পুনর্জন্ম – র্যামসে ক্যাম্পবেল
লেখক: বাংলা অনুবাদঃ দীপ ঘোষ
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
অন্ধকার! উঃ! আবার সেই শ্বাসরোধী অন্ধকার আমায় ঘিরে ধরছে! তবুও আমি নিশ্চিত কেউ আমার দিকে নজর রাখছিল! আচ্ছা, আমি কি অন্ধ হয়ে গেছি? তবে যে মনে হচ্ছিল কেউ আমার উপর ঝুঁকে পড়ে দেখছে? তা কি তবে স্বপ্ন? যেন অনেকগুলো স্বচ্ছ পর্দার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা এক মানবমূর্তি, যার মুখটা তৈরি শুধু জমাট অন্ধকার দিয়ে।
ঘন পলির মত অন্ধকার আমার চোখের উপরে জমে আছে, যেন কত জন্মের ঘুম আমায় বলছে, আর একটু বিশ্রাম নাও, এখনি কি দরকার জেগে ওঠার। না না! আমাকে মনকে সংহত করতে হবে, আমার যে কিছুই মনে পড়ছে না! খুব ভয় করছে!
শান্ত হও, এখন ভয় পাবার সময় নয়, যুক্তি দিয়ে ভাবার চেষ্টা কর, দৃষ্টি তোমার সঙ্গে বিদ্রোহ করলে বাকি ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নাও, তারা নিশ্চয় তোমায় সাহায্য করবে।
নাহ! কিছু ভাবতে পারছি না। আমার চিন্তা যেন এই অন্ধকারের অতল ঘূর্ণির মধ্যে পলকে ডুবে যাচ্ছে। সমস্ত অস্তিত্ব যেন হারিয়ে যাচ্ছে বুভুক্ষু শূন্যতার কাছে। কিছু বোঝার আগেই একটা জান্তব কান্না মেশানো ঘড়ঘড়ানি বেড়িয়ে এলো আমার মুখ থেকে।
ওহ, তাহলে আমার একটা শরীর অন্তত আছে। কিন্তু, এখনো নিজের শরীর আমি অনুভব করতে পারছি না। আমার কান্নার চাপা প্রতিধ্বনি থেকে বুঝতে পারছি, দেওয়াল কাছেই আছে। তবে এরকম গলার স্বর তো আমার ছিল না!
ছাড়ো, গলার স্বর নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এটা নয়। ভাবো, তোমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গে সাড় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর। হ্যা, এখন আমি নিজের শরীরটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু অসম্ভব দুর্বল লাগছে। হাত পা নাড়ানোর কোন ক্ষমতাই আমার নেই। আমি নিশ্চয় খুবই অসুস্থ।
এই যন্ত্রণার কি শেষ নেই? আর যন্ত্রণার কথা মনে পড়তেই বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়ে গেল – ভেসে চলেছি নদীতে, উথাল পাথাল স্রোতে প্রাণপণ চেষ্টা করছি সাঁতার কাটতে। জোয়ারের গর্জন আর জলের চাপে কানে তালা ধরে যাচ্ছে, আর শেষে নদীর গভীরে একটু বাতাসের জন্যে আমার ফুসফুস যেন ফেটে পড়তে চাইছে। অসহনীয় যন্ত্রণা, আর তারপর সব অন্ধকার। তবে কি নদীতে ভেসে আমি এখানে এসে পৌঁছলাম?
এতটা দৈব ঘটনা আমার জীবনে মেনে নিতে পারছি না। কে নিশ্চয়ই আমায় উদ্ধার করে এখানে এনেছে। কিন্তু আমার সেই উদ্ধারকর্তা কোথায়? আমার কান্না শুনেও সে এগিয়ে আসছে না কেন?
আবার ভয় আমায় গ্রাস করতে আসছে। এই সময় বুদ্ধি হারালে চলবে না। আমাকে যুক্তি দিয়ে ভাবতে হবে। হাজার হোক আমি একজন দার্শনিক। যাক, স্মৃতি তাহলে আস্তে আস্তে ফিরে আসছে। যতক্ষণ শরীরে বল না ফিরে আসে, এইভাবেই আমার অবস্থার কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দর্শনে পাওয়া যায় কিনা দেখি। তাতে কিছুটা সময়ও হয়তো কাটবে। নাহ, এই সময়ে যে ব্যাখ্যাটা মনের কোণে বাসা বাঁধছে তাকে বেশি প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। আমার সমস্ত অস্তিত্ব এখন বিপন্ন, আশা হারালে চলবে না। তাও অনুভব করলাম কপালে বিন্দু বিন্দু ঠান্ডা ঘাম জমছে।
আমার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার আগে কোন অশুভ চিন্তার বশবর্তী হলে চলবে না। শরীরের সাড় ফিরে আসছে সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু এখনো সময় লাগবে অনেকক্ষণ। যেন মনে হচ্ছে এক নতুন শরীরে আমার পুনর্জন্ম হচ্ছে। নাহ, এসব অসম্ভব কথা ভাবলে এখন চলবে না!
এর থেকে হাতটা নাড়ানোর চেষ্টা করি, মনকে একাগ্র করি এই কাজে। উফ, মনে হচ্ছে হাতের জায়গায় একটা ভারী ঠান্ডা বরফের টুকরো পড়ে আছে। শরীরের সঙ্গে তার যেন কোন যোগাযোগই নেই। এমনকি বুঝতেও পারছি না, এ কোন অসুস্থতার ফলাফল কিনা। ঠিক যেমন আমার দৃষ্টিশক্তির ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই। যেন মনে হচ্ছে মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া স্নায়ুবিন্দুগুলো এই অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু জলে ডুবলে কেউ অন্ধ হয়ে যায় কি করে? আর আমি তো মনে করতে পারছি এই অন্ধকারে কাউকে দেখেছিলাম! যদিও তার মুখটা কিছুতেই মনে আসছে না। নানা, আমি অন্ধ হয়ে যেতে পারিনা। এই অচেনা জায়গায় দৃষ্টিহীন আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকার অসহায়তা আমায় উন্মাদ করে তুলছে। ফুলে ভারী হয়ে যাওয়া ঠোটগুলো কাঁপিয়ে আমি আবার গুঙিয়ে উঠলাম। নাহ! ভুল করছি, কাউকে জানতে দেওয়া চলবে না যে আমি অসহায়। আমি জানিনা এখন কোথায় আছি, কারা আমার উপর নজর রেখেছে, তারা বন্ধু না শত্রু!
কোনক্রমে ঠোঁটদুটো নিজের ইচ্ছের বশবর্তী করে কান্নাটা চেপে নিলাম। অন্ধকারের মধ্যে এখন শুধু শব্দ আমার নিজের হৃদয়ের কষ্টকর প্রশ্বাসের। সেই ধ্বনি যেন নিজের প্রতিধ্বনির ভয়ে নিজেই কেঁপে উঠছে, আরো বেতাল হয়ে পড়ছে। উফ কোনরকমে যদি এই অসহ্য শব্দটাকে চিরকালের জন্যে বন্ধ করা যেত। আর তখনি শুনতে পেলাম আরেকটা ক্ষীণ খসখসানি। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে কেউ যেন এদিকেই আসছে।
অবশ চোখের পাতাদুটো যতটা পারি চেপে বন্ধ করে রাখলাম, শরীরটা শক্ত হয়ে উঠছে উত্তেজনায়। ছোটবেলার রাতগুলোয় ঘুম ভেঙ্গে গেলে এইভাবেই ঠান্ডা বিছানায় শুয়ে থাকতাম। মনে হত অন্ধকার নরকের প্রহরীরা আমায় ঘিরে ধরেছে, এখুনি নিয়ে যাবে চিরঘুমের দেশে। আরও স্মৃতি ফিরে আসছে তবে। কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই, পায়ের শব্দ আরো এগিয়ে আসছে।
কোথাও একটা তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ আমার নিস্তরঙ্গ অস্তিত্বটাকে যেন চুরমার করে দিল।
তার সঙ্গে সঙ্গে হলদেটে একটা আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার চোখের পাতায়। আমি চোখ দুটো আরো শক্ত করে বন্ধ করে রাখলাম। কিন্তু আলোটা এগিয়ে এসে যেন আমার সব অন্ধকারকে খুঁটে খুঁটে খেতে চাইছিল। নাহ, ওকে বুঝতে দিলে হবে না যে আমি এখনো জীবিত। দম বন্ধ করে পড়ে থাকলাম আমি, বুঝতে পারছিলাম আমার শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ে সে আমায় পরীক্ষা করছে। একসময় পায়ের শব্দ আর আলোটা কাঁপতে কাঁপতে দূরে চলে গেল। ওটা মশালের আলো, আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। আবার দূরে সেই ধাতব ঘসটানির শব্দের সঙ্গে অন্ধকার আমায় ঘিরে ধরল।
কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে আমি আবার ভাবা শুরু করলাম। এটা পরিষ্কার যে আমি একটা জেলখানার কুঠুরিতে আছি। পাথরের দেওয়াল আর চাবি দেওয়া ধাতব দরজার শব্দ সেই দিকেই ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু একটা জীবন বাঁচানোর জন্যে এমন শাস্তি কি করে হয়? হ্যা আমার মনে পড়েছে, মেয়েটি নদীতে ভেসে যাচ্ছিল, আমিই ওকে বাঁচানোর জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তবে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অধ্যাপকেরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করল? শহরের চার্চের ওই বিশপ? আমার অখৃষ্টানীয় দর্শনের জন্যে এরা অনেকেই আমার উপর খড়্গহস্ত, তা বলে কারারুদ্ধ? নাহ, এ অসম্ভব, আমার বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে আমার বিশ্বাস আর দর্শনের কোন সম্পর্ক নেই।
চিন্তার গতিকে রুদ্ধ করা অসম্ভব। ঢেউ এর মত একের পর এক স্মৃতির দরজা খোলা শুরু হয়েছে। অনেক কিছুই মনে পড়ছে, ছেঁড়া মাকড়সার জালের মতো। কিন্তু নিজের নাম? সেটা কিছুতেই মনে পড়ছে না! আবার সেই অজানা ভয়টা গ্রাস করছে আমাকে। নাহ, অন্যদিকে মন দিতে হবে। আবার চেষ্টা করি হাতটা নাড়ানোর।
এই নিস্তরঙ্গ অন্ধকারে সময় মূল্যহীন। তাই কতক্ষণ যে নিজের সঙ্গে নিজেই যুক্তিজাল বুনছিলাম তা জানিনা। যে করেই হোক আমাকে এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতেই হবে। আর তার জন্যে সবার আগে নিজের দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনা দরকার। তারপর যে করেই হোক ওই পাহারাদারকে কাবু করে এখান থেকে পালাতে হবে।
সমস্ত মনকে একাগ্র করে নিজের অঙ্গগুলি আবার খুঁজতে শুরু করলাম। নাহ, মনে হচ্ছে আমার শরীরটা যেন মন থেকে একেবারে আলাদা, শক্ত আর ভারী হয়ে আছে। ঠিক যেন অনেকদিন জলে ডুবে থাকা ফুলে ওঠা লাশ। না না, আবার কেন এসব ভাবছি, এসব অশুভ কথা ভেব না, মনকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখো! যতই চেষ্টা করি না কেন, চিন্তাটা মনের কোণে হিংস্র শ্বাপদের মত গুঁড়ি মেরে সুযোগ খুঁজছে ঝাঁপিয়ে পড়ার।
আরো কতক্ষণ পরে যে হতাশ হয়ে চেষ্টা থামালাম, জানি না, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাটা আবার লাফিয়ে বেড়িয়ে এলো – এই সমস্ত ঘটনাই খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়, আমি আসলে মারা গেছি। এই ভয়ংকর চিন্তাটা আমার শেষ ইচ্ছাশক্তিটুকুও শুষে নিল। চারদিকের অন্ধকার যেন পাথরের দেওয়ালের মত আমায় পিষে ফেলতে চাইছিল। এই অন্ধকার মহাবিশ্বে আমি একমাত্র চিন্তাশীল আত্মা।
নদীর কথাটা এখন খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে। বিকেলে দানিয়ুবের তীরে হাঁটছিলাম। তীব্র চীৎকার শুনে দেখলাম একটি মেয়ে জলে পড়ে গেছে। আমি ও আরেক তরুণ জলে লাফিয়েছিলাম মেয়েটিকে বাঁচাতে। তরুণটি মেয়েটির কাছে পৌঁছেও গেছিল কিন্তু আমি পড়ে গেলাম এক চোরা স্রোতের কবলে। সেই স্রোত আমায় টেনে নিয়ে গেল নদীর অতলে, যেখানে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
আমি হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামীকালের পঠনশৈলীর কথা ভাবছিলাম – প্লেটো, পিথাগোরাস আর ক্যান্ট। আমার প্রিয় ছাত্রদের কেউ কি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনল তবে? নানা, তাও হতে পারেনা। এমন চিন্তা মনে স্থান দিতে নেই। শুধু যদি জানা যেত আমি কোথায়। যুক্তি দিয়ে ভাবো, যদি তোমার অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে আজ না হোক কাল, তুমি জানতেই পারবে এর উত্তর। অহেতুক উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। কিন্তু এই অসহায় দশা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। যদি একটা আঙুলও নাড়াতে পারতাম। আবার চোখ বন্ধ করে হাতের আঙুলগুলো অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলাম। সেই আগের মতই তারা শুধু তাদের ঠান্ডা অস্তিত্ব জানান দিল। পিঠের নিচের পাথরের চাতালের সঙ্গে তাদের যেন কোন তফাৎই নেই।
আবার ডানহাতের দিকে নজর দিলাম। ভেঙে পড়লে চলবে না। আলাদা করে প্রত্যেকটা আঙ্গুলকে অনুভব করো আগে। নাহ, মনে হচ্ছে অন্ধকার যেন আঙুলগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে একটা দস্তানার মতো করে আটকে রেখেছে। কসাইয়ের টেবিলে পড়ে থাকা ঠান্ডা মাংসের টুকরোর মত পড়ে ছিল হাতটা।
আবার অন্ধকারের মধ্যে একা আমি, না ভুল হল, এবার সময়ও আমায় ছেড়ে গেছে। সেই ছোটবেলার এরকম অন্ধকারে শুয়ে প্রার্থনা করতাম, যেন আমার মৃত্যুর সময়েও আমার বিশ্বাস অটুট থাকে। অবিশ্বাসীর কখনো মুক্তি হয় না, এই কথা সত্যি হলে আমার মৃত্যুর পরে অসীম যন্ত্রণা অপেক্ষা করে আছে।
না, হাল ছাড়লে চলবে না। এইভাবে অচেনা কারাগারে নিজের মৃতদেহের সঙ্গে এইভাবে পড়ে থাকব না। বাম হাতের দিকে মনঃসংযোগ করলাম।
মিশরীয় মমির হাত ও বোধহয় এমনই হয়। মৃত চামড়া আর মাংসের আস্তরণের নিচে থাকে স্নায়ু আর পেশীর জাল, কিন্তু তারাও সংবেদনহীন। মনের সমস্ত চিন্তা একাগ্র করে আবার অনুভব করতে চাইলাম হাতটাকে। দাঁতে ঘষা লেগে অদ্ভুত একটা শব্দ বের হচ্ছে আমার মুখ থেকে। হাঁপিয়ে উঠেছি, কিন্তু পারতেই হবে, আর একটু, তারপরেই আসবে সাফল্য, মুক্তি। একটা মাত্র আঙুল যদি নড়ানো যেত। কিন্তু আমার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি যেন অন্ধকার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল। বেলুনের মত ফোলা হাতে আমার সমস্ত চেষ্টা অবয়বহীন গ্যাসের মত ভেসে বেড়াতে লাগল। আবার সেই চিন্তাটা ফিরে আসছে! পিথাগোরাস, প্লাটো, ভন হার্ডার, গ্যোটে – সবাই বিশ্বাস করেছিলেন! আর আমি অস্তিত্বের শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বাস হারাচ্ছি। নিজের উপর রাগে আর নৈরাশ্যে হাতটা মুঠো করে ধরলাম!
প্রথমে মনে হয়েছিল পুরোটাই মনের ভুল, তারপর বুঝলাম এখনো আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে, কোন অদৃশ্য দস্তানার আবরণ থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছে নিজেদের। প্রাথমিক বিস্ময় ও উল্লাসের ধাক্কা কাটিয়ে আস্তে আস্তে হাতটা তোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। পাশের ঠান্ডা দেওয়ালে ঘষটে হাতটা অন্ধকারে কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল। আর একটু, তার পড়েই আমি এই বন্দিদশা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারব। আর কয়েক ইঞ্চি উপরে তোলার পড়েই হাতটা এক টুকরো পাথরের মত আছড়ে পড়ল মাটিতে।
ঠিক আছে, তুমি এখনো ক্লান্ত, সময় লাগবে, চেষ্টা করে যাও, আমি বুঝিয়ে চললাম নিজেকে। আরো বেশ কয়েকবার প্রাণান্তকর চেষ্টার পরে বুঝলাম হাত ছাড়া শরীরের অন্য কোন প্রত্যঙ্গের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আর হাতটাও ওই কয়েক ইঞ্চির বেশি তোলা বা নাড়ানো অথবা বাঁকানো সম্ভব হচ্ছে না। আমার মনের হচ্ছিল মধ্যে হাতটা যেন একটা অচেনা মাংসপিণ্ড, যার উপর আমার কোন প্রভাবই নেই।
আমার জন্যে এই কারাগার আর শাস্তি খুব যত্ন করেই বেছে নেওয়া হয়েছে। আশা আর নিরাশার মাঝে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। আমার ছোটবেলার বিশ্বাসই ঠিক ছিল। আমায় বলা হয়েছিল সেই বিশ্বাসকে প্রশ্ন করা চরম অপরাধ। পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে বিধর্মীরা, আর সেই বিশ্বাস আমার মধ্যে ছিল, নদীর নিচে জ্ঞান হারানোর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। আজ আমি তার ফল ভুগছি। সেই মহাশক্তি আমার আত্মাকে প্রবেশ করিয়েছেন কোন অচেনা শরীরে, আর এখানেই আমায় সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণা সইতে হবে।
হ্যা আমায় অনন্তকাল এই নরকে অপেক্ষা করতে হবে, আর তার পরে আরও অনন্ত ধরে আমার এই মৃতদেহের উপর চালানো হবে অকথ্য অত্যাচার। নরকরের সেই অবর্ননীয় যন্ত্রণার কথা ভেবে আমার মন আতংকে ভরে উঠল। মাথার দুপাশের রক্তনালীগুলি প্রচণ্ড চাপে দপদপ করতে লাগল, কানের মধ্যে রক্ত চলাচল এত দ্রুত হচ্ছিল, যেন আমি কোন সমুদ্রের পাশে বসে আছি, তবু আমি শরীরটা নাড়াতে পারলাম না।
জানি না আরো কত সময় চলে গেছে, হঠাৎ বাইরে আবার সেই হোঁচট খেতে খেতে আসা পায়ের শব্দ পেলাম। আর তার সঙ্গে এবার যোগ দিয়েছে সুঠাম পদচারণার অধিকারী কেউ। আমি তখন আবার চোখ বুজে, ঠোট চেপে কাঠের মত শুয়ে আছি। নিঃশ্বাস চেপে আছি, আমার এই হতভাগ্য শরীরটাকে অত্যাচারে ভরিয়ে তোলার আনন্দ আমি ওদের পেতে দেবনা কিছুতেই। দরজার ওপার থেকে কথাবার্তার মত কিছু শব্দ ভেসে এলো, মানুষের গলার মতোই লাগছে। নিশ্চয় ওরা আমাকে নিয়েই আলোচনা করছে। আমাকে শান্ত থাকতেই হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার উপরে একটা অংশ ঝনাৎ করে সরে গেল, উঁকি দিল দুরুদুরু মশালের আলো। আমি চেষ্টা করতে লাগলাম চোখের পাতা না কুঁচকে একই ভাবে শুয়ে থাকতে। কিছুক্ষণ পরে মশালটি দরজার ওপারে আবার সরে গেল। আর তখনই আমার মনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমার বুক চিড়ে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস। ওরা নিশ্চয় শুনতে পায়নি! আতংকে দিশেহারা হয়ে আমার নিজের উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ সরে গেল। চোখ খুলে গেল, মুখটা ভয়ে বেঁকে গিয়ে একপাশ থেকে লালা ঝড়তে শুরু করল। কর্কশ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল, সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দুটি ছায়ামূর্তি।
নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না, ওরা নিশ্চয় চিরকাল এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে না, এখনো সময় আছে ওদের বোকা বানানোর। কিন্তু আমার মুখটা তখন একটা অচেনা মুখোশের মতো বিচিত্র ভঙ্গীতে হাঁ করে আছে। একজন আগন্তুকের থেকে বিজয়সূচক উচ্ছ্বাসধ্বনি ছিটকে এলো।
আর আশা নেই, এই অচেনা শরীরটাই আমার কাল হোল। মরিয়া হয়ে চোখটা খুলেই ফেললাম, আর হারানোর কিছু নেই। মশালের আলোয় দেখা যাচ্ছে একটা বামনাকৃতি বিকট চেহারা আমার উপর ঝুঁকে দাড়িয়ে আছে, লোকটার দুটো মাথার একটায় সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ জড়ানো। তার পাশে একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আছে রোগা কমবয়সী চশমা পড়া আরেকটি লোক। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, একদৃষ্টে সে খুঁটিয়ে দেখছে আমার শরীর। শেষ পর্যন্ত সে সোজা দাঁড়ালো, হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার মুখে বেদনার ছাপ সুস্পষ্ট।
এরা কি নরকের দূত? তাহলে তো এদের অভিব্যক্তির সঙ্গে তা মিলছে না? আলোয় চোখটা সয়ে এলে বুঝলাম প্রথম লোকটার দ্বিতীয় মাথা যেটা ভাবছিলাম সেটা একটা বড় কুঁজ। লোকটার সাড়া গায়ে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা।
তার মানে এরা আমাকে উদ্ধার করেছে! আমি সত্যি বেঁচে আছি! কোন অসুস্থতার কারণে শুধু হাত-পা নাড়াতে পারছি না। আমি হাতটা যতটা সম্ভব তুলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমি বেঁচে আছি। তরুণটি একবার সেদিকে তাকালো, কিন্তু তারপরে আবার আমার বাকি অঙ্গগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। পাশের বামনটি জড়িয়ে জড়িয়ে তরুণটিকে কিছু বলল।
“ভুল! সব ভুল! আবার অসফল হলাম!” তরুণটি নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল। “আমি আস্ত বোকা একটা, এমন উজ্জ্বল ধীসম্পন্ন মস্তিষ্ক! ভেবেছিলাম আবার তাঁকে বাঁচিয়ে তুলতে পারব! আর তার জায়গায় তৈরি হোল এই জড়বোধসম্পন্ন প্রাণীটি!”
বামনটি জিজ্ঞাসা করল আমায় নিয়ে কি করা উচিৎ। তরুণ হেলা ভরে উত্তর দিল যে সে আমায় নিয়ে কোনভাবেই উত্সাহিত নয়। এরপর আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে সে ঘরটি ছেড়ে চলে গেল। ওরা চলে যাবার অনেকক্ষণ পরেও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম আমার জিভটাকে নাড়াতে। কেউ ফিরে আসলে আমার বুদ্ধিমত্তা আর চিন্তাশক্তির প্রমাণ দিতেই হবে। আমি শুনতে পেয়েছি বামনটি তার মালিককে কি নামে ডাকছিল। আমার অসাড় জিভটা প্রাণপণে তিনটি অক্ষর উচ্চারণ করতে চাইছিল – “ফ্রানক -এন-স্টিন”।
কল্পবিশ্ব সম্পাদকঃ গল্পটি র্যামসে ক্যাম্পবেলের এ নিউ লাইফ অবলম্বনে লিখিত।
Tags: অনুবাদ গল্প, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, দীপ ঘোষ, পুনর্জন্ম, র্যামসে ক্যাম্পবেল, সুপ্রিয় দাস
এই অসাধারন লেখন শৈলীকে কি বলবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না । ফ্রাঙ্কেন্সটাইন অসফল হলেন কি তার নিজেরই ধৈর্যের পরীক্ষায়?