ডাইস
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
ট্যান, রাত সোয়া আটটা
হাভেন শহরটা যেখান থেকে মরুভূমিতে মিশে গেছে, সেটা একটা চৌমাথা।
সেন্ট্রাল রোড ধরে এগোতে থাকা সবুজ গাছ আর রঙিন বাক্সবাড়ির ঝাঁক ছোটো আর গরিব হতে-হতে চৌমাথার এক প্রান্তে থেমে গেছে। অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ফিলিং স্টেশনটা। মোটেল, রেস্টুরেন্ট, আর ক্যাসিনো রয়েছে আরেক প্রান্তে।
অবশিষ্ট কোণটা কোনও এক সময় হাউজিং হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেছিল। অবস্থার ফেরে সেখানকার আধা-পরিত্যক্ত ঘরগুলো এখন শরীর-বেচে খাওয়া মেয়েদের থাকার ও কাজের জায়গা।
সেই কোণেই, হাজারটা নোংরা জিনিসের গন্ধ মাখা দেওয়ালে হেলান দিয়ে, আরো তিনটে মেয়ের পাশে, আঙুলে সস্তা সিগারেট আর ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক লাগিয়ে আমি দাঁড়িয়েছিলাম।
না, আমি ‘লাইনের’ মেয়ে নই। রাতবিরেতে বাড়ি ফিরি বলে পিসি যতই গালাগাল দিক, আমার এখনও অতটা খারাপ অবস্থা হয়নি। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, মরুভূমির দিক থেকে শহরে ঢোকা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া যখন আমার হ্রস্বতম মিনিস্কার্ট আর ফিশনেট স্টকিং-এর মাঝের উন্মুক্ত থাই ফালাফালা করে দিচ্ছিল, তখন সত্যিই মনে হচ্ছিল…
কী দরকার এইরকম চাকরি করার?
“কত?”
কথাটা শুনে চমকে উঠলাম।
ভাগ্যিস! সিগারেটটা পুড়তে-পুড়তে প্রায় আঙুল অবধি এসে গেছিল।
“কী? কথা কানে যাচ্ছে না? গতরটা মাখন হলেও একটা কান তো কাটা, অন্যটাও খারাপ বুঝি?”
কথাগুলো, আর তার সঙ্গেই ঠিকরে আসা তামাক-মেশানো থুতুর দানাগুলো আমাকে এবার একদম সচেতন করে দিল। দেওয়াল ভেজানো শেষ করে জিপার টানার ফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল একটা দানব।
লোকটাকে হাসপাতালে পাঠানোর মতো অবস্থায় আনতে আমার কতক্ষণ লাগবে সেটা হিসেব করতে-করতেই দেখলাম, সন্ধে থেকে আমার পাশে দাঁড়ানো আরেকটা মেয়ে লোকটার হাত আর শরীরের ফাঁক দিয়ে নিজের হাতটা ঢুকিয়ে বলল, “কেন আজেবাজে জিনিস দেখছ ডার্লিং? আমি আছি না?”
আমাকে আরো কয়েকটা গালাগাল দিয়ে লোকটা ও’র গায়ে হেলান দেওয়া মেয়েটার মিনিস্কার্টের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কঙ্কালসার শরীরটা খাবলাতে-খাবলাতে চলে গেল। আমিও একটা শ্বাস ফেললাম।
কাল ব্রিফিং-এর সময়েই এই পয়েন্টটা তুলেছিলাম। বলেছিলাম, “হঠাৎ একটা নতুন মেয়ে ওদের এলাকায় ঢুকলে ওরা মেনে নেবে?”
এজি-র অফিস থেকে আসা শক্ত ধাতের মহিলা খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন, “শহরের ওই প্রান্তে তোমার মতো কেউ দাঁড়ালে সেটা অস্বাভাবিক দেখাবে না।”
কনকনে ঠান্ডা হাওয়াটা আমার শরীরে চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল আবার। কিন্তু ঠান্ডায় নয়, আমি থরথরিয়ে কেপে উঠলাম এই মিশনের জন্য আমাকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটা ভেবে।
তিন বছর আগের সেই মিশনে আমার টিমের সব ক’জন সদস্য প্রাণ হারিয়েছিল।
আমিও হারিয়েছিলাম।
মুখের কিছুটা অংশ, একটা কান, আর একগাদা জুনিয়রের মৃতদেহের ভিড়ে বেঁচে থাকা একমাত্র সিনিয়র অফিসার হিসেবে… সম্মান। সেই সম্মান ফিরিয়ে আনার জন্য তিনটে বছর ধরে আমি কী করিনি? কিন্তু জীবনের জুয়ায় ডাইসটা আমার বিরুদ্ধেই টাল খাওয়া। তাই যে দানই দিই না কেন, আমি শুধু হেরেই গেছি। হারতে-হারতেই আমি অ্যান্টি টেররিস্ট থেকে হোমিসাইড, ভাইস, এসব হয়ে ট্র্যাফিকে এসে ঠেকেছি।
অবশ্য শরীরের খুঁতটুকুই আমাকে এই এলাকায় মাঠে নামার মতো সবচেয়ে যোগ্য লোক করে তুলেছে।
এখানকার খদ্দেররা সত্যিই মানসিক রুগি। তাদের বেশিরভাগ অ্যাক্রোটোমোফিলিয়া-র পেশেন্ট, অর্থাৎ যে মানুষের শরীরের কোনও না কোনও অঙ্গ অ্যাম্প্যুটেট করে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের দেখলেই এদের, সোজা ভাষায়, হিট ওঠে। এমনকি এদের মধ্যে টেরাটোফিলিয়া-র পেশেন্টও আছে, যারা শুধু সেইসব মানুষের সঙ্গে সঙ্গমে ইচ্ছুক যাদের দেহে বিকৃতি ঘটেছে অস্বাভাবিক ভাবে!
এসব গা-ঘিনঘিনিয়ে ওঠা পাবলিককে ঠান্ডা করে দেওয়া আমার কাছে কোনও ব্যাপার নয়।
কিন্তু এখানে যা ঘটছে, সেটার সঙ্গে কি এদের কোনও সম্পর্ক আছে?
জন, রাত সাড়ে আটটা
মেয়েটা গত এক ঘন্টায় চারটে সিগারেট ধরিয়েছে, কিন্তু সেগুলো ও’র ঠোঁটের বদলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আঙুলেই থেকেছে।
চৌমাথার কোণে একটা টুলে বসে, ট্রে থেকে মাউথ ফ্রেশনার, লুব্রিক্যান্ট, আর ফ্লেভার্ড কন্ডোম বেচার মহৎ কাজ করতে গিয়ে আর পাঁচটা জিনিসের মতো এটাও আমার নজরে পড়েছিল।
মেয়েটা কাল অবধিও এখানে ছিল না।
মেয়ে হোক বা ছেলে, কাস্টমারদের খিদে মেটাতে গিয়ে এই লাইনে সবাই এত তাড়াতাড়ি ছিবড়ে হয়ে যায় যে দালাল, আর এই ব্যবসার কাপ্তেনরা, তাদের বেশিদিন রাখতে চায় না। ডিফেকটিভ প্রোডাক্ট বাজারে রাখলে বাজার নষ্ট হয়ে যায় না?
কিন্তু তাও, ওকে দেখে ঠিক, খদ্দের জোটাতে না পারলে দালালের মার খেতে হবে, এমনও লাগছে না।
তাহলে মেয়েটা কেন এসেছে এখানে? তাও আবার আজকের রাতটাতেই?
মেয়েটার মুখের একটা অংশ সার্জেনের ছুরিতে বাদ গেছে, কিন্তু যেটুকু রয়ে গেছে তাতেও অদ্ভুত লাবণ্য আছে। রোগাটে চেহারা আর ছোটো করে ছাঁটা চুল ও’র চেহারায় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপারও এনে দিয়েছে, যেটা এই লাইনে কাস্টমার জোটানোর পক্ষে আদর্শ।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আলো-আঁধারিতেও মেয়েটার চেহারার মধ্যে একটা চাবুক-সুলভ ব্যাপার আমি টের পাচ্ছি, যেটা ঠান্ডায় কেঁপে ওঠা অর্ধনগ্ন শরীরেও লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
কিন্তু সেটা কি এই কোণে যা ঘটছে তার জন্য দায়ী হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট?
গত আড়াই মাসে চারটে মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে এই চৌমাথায়।
প্রেমিকের শ্বাসরোধী নজরদারি থেকে পালিয়ে যাওয়া, সাধ মেটানোর পর দরে না পোষানোয় কাউকে মেরে তার লাশ গুম করে দেওয়া, বা কারো ক্যামেরাবন্দি হয়ে ব্ল্যাকমেলে নীরক্ত হতে-হতে সব ছেড়েছুড়ে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা, এসবের সঙ্গে এই নিরুদ্দেশের কেসগুলো মেলানো যায় না।
আড়াই মাস আগে এক সেনেটরের ছেলে ক্যাসিনো থেকে টাকা উড়িয়ে বেরিয়েছিল। সেটা শুক্রবারের রাত হওয়ায় ক্যাসিনোর দারুণ ভিড় ঠেলে যতক্ষণে ছেলেটার দেহরক্ষী বাইরে আসতে পেরেছিল, ততক্ষণে ছেলেটা এই কোণের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেছিল।
যেহেতু অনেক নামিদামি লোক এই কোণের ব্লকের খদ্দের, অথচ কাগজে-কলমে এখানে ক্ষণিকের সুখের সন্ধানে আসা লোকেদের ঘেন্নার চোখেই দেখা হয়, তাই এদিকে সার্ভেইল্যান্স ইচ্ছে করেই কমজোরি করে রাখা হয়।
দেহরক্ষী কম আলোতেও ছেলেটাকে কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখে। এরপর কী হতে পারে আন্দাজ করে সে মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
দশ মিনিট পরেও যখন ছেলেটা ফেরেনি, তখন প্রথমে সেই দেহরক্ষীটি, আর তারপর সে ও গাড়ির চালক দুজনে মিলে কোণের ব্লকটা খুঁজে দেখে। খবরটা শেষ অবধি পুলিশ এবং মিডিয়ার কাছে পৌঁছয়। তারপর শুরু হয় চিরুনি তল্লাশি। সেই হাঙ্গামায় এখানকার এমন বেশ কিছু ক্রেতাদের নামধাম সামনে আসে, যা চাঞ্চল্যকর বললেও কম বলা হয়।
কিন্তু ছেলেটাকে পাওয়া যায়নি। স্রেফ উবে গেছিল ও।
বিস্তর হইচই, ধরপাকড়, পাইকারি হারে লোকেদের হ্যারাস করা ইত্যাদির পর ব্যাপারটা সবে থিতিয়ে আসছিল। তখনই, প্রথম ঘটনার ঠিক পনেরো দিন বাদে, গায়েব হলেন এক দিদিমনি।
চমকে উঠবেন না। গার্লস স্কুলের প্রিন্সিপালদের মধ্যেও শরীরের টান জাগতেই পারে। সেসব তো আর বই পড়ে, বা নিউজ ভিড দেখে মেটে না। আর সেই চাহিদা যদি একটু বিশেষ ধরনের হয়, যেখানে প্রেমিক খোঁড়া বা হাতকাটা না হলে ব্যাপারটা ঠিক জমে না, তাহলে তো তাঁকে এখানেই আসতে হবে।
মহিলা এর আগেও এই কোণের ঘরগুলোর মেঝেতে পাতা তেলচিটে গদিতে জীবনকে মধুময় করে তুলেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি এখান থেকে আর বাড়ি ফেরেননি।
ফিলিং স্টেশনের সামনের সার্ভেইল্যান্স ফুটেজ দেখিয়েছিল, দিদিমনি এসেছিলেন, থেমেছিলেন, ফ্রেশ হয়েছিলেন, চলে গেছিলেন কোণের আলো-আঁধারিতে।
এবং হারিয়ে গেছিলেন!
লোকলজ্জার ভয়ে খবরটা তাঁর বাড়ির লোক বেমালুম চেপে গেল, শুধু কয়েকটা মহল ব্যাপারটা জানল।
তার ঠিক পনেরো দিন পর, রাতের মোটামুটি এই সময়টাতেই, হারিয়ে গেল এক ট্রাক ড্রাইভার।
এটাও কোম্পানি চেপে গেছিল, কারণ যে মাল নিয়ে শহর ছাড়ার জন্য এই রাস্তাটা বেছে নিয়েছিল লোকটা, সেটা ছিল বে-আইনি। তাছাড়া, সিকিউরিটি ডেটাবেসে সিরিয়াল অফেন্ডার ও মলেস্টার হিসেবে রেকর্ডেড একটা লোক কাজের জায়গায় রিপোর্ট না করলে কার কী আসে যায়?
মিডিয়া এসবের খবর পায়নি। তারা বরং সেনেটরের ছেলে কার সঙ্গে কোথায় চলে যেতে পারে সেই নিয়ে জল্পনা করে, আর সেনেটরের যাবতীয় নতুন-পুরোনো খবর ঘেঁটে বিক্রি বাড়াচ্ছিল।
সত্যি বলতে কী, আমিও এসবের খবর পাইনি। এমনকি প্রথম কেসটারও নয়।
এসব বড়ো-বড়ো ব্যাপারে আমার থাকার কী দরকার, বলুন?
কিন্তু আজ থেকে পনেরো দিন আগে যেটা হয়েছে, সেটা বেসের সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। তখন খোঁজ নিতে গিয়েই আমরা এই পাক্ষিক প্যাটার্নটা আবিষ্কার করেছিলাম।
আচ্ছা, মেয়েটাও কি প্যাটার্ন বুঝে কাউকে খুঁজতে এসেছে?
ট্যান, রাত পৌনে ন’টা
আর পারছি না!
শীত, বা দুর্গন্ধের জন্য নয়। আসলে, শারীরিক ক্ষতের টানে উত্তেজিত হওয়া মানুষের আনাগোনা, আর তাদের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে বুড়ি থেকে ছুঁড়ি, কচি থেকে বুড়োদের পেছনের অন্ধকার ঘরগুলোর দিকে যাওয়ার এই মিছিল দেখতে-দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
ক্লান্ত, নাকি আমার দিকে সেই দৈত্যাকৃতি লোকটার পর আর কেউ হাত বাড়াল না বলে ক্ষোভ? তাহলে কি, মুখে ফোটানো নির্বিকার ভাব, আর এই পোশাকের আস্তরণ সরিয়ে আমার আসলে চেহারাটা ধরা পড়ে যাচ্ছে সবার সামনে?
“ওখানকার রেগুলার লোকেদের মধ্যে কেউ এটা করছে না”, চিবিয়ে-চিবিয়ে বলেছিল সিটিকর্প থেকে আসা লোকটা। অবিশ্বাস আর ব্যঙ্গে আমার মুখটা বেঁকে গেছিল বলেই হয়তো লোকটা ব্যাখ্যা করেছিল, “ওই এলাকার লোকেরা নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই এটা হতে দেবে না। তারা জানে, কোনও রকম গোলমাল হলে তাদের পেটেই টান পড়বে।”
“কিন্তু ওই এলাকায় কাস্টমার ছাড়া তো কোনও বাইরের লোক যায় না”, আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, “আর এই চারটে দিনেই যারা ওই এলাকায় কাস্টমার হয়ে গেছিল, তাদের ব্যাপারে নিশ্চই খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল?”
“হয়েছিল”, এ.জি অফিসের ভদ্রলোক সংক্ষেপে বলেছিলেন।
“যারা গায়েব হয়েছে তাদের মধ্যে কোনও মিল থাকা তো দূরের কথা, আগে কখনও কোথাও তাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল, এমন প্রমাণও পাইনি আমরা।”, এই কথাগুলো যিনি বলেছিলেন তাঁর পোশাকটা সিভিলিয়ানের হলেও বসার ভঙ্গি আর চুলের ছাঁট প্রায় চিৎকার করে আসল পরিচয়টা দিচ্ছিল!
কারণটা সহজবোধ্য। গায়েব হওয়া চতুর্থ ব্যক্তিটি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল।
“সবচেয়ে বড়ো কথা”, টেবিলের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে এগিয়ে আসেন সুপার, “এগুলো যদি কিডন্যাপিং হত, তাহলে মুক্তিপণ চেয়ে একটাও দাবি এল না কেন?”
তাই ক্যাসাবিয়াংকার মতো আমাকেও এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আলো-আঁধারিতে। যতক্ষণ না আমি এমন কিছু দেখি যা থেকে এই রহস্যের একটা তল করা যায়।
আর, তেমন কিছু দেখতে পেলে, কী করব আমি?
মুখের যেদিক’টা সার্জেনের আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও এবড়োখেবড়োই থেকে গেছে, সেখানেই চামড়ার ভাঁজে একটা সূক্ষ্ম ট্র্যান্সমিটার রয়েছে। সেটা ট্যাপ করলে সংকেত পৌঁছে যাবে যথাস্থানে।
আরে! এ কখন…!
জন, রাত আটটা পঞ্চাশ
এ কী!
এই বাচ্চা মেয়েটা কোত্থেকে এল?
এও কি এই লাইনে ব্যবসা করে নাকি?
হ্যাঁ! তাই তো মনে হচ্ছে! মেয়েটার পরনে যে স্কুল ইউনিফর্মটা রয়েছে, তার স্কার্টের নিচের ছেঁড়াখোঁড়া অংশটা থেকে পা বলে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বরং সেখানে লোহা বা কালচে ফাইবারের স্টিক জাতীয় কিছু রয়েছে।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ড আগেও তো মেয়েটা ওখানে ছিল না।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, ল্যাম্পপোস্টের আলো আর ফিলিং স্টেশনের আলো কাটাকুটি করে যে ছায়া-ছায়া জায়গাটা তৈরি করেছে, ঠিক তার মধ্যেই দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। ক্যাসিনো বা ফিলিং স্টেশন থেকে বেরিয়ে এদিকে আসতে চাইলে কেউ ওকে দেখতে পাবে, অথচ ক্যামেরার দানাদার ফুটেজে ঘন ছায়ার মধ্য থেকে ওকে আলাদা করাই যাবে না।
বাব্বা! মেয়েটা খদ্দের জুটিয়ে ফেলেছে মনে হচ্ছে। তিনটে লোকই তো ও’র দিকে এগোচ্ছে!
এই এলাকায় যতরকম বিকৃত রুচির কারবার হয়, তার মধ্যে বাচ্চা মেয়েদের দিয়ে শরীরের খিদে মেটানোও অন্যতম। যদি এই দশ-বারো বছর বয়সী মেয়েটা সেই পেশাতেই একজন ‘সার্ভিস প্রোভাইডার’ হয়, তাহলে, যত খারাপই লাগুক না কেন, আমার হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।
কিন্তু যদি গত আড়াই মাসে গায়েব হওয়ার ঘটনাগুলোর ব্যাপারে মেয়েটা কিছু জেনে থাকে?
নাঃ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। পেট্রল পাম্পে মিকি আছে। ওকেই আপাতত আমার ট্রে সামলানোর গুরুদায়িত্বটা দিয়ে মেয়েটার কাছে যেতে হচ্ছে।
শেষে একটা বাচ্চা মেয়ে…!
আরে! এ কী? আমি কি ঠিক দেখছি?
কী সর্বনাশ! এ তো…!
ট্যান, রাত আটটা পঞ্চান্ন
শুধু আমার ইনস্টিংক্ট নয়, অভিজ্ঞতাও বলছিল, ল্যাম্প-পোস্টের ছায়াঢাকা জায়গাটার মধ্যে হঠাৎ করে উদয় হওয়া বাচ্চা মেয়েটাই এই কেসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোক।
ওই তো! অল্পস্বল্প নেশায় টলতে থাকা তিনটে লোকের মধ্যে একজনই মেয়েটার পিছু নিয়ে একদম ধারের দেওয়ালটার দিকে এগোচ্ছে। বাকি দু’জন কেমন যেন ঘুম-ঘুম ভঙ্গিতে পেছনে ফিরে যাচ্ছে!
আর দেরি করা যাবে না! আমার মনের সবক’টা অ্যালার্ম বাজতে শুরু করেছে। মেয়েটার পেছনে এবার…
“হ্যালো ডার্লিং”, চোখের কোণ দিয়ে মেয়েটাকে লক্ষ করায় এতটাই মনোযোগী ছিলাম যে তেলতেলে গলার মালিক কখন আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারিনি, “তুমি এতক্ষণ এখানে আছ, আর একবার আমার সঙ্গে দেখা করলে না?”
ডানদিকে তাকিয়ে বুঝলাম, এই এলাকার সবচেয়ে কুখ্যাত, সবচেয়ে নৃশংস আর স্যাডিস্টিক দালাল ‘ডাইস’ মর্গ্যান নিজের বড়ো গাড়িটা থেকে নেমে আমার কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে সদলবলে।
ও’র এই নামকরণের জন্য দায়ী ও’র কোমরে গোঁজা ছুরিটা, যেটা দিয়ে ও শুধু শত্রু নয়, ও’র কথার অবাধ্য হওয়া মেয়ে বা শিশুদের মুখও মিহি করে কাটা সবজির মতোই ফালাফালা করে দেয়।
আপদগুলো আর আসার সময় পেল না!
“মেহনতি মেয়েদের আমি খুব পছন্দ করি”, একটা বেড়ালের আদুরে ঘড়ঘড়ানির মতো করে বলছিল মর্গ্যান, “বিশেষ করে সেইসব মেয়েদের, যাদের ওপরওলা সব দিয়েও, কোথাও মেরে দিয়েছেন। কিন্তু দয়া-দাক্ষিণ্য দেখালে তো আমার চলবে না।
শহরের এই কোণে খাটতে হলে শুধু কমিশন নয়, আমাকে সার্ভিস দিয়েই যে শুরু করতে হয়, এটা তুমি জানতে না?”
এবার আমার খেয়াল হল, কেন এই এলাকার অন্য মেয়েরা আমার কাছে ব্যবসা হারানো নিয়ে একটুও চিন্তিত হয়নি। ছোটোখাটো দালালরাও নির্ঘাত সম্ভাব্য কাস্টমারদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিল। শুধু ওই পেচ্ছাপ করতে আসা লোকটা ছাড়া তাই আর কেউ…
এই অবস্থাতেও ব্যাপারটা ভেবে আমার একটু স্বস্তি হল।
আর তারপরেই একেবারে ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলে উঠল!
“কী হল ডার্লিং?”, মর্গ্যানের হাতে উঠে আসা ছুরিটার মতো ও’র গলাটাও নগ্ন হিংস্রতায় হিসহিসিয়ে উঠল, “তোমার কি দু’টো কানই গেছে?”
আমি আর দেরি করলাম না। হাত তুলে চামড়ার ভাঁজে লুকোনো ট্র্যান্সমিটারটা ট্যাপ করে পেছনের অবস্থাটা একবার দেখে নিলাম।
ল্যাম্প-পোস্টের ঠিক নিচে, দেওয়ালের কাছে জমাট অন্ধকারের মধ্যে মেয়েটাকে দেখতে না পেলেও ওইদিকে এগোনো লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম।
মিনিট দেড়েক অন্তত হাতে আছে, এমনটাই বুঝলাম।
তিন বছর ধরে আমার ভেতরে জমে ওঠা যে হতাশা, কষ্ট, অভিমান, আর ভাগ্যের ওপর অন্ধ আক্রোশ বেরোবার পথ খুঁজছিল, সেটা অবশেষে একটা মনের মতো টার্গেট খুঁজে পেল।
মর্গ্যানের একটু পেছনে দাঁড়ানো গোরিলার মতো লোকটা এক সময় পেশাদার কুস্তিগির ছিল। কিন্তু যেকোনো কুস্তিগিরের মতো ও নড়তে সময় নেয়।
আমি হাত চালালাম লোকটার চোয়ালের নিচের অংশের দিকে। ওই মারটা নিচের পাটির দাঁতগুলো ঠিকরে ওপরে তুলে দেয়, যাতে সেগুলো তালুর নরম অংশে গেঁথে যায়।
লোকটা মাটিতে পড়ার আগেই ও’র কোমরে একটা পা রেখে আমি অন্য হাঁটু আর কনুইটা সজোরে নামিয়ে এনেছিলাম আরেকজনের ওপর। দুটো প্রেশার পয়েন্টে একসঙ্গে মুয়ে থাই মার হজম করার মতো মানুষ এই পাগলাটে পৃথিবীতেও বিশেষ নেই, তাই আরেকটা আপদ বিদায় হল।
এবার মাটিতে উবু হয়ে বসে একটা পা পেছনদিকে চালিয়ে দিলাম।
মর্গ্যানের পায়ের হাড়টা যেভাবে ‘মট!’ শব্দ তুলে ভাঙল, তার মতো মিষ্টি আওয়াজ আমি অনেক দিন শুনিনি।
বন্দুক বের করা লোকটাকে দু’পায়ের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে সজোরে হাত চালালাম কন্ঠার হাড় লক্ষ্য করে। এই মারের একটাই পরিণাম হয়, তাই আর কিছু না ভেবে এবার আমার পা চালালাম দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র লোকটার আসল জায়গা তাক করে। লোকটা যন্ত্রণায় বেঁকে যেতেই ও’র মুখ আমার খুব কাছে এসে গেল। গলায় একটা মোক্ষম ‘চপ’ ও’র দু’চোখের আলোও নিভিয়ে দিল।
দেওয়ালের দিকে তাকিয়েই আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল।
বাচ্চা মেয়েটা, বা তার পেছনে হাঁটা লোকটা, দু’জনের কাউকেই আর দেখা যাচ্ছে না!
স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো ছিটকে উঠতে গিয়ে খেয়াল হল, মর্গ্যানের একটা গতি না করলে ও’র প্রভাবশালী বন্ধুরা ওকে চটপট ছাড়িয়ে তো আনবেই, সঙ্গীদের মেরেছি বলে ও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষীই হয়ে যেতে পারে।
ইচ্ছে ছিল না ওকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার, কিন্তু আর এক সেকেন্ডও নষ্ট করতে চাইছিলাম না।
মর্গ্যানের ছুরি-ধরা হাতটাই ও’র গলার কাছে নিয়ে গিয়ে মসৃণভাবে একটা টান দিল।
বুদবুদ তোলার মতো আওয়াজ করে রক্ত যখন ও’র গলা থেকে বেরিয়ে আশেপাশের নানা জিনিসের সঙ্গে নিজের বর্ণ-গন্ধ মেশাচ্ছে, ততক্ষণে আমি ছুটতে শুরু করেছিলাম।
আরে! রাস্তার ধারে একটা টুলে বসে যে বুড়োটা এতক্ষণ কন্ডোম বেচছিল, সে ওই পোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে কেন?
আমাকে ডাকছে নাকি লোকটা?
জন, রাত ন’টা
মেয়েটা ছুটে নয়, প্রায় উড়ে আসছিল।
ওহ! একটা মেয়ে একা হাতে অতগুলো বদমাইশকে নিকেশ করছে, এটা দেখলে এত আনন্দ হয় আগে বুঝিনি!
“ম্যাডাম”, আমি ও’র কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিই, “জন থ্যানড্রো, রিকভারি ব্র্যাঞ্চ।
আপনি যাদের খুঁজছেন, তারা ওই দেওয়ালের নিচে রয়েছে”।
মেয়েটার চোখে সন্দেহ স্পষ্ট হচ্ছে দেখে আমি পাভেলের দেওয়া পরিচয়পত্রটা ও’র দিকে এগিয়ে দিই। মেয়েটা কে, সেটা এবার আমি বুঝতে পেরেছি।
একটা বড়ো শ্বাস ফেলে মেয়েটা বলে, “আপনি এখানে থাকবেন, এটা আমাকে জানানো হয়নি কেন?”
“গোপনীয়তার খাতিরে আমাদের কাজ আলাদা রাখা হয়, আপনি তো সেটা জানেন”, আমি দু’হাত তুলে মেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা করি।
আমার কথা শুনে না হলেও আমার বয়স, মুখময় বলিরেখা, ধপধপে সাদা চুল, এসব দেখে মেয়েটা, মানে হাভেনের সবচেয়ে বিখ্যাত তথা কুখ্যাত অফিসার ট্যান একটু নরম হল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “ওরা কোথায় গেছে, আপনি কীভাবে বুঝলেন?”
“আমি আর আপনি প্রায় একই সময়ে বাচ্চা মেয়েটাকে আসতে দেখেছিলাম। তারপর, বিশেষ করে ও’র আজকের শিকার ও’র পিছু-পিছু চলতে শুরু করার পর আপনি অন্য কাজে একটু … ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আমি ওদের থেকে চোখ সরাইনি, বরং দেওয়ালের গা ঘেঁষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধাওয়া করেছিলাম দু’জনকেই।
মেয়েটা আমার চেয়ে অনেক দূরে ছিল, কিন্তু লোকটার জ্যাকেটে আমি একটা রেডিয়ন ট্র্যাকার ছুঁড়ে দিতে পেরেছিলাম। তার দৌলতেই… এই দেখুন…”
আমি কাউন্টারটা বের করি। সেটা দেখিয়ে দেয়, আমাদের থেকে কিছুটা দূরে, মরুভূমির উদ্দেশে এগিয়ে চলেছে উজ্জ্বল বিন্দুটা। অথচ আমাদের সামনে প্রথমে নিরেট দেওয়াল, তারপর ভাঙাচোরা আরো কিছু ঘর, কয়েকটা দুমড়ে-মুচড়ে থাকা গাড়ির কঙ্কাল, আর শেষে কাঁটাতার লাগানো পুরোনো চেকপোস্টের ধ্বংসাবশেষ। এর মধ্য দিয়ে কারো পক্ষে এভাবে এগোনো সম্ভব নয় বুঝেই মেয়েটা আমার কথা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে দেওয়াল আর মাটির সংযোগস্থলটা খুঁটিয়ে দেখল।
পুলিশের সাইরেনের আওয়াজটা তখনই আমার কানে ধাক্কা মারল।
মেয়েটা কিন্তু সেদিকে তাকায়নি।
আসলে যাবতীয় সিকিউরিটি সুইপে যেটা এতদিন ধরা পড়েনি, সেই ফিল্ডের ঝিলমিলটা দেখতে পেয়ে ও দেওয়াল আর মাটির মাঝে ওই এক চিলতে ফাটলটা থেকে চোখ সরাতেই পারছিল না।
“ঘিলি ফিল্ড”, কিছুটা অপ্রয়োজনীয় হলেও আমি বলে ফেলি, “মাত্র কয়েক মিনিট হল খোলা-বন্ধ করা হয়েছে বলে ওটুকু দেখা যাচ্ছে, নইলে ক্যামেরা হোক বা মানুষের চোখ, এখানে শুধু আধমরা ঘাস আর বালি মেশানো মাটি ছাড়া কিচ্ছু দেখতে পাবে না”।
মেয়েটা কেমন মোহাবিষ্টের মতো ওদিকে তাকিয়েই বলে, “আমরা এখানে ঢুকতে পারব?”
আমি কিছুক্ষণ হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি। ও’র পাঠানো সিগনালে সাড়া দিয়ে ব্যাক-আপ ইতিমধ্যেই এসে গেছে। তা সত্বেও ও একা এই ফাটল দিয়ে শত্রুর গুহায় ঢুকতে চাইছে এটা জেনেবুঝেও যে আর বড়োজোর মিনিটখানেক পরেই এই জায়গাটা একদম সিল হয়ে যাবে!
মেয়েটা কি পাগল, না অসমসাহসী?
আমি আর সময় নষ্ট করি না, শরীরটা যথাসাধ্য পাতলা করে নিয়ে ফাটলের মধ্য দিয়ে নামিয়ে দিই, আর তারপর একটা লাফ দিয়ে নিচে পড়েই গড়িয়ে যাই। আমার ঠিক পেছনেই, একটা বেড়ালের মতো নিঃশব্দে নেমে আসে মেয়েটা।
ট্যান, রাত ন’টা পাঁচ
নিঃশব্দে ছুটছিলাম আমরা।
আমি এই ধরনের অবস্থার জন্য নিজেকে তৈরি রাখি, কিন্তু বুড়োটাও আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল এই টানেলের মধ্য দিয়ে।
আমার মাথায় প্রশ্নরা কিলবিল করছিল, কিন্তু সেগুলো কাকেই বা জিজ্ঞেস করতাম আমি? বুড়োটা, কী যেন নাম… হ্যাঁ, জন। লোকটার পদবিটা উদ্ভট। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান নাকি? … যাকগে, জনকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো কিছু জানা যাবে, কিন্তু মিলিটারির লোকেরা নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে মুখ খুলতেই চায় না। এ আমি হাড়ে-হাড়ে জানি।
বিন্দুর সঙ্গে দূরত্বটা কমে আসছিল।
ওই তো, একটা সবজেটে আলো দেখা যাচ্ছে! ওখানেই কি…?
এটা কী???
“ডাইস!”
চমকে উঠে আমি পেছন ফিরে মর্গ্যানকে খোঁজার চেষ্টা করি, তারপর বুঝি, জন কথাটা বলেছে সামনের মেশিনটার দিকে তাকিয়েই।
“এটা একটা ডিফারেন্স ইঞ্জিন”, অদ্ভুত সবুজ আভায় মাখা ঘনকাকার জিনিসটা থেকে আমি চোখ সরাতে না পারলেও জনের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম, “ডিজিটালিস ইনকর্পোরেটেড-এর বানানো প্রবেবিলিটি ক্যালকুলেটর। ডাকনাম: ডাইস!”
ডিফারেন্স ইঞ্জিন? শব্দটা যেন চেনা… আরে হ্যাঁ! ক্রিপ্টোগ্রাফি ক্লাসের শুরুতেই আমাদের এটা পড়ানো হয়েছিল তো।
কম্পিউটার তৈরির পথে একেবারে প্রথম ধাপ ছিল জে.এইচ.মুলারের ধারণার ওপর ভিত্তি করে চার্লস ব্যাবেজের বানাতে চাওয়া এই মেশিন। এতে জটিল সমীকরণের নির্ভুল সমাধান বের করা সম্ভব ছিল। ট্র্যাজেডি হল, ব্যাবেজ অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন বানিয়ে কম্পিউটার তৈরির পথে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারলেও এই ডিফারেন্স ইঞ্জিন বানানোর মতো নিখুঁত যন্ত্রপাতি তৈরি হতেই তাঁর জীবৎকাল, মায় দেড় শতাব্দী পার হয়ে গেছিল।
কিন্তু এই মেশিনটাকে দেখে তো মিউজিয়াম পিস বলে মনে হচ্ছে না।
খটাং!
একটা ধাতব আওয়াজে আমার হুঁশ ফেরে।
মেশিনটার কিছু হল নাকি? ওটার সবুজ আলোটা লালচে হয়ে আসছে মনে হচ্ছে!
“পেছনে আসুন”, জনের গলাটা হিসহিসিয়ে ওঠে, “ও আমাদের দেখতে পেলে বিপদ আছে” ।
“ও মানে?”, আমার মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে। আর তারপরেই সেই ঘটনাটা ঘটে যেটা আজ অবধি আমার জীবনে কতবার ঘটেছে তা গোনার জন্য এক হাতের আঙুলগুলোই যথেষ্ট।
দারুণ ভয়ে আমার শরীরটা ভারী হয়ে ওঠে, কারণ কী ঘটছে সেটা আমি ততক্ষণে দেখতে পেয়েছি।
প্রকাণ্ড কিউবের মতো মেশিনটার আশেপাশে ছায়ার সঙ্গে মিশে থাকা ভাঙাচোরা জিনিসের স্তূপের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে কয়েকটা শরীর।
মরুভূমির কাছে থাকা, আর এই মেশিনের আভাই বোধহয় শরীরগুলোয় এখনও পচন ধরতে দেয়নি, কিন্তু শরীরের মালিকেরা যে মৃত সেটা তাদের বেঁকে যাওয়া মুখ, আর সাদাটে চোখ দেখেই বোঝা যায়!
চারটে… না, পাঁচটা শরীর আমাদের দিকে টলোমলো পায়ে এগিয়ে এল। গায়েব হয়ে যাওয়া চার মক্কেলের সঙ্গে স্কুল ড্রেস পরা মেয়েটাও এগিয়ে আসছিল তো।
“ওরা ইতিমধ্যেই মৃত, তাই কিল-শট দিয়ে ওদের থামাতে পারবেন না”, বলে জন, “চেষ্টা করুন মাথাটা শরীর থেকে আলাদা করতে, কারণ কন্ট্রোলটা মাথায় রয়েছে”।
লোকটা এসব ব্যাপারে এত জানল কী করে?
তবে হ্যাঁ, এই দারুণ বিপদের মধ্যে, নিরস্ত্র অবস্থাতেও লোকটার গলা একদম স্টেডি রয়েছে, মানতেই হবে।
যে লোকটা প্রথমে আমাদের কাছে পৌঁছল, তার চুলের ছাঁট বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এই সেই মিলিটারি অ্যাটাশে।
মরে গেলেও কি মিলিটারি কৌশলগুলো মনে থাকে? থাকে মনে হচ্ছে, কারণ লোকটা নড়বড়ে হলেও ও’র আঙুলগুলো যেভাবে কাঁকড়ার মতো বেঁকে তেলোর কাছে গুটিয়ে এসেছিল, তাতে বুঝতে পারছিলাম, মেরিন কোরের আন-আর্মড কম্ব্যাটের কায়দা মেনেই ও’র শরীর লড়বে।
“ট্যান!”, চিৎকার শুনে আমি জনের দিকে তাকালাম। একটা লাফ দিয়ে সবচেয়ে সামনের দুশমনের কাছে পৌঁছে গেল বুড়োটা, আর ঘাড় না ঘুরিয়েই আমাকে বলল, “আমি এদের দেখছি। আপনি দেখুন আজকের লোকটাকে বাঁচানো যায় কি না”।
হঠাৎ খেয়াল হল আমার, তাই তো! আজকে যে লোকটাকে নিজের পেছন-পেছন নিয়ে এসেছিল বাচ্চা মেয়েটা, সে তো পড়ে আছে সামনেই। ও ঠিক আছে তো?
নিচু হয়ে লোকটার নাকের কাছে হাত দিয়ে বুঝি, ও’র নিঃশ্বাস পড়ছে। ও’র অজ্ঞান শরীরটাকে কিছুটা পেছনে টেনে এনে টানেলের দেওয়ালে রাখি যত দ্রুত সম্ভব।
কিন্তু বুড়োটা হঠাৎ আমাকে এই দায়িত্ব দিল কেন? এটা কি বোকা-বোকা শিভ্যালরি দেখানোর সময়?
মিলিটারি লোকটার মাথাটা তখনই আমার মাথার ওপর দিয়ে টানেলের পেছন দিকে ছিটকে গেল।
আমি চমকে মুখ তুলে দেখলাম, লোকটার শরীরটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল।
জন কি খালি হাতে লোকটার ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দিল নাকি? কীভাবে?
বাকি চার জন একটু-একটু করে ঘিরে ফেলছিল জনকে। তার মধ্যেও জন চিৎকার করে বলল, “আপনি লোকটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন এখান থেকে। যে ফাটল দিয়ে আমরা ঢুকেছি, সেটার নিচে গিয়ে সিগনাল পাঠান। আপনার ফোর্স ওপর থেকে ফিল্ডটা ভাঙার চেষ্টা করতে পারবে তাহলে!”
“প্রশ্নই ওঠে না!”, চিৎকার করে উঠি আমিও, “এটা আমার অপারেশন, আমিই শেষ করব!”
জন হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, আর তারপর, অবিকল একটা বিষাক্ত সাপের মতো নিজের শরীরটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যাতে একটা বিশাল চেহারার লোক ও’র নাগালের মধ্যে এসে পড়ে।
এই নির্ঘাত সেই ট্রাক ড্রাইভার! লোকটার ঘাড়ে-গর্দানে চেহারায় যেখানে গলাটা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হত, জন কিন্তু সেখানেও আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছিল কোথাও, আর তারপর প্রায় একই মোশনে নিজেকে ঠিকরে নিয়ে এসেছিল আগে দাঁড়িয়ে থাকা জায়গার চেয়েও কিছুটা পেছনে, আর তারপর বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের মতো করে মাথাটা পেছন দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল।
একটা বুড়ো, সে যতই ট্রেনিং-এর মধ্যে থাকুক না কেন, এত শক্তিশালী হয় কীভাবে?
জন, রাত ন’টা পনেরো
পাঁচটার মধ্যে দু’টো গেছে! কিন্তু যে তিনজন আছে তারা অপেক্ষাকৃত কমজোরি হলেও আমার নাগালের বাইরে। তাছাড়া, শত হলেও, আমার বয়স এবার জানান দিতে শুরু করেছে নিজের কথা।
কোনওভাবে মেশিনটার কাছে পৌঁছতে পারলে আমি ব্যাপারটাকে সামলাতে পারব, কিন্তু ওই তিন জনকে অকেজো করে মেশিন অবধি পৌঁছনো সহজ হবে না।
চোখের কোণে একটা বাদামি বিদ্যুৎ দেখলাম বলে মনে হল।
না, বিদ্যুৎ নয়। ট্যান!
মেয়েটা প্রায় উড়ে এসে জোড়া পায়ের লাথি মারল দামি স্যুট পরে টলতে থাকা শরীরটাকে।
সেনেটরের ছেলে অনেক দিন আগেই মরে গেছিল। এবার ও’র শরীরটাও পেছনের একটা লোহার শিকে গেঁথে গেল।
মেয়েটার চোখ আছে বলতে হবে! আলো-আঁধারিতেও ছুঁচলো রডটা ও দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু এবার… সর্বনাশ!
বাচ্চা মেয়েটার শরীরের নিচে যে অংশটা প্রথম দর্শনে লোহা বা ফাইবার মনে হলেও আমার চোখে ন্যানোবট দিয়ে তৈরি দুটো চলমান কলাম বলে ধরা পড়েছিল, সেটা এবার দেখলাম তরল হয়ে ট্যানের কাছে পৌঁছে গেছে।
বাচ্চাটার গায়ে জোর নেই বলে ডাইস এবার নিজের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিজের হাতেই তুলে নিচ্ছে!
“ট্যান!”, আমার গলা ফাটানো চিৎকারটা কানে গেছিল বলে মেয়েটা মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতেও একদিকে সরে গেছিল, তাই সাপের মতো করে এগিয়ে আসা ন্যানোবটের স্রোতটা ও’র মুখ বা গলার নাগাল পায়নি, … কিন্তু ও’র পা দু’টোকে জড়িয়ে ধরেছিল!
“আঃ!” আর্তনাদ করে উঠল মেয়েটা। ও’র যন্ত্রণায় বেঁকে যাওয়া মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, ও’র পা দুটোকে পিষে ফেলছে ন্যানোবট দিয়ে তৈরি দুটো জীবন্ত তার। তাও মেয়েটা প্রাণপণে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিল, কারণ ষষ্ঠেন্দ্রিয় বা অন্য কিছু ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, ও’র মাথা বা গলার নাগাল পেলে ন্যানোবটগুলোর মাধ্যমে ডাইস ওকে শুধু মারবে না, বরং ওকে একটা অস্ত্রে পরিণত করবে।
শরীরের সবটুকু জোর নিজের ডান পা-তে নিয়ে আসার চেষ্টা করে কিক-বিক্সিং এর কায়দায় সেটা চালিয়ে দিলাম দিদিমনির গলা লক্ষ্য করে। মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে উড়ে গেল।
রইল বাকি এক।
বাচ্চা মেয়েটার শরীরটা মাটিতে অসাড় হয়ে পড়েছিল, কারণ ও’র চলাফেরার মাধ্যম ন্যানোবটগুলো তখন ট্যান-এর শরীরে কেটে বসেছিল নির্মম ভাবে। আমি তাও ঝুঁকি নিলাম না। একটা বাচ্চা মেয়ের গলা ছিঁড়ে নেওয়া আমার দ্বারা কিছুতেই হত না, তাই ট্রাক ড্রাইভারের কবন্ধ শরীরে কোমরের নিচে জিনসের সঙ্গে লাগানো ছোটো ছুরিটা ঝিকিয়ে উঠে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা মাত্র আমি সেটা টেনে নিলাম, এবং একটাই মোশনে মেয়েটার গলায় ছুরিটা যত জোরে সম্ভব চালিয়ে মেশিনটার দিকে ছুটে গেলাম।
হালকা লাল আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল ডাইস।
জিনিসটা তৈরি করা হয়েছিল ফাই বা গোল্ডেন রেশিও মেনে হেক্সাহেড্রন আকারেই। সারিবদ্ধভাবে সাজানো ভালভগুলো দিয়ে তৈরি জিনিসটা দেখে, জুয়া খেলতে যা লাগে তারই বড়ো সংস্করণ মনে হচ্ছিল।
রেডিয়েশন জোনের এত কাছে হাই এন্ড সার্ভার কাজ করবে না বলে মিলিটারি অন্যরকম প্রযুক্তি চেয়েছিল। সেই বরাতটা দখলের জন্য, গোপনে এবং বে-আইনি টেকনোলজি ব্যবহার করে এই মেশিনটা বানায় ডিজিটালিস ইনকর্পোরেটেড।
কিন্তু তিন মাস আগে তারা জানতে পারে যে মিলিটারি এখান থেকে বেস সরিয়ে, জায়গাটা মিলিশিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে। ফলে মেশিনটা বানানো নিরর্থক হয়ে যায়।
বে-আইনি এই জিনিসটা অন্য কোথাও সরানোর সুযোগ না থাকায় মেশিনটাকে অসম্পূর্ণ অবস্থায় রেখেই কোম্পানি এখান থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। ব্যাপারটা যাতে কারো নজরে না পড়ে সেজন্য মরুভূমির দিকের মুখটাও তারা সিল করে দিয়ে যায়। কিন্তু জিনিসটা ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে ভেবে তারা সেটাকে বন্ধ করেনি। বরং পরিত্যক্ত পাওয়ার লাইনগুলো ট্যাপ করে যাতে মেশিনটা নিজের দেখাশোনা করতে পারে, সেই ব্যবস্থা তারা করে রাখে।
“আ…” ট্যানের গলা থেকে বেরোনো কাতর আর্তনাদটা শেষ দিকে কান্নার চেহারা নিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, ও’র প্রতিরোধ শেষ হয়ে আসছে।
আমি বুঝলাম, আর সময় নেই। যা করার করতে হবে এক্ষুনি।
ডাইসের প্রাণ ভোমরা হল তার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় থাকা অংশটা। সাধারণ অবস্থায় কোনও মানুষের পক্ষে সামনের দিকের অ্যারেগুলো ভেদ করে ওই অবধি হাত বাড়ানোর আগেই হাই ভোল্টেজ শকে তাকে ছাই করে দেয় ডাইস।
আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে জায়গা মতো হাতটা চালিয়ে দিই। ভালভগুলো ভেঙে আমার হাত ঢুকে যায় মেশিনের ভেতরে।
আমি অনুভব করি, হাজার ভোল্টের কাছাকাছি বিদ্যুৎ আমার হাতের ওপর আছড়ে পড়ছে। নেহাত আমি বলেই…
পর মুহূর্তেই আমার মনে হয়, কিছু একটা ভুলে যাচ্ছি আমি। কী ভুলছি?
স্রেফ রিফ্লেক্স অ্যাকশনে নিজের বা হাতটা সময়মতো তুলে আনতে ফেলেছিলাম বলে ডাইসের শরীরে লেগে থাকা একটা লিভার আমাকে থেঁতলে দেওয়ার আগেই সেটাকে কোনওক্রমে ধরে ফেলতে পারি।
ডাইস নিরস্ত্র নয়, অসহায় তো নয়ই।
কিন্তু একটা হাত যদি নিজেকে বাঁচাতেই কাজে লাগে, তাহলে আমি ও’র ভেতরের সার্কিট-ব্রেকারগুলো ট্রিপ করব কী দিয়ে?
ট্যান, রাত ন’টা কুড়ি
অসহ্য যন্ত্রণা চোখের সামনে অন্ধকার জমাট করে তুললেও আমাকে অজ্ঞান হতে দিচ্ছিল না।
পায়ের ওপর পেঁচিয়ে বসা এই তারটা কীভাবে সরাই? জন কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?
দুম করে রাগ হয়ে গেল! সারা জীবন নিজের দেখভাল করে এসে এখন একটা বুড়োর মুখাপেক্ষী হতে হবে আমাকে?
গায়ের জোর নয়, বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে।
পা অসাড় হয়ে এসেছিল, তবু আঙুলে ভর দিয়ে একটা লাফ দিয়ে কিছুটা গড়িয়ে গেলাম, যেখানে দিদিমনির মুণ্ডহীন শরীরটা পড়েছিল।
যা ভেবেছিলাম, সেটাই হল। সাপের মতো আমার গলা লক্ষ্য করে এগিয়ে এল একটা চকচক করতে থাকা জীবন্ত তার। কিন্তু ততক্ষণে আমি জিনিসটা পেয়ে গেছি।
দিদিমনির কোমরে বেল্টে লাগানো ক্রিস্ট্যালগুলো আমি চিনতে পেরেছিলাম। বছর খানেক আগেও এগুলো খুব চলেছিল। এই ক্রিস্ট্যালের বিশেষত্ব হল, এগুলো দিয়ে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড নষ্ট করে দেওয়া যায়।
ক্রিস্ট্যাল লাগানো বেল্টটা একটানে খুলে নিয়ে আমি চাবুকের মতো চালিয়ে দিই প্রথমে একটা, তারপর অন্য তারটার মধ্যে। সঙ্গে-সঙ্গে ঝুরঝুর করে গড়িয়ে যায় ন্যানোবটগুলো, যেগুলো আলাদা অবস্থায় ধুলোর মতো ছোটো, এবং তেমনই নগণ্য।
অসহ্য যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে মুখ তুলেই বুঝতে পারলাম, বুড়ো প্যাঁচে পড়েছে।
দৌড়নো অসম্ভব। জোরে হাঁটাও ভীষণ কষ্টকর। কিন্তু হাতে জোর অটুট আছে আমার।
“জন!” বলে একটা চিৎকার করে আমি বেল্টটাই ও’র দিকে ছুড়ে দিলাম।
ডান হাতটা ডাইসের মধ্যে আটকানো, অন্য হাতটা দিয়ে সাংঘাতিক জোরে ধেয়ে আসা লিভারগুলোকে ঠেকানোর ফাঁকেই হাওয়া থেকে বেল্টটা ছিনিয়ে নিল জন। যে লিভারটা ও’র দিকে ছুটে আসছিল, সেটাকে ও বেল্ট দিয়ে মসৃণভাবে পেঁচিয়ে নিল, আর বেল্টের অন্য প্রান্তটা গুঁজে দিল ডাইসের একদিকে।
সপাটে লিভারটা আছড়ে পড়লে ডাইসের ভালভগুলোর ওপর। দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল মেশিনের ওই অংশটায়।
হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটি তখন নীলচে সাদা বিদ্যুতের বিশাল আর্ক তুলে মেশিনটার পেছনে এক দিক থেকে অন্য দিকে ছুটে যাচ্ছে!
আমি বুঝতে পারছিলাম, মেশিনটার ভেতরে দারুণ গরমে গলে যেতে শুরু করেছে ভালভগুলো। পোড়া গন্ধও পাচ্ছিলাম।
ছেঁড়াখোঁড়া কোট ফেলে তার নিচের যে রুপোলি বডিস্যুটটা পরে জন আমার সঙ্গে এই টানেলে নেমেছিল সেটা, আর ও’র হাত, হয়তো বা মুখের চামড়াও, পুড়ছে।
জন তবুও হাত সরিয়ে নিল না। বরং অন্য হাতটাই সজোরে মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে কিছু একটার ধরে হ্যাঁচকা টানল ও।
মেশিনটার আলোগুলো কিন্তু নিভল না। লাফিয়ে মেশিনটা থেকে পেছনে এসে পড়ল জন।
গড়িয়ে-গড়িয়ে আমার কাছে যখন এসে পৌঁছল ও, তখন দেখতে পেলাম, ও’র দুটো হাতই বীভৎসভাবে পুড়ে গেছে। সে অবস্থাতেও আমাকে ধরে দাঁড় করাল জন, আর বলল, “মিলিটারি অ্যাটাশে’র জুতোতে এমন কিছু পাবেন যেটা দিয়ে মেশিনটাকে ওড়ানো যায়, সেটা বের করুন।”
আমি নিজেকে ছেঁচড়ে সৈন্যটির কাছে নিয়ে গিয়ে ও’র শরীর হাতড়াতে লাগলাম।
পেয়েছি! জুতোর সোলের তলায় পাতলা পাউচে যেটা রয়েছে সেটা খুব স্টেবল একটা কেমিক্যাল পেস্ট, কিন্তু এই মুহূর্তে ডাইসের একটা দিকে যে পরিমাণ তাপ তৈরি হচ্ছে তাতে এটা দিয়ে বেশ গোছানো একটা বিস্ফোরণ…
“পেয়েছেন?”, জনের চিৎকার শুনে মুখ তুলে বুঝলাম, সেনেটরের ছেলের তখনও অল্পস্বল্প হাত-পা নাড়ানো শরীরটার কাছে গিয়ে একটা ভাঙা লোহার টুকরো ও’র গলায় চালিয়ে ও সেটাকেও নিথর করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। মাথা নেড়ে আমি প্যাকেটটা ও’র দিকে ছুড়ে দিই।
অত্যন্ত দ্রুত হাতে প্যাকেটটা ডাইসের একটা ভাঙা ভালভের মধ্যে গুঁজে দিয়ে আমার দিকে ছুটে আসে জন। ও’র মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝি, পালাবার জন্য বেশি সময় নেই।
আর তারপরেই ডাইসের একটা কেবল জনের দুটো পা-ই পেঁচিয়ে ধরে!
জন, রাত ন’টা পঁচিশ
কেবলটা আমার পা পেঁচিয়ে ধরামাত্র আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ট্যানের সঙ্গে আমি এখান থেকে বেরোতে পারব না।
“না!”, মেয়েটা আমার দিকে আবার আসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমি চিৎকার করে ওকে থামাই, “আর মিনিট খানেকের মধ্যে বিস্ফোরণ হবে, আমরা দু’জনে তার মধ্যে এখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে যেতে পারব না! আপনি এগোন!”
“প্রশ্নই ওঠে না!”, গর্জে ওঠে মেয়েটা।
মেয়েটা আমাকে ফেলে পালাতে চাইবে না আমি জানতাম, তাই আমি পুরোনো রেকর্ড ঘেঁটে জানা তথ্যটা কাজে লাগাই, আর মেয়েটাকে সেই নামে ডাকি, যেটা ও’র মা’র মৃত্যুর পর থেকে কেউ উচ্চারণ করেনি। বরং, ও’র রোদে-পোড়া বাদামি চেহারার সঙ্গে মানানসই ডাক নামটাই সরকারি হয়ে উঠেছে।
“তনয়া!”
মেয়েটার মুখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফোটে এবার। পায়ে জড়ানো তারের আসুরিক টানের সঙ্গে লড়তে গিয়ে হাঁফ ধরলেও আমি এক নিঃশ্বাসেই বলে চলি, “তোমার বাড়িতে অন্তত এক বুড়ি পিসি আছে তোমার অপেক্ষায়। কিন্তু আমার কেউ নেই। তাই, আমাদের দু’জনের এখানে মরাটা অর্থহীন হবে।
তুমি… প্লিজ … যাও!”
শেষ শব্দটা চিৎকার করে বলেছিলাম, কারণ ট্যান… তনয়া’র নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার মতো সময় ক্রমেই কমে আসছিল।
আমার সঙ্গে মেয়েটার শেষ বারের মতো চোখাচোখি হয়েছিল, তারপর প্রাণপণে নিজেকে, আর আজকে যে লোকটা ডাইসের শিকার হতে যাচ্ছিল তার অচেতন শরীরটাকেও টেনেহিঁচড়ে টানেলের অন্য প্রান্তে নিয়ে গেছিল তনয়া।
আমি শেষের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম।
তনয়া, এক মাস পরে
সেই রাতে, একটা বাঁক অবধি এসে পৌঁছতে পেরেছিলাম আমি। তার বেশি যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। সুযোগও পাইনি অবশ্য।
আগুনের একটা বিরাট গোলা, আর মানানসই রকম শব্দ তৈরি করেছিল বিস্ফোরকটা।
অসহ্য গরমে টানেলের কংক্রিটে শরীর ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা আমার ছিল না, তবে বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়া মিলিটারি টানেলটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল।
মানুষের হাইপোথ্যালামাস-কে প্রসেসর হিসেবে কাজে লাগিয়ে সচল থাকা প্রথম ডিফারেন্স ইঞ্জিনের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিল টানেলের ওই অংশে।
যেক’টা মানুষের শরীর ওখানে ছিল, সেগুলোও দারুণ তাপে গলে গিয়ে এমন চেহারা পেয়েছিল যে কাউকে আর আলাদা করা সম্ভব ছিল না।
ডাইসের পুরো ব্যাপারটার ওপর ‘ক্লাসিফায়েড’ তকমা লেগে গেছিল বলে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তবু, ফোর্সের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়া টুকরো-টাকরা কথা থেকে ছবিটা আমার কাছে একটু স্পষ্ট হয়েছিল।
প্রতি পনেরো দিন পর, নিজের মেইনটেন্যান্স করতে গিয়ে ব্যাটারি রিপ্লেস করার মতো করে নতুন হাইপোথ্যালামাস প্রয়োজন হত ডাইসের।
শহরের ওই কোণে ব্যবসা করা একটি বাচ্চা মেয়ে, যে খদ্দেরদের বিকৃত শখের খাতিরে স্কুলগার্লের ইউনিফর্মে ঘুরত, ডাইস মর্গ্যানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে এই ফাটলের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। কৌতূহলের বশেই সে ডাইসের কাছে গিয়ে পড়ে, এবং প্রথম শিকার হয়।
মেয়েটির মস্তিষ্ক থেকে ডাইস নিশ্চই জায়গাটার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছিল, তাই তাকে কাজে লাগিয়েই আরো চারটি শিকার ধরা হয়েছিল পরের দু’মাসে।
বুড়ি পিসি’র রাগ-রাগ ভালোবাসার আদরে সুস্থ হয়ে ওঠার ফাঁকে নিউজফিড থেকে বুঝতে পারছিলাম, ডিজিট্যালিস ইনকর্পোরেটেডের ব্যবসা লাটে উঠেছে। মিলিটারি তো নিশ্চুপ ছিলই।
কোণের ব্লকের হতভাগ্য নারী-পুরুষ-শিশুদের পুনর্বাসনের একটা কংক্রিট চেষ্টাও শুরু হয়েছে অবশেষে।
কিন্তু বীরত্বের মরণোত্তর পদকের জন্য, রিকভারি ব্র্যাঞ্চে কাজ করা জন থ্যান্ড্রো নামক বুড়োটার নাম আমি প্রস্তাব করতে পারিনি, কারণ কোনও ডেটাবেসে আমি ওই নামে কাউকে খুঁজে পাইনি।
লোকটা আসলে কে ছিল?
জন, এক মাস পরে
“অন্যায়।”, হেনরির গলাটা সিরিয়াস হলেও চোখের হাসিটা ও’র মনের ভাবটা ফুটিয়েই তুলছিল, “খুব অন্যায় করেছ তুমি। আরে, জন থ্যান্ড্রোকে বীরত্বের জন্য মরণোত্তর পদক দেওয়াতে চেষ্টা করেছিল মেয়েটা! আর সেই লোক কিনা বহাল তবিয়তে রোদ পোহাচ্ছে!”
সেই রাতটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
মেয়েটা আমার দিকে পেছন ফিরে ছেঁচড়ে টানেলের অন্য দিকে যাওয়া শুরু করা মাত্র আমি আমার আঙুলের পোড়া চামড়াগুলো টেনে সরিয়ে দিই।
আজ্ঞে না, আমার ব্যথা লাগে না। আমি ওরকমই।
চামড়ার তলায় তাপ ও বিদ্যুৎসহ কাঠামোটার ডগা থেকে বেরিয়ে আসা ধারালো নখ দিয়ে দ্রুত কেবলটা কেটে ফেলি আমি। তারপর লাফিয়ে পৌঁছে যাই মিলিটারি অ্যাটাশেটির কাছে।
পনেরো দিন আগে ও ক্যাসিনো থেকে বেরোনোর সময় আমাদের এক এজেন্ট ও’র ড্রিংকসের সঙ্গে কয়েকটা জিনিস মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল।
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, পরদিন লোকটা যখন একটা বৈঠকে থাকবে, তখন একটা বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গ ও’র দিকে ছুড়ে দেওয়া, আর সেটা হলেই ‘বুম’! কিন্তু সেই রাতে লোকটা ক্যাসিনো থেকে বেরিয়ে গায়েব হয়ে গেলে আমরা দারুণ চিন্তায় পড়ে যাই, কারণ শরীরে বোমা নিয়ে লোকটা গায়েব হয়ে যাওয়ার অর্থ, কোনও নিরপরাধ সিভিলিয়ানও ওই বোমার শিকার হতে পারেন!
তাই আমাকে ফিল্ডে নামতে হয়।
সেই রাতে অবশ্য অ্যাটাশেটির মৃতদেহই ছিল আমার রক্ষাকর্তা।
মরুভূমির দিকে খোলা টানেলের মুখটা সিল করে দেওয়া থাকলেও আমি লোকটার বডিটা হাতে তুলে নিয়ে ছুটি সেদিকেই। তারপর ও’র বডিটা ওই দরজায় গুঁজে দিয়ে মুখ দিয়েই সেই বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গটা তৈরি করে ছুঁড়ে দিই ও’র দিকে।
টাইমিংটা ভালোই ছিল, কারণ সেই বিস্ফোরণে সিল করা দরজায় ফাটল ধরামাত্র পেছনে ডাইসের ঘন্টাও বেজে গেছিল। তবে সেই সময়টুকুই আমার বেরিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট ছিল।
“তোমাকে এই পদবিটা কে দিয়েছিল জন?”, মজারু সুরে জানতে চায় হেনরি, বিদ্রোহী বাহিনীতে আমার হ্যান্ডলার।
“পাভেল”, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, “জন ‘দ্য অ্যান্ড্রয়েড’-কে সংক্ষেপে ‘জন থ্যান্ড্রো’ করে দেওয়ার আইডিয়াটা ওরই ছিল।”
Tags: ঋজু গাঙ্গুলী, গল্প, ডাইস, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস
হাইভোল্টেজ অ্যাকশন। পড়তে পড়তে একসঙ্গে কত কত ছবি চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছে— টার্মিনেটর(জাজমেন্ট ডে), টার্মিনেটর(স্যালভেশন), সাইবর্গ, ট্রান্সফর্মারস, ট্রানসেন্ডেন্স। সত্যি বাংলায় এই মুহূর্তে আপনি ছাড়া সাইবারপাংক থ্রিলার আর কেউ লিখছে কিনা সন্দেহ!
ভীষন ভালো লাগল। তীব্র অ্যাকশান আর সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ টেকনোলজির ছোঁয়া। তবে বড় কম্প্যাক্ট। রস পেতে গেল্ব অন্তত বারদুই পড়তে হয়।
wow wow wow!
বেশ ভালো লাগল।
রুদ্ধশ্বাস!
Just wow!!!
Action moment gulo darun. Kintu taar cheyeo bhalo ses ta. Jon the Android mon kere nilo.
ভালো লাগল। দুরন্ত গতি। হয়ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আরও ভালো লাগবে। অবশ্যই যদি তাদের মধ্যে বাংলা পড়ার আগ্রহ জন্মায়। ভবিষ্যতের উন্নত সাইবারবিদ্যার আভাষ স্পষ্ট। তবে মনে হয় গল্পের গতিটা আরও একটু কম হলে হয়ত আরও আগ্রহ আরও বাড়ত।