পুস্তক পরিচিতি – চারটি অতিমারী থিমের উপন্যাস
লেখক: কুণাল কর্মকার
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস, ইন্টারনেট
এবারের আলোচিত গল্পগুলির থিম অতিমারী বা মহামারী৷
১) দ্য মাস্ক অব রেড ডেথ— এডগার অ্যালান পো
শহরে মড়ক লেগেছে মড়ক৷ রেড ডেথ৷ আধঘণ্টার মধ্যে অতিযন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু৷ শহরাধিপতি প্রিন্স প্রস্পেরো-র অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না৷ তিনি তার সভাসদরা এবং শহরের ধনিক-শ্রেণী একটি মঠের দখল নিয়ে,বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন৷ খাবার, বিলাস-ব্যসন কোনও কিছুরই অভাব নেই৷ সাধারণের কষ্ট, মৃত্যু সব প্রাচীরের বাইরে৷
একদিন প্রস্পেরোর ইচ্ছায় ছদ্মবেশ পরিহিত বল নাচের আসর বসলো৷ সাতখানি ঘরকে সাত রঙের থিমে সাজিয়ে সে এক এলাহি ব্যাপার৷ কোন ঘর নীল রঙে সেজে উঠছে, অন্যগুলি সবুজ, কমলা, বেগুনি ইত্যাদি রঙে রঙ্গিন৷ সপ্তম ঘরখানি অবশ্য একদমই আলাদা, তার থিম-রং কালো; লাল আলোয় আলোকিত ঘরখানির আবহ আধিভৌতিক৷ অতিথিরাও ঘরটিকে এড়িয়েই যাচ্ছে, কারণটা বোধহয় মৃত্যুভয়৷
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হুল্লোড় বেড়েই চলেছে, হঠাৎই প্রস্পেরোর চোখে পড়ে একজন অচেনা লোক, সে মৃত্যু সেজেছে৷ রাগে ফেটে পড়ে প্রিন্স, এতো বড় সাহস! উদ্যত ছুরি হাতে সে আগন্তুকের পরিচয় জানতে চায়৷
মৃত্যুবেশী কোনও উত্তর দেয় না, সে এগিয়ে চলে কালো ঘরের দিকে৷
তারপর কী হলও,জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে এই গল্পখানি৷
১৮৪২ সালে গ্রাহাম’স লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্পটি লেখকের অন্যতম সেরা গথিক ফ্যান্টাসি৷ মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা বারবার এসেছে এডগার এর লেখায়, তবে তার রূপের এমন ভয়াল প্রকাশ খুব কম গল্পেই বিদ্যমান৷
২) জোন ওয়ান— কলশন হোয়াইটহেড
জম্বি ভাইরাসের কবলে সভ্যতা প্রায় ধ্বংস, তবে আশার কথা মানুষের জয় হয়েছে এবং সভ্যতার ফিরে আসার লড়াইয়ে মার্ক স্পিটস (নামটা উপাধি স্বরূপ পাওয়া) একজন সৈন্য৷ তার কাজ পুনর্গঠনের জমি তৈরি, মানে ওই আর কি অবশিষ্ট জম্বি নিকেশ৷ নায়কের চোখ দিয়ে পৃথিবীর ভাইরাস গ্রাস, সামাজিক বিনির্মাণ, বেঁচে থাকার লড়াই, নতুন সমাজের ধীর পদচারণ, এ সবই মূর্ত হয়ে উঠেছে, সর্বোপরি এই উপন্যাসটি অনামা এক মানুষের মার্ক স্পিটস হয়ে ওঠার গল্প৷
হরর সাইফাই জনরার উপন্যাসখানি ২০১১-র নিউইয়র্ক টাইমস এর বেস্টসেলার লিস্টে বহুদিন অবস্থান করেছিল৷
৩) কোল্ড স্টোরেজ— ডেভিড কোয়েপ
স্ল্যাশার মুভি ভালো লাগে? বীভৎস রসে বুক কাঁপে না? সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলুন উপন্যাসটা৷ এবার জম্বি ফাঙ্গাসের পালা৷
১৯৭৯-এ স্কাই ল্যাব থেকে মিউটেট করতে থাকা করডাইসেপস ফাঙ্গাস ভর্তি একটা ট্যাঙ্ক খসে পড়ল অস্ট্রেলিয়ান আউট-ব্যাকের এক ছোট্ট শহরে৷ পরিবর্তিত ফাঙ্গাসের প্রিয় শিকার এখন মানুষ৷ মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে, মানুষগুলোকে একাধারে দাস এবং খাদ্যে পরিণত করে, দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি এবং সংক্রমণ৷ অচিরেই ছোট্ট শহরটা না মৃতদের ডেরায় পরিণত হল৷
এবার আমেরিকান বৈজ্ঞানিকদের মঞ্চে প্রবেশ৷ অনেক কাঠখড় আর প্রাণের বিনিময়ে, শহর জ্বালিয়ে দেবার আগে তারা ফাঙ্গাসের একটি নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেল তাদের গহন গুহার হিমঘরে, ফর রিসার্চ পারপাস৷
এদিকে ফাঙ্গাস বাবাজি চুপচাপ মিউটেটড হয়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে তার বুদ্ধি আর খিদে৷
অতঃপর আবার বেরিয়ে আসা, এবং আরও বীভৎস রসের অবতারণা৷ যথারীতি পৃথিবী রক্ষার্থে ডাক পড়ল সেই পুরোনো বৈজ্ঞানিকের৷
এ তো সেই বহু পুরোনো হেজে যাওয়া গল্পের প্লট৷ হ্যাঁ, একদমই তাই, কিন্তু লেখকের বুদ্ধিমত্তা আর অসামান্য কৌতুক রসবোধ গল্পটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে৷ চরিত্রচিত্রণের গুণে সব জীবন্ত৷
এই ফাঙ্গাস হাড় কাঁপাবেই৷
লেখক জুরাসিক পার্ক, স্পাইডার-ম্যান, মিশন ইম্পসিবল এর মতো সিনেমার চিত্রনাট্যকার৷
৪) সিভিয়ারেন্স— লিং মা
এক সন্তানসম্ভবা মহিলার জবানিতে অতি-মারী কবলিত নিউ-ইয়র্ক শহরে বেঁচে থাকা এবং অবশেষে ছেড়ে যাবার কাহিনি৷
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে হঠাৎই শেনফিভার (চায়নার শেনজেন এ উৎপত্তি) নামের এক অদ্ভুত ছত্রাক সংক্রমণে পৃথিবী ব্যাতিব্যস্ত৷ সংক্রমিত মানুষগুলো নিজেদের সত্তা ও বোধ জলাঞ্জলি দিয়ে, মেশিনে পরিবর্তিত হয়ে, একই কাজ বারবার করতে থাকে আমৃত্যু৷ কোনও ওষুধ বা টীকা নেই৷ আমাদের নায়িকা ক্যান্ডেস শেন আর তার মতো অল্প কিছু নাগরিক এই রোগের থেকে ইমিউন৷ ক্যান্ডেস নিজের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে শুরু করে ব্লগ লেখা, নিউইয়র্ক ঘোষ্ট৷ মহানগরের শেষের দিনগুলি মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে তার লেখায়৷
একটা সময় আসে যখন, শহরটা আর বাসযোগ্য থাকে না, আর তার মতো কয়েকজন বেরিয়ে পড়ে ফেলিসিটি নামক এক মরূদ্যানের উদ্দেশে, সেখানে নাকি রোগের প্রকোপ নেই৷
এই ফেলিসিটি কি সত্যিই নিরাপদ, জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে ২০১৮-র কার্কাশ প্রাইজ বিজয়ী উপন্যাসটি৷
Tags: ইন্টারনেট, কুণাল কর্মকার, গ্রন্থ পরিচিতি, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস