পিঁপড়ে
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: তৃষা আঢ্য
পিঁপড়ে
লেখক – অদ্রীশ বর্ধন
অলংকরণ – তৃষা আঢ্য
পিঁপড়ে, শুধু পিঁপড়ে। মস্ত হলঘরের যেদিকে তাকানো যায়, কেবলই পিঁপড়ে। রঙীন পিঁপড়ে—বিরঙ পিঁপড়ে, রাক্ষুসে পিঁপড়ে—লিলিপুট পিঁপড়ে, নিরামিষপ্রিয় পিঁপড়ে—আমিষলোভী পিঁপড়ে, বিষাক্ত পিঁপড়ে—নির্বিষ পিঁপড়ে। কাচের শোকেসে পিঁপড়ে, তারের খাঁচায় পিঁপড়ে, জলঘেরা দ্বীপে বন্দী পিঁপড়ে, মাটির তলায় সারি সারি সুড়ঙ্গভর্তি পিঁপড়ে।
মোট কথা, পিঁপড়েদের নিয়ে একটা জগৎ। অক্ষয় দত্ত এই জগতের সৃষ্টিকর্তা। পিঁপড়ে সংগ্রহ তার নিছক ৰাতিক নয়—গবেষণার অঙ্গ। পোকামাকড়ের বিশাল দুনিয়া থেকে কিছু একটা আবিষ্কার করতেই হবে। তাহলেই যন্ত্রযুগের আরও উন্নতি সম্ভব। একেই বলে বায়োনিকস অর্থাৎ বায়োলজি আর মেকানিকস-এর যোগফল।
আজব সংগ্রহশালার ঠিক মধ্যিখানে একটা মস্ত টেবিল। টেবিলে কনুই পেতে বসে পরমাসুন্দরী একটি বউ। অক্ষয় দত্তর যুবতী স্ত্রী–নিভা।
নিভা বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল আর ভাবছিল। এত পেয়েও সুখ নেই নিভার মনে। দিনরাত পিঁপড়ে ঘেঁটে ঘেঁটে তার স্বামী নিজেই যেন একটা পিঁপড়ে হয়ে গিয়েছে। বউয়ের দিকে নজর নেই।
আবার ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিভা। যে মেয়ে স্বামীর সোহাগ পায় না, তার প্রাণে সুখ থাকতে পারে না।
এমন সময়ে নিভার চোখ পড়ল সামনে। টেবিলের ওপর একটা বেলজিয়াম কাঁচের বেলজার। কাঁচের ঘেরাটোপে বন্দী একটা ভারী সুন্দর পিঁপড়ে। দেখেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল নিভা।
এরকম পিঁপড়ে এর আগে সে কখনো দেখেনি। লম্বায় ইঞ্চিখানেক। রামধনু রঙের মিক্সচার যেন স্প্রে করে ছড়ানো সারা গায়ে। তার মধ্যেই পাগুলো ছাই-ছাই সাদা, গিঁটে গিঁটে কালো রেখা। মাথাটা লালচে বাদামী। ধড়টা সাদা আভাযুক্ত ম্যাজেন্টা ধরনের। বড় বড় পুঞ্জাক্ষির রঙ গাঢ় বেগনী।
পিঁপড়ে যে এত সুন্দর হয়, এমন রঙীন হয় তা তো জানা ছিল না নিভার। দেখল খানিকটা কাঁচা মাংস নিয়ে কুটকুট করে খাচ্ছে পিঁপড়েটা আর জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছে নিভাকে।
হুমড়ি খেয়ে পড়ল নিভা। বেলজারের কাচে ভেসে উঠল ওর সুন্দর মুখের প্রতিবিম্ব। দুষ্মন্ত যে রূপ দেখে মরেছিলেন, এ সেই রূপ। কিন্তু হায়রে কপাল, এহেন রূপও ধ্যানভঙ্গ করতে পারেনি সাধনামগ্ন অক্ষয় দত্তর।
আবার ফোঁস করে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল নিভা।
পেটুক পিঁপড়েটা তখনো মাংস খেতে খেতে দেখছিল নিভাকে। মনে পড়ল, অক্ষয় দত্তর কাছে শোনা সর্বভুক পিঁপড়েদের লোমহর্ষক গল্প। আফ্রিকায় বা আমাজনের গহন অরণ্যে এরা পঙ্গপালের মত দল বেঁধে বেরোয়। ক্ষিদের চোটে রাস্তায় যা পায়, তা-ই চেটেপুটে সাবাড় করে দেয়। গাছপালার শুধু কাঠ পড়ে থাকে, জন্তুজানোয়ার মানুষদের থাকে চকচকে সাদা কংকাল। হাড় থেকেও নাকি খুঁটে খুঁটে মাংস খেয়ে নেয় পেটুক পিঁপড়েরা।
ঠিক এই সময়ে নিভার মনে হল পিঁপড়েটার ঠোঁট নড়ছে। মাংস খাওয়া আপাতত বন্ধ। বড় বড় বেগনি রঙের পুঞ্জাক্ষি মেলে সটান তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
প্রথমটা ভ্রূক্ষেপ করেনি নিভা। মশগুল হয়েছিল নিজের দুঃখের চিন্তায়। তারপর দেখল, রঙীন পিঁপড়েটা সামনে এগিয়ে আসছে। সামনের দুটো পা বেলজারের কাঁচে রেখে ঠোঁট নাড়ছে।
নিভার কেন জানি মনে হল, পিঁপড়েটা কথা বলছে। তারপরেই ভাবল পিঁপড়ে আবার কথা বলবে কি? দূর! দূর!
ড্যাবডেৰে বেগনি চোখদুটো কিন্তু নিমেষহীন ভাবে তখনো তাকিয়ে ওর দিকে। চাউনির মধ্যে কিরকম যেন একটা অপার্থিৰ ভাৰ। গা শিরশির করে উঠল নিভার।
পিনপিনে আওয়াজটা কানে এল ঠিক তখুনি। খুব সরু একটা শব্দ– মশার ডানা নাড়ার পিনপিনে আওয়াজের মত।
উৎকর্ণ হল নিভা। সত্যিই তো! খুব মিহি পিন-পিন-পিন-পিন আওয়াজ ভেসে আসছে বেলজারের মধ্যে থেকে।
হঠাৎ কি খেয়াল হল, বেলজারের কাঁচে কান পাতল নিভা। খেয়ালটা উদ্ভট, কিন্তু পরিণামটা যে
অমন মারাত্মক হবে কে জানত। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠল নিভা।
পিনপিনে আওয়াজটা মশার ডানা নাড়ার শব্দ না–মানুষের কণ্ঠস্বর। পোকামাকড়ের গলায় মানুষ কথা কইছে যেন!
তাজ্জব হয়ে গেল নিভা। স্পষ্ট শুনল অপার্থিব স্বরে বলছে পিঁপড়েটা —“আচ্ছা আহাম্মক মেয়ে
তো! বকে বকে মুখে ফেণা উঠে গেল যে! কাঁচটা সরিয়ে নিতে বলছি না?”
নিভা হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পেল না। পিঁপড়েও নাকি হুকুম করছে তাকে? স্বপ্ন-টপ্ন দেখছে না তো?
পিঁপড়েটা কিন্তু এবার লালচে বাদামী মাথা ঠুকছে বেলজারের গায়ে। দেখে মায়া হল নিভার।
বলল—“বেলজার তুললে কামড়ে দেবে না তো?
রেগেমেগে পিঁপড়েটা জবাব দিল—“মেয়েদের মাংস মেয়েরা খায়?”
নিতা অবাক হয়ে বলল— “তুমি মেয়ে নাকি?”
পিঁপড়ে রেগে বলল—“কেন, প্রমাণ চাই নাকি?”
এরপর দু’তরফে যা কথাবার্তা হল, তা থেকে জানা গেল : এ পিঁপড়ে সাধারণ পিঁপড়ে নয়। আগের জন্মে ছিল তপস্বিনী। পদস্খলন হওয়ায় এ জন্মে পিঁপড়ে হয়ে জন্মেছে। পূর্বজন্মে অর্জিত বহু অলৌকিক ক্ষমতাও প্রকট হয়েছে এ জন্মে। যেমন, পিঁপড়ে হয়েও সে মানুষের মত কথা বলতে পারে। সিদ্ধ যোগিনীর মত অন্য মানুষ-পশু-পাখীর মনের কথা বুঝতে পারে। এমনকি নিজের দেহ ছেড়ে অন্যের দেহতেও প্রবেশ করতে পারে—যেমন করেছিলেন শঙ্করাচার্য কামশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য।
শুনতে শুনতে আকেল গুড়ুম হয়ে গেল নিভার। মনে মনে ভাবল, মিথ্যে বুকনি ছাড়ছে পিঁপড়েনি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর মনের কথা বুঝে নিয়ে পিঁপড়েনি যা বলল, তা আরও আশ্চর্য। বলল, নিভা কেন এত অসুখী, তা সে জানে। আত্মভোলা স্বামীদের কব্জায় আনতে হলে যে কটি গুণ থাকা দরকার মেয়েদের, তা নিভার নেই বলেই অক্ষয় দত্ত সুন্দরী বউয়ের দিকে ফিরে তাকানোর সময় পায় না। এসব ক্ষেত্রে বউদের দজ্জাল হতে হয়। শুধু রূপ দিয়ে কি পুরুষদের ভোলানো যায়? অক্ষয় দত্তকে এক রাত্রেই শায়েস্তা করে দিতে পারে পিঁপড়েনি।
নিভা তো শুনেই লাফিয়ে উঠল। বিষম আগ্রহে জানতে চাইল কি সেই পন্থা যা দিয়ে ধ্যানভঙ্গ করা যাবে ব্যোমভোলা পতিদেবতার। মন্ত্রতন্ত্র কিছু কি? নাকি বশীকরণ কবচ?
মুচকি হেসে পিঁপড়েনি বলল—“না, না, সেসব কিছু নয়। আমি তোমার মধ্যে যাবো, আর তুমি আমার মধ্যে আসবে। আমি ইচ্ছা করলেই সেটা হবে। তারপর এমন ভেল্কী দেখাবো যে কাল সকাল থেকে দেখবে বউমুখো হয়ে গেছে তোমার সাধক স্বামী। সেই সঙ্গে আমারও একটা ইচ্ছে মিটিয়ে নেওয়া যাবে।…”
নিভা জানতে চেয়েছিল, ইচ্ছেটা কি? তাই শুনে লজ্জা-লজ্জা সুরে পিঁপড়েনি বলেছিল, মেয়েমানুষ হয়ে কি মুখ ফুটে তাকে সেকথা বলতে হবে?
নিভা তখন ভেবে দেখল। মতলবটা মন্দ নয়। গতজন্মে আত্মসংযমের অভাৰে একবার পদস্খলন হয়েছে পিঁপড়েনির। এ জন্মেও হয় হোক–নিভার তাতে লোকসান নেই—বরং ষোলআনাই লাভ।
রাজী হয়ে গেল নিভা। বলল—“এসো তুমি আমার মধ্যে। কিন্তু কাল ভোরবেলাই ফিরিয়ে দিতে হবে আমার শরীর। একরাত্রের বেশীর ধার দিতে পারব না বাপু। হাজার হলেও স্বামী তো।”
পিঁপড়েনি আর কিছু বলল না। ড্যাবডেৰে চোখে চেয়ে রইল নিভার দিকে। নিভার মনে হল ছোট ছোট তড়িৎরেখা যেন পুঞ্জ পুঞ্জ অক্ষি থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে প্রবেশ করছে ওর চোখে। ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট হয়ে আসছে সবকিছু…অন্ধকার…নিরন্ধ্র তমিস্রা…কিছুক্ষণ পর ফিকে হয়ে এল গাঢ় অমানিশা…চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে এল একটা নারীমুখ। মেঘকালো চোখে তার দিকে চেয়ে হাসছে তারই মুখ।
নিজের দেহের দিকে তাকালো নিভা। শিউরে উঠল তার পিঁপড়ে-দেহ দেখে! …
এরপরের ঘটনা খুব বড় নয়।
নিভার শোবার ঘর পিঁপড়ে-ঘরের লাগোয়া। সমস্ত রাত ধরে সে-ঘরে আলো জ্বলতে দেখল পিঁপড়েরূপী নিভা! বুঝল নিভারূপী পিঁপড়ে ঘুমোতে দিচ্ছে না বেচারা অক্ষয় দত্তকে। আহারে! সারাটা দিন খাটাখাটুনির পর মড়ার মত ঘুমোয় মানুষটা। ঘুমোতে না পারলে পরের দিন কোনো কাজ করতে পারে না।
মনে মনে বড় অনুতাপ হল নিভার। এতটা চক্রান্ত না করলেও চলত। কিন্তু ওঘরে যাওয়ার পথও বন্ধ। শুতে যাবার সময় নিভারূপী পিঁপড়ে বেলজার চাপা দিয়ে গেছে তাকে। কাঁচের মধ্যে দিয়ে বন্দিনী নিভা ভোররাত পর্যন্ত আলো জ্বলতে দেখল শোবার ঘরে। ভোর রাতের দিকে নিভল আলো। পিঁপড়ে-ঘরে ঢুকল নিভারূপী পিঁপড়ে। সারামুখে পরম পরিতৃপ্তি।
মস্ত ঢেকুর তুলে বেলজারের সামনে এসে দাঁড়াল সে। নিভার উৎকণ্ঠিত চোখের দিকে তাকিয়ে বললে লজ্জা-লজ্জা সুরে—“একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। অনেকদিনের ক্ষিদে তো—“
বলতে বলতে সেইরকমভাবে ওর দিকে চাইল নিভারূপী পিঁপড়ে। ডাগর চোখ থেকে যেন ঠিকরে এল বিদ্যুৎরশ্মি। আবার চোখে অন্ধকার দেখল নিভা; একটু পরে দেখল, সে দাঁড়িয়ে বেলজারের বাইরে। যে-যার শরীর ফিরে পেয়েছে।
ছুটটে শোবার ঘরে গেল নিভা। গিয়ে দেখল স্বামী নেই। খাটের যেদিকে স্বামী শোয়, সেখানে শুয়ে আছে একটা চকচকে কংকাল। কণামাত্র মাংস নেই হাড়গুলোয়। মাংসভুক পিঁপড়েরা যেভাবে হাড়গোড় থেকে খুঁটে খুঁটে মাংস খেয়ে রেখে যায় শুধু কংকালখানা—স্বামীর অবস্থাও হয়েছে তাই। ক্ষিদের জ্বালায় উপোসী পিঁপড়েটা আর কিছু রাখেনি।…
হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আছড়ে পড়ল নিভা। সংগে সংগে কংকালটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জাপটে ধরল ওকে। বলল—“নিভা! নিভা!”
চোখ মেলে নিভা দেখল, অক্ষয় দত্ত ওকে জড়িয়ে ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। দুইচোখে নিঃসীম উদ্বেগ। বলছে—“কি হয়েছে নিভা? ফোঁপাচ্ছ কেন?”
স্বামীর বুকে মুখ গুজে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল নিভা। বলল অবরুদ্ধকণ্ঠে—“স্বপ্ন দেখছিলুম যে!”
কঃ সঃ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ফ্যানট্যাসটিক পত্রিকার ১৯৮৩ সালের এপ্রিল সংখ্যায়। কল্পবিশ্বে গল্পটি পুনঃপ্রকাশ করা হল। লেখাটি টাইপ করে আমাদের সাহায্য করেছেন দীপ ঘোষ।
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, গল্প, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, তৃষা আঢ্য, পিঁপড়ে, পূজাবার্ষিকী, ফ্যান্টাসি গল্প