টিথোনাস
লেখক: ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী
শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ
গায়ের চামড়া আস্তে আস্তে কুঁচকিয়ে শিথিল হয়ে আসে। মাথার চুল পেকে সাদা হয়ে যায়। হাতের আঙুলের গাঁটগুলো ক্রমে শক্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসে। দেহের হাড়গুলো ঘুণ ধরা কাঠের মত ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। তারপর জীবনী শক্তির অভাবে রোগের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায় সাধারণ ব্যাধিও তখন মারাত্মক হয়ে পড়ে।
কিভাবে মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাল তাকে গ্রাস করে দাদামশায়ের মৃত্যু একটা ডক্যুমেন্টারী ছবির মত সেটা আমার চোখের সামনে মেলে দিল।
মধ্যবিত্ত পরিবার গৃহকর্তার মৃত্যু শোকের চাইতে বিশৃঙ্খলাই বেশী আনে। কয়েক ছটাক আশয় নিয়ে বিবাদ বিতণ্ডার অবধি ছিল না। অবশেষে ধুলোর ঝড় যখন থামলো তখন দেখা গেল মামলা মোকর্দমার জন্য যা খরচ হয়েছে তা পূরণ করতে গেলে দোতলা বাড়ীর নীচের তলাটা ভাড়া না দিলে আর উপায় নেই।
কলকাতা শহরের ঠিক বুকের মধ্যে নর্দার্ন অ্যাভিন্যুতে বাড়ীখানা। ইস্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, গোটা পাঁচেক সিনেমা মায় শ্মশান পর্যন্ত বাড়ীর এক মাইলের মধ্যে। কাজেই এ হেন বাড়ী ভাড়া দেবো প্রকাশ হওয়া মাত্রই লোকে যেন আমাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। শান্তিতে বাড়ীতে পাঁচ মিনিট বসতে পারি না। সব সময় নীচের ঘরে ডাক পড়ছে। বিশেষতঃ রবিবারের সকালে এটা যেন আরও অসহ্য হয়ে পড়ে। এমনি এক রবিবারে ভেবেছিলাম ভোরবেলায় উঠে পালাবো। দুঃখের কথা আমার ভোর হয় আটটায়। চিরকালের ঘুমকাতুরে আমি। সবে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে খবরের কাগজখানা খুলে বসেছি, অমনি সদর দরজার কলিং বেলের আওয়াজ।
বেশ বিরক্ত হয়েই নীচে নেমেছি। দরজা খুলতেই একেবারে চমকে গেলাম। একজন মহিলা সঙ্গে একটি বৃদ্ধ। কিন্তু মহিলাটির দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। অপরূপ সুন্দরী – কি গায়ের রঙে কি মুখের গড়নে। পরনে একটি বিচিত্র ডিজাইনের শাড়ী যা কোথাও কখনও দেখেছি বলে মনেই পড়ে না। সবচেয়ে আশ্চর্য কথা অবশ্য চেহারা দেখে বাঙালী এমন কি ভারতীয় বলেই মনে হয় না। বেশ কিছুক্ষণ বোধ হয় তাকিয়ে ছিলাম। ভদ্রমহিলার কথায় সম্বিৎ্ ফিরলো।
‘নমস্কার, আপনিই বোধ হয় ডক্টর বোস। ভেতরে আসতে পারি কি? আমাদের ডক্টর সুশোভন রায় আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।’
বিস্ময়ের উপর বিস্ময়! দেখতে বাঙালীর মত নয় অথচ পরিষ্কার বাঙলা বলছেন। ত্রস্ত হয়েই বলেছি, ‘আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন। কি ব্যাপার বলুন তো।’
‘আপনার বাড়ীর নিচের তলাটা তো ভাড়া দেবেন। আমরা ওটা নিতে চাই।’
যদিচ এটা বেশ ভদ্র পাড়া তবুও বিদেশীদের পক্ষে এটা যথেষ্ট অভিজাত নয় বলেই আমার ধারণা। কাজেই ভদ্রমহিলার এ প্রস্তাবে বেশ একটু দ্বিধায় পড়লাম। একটু বিমূঢ় ভাবে প্রশ্ন করেছি, ‘কিন্তু আপনারা কি এ পাড়ায় থাকতে পারবেন? চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনারা বিদেশী। হয়তো এখনও কলকাতার হালচাল সম্পর্কে আপনাদের পরিষ্কার ধারণা নেই।’
ভদ্রমহিলা হেসে বলেছেনঃ ‘সেজন্য আপনি চিন্তা করবেন না। ডক্টর সুশোভন রায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আমরা ঠিকই করে ফেলেছি এখানে থাকবো। আপনি যা ভাড়া চাইবেন তাই আপনাকে দেবো – এবং যে কোন কারেন্সীতে, টাকায় চান টাকায়, ডলারে চান ডলারে, পাউন্ডে চান পাউন্ডে।’
এ ধরনের প্রস্তাব স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখি ভদ্রমহিলা ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে চেক বই বার করছেন। বিচিত্র সেই চেক বই। প্রতিটি পাতা তার ভিন্ন ভিন্ন বিদেশী ব্যাঙ্কের!
‘কিন্তু আপনাদের পরিচয় তো কিছুই জানা হলো না। আপনাদের আদি দেশ কোথায়?’ – একটু ক্ষীণভাবেই প্রশ্ন করেছি। বলা বাহুল্য ইতিমধ্যেই একটু দুর্বল হয়ে পড়েছি।
‘ডক্টর বোস, আমার কর্তা ডক্টর টিথোনাস।’ সঙ্গের বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লেন।
‘আমাদের দেশ?’ মিসেস টিথোনাস একবার ডক্টর টিথোনাসের দিকে তাকালেন – ‘আদি দেশ দিয়ে আর কি হবে? আমরা এখন আমেরিকান! আশা করি বাড়ী ভাড়া দিতে এখন আর আপনার কোনও আপত্তি নেই। বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের অনুরাগ প্রবল।’
কতকটা মোহাচ্ছন্নের মত ছ মাসের অগ্রিম ভাড়ার চেকটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিলাম। ওরা চলে যাবার পর অসংখ্য প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো কেন ওরা দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে এ পাড়ায় বাড়ী নিলো? কি প্রয়োজনে ওরা এদেশে এসেছে? কোনও গুপ্তচর দলের মধ্যে পড়লাম না তো!
আর কাল বিলম্ব না করে ডক্টর রায়কে ইনস্টিটুট অব্ মলিক্যুলার বায়োলজিতে ফোন করলাম।
জানা গেল যে ডক্টর রায়ই ওদের আমার কাছে পাঠিয়েছেন। সম্প্রতি ডক্টর টিথোনাসের সঙ্গে মাষ্টার মশায়ের কোপেনহ্যাগেনে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আলাপ হয়। সেখানে ওরা কলকাতায় গিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। টিথোনাস দম্পতির মতো শরীরের টিস্যুর ওপর এত বড় বিশেষজ্ঞ আর নাকি কেউ নেই। ওরা সে বিষয়েই কাজ করবেন এখানে। ভারত সরকার ওঁদের সব রকম সুবিধাই দিচ্ছেন।
‘কিন্তু এই বিরাট শহরে এত জায়গা থাকতে ওরা আমার বাড়ীতে ওঠার জন্য এত ব্যাগ্র কেন?’ – বেশ একটু কৌতূহলের সাথেই মাষ্টার মশায়কে জিজ্ঞেস করেছি।
‘সেটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ওরা কোপেনহ্যাগেনে যে রকম একটা বাড়ী সন্ধান করতে বলেছিলেন তার সঙ্গে তোমার বাড়ীর বর্ণনা অবিকল মিলে যায় – ঠিক বড় রাস্তার ওপরে নয় বরং একটু গলির ভেতরে। একটা বড় হলঘর, তিনটে বড় ঘর, গ্যারেজ। সবচেয়ে আশ্চর্য কোনও রান্নার জায়গার দরকার নেই! কারণ ওরা কোনও রান্না করা খাবার খান না।’
টাকার প্রয়োজন এত বেশী ছিল যে এ রহস্য নিয়ে আর মাথা ঘামাবার ইচ্ছা হলো না। নীচের তলাটা লোকজন ডেকে সাফসুতরো করছি এমন সময় ওরা এসে পড়লেন। জিনিষপত্র খুব বেশী নেই বললেই চলে। শুধু গোটা কয়েক খুব ভারী কালো রঙের বাক্স। সবচেয়ে অদ্ভুত ওদের গাড়ীটা। একটা লম্বা ভ্যান – হঠাৎ দেখলে এ্যাম্বুলেন্স বলেই ভুল হবে। তা থেকেও দুটো লম্বা লম্বা কফিনের মতো বাক্স বেরোলো। দেখতে দেখতে বাড়ীর চেহারা সম্পুর্ণ পালটে গেল। ভারী ভারী পর্দা পড়লো দরজা জানালার ওপর।
আমি একটা ছোট বেসরকারী কলেজে কেমিস্ট্রি পড়াই। সন্ধ্যের দিকে একটা টিউটোরিয়াল হোমে পার্ট টাইম করি। কাজেই সময়ও হাতে খুব বেশী থাকে না। মিসেস অথবা ডক্টর টিথোনাসের সঙ্গে দেখাশোনাও হত কালে ভদ্রে। ওরাও বোধ করি খুব ব্যাস্ত। বাড়ীতে থাকেনই খুব কম।
সেটা বোধ করি একটা ছুটির দিন হবে। সন্ধ্যের পর প্যালগ্রেভের গোল্ডেন ট্রেজারীর পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা জায়গায় চোখটা আটকে গেল। টেনিসনের একটি কবিতা। নাম টিথোনাস!
The woods decay, the woods decay and fall
The vapors weep their burthen to the ground
Man comes and tills the field and lies beneath,
And often many a summer dies the swan.
টেনিসনের কবিতায় টিথোনাস স্বর্গের দেবী ইওসকে বিয়ে করে অমরত্ব লাভ করেছিল বটে কিন্তু অজর যৌবন চাইতে ভুলে গিয়েছিল। জরাগ্রস্ত মৃত্যুহীন জীবনের ভার তার কাছে দুঃসহ হয়ে পড়েছে। বার বার সে কবরের শীতলতা ও শান্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করেছে।
কিছুটা বিমূঢ়ভাবে বোধহয় টিথোনাস নামটির বিষয়ে ভাবছিলাম এবং সেই সঙ্গে নীচের তলার আগন্তুকদের কথাও স্বভাবতই মনে পড়ছিল, এমনি সময়ে হঠাৎ টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠলো।
‘হেলো, কে?’
‘আমি মিসেস টিথোনাস কথা বলছি, ডক্টর বোস।’
‘কি ব্যাপার, হঠাৎ?’
‘আজ আপনাদের হোলির উৎসব, ছুটির দিন। ডক্টর রায় এবং আরও কয়েকজন বন্ধু আমাদের এখানে এসেছেন। আপনি যদি আসেন এবং সন্ধ্যেটা এখানেই কাটিয়ে যান তো আমরা খুবই খুশী হই। সম্পূর্ণ ইনফর্মাল বুঝতেই পারছেন।’
সাজগোজ করে নীচে নামতেই হল। ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকে সত্যি নিজেদের বাড়ী বলে চিনতেই পারিনি। বাঁ দিকে একটা অংশ তো পুরোপুরি একটা হাসপাতালের ক্ষুদে সংস্করণ। বসবার ঘরটা এমনভাবে সাজানো যে সেটা বৈঠকখানা না শোবার ঘর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি যখন ঢুকলাম তখন সেখানে একটা অদ্ভুত নীলাভ আলো জ্বলছে। এক কোণায় একটা ধূপদানে কিছু ধূপ পুড়ছে। আশ্চর্যের কথা এমন মিষ্টি ধূপের গন্ধ আগে কখনো নাকে গেছে বলে মনে পড়ে না তো। কোন একটা গভীর বিষয়ে আলোচনায় মগ্ন ডক্টর রায়, মিসেস টিথোনাস এবং আরও দুজন অপরিচিত ব্যাক্তি।
ডক্টর রায় বলছেন, ‘আমি ঠিক আপনাদের থিওরীটা বুঝতে পারছি না, মিসেস টিথোনাস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের কোলাজেন ও ইলাস্টিন প্রভৃতি টিস্যুগুলো ক্রমশঃ তাদের তরুণ বয়সের গুণ হারাতে থাকে। আপনাদের এই তথাকথিত র্যাডিক্যাল ক্যাপচার এজেন্ট ইন্জেকশানের ফলে সে ক্ষতি বন্ধ হবে কি করে?’
মিসেস টিথোনাসের প্রাণ খোলা হাসিতে সারা ঘর যেন কাঁপতে লাগলো, ‘ডক্টর রায়! আপনার বন্ধু নেব্রাস্কার ডক্টর হারমানের কাজ আপনি ভুলে গেছেন!! শরীরের কতকগুলো এনজাইম রক্তের অক্সিজেনের ওপর ক্রিয়া করে যে হাইড্রোপেরোক্সিল র্যাডিক্যাল সৃষ্টি করে, সেগুলো সারি সারি টিস্যু কোলাজেনের মধ্যে শিকলের বাঁধন পরিয়ে দেয় বলেই কোলাজেন শক্ত, জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বার্ধক্য এসে মানুষকে গ্রাস করে। এর থেকে মানুষকে রক্ষা করার গোপন তত্ত্ব আমি জানি।’
শেষ কথাটা বলার সময় মিসেস টিথোনাস একবার অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকালেন। কেমন যেন সেই দৃষ্টি। গা শিরশির্ করে উঠলো। ডক্টর রায়ের কথার মধ্যে বিদ্রুপের ঝাঁঝ ফুটে উঠলোঃ ‘ভাবছি আপনার মারক্যাপটোফুলমিন ওষুধটা নিয়ে গিয়ে রোজ দু ফোঁটা করে খেয়ে দেখবো। এখন আমার একটা ছবি তুলে রাখুন। দুদিনে যখন আমার টাকে চুল গজিয়ে যুবক ব’নে যাবো তখন আপনার বিজ্ঞাপনে কাজ দেবে!’
বলা বাহুল্য, এর পর পার্টি ভেঙে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। মাষ্টার মশায় চলে যাওয়ার পর আমিও ওপরে চলে আসবার জন্য উঠে দাড়িয়েছি।
‘সে কি আপনি এখুনি উঠছেন কেন?’ – মিসেস টিথোনাস বলেছেন – ‘বসুন, বসুন! সবে তো রাত সাড়ে ন’টা। যাই বলুন, আপনার মাষ্টার মশায় ডক্টর সুশোভন রায় বড় বৈজ্ঞানিক হতে পারেন কিন্তু বড় বেরসিক এবং মোটেই পরমতসহিষ্ণু নন!’
আমি সংক্ষেপে বলেছি, ‘ওকে ভুল বুঝবেন না। এরকম চটে যেতে ওকে বড় একটা দেখিনি। আচ্ছা, বয়স বাড়ার সঙ্গে কোলাজেন এবং ইলাস্টিনের পরিবর্তন রোধ করার তত্ত্বটা না হয় বুঝলাম কিন্তু হার্ট, লাঙ্স, কিডনী প্রভৃতি বিভিন্ন অপরিহার্য দেহযন্ত্রের ক্ষয় ক্ষতি রোধ করবেন কি করে?’
আবার মিসেস টিথোনাসের সেই দিলখোলা হাসিঃ ‘মোটর গাড়ীতে যন্ত্রাংশ খারাপ হলে কি করেন? খারাপ হয়ে যাওয়া অংশটা ফেলে দিয়ে নতুন লাগিয়ে নেন না? সেই রকম মানুষের দেহটাকে একেবারে, নতুনের মত করে নেওয়া যায় অতি সহজেই।’
ওর কথার মধ্যে একটা সহজ সুর ছিল। তবুও বিস্ময়ে চেচিয়ে উঠেছিঃ ‘তবে কি মানুষ অমর হবে নাকি?’
মিসেস টিথোনাস বলেছেনঃ ‘গুড হেভেন্স! আপনিও আপনার মাষ্টারের মত ক্ষেপে উঠলেন যে? দেখেছেন কাণ্ড! আপনাকে কোনও আহার্য বা পানীয় কিছুই দেওয়া হয় নি এখনও পর্যন্ত। অথচ কথা ছিল এটা একটা আনন্দানুষ্ঠান।’
মিসেস টিথোনাস উঠে গেলেন। ফিরে এলেন হাতে একটা গেলাস নিয়ে।
‘আমরা রান্না করা কিছুই খাই না জানেন তো। তবে আমরা যা সাধারণতঃ খাই আপনাকে তাই খেতে দিচ্ছি।’
গেলাসটা হাতে নিয়েছি। দেখি ঘরে যারা এতক্ষণ নিঃশব্দে বসে ছিলেন তারা উঠে দাড়িয়েছেন। মিসেস টিথোনাস তাদের দিকে একবার তাকালেন। আমিও ওদের দিকে তাকালুম। এদের এর আগে কখনও দেখিনি। দুজনের পরনেই সাহেবী পোষাক, চেহারা দেখলে ভারতীয় বলেই মনে হয়। কিন্তু আশ্চর্য! দুজনেরই মুখের চেহারা বিবর্ণ, রিক্ত! কোনো জীবিত মানুষের মুখ ও চোখের ভাব কখনও এরকম দেখিনি।
মিসেস টিথোনাস আমার বিস্ময়কে আমল না দিয়ে বললেনঃ ‘সমর সিন্হা এবং চন্দ্রশেখরন্ মীট ডক্টর বোস। ওয়েল, গুড নাইট টু বোথ অফ ইউ।’
যন্ত্রচালিতের মতো সমর ও চন্দ্রশেখরন্ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কোনো কথা বললো না, চোখের পাতা নড়লো না, পোষাকের ভাঁজ কুঁচকালো না।
জীবনে কখনো বোধ হয় এমন অস্বস্তিতে পড়িনি। কি করে তাড়াতাড়ি উঠে পালানো যায় ভাবছি, কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারছি না। আস্তে আস্তে গেলাসে একটা চুমুক দিলাম। আনারসের স্বাদ, এমন কিছু বিচিত্র স্বাদ নয়। বোধ হয় টিনের জিনিষ হবে।
মিসেস টিথোনাস প্রশ্ন করেছেনঃ ‘আপনার বাড়ীতে আর কে থাকেন বলুন তো?’
কিছু না ভেবেই বলেছিঃ ‘আজ তো আর কেউ নেই। মাসীমারা দেশে গেছেন। চাকরটাকে ছুটি দিয়েছি হোলির জন্য আজকের রাতটা। আচ্ছা ডক্টর টিথোনাসকে সারা সন্ধ্যে দেখলাম না কেন?’
পাল্টা প্রশ্নের জবাব কি পেয়েছিলাম আজ আর মনে পড়ছে না। কারণ মনে হয় তখন ধীরে ধীরে আমি এক সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছি। বালিয়াড়ি, অজানা ঝিনুক মুক্তো, উলটানো ভাঙা নৌকা, বিচিত্র শ্যাওলা; তারপর চোরা বালি।
আস্তে আস্তে ডুবছি। ইঞ্চি ইঞ্চি করে মিনিটে মিনিটে। জানি না কে আমাকে বাঁচাবে।
একবার উঠেছি, আবার নেমেছি। কয়েক ইঞ্চির মধ্যে কতক্ষণ যে আকুঁ পাঁকু করেছি কে জানে। অবশেষে আশা ছেড়ে দিয়েছি। বাঁচতে চাই না। সমুদ্রের ফেনা ক্ষণে ক্ষণে এসে যেন লাগছে আমার মুখে চোখে। সেই সঙ্গে এক বিচিত্র ধূপের গন্ধ।
কিন্তু তীব্র, বড়ো তীব্র তার স্বাদ – জিভে গলায়, সর্বত্র। আস্তে আস্তে এক নরম চোরা বালিতে তলিয়ে যাচ্ছি।
……… চোখ মেললাম। একটা ঠান্ডা ঘরের কোনায় পড়ে আছি। বুঝতে পারছি না এটা কোথায়। এই কি নরক? তাহলে কি আমি মৃত?
পাশের দেওয়ালে ছায়া পড়লো। তাকালাম। আশ্চর্য! চিনতে পারছি সেই বিবর্ণ দৃশটিঃ সমর সিন্হা। পরনে সাদা পোষাক যেমন ডাক্তারদের থাকে অপারেশন টেবিলে। পাশে আর একটি মুর্তি এসে দাড়ালোঃ চন্দ্রশেখরন্
উঠে বসলাম। মাথা ঘুরছে। মনে হয় শুয়ে পড়ি। তবু বিস্ফারিত চোখে দেখলাম সত্যি এটা একটা অপারেশন থিয়েটার। আসলে আমাদেরই নীচের বড়ো ঘরটাকে এমনি কায়দায় সাজানো হয়েছে। বিরাট কতগুলো বেশী পাওয়ারের আলো জ্বলছে।
কয়েক মুহুর্ত যেন সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে সমর ও চন্দ্রশেখরন্ বেরিয়ে গেল। অল্প পরে যখন ওরা ফিরে এল দেখি যেন কি একটা ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। অপারেশন টেবিলে নামিয়ে দিতেই সভয়ে লক্ষ্য করলামঃ একটি যুবতীর মৃতদেহ। মুখ থেকে যেভাবে রক্ত ঝরছে মনে হয় সদ্য মৃত – কারা যেন গলা টিপে হত্যা করেছে!
দরজায় কার পদশব্দ। ফিরে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম মিসেস টিথোনাস ঢুকছেন। তারও পরনে ডাক্তারী পোষাক। এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি সামনে কাঁচের আলমারীতে নানা রকমের যন্ত্রপাতি রাখা ছিল। মিসেস টিথোনাস ক্ষিপ্র হাতে অপারেশন শুরু করলেন। হতবাক হয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম কি নৈপুন্যের সঙ্গে উনি মেয়েটির হৃৎপিন্ড বার করে এনে সে জায়গায় একটা নকল প্লাস্টিকের পাম্পের মত বস্তু প্রবেশ করিয়ে দিলেন। দেহের সঙ্গে একটা ছোট সাইজের মোটর লাগিয়ে দিলেন এবং সেই সঙ্গে রেডিও ভ্যাল্ভের মত একটি টিউব। সেই টিউব ভ্যাল্ভে আলো পড়তেই পাম্প সচল হলো। একটা স্বচ্ছ টিউব সেই পাম্পের প্রান্ত থেকে পাশের ঝোলানো বোতলে রাখা একটা তরল পদার্থ টানতে লাগলো।
হঠাৎ অনুভব করলাম আমার দুই বাহুর ওপর হিমশীতল স্পর্শ। দেখি সমর ও চন্দ্রশেখরন্ আমার দুই হাত ধরেছে। আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে অপারেশন টেবিলের দিকে। ভয়ে চীৎকার করতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না।
মিসেস টিথোনাসের চোখে আবার সেই অদ্ভুত চাহনি দেখেছিলাম তখনঃ ‘ভয় নেই ডক্টর বোস। মাত্র চার লিটার তাজা রক্ত আপনার এ মেয়েটিকে দিতে হবে। আপনি তাতে মরবেন না। আমার মারক্যাপটোফুলমিন অলরেডী আপনার শরীরের মজ্জায় মজ্জায় মিশে গেছে। আপনি অমর হবেন। সেই সঙ্গে এই মেয়েটিও এক নতুন অমর জীবন পাবে। হার্টটা বড় খারাপ ছিল। নাউ শী উইল হ্যাভ এ ব্র্যান্ড নিউ হার্ট এবং সেই সঙ্গে নিউ ব্লাড উইথ মারক্যাপটোফুলমিন!’
…… দরজায় কারা যেন আঘাত করছে। সে আঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অসহ্য নন্ত্রনায় আমার হাত ছিড়ে পড়ছে। কোন এক বড় আর্টারী ছিন্ন করে ওরা টিউব লাগিয়েছে। তীর বেগে রক্তধারা টিউব বেয়ে ছুটেছে পাম্পের মধ্য দিয়ে সেই প্ল্যাস্টিক হার্টের দিকে।
যন্ত্রনায় চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। শুনতে পাচ্ছি দরজায় খিল ভাঙার শব্দ – কড়াৎ-কড়!
…… আবার চোখ মেলেছি যখন তখন বাইরের সকালের আলো। হাতে একটা ব্যান্ডেজ। আমার নিজের ঘরেই শুয়ে আছি। ঘরের প্রান্তে টেলিফোনে মাষ্টার মশায় কার সঙ্গে যেন কথা বল্ছেনঃ ‘কি বললেন, সন্ধান পেয়েছেন? কোথায়? ডায়মন্ড হারবার রোডে? স্ট্রেঞ্জ! ধরতে পারেন নি! হুঁ, বুঝলাম কালো রঙের ভ্যান থেকে হঠাৎ হেলিকপ্টারের মত পাখা বেরিয়ে এল। তারপর সোজা বে অব বেঙ্গলের দিকে উড়ে চলে গেল। এ সব গাঁজাখুরি গল্প অন্য লোকের কাছে করবেন, মশায়! একটি সুন্দরী বিদেশিনী এবং একটি পালিত কেশ বৃদ্ধ ওরকম কর্পূরের মত উবে যেতে পারে না। মাদ্রাজ, কোচিন, কলম্বো সর্বত্র খোঁজ নিন। কি বললেন, কোথা থেকেও কোনও সন্ধান পান নি। আবার খুঁজুন। ভয় নেই, ওদের খুঁজলে আমেরিকান এইড বন্ধ হবে না! কারন ওরা মোটেই আমেরিকান নয়। আজ রাত্রে তার পাওয়াতেই আমার প্রথম খটকা লেগেছিল। তার পরেই ত’ আমি ডক্টর বোসকে জ্যান্ত উদ্ধার করলুম। খালি আপনাদের অপদার্থতায় ওই ডাইনীটাকে ধরতে পারলাম না!’
সশব্দে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন কয়েক মুহুর্তের জন্য। তার পর আবার ফোনটা তুললেন। ডায়াল করে বল্লেনঃ ‘হ্যালো হিন্দু সৎকার সমিতি। আমি ইনস্টিট্যুট অব্ মলিক্যুলার বায়োলজি থেকে ডক্টর রায় বলছি। সতেরো নম্বর নর্দার্ন অ্যাভিন্যুতে একটা বড় ভ্যান নিয়ে চলে আসুন। তিনটে মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ ঠিকই বলছি – দুটি পুরুষ ও একটি নারী। মেয়েটি কাল রাত্রে মারা গেছে। কিন্তু পুরুষ দুটির মৃতদেহ একটু পুরোনো তবে বিকৃত নয়। নামঃ সমর সিন্হা ও চন্দ্রশেখরন্। বেশ কিছুদিন এদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। কাল এদের পাওয়া গেছে।’
আমি আরেকবার চোখ বুজলাম।
কঃসঃ – টিথোনাস গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালের আশ্চর্য! শারদীয়া সংখ্যায়। লেখকের কন্যা শ্রীমতী যশোধরা রায়চৌধুরীর অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশিত হল। গল্পটি টাইপ করে ডিজিটালাইজড করতে সাহায্য করেছেন দোয়েল বর্মণ।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, টিথোনাস, ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী, প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা