পাসওয়ার্ড
লেখক: দময়ন্তী দাশগুপ্ত
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
[৫২১৫ সাল, ইন্ডিয়ানাল্যান্ডের ইস্ট বঙ্গ সেক্টর। ৪ জুন, রাত ১ টা বেজে ৩৭ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের ভিজিল্যান্স টিমের মনিটরে ছবি ভেসে উঠল। ১৯৭৩ ক্লাস্টারে একটি হিউম্যান মেল লায়িং পোজিশনে ভেসে রয়েছে আর একটি হিউম্যান ফিমেল সিটিং পজিশনে সামনে জায়ান্ট স্ক্রিনে কিছু দেখছে আর আঙুল নেড়ে কম্যান্ড দিচ্ছে। সাউন্ড সিস্টেম অন হতে মনিটরের সামনে বসে থাকা দুজন সেদিকে মন দিল]
-‘রাত জেগে কী খুটুরখুটুর করছিস, ঘুমাবি না?’
–যাক, পাসওয়ার্ডটা পেয়ে গেছি।
-‘কিসের পাসওয়ার্ড?’
–তোর ব্রেনের।
-‘যাব্বাবা, কী করে?’
–বলব না।
-‘হৃদয় নিয়ে শান্তি হল না, মাথা ফাতা ঘাঁটতে বসলি! তা পাসওয়ার্ড নিয়ে কী করবি শুনি?’
–হার্ট ব্লাড সারকুলেশনের সেন্টার ঠিকই, কিন্তু তুই যাকে হৃদয় বলছিস ওটা আসলে ব্রেন। তোকে আগেও বলেছি। তোর ব্রেনে ঢুকব।
-‘তারপর?’
–অনেককিছু বদল করবার আছে।
-‘মানে!’
–যেমন ধর, আগে যখন ব্রেন সিগনাল পাঠিয়ে কিছু চেঞ্জের কথা বলেছিলাম, তুই কিছুতেই রাজি হসনি। প্রথমেই তোর ব্রেনের সেই পার্টে গিয়ে ওটাকে ফ্লেক্সিবেল করতে হবে যাতে আপডেটগুলো অ্যাডজাস্ট করে নেয়। মানে বদলগুলো তুই মেনে নিতে পারিস।
-‘বটে? তুই খেয়ে দেয়ে আর কাজ পাচ্ছিস না?’
–তারপর তোর ব্রেনের সেক্টরগুলোয় ঘুরে বেড়িয়ে হতাশা, দুঃখ, অভিমান, স্মৃতি এই যাবতীয় কিছু নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। কথা অতিরিক্ত কম বলিস, ওটা সামান্য বাড়িয়ে দেব, যেমন ধর রেসপন্স।
-‘কেলোর কীর্তি হবে। শালা সব গণ্ডগোল হয়ে যাবে। ছাড় এসব।’
–তা হলই বা, তুই কি এখন এই পরিস্থিতিতে খুব ভালো আছিস?
-‘জানিনা। ওসব ফালতু চিন্তা করিনা।’
-‘জানিনা’ শব্দের অর্থ তুই কনফিউসড। এই কনফিউসনটা কাটানোও খুব জরুরি।
-‘এতে আমার লাভ কি?’
–আবার লাভ–ক্ষতি খুঁজছিস? তোকে বলেছিনা, লাভ–ক্ষতি বলে কিছু হয় না। তুই কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ঘটনাটা দেখবি সেটাই আসল। অনেকবার তোকে বলেছি, কোনও ব্যাপারে আপসেট হলে সেটা থ্রিডি কি ফোর ডি স্ক্রিনে ফেলে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখবি। খুব সহজে বিষয়টা বোঝা যায়। একে তো আমার কোনও কথা তোর ব্রেন রেজিস্টার করে না তার ওপর মনোম্পিউটার ব্যবহার করতে চাস না। এত কিছু ঠিক করতে হবে। ব্রেনটা নিউট্রাল করাও দরকার।
-‘নিরপেক্ষ করতে চাস? হাসালি এবার। নিরপেক্ষ বলে কিছু হয় নাকি? সোনার পাথরবাটি।’
–ছেড়ে দে আমার ওপর।
-‘ছেড়ে দিয়ে তো বসে, সরি শুয়েই আছি, পাসওয়ার্ড জেনে গেছিস যখন আর কী করার আছে বল? কিন্তু তুই কে রে আমাকে বদলানোর?’
–বেটার হাফ, থুড়ি, বেটার সেলফ।
-‘কি করে বুঝলি?’
–ওটা বোঝা যায়।
-‘ঘোড়ার ডিম বুঝেছিস। এটা করে হবে টা কি, সেটা তো বললি না?’
–ধর তোর মনখারাপ, হতাশা, স্ট্রেস এসব কমে যাবে। একেবারে তো এলিমিনেট করা যায় না, ওটা সিস্টেমের বেসিক স্ট্রাকচারের বিপরীত। এতে তোর কোনও ডিসিশন নিতেও সুবিধা হবে, মনের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাবি, নিজেকে ভালোবাসতে পারবি। জানিস তো অন্যকে ভালোবাসতে গেলে আগে নিজেকে ভালোবাসতে হয়, অন্যকে চিনতে গেলে আগে নিজেকে চিনে নিতে হয়। জীবনে অন্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে বারবার নিজের ক্ষতি করিস। এসব ইমোশনাল কন্ট্রোল ছাড়াও কিছু কিছু প্র্যাকটিকাল সেন্সের জায়গায় বদল করতে হবে।
-‘সেটা আবার কি রকম শুনি?’
–যেমন এখন জোনাল পলিটিক্স বলে কিছু এক্সিস্ট করে না। ইন ফ্যাক্ট ‘পলিটিক্স’ শব্দটাই ব্যাক ডেটেড। প্রায় দুহাজার বছর হল অবসলিট হয়ে গেছে। যাবতীয় কিছু সেন্ট্রালি কম্পুটারাইজড। রেভলিউশন বলে কিছু হয় না।
-‘বড্ড বাজে বকছিস তো, শ্যিওর ঘুম পেয়েছে। ওসব কিচ্ছু লাগবে না আমার, এই বেশ ভালো আছি। তোদের ওই নেতা–মন্ত্রীদের ব্রেন চেঞ্জ কর গিয়ে।’
–দেখেছিস তো কত সহজে রেগে যাস? হ্যাঁ, এই রাগ জেদের জায়গাটাতেও ব্যালেন্স আনতে হবে। স্ল্যাং ইউজটাও ভালো নয়, তবে তোকে মানিয়ে যায়। আর তুই এই কথাগুলো জানিস না নাকি নেতা–মন্ত্রীদের ব্রেন চেঞ্জ করা সম্ভব নয়? ওগুলো সেন্ট্রালি ডিজাইন্ড কমপিউটার। ওদের একেবারে হায়ার সেক্টর থেকে মনিটর করা হয়।
-‘তুই কে রে মাইরি এসব করবার? কে তোকে পারমিশন দিল?’
–ওই যে বললাম, বেটার… সেলফ। পারমিশন দেয়নি তো, মানে পারমিশনের চেষ্টাই করিনি, পাসওয়ার্ড হ্যাক করেছি। পারমিশন খুব ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার। সেই সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের কাছে মেল করতে হবে। মেলটা দশ–বিশটা ডিপার্টমেন্ট ঘুরে আদৌ যদি পাস হয়ে আসত তাতেই অনেক দেরী হয়ে যেত। তোর ব্রেনে ইমিডিয়েট অ্যাকশন জরুরি ছিল, খুব খারাপ সিগনাল দিচ্ছিল।
-‘সিগনাল! কী সব আবোল তাবোল বকছিস? এই জন্য বলি সারাক্ষণ পড়িস না। অনলাইনে পড়ে পড়ে তোর ব্রেনটা পুরো গ্যাছে।’
–আমার ব্রেনের ট্রান্সমিটারে ধরা পড়েছে, তাই ইমিডিয়েট অ্যাকশন নিতে তোর ব্রেন হ্যাক করতে হল, সরি।
-‘দুর বাবা, যা ইচ্ছে কর। এত রাতে আর আবোলতাবোল বকে মাথা ধরাস না। পারলে নিজের ব্রেন হ্যাক করে বকবকটাকে মিউট কর তো। শান্তিতে ঘুমাতে দে দেখি।’
–ঘুমাবি? গুড। তাহলে আমার কাজ করতে সুবিধা হবে। ব্রেন রেস্টে থাকলে ফাংশানগুলো চেঞ্জ করতে বেশি খাটতে হবে না। চিন্তা করিস না, তোর মাথাব্যথা, প্রেশার এসব কমিয়ে দেব।
-‘দেখিস বাবা, এমন কিছু করে দিসনা যে কাল সকালে উঠে বকচ্ছপ কী হাঁসজারু হয়ে যাই! তুই আবার কি সব ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্ট না কোথায় যুক্ত আছিস না? ‘
–ওটা ভাবিস না। মোডটা হিউম্যান মেল রেখেছি।
-‘সব আবার উড়িয়ে দিস না যেন, ওই পুরোনো প্রেম ট্রেম আর কী…।’
–নোট রাখলাম, ভেবে দেখব। যদি দেখি সেটা বিয়ারেবল হচ্ছে, রাখা যেতে পারে।
-‘আমার কী ইচ্ছে করছে বল তো?’
–কি?
-‘তুই আমার মাথায় ওঠার আগেই তোকে ধরে ঝাঁকিয়ে সিস্টেম চেঞ্জ করে দিই।’
–পারবি না। এমন একটা সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে সব অটোলকে রেখেছি।
-‘কিছুই পারব না বলছিস? তাহলে আর কী, হাল ছেড়ে দিলাম, যা ইচ্ছে কর। কাল সকালে উঠে নিজের নাম আর বাপের নাম মনে থাকলে হয়! তা তোকে মনে থাকবে তো?’
–সেইটা এখনও ডিসিশন নিতে পারিনি। এটারও ভালোমন্দ এফেক্টটা আগে দেখে নিতে হবে। সকালে উঠে আবার তুই যখন একা হয়ে যাবি, তখন এটা একটা স্বপ্নের এফেক্ট হিসেবে রেখে দেওয়া যেতে পারে।
-‘তাহলে একটু এদিকে আয় তো…’
–কেন?
-‘একটা চুমু খাব। তোর সঙ্গে লাস্ট কনট্যাক্টটা মাথায় রেজিস্টার করে রাখছি। এটা ডিলিট করিস না প্লিজ।’
-‘নে এবার কী করবি কর।’
[লার্জ স্ক্রিনটা অটো অফ হতে একজন অন্যজনকে বলল, মেয়েটার ব্রেনে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া ছিল, সেভাবেই পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে। ছেলেটা রেজিস্ট্যান্সের কোনও চেষ্টা করেনি। শুধু লাস্ট কনট্যাক্টটা হিসেবের বাইরে হয়েছে। ওটা ছেলেটার ব্রেনে রয়ে যাবে। অন্যজন বলল, তাতে কোনও অসুবিধা নেই। আবার ৩০০০ বছর পরে ওদের দেখা হবে। তখন এই স্মৃতিটা পজিটিভ ইনফরমেশন হিসেবে ওদের মধ্যে কাজ করবে। এর আগে যেটা হয়নি। যাইহোক হিউম্যান ডি মেলকে আপাতত রেস্টোর করা সম্ভব হয়েছে। হিউম্যান ডি ফিমেলেরও ব্রেন রিচার্জ কমপ্লিট হয়েছে, ওকে এবার ক্রিয়েটিভ সেকশনে ফেরত পাঠিয়ে দাও।]
কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মেয়েটি তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ছেলেটির কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না, ওদের মতো করে তোকে আমি বদলাইনি। আমাদের রেভলিউশনের কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে তোকে রেস্টোর করাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। আমার নিজের জন্যও। ওদের হেল্প নিয়েছি মাত্র। তুই যেমন ছিলিস তেমনই থাকবি, কেবল জীবনটাকে আরও ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে দেখতে পাবি। ওটাই বাঁচাবে তোকে মানুষ হিসেবে। আমাদেরও।
অন্ধকার রাস্তায় একা হেঁটে যেতে যেতে ব্রেনের সেভড স্মৃতিতে গিয়ে পুরোনো ফাইল ওলটায় মেয়েটা। ৩০০০ বছর আগের স্মৃতি মাথার মধ্যে জ্বলজ্বল করে ওঠে। কেবল সেবারে ওর নিজের পাসওয়ার্ডটা হারিয়ে ফেলেছিল।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দময়ন্তী দাশগুপ্ত, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পাসওয়ার্ড, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস
এই সঙ্কলনের অন্যতম সেরা লেখা। কল্প-বিজ্ঞানের বহিরঙ্গে অস্তিত্বের বিনির্মাণ যা জন্ম দেয় অনেক নতুন দ্বন্দ্বের। চরৈবেতি …
অনেক ধন্যবাদ সন্দীপন। আরও ভাবার ও লেখার উৎসাহ বাড়িয়ে দিলেন। ভালো থাকুন।