরম হয়ে যায় যে আমরা মাটির তলায় আমাদের সভ্যতা গড়ে তুলি। জনসংখ্যা খুবই নিয়ন্ত্রিত। দেশ বলে কোনও ব্যাপার নেই। আমরা সবাই এক। সকলের ভাষা খুব কাছাকাছি। বেশিরভাগই সকলেই বোঝে। যেটুকু না বোঝা থাকে তার জন্যে আমরা ভাব বিনিময় করি। মস্তিস্কে ছবি পাঠাই। মানুষেরা সকলে মিলে অত্যন্ত সুখে আর আনন্দে একসঙ্গে আছি।
ফ্যামিলি ড্রামা ১ – হুগলি, ৩৫১১
টিনটিন টু বাড়িতে ঢুকলেন। তাকে সাধারণত ইউনিভার্সিটি যেতে হয় না। প্রায়ই ঘর থেকে ক্লাস নেন। ছাত্রছাত্রীরাও বাড়ি থেকে ক্লাস করে। কেউ কেউ ইউনিভার্সিটিতেও আসে। যার যেমন ইচ্ছে। আজ তিনি ভূতল ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে ঘরের বাইরে বেরোলে মন প্রসন্ন হয়। তা ছাড়াও আর একটি কাজ ছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি তার ছেলের অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন।
তাদের সঙ্গে কথা বলার পর তার প্রসন্নতা খুব বেশি আর রইল না। তিনি চাইলেই এসব ছোটখাটো বিরক্তি মনের শক্তি ব্যবহার করে সরিয়ে ফেলতে পারেন। তবে আজ তিনি তা করবেন না ঠিক করলেন। মাঝেমাঝে নিজের ছেলেকে তার প্রচন্ড চড়াতে ইচ্ছে করে। কেন করে তা জানেন না! এ যুগে কেউ বাচ্চাদের মারধোর করেন না। টিনটিন টু মেজাজ ঠান্ডা হলে নিজেই লজ্জা পান, এসব প্রাগৈতিহাসিক ইচ্ছে মনে চাগাড় দেওয়ার জন্যে। কিন্তু এখন সেসব লজ্জাটজ্জা একেবারেই পাচ্ছেন না। পুরানো যুগের মানুষের মতো এসব ব্যাপার শক্তভাবে সামলানো দরকার ভেবে তিনি বাড়িতে ফিরলেন।
তার বাড়ির নাম বত্রিশ। কেন বত্রিশ? তিনি জানেন না। এই বাড়ি তার স্ত্রীর নামে। তিনিই বিয়ের পর এই বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে থাকতে এসেছেন। বাড়িতে ঢুকতেই তিনি একটা চিন্তার তরঙ্গের আদানপ্রদান টের পেলেন। তার মেয়ে আর বউ কথা বলছে। দুজনেই বাড়ির দুপ্রান্তে। একজন ছবি আঁকছে। আর একজন মাটির পাত্র বানাচ্ছে। তারমধ্যেই মা মেয়ের গল্প চলছে। টিনটিন টু শুনছেন।
আপেল তার মা’কে বলছে – তুমি একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? আজকাল আর আমাদের বাড়ির সামনে সেভাবে ভিড় হয় না।
কুক্কুরীপা উত্তর দিলেন – কেন একথা বলছ?
নাঃ কিছুদিন ধরে লক্ষ করলাম লোকে আর টগরবীরের বাড়ি দেখতে আসছে না, তাই বললাম।
কুক্কুরীপা কোনও উত্তর দিলেন না।
একটু সময় সব চুপচাপ।
আপেল এবার বলল- এই যে দাদা বছরের পর বছর কবিতা লিখতে পারছেনা। তুমি কি এখনও ভাবো দাদা টগরবীরের মতো কবি হবে?
কুক্কুরীপা বললেন – দেখ! অনুভব হল তার একান্ত নিজের ব্যাপার। সেই অনুভব হয় বোঝা যায় অথবা বোঝা যায়না। তার মাঝামাঝি কিছুই নেই।
তোমার কথা বুঝলাম না।
মানুষের কাজ শুধুমাত্র ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। বীজবপন করা। আর কিছু নয়। আর কিছু খোঁজা মানুষের সাজে না।
মা তোমার বেশিরভাগ কথাই বড় দূর্বোধ্য।
তুমি কি টগরবীরের শিক্ষা ভুলে গেলে। মনকে শান্ত রাখতে হলে কখনও স্বপ্ন দেখবে না। ধর তুমি কিছুর স্বপ্ন দেখলে, বাস্তবে হল তার উল্টোটা। তখন তোমার মন বিক্ষিপ্ত হবে।
মানে তুমি বলছ যে, দাদার কবি হওয়ার স্বপ্ন তুমি দেখ না, তাই তো?
এ প্রশ্নের উত্তর তোমায় আমি এখনই দিলাম।
আবার দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ। আপেল আবার প্রশ্ন করল। মনে হয় দাদার কারণে তার মন বিক্ষিপ্ত।
আচ্ছা মা, এ বাড়ি একসময় কবি টগরবীরের ছিল। এখন তুমি এখানে থাক। তোমরা যেহেতু একই পরিবারের মানুষ তোমার কবি টগরবীরের কোনও ছবি বাব্যবহারের জিনিস দেখার সৌভাগ্য কখনও হয়নি।
কুক্কুরীপা বললেন – কবি টগরবীর ছিলেন একটি চিন্তন। একটি বিশেষ চিন্তন। বহুবছর আগে পৃথিবীর উপরের মানুষ যখন ভূগর্ভে এসে থাকতে লাগল তখন তারা অত্যন্ত বিচলিত ছিল। লক্ষ বছর আকাশের নিচে যারা বাস করে, আকাশ দেখতে না পেলে তাদের এ অবস্থা খুব স্বাভাবিক। কবি টগরবীর তখন একজন মানুষ থেকে সিদ্ধ হয়ে উঠলেন। মহাসিদ্ধ। তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন সারা পৃথিবীতে। একজন কবিই শুধু তা পারেন।
তুমি কিন্তু আবার বড্ড হেঁয়ালি করছ। আমার কথার উত্তর দিলে না।
প্রতিবারের মতো তোমার প্রশ্নের জবাব আমি দিয়েছি। কবি টগরবীরকে আমরা সবাই দেখেছি। তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন।
টিনটিন টু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মানসিক যোগাযোগ ছিন্ন করে বসার ঘরে বসে রইলেন। তিনি এক পরম বিদূষী নারীকে জীবনে পেয়েছেন। এঁকে শ্রদ্ধা করা যায়। ভালোবাসা যায় না। তিনি সেই বিয়ের সময় থেকে চেষ্টা করেছেন।
বিয়ের পর যখন জানলেন তার স্ত্রী কবিতা ভালোবাসেন তখন একদিন বেশ কিছু দীর্ঘকবিতা তিনি মুখস্থ করে মহড়া দিয়ে এলেন। অথচ ঝাড়া মুখস্থ করা সব ক-টি কবিতা তিনি মোক্ষম সময়ে ভুলে গেলেন। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের সারা সময়টা তিনি কাটিয়ে দিলেন কবিতাগুলো মনে করার চেষ্টায়। তাপনিয়ন্ত্রিত আবহাওয়াতেও তিনি টপটপ করে ঘামতে লাগলেন। তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেসকরলেন – আপনি অসুস্থ বোধ করছেন?
টিনটিন টু দু-চারবার লম্বা শ্বাস টেনে নিজের লজ্জা তাড়িয়ে বললেন – না, আমি আসলে আপনাকে কিছু কবিতা শুনিয়ে মুগ্ধ করতে চাইছিলাম। শুনেছিলাম আপনি টগরবীরের বংশের। কবিতা ভালোবাসেন।
তার স্ত্রী রহস্যময় হেসে বলেছিল – আমি আপনার উপর এমনিতেই মুগ্ধ। নইলে আমরা একসঙ্গে থাকতাম কীভাবে। তারচেয়ে আমি বরং আপনাকে একটি কবিতা শোনাই। শুনবেন?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলেন টিনটিন টু। কুক্কুরীপা শুনিয়েছিলেন–
দিনে বধূ কাকের ডরে কাঁপে,
রাতদুপুরে সে-ই ছোটে কামরূপে!
কুক্কুরীপার চর্যা এমনই যে
কোটির মাঝে একজন তা বোঝে।
টিনটিন টু জিজ্ঞেস করেছিলেন – এটার মানে কী? এটা কীরকম ধরনের ভাষা? এতো মনে হচ্ছে বহু প্রাচীন ভাষা?
কুক্কুরীপা জবাব দিয়েছিলেন – এটা সান্ধ্যভাষা। এই ভাষার অনেকগুলো স্তর আছে। বিশুদ্ধ কবিতার মতো। এর প্রতিটা স্তরে যাওয়ার চেষ্টা আপনি যদি সারাজীবন ধরে করে যান তবে একদিন আপনি এর মানে বুঝতে পারবেন। আপনিও একদিন কবি হয়ে উঠবেন।
সেদিন থেকেই টিনটিন টুয়ের মনে হতে লাগল তার স্ত্রী যেন এ জগতের মানুষ না। এক রহস্যময় প্রাচীন জগত থেকে সে যেন এসেছে। আর সেই চিন্তা আস্তে আস্তে তার মনের গহনে চলে গেল।
আজ বেশ রাতের দিকে শোয়ার ঘরে ঢুকলেন টিনটিন টু। কুক্কুরীপা ঘুমোচ্ছেন। তিনি পুরোপুরি নগ্ন হয়ে শুয়ে আছেন। টিনটিন টুর ইচ্ছে হল, স্ত্রীর পাশে শোন। তাকে একটু আদর করেন। শোবার ঘরে তাদের জীবনের প্রথমদিককার একটা বড় ফটো রাখা আছে। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎই টিনটিন টু অবাক হয়ে লক্ষ করলেন ছবির থেকে তার বয়েস অনেক বেড়ে গিয়েছে। অথচ কুক্কুরীপাকে দেখতে প্রায় একইরকম আছে। তার বয়েস প্রায় বাড়েনি।
এই রহস্যময়ী নারীকে দেখে তার ভয় ভয় করতে লাগল। মানসিক নিয়ন্ত্রণ কোনও কাজে এল না। জিগজ্যাগয়ের ব্যাপারে তিনি তাঁকে কী জিজ্ঞেস করবেন ভেবেছিলেন তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলেন।
পরদিন সকালে গিয়ে তার আবার মনে পড়ল সে কথা। জিগজ্যাগ আবার একবার এক্সটেনশান নিয়েছে।
ফ্যামিলি ড্রামা ২ – ব্যান্ডেল, ২০১০
ছন্দার মা একদিন লক্ষ করলেন তার মেয়ে বাড়িতে একা একা থাকতে চায়। একা একা ঘুমোতে চায়। মাঝে মাঝেই একা একা বাগানে কুয়োর পাড়ে, মন্দিরে বিড়বিড় করে। রাতের বেলা মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে জিগজিগ বলে ডেকে ওঠে।
বাবাদের চোখে এসব ঘটনা অনেক পরে ধরা পড়ে। মিতালি দুটো ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হলেন। হয় তার মেয়েকে ভূতে ধরেছে। নয় তার মেয়ে প্রেমে পড়েছে। এই বয়েসি টিনএজ মেয়ের পক্ষে যা খুবই স্বাভাবিক।
এক সন্ধেবেলা ছন্দার বাবার সঙ্গে তার মায়ের এই ধরনের কথাবার্তা হল:
মিতালি – (ফুঁপিয়েকান্না)
বিশু – কী ব্যাপার? সন্ধেবেলা হঠাৎ কান্নাকাটি কিসের?
মিতালি – আরও ফুঁপিয়ে কান্না।
বিশু – আরে! এত কান্নাকাটি কিসের? ব্যাপারটা বলবে তো।
মিতালি – জোরে জোরে ভেউভেউ করে কান্না।
বিশু – (ব্যতিব্যস্ত হয়ে) – আরে শুধু কাঁদলে হবে? ব্যাপারটা না বললে তো কিচ্ছু বুঝছি না।
মিতালি – উঁউঁউঁ আমার কি সব্বনাশ হল গো – ও – ও
বিশু – কি হল? হলটা কি বলবে আমায়।
মিতালি – আমার মেয়েটা… এইজন্যে বলতাম ওইটুকু মেয়ে, তাকে এত কবিতার বই কিনে দিওনা।
বিশু – কবিতার বই! কবিতার বইয়ের আবার কী হল?
কথাবার্তার এইরকম পর্যায়ে ছন্দা চলে এল। বিশু তাকে দেখে বললেন – কী ব্যাপার বলতো মামনি। তোর মা এমন করছে কেন?
ছন্দা একবার তার মায়ের দিকে তাকাল। মিতালি মেয়েকে এখনও তার সন্দেহের কথা বলেননি। তার স্থির ধারণা ভূত বা ছেলে তার মেয়েকে যাতেই পাক, তিনি কিছু বললেই তার মেয়ে তার সঙ্গে ঘর ছেড়ে পালাতে পারে। চন্দন মালের প্রচুর সিনেমায় এ জিনিস তিনি দেখেছেন। তার প্রতি ছবির মধ্যেই এ ধরনের একটা দৃশ্য থাকে। ইলোপ-টিলোপ করার দৃশ্য প্রভঞ্জন চৌধুরীর সিনেমার একটা স্পেশালিটি।
তার সিনেমার নায়িকার রোলে প্রায়ই প্রভঞ্জন চৌধুরী নিজের মেয়েদের নামিয়ে দেন। তার মেয়েরা প্রত্যেকেই এক একজন দশাসই চেহারার। আর এসব ছবিতে চন্দন মালের রোল থাকে ধুতি পাঞ্জাবি পরা ভোলেভালা ধরনের হিরোর। প্রায়ই দেখা যায় চন্দন মাল ও প্রভঞ্জন চৌধুরীর মেয়েরা দজ্জাল শাশুড়ি আর ভিলেন শ্বশুরের হাত থেকে হাত এড়িয়ে এদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এত ছুটোছুটির সিন দেখানোর পরে ক্লান্ত হয়ে প্রভঞ্জন চৌধুরী ছবির নামের ব্যাপারে খুব একটা কসরৎ করতে চায় না। তার ছবির নাম বেশিরভাগ সময়ে হয় বড়ছেলের বউ, মেজছেলের বউ…. সেজছেলের বউ… এইসব।
ছন্দা কিছুক্ষন তার মায়ের দিকে দেখল। তারপর একটা ছোট্ট নিশ্বাঃস ফেলে বলল – বাবা মায়ের ধারণা হয় আমাকে জিগজ্যাগ নামের এক ভূতে পেয়েছে বা আমি ওই নামে একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করছি।
মিতালি কিছুক্ষন অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বিশু কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন – সে কি মিতালি সত্যি নাকি? – তারপরেই তার খেয়াল হল ভুল মানুষকে কথা জিজ্ঞেস করছেন। হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। ছন্দার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – হ্যারে মামনি! সত্যি নাকি?
ছন্দা স্পষ্টস্বরে বলল – না বাবা! একদম ভুলভাল কথা।
বিশু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, তার বউ সব কিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি করে। বহুবার তিনি স্ত্রীকে চন্দন মালের সিনেমা দেখতে বারণ করেছেন। ওই মালের সিনেমা দেখিয়ে দেখিয়ে তার হলের বদনাম হয়ে যাচ্ছে। খুব শিগগিরি হল দুটো তুলে ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আছে তার।
ঠিক এইরকম একটা শান্তিশান্তি সময়ে মিতালি চোখ সরু করে ছন্দাকে জিজ্ঞেস করলেন – তোকে কে বলল আমি এই কথা ভেবেছি? আমি তো বলিনি।
ছন্দা খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল – জিগজ্যাগ বলল। একটু আগেই আমার মাথার ভিতর থেকে জানাল। আর শোন জিগজ্যাগ কোনও ভূতটূত নয়। অত্যন্ত ভালো ছেলে। তবে এ যুগের নয়। সে এসেছে ভবিষ্যত থেকে। আর ও মাটির তলার একটা শহরে থাকে।
কথোপকথন ২ – ব্যান্ডেল, ২০০৯
জিগ!
বলো রি।
কিছু তোমার কথা বল।
আমি এক অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীর এক সুখী মানুষ।
কিন্তু তোমার কথা শুনলে তা মনে হয় না।
তোমার কথা বুঝলাম না রি।
তোমার কথা শুনে তোমাকে একজন সুখী মানুষ মনে হয় না।
এ কথা কেন বলছ?
ছাড়! তুমি তোমার বাড়ির কথা কিছু বল। তোমার বাবা মা, তোমার পরিবারের কথা।
পরিবারে আমার সবচেয়ে আদরের হচ্ছে আমার বোন। সামনাসামনি আমরা দুজনে একে অপরকে একদমই সহ্য করতে পারি না। অথচ দুজনে দুজনকে খুব ভালোবাসি।
সে কি? এতো আজকের দুনিয়ার ঘটনা বলে মনে হচ্ছে।
মানুষের সম্পর্কগুলো এরকমই বোধহয়। এক মানুষের আর একমানুষকে ভালোবাসার ব্যাপারটা বোধহয় খুব একটা পাল্টায়না।
হুম তুমি ঠিকই বলেছ।
এরপরেই আসবে আমার মায়ের কথা। আমার মা খুব ভালো মাটির কাজ জানেন। মাটির কলসি বানানোতে পৃথিবীজোড়া তার খ্যাতি।
হি হি হি হি হি।
রি তুমি এত হাসছ কেন? ওহ, মাটির কাজের ব্যাপারটা তোমার দুনিয়ায় খুবই মামুলি তাই তো?
স্যরি স্যরি।
মাটি আমাদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার বস্তু।
সে আমাদের কাছেও। তবু শুনতে ইচ্ছে করছে, কেন ভবিষ্যতের মানুষ মাটিকে এতো শ্রদ্ধা করে।
দুটো কারণে। সামান্য কয়েকরকমের ধাতু আর মাটি ছাড়া অতীতের মানুষ আর কিছুই আমাদের ব্যবহারের জন্যে ছেড়ে যায়নি। দ্বিতীয়, এই মাটিই আমাদের এক ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা করেছে।
কি রকম?
যথেচ্ছ পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারে তিন হাজার সাল আসার অনেক আগে আগে থেকেই পৃথিবী ভয়াবহ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। হিমবাহগুলো গলিয়ে প্রায় শেষ করে ফেলেছিলে তোমরা অতীতের মানুষেরা। বৃষ্টি কম হচ্ছিল। আস্তে আস্তে মানুষ বাড়ি বানাচ্ছিল মাটির তলায়।
মাটির তলায়? কী ভাবে?
এখন যেমন তোমাদের বাড়ির ছাদটা উপরের দিকে হয়, পরের দিকে সেটাই হতে লাগল উল্টোভাবে। অর্থাৎ, ছাদটা হতো ভূপৃষ্ঠে। বাড়িটা আন্ডারগ্রাউন্ড। আর ঠিক সেইসময় একটা মহামারী হতে লাগল মানুষের মধ্যে। কেউ বলে আকাশ দেখতে না পাওয়ার জন্যে, আবার কেউ বলে তা সূর্যের আলো গায়ে না লাগার জন্যে। আবার কেউ বলে তা পারমাণবিক দূষণে।
কি রোগ?
বিষাদ। দুঃখ রোগ। মেলানকলিক। ডিপ্রেশন। পটাপট মানুষ মরতে লাগল। পৃথিবীর জনসংখ্যা খুব কম হয়ে গেল।
তারপর?
চিন্তা কর রি, এমন এক পৃথিবীর কথা, যেখানে সারিসারি ঘরবাড়ি আছে। অথচ তাতে মানুষ নেই। কলকারখানা, অফিস কাছারি সব আছে। তাতে কোনও লোক নেই। মাঠে চাষ হচ্ছে না। কোথাও কোনও কাজ হচ্ছে না। পারমাণবিক রিয়্যাকটারগুলো চালাবার লোক নেই। গাড়িগুলোতে তেল নেই। মাঝেমাঝে অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ। এরকম একটা সময়ে রিয়্যাকটরগুলো রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে বার্স্ট করল। কিছু মানুষ তখন মাটির তলায় তাদের বাড়িতে বসে গুমরোতে গুমরোতে বেঁচে রয়েছে। ভয়াবহ দৃশ্য।
তুমি এই ব্যাপার দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি। বিভিন্ন উপগ্রহ ক্যামেরা থেকে সংগ্রহ করা ছবি আমাদের মিউজিয়ামের আর্কাইভে আছে।
তারপর কী হল?
সকলের মনে হল এবার পৃথিবী থেকে মানুষ সম্পূর্ণ সাফ হয়ে যাবে। সব শেষ।
তারপর?
আর সে সময়েই এলেন কবি টগরবীর। মানুষের উপর প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধের সময়ে টগরবীর আমাদের শেখালেন এক আশ্চর্য উপায়। নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। নিজের মস্তিস্ক দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। যে কোনও উপায়ে, যে কোনও সময়ে নিজেকে খুশি রাখতে। মানুষ এক নতুন মহামানবের সন্ধান পেল। কবি টগরবীর আমাদের সৌভাগ্যক্রমে দীর্ঘজীবি ছিলেন। তার জীবদ্দশাতেই আমার পূর্বপুরুষেরা আবার বেঁচে থাকার নতুন উদ্যম পেলেন। মানুষ আবার একবার প্রায় শেষ হতে হতে বেঁচে গেল। শোক, দুঃখ, কষ্ট সব চিরতরে ভুলে গিয়ে তারা আবার বেঁচে থাকতে শিখল।
বাঃ তাহলে তোমাদের ভবিষ্যতে মানুষের তো কোনও অভাব নেই। সবদিক থেকে তারা পরিপূর্ণ।
ধর, তুমি এমন একটা প্রাসাদে আছ যেখানে সবকিছু আছে। অনেক লোকজন সেখানে। শুধু কেউ কারোর বন্ধু নয়। সেখানে কারোর একে অপরের জন্যে কোনও অনুভব নেই। তুমি কী সেই প্রাসাদে থাকতে চাইবে?
মানে?
আমার দুনিয়ায় বহু বছর ধরে কাছাকাছি থাকা একজন যখন হারিয়ে যায়, চলে যায়, মারা যায়, মানুষেরা কোনও কারণে যখন আর কাছাকাছি থাকতে পারে না, তখন তাদের একে অপরের কোনও অনুভূতি হয় না। তারা তাদের মনকে শান্ত রাখে। একে অপরকে বোঝায় এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার।
কী বলছ? এ তো দেবতাদের মতো ব্যাপার স্যাপার। দুঃখ নেই, রাগ নেই, অভিমান নেই, কষ্ট নেই। একেবারে যেন স্বর্গ স্বর্গ জায়গা।
হয়তো। তবে সবাই স্বর্গে থাকতে চায় না। এই পৃথিবীই কিছু মানুষের কাছে অনেক আকর্ষনীয়।
আচ্ছা সবার কথা হল। তোমার বাবার কথা তো হল না।
আমার বাবা খুব অদ্ভুত মানুষ, জান তো! আমি লক্ষ করছি আমার পৃথিবীর থেকে তোমার সময়ের মানুষের সঙ্গে তার অনেক মিল।
কেন বললে?
আগে বুঝতাম না, তবে এখন যেন মনে হয় আমার বাবার মধ্যে এই পৃথিবীর একটু একটু ব্যাপার রয়ে গিয়েছে। চারিদিকে দেবতাদের ভিড়ে আমার আজকাল নিজের বাবাকে অনেকটা মানুষ বলে মনে হয়। কে জানে, আমার বাবার জন্যেই আমি বোধহয় একটু অন্যরকম। আমার বাড়ির কথা তো অনেক হল। এবার তোমার বাড়ির মানুষদের কিছু কথা বল।
আমার বাড়ির মানুষের কথা আর কী বলার আছে। সবাইকে তুমি দেখেছই। কয়েকজনের রূপ ধরে তুমি আমাকে বোকা বানাতেও এসেছিলে। আমার বাবা মা দুজনেই খুব সোজা ধরণের মানুষ। আমায় খুব ভালোবাসেন।
তুমি খুব লাকি রিদম।
এ কথা কেন বলছ? তোমার বাবা মাও তো তোমায় ভালোবাসেন।
বাবা অবশ্যই বাসেন। কিন্তু মা-
কেন তোমার মা তোমায় ভালোবাসেন না?
হয়তো বাসেন। আমার আসলে ঠিক জানা নেই। আমার মা-ই আবার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমরা মায়ের বাড়িতেই থাকি। বাড়িটার নাম বত্রিশ। আমার বাবা বেশ পরিবারের প্রধান ধরনের ভাব রাখেন। অথচ আমরা সকলেই মনে মনে জানি আমাদের পরিবারে মায়ের কথাই শেষ কথা। আমার মায়ের সঙ্গে টগরবীরের কিছু একটা সম্পর্ক আছে। কারণ বত্রিশ নামের বাড়িটাতেই আগে থাকতেন টগরবীর।
ওয়াও! এটা তো দারুণ ব্যাপার। তুমি নিজে তার মানে টগরবীরের বংশধর?
হয় তো।
হয় তো কেন বলছ?
কারণ আমার মা টগরবীরের ব্যাপারে কোনও কথাই বলতে চায় না। কেন তা আমরা জানিনা। ঠিক যেমন আমরা বুঝে উঠতে পারি না মা আমাদের কতটা ভালোবাসেন বা আদৌও বাসেন কিনা। তার বেশিরভাগ কথাই খুব হেঁয়ালিমাখা। মাঝেমাঝে আমার মনে হয় তোমার সঙ্গে আমার এই দেখা হওয়াটা, কথা বলাটাও যেন তারই ইচ্ছেতে হচ্ছে।
পাগলা সাইক্রিয়াটিস্ট – উল্টোডাঙ্গা, ২০১০
বিশু যখন তার মেয়েকে নিয়ে উল্টোডাঙায় ভাঙাচোরা বাড়িটার সামনে পৌঁছল, তার মনে হল সে ভুল জায়গায় এসে গিয়েছে। ভুল ভাঙ্গল নেমপ্লেট দেখে। বাইরে নেমপ্লেট দেওয়া আছে। সাইক্রিয়াটিস্ট মাধব গুছাইত।
চেম্বারে ঢুকেই ছন্দা দেখল ভদ্রলোক একটা অদ্ভুত কাজ করছেন। খুব মন দিয়ে তিনি নাকের চুল ছিঁড়ছেন। একটি একটি চুল মন দিয়ে ছিঁড়ছেন। নাকের টিস্যু বেশ স্পর্শকাতর জায়গা। ছিঁড়তে গিয়ে মাধব গুছাইতের চোখে প্রায় জল এসে যাচ্ছে। তাও তিনি বেশ আয়েশ করেই ছিঁড়ছেন। ছেঁড়ার পরে সেই চুল তিনি বেশ মন দিয়ে দেখছেন। সেই চুল হাতের উপরের পিঠে রাখা হচ্ছে। তারপর হাতের তালুর উল্টোপিঠে সেই চুল রেখে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন। চোখের দৃষ্টি বেশ অপ্রকৃতস্থ। ছন্দার পরিস্কার ধারণা হল ভদ্রলোকের মাথার ঠিক নেই।
ছন্দার একবার ইচ্ছে হল ভদ্রলোককে বলে – হাতটা ধুয়ে এলে ভালো হয়।
কিন্তু তা না করে সে বেশ কৌতুহলের সঙ্গে মাধব গুছাইতকে দেখতে থাকল। মাধব গুছাইত সরাসরি তার দিকে তাকাচ্ছেন না। অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। ছন্দা চোখ অন্যদিকে ফেরালেই তাকে দেখছেন। তার দিকে চোখ সরু করে তাকাচ্ছেন। দু-একবার চোখে চোখ পড়তেই মাধব গুছাইত চোখ সরিয়ে নিলেন।
সে এখন ক্লাস ইলেভেনে পড়া একটি মেয়ে। তার যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব আছে। সে ঠান্ডা চোখে মাধব গুছাইতের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে রইল। যে মানুষ সোজাসাপ্টা দেখে না তার মনে চোর থাকে। তবে ছন্দার ধারণা হল, এ লোকটির মনে চোর নেই। এ পাগল। বিশেষ ধরনের পাগল।
ছন্দার বাবা বিশুবাবু গলাখাঁকারিয়ে বলল – ইয়ে ডাক্তারবাবু আপনাকে কাল ফোন করে ছিলাম। আমি বিশু মাইতি। ব্যান্ডেল থেকে। আমার মেয়ে ছন্দা। এর কথাই আপনাকে ফোনে বলেছিলাম।
মাধব গুছাইত হাসিহাসি মুখে বিশুর দিকে তাকিয়ে বলল – আচ্ছা আচ্ছা। এই সেই মেয়ে যার মাথায় ভূত আসে। কবিতা পড়ে। ভূতের নাম ঝকমক।
ছন্দা বলল – ঝকমক নয়। জিগজ্যাগ। আর সে কোনও ভূত নয়। সে একজন কবি।
মাধব গুছাইত ছন্দার দিকে তাকিয়ে একটু চালাক হাসি দিলেন। যেন তার সব মনে ছিল। তিনি ছন্দাকে বাজিয়ে দেখছিলেন। বললেন – কবিতা খুব ভালো জিনিস, আমার আবার কবিতা টবিতার কথা শুনলেই মাথার মধ্যে সব যেন লাট খেয়ে যায়। যাইহোক – বলেই বিশুর দিকে ফিরে বললেন – আপনার বাড়িটা কোথায় বলেছিলেন? ব্যান্ডেলে না? বড় চমৎকার জায়গা মশাই। আমার ভদ্রেশ্বরে আর ব্যারাকপুরে দুটো ফ্ল্যাট কেনা আছে। ব্যান্ডেলেও বাড়ির দাম বেশ বাড়ছে। প্রচুর ফ্ল্যাটের অফার পাচ্ছি। তবু গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি কেনার খুব শখ অনেকদিনের। আচ্ছা আপনার বাড়িটা কী গঙ্গার ধারে?
বিশু হঠাৎ এরকম প্রশ্ন শুনে একটু সামলে নিয়ে বলল – আজ্ঞে না।
মাধব গুছাইত মিটমিট করে হাসতে হাসতে বললেন – আমার আবার গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি কেনার অনেকদিনের খুব ইচ্ছে জানেন তো। এমনিতে আমার আরও চারটে বাড়ি আছে। তার মধ্যে দুটো ফ্ল্যাট। একটা গড়িয়ায় আর একটা বারাসাতে। বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর ইনভেস্ট করে রেখেছি বুঝলেন তো! দুটো বাড়ি। একটা বনগাঁয় ইছামতির ধারে আর একটা মেদিনীপুরে। রূপনারায়নের পাড়ে। বাড়িগুলো থেকে যে কী চমৎকার দৃশ্য দেখা যায় যে কী বলব। আমার অবশ্য এসব জায়গায় খুব একটা যাওয়া হয় না। আসলে শ্যামবাজারে এঁদোগলিতে ভাড়াবাড়িতে থাকি তো। সেখান থেকে এসব জায়গায় যাওয়া খুব চাপের।
বলতে বলতেই নাক থেকে তিনি একটা চুল ছিঁড়ে নিলেন। ব্যথায় তার চোখ ছলছল করে এল। চুলটিকে পরম মমতায় একটু দেখে হাতের তালুর উল্টো দিকে রেখে ফুঁ দিয়ে তিনি উড়িয়ে দিলেন।
ছন্দা নিজের বাবার দিকে তাকাল। কী শুনে তিনি এই পাগলা সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিজের সুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করাতে এনেছেন ভগবানই জানেন। মাধব গুছাইত ঝট করে ছন্দার দিকে ঘুরে গিয়ে বললেন – জিগজ্যাগের ব্যাপারটা একটু ছোট করে বলবে? আমার হাতে আজ একদম সময় নেই। রাজারহাটে একটা বাড়ি দেখতে যেতে হবে।
ছন্দার বিরক্তি লাগছিল। এরকম একটা মাথাখারাপ লোকের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। সে চুপ করে বসে রইল।
জিগজ্যাগ কী রোজই আসে তোমার কাছে?
কিছুদিন পরপর আসে।
জিগজ্যাগকে দেখতে কেমন?
তাকে দেখা যায় না। তবে তার কথাবার্তা শুনে মনে হয় তার বয়েস অল্প। কুড়ি বাইশের মধ্যে।
আচ্ছা। তা জিগজ্যাগের সম্পর্কে কিছু বল? যেমন সে কী করে? তার ভবিষ্যতের বাড়িতে কে কে আছে?
সে কবিতা খুব ভালোবাসে। অনেক কবিতা জানে। তাদের সমাজে শিল্পী, কবি এদের খুব সন্মান।
অনেক কবিতা জানে। তোমার থেকেও বেশি?
তা কী করে জানব। সে ভবিষ্যতের মানুষ। সে যেসব কবিতা জানবে আমি তা নাও জানতে পারি।
জিগজ্যাগ কবিতা ভালোবাসে এতো খুব ভালো ব্যাপার। আমিও একসময় কয়েকটা কবিতা পড়েছিলাম। বেশিরভাগই ভুলে গিয়েছিলাম। আজ সকাল থেকে সেরকম একটা কবিতা দেখি মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে। হঠাৎ করে কেউ যেন মাথায় ঢুকিয়ে দিল। আচ্ছা ধর তাকে এমন একটা কবিতার কথা বলা হল যা বহুদিন আগে বাংলাভাষায় লেখা, সেটাও সে জানবে?
জানতেও পারে। আমি কখনও তার পরীক্ষা নিইনি।
এই দেখ আমি কাগজে সেই ভুলে যাওয়া কবিতাটা লিখে রেখেছি। আবার যদি ভুলে যাই। দেখ দেখ। একদম বাংলা ভাষায় লেখা। অনেকদিন আগেকার ভাষা যদিও। আমার মনে হয় তুমি এটা জান না –
হাঁউ নিরাসী খমণ ভতারি।
মোহোর বিগোআ কহণন জাই॥
ফেটলিউ গোমাএ অন্ত উড়ি চাহি।
জাএ থুবা হামসো এথু নাহি॥
পহিল বিআণ মোর বাসনয়ূড়া।
নাড়ি বিআরন্তে সেব বায়ূড়া।
জাণ জৌবণ মোর ভইলে সিপূরা।
মূল মখলি বাপ সংঘারা॥
ভনথি কুক্কুরিপা এ ভবথিরা।
জো এ থু বুঝএ সো এ থু বীরা॥
কবিতা দেখে ছন্দার মনে হল মাধব গুছাইত খুব সাধারণ ধরনের পাগল না। বেশ বড় রকমের উন্মাদ।
ছন্দা মাথা নেড়ে বলল – এ রকম কোনও কবিতা নেই। হতেই পারে না।
মাধব গুছাইত বেশ আনন্দিত গলায় মাথা নেড়ে বললেন – বাঃ তার মানে তুমি কবিতাটা জান না। এবার দেখার দরকার জিগজ্যাগ কবিতাটা জানে কি না।
ছন্দার এত বিরক্তি লাগছে যে তার কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার মনে হচ্ছে এই মনোচিকিৎসকটির খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হওয়া প্রয়োজন।
মাধব গুছাইত একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন – আচ্ছা ছন্দা তোমার কখনও মনে হয় না এই ভূতটা, স্যরি এই ভবিষ্যতের লোকটা এতো মানুষ থাকতে তোমার কাছে কেন আসে? তোমার সঙ্গেই দিনের পর দিন গল্প করে? তোমাকে তো বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে মনে হয় দেখে। এই বেসিক প্রশ্নটা তোমার মাথায় আসেনি কখনও?
আমাদের আলাপটা হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিল। তারপর দেখা গেল ওর একটা গভীর সমস্যা আছে। ও ওর সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করে?
কী সমস্যা?
ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ওর বাড়ির সকলেই খুব কৃতী। আর ও তাদের মাঝখানে কিছু করে উঠতে পারছে না।
ও কী করতে চায়?
ও একজন বড় কবি হতে চায়। ভবিষ্যতে সমাজে কবিরা সবচেয়ে উঁচু জায়গা পেতে চলেছে। ও প্রচুর কবিতা জানে। কিন্তু লিখতে পারেনা। কারণ সত্যিকারের কবি হয়ে উঠতে গেলে একটা বিশেষ ব্যাপার থাকার দরকার।
কী ব্যাপার?
তা আমি জানি না। তবে ও যা লিখতে চায় তা লিখতে পারে না। নিজের কোনও লেখাই ওর মনঃপুত হয় না। তাই ও আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে।
তুমিও তো প্রচুর কবিতা পড়, তাই না?
হ্যাঁ।
তুমিও নিশ্চয়ই যা লিখতে চাও তা লিখতে পার না। অথচ তুমি খুব বড় কবি হতে চাও। ঠিক বলছি তো?
ছন্দা চুপ করে রইল। মাধব গুছাইত বললেন – দেখ ছন্দা, তোমার পুরো সমস্যাটাই আমি জানি। তোমার বাবা আমাকে ফোনে সবই বলেছেন। তাও আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম। কেন জান?
ছন্দা আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে না বলল।
মাধব গুছাইত বললেন, – তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে। আর খুব অনুভূতিপ্রবণ। তুমি একটু ভেবে দেখ যে মনেমনেই তুমি একজনকে তৈরি করনি তো যাকে তুমি জিগজ্যাগ ভাবছ। তোমার মতো বয়ঃসন্ধির মেয়ের কাছে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এ বিষয়ে আমি আরও অনেক কিছু বলতে পারতাম। বলছি না কারণ আমায় রাজারহাটে একটা ফ্ল্যাট দেখতে যেতে হবে। বাড়ির দালাল পৌঁছে গিয়েছে। সে আমায় পাগলের মতো ফোন করছে। এই দেখ এরমধ্যে সে কুড়িবার আমায় মোবাইলে মিসড কল দিয়েছে।
বলে মিউট করে রাখা মোবাইলটা তুলে তিনি দেখাতে লাগলেন।
বিশুবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন – আমরা তাহলে আজ আসি স্যার।
মাধব গুছাইত কবিতার কাগজটা ছন্দার হাতে দিয়ে আরাম করে নাকের চুল টানতে টানতে বললেন – আসুন।
বেরিয়ে লিফটে উঠেই বিশু পকেটে হাত দিয়ে বললেন – এই যাঃ গাড়ির চাবিটা মনে হচ্ছে ওনার চেম্বারেই ফেলে এসেছি। তুই নাম। আমি নিয়ে আসছি।
এতক্ষণ পরে ছন্দার মেজাজ একটু ঠিক হল। লিফটে করে নামতে নামতে সে একটু মুচকি হাসল। ভাবল – তার বাবা বানিয়ে কথাটাও বলতে পারেনা। একটা নেহাৎই বাজে অজুহাত দিয়ে মাধব গুছাইতের সঙ্গে একটু কথা বলতে গেল।
বিশু তাড়াতাড়ি করে ফিরেই দেখলেন, মাধব গুছাইত চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাকে দেখে চোখ মিটমিট করতে করতে বললেন – কী ব্যাপার, কবিতাটা আসল কি না জানতে এসেছেন?
বিশু মনে মনে ভাবলেন – নাঃ লোকটার বেশ ক্ষমতা আছে। মুখে বললেন – আজ্ঞে হ্যাঁ।
মাধব গুছাইত বলল – মেয়েকে তো লিফটে পাঠিয়েছেন মনে হচ্ছে। তাহলে চলুন আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামি।
নামতে নামতে মাধব গুছাইত বললেন – কবিতাটা শুধু আছে তাই নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বইতে আছে। বইটার নাম চর্যাপদ। লেখা হয়েছিল বাংলার পালরাজত্বের শেষের দিকে। লিখেছিলেন এমন এক কবি যাকে কেউ বলে নারী আবার কেউ বলে পুরুষ। বাংলায় মানুষজনের যখন মুসলিম আক্রমণে খুব দুরবস্থা, সেই চিলুবিলু অবস্থার সময় বইটা হারিয়ে যায়। তারপর অনেক বছর পরে নেপালের রাজার লাইব্রেরিতে এই বই পাওয়া যায়।
আশ্চর্য ঘটনা এটা নয়। আশ্চর্য ঘটনা হল এই কবিতাটা আমি ছাত্র অবস্থায় পড়েছিলাম, এবং সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। আপনারা আসার দশমিনিট আগে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে আমার কবিতার প্রত্যেকটা লাইন মনে পড়ে গেল। কিন্তু কিছুতেই কবির নামটা মনে করতে পারলাম না।
উপসংহার
রি
হুম
তুমি কী করছিলে?
তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
তুমি কী জান আমাদের দুজনের দুজনের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
ছাড় ওসব কথা। তুমি তো অনেক কবিতা জান বলত এটা কার লেখা–
হাঁউ নিরাসী খমণ ভতারি।
মোহোর বিগোআ কহণন জাই॥
ফেটলিউ গোমাএ অন্ত উড়ি চাহি।
জাএ থুবা হামসো এথু নাহি॥
পহিল বিআণ মোর বাসনয়ূড়া।
নাড়ি বিআরন্তে সেব বায়ূড়া।
জাণ জৌবণ মোর ভইলে সিপূরা।
মূল মখলি বাপ সংঘারা॥
ভনথি কুক্কুরিপা এ ভবথিরা।
জো এ থু বুঝএ সো এ থু বীরা॥
এটা একটা অনেক পুরানো কবিতা। এটার দুটো মানে হয়। একটা সাধারণ আর একটা অসাধারণ মানে। আমাকে মা অনেক ছোটবেলায় এই কবিতাটা শুনিয়েছিল। অত্যন্ত রহস্যময়ী কবির লেখা এ কবিতা। অনেকেই ভাবে তিনি একজন নারী। তাই এ কবিতাও খুবই রহস্যময়। এটা সান্ধ্যভাষায় লেখা। কবি টগরবীরও এই ভাষায় লিখতেন।
ছন্দার খুব আনন্দ হল। আবার প্রমাণ হয়ে গেল জিগজ্যাগ সত্যিই আছে। এ কবিতা সে জানত না। জিগজ্যাগ জানে।
তোমার খুব আনন্দ হচ্ছে ছন্দা। সাইক্রিয়াটিস্টকে তুমি ভুল প্রমাণিত করেছ।
তোমার সঙ্গে এই এক অসুবিধা। আমি অনেক কিছু বোঝাবার আগে তুমি বুঝে যাও।
তুমিও অনেক কিছু বোঝ ছন্দা। যা আমি বুঝি না।
যেমন?
এই যেমন তুমি ভেবে ভেবে বার করে ফেলেছ কিসের অভাবে আমার যুগে সত্যিকারের কবির জন্ম হচ্ছে না। একজন কবি হতে গেলে সবচেয়ে বেশী কি প্রয়োজন? তাই তো?
ঠিক বুঝতে পারিনি। তবে হতেও পারে যেটা বুঝেছি সেটাই ঠিক। তুমি এই কবিতাটার মানে বোঝাও।
এই কবিতার মানে বোঝান খুব শক্ত। তুমি তো জান কবিতা একটা অনুভবের ব্যাপার। আর এই কবিতা অনুভবেরও বাইরে। এ কবিতা যাপন করার কবিতা। নিজের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে যা যাপন করতে হয়।
তবু বোঝাও। আমার এই কবিতার মানে বুঝতে ইচ্ছে করছে।
পৃথিবীর আরও অনেক শ্রেষ্ঠ কবিতার মতো এর বিভিন্ন মানে হয়। এর একটা মানে এভাবে করা যায় যে, কবি শুধু প্রসব করে যান। অথচ তিনি যা বিয়োন তা তিনি দেখতে পান না। তার বাসনা এক যোগ্য সন্তানের, কিন্তু সেই যোগ্য মানুষ তিনি কিছুতেই খুঁজে পান না। তার নবযৌবন পূর্ণ, তবু বপনক্ষেত্র কিছুতেই পূর্ণ হচ্ছে না। অথচ তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার স্থির বিশ্বাস একদিন তিনি যা খুঁজছেন তা ঠিক পাবেন। গভীর অনুভবের কথা। সবাইকে যা বোঝান যায় না।
বড্ড হেঁয়ালি ধরনের কথা।
টগরবীরের কবিতাতেও এমন এক চরিত্রের কথা পাওয়া যায়। এক আদিকবির কথা। মানুষের যখন চরম দুরাবস্থা হয় তখন তাকে পথ দেখাতে তিনি আসেন। এক মহাসিদ্ধা। তাঁর সিদ্ধির জোরে তিনি বত্রিশস্বর্গের সবচেয়ে উপরের স্বর্গ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ফিরে এসেছিলেন পৃথিবীতে। তিনি জানতেন সব স্বর্গসুখের চেয়েও বড়সুখের সন্ধান তিনি পেয়েছেন। কোনও কিছু পাওয়ার থেকেও ত্যাগের সুখ নাকি আরও বড়। তাতে অনেক বড় প্রাপ্তি।
জিগ!
বল রি।
তুমি আমার সঙ্গে সবসময় এমন করেই থাকবে তো সারাজীবন?
আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? আমি একদিন সত্যিই এক কবি হয়ে উঠব?
আমি জানি না।
ঠিক বলেছ রি, তুমি জান না। আমি জানি। আমি আর কবি হতে চাই না। আমি আর কিছুই হতে চাই না। আমি চাই যাতে সবসময় এমনি করে তোমার সঙ্গে, তোমার পাশে বসে থাকি। আর তোমায় দেখি।
২০১২ সালের এক মার্চ মাসে ছন্দা বিদেশ চলে গেল। বিশু আর মিতালি চাইছিলেন তাদের মেয়ে অন্য কোথাও যাক। দেশেরই অন্য কোনও জায়গায়। তারা এ কথা পাড়তেই তাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে ছন্দা এককথায় রাজি হয়ে গেল। নতুন দেশে সে গেল এবং সেখানেই থেকে গেল।
বিশু সিনেমা হলদুটো ভেঙে ফেললেন। প্রভঞ্জন চৌধুরী মারা যাওয়ায় হিরো চন্দন মাল রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। তার বোকাসোকা ভালোমানুষের অভিনয় দেখে এখন আর লোকে ভুলছে না। বিশু সেখানে একটা লাইব্রেরি বানালেন। মিতালি এসে সারাদিন বসে থাকেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে এসে বই পড়ে। দুজনে তাদের দেখেন আর ভাবেন একসময় তাদের মেয়ে একদিন ফিরে আসবে। বহুদিন পরে সে যখন ফিরবে তখন সে জিগজ্যাগকে পুরোপুরি ভুলে যাবে। ভবিষ্যত কখনও অতীতকে পাল্টাতে পারেনা। সময়ের এমনই নিয়ম।
৩৫১৮ সালে ওই একই জায়গায় মাটির তলায় রয়েছে একটা ডোম থিয়েটার। জিগজ্যাগ পুরস্কার নিতে উঠেছে। প্রচুর মানুষের ভিড় চারিদিকে। সারা পৃথিবীর মানুষ, যারা আসতে পারেনি তারা নিজেদের মনে লাইভ শো দেখছে। মঞ্চের সামনে গর্বিত মুখে বসে আছে তার বাবা টিনটিন টু। এযুগের মানুষের মতো তিনি মেপেমেপে খুশি হতে পারেন না। তার মুখ জ্বলজ্বল করছে। মাঝে মাঝেই তিনি উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ছেন। হাত টাত ঘষছেন। আজ তার বড় আনন্দ। আপেলও আজ খুব খুশি। বন্ধুদের সঙ্গে সেও বসে আছে। নিজের দাদাকে নিয়ে তার গর্বের অন্ত নেই।
জিগজ্যাগ তার মহাকাব্য শেষ করেছে। মহাকাব্যের বিষয়বস্তু বর্তমানের একটি ছেলের সঙ্গে বহুযুগ আগেকার একটি মেয়ের বন্ধুত্ত্ব। তাদের মধ্যে মিল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। অথচ কোনও এক অজানা সুতোয় তারা বাঁধা।
মহাকাব্যটি এ মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য বলে স্বীকৃত হয়েছে। মহাকাব্যটির বিশেষত্ব হচ্ছে পড়ার চেয়ে গান গেয়ে শোনালে আরও ভালো লাগে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। জিগজ্যাগকে টগরবীরের মতো বড় কবি বলে মনে করা হচ্ছে। আজ তারই সম্বর্ধনা।
জিগজ্যাগের লেখা পড়ে মানুষের মনে এক নতুন অনুভূতির জন্ম হচ্ছে। পড়া শেষ করার পরে কি যেন একটা গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকে। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একা একা বসে থাকতে ভালো লাগে। মন করে অজানা কোথাও চলে যেতে। কিছু চেনা মানুষের নাম বেশি করে মনে পড়ে। মানুষ এখনও এই অজানা অনুভূতির নামকরণ করতে পারেনি।
মঞ্চ থেকে অনেকটা দুরে বসে আছেন কুক্কুরীপা। মায়েরা সন্তানের অনেক না বলা কথাও বোঝে। তিনি জিগজ্যাগকে দেখছেন। তার সন্তান অনেক বড় কবি হবে। ভুবনজোড়া তার নাম হবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের সঙ্গে একাসনে বসাবে। কিন্তু মানুষ হিসাবে সে বড় কষ্ট পাবে। তার হৃদয় রক্তাক্ত হবে। আর সেই ক্ষতবিক্ষত হৃদয় সে সারাজীবন বহন করে বেড়াবে। কবি হওয়ার সবচেয়ে বড় দান সে দিয়েছে। সে নিজের মনের উপর তার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়েছে। চিরখুশির জগৎ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছে। বহু বহুযুগ আগে মানুষ এ রকম ছিল। তার সন্তান সেই মাটিমাখা মানুষের মতো হয়ে গিয়েছে।
তিনি মহাসিদ্ধা। বহুদিন আগে বুঝেছিলেন মানুষের বড় দুঃসময়। পৃথিবীর উপর থেকে সদ্য নিচে আসা মানুষগুলো তখন বিচলিত, দিশাহারা। তিনি বিস্তার করলেন এক অপূর্ব মায়াজাল। তাদের মধ্যে পরিচিত হলেন কবি টগরবীর নাম নিয়ে। তাদের ছড়িয়ে দিলেন মন নিয়ন্ত্রণের, আজীবন নিজেকে সুখী ভাবার এক মায়াজাল। মায়ার এই সংসারে, চিরায়ত আনন্দের, খুশির এক মহামায়া।
আজ একজনকে তৈরি করলেন। যে সেই মায়াজাল কেটে তাদের বার করবে। কোনও একদিন সে তাদের পৃথিবীর মাটির উপরে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবে। তারা আবার সূর্যের সন্তান হয়ে গায়ে রোদ মাখবে, জোৎস্নায় বসবে। দুঃখ, বেদনাকে চিনবে ও জানবে। জানবে এই পৃথিবীই হল স্বর্গ। বত্রিশ স্বর্গের অবস্থান এখানেই। যে কথা বহুযুগ আগে তিনি অনুভব করেছেন। যে অনুভবের কথা কারোকে বলা যায় না। শুধু বোঝান যায়। ভালোবাসার মানুষকে বোঝান যায়। মানুষ আবার ভালোবাসতে শিখবে।
আজকাল তার বড় ক্লান্ত লাগে। গভীর ঘুম আসে। অনেকদিন স্বপ্ন দেখা হয় না। তবু তার মন আজ প্রশান্তিতে ভরে আছে। তিনি ঘুমোলে, হয়তো চমৎকার একটা স্বপ্নও দেখবেন। নদী, বন, ফুল, পাখি নিয়ে এক চমৎকার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের কোনও অর্থ থাকবে না। সেই স্বপ্নে হয়তো একটি চমৎকার মেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। মেয়েটি বড় ভালো। সে এসে তার মায়াময় চোখদুটো তুলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে চোখে প্রশ্ন থাকে। কুক্কুরীপার কাছে সে প্রশ্নের জবাব থাকে না। তাকে তিনি চেনেন। সেই মেয়েটি খুব দুঃখ পেয়েছিল, কিন্তু তার দুঃখের কথা সে কাউকেই কোনওদিন বলেনি। কারও ওপর তার কোনও রাগ নেই।
মেয়েটিকে তার বলতে ইচ্ছে করে – এই পৃথিবী এক নারী। এই প্রকৃতি এক নারী। নারীরাই পুরুষদের জন্ম দেয়, তাদের বাঁচিয়ে রাখে, একজন প্রকৃত পুরুষে পরিণত করে পৃথিবী, প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। পুরুষের সে ক্ষমতা নেই। নারীদের অনুভব বোঝার ব্যাপারে তারা বড়ই আনাড়ি।
অথচ স্বপ্নে তাকে কিছুই বলা হয়না। এখন নিজের সন্তানকে দেখতে দেখতে ফিসফিস করে কুক্কুরীপা বলে উঠলেন – ভনথি কুক্কুরিপা এ ভবথিরা। জো এ থু বুঝএ সো এ থু বীরা।
এ সংসার স্থির। যে এই কথাটি বোঝে, সেই আসলে বীর।
Tags: কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, জিগজ্যাগ ও দুজন রানী, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী, পূজাবার্ষিকী
টগরবীর = রবি টেগর
দুর্দান্ত এক গদ্য, ভাবনার নতুনত্ব, সব মিলিয়ে চমক প্রদ!!!
আশ্চর্য ভালো উপন্যাস! আপনাকে কিভাবে অভিনন্দন জানাব জানি না। একেবারে নতুন কনসেপ্ট, অথচ কী সহজ ভাবে বলা গল্প! আপনার ভাষায় যাদু আছে।
আহা! ভারি স্নিগ্ধ লেখা!
–অগ্নিভ
বেশ লাগলো ভাবনাটা। লেখাটা আরেকটু ছড়িয়ে জিগজ্যাগের যন্ত্রণা তৈরি হওয়া আর তা থেকে কবিতা বেরোনোটা বর্ণনা করা গেলে আরো ভালো লাগতো। চর্যাপদের ব্যবহার ভাবনার জন্য স্যালুট।
Home othar aagei ses hoye gelo thik keno sanjhbatir rupkotha
হিরো চন্দন মালের …sir,chadmo naam ta ekebare zata diechen.
galpo tao khub bhalo laglo.
prosenjit
Sohoj shundor lekha.