ডুবুরি
লেখক: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: ধ্রুবজ্যোতি দাস এবং দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
ক্ষীণ অ্যালার্মের আওয়াজের সাথে ঘুমের মধ্যে বাবার ডাক শুনে উঠে পড়ল বান্টি। ভালো নাম নির্মাল্য। মাইথন ডিনোবলি–র চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র সে। ভোর বেলা স্কুলের জন্য মা তৈরি করলেও রোজ বাবার মোবাইলের অ্যালার্ম আর বাবার ‘বান্টি, উঠে পড় বাবু’ শুনেই ঘুম ভাঙে। ছেলেকে উঠিয়েই তৈরি হয়ে প্ল্যান্টে যায় বাবা। মাঝে দিন পনেরো বাড়িতে বহু মানুষের সমাগমে সব থম মেরে ছিল। আজ আবার বাবা ঘুম ভাঙিয়ে দিল ঠিক সময়ে।
গুঞ্জা ছেলেকে ডাকতে এসে দেখে সে বিছানায় বসে আছে। এই কদিনে ছোট্ট ছেলেটা কেমন স্বাবলম্বী হতে শিখে গেছে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে চোখের জল লুকোল গুঞ্জা। সহানুভূতির ভিত্তিতে তার চাকরি হতে চলেছে ডিভিসি–রই একটি অফিসে। প্লান্টে নয় অবশ্যই।
“মা, জানো তো, বাপিই আমায় ঘুম থেকে তুলে দিল।”
বান্টির দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে বলল গুঞ্জা, “বাপি তোমায় বড্ড ভালোবাসত যে সোনা। তুমিও তো বাসতে। কিন্তু যা ঘটেছে, তা তো বদলাতে পারব না বাবা, মনটা শক্ত করো, মন দিয়ে পড়াশুনো করো, আর এমনি করে নিজে নিজে সকাল সকাল স্কুলের জন্য উঠে পোড়ো। গুড বয়।”
“আমাকে বাপিই ডেকে দিয়েছে মা। আমি স্পষ্ট বাপির অ্যালার্মটা শুনলাম, আর বান্টি উঠে পড় বলল বাবা। তবে খুব আস্তে আস্তে, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে।”
“অন্য কিছুর আওয়াজ হবে হয়ত। অন্য কারও মোবাইলও হতে পারে। বাপির ফোন তো নট রিচেবল হয়ে গেছে কদিন আগে।”
বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এমনিতেই কল্পনাপ্রবণ। তার ওপর সদ্য পিতৃবিয়োগ। গুঞ্জা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর পর একবার অফিসে গিয়ে জেনে আসতে হবে দরখাস্তের সাথে আরও কী কী লাগবে। কর্মরত অফিসারের বিধবা পত্নী। অন্যের জন্য প্রাণ ত্যাগ করেছে, না হওয়ার কারণ নেই। তবু নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে চেয়ারে না বসা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না।
১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাস। মহাবীর কোলিয়ারির নিংহা কূপে মাটি থেকে ৮৬ মিটার গভীরে কাজ করছিল ২৩২ জন শ্রমিক। আচমকা পরিত্যক্ত পিটে জমে থাকা জল কর্মব্যস্ত ৩৪ নং কূপের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। কপাল ভালো ১৬১ জনের, যারা বিপদের আভাস পাওয়া মাত্র ওপরে উঠে আসতে পেরেছিল। তারপরেই লিফ্ট অচল। নীচে রয়ে গেছে ৭১ জন শ্রমিক। কোলিয়ারির ইতিহাসে খুব গর্বের সঙ্গে স্মরণ করা হয় ইসিএল কর্তৃপক্ষের কৃতিত্বের কথা। অতি তৎপরতার সঙ্গে মূল খনিমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিকল্প সরু সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সেই পথে ঠিক একজন ঢোকার মতো ধাতব আধার প্রবেশ করিয়ে অন্ধকার পাতাল থেকে জবজবে ভিজে শ্রমিকদের একে একে উদ্ধার করে আনা হয় পঁয়ষট্টি জনকে। মাত্র ছয়জন হতভাগ্যকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আদিত্য চৌধুরী ছিল ভাগ্যবানদের একজন। খনির টেকনিকাল সুপারভাইজার। ভূগর্ভে বাতাস আটকে যে অংশটুকু জলের দখল থেকে বেঁচেছিল সেই দিকে সকলকে চালনা করে নিয়ে যাওয়া, চার–পাঁচ দিন ধরে অন্ধকার ও রাক্ষুসে জলের শাঁড়াসি আক্রমণের মধ্যে ফুরিয়ে আসা প্রাণবায়ুতে সঞ্চয়ী শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে সহকর্মীদের মনোবল বাড়ানো এবং বাঁচার ব্যকুলতায় ছোট্ট ক্যাপস্যুল লিফ্টে হুড়োহুড়ি না করে একে একে অসুস্থ মানুষগুলোকে ভূপৃষ্ঠে রওনা করানোর দায়িত্ব নিয়েছিল যে গুটিকয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তাদের মধ্যে আদিত্য একজন। সবাইকে ওপরে পাঠানোর ফাঁকে বারবার জলের মধ্যে বিপজ্জনকভাবে হদিশ না মেলা ছয় শ্রমিকের তল্লাশি চালিয়ে গিয়েছিল। নিজে ওঠে একেবারে শেষে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায়।
সফল অপারেশনের জয়জয়াক্কারের মধ্যেও আদিত্য কিছুতেই ভুলতে পারছিল না জিতেন গরাইয়ের স্ত্রীর বুক চাপড়ে কান্না, দুলু মণ্ডলের মায়ের শূন্য চাওনি কিংবা মহেশ বাউরির সদ্য পরিনীতা স্ত্রীর মাসের পর মাস ঘাতক কূপ আর ত্রাণকারী সুড়ঙ্গের সামনে গিয়ে প্রতিদিন অধীর আগ্রহে সন্ধ্যে পর্যন্ত অপেক্ষা। কোলিয়ারিতে মন টিঁকছিল না। চেষ্টা চরিত্র করে কাজ জোটাল ডিভিসি–র একটা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। মাইথনে সাতশো গ্রাম ডোবানো বিশাল জলাধারের গা ঘেঁষে একটি পাহাড়ের গহ্বরে বেশ রোমাঞ্চকর ইউনিট। গুহার ভেতর টারবাইন আর ট্রান্সফর্মারের বিকট শব্দ আর সেই সাথে জল বয়ে যাওয়ার একটানা ঝরঝর।
আদিত্য চৌধুরীর সাহসের দুর্নাম তার সাথে করেই মাইথন পাঞ্চেতেও ছড়িয়েছিল। ড্যামে কোনও বিপদ আপদ দুর্ঘটনা ঘটলেই কেন জানি আদিত্যর কানে ফেলা হোত, আর সেও নিজের কাজ ফেলে, এমনকি রাতের ঘুম ফেলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেত। পলিটেকনিক পাস করা টেকনিশিয়ান সে। বিই পাস ইঞ্জিনারদের সমতুল্য না হলেও অভিজ্ঞতার জেরে ধাপে ধাপে ওপরে উঠছিল। একটু দেরিতে হলেও বিয়েটা করেই ফেলল। ভারতবর্ষের বহু জায়গায় বাঁধ আর তার জলাধার দেখেছে গুঞ্জা, কিন্তু বাড়ির কাছেই এই মাইথন ড্যামের চারপাশে যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর তার দিগন্ত বিস্তৃত গভীর রিজার্ভয়ারের যে রূপ তার তুলনায় বাকিগুলোকে শিশু মনে হয়। তাই বিয়ের পর এই বিশাল জলাধারে নৌকো বিহার করে দূরে সবুজ পাহাড়ওয়ালা ‘সবুজ দ্বীপ’–এ ঘুরে আসা আর ডিভিসির জলে ঘেরা গেস্ট হাউসে শখের রাত্রিবাস ছাড়া আলাদা করে মধুচন্দ্রিমার আবদার জনায়নি বরের কাছে। এত সুন্দর জায়গা থাকতে কোন আহাম্মক দূর দূরান্তে হুড়মুড়িয়ে পাহাড় নদী দেখতে ছোটে?
বাঁধের জলে বোটিং করতে গিয়ে অতি উৎসাহীদের বিপদও যে হয় না তা নয়। এত গভীর জলাধারে, বিশেষ করে যেখানে জল ওপর থেকে প্রবাহহীন মনে হলেও ভেতরে চোরা স্রোতের গতি প্রকৃতি বোঝা যায় না, সেখানে ডুবুরি খুব একটা সহজলভ্য নয়। কেউ ডুবে গেলে দেহ খুঁজে পেতে বেশ কয়েকদিন লেগে যায়। বেশির ভাগই মেলে লকগেটের কাছে বা টারবাইনের আশেপাশে যেদিকে আবদ্ধ নদী ওপারে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। পরোপকারের তাগিদ হোক বা রোমাঞ্চের হাতছানি, আদিত্য গুঞ্জার আপত্তি সত্ত্বেও ডুবুরির কাজ করে। কোম্পানিও তেমন তেমন বিপদে পড়লে ভাড়া করা ডুবুরিদের আগে শখের ডুবুরি আদিত্য চৌধুরীর কানে খবর ফেলবেই। দুর্ঘটনা ছাড়াও হাইডাল ইউনিটের রিজার্ভয়ের তলায় কোনও গোলমাল হলে ডুবুরি নামাতে হয়। কালে ভদ্রে যাই ঘটুক সবার আগে আদিত্যকেই অতন্দ্র পাওয়া যায়। সেদিনও পাওয়া গেল। সবে সন্ধ্যে বেলায় গা ধুয়ে চা জলখাবার নিয়ে বসেছে। মুড়ির বাটি অসমাপ্ত ফেলে চায়ের কাপে কোনওক্রমে একটা বড় চুমুক দিয়ে ডুবুরির পোশাক, হেলমেট আর অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে বেরিয়ে গেল সে।
“ওগো, অন্ধকার হয়ে এসেছে। ড্যামের জল ঘোলাটে লাগছে। দু ফুট গভীরেই অন্ধকার। তুমি যেও না প্লীজ। বড্ড ভয় করছে আমার।”
“কোনও ভয় নেই। যদি অসুবিধা দেখি আজকে জলে নামব না। কিন্তু যদি দেখি আশা আছে, তাহলে দেখব অ্যাটলিস্ট বাচ্চাটাকেও যদি বাঁচাতে পারি।”
“মনটা কু গাইছে গো। যেও না।”
“আমিও যাব বাপির সঙ্গে। আমিও স্কুবা ডাইভার হব।”
তীরে গিয়ে মনে হল একটা মাথা বহু দূরে ভাসছে ডুবছে। অন্য ডুবুরিরা কাজে নেমে পড়েছে। ভাবার সময় নেই। সাজ সরঞ্জাম নিয়ে ঝাঁপ মারল জলে। কিছু দূর সাঁতরে আসার পর মনে হল, পকেটে যা সব আছে সেগুলোর বারোটা বেজে গেল। আর উপায় নেই। যাক। দুজনকে অচৈতন্য অবস্থায় তুলেছিল ডুবুরির দল। একজনকে টারবাইনের সুড়ঙ্গের বাইরে পাথরের খাঁজ থেকে টেনে ছাড়িয়ে আনতে হয়, আর অন্যজন তার একটু আগেই উদ্ধার হয়েছে। প্রথমজনকে বাঁচানো যায়নি। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি বারো বছরের ছেলেটাকেও। কিন্তু ওরই মাথাটা এই তল্লাটে ভাসতে দেখেছিল আদিত্য। তীরে সবাই বারণ করছিল। কিন্তু যদি পাওয়া যায় ভেবে অন্ধকার জলে হেলমেটের টর্চ জ্বালিয়ে ডুব দিয়েছিল আদিত্য। এরা খোলা আকাশের নীচে ড্যামের জল দেখে ভয় পাচ্ছে? খনির অন্ধকার তো দেখেনি। ভয় পেয়ো না গুঞ্জা।
কিন্তুর গুঞ্জার ভয়টাই সত্যি হল। বাঁধের গভীরতাই টেনে নিল শেষ পর্যন্ত। জলের ধারে এসে স্ত্রী পুত্র সাত দিন ধরে সারাদিন অপেক্ষা করে থাকত, অফিস ও প্লান্টের লোকজন জোর করে কোয়ার্টারে পৌঁছে দিত বিকেলের দিকে। লোকে লোকারণ্য, আরও ডুবুরি নামল, জাল পড়ল। কিন্তু বিপুল জলরাশির কয়েশো ফুট গভীরে কোথায় গিয়ে যে লুকিয়েছে রহস্যপ্রিয় মানুষটা।
বান্টির কল্পকাহিনীতে কেউ মজা পায়, কেউ বিরক্ত হয়। মা ছাড়াও স্কুলের বন্ধুদের কাছে ফলাও করে গল্প করে, তার বাবা রোজ সকালে আর বিকেলে মোবাইলের অ্যালার্ম বাজিয়ে ডেকে দেয়। সকালে স্কুল, বিকেলে ক্যারাটে ক্লাস – যেমন বরাবর হয়ে এসেছে। গলাও শোনা যায় কখনও কখনও। বাচ্চা ছেলের কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু ছেলেটা পাড়ার বন্ধুদের মারফত ভৌতিক গুজব ছড়িয়ে সবার নজর কেড়ে গুরুত্ব পেতে চাইছে। এটা তো চালিয়াতি।
বছর ঘুরতে চলল। রোজ কত মানুষ চলে যাচ্ছে। মানুষের স্মৃতিতে আদিত্য চৌধুরী অতটা জীবন্ত নয়। শুধু সংগতভাবেই এখনও রয়ে গেছে গুঞ্জার দৈনন্দিন হাহাকারে আর বান্টির কল্পনায় – “বান্টি উঠে পড় বাবু”।
দূর থেকে দেখলে মনে হয় প্রচণ্ড অগ্নিকাণ্ডে ধুঁয়োর কুণ্ডলী উঠছে আকাশের দিকে। বোমা বিস্ফোরণও মনে হতে পারে। সঙ্গে ঝস্ ঝস্ শব্দ। কিন্তু কাছে গেলে আগুনের উত্তাপের বদলে গায়ে মুখে লাগে গুঁড়ি গুঁড়ি জলের স্পর্শ। ভেজা ভেজা ঠাণ্ডা ঠান্ডা। জলের উত্তাল পতনের ভয়াবহ গর্জনে কয়েক কিলোমিটার লম্বা ব্রীজটা যেন গুম্গুম্ করে কাঁপছে। চারখানা লকগেট এক সাথে খুলে দিলে গা ছম ছম করবে না এমন অনুভূতিহীন বুক মেলা দুর্লভ। বর্ষায় লকগেট খোলা ড্যামে প্রায় চল্লিশ ফুট ওপর থেকে বিপুল জলরাশির ধোঁয়াধার পতন যে দেখেনি তাকে বর্ণনা করে বোঝানো মুশকিল। দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যায়, মাথায় ঝিম ধরে। ভয় করে। একবার পড়ে গেলে কি ঐ জলকণার মতো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে হবে?
“মা শুনতে পাচ্ছ? মাসি শুনে দেখো।”
“কী শুনব? জল পড়ার শব্দ?”
“অ্যালার্মের শব্দ! বাবার মোবাইল বাজছে। রোজ বিকেলে এই সময় বাজে। সকালেও বাজে। খুব আস্তে আওয়াজ হয়। কিন্তু এখন বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে।”
“দিদি, তোর ছেলেকে কিন্তু চাইল্ড সাইকাট্রিস্ট দেখা। এতদিন পরেও আবোলতাবোল বকা গেল না?”
“আমি আবোলতাবোল বকছি না মাসি। তুমি কান পেতে শোনো। জলের আওয়াজে ভালো বুঝতে পারছ না। এই শব্দটা আমার খুব চেনা। মা, তুমিও কি শুনতে পাচ্ছ না?”
“আমরা কেউ পাচ্ছি না তুই ছাড়া। তবে জানিস তো দিদি, আমি গতকাল ট্রেনে ওঠার আগে আদিত্যদার নম্বরে ফোন করতে কিন্তু রিং হল। কেউ ধরল না। আমি ভাবলাম বুঝি তোরা নাম্বারটা নতুন করে নিয়েছিস।”
“বান্টিবাবুর কি এক্ট্রা সেন্সিটিভ পারসেপশন আছে? শুনেছি মানুষ যেসব আওয়াজ শুনতে পায় না বাদুড় বা কোনও কোনও জন্তু সেসব পায়।” বান্টির মেসোমশাই টিপ্পুনি কাটল।
গুঞ্জা ধমকাতে গিয়েও একটু অন্যমনস্ক হল। একটা পিঁ পিঁ পিঁ গোছের আওয়াজ তার কানেও গেছে মনে হল। কিন্তু সেটা মোবাইলের অ্যালার্ম কিনা বোঝার আগেই থেমে গেল। ধুর! কী বোকা সে! এখানে আরও মানুষজন আছে। তাদের কারও মুঠোফোনের আওয়াজ হতে পারে, পাওয়ার প্লান্টের আওয়াজও হতে পারে। মনে শূন্যস্থান তৈরি হলে তাতে কত কী বাসা বাঁধে। বান্টির মুখে শুনে শুনে গুঞ্জারও ভীষণ ইচ্ছা করে আদিত্যর কোনও আভাস পেতে। আর যদি কেউ স্বেচ্ছায় ভুল দেখতে, ভুল শুনতে চায়, তাহলে কাল্পনিক শব্দের অভাব হয় না। মাথা থেকে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলল গুঞ্জা।
আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে বিকেলের সূর্য উঁকি মারতেই পতনশীল জলের ধারার ওপর চমৎকার রামধনু দেখা দিল। সবাই এ ওকে ডেকে রামধনু দেখাচ্ছে। কিন্তু ও কী? এও কি গুঞ্জার চোখের ভুল? রামধনুর মধ্যে বসে আছে এক ডুবুরি! অন্ধকার পাতালে যেন। তার মাথার টর্চ থেকে ক্ষীণ আলোয় যে অবয়বটা ফুটে উঠল সেটা যে ভীষণ চেনা, এক বছর আগে বাঁধের জলে হারিয়ে যাওয়া অসম সাহসী মানুষটার। চমকে উঠে ছেলের দিকে তাকাতেই বান্টি বলে উঠল, মা দেখলে?
“দিদি!” চমকে দিদিকে জড়িয়ে ধরেছে রঞ্জাও।
দৃশ্যটা কয়েক মিনিট পর মিলিয়ে গেল। রামধনুটাও ফিকে হয়ে এসেছে। তিনজনেই কি একই ভুল দেখল? না, তিনজন তো নয়। যারা ওখানে ছিল তাদের অনেকেই দেখে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। এমনিতে বর্ষাকালে খুব বেশি পর্যটক আসে না। তার ওপর এত বিস্তৃত জায়গা যে লোকজন হলেও ঠিক ভিড় জমে না। অনেকেই জলের ধারাপাত থেকে দূরে গিয়েছিল। কিন্তু রামধনুর দর্শকরা ক্রমে একত্রিত হল। কেউ দেখেছে, কেউ দেখেনি। কিন্তু যারা দেখেছে তারা সবাই তো আদিত্যর বৃত্তান্ত জানেও না। তাহলে এতগুলো মানুষ একসাথে নিশ্চই ভুল দেখেনি। তার মানে কি গুঞ্জার কানে পৌঁছনো পিঁপিঁপিঁ শব্দটার উৎসও..? বান্টির কথা কি..?
গুঞ্জা পাওয়ার প্লান্টে আদিত্যর এক বন্ধুকে ফোন করল। ভদ্রলোক কথাটা উড়িয়ে দিল প্রথমে। ফোনে তার সাথে আরও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথা বলাল গুঞ্জা। “সত্যি হোক, মনের ভুল হো্ ভিশুয়াল প্যারাডক্স হোক, আপনি এখানে আসুন একবার।”
ডিভিসি–র কর্তৃপক্ষকে রাজি করানো যাচ্ছে না জলের তলায় ফের অনুসন্ধান চালাতে। ছেলের মতো মায়েরও হ্যালুসিনেশন হচ্ছে বলে বর্ষার ফুলে ফেঁপে ওঠা সমুদ্র প্রমাণ জলাধারে ডুবুরি নামানো যায় না। এই সময় বোটিংও বন্ধ। লকগেট এখনো খোলা রয়েছে। এই বিপজ্জনক স্রোতে মানুষ নামানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্ল্যান্টের এক নতুন ইঞ্জিনিয়ারও দৃশ্যটা দেখেছে। সে আদিত্যকে দেখেনি, কিন্তু তার বর্ণনাটা গুঞ্জা চৌধুরী বা অন্যান্য কারো কারো বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে। ডুবুরি ভূতের গল্পটা চারদিকে চাউর হয়ে স্থানীয় পর্যটকদের আগমণ বাড়িয়ে দিল। কর্তৃপক্ষ জল ছাড়া বন্ধ না হওয়া অব্দি ব্রীজে যাতায়াতে ভীষণ কড়াকড়ি লাগিয়ে রাখল।
ভগ্নীপতি রাকেশ রামধনু দেখলেও তাতে কোনও মানুষের ছায়াছবি দেখতে পায়নি। সে অন্যদিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু শ্যালিকা আর তার পুত্রের অবস্থা দেখে নিজের ছুটি বাড়িয়ে মাইথনে থেকে গেল। এই রহস্যের একটা হিল্লে করে যেতে হবে। অনেক বলে কয়ে আবেদন নিবেদনের পর জল ছাড়া বন্ধ হতে ডিভিসি জলাধারে রোবট ডুবুরি নামাতে রাজি হল। যন্ত্রমানবরা জলের তলায় এনতার ছবি তুলে পাঠাতে লাগল বেতার সংযোগ মারফৎ।
দ্বিতীয় দিন মনিটরে ভেসে উঠল এক ডুবুরি আবছা ছবি। লকগেটের কাছে ঠিক যেন ওপর দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চোখদুটো খোলা। যন্ত্রে একবার ধরা পড়ল অ্যালার্মের শব্দও। মানুষ ভূতের গল্প শোনা যায়, কিন্তু আষাঢ় মাসে যে মোবাইলের ভূতের আষাঢ়ে কাহিনী সত্যি হয়ে যাবে কে জানত? জলের তলায় কোনও মোবাইল ঠিক থাকতে পারে না। আর থাকলেও চার্জড থাকছে কী করে? কিন্তু মানুষের চোখের ভুল হতে পারে, রোবট, ক্যামেরা কম্পিউটার, সেন্সার–রেকর্ডার সবাই কি ভুল করছে? আর আদিত্যর দেহটা যে জলের তলাতেই রয়ে গেছে তা তো জানা কথা। কিন্তু এত দিনে তো পচে যাওয়ার কথা। ডুবুরির পোশাকখানাও নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা! তাহলে?
সেফটি বেল্ট ও বাড়তি সাবধানতা নিয়ে দু’জন মানুষ স্কুবাকেও নামানো হল। লকগেটের কাছে যে জায়গা থেকে ছবি আর আওয়াজ এসেছে সেখানটা কেবলই বালি, কিচ্ছু নেই, অথচ আবছা অবয়বটা এখানেই ধরা পড়েছে। ভালো করে তল্লাশী চালাতে একটা ফাঁপা গহ্বর পাওয়া গেল। বুদ্বুদের মত বাতাসে থলি। চাপে বালি ধসে যেতে পড়ল, তারা ভেতরে নামল প্রায় আরও ফুট ছয়েক নীচে। আবছা ছবিটা এবারে স্পষ্ট, একজন ডুবুরি ওপর দিকে স্থির তাকিয়ে হেলে রয়েছে। টর্চটায় আবার ক্ষীণ আলো জ্বলছে। সেই ক্ষণিক ভেসে ওঠা ছবির বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যায়। তুলে আনা হল যা পাওয়া গেল। দেহ না বলে কঙ্কাল বলাই সঙ্গত – অস্থির ওপর চর্ম। পোশাকখানা দেখতে গোটাই, কিন্তু তুলতে গিয়ে দেখা গেল থুসথুসে। তারই পকেট থেকে পাওয়া গেল একটা ঘুমন্ত মোবাইল। যদিও নষ্ট, কিন্তু দেখে মনে হল না অনেক দিন ধরে জলের তলায় ছিল, মনে হচ্ছে সদ্য তোলা হয়েছে।
এতদিনে দেহটার যা অবস্থা হওয়ার কথা ছিল তার তুলানায় যথেষ্ট ভালো আছে কী করে এটাই সবার বিস্ময়। চীফ ইঞ্জিনিয়ার মহাশয় গুজব ছড়ানোর ঘোর বিরোধী। জলের তলায় মাটির নীচে ঐ এয়ার পকেটই হয়ত দেহটাকে অবিকৃত রাখতে সাহায্য করেছিল। গহ্বরে পাওয়া গ্যাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হল। জলের নীচে মাটিরও তলায় অন্ধকারে থাকা দেহটার ছবি কী করে জলের ধারায় সৃষ্টি রামধনুতে পৌঁছল, চার্জ না দেওয়া সত্ত্বেও চলভাষ কী করে জীবন্ত ও জাগ্রত ছিল, নাকি ছিল না – তাই নিয়ে অলৌকিক কাহিনীর সাথে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কনফারেন্স বসে গেল। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাছাকাছি কি তাহলে এমন কোনও বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে যার ফলে টর্চের ব্যাটারির চার্জ ফুরোয়নি, মুঠোফোনখানা সচল ছিল? সেখান থেকে অ্যালার্ম বেজেছে আর সেই তরঙ্গ জল বা অন্য কোনও মাধ্যম বাহিত হয়ে বান্টির কানে পৌঁছেছে। হয়ত আরও অনেকের কানেই ঢুকেছে, কিন্তু তাদের কাছে তো সেই শব্দের কোনও তাৎপর্য নেই, তাই তারা খেয়াল করেনি। কিংবা বান্টির বাড়তি কোনও তরঙ্গবার্তা ধরার ক্ষমতা আছে, কিংবা সূক্ষ্ম ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা বাবার প্রতি তীব্র টানজাত টেলিপ্যাথি অথবা সেই জাতীয় কিছু যার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেলেনি। গহ্বরটার মধ্যে আঁশটে গন্ধের গ্যাসটা কি ওজোন গ্যাস? আর আলো ও জলের বিশেষ সমন্বয়েই হয়ত জলগর্ভের দৃশ্যটার এক অসদ্বিম্ব কোনও পথে মরিচীকার মতো মিনিট খানেকের জন্য ভেসে উঠেছে। কিন্তু মৃত বাবার কণ্ঠস্বর শোনার যে দাবি ছেলেটা করেছে তা তার কল্পনা। যেহেতু অ্যালার্মের সাথেই বাবার ডাকটা নিয়মিত ব্যাপার ছিল, সেটা বান্টির মনস্তত্ত্বে গভীর হয়ে বসেছিল।
বান্টির এতদিনের অপেক্ষা, এতদিনের রহস্যে কেমন যেন জল পড়ে গেল। এই কঙ্কালটাকে নিজের বাবা বলে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এই মানুষটা তো আজ সকালেও তাকে ডেকেছে, “বান্টি উঠে পড়ো বাবু”। গুঞ্জা কাঁদতে ভুলে গেছে। সে কিছুতেই দাহ করতে দেবে না। নিথর দেহটা জড়িয়ে একেবারে উন্মাদিনীর মতো বলে চলেছে, কথা বল, কথা বল। বান্টি না হয় ছোট, তার মাও যদি এমন পাগলামি করে? রঞ্জা আর রাকেশ হিসশিম খেয়ে যাচ্ছে। শেষমেষ সৎকারের আয়োজন হল। নিয়ম রক্ষার্থে একটা ডেথ সার্টিফিকেট দরকার। দেহটা স্থানীয় হাসপাতালে গেছে ময়না তদন্তের জন্য। বায়োলজি, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স থেকে মেটা ফিজিক্সের জোর আলোচনা।
ডাক্তার খসখস করে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে গিয়েও হঠাৎ চমকে উঠলেন। বাকিরা ঝুঁকে পড়ল দেহের ওপর। কঙ্কালের দেহ পরীক্ষা করে দেখা গেল সবে ঘণ্টা খানেক হল মারা গেছে।
Tags: ডুবুরি, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ধ্রুবজ্যোতি দাস, পূজাবার্ষিকী, শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
গল্পের মানবিক দিকটা ভালো লাগল।
গল্পের রহস্য আর ফ্যান্টাসি পেরিয়ে একটা মন খারাপের অনুভূতি ঘিরে রইল। কুর্নিশ আপনাকে লেখক।
ধন্যবাদ