টাইম লকার
লেখক: প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
প্রফেসর পুরকায়স্থ গান শুনতে ভীষণই ভালবাসেন। একজন বৈজ্ঞানিক হলেও গানবাজনার দিকে তাঁর বরাবরই ঝোঁক ছিল। যদিও ইদানীং তিনি বেশির ভাগ সময়টাই আকণ্ঠ খেয়ে থাকেন, তবুও বৈজ্ঞানিক হিসেবে তাঁর কর্মদক্ষতা নেহাত অস্বীকারও করা যায় না। আসলে প্রথাগত পড়াশোনায় তাঁর খুব একটা আগ্রহ ছিল না, তাই ওঁর যুগান্তকারী গবেষণামূলক থিয়োরিগুলোর জন্য বিশেষ কোন সরকারী আর্থিক সাহায্যর ব্যবস্থা করা গেলো না। সায়েন্স কলেজে পড়িয়েই আপাতত উনি দিনাতিপাত করছেন। তবে নেহাত শখেই তিনি একটা ল্যাবরেটরি বানিয়ে নিয়েছেন। সরকারী সাহায্য তেমন না পেলেও তার বানানো কিছু জিনিসের খোলা বাজারে বিক্রি মন্দ নয়। এখন যেমন তিনি একটা রোবট বানানোয় মন দিয়েছেন। তা রোবট তো কতোই আছে বাজারে, ওঁরটার বিশেষত্ব কি? না আসলে, এই রোবটটি পানীয় বানানোতে বড়ই পটু! সে ড্রাই মারতিনি হোক কিম্বা জিন পাহিত! কিম্বা জুয়ান কলিন্স বা নিতান্তই শ্যান্দি, নামটা শুধু বলার অপেক্ষা। আট – দশ মাস লাগলো অবশ্য জিনিসটা বানাতে, কিন্তু কাজের হয়েছে। আপাতত একটা ভেসপার মারতিনি অর্ডার করে তিনি আরামকেদারায় আরাম করে বসলেন। নাহ, গবেষণাগারটা বড্ড এলোমেলো হয়ে আছে – রোটা ভেপর, গ্লভ বক্স, রিওমিটারগুলোতেই অর্ধেক জায়গা ভরে গেছে। টেবিলের ওপরে এদিক সেদিক ছড়ান রাউন্ড বটম ফ্লাক্স, ম্যাগনেটিক স্টারার, ফানেল, বিকার, টেস্ট টিউব ইত্যাদি। আচ্ছা আপাতত যেগুলো বিশেষ কাজে লাগছে না সেগুলোকে ওই বাক্সে ঢুকিয়ে…
“প্রফেসর সাব, কেমন আছেন? অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম না তো?”
পুরকায়স্থ একটু চমকে ফিরে তাকালেন। দরজায় সূরজপ্রসাদের দীর্ঘ ছায়াটা এসে পড়েছে। তাঁর মুখে একটু হাসির রেখা দেখা দিল।
“আরে এসো এসো সূরজপ্রসাদ! তোমার কথাই তো ভাবছিলাম। তোমার তো গতকালই আসার কথা ছিল।”
“হাঁ তা তো ছিল, একটা কাজে একটু আটকে পড়েছিলাম। কিছু মনে করবেন না…”
“আরে না না সে ঠিক আছে। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে! তোমার জন্য একটা ডাবল মারতিনি বলি?” প্রফেসর হেসে তার সাকী-বটকে নির্দেশ দিলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটা যান্ত্রিক হাত সূরজপ্রসাদের সামনে চওড়া কাঁচের গ্লাসটা ধরল।
সুরজপ্রসাদ একটু চমকে গেছিল ঠিকই। তবে প্রফেসরের সঙ্গে তো আর তার কম দিনের সম্পর্ক নয়। এরকম আজব কিসিমের যন্ত্রপাতি দেখতে সে বেশ অভ্যস্ত। প্রফেসর তো এসব বানিয়েই খালাস। বিক্রি তো তাকেই করতে হয় না কি!
“বাহ! বাহ! প্রফেসর সাহিব। কি বড়িয়া ড্রিঙ্ক বানিয়েছে আপনার রোবট!” কথা বলতে বলতেই এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল সুরজপ্রসাদ। অনেকদিন প্রফেসরের থেকে কাজের জিনিস কিছু পাওয়া যায় নি। শেষবার যে নিউরো-গানটা পেয়েছিল সেটা থেকে বেশ কয়েক কোটি টাকা লাভ হয়েছিল তার। কিছুই নয়, বন্দুকটা পেশাদার খুনিদের বিক্রি করে দিয়েছিল। কোন রক্তপাত নেই, শুধু শিকারের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বরাবরের মতো অকেজো হয়ে যায় এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মৃত্যু নিশ্চিত। প্রফেসর সাহাব অবশ্য অত কিছু ভেবে বানাননি যন্ত্রটা, আসলে উনি শখেই এইসব বানিয়ে থাকেন। কিন্তু আপাতত সূরজপ্রসাদকে একটু সাবধানে থাকতে হবে, অ্যান্টি-রায়ট পুলিস যেন কোনমতেই তার খোঁজ না পায়। এইধরনের কাজে ঝুঁকি আছে ঠিকই, কিন্তু লাভের অঙ্কটার কথা ভাবলেই…
“কি হে? কী ভাবছ?” প্রফেসর আলগোছে বললেন।
“আপনি হামার বেওসায় যোগ দিন না প্রফেসর-জী। এই সায়েন্স কলেজে পড়িয়ে আর কতোটুকুই বা প্রফিট হয় আপনার? আপনি আপনার মতো গবেষণা করবেন, আর ফান্ডের ব্যাপারটা আমি বুঝে নেবো!”
“না হে, তুমি তো জানই – টাকা পয়সার ব্যাপার নয়। আমি আমার মতো এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যে কি বানিয়ে ফেলি, আমি নিজেই জানিনা! আর তাছাড়া ওইভাবে কারো নির্দেশে আমার পক্ষে কাজ করা সম্ভবও নয়। আমার মনে হয় সচেতন ভাবে কিছু কাজ করা আমার পক্ষে নেহাতই অসম্ভব।” প্রফেসর অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিলেন।
সূরজপ্রসাদ একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। তার অনেকদিনের ইচ্ছা প্রফেসর তার হয়েই কাজ করুক। তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী দল প্রফেসরের খোঁজ পেয়ে যাক, এটা সে মোটেই চায় না। কিন্তু লোকটা বড্ড খামখেয়ালী।
“আচ্ছা আচ্ছা, সে না হয় দেখা যাবে। এখন কিছু তৈয়ার করছেন নাকি?” কথা বলতে বলতে সূরজপ্রসাদ ল্যাবের ফ্লোর থেকে অ্যাপ্রনটা তুলে নিলো। লোকটা শুধু খামখেয়ালীই নয় বড্ড অগোছালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোন হ্যাঙ্গার অবশ্য দেখতে পেল না সে। তবে ঘরের কোনে একটা ছোট্ট লোহার আলমারি। যদিও আলমারিটায় কিছুই রাখা নেই। সূরজপ্রসাদ ওটার মধ্যেই অ্যাপ্রনটাকে রেখে আবার চেয়ারে এসে বসল।
“না। এখন তো তেমন কিছুই করছি না। তবে… ” প্রফেসর এক মুহূর্তের জন্য থমকালেন। একটু ইতস্তত করে আবার বললেন, “তুমি কি আরেকটা ড্রিঙ্ক নেবে?”
“নেহি স্যার, সুক্রিয়া। আমাকে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে। কিছু বিশেষ কাজ আছে।”
“আরে তাতে কি হল! কাজ তো থাকবেই। আমার তো মনে হয় যখন কম সময়ে বেশি কাজ করার দরকার থাকে তখনই আমি বেশি এফিসিয়েন্টলি কাজ করতে পারি।”
“বাট স্যার, আই থিঙ্ক দ্যাট পিউরলি ইজ অ্যা ম্যাটার অফ স্কিল! কিন্তু আপনি এত অবাক হয়ে কী দেখছেন?”
সূরজপ্রসাদ প্রফেসরের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘরের কোনের দিকে তাকাল। প্রফেসর একদৃষ্টে আলমারিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। অ্যাপ্রনটা রেখে সূরজপ্রসাদ আলমারির দরজাটা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেনি। আধখোলা দরজাটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরে অ্যাপ্রনটার কোন চিহ্ন নেই! আলমারিটা সম্পূর্ণ খালি!
সূরজপ্রসাদ একটু হতভম্ব হয়ে আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেল। না, ওটা সম্পূর্ণ ফাঁকা নয়। নীলচে কালো রঙের ছোট্ট রাগবি বলের মত দেখতে একটা জিনিস অ্যাপ্রনটার যায়গায় পড়ে আছে।
“এটা কী হোলো? আপকা লকার সামান কো পিঘলা দেতা হ্যায় কেয়া?” উত্তেজনায় সূরজপ্রসাদের মুখ দিয়ে মাতৃভাষা বেরিয়ে এলো।
“হা হা! তুমি নিজেই দেখো, ওই জিনিসটাকে বের করো তো!”
সূরজ অবশ্য হাত দিয়ে বলটাকে ধরার সাহস পেল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা টেস্ট টিউব হোল্ডার দেখতে পেয়ে সেইটা দিয়ে সে বলটাকে সাবধানে টেবিলের ওপরে রাখল। কিন্তু বলটা ততক্ষণে রং বদলাতে শুরু করেছে। নীলচে কালো রং থেকে ওটা আসতে আসতে সাদাটে হয়ে যেতে লাগলো। একইসঙ্গে ওটার আয়তন বাড়ছিল এবং একটা অর্ধ-তরল সাদা পদার্থের মতো টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। পাঁচ-দশ সেকেন্ডের মধ্যে সূরজ এর বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে টেবিলের ওপরে অ্যাপ্রনটা ফিরে এলো।
“এটাই হচ্ছে, বুঝলে। আমি আলমারিটায় কিছু একটা রাখছি, সেটা ছোট হয়ে গিয়ে অন্যরকম আকার আকৃতির কোন একটা জিনিস হয়ে যাচ্ছে। আবার বাইরে আনছি যেই, ওটা আস্তে আস্তে আগের জিনিসে ফিরে যাচ্ছে। জানিনা এই আলমারিটাকে নিয়ে করব! কোন ম্যাজিশিয়ানকে বিক্রি করা যেতে পারে বড়জোর।”
“আপনি এটা কী ভাবে বানালেন?”
“সেটাই তো, আমি নিজেও খুব একটা শিওর নই। মনে হয় এটা ডাইমেনশনের ব্যাপার। স্পেস-টাইম নিয়ে আমার সাম্প্রতিক গবেষণাতেই খুব সম্ভব আলমারিটার মধ্যে একটা সময়গত-চতুর্মাত্রিক পথ খুলে গেছে। যদিও আমি এখনো জানিনা এটা ঠিক কিভাবে হলো।” প্রফেসর একটু কিন্তু কিন্তু করে উত্তর দিলেন।
সূরজ ব্যাপারটা একেবারেই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে প্রফেসরের দিকেই তাকিয়েছিল এবং একইসঙ্গে দ্রুত অনেককিছু চিন্তা করছিল। এই লকারটাকে… তার মুখে একটা ক্রুর হাসির রেখা ফুটে উঠল। ওদিকে প্রফেসর কিছুটা আপনমনেই বলে যাচ্ছিলেন-
“ধাঁধা, বুঝলে ধাঁধা। আমার মনে হচ্ছে আলমারিটা আমাদের এই স্থান-কাল অবিচ্ছিন্নতার অংশই নয়। দাঁড়াও তোমাকে আরেকটু ভালভাবে বুঝিয়ে বলছি। ওই কাঠের বেঞ্চটা দেখতে পাচ্ছ? ওটাকে এই আলমারিটার মধ্যে ঢোকাও তো।”
“মা -মানে?” সূরজ অবাক হয়ে বেঞ্চটার দিকে তাকাল। “এই পাঁচ ফুটের বেঞ্চটা কীভাবে লকারের মধ্যে… লকারটা তো মেরেকেটে তিন ফুট বাই তিন ফুট হবে!”
“আরে দেখোই না চেষ্টা করে।” প্রফেসর মিটিমিটি হেসে বললেন। “আস্তে আস্তে, কোণের দিকটা আগে ঢোকাও।”
সূরজ অবিশ্বাস ভরে বেঞ্চটা আলমারির মধ্যে একটু ঢোকাল। কিন্তু ওকে যেন বেশী কসরত করতেই হল না। বেঞ্চটাকে সামান্য ঠেলেতেই ওটা প্রায় নিজে নিজেই আলমারিটার মধ্যে ডুবে যেতে লাগলো। হ্যাঁ ঠিক এটাই মনে হল সুরজের। জলের থেকে একটু ভারী কোন জিনিসকে যেমন জলে ফেললে আস্তে আস্তে ডুবে যায়, সেইভাবেই বেঞ্চটা সুরজের হতভম্ব দৃষ্টির সামনে আলমারির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুরজের চোয়াল ঝুলে গেল। “অ্যাঁ! – এটা কী ব্যাপার? কীভাবে…” সূরজ প্রায় তোতলাচ্ছিল।
আলমারিটার মধ্যে তখন বেঞ্চটার চিহ্ন মাত্র নেই, কিন্তু সেই যায়গায় স্বচ্ছ গাঢ় বেগুনি রঙয়ের কিছুটা চৌকো মতো একটা বস্তু পড়ে আছে। খুব বেশি হলেও ওটার আয়তন চার ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চির বেশি নয়!
সুরজের অবস্থা দেখে প্রফেসর হাসছিলেন। “আরে অত অবাক হবার কিছু নেই। এক গ্লাস জলে দু -চামচ চিনি ফেললে কী হবে? চিনিটা জলে পুরো মিশে যাবে, তাই তো? কিন্তু জল ছাড়া বাতাসে কিন্তু ওটা মিশে যায় না! বুঝলে কিছু?”
“না, আরেকটু এক্সপ্লেন করে বলুন।”
“খুব সহজ! চিনি হল এই বেঞ্চটা, আর জল হল আলমারিটা। যেভাবে চিনি জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়, সেভাবেই বেঞ্চটাও আলমারিটার মধ্যে চলে গেছে। ওটার অস্তিত্ব আর বাহ্যিক আকার আয়তনের কিছু পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। তবে পার্থক্য একটাই, বেঞ্চটা পরিবর্তিত হয়েই যাই হয়ে থাকুক, ওটাকে আবার আলমারির বাইরে আনলেই ওটা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। যাও না, ওই বেগুনি জিনিসটাকে আলমারি থেকে বের করো দেখি!”
“পাগল হয়েছেন! আমি চাইনা আমার হাতটাও চেঞ্জ হয়ে অন্য কিছু হয়ে যাক! নো-নেভার!”
“আহা, অত ভয় পাবার কিছু নেই, পরিবর্তনটা অতও তাড়াতাড়ি হয় না। একটু সময় লাগে। দেখো আমিই হাত দিচ্ছি ভেতরে।” বলতে বলতে প্রফেসর বেগুনি আয়তঘনকটাকে আলমারি থেকে বার করে টেবিলের পাশে রাখলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওটা আবার পাঁচ ফুটের কাঠের বেঞ্চে পরিবর্তিত হয়ে গেলো।
“উফ্! কী সাংঘাতিক!” সূরজ অস্ফুটে বলল। “কোন জিনিস কীসে কনভার্ট হয় সেটার একটা লিস্ট তৈরি করছেন না কেন?”
“ধুস, কী হবে! এমনিতেই এটা কি কাজে লাগবে বুঝতে পারছি না।”
সূরজ দ্রুত ভাবছিল। আপাতত তার সামনে অনেক কাজ পরে আছে। আজ প্রফেসর সাহাবের কাছে এসে বিশেষ কিছুই লাভ হল না। এখানে আর সময় নষ্ট করার মানে হয়না। ওদিকে মুখার্জী নিশ্চয়ই তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু এই অদ্ভুত লকারটা নিয়ে কী করা যায় ?
“ওক্কে স্যার! আমি বিশ হাজার দিচ্ছি ,লকারটা আমাকে দিয়ে দিন।” সূরজ আর সাতপাঁচ না ভেবেই বলল। জিনিসটা তাকে আকৃষ্ট করেছে যখন নিয়েই নেয়া যাক ! পরে ভেবে দেখা যাবে কোন কাজে লাগানো যায় কিনা।
“সোল্ড! এমনিতেই ওটা আমার ল্যাবে ফালতু জায়গা নষ্ট করছে।” প্রফেসর একটা চুরুট ধরিয়ে উত্তর দিলেন।
দশ মিনিটের মধ্যে সূরজ আলমারিটাকে গাড়ির ডিকির মধ্যে সাবধানে শুইয়ে রেখে নিজের অফিসের দিকে রওনা দিয়ে দিল। অবশ্য একটা কালো এসইউভি যে সঙ্গে সঙ্গেই ওর পিছু নিলো সেটা ওর দৃষ্টি এড়াল না !
|| ২ ||
“কি ব্যাপার সূরজ? সারাদিন তোমার কোন খবরই নেই? কী ভাবলে?” মুখার্জী হিসহিসে গলায় বলল।
মুখার্জীর চেহারাটা দেখে ওর সম্পর্কে কোন ধারণাই করা যায় না। ছোটখাটো চেহারার ভালমানুষ টাইপের দেখতে মুখার্জীর মধ্যে যে কি পরিমাণে ক্রূরতা আর ধূর্ততা লুকিয়ে আছে, তা সুরজের থেকে বেশি কেউ জানে না। টাকার জন্য লোকটা করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। অবশ্য ব্যবসার খাতিরে এদের সঙ্গে তার ওঠা-বসা লেগেই আছে, তবু এই লোকটার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না সূরজ। চাউনিটার সাথে সাপের চাউনির যথেষ্ট মিল আছে।
এখন অবশ্য দেয়াল জোড়া এলইডি স্ক্রিনটার দিকেই তাকিয়ে ছিল সূরজ। কাল প্রফেসরের বাড়ি থেকে ফিরতে বেশ রাতই হয়েছিল। অবশ্য পুলিশের গাড়িটা যে তাকে ফলো করছে বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। নয় নয় করে পনের কুড়ি বছর হয়ে গেল তার এই লাইনে। পুলিশের সাথে লুকোচুরি তাকে কম খেলতে হয়নি! মনে হয় নিউরো গানটার ব্যাপারেই পুলিশ পেছনে লেগেছে। তবে ওদের হাতে এখনো কোন প্রমাণ যে নেই, এই ব্যাপারে সূরজ নিশ্চিত। নইলে শ্যাডো না করে সরাসরি গ্রেপ্তারই করত। কিন্তু তবু এই মুহূর্তে কোন ঝুঁকি নিতে চায় নি সূরজ। এখন যে কাজটায় হাত দিয়েছে ওরা সেটা সাকসেসফুল হলে এত টাকা আসবে যে স্বচ্ছন্দে যেকোনো নিরপেক্ষ দেশে গা ঢাকা দেয়া যাবে। পুলিশ ওর টিকিও ছুঁতে পারবে না। কাল তাই আর অফিসের দিকে যায়ই নি। চুপচাপ বাড়ি এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আজ সকালে অফিস যাওয়ার সময়েই বেরোল। রাস্তায় একটা শপিং মলে গাড়ি থামিয়ে কিছু ষ্টেশনারী জিনিস কিনল। তারপর সোজা অফিস। পুলিশকে সন্দেহের কোন অবকাশই দেয়া যাবেনা। আপাতত মুখার্জীর সঙ্গে ভিডিও কলটা করছে নিজের অ্যান্টি-চেম্বারে বসে।
“আমাদের আরো সাবধান হতে হবে মুখার্জী! পুলিশ আমাদের পেছনে লেগেছে।”
বিরক্তিতে ভ্রুটা কুঁচকে গেল মুখার্জীর। “মনে হয় ওরা কিছু সন্দেহ করেছে, আর দেরি করা যাবেনা সূরজ। এবারে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে।”
“না না, তা কি করে সম্ভব? কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা ওরা কী করে আঁচ করবে? আমি তো ভাবছিলাম ওরা অন্য কোন কেসের জন্য ইনভেস্টিগেট করছে।”
“মাথাটা একটু খাটাও সূরজ। টেলিপোর্টেশন নিয়ে কি মারাত্মক রেষারেষি চলছে বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর মধ্যে তা তো তোমার অজানা নয়। এমনকি দেশের সরকারগুলোও এর মধ্যে জড়িয়ে গেছে। হিউম্যান টেলি-পোর্ট সম্ভব হলে কি কি হতে পারে একবার ভেবে দেখেছ? ট্রান্সপোর্ট কস্ট উইল বিকাম জিরো! শুধু কি তাই? বিনা খরচে স্পেসস্টেশনগুলোতে লোক পাঠানো যাবে, এছাড়াও মিলিটারি ইউসেজের কথা তো ছেড়েই দিলাম। যে দেশ প্রথমে এটা আবিষ্কার করতে পারবে, স্পেস নজরদারী তো তাদের হাতের মুঠোয়!”
“আরে এসব তো আমি জানিই! নতুন কিছু থাকলে বল।”
“থামো! তুমি ব্যাপারটার গুরুত্বই এখনো বুঝতে পারো নি, সূরজ। শুধু টাকার কথাই ভেবে যাচ্ছ। নন লিভিং সাবস্টেন্স টেলি-পোর্ট করা বহু আগেই আবিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু হিউম্যান টেলিপোর্টেশন অত সহজ না। টেলিপোর্টেড সাবজেক্ট আর ফাইনাল সাবজেক্টের মধ্যে শক্তি, ভর, গতি, চৌম্বকীয় ক্ষেত্র ইত্যাদি কোয়ান্টাম অবস্থাগুলো ঠিকমত ট্রান্সফার না করতে পারলে হিউম্যান টেলিপোর্টেশন সম্ভবই নয়। আর এই আণবিক অবস্থা মানে এনট্যাংগলমেন্টের সঠিক হিসেব করার জন্য যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার দরকার সেটাই আমরা গ্যালওয়ে টেকনোলজি সলিউশন থেকে চুরি করেছি আগের সপ্তাহে!” টানা কথাগুলো বলে থামল মুখার্জী।
“হ্যাঁ তা কি আর জানি না! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সেটা তো জানাজানি হবার কথা নয়। গ্যালওয়ে তো নিজের স্বার্থেই এটা ডিসক্লোস করবে না, অন্তত রাইভ্যাল কোম্পানিগুলোর সামনে মান-সম্মান খোয়ানোর ভয় তো আছেই”
“তুমি এখনো কিছুই বোঝোনি।” মুখার্জী রাগত ভাবে বলল। “বলছি না, এই ব্যাপারটা আর শুধু বেসরকারি স্তরেই আটকে নেই। সরকারের ইন্টারেস্ট কেন বেড়ে গেছে সেটা তো একটু আগেই বললাম। আমার মনে হয় ওরা ফোন কল বা স্যাটেলাইট কল ইতিমধ্যেই ট্যাপ করেছে। যদিও আমরা যেভাবে মাস্কিং করছি আমাদের কনভারসেশন চট্ করে ডিসাইফার হয়ত করতে পারবে না, কিন্তু – না সূরজ, আর দেরি করা চলবে না! আমাদের প্ল্যানিং-এ কিছু ইমপ্রোভাইজ করতেই হবে। আমি ব্র্যাঞ্জোকে খবর পাঠিয়েছি। ডিভাইসটা আমরা আজ-কালের মধ্যেই ওকে দিয়ে দেব।”
সূরজ এবারে একটু নার্ভাস হয়ে পড়ল। ব্যাপারটা আস্তে আস্তে বেশ জটিল হয়ে পড়ছে। নাহ্ যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কোয়ান্টাম কম্পিউটারটা ব্র্যাঞ্জোকে দিয়ে দেয়া যায় ততই মঙ্গল। তারপর ওটা নিয়ে ওরা যা খুশি করুক। সূরজদের কাছে তেমনই নির্দেশ আছে। ব্র্যাঞ্জো তারপর ওটা পাশের কোন প্রতিবেশী দেশকে বিক্রি করলো না অন্য কোন কোম্পানিকে, তা নিয়ে সূরজদের কোন মাথাব্যথা নেই। শুধু জানে ফরেন অ্যাকাউন্টে যে টাকাটা ঢুকবে তা দিয়ে আরামসে পায়ের ওপরে পা তুলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যাবে।
“ঠিক আছে। তাহলে কী করবো বল?”
“আমাকে আগে ব্র্যাঞ্জোর সাথে যোগাযোগ করতে দাও। সব কিছু সেটল করে তোমাকে আবার ফোন করবো। তবে এই সেম ব্রিজটা ইউজ করবো না, ভিডিও কলের জন্য। অন্য ব্রিজ ইউজ করবো। বাই, টেক কেয়ার। অ্যান্ড বি কেয়ারফুল!”
|| ৩ ||
কিছুটা জোর করেই কাজে মন বসানোর চেষ্টা করছিলো সূরজ। একটা লোকদেখানো বিজনেস তো তার আছেই, যেটার আড়ালে অন্ধকার জগতের কাজকর্মগুলো চলে। কিন্তু কিছুতেই কাজে মন বসছে না। মুখার্জীর সাথে শেষ কথা হয়েছে তিন দিন হয়ে গেল। তারপর থেকে লোকটার আর কোন পাত্তাই নেই। কিছু বিপদ হল না তো? পুলিশি পাহারা রীতিমত জোরদার হয়েছে এখন। আর লুকিয়ে চুরিয়ে ওরা ফলোও করছে না। এই বত্রিশ তলার অফিস ঘর থেকেও মাঝেমধ্যেই হেলিকপ্টারের চক্কর মারাটাও বেশ দেখা যাচ্ছে।
আচমকা সূরজকে সচকিত করে ইন্টারকমটা বেজে উঠল। অ্যানসারিং বাটনটা টিপতেই রিসেপশনিস্টের রিনরিনে গলা ভেসে এলো – “স্যার একজন ভিজিটর এসেছেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা নেই, কিন্তু বলছেন ভীষণ জরুরি ব্যাপার। এখুনি দেখা না করলেই নয়। নাম বললেন মুখার্জী।”
ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো সূরজ তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল। অ্যাঁ! মুখার্জী এখানে! লোকটা কি পাগল হয়ে গেল? এই পুলিশি অবস্থায় সরাসরি দেখা করতে আসাটা কি ভয়ঙ্কর রিস্কের ব্যাপার নয়? কোনরকমে উত্তেজনা দমন করে সূরজ ঠাণ্ডা গলায় মুখার্জীকে পাঠিয়ে দিতে বলল।
দশ মিনিটের মধ্যে মুখার্জী হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। মুখার্জীর দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই কদিনে যেন ওর ওপর দিয়ে ঝড় গেছে। চোখ লাল টকটকে। চুল উসকো-খুসকো ,জামা এলোমেলো।
“একি মুখার্জী! একি হাল তোমার? আর তুমি এখানে এলেই বা কেন? জানো না পুলিশ কিভাবে নজর রাখছে আমার ওপরে?”
“আরো রাখো ওসব কথা।” মুখার্জী উত্তেজনায় একটু একটু কাঁপছিল। “উই আর ইন গ্রেভ ডেঞ্জার। শেষ তিনদিনে আমার সাতজন বিশ্বস্ত লোককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে তাই জানিনা। গ্যালওয়ে খুব সম্ভব শুধু পুলিশের ভরসায় না থেকে ভাড়াটে গুণ্ডা লাগিয়েছে। এর মধ্যেই ব্র্যাঞ্জোর সাথে যোগাযোগ হওয়াতে ওর কথামত বাইপাসের ধারে দেখা করতে গেছিলাম। কিন্তু জায়গায় পৌঁছে দেখি গোটা এলাকা পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। ভাবলাম কিছুক্ষণ লুকিয়ে গাড়িতে বসে থাকি। কিন্তু গাড়ির কাছে ফিরে দেখলাম ড্রাইভার নেই! খুব ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিল ডেরায় ফেরার পথেই কেউ না কেউ ধরবে। তাই ভয় পেয়ে তোমার অফিসেই চলে এলাম।”
“মানে! তুমি কোয়ান্টাম কম্পিউটারটা নিয়ে আমার কাছে চলে এসেছ?” সূরজ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। “এটা তুমি কী করলে মুখার্জী! আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড? পুলিশদের ধরার ইচ্ছে থাকলে তো তোমাকে ওখানেই অ্যারেস্ট করত! এটা যে ট্র্যাপ তুমি বুঝতে পারলে না? ওরা পুরো গ্যাংটাকে ধরার জন্যই এটা সাজিয়েছিল। তুমি নিজেও ডুবলে আর আমাকেও ডোবালে!” সুরজের শেষের কথাটা হাহাকারের মতো শোনাল।
মুখার্জীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। নিজের ভুলটা ভালই বুঝতে পেরেছে এতক্ষণে। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল গোটা তিরিশেক পুলিশ ভ্যান অফিসের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে ইতিমধ্যেই।
সূরজ হতাশ হয়ে সোফায় গা ছেড়ে দিয়েছে। মুখার্জী কোনরকমে বলল, “কুইক, সূরজ! পুলিশ এসে পড়বার আগেই ডিভাইসটাকে লুকিয়ে ফেল!”
“আরে কোথায় লুকাবো? ওরা তো স্ক্যানার নিয়েই আসবে! অফিস ঘরের ফ্লোর খুঁড়ে ফেলে কিংবা সিলিং-এর মধ্যে লুকালেও স্ক্যানারের হাত থেকে রেহাই…”
লকার! লকার! বিদ্যুৎচমকের মতো সুরজের মাথায় প্রফেসর পুরকায়স্থর লকারের কথা ঝলসে উঠলো। হ্যাঁ ওই আজব লকারই এই যাত্রা বাঁচাতে পারে তাকে।
“উপায় পেয়ে গেছি মুখার্জী, শিগগির ডিভাইসটা দাও আমাকে। ওটা কিভাবে ওদের চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে ফেলতে হবে আমি জানি।” বলতে বলতেই পাতলা চামড়ার ব্রিফকেসটা একরকম কেড়েই নিলো সূরজ। “শোনো তুমি এখনই বেরিয়ে যাও, নিচে পুলিশ হয়ত তোমাকে ধরবে, কিন্তু সার্চ করে তো কিছুই পাবেনা। তবু যদি অ্যারেস্ট করে আমি আমার লোক দিয়ে তোমাকে ছাড়িয়ে আনব।”
ঘটনার আকস্মিকতায় মুখার্জী একটু ঘাবড়ে গেছিল। তো তো করে বলল, “মানে, কিন্তু কো-কোথায় লুকাবে?”
“আঃ! এত কথা বলার সময় নেই এখন। তুমি এখনি বেরিয়ে যাও।” সূরজ হতভম্ব মুখার্জীকে প্রায় ঠেলে ঘরের বাইরে বার করে দরজা লক করে দিল। রিসেপশনে ফোন করে বলল যদি পুলিশ সার্চ করতে আসে তাহলে যেন সার্চ ওয়ারেন্ট দেখাতে বলা হয়, ওয়ারেন্ট দেখালে পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে যেন কনফার্ম করে নেয় অফিসের লিগাল সেল।
যাক, কিছুটা সময় পাওয়া গেল। সূরজ অ্যান্টি চেম্বার থেকে লকারটা নিয়ে এলো। নিতান্ত খেয়ালের বশেই কিনে ফেলা লকারটা এতো কাজে আসবে ভাবেইনি সে। লকারের পাল্লাটা খুলে ডিভাইসটা রাখতে গিয়েই আঁতকে উঠল সূরজ! এটা কী! এটা লকারের মধ্যে এলোই বা কীভাবে!
জিনিসটা কিছুই নয়। একটা অদ্ভুত দর্শন ছোট্ট গিরগিটি। মেরেকেটে তিন ইঞ্চি লম্বা হবে। গায়ের রং সবুজে কালোয় মেশানো। চোখ দুটো হলুদ।
ওদিকে দরজায় ততক্ষণে দুম দুম ধাক্কা পড়তে শুরু করেছে। বাইরে থেকে ডিউটি অফিসারের চীৎকার শোনা গেল, “ওপেন দ্য ডোর!”
আর এই সামান্য গিরগিটি নিয়ে ভাববার সময় নেই। সূরজ বিরক্ত ভাবে হাত বাড়িয়ে মুঠোয় গিরগিটিটাকে ধরল, তারপর প্রায় পিষে ফেলল! ছুঁড়ে লকারের কোণায় প্রায় আধমরা জীবটাকে ফেলে কোয়ান্টাম কম্পিউটারটা লকারে ঢুকিয়ে একটু সময় নিলো। ব্যাটারা আরো কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কাক। ধীরে সুস্থে ঘরের কোণে বেসিনটায় হাত মুখ ধুলো। তারপর দরজাটা খুলল।
হুড়মুড় করে ঘরে জনা দশেক পুলিশ ফোর্সের সাথে অফিসার ঢুকে পড়লেন।
“এতক্ষণ কি করছিলেন?” কর্কশ গলায় প্রশ্ন করলেন অফিসার।
“সরি। ওয়াস ইন ওয়াশরুম।” সূরজও ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল।
ততক্ষণে অবশ্য অফিস ঘর প্রায় তোলপাড় করা শুরু হয়ে গেছে। সূরজ আয়েশ করে সোফায় বসে কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করতে লাগল। আধঘণ্টা ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও অবশ্য কিছুই পাওয়া গেল না। স্ক্যানার আর এক্স রে মেশিনগুলোও কিছুই খুঁজে পেল না।
“কোথায় লুকলেন কোয়ান্টাম ডিভাইসটা?” অফিসার চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“কীসের কথা বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। অকারণে হ্যারাস করার জন্য আমি কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে লিগাল অ্যাকশন নিতে পারি।” সূরজ একটা ব্যাঙ্গের হাসি দিল। অফিসার একটা হিংস্র চাউনি ফিরিয়ে দিয়ে ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
উফ্ ! বড় একটা ফাঁড়া কাটল। মুখার্জীর বোকামির জন্য আরেকটু হলেই হয়েছিল আর কি! সূরজ একটা সিগারেট ধরাল। লকারটা এইভাবে কাজে আসবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। এইবার লকারটা খুলে দেখা যাক কম্পিউটারটা কী জিনিসে পাল্টে গেল? সূরজ লকারের দরজায় হাত ছোঁয়াল। ভেতরে কী থাকবে গেস করা যাক। একটা পিরামিড? একটা কিউব? নাকি কোন স্ফিয়ার বা সিলিন্ডার?
এক ঝটকায় লকারের দরজাটা খুলল সূরজ।
লকারটা পুরো খালি! কোন কিছুর চিহ্নমাত্র নেই!
|| ৪ ||
“স্যার, কিছু তো বলুন! হলোটা কি? আমার জিনিসটা গেল কোথায়? কীভাবে ফেরত আনব?” সূরজ প্রায় কাঁদো কাঁদো ভাবে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলো।
শেষ তিনদিনে সূরজের বয়েস প্রায় বিশ বছর বেড়ে গেছে। সেদিন লকারটা খুলে ডিভাইসটাকে না দেখতে পেয়ে ও প্রথমে আঁতকে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু অবস্থার গুরুত্বটা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল হয়ত একটু বাদেই ফিরে আসবে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেও যখন ডিভাইসটার নামগন্ধ অবধি পাওয়া গেল না তখন একটু একটু করে ভয় পেতে শুরু করেছিল। তারপর অন্তত কয়েক হাজার বার লকারের দরজা খুলেছে আর বন্ধ করেছে! কিন্তু কম্পিউটারের আর কোন পাত্তা পাওয়া যায় নি। লকারের ভেতরটা তন্ন তন্ন করে দেখতেও বাকি রাখে নি, যদিও তিন বাই তিন ফুট লকারে কতটাই বা জায়গা থাকে। তারপরই প্রফেসরকে ফোন করেছিল, তিনি সব শুনে দিন দুই বাদে আসতে বললেন। এই দুদিন সূরজ অফিস ঘরেই পড়ে ছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্যও লকারটা থেকে চোখ সরায়নি। যদি কোন উপায়ে ফিরে আসে জিনিসটা। কিন্তু অপেক্ষাই সার। ডিভাইসটা না পেলে মুখার্জী ওকে ছাড়বে না। বড়লোক হওয়া দূরে থাক, এখন প্রাণটা বাঁচলে হয় ! মুখার্জী যদি ভাবে ও ওকে ঠকানোর চেষ্টা করছে! আর ভাবতে পারল না সূরজ।
“স্যার কম্পিউটারটা কি আর কোনদিন পাবো না? ওটা যে বহুত কীমতি চিজ আছে! কিছু তো বলুন।”
প্রফেসর একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। “ব্যাপার খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না সূরজ।” চিন্তিত মুখে একটা চুরুট ধরালেন তিনি। “তুমি আমাকে কি বলেছিলে? লকারটার মধ্যে একটা গিরগিটি জাতীয় প্রাণী দেখতে পেয়েছিলে, তাই তো?” কিন্তু তোমার অফিসঘরে বত্রিশ তলায় ওটা গেলই বা কী করে ?”
“আরে স্যার ওই লিজার্ডটাকে নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর কি আছে? আপনি বলুন কম্পিউটারটা কিভাবে -”
“না না, সূরজ তুমি ব্যাপারটাই বুঝছ না! আমার ফাইন্ডিংস যদি ঠিকঠাক হয় তাহলে ওই কম্পিউটার পাবার আশা তোমার ছেড়ে দেয়াই ভালো। আমি তোমাকে কি বলেছিলাম মনে আছে? ওই লকার খুব সম্ভবত আমাদের এই সময়কালের অংশই নয়। আমার ধারণা ওই গিরগিটিটাও অন্য কোন সময় মানে অন্য ডাইমেনশনের প্রাণী। ওটা একা এসেছিল সেরকম মনে করারও কোন কারণ নেই! হয়ত ওটার দলে আরো কেউ ছিল। তুমি একটাকে মেরে দিয়েছ, ওর বাকি সঙ্গীরা ওকে খুঁজে না পেয়েই হয়ত কিছু সন্দেহ করে তোমার কম্পিউটারটাকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে!”
সুরজের চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল। “এসব আপনি কি বলছেন প্রফেসর সাহিব? গিরগিটিরা আমার কম্পিউটার নিয়ে গেল? আমি তো কিছুই বুঝছি না !”
“আরে গিরগিটি নিয়ে যায়নি। বেসিক্যালি অন্য ডাইমেনশনের প্রাণী কিরকম দেখতে হবে সেটা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। যেরকম আমার অ্যাপ্রনটা লকারের মধ্যে গিয়ে একটা বল হয়ে গিয়েছিল, বেঞ্চটা একটা চৌকো বাক্সের মত! ওই গিরগিটিটাও বাইরে আসলে কী হত কে জানে? কিন্তু তুমি ওটাকে বাইরে আনার আগেই মেরে ফেলেছিলে, তাই আর বোঝা যায়নি। তা সে যাই হোক, আসল ব্যাপারটা হল যে তোমার কম্পিউটার এখন অন্য কোন টাইম স্পেসে চলে গেছে। কীভাবে সেটা নিয়ে আমি শিওর নই।”
“তাহলে কি ওটা আর আমি ফিরে পাবো না?” সূরজ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
“সেটাও আমি এখনই বলতে পারছি না। আমাকে আরো দু একদিন সময় দাও। আরো একটু রিসার্চ করতে হবে। তবে হ্যাঁ, তুমি নিজে ওই লকারটার মধ্যে একবার ঢুকে দেখতে পারো! যদি তোমার ডিভাইস যে ডাইমেনশনে আছে সেই টাইম স্পেসেই তুমি পৌঁছে যেতে পারো তাহলে ওটা খুঁজে পেলেও পাওয়া যেতে পারে। যদিও ওই সেম টাইম স্পেসেই তুমি পৌঁছবে সেটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা সম্ভব নয়।”
“থাক। আমি অতটাও পাগল হয়ে যাইনি।” সূরজ অবসন্ন ভাবে উঠে দাঁড়াল। “আজ আসি, আপনি রিসার্চ চালিয়ে যান। আমি দিন দুয়েক বাদে আবার আসছি।”
সায়েন্স কলেজের পার্কিংয়ের দিকে এগোতে এগোতে সূরজ ভেবেই পাচ্ছিল না এবারে কি করা যায়। মুখার্জী ওকে কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। আসল ঘটনা ওকে বোঝানো শক্ত। মুখার্জী এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই ধরবে। পালিয়েও কোন লাভ নেই, এই লাইনে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যু। মুখার্জীর গ্যাং ওকে খুঁজে বের করবেই। একমাত্র প্রফেসরের ওপরে আপাতত ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। ভাবতে ভাবতেই গাড়ির দরজাটা খুলে সিটে বসতেই মেরুদণ্ড দিয়ে যেন একটা বরফের স্রোত নেমে গেল!
মুখার্জী! পেছনের সিটে বসে লুকিং গ্লাসের মধ্যে দিয়ে ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। চোখে সাপের চাউনি ,ঠোঁটের কোণে ক্রূর হাসি।
“তু -তুমি! এখানে!” সূরজ বুঝতে পারল ওর গলা শুকিয়ে আসছে।
“কি ব্যাপার সূরজ? তুমি কন্টাক্টই করছ না কিছুদিন ধরে? আমার প্ল্যান করা হয়ে গেছে। ডিভাইসটা নিয়ে আমি কিছুদিনের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যাব। তারপর অবস্থা একটু সুবিধের হলে পাচার করা যাবে। চলো এখনই তোমার অফিসে, আমি সব ব্যবস্থা করেই এসেছি।”
“না -মানে, তুমি আবার ভুল করছ! এখন ডিভাইসটা দেয়াই যাবেনা। পুলিশ এখনো নজর রাখছে।” সূরজ কোনরকমে বলল।
কানের ওপরে ঠাণ্ডা লেজার গান টার স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল সূরজ। মুখার্জী হিসহিসে গলায় বলল, “ডোন্ট ট্রাই টু ডবল ক্রস মি! তোমার ব্যাপার আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না সূরজ। আমার সবদিকেই চোখ আছে। তুমি যদি ভেবে থাক আমাকে ঠকিয়ে তুমি নিজেই ডিভাইসটা বিক্রি করে দেবে, তাহলে তোমার মতো মূর্খ আর দুটো নেই।”
“না না! এসব তুমি কি বলছ? আমি আসলে ওটা যেভাবে লুকিয়েছি, বার করতে একটু তো সময় লাগবেই! আর আমি আজও অফিস থেকে বেরোনোর সময় পুলিশকে ফলো করতে দেখেছি। তাই বলছি, রিস্ক নেবার কি দরকার ?”
মুখার্জী একটু ভাবলো। তারপর গম্ভীর গলায় বলল- “তোমাকে আর দুদিন টাইম দিলাম। পরশু আমার একজন লোক তোমার কাছে আসবে। ওকে তুমি ডিভাইসটা দিয়ে দেবে। আশা করি তুমি কোন চালাকি করার চেষ্টা করবে না। গাড়িটা থামাও! আমি এখানেই নেমে যাব।”
সূরজ রাস্তার ধারে গাড়িটা পার্ক করলো। ওর গাড়ির পেছনেই একটা লাল এসইউভি আসছিল। মুখার্জী ওটাতে উঠে গেল।
যাক! আরো দুদিন টাইম পাওয়া গেল। সূরজ অফিসের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে দিল। প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছে। বুঝতে পারছে না শেষরক্ষা হবে কিনা। অফিসের পার্কিং-এ গাড়িটা রেখে লিফটে উঠতে উঠতে ভাবছিল সূরজ। কিছু একটা মিরাকল কি হতে পারে না! একটা মিরাকল!
চেম্বারের দরজাটা খুলে লাইটটা জ্বালতেই আবার একটা বরফ গলা জলের স্রোত যেন মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে গেল সুরজের! ভুল দেখছি না তো? চোখটা হাত দিয়ে ভালো করে কচলে নিয়ে আবার তাকাল সূরজ।
নাহ্ ,সে ভুল দেখেনি। টেবিলের ওপরে শোভা পাচ্ছে চামড়ার পাতলা ব্রিফকেসটা। তার ওপরেই সযত্নে রাখা, কোয়ান্টাম কম্পিউটার !
সূরজ প্রায় ছুটে গিয়ে টেবিলের ওপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এই তো, এই তো! কিভাবে এটা চলে গেছিল? কোথায়ই বা চলে গেছিল? ফেরতই বা এলো কিকরে? নাহ্ ,আর এসব জানার দরকার নেই তার। আনন্দের খবরটা আগে প্রফেসরকে দেয়া যাক। তারপর মুখার্জীকে এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবে সে। আর না, উফ মরতেই বসেছিল প্রায় এসবের চক্করে! পকেট থেকে ফোনটা বার করে প্রফেসরের নম্বরটা ডায়াল করতে গেল সূরজ।
উত্তেজনার বসে আর কিছু খেয়াল করে নি সে। যখন খেয়াল করলো, ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। ভয়ার্ত একটা চীৎকার করে দরজার দিকে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো সূরজপ্রসাদ। কিন্তু পারলো না। ঘরের কোণ থেকে একটা বিশালকায় হাত আবির্ভূত হয়েছে। গাঢ় সবুজ – কালোয় মেশানো রং। কব্জির ওপর থেকে খাঁজকাটা কাটা কনুই পর্যন্ত। অনেকটা কুমিরের পিঠের মতো। হাতের আঙুলগুলো হলুদ।
সেই বিশালকায় দৈত্যকার হাত সূরজকে প্রায় একটা খেলনা পুতুলের মতো মুঠোর মধ্যে ধরে শূন্যে তুলে নিলো! সূরজ হাত দিয়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিলো। তখনও তার জ্ঞান ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে মুঠোর মধ্যে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তবু তার মধ্যেই কোনরকমে ও হাতটাকে বাধা দেবার চেষ্টা করছিলো আর বিকট, জান্তব চীৎকার ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। যদিও কয়েক মুহূর্তও এই অসম লড়াই স্থায়ী হলো না। দৈত্যকার হাতের এক মোক্ষম চাপে ওর শরীরের হাড়গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। সুরজের চোখের ওপরে একটা অন্ধকার পর্দা নেমে এলো। হাতটা ওর বডিটা অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে যখন ঘরের কোনে অদৃশ্য হয়ে গেল ততক্ষণে সূরজপ্রসাদ চির-ঘুমের দেশে চলে গেছে।
|| ৫ ||
নিউজ চ্যানেলটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন প্রফেসর পুরকায়স্থ। এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোন কিনারা পুলিশ করতে পারে নি। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে ভিক্টিমের শরীরের সবকটা হাড় ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। কিভাবে সেটাই কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। প্রফেসর নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন। আচ্ছা, সূরজ তিনদিন আগে পৌঁছে গিয়ে নিজেই নিজেকে পিষে মেরে ফেলেনি তো! কে জানে! বৃদ্ধ প্রফেসর তাঁর সাকী-বটকে একটা ভেসপার মার্তিনি বানানোর অর্ডার দিলেন।
(লুইস প্যাডগেটের লেখা টাইম লকার গল্পের মর্মানুবাদ)
Tags: অনুবাদ গল্প, টাইম লকার, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত