পক্ষীরাজ
লেখক: বিশ্বদীপ দে
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
বিনু যখন কথাটা আমায় বলেছিল, চারপাশ তখন আকাশজোড়া কালো মেঘের ছায়ায় ময়লা ও আবছা হয়ে এসেছে। যে কোনও সময় বৃষ্টি নেমে পড়বে। ঘরের আলোটা জ্বালানো ছিল না। বাইরের বিবর্ণ আলোতে বিনুর মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম। ওই কম আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ওর উজ্জ্বল চোখদুটো। মনে মনে ভয় করছিল। বিনু কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? ওর চোখের ভাষা অপ্রকৃতিস্থ রকমের জ্বলজ্বলে! তা ছাড়া ও যা বলছে, তাও তো কোনও সুস্থ লোক বলবে না। শরীরী ভাষাতেও এক ধরনের অস্থিরতা স্পষ্ট।
সামনে রাখা কাপে ঠান্ডা হচ্ছে কফি। বিনু নিজের মনে বলে চলছিল, ‘‘ঘোড়াটার চেহারায় একটা আলাদা জেল্লা ছিল, জানিস! সাধারণত ময়দান চত্বরে যে সব ঘোড়া ঘুরে বেড়ায়, তাদের চেহারার মতো নয়। শুনেছি এগুলো সব রেসের বাতিল ঘোড়া। কোনওটা আবার গাড়ি চালায়। লোকজনকে শহর দেখায়। কিন্তু এই ঘোড়াটাকে আমার দলছুট মনে হচ্ছিল। তাই কী এক কৌতূহলে আমি ঘোড়াটার খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম। আর যেতেই চোখে পড়ল ব্যাপারটা। ওর পিঠের দু’পাশে সন্তর্পণে লুকনো আছে একজোড়া ডানা!’’
সাধারণত রচনার সঙ্গে আমার কোনও মতই মেলে না। ছুটির দিনে আমার আড্ডা দেওয়া নিয়েও আমাদের মতান্তর হয়েছে। ওর মতে, সবাইকে আড্ডায় ঢুকতে না দিয়ে আমার উচিত ঠিকঠাক লোকজনকে অ্যালাও করা। বিনুর মতো অনেকেই আমার কাছে আসে, যারা স্রেফ পাড়ার লোক বলেই আমার ড্রইংরুমে এন্ট্রি পায়। কোনওদিন রচনার কথাকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সেটাই উচিত।
এক পাড়ায় থাকা ছাড়া বিনু আর আমার মধ্যে কোনও কিছুই ‘কমন’ নেই। হ্যাঁ, ছোটবেলাটা আছে। সেটাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে এসেছে। তবু মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে ও। আমিও এড়িয়ে যাই না। কেমন একটা করুণা, না এটা মোটেই ঠিক বলছি না, হয়তো ছোটবেলার মায়ার বশেই আমরা গল্পগুজব করি। তখন দূর থেকে দেখলে আমাদের অনেকটা বন্ধুর মতোই লাগে।
ভুল যে করেছি, আজ স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এই সব পাগলাটে লোককে পাত্তা না দেওয়াই ভাল। আপাতত ওকে থামাতে গেলে এক ফুঁয়ে ওর উত্তেজনা নিভিয়ে দেওয়া দরকার।
—কিন্তু এটা তো কার্তিক মাস নয়। আর তখন তো দিনের বেলা। জ্যোৎস্নাও নেই।
বিনু আচমকা কথা থামিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমার মুখে রসিকতার কোনও ছায়া ছিল না। বললাম, ‘‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে। জীবনানন্দ পড়িসনি? অবশ্য ঘোড়াগুলোর পিঠে ডানা ছিল কি না, সেটা জীবনানন্দ লেখেননি। হয়তো রাত্তির বলে ঠিক দেখতে পাননি।’’
বিনু ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছিল না। বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, ‘‘তুই আমার কথাটা বিশ্বাস করছিস না, তাই তো?’’
আলতো হাসলাম। কিছু বললাম না। নীরবতার মানেটা বুঝতে পেরে চুপ করে গেল বিনু। তারপর নিজের মনেই হাসল। খুব বিষণ্ণ একটা ছেঁড়া ছেঁড়া হাসি। বলল, ‘‘সরি। তোর সময় নষ্ট করলাম। আসলে কী জানিস, একটা চুয়াল্লিশ বছরের আধবুড়ো লোক পক্ষীরাজ দেখেছে এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, এ টুকু বোধ আমার আছে। তাই এত বড় খবরটাকে চেপে রেখেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল, কাউকে অন্তত বলা দরকার। না হলে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। কাকে বলা যায়, এ কথা ভাবতে গিয়ে যার কথা মনে এল সে তুই, অতনু। কিন্তু বুঝতে পারছি, এ কথা কাউকেই বলা যাবে না।’’
জানতে চাইলাম, ‘‘ধর তোকে যদি আমি এমন একটা বিতিকিচ্ছিরি গল্প দিতাম, তুই বিশ্বাস করতিস?’’
আহত চোখে বিনু দেখল আমায়। তারপর বলল, ‘‘প্রথমে হয়তো করতাম না। তারপর ভেবে দেখতাম। আমি তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারিনি প্রথমে। যদিও পরে ভেবে দেখেছি, কী করে এমনটা হতে পারে।’’ আমি যে ওর কাছ থেকে এ বিষয়ে ডিটেইলস জানতে চাইব না, সেটা আন্দাজ করেই ও নিজের মনে বলে চলল, ‘‘রূপকথার জগৎটা তো হতেই পারে একটা অন্য ডায়ামেনশনের দুনিয়া। কখনও কখনও সেটা আমাদের ডায়ামেনশনের সঙ্গে মিলে যায়। তখন সেই জগতের বাসিন্দাদের আমরা দেখতে পাই।’’
বেলা হয়ে আসছে। ছুটির দিনে অনেকেই আসে আড্ডা দিতে। কিন্তু আজকের ওয়েদারে আর কেউ আসেনি। যদি আসত, তাহলে বিনু ওর এই গল্প দেবার সাহস পেত না।
ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফিতে চুমুক মেরে বিনু বলল, ‘‘তুই আর একটা কথা বলবি, আমি জানি। বলবি আমার মোবাইলে কেন ছবি তুলে নিইনি। কিন্তু বিশ্বাস কর, প্রথম যখন ব্যাপারটা দেখলাম, এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, সে সব কথা মনে ছিল না। একটু পরেই তো দেখলাম ঘোড়াটা নেই। নিরিবিলি জনহীন মাঠের প্রান্ত ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে হাওয়া। দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও চারটে ঘোড়া। যে যার মতো চড়ছে। কিন্তু তারা কেউ পক্ষীরাজ নয়।’’
কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর বিনু উঠে পড়ল। ‘‘নারে, চলি। বৃষ্টি একবার নেমে গেলে আর বেরতে পারব না।’’
বিনু বেরিয়ে যাওয়ার পরেও আমি বসে রইলাম আমার চেয়ারে। রচনা স্নান করতে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছিল। আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল বিনুর কথাগুলো।
— অফিসের কাজে মাঝেমধ্যে ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রিট চত্বরে যাই। সেদিনও গিয়েছিলাম ময়দানের দুটো অফিসে। তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গেল, তাই গড়ের মাঠে একটু ঢুঁ মারছিলাম। ছোটবেলা থেকেই এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়, জানিস। বাবার সঙ্গে কতবার যে এসেছি! ভাবতেও পারিনি কোনওদিন এখানেই…
আধো অন্ধকার ঘরের মধ্যে বিনু অনর্গল কথা বলে চলাটা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, যেন কোনও একাঙ্ক নাটক দেখছি। কখনও ভয়, কখনও বিস্ময়, কত রকম অভিব্যক্তি!
— কেমন একটা অদ্ভুত ভয় করছিল। এমন অসম্ভব একটা কিছুর সাক্ষী হলে, চারপাশের সমস্তটাই অলৌকিক মনে হয়।
একটা দমচাপা ভয়ে শুকনো চোখমুখে আমি রেড রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম ধর্মতলার মোড়ের দিকে। যেখানে অনেক ভিড়, হইচই, ব্যস্ততা—সেখানে চলে যেতে ইচ্ছে করছিল।
একটা চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপ হাতে ঠকঠক করে কেঁপে যাচ্ছিলাম, জানিস। কেন এই কাঁপুনি, সেটা নিজের কাছেই স্পষ্ট হচ্ছিল না। ভূত দেখার মতো একটা অনুভূতি হচ্ছিল।
বিনু চলে গেছে। ওর বসে থাকা চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে একটা খিস্তি দিয়ে বললাম, ‘‘অনেক হয়েছে, এ বার থাম।’’
বিনু ওরফে বিনয় সান্যাল পক্ষীরাজ দেখেছে।
কথাটা পাড়ায় রটে গেল। আমি কিন্তু রটাইনি। বিশ্বাস করুন। আমি মাত্র দু’জনকে বলেছিলাম। তারাও আমার বাল্যবন্ধু। বিনুকে ছোটবেলা থেকেই চেনে। এতদিনের চেনা একটা ভালমানুষ বন্ধু হঠাৎ পাগল হয়ে গেল, সেটা ওদের সঙ্গে শেয়ার না করে পারিনি।
কথাটা সেখান থেকেই ফুলকি ছড়াতে শুরু করে। তারপর আস্তে আস্তে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সকলেই জেনে যায়। বিনু গড়ের মাঠে একটা ঘোড়া দেখেছে। যার পিঠে একজোড়া ডানা।
উত্তরপাড়ার মতো মফস্সল এলাকায় এ সব গল্প আলোর বেগে ছোটে। তারপর যা হয়, ব্যাপারটা মুখরোচক হয়ে উঠতে থাকে। এখন বিনু রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পায়, ‘পক্ষীরাজ’ সম্ভাষণ। ব্যাপারটা বলাই বাহুল্য, বিনু ভাল ভাবে নেয়নি।
এমনিতে আমাদের পাড়ায় বিনুদের পরিবার রীতিমতো প্রাচীন ও সুপরিচিত। সকলেই একডাকে চেনে। বিনুর জ্যাঠা–কাকারা সবাই বেশ প্রতিষ্ঠিত। ওর বাবাও বেশ সফল একজন উকিল ছিলেন। কিন্তু বিনু যখন কিশোর, তখনই দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। তারপর থেকে বেশ কষ্টেই দিন কেটেছে মা–ছেলের। অনেকেই ভেবেছিলেন, বিনু বড় হয়ে চাকরি করে মায়ের কষ্ট দূর করবে। কিন্তু জীবনটা তো আর সিনেমা নয়। তাই বিনুর পড়াশোনা বেশি দূর হল না। ব্যবসা করবার চেষ্টা করেও কিস্যু করতে পারেনি। আপাতত হাজার দশেক টাকার একটা কেরানির চাকরি করে। তা দিয়ে মা ও ছেলের অবশ্য চলে যায়। কিন্তু বাকি বন্ধুদের মতো বিনুর আর প্রতিষ্ঠা পাওয়া হয়নি।
বিনু ছেলে হিসেবে বেশ ভাল, হাসিখুশি। তাই বিরাট কিছু জীবনে করতে না পারলেও পাড়ায় ওর একটা পরিষ্কার ইমেজ ছিল। সান্যাল বাড়ির ছেলে হিসেবেও আলাদা একটা পাত্তা পেত।
কিন্তু পক্ষীরাজের দৌলতে সেই ইমেজ একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। গুন্ডা–মস্তান হয়ে গেলেও লোকে আজকাল একটা ভয় মেশানো ভক্তি করে। কিন্তু পাগলকে কে আর পোঁছে। তা ছাড়া, উঠতি ছেলেরা কাউন্টারের সিগারেট খেতে খেতে একটু কমিক রিলিফ পেলে বর্তে যায়। তারাই ব্যাপারটাকে একেবারে টাটকা রেখে দিল। আসতে যেতে বিনুকে এই নতুন সম্ভাষণে ডাকা শুরু করল তারা। বিনু প্রথম প্রথম রুখে দাঁড়ালেও আস্তে আস্তে মেনে নিল।
মজার খোরাক বেশিদিন একই রকম মজা দেয় না। তাই একটা সময়ের পরে আওয়াজ দেওয়ার পরিমাণ খানিক কমলেও পাড়ায় বিনুর পাত্তা না পাওয়াটা একেবারে স্থায়ী হয়ে গেল। বিনুও সবাইকে কেমন যেন এড়িয়ে চলত।
সত্যি বলতে কী, আমার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন অপরাধবোধ জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু আমি নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছিলাম। রচনাও আমাকে সমর্থন করেছিল। এমন একটা অসম্ভব কথা শুনলে সেটাকে চেপে রাখা বেশ কষ্টকর। তা ছাড়া আমি তো জনে জনে বলে বেড়াইনি। যে দু’জনকে বলেছিলাম, তাদের থেকেই কথাটা রটে গেছিল। কাজেই আমার নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনও মানেই হয় না।
বলতে গেলে বিনুকে নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধই হয়ে গেছিল। আচমকাই একদিন খবরটা পেলাম। বিনুর নাকি সম্বন্ধ দেখা হচ্ছিল। একটা বয়স পর্যন্ত বিনু বিয়ে করতে রাজি ছিল না। তবে এ বার ওর মা একরকম জোর করেই ওকে রাজি করিয়েছিল। ব্যাপারটা মোটামুটি পাকা হয়ে যাওয়ার পথে, সেই সময় কোনও ভাবে পক্ষীরাজের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই, এর পর মেয়ের বাড়ির লোক বেঁকে বসে। বিয়েটা ভেঙে যায়।
আপাতদৃষ্টিতে যাকে সুস্থ বলে মনে হয় সে যে ভেতরে ভেতরে এমন পাগলামির বীজ বহন করতে পারে, সেটা মেয়ের বাড়ির কাছে আশ্চর্য ঠেকেছিল।
তবে কেবলমাত্র ওই কারণেই ক্যানসেল হয়েছে কি না সেটা বলা কঠিন। কারণ, সবটাই শোনা লোকমুখে। তবে ভেতরে ভেতরে আবার আমার অপরাধবোধ ফিরে আসছিল। যে অপরাধবোধের নুড়িগুলো নামিয়ে রাখছিলাম, সেগুলো যেন পেল্লাই পাথর হয়ে ফেরত আসতে লাগল।
এরই মধ্যে বিনুর সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে গেল। বাজার থেকে ফিরছি। দেখি, উল্টোদিক থেকে সাইকেল চালিয়ে আসছে। বোধহয় বাজারে যাচ্ছিল। চেহারাটা খানিক শুকিয়েছে। অবশ্য আমার দেখার ভুলও হতে পারে। অনেকদিন তো দেখা হয়নি। কিন্তু মন বলছিল, ভুল নয়। একটা অব্যক্ত ক্ষোভ যেন পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে ওর শরীরময়।
ওৱ সঙ্গে চোখাচোখি হতে হাসলাম। বিনু হাসল না। বরং ওর চোখের ভাষায় মনে হল, পারলে আমার ওপর হাত চালিয়ে দেয়। নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল বিনু। সবে যখন টপকেছে আমায়, আলতো করে ডাকলাম, ‘‘কীরে বিনু!’’
সাড়া দিল না। চলে গেল। সাইকেল নিয়ে বাজারের সামনের রাস্তার আবর্জনা, ভিখারি, রিকশা, বাইক, কাদা আর বাজারফেরত ও বাজারমুখী মানুষের ঢল, তার ভিতর দিয়ে বিনু অদৃশ্য হয়ে গেল।
সাইকেল নিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া বিনু এর পর সমস্ত ভিড়েরই আড়ালে চলে গেল। একদিন রাতে। ঘুমের মধ্যে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।
বিনু যদি আত্মহত্যা করত, আমার পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল হত। কিন্তু হৃদ্ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ব্যাপারটাকে অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমিও সে ভাবে ভেবে নিলাম। তবে খারাপ লাগছিল খুবই। কীই বা বয়স! সারা জীবন তো স্ট্রাগলই করে গেল। সেই কষ্টই ওকে তিলে তিলে শেষ করে দিল।
আরও নানা কথা ভেবেছিলাম। বিশ্রী কষ্ট চেপে ধরছিল বুকের ভেতরটা। কিন্তু নাহ্, সেই কষ্টের মধ্যে কোথাও অপরাধবোধ ছিল না। আমিই ঢুকতে দিইনি। একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে বসে ছিলাম জানলার ধারে।
জানতাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই ফিকে হয়ে যাবে। গেলও। বিনুকে সবাই ভুলে গেল। আমিও। কিন্তু আচমকাই মনে পড়ল গতকাল রাতে।
আসলে গতকাল রাতে আমি বাড়ির পাশের মাঠে আবিষ্কার করেছি একটা পক্ষীরাজ ঘোড়াকে! সাদা ধবধবে চেহারা।
গল্পের বইতে যেমন আবহ দেখা যায়, অবিকল সেরকম। একটা অলৌকিক মুহূর্ত যেন! মাঠের উত্তর দিকের গোলপোস্টের পিছনেই, যেখানে ঘাস খুব ঘন, সেখানে মুখ ডুবিয়ে রেখেছিল ঘোড়াটা। নিজের মনে। জানলা দিয়ে দেখছিলাম আমি। তেল চুকচুকে ত্বকে চাঁদের আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছিল।
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠেছিলাম বাথরুমে যাব বলে। তখনই দেখতে পেয়েছিলাম দৃশ্যটা। দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার দাঁতে দাঁত লেগে গেল। রচনা গেছে বাপের বাড়ি। বাবা–মা নীচের ঘরে। আমার চারপাশে কেউ নেই। মধ্যরাতের নির্জনতার ভেতর একটা ঘোড়া। ঘোড়াটার পিঠের দু’পাশে ভাঁজ করে রাখা… হ্যাঁ, ডানা।
ঠিক দেখছি কি না বোঝার জন্য নীচে যাওয়া দরকার। কিন্তু নীচে নামলেই বাড়ির বাকিরা টের পেয়ে যাবে। কী করে নামব এ সব ভাবতে না ভাবতেই দেখি, ঘোড়াটা নেই!
বহুদিন আগে শোনা কথাটা মাথার মধ্যে পাক খেয়ে গেল। ‘‘রূপকথার জগৎটা তো হতেই পারে একটা অন্য ডায়ামেনশনের দুনিয়া। কখনও কখনও সেটা আমাদের ডায়ামেনশনের সঙ্গে মিলে যায়। তখন সেই জগতের বাসিন্দাদের আমরা দেখতে পাই।’’
মাথার মধ্যে কথা বলছিল বিনু। আর আমি ধপ করে বসে পড়েছিলাম খাটের ওপর। ঘামছিলাম।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হল না। আরও একটু অংশ বাকি আছে। আর সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আজ সকালে বেশ ভোরে উঠে পড়েছিলাম। কৌতূহল আর কৌতূহলে অস্থির হয়ে যাচ্ছি। নীচে নেমে এসে দেখলাম রোজকার মতোই ফুটবল খেলছে বাচ্চারা। আমি এগিয়ে গেলাম মাঠের উত্তর দিকের গোলপোস্টের দিকে। রাতের অন্ধকারে ঘুম ভাঙা ঘোরে যা দেখেছিলাম, সেটাকে দিনের বেলায় অবিশ্বাস করার রসদ খুঁজতে। পেলাম না। পোস্টের পিছনদিকে থাকা ঘাসগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ তার একটা বড় অংশ উদরস্থ করেছে!
কেউ ঘাস খেয়ে গেছে মানেই সেটা কাল রাতেই খেয়েছে, তেমনটা অবশ্য না–ই হতে পারে। হয়তো বেশ কিছুদিন ধরেই ওই জায়গার ঘাসটা খেয়েছে অন্য কোনও পশু। আমি কি রোজ খেয়াল করি? কিন্তু এ সব ভাবতে গিয়েও মনে হল, ভাবনাটা তেমন জোরদার নয়।
অস্থির মন নিয়েই অফিস গেলাম। কিন্তু সারাদিন কাজে মন বসল না। দুপুর দুপুরই বেরিয়ে এলাম।
বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পেলাম দৃশ্যটা। সিং বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ঘোড়া! দেখার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। খানিক সামনে এগিয়ে গেলাম। নাহ্। এর পিঠে ডানা নেই। চেহারার ঔজ্জ্বল্যও তেমন নয়।
এমন সময়ে কেউ কোমরে খোঁচা মারল। তাকিয়ে দেখি পাশের বাড়ির ছোটন। ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘‘কী অতনুদা, কী দেখছ। জহরদার ছেলের বিয়ে তো। মাড়ওয়ারিদের মতো ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাবে। শালা আজ যাবে, কাল থেকে সহিস, ঘোড়া–ফোড়া সব এসে হাজির। একেবারে রাজার ব্যাটার বিয়ে।’’
—কাল থেকে?
—আবার কী! ঘোড়াটা তো পুরো এলাকা ছানবিন করে ফেলল। দ্যাখোনি কাল?
চমকে গেলাম। তবে কি এই ঘোড়াটাই… কাল রাতে…? মনকে সেটাই বোঝাতে চাইছিলাম। কিন্তু কাল রাতে যাকে দেখলাম সে রীতিমতো স্বাস্থ্যবান। এ তো একেবারে হাড় জিরজিরে। তা ছাড়া, এর পিঠে কোনও ডানা… সত্যিই কি নেই? আরও একটু কাছে গিয়ে দেখলে হয়। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়।
ছোটনের বকবক শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরছিলাম। সন্ধে নেমে গেছে পুরোপুরি। ছোটনের আপনমনে বলা কথার ভিড়েই আলতো করে আমিও একটা কথা ভাসিয়ে দিলাম।
বাস্তব পৃথিবীতে কোনও ঘোড়ারই পিঠে একজোড়া ডানা নেই। থাকতে পারে না। নাহ্… আর যদি থাকেও সেটা কারও দেখতে পাওয়া উচিত নয়।
ছোটন চলে গেছে। স্ট্রিটলাইটের আলোয় গা ভাসিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, কাল তো পূর্ণিমা ছিল না! কেননা ক’দিন আগেই রচনা বলছিল, ওর গাঁটের ব্যথাটা অল্প বেড়েছে। তখনই পূর্ণিমার প্রসঙ্গটা এনেছিল। সেটা অন্তত হপ্তাখানেক আগের কথা। কিন্তু কাল যদি পূর্ণিমা না–ই থাকবে তা হলে বাইরেটা অত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল কেমন করে?
কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। যেন একটা ট্রেন একবার অন্ধকার, একবার আলোর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম, আমার আবার দাঁতে দাঁতে ঠকঠকানি লেগে যাচ্ছে। সারা শরীর কাঁপছে। কথাটা কি কাউকে বলব? না হলে যেন ঠিক স্বস্তি পাচ্ছি না। কিন্তু কাকে বলা যায়! রচনাকেও আমি এ কথা বলতে পারব না।
তা হলে কে? যার কথা মনে এল সে বিনু। আমার বাল্যবন্ধু বিনু। যাকে শেষবার সাইকেল চালিয়ে ভিড়ের পৃথিবী ছেড়ে ক্রমশ দূরে চলে যেতে দেখেছি। ওকেই একমাত্র এ কথা বলা যেত। বিনুর কথা খুব মনে পড়ছে।
ভাবতে গিয়েই চমকে উঠলাম। এ সব কী ভাবছি! কেন ভাবছি। আমি কি সত্যিই… আমি কি আদৌ পক্ষীরাজটাকে দেখেছি! নাকি ওটা একটা সাধারণ ঘোড়াই ছিল।
বাড়ি ফিরে এসেছি। বাড়ি একেবারে ফাঁকা। মা–বাবা সম্ভবত কাছাকাছি কারও বাড়িতে গেছে। ঘরের নির্জনতা আমার ভালো লাগছিল না। যেখানে অনেক ভিড়, হইচই, ব্যস্ততা—সেখানে চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। ঠিক বিনুর মতো। ও–ও তো গড়ের মাঠ থেকে পালিয়ে গেছিল ভিড়ে ঠাসা ধর্মতলার মোড়ে।
আমার খুব একটা একা লাগছিল না। মনে হচ্ছিল বিনুও এখানেই আছে। আমার সঙ্গে। ঠিক যেমন সেদিন বসেছিল ড্রইংরুমের চেয়ারে।
মাঠের দিকের জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছি। আজ রাতে আর ওটা খুলে শোয়া যাবে না।
Tags: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পক্ষীরাজ, পূজাবার্ষিকী, বিশ্বদীপ দে
Fantasyr sathe horror er khub sundor mishel aache ei golpe. Sathe paap bodher bypartao golper sesh e durdanto BHABE merge koriyecho. Khub bhalo laglo tomar golpo pore. Tomar golper Bhasha borabor e khub sundor, etio bytikrom noy. Tomar notun lekha porar opekkhai roilam.
kobita, mone holo ekta chomotkar kobita porlam!