নক্ষত্রের রাত
লেখক: বিশ্বদীপ দে
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
(১)
আর্ল, ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮
প্রিয় থিও,
কাল রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি।
ঘুম ভেঙে বারবার তোমার কথা মনে হচ্ছে। তোমাকে সব জানাই। কিন্তু এই কথাগুলো লিখতে গিয়ে কেন জানি না কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। স্বপ্ন স্বপ্নই। তবু অন্য সব স্বপ্নের মতো ঘুম ভাঙার পরেও এবার যেন তার রেশ মিলিয়ে যাচ্ছে না। যেন কোনও অর্ধেক আঁকা ছবির মতো। বারবার অর্ধসমাপ্ত ক্যানভাসের সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে।
গত ১৭ তারিখ থেকে এখানে পাকাপাকি ভাবে থাকছি। এই ‘ইয়েলো হাউসে’। ভালোই লাগছে। গত মে মাসে যখন এসেছিলাম, তার তুলনায় অনেকটাই সাজাতে পেরেছি। পাশেই রেস্তোরাঁয় খাওয়ার ব্যবস্থা। বিধবা ভেনিস্যাক, মানে আমার বাড়িওয়ালি, সেই চালায়। তোমাকে হয়তো এগুলো আগেও বলেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে স্বপ্নের ঘোরের কারণেই বোধহয় আবারও বললাম। নাকি বলিনি? দেখেছ আমি এখনও ঘুম, বলা ভালো স্বপ্নের ঘোরটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
তার চেয়ে স্বপ্নটার কথা বলি। যদিও তেমন বলার কিছু নেই। কেননা স্বপ্নটা খানিক একঘেয়েও। মনে হচ্ছিল আমি একটা যাত্রায় বেরিয়ে পড়েছি। কিংবা বেরোইনি। আমাকে কেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানে আমি এখানেই রয়েছি। কিন্তু মাথার উপরের আকাশটা যেন আমার বিছানার কাছে নেমে এসেছে। আর আমি আস্তে আস্তে নক্ষত্রমালার ভিতর দিয়ে ভাসতে ভাসতে সেই আকাশের ভিতর ঢুকে পড়ছি।
ঘুমটা ঝট করে ভেঙে যেতেই মনে পড়ল তোমার কথা। নিশ্চিত করে বলতে পারি না, কিন্তু তারাদের দিকে তাকালেই আমার মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখছি। সেই চিন্তাই কি স্বপ্নের মধ্যে এভাবে ঢুকে পড়ল? জানি না। কেবল মনে হল এটার কথা তোমাকে জানাই। আর লিখতে লিখতেই আমার মনে পড়ে যাচ্ছে গত রাতের কথা।
আসলে কাল রাতে আমি একা ছিলাম না। ‘ক্যাফে ডি লা গের’-এ গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, যে ক্যাফের ছবি আঁকলাম ক’দিন ধরে। আজব জায়গা একখানা। সারা রাতের জন্য খুলে রাখা বিষণ্ণ এক টুকরো পৃথিবী। তোমায় আগেই লিখেছিলাম আমার ‘নাইট ক্যাফে’ ছবিটায় আমি দেখাতে চেয়েছি ক্যাফে একটা এমন জায়গা যেখানে কেউ নিজেকে নষ্ট করে ফেলতে পারে। হয় সে পাগল হয়ে যাবে অথবা কোনও অপরাধ করে বসবে।
যাক সেকথা। এহেন জায়গায় কয়েক দিন ধরেই একজনকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমারই মতো সঙ্গীহীন এক আগন্তুক। অচেনা লোকের সঙ্গে নিজে গিয়ে কথা বলা আমার স্বভাব নয়। কিন্তু এই লোকটাকে দেখলে তা মনে হয় না। কাল সন্ধেয় আমি নিজেই ওর টেবিলে গিয়ে বসলাম। লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায়, একজন স্বপ্নদর্শী। আমারই মতো। ডিম্বাকার মুখটা বড় সুন্দর। ঢেউ খেলানো চুল আর দাড়ির মধ্যে রুপোলি রেখা। ভুরুটা ধবধবে সাদা, যেন শ্বেতপাথরের। আর মাথায় একটা অদ্ভুত টুপি। যেন ডানা গজিয়েছে! হঠাৎ দেখলে তেমনই মনে হয়।
তারপর সামান্য দু’কথার পর আমি বাড়ি ফিরে এলাম। ক’দিন পরপর রাত জেগে ছবি আঁকার ধকলে খানিক ক্লান্তিই পেয়ে বসছিল। ওঠার আগে লোকটার কাছে জানতে চাইলাম ও কি এখানেই থাকবে সারা রাত? যেমন অন্য লোকগুলো থাকবে বলে বসে আছে? ও সামান্য হেসে চুপ করে রইল। বুঝলাম, এ সেই হতভাগ্যদের একজন যার রাতটা কাটানোর মতো জায়গা নেই। পকেটও ফাঁকা। তাই এখানেই বসে থাকবে রাতভর। এরকম এখানে অনেকেই থাকে। কী মনে হল, বলে ফেললাম, তুমি চাইলে রাতটা আমার ওখানে থাকতে পারো।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাসল। আশ্চর্যজনক ভাবে ও একটাও কথা বলছিল না। ভেবেছিলাম লোকটা হয়তো এমনই। স্বল্পভাষী। কিন্তু ওর সঙ্গ আমার ভালো লেগেছিল।
কিন্তু বাড়িতে আসার পর যখন মুখ খুলল চমকে উঠলাম। ওর কণ্ঠস্বর জাদুময়। কেমন একটা ছন্দ রয়েছে। লোকটা অদ্ভুত সব কথা বলছিল। সেসব কথা এর আগে আমাকে কেউ বলেনি। আমরা অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম।
এইবার সব মনে পড়ছে। এক অজানা ব্রহ্মাণ্ডের কথা বলছিল ও। ওর কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই চোখ চলে যাচ্ছিল জানলার বাইরে আকাশের দিকে। মনে হচ্ছিল, এই নক্ষত্র আর আমরা ছাড়া অন্য সব কিছু যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তারপর রাত আরও খানিক গড়াতেই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। আর ঘুমনোর পর শুরু হল স্বপ্ন দেখা। এমন স্বপ্ন আমি কখনও দেখিনি।
স্বপ্নের ভিতরে আমি একা ছিলাম না। সেই আগন্তুক, আমার সেই নতুন বন্ধুও ছিল। সেও ভেসে যাচ্ছিল তারার আলোকিত উদ্ভাসের ভিতর দিয়ে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। কিন্তু যাচ্ছি। তারপর কী যেন একটা কারণে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আতঙ্কে চিৎকার করতে ইচ্ছে হল। আর তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল।
ঘুম থেকে উঠে দেখি ও চলে গেছে। পাশের বিছানাটায় ঘুমোচ্ছিল। চাদরটা এখনও কুঁচকে আছে। যেন এইমাত্র এখানে ছিল। আমি ঘুম ভেঙে উঠে বসতেই বেরিয়ে গিয়েছে। আসলে ভোর হওয়ার আগেই হয়তো উঠে বেরিয়ে গিয়েছে। অদ্ভুত লোক!
এখন জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখতে পাচ্ছি উজ্জ্বল হলুদ রোদ্দুরে ভরে আছে চারপাশ। মাথাটা এখনও ভার হয়ে আছে। আরও খানিক বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। এই চিঠি এবার ছাড়তে হবে। ভালো থেকো। উষ্ণ করমর্দন।
চিরদিনের তোমার
ভিনসেন্ট
(২)
আর্ল, ২৬ ডিসেম্বর ১৮৮৮
প্রিয় ভিনসেন্ট,
জানি না এই চিঠি আদৌ তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারব কিনা। কিন্তু হাসপাতালে তোমাকে দেখতে যাওয়ার হিম্মত নেই। এক বেশ্যাখানার দাসীর পক্ষে সেটা বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে, তাই না? তা ছাড়া তোমার সঙ্গে থাকা মানেই আবার থানা-পুলিশের ভয়। আমি তোমাকে কোনও দিনও ক্ষমা করতে পারব না বাপু। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক, তোমাকে চিরকালই ভালোবাসব।
আচ্ছা, নিজের কাটা কানটা কাগজে মুড়িয়ে তুমি আমায় দিয়ে গেলে কোন সাহসে? আমি তখন যদি পুলিশকে না জানাতাম কেউ জানতেও পারত না নিজের ঘরে মরে কাঠ হয়ে পড়ে থাকতে তুমি! ভালোবাসা? একে তুমি ভালোবাসা বলবে? সবাই ঠিকই বলে তোমায়। লালচুলের পাগল!
তোমার জন্য তোমার ওই বন্ধু গগ্যাঁ, ওকেও তো ভুগতে হয়েছে। পুলিশ ওকে গ্রেফতার করেছিল তোমায় খুনের দায়ে। আসলে তখনও কেউ ভাবতে পারেনি তুমি বেঁচে আছ। ভাবছ কী করে জানলাম? এসব খবর এখানে সবাই জানে। আমি ঠিক করে ফেলেছি তোমায় ছায়াও আর মাড়াব না এ জীবনে। তুমি কোনদিন আমাকেও বিপদে ফেলে দেবে নির্ঘাত।
এখনও বলছি, নিজেকে শুধরে নাও। নাহলে তোমাকে সবাই পাগলা গারদে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দেবে। অবশ্য করাই উচিত। তুমি কি বলতে চাও তুমি পাগল নও? পাগল না হলে কেউ ওরকম সব কথা বলে?
জানি এ চিঠি কোনওদিনই তোমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে না। তবু এই চিঠি লিখেই তোমার সঙ্গে কথা বলছি। তোমাকে, তোমার মতন উদ্ভট লোককে দেখলে মায়া হয় আমার।
বাঁচতে চাইলে নেশা ছাড়ো। নেশায় তোমার শরীর ভেঙে পড়ছে। নাহলে তুমি যে সব স্বপ্ন দেখো, সাধারণ লোক কখনও দেখবে না। আমি মূর্খ মেয়েমানুষ, অত ভাষা, অত জ্ঞান আমার নেই। তুমি শিল্পী। তোমাকে এসব বলার যোগ্যতা আমার নেই। তবু বলি, সুস্থ থাকার চেয়ে ভালো কিছু তো নেই।
আমার ক্ষত সারতে এখনও সময় লাগবে। তুমি যদি সম্পূর্ণ পাগল না হয়ে গিয়ে থাক, তোমার মনে থাকা উচিত গত বছর কুকুরের কামড়ে আমার হাতটা দফারফা হয়ে গিয়েছে। আমার ক্ষতস্থানে তুমি হাত বুলিয়ে দিতে। সেই তুমিই নিজের শরীরে এত বড় ক্ষত তৈরি করলে কেন? কেন? তোমায় হয়তো আর পাব না। আর তুমিও আমায় ভুলে যাবে। কিন্তু নিজের ক্ষত সারানোর চিকিৎসার খরচ জোগাতে এখানে আমায় আসতেই হবে। গরিব মানুষ খেটে খাই, তোমার মতো নেশা করে আজব স্বপ্ন দেখলে আমার চলবে না। আর যতবার আসব তোমার কথা মনে পড়বে।
সেদিন তুমি কী বলে গিয়েছিলে পাগলের মতো, মনে পড়ে তোমার? কাগজে মোড়ানো ওই কানটা যখন তুমি আমায় দিলে? প্রত্যেকটা কথা মনে আছে। বিড়বিড় করতে করতে বলছিলে, গঁগ্যা চলে গেলে তুমি আবার একা হয়ে যাবে। তোমার মাথার মধ্যে সব সময় যেন একটা সুর ভেসে আসছে। যেন কে ডাক পাঠাচ্ছে। কীসের ডাক? কোথায় যেতে চাও তুমি? কী যে ছাইপাশ বলে যাচ্ছিলে!
তুমি মানুষটা ভালো। কিন্তু তোমার মাথাটা একদম ঠিক নেই। সেরে ওঠো ভিনসেন্ট। তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
ইতি তোমার
র্যাচেল
(৩)
আর্ল, লামার্টিন, ফেব্রুয়ারি ২৭ ১৮৮৯
মঁসিয়ে মেয়র,
আপনাকে এই চিঠি লিখছি বিবেকের তাড়নায়। আপনি অবশ্যই অবগত যে গতকাল ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ বা ভুড, যাকে এলাকায় সবাই ‘লালচুলের পাগল’ বলেই চেনে, তাকে পুলিশ আটক করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যে পিটিশন জমা পড়েছিল, তারই ভিত্তিতে ওকে আবারও হাসপাতালে পাঠানো হল। হাসপাতালে লোকটা এই প্রথম গেল, তা নয়। কিন্তু এবার যেভাবে জোর করে সবাই মিলে ওকে তাড়াল আমার সেটা ভালো লাগেনি। এলাকার অধিকাংশই একমত লোকটা বদ্ধ পাগল হয়ে উঠেছে। যদিও এখনও খুব বেশি ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই যে হয়ে উঠবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং যা মনে হচ্ছে, ও সেই পথেই যাচ্ছে। এলোপাথাড়ি লোকজনকে আক্রমণ করছে। মেয়েদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। অশ্লীল কথা বলছে। সবাই আতঙ্কিত ওকে নিয়ে।
এমন একটা লোকের পক্ষ নিয়ে চিঠি লিখছি বলে আপনার হয়তো অবাক লাগছে। এলাকার লোকজন জানলে হয়তো আমাকেও হাসপাতালে পাঠাবে। সবচেয়ে বড় কথা, ওই পিটিশনে ‘এফ’ নামের যে ৪৫ বছরের মানুষটার সই আছে, সেটা আমি। ক্যাফের দেখাশোনা করি। সকলের দেখাদেখি আমিও সই করেছি। কিন্তু এখন বিবেকের দংশনে ভুগছি। আর তাই আপনাকে এই চিঠি।
আসলে গত পরশু রাতে আমি যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন আমার সঙ্গে ভিনসেন্টের দেখা হয়। রন নদীর তীরে। আমাদের এখান থেকে রন নদী একেবারেই সামনে। দু’-এক মিনিটের পথ। আমি রাতের বেলা বাড়ি ফেরার আগে কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়াই। সেদিনও দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি, ভিনসেন্ট হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকার আকাশে ঝলমল করছে তারা। দেখার মতোই দৃশ্য। কিন্তু ওই আবছা আলোতেও মনে হল ভুডের দৃষ্টিতে অন্য কিছু একটা আছে। ও যেন আরও অন্য কিছু খুঁজছে।
আমাকে দেখে মৃদু হাসল। মনে হল না এই লোকটাই ক’দিন ধরে এলাকার মানুষদের উত্যক্ত করে মেরেছে। ওই আলো-আঁধারির মধ্যে আমাকে দেখে ও বলল, ‘‘ক’মাস আগে একটা ছবি এঁকেছিলাম ঠিক এই দৃশ্যটাকে নিয়ে। কিন্তু মাথার উপরের ওই আকাশটাকে ক্যানভাসে ফোটানোর ক্ষমতা আমার নেই।’’ এরপরে ও যা বলল, তাতে আমার ওর উপরে মায়াই হল। লোকটা আমাকে বিশ্বাস করে। সাধারণত কারও সঙ্গেই খুব একটা কথা বলে না। আমার সঙ্গেও যে খুব বলে তা নয়। কিন্তু চোখাচুখি হলে বরাবরই হাসে। হয়তো ওর মনে হয় আমি ওকে বন্ধু বলে মনে করি। ও তো আর জানে না ওর বিরুদ্ধে পিটিশনে আমারও সই রয়েছে। কিংবা সেই সময় হয়তো ওর এসব মনেও ছিল না। মনে হচ্ছিল, লোকটা কোথাও নেই!
ভুডের বক্তব্য, ওর বরাবরই মনে হয় রাত অনেক বেশি জীবন্ত আর দিনের থেকে বেশি রঙিন। ও নাকি ওর ছবিতেও সেটা আনতে চাইছে। স্বপ্নের ভিতরে ও সুদূর মহাকাশের নক্ষত্র থেকে নক্ষত্র ছুঁয়ে কী এক অনর্গল সুর বয়ে যেতে দেখেছে! এই চেনা জগতের আড়ালে রয়েছে এমন এক জগৎ, যা আমাদের চেতনার জগৎ, এই বিশ্বের সীমার বাইরে। সেই জগতের সন্ধান নাকি মানুষ কেবল স্বপ্নেই পেতে পারে। ও সেই স্বপ্নকে আঁকতে চায়। ওর বিশ্বাস একদিন সেটা পারবেই। কিন্তু স্বপ্নগুলো নাকি শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায় তীব্র ভয়ে। তখন আর ওর মাথার ঠিক থাকে না। কী করে বসে কোনও ঠিক নেই।
এসব কথা যে বলে সে যে আর সুস্থ নেই তা তো সহজেই বোঝা যাচ্ছে। সব থেকে বড় কথা, কথাগুলো ও ঠিক আমাকেও বলছিল না। মনে হচ্ছিল, নিজেকেই বলছে। কেমন থমকে থমকে। স্বগতোক্তির মতো ঠোঁট চেপে। ওর শুশ্রুষা প্রয়োজন। তাই ওকে হাসপাতালে পাঠানোয় আমার আপত্তি নেই। কিন্তু যেমন ঘৃণা ওর সম্পর্কে সকলে উগরে দিচ্ছে, তাতে তীব্র আপত্তি আছে। আর যাই হোক, ক্ষতিকারক তো ছিল না মানুষটা।
এই চিঠি নেহাতই নিজের বিবেককে সান্ত্বনা দিতে লেখা। পড়া হয়ে গেলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিতে পারেন। তবে একটাই অনুরোধ, লোকটা সুস্থ হলে ওকে যেন এখানে আবার থাকতে দেওয়া হয়। মহামান্য, সেটুকু আপনি যদি দয়া করে নিশ্চিত করেন বাধিত হব।
ইতি
এফ
(৪)
আর্ল, ৯ মে ১৮৮৯
প্রিয়তমা,
এখন অনেক রাত। জানলার বাইরে খোলা আকাশের বুকে জ্বলতে থাকা নক্ষত্রগুলিকে দেখে বারবার একজনের কথা মনে পড়ছে। ভিনসেন্ট। এরকম অদ্ভুত লোক আমি আমার জীবনে আর দেখিনি। পাঁচ মাসও হয়নি ওঁকে চিনি। তবু মায়া পড়ে গিয়েছে। ওঁর আঁকা আমি দেখেছি। স্বীকার করছি চিত্রকর হিসেবে আমার ওঁকে খুব দরের মনে হয়নি। আমার একটা পোট্রেট উনি এঁকে দিয়েছিলেন। সেটা আমার একেবারেই পছন্দ হয়নি। মা’রও বেজায় অপছন্দ ছবিটা। মা তো ওটাকে মুরগির ঘরের ফুটো ঢেকে রাখতে ব্যবহার করছে।
কিন্তু ভিনসেন্ট নিজে এক জীবন্ত বিস্ময়। তুমি ওকে এক-আধবার দেখেছ। অবশেষে গতকাল উনি স্যাঁ রেমির পাগলা গারদে ভর্তি হয়েছেন। হ্যাঁ, নিজেই। আমি ওর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি।
গত ক্রিসমাসের আগের দিন একেবারে সকালে ওঁকে আমি প্রথমবার দেখি। আমার রাতের ডিউটি ছিল। একজন ইন্টার্নকে কতটা খাটতে হয়, সে তো তুমি জানোই। সেদিনও হয়েছিল। সকালের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছে। তখনই দেখলাম পুলিশ ওঁকে নিয়ে এল এখানে। নিজেই নিজের কান কেটে ফেলেছে একটা লোক! প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। হ্যালুসিনেশনে ভুগছেন। রোগাটে মুখ। পাগলাটে দৃষ্টি।
প্রথম দেখাতেই কেমন মায়া পড়ে গেল। আমি ওঁকে সুস্থ করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো আমার প্রতি ওঁর একটা টান গড়ে উঠেছিল দ্রুত। এই আর্লে খুব বেশি মানুষের সঙ্গে ওঁর সখ্য গড়ে ওঠেনি। বুঝতাম মানুষটা অসম্ভব একা। কেবল ক্যানভাসটা ছাড়া ওঁর বুঝি আর কেউ নেই। ও হ্যাঁ, এক ভাই আছে। প্রাণাধিক প্রিয়। থিও। এ ছাড়া মা-বোন এরাও রয়েছে। কিন্তু তাও মানুষটা অসম্ভব একলা।
একটু সুস্থ হওয়ার পর উনি আমাকে বলেছিলেন ওঁর জীবন নাকি অনেক পাল্টে গেছে। কিছুদিন সব ঠিক থাকে। আবার মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে আশ্চর্য সব স্বপ্ন আসে।
ক’দিন আগের কথা বলি। বেশ রাত হয়ে গেছে। আমরা খানিকটা মদ পান করার পর চুপ করে বসে আছি। জানলার বাইরে ঠিক আজকেরই মতো ঝলমলে তারাভরা রাত।
হঠাৎ ভিনসেন্ট বললেন, ‘‘ড. রে, আপনাকে একটা কথা বলব?’’ তারপর আমার সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘হাসপাতালে আমাকে দেখতে যে এক সুন্দর পুরুষ এসেছিল, আপনি তাকে দেখেছিলেন? ও ক’দিন আগে এখানেও এসেছিল।’’
আমি অবাক হলাম। উনি যেমন বর্ণনা দিচ্ছেন, তেমন কাউকে আমি কখনও দেখিনি। অথচ ওঁর দাবি আমি ঘরে ঢোকার সময়ও নাকি ওঁর সেই বন্ধু এই ঘরেই ছিল। কী আর বলব? অসুস্থ মানুষ, তাঁকে তো আর বলা যায় না সবই ওঁর কল্পনা।
অথচ ভিনসেন্টের মতে মাঝেমাঝেই নাকি ওই বন্ধু ওঁর সঙ্গে দেখা করে। সে-ও নাকি এক স্বপ্নদর্শী মানুষ। কিন্তু ঘুমোতে চায় না। ঘুমের ভিতর দিয়ে কোনও অজানা জগতের দরজা নাকি খুলে ফেলতে শুরু করেছে। তাই ভয়ে আর ঘুমোতে চায় না। জোর করে জেগে থাকে রাতের পর রাত।
বলতে বলতে থেমে গেল ভিনসেন্ট। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘জানি আপনিও আমাকে পাগলই মনে করেন। সেই যে গত ফেব্রুয়ারিতে সবাই মিলে পিটিশন দিয়ে আমাকে পাগল প্রতিপন্ন করল, তারপর থেকে আমার আতঙ্ক আরও বেড়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন একটা কুঠুরিতে আমাকে বন্ধ করে রেখেছিল ওরা। সেই অন্ধকার কুঠুরির মধ্যে রাতের পর রাত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে গিয়েছি। আর মাঝে মাঝেই অপার্থিব আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠেছি। আমি সেসব আপনাকে বলতেও চাই না।’’
বুঝলাম মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। বললাম, ‘‘থাক না। এসব কথা আপনি ভুলে যান।’’
ভিনসেন্ট বিষণ্ণ হাসল। বলল, ‘‘মাঝে ক’টা দিন ভালোও কেটেছে। কিন্তু আবারও আক্রমণ হতে পারে। তাই মনে হচ্ছে এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার।’’
ওর সিদ্ধান্তে কোনও ভুল নেই। আশা করি স্যাঁ রেমিতে ওঁর ভালো চিকিৎসা হবে। তুমিও ওঁর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কোরো।
শিগগিরি দেখা হবে। ভালো থেকো।
শুধু তোমার
ফেলিক্স
(৫)
স্যাঁ রেমি, ১ আগস্ট ১৮৮৯
বন্ধু গগ্যাঁ,
ভেবেছিলাম সুস্থ হয়ে উঠব। গত জুন মাসে ক্যাফে ভলপিনি-তে তোমরা যে প্রদর্শনী করেছিলে তাতে যোগ দিতে পারিনি। থিও-ই বারণ করেছিল। আমিও বেশি জোর করিনি। কারণ তখন তো ভালো হয়ে উঠছিলাম। ভেবেছিলাম সেরে উঠলে পরে আবার এমন কিছু হলে তখন যোগ দেব। কিন্তু মনে হয় না, তেমন কিছু আর কখনও হবে।
একটা ঘোরের মধ্যে এই চিঠি লিখছি। জানি না আর কখনও ব্রাশ হাতে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়াতে পারব কি না। কিন্তু তুমিই বলো, সব কিছু কি এভাবে শেষ হতে দেওয়া যায়? একেক সময় এত ভালো থাকি! ছবির পর ছবি এঁকে যাই! কিন্তু আচমকাই আবার সব বদলে যেতে থাকে।
এর আগে এখানে এমন পাগল দেখেছি যারা দিনরাত চিৎকার করে চলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিকট চিৎকার। কিন্তু এখানকার সবারই বিপুল ধৈর্য। তারা ঠিক সামলে নেয়। শুনছি, আমিও নাকি মাঝেমধ্যে চিৎকার করে উঠছি। সপ্তাহ দুয়েক হল এটা হচ্ছে। নিজেকে নিয়ে নিজেই আতঙ্কে থাকি। আমিও ওরকম বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি না তো?
আমি জানি, আমার উন্মত্ততা নিয়ে তুমি নিঃসন্দেহ। গত ডিসেম্বরের স্মৃতি এখনও তোমায় তাড়া করে। আসলে তুমি ‘ইয়েলো হাউস’-এ একসঙ্গে থাকতে শুরু করার পর আমার ভিতরে পাক খেতে থাকা অশান্তি অনেক স্তিমিত হয়েছিল। দু’জনে মিলে ছবি আঁকা, মন্টপিলিয়ের যাওয়া… ওহ! তারপর আবারও সেই আক্রমণ। জানি তুমি বুঝবে না, তবু এখন এই কথাগুলো লিখে রাখা দরকার বলে মনে করি। তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা, ক্যাফেতে গ্লাস ছুড়ে মারা এসব যখন করেছি, বিশ্বাস করো বন্ধু, আমি যেন আমার মধ্যে ছিলাম না। আর তারপর তোমার দিকে রেজার হাতে ছুটে যাওয়া।! কী করে পারলাম? নিরিবিলি রাস্তায় একা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে আমাকে ওই ভাবে দেখে তুমি আতঙ্কিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তুমি পুলিশকে বলে গিয়েছিলে, তুমি প্যারিসে ফিরে যাচ্ছ, কারণ তোমাকে দেখলে আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ব। থিও আমাকে সব বলেছে। কিন্তু কী করে বোঝাই বন্ধু, তোমার উপরে আমার কোনও রাগ নেই। তবে এটা ঠিকই, তোমার সঙ্গে যা করেছি ঠিক করিনি। কান কেটে ফেলার পর যদি মরেই যেতাম পুলিশ তোমাকে ছাড়ত না। মিথ্যে খুনের দায়ে ফেঁসে যেতে তুমি। পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো বন্ধু।
আসলে কী জানো, ভালো থাকতে থাকতেই অদ্ভুত স্বপ্নগুলো আমার জীবনে ফিরে ফিরে আসে। আর সমস্ত সুতো যেন কেউ ছিঁড়ে দিতে থাকে। এই নশ্বর জীবনের চেনা ছক, চেনা জ্ঞানের থেকে বহু দূরের কোন অস্তিত্ব একেবারে আমার শিকড় ধরে টান মারে আর হিড়হিড় করে সরিয়ে নিয়ে যায় না জানি কোন সুদূর জগতে। তোমাকে কি কখনও বলেছি সেই স্বপ্নের কথা? আমার মনে নেই। আমার এখন কিছুই মনে পড়ছে না বন্ধু।
তোমার কাছে এসবই আমার মানসিক বৈকল্যের লক্ষণ মনে হতে পারে। কিন্তু অনুভবে যা বুঝেছি, তাকে মিথ্যে বলে ভাবতে পারা যায় কি?
ছবির কথায় আসি। তোমাকে বলেছিলাম মনে পড়ে, রাতের আকাশ আমায় কেমন টানে? নক্ষত্রের রাত। সেই ছবিই এঁকেছি কিছুদিন আগে। কিছুদিন নাকি কয়েক সপ্তাহ? মনে করতে পারছি না। বললামই তো মাথাটা কাজ করছে না।
আমাকে এখানে ছবি আঁকিয়ে হিসেবে এরা বেশ খাতির করে। কেবল দোতলায় একটা সুন্দর ঘর দিয়েছে তাই নয়। ছবি আঁকার জন্য নীচতলাতেও একটা ঘর দিয়েছে। ওটাই আমার স্টুডিয়ো। তবে দোতলার ঘরে রং-তুলি ব্যবহারের অনুমতি নেই। রাতে তাই ঘরে বসে কাগজে পেনসিল দিয়েই ছবি এঁকেছি।
আমার এক বন্ধু আমাকে সেই স্বপ্নের হদিস প্রথমবার দিয়েছিল। আসলে এই ক’দিন ওই স্বপ্ন বারবার হানা দিয়েছে ঘুমের মধ্যে। সেই নিষিদ্ধ স্বপ্ন। হ্যাঁ, নিষিদ্ধই মনে হয় সেই স্বপ্নকে। কেবলই মনে হয় আমি এক অনধিকারীর মতো প্রবেশ করে ফেলেছি মানুষের বোধের অতীত এক জগতে। যা যা দেখেছি আর অনুভব করেছি, সেই ভয়ঙ্কর ও অপার্থিব অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার মতো চিহ্ন ও সংকেত পৃথিবীর কোনও ভাষার ভাণ্ডারেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর বুঝতে পারি সেই স্বপ্নের আড়ালে এমন কিছু রয়েছে যার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। এ সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও ক্রমশ সেই ভয়ঙ্করতার একটা ছায়ার আঁচ পাচ্ছি। কিন্তু সে ব্যাপারে কিচ্ছু বলার মতো ক্ষমতা, বলা ভালো সাহস আমার নেই। কেবল ঘুমের গোপনে কোন মহা অস্তিত্বের ছায়া আমার সব এলোমেলো করে দিতে থাকে। সেই অচেনা জগতের আরও গভীরে যাওয়ার ইচ্ছে আর অন্যদিকে এক ভয়ঙ্করের আভাস আমার মধ্যে প্রবল দোলাচল তৈরি করতে। স্বপ্নকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে থাকে এমন এক আতঙ্ক, বলে বোঝাতে পারব না।
একেক দিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যেত। দেখতাম জানলার বাইরে তখনও জ্বলজ্বল করছে একটা বিরাট তারা। কত বড়! আমার স্বপ্নে দেখা সেই আকাশটা আঁকতে ইচ্ছে করত। কাগজ নিয়ে বসতাম। দেখতাম বাইরে দিগন্ত পর্যন্ত কেউ যেন প্রশান্তির একটা প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে। গ্রাম্য প্রকৃতি আর বইতে থাকা হাওয়া এসে মনের ভিতর থেকে সেই স্বপ্নের সঙ্গে লড়ার সাহস দিত।
বহু স্কেচ করেছি, জানো? কুড়ি-একুশটা স্কেচের পর অবশেষে আসল ছবিটা এঁকেছি। কিন্তু কী জানো এত খেটেও লাভ হয়নি। ‘দ্য স্টারি নাইট’ ছবি হিসেবে ব্যর্থ।
গম খেত, পাহাড়, অলিভ গাছ এসব ঠিকই আছে। সাইপ্রেস গাছটাও। কিন্তু রাতের আকাশের তন্ময়তা কই? স্বপ্নের ভিতরে দেখা সেই অচেনা ব্রহ্মাণ্ড? তার আভাসটুকুও যদি আনতে পারতাম।
সেই স্বপ্ন যেমন আশ্চর্যের, তেমনই আতঙ্কের। সেই আতঙ্ক, সেই বিস্ময়কে ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। সামান্যটুকু পেরেছি। বাকিটা কখনও পারব না বোধহয়। হয়তো ভাষায় তাকে প্রকাশ করা যায়, কখনও কেউ করবেও। কোনও অসীম প্রতিভাবান লেখক।
কিন্তু একজন শিল্পী হিসেবে সেই সত্যকে আমি ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না ক্যানভাসে, এটা চরম ব্যর্থতা নয়? গত দু’বছরে অনেক ছবি আঁকলেও রাতের আকাশ আঁকতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। রন নদীর তীরের ছবিতে পারিনি। ক্যাফে টেরাসের রাতের ছবিতেও নয়। এবারও পারলাম না। কখনও পারব কি? কোনওদিন?
অথচ মনের ভিতরে ক্রমেই স্পষ্ট জমে রয়েছে ছবিটা। আকাশের তারাকে একেবারে অন্য রকম ভাবে দেখিয়েছি। কিন্তু হায়, তাও যে আমার স্বপ্নের ধারেকাছেও যায়নি। আবার কি চেষ্টা করা উচিত? তুমি কি মনে করো বন্ধু?
কেন জানি না মনে হচ্ছে, হয়তো আর বেশি সময় হাতে নেই। ভালো থেকো।
তোমার
ভিনসেন্ট
(৬)
স্যাঁ রেমি, ২৫ ফেব্রুয়ারি
প্রিয় থিও,
কাল বন্ধু চলে গেছে। আর আসবে না।
আমি আর্ল-এ গিয়েছিলাম দু’দিনের জন্য। তারপর এমন হল, আমাকে গাড়িতে স্যাঁ রেমি-তে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। ড.পেরঁ বারবার জানতে চাইছেন আগের দিন রাতে কী হয়েছিল। আমি বলিনি। কী করে বলব ওই দিন রাতে আমি আর বন্ধু একসঙ্গেই ছিলাম। অনেক দিন পর দেখা। গল্প আর পান করতে করতে রাত গড়াল। তারপর রাতে আবারও স্বপ্নের ভিতরে আমরা সেই দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলাম। থিও, আমি ভাবতেও পারছি না আমার বন্ধু আর স্বপ্ন থেকে ফিরবে না। আর আমিও এমন এক অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলাম, হয়তো ফিরতে পারতাম না।
আমি কি খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম? সম্ভবত। হোটেলের অন্য ঘর থেকে লোক ছুটে এসেছিল। আমি যত বলি, আমার বন্ধু কই? ওরা তত গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল। তারপর গাড়ি এল। সেই থেকে অস্থির হয়ে আছি।
আমি আর লিখতে পারছি না। হাত কাঁপছে।
(৭)
প্যারিস, ২৪ এপ্রিল ১৮৯০
প্রিয় বোন,
একটা ভালো খবর দিই। ভিনসেন্ট অনেকটা সেরে উঠেছে। এবারের মতো এত দীর্ঘ সময় ও কখনও অসুস্থ থাকেনি। সেই ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে চলছে। তোমারও চিন্তা হচ্ছে জানি। তাই লিখলাম। আশা করা যায় আর দিনকয়েকের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্যারিসে একটা প্রদর্শনীতে ভিনসেন্টের ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। ছবিগুলি উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। কাল লোকেরা আমায় ডেকে ডেকে প্রশংসা করেছে। কেউ যখন ওর সম্পর্কে এমন বলে আমার এত ভালো লাগে যে কী বলব। ঈশ্বরের কাছে প্রতি মুহূর্তে প্রার্থনা করে চলি যেন ও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। আসলে ভিনসেন্ট ভালো আছে, সুখে আছে— এই পৃথিবীতে এটা জানার চেয়ে বেশি শান্তি আমি আর অন্য কোনও কিছুতে পাই না।
গত ফেব্রুয়ারিতে আর্ল-এ যাওয়াটাই ওর কাল হল। দু’দিন থেকেই এমন অসুস্থ হল, গাড়িতে করে ওকে স্যাঁ রেমিতে ফেরাতে হল। তার আগের রাতে ও যে কোথায় ছিল জানাই যায় না। একটা ছবি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল, সেটাও আর পাওয়া যায়নি।
গত ১৫ মার্চ ওর শেষ চিঠি পেয়েছি। সেটাতে ও বারবার লিখেছে, মাথাটা একদম পরিষ্কার নেই। ব্যথা-ট্যথা কিছু হচ্ছে না, কেবল কেমন একটা হতভম্ব ভাব।
অসুস্থ হওয়ার পর একবারই ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। এপ্রিলের গোড়ায়। ও অবশ্য জানে না। তখন ও ঘুমোচ্ছিল। আমি ডাকার চেষ্টা করিনি। মূলত ড. পেরঁ-র সঙ্গেই কথা বলতে গিয়েছিলাম।
উনি কতগুলো অদ্ভুত কথা বললেন। বেশ কয়েক মাস ধরেই দেখছেন তো। ভিনসেন্ট সম্পর্কে ওঁর পর্যবেক্ষণটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উনি বললেন, ভিনসেন্ট নাকি ঘোরের মধ্যে বেশ কয়েকটা নাম নেয়। আমার কথা বলে। জো এবং আমাদের সন্তানের কথা বলে। গঁগ্যা বা ওর অন্য শিল্পী বন্ধুদের কথাও। কিন্তু সেই সঙ্গে আরও একজনের কথাও ও বলে। বারবার ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করে। সে যে কে, তাতেই ধাঁধা।
এরপর ডক্টর তিনটি চিঠি আমায় দেখান। দু’টো আমায় লেখা। তার একটা অসমাপ্ত। অন্য চিঠিটা গঁগ্যাকে লেখা। কিন্তু এই চিঠিগুলো কেন ভিনসেন্ট পোস্ট করেনি সেটা বুঝলাম ওগুলো পড়ার পরেই। ও আমাকে সামনাসামনি এমন কোনও লোকের কথা বলেনি। হয়তো এই নিয়ে আমাকে কিছু জানাতে চায়নি। জানি না কেন। আমার মনে হচ্ছে, সেই লোককে আমি চিনতেও পেরেছি। কিন্তু হিসেব মেলাতে পারছি না।
ড. ফেলিক্স রে-কে তোমার মনে আছে? আর্ল-এ থাকাকালীন যে তরুণ চিকিৎসক ওর চিকিৎসা করেছিল। তার ঠিকানা জোগাড় করে তাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। উত্তরে জানলাম, সেই বন্ধুর কথা একদিন আবেগের বশে ড. রে-কেও বলেছে ভিনসেন্ট। হয়তো আমাকেও বলবে ভেবেছিল সামনাসামনি। তাই চিঠি পোস্ট করেনি। একই কাণ্ড করেছে গঁগ্যার বেলাতেও।
এ সম্পর্কে আমি বোধহয় একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি। আসলে ভিনসেন্ট কাগজে পেন দিয়ে একটা ছবি এঁকেছিল। তারপর সেটা কেটে দিয়েছে। কাগজটা মুড়িয়ে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলতে গিয়েছিল। পারেনি। সেটা ওর খাটের পাশেই পড়ে ছিল।
আমি ওকে দেখতে গিয়ে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে প্যারিসে ফিরে আসি। একটা মুখের ছবি। বলা যায় প্রাথমিক স্কেচ। পছন্দ হয়নি বলে কেটে দিয়েছে। ছবির তলায় কয়েকবার লেখা ‘বন্ধু’। শেষে সেটাও কেটে দেওয়া।
যদিও এলোমেলো ভাঁজ করা, কাটাকুটি করা। তার ওপর পেনসিল স্কেচ বলে খানিক ঝাপসাও হয়ে এসেছে। তবু ছবিটা দেখেই কেমন চেনা চেনা লাগছিল। সন্দেহ নিরসন করতে লাইব্রেরি যাই। আর তারপর গ্রিক পুরাণের বই ঘেঁটে একটা ছবি আমি খুঁজে পাই। এই ছবি আমি আগেও দেখেছি। তাই চেনা লাগছিল। বইয়ের পাতায় দেখার পর নিশ্চিত হই আমি যা ভাবছি তাই। সৌম্য ও সুন্দর মুখ। কানের দু’পাশ দিয়ে বেরিয়েছে একজোড়া ডানা।
ভিনসেন্টের সেই রহস্যময় বন্ধু, যে ওকে ঘুমের ভিতর দিয়ে এক অচেনা দুনিয়ায় নিয়ে যেতে চায়, সে কোনও মানুষ নয়। তার নাম হিপনোস। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী ঘুমের দেবতা।
তোমাদের
থিও
পুনশ্চ। তুমি খুব ভালো লেখ। ভিনসেন্ট তোমার কত প্রশংসা করে। বলে, তুমি এমন ভাবে নিসর্গ দৃশ্য বা শহরের দৃশ্য বর্ণনা করো যেন মনে হয় কোনও গল্প-উপন্যাস পড়ছি। তোমার মতো সংবেদী মানুষকে এই অদ্ভুত ঘটনার কথা জানালাম। সবাই এসব বোঝে না। জো-কে বলেছি। আমার স্ত্রী-ও তোমার মতো। নইলে ভিনসেন্টকে বোঝার ক্ষমতা ক’জনের আছে বলো? অবশ্য আরও গভীরে ভেবে দেখলে মনে হয়, কারওই কি আছে?
(৮)
বোস্টন, ২০ জুন ১৮৯০
শ্রদ্ধেয় ড. পল গাশে,
ড. ফার্গুসনের কাছ থেকে আপনার ঠিকানা পেয়েছি। আপনার সঙ্গে ওঁর সখ্যের কথা জানি। শুনেছি নিয়মিত পত্রালাপের মাধ্যমে আপনারা দু’জনে বিভিন্ন কেস নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। দু’মাস হয়ে গেল আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। উনিই আমায় বললেন, আমার সমস্যাটার কথা যেন আপনাকে লিখে জানাই। পরে উনিও চিঠি লিখবেন। যদিও আমি সুলেখক নই, তবু চেষ্টা করছি।
পেশায় আমি একজন সেলসম্যান। সদ্য বিয়ের প্রথম বছর পেরিয়েছি। আমার স্ত্রী সুজান এই মুহূর্তে অন্তঃসত্ত্বা। আমরা অধীর আগ্রহে আমাদের সন্তানের জন্মের প্রতীক্ষায়। আপাত ভাবে এই সময় যে কোনও মানুষেরই সুখে থাকার কথা। আমিও ছিলাম। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরেই রাতের বেলা শুতে যাওয়া আমার কাছে আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোজ নয়, তবে মাঝেমধ্যে আমি অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখি। আর এটাই আমার সমস্যা।
স্বপ্নগুলো সত্যিই বিচিত্র। ঘুম ভাঙার পরে যে সব মনে থাকে তাও নয়। কিন্তু দুটো জিনিস মনে রয়েছে। এক, আমি স্বপ্নের ভিতরে অন্ধকার আকাশের ভিতরে ভেসে চলেছি। চলেছি তো চলেছি। চারপাশে যে জগৎ তা আমার অজানা। গ্রহ-নক্ষত্রে ভরা যে চেনা আকাশটা দেখে এসেছি তার থেকে অনেকাংশেই আলাদা। আমার কেবলই ইচ্ছে করে সামনের দিকে ভেসে যেতে। কিন্তু তারপর কিছু পথ পেরনোর পর অদ্ভুত কাণ্ড হয়, জানেন? কেবলই দেখি একটা অদ্ভুত আলোয় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। আর তারপর বুঝতে পারি আমায় আর এগোতে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, আমি বুঝতে পারি আমার চারপাশে কেউ বা কিছু একটা রয়েছে যার উপস্থিতি আমাকে আতঙ্কের চোরাস্রোতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর তারপর আমার ইচ্ছে করে চেঁচিয়ে উঠতে। আর তারপরই ঘুম ভেঙে যায়।
কেন এমন হয় জানি না। আকাশের প্রতি আমার একটা বিস্ময়বোধ রয়েছে। তবে সেটা বোধহয় সব মানুষেরই থাকে। সেটা এভাবে আমার স্বপ্নের কারণ হয়ে উঠবে ভাবিনি। এই একই স্বপ্ন ক’দিন ছাড়া ছাড়া দেখি। আরও অনেক অনুভূতি হয় স্বপ্নের ভিতরে। সেসব গুছিয়ে বলতে পারব না।
ড. ফার্গুসনের কাছে শুনলাম, আপনি ওঁকে ক’দিন আগেই এক চিঠিতে লিখেছেন আপনার এক রোগীর কথা। সে বছরখানেক পাগলা গারদে কাটিয়ে এখন আপনার তত্ত্বাবধানে রয়েছে। নাম সম্ভবত ভিনসেন্ট। ছবি আঁকে। সেও নাকি এমন সব স্বপ্ন দেখে। মাঝেমাঝে সুস্থ থাকে। তারপর আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমার ভয় হয়, আমিও সেই পথে এগোচ্ছি না তো? একমাত্র ড. ফার্গুসন ছাড়া আমার এই স্বপ্নের কথা আর কেউ জানে না। সুজানও না। এই অবস্থায় এসব কথা ওকে বলা একদমই উচিত নয়।
এখন আশা, আপনাদের সাহায্যে আমি এই বিশ্রী স্বপ্নের হাত থেকে রেহাই পাব।
ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদান্তে
উইনফিল্ড
(৯)
অ্যবের-সুর’ওয়াজ, ২৭ জুলাই ১৮৯০
প্রিয় ভিনসেন্ট,
সময় তাহলে হয়ে এল। কী বলো?
স্যাঁ রেমি থেকে এখানে এসে প্রথম কিছু সময় বেশ ভালো ছিলাম। অ্যবের একটা অপূর্ব জায়গা। গ্রাম বলতে তো এমনই হওয়া উচিত। চারপাশে কত সব উজ্জ্বল রং! কিন্তু আস্তে আস্তে সেসবও কেমন ফিকে হয়ে গেল!
আয়নার দিকে তাক করে কখনও চিঠি লিখিনি। ছবি এঁকেছি বহু বার। মাঝে মাঝে ভেবেছি, আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা কি আত্মরতি? কিন্তু নাহ! তুমি জানো আমি তেমন হতে পারিনি।
অবশ্য আমি কী হতে চেয়েছি বা পেরেছি, এসব নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা কখনও কি ছিল? সকলের চোখেই আমি একটা ফালতু লোক। হতে পারে। তবে সেই ফালতু লোকটার হৃদয়ে ঠিক কী ছিল সেটা বোঝানোর জন্য আমার ছবি রয়ে যাবে। যতই বিষণ্ণ থাকি না কেন, হৃদয়ে সব সময়ই যে এক সুর বাজতে থাকে।
জানি এভাবে জীবন চলে না। কী করব আমি এই সুর নিয়ে? এই সুর আমি নক্ষত্রের বুকে বাজতে শুনেছি। ওহ! ওদের দিকে তাকালেই আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আকাশের গায়ে ওদের ফুটে থাকতে দেখলে আমার বারবার মনে হতে থাকে, ওরা ফ্রান্সের মানচিত্রের গায়ে আঁকা কালো বিন্দুর মতো সব স্থান। যেমন লোকে ট্রেনে চেপে তারাস্কন বা রন-এ চলে যায়, তেমনই নক্ষত্রের কাছে আমাদের পৌঁছতে পারার একটাই উপায়। মৃত্যু।
তাহলে কি শেষ পর্যন্ত ওখানেই চললাম ড. পল গাশে? প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম আপনি আমার থেকেও বেশি পাগলাটে। স্নায়ুর পীড়ায় আমার চেয়েও ঢের বেশি ভুগছেন বলে মনে হয়। ওই বিষণ্ণতাকে ফুটিয়ে রেখেছি আপনাকে নিয়ে আঁকা পোট্রেটটায়। তবে ডাক্তার হিসেবে আপনি বেশ ভালো। মানুষ হিসেবেও।
ওঁর সঙ্গ ভালো লাগে। এই ঠা ঠা পড়া রোদে গমখেতে ঘুরে বেড়াই। পথে দেখা হলে যখন আমার জন্য ওঁকে চিন্তিত দেখি ভালো লাগে।
আমার স্বপ্নের কথা ওঁকে বলেছি। বলেছি হারিয়ে যাওয়া সেই বন্ধুর কথা। গত ফেব্রুয়ারিতে আর্লে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার সময় ও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। আর আসে না। আসলে ওকে চিনতে পেরে গিয়েছিলাম, তাই ও আর আসেনি। তবে হ্যাঁ, স্বপ্নের ভিতর ওকে দেখলেই বুঝে যাই, আজ আবার আমাদের অভিযানের দিন।
ড. গাশেকে একথা বলেছি। ভেবেছিলাম উনি হয়তো হেসে ফেলবেন। কিন্তু উনি হাসেননি। বরং আরও অন্ধকার হয়ে গেছে ওঁর মুখ। ক’দিন আগে হঠাৎ বললেন, ‘‘স্বপ্ন কিন্তু তুমি একা দেখো না ভিনসেন্ট। স্বপ্নের সব কিছুকে মিথ্যে আর চারপাশের সব কিছুকে সত্যি ভেবে নিয়ে আমরা ঠিক করছি কিনা সেটা ভাবা দরকার।’’ ওঁর বলার ভঙ্গিতে এমন একটা ভাব ছিল, আমার দাঁতে চেপে রাখা চুরুট খসে পড়ে গেল। বললাম, ‘‘তার মানে আপনিও…’’
ড. গাশে উত্তর দেননি। আমিও আর কথা বাড়াইনি। বুঝেছিলাম, উনি এসব নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন। কিংবা আমি আরও একটু সুস্থ হলে বলবেন। যাক। সেই স্বপ্নের কথা যত কম আলোচনা করা যায়, তত ভালো।
রাতের অন্ধকারে তারাভরা আকাশ আর আমার প্রিয় সাইপ্রেস। মৃত্যুর গাছ। সেই ছবিটার কথা খুব মনে পড়ছে। বরাবরই সাইপ্রেসকে আমি অত বড় করে এঁকেছি। লোকে বলেছে, গাছ কী করে অত বড় হবে? ওদের বোঝাতে পারিনি আমি গাছ আঁকিনি। ওগুলো আমার আকাঙ্ক্ষা। একদিন ওই গাছগুলোর মতোই বেড়ে উঠে আমি আকাশকে ছোঁব। আকাশ নয়। মহাকাশ। নিজের অস্তিত্বকে সুদূর জগতে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ভিনসেন্ট। সেই টান আমার দিন দিন বাড়ছে। আর বুঝতে পারছি, সময় হয়ে আসছে। ক্যানভাসের সামনে দাঁড়াতেও আর ভালো লাগে না। যতই চেষ্টা করি না কেন আমার ক্ষমতা নেই সেই মহাজাগতিকতাকে ব্রাশের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলব। তাহলে জীবনে আর কী বাকি থাকল? একবার রাত্রির গোপন কুঠুরিতে ঝাঁপ দিয়ে সেই অজানা সত্যির সন্ধান যে পেয়েছে, তারা জীবনে আর কখনও শান্তি পাবে না। ঘুমের গোপনে কোন মহা অস্তিত্বের ছায়া আমার সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। শিল্পী হিসেবে ব্যর্থতার মতোই সেই অশান্তিও আমায় কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলছে।
শুধু মনে পড়ছে থিও-র মুখটা। আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার মৃত্যুর পরে তার করুণ মুখে একটা কালচে হলুদ রঙের রোদ্দুর খেলা করছে। থিও, প্রিয় ভাই আমার, বড্ড ভালোবাসি তোমায়। গত জুনে যেদিনটা তোমরা এলে, খুব ভালো কেটেছিল! তোমার স্ত্রী জো আর ছোট্ট বাচ্চাটা… তুমি ওর নাম রেখেছ ভিনসেন্ট। কেন রাখলে? বলেছিলাম বাবার নামে রাখো। তবু তুমি আমার নামই দিলে। প্রার্থনা করি ছোট্ট ভিনসেন্টের জীবন যেন একটা অন্য জীবন হয়। এই ভিনসেন্টের ছায়াটুকুও সেখানে যেন না থাকে।
এক শহর থেকে অন্য শহর, এক জীবন থেকে এক জীবন, এক সম্পর্ক থেকে অন্য সম্পর্ক— আর নয়। আর নয়। নাহ… আমি ক্লান্ত থিও। এবার একটা অন্য যাত্রা।
একটা সাইপ্রেস গাছের ছায়া এসে এই লেখাটা ঢেকে দিচ্ছে। কবরখানায় যেমন থাকে। নিঃসঙ্গতার ভিতরে একটা সাইপ্রেস গাছের ছায়া…
(১০)
বোস্টন, ২৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯০
শ্রদ্ধেয় ড. গাশে,
ড. ফার্গুসনের কাছ থেকে ভিনসেন্ট নামে সেই শিল্পীর মৃত্যুর খবরটা পেয়েছি। সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। সেই সঙ্গে কেমন ভয়ও হচ্ছে ডাক্তারবাবু। ভিনসেন্টকে আমার বড় চেনা মনে হয়। জানি না কেন। হয়তো ওই স্বপ্নের কারণেই। তার উপর সে ছিল আমারই বয়সি।
আপনি ড. ফার্গুসনকে ভিনসেন্টের কেস স্টাডিটা পাঠিয়েছেন। সেটা উনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। কী আশ্চর্য জীবন! একটা লোক রাতের বেলা জেগে জেগে পাতার পর পাতা স্কেচ করে যাচ্ছে। চেতনায় ভেসে আসা মহাজগৎকে নিজের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে চায় সে। তার ছবি বিক্রি হচ্ছে না, তবু প্যাশনের বিস্ফোরণ হয়ে চলেছে! সে ভেবে নিচ্ছে গ্রিক দেবতা এসে তার সামনে বসছে। তার সঙ্গে ভেসে পড়ছে একই স্বপ্নের গভীরে।
লোকটা শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়ছে নিজেই নিজের আততায়ী। দৃশ্যটা যেন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। একটা লোক একা একা হেঁটে যাচ্ছে। বিকেলের নির্জন আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে সে হাতে তুলে নিচ্ছে বন্দুক। পরে মৃত্যুশয্যায় আপনি যখন বলছেন, চাইলে এখনও ওকে বাঁচাতে পারেন, ও বলে দিচ্ছে বেঁচে উঠলে আবারও একই কাজ করবে সে!
পড়তে পড়তে সত্যিই খুব বিষণ্ণ লাগছিল জানেন। আর ভয় হচ্ছিল। আমারও এমন হবে না তো? এমনিতে তো ভালোই থাকি। কিন্তু মাঝে মাঝে… এই তো ক’দিন আগের কথা। সারাদিনের খাটাখাটনির পর ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখলাম জানলা গলে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে বিছানায়। অনুভব করলাম যেন কেউ আমাকেই আমার ভিতর থেকে ছিঁড়ে নিয়ে কোন সুদূরে… সেই স্বপ্ন যেন আমার ঘুমের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে আমার জীবনের এক সত্যি হয়ে উঠছে।
তবে এখন আবার সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। আপাতত ভালো আছি। আর এখানেই ভয় হয়, একদিন আচমকা যদি সব কিছু আর ঠিক না হয়? সব সুতো যদি ছিঁড়ে যায় বরাবরের মতো?
আমি শিল্পী নই। একজন সাধারণ মানুষ। আমার জীবনে কে এই অভিশাপ বয়ে নিয়ে এল বলতে পারেন? ভয় হয়, আমার বংশের পরবর্তী প্রজন্মও রক্তের মধ্যে এই অভ্যেসকে বহন করে চলবে না তো? এই দুশ্চিন্তাটা মাঝেমধ্যেই হয়। খুব হয়।
যাক। শেষ করার আগে আপনাকে একটা ভালো খবর দিই। গত ২০ আগস্ট সুজান আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আমার মনটাও তাই বেশ ভালো রয়েছে।
ছেলের নাম রেখেছি হাওয়ার্ড। হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফট।
ভালো থাকবেন।
বিনীত
উইনফিল্ড
লেখকের কথা: একটা ছবি। স্টারি নাইট উইথ থুলু। শিল্পী রে ভ্যানটিলবার্গ। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের বিখ্যাত ছবির সঙ্গে শিল্পী মিশিয়ে দিয়েছিলেন এইচ পি লাভক্র্যাফটের কল্পনা। সেই ছবিই এই লেখার প্রেরণা। এ ছাড়া ভিনসেন্টের শেষ সাত মাসের চিঠির সংকলন ‘এভাবেই চলে যেতে চাই’ (অনুবাদ: সন্দীপন ভট্টাচার্য। প্রকাশক: মনফকিরা) বিশেষ সাহায্য করেছে। আর ইন্টারনেট জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র মণিমুক্তোর সাহায্য তো আছেই। ভিনসেন্টের বিরুদ্ধে যে পিটিশন জমা দিয়েছিলেন প্রতিবেশীরা, সেই পিটিশন পর্যন্ত উপলব্ধ ইন্টারনেটের মায়াভুবনে! সবশেষে উল্লেখ করতেই হয় এইচ পি লাভক্র্যাফটের কথা। তাঁর ‘হিপনোস’ ও অন্যান্য রচনা ঢুকে পড়েছে এই লেখায়। ভিনসেন্টের জীবনের অংশ হয়ে। অলমিতি।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, বড় গল্প, বিশ্বদীপ দে, সুপ্রিয় দাস
একজন রঙের অক্ষরে ‘লিখছেন’ তারার ভুবনগ্রাম আর একজন শব্দের বর্ণালীতে ‘আঁকছেন’ গল্পমালার চালচিত্র। আরও একজন এই দুই শিল্পীর মর্মবেদনাকে লিখলেন সুরের কথামালায় যে সুর তারায় তারায় ব্যাপ্ত হয়ে ডাক দেয় ‘দূরে কোথাও …’। সাহিত্য আর সামগ্রিক সংস্কৃতির প্রতি সপ্রেম আশ্লেষ না হলে এমন লেখা লেখা যায় না।
অনেক প্রশ্রয় পেলাম সন্দীপন। এ লেখার প্রেরণা যে গান থেকে পেয়েছিলাম, তা তোমার সূত্রেই প্রথম শোনা। এ লেখার সঙ্গে তাই তোমারও যোগ রয়েছে।
Khub sundor hoyeche lekhata,ager gulor theke khub alada..
অনেক ধন্যবাদ মধুরিমা।
দুর্দান্ত লেখা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। মুগ্ধতা নিও।
অনেক ধন্যবাদ। তুমিও ভালোবাসা নিও।
অদ্ভুত মন কেমন করা রচনা
ধন্যবাদ। উৎসাহ পেলাম।
শব্দের অদ্ভুত কোলাজ এই রচনা টি। একটি আলাদা ধরনের অনুভূতি। অনেক শুভেচ্ছা। (शब्दों का एक अनोखा कोलाज है यह रचना) ।
– নীলম শর্মা ‘অংশু’
অনেক ধন্যবাদ।
অ-সা-ধা-র-ণ।
মুগ্ধ বিস্ময়ে ছুটিয়ে নিয়ে গেল লেখাটা।
ভিনসেন্টের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে এ লেখা যায় না।
খুব আনন্দ পেলাম রাজীবদা।
আমার লেখার আঙ্গিক টা অসাধারন লাগল। লুপ্ত প্রায় পত্র সাহিত্যকে নতুন করে অনুভব করলাম
অনেক ধন্যবাদ।
এক অসাধারণ সাহিত্যময় লেখা। narrative আমার অপছন্দ কিন্তু একটি মাত্র ব্যতিক্রম হলো এই ধরনের কাব্যধর্মী লেখা যা সাধারণ narrative কে করে তোলে অসাধারণ !
চিঠিগুলো পড়তে পড়তে এক অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরি হলো মনের মধ্যে। বিশেষ করে শেষ চিঠিটা।
Bhishon onnorokom. Chithir collage. Onubhutir collage. Mon chhuye gelo!