পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ
লেখক: উইলিয়াম গিবসন
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
অন্যান্য সমস্ত দেশের থেকে, জাপানের সহজাত ভাবে চির-অগ্রসর ও আধুনিক হওয়ার কারণ কি? আমি যখন ছোট ছিলাম, আমেরিকাই তখন ছিল ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। আর জাপানের নাম শোনা যেত পুরনো টিনের রোবট আর নরম প্লাস্টিকের খেলনা মহাকাশচারী পুতুল বানানোর জন্যে। কিন্তু গত চার দশক ধরে, ভবিষ্যতের পৃথিবীর সাথে আমেরিকার বিশেষ সম্পর্কটি বিনষ্ট হয়েছে।
আশির দশকে, আমি এক বিশেষ শ্রেণীর কল্প-বিজ্ঞান লিখে বেশ পরিচিতি লাভ করলাম, যাকে অনেক সাংবাদিক সাইবারপাঙ্ক হিসাবে অভিহিত করেন। দেখলাম, অদ্ভুতভাবে জাপান অনেক আগেই এই জনপ্রিয় সংস্কৃতির সাথে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে বসে আছে। এটা ভাবলে ভুল হবে যে জাপানে সাইবারপাঙ্ক নিয়ে বিরাট আলোড়ন চলেছিল, বা জাপানের সাহিত্যর মধ্যে আগে থেকেই সাইবারপাঙ্ক গোছের কিছু উপাদান বর্তমান ছিল – আসলে আধুনিক জাপান নিজেই ছিল সাইবারপাঙ্ক সংস্কৃতি। জাপানের অধিবাসীরা সেটা জানত এবং ওরা ব্যাপারটাকে বেশ উপভোগই করত। আমার এখনো মনে আছে যেদিন এক তরুন জাপানী সাংবাদিক আমাকে টোকিওর সিবুয়া* জায়গাটা দেখতে নিয়ে যায়। সুউচ্চ বহুতলগুলি থেকে হাজার সূর্যের আলোর মত নানারকম বিশাল বোর্ডের বিজ্ঞাপনের অ্যানিমেশনে ধুয়ে যাচ্ছিল আমার বন্ধুর মুখ, উত্তেজিত হয়ে সে বলেছিল “দেখছেন দেখছেন – এই হল সেই ব্লেড রানারের কল্পনার শহর”। সত্যিই তাই – এই শহরই তো দেখেছিলাম সিনেমায়।
পশ্চিমের একটা ধারনা আছে যে জাপান নাকি পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো ভবিষ্যতকে জিতে নিয়েছে – যেটা অনেকে জাপানের ক্রমাগত অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা করলে খুব বড়সড় ভুল হবে। ঐ অর্থনৈতিক উন্নতির বুদবুদ অনেকদিন আগে ফেটে গেলেও, জাপান কিন্তু আগের থেকেও অনেক বেশি আধুনিক, ভবিষ্যতদ্রষ্টা। সেটা কিভাবে?
এর উত্তরও, অনেক কিছুর মতোই লুকিয়ে আছে অতীতের গর্ভে।
বহুবছর বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর, মেইজি আমলে** জাপানিরা যেন হঠাৎ করেই এক ধাক্কায় “সভ্যতা এবং জ্ঞান” এর পথে চলার জন্য নিজেদের উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। যে যন্ত্রসভ্যতাকে তারা আপন করে নিয়েছিল, তা তাদের পূর্বেকার জীবনযাত্রার তুলনায় ভীনগ্রহী সভ্যতা ছিল। এই সভ্যতার বেশ খানিকটা তারা ব্রিটিশদের থেকে নিয়েছিল – বলতে গেলে পুরো শিল্প বিপ্লব এবং রেল ব্যবস্থাই। কেবল লণ্ডন থেকে টোকিয়তে সভ্যতার এই স্রোত যেভাবে ফল্গুধারার মত প্রবাহিত হয়েছিল, সারা ইংল্যান্ড থেকে বাকি জাপানে তার অতটা প্রভাব পড়েনি। কারন, লন্ডন তখন তথ্য, জ্ঞান এবং বিপুল পুঁজির এক কেন্দ্রবিন্দু ছিল, যা উৎপাদন শিল্পের অগ্রগতির প্রধান সহায়ক হয়ে উঠেছিল। সারা ইংল্যান্ডে শিল্প উন্নতির রমরমা দেখে জাপানিরা ভীষনভাবে সংক্রমিত হয়ে পড়েছিল। অপরিমিত মাত্রার এই সংক্রমণে প্রথমে তারা উন্মাদ হয়ে গেল – এবং তার অভিঘাতে বিচ্ছিন্ন এবং বিদীর্ন হয়েও, শেষ অবধি বেঁচে রইল।
জাপানের মধ্যে যে অংশটা টিঁকে ছিল, সেটাই এশিয়ার প্রথম শিল্পোন্নত দেশের জন্ম দিল – অস্বাভাবিক মানসিক টানাপোড়েন এবং অগ্রগতির মূল্যে হিসেবে। এটা হবারই ছিল। আমরা জানি যে এই একই যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশদেরও যেতে হয়েছিল, যা আধুনিকতার পথে চলার অভিঘাত হিসাবে পরিচিত। কিন্তু ব্রিটিশদের এই অভিঘাত প্রধানত এসেছিল নিজেদের ভেতর থেকেই – তাই এটা প্রত্যাশিত না হলেও, অচেনা ছিল না। কিন্তু মেইজির জাপানিরা একদম বিদেশী প্রযুক্তি হজম করতে গিয়ে সাপের ছুঁচো গেলার মত অবস্থায় পড়ল। কিন্তু সেখানে না থেমে, চোঁয়া ঢেঁকুর তুলতে তুলতেই সময়ের পথে দিশাহারা জাপান প্রচন্ড গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল; প্রায়–প্রাণঘাতী মাত্রার প্রযুক্তি সহযোগে ভাবীকালকে আলিঙ্গন করার নিবিড় তাড়নায়।
ফলস্বরূপ, কয়েক দশক পর, জাপান এক সামরিক-শিল্পোন্নত দেশে পরিনত হলো (আবার এশিয়ার প্রথম) – যার বেশিরভাগ শক্তি ব্যয়িত হতে থাকল আঞ্চলিক যুদ্ধে ব্যস্ত থেকে। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধং দেহী ভাবের জন্যই এরা যুক্তরাষ্ট্রর সাথে সামরিক কলহে জড়িয়ে পড়ল – সেই যুক্তরাষ্ট্র যেখানে শিল্পবিপ্লবের পর অনাগত ভাবীকাল পরম নিশ্চিন্তে আশ্রয় পেয়েছিল। আমেরিকার সাথে যুদ্ধের কিছুদিন পরেই জাপান দেখতে পেল, তার দুটো শহর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে – এমন এক অস্ত্রের আঘাতে, যা এক ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির দান। জাপানের শত্রু যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, তা তৎকালীন সময়ের তুলনায় অনেক অনেক এগিয়ে। শত্রুর কাছে এমন এক অচেনা শক্তিশালী মারনাস্ত্র বর্তমান, যার কাছে মেইজি যুগের সেরা প্রযুক্তিবিদদের কুক্ষিগত সর্বোতকৃষ্ট অস্ত্রও খেলনাবাটির সামিল। এদিকে যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে, মিত্রশক্তির কাছে এসে গেল প্রথম ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার, অক্ষ শক্তির একের পর এক গোপন সংকেত উন্মোচিত হতে লাগল অবহেলায়। যুদ্ধের প্রযুক্তি পরিণত হল প্রযুক্তির যুদ্ধে।
জাপান পরাজিত হল এবং তার সাথে সাথে এক বিদেশি শক্তি জাপানকে অধিগ্রহন করল, আমূল সামাজিক পরিবর্তন সাধনের অভিপ্রায়ে। এশিয়ার ইতিহাসে এ ঘটনা অভূতপূর্ব। আমেরিকা স্থির করল, জাপানের জাতীয় চরিত্রের পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে জাপান আর এভাবে আমেরিকার শক্তিবিস্তারে অসুবিধের সৃষ্টি করতে না পারে। যদিও আমেরিকার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। জাপানের সামাজিক ও সংস্কৃতিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস করে বিদেশী সাম্যবাদী চিন্তাধারা আমদানি করার আগেই, আমেরিকাকে কমিউনিজমের জুজুর ভয়ে অন্য দিকে নজর দিতে হল।
যুদ্ধ পরবর্তী জাপান যেন একই চামড়ার আবরণে ঢাকা দুটি আলাদা প্রানী। ক্রমশই বাড়তে থাকা মানসিক যন্ত্রনা নিয়ে মূহুর্মুহু এবং প্রচন্ড বেগে পরিবর্তনরত সময়ের সরণীপথে ঘুরপাক খেতে খেতে জাপানে জন্ম নিল এক সংকর সংস্কৃতি। পরবর্তী পঞ্চাশ বছর জাপান প্রতিটা ক্ষেত্রেই, কি উৎপাদনে, কি তার বিপণনে – আমেরিকাকে ছাপিয়ে চলে গেল – যে কিনা যুদ্ধপরবর্তীকালে আমেরিকারই হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
এদিকে আমেরিকা, যে নিজেকে বিজয়ী ভাবতেই মশগুল ছিল, জানতেও পারল না – অজান্তে তারা এক এমন শক্তির জন্ম দিয়েছে, যে হারতে জানে না।
এটা মোটেই আশ্চর্যের হবে না যদি বলি, আধুনিকতা এখন জাপানেই নিহিত। কিন্তু তা বললে আসলে উলটো বলা হয়। জাপানই এখন ভবিষ্যতে বাস করে, আধুনিকতায় স্বপ্ন দেখে। আর প্রায় এক শতাব্দী ধরে তারা সেভাবেই আছে। ক্রমাগত প্রযুক্তির পরিবর্তনের বলি হয়ে, সময়ের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে, অথচ গতানুগতিক সংস্কৃতিকে আঁকড়ে, হঠাৎ বিনা ঘোষনায় নিজেদের পরিবর্তন ঘটিয়ে, আজ আমরা সবাই যেন কিছুটা অচেনা, অস্বাভাবিক এবং বিকৃত হয়ে পড়েছি।
জাপান আসলে এই প্রক্রিয়াটা অনেক আগেই শুরু করতে পেরেছিল।
*সিবুয়া ঃ টোকিও শহরের একটি বিশেষ অংশ। নৈশজীবন, বিনোদন ও বানিজ্যকেন্দ্র রূপে বিখ্যাত। এটি শহরের সবথেকে ব্যস্ত রেলস্টেশন ও বটে।
**মেইজি যুগঃ সম্রাট মেইজির রাজত্বকালকে (১৮৬৮-১৯১২) জাপানে মেইজি যুগ বলা হয়। এই সময় সামন্ততান্ত্রিক জাপানের অবসান ঘটে উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর জাপানের আবির্ভাব ঘটেছিল। সমাজ সংস্কৃতি, রাজনীতি, শাসনব্যাবস্থা, অর্থনীতি থেকে বৈদেশিক নীতি সবক্ষেত্রেই পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল জাপানে।
লেখক পরিচিতিঃ উইলিয়াম ফোর্ড গিবসন
একজন বিখ্যাত আমেরিকান-কানাডিয়ান কল্পবিজ্ঞান লেখক। তার জন্ম হয় ১৯৪৮ সালে আমেরিকার সাউথ ক্যারোলিনায়। ১৯৭০ সাল থেকে লেখকজীবনের শুরু থেকেই তিনি নয়র ভবিষ্যতের গল্প লিখতে শুরু করেন। তার গল্পের বিষয়বস্তু বেশিরভাগ সময়েই – মানুষের উপর যন্ত্র সভ্যতা – বিশেষ করে কম্পীউটরের প্রভাব। একে তিনি ব্যখ্যা করেছেন – উন্নত প্রযুক্তির সাথে সমাজের অবক্ষয় রূপে। বর্তমান কল্পবিজ্ঞানের সাইবারপাঙ্ক গোত্রের জনক হিসাবে গিবসন বিখ্যাত হয়ে থাকবেন। তার বিখ্যাত বই নিউরোম্যান্সারকে সত্তরের দশকে কল্পবিজ্ঞানের আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়।
বাংলা অনুবাদ – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং দীপ ঘোষ
Tags: অনুবাদ, উইলিয়াম গিবসন, দীপ ঘোষ, দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ, প্রচ্ছদ কাহিনি, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয় দাস