পাল্টা
লেখক: অনুরাধা কুন্ডা
শিল্পী: অঙ্কিতা
একটা বিশেষ রকমের কাচের জার। গোলাকৃতি। লম্বাটে গলা। অর্ধেক একধরনের প্রিজারভেটিভ ফ্লুইডে ভর্তি। হালকা সবুজ। ঠাহর করে দেখলে বোঝা যায়, সবকটি কাচের জারের মধ্যে রয়েছে একটি করে ভ্রূণ। কোনওটিই মৃত নয়। তরলের মধ্যে ভাসমান ওই হালকা সবুজ রঙের একটি করে ডিম্বাশয়। ভ্রূণগুলি ওই কৃত্রিম ডিম্বাশয়ের মধ্যে চমৎকার বেড়ে উঠছে। তাপমাত্রা অবিকল মানবদেহের এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলিও। তাই ভ্রূণগুলির কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। অনেকের নাক চোখ বোঝা যাচ্ছে। ল্যাবরেটরিতে সারি সারি ভ্রূণের দিকে তাকিয়ে খুব পরিতৃপ্তির হাসি হাসলেন ড. মিত্র।
এরা সবাই পুরুষ ভ্রূণ।
তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী এ দেশে প্রতি ছয়মাস অন্তর দু’শো পুং ভ্রূণ জন্মগ্রহন করে। সব পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণাধীন।
এদেশে কোনও নারী নেই। এই প্রজন্মের পুরুষরা নারী চোখেও দেখেনি। ডাক্তার ও তাঁর সমসাময়িকদের মনে ক্ষীণ নারী স্মৃতি আছে বটে কিন্তু তাঁরা কাজে, সাফল্যে, বৈভব এবং আনন্দে এত বেশি মগ্ন ও মত্ত যে সেই স্মৃতি অচিরেই মুছে যাবে।
ড.মিত্র বা অবিনাশ, ত্রিলোকেশ, সজীব, রিটন যারা যারা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাঁদের একটি নির্দিষ্ট জীবনকাল ও শৈলী আছে।
সকালে তাঁরা ওয়াকে যান। ফিরে এসে দেখেন রোবট রকোকু ব্রেকফাস্ট টেবল সাজিয়ে ফেলেছে। রকোকু একেকদিন একেকরকম খাবার বানায়। আজ বাটার টোস্ট তো কাল লুচি তরকারি। প্রতিটা লুচি সমান গোল ও ফুলকো। কখনো দোসা। বা পোহা। ব্রেকফাস্ট করে ওঁরা স্নানে যান। কাপড়জামা কাচার জন্য সেবা নামে একটি রোবট আছে। কোনও কাপড়ে একটিও দাগ থাকেনা। খবরের কাগজ পড়া, খবর শোনা শেষ হলে হাল্কা ব্যায়াম করে ওঁরা অফিস বা ল্যাবে যান। লাঞ্চ প্যাক রেডি করে রকোকু গাড়িতে তুলে দেয়। এরপর সারাদিন অফিস। স্কুল। কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয়। হাসপাতাল। কোর্ট। ব্যবসা। কেউ কাউকে ডিস্টার্ব করে না। পুরুষ উদার প্রকৃতির। তাই ঝগড়া ঝাটি নেই। শুধু তীব্র প্রতিযোগিতা। আরও উচ্চমানের পুং ভ্রূণ ও অনুরূপ ডিম্বাশয় তৈরি করার অনলস প্রয়াস। ওই এক ঝামেলা। ডিম্বাশয় ছাড়া ভ্রূণ থাকছে না। তবে শিগগিরই হয়তো বৈজ্ঞানিকরা একটা বিকল্প ব্যবস্থা করে নেবেন। তবে ওই প্রতিযোগিতার জন্য পুরুষে পুরুষে তীব্র হিংসা বিনিময় হয়। সবাই সেইজন্য সবসময়ই সশস্ত্র থাকেন। খুব উঁচু ধরনের প্রতিযোগিতা হলে খুনখারাপি কোনও ব্যাপার নয়। সেক্ষেত্রে খুনের ন্যায্যতা মাপার যন্ত্র আছে। অর্থাৎ যদি খুনি বেটার ভ্রূণ তৈরি করতে পারেন, তবে তাঁর শাস্তি হয় না। বহু যত্নে স্পার্ম কালেক্ট করে কৃত্রিম ডিমের সঙ্গে মিলন ঘটানো এক সূক্ষ্ম কাজ। ওঁরা সবাই কাজে নিবেদিত। ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। রকোকু কাচা জামাকাপড়, চা বা কফি, খাবার সযত্নে বেড়ে দেয়। ওঁরা টিভিতে খেলা দেখলে রকোকু অসুবিধে করে না। সেবা ম্যাসাজ করে দেয়। ততক্ষণে ডিনার সাজিয়ে ফেলে রকোকু। সেও একেকদিন একেকরকম। কোনও পুনরাবৃত্তি নেই। তাই বোরডম নেই। এরপর নিজেদের পেপারওয়ার্ক। বই পড়া। যদি শারীরিক প্রয়োজন হয় তবে লিজ বলে একজন রোবট আছে। সে চমৎকার ভাবে পুরুষের যৌনচাহিদা মেটাতে পারে। একেকদিন একেকরকম কামকলাতে দক্ষ সে। তাই কোনও অতৃপ্তি নেই। বা থাকার কথা নয়। চাইলে সে রতিক্রিয়ার পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারে বা গুনগুন করে লোরি গাইতে পারে। অবশ্যই সেটা যদি ড.মিত্ররা অ্যালাও করেন তবেই। গোটা দেশ সুনিয়ন্ত্রিত। এইভাবে জীবন চলছে।
তবে প্রতি বাড়িতেই রোবটের নাম রকোকু বা সেবা বা লিজ। এতে পুরুষদের কোনও অসুবিধে হয় না। তবে তাঁরা কবিতা পড়লে বা গান গাইলে বাহবা দেবার জন্য, মুগ্ধ হবার জন্য একমাত্র পুক জাতীয় রোবটরাই আছে। তারা সংখ্যাতে কম এবং একটু বেশি দামী।
ড. মিত্রের বাড়িতে রয়েছে তার ছেলে নিষাদ। বাবা ছেলে দিব্যি আছেন। রোবটরা সব রকম চাহিদা নিখুঁত ভাবে সামলাচ্ছে। নিষাদ ড. মিত্রর স্পার্মপ্রসূত। তাই তার বাবা পরম তৃপ্ত। নিষাদ গিটার বাজায় এবং বিজ্ঞাপন লেখে। তার জন্য একটি ঠিকঠাক ডিম্বাশয় বানাতে বিজ্ঞানীরা তৎপর। অবশ্য আরও একশ নিরানব্বইটি ডিম্বাশয় একই সঙ্গে তৈরি হবে।
ড. মিত্র খুব ভালো মুডে আছেন। গবেষণার এমন একটা ধাপ এসে গেছে যখন আর ভ্রূণ রক্ষা করার জন্য জরায়ু প্রয়োজন হবে না। শিস দিয়ে একটা গান ভাঁজছিলেন তিনি। তাঁর পুক মাথা নাড়িয়ে তাল দিচ্ছিল। নিষাদ খুব ব্যস্ত হয়ে এসে বলল সে কিছুদিন ছুটিতে যেতে চায়। কাজ খুব বেশি করে ফেলছে। এটা কিছু নতুন না। বাবা ছেলেতে একসঙ্গে ও যান আবার আলাদাও। যে যার নির্দিষ্ট রকোকু, সেবা, লিজ, পুক-কে নিয়ে আলাদা বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। বাবার অনুমতি নিয়ে ইটালি চলে গেল নিষাদ। তার সঙ্গে তার নিজস্ব বাহিনী। গন্ডোলাতে বসে খানিক গিটার বাজানোর পর ক্লান্ত লাগলো। নেট সার্ফিং করতে লাগলো নিষাদ। সেবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎই সাহিত্য পড়তে গিয়ে আটকে গেল নিষাদ। নারীজাতিতে না। আলুসিদ্ধতে। নারীজাতি যা যা কাজ করতো সেগুলি সবই রকোকু বা লিজ অনেক বেটার করে। কিন্তু এই আলুসেদ্ধ ব্যাপারটা নিষাদ জানে না। সে বেসিক্যালি নন ভেজ খায়। গল্পে আছে “আলুসিদ্ধতে নুন কম হইয়াছিল বলিয়া নিশানাথ স্ত্রীকে একটি চপেটাঘাত করিয়াছিল। ইহা কি বা দোষের? কে জানিত চড় খাইয়া ম্যালেরিয়া ভোগা বউটা মরিয়া যাইবে?”
নিষাদ রকোকু-কে বললো, আলুসেদ্ধ বানাতে পারবে? হোটেলে ফিরে ম্যানেজারকে বলে সোজা কিচেনে গেল রকোকু। চমৎকার কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ দিয়ে মেখে আনলো একটু ঘি ছড়িয়ে। নিষাদ মন দিয়ে আলুসেদ্ধটা খেল। পারফেক্ট। নিখুঁত। তার মন হাঁকুপাকু করছিল। কি চায় ঠিক বুঝতে পারছিলো না। হঠাত সে বললো, আচ্ছা তুমি নুন কম দেওয়া মানে ইমপারফেক্ট আলুসেদ্ধ বানাতে পারবে?
রকোকু সব কিছু নিখুঁত বানানোর জন্য প্রোগ্র্রামড। সে কম নুন দেওয়া আলুসেদ্ধ বানাতে পারবে না বলে জানিয়ে দিল। এবার নিষাদ বুঝতে পারলো আসলে তার মন আলুসেদ্ধ খেতে চাইছে না। চাইছে চড় মারতে।
কিন্তু রকোকু-কে কুড়িটির বেশি চড় মারা যাবে না। এভাবেই তারা তৈরি। একুশ নম্বরে বিগড়ে যাবে। বিফোর টাইম খারাপ হলে রোবট পাওয়া যায় না। একটা প্রবল চড় মারার সুপ্ত বাসনা নিয়ে নিষাদ ছুটি ক্যানসেল করে ফিরে এল। লিজ, সেবা বা পুককেও কুড়িবার চড় মারা হয়ে গেছে। আর রিস্ক নেয়া যাবে না।
নিষাদের মনের মধ্যে একটা আশ্চর্য সমস্যা। রোকোকু অপূর্ব খাদ্য সম্ভার নিয়ে আসছে। তার মুখে রোচে না। লিজ তার শরীরের সম্ভার সাজিয়ে নিয়ে আসে মোহময় ভঙ্গীতে। নিষাদ অতৃপ্ত থাকে। কাউকে একটা চড় মারার ক্ষমতা নেই তার! আক্রোশ জমতে থাকে। গিটার ছুঁড়ে ফেলে। পুপকে আচমকা একদিন চড় মেরেই বসল সে। ভুলে গেছিল কুড়ির কোটা শেষ। কাজটা করার সঙ্গে সঙ্গে বিগড়ে গেল পুপ। রোবটিক নিয়মে পাল্টা চড় আসবে একুশ নম্বরে। তাই হল। মোক্ষম চড়ে মাথা ঘুরে গেল নিষাদের। আক্রোশের পাহাড় মাথায় নিয়ে বেরিয়ে এলো সে। লাথি মারতে ইচ্ছে করছে। হাত পা টেনে ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাকে? লিজ বা সেবাকে ছোঁয়া যাবে না। পুপ বুঝিয়ে দিয়েছে। পাগলের মতো বেরিয়ে গেল নিষাদ। সিঁড়ি দিয়ে নামছে। সামনে ও কে? অপ্রতীম। পুলকেশের ছেলে। বাচ্চা। বছর দশেকের হবে। কি নরম! কোমল! এ পাল্টা চড় মারতে পারবে না। কি যেন ভর করলো ওকে। এক হ্যাঁচকা টানে বাচ্চা ছেলেটাকে উঠিয়ে নিজের বেডরুমে ফেলল নিষাদ। রকোকু দেখল। সেবা দেখল। ওরা এখতিয়ারের বাইরে কথা বলে না।
ছেলেটা ভয়ে নেতিয়ে গেছে। প্রথমে কয়েকটা সটান চড় মারলো ওকে নিষাদ। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
পুলকেশ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে বীভৎস ভাবে ধর্ষিত। এটা খবর হয়ে বেরোনোর পর ড. মিত্র অসম্ভব ডিপ্রেসড। নিষাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ড. মিত্রর কিছু ভালো লাগছে না। অসম্ভব রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কাউকে চড় মারেন। খিমচে দেন। আইনজীবী এসে কথা বলে গেছেন। মাথা টিপটিপ করছে। সেবা চা দিয়ে চলে গেছে। সম্ভব হলে নিষাদ মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন এটা প্রতিপন্ন করে ওকে ছাড়াতে হবে। রাত বাড়ছে। ফাঁকা রাস্তা। একবার হেঁটে এলে হয়।
রাতপোষাকে নেমে গেলেন তিনি। পার্কের চারধার ঘুরে নদীর রাস্তা। খুব নির্জন। পেছনে কার পায়ের শব্দ? তাঁকে ফলো করছে কেউ? পেছন ফেরার আগে কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। নিমেষে টেনে নিয়ে গেল ঝোঁপে। কিল। চড়। লাথি। মুখ বেঁধে ফেলেছে তাঁর। পোশাক ছিঁড়ছে হিংস্র হাতে। জ্ঞান হারাতে হারাতে পুলকেশের প্রতিহিংসা মাখা মুখটা দেখতে পেলেন ড. মিত্র ।
জেলে ধর্ষক ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এক ধর্ষিত বাবা। দুজনেই চুপ।
অনেকক্ষণ পর নিষাদ কথা বললো।
বললো, আমি বুঝতে পেরেছি বাবা। আমি শুধু ডমিনেট করতে চেয়েছিলাম।
রকোকু, সেবা, লিজ আর পুকরা তখন ব্যালকনিতে বসে বিকেলের চা খাচ্ছিল।
ওরা নিশ্চিন্ত। ওদের একটাও এক্সট্রা চড় মারা যায় না। চা টা অসম্ভব ভালো ফ্লেবারের।
Tags: অঙ্কিতা, অনুরাধা কুন্ডা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা