নবজাতক
লেখক: মধুমিতা মুখার্জী
শিল্পী: বানী ভট্টাচার্য
–সিস্টার, বাচ্চাটা এখনও কাঁদেনি? মিনিট দুয়েক তো হয়ে গেল ডেলিভারীর?
–না স্যার, এখনও কাঁদেনি। ভালো করে দেখুন তো বাচ্চাটার মুখটা কেমন হাসি হাসি আর পরিণত! আর তাকানোটাও লক্ষ্য করুন, আমার দীর্ঘ বারো বছরের নার্সিং প্রফেশনে এরকম স্পষ্ট চোখের ভাষাওয়ালা বাচ্চা কখনও দেখিনি।আর এমনি তো সব কিছুই স্বাভাবিক দেখছি।
–হুমম্। কিন্তু, বাড়ির লোকজন তো বাইরে অপেক্ষা করছে, তাদের তো কিছু বলতে হবে?
মফঃস্বল শহরের সরকারি হাসপাতালের সিনিয়ার ও.টি. নার্স আর ডাক্তারের চোখে মুখে চিন্তার স্পষ্ট ছাপ। আজকাল পেশেন্টের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বড্ড মেপে বলতে হয়, কখন যে বাড়ির লোকজন ক্ষেপে উঠে মারতে আসবে কিছুই বলা যায় না।
–সিস্টার, আপনি বাইরে গিয়ে বলে দিন যে, সব ঠিক আছে।
–মিসেস স্তুতি পালের বাড়ির লোক কে আছেন?
নার্সের ডাকে সামনের জটলার মধ্যে থেকে কিছু মানুষ উঠে সামনে এসে দাঁড়ালেন।
–এই যে, এ ওঁর স্বামী। দিদি, কি হল ছেলে না মেয়ে?
ও.টি. নার্স মিস দিক্ষিত মুখ ভরতি হাসি ফুটিয়ে বলেন–
–মিষ্টি খাওয়ান সবাইকে। তিন কেজি ওজনের ছেলে হয়েছে আপনার।
–ইয়ে মানে, মা–বাচ্চা দুজনেই ঠিক আছে তো দিদি? আসলে বেশ কিছুদিন ধরে বাচ্চার নড়াচড়া ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
–হ্যাঁ হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।
***
আজ তিনদিন হল সদ্যোজাত ছেলে কোলে স্তুতি বাড়ি ফিরেছে। বাড়িশুদ্ধ সবাই আনন্দে মাতলেও ও ঠিকমতো খুশি হতে পারছে না কেন, সেটা স্তুতি ঠিক বুঝতে পারছে না।
এমনি দেখতে গেলে বাচ্চার দুধ খাওয়া বা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস সবই স্বাভাবিক। কিন্তু, বাচ্চা কখনওই খাওয়ার জন্য কাঁদে না। আর প্রতিবার খাওয়ার পরে ঠিক দুবার ন্যাপী ভেজায়। একদিন ইচ্ছে করে প্রায় ছ’ঘন্টা না খাইয়ে দেখেছে যে, বাচ্চার মধ্যে কোনও বিকার নেই। অত্যন্ত সাবলীলভাবে হাত-পা নাড়ছে। আর চোখ দুটো! উফফ, ওই ক-দিনের শিশুর চোখদুটো যেন কত কিছু বলে চলেছে। চোখের রংও যেন কেমন ধূসর বর্ণের।
বাড়িতে কাকে ওর এই অনুভূতির কথা বলবে বুঝতে না পেরে একদিন দোনামনা করে ওর বর সুমনকে বলেই ফেলল। তার ফল হল উলটো। সুমনের ধারণা হল ওর মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিয়েছে তাই নিজের ছেলেকে সহ্য করতে পারছেনা। তারপর থেকেই সুমনের মা সর্বক্ষণ স্তুতির ছেলেকে পাহারা দেন, ও শুধু খাওয়ায়।
স্তুতি স্পষ্ট দেখেছে যে, ছেলে ওর দিকে কেমন করে যেন তাকায় আর সর্বক্ষণ কিসব চিন্তা ভাবনা করে। ভুরু কুঁচকে এরকমভাবে সিলিং এর দিকে তাকাতে কখনও কোনও বাচ্চাকে পৃথিবীর কেউই দেখেনি বোধহয়।
দিনের পর দিন যায়, বাচ্চাটাও একটু একটু করে বড় হয় আর সেইসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ঠাকুমার পাহারাও কমে যায়। স্তুতিও সংসারের সব কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। তবুও নিজের সন্তানের প্রতি স্তুতির সেরকম মায়া জন্মায় না বলে নিজের ওপরই মাঝে মাঝে ধিক্কার হয়। একটা ছোট শিশু, যাকে নিজের শরীরে এত দিন বহন করেছে তার প্রতি এত ঔদাসিন্য কেন? তবে কি ও নিজেই স্বাভাবিক নয়? নাহ্, স্তুতি এসব নিয়ে আর বেশি ভাববে না।
এখন ক-দিন ব্যবসার কাজে সুমন অন্য শহরে গেছে তাই স্তুতি একাই রাতে ছেলে সন্তুকে নিয়ে ঘুমায়। সন্তুর এখন ছয় মাস বয়স তাই সব রকমের খাবার-দাবার খায় আর মুখ দিয়ে বিভিন্ন রকমের আওয়াজও করে।
একদিন মাঝরাতে একটানা ঝিনঝিনে একটা একঘেঁয়ে আওয়াজে স্তুতির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে হঠাৎ মনে হয় তারা ভরা খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে হতবাক হয়ে, নিশ্চল শুয়ে শুয়ে সব লক্ষ্য করতে থাকে স্তুতি। সারা ঘরে জোনাকির মতো কিছু আলোর ফুলকি উড়ে চলেছে! ওদের আলোতেই বোঝা যাচ্ছে যে ওগুলো জোনাকি নয়, সঙ্গে ছোট্টো ছোট্টো এ্যান্টেনার মতো কিছু মাথার ওপরে লাগানো আছে। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার ঘটল এরকম কিছু সময় চলার পরে। দেখা গেল, সব আলোগুলো একসঙ্গে মিলে একটা মানুষের মতো আকার ধরেছে যার উচ্চতা মেরেকেটে এক হাতের মতো। সেই আলোর ছোট্টো মানুষ সন্তুর সামনে খাটের ওপর আকাশে ভেসে রয়েছে আর সন্তু বড় বড় চোখ করে মুখ দিয়ে যান্ত্রিক একটা শব্দ করে কিছু বলছে!
ভয় পেয়ে চমকে উঠে বসে স্তুতি, আর সঙ্গে সঙ্গে আলোর ফুলকিগুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে যায়। ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখে কিরকম একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে সন্তু ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টি কোনও শিশুর হতেই পারে না, কে এই বাচ্চাটা?
একটা ঝিম ধরানো মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে আর স্তুতির কিচ্ছু মনে নেই। সকালে শাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাঙে সঙ্গে অসহ্য মাথা ব্যাথা। তাকিয়ে দেখে ছেলে শাশুড়ির কোলে হাসি মুখে হাত-পা ছুঁড়ে খেলছে। চোখের রংটা ধূসর হলেও অন্য শিশুদের সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। তাহলে কি সব মনের ভুল ছিল?
শাশুড়িমা স্তুতিকে বলেন যে, ছেলের কান্না শুনে উনি এসে দেখেন যে সে বিছানা ভিজিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে আর স্তুতি অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এতদিনে এই প্রথম এত হাসি খুশি বাচ্চা কাঁদল তাও আবার স্তুতির ঘুমের জন্য, তাই তিনি রেগে গেছেন।
নাহ্, স্তুতি এবারে বুঝতে পারছে যে ওর ছেলে সম্পূর্ণ সুস্হ শিশু। আর বাচ্চার সম্বন্ধে উল্টোপাল্টা ভাববে না।
দিন দিন স্তুতির ছেলের ওপর মায়া-মমতা জন্মাতে থাকে আর ছেলেও একদম অন্য বাচ্চাদের মতো বেড়ে উঠতে থাকে। অবশ্য অন্য বাচ্চাদের মতো বলাটা ঠিক নয়, ওর বয়সের অন্য বাচ্চাদের থেকে বেশি ভদ্র-সভ্য হয়েই বড় হতে থাকে সন্তু।
স্কুলে ভর্ত্তি হবার পরীক্ষায় এক নম্বরে সন্তুর নাম ওঠে। তারপর থেকে ক্লাসের প্রতিটা পরীক্ষায় সন্তু প্রথম হতে থাকে। ও কখনওই অসুস্হ হয় না, তাই স্কুলেও নিয়মিত হাজিরা আর পড়াশোনায় ভালো হওয়ার জন্য সকল শিক্ষকদের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠে অচিরেই। তবে পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনও কিছুতে সন্তুর বিশেষ উৎসাহ দেখা যায় না। সারাদিন বিভিন্ন বইয়ের মধ্যেই ও ডুবে থাকে।
***
সব কিছুই একদম স্বাভাবিক চলছিল এরকম একদিন যখন সন্তুর প্রায় বারো বছর বয়স, স্তুতির মনে আবার ওর সম্বন্ধে ভয় জন্মাল।
সন্তু দরজা বন্ধ করেই ছোট থেকে পড়াশোনা করে আর তাতে কেউ কখনও অস্বাভাবিক কিছু মনে করেনি। এরকম একদিন সন্তুর পড়ার ঘরের বাইরে দিয়ে যাবার সময়ে বন্ধ দরজার ভেতর থেকে একঘেঁয়ে যান্ত্রিক স্বর শুনতে পায় স্তুতি। সেই শুনে দরজার ফাঁক দিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখে যে সন্তুর পড়ার ঘরের আলো নেভানো আর টেবিলের ওপর সেই আলো দিয়ে তৈরি এক হাত মতো মানুষের অবয়ব। সন্তুর মুখ দিয়ে যান্ত্রিক স্বর বেরোচ্ছে সেই আলোক মূর্তির উদ্দেশ্যে। আরও ভালো করে দেখার জন্য স্তুতি দরজাটা আরও একটু ফাঁক করতে ‘খুট’ করে শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে আলোর মানুষ বিন্দু বিন্দু হয়ে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আর একটা মিষ্টি নেশার মতো গন্ধ ভেসে আসে।
যখন চোখ খোলে স্তুতি দেখে ও বিছানায় শুয়ে আছে আর সন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সামনে ঝুঁকে বসে আছে। ওর চোখে কিন্তু সেদিনের সেই ছ’মাস বয়সের মতো রাগ নেই, যা আছে সেটাকে করুণা বলা যেতে পারে।
স্তুতিকে চোখ খুলতে দেখে সন্তু হাত ধরে বিছানায় উঠে বসায় আর পাশের টেবিল থেকে এক গ্লাস জল এনে হাতে ধরিয়ে দেয়। স্তুতি ভয়ে ভয়ে পুরো গ্লাসের জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নিতেই সন্তু আস্তে করে উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে আসে। সামনে বসে বেশ পরিণত বয়স্ক মানুষের মতো ভারী গলায় বলে ওঠে–
–তোমাকে কিছু বলার আছে, মা।
অজানা আশঙ্কায় স্তুতির বুক কেঁপে ওঠে। আতঙ্কিত স্বরে বলে ওঠে–
–কি বলবি তুই? আমি কিচ্ছু জানতে চাই না।
বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
–ভয় পেওনা। আমি যা বলছি তা দয়া করে মন দিয়ে শোনো। আর, সেগুলো কাউকে বোলো না।
বলে উঠে গিয়ে ঘরের ফাঁকা দেওয়ালে আঙ্গুল ঠেকায় সন্তু। স্তুতি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখে যে, সেই দেওয়ালে পর্দা ফেলা সিনেমার মতো একটা আলোর মতো পড়েছে। সেখানে অনেকগুলো গ্রহ আর উপগ্রহের ছবি ভেসে উঠেছে। পাশ থেকে সন্তুর বড়দের মতো গলায় ধারাভাষ্য ভেসে আসতে থাকে।
–তুমি যেটা দেখতে পাচ্ছো তা বিটা-ওয়ান গ্যালাক্সির আলোক চিত্র। এটা পৃথিবীর থেকে দু’হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আমি এই গ্যালাক্সির জিটা গ্রহের প্রাণী। মানে তোমাদের কাছে এলিয়েন। বেশ কিছু বছর ধরে খুঁজে আমরা আমাদের গ্রহ ছাড়া একমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণের অস্তিত্ব পেয়েছি। আর তার সঙ্গে এটাও আমাদের কাছে ধরা পড়েছে যে, অচিরেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সোজা কথায় বলতে গেলে, পৃথিবীর মাটির স্তরে বা টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার ফলে যে সুনামী এবং বড় মাপের ভূমিকম্প হচ্ছে এগুলো তারই পূর্ব লক্ষণ। এত সুন্দর সবুজ গ্রহটাকে বাঁচানোর জন্য আমরা পৃথিবীকে সাহায্য করব বলে ঠিক করি। কারণ, আমাদের প্রযুক্তি পৃথিবীর থেকে লক্ষ বছর এগিয়ে আছে। তারজন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের ভ্রুণে আমাদের প্রযুক্তি– চিপের মাধ্যমে আমরা স্থাপন করছি। সেই ভ্রূণজাত সন্তানেরা বড় হয়ে আমাদের প্রযুক্তি মানুষকে শিখিয়ে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। এর আরেকটা উদ্দেশ্য হল মানুষকে বোঝানো যে, তারা নিজেরাই গবেষণা দ্বারা এই পথ খুঁজে পেল।
–কিন্তু, এত কিছুর দরকার কী? সরাসরিই তো সাহায্য করা যেত!
–না যেত না। সারা পৃথিবীতে রাজনীতির জন্য মানুষরা নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত। সব দিক বিবেচনা করে আমরা ঠিক করি, মানুষের একজন হয়েই এর মোকাবিলা করতে হবে। তুমি চিন্তা করো না মা, আমি তোমার সন্তানই থাকবো। ভবিষ্যতে বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানী হয়ে তোমার মুখ উজ্জ্বল করব। আমি জানি এই কথা তুমি অন্য সবার থেকে গোপন রাখতে পারবে।
***
এই ঘটনার বছরচারেক পর টেলিভিশনের পর্দায় সন্তুকে ভারতবর্ষের সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে পুরস্কার নিতে দেখতে দেখতে সুমন বলে ওঠে,
–কার ছেলে দেখতে হবে তো?
স্তুতি এক মুখ হেসে বলে,
–সে আর বলতে!
সমাপ্ত
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বানী ভট্টাচার্য, মধুমিতা মুখার্জী