দ্রোণাচার্য্য
লেখক: অনিন্দ্য বসু
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
টুটুলদের ছাতের পাঁচিলে একটা ছোট্ট নীল রঙের পাখী এসে বসল। গরমকালের বিকেল। টুটুলের এবার ক্লাস নাইন হবে। এখন টুটুলের গরমের ছুটি চলছে। টুটুল একমনে একটা রবারের ফুটবলে ড্রিবল প্র্যাকটিস করছিল ছাতের একটা কোনায়। তবে তার একটা কান খাড়া ছিল চিলেকোঠার ঘরের দিকে। ওখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল টুটুলের ছোড়দা রন্টু আর তার আমেরিকাবাসী বন্ধু সপ্তক। এখন ছুটিতে এসেছে কয়েকদিনের জন্য। সপ্তক আমেরিকার একটি নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক নিয়ে ডক্টরেট করছে। তবে ওর ভীষণ ঘুরে বেড়ানোর নেশা। আমেরিকার সবকটি ন্যাশানাল-পার্কেই ও বেড়িয়েছে অনেকবার। ওয়াইল্ড লাইফ দেখার খুব নেশা! সপ্তক হঠাৎ একটা চাপা বিস্ময়ের চিৎকার করে উঠল! ‘আরে এখানে ফ্লোরিডা স্ক্রাব-জেয় কি করে এলো?’ চিৎকারটা শুনে টুটুল চমকে ছাতের পাঁচিলের দিকে তাকাল। আর ঠিক তখনই দেখতে পেল ঐ নীল রঙের পাখীটাকে। ইতিমধ্যে সপ্তক বেরিয়ে এসেছে চিলেকোঠার ঘর থেকে। পেছন পেছন ছোড়দাও! সপ্তকের চোখে অবাক বিস্ময়!
টুটুলের ছোড়দা রন্টু বলল, ‘এটা কী কোনও রেয়ার স্পিশিসের বার্ড?’
সপ্তক বলে উঠল, ‘এন্ডেন্জার্ড স্পিসিস। কিন্তু এই পাখী তো নর্থ আমেরিকার সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ছাড়া কোথাও থাকে না! এখানে এল কী করে?’
পাখীটা ইতিমধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের একবার দেখে নিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে প্রথমে সামনের গাছটার একটা ডালে একবার বসে পরক্ষণেই আবার উড়তে উড়তে গাছের ওপারে চলে গেল। আর দেখা গেল না! সপ্তকও খানিকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে তারপর হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল, ‘এই রে! আজ সেজমাসির বাড়ি নেমন্তন্ন! এক্ষুণি বাড়ি ফিরে মা-দের নিয়ে বেরুতে হবে। আমি চলি রে রন্টু! কাল তাহলে সকালবেলা তোকে তুলে নিচ্ছি আমি।’ এই বলতে বলতে সপ্তক ছাতের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। টুটুলের ছোড়দা রন্টু, তার অন্যান্য কলেজের বন্ধুরা আর সপ্তক মিলে কাল যাচ্ছে কোলাঘাটের একটি বাগানবাড়িতে পিকনিক করতে। কাল রবিবার। তাই টুটুলের ও খুব যাওয়ার ইচ্ছে ছিল! কিন্তু কথাটা ছোড়দাকে বলতেই সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, ‘য্যা য্যাঃ! এসব বড়দের আড্ডায় তোর মত লিলিপুটদের প্রবেশ একেবারে নিষেধ!’ শুনে টুটুলের এইসান রাগ হল! ছোড়দাকে বিশ্রী মুখ ভেঙিয়ে সে এক ছুটে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। সামনে মা-কে দেখতে পেয়ে টুটুল বলল, ‘মা আমি একবার শঙ্করদের বাড়ি যাচ্ছি।’ টুটুলের মা বললেন, ‘সাতটার মধ্যে ফিরে আসবে। গরমের ছুটি বলে পড়াশুনো একবারে তাকে তুলে দিও না!’
‘ঠিক আছে!’ -কথা না বাড়িয়ে টুটুল একতলায় নেমে দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল শঙ্করদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। টুটুলদের গলি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে গেলে বড় রাস্তার ওপর দশ-বারোটা বাড়ী পরেই শঙ্করদের গোলাপি রঙের দোতলা, গ্রীল দেওয়া বাড়ি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, ‘শঙ্কর, এই শঙ্কর!’ বলে দুবার ডাকল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করদের বাড়ির ছাতের পাঁচিলে একটা মুখ দেখা গেল!, ‘দরজা খোলা আছে। ওপরে উঠে আয়!’ ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে টুটুল লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাতে চলে এল। শঙ্কর ও’র প্রাণের বন্ধু। ছাতে উঠেই খবরটা বন্ধুকে জানিয়ে দিল, ‘জানিস্ আমাদের বাড়ির ছাতে আজকে একটা ফ্লোরিডা স্ক্রাব-জেয় উড়ে এসে বসেছিল!’
– ‘কী-জে?’ ‘কী উড়ে এসেছিল?’
-‘ফ্লো-রি-ডা-স্ক্রা-ব-জে-য়!’ ‘বোঝা গেল?’
-‘সেটা কী? এক রকমের পাখী?’
-‘হ্যাঁ। আর সে পাখী শুধু নর্থ আমেরিকাতেই পাওয়া যায়।’
-‘তাহলে বোধ হয় কারুর পোষাপাখী। খাঁচা থেকে পালিয়েছে।’
টুটুল ভীষণ গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার তা মনে হয় না! পাখীটা যে রকম কনফিডেন্টলি ঘুরে তাকাল আমার দিকে তারপর ধীরে সুস্থে উড়ে গেল, তাতে খাঁচা খুলে উড়ে আসা পাখী বলে মনে হল না।’
-‘তা তুই কী বলতে চাস পাখীটা সেই স্টেট্স্ থেকে উড়তে উড়তে তোদের বাড়ীর ছাতে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল!’
-‘আরে না না। তা বলিনি। তবে, কীরকম রহস্যজনক না?’
-‘দ্যাখ্ টুটুল। সবেতে তুই রহস্য খুঁজিস না প্লীজ!’
-‘আরে! এটা তোর রহস্য মনে হচ্ছে না?’
শঙ্কর হাল ছেড়ে দিয়ে হাতের ইয়ো-ইয়ো-টার সুতো গুটোতে লাগল।
শঙ্কর বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না দেখে টুটুল কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল, ‘তোদের সামনের ঐ হলুদ বাড়িটাতে নতুন লোক এসেছে, না রে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কে রে?’
-‘ঐ তো। যারা আগে ঐ বাড়ীটা তে থাকত, তাদের বাড়ীর ছেলে। অনেকদিন বাদে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছে।’
-‘আর ও’র বাবা-মা?’
-‘ওনারা অনেকদিন আগে মারা গেছেন।‘
ইতিমধ্যে টুটুলদের অন্যান্য পাড়ার বন্ধুরা এসে ডাকাডাকি করতে লাগল খেলা শুরু করার জন্য। ওরাও রোজকার মত শঙ্করদের বাড়ীর পাশের মাঠে বিকেলের ফুটবল খেলা শুরু করে দিল। খেলার শেষে এটা সেটা নিয়ে কথা হল কিছুক্ষণ। তারপর যে যার বাড়ির দিকে। টুটুল, ওদের বাড়ির গলির উল্টোদিকে যে চায়ের দোকানটা আছে সেটা অবধি এসে সেখানে একটা হইচই হচ্ছে দেখে সেদিকে এগিয়ে দেখতে গেল যে ব্যাপারটা কী। চায়ের দোকানের সামনে বড় জটলা করে মনে হচ্ছে সবাই যেন একটা মজা দেখছে! টুটুল ভিড়ের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে দেখল পাগলা নাড়ুকে চুলের মুঠি ধরে পাড়ার কুখ্যাত গুন্ডা লকেট নির্দয়ভাবে মারছে! টুটুলের বুকটা মুচড়ে উঠল। নাড়ু একেবারে নির্বিরোধী একটু পাগলাটে একটা ছেলে। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে। কতদিন টুটুলের সঙ্গে রাস্তায় ছুটে ঘুড়ি ধরে দিয়েছে! রোজ সকালে আর বিকেলে চাওলা বিশুদা ও’কে এক ভাঁড় চা আর একটা নোন্তা বিস্কুট ফ্রিতে দেয়। বিশুদার বউ ওকে খুব ভালবাসে। সেই নাড়ুকে কেন কে জানে, লকেট নির্দয়ভাবে মারছে, আর নাড়ু চিৎকার করে কাঁদছে। বিশুদা হাতজোড় করে কাঁদ-কাঁদ হয়ে বলছে, ‘লকেট ভাই! ও পাগল ছাগল, ওকে মেরো না!’
লকেট কিছুদিন আগে জেল থেকে বেরিয়েছে। একটা খুনের মামলায় জেলে গিয়েছিল, কিন্তু কিছু প্রভাবশালী লোকের কৃপায় কি করে যেন আবার ছাড়া পেয়ে গেছে। আশপাশের লোকেদের কথায় টুটুল বুঝল যে নাড়ু কাপে চা নিয়ে একটা বিস্কুট বাক্স থেকে বার করতে গিয়ে লকেটের গায়ে গরম চা ফেলে দিয়েছে! তাই লকেট তাকে মেরে ধরে মাস্তানকে সমীহ করা শেখাচ্ছে! লকেট একটা ঘুঁশি মরবে বলে হাতটা তুলেছে, হঠাৎ লকেটের মুখটা বেঁকে গেল আর দু-একবার টাল খেয়ে অতবড় লাশটা সোজা মাটিতে দড়াম করে পড়ে গেল! লকেটের কিছু চ্যালারা অম্নি হাঁ হাঁ করে ছুটে গিয়ে লকেট কে তুলতে গেল। আর কী আশ্চর্য! ঠিক তখুনি টুটুলের চোখে পড়ল, বিশুদার চায়ের দোকানের পাশের ল্যাম্প পোস্টের মাথায় বসে আছে সেই নীল রঙের ছোট্ট পাখীটা! এই সব গোলমাল ভুলে গিয়ে টুটুল ঐ পাখীটাকে দেখবার জন্য ল্যাম্পপোস্টটার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু পাখীটা হঠাৎ নীচের দিকে ডাইভ দিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে বিশুদার চায়ের দোকান পেরিয়ে খেলার মাঠটার দিকে উড়ে গেল। টুটুল আবার চায়ের দোকানের কাছে ফিরে এসে দেখল, লকেট চোখ উলটে পড়ে আছে। ও’র চ্যালারা একটা ট্যাক্সি ধরে, তাতে লকেটকে ধরাধরি করে শুইয়ে নিয়ে চলে গেল। নাড়ু আস্তে আস্তে গালে হাত বুলতে বুলতে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়ল। টুটুল বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
।।২।।
পরের দিনটা রবিবার। সকালের জলখাবার খাওয়ার সময় টেবিলে বসে টুটুলের বাবা বললেন, ‘বাজারে গিয়ে শুনলাম, কাল নাকি লকেট গুণ্ডা হঠাৎ মারা গেছে! নাড়ুকে মারতে গিয়ে নিজে হঠাৎ মরে পড়ে যায়! পুলিস নাকি বলেছে লকেট খুন হয়েছে! ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক!’ মা বলে উঠলেন, ‘এই তো, তুমি আবার এতেও রহস্য খুঁজতে শুরু করলে? ঐ করে করে তোমার ছেলেটাও সবেতে মিস্ট্রি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে!’ ঐ লকেট টকেটরা ঐ রকম লাইফ-স্টাইল চালায়, নেশা-ভাং করে, যে কোন সময় একটা স্ট্রোক হয়ে মরতেই পারে! এতে আবার রহস্যের কী আছে! গেছে গেছে, আপদ গেছে! ঐ রকম শয়তানের মৃত্যু এই রকম করেই হয়!’ টুটুলের বাবা বললেন, ‘আরে না না! এটা সেরকম ব্যাপার নয়! বাজারে একজনকে বলতে শুনলুম, লকেটকে নাকি এক অদ্ভুত উপায়ে খুন করা হয়েছে!’ টুটুল চুপ করে রইল। কারণ কাল যখন এইসব কান্ড ঘটছিল, সে যে সেখানে উপস্থিত ছিল সেটা বললে নির্ঘাত মা’র কাছে প্রচন্ড বকুনি খাবে! তবে সে খানিকটা অবাক হয়ে গেল, যে লকেট খুন হয়েছে বলে রটে গিয়েছে শুনে। এ নিয়ে আর কথা অবশ্য এগুলো না। টুটুলের বাবা’র বন্ধু অবিনাশকাকু প্রতি রবিবারের মত এদিন ও এসে পড়লেন এবং টুটুলের বাবা আর অবিনাশ কাকু দুজনে বাইরের ঘরে বসে দাবা খেলায় জমে গেলেন। টুটুলও প্রতি রবিবার সকালের মত শঙ্করদের বাড়ীর দিকে বেরিয়ে পড়ল। শঙ্করদের বাড়ীর কাছাকাছি এসে টুটুল দূর থেকে দেখল, শঙ্কর ওর বাড়ির সামনেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা-ওলা বিশুদার দোকানের হেল্পার নন্টের সঙ্গে হাত-পা নেড়ে কথা বলছে। দুজনেই বেশ উত্তেজিত! টুটুল কাছে আসতে আসতে নন্টে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে বাজারের দিকে চলে গেল। শঙ্কর টুটুলকে দেখেই বলে উঠল, ‘জানিস, লকেট কালকে মারা গেছে! ভর বিকেলে, সবার সামনে নাকি খুন হয়েছে! কিন্তু কী করে হোল, কে করল, কেউ বুঝতে পারছে না!’
-‘তোকে কে বলল? নন্টে?’
– ‘হ্যাঁ। কী করে খুন হয়েছে জানিস? লকেটকে গুলি করে মেরেছে! কিন্তু খুব নাকি অদ্ভুত ধরনের গুলি।’
-‘সে কী? যাঃ গুলি কি করে করবে? আমি তো ওখানে ছিলাম! লকেট তো নাড়ুকে মারতে মারতে নিজে হঠাৎ পড়ে গেল! কেউ তো গুলি করেনি। তা হলে তো সবাই দেখতে পেত। পকেট থেকে পিস্তল বার করে, তাক করে গুলি করলে কেউ দেখতে পেত না?’
শঙ্কর বলল, ‘ঐখানেই তো রহস্য! কি করে কেউ সবাই কে লুকিয়ে গুলি করল? আর নন্টে বলছে যে, লকেটের বুকের ভেতর থেকে নাকি একটা গুলি পাওয়া গেছে, যেটা নাকি খুব অদ্ভুত ধরনের। পুলিশ এরকম গুলি আগে কখনও দেখেনি!’
-‘অদ্ভুত ধরণের গুলি মানে? আর নন্টে এত কথা জানল কী করে?’
-‘কারণ, কাল রাতে নাকি থানার বড়বাবু বিশুদার দোকানে এসেছিলেন আর বিশুদাকে নানা রকম প্রশ্ন করেন। আর কথায় কথায় ঐ অদ্ভুত গুলির কথা বলেন। নন্টে তখন পাশের কলে কাপ-ডিশ ধুচ্ছিল, তাই শুনেছে!’
-‘কী শুনেছে?’
-‘এই যে ওটা নাকি খুব স্পেশাল গুলি!’
এরপর আর এই নিয়ে কোনও কথা হল না। টুটুল আর শঙ্কর দুজনে শঙ্করদের ড্রয়িং রুমে বসে দু-দান দাবা খেলল। একবার টুটুল জিতল, একবার শঙ্কর।
বিকেলে টুটুলদের ও’র ছোটমাসির বাড়ী নেমন্তন্ন ছিল। আজ টুটুলের মাসতুতো বোন ঝিল্লির জন্মদিন। ছোটমেসো একজন ম্যাজিশিয়ানকে এনেছিলেন। উনি নানা রকম ম্যাজিক দেখালেন। টুটুলের পকেট থেকে একটা স্প্যানিশ পেসো (স্পেনের পয়সা) বার করে বললেন, ‘তুমি স্পেন-এ কবে গিয়েছিলে? বাবা-মা জানেন?’ তারপর টুটুল, ঝিল্লি আর ওর বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে কিছুক্ষণ ঝিল্লির নতুন উপহার পাওয়া কম্পিউটার গেমটা খেলে, দারুণ একটা ডিনার খেয়ে বাড়ীর দিকে রওনা হল। পাড়ার কাছাকাছি আসতে আসতে প্রায় রাত বারোটা বেজে গেল!
টুটুলদের গাড়ীটা খারাপ হওয়াতে ও’রা ট্যাক্সি করে গিয়েছিল মাসির বাড়ি। ফেরাটাও ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সিটা গলির মুখে ছেড়ে দিয়ে টুটুলের বাবা বিল মেটাচ্ছেন তখন দেখা গেল, টুটুলের বাড়ীর উল্টোদিকের বস্তিতে একটা হইহই আওয়াজ চিৎকার –এই সব হচ্ছে। টূটুলের বাবা বললেন, ‘তোমরা বাড়ী যাও, আমি দেখে আসছি কী হল আবার!’ টূটুলের মা বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘এত রাতে কী দরকার তোমার?’ কিন্তু টুটুলের বাবা এসব ব্যাপারে টুটুলের মতই কৌতুহলী। আর ওনার মত হচ্ছে, এক পাড়ায় বসবাস করে পড়শি হিসেবে অন্যদের বিপদে এগিয়ে যাওয়া দরকার। সে পাকাবাড়ীর পড়শিই হোক কিম্বা খোলার চালের বস্তিই হোক। এত রাতে হঠাৎ হইচইয়েই বোধহয় বস্তির সামনের বটগাছটার সবকটা কাক এক সঙ্গে কা-কা করে ডাকছিল আর ডানা ঝাপটাচ্ছিল। টুটুল আর তার মা বাড়ি ফিরে এল। প্রায় আধঘন্টা বাদে টুটুলের বাবা ফিরলেন। টুটুল নিজের ঘরে শুতে চলে গেলেও তার কানটা খাড়া ছিল বাবা-মায়ের ঘরের দিকে! বাবা বাড়ী ঢোকার শব্দ পেয়েই টুটুল পা টিপে টিপে বাবা-মায়ের ঘরে বাইরে এসে দাঁড়াল! ভেতর থেকে মায়ের বিরক্ত অভিযোগ কানে এল, ‘এত রাত্তির বেলা ঐ সব বস্তি-টস্তির মধ্যে তোমার যাওয়ার কী দরকার ছিল? আর হয়েছেই বা কী ওখানে?’ টুটুলের বাবার চাপা উত্তেজিত উত্তর কানে এল টুটুলের, ‘আরে বাপ্রে! কী বলছ গো! ওখানে তো একটা ভীষণ mysterious ব্যাপার ঘটে গেছে!’ টুটুলের মা বলে উঠলেন, ‘কী এমন mysterious ব্যাপার!’। টুটুলের বাবা বলে চললেন,’আজকে আমরা যখন বাড়ী ফিরছি, তখন ঐ বস্তির মাতাল মদন, খালধারের চোলাইয়ের ঠেক থেকে প্রচুর মদ খেয়ে এসে, রোজকার মত ওর বৌ-টাকে ঘরের দরজায় লাথি মেরে ঘুম ভাঙিয়ে টেনে তুলে মারতে শুরু করেছিল। এ প্রায় রোজকার ব্যাপার। সুতরাং কেউ খুব একটা বাধা দেয়নি। কিন্তু মদন যখন ওর বৌ-টাকে রাস্তার ওপর ফেলে লাথি মারছে, তখন হঠাৎই নাকি একটা হেঁচকি তুলে সটান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মদন। ওর বৌ প্রথমে বুঝতে পারেনি। ভেবেছে বোধহয় মদের নেশাটা কিছু বেশি হয়ে গেছে বলে সটান শুয়েই পড়েছে মাটিতে। কিন্তু তারপর ও কোনওমতে উঠে যখন মদনকে ডাকছে, তখন সাড়া শব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে পাশের ঘরের কয়েকজনকে ডেকে তুলে আনে। সবাই মিলে এসে মদনকে দেখে বোঝে যে মদন মরে গেছে! আর ওর বুকের একটা জায়গা রক্তে ভিজে গেছে!’ ওদের সন্দেহ হচ্ছে যে কয়েকদিন আগে লকেট যে ভাবে মরেছে, মদন ও কাল সেই ভাবেই মরেছে! সেই নিয়েই তো এত হইচই হচ্ছিল। আমি যখন গেলাম তার কিচ্ছুক্ষণ আগেই পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেছে।‘ টুটুল সবে এই পর্যন্ত শুনেছে, এমন সময় অসাবধানে দরজায় হাত পড়ে গিয়ে একটা আওয়াজ হোল। টুটুলের বাবা ‘কীসের যেন আওয়াজ হোল?’ বলতেই টুটুল নিঃশব্দে একটি ছোট্ট লাফ মেরে ওখান থেকে সরে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে সোজা বিছানায়! পাশের ঘর থেকে বাবার দরজা খোলার আওয়াজ আর মা-বাবার অস্পষ্ট কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে শুনতে টুটুল ঘুমিয়ে পড়ল।
পরেরদিন সকালবেলায় টুটুল ঘুম থেকে উঠল একটু বেলার দিকে। এখন ছুটি চলছে, সুতরাং টুটুলেরও ঘুমের বহর বেড়েছে। ততোক্ষণে টুটুলের বাবা অফিস চলে গিয়েছেন। মা রান্না ঘরে কীসব টুকটাক কাজে ব্যস্ত। মুখ ধুয়ে টুটুল ডাইনিং টেবিলে বসে বাড়ির কাজের মাসী বেবীকে বলল ব্রেকফাস্ট দিতে। টুটুলের মা রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘আজ কী খালি সারাদিন খেলার প্ল্যান নাকি একটু লেখাপড়ার ইচ্ছে আছে? গরমের ছুটি বলে তো পড়াশুনোর পাট একেবারে চুকিয়ে দিয়েছো দেখছি!’ মায়ের মেজাজ বিশেষ সুবিধের নয় দেখে (বোধহয় সকালে রান্নার মাসির আসতে একটু দেরি হয়েছিল? হবেই তো। ওদের বস্তিতে এতবড় একটা কান্ড ঘটে গেল। মাসিকে পরে জিজ্ঞেস করতে হবে) টুটুল দুধ-কর্নফ্লেক্সে মনোনিবেশ করে খুব নিরীহ গলায় জবাব দিল ‘না। এখন দুটো চ্যাপ্টার এলজেব্রার অঙ্ক করে নিয়ে তারপর একটু শঙ্করদের বাড়ি যাব। হ্যাঁ মা?’
‘বেশি দেরী করবে না!’ কথা আর না বাড়িয়ে টুটুল ঘন্টা দেড়েকে অঙ্কগুলো শেষ করে নিয়ে শংকরদের বাড়ীতে প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে পৌঁছে গেল। আজ আর ছাতে নয়, বরং ওদের ড্রয়িংরুমে বিরাট গুলতানি চলছে! টুটুলদের পাড়ার খোকন, বুম্বা, সমীর, টিন্টু –এরা সবাই হাজির! জোর আড্ডা চলছে। বিষয়বস্তু অবশ্যই কালকের রাত্তিরের বস্তির মাতাল মদনের রহস্যজনক মৃত্যু। খোকন বলছিল, ‘বাবা সকালে বলছিল যে, যে দুজন মরেছে, তারা দুজনেই কিন্তু ভীষণ বদমাইশ আর গুণ্ডা টাইপের লোক। হয়তো ঐ দুজনের কোনও কমন শত্রু এই কাজটা করেছে!’ ইতিমধ্যে টুটুল ঘরে ঢুকে একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসে পড়ে খোকনের কথার পিঠে বলে উঠল, ‘কাকু তো ঠিকই বলেছেন! কিন্তু আসল রহস্য তো সেখানে নয়। আসল রহস্য হল, লোক দুটোকে মারল কীভাবে? সেটাইতো কেউ ধরতে পারছে না! আমার সেই ব্যোমকেশ বক্সীর ‘পথের কাঁটা’ রহস্যটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!’ টুটুলের বন্ধুরা অমনি সমস্বরে হইহই করে উঠল, ‘এই রে! আবার টুটুলের গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়ে গেল তো!’ বুম্বাটা বরাবরের ফিচ্লে। টুটুলকে রাগিয়ে দেওয়ার কোনও সুযোগ ও ছাড়তে রাজি নয় – ‘টুটুল, এ কেসটা তুই বরং কলকাতা পুলিসের জন্য রেখে দে! ওদেরও তো মাঝে মাঝে খুনি টুনি ধরতে ইচ্ছে করে!’ সঙ্গে সঙ্গে হাসির ফোয়ারা উঠল ড্রয়িংরুমে। তারপর একথা, সেকথা বলতে বলতে বেলা হয়ে গেল। বেশির ভাগটাই পাড়ার দুটো রহস্যময় খুনকে নিয়ে। শঙ্করদের বসার ঘরের ওয়াল ক্লকে দেড়টা বাজে দেখে টুটুল উঠে পড়ল; বেশী দেরী হলে মায়ের কাছে নিশ্চিত বকুনি খেতে হবে। শঙ্করদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়তেই যেন এক ঝলকে আবার সেই নীল ছোট্ট পাখিটা টুটুলের চোখে পড়ল! সেটা ফুড়ুৎ করে টুটুলের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে শঙ্করদের বাড়ীর উলটো দিকের সেই হলুদ বাড়ীটা, যেটা অনেকদিন খালি পড়ে ছিল, সেই বাড়ীর বাগানের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। টুটুলের ইচ্ছে হল, একবারটি ঐ বাগানের ভেতরে ঢুকে দেখে আসে যে পাখীটা কোথায় গেল। কিন্তু মায়ের বকুনিকে বড় ভয় টুটুলের! অগত্যা বাড়ীর পথ ধরল সে।
।।৩।।
এর পরের কয়েকদিন কলকাতার নানান অঞ্চল থেকে অদ্ভুত সব খুনের খবর আসতে লাগল! পরের খুনটা হল টুটুলদের পাড়ার কাছাকাছি আর একটি পাড়ায়। একদিন রাত্তিরের দিকে কয়েকটা বদমাইস ছেলে মিলে একটি মেয়েকে উত্যক্ত করছিল নির্জন রাস্তায়; আর যেই একটা ছেলে মেয়েটির হাত ধরে টানতে গেছে, তখনি তার ওপর নেমে এল সেই ভয়ানক মৃত্যুবাণ! ছেলেটার বুকের ভেতর পাওয়া গেল সেই রহস্যময় বুলেট। এর কয়েকদিন পরেই মধ্য কলকাতার একটি বাড়ীতে ডাকাতি করে পালানোর সময় ডাকাতদলের দুজন সেই একই রকম রহস্যময় গুলি খেয়ে মরল! এরকম আরও কয়েকটা খুন হয়ে গেল। সারা শহরে এই নিয়ে তোলপাড়! খবরের কাগজগুলো এক ঘেঁয়ে রাজনৈতিক খবরগুলোর বদলে এই নতুন রহস্যের সন্ধান পেয়ে তুমুল উৎসাহে নানান খবর, বিশেষজ্ঞের মতামত, সতর্কতা ইত্যাদি ছাপাতে লাগল! বলা বাহুল্য টুটুলদের বাড়ীতেও এই নিয়ে প্রচুর আলোচনা হতে থাকল। দুটো সপ্তাহ এই করে কেটে গেল। দেখতে দেখতে আর একটা রবিবার এসে পড়ল। রবিবারের সকালবেলা টুটুলদের বাড়ীতে টুটুলের বাবার কয়েকজন বন্ধুরা এলেন। টুটুলের বাবার স্কুলের বন্ধুদের একটা দল আছে যারা মাসে একবার করে কারো না কারো বাড়ীতে আড্ডা দেন। শুরু হয় সকাল সকাল তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে একেবারে বিকেলের চায়ের পর্বে গিয়ে আড্ডা শেষ হয়। ওদিকে টুটুলের ছোড়দার বন্ধুদের একটা দলও সেদিন ওদের বাড়ীতে আড্ডা মারতে চলে এসেছে। কারণ, ওদের বন্ধু সেই সপ্তক তো এবার আমেরিকা ফিরে যাবে। তাই টুটুলের ছোড়দা ও তার বন্ধুদের আজ সপ্তকের সঙ্গে সারাদিন ব্যাপী একটা ম্যারাথন আড্ডা চলবে। আড্ডার ঠিকানা ওদের বাড়ীর ছাদের সেই চিলেকোঠার ঘর!। টুটুলের আজকের প্ল্যান হল বাবা ও তার বন্ধুদের আর দাদা ও তার বন্ধুদের আড্ডায় কোনও রকমে ঢুকে পড়া। কারণ বড়রা নানান রকম ইন্টারেস্টিং ব্যাপার নিয়ে আড্ডা দেয়, যেগুলো চুপ করে শুনতে টুটুলের দারুণ লাগে মাঝে মাঝে! সকালটা তাই সে ছাতে ফুটবল প্র্যাকটিসের বাহানায় পড়ে রইল। চিলেকোঠার ঘর থেকে নানান কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। টুটুলের ছোড়দা রন্টুর এক বন্ধু সোমক বলছিল শহরের এই নতুন রহস্যের কথা। কী ভাবে দুমদাম লোক মারা যাচ্ছে। যদিও তারা কোনও না কোনও অপরাধ করছিল তাদের মৃত্যুর সময়টাতে। তবুও, এরকম হঠাৎ নেমে আসা মৃত্যু কী ভয়ানক অনিশ্চয়তা এনে দিচ্ছে মানুষের জীবনে। তাতে, সপ্তক বলল, ‘আরে সে তো এখন টেররিস্টদের কল্যাণে সারা বিশ্বজুড়েই মানুষের প্রাণের নিশ্চয়তা চলে গেছে। কে কোথায় কখন আত্মঘাতী বোমায় উড়ে যাবে কে জানে!’ সেই থেকে আড্ডা ঘুরে গেল সন্ত্রাসবাদীদের কী ভাবে বাগে আনা যায় সেই দিকে। রন্টুর বন্ধু অনিমেষ বলল, ‘ঐ ড্রোন স্ট্রাইকই বেস্ট রাস্তা!’ তাতে একটা ভীষণ তর্ক শুরু হয়ে গেল। সব কথা ঠিক বুঝতে না পেরে (সব্বাই এত চ্যাঁচাচ্ছিল যে শোনাও যাচ্ছিল না) টুটুল নীচে নেমে বাবাদের ড্রইংরুমের আড্ডায় কী হচ্ছে সেটা শুনতে গেল। সেখানে তখন বিজিৎকাকু আর সমীরকাকুর ফাটাফাটি তর্ক হচ্ছে এই রহস্যময় খুনগুলো নিয়ে। বিজিৎকাকুর বক্তব্য যে, যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে! দেশে আইন-আদালতের বিশ্রী অবস্থা। যেখানে সেখানে ছিনতাই, চুরি, খুনজখম হচ্ছে। অপরাধীরা নির্বিবাদে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। অতএব, কেউ যদি আড়াল থেকে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে এই বদমাইসদের শাস্তি দেয় তো দিক! সমীরকাকু পেশায় আইনজ্ঞ। তিনি বলছেন যে সেটা হলে তো পুরো অরাজকতার চুড়ান্ত হবে। সভ্য সমাজে এটা তো চলতে দেওয়া যেতে পারে না। অপরাধ কেউ করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন, আদালত, কারাগার আছে। টুটূল বুঝল যে, বড়রা সবাই কিন্তু এই নতুন রহস্যের সংস্পর্শে এসে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছে। টুটুল বড়দের এত ভালোমন্দর কচকচি সহ্য করতে না পেরে বেশ বোর হয়ে গিয়ে শঙ্করদের বাড়ীর দিকে রওনা দিল। শঙ্কর আজকে ওদের ড্রয়িংরুমে বসে টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল দেখছিল। ওখানে উত্তর আমেরিকার পাখিদের ওপর একটা ডকুমেন্টারি দেখানো হচ্ছিল। টুটুল ঘরে ঢুকতেই শঙ্কর বলে উঠল, ‘এই টুটূল! একটু আগেই এই শোটাতে তোর সেই ফ্লোরিডা স্ক্র্যাব্-জে দেখাল!’ টুটুল শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, ‘জানিস আমি সেদিন তোদের বাড়ী থেকে ফেরার সময় সেই নীল পাখিটাকে আবার দেখলাম। তোদের বাড়ীর উলটো দিকের ঐ হলুদ বাড়ীটার বাগানের দিকে উড়ে গেল। শঙ্কর বলে উঠল, ‘আরে ঐ বাড়ীটা নিয়ে সেদিন একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং ঘটনা হয়েছে! আমি এই বুধবার দিন সকালবেলা আমাদের বাড়ীর পাশের মাঠটা তে প্র্যাকটিস করছিলাম। হঠাৎ একবার ফুটবলটাতে বেকায়দায় কিক্ করায় ওটা ঐ উল্টোদিকের হলুদ বাড়ীটার বাগানে গিয়ে পড়ল! আমি তো কী করব বুঝতে না পেরে ওদের দরজার কলিং বেলটা টিপলাম। একটু পরেই দরজা খুলে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। খুব লম্বা আর চশমা পরা। গায়ে একটা ড্রেসিং গাউন আর পাজামা। আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন কী চাই। আমি আমতা আমতা করে বললাম যে ওনার বাগানে আমার ফুটবলটা পড়ে গেছে। তো উনি বললেন, ‘বেশ চল তাহলে তুমি আর আমি মিলে খুঁজে বার করি!’ এই বলে আমায় নিয়ে বাড়ীর ভেতরে ঢুকে, ওদের মেইন করিডোরটার শেষে একটা দরজা খুলে বাগানে নিয়ে গেলেন। বাগান থেকে বলটা নিয়ে যখন আসছি, তখন দেখলাম যে ওনার বাগানের ভেতরে কয়েক রকমের পাখীর পালক পড়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করাতে হেসে বললেন যে উনি পাখী নিয়ে নানা রকম গবেষণা করেন তাই অনেক পাখী পোষেন। তারপর আমায় একটা চকোলেট দিলেন। ও হ্যাঁ, উনি আমার নাম জিজ্ঞেস করাতে নাম বললাম আর উনি বললেন ওনার নাম সত্যসাধন রায়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, কোনও পাখীর আওয়াজ পেলাম না!’
-‘তুই জিজ্ঞেস করলি না যে ওনার পোষা পাখিদের মধ্য একটা ফ্লোরিডা স্ক্র্যাবজে আছে কী না?’
‘ঐ যাঃ! ভুলে গেছিলাম। দাঁড়া আবার দেখা হলে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করব। অবশ্য ভদ্রলোক বোধহয় খুব একটা বাড়ীর বাইরে যান না। এর মধ্যে খালি একদিন দেখলাম ওনাকে বেরোতে। সেটাও গাড়ীতে করে।’ ইতিমধ্যে টুটুলদের আরো অন্যান্য বন্ধুরা এসে পড়ল। শঙ্করদের বাড়ীর পাশের মাঠে যথারীতি ওদের উইক-এন্ডের ফুটবল খেলা শুরু হয়ে গেল। টুটুল মিনিট চল্লিশেক খুব দৌড়োদৌড়ি ঘামে জবজবে ভিজে সবাই মাঠের এক কোণের গাছের ছায়ায় বসে কিছুক্ষণ গল্প করে একে একে বাড়ীমুখো রওয়ানা দিল।
বাড়ী ফিরে টুটুল দেখল ছোড়দার বন্ধুরা ছাতের আড্ডা শেষ করে, খাওয়া দাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে সব। ওদিকে টুটুলের বাবার বন্ধুরাও রেডি। টুটুল তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিয়ে সবাইয়ের সঙ্গে ওদের বড়সড় ডাইনিং স্পেসের মেঝেতে বিছিয়ে দেওয়া চাদরে বসে জমিয়ে খাওয়া শুরু করল! খেতে খেতেও আড্ডা। টুটুল খাওয়ার ফাঁকে এক সময় ওর ছোড়দার বন্ধু সপ্তককে বলল, ‘জানো সপ্তকদা, সেই ফ্লোরিডা স্ক্রাব্জের খবর পেয়েছি। ওটা আমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক এসেছেন, নাম সত্যসাধন রায়, ওনার পোষা! উনি মনে হয় আমেরিকা থেকে এনেছেন। পাখী নিয়ে উনি গবেষণা করেন।‘ সপ্তক একটু অন্যমনস্ক ভাবে একটা বেগুন ভাজায় কামড় বসিয়ে বলল, ‘সত্যসাধন রায়! … আমি একজন সত্যসাধন রায়কে চিনি। অবশ্য তিনি সম্ভবতঃ অন্য লোক। আমি যাঁর কথা বলছি তিনি সাদার্ণ ক্যালিফোর্নিয়ার এক ইউনিভার্সিটি-তে রোবটিক্সের ওপর রিসার্চ করতেন প্রায় বছর পাঁচেক আগে। ওনার একটা পেপার কম্প্যুটার সায়েন্সের একটি বিখ্যাত পত্রিকায় পাবলিশ্ড্ হয়ে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। আমি তখন সবে মাস্টার্স করতে ঢুকেছি। আমার রিসার্চ গাইড আর আমাদের ডিপার্টমেন্টের অন্য কয়েকজন প্রফেসর বেশ উত্তেজিত ছিলেন পেপারটা নিয়ে। আমার এক বন্ধু তন্ময় তখন ঐ ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। ও’র কাছে একবার কথা প্রসংগে শুনেছিলাম যে, ঐ পেপারটা বেরোনোর পর ভদ্রলোক নাকি ইঊ এস গভর্মেন্টের একটা স্পেশাল ফান্ডিং পেয়েছিলেন ওনার রিসার্চের জন্য। তারপর বছর দেড়েক আগে ভদ্রলোক হঠাৎ ওনার কাজ এবং রিসার্চ ছেড়ে দিয়ে উধাও হয়ে যান। কেন যে উনি চলে গেলেন হঠাৎ আর কোথায়ই বা গেলেন সেটা কেঊ জানে না। ডিপার্টমেন্ট থেকে ওনার খোঁজ করার প্রচুর চেষ্টা হয় কিন্তু কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি। ওদের ধারণা উনি দেশে ফিরে এসেছেন। টুটুলের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘উনি ঠিক কী নিয়ে গবেষণা করতেন? মানে রোবটিক্স তো একটা বেশ বড় এরিয়া।’ সপ্তক জানাল যে সেটা জানে না। তবে জেনে নেওয়া খুব কঠিন নয়। সপ্তকের বন্ধু তন্ময় জানবে। তারপর যথারীতি আড্ডার গতি আবার সেই রহস্যময় খুনগুলোর দিকে ঘুরে গেল। টুটুলের ছোড়দা বলল যে এটা বোঝাই যাচ্ছে এটা কোনও ‘সিরিয়াল কিলার’-এর কাজ! হয়তো কোনও বিকৃত মানসিকতা থেকে সে একের পর এক খুন করে চলেছে! অর্থাৎ কোনও কারণ ছাড়াই খুন। টুটুলের বাবার বন্ধু সমীরণ কাকু বললেন, ‘আমার কিন্তু তা মনে হয় না! প্রতি ক্ষেত্রেই যারা খুন হয়েছে, তারা খুনের সময়টাতে কোনও অনৈতিক বা অন্যায় কাজ করছিল। কেউ যেন তাদের নির্মমভাবে শাস্তি দিয়ে সমাজকেই একটা শিক্ষা দিচ্ছে!’
।।৪।।
টুটুলদের বাড়ীর সেই আড্ডার পর প্রায় দশ বারো দিন কেটে গিয়েছে। ইতিমধ্যে আর শহরের পথে ঘাটে হঠাৎ কেউ রহস্যজনক ভাবে মারা পড়েনি। খবরের কাগজ আর টিভির চ্যানেলগুলো রহস্য ছেড়ে আবার গতানুগতিক খবরের কচকচিতে ঢুকে পড়েছে। একদিন বিকেলের দিকে টুটূল তার বিকেলের খেলা সেরে ফিরছিল। গরমের ছুটি শেষ হয়ে আসছে। আর কদিন বাদেই স্কুল খুলবে। অতএব সকাল বিকেলের এই লাগাম ছাড়া আড্ডা আর খেলারও ইতি হবে। টুটুল তাই একটু মনমরা হয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিল। হঠাৎ দেখল যে সত্যসাধনের বাড়ী থেকে একটা গাড়ী বেরিয়ে গেল। ভেতরে একজন চশমা পরা দীর্ঘদেহের ভদ্রলোককে দেখে টুটুল বুঝল ইনিই সম্ভবতঃ সত্যসাধন রায়। কী মনে করে, টুটুল একটু অ্যাডভেঞ্চারের লোভে রাস্তা পেরিয়ে সত্যসাধনের বাড়ীর সামনে পৌছে গেল। সবুজ রঙের কাঠের দরজার ওপর পেতলের ফলকে লেখা ‘সত্যসাধন রায় ১৩/১ মাধবদাস রোড, কলকাতা…’। দরজার সামনে থেকে সরে এসে টুটুল এবার বাগানের পাঁচিল টপকে সত্যসাধনের বাগানে ঢুকে পড়ল। যদি সেই নীল পাখিটাকে দেখা যায়? বাগানটা কিন্তু আশ্চর্য রকমের নিস্তব্ধ! বিকেলের আলো তখন প্রায় মরে এসেছে। বাগানটার বড় বড় গাছগুলোর তলায় একটু একটু অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। টুটুলের কী খেয়াল হোল, বাগান থেকে যে লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা বাড়ীটার গা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে সেটা দিয়ে ধাপে ধাপে উঠতে শুরু করল!
সিঁড়িটার সবচেয়ে ওপরের ধাপে উঠে টুটুল দেখল সে একটা বন্ধ দরজার সামনে পৌছেছে। এক পাশে একটা জানলা দিয়ে এক টুকরো আলো দেখা যাচ্ছে। টুটুল সিঁড়িটার সঙ্কীর্ণ ল্যান্ডিং থেকে ঝুঁকে জানলাটা দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল। দেখে মনে হল একটা ল্যাবরেটরী বা লাইব্রেরি গোছের ঘর। দুদিকের দেওয়ালে বুক শেলফ্ভর্তি বই। টুটুল যতটুকু দেখতে পেল তাতে সেগুলো সবই অঙ্ক বা কম্প্যুটার সায়েন্সের বই-পত্তর বলে মনে হল। উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা ছবি ঝুলছে। এক ভদ্রলোকের। চোখে চশমা। স্যুট-টাই পরা। পেছনে একটা বিদেশী ইউনিভার্সিটির ছবি। দেওয়ালটার সামনে একটা টেবিল। সেই টেবিলে অনেকগুলো কম্পুটার মনিটর দেখা যাছে সারি সারি। কিন্তু সেগুলো এখন অন্ধকার। কম্প্যুটার টেবিলের ডান দিকে আর একটা টেবিল। তার ওপর অনেকগুলো যন্ত্রপাতির টুকরো, ভগ্নাংশ ছড়ানো রয়েছে। ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমেছে। বাগানের গাছগুলো অন্ধকারে ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে। টুটুল হতাশ হয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে, বাগানের পাঁচিল টপকে রাস্তায় নামল। কোনও পাখীর খাঁচা বা ঘর তো দেখতে পেল না! খুব আশা ছিল ঐ নীল পাখীটার বা অন্য কোনও পাখীর দেখা হয়ত মিলবে!
বাড়ী ফিরে টুটুল গেল তার ছোড়দা রন্টুর ঘরে। রন্টু মন দিয়ে কী একটা টাইপ করছিল তার ল্যাপটপে। টুটুলকে দেখে একটু সন্ধিগ্ধ চোখে বলল, ‘কী বাবা? কী মতলবে আগমন? এখন কিন্তু আমায় একদম ডিস্টার্ব করবি না। ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছি একটা।’ টুটুল খুব নিরীহ গলায় বলল, ‘না না ! আমি শুধু তোর কাছ থেকে সপ্তকদার ইমেইল-টা চাইতে এসেছিলাম। একটু দিবি?’ রন্টু একটু অবাক হলেও আর কথা বাড়াবে না বলেই বোধহয় টুটুলকে সপ্তকের ইমেইলটা দিল। টুটুল নিচের ঘরে নেবে, বাবার পারমিশন নিয়ে, ওদের ডেস্কটপে লগ-ইন করে সপ্তককে ইমেইল লিখতে বসল। জানার বিষয় একটাই। টুটুল আজকে যে ইউনিভার্সিটির ছবিটা দেখল সেটার কথাই কী সেদিন সপ্তকদা বলছিল? যেখানে ও’র চেনা সত্যসাধন রায় পড়ত? উত্তর মিলল পরের দিনই। এই ইউনিভার্সিটিতেই তো সপ্তকের চেনা সেই সত্যসাধন রায় গবেষণা করতেন! কিন্তু তিনি তো রোবট টোবট নিয়ে রিসার্চ করতেন বলে টুটুল শুনেছিল। তাহলে পাখীর গবেষণা কবে থেকে শুরু করলেন? কেনই বা কোনও পাখীর দেখা মিলল না ওনার লাইব্রেরী বা ল্যাবরেটরীতে? হয়তো বাড়ীর অন্য কোথাও পাখীগুলো রাখা আছে? টুটুলের মনটা ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল। কিন্তু এই নিয়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে এক্ষুণি আলোচনা করতে মন চাইল না। যদি ওরা আবার হাসিঠাট্টা শুরু করে দেয়? অনিমেষকাকুকে একবার বলে দেখলে কেমন হয়? টুটুলের সঙ্গে তো ওনার দারুণ ভাব। মন ঠিক করে উঠতে পারল না। ইতিমধ্যে, টুটুল সত্যসাধন রায় সম্বন্ধে আরও কয়েকটা কথা নেহাতই আকস্মিক ভাবে জেনে ফেলল। প্রথম খবরটা জানাল টুটুলদের কাজের মাসী। সকালে ঘর ঝাঁট দিতে দিতে বেবী মাসী গল্প করছিল টুটুলের মায়ের সঙ্গে -‘জানো দিদি। ঐ আমাদের মেন রাস্তার ওপর যে হলদে বাড়ীটা। সেটাতে লোক এয়েচে। ওদের বাড়ীর একমাত্র ছেলে গো! সতু রায়। সে ফিরে এয়েচে। সে নাকি বাইরে ছিল এদ্দিন। ও’র বাপ মা তো অপঘাতে মলো। সতু বাবুর বাপকে তো শুনিচি ঐ লকেট গুন্ডা নাকি ছুরি মেরেছিল গো! সে তো ভয়ানক কান্ড হয়েচিল এ পাড়ায়। তা প্রায় বছর সাতেক আগে হবে। তোমরা তখনো এ পাড়ায় আসনি। সতু বাবু তখন বাইরে। খবর গেচল। কিন্তু কে মেরেচে সেটা তো পুলিশ বার কত্তে পারলে না। তবে সব্বাই বলত ঐ লকেটেই মেরেচে। লকেট একদিন গুচ্ছের চোলাই গিলে আমাদের বস্তির একটা মেয়েকে বিরক্ত করছিল, আর সেই সময় সতুবাবুর বাবা ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওনার দশাশই চেহারা ছিল। উনি সেই গুন্ডাটাকে রাস্তার মাঝখানে পায়ের জুতো খুলে মেরেছিলেন। তার দু-একদিন পর উনি রাত্তিরের দিকে একটা নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছিলেন আর ওনার একেবারে বাড়ীর সামনে ওনাকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। সতুবাবু তখন এয়েছিল। থানা-পুলিসে খুব ছোটাছুটি করেছিল লকেটকে ধরার জন্য। কিন্তু সে তো তখন ফেরার। আর পুলিসও নাকি কেস নেয়নি। কোনও সাক্ষী ছিল নি তো।’ ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে টুটুল খুব মনযোগ দিয়ে কথাকটা শুনল। বেবীদি আরো বলল যে সত্যসাধনের মা নাকি এই ঘটনার পর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। মাথাটাও খারাপ মত হয়ে যায়। তারপর বছর পাঁচেক আগে উনি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন! সত্যসাধন সেই সময় কয়েকদিনের জন্য নাকি দেশে এসেছিলেন। মায়ের শ্রাদ্ধ শান্তি মিটিয়ে আবার আমেরিকা ফিরে যান। তারপর আবার এই এলেন। বেবীমাসী তো ভাবতেই পারছে না একা একা ঐ ভূতের মত বাড়ীটাতে উনি থাকেন কী করে? টুটুলের উৎসাহে জল ঢেলে টুটুলের মা এবার বেবীমাসীকে তাড়া লাগালেন ঝাঁট শেষ করে অন্য কাজে হাত লাগাতে। মায়ের তাড়া খেয়ে বেবীমাসীও আর বেশি গল্প বাড়াল না। কিন্তু এই কটা কথায় টুটুলের মাথায় দপ্দপ্ করে কয়েকটা আলো যেন জ্বলে উঠল। সপ্তকদাকে ইমেল পাঠাতে হবে এক্ষুনি! আর তারপর আর একটিবার ঢুকতে হবে সত্যসাধনের বাড়ীতে। টুটুল তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে মায়ের অনুমতি নিয়ে ও’র বাবার কম্প্যুটারটা থেকে সপ্তককে একটা ইমেল ছাড়ল কতকগুলো কথা বুঝিয়ে আর কয়েকটা প্রশ্ন নিয়ে। তারপর ছুটল শঙ্করের বাড়ির দিকে। শঙ্করের সঙ্গে মন দিয়ে পরামর্শ করতে হবে!
শঙ্করের বাড়ীতে ঢুকে সংক্ষেপে সবটা বলে ওরা দুই বন্ধু ছাতে উঠল বেশ ভাল করে নিরিবিলিতে পরামর্শ করতে। কী করে সত্যসাধনের অগোচরে ও’র লাইব্রেরী ঘরে ঢোকা যায়? অনেক কথাবার্তার পর প্ল্যান ঠিক হল। …..
বিকেল বেলায় প্ল্যান অনুযায়ী টুটুল শঙ্করদের বাড়ী পৌছে গেল। তারপর দুজনে মিলে ওদের পাশের মাঠে কিছুক্ষণ লোক দেখানো প্র্যাকটিস চালাল। ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় শঙ্করের একটি লম্বা শটে রাস্তা পেরিয়ে বলটা সত্যসাধনের বাড়ীর পাঁচিল টপকে বাগানে গিয়ে পড়ল। অতএব শঙ্কর রাস্তা পেরিয়ে সত্যসাধনের বাড়ীর দরজায় বেল বাজাল। আর এদিকে টুটুল সত্যসাধনের বাড়ীর সামনের দেবদারু গাছটার পিছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুললেন সত্যসাধন স্বয়ং। টুটুল গাছের আড়াল থেকে দেখল, সেদিন লাইব্রেরী ঘরে যার ছবি দেখেছিল, এ সেই। খালি চুল একটু পেকেছে। চোখের চশমার কাঁচটাও আরও মোটা মনে হল। শঙ্কর বলল ওদের বলটা আবার বাগানে পড়ে গেছে। সত্যসাধন হেসে এক পাশে সরে দাঁড়ালেন, আর ঠিক তখনই টুটুলের ছোঁড়া একটী ঢিলে সত্যসাধনের বাড়ীর একতলার জানলার কাঁচের কিছুটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল! সত্যসাধন চমকে উঠে বাড়ীর ভেতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। টুটুল শুনতে পেল উনি শঙ্করকে বলছেন দরজাটা বন্ধ করে দিতে। শঙ্কর দরজাটা বন্ধ করার ভান করে টুটুলকে ইশারা করল। আর টুটুল বিদ্যুৎবেগে ওদের বাড়ীতে ঢুকে সামনে একটা সিঁড়ি পেয়ে সেটা দিয়ে পা টিপে টিপে দোতলায় চলে এল। ইতিমধ্যে শঙ্কর এগিয়ে গেছে বাড়ীর ভেতরের দিকে যেখানে সত্যসাধন দাঁড়িয়ে জানলাটা পরীক্ষা করছিলেন। টুটুল দোতলায় উঠে একটা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। টুটুলের একটু সময় লাগল বাড়ীটার ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে সেটা বুঝতে। মনে মনে একটা হিসেব করে টুটুল এগিয়ে গেল সেই লাইব্রেরী ঘরটার দিকে যেটা সে আগেরদিন বাইরের সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে দেখে গেছিল। ঘরটার দরজা খোলা। টুটুল পা টিপে টিপে ঢুকে পড়ল ঘরটার ভেতর। একটু যেন অন্ধকার। জানলাগুলো বন্ধ আজ। দরজার বাঁ-দিকে সেই একটা লম্বা টেবিলে সারি সারি কম্প্যুটার মনিটর। তবে আজকে তার কতকগুলো সচল রয়েছে। টুটুল সভয়ে দেখল একটা মনিটরে তাকে দেখা যাচ্ছে। আর অন্যান্য মনিটরে বাড়ীটার অন্য কিছু অংশ! একটা-তে বাগানটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে সত্যসাধন আর শঙ্কর বল খুঁজছে। এবার দরজার ডানদিকটাতে তাকিয়ে টুটুল ভয়ানক চমকে উঠল! একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে অবিকল টুটুলের দেখা সেই নীল পাখিটার মত গোটা তিনেক পাখী সাজানো রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও প্রাণের স্পন্দন নেই। ঠিক যেন পাথরের মূর্তি। আর বাক্সটার বাইরে, টেবিলের ওপর শোয়ানো রয়েছে ঐ রকম আর একটি পাখী। তফাৎ শুধু একটাই। এই পাখীটার পেটের দিকটা খোলা, আর তার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আছে কিছু কল-কব্জা, কিছু লাল-নীল রঙের তার! তার মানে, এগুলো পাখী নয়। পাখীর মত দেখতে কোনও খেলনা বা যন্ত্র! আর বেশীক্ষণ থাকাটা ঠিক হবে না ভেবে টুটুল ঘরের বাইরে পা বাড়াল। ঠিক বেরোনর মুখে এক ঝলকে দেখল আর একটা দুরের টেবিলে রাখা মনিটরে একটা ছবি ভেসে উঠেছে সেই সময়! লকেট গুন্ডার মৃত মুখটার একটা ক্লোজ-আপ! টুটুলের বুকে তখন হাতুড়ি পড়ছে! কী করে যে টুটুল পা টিপে টিপে আবার নীচে নেমে তারপর একচ্ছুট্টে বাইরে এল সে টুটুলই খালি জানে! বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল শঙ্কর আর সত্যসাধন রায় কথা বলতে বলতে করিডোরটা দিয়ে দরজার দিকে আসছে। রাস্তায় বেরিয়ে টুটুল চলে গেল ওদের খেলার মাঠে। শঙ্কর এসে পড়ল তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই। টুটুল সংক্ষেপে শঙ্করকে যা যা দেখেছে সবটা বলে উত্তেজিত শঙ্করকে বাই করে বাড়ীর দিকে দৌড়ল। তার এখন ভীষণ দরকার দুজন-কে। এক সপ্তকদা আর দুই অনিমেষ কাকু! প্রথমে সপ্তকের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। এই ভাবতে ভাবতে টুটুল তিনতলায় ছোড়দার ঘরে উঠে এল। ছোড়দাকে খুব নিরীহ গলায় অনুরোধ করল যে যদি কোনও ভাবে সপ্তকের সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারে। প্রথমে টুটুলের ছোড়দা বেশ রেগে গেল অসময়ে ওকে বিরক্ত করার জন্য। টুটুল তখন আসল কথাটা কিছুটা খুলে বলল। ছোড়দা যদিও সব কথা বিশ্বাস করল না, তবুও ঘটনার গুরুত্বটা বুঝে, সপ্তককে স্কাইপে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কয়েকবার চেষ্টায় সপ্তককে ধরা গেল! ওদের ওখানে তখন খুব সকাল। হঠাৎ এই সময়ে স্কাইপের কল পেয়ে সপ্তক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল। কিন্তু রন্টু সব ব্যাপারটা কিছুটা খুলে বলাতে সপ্তক ও খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল। টুটুল সপ্তককে জিজ্ঞেস করল যে সে কী জানে সত্যসাধন ঠিক রোবটিক্সের কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন? তার সঙ্গে কি প্রাণী জগতের কোনও যোগাযোগ রয়েছে? যেমন পাখীর? সপ্তক দু-এক মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে ঐ ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানাল যে সত্যসাধনের বিষয় ছিল ‘বায়ো-মাইমেটিক রোবটিক্স। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণী আকৃতি আর তাদের আচরণকে নকল করে এক ধরনের রোবট তৈরী করা হয় বিদেশের কিছু কিছু বিখ্যাত রিসার্চ ইন্সটিটিউটে। যেমন এম-আই-টি তে এই রকম একটি ল্যাবরেটরী আছে। ওখানে চিতার চেহারা আর চলাফেরার অনুকরণে একটি রোবট তৈরী করা হয়েছে সম্প্রতি! মোটমাট সত্যসাধন এই বিষয়েই গবেষণা করেছিলেন। উত্তেজনায়, বিস্ময়ে, ভয়ে টুটুল তখন প্রায় থর থর করে কাঁপছে। রন্টুও ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে টুটুল আর সপ্তকের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিল। ঠিক হল, এক্ষুণি একবার অনিমেষ কাকুকে ফোন করে আসতে বলা হবে। ইতিমধ্যে রন্টু নিচে নেমে ওদের বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে সবটা বুঝিয়ে বলল। আর এটাও জানাল যে টুটুলই সব ব্যাপারটা এক সূত্রে গেঁথেছে! টুটুলের বাবা সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষকে ফোন করলেন। আধ ঘন্টার মধ্যে টুটুলের অনিমেষ কাকু চলে এলেন। সবাই মিলে ওদের ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসা হল। অনিমেষের সতর্ক প্রশ্নের উত্তরে এক এক করে টুটুল সব ঘটনার কথা বলল। আর তার সঙ্গে এটাও জানাল যে সে কীভাবে এই সব কটা জিনিস একত্র করে রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। অনিমেষ এরপরেই পর পর কয়েকটি ফোন করলেন। আধ ঘন্টার মধ্যে টুটুলদের বাড়ীর সামনে দুটো পুলিসের গাড়ী এসে দাঁড়াল। ভেতরে বসে রয়েছে বেশ কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশকর্মী। তাঁদের প্রতেকের হাতে রাইফেল। টুটূলের উত্তেজনায় প্রায় চুল খাড়া হয়ে উঠেছে ততোক্ষণে। অনিমেষ পুলিশের গাড়ীতে উঠে চলে গেলেন সত্যসাধনের বাড়ীর দিকে। টুটুলের ভীষণ ইচ্ছে ছিল ওঁর সঙ্গে যাওয়ার। কিন্তু সে অনুমতি যে কিছুতেই মিলবে না সেটা টুটুল জানতো বলেই আর বৃথা আবদার করেনি। পুলিসের গাড়ী দুটো চলে যাওয়ার মিনিট দশেকের মধ্যেই একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে টুটুল দৌড়ে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। টুটুলের বাবা, মা, ছোড়দাও এসে পড়ল। দূরে, শঙ্করদের বাড়ীর উলটো দিকের আকাশটা তখন লাল হয়ে গেছে। বারুদের একটা তীব্র পোড়া গন্ধে সমস্ত পাড়াটা ম-ম করছে! টুটুলের বাবা অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘সব শেষ?’
টুটুলকে আরো ঘন্টা দু-তিন উত্তেজনায় বারান্দা আর ঘর করতে হল। ও’র মনের অবস্থা বুঝতে পেরে টুটূলের বাবা-মাও ওকে কিছু বলছিলেন না।! রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ টুটুলদের বাড়ীর সামনে একটা পুলিসের গাড়ী আর একটা প্রেসের গাড়ী এসে দাঁড়াল। টুটুল বারান্দা থেকে দেখতে পেয়েই এক দৌড়ে নীচে নেমে দরজা খুলে দিল। অনিমেষ, আর বেশ কয়েকজন পুলিসের পোশাক পরা লোক ও কয়েকজন সাংবাদিক ও প্রেস ফোটোগ্রাফার ভেতরে ঢুকে এলেন। টুটুলের বাবা ইতিমধ্যে ওঁদের কে আপ্যায়ন করে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলেন। অনিমেষই প্রথম কথা বললেন। – ‘আমরা সত্যসাধনকে জীবিত অবস্থায় ধরতে পারলাম না! টুটুল বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনি ওনার ক্লোজসার্কিট টিভির মনিটর দেখে বুঝেছিলেন যে ওনার ক্রাইমগুলো আর চাপা থাকবে না। তাই পুলিসের হাতে ধরা পড়ার আগেই উনি ওনার ল্যাবরেটরীতে বসে একটা এক্সপ্লোসিভের সাহায্যে…. ‘টুটুলের বাবা বাধা দিয়ে বললেন ‘অনিমেষ তুমি গোড়া থেকে পুরো ব্যাপারটা বল!’ প্রেসের যে ভদ্রলোকেরা এসেছিলেন তাঁরাও বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ স্যার! প্রথম থেকে বললে আমাদের রিপোর্টিং-এ সুবিধে হবে’। অনিমেষ বললেন, ‘বেশ! বলছি। এই ঘটনায় হিরো যদি কেউ থেকে থাকে তবে সে হচ্ছে আমাদের টুটুলবাবু। এনি ওয়ে। ব্যাপারটা গোড়া থেকে শুরু করি।’
-‘বছর দশেক আগের কথা। ১৩/১ মাধবদাস রোডের ঐ হলুদ বাড়িটিতে থাকত একটি ছোট পরিবার। শিবসাধন রায়, বিমলা রায় ও তাঁদের ছেলে সত্যসাধন রায়। সত্যসাধন ছিল খুবই মেধাবী। স্কুল কলেজের পড়া তখন তার শেষ হয়েছে। সে পাড়ী দিল আমেরিকায়। একটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করার সুযোগ পেয়েছে সে। এই সুযোগ ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর তার নিজের প্রিয় বিষয় রোবটিক্স নিয়েই সে কাজ করতে যাচ্ছে যখন! ঐ ইউনিভার্সিটিতে কাজ করতে করতে একটি বিশেষ ধরনের রোবট তৈরীর দিকে তার মনোযোগ আর উৎসাহ বেড়েই চলল। ফলে গবেষণার বিষয় হিসেবেও সে এটাকে বেছে নিল। এই বিশেষ রোবটদের বলা হয় বায়ো-মাইমেটিক রোবট। অর্থাৎ যে ধরণের রোবট কোনও বিশেষ বিশেষ প্রাণীর অনুকরণে তৈরী করা হয়। সত্যসাধনের ঝোঁকটা প্রথম থেকেই পাখীর ওপর পড়ে। ছোটবেলায় ওদের বাড়ীতে কয়েকটা পোষা পাখী ছিল। সেই থেকে পাখীদের ওপর সত্যসাধনের দূর্বলতা। কাজ চলতে লাগল জোর কদমে। কয়েকটা পেপার ও বেরোল রোবটিক্সের কয়েকটি বিখ্যাত জার্নালে। ইতিমধ্যে সত্যসাধন এমন কতকগুলো রোবট তৈরী করল যেগুলো একটা পাখীর দেহের নড়াচড়া, অঙ্গ ভঙ্গী, তার ওড়া এগুলোও প্রায় হুবহু নকল করতে পারে। এই সময় সত্যসাধনের গবেষণা ইউ এস গভর্নমেন্টের নজরে পড়ল। গভর্নমেন্ট থেকে ওকে বিশেষ গ্রান্ট দিয়ে ওদের একটি গোপন গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করার আমন্ত্রণ জানানো হল। এই কেন্দ্রে তখন ড্রোন নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছিল। সত্যসাধন এই আমন্ত্রণ খুব খুশী হয়ে গ্রহণ করল আর ফ্লোরিডার একটি গোপন রিসার্চ ল্যাবরেটরীতে তার কাজ শুরু করল। কাজ তার বেশ ভালই এগোচ্ছিল। এক ধরণের আড়িপাতা ড্রোন যেগুলো দেখতে ছোট ছোট পাখী বা পতঙ্গের মতো, সেইরকম রোবট তৈরীর ক্ষেত্রে সত্যসাধন অভাবনীয় সাফল্য দেখাচ্ছিল। এমন সময়, দেশ থেকে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত শিবসাধনের মৃত্যুর খবর পৌঁছোল সত্যর কাছে। সত্য সঙ্গে সঙ্গে ছুটি নিয়ে কলকাতা চলে এল। এসে শুনল যে শিবসাধন ছুরির আঘাতে মরেছেন। এবং সবার সন্দেহ এ লকেট গুন্ডা আর তার মদের সাকরেদ মদনের কাজ। সত্যসাধন পুলিশের সঙ্গে দেখা করলেন, ওপর মহলে ছোটাছুটি করলেন, কিন্তু লকেট বা মদনকে জেলে পুরতে পারলেন না। কোনও সাক্ষী পাওয়া গেল না। লকেটের অ্যালিবাই ছিল। আর একদিনের ঘটনার ভিত্তিতে শুধু অনুমানের বশে তো কাউকে মার্ডার চার্জে ফেলা যায় না! অতএব, লকেট আর মদন বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। এই ঘটনায় সত্য আরও একটা জোরাল আঘাত পেলেন। সম্ভবতঃ এই সময় থেকেই তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করে। কয়েকদিন কলকাতায় থেকে তিনি আবার আমেরিকায় ফিরে গেলেন। এই অন্যায় হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার সঙ্কল্প করলেন মনে মনে। এই সময় থেকে সত্যসাধন সম্ভবতঃ গোপনে তাঁর রোবটকে কীভাবে ক্ষুদে মারণ ড্রোনে পরিণত করা যায় সেই গবেষণায় ডুবে গেলেন। এর কয়েক বছরের মধ্যে সত্যসাধনের মা আত্মহত্যা করলেন। সত্যসাধন দেশে ফিরলেন, মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শেষ করে আবার ফিরে গেলেন আমেরিকায়। তাঁর মনে তখন প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে! সত্যসাধন তাঁর গবেষণায় অসাধারণ সাফল্য পেলেন। তিনি এমন একটি ড্রোন তৈরী করলেন, যা দেখতে পাখীর মত। হুবহু পাখীর মত নড়াচড়া করতে এবং উড়তে সক্ষম। একজন চালক এই পাখীর নড়াচড়া, উড়ান সবটা একটি কম্প্যুটারের সাহায্যে দূরে বসে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। শুধু তাই না, এর সাহায্যে একটি লক্ষ্যবস্তুকে দূর থেকে বসে কম্প্যুটারের স্ক্রীনে দেখতে পারবে এবং লক্ষ্যস্থির হলে, কী-বোর্ডের একটি বোতামের চাপে এই পাখী ড্রোন থেকে ছুটে যাবে অব্যর্থ একটি গুলি, যার মধ্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর মারণ বিষ সায়ানাইড! গুলির সঙ্গে সঙ্গে এই বিষ লক্ষ্যের শরীরে প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেরে ফেলবে। এই পাখী ড্রোন তৈরী করার পরেই সত্যসাধন ইউ এস গভর্নমেন্টের কাজ ছেড়ে দেশে চলে এলেন। তারপর শুরু হল তাঁর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার খেলা। প্রথমে মারলেন লকেটকে। লকেটকে মারার কয়েকদিন আগে যখন সত্যসাধন তাঁর একটি পাখী ড্রোন যেটি দেখতে ফ্লোরিডা স্ক্র্যাব-জে পাখীর মত, সেটিকে একটা ট্রায়াল হিসেবে এই অঞ্চলের আশপাশে ওড়াচ্ছিলেন, তখন দৈবাৎ সেটি টুটুলের চোখে পড়ে। এইখানেই টুটুলের প্রথম ক্রেডিট! ও যখন জানল যে এই পাখী শুধুমাত্র সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ছাড়া অন্যত্র মেলে না, তখন ও’র মনে কৌতুহল জেগে উঠল যে এ পাখী এখানে এলো কী করে? এর উত্তর পেতে টুটুল পাগল হয়ে উঠল। আর শঙ্করের সঙ্গে কথা বলে যখন জানল যে সত্যসাধন পাখী নিয়ে গবেষণা করেন আর উনি আমেরিকা থেকে সম্প্রতি ফিরেছেন তখন ও’র সন্দেহ হল যে ঐ ফ্লোরিডা স্ক্র্যাব-জে নিশ্চয়ই ওনার পোষা। ইতিমধ্যে শহরে শুরু হয়ে গেছে রহস্যজনক সব হত্যা। সত্যসাধন তাঁর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার পর আরো বড়সড় একটা মারণ খেলায় মাতলেন। তিনি নিজেকে প্রায় ঈশ্বরের মত শক্তিমান ভাবতে শুরু করেছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, যেখানে যত অন্যায়-অবিচার হচ্ছে দূর্বলের ওপর, তার শাস্তি দেবার কর্তা তিনি! আইন নয়। তিনিই ঠিক করবেন কে মরবে তার অন্যায়ের শাস্তি পেতে। সত্যসাধনের মনের অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না। তিনি ক্রমশ বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন। আর একের পর এক খুন করে চলেছিলেন তাঁর মারণ ড্রোন দিয়ে। এরই মধ্যে টুটুলদের বাড়ীতে রবিবারের আড্ডায় টুটুল ড্রোনের বিষয়ে ওর দাদা-দের কথাবার্তা থেকে একটু বিশদে জানতে পারল। সেই আড্ডাতেই টুটুলের দাদা রন্টুর বন্ধু সপ্তক জানাল যে সত্যসাধন নামে একজনকে সে জানত যে রোবট নিয়ে কাজ করত। পাখী নিয়ে নয়। টুটুল একদিন চুপি চুপি সত্যসাধনের বাগানে ঢুকে পড়ল ফ্লোরিডা স্ক্র্যাব-জে খুঁজতে। কিন্তু বাগান খুঁজে আর সত্যসাধনের লাইব্রেরী ঘরে বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে সে পাখীর কোনও সাড়া শব্দ বা দেখা পেল না। বরং লাইব্রেরী জুড়ে নানান কম্প্যূটার আর রোবটিক্সের বই আর বেশ কিছু কম্প্যুটার টার্মিনাল এইসব দেখতে পেল। টুটুলের মনটা ধোঁয়াশায় রইল। তারপর যখন সে তার কাজের মাসীর সঙ্গে তার মায়ের কথোপকথন শুনে সত্যসাধনের বাবার মৃত্যুর কথা জানল, তার মনে একটা অদ্ভুত সন্দেহ দানা বাঁধল! এইখানে আমি টুটুলের আশ্চর্য বুদ্ধি আর কল্পনা শক্তির তারিফ না করে পারছি না (টুটুলের বুকটা গর্বে প্রায় দশহাত হয়ে গেলে কথাটা শুনে)। ও’র মনে হল মদনের হত্যার পেছনে সত্যসাধনের হাত নেই তো? ও আসলে ড্রোনের কথা ভেবেছিল, সত্যসাধনের রোবটিক্সের গবেষণার কথা ভেবেছিল আর লকেটের মৃ্ত্যুর দিন কাছেপিঠে সেই নীল রঙের ফ্লোরিডা-স্ক্র্যাবজেটাকে যে ও দেখেছিল সেটা ও’র মনে পড়েছিল। এইখান থেকে ও’র মনে হল যে আরো ভাল করে জানবে, সত্যসাধন কী নিয়ে গবেষণা করত। সেটা জানতে বল আনতে যাবার ছুতো করে ও আর শঙ্কর ঢুকে পড়ল সত্যসাধনের বাড়ীতে। তারপর লাইব্রেরীতে গিয়ে টুটুল খুঁজে পেল সত্যসাধনের সেই মারন ড্রোন পাখীগুলোকে। কয়েকটার কলকব্জা তখন খোলা ছিল সম্ভবতঃ সত্যসাধন তখন কিছু সারাচ্ছিলেন। ঘর থেকে বেরোনোর মুখে টুটুলের চোখে পড়ল যে একটা কম্প্যুটারের মনিটরে মদনের মৃত শরীরের নানান ফোটো আর ক্লোজ-আপ দেখা যাচ্ছে যেগুলো কাগজে বেরোয়নি। এই যান্ত্রিক পাখীগুলো দেখে আর মদনের মৃতদেহের ওপর থেকে তোলা ছবিগুলো দেখে টুটুল নিঃসন্দেহ হল যে সত্যসাধন ঐ পাখীগুলো এক ধরনের মারণ ড্রোন, আর সত্যসাধন এইগুলোকে চালিয়ে একের পর এক হত্যা করে চলেছেন। ও বাড়ী ফিরে এসে সঙ্গে সঙ্গে সপ্তককে ফোন করে জানল যে সত্যসাধন Biomimetic robot নিয়ে গবেষণা করতেন। তখন ও আর দেরী না করে আমায় ফোনে সব জানাল। ইতিমধ্যে, সত্যসাধনের বোধহয় জানলার কাঁচ ভাঙার ব্যাপারটা নিয়ে কোনও সন্দেহ হয়ে থাকবে। হয়তো টুটুল বেরনোর সময় কোনও শব্দ করে ফেলেছিল! যাই হোক, শঙ্কর চলে গেলে, সত্যসাধন সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরীতে এসে ওনার সি-সি টিভির ফুটেজ দেখে বুঝলেন যে টুটুল লাইব্রেরী ঘরে ঢুকে ছিল। আর সেই সময় যেহেতু যন্ত্রপাতি সব খোলা আর ছড়ানো ছিটনো ছিল, কম্প্যুটের মদনের হত্যার ভিডিও-টা (যেটা উনি ওনার ড্রোনের সাহায্যেই রেকর্ড করেছিলেন) চলছিল। ফলে, উনি বুঝতে পারলেন যে ওনার অপরাধের সরঞ্জাম একজন অন্ততঃ দেখে ফেলেছে। তাই, উনি পুলিসের হাতে ধরা পড়ার সম্ভবনা এড়াতে নিজেকে লাইব্রেরী ঘরে বন্ধ করে এক ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে আত্মহত্যা করলেন। এই কাজটা করার আগে, উনি একটা চিঠি লিখে সেটা ওনার শোয়ার ঘরের টেবিলে চাপা দিয়ে গিয়েছিলেন। এই চিঠিটা ওনার দীর্ঘ স্বীকারোক্তি। এখান থেকেই আমরা জানতে পারি কীভাবে আর কেন উনি এই হত্যাগুলো করেছেন। টুটুল আমায় যে গল্পটা বলেছিল তার সঙ্গে প্রায় সবটাই মিলে গেছে সেটা। সুতরাং এ মামলার একমেবাদ্বিতীয়ম হিরো আমাদের টুটুল বাবু! ব্রাভো! ‘…পুলিসের লোকেরা আর প্রেসের লোকজন অনেক ছবিটবি তুলে, আরও অনেকটা রাত্তিরে চলে যাওয়ার পর, টুটুল বাবার কাছ ঘেঁসে সোফাটায় বসে ফিস ফিস করে বাবাকে বলল, ‘জানো বাবা! আমি মনে মনে সত্যসাধনের একটা নাম দিয়েছিলাম। ‘দ্রোণাচার্য্য’! মানে ড্রোন-আচার্য্য আর কী!’ টুটুলের বাবা ওকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘বাঃ! ভাল নাম ভেবেছিস তো!’ যদিও উনি এতগুলো খুন করেছেন, তবুও ওনার প্রতিভা-কে তো অস্বীকার করা যায় না! এই রকম অসাধারণ একটি যন্ত্র তো ওনার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। ড্রোনের আচার্য্যই বটে!’ টুটুলের মা এবার ওনার স্বভাবসুলভ রাগ রাগ গলায় ছেলেকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, ‘নাও নাও! রাত দুপুরে আর নাম দেওয়া ভাবতে হবে না। যা একটা সাংঘাতিক দিন গেল। এবার আর একটাও কথা নয়! সব্বাই ঘুমোতে যাবে।‘ অতএব গুড নাইট!
Tags: অনিন্দ্য বসু, গল্প, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, দ্রোণাচার্য্য
দারুণ…অসাধারন…ছোট বেলার সন্দীপ রায়ের বা সত্যাজিত রায়ের ছোট গল্পের অনুভুতি হছছিল….proud of u Santul….
ধন্যবাদ!
খুব সুন্দর হয়েছে। তবে পাখিটা নর্থ আমেরিকার না হয়ে কলকাতার শালিক বা চড়াই হলে হয়তো আরও বুদ্ধি খাটিয়ে অপরাধীকে ধরতে হত।
ধন্যবাদ! আসলে পাখীটা নর্থ আমেরিকার হওয়াটাই তো গল্পের ধরতাই ছিল এক অর্থে তাই ঐ ভাবেই গল্পটা সাজিয়েছিলাম আর কী! তবে ভবিষ্যতে কোন লেখা লিখলে এই বিষয়টা মাথার রাখবো।
Excellent! America and Kolkata are not too far from each other over-riding current anti-globalization waves! Good story for kids, fit for mainstream publication.
Thank you! I am glad you liked the story!
Bhison sundor dada. Just loved it. Khali akta kotha boli, chalia jao…👏👏👏
many many thanks to writer for this adventure story.I liked very much.
darunn..eirokom golpo aro asa kori