নয়নবাবুর আয়না
লেখক: রাজকুমার রায়চৌধুরী
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
নয়ন হাজরার বয়স বছর পঞ্চাশেক। একটু নাদুস নুদুস চেহারা। হাইট ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির কম বই বেশি হবে না। পোশাকে আশাকে সৌখিন বলা যায়। চোখে রিমলেস সোনার চশমা। নয়নবাবুর বাবার রঙের দোকান ছিল বৌবাজারে। দোকানটা আর উত্তর কোলকাতায় একটা দোতলা বাড়ি নয়নবাবু উত্তরাধিকার সূত্রে পান। নয়ন বাবু ব্যবসার আরো উন্নতি করেন। এখন কলকাতায় চারটি দোকান ছাড়াও বর্ধমান ও আসানসোলে ওনার অন্য ব্যবসাও আছে। বাড়িতে নয়নবাবু একাই থাকেন, স্ত্রী সৌদামিনী মারা গেছেন তিন বছর আগে। একমাত্র ছেলে চয়ন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, থাকে ভুবনেশ্বরে। বাড়িতে একজন রাতদিনের কাজের লোক আছে, নাম পশুপতি। পশুপতির অবশ্য বয়েস হয়েছে। প্রায় ষাট বছর হবে। ছেলেকে নয়নবাবু ব্যবসায় ঢোকাবার চেষ্টা করেছিলেন। চয়ন রাজি হয়নি, তবে দরকার পড়লে নয়নবাবু ছেলের পরামর্শ নেন। নয়নবাবুর হঠাৎ ইচ্ছে হল একটা ভালো আয়না কিনবেন, দামী আয়না যেরকম আগে কলকাতার বড় বড় ফ্যামিলিতে থাকত। ওনার ধারনা বাড়ির আয়নাটা নষ্ট হয়ে গেছে। উনি একটা মানুষ প্রমাণ আয়না কিনতে চান।
(২)
নয়নবাবু কলকাতায় থাকলে বৌবাজারের পুরনো দোকানটাতেই বসেন। তবে সপ্তাহে বেশিরভাগ দিন ব্যবসার সূত্রে নানান জায়গায় ঘুরতে হয়। এক শুক্রবার নয়নবাবু বিকেলের দিকে দোকান বন্ধ করে বৌবাজারের একটা বড় ফার্নিচারের দোকানে হাজির হলেন। এখানে পুরনো বনেদী বাড়ির অনেক চেয়ার, টেবিল, আসবাবপত্র ও নানা সৌখিন জিনিষ পাওয়া যায়। দোকানের মালিক নয়নবাবুর চেনা।
নয়নবাবু আয়না কিনতে চান শুনে মালিক সদানন্দবাবু বললেন, “কি রকম আয়না চান বলুন”
“বেলজিয়ান গ্লাসের আয়না আছে আপনার কাছে? শুনেছি পৃথিবীর সেরা আয়না বেলজিয়ানরা তৈরি করে।”
নয়নবাবুর কথা শুনে সদানন্দবাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসলেন।
“কেন আমি কি ভুল বলেছি?”
“না না কিছু মনে করবেন না, আপনার মত অনেক লোকের তাই ধারণা। শুনুন আমার ছেলে বেশ কিছুদিন বেলজিয়ামে ছিল, ওখানের লোকেরা জানেই না যে ওদের আয়না পৃথিবীবিখ্যাত। ওদের চকোলেট যে বিখ্যাত এটাই ওরা জানে। তবে জার্মান আয়না নিয়ে যান। খুব ভালো আয়না দিতে পারি, তবে দামটা একটু বেশী পড়বে।”
নয়নবাবু বললেন বেশী দাম দিতে ওনার আপত্তি নেই। কয়েকটা আয়না দেখে নয়নবাবুর ভালোই লাগল। আয়নাগুলো দেখতে দেখতে ওনার নজর পড়ল আলাদা করে রাখা একটা আয়নার দিকে। আয়নাটা অবশ্য আপাদমস্তক কাপড় দিয়ে ঢাকা।
নয়নবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “এটা ঢাকা কেন? বিক্রির জন্য নয় বলে, নাকি বিক্রি হয়ে গেছে?”
সদানন্দবাবু কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, “না বিক্রি হয়নি, আয়নাটা একটা নিলামে কিনেছি। ওরাই আমাকে আয়না ঢাকা দিয়ে রাখতে বলেছিল। এটা একটা খুব বড় বনেদী বাড়ির আয়না। জার্মানী থেকে সোজা আমদানি করা; তবে আয়নার নাকি একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে, সকলে সেটা টের পায় না। তবে অনেকের বেশ অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাই ঢাকা দিয়ে রাখা।”
সদানন্দবাবুর কথা শুনে নয়নবাবুর কৌতূহল হল। অনেকদিনের ইচ্ছে বাড়িতে এমন একটা জিনিষ থাকবে যা কারোর নেই। কিন্তু তিনি তো আর কোটিপতি নন যে দুষ্প্রাপ্য এমন জিনিস কিনবেন যার দাম কোটি কোটি টাকা। নয়নবাবু আয়নাটার দাম দিয়ে দিলেন, বাড়িতে ওরা পাঠিয়ে দেবে।
(৩)
কয়েকদিন পরেই আয়না নয়নবাবুর বাড়িতে চলে এসেছে। নয়নবাবু ভাবলেন একা আয়নাটার ঢাকা খোলা ঠিক হবে না। ওনার এক প্রতিবেশী আছেন চঞ্চল চাকলাদার, ভদ্রলোক একটি সরকারি অফিসে কাজ করেন ও নানান বিষয়ে পড়াশুনা করেন। নয়নবাবু চাকলাদারকে আয়নাটার গল্প আগেই বলেছিলেন। শুনে চাকলাদার খুবই কৌতূহলী হয়েছিলেন। নয়নবাবু ফোন করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চাকলাদার এসে হাজির৷ দুজনে মিলে আয়নাটার ঢাকা খুললেন, আয়নাটা বেশ চকচকে। দুজনে আয়নটার সামনে দাঁড়ালেন। একমিনিট পরেই চাকলাদার বললেন “কই কিছুইতো অস্বাভাবিক দেখছিনা।”
নয়নবাবু নিবিষ্ট মনে আয়নায় নিজের প্রতিফলন দেখছিলেন। হঠাৎ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, “ওই যে ওটা কি? ওটা তো একটা কঙ্কাল”
“কোথায়?”
চাকলাদারের প্রশ্ন শুনে নয়নবাবু চিৎকার করে ওঠেন, “আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? আমার প্রতিফলনে শুধু আমি নেই, আমার ঠিক পেছনেই একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে।”
“আরে দূর আমি তো আপনাকেই দেখছি। ওই দোকানদার একটা আজগুবি গল্প বলেছেন আর আপনি তাই বিশ্বাস করে বসেছেন।”
চাকলাদারের কথা শুনে নয়নবাবু উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
“না না চঞ্চলবাবু, আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার পিছনে আমার কঙ্কাল।”
“আপনার কঙ্কাল বুঝলেন কি করে?”
“কেন আমি একবার পায়ের এক্সরে করিয়েছিলাম। এই কঙ্কালটার পা ঠিক ওরকম দেখতে”
এবার চাকলাদার না হেসে থাকতে পারলেন না।
“আরে সব কঙ্কালের পা একরকম, বড়োজোর পায়ের দৈর্ঘ্য কম বেশী হতে পারে।”
“যাইহোক আজকে আয়নটা ঢাকা দিয়ে রাখুন, কালকেও একই অভিজ্ঞতা হলে আমাকে জানাবেন।”
(৪)
দুদিন ধরে নয়নবাবু পরীক্ষা করে দেখেছেন, সেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। নিজের প্রতিফলনে কঙ্কাল দেখছেন তার পাশেই দাঁড়িয়ে, তবে একই কঙ্কাল সব সময় দেখছেন কিনা এটা নয়নবাবু বুঝতে পারছেন না। পশুপতিকে বলেছেন আয়নার সামনে দাঁড়াতে। ওকে অবশ্য কঙ্কালের ব্যাপারে কিছু বলেননি। পশুপতি অবশ্য নিজের বা নয়নবাবুর প্রতিফলন ছাড়া কিছুই দেখতে পায়নি। শুধু বলেছে যে আয়নাটা খুব ভালো আর ঝকঝকে। নয়নবাবু এরপর চাকলাদারকে ডেকে পাঠান।
“আপনি একবার ডঃ পাকড়াশীর সঙ্গে দেখা করুন না।”
চাকলাদারের কথা শুনে নয়নবাবু ক্ষুব্ধ হন।
“কেন ডাক্তার কেন, আপনার কি ধারনা আমি পাগল হয়ে গেছি?”
“আরে না না, ডঃ পাকড়াশী শুধু সাইকিয়াটিস্ট নন, নানা বিষয়ে ওনার গভীর জ্ঞান আছে। এইসব বিষয়ে উনি রিসার্চ করেন। আপনি এরকম দেখছেন কেন তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ওনার থেকে ভালো কেউ দিতে পারবেন না।”
কিন্তু নয়নবাবু যথেষ্ট কনভিনসড হলেন না। শেষে চাকলাদার বললেন “একবার অন্তত দেখান, ভালো না লাগলে আর যাবেন না”
নয়নবাবু আর খুব আপত্তি করলেন না। বিশেষ করে যখন জানলেন ডঃ পাকড়াশীর ফিস খুব বেশি নয়।
(৫)
চাকলাদারের সঙ্গে ডঃ পাকড়াশীর জানাশোনা থাকাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে খুব দেরি হল না। এক শুক্রবার সকাল এগারোটায় চাকলাদার আর নয়নবাবু ডঃ পাকড়াশীর চেম্বারে গেলেন। ডঃ পাকড়াশী ছোটখাটো মানুষ, তবে দেখে শক্ত সমর্থ মনে হয়, গাত্রবর্ণ মাঝামাঝি। ডঃ পাকড়াশী নয়নবাবুর কথা খুব মন দিয়ে শুনলেন।
“মিঃ হাজরা, এর আগে কি এরকম কোন অভিজ্ঞতা আপনার হয়েছিল? মানে শুধু আয়না নিয়ে নয়, অন্য যে কোন বিষয়ে”
“হ্যাঁ খুব ছোটবেলায় একবার রাত্রে জানালার পর্দার উপর কঙ্কাল দেখেছিলাম, যেমন ৪৪০ ভোল্টের মেশিনের গায়ে আঁকা থাকে একটা কঙ্কালের মুণ্ডু আর দুটো হাত। অবশ্য বেশীক্ষণ দেখিনি।”
নয়নবাবুর কথা শুনে ডঃ পাকড়াশী খুব অবাক হলেন না।
“দেখুন আপনার যে একটা হ্যালুসিনেশন হচ্ছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তবে আয়নাটা ভালোভাবে পরীক্ষা না করে আমি কিছু বলতে চাই না। শুনলে অবাক হবেন এর মধ্যেও অঙ্ক আছে। আমি লোক পাঠাব, আপনার বাড়ি থেকে আয়নাটা ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাবে। সামনের সপ্তাহে একবার দেখা করবেন।”
(৬)
পরের শুক্রবার চাকলাদার আর নয়নবাবু ডঃ পাকড়াশীর চেম্বারে হাজির। আধঘণ্টা অপেক্ষার পরেই ওদের ডাক পড়ে। ডঃ পাকড়াশীকে বেশ খুশীই দেখাচ্ছিল।
“নয়নবাবু আপনার আয়নাটা আমি আমার এক বিজ্ঞানী বন্ধুর কাছে পাঠিয়েছিলাম। ও আমাদের ব্রেন কিভাবে আলোকে দেখে, বিভিন্ন কম্পাঙ্কের আলো মিশে প্রতিসরণে কিরকম দেখায় এ বিষয়ে একজন এক্সপার্ট। আপনার আয়নাটাকে সত্যিই একটা ম্যাজিক আয়না বলা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব মসৃণ দেখলেও আয়নাতে খুব সূক্ষ্ম একটি ঢেউ আছে। সবাই এটা টের পায়না। এর ফলে আপনার যে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে সেটার বৈজ্ঞানিক নাম ‘এনটপিক হ্যালুসিনেশন’।”
“সেটা আবার কি ডঃ পাকড়াশী”
“দেখুন ব্যাপারটা একটু টেকনিক্যাল, সহজ করে বলতে গেলে এর ফলে আপনি নানা রকম প্যাটার্ন দেখতে পাবেন যা নানা রকম চেহারা নিতে পারে।”
“তাহলে চাকলাদার কেন কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না?”
নয়নবাবুর কথা শুনে ডঃ পাকড়াশী মৃদু হাসলেন।
“এর কারণ একই জিনিষ লোকে বিভিন্নভাবে দেখে। আমরা মনে করি যে আমরা চোখ দিয়ে দেখি। কিন্তু আমরা মাথা মানে ব্রেন দিয়ে দেখি। চোখ শুধু লেন্সের কাজ করে। অনেক সময় একটা জ্যামিতিক ছক মাথায় ভেসে আসে। এটা কিছু ড্রাগ খেলেও হয়। এই অবস্থাকে ‘হিপনোগোগিয়া’ বলে।”
“কিন্তু আমি যে কঙ্কাল দেখলাম সেটা কি করে ব্যাখ্যা করবেন?”
নয়নবাবুর প্রশ্ন শুনে ডঃ পাকড়াশী কোন উত্তর না দিয়ে ড্রয়ার খুলে কয়েকটা ছবি বার করে নয়নবাবুকে দেখালেন। নয়নবাবু অবাক হয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগলেন।
“আরে এই ছবিটা তো কঙ্কালের ছবি”
“না কঙ্কাল নয়, ওটা ফ্র্যাকটাল”
“ফ্র্যাকটাল? সেটা আবার কি?”
এবার চাকলাদার খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বললেন “আরে আমি সেদিন একটা বিজ্ঞানের উপর লেখা পড়ছিলাম, মূলত অঙ্কের উপর। তাতে পড়লাম ফ্র্যাকটাল, কেয়স ইত্যাদির কথা। খুব ইন্টারেস্টিং লাগছিল, তবে পুরোটা বুঝতে পারিনি। ফ্র্যাকটালের ডাইমেনসন নাকি ২, ৩ এসব পূর্ণ সংখ্যা হয় না।”
“ঠিকই বলেছেন”, ডঃ পাকড়াশী চাকলাদারের কথা শুনে বলেন।
“আসলে ফ্র্যাকটালের মূলতত্ব হল অনেক জটিল চিত্র খুব সহজ একটি চিত্রকে বার বার রিপিট করলে পাওয়া যায়। অবশ্য বিশেষ বিশেষ চিত্রের জন্য আলাদা ফরমুলার দরকার। কঙ্কাল ফ্র্যাকটালটার ফরমুলা আবিষ্কার করেছে দুজন বাঙালী ছেলে, আকাশ সাহা আর দীপ্ত সেন। ওরা ব্যাঙ্গালোরে একটা আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে। আপনি যদি অনুমতি দেন আমি একটা পেপার লিখব ওদের সঙ্গে। আপনার কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং।”
“ডঃ পাকড়াশী পেপার না হয় লিখলেন তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আমার আয়নার ব্যাপারে কি ঠিক করলেন?”
“দেখুন নয়নবাবু, কিছুদিন পরে হয়ত আপনার হ্যালুসিনেশন দূর হয়ে যাবে। তবে আমার আ্যডভাইস হবে আয়নাটা আপনি ফেরত দিয়ে অন্য আয়না নিন।”
নয়নবাবু চুপ করে থাকেন।
চাকলাদার বলেন, “নয়নবাবু আপনার আয়নাটা আমাকে দিন, আপনি যে দামে কিনেছেন ওই দামই আপনাকে দেব। এরকম আয়না হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।”
“হ্যাঁ, এটাই ভালো হবে। নয়নবাবু মাঝে মাঝে আয়নার সামনে গিয়ে দেখবেন কঙ্কালটা দেখতে পারছেন কিনা।”
এবার ডঃ পাকড়াশীর কথাটা নয়নবাবুর মনে ধরে। ফিস দিতে গেলে পাকড়াশী নেন না। বলেন “পেপার লেখার যে অনুমতি দিয়েছেন ওটাই যথেষ্ট।”
(৭)
এরপর প্রায় ছমাস কেটে গেছে। প্রথম প্রথম আয়নায় কঙ্কালটা দেখতে পেলেও পরে নয়নবাবু অন্য ধরনের জ্যামিতিক প্যাটার্ন দেখতে পান। আস্তে আস্তে সেটাও ক্ষীণ হয়ে আসে।
ডঃ পাকড়াশীর কথাই সত্যি হয়। নয়নবাবুর হালুসিনেসান দূর হয়। তবে নয়নবাবু আয়নটা চাকলাদারের কাছ থেকে আর ফেরত নেননি। এবার আসল বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না কিনেছেন। এটাতে পরিষ্কার নিজের প্রতিফলন দেখছেন। কোন সমস্যাই আর নেই।
Tags: গল্প, নয়নবাবুর আয়না, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রাজকুমার রায়চৌধুরী