নতুন পৃথিবী
লেখক: গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: অনন্যা বসু, দীপ ঘোষ, সুপ্রিয় দাস
জালের থেকে বুড়ো আঙ্গুলের মতো বড় একটা পোকাকে ছাড়িয়ে নিল হিলা। হ্রদের জলে ডুবিয়ে আঠাটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খাবে নাকি?’
পোকাটা তখনো মরে নি। আমার গা গুলিয়ে উঠল। কোনো প্রাণীর মৃতদেহই কোনোদিন খাইনি। আমাদের সব প্রোটিন কৃত্রিমভাবে তৈরি। কোনোক্রমে বললাম, ‘না। কী এটা?’
নির্বিকার ভাবে পোকাটাকে মুখের মধ্যে পুরে চিবোতে চিবোতে হিলা উত্তর দিল, ‘মশা। মেয়ে মশাগুলো মানুষের রক্ত খায়, তাই আমরা সেগুলো খাই না, ছিপ দিয়ে মাছ ধরার টোপ করি। মাছি, মৌমাছি এসব দিয়েও ভালো টোপ হয়। কিন্তু ছেলে মশাগুলো খেতে দারুণ।’
আমার মন চলে গেলো এক বছর আগে। একদিন সকালে উঠে অভ্যাস মতো পার্সোনাল সেক্রেটারির থেকে রাতের খবরগুলো চেক করতে গিয়ে দেখি একটা জরুরি মেসেজ। পাঠিয়েছে অ্যারেস প্লানেটারি কাউন্সিল। আমাকে দুদিন পর কাউন্সিলের সেক্রেটারির অফিসে দেখা করতে অনুরোধ করা হয়েছে। সেক্রেটারির অফিস হেলাস প্লানিটিয়া গহ্বরের ঠিক মাঝখানে, আর আমি থাকি হেলাসের একেবারে বাইরের দিকে। হেলাসের বাইরে শুধু কয়েকটা রিসার্চ স্টেশন আছে, তা ছাড়া কোনো মানুষ বাস করে না। সব কাজ ফেলে এক হাজার কিলোমিটার যাওয়া সহজ নয়, কিন্তু যথেষ্ট কারণ না থাকলে কাউন্সিলের অনুরোধ কেউ ফিরিয়ে দেয় না। নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হলাম।
সেক্রেটারির সঙ্গে আমার ভালোই পরিচিতি। ‘হ্যালো আরনি, এত জরুরি তলব কেন?’ আমি ওর অফিসের দরজার পাশে কোটটা টানাতে টানাতে বলেছিলাম।
‘বসো, রণ। কাউন্সিলের একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে। তার আগে বলো, তুমি বর্তমানে পৃথিবীর অবস্থা সম্পর্কে কী জানো?’
‘স্কুলে যা পড়েছিলাম। তার পরে আর নিজের কাজের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময় পেয়েছি কোথায়?’
‘স্কুলে কী পড়ানো হয় মনে আছে? বলো তো? আমি জানতে চাইছি তার একটা কারণ আছে।’
‘আমাদের পূর্বপুরুষরা পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলে কলোনি শুরু করার পরেই পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগেছিল। তার ফলে পৃথিবী থেকে মানুষের চিহ্ন মুছে গেছে। এমনকি চাঁদের কলোনিটাও মিসাইল আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর থেকে শুধু মঙ্গলেই মানুষের অস্তিত্ব আছে। পৃথিবীতে তেজস্ক্রিয়তা হয়তো এত বেশি হয়েছিল যে সম্ভবত কোনো উন্নত জীবই আর বেঁচে নেই।’ আমি বললাম।
‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন শুরু হয়েছিল জানো?’
‘না, তবে অনুমান করতে পারি। এক হাজার কোটি লোকের বেঁচে থাকার জন্য যত প্রাকৃতিক সম্পদের দরকার হত তা পৃথিবীতে ছিল না। আমার আরো একটা কথা মনে হয়। এই যে আমরা সবাই সবাইকে চিনি, পৃথিবীতে এর কোনো সুযোগ ছিল না। থাকলে যুদ্ধটা হত না। মিসাইলের বোতাম টেপার আগে পরিচিত-বন্ধু-আত্মীয়দের মুখ মনে পড়ে যেত।’
‘আমাদের সমাজতাত্ত্বিকরাও ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর জোর দিচ্ছেন। সেই জন্যই মঙ্গলে লোকসংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে আমরা ধীরে চলো নীতি নিয়ে চলছি। কিন্তু আসল প্রশ্নটা হল এতদিন তো চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে প্রাকৃতিক সম্পদ কম পড়ল কেন?’
আমি একটু অবাক হয়েই তাকিয়েছিলাম। স্কুলে আমি যা বললাম তার থেকে বেশি কিছু পড়ানো হয় নি। বললাম, ‘এত পুরানো কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? এক হাজার বছর আগের পৃথিবীতে কী হয়েছিল জেনে কী হবে?’
আরনি বলেছিল, ‘সংশোধন করে দিই, আমাদের হিসেবে এক হাজার বছর আগের কথা বলছি বটে, কিন্তু পৃথিবীর হিসেবে সেটা প্রায় উনিশশো বছর। আর একটু ধৈর্য ধরো। একটা কথা বলো, মঙ্গলের মাটিতে আমরা যে আজ স্যুট ছাড়া হাঁটতে পারছি, সেটা কিভাবে সম্ভব হল?’
‘মার্স ওয়ার্মিং। অটোমেটিক ফ্যাক্টরি দিয়ে সিএফসি গ্যাস তৈরি করে মঙ্গলের বাতাসে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। গ্রিনহাউজ গ্যাস মঙ্গলকে গরম করেছে, তার ফলে মেরুর জমাট কার্বন ডাই অক্সাইড আর জলীয় বাষ্প বাতাসে মিশে বায়ুচাপ আর তাপমাত্রা বাড়িয়েছে। তাও তো হেলাসের বাইরে এখনো স্যুট পরতে হয়। সবাই যা জানে, তা জিজ্ঞাসা করে সময় নষ্ট করছ।’
আমার শেষ কথাটা অগ্রাহ্য করে আরনি বলে চলল, ‘পৃথিবীতেও ওয়ার্মিং হয়েছিল। তবে মঙ্গলে যেটা পরিকল্পনা মাফিক, পৃথিবীতে সেটা ছিল অনিয়ন্ত্রিত। গাছ কাটা এবং কয়লা আর তেল পোড়ানোর ফলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়ে। তাই গোটা গ্রহের উষ্ণতা বেড়ে গিয়েছিল। মঙ্গলে আমরা কখনো সমুদ্র দেখিনি, পৃথিবীর অধিকাংশটাই ছিল সমুদ্র। দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে যায়। বুঝতেই পারছ হাজার কোটি লোকের চাপ এমনি পৃথিবী নিতে পারছিল না, কাজেই জমি আরো কমে গেলে কী হতে পারে। আরো অনেক সমস্যা হয়েছিল। তার ফলে একসময় প্রাকৃতিক সম্পদের দখল নিতে যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। নিউক্লিয় অস্ত্র যে পরিমাণ ছিল, তার খুব কম অংশই ব্যবহার করা হয়। ওয়ার্মিঙের জন্য এমন অবস্থা হয়ে পড়েছিল যে ঐটুকুতেই সমাজের সব কিছু ভেঙে পড়েছিল। এই পর্যন্ত খবর আমাদের কাছে এসেছিল। তোমার সেক্রেটারির কাছে কয়েকটা ফাইল পাঠালাম, পড়ে দেখো।’ পার্সোনাল সেক্রেটারি কানের কাছে পিং করে জানান দিল মেসেজ এসেছে।
একটু চুপ করে আরনি বলতে শুরু করল, ‘আমরা পুরানো সমস্ত ফাইল দেখছিলাম। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের কলোনি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে ইচ্ছা থাকলেও পৃথিবীর খবর বেশি করে নেওয়ার সুযোগ হয় নি। নিউক্লিয়ার যুদ্ধের পরে যখন একে একে সমস্ত রেডিও স্টেশনগুলো বন্ধ হয়ে যায়, ধরে নেওয়া হয়েছিল যে পৃথিবীতে আর মানুষ নেই, আমরাই একমাত্র সারভাইভার।
‘পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের কলোনি যে কী সমস্যায় পরেছিল তা তুমি জানো। গত হাজার বছরে বেশ কয়েকবার আমরা খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসি। অবশেষে গত বছর অ্যারেস কাউন্সিল সিদ্ধান্ত করে যে মঙ্গলে কলোনির এখনি ধ্বংসের সম্ভাবনা নেই, এবার অন্যদিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে। কাউন্সিল তাই দুটো মহাকাশ অভিযানের পরিকল্পনা করেছে, কয়েকদিনের মধ্যে সকলের মত নেওয়া হবে। যদি অনুমোদিত হয়, একটা যাবে গ্রহাণু বলয়ে, সেখানে মূল্যবান খনিজের জন্য অটোমেটিক মাইনিং শুরু করার পরিকল্পনা আছে।
‘অন্যটা যাবে পৃথিবীতে, আমরা দেখতে চাই কোনো মানুষ সেখানে বেঁচে আছে কিনা। পৃথিবীর থেকে বেরোনো তেজস্ক্রিয়া মেপে আমাদের পদার্থবিদরা বলেছেন আসলে নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল আমরা যা ভেবেছিলাম তার থেকে কম। এতদিন পরে তেজস্ক্রিয়া অনেক কমে নিরাপদ মাত্রায় এসেছে। মানুষ থাকলেও নতুন কোনো টেকনোলজিকাল সভ্যতা নিঃসন্দেহে নেই। পৃথিবীর অবস্থা মহাকাশ থেকে দেখার কোনো উপায় নেই। কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ একবার বেড়ে গেলে, কয়লা তেল পোড়ানো বন্ধ হলেও সে কমতে চায় না। কারণ পৃথিবীর অনেক অঞ্চলই এখন নিশ্চয় মরুভূমি, সেখানে গাছপালা হয় না। তাই তাপমাত্রা বিশেষ কমেনি। সমুদ্র থেকে জল অনেক বেশি বাষ্প হয়ে মেঘের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় গোটা গ্রহটা সারাক্ষণ মেঘে ঢাকা। তাই ভালো করে দেখার একমাত্র উপায় হল কাউকে একজনকে মাটিতে নামতেই হবে। পৃথিবীর এখন কী অবস্থা আমরা জানি না, সেখানে যে কোনো রকম বিপদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে। তাই এমন মানুষ দরকার যে শারীরিক ভাবে, রিফ্লেক্সের দিক থেকে, খুব ভালো কন্ডিশনে আছে।’ আমার দিকে তাকিয়ে থামল আরনি।
‘জানতাম গত বছর তোমার ক্লাবের হারটাকে তুমি মেনে নিতে পারোনি। সামনের বছরও ফুটবলের কাপটা আমাদের বাঁধা। তাই আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজের ক্লাবকে জেতাতে চাইছ।’ আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম। ‘ঠিক আছে, আমি রাজি। কবে রওনা হতে হবে?’ আমার ভাবতে একটুও সময় লাগলো না। এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া যায়! বাড়ি আর ল্যাবরেটরি, ল্যাবরেটরি আর বাড়ি — এই একঘেয়ে জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
‘আমি কাউন্সিলকে বলেছিলাম তুমি রাজি হবে। যাওয়ার আগে অনেক ট্রেনিং নিতে হবে। ভেবো না শুধু ভালো স্পোর্টসম্যান বলে তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। আমাদের দরকার ছিল একজন জীববিজ্ঞানী, সেই জন্যই তোমার নাম আসে। শারীরিক সক্ষমতাটা এক্সট্রা। আমি কাউন্সিলকে বলেছিলাম বিপদের সম্ভাবনা আছে শুনলে রণ অভিযানে যেতে রাজি হবেই। আমিও যাব, এবং কারণটা ঐ একই।’ আরনি হাসতে হাসতে বলেছিল।
মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে আসতে লেগেছিল চারমাস। সময়টা যে কমানো যেত না তা নয়, কিন্তু ক্যাপ্টেন জ্বালানি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আমাদের মহাকাশযানের নাম দেওয়া হয়েছে ধরিত্রী। তাতে ছিলাম আমরা চারজন – আরনি, ক্যাপ্টেন মেরিনা, ইঞ্জিনিয়ার জেনা, আর আমি। আরনি নিজে ডাক্তার, আমাদের রক্তে আছে ন্যানোডক, তাছাড়া অটোডক তো আছেই। রকেটের পুরোটাই প্রায় অটোমেটিক, তাই চারজনেই চালানো গেছে। উপায়ও ছিল না, খুব বেশি লোককে পৃথিবীতে নিয়ে যাওয়া আবার ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা ধরিত্রীর নেই। তাছাড়া এমার্জেন্সির জন্য কিছু জ্বালানি রিজার্ভে রাখতে হবে।
গোটা পৃথিবীটাই যেন ধূসর মেঘের স্তরে ঢাকা, তা ভেদ করে বিশেষ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। রাডার ইমেজ থেকে আমরা একটা ল্যান্ডিং সাইট ঠিক করি। আগে থেকেই ঠিক ছিল যে প্রথমে আমি নামব। আমার রিপোর্টের পরে দ্বিতীয় ল্যান্ডারটা নিয়ে আরনি কোথায় নামবে ঠিক করা হবে। ল্যান্ডারগুলোতে মোটামুটি একজনেরই জায়গা, দুজন ঢুকতে গেলে কষ্ট করতে হবে। রাডার থেকে বোঝা গেছে যে পৃথিবীর স্থলভাগের অনেকটা সমুদ্রের তলায় চলে গেছে। ল্যান্ডিং সাইটটা এমন জায়গায় ঠিক করেছিলাম যেখানে ভাষা ছিল মঙ্গলে যে ভাষা ব্যবহার করি তার কাছাকাছি। মানুষ যদি টিকে থাকে, এত দিনে নিশ্চয় তাদের ভাষাও অনেকটা পালটে গেছে, তবে তার জন্য পার্সোনাল সেক্রেটারি তো আছেই। রকেটের কম্পিউটারের নাম সিঙ্গুলারিটি, সে হাজার বছর আগের পৃথিবীর সব কটা প্রধান প্রধান ভাষা জানে। সিঙ্গুলারিটি আর পার্সোনাল সেক্রেটারি মিলে পৃথিবীর যে কোনো ভাষাকে সামলে দিতে পারবে। মাটিতে যেই নামুক, যাতে কোন সময়েই তার সঙ্গে ধরিত্রীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়, সে জন্য তিনটে ছোট উপগ্রহ ক্লার্ক কক্ষপথে বসানো হয়েছে।
গত ছ’মাসে পৃথিবী সম্পর্কে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। তার মধ্যে যেমন ইতিহাস ছিল, তেমনি ছিল পৃথিবীর গাছপালা জন্তু জানোয়ারের কথা। আমি জীববিদ বটে, কিন্তু পৃথিবীর মতো বৈচিত্র্যময় জীবজগৎ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা নেই। জানি মঙ্গলের প্রায়-কৃত্রিম জগতের সঙ্গে পৃথিবীর তুলনাই চলে না। বর্তমানে পৃথিবীর পরিস্থিতি নিশ্চয় অনেক পালটে গেছে। তাও ভেবেছিলাম যে পৃথিবীতে কোনো কিছুই আমাকে ঘাবড়ে দিতে পারবে না। এখন বুঝতে পারছি কতটা ভুল ছিল সেই ভাবনা।
ধরিত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ল্যান্ডারটা যখন মেঘের স্তর ভেদ করে নামল, তখনই প্রথম নিচের মাটি দেখতে পেলাম। ক্যামেরাও সঙ্গে সঙ্গে ধরিত্রীতে ছবি পাঠাচ্ছিল। পৃথিবীতে অন্তত এখনো জীবনের চিহ্ন আছে — নিচটা ঘাস আর গাছে সবুজ হয়ে আছে। মানুষ বসবাসের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ল না। খালি অনেকটা জায়গা কালো হয়ে আছে, সেখানে আগুন লেগেছিল। কিন্তু আগুন তো প্রাকৃতিক কারণেও লাগতে পারে। তাহলে কি মানুষ সত্যিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে?
ল্যান্ডার নামিয়েছিলাম একটা হ্রদের পাশে। একটু সময় দিলাম নিজেকে, পৃথিবীর গ্রাভিটি অনেক বেশি। ঠিক যেন পিঠের উপরে একটা বোঝা চাপানো আছে — মানিয়ে নিতে হবে। কেমিক্যাল অ্যানালাইজার থেকে দেখলাম, বাতাসে কোনো ক্ষতিকর গ্যাস নেই। মঙ্গলের সঙ্গে তফাত এই যে কার্বন ডাই অক্সাইডের বদলে অধিকাংশটাই নাইট্রোজেন — জীবনে এই প্রথম কোনো ফিল্টার ব্যবহার না করে নিঃশ্বাস নিলাম। বেরোনোর আগে অ্যাটমস্ফিয়ার স্যুটটা পরে নিলাম। স্পেসস্যুটের মতো না জবড়জং না হলেও পৃথিবীর অভিকর্ষে এটাও বেশ ভারি। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব থাকলেও আধুনিক টেকনোলজি নিশ্চয় হারিয়ে গেছে। এই স্যুটটা দেখলে ভয় পেয়ে যেতে পারে, সেজন্য এটা ব্যবহার না করার কথাও একবার হয়েছিল। কিন্তু এই তাপমাত্রায় স্যুট ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তাছাড়াও স্যুটটা অনেক ভাবে কাজে লাগবে। বিশেষ করে পোকামাকড় যাতে কাছে না আসতে পারে, তার জন্য একটা ইন্টালিজেন্ট আলট্রাসাউন্ড জেনারেটর আছে।
ল্যান্ডারের দরজা খুলে বেরোলাম। চারদিকে চোখ বোলালাম। জঙ্গলের ছবি বুকফিল্মে দেখেছি, কিন্তু চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না। সেই কথা রেডিওতে বললাম। মেরিনা মন্তব্য করল, ‘সিঙ্গুলারিটি দেখাচ্ছে এই অক্ষাংশে চিরহরিৎ জাতীয় গাছ পাওয়া উচিত ছিল। তার জায়গায় রয়েছে বাবুল, নিম, বাঁশ, মহুয়া এই সব গাছ যেগুলো নিরক্ষরেখার কাছে পাওয়া যেত। এটা তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফল। মঙ্গলের তুলনায় গাছ নিশ্চয় অনেক বেশি, কিন্তু গোটা কয়েক গাছ আর প্রচুর ঝোপঝাড় — পৃথিবীতে একে জঙ্গল বলত না।’
‘টানা একটা আওয়াজটা হচ্ছে শুনতে পাচ্ছ? এটা কিসের আওয়াজ সিঙ্গুলারিটির ডাটাবেস থেকে বলা সম্ভব?’
‘এক ধরনের পোকা, এর নাম ঝিঁঝিঁ। কিন্তু এত জোরে আওয়াজ কোনো রেকর্ডিঙে নেই।’ কয়েক সেকেন্ড বিরতির পরে মেরিনা বলেছিল।
হ্রদের ধারে গেলাম। এক জায়গায় এত জল কখনো দেখিনি। যা ভেবেছিলাম, পাখি সংখ্যায় তার থেকে অনেক কম। কয়েকটা ছোট ছোট পাখি চোখে পড়ল, তারা হ্রদের উপর ঝাঁক বেঁধে উড়ছিল। হ্রদের চারদিকটা ঘাস, তার মাঝে একটা জায়গা ফাঁকা। মনে হয় পায়ে পায়ে পিষে গেছে। এ কি মানুষের কীর্তি? নাকি জানোয়াররা জল খেতে আসে? যা হোক, এই পথটাকেই অনুসরণ করা যাক।
অটোমেটিক হ্যান্ডগানটা হাতে নিলাম। মঙ্গলে বন্দুকের চল নেই — পৃথিবীতে বিপদ আপদের কথা চিন্তা করে আমাদের প্রযুক্তিবিদরা পুরানো ডিজাইন থেকে এটা বানিয়েছেন। দেখতে ছোটো রাইফেলের মতো হলেও আসলে এর অনেকগুলো সেটিং আছে। লেজার, সনিক এবং প্রজেক্টাইল – তিনরকম ভাবে এর ব্যবহার করা যায়। আমি নিয়মিত চালানোও অভ্যাস করেছি।
পথটা গিয়ে ঢুকেছে বনের মধ্যে। বড় গাছ কম, কিন্তু ঝোপঝাড় অনেক — ভিতরে দেখা যাচ্ছে না। খুব সাবধানে চারদিকে খেয়াল রেখে হাঁটতে হচ্ছে। পোকার ডাক আছে, জঙ্গলের মধ্যে অন্য আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। ঝোপের মধ্যে থেকে শুকনো পাতার উপর সড়সড় আওয়াজ আসছে, কিন্তু বড় কোনো প্রাণী নিশ্চয় নয়, কারণ কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সেদিকেই মন ছিল, হঠাৎ পথের একটা জায়গায় পা দিতেই পায়ের তলা থেকে মাটিটা যেন সরে গেল। হুড়মুড় করে একটা গর্তে পড়ছিলাম, কোন রকমে হাতের কাছে দড়ির মতো কিছু একটা পেয়ে আঁকড়ে ধরলাম। সেটাও ছিঁড়ে হাতে চলে এলো — নিচে গিয়ে পড়লাম।
উঠে দাঁড়িয়ে উপর দিকে তাকালাম। কিছুটা উপরে গর্তের মুখ। হাতের দিকে তাকালাম, একটা শিকড়ের ছেঁড়া টুকরো ধরে আছি। এটাই আমাকে বাঁচিয়েছে, সোজা নিচে পড়লে আর দেখতে হত না। পৃথিবীর অভিকর্ষের জন্য তো আমার হাড়গোড় তৈরি নয়। ক্যামেরাও ঠিক আছে, কিন্তু রেডিও অন করে বুঝলাম, সমস্যা হয়েছে। কোনোভাবেই ধরিত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না।
একটা জিনিস বুঝলাম, মানুষ এখনো পৃথিবীতে টিকে আছে– নাহলে এরকম ফাঁদ কে বানাবে। কিন্তু কী করে এই গর্ত থেকে উদ্ধার পাব? তারপর আবার ল্যান্ডারে যেতে হবে রেডিও পাল্টাতে। গর্তের গায়ে যেরকম শিকড় বেরিয়ে আছে, ধরে ধরে সহজেই উঠে পড়তে পারব। কিন্তু একটু অপেক্ষা করব কি? যারা ফাঁদ পেতেছে, তারা নিশ্চয় দেখতে আসবে। তাদেরকে আর খুঁজতে যেতে হবে না। কিন্তু হয়তো তারা অনেক দিন পরপর একবার আসে। এক কাজ করা যাক। উপরে উঠে কোনো ঝোপের বা গাছের আড়ালে একটু অপেক্ষা করি। একটু সাবধানেও থাকতে হবে। ফাঁদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যে বড়সড় জন্তু জানোয়ারও এখানে আছে।
এতদিনের ফুটবলের ট্রেনিঙের জন্য শিকড় ধরে উঠে আসতে অসুবিধা হয়নি। গর্তের উপরে গাছের ডালপালা দিয়ে তার উপরে আলগা করে মাটি লতাপাতা এমনভাবে বিছানো ছিল যে পা দেওয়ার আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি। ঝোপের বাধা পেরিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছিল, শেষকালে লেজার দিয়ে কেটে ভিতরে ঢুকলাম। একটু দেখেই যাই, এখান থেকে ল্যান্ডার পর্যন্ত যেতে আধঘণ্টাও লাগবে না। একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একটু পরেই আওয়াজে বুঝলাম পথ ধরে জঙ্গলের ভিতর থেকে কেউ একজন আসছে। কাছে এলে দেখলাম একটি ছেলে। দেখে মনে হয় বয়স অল্পই, কুড়ির আশেপাশে। লম্বায় আমার বুকের কাছে। পেশীবহুল চেহারা। গায়ে মোটা কাপড়ের পোশাক, হাতে দস্তানা, মাথাতে একটা কাপড়ের টুপি, মুখের অনেকটা ঢাকা। শুধু চোখদুটোই দেখা যাচ্ছে। হাঁটু পর্যন্ত তোলা জুতো। হাতে একটা বল্লম। কোমরে একটা গুলতি, তার পাশেই একটা থলি — সম্ভবত তার মধ্যে গুলতির জন্য পাথর রাখা আছে। পিঠেও কয়েকটা ঝোলা। সোজা হেঁটে এসে ফাঁদটার কাছে দাঁড়াল। ভালো করে গর্তটার ভিতরটা দেখল, তারপর এদিক ওদিক তাকাতে থাকল।
দেখা দেওয়ার এইটাই ঠিক সময়। আমি খালি হাতদুটো উপরে তুলে ধরলাম যাতে ছেলেটা ভয় না পেয়ে যায়। বাইরে এক পা বেরিয়ে এলাম। ছেলেটা নিশ্চয় আওয়াজ পেয়েছিল, ঘুরে তাকাল। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, তারপর বিদ্যুৎবেগে বল্লমটা তুলে ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে আমি নড়ার সময় পাইনি। বল্লমটা আমার উপরে তোলা হাতের উপর দিয়ে গিয়ে গাছের গায়ে বিঁধে গেল। আমি তাড়াতাড়ি করে কোমর থেকে হ্যান্ডগানটা হাতে নিয়ে ওর দিকে তুলে ধরলাম।
এবার ওর পালা। না বলতেই হাতদুটো উপরে তুলে ধরল, তারপর কথা বলল। সামান্য অসুবিধা হলেও বুঝতে পারলাম, ও বলছে, ‘গুলি করো না, পিছন দিকে দেখো।’
ওর দিক থেকে নজর না সরিয়ে কয়েক পা সরে গেলাম। তারপর মাথাটা ঘোরালাম।
বল্লমটা একটা সাপকে গাছের গায়ে বিঁধে রেখেছে। মঙ্গলে সাপ নেই, তাই আমি সাপ চিনি না। এটার বিষ আছে কিনা জানি না। আমরা ল্যান্ডিঙের জন্য এই জায়গা বেছেছিলাম, তার একটা বড় কারণ এখানে শীতকাল চলছে। দেখা যাচ্ছে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াতে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের শীতঘুমের ব্যাপারটা আর নেই। সাপটা গাছের উপরে ছিল, হয়তো আমার হাত তোলাতে ভয় পেয়ে কামড়াতে এসেছিল। আমি হ্যান্ডগানটা নামালাম।
এভাবেই হিলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওর কথা মোটামুটি বুঝতে পারছিলাম, হয়তো চার পাঁচটা শব্দের একটা চিনতে পারছিলাম না। অধিকাংশ সময়েই সেটা কোনো গাছ বা প্রাণীর নাম, যা আমাদের মঙ্গলে নেই। পার্সোনাল সেক্রেটারি কানের কাছে ফিসফিস করে মানে বলে দিচ্ছিল। হিলা মরা সাপটা ওর একটা ঝুলিতে ভরতে ভরতে আমাকে পরপর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এত লম্বা হলে কি করে? তোমার গায়ে এরকম অদ্ভুত পোশাক কেন? তোমার গা এতটা খোলা, পোকা কামড়াচ্ছে না?’
আমরা ঠিক করেছিলাম যে প্রথমেই কোথা থেকে আসছি বলব না। তাই লম্বা হওয়ার কারণ যে মঙ্গলের কম অভিকর্ষ, তা বলা গেল না। শুধু বললাম, ‘আমি যে জায়গা থেকে আসছি, সেখানে সবাই আমার মতো লম্বা আর আমার মতোই জামা কাপড় পরে।’
এখন তাহলে কী করি? ধরিত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। তার জন্য ল্যান্ডারে যেতে হবে। কিন্তু হিলাকে নিয়ে গেলে চলবে না, তাহলে ও যে প্রশ্ন করবে তার উত্তর আমি দিতে পারব না। আবার ওকে ছেড়ে দিলে পরে যোগাযোগ করব কেমন করে? হিলাই সমস্যার সমাধান করে দিল। ফাঁদটা আবার ঠিক করে পাততে পাততে বলল ও হ্রদের ধারে যাচ্ছে। ল্যান্ডারটা কামুফ্লাজ মোডে রয়েছে, চট করে ওর চোখে পড়বে না। ওকে আড়াল করে একবার ল্যান্ডারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করব।
আমি ওর সঙ্গী হলাম, কিন্তু পৃথিবীর অভিকর্ষ সামলাতে না পেরে বারবার পিছিয়ে পড়ছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে হিলা বলল, ‘একটু পা চালিয়ে চলো, যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি আসবে, দাঁড়াতে হবে। অন্ধকারও তাড়াতাড়ি নামে এই সময়ে।’
আমিও উপর দিকে তাকালাম, কিন্তু আগের থেকে আলাদা কিছু বুঝলাম না। সেই একই রকম মেঘে ঢাকা আকাশ। আমার তো মেঘ দেখার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে, তাই ওর কথা মেনে নিলাম। ওর পাশে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি বন্দুক চেনো। তোমার আছে?’
‘আমাদের গ্রামে বন্দুক আছে।’ আর বিশেষ বলতে চাইল না হিলা। হয়তো ভাবছে আমি ওদের গ্রাম সম্পর্কে খবর নিচ্ছি কোন মতলবে।
‘আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?’
‘তুমি যাবে? আমাদের গ্রামে অপরিচিত লোক খুব কম আসে। আশপাশের গ্রামের সবাইকে আমি চিনি। কেউ কেউ বলে উত্তরের পাহাড়ের ওধারের লোকরা ইচ্ছা করলেই খুব লম্বা হতে পারে। কিন্তু আমি কাউকে চিনি না যে নিজের চোখে দেখেছে। তুমি কি উত্তরের পাহাড় টপকে এসেছ?’
‘না, আমার বাড়ি আরো অনেক দূরে।’
হিলা কথা বলতে ভালোবাসে। তাই প্রথমে চুপ করে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ওর থেকে অনেক খবর পেলাম। গ্রামের আশেপাশে গমের চাষ হয়, সেটাই প্রধান খাবার। ওদের গ্রামে হিলাই একমাত্র যে মাছ ধরতে আর শিকারের খোঁজে দূরে দূরে যায়। ফাঁদগুলো হিলাই পাতে, কয়েকদিন ছাড়া ছাড়া দেখতে আসে। আশেপাশে বড় জন্তু বলতে শুয়োর আর বুনো কুকুরের দল। হিলা সবচেয়ে ভয় পায় যে জন্তুকে তার বর্ণনা শুনে আমি চিনতে পারলাম না। তার নাম জুর্কা। বিড়ালের মতো বড়, লম্বা লেজ, বিরাট বিরাট দলে ঘুরে বেড়ায়। তারা গাছেও উঠতে পারে। তাই বুনো কুকুরের সামনে পড়লে যদিও বা বাঁচা যায়, জুর্কার দলের কবলে পড়লে বেঁচে খুব কম লোক ফিরেছে। বিড়াল আমি চিনি, মঙ্গলে যাওয়ার সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা যে সমস্ত প্রাণী নিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে বিড়াল কুকুর দুইই ছিল। ইঁদুরও ছিল, তবে তাদের মঙ্গলে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক পরিকল্পনা করে হয়নি।
‘ঐ পাহাড়ের ওপারে কখনো যাওয়ার চেষ্টা করনি?’ আমি দক্ষিণ দিকে দেখিয়ে বলি।
‘না। গিয়ে কী হবে? পাহাড় পেরোলে শুধু বালি আর বালি। জল নেই, কাঁটাগাছ ছাড়া কিছু নেই, শিকার পাব না। তাই ওদিকে কেউ কখনো যায়নি।’
বলতে বলতে বৃষ্টি এলো। টেরাফর্মিঙের কল্যাণে মঙ্গলে আকাশ থেকে জল পড়া আমার অজানা নয়, যদিও গত দশ বছরে কত বার তা হয়েছে হাতে গুনে বলতে পারি। কিন্তু এই রকম আকাশ ভাঙা বৃষ্টি কল্পনাতেও আনতে পারি না। হিলা আর আমি একটা বড় গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার স্যুট অবশ্য আমাকে ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচাল। হিলা নিশ্চয় খেয়াল করেনি, কোনো ভাবান্তর দেখলাম না,
কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থামল। সূর্যের মুখ অবশ্য দেখা গেল না, সে সারাক্ষণই মেঘের আড়ালে। আবার আমরা রওনা হলাম। বন থেকে বেরোনোর আগে হিলা পিঠের ঝুলি থেকে একটা খুব পাতলা জাল বার করলো। সেটা একটা গাছে টান টান করে বাঁধল। তারপর একটা ছুরি বার করে আমি কিছু বলার আগেই নিজের আঙুলটা সামান্য কাটল। রক্তটা জালের গায়ে ভালো করে মাখিয়ে দিল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা দিয়ে কী করবে?’
‘মাছ ধরব, তোমাদের গ্রামে তোমরা মাছ ধরো না? তার টোপ লাগবে।’ বলে বসে পড়ল হিলা। নিজের কাটা আঙুলটা মুখে পুরে চুষতে লাগল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম নানা ধরনের পোকা সোজা উড়ে এসে জালের গায়ে বসছে। কিন্তু জালে বোধহয় আঠা লাগানো আছে, আর উড়ে যেতে পারছে না। এতক্ষণ স্যুটের আলট্রাসাউন্ডের জন্যই নিশ্চয় খেয়াল করিনি, চারদিকে প্রচুর পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে হিলা জালটা খুলে নিয়ে হ্রদের পাশে গিয়ে বসল। তার পরের গল্প তো প্রথমেই বলেছি। কয়েকটা পোকা খাওয়ার পরে পিঠ থেকে একটা লম্বা সরু সুতো বার করল, তার একপাশে একটা বাঁকানো হুক আর একটা পাথর বাঁধা। সুতোর অন্য প্রান্তটা নিয়ে বল্লমের মুখে বাঁধল। একটা পোকা নিয়ে হুকে বিঁধিয়ে হুক পাথর সমেত জলে ছুঁড়ে দিল। বুঝলাম মাছ ধরবে, তার মানে ওর কিছুক্ষণ সময় লাগবে।
‘ঠিক আছে, তুমি মাছ ধরো। আমি একটু আসছি।’ ও নিশ্চয় ভাববে আমি শরীরের প্রয়োজন মেটাতে আড়ালে যাচ্ছি। আমি যে বড় ঝোপের আড়ালে ল্যান্ডারটা ছিল, সেদিকে গেলাম। ল্যান্ডারটার ভিতরে ঢুকে স্পেয়ার রেডিওটা নিলাম। ধরিত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বললাম আমি হিলার গ্রামে যাচ্ছি।
জেনা বলল, ‘অন্য ল্যান্ডারটাতে কিছু একটা প্রবলেম হয়েছে। সারানোর চেষ্টা করছি। যদি তুমি কোনো বিপদে পড়, আমরা হয়তো সাহায্য করতে পারব না।’
‘কিন্তু এরকম সুযোগ আর আসবে কিনা কে জানে। মানুষের সংখ্যা খুব কমে গেছে, তাদের খুঁজে বার করা শক্ত।’ আমি বললাম। পৃথিবীর টেকনোলজির যা অবস্থা, আমার কে কী করবে?
‘আমাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য সফল, পৃথিবীতে এখনো মানুষ আছে আমরা জানতে পেরেছি। সে খবর মঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়েছি, আধ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর আসবে। যেতে চাইলে যাও, কিন্তু রেডিয়োটা অন রেখো। তবে এমার্জেন্সি না হলে আমরা রেডিয়োতে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব না।’ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মেরিনা বলল।
হিলা এর মধ্যে বেশ কয়েকটা মাছ ধরে ফেলেছে। সেগুলোকে আর একটা ঝুলির মধ্যে ভরে ফেলেছে। জাল থেকে বাকি পোকাগুলোকে ছাড়িয়ে একটা কৌটোর মধ্যে নিয়ে হিলা উঠে পড়ল। আমিও ওর সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম ওর গ্রামের দিকে। ঘণ্টা চারেক আগে আমি ল্যান্ডারে এসে পৃথিবীতে নেমেছি। এর মধ্যে কত কী ঘটে গেল।
বুঝতে পারছি হিলা খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে চাইছে, কিন্তু আমার জন্যই দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অনেক দূরে যেতে হবে?’
‘আমি একা থাকলে সন্ধের অনেক আগে পৌঁছে যেতাম। কিন্তু তুমি তো হাঁটতেই পারছ না। এই জঙ্গলে রাতে বিপদ হতে পারে। এদিকে জুর্কার একটা দল আছে। তোমার ঐ একটা বন্দুকে আর কটা গুলি আছে? বল্লম আর বন্দুক দিয়ে কিছু হবে না।’
আমার হ্যান্ডগানটা যে ঠিক পুরানো দিনের রাইফেল নয় সে কথা হিলাকে বললাম না। যেতে যেতে হিলার কাছে ওদের গ্রাম সম্পর্কে আরো শুনছিলাম। হিলার বাবা মা ভাই বোন কেউ নেই। গ্রামের যে প্রধান, সের্গি, তাকে হিলা পছন্দ করে না। লোকটা নাকি ভীষণ লোভী। হিলাকে শিকারের বদলে ঠিকঠাক মতো গম দেয় না। কিন্তু ওর কজন সাগরেদ আছে, তারা একেবারে গুণ্ডা। তার উপর গ্রামের একমাত্র বন্দুকটাও ওর সম্পত্তি। তাই হিলা কিছু বলতে সাহস পায় না। ওর ইচ্ছা পালিয়ে যাবার, কিন্তু যাবে কোথায়? উত্তরে পাহাড় টপকাতে পারবে না, রাস্তা চেনে না। দক্ষিণের আগুন-ঢালা এলাকা পার হওয়াও অসম্ভব। আশে পাশে কয়েকটা গ্রাম আছে, কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। তার থেকে দূরে কী আছে হিলা জানে না।
‘হিলা, তোমাদের গ্রামের লোকরা কি চিরকালই এখানে থাকে? নাকি অন্য কোথাও থেকে এসেছিল?’
‘ইস্কুলে পড়েছি চিরকাল আমরা এখানে ছিলাম না। অন্য জায়গা থেকে এসেছি।’
‘তুমি ইস্কুলে পড়েছ?’
‘তা না তো কি? তুমি কি ভেবেছ আমি লেখাপড়া জানি না? আমাদের গ্রামের সবাই দু বছর ইস্কুলে যায়।’
‘ইস্কুলে কী পড়েছিলে পুরনো দিনের কথা, মনে আছে?’
হিলার ভালোই মনে আছে। হাজার হাজার বছর আগে মানুষ নাকি দেবতাদের প্রায় সমকক্ষ হয়ে গিয়েছিল। তারা আকাশ উড়তে পারত। তাদের এমন সব অস্ত্র ছিল যাতে করে দশটা গ্রামকে মুহূর্তে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দেবতাদের সমান হতে চেয়েছিল বলে দেবতাদের রাগ হয়। তারা সূর্যের তেজ বাড়িয়ে দেয়। মানুষ সে জন্য দেবতাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু করেছিল। তাতে পৃথিবীর সব গ্রাম যোগ দেয়। সেই গ্রামগুলো ছিল বিরাট বড়, একটা একটা গ্রামে হাজার হাজার লোক থাকত। যুদ্ধে দেবতাদেরই জিত হয়। প্রায় সব মানুষ মরে যায়। কিছু লোক মাটির তলার গুহাতে লুকিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। অনেকদিন তারা গুহাতে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু দেবতাদের অভিশাপে গুহা থেকে বেরোনোর পরে নানা রকম রোগে অনেক লোক মারা যায়। যেসব বাচ্চা জন্মাত, তারাও প্রায়ই বিকলাঙ্গ হত। তখন কিছু কিছু লোক এইখানে পালিয়ে আসে। জঙ্গল কেটে থাকতে শুরু করে। দেবতাদের অভিশাপ এই জায়গা পর্যন্ত পৌঁছোয় নি।
কথায় কথায় অন্ধকার নেমে এসেছে। হিলা কিন্তু জঙ্গলে রাত কাটাতে রাজি নয়। আমি বললাম, ‘আমি একটা আলো জ্বালাই? অন্ধকারে দেখতে অসুবিধা হচ্ছে।’ টর্চ জ্বাললাম।
হিলা অবাক হয়ে বলল, ‘এটা কী? আগুন নেই, কিন্তু আলো জ্বলছে।’
আমি বললাম, ‘এর নাম টর্চ।’
হিলা বিদ্যুতের ব্যবহার জানে না, কোনো রকম মোটর লাগান গাড়ি বা যন্ত্রপাতি দেখেনি। পৃথিবী মনে হচ্ছে একেবারে সেই শিল্প বিপ্লবের আগের যুগে ফিরে গেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর বিশ্বযুদ্ধের ফলে আধুনিক বিজ্ঞানপ্রযুক্তি নিশ্চয় একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এত গরম আর এত আর্দ্রতাতে কোনো স্টিল বা লোহার তৈরি জিনিস টেকাও শক্ত। কিন্তু তাহলে বন্দুক ব্যবহার করে কেমন করে? বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বন্দুকের বুলেট বানাতে তো আধুনিক প্রযুক্তি লাগবেই। বন্দুক মানে তাহলে কি পুরনো শটগান? হিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম। এতক্ষণে হিলা আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে, বন্দুকের কথা বলতে আপত্তি করল না। যা বর্ণনা পেলাম, রাইফেলই মনে হচ্ছে।
‘সের্গিকে বন্দুক চালাতে দেখেছ?’
‘তা আর দেখিনি? গ্রামের কাছে বুনো শুয়োর এলে তো ওটা দিয়েই গুলি করে মারে। শুনেছি মানুষও মেরেছে। অবশ্য আমি নিজে দেখিনি, সবাই বলে।’
তার মানে বুলেটের খুব অভাব নেই। কিন্তু হিলার কাছে যা শুনছি, তাতে করে কাছের কোনো জায়গায় এ ধরনের বুলেট বানানো সম্ভব বলে মনে হয় না। ‘আচ্ছা হিলা, তোমাদের গ্রামে অপরিচিত লোক যারা আসে, তারা কি ব্যাপারী? তারা তোমাদের সঙ্গে মেশে?’
‘হ্যাঁ, ওরা ব্যাপারী। কিন্তু গ্রামের কারোর সঙ্গে মেশে না, সের্গির বাড়িতেই থাকে। সের্গিই গ্রামের হয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলে, দরদাম করে। দাঁড়াও, একটু চুপ করো। একটা আওয়াজ শুনলাম মনে হচ্ছে।’
হিলা কিছুক্ষণ শোনার চেষ্টা করল। বলল, ‘সর্বনাশ, জুর্কা। আমাদের আওয়াজ পেয়েছে মনে হয়। কিংবা তোমার ঐ আলোও দেখে থাকতে পারে। এই দিকটাতে দৌড়োও।’
হিলার কাছে জঙ্গলের মধ্যে দৌড়নো নিশ্চয় সহজ, কিন্তু আমার পক্ষে তা নয়। একবার যদি পড়ে যাই বা গাছে ধাক্কা খাই, আমার পলকা হাড় মট করে ভেঙে যাবে। তাছাড়া আমার কাছে অস্ত্র আছে। দেখিই না জুর্কা কোন প্রাণী। দাঁড়িয়ে গেলাম, হিলাকেও বললাম, ‘ভয় পেয়ো না।’
হিলা ভয় পেলেও আমাকে ছেড়ে পালাল না, হাতে বল্লমটা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।। শুনতে পেলাম শুকনো পাতার উপর মড়মড় আওয়াজ। অন্ধকারের মধ্যে অনেকগুলো চোখ জ্বলজ্বল করছে। আমাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে। টর্চের আলোটা ফেললাম।
জুর্কা আর কিছু নয়, ধেড়ে ইঁদুর। মঙ্গলে যে রকম ইঁদুর আছে তার থেকে অনেক বড়, কিন্তু ইঁদুর। মনে হয় তেজস্ক্রিয়ার ফলে ইঁদুরের সাইজ বেড়েছে। একটা দুটো ইঁদুর হলে কথা ছিল না, কিন্তু শ’য়ে শ’য়ে সংখ্যায়। ইঁদুরগুলো আলো দেখে একটু থমকেছিল, কিন্তু তারপরেই আবার এগোতে শুরু করল।
হ্যান্ডগান তুলে ধরে ট্রিগার টিপলাম। কিন্তু গুলিতে কটাকে মারব? একটা মরলে তার উপর দিয়ে আর একটা এগিয়ে আসছে। গুলি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ইঁদুর শেষ হবে না। সত্যিই সাধারণ বন্দুকের কর্ম নয়। লেজার ব্যবহার করব ভাবলাম, কিন্তু ধরিত্রী থেকে জেনা নিশ্চয় ক্যামেরা মনিটর করছিল, কানের কাছে ওর ফিসফিস শুনলাম, ‘সনিক’। ঠিক, একসঙ্গে এতগুলো ছোট ছোট জন্তুর জন্য আলট্রাসনিক প্রজেক্টরই ঠিক হবে। হিলার হাত ধরে আমার একেবারে কাছে টেনে আনলাম। বললাম ‘আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। একদম ছাড়বে না।’
হ্যান্ডগানটা দুহাতে তুলে ধরলাম। আলট্রাসাউন্ড বেরিয়ে এসে একটা ছোটোখাটো ঝড় তৈরি করল। ইঁদুরগুলো কাগজের টুকরোর মতো উড়ে যাচ্ছিল। চারদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করলাম।
হিলার চোখ বড়বড় হয়ে গেছে। এত জোরে ধরেছিল যে আমার পাঁজরাতে চিড় ধরার উপক্রম। ‘সত্যি করে বলো তো তুমি কে? তুমি কি মানুষ?’
আর লুকানোর কোনো মানে হয় না। আমার কানে রেডিওতে ধরিত্রী থেকে একই মত এলো। কোনো এক সময় তো সমস্ত কিছু খুলে বলতেই হবে।
‘হিলা, আমি মানুষ কিন্তু আমি আসছি মঙ্গল গ্রহ থেকে। যে যুদ্ধের কথা তুমি বলছিলে, তার আগে কিছু মানুষ মঙ্গল গ্রহে চলে গিয়েছিল। আমি তাদেরই বংশধর।’
হিলা জিজ্ঞাসা করল, ‘মঙ্গল গ্রহ কোথায়? উত্তরের পাহাড়ের ওপারে? শুনেছি সেখানে জাদুকররা থাকে।’
হিলারা কখনো আকাশে গ্রহ তারা দেখতে পায়নি। সূর্য বা চাঁদ ছাড়া অন্য কোনো জ্যোতিষ্ক এখান থেকে আর দেখা যায় না। গোটা গ্রহটার জন্যই কি এটা সত্যি, পুরোটাই তো মেঘে ঢাকা? ইতিহাসে পড়েছি জ্যোতির্বিদ্যা হল প্রথম বিজ্ঞান। এই মেঘের আবরণ কী বিজ্ঞানকে আবার নতুন করে শুরু হতে দিচ্ছে না?
গ্রামে পৌঁছোনোর আগে আমাকে বিশ্রাম নিতে হল কয়েকবার। হিলার জ্ঞান কম হতে পারে, কিন্তু জানার ইচ্ছা অনেক। বাকি কয়েক ঘণ্টা ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে কেটে গেল। বিশেষ করে অন্য গ্রহ সম্পর্কে শোনার পর থেকে তা নিয়ে ওর কৌতূহলের শেষ নেই। গ্রামের কাছে যখন পৌঁছোলাম তখন মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেছে।
গ্রামের বাইরেই ছিল গমের ক্ষেত, সেগুলো দেখলাম বেড়া দিয়ে ঘেরা। বেড়াটা খুব একটা উঁচু নয়। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোন জন্তু ফসল খেতে আসে?’
‘খরগোশের পাল। যখন আসে, সামনে যা ঘাস পাতা ছোট গাছপালা আছে, সব খেয়ে শেষ করে দেয়। ‘
‘খরগোশের পাল? কটা খরগোশ থাকে এক পালে?’
‘কে জানে? গুনব কি করে? এত জোরে দৌড়তে পারে যে গোনা শক্ত। কয়েক হাজার হতে পারে। তীর ধনুক বা বল্লম দিয়ে মারা খুব শক্ত। সের্গির বন্দুকটা পেলে হয়তো কিছু মারা যেত, কিন্তু একটা বন্দুক দিয়ে আর কটা মারা সম্ভব?‘
বুঝলাম যে সব প্রাণী বিশেষ করে বেশি তাপমাত্রায় তাড়াতাড়ি বংশবৃদ্ধি করতে পারে, তারাই এই নতুন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। সে জন্যই মশা, মাছি, ইঁদুর, খরগোশ সংখ্যায় এত বেশি, তারা আয়তনেও বেড়েছে। অথচ বড় জন্তু বিশেষ চোখে পড়েনি। সরীসৃপের মতো ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণীও নিশ্চয় অনেক বেড়ে গেছে। হিলাকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হলাম।
হিলার কুটির গ্রামের একেবারে বাইরের দিকে, সেদিন রাতটা সেখানেই কেটে গেল। পরের দিন সকালে হিলা সের্গির কাছে গেল। নিশ্চয় কালকের গল্প বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলেছে, কিছুক্ষণ পরেই এসে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চল, সের্গি তোমার সঙ্গে এখনি দেখা করতে চায়। ওর কথা না শুনলে ও গ্রামে কাউকে টিকতে দেয় না।’
গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আমার অদ্ভুত পোশাক অনেকের চোখে পড়ল। হিলাকে কেউ কেউ আমাকে নিয়ে প্রশ্নও করল, কিন্তু ও এড়িয়ে গেল। আমাকে ফিসফিস করে বলল, ‘সের্গি কারোর কাছে তোমার পরিচয় দিতে বারণ করেছে।’
‘এসো, এসো। আমি হিলার কাছে তোমার কথা শুনলাম। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না, তাই তোমার থেকেই শুনতে চাই।’ সের্গি হেসে অভ্যর্থনা জানালো।
আমি আমার কথা বললাম। আমরা কোথা থেকে আসছি, আমাদের ইতিহাস এসব বললাম। সাবধানতার জন্য, আমি যে সারাক্ষণ আমাদের রকেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, সেটা বলিনি। লোকটাকে প্রথম দর্শনে আমার তেমন পছন্দ হচ্ছিল না। সবসময় হাসছে, কিন্তু সে হাসি চোখ অবধি পৌঁছোয় না। হয়তো হিলার কথা আমাকে প্রভাবিত করেছে। সের্গি সব শুনে বলল, ‘বাঃ, খুব ভালো কথা। তা এখন তুমি কী করবে? আমাদের গ্রামকে সাহায্য করবে?’
‘সেটা আমার উপর নয়, আমি কয়েকদিনের মধ্যেই রকেটে ফিরে যাব। ভবিষ্যতে কী হবে অ্যারেস কাউন্সিল ঠিক করবে। আমার মনে হয় শুধু এই গ্রাম কেন, আমরা চেষ্টা করব আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা সব মানুষের কাছেই যেন পৌঁছোয়।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়, তা তো বটেই।’ সের্গি বলল। ‘আচ্ছা, তোমার বন্দুকটাতে নাকি ঝড় তুলতে পারে? আমাকে একবার দেখাবে?’
‘এই ঘরের মধ্যে? আচ্ছা, কম করে দেখাচ্ছি।’ আমি সনিকের সবচেয়ে কম সেটিঙে রেখে ঘরের একটা টেবিলের দিকে তাক করলাম। টেবিলটা কেঁপে কেঁপে উঠল।
সের্গিকে দেখে মনে হল ও হ্যান্ডগানটা হাতে নিয়ে দেখতে চাইছে, কিন্তু চাইতে ইতস্তত করছে। ঠিক আছে, আমি এত তাড়াতাড়ি আমার একমাত্র অস্ত্র ওর হাতে তুলে দিতে রাজি নই।
‘ভালো, ভালো। কাল সারাদিন তোমার অনেক পরিশ্রম গেছে, এখন আমার বাড়ি থেকে বেরোলে সবাই জ্বালাতন করবে। আজ তুমি আমার বাড়িতে অতিথি। খেয়েদেয়ে এখানেই বিশ্রাম করো। সন্ধেবেলা গ্রামের সবাইকে ডেকে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। হিলা, তোমাকে পাশের গ্রামে একটা চিঠি নিয়ে যেতে হবে, আর কাউকে পাচ্ছি না।’
হিলা চলে গেল। ব্যাপারটা খুব পছন্দ না হলেও মুখের উপরে কিছু বলতে পারলাম না। খালি বললাম, ‘আমি কোনো মাছ বা মাংস খাই না।’ একটু পরেই খাবার এলো, এলাহি ব্যবস্থা। প্রায় সব খাবারই অচেনা, সের্গি চিনিয়ে দিল। সবচেয়ে বেশি ছিল নানা রকম মাশরুম। মঙ্গলে মাশরুম নেই, পৃথিবীতে এই আর্দ্র গরম জলবায়ুতে ব্যাঙের ছাতার বাড়বাড়ন্ত। খাওয়ার পরেই আমাকে খাতির করে একটা ঘরে নিয়ে গেল সের্গি। বলল, ‘এখানেই বিশ্রাম করো।’
ক্লান্ত তো ছিলাম বটেই, কিন্তু শোয়ার সামান্য পরেই কেমন একটা অস্বস্তি হতে শুরু করল, যেন শরীর অবশ হয়ে আসছে। তারপরেই হঠাৎ সারা শরীরটা গরম হয়ে গেল। হ্যান্ডগানটা হাতে নিলাম। ভাবছি কী ব্যাপার, এমন সময় দরজাটা একটুখানি ফাঁক হয়ে গেল। কে যেন উঁকি মারল। আমি নড়াচড়া না করে শুয়ে রইলাম।
দরজা খুলে সের্গি ঘরে ঢুকল, সঙ্গে আর একটি অচেনা লোক। সের্গি ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে বলল, ‘এই সেই লোক যার কথা তোমাকে বলেছিলাম। বলছে অন্য গ্রহ থেকে এসেছে। অন্য গ্রহ কি জানি না, কিন্তু ওর হাতে যে অস্ত্রটা দেখছ, তা তোমাদেরও নেই। এটা তোমাকে দিতে পারি, কিন্তু তার বদলে আমাকে আরো পঞ্চাশটা রাইফেল আর পাঁচ হাজার বুলেট দিতে হবে।’
নতুন লোকটা বলল, ‘ও তো এখনো বেঁচে আছে। তোমাকে বলেছিলাম আগে মেরে ফেলতে।’
‘তা আছে, তবে বেশিক্ষণ নয়। ওর কথায় বুঝলাম মাশরুম চেনে না। এমন জিনিস খাইয়েছি, পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু কথা বলা নড়াচড়া একেবারে বন্ধ।’
‘ঠিক আছে, দেখি ওর বন্দুকটা।’ লোকটি আমার দিকে হাত বাড়াল। সের্গি সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সরিয়ে দিল। ‘ধীরে, সিভ, ধীরে। আগে বোঝাপড়া হোক, তারপরে হাতে পাবে। ও তো পালিয়ে যাচ্ছে না।’
‘পঞ্চাশটা রাইফেল দিয়ে তুমি কী করবে? এই গ্রামে যে কটা লোক আছে তার জন্য তো একটাই যথেষ্ট।’
‘এই গ্রাম শুধু নয়, আমি আশেপাশের সব গ্রামে আমার শাসন চালাতে চাই।’
সিভ নামের লোকটা ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘জমিদার হতে চাও, না রাজা?’
‘তাতে তোমাদের কী? তোমাদের সঙ্গে আমার যা চুক্তি, আমার দিকে থেকে আমি পুরোপুরি কার্যকরী করব। উত্তর পাহাড়ের ওপারে তোমরা কী করছ, আমি দেখতে যাচ্ছি না, তোমরাও আমার ব্যাপারে মাথা গলাবে না।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু তুমি প্রচুর দাম চাইছ, জিনিস না দেখে আমি কথা দিতে পারব না।’
সের্গি বলল, ‘দাম আমি কমই চাইছি। এইরকম বন্দুক একটা পেলে তার থেকে তোমরা আরো বানিয়ে নিতে পারবে। ঠিক আছে, কিন্তু তোমার হাতে দেব না। আমি দেখাব।’
সিভ একটু কঠিন গলায় বলল, ‘বন্দুক হাতে পেলেও কেমন করে চালাতে হয় তা বুঝতে তোমার দেরি হবে। সেই কথাটা মনে রেখ।’ দেখলাম সিভের হাতে উঠে এসেছে একটা ছোট রিভলভার।
সের্গি একটু বিচলিত হয়ে বলল, ‘আরে আমি তোমাকে মারতে যাব কেন? আমার কী লাভ?’
সিভ বলল, ‘সেই কথাটা মনে রেখো।’ তবে রিভলভারটা নামাল।
সের্গি আমার দিকে হাত বাড়াল। সিভ যখন রিভলভার বার করেছিল তখন দুজনেরই নজর ছিল সেই দিকে। সেই সুযোগে আমি হ্যান্ডগানটা অন করেছি। বললাম ‘কেউ নড়বে না।’
সিভের দিকেই তাক করে রেখেছিলাম কারণ ওর কাছেই অস্ত্র আছে। সিভ আমার কথা না শুনে রিভলভার ওঠাতে গেল, আমি শুয়ে শুয়েই ঘোড়া টিপলাম। ভেবেছিলাম আলট্রাসাউন্ড সেটিঙে আছে, রিভলভারটা হাত থেকে ছিটকে পড়বে। কিন্তু ছিল প্রজেক্টাইলে, গুলিগুলো সোজা গিয়ে লাগল বুকে। আর্তনাদ করে রিভলভার ফেলে বুক চেপে পড়ে গেল সিভ। আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত পড়ে জামাটা লাল হয়ে গেল। আমি হ্যান্ডগানটা সের্গির দিকে ঘোরালাম।
সের্গি ভয়ে পিছোতে পিছোতে দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার প্যারালিসিস হয়নি?‘
আমার রক্তের ন্যানোডক অণুরা প্রায় যে কোনো রকম ক্ষতিকর পদার্থদের ভেঙে দেয়, তাই বিষ আমার কিছু করতে পারবে না। হিলার সঙ্গে দেখা হওয়ার সময়ে সাপটা আমাকে কামড়ালেও আমার কিছু হত না, ন্যানোডকের কাছে এটা কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু হিলা সে কথা জানত না। ন্যানোডকরা কাজ করতে শুরু করলে শরীর গরম হয়ে ওঠে, সেটা টের পেয়েই আমি সাবধান হয়ে গিয়েছিলেম। এসব কথা সের্গিকে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন আমি কী করি? সিভের মারা যাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা, সের্গিকে তো ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করতে পারব না। মেঝে থেকে রিভলভারটা কুড়িয়ে নিলাম। রেডিয়োতে বললাম, ‘সব শুনেছ?’
আরনি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমরা তিনজনেই এখানে। ভীষণ চিন্তায় ছিলাম। গুলিটা যার লেগেছে তার কী অবস্থা?’
‘মারা গেছে। অন্য ল্যান্ডারটার কী খবর?‘
‘এখনো ঠিক হয়নি। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
আমার ল্যান্ডারটা যেখানে আছে, সে রাস্তা পার্সোনাল সেক্রেটারির কাছে থেকে জেনে নেওয়া যাবে, কিন্তু যেতে সময় লাগবে। সের্গির লোকজন পিছু নিতে পারে। তাহলে কি কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে অন্য ল্যান্ডারটা ঠিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব? কিন্তু সের্গিকে তো দিনরাত চোখে চোখে রাখা সম্ভব নয়। ভাবছি কী করব, এমন সময়ে দরজায় হঠাৎ টোকা। সের্গির মুখে একটু আশার আলো ফুটল। তাহলে কি ওর কোনো সাগরেদ এসেছে? ফিসফিস করে ওকে চুপ করে থাকতে বললাম। তারপর গলা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে?’
চাপা কণ্ঠে জবাব এলো, ‘আমি হিলা। রণ, তাড়াতাড়ি দরজা খোলো। তোমার ভীষণ বিপদ। এখনি পালাতে হবে।’
‘কী বিপদ?’
‘তোমার ভাগ্য ভালো যে তুমি এখনো বেঁচে আছ। আমি চিঠিটা দিয়ে ফিরছিলাম, এই গ্রামের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা। সে জিজ্ঞাসা করল সের্গি ওর থেকে বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা নিয়ে এসেছে কেন আমি জানি কিনা, সের্গি ওকে কিছু বলেনি। সকালবেলা সের্গির ভাবগতিক আমার পছন্দ হয়নি। মনে হয় রাত্রিবেলা তোমার খাবারে ও মিশিয়ে দেবে বলে এনেছে।’
আমি সের্গির দিক থেকে বন্দুক না সরিয়ে দরজাটা খুললাম। বললাম, ‘ভিতরে এসো।’
হিলা ঘরে ঢুকেই থমকে গেল। বলল, ‘কী হয়েছে এখানে? এই লোকটা তো মরে গেছে মনে হচ্ছে।’
আমি বললাম, ‘সের্গি আর এই সিভ আমাকে মেরে বন্দুকটা কেড়ে নিতে এসেছিল। ধস্তাধস্তিতে গুলিতে মারা গেছে।’
আমাকে কিছু বলতে হল না, হিলা সোজা একটা দড়ি নিয়ে এসে সের্গির হাত পা বেঁধে খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখল। একটা কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে দিল। বলল, ‘চলো পালাই। দরজাটা বন্ধ করে দিই, বিকেলের আগে ওকে কেউ খুঁজে পাবে না। তার আগেই আমরা অনেক দূরে চলে যাব। বনের রাস্তাঘাট আমার থেকে বেশি কেউ চেনে না, আমাদের নাগাল পাবে না। রাত্রিবেলা জঙ্গলে ঢুকতে সাহসও পাবে না।’
হিলা ওর বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। তারপরেই রওনা দিলাম হ্রদের দিকে।
কোনো মানুষের মৃত্যু আমার হাতে হল, এ কথা ভাবতেই পারছিলাম না। আমাকে বিষ খাইয়ে মারতে চেয়েছিল, আমি ট্রিগার না টিপলে ও গুলি চালাত, আমি ওকে মারতে চাইনি, এ সব সত্যি। কিন্তু তাও সিভের মৃত্যুটা বারবার মনে আসছিল। হিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সিভকে তুমি চিনতে?’
‘না, দু একবার দেখেছি। বলেছিলাম ব্যাপারীরা সের্গির বাড়িতে থাকে, ওর সঙ্গেই কথা বলে। সিভও সেইরকম জিনিসপত্র নিয়েই আসত।’
‘ও কোথাকার লোক তুমি জানো?’
‘না।’
‘উত্তরের পাহাড়ের ওপারে জাদুকররা থাকে বলেছিলে। কী শুনেছ তাদের সম্বন্ধে?’
‘লোকে বলে যে ওরা নাকি আগুন ছাড়া আলো জ্বালতে পারে, এমন গাড়ি চড়ে যাতে ঘোড়া লাগে না, ওদের তৈরি বন্দুক থেকে একসঙ্গে একশোটা গুলি বেরোয়। এরকম আরো কত কথা।’
আমি রেডিয়োতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বুঝলে?’
‘হ্যাঁ, ঐ অঞ্চলে আবার প্রযুক্তির বিকাশ শুরু হয়েছে। তুমি ফিরে এসো, তারপর কথা হবে। এই রকম বিপদের মধ্যে আবার যাওয়ার আগে অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হবে। মনে হয় অন্য কোনো অভিযান পাঠানোই ভালো, তারা আরো তৈরি হয়ে আসবে।’ মেরিনা বলল।
একটা চিন্তা মাথার মধ্যে কুরেকুরে খাচ্ছিল। সেই কথা বললাম। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলাম। মেরিনা হিসাব করে বলল যথেষ্ট জ্বালানি আছে। এখন কাউন্সিলের সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষা।
কয়েক ঘণ্টা পরে হিলাকে বললাম, ‘সের্গি তোমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল, হাতে পেলে খুন করে ফেলবে। তাহলে তুমি এখন কী করবে? গ্রামে ফেরার রাস্তা তো বন্ধ।’
‘ঠিক। তা বলে তোমাকে নিয়ে এসেছি, তোমার বিপদে কিছু না করে পালিয়ে যেতে পারি না। আশেপাশের গ্রামেও থাকা যাবে না। তাই ভাবছি দূরে কোথাও চলে যাব।’
‘কত দূরে যেতে চাও? আমাদের সঙ্গে যাবে?’
‘তোমাদের সঙ্গে? কোথায়?’
‘মঙ্গলগ্রহে। তোমার থেকে পৃথিবীর সম্পর্কে খবর পাব, আমাদেরও লাভ। যদি মঙ্গলে না থাকতে পারো, পরে তো আবার পৃথিবীতে অভিযান আসবেই, তার সঙ্গে ফিরে আসবে।’
হিলা আমার দিকে ফিরে তাকালো। ওর চোখ চকচক করছে।
Tags: অনন্যা বসু, কল্পবিজ্ঞান গল্প, গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, দীপ ঘোষ, নতুন পৃথিবী, সুপ্রিয় দাস
অসাধারণ! এমন লেখা বারবার পড়তে চাই!
ধন্যবাদ
Best valo
কল্পবিজ্ঞানের গল্প পরতে ভীষণ ভালোবাসি ।
নতুন পৃথিবী গল্পটা খুবই ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ পীযূষ কান্তি দাস ও সোনালি মিশ্রকে।
Er to part 2 thanks uchit…likhe felun…