না-মানুষ
লেখক: সুস্মিতা কুণ্ডু
শিল্পী: সূর্যোদয় দে
ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে বাইরের পার্কটায় এসে বসল কৃষ্ণেন্দু। পার্কটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা, গুটিকয় স্টুডেন্ট এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। সামার ভ্যাকেশন শেষ হ’তে এখনও প্রায় একমাস বাকি আছে। বেশিরভাগই ছুটিতে যে যার বাড়ি চলে গেছে। সেপ্টেম্বর থেকে ফল সেমিস্টার শুরু হলেই পিলপিল করে নতুন পুরনো স্টুডেন্টে ভরে যাবে সারা চত্বরটা।
টেক্সাসের ছোট্ট শহর কলেজ স্টেশনের এই ইউনিভার্সিটিতে সামার প্রজেক্টের জন্য মাস চারেক হ’ল এসেছে কৃষ, ওরফে কৃষ্ণেন্দু। দিল্লির জহরলাল ইউনিভার্সিটির জিওলজির রিসার্চ স্টুডেন্ট ও। এইখানে গত ক’মাস ধরে ওদের কোলাবোরেটর প্রফেসর অ্যান্ড্র্যু রেল্ম-এর সাথে একটা আর্টিকেলের ওপর কাজ করছে। রোজ সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অব্দি ল্যাবে আর রুমের টেবিলের কম্পিউটারে ঘাড় গুঁজেই সময় কেটে যায়। দুপুরে ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়াতেই যাই হোক একটা খেয়ে নেয়, স্যান্ডউইচ, চিকেন স্যালাড, পিৎজ্জা, পাস্তা, ফ্রুটস …।
রাতের বেলায় বাড়ি আসার পথে একটা বার্গার কিনে নিয়ে চলে আসে, রান্নাবান্নার পাট রাখে না। বাড়ি বলতে অবশ্য সাব-লিজে নেওয়া একটা ওয়ান বি.এইচ.কে অ্যাপার্টমেন্ট। যে স্টুডেন্টটি এই বাড়িটা লিজ নিয়েছিল, সে সামার ভ্যাকেশনে সাউথ আমেরিকায় তার বাড়ি যাওয়ার সময় সাবলিজ দিয়ে গেছে কৃষকে। ভাড়া বেশ কম আর ইউনিভার্সিটি থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট পনেরোর পথ, গাড়ি না থাকার অসুবিধেটা তাই পোয়াতে হয় না। এই বিল্ডিংটায় কৃষের অ্যাপার্টমেন্টটা ছাড়ায় আরও তিনটে অ্যাপার্টমেন্ট আছে। দুটো নীচের ফ্লোরে আর একটা দোতলাতে, কৃষের ফ্ল্যাটের উল্টোদিকে। একতলার একটা ফ্ল্যাটের ‘জস পার্কার’ নামের ছেলেটি ওর ইউনিভার্সিটিতেই আণ্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্ট, সোশ্যাল স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের। কেনাকাটার যা দরকার পড়ে ও-ই গাড়িতে করে নিয়ে যায় দোকান বাজারে।
(২)
পার্কে বসে ল্যাপটপে প্রোজেক্ট ওয়ার্কের নোটসগুলোয় চোখ বোলাচ্ছিল কৃষ। ফাইনাল ড্রাফটটা জমা দিতে হবে ডঃ রেল্মকে, আর একমাস বাদেই ফেরার দিন। এমন সময় পিঠে একটা মৃদু চাপড়ানিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, অ্যালিসন দাঁড়িয়ে। অ্যালিসন রোডস, মেয়েটি ডঃ রেল্মের আন্ডারে পি. এইচ. ডি. করছে গত দু’বছর হ’ল। এই আর্টিকেলটায় কৃষের সাথে কাজ করছে। একগাল হেসে মেয়েটি বলল,
-“হাই কৃষ! কী সবসময় ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে থাকো। আজ তোমায় ডিনারের পর এক জায়গায় নিয়ে যাব চ’লো।”
-“কোথায় সেটা বলবে তো?”
-“এটুকুই বলব, বেশ ইন্টরেস্টিং জায়গা। তুমি তোমার ‘স্যান্ডিনার’ সেরে ডট সাড়ে সাতটায় ওয়েট কোরো তোমার ফ্ল্যাটে। আমি পিক করে নেব তোমায়।”
-“ওকে বাবা ওকে! কিন্তু ‘স্যান্ডিনার’ মানে…”
খিলখিলিয়ে হেসে অ্যালি বলল,
-“স্যান্ডউইচ-ডিনার”
(৩)
ঠিক সাড়ে সাতটায় অ্যালি এসে পিক করল কৃষ্ণেন্দুকে। সারা রাস্তা হাজার পিড়াপীড়িতেও বলল না, গন্তব্যস্থল সম্পর্কে। বেশ মিনিট পনেরো ড্রাইভ করার পর একটা ফাঁকামত জায়গায় ছোট্ট একতলা বাড়ির ড্রাইভওয়েতে পার্ক করল গাড়িটা অ্যালি। ওর সাথে ঘরে ঢুকে কৃষ্ণেন্দু দেখল আরও চারটে ছেলেমেয়ে বসে রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিভিংরুমে। তার মধ্যে একজনকে দেখে খুব অবাক হ’ল ও, জস পার্কার, ওর একতলার ফ্ল্যাটের সেই বন্ধু। বাকি তিনজনের সাথে অ্যালি আলাপ করিয়ে দিল।
-“মিট মিঃ কৃষ সিনহা রয়!”
এক এক করে অন্যদের নাম জানল কৃষও। মিগ্যুয়েল ক্যাস্ত্রো, বলিভিয়া থেকে এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে এসেছে, এনসিয়েন্ট ইংলিশ লিটারেচার স্টাডিজ ওর বিষয়। আরেকজন এজরা কোলম্যান আর তার বান্ধবী জেনিফার বিংহ্যাম। বাড়িটা ওদেরই। জেনিফার একটা পেট্রল পাম্প লাগোয়া লোকাল কনভেনিয়েন্ট স্টোরের ম্যানেজার আর এজরা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে অ্যাসিসট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান।
সবার সাথে আলাপ পরিচয় পর্ব শেষ হ’লে, কৃষ গোটা ঘরটার চারদিকে একবার চোখ বোলালো। নানা রকমের বই, সমস্তই প্যারানর্মাল, সুপারন্যাচরাল বিষয়বস্তুর ওপর। অতিপ্রাকৃতিক, ভৌতিক, উপকথা, লোককথা, অলৌকিক সমস্ত ক্রিয়েচার, সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনা যা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যখ্যা করা যায় না, সেই সবকিছুর রেকর্ড গোটা বুক শেলফগুলো জুড়ে।
অবাক চোখে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল, -“তোমরা কী ক’রো এখানে?”
এজরা ওর হাতে একটা কোল্ড ড্রিংকসের ক্যান দিয়ে বলল,
-“আমরা দেশ বিদেশের অলৌকিক ঘটনা নিয়ে চর্চা করি। যাদের তোমরা সাধারণতঃ মনস্টার ব’লো, তাদের হাল হকিকত নিয়ে আমরাও গবেষণা করি।”
আরও অবাক হয়ে কৃষ বলে,
-“মনস্টার! ওসব তো ছেলেভোলানো গপ্পো। বইয়ের পাতাতেই ভালো লাগে। সত্যি সত্যি কি আর এসব হয় নাকি?”
এবার মিগ্যুয়েল খুব উত্তেজিত হয়ে স্প্যানিশ টানওয়ালা ইংরেজিতে বলে উঠলো,
-“মনস্টার হয়, একশ বার হয়। আমাদের সাউথ আমেরিকাতে কত রকমের মনস্টার হয় জানো তুমি? আমার নিজের দাদু দেখেছিলেন একবার একটা জোম্বি, সেমেটরির কবর থেকে উঠে আসছিল।”
কৃষও একটু উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে,
-“তোমরা কেউ নিজের চোখে দেখেছ? এই একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান পড়ে আমি এসব অলৌকিক টলৌকিক মানতে পারলামনা বাপু, সে তোমরা যা-ই বোঝাও না কেন আমায়।”
ঘরের আবহাওয়া একটু গরম হচ্ছে দেখে জেনিফার আর অ্যালিসন মিলে একটু কথা ঘোরানোর চেষ্টা করতে লাগল।
-“এই তোমরা এবার থামো তো দেখি। অনেক এসব হ’ল, আমাদের ক্যাম্পিংয়ের কী হ’ল বলবে এবার? জস তুমি ক্যাম্পিং পারমিট অ্যাপ্লাই করেছো? আর এজরা তোমায় কিন্তু ওই বড় গাড়িটা মানে ওই আর. ভি. টা বুক করতে হবে, মনে থাকে যেন। আমি আর জেনি তিনটে টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগস এবং আর যা যা খাবার লাগবে সব ব্যবস্থা করব।”
জেনিফারও বলে ওঠে,
-“হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও তাহলে বার্বিকিউ করার পোর্টেবল চুল্লিটা নিয়ে নেব। মিগ্যুয়েল, তোমায় বেশি ঝামেলা নিতে হবে না, একটা ছ’কেজির প্রোপেন গ্যাসের সিলিণ্ডার নিও শুধু বার্বিকিউ করার জন্য, গোটা চল্লিশ ডলার দাম লাগবে প্রায়। আর আমি আর অ্যালি এই উইকেন্ডে সব কেনাকাটা করতে যাবো, আমাদের সঙ্গে যেও, মাল বইতে হবে কিন্তু।”
সবাই হই হই করে ক্যাম্পিংয়ের প্ল্যানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জস কৃষ্ণেন্দুকে বলল,
-“কৃষ, হোয়াই ডোন্ট ইউ জয়েন আস? আমরা নেকস্ট টু নেক্সট উইকেন্ডে ‘স্যামুয়েল হিউস্টন ন্যাশনাল ফরেস্ট’-এ যাচ্ছি ক্যাম্পিং করতে। তুমিও চ’লো, তোমার আর্টিকেলও তো ততদিনে সাবমিট হয়ে যাবে বলেছিলে। এখান থেকে হার্ডলি ঘন্টা দু্’য়েকের ড্রাইভ। শনিবার সকালে রওনা হ’ব, শনি রবি জঙ্গলে কাটিয়ে সোমবার আর্লি মর্ণিং ফিরে আসব। কি রাজি তো?”
একটানা ল্যাব আর আর্টিকল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিল কৃষ্ণেন্দুও। তাছাড়া ক’হপ্তা বাদে তো দেশে ফিরেও যাবে, তাই বেশ আনন্দের সাথেই ওদের প্রস্তাবে সম্মত হ’ল ও।
(৪)
দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে দিন দ’শেক কেটে গেল। কৃষ্ণেন্দুও প্রোজেক্টের সব কাগজপত্র জমা দিয়ে বেশ ঝাড়া হাত পা হয়ে গেল। এখন শুধু দেশে ফেরার প্যাকিং আর টুকটাক গিফট, চকলেট শপিং চলছে, আর সাথে ক্যাম্পিংয়ের প্রস্তুতি।
শনিবার সক্কাল সক্কাল একটা বড় ক্যারাভান জাতীয় গাড়ি, যেটাকে এদেশে আর. ভি. মানে রিক্রিয়েশনাল ভেহিকল বলে, নিয়ে হাজির হ’ল এজরা আর জেনিফার। গাড়িটার ভেতরেই ছোট্ট কিচেন, ছোট্ট বাথরুম আর ঘুমনোর কয়েকটা সরু ফোল্ডেবল বেড। জস আর কৃষকে ওদের বিল্ডিং থেকে পিক-আপ করে ওরা অ্যালিসনকে পিক-আপ করল। তিনখানা টেন্ট, বার্বিকিউ স্টোভ আর রান্নাবান্নার কাঁচামাল অ্যালিসনের বাড়িতেই ছিল। ওখান থেকে গেল মিগ্যুয়েলের হস্টেলে, যেখানে ইউনিভার্সিটির এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্টরা থাকে সব। মিগ্যুয়েলের কাছে শুধু বার্বিকিউ এর জন্য গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। ঝটপট সব লটবহর নিয়ে ওরা ছ’জন রওনা দিল।
গাড়ি এজরাই চালাচ্ছিল। ঘন্টাদুই ড্রাইভ করার পর ওরা পৌঁছল ‘স্যামুয়েল হিউস্টন ন্যাশনাল ফরেস্ট’-এ। ফরেস্ট এরিয়ায় ঢোকার আগে একটা বড় চত্বরে পার্কের মত করা। দরকারি কাগজপত্র সাবমিট করার জন্য রেঞ্জারের অফিস, কিছু দোকান যেখানে ক্যাম্পিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়, কিছু খাবার-দাবারের দোকান, রেস্টরুমস, এইসব আর কি। গাড়িটা পার্ক করে জস আর এজরা গেল অফিসটায় পারমিটের জন্য কাগজপত্র দেখাতে। ওদের কাগজপত্র সব ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে ওদের একটা স্পট নাম্বার আর গাড়ির পার্কিং পারমিট দিল অফিস থেকে।
ফের গাড়ি নিয়ে ফরেস্টের ভেতরদিকে রওনা দিল ওরা। ওদের জন্য নির্ধারিত স্পটটা অনেকটা ভেতরদিকে। একরের পর একর বিস্তৃত এই ফরেস্টের সমস্ত জায়গা মানুষের যাওয়ার উপযুক্ত নয়। বেশিরভাগ জায়গাতেই জলাভূমি, বিস্তীর্ণ ঘাসজমি, আর বাকিটা বড় বড় গাছ। নানা ধরনের জন্তুজানোয়ারও আছে এই গোটা ফরেস্ট জুড়ে। তবে হিংস্র কোনও জন্তু সেরকম নেই এখানে। কয়েক মাইল লম্বা লম্বা হাইকিং আর ওয়াকিং ট্রেলস আছে জঙ্গলটায়। বিচিত্র এই প্রকৃতিকে জানার চেনার একাত্ম হওয়ার জন্যে এর থেকে ভালো উপায় আর কিছু হয় না।
স্পটে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে নিচে নেমে সবাই একটু হাত পা ছাড়িয়ে নিল। ঘড়িতে তখন প্রায় বারোটা বাজে। বার্বিকিউ এর স্টোভ, রান্নার জিনিসপত্র, ফোল্ডিং চেয়ার, সব নামিয়ে লাঞ্চের জোগাড় করতে ব্যস্ত হ’ল সবাই। কৃষ এক এক করে জিনিস নামাচ্ছিল গাড়ি থেকে। টেন্টগুলো যেই নামাতে গেল, ওমনি মিগ্যুয়েল এসে বলল,
-“থাক থাক, ওগুলো নাহয় পরে নামানো হবেখ’ন।”
যদিও একটু অবাক লাগল কৃষের তাও কিছু না বলে পাশে রাখা আরেকটা ছোটো কালো ডাফল ব্যাগ নামাতে গেল। ওমনি মিগ্যুয়েল তড়িঘড়ি কালো ব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নিল ওর হাত থেকে। এবার সত্যি সত্যি বেশ অদ্ভুত লাগল কৃষের।
(৫)
সারাদিন টুকটাক বার্বিকিউ করে খেয়েদেয়ে, খানিকটা ট্রেইল ধরে হাঁটার পর সন্ধেবেলা ফাইনালি সবাই গাড়ির কাছে ফিরে এল। ওদের স্পটের আশেপাশে আরও দু’টো আর. ভি পার্ক করা। একটা ফ্যামিলি আছে, বাবা মা আর বছর বারো তেরোর দুটো ছেলে মেয়ে। অন্য আর. ভি. টায় আছে জনা চারেক ছেলে। ওরা কিন্তু পৌঁছনোমাত্রই টেন্ট টাঙিয়ে বন ফায়ার জ্বালানোর কাঠকুটো জোগাড় করে ফেলেছে। কৃষ আর অযথা প্রশ্ন করলনা ওর সঙ্গীদের।
সন্ধে নেমে আসার মুখে, হঠাৎ মিগ্যুয়েল আর এজরা মিলে সব জিনিসপত্র ফের গাড়িতে তুলতে লাগল। এবারে কৃষ বাধ্য হ’ল জিজ্ঞাসা করতে,
-“মিগ্যুয়েল, এজরা, এসব কী হচ্ছে? জিনিসপত্র ফের গাড়িতে তুলছ কেন? এনি প্রবলেম?”
একটু হেসে মিগ্যুয়েল বলল,
-“শুধু ক্যাম্পিং করতে আমরা এখানে আসিনি মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড। আই হোপ ইউ আর নট উইক-হার্টেড, কৃষ!”
এজরা ওকে থামিয়ে বলে উঠল,
-“লেট মি এক্সপ্লেইন টু ইউ, কৃষ। আমাদের বাড়িতে যে সব বই, রেকর্ডস তুমি দেখেছ সেগুলো আমরা তো শুধু পড়ি যে তা নয়। আমরা হাতে নাতে ট্রাই করে দেখি, বাট সো ফার নো লাক! বাট দিস টাইম, ইট উইল বি ডিফারেন্ট। এইবার মিগ্যুয়েল আছে আমাদের সাথে। ও বলিভিয়ার ছেলে অ্যান্ড ইউ নো, পেরু বলিভিয়া এই সব জায়গা নানা ধরনের অতিপ্রাকৃতিক উপকথার, ভুডু ম্যাজিকের খনি। তাই এইবার আমরা নির্ঘাত সাকসেসফুল হব।”
হতবাক হয়ে কৃষ বলল,
-“আমি তো কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা!”
অ্যালিসন, জেনিফার আর জসও এসে গাড়িতে উঠে পড়ল। ব্যাপারটা ঠিক ভালো না লাগলেও কৌতুহল দমাতে না পেরে কৃষ্ণেন্দুও উঠে বসল গাড়িতে। এজরা গাড়িটা চালিয়ে জঙ্গলের আরও ভেতর অব্দি নিয়ে চলল। ওদের স্পটটা পেছনে ফেলে রেখে বেশ খানিকটা আসার পর পিচের রাস্তা শেষ হয়ে মাটির রাস্তা শুরু হ’ল, তাও আবার বেশ সরু। ‘অফ লিমিটস’ ‘নো ট্রেসপাসিং’ ‘পারমিটেড এন্ট্রি এন্ডস হিয়ার’ ইত্যাদি লেখা কয়েকটা সাইনবোর্ড পেরিয়ে আসার পর রাস্তাটা এতটাই সরু হয়ে গেল যে আর গাড়ি নিয়ে এগোনোর পথ রইল না। ততক্ষণে স্পট থেকে ওরা প্রায় মাইল সাতেক দূরে চলে এসেছে। উপায়ান্তর না দেখে গাড়িটা ওখানেই পার্ক করল ওরা। এজরা বলল,
-“চিন্তার কিছু নেই, সামনেই টেন্ট খাটানোর ফাঁকা জায়গা আছে।”
ব্যাগ, টেন্ট, জল, খাবার, সব ঘাড়ে নিয়ে ওরা হাঁটতে শুরু করল। মিগ্যুয়েলের ঘাড়ে সেই রহস্যময় কালো ব্যাগটি। মিনিট দশেক হাঁটার পর ওরা পৌঁছল একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা চত্বরে। ব্যাটারি দেওয়া ক্যাম্পিং লাইটগুলো জ্বালিয়ে ওখানেই সবাই তাবু টাঙাতে শুরু করল। কৃষ ওর হাতের মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। ফাঁকা চত্বরটার একধারে বেশ ক’টা আয়তাকার পাথর গোঁজা। ভালো করে দেখে ওগুলোকে টুম্বস্টোন বলেই মনে হ’ল, গা টা শিউরে উঠল ওর, জায়গাটা পরিত্যক্ত সিমেটরি নয় তো?
এ’রকম জায়গায় এই ছেলেমেয়েগুলো কেন এসেছে? দেখে তো মনে হ’চ্ছে জেনেবুঝেই এসেছে এখানে।
তাঁবুগুলোর কাছে ফিরে গিয়ে দেখে এজরা আর মিগ্যুয়েল একটা হাতে আঁকা ম্যাপ নিয়ে লোকেশনটার সাথে মেলাচ্ছে। ওদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করাই বৃথা। জস অন্যদিকে কিছু কাঠকুটো জড়ো করে ক্যাম্প ফায়ার বানাচ্ছিল। জেনিফার আর অ্যালিসন আগুনের চারধারে গোল করে বেশ ক’টা মোটা গাছের গুঁড়ি, বড় পাথর রেখে বেশ বসার মত ব্যবস্থা করেছে। সেখানে বসে বসে সবাই গাছের ডালে মার্শমেলো বিঁধিয়ে আগুনে গরম করে খেতে লাগল। আড্ডাও বেশ জমে উঠেছিল। কিন্তু কৃষের মন থেকে ধোঁয়াশাটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। অবশেষে ও বলেই ফেলল,
-“তোমরা কি জানো, এই জায়গাটা একটা সিমেটরি, কবরখানা?”
ওর এই আকস্মিক প্রশ্নে হঠাৎ করে সবাই চুপ করে গেল। চারদিকে পিনপতনের নিস্তব্ধতা, শুধু জঙ্গলের গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ আর ঝিঁঝিঁপোকার একটানা ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। এজরা বলে উঠল,
-“জানি, তাই তো এই জায়গাটাতেই এলাম।”
হাতের সেই ম্যাপের মত কাগজটা দেখিয়ে বলল,
-“মিগ্যুয়েল এটা জোগাড় করেছে। প্রায় মাস ছয়েক আগে এই ফরেস্টের গভীরে জনা দশেক মানুষের একটা দল ক্যাম্পিং করতে এসেছিল, কিন্তু ফরেস্ট পার্কের খাবার খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যায় তারা। পার্কের কতৃপক্ষ নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য জানিয়েছিল, লোকগুলো ‘বায়উ’ মানে বিস্তীর্ণ জলাভূমি এলাকায় ভুল করে ঢুকে, তলিয়ে গেছে। তাদেরকেই ওইখানে কবর দেওয়া আছে।”
এই বলে দূরের ওই জায়গাটার দিকে আঙুল দেখায় এজরা।
একটা ফাইল খুলে দেখিয়ে বলে,
-“এই দেখো আসল ঘটনার রেকর্ড, যা ওরা লুকিয়ে রেখেছিল। মিগ্যুয়েল না জানি কীভাবে জোগাড় করেছে।”
কৃষ অবাক হয়ে শুনতে থাকে। একটু আফশোসও লাগে এদের সাথে আসার জন্য। কী যে উদ্দেশ্য এদের সেটাই বুঝতে পারছে না। ওর চোখের দৃষ্টি দেখে মিগ্যুয়েল বলে,
-“ফ্রেণ্ড, আগেই তোমায় বলেছিলাম এসব দুর্বল মানুষদের জন্য নয়! তুমি বরং এক কাজ করো, আর. ভি. তে গিয়ে সব দরজা লক করে ঘুমিয়ে পড়ো, কাল সকালে বেরিও একদম। ওটাই তোমার জন্য ভালো, বিকজ ইউ নো হোয়াট উই আর অ্যাবাউট টু ডু নাউ? উই আর গোয়িং টু ‘রেইজ দ্য ডেড’ !”
মিগ্যুয়েলের ব্যঙ্গাত্মক সুর যতটা না আশ্চর্য করল কৃষকে তার চেয়ে বেশি অবাক হ’ল ওর শেষের কথাগুলো শুনে। বলে কী ছেলেটা! পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে জস এগিয়ে এসে কৃষের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-“কুল ডাউন এভরিবডি! আই থিংক অন্যান্যবারের মত এবারেও কিছু হবে না! জাস্ট এ লিটল বিট ফান, অ্যাড্রেনালিন রাশ, ইউ নো।”
এরপর আর বেশিদূর গল্পগাছা এগোল না। জেনি আর অ্যালি ওদের তাঁবুতে চলে গেল। জস আর কৃষ নিজেদের তাঁবুতে। যাওয়ার আগে কৃষ দেখল এজরা আর মিগ্যুয়েল সেই কালো ডাফল ব্যাগটা খুলে কতকগুলো বই আরও কীসব পুরনো পুঁথির মত পাণ্ডুলিপি, নানারকম জিনিসে ভরা ছোট ছোট কাঁচের বয়াম বার করতে লাগল। বইগুলো কৃষ আগেও দেখেছে এজরা আর জেনির বাড়িতে। ওরা কি তবে কোনও ব্ল্যাক ম্যাজিকের রিচ্যুয়াল করবে? জস, জেনি, আর অ্যালিও কি যোগ দেব তাইতে? একরাশ প্রশ্ন আর অস্বস্তি মনের মধ্যে নিয়ে ঘুমোতে গেল কৃষ।
(৬)
বেশ রাত্রের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল কৃষ্ণেন্দুর। আসলে কখনও এরকম জঙ্গলে তাঁবুর মধ্যে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা নেই তো। মাথার কাছের মোবাইলটায় দেখল সবে ১২টা বাজে। পাশের স্লিপিংব্যাগটার দিকে তাকিয়ে দেখল জস নেই, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। কয়েক মিনিট ছটপট করার পর নিজের স্লিপিং ব্যাগের চেইনটা খুলে উঠে দাঁড়াল। জসকে ফোন করার জন্য মোবাইলটা হতে নিয়ে মনে পড়ল সেই বিকেল থেকে ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। ওদের অ্যালটেড স্পটটায় শেষ একটু টিমটিমে নেটওয়ার্ক পেয়েছিল কিন্তু তারপর থেকে নেটওয়ার্কের দাঁড়ি একটাও আর নেই।
সোয়েটারটা গায়ে গলিয়ে তাঁবুর চেইনটা খুলে বাইরে বেরলো কৃষ। সোজাসুজি চোখ গেল দূরের ওই টুম্বস্টোনগুলোর দিকে। একটা আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে চারটে ছায়ামূর্তি। তার পাশে দাঁড়ানো আরেকজনের শরীরের সিল্যুয়েট দেখে বুঝতে পারল ওটা মিগ্যুয়েল। কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছে বাকিদের। ধীর পায়ে আরও কিছুটা এগিয়ে একটা উইলো গাছের আড়ালে লুকিয়ে নজর করতে থাকলো কৃষ। হালকা হালকা মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ ভেসে আসছে, বিজাতীয় ভাষা, চিনতে পারলনা কৃষ। মিগ্যুয়েল একটা কাঁচের বয়াম থেকে একটা তরল পদার্থ ওই টুম্বস্টোনগুলোর সামনের জমিতে ঢালতে লাগল। নানারকম রিচ্যুয়ালস শেষ হ’লে, ওরা যেন কীসের অপেক্ষায় বসে রইল। বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটার পর মনে হ’ল জস, জেনি আর অ্যালি কিছুটা হতাশ হয়ে তাঁবুর দিকে ফিরে আসছে। কৃষ তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ল।
একটু পরেই জস ফিরে এল। কৃষকে শুয়ে থাকতে দেখে ও-ও নিশ্চিন্তে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ল। কিন্তু কৃষের আর ঘুম আসতে চায় না কিছুতেই। ধীরে ধীরে জসের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ গাঢ় হ’লে ও বেরিয়ে তাঁবুর বাইরে উঁকি মারল। দূরের ওই জায়গাটায় দুটো পুরুষমূর্তি মানে এজরা আর মিগ্যুয়েল বসে আছে, ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। দু’টোই বদ্ধপাগল ছাড়া আর কিছুই না! অ্যালি আর জেনির তাঁবুর ব্যাটারিওয়ালা ল্যাম্পটা নেভানো, ওরাও ঘুমোচ্ছে তার মানে। উফফ্ এই ক্যাম্পিং ট্রিপটা শেষ হ’লে বাঁচে! মোবাইলের ঘড়িতে দেখল দেড়টা বাজে। কৃষ্ণেন্দু ফের ঘুমোবার চেষ্টা করল।
(৭)
তখন ঠিক ক’টা বাজে কৃষ্ণেন্দু জানেনা, একটা পুরুষ কণ্ঠের চিৎকারে রাত্রের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে দেখল পাশে জসও উঠে বসেছে। শিগগির দু’জন স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে, হাতের মোবাইলের আলো জ্বেলে তাঁবুর বাইরে এল। সামনে তাকিয়ে দেখল যেখানে আগুনের পাশে এজরা আর মিগ্যুয়েল বসেছিল সেখানে গোটা চারেক ছায়ামূর্তি। অ্যালি আর জেনি কি তবে ওখানে… কিন্তু না! চিৎকারের শব্দে ওরাও পাশের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাহলে ওই মূর্তিগুলো কারা?!
অ্যালি আর জেনিকে অপেক্ষা করতে বলে কৃষ্ণেন্দু আর জস এগিয়ে গেল ছায়ামূর্তিগুলোকে লক্ষ্য করে।
বেশ খানিকটা কাছাকাছি আসতে, আতঙ্কে সারা পৃথিবী কৃষের পায়ের তলায় যেন দুলে উঠল। যে চারটে অবয়ব ওরা দেখেছিল, সেগুলো কোনও মানুষের নয়, কোনও জীবন্ত মানুষের নয়। গলা পচা মৃতদেহ। কঙ্কালের ওপর তাল তাল পচা মাংস লাগানো যেন। জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া কাপড়চোপড় আটকে আছে। চোখগুলোতে নিষ্প্রাণ মরা মাছের মত দৃষ্টি। একজনের আবার চোখের মণি কোটর থেকে বেরিয়ে ঝুলছে। কয়েক মাসের গলা মৃতদেহ হঠাৎ কবর থেকে উঠে এসে পৃথিবীর বুকে হাঁটতে শুরু করলে যেমন লাগে, সেরকম। কবর ভাবতেই টুম্বস্টোনগুলোর দিকে চোখ গেল কৃষের। প্রবল আতঙ্ক নিয়ে দেখল চারটে বড় বড় গর্ত, আর তার চারপাশের মাটিগুলোও যেন নড়ছে। একটা প্রায় কংকাল হয়ে আসা হাত মাটির গভীর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর আর একটা, তারপর মাটি ফুঁড়ে পুরো দেহটা।
নরকদর্শনের এখানেই শেষ হ’লনা। একটু দূরে হালকা ওই আগুনের আভায় দেখতে পেল একটা মানুষের দেহ পড়ে, তার পেটের ওপরে আরেকটা মানুষ চেপে বসে, মুখটা নামিয়ে রেখেছে নিচের মানুষটার বুকের ওপর। ওপরের মানুষটার গায়ের ব্লু টি-শার্টটা বলে দিচ্ছে ওটা মিগ্যুয়েল, অন্যজন কী তবে…
এমন সময় মিগ্যুয়েল মুখ তুলল, রক্তমাখা মুখটা, দুই চোয়াল নড়ছে। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে পরম তৃপ্তি সহকারে কিছু চিবিয়ে খাচ্ছে। ও মুখটা তুলতেই নজরে এল নিচের লোকটার হলুদ জামাটা। যদিও বেশিটাই রক্তে লাল, তবুও আবছা আলোয় চিনতে অসুবিধে হ’লনা ওটা এজরার জামা। গা গুলিয়ে উঠল কৃষের, মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল তার আগেই জস ধরে নিল। জসের দুটো হাত ঘামে ভেজা। ফিসফিস করে বলল,
-“লেট’স রান টু দ্য আর. ভি.”
বলেই দৌড় লাগাল।
কৃষও ছুটতে গিয়ে দুম করে পড়ে গেল। বেশ খানিকটা শব্দ হওয়ায় ওই না-মানুষগুলোর দৃষ্টি এদিকে পড়ল, ওদের একজন তড়িঘড়ি এগোতে গিয়ে ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকা আগুনের ওপর পড়ে গেল। একটা নারকীয় চিৎকার বেরলো না-মানুষটার গলা দিয়ে। মিগ্যুয়েলও ফিরে তাকাল এদিকে, কিন্তু আগুনটা প্রায় নিভে যাওয়ায় কিছুই দেখতে পেল না আর কৃষ। প্রাণপণে দৌড় লাগাল জসের পেছন পেছন।
তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভীত সন্ত্রস্ত জেনিফার আর অ্যালিসনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে জস চেঁচাল,
-“রান রান! রান টু দ্য আর. ভি.”
হাঁপাতে হাঁপাতে সবাই ছুটতে লাগল। ওই না-মানুষগুলো ততক্ষণে হেলেদুলে বিচিত্রভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে আসছে। কৃষ দৌড়তে দৌড়তে শুনতে পেল অ্যালির আর্তচিৎকার। কিন্তু পেছন ফিরে তাকানোর সাহস আর কারোর হ’ল না। তিনজনে ছুটে গিয়ে গাড়িটায় উঠে বসে দরজা বন্ধ করে দিল, ভাগ্যিস জসের কাছে চাবিটা ছিল। গাড়িতে বসে সবাই হাঁপাতে লাগল। কোনওমতে ঘড়ির দিকে তাকাল কৃষ, চারটে বাজতে যায়। চিৎকার করে উঠল,
-“জস শিগ্গির গাড়ি স্টার্ট করো! উই হ্যাভ টু গেট আউট অফ দিস প্লেস! নাউ!”
জেনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
-“না না না, এজরা- অ্যালি- মিগ্যুয়েল ওরা এখনও গাড়ির বাইরে! উই কান্ট লিভ দেম!”
জস বলল,
-“ওদের আর ফিরে আসার কোনও আশা নেই জেনি! জোম্বিরা ওদের শেষ করে ফেলেছে এতক্ষণে! আর মিগ্যুয়েল!! হি ইজ দ্য ওয়ান হু ডিড দিস টু আস!”
জেনি বলে,
-“কী বলছ কী তুমি? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
কৃষও বলে,
-“জোম্বি! সে তো এমনি লোককথা…”
জস বলে,
-“লোককথা যে নয় চোখের সামনে দেখলে তো। আর জেনি, মিগ্যুয়েলের ব্যাপারে সব আমি বলছি তোমাদের, বাট ফার্স্ট উই নিড টু গো।”
জস ড্রাইভারের সিটে বসে গাড়িটা স্টার্ট করার চেষ্টা করল চাবি ঘুরিয়ে। বিকট শব্দ তুলে এঞ্জিন স্টার্ট হ’ল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল। আবার চেষ্টা করল জস, ফের একই কাণ্ড। স্টিয়ারিংয়ের ওপর জোরে ঘুঁষি মেরে বলল,
-“এটা মিগ্যুয়েলের কাণ্ড! আমরা যখন তাঁবু খাটাচ্ছিলাম, গাড়ি থেকে ব্যাগ আনার নামে আমার কাছ থেকে চাবিটা নিয়েছিল একবার। তখনই গাড়িতে কিছু করে গেছে ও। দ্যাট ব্লাডি মনস্টার, আই উইল কিল হিম। ওর জন্যই এই সাংঘাতিক কাজে নামলাম আমরা। এর আগে আমরা প্ল্যানচেট, উইজা বোর্ড এইসব করতাম। এক দু’বার বিভিন্ন হন্টেড হাউসের সন্ধান পেয়ে সেখানে রাত কাটিয়ে এসেছি, কিন্তু কিচ্ছু হয়নি। ক’মাস আগে মিগ্যুয়েল ইউনিভার্সিটিতে এল এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে। না জানি কীভাবে এজরার সাথে ওর দোস্তি হ’ল। আমাদের ক্লাবে আসতে শুরু করল। তারপর একদিন বলল ওর পরিবারের একজন নাকি ‘হোনগান’ মানে আফ্রিকান ভুডু প্রিস্ট ছিল। তার থেকে ও শিখেছে মৃতদের কবর থেকে জাগানোর কৌশল। মানে সোজা কথায় জোম্বি বানানোর কৌশল। এই জায়গাটারও সন্ধান ওই বার করে। অপঘাতে মরা মানুষদের গণকবরে, চারজন মানুষ মিলে বিশেষ কিছু রিচ্যুয়াল করলে, তারা মাটির তলা থেকে উঠে আসবে।”
কৃষ বলল,
-“তোমরা এরকম সাংঘাতিক একটা কাজ করতে রাজি কীকরে হ’লে এটা ভেবেই আমার অবাক লাগছে। একবারও ভাবলে না, মৃত মানুষগুলো যদি সত্যিই উঠে আসে তারপর কী হবে? তারা তো তোমাদেরই আক্রমণ করবে।”
-“আমি আর অ্যালি বলেছিলাম সেটা। মিগ্যুয়েল তখন বলেছিল, ওদের ফের কবরে পাঠিয়ে দেওয়ার ‘ভুডু’ ম্যাজিকও ওর নাকি জানা। কিন্তু এখন তো জানলাম মিগ্যুয়েল নিজেও … যেভাবে এজরার গা থেকে মাংস খুবলে খাচ্ছিল ও।
উই আর সো সরি কৃষ! আমাদের জন্য তুমি এরকম গ্রেভ ডেঞ্জারে পড়লে।”
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে জস।।
জসের কথাগুলো শুনে প্রবল জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো জেনিফারও,
-“তার মানে এজরা ইজ ডেড!”
(৮)
কৃষের দিশেহারা লাগে, ভেবে পায়না কী করে সামলাবে দু’জনকে। কীকরেই বা মুক্তি পাবে জোম্বিগুলোর হাত থেকে। যে কোনও মুহূর্তে ওরা এসে পড়বে গাড়িটার কাছে। প্রায় গোটা দশেক জোম্বি, সঙ্গে আবার মিগ্যুয়েল। না জানি ও কী ধরনের নরখাদক, দেখতে তো ওই জোম্বিদের মত নয়। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতই, অথচ স্বভাবে জোম্বি।
জসকে জিজ্ঞাসা করে,
-“মিগ্যুয়েল তাহলে আসলে কি?”
-“মিগ্যুয়েল আসলে ঠিক জোম্বি নয়। আমি একটা বই ঘাঁটতে গিয়ে এরকম কিছু ক্রিয়েচারের কথা পেয়েছিলাম। এদের বলে ঘৌল(Ghoul)। এরা একধরনের ডিমন বা শয়তান। ওই ভুডু ম্যাজিকেরই ফসল। এরাও জোম্বিদের মত নরখাদক। তবে ওদের সাথে তফাৎ দু’জায়গায়। এক হ’ল ঘৌলরা মানুষের মত রূপ নিয়েই থাকতে পারে, জোম্বিদের মত কদাকার নয়। আর দুই হ’ল এরা জোম্বিদের মত বুদ্ধিহীণ নয়। ঘৌলদের চিন্তাশক্তি স্বাভাবিক মানুষদের মতই।”
-“সে তো মিগ্যুয়েলকে দেখেই বুঝতে পারছি!”
এমন সময় হঠাৎ করে গাড়ির ছাদে ধুপ করে কিছু একটা লাফানোর শব্দ হ’ল। তিনজনেই ভয়ে শিউরে উঠল। ঝটপট কৃষ গাড়ির ভেতরের আলোগুলো নিভিয়ে দিল। বাইরে ভীষণ হাল্কা ভোরের আলো ফুটেছে। অন্ধকারটা চোখে সয়ে গেলে দেখল যে বেশ ক’টা অবয়ব গাড়ির চারপাশে ঘুরছে। তিনজনেই প্রবল আতঙ্কে হাঁপাতে থাকল, অবধারিত মৃত্যু সামনে। এরকম নারকীয়ভাবে মরতে হবে ভেবে বুকটা কেঁপে উঠল কৃষের। তবু মনে জোর সঞ্চয় করতে লাগল, এভাবে হেরে গেলে চলবে না। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। কোনমতে মাইল সাতেক পথ পেরিয়ে যদি ওদের পুরনো ক্যাম্পিং স্পটটায় পৌছতে পারে, ওখানের লোকগুলোর সাহায্য পাবে। নেটওয়ার্ক পেলে রেঞ্জার অফিসটায় বা পুলিশ স্টেশনে ফোন করতে পারবে।
কৃষ জসকে জিজ্ঞাসা করে,
-“এদেরকে মারার কোনও উপায় তোমরা পাওনি তোমাদের রেকর্ডস ঘেঁটে।”
-“প্রচলিত লোককথা অনুসারে একমাত্র মাথা কেটে দিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে জোম্বিদের মারা সম্ভব, ঘৌলদেরও নিকেশ করারও একই উপায় হবে আশা করি। কিন্তু আমাদের কাছে তো কোনও অস্ত্রই নেই। এজরা কয়েকটা বড় বড় চপার নিয়েছিল ব্যাগে কিন্তু মিগ্যুয়েলই বারণ করে, বলে এর প্রয়োজন হ’বেনা।”
জেনিফার এতক্ষণ কষ্টে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে গাড়ির মেঝেয় বসেছিল। এবার উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে বলল,
-“মিগ্যুয়েল বারণ করলেও আমি ওগুলো গাড়িতে কী ভেবে জানিনা, তুলে নিয়েছিলাম। এক্ষুণি আনছি।”
বেশ ক’টা শক্তপোক্ত বড় ধারালো ব্লেডের চপার নিয়ে এল জেনিফার গাড়ির পেছন দিকটা থেকে। সেইসাথে একটা প্রোপেন গ্যাসের সিলিন্ডার, যেটা রান্নার কাজে ব্যবহার করছিল ওরা।
(৯)
ওদের এইটুকু কথা বলার সময়টুকুর ভেতরেই গাড়ির চারপাশটা না-মানুষেরা ঘিরে ধরেছে। মাঝে মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে বড় গাড়িটায়। ওরা তিনজন, হাতে তিনটে চপার নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর।
বেশ ক’টা মিনিট নিস্তব্ধে কেটে যায়, তারপরেই ঝনঝন শব্দে গাড়ির কাঁচটা ভেঙে পড়ে। ভেতরে যে ঢুকে আসে তাকে দেখে ওরা আঘাত করার কথা ভুলে গিয়ে থ’ হয়ে যায়।
অ্যালিসন!
কিন্তু অ্যালিসন আর সেই অ্যালি নেই। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক রক্তাক্ত খোবলানো শরীর, কিন্তু চোখে মরা মাছের দৃষ্টি। ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।
-“ওহ্ মাই গড্! অ্যালি হ্যাজ বিকাম আ জোম্বি! দে আর কন্টেজিয়াস। অ্যালিকে ওরা আঁচড়ানো কামড়ানোর ফলে ও-ও জোম্বি হয়ে গেছে।”
চিৎকার করতে থাকে জস।
শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায় কৃষের। হা ঈশ্বর! এ কোন বিভীষিকার মুখোমুখি হ’তে চলেছে ওরা।
অ্যালির পিছুপিছু এসে ঢোকে মিগ্যুয়েল। ক্রুর হেসে বলে,
-“একটা এজরা দিয়ে কি আমাদের এতগুলো লোকের পেট ভরে বলো? কতদিন ভরপেট খাইনি, তোমাদের ওই শাকপাতা আর চিকেন বিফ পর্কের ছিবড়ে খেতে খেতে জিভের স্বাদই যেতে বসেছিল। বাট ইউ নো হোয়াট? এজরা ছেলেটা গম্ভীর হ’লে কী হবে, হি টেস্টেড ভেরি সুইট!”
জেনিফার আর থাকতে না পেরে হাতের চপারটা নিয়ে হামলা করতে ছুটল মিগ্যুয়েলের ওপর। কিন্তু তার আগেই অ্যালিসন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। জেনিফার ওর গর্দান লক্ষ্য করে চপার দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করতে লাগল, আর অ্যালিসন জেনিফারের গলায় দাঁত বসাতে উদ্যত হ’ল। মিগ্যুয়েল এর মধ্যে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে। বাকি জোম্বিগুলো উঠে আসতে লাগল গাড়ির ভেতর। জস আর কৃষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চপার চালাতে লাগল। একটা একটা করে না-মানুষদের মুণ্ডু, ধড় থেকে আলাদা করতে পারলে তবেই ওরা বাঁচবে।
বেশ খানিকটা সময় এই নারকীয় হত্যালীলায় কেটে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে পড়ে গিয়ে কৃষ দেখে তখনও মিগ্যুয়েল এবং আরও গোটাকয় জোম্বি অবশিষ্ট রয়েছে। জেনিফারের দেহটা বাসের পাদানীর ওপর লুটিয়ে পড়ে, তার ওপর মুখ ডুবিয়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে অ্যালিসন। কৃষের ডানচোখের ওপর রক্ত গড়িয়ে এসে চোখটা ঝাপসা লাগছে। তবু দেখতে পেলো অন্য দুটো জোম্বি ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ জস, কৃষকে টপকে মিগ্যুয়েলের ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য জস যখন ওর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, কৃষের নাকে একটা অদ্ভুত মানুষের গন্ধ এল। জিভটা কেমন লালারসে ভরে উঠল। পেটের মধ্যে খিদেয় নাড়িগুলো পাকিয়ে উঠল। বাম হাতের কব্জিতে একটা জোম্বির, একটু আগে কামড়ের দাগটা কেমন শির শির করছে।
কৃষের বুঝতে বাকি রইল না যে ও নিজেও ইনফেক্টেড। একটু বাদে ও-ও মিগ্যুয়েল আর তার দলবলেরই একজন হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পরে জসও হয় খাদ্য, নয় তো খাদক হয়ে যাবে। এক পলকের জন্য চিন্তা করল কৃষ। তারপর জেনিফারের দেওয়া ওই প্রপেন গ্যাস সিলিন্ডারটা সিটের তলা থেকে তুলে এনে তার সেফটি নজলটা খুলে ফেলল। পকেটে একটা লাইটার ছিল, সেটা বার করে জ্বালিয়ে সিলিন্ডারের মুখের সামনে ধরল। বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজে চারপাশটা কেঁপে উঠল। আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, আগুনে পোড়া জোম্বিদের দেহগুলোও ছিটকে পড়ল এদিক ওদিক। একটু পরে সশব্দে গাড়ির অয়েল ট্যাঙ্কটাও বার্স্ট করল। সব দেহাবশেষগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ধিকধিক করে জ্বলতে লাগল গাড়িটা।
(১০)
পরেরদিন লোকাল নিউজ চ্যানেলগুলোয় বারবার খবরটা ভেসে উঠতে থাকল।
“স্যামুয়েল হিউস্টন ন্যাশনাল পার্কে দুর্ঘটনা! ক্যাম্পিংয়ের জন্য জনপ্রিয় এই ফরেস্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হত চারজন তরুণ তরুণী। ভোরবেলায় ট্রেকিং করতে বেরিয়ে আরেকদল ক্যাম্পাররা টিলার মাথায় উঠে, দূরে ধোঁয়া উঠতে দেখতে পান। সেই ধোঁয়া লক্ষ্য করে তারা পৌঁছোন অকুস্থলে। জ্বলন্ত গাড়িটির নাম্বার প্লেট দেখে জানা যায় যে নিহত ক্যাম্পাররা তাদের ভেহিকল নির্দিষ্ট স্পটে না রেখে, নিষিদ্ধ এলাকার ভেতরে চলে গেছিল। কী থেকে এই দুর্ঘটনা তা এখনও জানা যায়নি, তবে লোকাল পুলিশের ফরেনসিক বিভাগ তদন্ত চালাচ্ছে গাড়ি এবং নিহতদের দেহাবশেষ নিযে। অকুস্থলের একটু দূরে আরেকটি অর্ধভুক্ত মৃতদেহও পাওয়া গেছে। মৃত ব্যক্তিটিও ওই ক্যাম্পার দলটিরই একজন ছিল বলে জানা গেছে। এটা আকস্মিকভাবে চলে আসা কোনও হিংস্র পশুর কাজ বলেই পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জানিয়েছে। ন্যাশনাল পার্কটিতে ক্যাম্পিং বন্ধ রাখা হয়েছে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ”
ষষ্ঠ ক্যাম্পারের সম্পর্কে অবশ্য নিউজে কিচ্ছু জানানো হয়নি। তার কারণ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোকেরা এবং হসপিটালের লোকেরা হতভম্ব যে আশঙ্কাজনকভাবে পুড়ে যাওয়া একটা মানুষ কীভাবে হসপিটালের বেড থেকে পালিয়ে যেতে পারে। মিগ্যুয়েল কাস্ত্রোর এই অন্তর্ধানের খবর মিডিয়ার থেকে লুকোনো আছে তাই।
(১১)
মোটেলের ঘরটায় ঢুকে বিছানাটার ওপর বসে মিগ্যুয়েল ভাবে, ঠাণ্ডা মাথায় সবটা মেটাতে হবে। কৃষকে সিলিন্ডার টেনে নিয়ে লাইটারটা জ্বালাতে দেখেই গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল মিগ্যুয়েল, তাই আগুন ওকে বেশি ছুঁতে পারেনি। কিন্তু বাকি সবাইকে গ্রাস করেছিল আগুনের শিখা। জোম্বিদের প্রমাণ লোপাটের জন্য ওদের দেহের পোড়া টুকরোগুলো ফের ওই কবরে ঢুকিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এজরার দেহটা টেনে এনে গাড়ির আগুনে ফেলবার আগেই অন্য ক্যাম্পারগুলো এসে যায়। তাই নিজেও পুড়ে গিয়ে অজ্ঞান হওয়ার ভান করে সে। হসপিটালে এনে ওকে ক্লিন করে বেডে দেওয়ার একটু পরেই সুযোগ পেয়ে, ও পালিয়ে এসে ওঠে এই মোটেলে। ঘৌলদের শরীর মানুষ বা জোম্বিদের মত এত দুর্বল নয় যে ওইটুকু আগুনে ওর কিছু হবে। এখানের লুজ এন্ডগুলো সব টাই আপ করে, তথ্যপ্রমাণ লোপাট করে, মিগ্যুয়েল অন্য কোনও নামে অন্য কোথাও গিয়ে আবার ঘাঁটি গাড়বে। আবার কিছু মানুষকে বোকা বানিয়ে, তাদের দিয়ে কালোজাদু করিয়ে, জাগিয়ে তুলবে মাটির তলায় শুয়ে থাকা মৃতদেহগুলোকে। পৃথিবীর বুকে রাজত্ব হবে ওর, ওর মত না-মানুষদের।
Tags: গল্প, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, না-মানুষ, সুস্মিতা কুণ্ডু, সূর্যোদয় দে