জীববিজ্ঞানের তন্তুর জাল
লেখক: সুপূর্ণা সিংহ
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
একটি মাটির বাড়ির চালের দিকে তাকালে দেখা যায় চালটা অনেক ধরণের দড়ি, কাঠি দিয়ে তৈরি – তাদের মধ্যে কিছু কিছু কঠিন, কিছু কিছু নরম। চালটা গড়তে খড়, দড়ির মতো নরম তন্তু যেমন ব্যবহার হয়েছে, তেমনি ব্যবহার হয়েছে বাঁশের মতো কঠিন বস্তু।
জীবজগতে আমরা একই ধরণের গঠন লক্ষ্য করি। আমাদের শরীরের মধ্যেও দেখি বিভিন্ন নমনীয়তার দড়ি, কাঠির ব্যবহার। আমাদের কঙ্কাল তৈরী শক্ত হাড় দিয়ে। তার ওপরে নরম অ্যাকটিন (Actin) তন্তু রয়েছে আমাদের পেশীতে। এইভাবে একের পর এক পরত কঠিন আর নরম তন্তুর জাল দিয়ে তৈরি আমাদের দেহ।
আমরা যত ছোট স্তরে যাই, দেখি যে বিভিন্ন নমনীয়তার লম্বা তন্তু (polymer) আমাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিছু কিছু তন্তু হয় সূচের মতো কঠিন অন্যগুলি হয় সুতোর মতো নরম। আরো কিছু তন্তু আছে যেগুলো ‘টয়াইন’ (twine) সুতোর মতো – খুব শক্তও নয় খুব নরমও নয়। আমাদের দেহের কোষ ‘সাইটোস্কেলিটন’ (cytoskeleton) – এর শক্ত জটায় আবদ্ধ। এই সাইটোস্কেলিটন নানা নমনীয়তার তন্তু দিয়ে তৈরি। তা কঠিন মাইক্রোটিউবিউল (microtubule), অ্যাকটিন (Actin), তাছাড়া আরো অনেক মাঝারি নমনীয়তার তন্তুর জট দিয়ে তৈরি। আমাদের ‘জিন’ এর সূত্র যে পদার্থের মধ্যে নিহিত, সেই DNA হল একটা মাঝারি নমনীয়তার পলিমার (semi-flexible polymer)। একজন মানুষের DNA প্রায় এক মিটার লম্বা। ভাবতে আশ্চর্য লাগে কিভাবে অতো লম্বা একটি অণু একটি কোষের কেন্দ্রে কয়েক মাইক্রন (১০–৬ মিটার) পরিসরের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। এটা কিছুটা যাত্রার পূর্বে সুটকেসের মধ্যে কাপড়–চোপড় গোছানোর মতো। যদিও DNA এর ক্ষেত্রে এই কাজটা অনেক কঠিন, কারণ কোষের মধ্যে তাপজনিত ওঠা–নামা রয়েছে। DNA আর অন্য জৈব পলিমারের স্থিতিস্থাপকতা বোঝা আমাদের প্রয়োজন – কারণ তার থেকেই আমরা জানতে পারব কিভাবে তাদের স্থিতিস্থাপকতা কোষ সমূহের মধ্যে তাদের বিভিন্ন কাজকর্ম করতে সাহায্য করছে। DNA তার বিভিন্ন কাজকর্ম করার জন্য বিভিন্ন আকার ধারণ করে। যেমন প্রতিলিপি তৈরীর সময় জিনের সূত্রের অণুলিপি তৈরীর সুবিধার জন্য DNA- এর জটা খুলে যায়। আবার জিনের সূত্র অক্ষুন্ন রাখার জন্য DNA একটা পাকানো টেলিফোনের তারের মতো হয়ে থাকে। এইসব বিভিন্ন আকারের DNA আর অন্যান্য জৈবিক পলিমারগুলোর গঠন ও কর্মপ্রণালী বুঝতে গেলে তাদের স্থিতিস্থাপকতা সম্বন্ধে সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
জৈবিক স্থিতিস্থাপকতার কেন্দ্রে রয়েছে একটি দৈর্ঘ্য। এর নাম হ’ল ঋজু দৈর্ঘ্য (persistence length)। এই দৈর্ঘ্য দেখে আমরা বুঝতে পারি একটি জৈব পলিমার, যেটা তাপের ওঠা নামার মাঝে ঝাঁকুনি খাচ্ছে, তার দৃঢ়তা কতটা। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, এই দৈর্ঘ্যের মধ্যে পলিমারটি ঋজু – যেমন ধরা যাক একটা গাছের শক্ত ডালের ঋজু দৈর্ঘ্য একটা লতার বোঁটার থেকে অনেক বেশী। কোষের গণ্ডিতে সাইটোস্কেলিটনের অ্যাকটিন তন্তুর দৈর্ঘ্য ১৬ মাইক্রন (১৬ × ১০–৬ মিটার)। অপরপক্ষে DNA এর মতো নমনীয় জৈব তন্তুর ঋজু দৈর্ঘ্য হল ৫০ ন্যানোমিটার (৫০ × ১০–৯ মিটার)।
জৈবিক অণুর পরীক্ষা
আগে DNA ও অন্যান্য জৈবিক অণুর পরীক্ষা নিরীক্ষা হতো অনেকগুলো অণুর সমষ্টি নিয়ে। এর ফলে পৃথকভাবে একেকটি অণুর স্থিতিস্থাপকতা সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যেত না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, স্থিতিস্থাপকতা প্রোটিনের সাহায্যে DNA অণু বাঁকাতে সাহায্য করে। জৈবিক অণুগুলোকে আলাদা করে টেনে, মোচড় দিয়ে তাদের স্থিতিস্থাপকতা সম্পর্কে জানতে পারি। সেই অণু একটা সুতোর মতো পাকানো DNA থেকে শুরু করে একটা ভাঁজ করা প্রোটিন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকারের অণু হতে পারে। ১৯৯৪ সালে কার্লোস বুস্তামান্তে (Carlos Bustamante) আর তাঁর সহকর্মীরা DNA’র স্থিতিস্থাপকতা মাপলেন। DNA অণুর একপ্রান্ত একটা কাচের পাতের সঙ্গে আটকালেন, অন্য প্রান্তটাতে আটকানো হল ১ মাইক্রন (১০–৬ মিটার) পরিসরের একটা চৌম্বকীয় দানা। DNA অণুকে টানা হল একটা চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সাহায্যে আর DNA অণুর দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি মাপা হ’ল চৌম্বকীয় দানাটিকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে রেখে। এই মাপের সাহায্যে তৈরী হ’ল DNA –র বল–দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি (force extension) চিত্র। দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি বলতে আমরা এখানে বোঝাচ্ছি DNA –র দুই প্রান্তের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি। পুরো DNA অণুর দৈর্ঘ্য কিন্তু একই থাকে, বদলায় না। এছাড়াও DNA –র স্থিতিস্থাপকতা মাপার জন্য আরেকটা পরীক্ষা করা হয়। চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সাহায্যে আগের পরীক্ষার মতো করে সাজিয়ে তারপর চুম্বকের সাহায্যে চুম্বকের দানাটা ঘুরিয়ে DNA অণুকে মোচড় দেয়া হয়। এইভাবে DNA –র মোচড়ের সঙ্গে যুক্ত স্থিতিস্থাপকতা (twist elasticity) –র বিশ্লেষণ করা যায়। এই মাপের সাহায্যে DNA –র দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি কিভাবে মোচড়ের সঙ্গে বদলায় তার চিত্র পাওয়া যায় আর তার থেকে DNA –র মোচড় ভিত্তিক জৈবিক কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারা যায়। যেমন, DNA কোষের কেন্দ্রে গুছিয়ে ভাঁজ করার পথে প্রথমে হিস্টোন প্রোটিনের নলের ওপর লতার মতো পাকিয়ে যায়। এরnজন্য DNA –র মোচড় দিয়ে পাক খাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। একটা ‘দড়ির খেলা’ দিয়ে এই প্রবন্ধ শেষ করছি। আশা করছি এই সহজ খেলার মধ্যে দিয়ে DNA ও অন্যান্য জৈব তন্তুর স্থিতিস্থাপকতা জনিত কার্যকলাপ কিছুটা স্পষ্ট হবে।
DNA এর বল – দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি চিত্র (Force – Extension Graph of DNA)
দড়ির খেলা
একটা পরীক্ষা সহজেই করা যায়, যেটা ভাবা যেতে পারে বড়ো মাপের একটা ‘DNA পরীক্ষা’। Lemons আর Lipscombe এই পরীক্ষা করেছেন।ধরা যাক ছোট (০.১ মিটার), বড়ো (০.৮ মিটার) মাপের দড়ি নেয়া হ’ল যার ঋজু দৈর্ঘ্য ০.২৫ মিটার। বিভিন্ন দৈর্ঘ্য (l) নির্ণয় করার জন্য প্রতিটা দড়ির ওপর কয়েকটা দাগ দেয়া হ’ল। এরপর দড়িটা ২ মিটার উচ্চতা থেকে ফেলার পর দড়ির এক প্রান্ত থেকে এই একেকটা দাগ পর্যন্ত দূরত্ব নির্ণয় করে সেই একই পরীক্ষা চল্লিশবার করা হল। সব শেষে প্রতিটা দৈর্ঘ্য (l) এর জন্য দড়ির দুই প্রান্তের মধ্যে ব্যবধান মাপা হ’ল। ধরা যাক সেগুলো r1, r2, r3 ……. ইত্যাদি। এবারে সব শেষে,
<r> = 1/40 [r12 + r22 + r32 + …. + r402] অঙ্ক কষে বার করা হ’ল। এবারে <r2> কিভাবে দৈর্ঘ্যের সঙ্গে বদলাচ্ছে তার একটা চিত্র তৈরী করা হল – তার থেকে নির্ণয় করা যায় দড়িটা কতটা দৃঢ় বা কতটা নরম।
DNA তন্তুর জাল
Tags: জীববিজ্ঞানের তন্তুর জাল, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, প্রবন্ধ, সুপূর্ণা সিংহ
জীব বৈশিষ্ট্যের দুরূহ বিজ্ঞান এক ছন্দোবদ্ধ শিশু সুলভ সারল্যে উঠে এসেছে মেদ বর্জিত বিনির্মাণে। লেখিকা নিজের বিজ্ঞান সাধনার বোধ জারিত করেছেন আগামী প্রজন্মের মধ্যে।