নবজাগরণের মানুষ
লেখক: জয়ন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
সকলে হর্ষধ্বনি করে উঠল, যখন ক্ষুদ্রকায় লোকটি তাদের জানাল, সে একজন বৈজ্ঞানিক।
তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা তাদের কম্পিউটারগুলির পাশে দাঁড়িয়ে নৃত্য শুরু করল, ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিবিদরা তাদের ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। বিশাল ল্যাবরেটরিটা জমায়েত হওয়া সাংবাদিকদের ঘন ঘন হাততালিতে ফেটে পড়ল। হেরাল্ড পত্রিকার সাংবাদিক স্যালাগ্নিককে ব্যাপারটা এতই গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল যে, সে এই দৃশ্যটির বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিল,কয়েক বছর আগে অ্যাপোলো মহাকাশযানের উৎক্ষেপণের সময়ে নাসার কর্মীদের প্রবল আনন্দোল্লাসের কথা তার মনে পড়ছে।
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!” ইটালিয়ান জীবরসায়নবিদ ড: বাৎজা বললেন, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে ও একজন দারোয়ান নয়।”
সাংবাদিকটি তার নোট থেকে মুখ তুলল, “ক্ষমা করবেন স্যার, আপনি বলছিলেন…?”
“বলছিলাম, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এমন একজনকে আমরা আনতে পেরেছি যে আমাদের মূল্যবান কিছু জানাতে পারবে।”
“এ ব্যাপারে কি সত্যিই তেমন কোনো সন্দেহ ছিল?” প্রশ্ন করল স্যালাগ্নিক। পেনসিলটা পৃষ্ঠার ওপরে ধরা, লিখে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
“অবশ্যই ছিল,” জবাব দিলেন ইটালিয়ান বিজ্ঞানী। “আমরা জানতাম, হার্ভার্ড ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে কোনো একজনকে টেনে নিয়ে আসতে পারব, কারণ এই মুহূর্তে আমরা ঐ বিল্ডিংয়ের ভেতরই আছি। কিন্তু সে যে-কোনো লোকই হতে পারত। আমরা হয়তো দেখতাম যার সঙ্গে কথা বলছি, সে কলেজের কোনো নবাগত ছাত্র… কিংবা ঝাড়ুদারনি… বা, এমনকি ল্যাব দেখতে আসা কোনো টুরিস্টও হতে পারত। আমরা নিশ্চিত ছিলাম না, ঠিক কোন জায়গাটায় আমাদের এ.টি.ভি. আভির্ভূত হবে–”
“এ. টি. ভি,” ঝড়ের মতো তার নোটবুকে লিখতে লিখতে সাংবাদিক বলল, “ওটা হল ‘এরিয়া অব টেমপোরাল ভ্যাকুইটি’ অর্থাৎ, একটা নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেকার কালগত শূন্যাবস্থা, তাই তো?”
“ঠিক বলেছেন। ওটা অনেকটা ঐ সব যন্ত্রগুলোর মতো, যেগুলো আপনারা অ্যামেরিকানরা ১৯৭০-এর দশকে বিভিন্ন গ্রহের যেখান-সেখান থেকে মাটির নমুনা তুলে আনার জন্য আন্তর্গ্রহ অনুসন্ধানকারী মহাকাশযানগুলোতে বসিয়েছিলেন। পার্থক্য হলো, এবারে আমরা শুধু একটি জীবন্ত মানুষকে তুলে এনেছি, এবং সেটা আমাদেরই গ্রহ থেকে। এই মানুষটি হলো নিতান্তই – কী বলা যায় – একটা ঐ রকমই যেখান-সেখান থেকে তুলে আনা নমুনামাত্র।”
“কিন্তু ঠিক ততখানি ‘যেখান-সেখান’ থেকে তুলে আনা নয়, আশা করি…”
“ওহ্ না, অবশ্যই নয়। আমরা জানতাম, আমাদের এ.টি.ভি. ফিজিক্স ল্যাবেরই কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় আবির্ভূত হবে।আমরা ধরে নিয়েছিলাম, উচ্চ পর্যায়ের গবেষণার জায়গা হিসেবে এই স্থানটি আরও বহু বছর টিকে থাকবে। কিন্তু এই বাড়িটা ছাড়া একেবারে সঠিক জায়গা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল অত্যন্ত অস্পষ্ট। আর সময় সম্পর্কে বলতে গেলে, আমরা নিশ্চিতভাবে জানতাম, আমাদের এই অতিথি–” তিনি সেই ক্ষুদ্রকায় মানুষটির দিকে ইঙ্গিত করলেন, সে তখন মৃদু হেসে বিস্মিতভাবে মাথা নাড়ছিল – “তিনশো বা চারশো বছর পরেকার ভবিষ্যৎকাল থেকে আসছে।”
স্যালাগ্নিক ঘরের অপরদিকে দাঁড়িয়ে থাকা এই নতুন সেলিব্রিটির দিকে তাকিয়ে রইল, এখন তাকে ঘিরে রয়েছে অজস্র ক্যামেরা আর আলো। সে অবশ্য আগন্তুককে আরও ভালোভাবে দেখতে পেত যদি কাছের দেওয়ালে লাগানো টিভির পর্দায় চোখ রাখত– কারণ ভবিষ্যৎ থেকে আগত বিজ্ঞানীর বর্তমানের ছ’ঘণ্টা সময়সীমার সমস্তটুকুই এখন টেলিভিশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু সে নিজের চোখ দিয়েই ঐ ছোট্ট মানুষটিকে দেখতে চাইছিল। ‘আমি ওখানে ছিলাম’, সে তার নাতিপুতিদের একদিন বলতে পারবে, ‘আমি তখন ঠিক ঐ ঘরটাতেই ছিলাম, যখন আমরা ভবিষ্যৎ থেকে লোকটিকে ধরে এনেছিলাম।’
এক নির্বোধ সাংবাদিক চিৎকার করে ঐ গতানুগতিক প্রশ্নটাই করে বসেছিল, “কেমন মনে হচ্ছে এখন?” (‘চাঁদে পা দেওয়া প্রথম মানুষ হিসেবে কেমন মনে হচ্ছে এখন?’ তারা এ ধরনের প্রশ্ন করতেই অভ্যস্ত। ‘সাতটা সোনার মেডেল পেয়ে কেমন মনে হচ্ছে এখন?’ আপনার স্ত্রী সুদ্ধ সমস্ত পরিবার উল্কার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে খবরটা পেয়ে কেমন মনে হচ্ছে এখন? রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে কেমন মনে হচ্ছে এখন?’), এবং ছোট্ট মানুষটি তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
“বলতে কি,”আলোর দিকে চোখ পিটপিট করে সে বলছিল, “ব্যাপারটা পুরোটাই একেবারে অপ্রত্যাশিত। এই আমার ক্ষেত্রে যেটা ঘটল এই সবকিছুই … মানে আমি বলতে চাইছি, আমি সারা জীবনে কোনো কিছুই জিতে পাইনি, এবং আমি ভাবতেও পারিনি যে, আমি, এত লোকের মধ্যে এই আমিই সেই লোক, যে …আপনারা জানেন… এইভাবে এখানে উপস্থিত হয়েছি। এবং আমি বলতে চাই, এটা নিঃসন্দেহে একটা বিরাট সম্মান এবং এখানে আপনাদের মধ্যে এসে আমি যতটা হতে পারা যায়, নিঃসন্দেহে ততটাই গর্বিত বোধ করছি, এমনকি এই আসাটা অতি অল্প সময়ের জন্য হলেও।… উম্ম্… ” সে ঠোঁট কামড়ে আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ পিটপিট করে বলা শুরু করল, “আমি আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই যে, আমার যুগটা সত্যিই, উম্ম্, খুবই উন্নত – অন্তত আমরা সেটাই মনে করে থাকি, হা হা! আদ্দিস আবাবায় যে বিশ্বমেলাটা হয়েছিল তার মূল বাণীটাই ছিল, ‘জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক সাফল্যের তৃতীয় নবজাগরণ’… যে নবজাগরণ বাইশ শতকের প্রথমদিকে হওয়া নবজাগরণের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বলা যায় –কিন্তু তার কথাটাও নিশ্চয়ই আপনাদের জানা নেই, নাকি আছে? হুম্ম্… সত্যি বলতে কি আমি খুব একটা ভালো বলিয়ে-কইয়ে নই, বুঝলেন কিনা, কিন্তু, উম্ম্… আমি আশা করছি যে, আপনাদের আমি আমাদের সময়ের বেশ কিছু জ্ঞান বিতরণ করতে পারব, যা হয়তো আপনাদের কৌতূহল জাগিয়ে তুলবে, এবং, উম্ম্…খানিকটা সাহায্যও হয়তো করবে, কী বলেন?”
লাজুকভাবে মৃদু হাসল সে।
“খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার!” বিড়বিড় করে বললেন ড: বাৎজা। “এই তিন চার শতাব্দীতে ভাষার যথেষ্ট পরিবর্তন হওয়ারই কথা, কিন্তু এ তো দেখছি আমার চাইতেও ভালো ইংরেজি বলছে। মনে হচ্ছে ভাষার এই স্থিতাবস্থার কারণ হয়তো সিনেমা…”
“সেটা তো ভালো ব্যাপারই।” ফিসফিস করে বলল স্যালাগ্নিক। “ভেবে দেখুন, এই প্রোজেক্টটা যদি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো, যদি আপনাদের এ.টি.ভি. একটা তিন বছরের বাচ্চাকে অথবা কোনো নির্বোধ মানুষকে–যে কিছুই বলতে পারে না– তুলে নিয়ে আসত, তাহলে গভর্নমেন্ট এত তাড়াতাড়ি তার অনুদানের টাকাগুলো ফিরিয়ে নিত যে, আপনাদের মাথা ঘুরে যেত।”
তার মনে পড়ল নাসা কী চেষ্টাই না করেছিল কংগ্রেসকে বোঝাতে যে, চন্দ্রাভিযাত্রীরা যে মূল্যবান বৈজ্ঞানিক তথ্য নিয়ে এসেছে, অর্থাৎ আধ ডজন ব্যাগভর্তি চাঁদের নুড়িপাথর, তাতে এই অভিযানের পেছনে যে কোটিকোটি ডলার খরচা হয়েছে তা পুষিয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের কাছে চন্দ্রাভিযান বাস্তববর্জিত বলে বিবেচিত হওয়ায় অচিরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। এই ল্যাবরেটরির কর্মীদের মধ্যেও ঐ একই ধরনের চাপ ছিল…
কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের কপাল যেন খুলে গেছে।
“ও হ্যাঁ”, সেই ছোট্ট মানুষটি বলে চলেছিল, “আমি প্লাজমিক বায়োফিজিক্সের প্রোফেসর ছিলাম, তা প্রায়…ধরুন…হ্যাঁ, প্রায় আঠাশ বছর ধরে।”
“একটু আমাদের বলবেন ওর মানেটা কী?” ভীড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে একজন সাংবাদিক চিৎকার করে প্রশ্ন করল।
সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে অজস্র ক্রুদ্ধ স্বর ঝড়ের মতো তার মাথায় আছড়ে পড়ল–‘এই চুপ!’, ‘দয়া করে চুপ করুন!’, ‘বের করে দাও লোকটাকে!’, ‘শ্শ্শ্!’, ‘ওটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলব!’, ‘থামুন !’
আগেই ঠিক ছিল, সাংবাদিকরা চুপ করে থাকবে, প্রশ্নের ব্যাপারটা একদল বিজ্ঞানী ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে যে প্যানেলটা করা হয়েছে, তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হবে, যারা উপযুক্ত প্রশ্ন করে ঐ অল্প সময়টার সঠিক সদ্ব্যবহার করতে পারবে। ঐ সাংবাদিকটির অবান্তর প্রশ্নে ইতিমধ্যেই খানিকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে …
“প্রোফেসর,” নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্যাথলজিস্ট ড: স্ক্লার বলা শুরু করলেন, “প্রথমে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দিয়েই শুরু করা যাক।” অত্যন্ত গম্ভীরভাবে কথাগুলো তিনি বললেন, কারণ তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন যে, সারা পৃথিবী তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ শুনছে। “আমি এমনকি আপনার নাম জিজ্ঞেস করার জন্যেও থামব না–”
“মডেস্টো ১৪এক্স গুডইয়ার।” বাধা দিয়ে বলে উঠল ছোট্ট মানুষটি।
“–বা আপনার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাইব না। আমরা যারা এখানে জড়ো হয়েছি, আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির অন্তত কিছু যদি সমাধান করা যায়, সে ব্যাপারেই আমরা আগ্রহী। প্রথমেই জিজ্ঞেস করি–”
তিনি একটু থামলেন এবং একটা নাটকীয় আবহ তৈরী হতে দিলেন।
“—আপনার সময়ের লোকেরা কি ক্যান্সারের ওষুধ খুঁজে পেয়েছে?”
আগন্তুক মৃদু হাসল। “হায় ভগবান, অবশ্যই পেয়েছে,” সে উত্তর দিল, “আমরা ক্যান্সার নিয়ে প্রায় কোনো আলোচনাই আর করি না। মানে আমি বলতে চাইছি, একমাত্র মহাকাশের প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে যারা এ রোগ নিয়ে আসে তারা ছাড়া, আর..”
স্ক্লার তাকে থামিয়ে দিলেন। “একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন কীভাবে এটা সারে?” তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা তীব্র আগ্রহ ফুটে উঠল।
“ওফ্!” দম ছেড়ে সিলিঙের দিকে একবার চোখ তুলে ছোট্ট মানুষটি বলতে শুরু করল, “হুম্, দাঁড়ান দেখি। বড় শক্ত প্রশ্ন করেছেন।” বেশ কয়েক সেকেণ্ড সে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। “ব্যাপার কি জানেন, আমার কোনোদিন ক্যান্সার হয়নি এবং আমি যাদের চিনি তাদের মধ্যে খুব কম জনেরই…কিন্তু যদি আমাদের কারুর ক্যান্সার হয়ই, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে রিং করি, সে তখন আসে এবং, উম্ম্…”
“সে কী করে তখন?”
“মানে, সে তখন আমাদের ওই ওষুধটা দেয়, আর তখন আমরা…স্রেফ ঘুমিয়ে পড়ি, আর ঘুম থেকে উঠে দেখি সব সেরে গেছে।”
“ওই ওষুধটা?” জানতে চান স্ক্লার।
“হ্যাঁ, মানে…আমার আশঙ্কা হচ্ছে আমি আপনাদের কেবল ব্র্যান্ড নামটাই বলতে পারব–ওর নাম হলো গিয়ে, ‘গ্রো-গো-ওয়ে’। আমার মনে হচ্ছে, এতে আপনাদের খুব একটা লাভ হবে না…”
ড: স্ক্লারকে খুব হতাশ দেখাল।
“বুঝতেই পারছেন, আসলে এটা আমার জানার এলাকার মধ্যে পড়ে না।” অপ্রস্তুতভাবে ঘাড় নেড়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল সে।
“আচ্ছা, একটু আগে আপনি ডাক্তারকে রিং করে ডাকার কথা বলছিলেন,” প্যানেলের আর একজন জিজ্ঞেস করলেন, (ড: স্ক্লার তখন নতুন কিছু প্রশ্ন লিখতে ব্যস্ত) “আমি একজন যোগাযোগব্যবস্থা সম্পর্কিত ইঞ্জিনিয়ার। আপনাদের সময়কার যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্বন্ধে যদি কিছু আমাদের বলেন।”
“আনন্দের সঙ্গে।”
“যেমন ধরুন, যখন আপনি ডাক্তারকে রিং করেন তখন ঠিক কী ঘটে?”
“কেন, ডাক্তার তক্ষুনি চলে আসে। অন্তত তার আসারই কথা। কিন্তু আপনাকে বলতে বাধা নেই, আপনি মাঝেমাঝেই রূঢ় ব্যবহার আর নিম্নমানের চিকিৎসা পাবেন। আপনাকে সে বলবে, সে এখন ভয়ঙ্কর ব্যস্ত এবং ”
“প্লীজ স্যার, আমি জানতে চাইছি, ওটা কীভাবে কাজ করে। আপনারা কি ঐরকম যন্ত্র ব্যবহার করেন?” ইঞ্জিনিয়ার কাছের টেবিলটা আঙুল দিয়ে নির্দেশ করলেন, “টেলিফোন?”
“ওহ্ টেলিফোন! হ্যাঁ, ওসব আমরাও ব্যবহার করি, শুধু সেগুলো দেখতে ওটার মতো নয়। আরেব্বাস ! আমাদের ওখানে ওটা কী দারুণ একটা অ্যান্টিক হতে পারত…না, আমাদেরটা কানের পেছনে লাগানো থাকে।” সে নিজের কানের পেছনে হাতটা নিয়ে গেল। “এই যাঃ,আমি আমারটা ফেলে এসেছি, নইলে আপনাদের দেখাতে পারতাম…কিন্তু সে যাই হোক, আমরা যখন কোনো ডাক্তারকে রিং করি সেটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। তখন আমরা বাথরুমের লাল বোতামটা টিপি, বাথরুমটা বিছানার পাশেই কিনা, তারপর আমরা বর্ণনা দিই আমাদের শরীরের – কিন্তু আপনাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন।”
“না, না, বলে যান।”
“আমরা শুধু বলি, ‘আমি অসুস্থ বোধ করছি, কাউকে এখানে পাঠান।’”
“অন্যদিকে কে থাকে?”
“কেন… লোকজনরা থাকে, আর তারা আমার কথা শুনে সাহায্য পাঠায়।” কেমন একটা অনিশ্চিতভাব তার মুখে ফুটে ঊঠল। একটু থেমে সে বলল, “অবশ্য এতে বেশ কয়েক মিনিট সময় লেগে যায়।”
“এই সমস্ত ব্যাপারটা কীভাবে কাজ করে? যোগাযোগের এই যান্ত্রিক ব্যবস্থাটা আমাদের একটু ব্যাখ্যা করে বলুন।”
“কীভাবে যে বলি!” ভবিষ্যৎ থেকে আগত বিজ্ঞানীর স্বীকারোক্তি, “আমি এ ব্যাপারে সত্যিই কিছুই জানি না। আমি কখনোই এটা জানার কথাও ভাবিনি। মানে, আমি বলতে চাইছি, বোতামটা সবসময়েই দেওয়ালে লাগানোই থাকে আর যখন দরকার পড়ে তখন আমি শুধু… আমার সত্যিই ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে, কিন্তু বুঝতেই পারছেন, ওটা আমার কোনোভাবেই চর্চার ক্ষেত্র নয়। আমার চর্চার বিষয় হলো সম্পূর্ণভাবেই এক বিশেষ ধরনের ক্রোমোজোম্যাটিক উদ্ভিদ-দানা, যেগুলোকে বলা হয় ‘ফিলিপস্ বডি’ এবং…সে যাই হোক, যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, লাইনের অপরদিকে যারা থাকে, তাদের কর্মদক্ষতাকে কোনোভাবেই বিশ্বের সেরা বলা চলে না। বিশ্বাস করুন, ওদের পরিষেবার মান আজকাল ভয়ানক খারাপ হয়ে পড়েছে, আর সবসময়েই তো আজ এটা নিয়ে কাল ওটা নিয়ে ওদের ধর্মঘট লেগেই আছে। ফলে…”
“অস্ত্র!” একজন সেনানায়ক বলে উঠলেন, “আপনাদের সামরিক অস্ত্রভাণ্ডারের সব থেকে উন্নত অস্ত্রগুলো কী”
“স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কোনো সামরিক বাহিনী নেই, কিন্তু…ও হ্যাঁ, আমাদের হাতে বেশ কিছু ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র আছে বটে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওগুলোর একটাকে সংক্ষেপে বলা হয় ভি আর ভি। – আমি ঠিক জানি না ঐ তিনটে অক্ষরের সঠিক মানে কী – যেটা কোনো শহরের ওপর প্রয়োগ করলে সেই জায়গাটা জুড়ে একটা চোদ্দ মিটার গভীর গর্ত হয়ে যাবে, অথচ আশেপাশের জনপদের গায়ে আঁচটি পর্যন্ত লাগবে না। একবার একটা সত্যিই ব্যবহার করা হয়েছিল – পোয়ের্তো রিকো’র সাঁ হুয়ান শহরে।”
“ওটা কীভাবে কাজ করে?”
“হুম্ম্…এবার আমায় আপনি সত্যিই বেকায়দায় পেয়েছেন। কী যে বলব বুঝতে পারছি না, আমি একেবারেই বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে গেছি।” মুখটা অন্ধকার করে চুপ করে গেল সে। কিন্তু তারপরই তার মুখটা ঊজ্জ্বল হয়ে উঠল। “ব্যাপার কি জানেন? এ ব্যাপারে আপনার দরকার একজন নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলা। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি জুলিয়ো ৬এক্স ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে কথা বলেন। ও আমার একজন পুরোনো বন্ধু…যদিও এক্ষুনি সেটা আপনাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, তাই না? হুম্ম্…আমার মনে হচ্ছে আমি যেন কোথায় পড়েছিলাম যে, জোয়ারের ওপর চাঁদের আকর্ষণ যে নিয়মের ফলে হয়, সেই একই নিয়ম এখানেও ব্যবহৃত হয়। জোয়ারের ওপর চাঁদের আকর্ষণ–কথাটা কি ঠিক বললাম? অবশ্য আমার সত্যিই ওসব জানার কথা নয়।”
স্যালাগ্নিক তার সঙ্গীর দিকে ঝুঁকে ফিস ফিস করে বলল, “আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু এই লোকটা তো কোনো কিছু সম্পর্কে কোনো কিছুই জানে না। কী পাচ্ছি তাহলে আমরা?”
ড: বাৎজা শুধু মাথা নাড়লেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এক্ষুনি কেঁদে ফেলবেন।
ছোট্ট মানুষটি তখন মাধ্যাকর্ষণ বিরোধী বেল্ট-এর নির্মাণ কৌশল ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিল, যেটা পরে তার ছেলে লেকের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। “ওটা একবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তখন বাধ্য হয়ে আমাদের মিস্ত্রি ডাকতে হয়। সে…হ্যাঁ, সে আমাকে বলেছিল ওর মধ্যে একটা ব্যাটারি থাকে, আর…হ্যাঁ, ত্রিকোণাকৃতি স্পঞ্জের মতো একটা কিছু থাকে…যতদূর মনে হচ্ছে ওটাকে লেভিয়া বলা হয়, কিন্তু জানি না ওটা কী দিয়ে তৈরী। জিঙ্ক হতে পারে কি?”
বিজ্ঞানীরা বহুক্ষণ আগেই নোট নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।
ড: বাৎজা স্যালাগ্নিকের দিকে ঘুরে বসলেন। “শুনুন,” অনুনয়ের সুরে তিনি বললেন, প্রবল হতাশা তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা তীক্ষ্ণতা এনে দিয়েছিল, “যদি আপনি কোনোভাবে মধ্যযুগে চলে যান, সেখানে আপনি বর্তমান যুগের জ্ঞান কতটুকু প্রদর্শন করতে পারবেন বলে মনে করেন? তখনকার মানুষকে কি আপনি বলতে পারবেন, কীভাবে এরোপ্লেন তৈরী করা হয়? কিংবা অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করতে পারবেন? বা, নাইলন তৈরী করে দেখাতে পারবেন? কতটা সফল হবেন আপনি?”
স্যালাগ্নিক কাঁধ ঝাঁকালো। “আমার মনে হয়..” সে সাহস করে মন্তব্য করল, “আমার মনে হয়, এমনকি নবজাগরণের যুগেও নবজাগরিত মানুষ খুব একটা বেশী ছিল না।”
ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডার চলতেই থাকল।
“আমার মনে আছে, আমি মেকানিকের কাঁধের ওপর দিয়ে দেখছিলাম, যখন সে ব্যাটারিটা পালটাচ্ছিল।” ছোট্ট মানুষটি তখন বলে যাচ্ছিল, “আর ওটার মধ্যে ছিল একগাদা তারের ছোট একটা বান্ডিল, আর…”
লেখক পরিচিতিঃ টি.ই.ডি. ক্লায়েন (T.E.D. Klein) অ্যামেরিকার একজন অতি উচ্চস্তরের হরর গল্পের লেখক ও সম্পাদক। জন্ম : ১৫/৭/১৯৪৭। মূলত হরর গল্পের লেখক হলেও অন্য ধরনের গল্পও লিখেছেন। যদিও তাঁর সামগ্রিক লেখার সংখ্যা খুবই কম। তাঁর এই সায়েন্স ফিকশন গল্পটি (Renaissance Man) ১৯৭৪ সালে রিচার্ড ডেভিস সম্পাদিত “Space-2” সায়েন্স ফিকশন অ্যান্থলজিতে প্রকাশিত হয়। “নবজাগরণের মানুষ” এই গল্পটিরই আক্ষরিক অনুবাদ।
Tags: অনুবাদ গল্প, গল্প, জয়ন্তকুমার মুখোপাধ্যায়, টি. ই. ডি. ক্লায়েন, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, নবজাগরণের মানুষ, সুপ্রিয় দাস