দুখা
লেখক: সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
নিশীথবাবু বললেন, “আপনারা তো ওর বন্ধু। আপনারা একটু বুঝিয়ে বলুন না।”
পরেশদা ‘ফোঁস’ করে নিঃশ্বাস ফেললেন, “বলে লাভ কি? সুখেন আমাদের কথায় আর কবে কান দিয়েছে?”
নিশীথবাবু বললেন, “কিন্তু এ যে আগুন নিয়ে খেলা! এ জিনিস আগে কোনওদিন কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই। কি কুক্ষণেই যে মুখ ফসকে ওর কাছে সেদিন বলে ফেলেছি দুখার কথাটা!”
আমি বললাম, “ব্যাপারটা কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। সুখ-দুঃখ–এসব তো ফিলোজফিক্যাল কথাবার্তা। তার জন্য এত ক্রিয়াকাণ্ড কেন লাগবে? আর বিপদের ভয়টাই বা কীসের?”
নিশীথবাবু বললেন, “অর্থাৎ দুখার কথাটা আপনার ঠিক বিশ্বাস হয়নি। না হলেই ভালো। বিশ্বাসীর চেয়ে অবিশ্বাসীর নিরাপত্তাবোধ অনেক বেশি হয়। বিশ্বাস করলেই যত ঝামেলা।”
পরেশদা ফোড়ন দিলেন, “আমাদের সুখেনের মতো।”
আমি বললাম, “কুচনের সঙ্গে সুখেনের পরিচয়টা কি আপনিই করিয়ে দিয়েছেন?”
নিশীথবাবু বললেন, “তা একরকম বলতে পারেন। কুচনের সঙ্গে আমার আলাপ মুম্বাইয়ে। ওখানে একটা টেক্সটাইল মিলে ও কাজ করত। আমারও কার্যসূত্রে তখন মুম্বাইতে বাস। তখনই পরিচয়। এদিকে সুখেন-ও কুচনের গ্রামের সঙ্গে রিলেটেড, সেটা জানেন কি?”
কথা হচ্ছিল সুখেনের গ্রামের বাড়িতে বসে। আমি, সুখেন, পরেশদা – আমরা একই অফিসে সহকর্মী এবং একই কালচারাল ক্লাবের মেম্বার। নিশীথবাবু ওই ক্লাবের সেক্রেটারি। গত ক’দিন ধরেই নিশীথবাবুর সঙ্গে সুখেন গুজগুজ ফুসফুস করছিল। তার কারণটা আজ জানা গেল। সেই উপলক্ষ্যেই আমি আর পরেশদা আজ সুখেনের গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছি। এসব গাঁজাখুরিতে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, কিন্তু সুখেনের অনুরোধ ফেলতে পারিনি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হয়ে ওঠার দিনটা সে বন্ধুদের সঙ্গে সেলিব্রেট করতে চায়।
পরেশদা বললেন, “জানি না তো। আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ভেতরে কিছু কেস আছে। ব্যাপারটা কী বলুন তো?”
নিশীথবাবু নিচু গলায় বললেন, “কুচন বোধহয় জানে না। কিন্তু বহুকাল আগে ওর গ্রামের একটা মেয়ের সঙ্গে সুখেনের ইয়ে ছিল।… যাক গে, এসব কথা চেপে যান। আজকের দিনে কথাগুলো খুব একটা দরকারি-ও নয়। কুচনকেও কিছু বলবেন না। এসব ঘটনার সময় ও মুম্বাইতে ছিল।”
সুখেনের গ্রামের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা এই ঘরের চৌহদ্দির মধ্যেই। বাড়িটা গ্রামের শেষ প্রান্তে, এর পেছনেই শুরু হয়ে যাচ্ছে খাঁ-খাঁ মাঠ। এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। সুখেনের বৈঠকখানায় আমরা তিনজন বসে আছি। তিনটে খালি চায়ের কাপ হাঁ করে চেয়ে আছে ছাদের দিকে। পরেশদা পকেট থেকে লাইটার বার করে বিড়ি ধরালেন।
ঘরের মধ্যে ষাট পাওয়ারের হলদে বালব জ্বলছে। এই আলোয় খুব ঘন ছায়া পড়ে। ঘরের বাইরের জানালা দিয়ে অন্ধকার মাঠে জোনাকির ছুটে বেড়ানো দেখতে দেখতে মনটা যেন আজকের রাতটার অস্বাভাবিকত্ব ভুলে গেল।
পাশের ঘরে দরজা বন্ধ। ভেতরে কুচন আছে সুখেনের সঙ্গে। কুচন লোকটা ভারি অদ্ভুত। বুড়ো হয়েছে, কিন্তু সঠিক বয়স বোঝা যায় না। শুকনো, দড়িপাকানো চেহারা, গায়ের চামড়া খসখসে, আর মুখের সঙ্গে বেমানান ধোঁয়াটে ধূসর চোখ। কথা বলে ধীরে ধীরে, কিন্তু গলার স্বর তীক্ষ্ণ। সেইসঙ্গে আর একটা কথা না বললেই নয়, কুচনের মুখ দেখে মনে হয়, সে দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করে না। যারা অনেক দুনিয়াদারি দেখেছে, তাদের হয়তো এরকমই হয়।
সুখেনকেও আমি যে খুব পছন্দ করি, তা নয়। অফিসের কলিগ, এক কালচারাল ক্লাবের মেম্বার–ওই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে ওকে আমি এককথায় বলব স্বার্থপর। নিজের সুখ ছাড়া ও যেন আর কিছু বোঝে না। কিন্তু সে যাই হোক, আজকের ঘটনাটা যেন মাত্রাছাড়া পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছেছে।
পরেশদা একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন। আমি বললাম, “ব্যাপারটা কিন্তু এখনও আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার নয় নিশীথবাবু। দুখা-টা আসলে কে?”
“‘কে’ নয়, ‘কি’।” নিশীথবাবু সংশোধন করে দিলেন। “কুচন আপনাকে আমার চেয়েও ভালো করে বোঝাতে পারবে অবশ্য। আমি ওর কাছে শুনে যেটুকু বুঝেছি, তা হল দুখা হচ্ছে স্যাডনেস পার্সোনিফায়েড, মূর্তিমান দুঃখ।”
“আরেকটু খুলে বলুন।”
“জানলে তো বলব। বলছি না, এসব ব্যাপারে অথরিটি হচ্ছে কুচন। তা-ও মোটামুটি আমার ধারণাটা বলছি শুনুন। সব মানুষই সুখ-দুঃখ পায়। সুখটা মানুষ চায়, দুঃখটা চায় না। কুচনের দাদু ছিল ওদের পাশাপাশি বিশ-পঁচিশটা গাঁয়ের মস্ত ওঝা, বিরাট তান্ত্রিক সাধক। সে কোনও একটা গোপন পুঁথিতে দুখার কথা পড়েছিল। সব মানুষের ভেতর দুখা আছে। দুখা আছে বলেই মানুষ দুঃখ পায়। ওই পুঁথিটায় মানুষের শরীর থেকে দুখাকে বার করার প্রক্রিয়া লেখা ছিল।”
পরেশদার বিড়ি শেষ হয়ে এসেছিল। চায়ের কাপে সেটা ফেলে তিনি বললেন, “এই গপ্পো আপনি সুখেনকে শুনিয়েছেন?”
“হ্যাঁ। সুখেন তো প্রথমে বিশ্বাস করতেই চায়নি। একদিন জোর তর্ক হল। সুখেন আমাকে তর্কের ঝোঁকে বলে বসল ‘লায়ার’। আমিও ছাড়বার পাত্র নই। আমি বললাম, ‘যার কাছে এসব শুনেছি তার সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি; সত্যি-মিথ্যা তুমি বুঝে নাও’। ব্যাস, কুচনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। তবে তার জের যে এতদূর গড়াবে, ভাবিনি।”
আমি চুপ করে সুখেনের কথা ভাবছিলাম। সত্যিই কি এমন করা সম্ভব? এইভাবে কি দুঃখ দূর করা যায়? ‘দুখা’ বলে সত্যি যদি কিছু থাকে, তাকে শরীর থেকে বার করে আনলেই কি দুঃখ শেষ? দুঃখ কি শুধু শরীরে থাকে? মাথার যন্ত্রণা সারানোর উপায় কি কখনও মাথা কেটে ফেলা হতে পারে?
পাশের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল সুখেন আর কুচন। সুখেন একটা সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরেছে। কুচনের পরণে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, ঊর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত। আমাদের সবার মুখগুলো সে একবার দেখল। আমি লক্ষ করলাম, নিশীথবাবুর দিকে সে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল; কী যেন বলতে গিয়ে ঠোঁট ফাঁক করেও নিজেকে সামলে নিয়ে আবার পাশের ঘরে ঢুকে গেল।
সুখেন এসে আমার পাশের চেয়ারটায় বসল, বলল, “বুঝলেন পরেশদা, বেশ এক্সাইটেড লাগছে।”
পরেশদা ভ্রূ কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন। “যা করছ, ভেবেচিন্তে করছ তো? হয়তো পুরোটাই ফালতু ব্যাপার হতে যাচ্ছে, কিন্তু তাও… মন্ত্রতন্ত্র… বিশ্বাস না করলেও অবিশ্বাস করতেও পারি না পুরোপুরি। সব ঠিকঠাক তো?”
সুখেন বলল, “কুচন তো তাই বলছে।”
পরেশদা বললেন, “কিন্তু এরকম বেয়াড়া খেয়াল তোমার মাথায় চাপল কেন?”
সুখেন হাসল। “বেয়াড়া মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু আমি ভেবে দেখলাম, এটাই বুদ্ধিমানের কাজ। যত দুঃখ আমি পাচ্ছি, দুঃখ অনুভব করছি, সব কিছুর কারণ আমার দুখা। এই দুঃখ বোধের কারণটাকে যদি শরীর থেকে উপড়ে ফেলতে পারি, তাহলে আর কি বাকি রইল? শুধু সুখ, সুখ!”
নিশীথবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “আজ পর্যন্ত সুখের কোনও কমতি হচ্ছিল কি তোমার?”
সুখেন বলল, “না, কমতি হয়নি। টাকাপয়সা বলুন আর মেয়েছেলে বলুন – কোনওটারই অভাব আমার হয়নি। কিন্তু দুখার কথাটা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে, পরিপূর্ণ নির্ভেজাল সুখ আমার পাওয়া হয়নি কখনও। দুখাটাকে বিদায় করতে পারলে শুধুই সুখ, ব্যাস।”
ঘরের হলদে রঙের আলোটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। একটা মাঝারি আকারের মথ ফড়ফড় করে উড়ছিল আলোটার কাছে। একটা টিকটিকি কোথা থেকে এসে খপ করে ধরে ফেলল তাকে।
সুখেন বলল, “ওই টিকটিকিটাকে দেখো। লাইফে ওর শুধু সুখ। কুচন বলছিল, ইতর প্রাণীদের দেহে নাকি দুখা থাকে না।”
ঈষৎ ব্যঙ্গমিশ্রিত সুরে আমি বললাম, “তুমি কি টিকটিকির জীবন চাইছ, সুখেন?”
ব্যঙ্গটা ওর কানে লাগল, মুখটা একটু লাল হয়ে উঠল। দাঁতে ঠোঁটটা একবার কামড়ে ও বলল, “যদি দুঃখবিহীন সুখের জীবন মানে পিঁপড়ের জীবনও হয়, তাতেও আমার আপত্তি নেই। দুখাটাকে দূর করতে পারলে আমার জীবনটা এত সুখের হবে যে তোমাদের ওসব ফিলোজফিক্যাল সমস্যা আমাকে জ্বালাতে পারবে না।”
টিকটিকির চোয়ালে ছটফট করতে থাকা মথটা নিষ্পন্দ হয়ে গেল। এবার ওটাকে ধীরে ধীরে গলাধঃকরণ করছে টিকটিকিটা। -সুখ! নিরেট, জান্তব সুখ!
পরেশদা বলেলেন, “এই দুখা বার করা–এ কাজ আগে কখনও কেউ করেছে?”
নিশীথবাবু বললেন, “না, এই প্রথম।”
সুখেন বলল, “উঁহুঁঃ, আগেও হয়েছে। এই কুচনেরই দাদু করেছিল ওর দিদিমাকে তার মৃত্যুশয্যায়। সেটা সাক্সেসফুলও হয়েছিল। কুচন বলছিল, ওর দিদিমা সুখেই মরেছিল।”
নিশীথবাবু বললেন, “ও, তাই। এটা অবশ্য জানতাম না। যাক, কুচনের তাহলে বংশগত অভিজ্ঞতা আছে এসব ব্যাপারে।”
“তা আছে।” কুচনের তীক্ষ্ণ গলার স্বর শুনে আমি একটু চমকে উঠে ওর দিকে তাকালাম। কুচন তাকিয়ে আছে নিশীথবাবুর দিকে। লোকটা যে কখন এসেছে, বুঝতে পারিনি একদম।
সুখেন বলল, “কি কুচন, সব রেডি?”
কুচন বলল, “হ্যাঁ, আপনি শুয়ে পড়ুন সোজা হয়ে খাটের উপর। চোখ বন্ধ রাখবেন, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক। দশ মিনিট শুয়ে থাকুন, তারপর আমি যাচ্ছি ওঘরে।”
পরেশদা বললেন, “বেস্ট অব লাক।”
আমিও শুভেচ্ছা জানালাম বটে, কিন্তু মনটা যেন খালি কুডাক ডাকছিল। এ যা হতে যাচ্ছে, এসব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কোথায় যেন একটা গভীর অমঙ্গলের আভাস পাচ্ছি আমি। মন বলছে, যাই ঘটুক, তার পরিণাম ভালো হবে না। দুখা কেমন জিনিস আমি জানি না, কিন্তু তাকে জোর করে শরীর থেকে টেনে বার করে আনার ফল, সুখেন যাই বলুক, কখনও ভালো হতে পারে না।
সুখেন পাশের ঘরে চলে গেল। তার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল কুচন।
আমি বললাম, “কুচনবাবু, দুখা দেখতে কেমন?”
কুচন বলল, “দাদুর কাছে শুনেছি, দুখা মিশমিশে কালো। শরীর থেকে বেরিয়ে দিদিমার দুখাটা নাকি হুশ করে রাতের অন্ধকারে মিশে গেছিল। একটা চকচকে কালো মানুষ – সে যখন পাশ দিয়ে যায়, তখন সারা গা ঠান্ডা হয়ে যায়, সেঁতিয়ে যায়।”
পরেশদা বললেন, “আপনি দাদুর কাছেই এই বিদ্যা শিখেছেন?”
কুচন একটু হাসল। “দাদু এ বিদ্যা কাউকে শিখিয়ে যায়নি। সে মরার পর তার একটা বাক্সের মধ্যে আমি বইটা খুঁজে পেয়েছিলাম। পদ্ধতিটা কঠিন কিছু নয়। কৃষ্ণপক্ষের রাত, কয়েকটা চেনা শিকড়বাকড় আর দুখা-আকর্ষণের মন্ত্র জানা থাকলেই কাজটা করা যায়।”
আমি বললাম, “মন্ত্রটা কী?”
কুচন আবার হাসল। “মাফ করবেন, ওটি বলতে পারব না।… নিশীথবাবু, সুখেনবাবুকে কতদিন চেনেন আপনি?”
নিশীথবাবু বললেন, “অনেকদিন। কেন?”
“না, এমনি।… আপনি যেদিন ওঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, সেদিন যেন চেনাচেনা লাগছিল।”
“চেনাচেনা লাগছিল? এখন চিনতে পেরেছ? আগে ওর সঙ্গে কোথাও চেনা-পরিচয় হয়েছিল?”
কুচন জানালার বাইরের অন্ধকার মাঠে জোনাকির উড়ন্ত আলোক বিন্দুগুলো দেখতে দেখতে অদ্ভুতভাবে হাসল। “পরিচয় হলেই কি চেনা হয়? দুনিয়ায় কে কাকে চিনতে পারে বলুন?”
মনে হল, কুচন কি একটা কথা যেন ‘বলি, বলি’ করেও বলল না। তাকিয়ে দেখি, তার ভ্রূ দুটো কুঁচকে গেছে, তার বলিরেখাকীর্ণ মুখে অদ্ভুত একটা ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি।
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই পলকের মধ্যে তার মুখের ভাব স্বাভাবিক হয়ে গেল। একটু হেসে সে বলল, “যাই, কাজটা সেরে আসি। সুখেনবাবুকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ করে দিয়ে আসি। তারপর হাতে মিনিট দশেক সময় থাকবে দুখা বার হওয়া পর্যন্ত। তখন আর একটু গল্প করব আপনাদের সঙ্গে।”
উঠে গিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল সে।
পরেশদা বললেন, “নিশীথবাবু, কেন জানি না, আমার কিন্তু লোকটাকে সুবিধার লাগছে না।”
নিশীথবাবু কিছু বললেন না, গুম হয়ে বসে রইলেন। কুচনের ব্যবহারের অস্বাভাবিকত্বটা তাঁর নজরেও পড়েছে, বুঝতে পারলাম।
পাশের ঘরে দরজা বন্ধ। ভেতরে কী হচ্ছে, কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। দরজা খুলে উঁকি মারার প্রবল কৌতূহল হতে লাগল, কিন্তু নিজেকে সংযত করলাম। একটা চাপা উত্তেজনা, একটা ‘কী হয়, কী হয়’ ভাব রক্তচাপ বাড়িয়ে দিল। আমার সঙ্গী দুজনের অবস্থাও আমার মতো। পরেশদা রুমাল দিয়ে মুখ মুছে চাপা গলায় আমাদের মনের আশংকাটারই প্রতিধ্বনি করলেন, “কোনও বিপদ-আপদ হবে না তো?”
খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে, তাও বুঝতে পারলাম, আমার কপাল ঘেমে গেছে। পরেশদার কথার উত্তর কেউ দিল না।
একটা জোনাকি এসে উড়তে উড়তে ঘরের দেওয়ালে বসল। হালকা সবুজ আলোর আভা দপদপ করতে লাগল। পরমুহূর্তেই টিকটিকিটা এসে ‘খপাৎ’ করে পোকাটাকে মুখে পুরল। বন্ধ দরজার ওপার থেকে শুনতে পেলাম অস্পষ্ট স্বরে মন্ত্রপাঠ শুরু হল।
এমন অদ্ভুত সুরের মন্ত্র আমরা জীবনে শুনিনি। ভেতরটা যেন একটা অদ্ভুত কান্নায় মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হল, সারা জীবনে যত ছোট-বড় দুঃখকষ্ট পেয়েছি এবং পাওয়ার কথা কল্পনা করেছি, সব যেন ঢেউয়ের মতো এসে ডুবিয়ে দিতে চাইছে আমার ‘আমি’টাকে। কী অদ্ভুত করুণ কান্নার মতো সেই সুর! মনে হল, ঘরের আলোটাও যেন মরে যেতে শুরু করেছে, নিবে যাচ্ছে মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে। দুখাকে ডাকছে কেউ। সে আসছে। যত কান্না, যত দুঃখ, যত যন্ত্রণা পৃথিবীতে আছে, সব নিয়ে সে বেরিয়ে আসছে একটা মানুষের শরীর ছেড়ে। তাকিয়ে দেখি, আমার দুই সঙ্গীই দু-হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
তারপর হঠাৎ করেই মন্ত্রপড়া থেমে গেল। আমরা স্থির হয়ে বসলাম। পরেশদা আবার রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন, সেইসঙ্গে চোখ-ও। নিশীথবাবুও রুমাল বার করলেন। পরিবেশটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল। এতক্ষণ যে ভয়ংকর ভারি বোঝাটা বুকের উপর চাপানো ছিল, সেটা ক্রমশ হালকা হয়ে এল।
দরজা খুলে বেরিয়ে এল কুচন, চেয়ারে বসে আমাদের দিকে তাকাল। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে সফল।
নিশীথবাবু বললেন, “সব ঠিকঠাক?”
কুচন বলল, “একদম ঠিকঠাক।”
“দুখা?”
“মিনিট দশেক লাগবে তার শরীরটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। আমার আর কিছু করণীয় নেই। দুখা বেরিয়ে এসে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরুন, স্বচক্ষেই দেখতে পাবেন।”
পরেশদা বললেন, “আর সুখেন?”
“সে এখন সবচেয়ে সুখী মানুষ। তার আর কোনও দুঃখ নেই, শুধুই সুখ আর সুখ।”
নিশীথবাবু বললেন, “তোমার দিদিমার মৃত্যুশয্যায় তোমার দাদু তার দুখা বার করেছিলেন, এটা আমাকে আগে বলোনি তো?”
কুচনের মুখ শক্ত হয়ে উঠল। “আপনি সুখেনবাবুকে অনেকদিন চিনতেন, এটাও তো আমাকে বলেননি আপনি। আমার কথা ওকে বলেছেন, কিন্তু ওর কথা আমাকে বলেছেন অনেক পরে, যখন ও আপনাকে ‘লায়ার’ বলল আর আপনি নিজেকে সাপোর্ট করার জন্য আমার সাহায্য চাইলেন।”
পরেশদা বললেন, “আরে আরে, ব্যাপার কী কুচনবাবু? এত রেগে যাচ্ছেন কেন?”
কুচন নিজেকে সামলে নিল। “না, রেগে যাওয়া আমার উচিত নয়। আজ আমার সুখের দিন। আজ আমি রাগ করব না।… আমার দিদিমার কথা বলছিলেন? জানেন আমার দাদু কেন দিদিমার দুখা বার করেছিল? আমার দিদিমার বয়স তখন পঁয়ত্রিশ, দাদুর চুয়াল্লিশ। দিদিমার মৃত্যুশয্যায় ও কাজ হয়নি; ওই শয্যায় দিদিমার মৃত্যু হয়েছিল। সে কিসে মরেছিল জানেন? সুখে! কেন দাদু তাকে মেরেছিল জানেন? দাদু তাকে অন্য একটা ছেলের সঙ্গে এক বিছানায় দেখে ফেলেছিল।”
আমরা তিনটে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম। কুচনের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠল। “নিশীথবাবু, আরতি আমার মেয়ে ছিল।”
নিশীথবাবু স্পষ্টতই ঢোঁক গিললেন।
কুচন বলল, “আরতির ঘরে তার প্রেমিকের ফোটো পেয়েছিলাম আমি। বলুন তো কে?”
আমার কাছে ব্যাপারটা হঠাৎ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল। অস্ফূটে বললাম, “সুখেন!”
কুচন বলল, “ঠিক বলেছেন। আমার আইবুড়ি মেয়ে দু’মাসের পোয়াতী হওয়ার পর সুখেন কেটে পড়ল। আরতি গলায় দড়ি দিয়েছিল। আমি তখন মুম্বাইতে।”
পরেশদা আবার মুখ মুছলেন।
কুচন বলে চলল, “পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আমি পাকাপাকি জানতে পারলাম ঘটনার সত্যতা। তার সঙ্গে পড়শীদের ফিসফাস তো ছিলই।… নিশীথবাবু, আপনি সব জানতেন। কিন্তু আপনি আমাকে কখনও বলেননি।”
নিশীথবাবু বললেন, “দাঁড়াও, তুমি কিন্তু আমাকে এভাবে ইনক্রিমিনেট করতে পারো না। এসব ঘটনা ঘটার অনেক পরে সুখেনের সঙ্গে আমার পরিচয়। সুখেনের কাছে আমি আরতির কথা শুনেছিলাম, ঠিক। কিন্তু তোমাকে বললে তুমি কি করতে? ওর বিরুদ্ধে কেস করতে? ওকে মারতে? আমি তোমাকে অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছি কুচন, আমার প্রতি তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।”
পরেশদা হঠাৎ বললেন, “তুমি সুখেনকে কি করেছ, কুচন?” সম্বোধনটা তাঁর ‘তুমি’তে নেমে গেল।
কুচন তাঁর দিকে তাকাল, তার চোখে প্রতিহিংসার আনন্দ আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সে বলল, “ওর দুখা বার করেছি। অনেকদিন খুঁজেছি ওকে। শেষে ভাগ্য আমাকে এনে দিয়েছে ওর কাছে। আমি সত্যিই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ নিশীথবাবু। আপনিই আমাকে শেষপর্যন্ত ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।”
“দুখা বেরোলে কি হয় কুচন?”
“কি হয়? কি হয়?” কুচন হা হা করে হেসে উঠল। “কি আবার হয়? মানুষ মরে। কিন্তু এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু পৃথিবীতে আর নেই। মানুষটা মরে কীসে, জানেন? সুখে। দুখা যেই বেরিয়ে আসে, অমনি যত সুখ সব লোকটাকে চেপে ধরে। সেই সুখের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কোনও মানুষের নেই। যন্ত্রণা পায়, তাতেও সুখ হয়, আরও যন্ত্রণা পায়, আরও সুখ হয়–দুখা তো আর নেই যে দুঃখ পাবে! এইভাবে সুখের যন্ত্রণায় লোকটা মরে।”
হঠাৎ ঘরের আলোটার তেজ কমে গেল। মাঠের ওপারে ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে গেল। আমার শীত করতে লাগল। কুচন বলল, “দুখা বেরোচ্ছে।”
আমাদের চোখগুলো বন্ধ দরজার গায়ে আটকে রইল।
কুচন বলল, “সুখ একটা দানব। দুঃখ খারাপ নয়, সে সুখ-দানবকে সামলে রাখে, আটকে রাখে। দুখা না থাকলে সুখের দানব একটা মানুষকে পিষে মেরে ফেলে।”
প্রচন্ড শীতে মনে হল আমি জমে যাচ্ছি। বন্ধ দরজা ভেদ করে বেরিয়ে এল দুখা–নিরেট অন্ধকার দিয়ে তৈরি একটা ছায়ামূর্তি। তার উপস্থিতিতেই মনে হল আমার সারা শরীরটাকে কে যেন কালো দীঘির জলে ডুবিয়ে দিল। সাপের মতো চকচকে গায়ের দীপ্তি তার, সাপের মতোই দ্রুত তার গতি। বিস্ফারিত চোখে আমরা চেয়ে রইলাম। আমাদের সামনে দিয়ে দুখা জানালা গলে অন্ধকার মাঠের কালো গায়ে মিশে গেল।
আলোটা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, শীত শীত ভাবটা কেটে গেল।
কুচন উঠে দাঁড়াল। “আমার কাজ শেষ। আমি চললাম।”
নিশীথবাবু লাফ দিয়ে তার জামার হাতা খামচে ধরলেন। “খুনীটাকে ধরুন, পালাতে দেবেন না।”
ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল কুচন। “খুনী? আমি? কোর্টে প্রমাণ করতে পারবেন তো? দুখাকে সাক্ষী ডাকতে পারবেন তো? অ্যাঁ?”
পাশের ঘর থেকে হঠাৎ একটা বিকট হাসির শব্দে আমরা চমকে উঠলাম। বীভৎসভাবে কে যেন হাসছে–সে হাসিতে মজা নেই, আনন্দ নেই, কেবল একটা দানবীয় হিংস্রতা।
“ওই যে, শুনুন, শুনে নিন তার গলা,” কুচন ব্যঙ্গের হাসি হাসল।
তবে তো সুখেন বেঁচে আছে! কিন্তু এ কি ওর-ই কণ্ঠস্বর? এ কী বীভৎস, ভয়াবহ শব্দ?
কুচন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলে গেল, “চললাম। তবে এরপর ওর মুখের দিকে না তাকালেই ভালো করবেন।”
তার কয়েক মুহূর্ত পরেই পাশের ঘরে একটা প্রচন্ড শব্দ পেলাম। জড়তা কাটিয়ে তিনজনেই ছুটলাম সেদিকে।
ঘর খালি। খাটের উপর বিছানার চাদর ভীষণ রকমের মোড়া-মোচড়ানো হয়ে পড়ে আছে, যেন কেউ প্রচন্ডভাবে ছটফট করেছে তার উপর। কিন্তু সুখেন কই?
পরেশদা আঙুল দেখালেন। “ওই যে।”
এ ঘরের একটা দরজা দিয়ে মাঠের দিকে যাওয়া যায়। দরজাটা হাট করে খোলা।
সুখেন মাঠে গেছে! শব্দটা ছিল জোরে দরজা খোলার।
আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। বিশাল মাঠ, সম্পূর্ণ অন্ধকার। কোথায় খুঁজব ওকে এর মধ্যে?
শেষে পরেশদাই বললেন, “মোবাইলে টর্চ জ্বালো। ওকে তো আর মাঠে ফেলে যাওয়া যায় না।”
তাই হল। আমরা নামলাম মাঠে। অন্ধকারে জোনাকিরা ছোটাছুটি করছে। মৃদু মৃদু হাওয়া বইছে। আমরা ডাকতে লাগলাম, “সুখেন! সুখেন!”
খুঁজতে খুঁজতে ওঁদের থেকে একটু আলাদা হয়ে পড়েছিলাম। মোবাইল টর্চের আলোয় ঘাস-ওঠা কাঁকুরে মাঠের উপর দিয়ে হাঁটছিলাম আমি। হঠাৎ শুনলাম, পরেশদা ডাকছেন আমার নাম ধরে।
“এদিকে এসো! এদিকে!”
তাঁর টর্চের আলো লক্ষ করে ছুটলাম। দেখি, নিশীথবাবু বমি করছেন মাঠের একপাশে।
পরেশদা বললেন, “উনিই প্রথম আবিষ্কার করেছেন। শকটা সামলাতে পারেননি।… ওই যে, ওইখানে পড়ে আছে।”
দুরুদুরু বুকে টর্চ ফেললাম কাছেই পড়ে থাকা দেহটার উপর।
মন শক্ত করে রেখেছিলাম, কিন্তু তাও বলব, এ দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। নিশীথবাবুর বমি হওয়া স্বাভাবিক। বুঝতে পারলাম, কুচন কেন ওর মুখের দিকে তাকাতে ‘না’ বলে গিয়েছিল।
সুখেন পড়ে আছে মাটির উপর, তার চোখের মণি সাদা, তাকিয়ে আছে তারাভরা রাতের আকাশের দিকে। তার মুখজুড়ে একটা ভয়াবহ হাসি। দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে, জিব ঝুলে পড়েছে মুখের একপাশে, চোখ বিস্ফারিত, একটা দানবীয় উল্লাস যেন ফেটে পড়ছে তার সারা মুখে। সে মুখে কোনও দুঃখ নেই, ব্যথা নেই, শুধু সুখ–একটা বিকট, বীভৎস পৈশাচিক সুখের বহিঃপ্রকাশ।
সুখেন মারা গেছে।
সুখে!
Tags: গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস, সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
বেশ প্রগাঢ় দর্শন । হ্যাঁ দর্শনই বলব । দুখা ঘর থেকে বেরোবার পর অবশ্য একবার মনে হয়েছিল গল্পটি আপনি হয়ত অন্য ভাবে শেষ করতে চলেছেন।
ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ।
দারুণ গল্প! টানটান, শ্বাসরোধী, আবার দার্শনিকও। আরও আসুক এমন আখ্যান।
আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ, ঋজুবাবু।
ভিন্নধর্মী প্লটের গল্প। সাধারণত তন্ত্রমন্ত্র ভূতপ্রেতের গল্প এড়িয়ে চলি, ভালো লাগে না তাই। কিন্তু এই গল্পটা বেশ উপভোগ করেছি। গল্পের দর্শনটাই গল্পটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। সেইসাথে সাবলীল লেখা! সবমিলিয়ে স্বার্থক গল্প। শুভকামনা রইল।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। ভাল থাকবেন।