পৈশাচিক খিদে
লেখক: সাকিয়ো কোমাৎসু
শিল্পী: সুমন দাস ও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
কোন কারণ নেই।
কেন সবসময় কারণ থাকতেই হবে? মানুষ শুধু কারণ খোঁজে, কিন্তু আসল কারণ গুলোর পেছনের যুক্তিকে কখনোই ব্যাখ্যা করা যায় না। এই যে মানুষের সমস্ত জীবন কেন এরকম? কেন শুধু এইভাবেই চলে, অন্য কোনভাবে কেন নয়?
এই ধরনের প্রশ্নকে কি কেউ কোনদিন ব্যাখ্যা করতে পেরেছে?
****
প্রচন্ড আক্রোশে দাঁতে দাঁত চেপে জানলার বাইরে তাকিয়ে মানুষটা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কখনো কখনো হঠাৎই এই ধরনের উন্মত্ততা তাকে উদ্বেল করে তোলে। তার সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করে এক অযৌক্তিক হিংস্র ধ্বংসের তাড়না। এটা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। ভেতরের ঘরে ফিরে যাওয়ার আগে, হ্যাঁচকা টানে পর্দাটা টেনে দিয়ে সে নিজেকে শক্ত করে ফুসফুস ভরে শ্বাস নিল।
“এই সৃষ্টি, যাতে আমরা বাস করি, বিশ্রীরকমের হাস্যকর। আর বেঁচে থাকা! সেটা তো অত্যন্ত হাস্যকর রকমের বিশ্রী। আর সবথেকে বড় কথা আমার মত ফালতু মানুষ, অসহ্য রকমের হাস্যকর।
কেন এত ফালতু ?
কেন? আবার সেই কেন।
অপদার্থ, হাস্যকর, কারণটা খুব সহজভাবে বললেও হাস্যকর আর অপদার্থ। সবকিছু – সমৃদ্ধি, বিজ্ঞান, প্রেম, যৌনতা, রুজিরুটি, বুদ্ধিজীবি মানুষ – প্রকৃতি, পৃথিবী, মহাবিশ্ব – সবকিছু ন্যক্করজনক ভাবে কুৎসিত, হতাশাজনক ভাবে নির্বোধ। এই জন্যে-
না। “এইজন্যে” নয়, কিন্তু সে যাই হোক গে, আমি আসলে কাজটা করব।
“আমি করবই।” সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মানুষটা নিঃশব্দে চেঁচিয়ে উঠল, “আমি করেই ছাড়ব।”
অবশ্যই, যদিও এটাও বাকি সবকিছুর মতই একটা মূর্খামি। হয়তো এই পৃথিবীর সমস্ত বোকামিগুলোর মধ্যে সব থেকে বড় বোকামি এটা। তবুও এটার মধ্যে একটা অন্যরকমের স্বাদ আছে, ঝাঁঝালো, তীক্ষ্ণ। সম্ভবতঃ সেটা এই নিখুঁত পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনার অন্তঃস্থলে যে পাগলামির ছোঁয়া আছে, হয়ত তারই ফলাফল। হতে পারে, কিন্তু তবুও –
আমি এখন যা করতে চলেছি তা এই পৃথিবীতে আগে কেউ তার সুস্থ মস্তিষ্কে করার চেষ্টা করেনি।
পৃথিবী ধ্বংস করা? কত হাজার হাজার মানুষ ইতিহাসের পাতা জুড়ে কল্পনাটাকে পোষণ করে এসেছে। না, এই মানুষটির পরিকল্পনাটা অতও বস্তাপচা নয়। তার মনুষ্য জীবনের উপরে এই প্রচন্ড আক্রোশ এত গতানুগতিক ফালতু পরিকল্পনায় মিটতে পারেনা।
আমাকে জ্বালিয়ে খাক করা আগুনের শিখাটাকে নেভাতে পারে একটা সত্যিকারে বেপরোয়া কাজ…
*****
ভেতরের ঘরে ঢুকে সে দরজাটা বন্ধ করে দিল, আলোটাও নিভিয়ে ফেলল। “এইবার” – চিন্তাটাই তার চোখে ক্রুর ঝিলিক তুলল – এইবার আসল কাজ শুরু হবে।
শীতল আলোয় ঘরের ভেতরটা চকচক করছিল। এক কোণে একটা ইলেকট্রিক রেঞ্জ আর ওভেন, একটা গ্যাসবার্নার, একটা মাংস কাটার দা, একটা বড় আর একটা ছোট ফ্রাইংপ্যান, বিভিন্ন রকমের ছুরির সমাহার, এবং একটা রান্নাঘরের ক্যাবিনেট ভর্তি হরেকরকমের সস, মশলা আর সব্জিপাতি। সেগুলোর পাশে একটা অটোমেটেড অপারেশন টেবিল, মানব শরীরের উপর যেকোনো ধরনের অস্ত্রোপচার করার জন্য পুরোপুরি প্রোগ্রামড আর জিনিসপত্রে সজ্জিত, তা সে যতই জটিল আর দুরূহ হোক না কেন – সেরা হাসপাতালগুলোর থেকেও সেরা ব্যবস্থাপনা। আর তারপাশেই, কৃত্রিম অঙ্গের স্তুপঃ হাত, পা, মানবদেহের যতধরনের অত্যাধুনিক কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাওয়া যায়।
সবকিছু প্রস্তুত। সম্পূর্ন একমাস সময় লেগেছে তার, এই পরিকল্পনাটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তৈরি করতে, আর একমাস লেগেছে সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করতে। তার হিসাব অনুযায়ী আরও একমাসের একটু বেশী লাগবে সম্পূর্ন কাজটা শেষ করতে।
ঠিক আছে, তাহলে – এবার শুরু করা যাক।
ট্রাউজার খুলে, মানুষটা অপারেশন টেবিলে উঠল। বেশ কিছু কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ইলেকট্রোড শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে ভিডিওটেপটা চালু করল।
কাজ শুরু হল –
নাটকীয়ভাবে সে অপারেশন টেবিলের পাশে রাখা স্ট্যান্ড থেকে সিরিঞ্জটা তুলে নিল। যন্ত্রপাতিগুলো ঠিক করে নিয়ে সে একবার প্রেসারটা চেক করলো, – সামান্য হাই হয়ে আছে। স্বাভাবিক, প্রথমবার তো। ডান উরুতে লোকাল আনস্থেটিকের সূঁচটা প্রবেশ করালো সে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পায়ের সমস্ত অনুভূতি চলে গেল। তারপর সে অটোমেটিক অপারেটিং মেশিনটা চালু করল। যান্ত্রিক গুনগুন আর ভোঁ ভোঁ শব্দ, অত্যুজ্জ্বল আলোর দপদপানি; তার সমস্ত শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়। কালো যন্ত্রটার একটা হাত থেকে আরও অনেক বাহু প্রসারিত হচ্ছে তার দিকে।
অপারেটিং টেবিলের ক্ল্যাম্পগুলো তার পা-টাকে জড়িয়ে ধরল জঙ্ঘায় আর গোড়ালিতে। একটা ধাতব বাহুর নখে ধরা সংক্রমন প্রতিরোধক তুলোর প্যাড ধীরে ধীরে এসে তার উরূসন্ধি ঢেকে দিল। বৈদ্যুতিক ছুরিটা মাখনের মত কেটে বসল পায়ে, নিঃসাড়ে ঢুকে গেল চামড়ার মধ্যে; বিশেষ রক্ত ছিলনা। মাসল টিস্যু কেটে গেল। একটা বড় ধমনী খুলে এল। সেটিকে ফরসেপ দিয়ে চেপে ধরা, লিগাটেশ, জোড়া লাগতে চাওয়া পেশীগুলির মধ্যে ফাটল তৈরি করা, গুনগুনে করাতটা ঘুরতে ঘুরতে নেমে এল ঠিক যেখানে মাসল আর ট্যিসুর ফাঁক দিয়ে ফিমার দেখা যাচ্ছে। করাতটা হাড় স্পর্শ করতেই, আকস্মিক ধাক্কায় মানুষটা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
অথচ কোনরকম কম্পনই ছিলনা। হীরে বসানো আলট্রাহাইস্পিডের করাতটা অতি মৃদু একটা ঘস ঘস আওয়াজ তুলে হাড়টা কাটতে লাগল, একইসাথে কাটা জায়গা জুড়ে একটা শক্তিশালী উৎসেচকের মিশ্রণও ঘষতে থাকল জায়গাটায়। ঠিক ছয় মিনিটের মধ্যে তার ডান পাটা পরিষ্কারভাবে উরুসন্ধি থেকে বিভক্ত হয়ে গেল।
একটা গজকাপড়ের টুকরো দিয়ে ঘামে ভিজে যাওয়া মুখটা মুছে নিল মানুষটা। যান্ত্রিক হাত এগিয়ে এসে তাকে একগ্লাস ওষুধ ধরিয়ে দিল। এক ঢোঁকে সমস্ত ওষুধটা গিলে ফেলে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। তার নাড়ি দ্রুততালে দৌড়াচ্ছে, আরও আরও ঘাম গড়াচ্ছে কপাল বেয়ে। কিন্তু বিশেষ রক্তক্ষরণও হয়নি, আর যন্ত্রণার কোন অনুভূতিও নেই। নার্ভ ট্রিটমেন্টটা খুবই ভালো কাজ করেছে। এই অত্যাধুনিক চিকিৎসায় কোন রক্ত দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। সে ফুসফুসে সামান্য অক্সিজেন টেনে মাথা ঘোরাটা কমাতে চাইল।
তার ডান পাটা তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকরের মত টেবিলের উপরে পড়ে আছে। যেখানে ফেলা হয়েছিল সেইখানেই। একটা সঙ্কুচিত গোলাপী মাংসপেশি হলুদ চর্বির আস্তরণে ঘেরা, কালচে লাল রঙের মজ্জা সাদা হাড়ের ঠিক মাঝখানে; স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মধ্যে থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। রক্তক্ষরণ নেই বললেই হয়। সে তাকিয়ে রইল ভাঁজ হয়ে পড়ে থাকা লোমশ বস্তুটার দিকে। পাগল করা হাসিতে আরেকটু হলেই তার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন হাসার সময় নয়। এখনো অনেক কাজ বাকি।
সে বেশ কিছুক্ষন বিশ্রাম নিল দূর্বলতা কাটাতে। তারপর পরিকল্পনার পরবর্তী অংশ সম্পাদন করার জন্যে উঠে বসল।
ব্যান্ডেজবিহীন চিকিৎসায় জায়গাটা এরমধ্যেই সেরে উঠেছে; যন্ত্রটা থেকে একটা ধাতব হাত বেরিয়ে এসে একটা আর্টিফিসিয়াল পা তুলে নিল। কৃত্রিম সাইন্যাপস্ সেন্টার থেকে একটি সংকেতপ্রান্ত নিয়ে জোড়া হল কাটা জায়গার একটা স্নায়ুকোষের সাথে। শেষপর্যন্ত, একটা স্ট্র্যাপ আর কিছু বিশেষ বন্ধনীর সাহায্যে কৃত্রিম অবলম্বন অবয়বটি দৃঢ়ভাবে যুক্ত হয়ে গেল অবশিষ্ট উর্বস্থির সঙ্গে। সে সতর্কভাবে নতুন পাটাকে ভাঁজ করার চেষ্টা করল।
এতক্ষণ অবধি সব ঠিকঠাক আছে। সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তার বড় দূর্বল লাগছে, হাল্কা কাঁপছেও; কিন্তু সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে আর ধীরে ধীরে হাঁটতেও সক্ষম। নকল চরণটি কোন বিশেষ প্রকার হাল্কা ধাতু দিয়ে তৈরি। প্রতি পদক্ষেপে একটা ক্ষীণ ধ্বনি উঠছে। বেশ, যথেষ্ট ভালো। বেশীরভাগ সময়ে সে হুইলচেয়ারই তো ব্যবহার করবে।
মানুষটা নিজের ডান পাটা টেবিলের উপর থেকে তুলে নিল। সে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল, এতটাই ভারী! ভেতরে ভেতরে আরও একবার সেই পাগলপারা হাসির আক্রোশ তাকে অভিভূত করে দিচ্ছিল। সারাজীবন ধরে আমি এত ভার টেনে বেড়িয়েছি। কত কিলোর বোঝা থেকে সে মুক্তি পেল এই অবলম্বনটাকে দেহ থেকে বাদ দিয়ে?
“বেশ”, সে নিজের মনেই বিড়বিড় করল, ফিকফিক করে হাসতে হাসতে, “যথেষ্ট হয়েছে… এবার রক্তটা বের করে ফেলতে হবে।”
সদ্যবিচ্ছিন্ন দূর্বহ অঙ্গটাকে অপারেশন টেবিল থেকে তুলে নিয়ে সে প্লাস্টিক জ্যাকেটটাকে ছাড়াল। গোড়ালিটা বেঁধে পা-টাকে কড়িবরগা থেকে ঝুলিয়ে তাকে শক্ত হাতে নিংড়াতে শুরু করল। টপ টপ করে রক্ত পড়তে থাকল কাটা মুখটা থেকে।
কিছু পরে সেটাকে বেসিনে ভালো করে ধুতে, জল লেগে স্যাঁতস্যাঁতে লোমশ পাটাকে মনে হচ্ছিল একটা রাক্ষুসে ব্যাঙের পায়ের মত ফ্যাকাসে।
কিছুক্ষন সে বস্তুটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। খোঁচা হয়ে বেরিয়ে থাকা হাঁটু, ভাঁজ না হতে চাওয়া মাংসপেশী, হাজা ধরা আঙুল – এটা আমার পা! এবার সে রীতিমত কাঁপতে লাগল, পেটে হাত চেপে নুয়ে পড়ল খিল ধরিয়ে দেওয়া তীব্র হাসিটাকে সামলাতে। শেষপর্যন্ত এই নাছোড়বান্দা খেলুড়ে পা-এর একটা গতি হতে চলেছে।
এবার রান্না চাপানো যাক।
একটা বড় ছুরি দিয়ে সে পাটাকে হাঁটু থেকে দুখানা করল। একটা ধারালো মাংস কাটার ছুরি দিয়ে ছালটা ছাড়াতে শুরু করল। উরুর কাছে মাংসটা বেশ পুরু আর লোভনীয়। হতেই হবে, এটা যে রাং-এর মাংস। গ্রন্থিগুলো খুবই শক্ত। কাটতে কাটতে সে আবার ঘামে ভিজে উঠল। দ্রুত কাটা মাংসের স্তুপ তৈরি হল। মাংসগুলোয় ঝিল্লী লেগে আছে। টেংরি–র টুকরোগুলোকে সে ফোটাতে দিল একটা হাঁড়িতে। একে একে তাতে পড়তে থাকল তেজপাতা, লবঙ্গ, সেলেরি, পেঁয়াজ, মৌরি, কেশর, মরিচ, আরও নানানরকম মশলা আর সব্জির টুকরো। হাঁটুর কাছে সামান্য মাংস লেগে থাকা বাকি পাটাকে সে ফেলে দিল। স্টেক বানানোর জন্য সে যে রাং-এর মাংসটা সরিয়ে রেখেছিল এবার তাতে নুন আর মরিচ আর প্রচুর দই মাখালো সুস্বাদু করার জন্য।
আমার সাহস হবে এটা খাওয়ার? এতক্ষণে তার মনে প্রশ্ন জাগল। কি একটা যেন গলার কাছে সারাক্ষন দলা পাকিয়ে আছে। সে কি হজম করতে পারবে এটা?
ঘামে ভরে গেছে তার কপাল, দাঁতেদাঁত চেপে মানুষটা বলল, “আমি খাবই”। এটা তো আর পাঁচ দশটা রান্না করা জন্তুর মাংসের থেকে আলাদা কিছু নয়। যেমন মানুষ গরু বা ভেড়া খায়, ওরাও তো ভদ্র, সভ্য, তৃনভোজী; করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। আদিম মানুষরা তো মানুষের মাংসও খেত, এমনকি আজকের দিনেও কিছু বুনোজাতি আছে যারা মানুষের মাংস খায়। খাদ্যের জন্য একটা পশুকে হত্যা করা, এর কি সত্যিও কোন কারণ রয়েছে? অন্যান্য মাংসাশী প্রানীদেরকে বেঁচে থাকতে গেলে হত্যা করতে হয়। কিন্তু মানুষ???
মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেদিন থেকে তাদের অস্তিত্ব বর্তমান, মানুষ তাদের লক্ষ লক্ষ সঙ্গীকে হত্যা করেছে কিন্তু খাদ্যের জন্য নয়। সেদিক থেকে বিচার করলে এটা তো একদমই নিরীহ ব্যাপার। আমি তো আর কাউকে খুন করতে জাচ্ছি না। এমনকি অবলা জন্তুগুলোকেও আমি বধ করছি না। আমি শুধু আমার নিজের, একান্ত নিজের মাংস খাচ্ছি। আর কোন খাদ্য কি এতটা নির্দোষ হতে পারে?
ফ্রাইং প্যানের তেলটা চিড়বিড়িয়ে উঠল। কাঁপা হাতে সে একটা বড় মাংসখন্ডকে খামচে ধরে দ্বিধাগ্রস্তের মত ছুঁড়ে দিল ফ্রাইং প্যানে। চর্বি ভাজার রসাল গন্ধে ভরে যাচ্ছিল ঘরের বাতাস। কাঁপতে কাঁপতে লোকটা হুইল চেয়ারের হাতলদুটোকে এতজোরে চেপে ধরল যে ঐগুলো প্রায় ভেঙ্গেই যাচ্ছিল।
বেশ। আমি একটা শুয়োর। অথবা, সমস্ত মানুষই শুয়োরের থেকেও বেশী কদর্য, জঘন্য। আমার ভেতরে একটা অংশ আছে যেটা শুয়োরের থেকেও হীন, আর অন্য অংশটি “মহান”; আর এই মহান অংশটা অসম্ভব লজ্জিত ও রেগে আছে ঐ শূয়োরের থেকেও ঘৃণ্য অংশের জন্য। তাই আজ এই মহান অংশটা ওই পশুর চেয়েও অধম অংশটাকে খেয়ে ফেলবে। এতে ভয়টা কোথায়?
মুচমুচে লালচে করে ভাজা মাংসটা প্লেটের উপরে রাখা আছে। মানুষটা তার উপরে কাসুন্দী ঢালল, একটু লেবুর রস চিপে নিল আর সামান্য মাখন, একটু গ্রেভী তুলে নিল পাত্রে। খাওয়া শুরু করার আগে তার কাঁটাচামচ আর ছুরি ধরা হাত দুটো কাঁপতে কাঁপতে প্লেটের গায়ে ধাক্কা লেগে অনবরত ঝন ঝন আওয়াজ তুলতে লাগল। ঘামে ভিজে গিয়ে, সে ছুরিটাকে সর্বশক্তি দিয়ে মুঠো করে ধরল, গায়ের জোরে কাটতে থাকল মাংসের টুকরোটা, কাঁটা চামচটা ঠেলে ঢোকাল টুকরোটায় আর অসম্ভব আতঙ্কের সাথে মুখের ভেতরে ঢোকাল মাংসখন্ডটাকে।
তৃতীয় দিনে, সে বাম পা-টাকে কাটল। ঠিক আগের বারের মতই, চর্বি মাংস হাড় এবং অন্য সবকিছু। খন্ডগুলোকে লোহার কাঠিতে বিঁধিয়ে ভালো করে ঘি মাখিয়ে বড় চুল্লীটায় সে তন্দুরী বানানোর জন্য ঢোকাল। এবার আর তার কোন ভয় নেই। সে যে এত অদ্ভুতরকমের সুস্বাদু, তা তার জানাই ছিল না। এই আবিষ্কারটার সাথে সাথে একটা অন্যরকমের রাগ আর পাগলামি তার মনের মধ্যে শিকড় গেঁড়ে বসে গেছে।
এক সপ্তাহ পরে ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে গেল। এবার তাকে দেহের নিম্নাংশকে কেটে বাদ দিতে হবে।
হুইলচেয়ারে লাগানো টয়লেটে, সে জীবনের শেষবারের মত সশরীরে মলত্যাগের পুলক অনুভব করল। বিষ্ঠা ত্যাগের সাথে সাথে সে হো হো করে হেসে উঠল।
কি অবস্থা! আমি কি হাগছি, নিজেকেই। আমার পেটের মধ্যে আমারই অংশ হজম হয়ে আমার নিষ্ঠীবন হয়ে বেরোচ্ছে!
এটাই সম্ভবত নিজেকে অবমাননার চূড়ান্ত রূপ – অথবা এটাই হয়তো আত্মশ্লাঘার সর্বোৎকৃষ্ট পথ?
তবে গ্লুটাস মাক্সিমাসের অংশটাই সবথেকে বেশী সুস্বাদু ছিল।
কোমরের তলা থেকে কিছুই আর নেই। যান্ত্রিক পাদুটোর কাজও শেষ, সে সেইসময়ের জন্যে ওইদুটোকে সরিয়ে রাখল। এবার দেহের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পালা। অটোমেটিক অপারেশন মেশিনের যান্ত্রিক মস্তিষ্কের সাথে মানুষটা পরামর্শ করতে বসল। “আমি যদি আমার পাকস্থলী খেয়ে ফেলি, তারপরেও কি আমার খিদে হবে?”
উত্তর এল, “প্রায় আগের মতই হবে।”
সে বৃহদন্ত্রটা ফেলে দিল, আর ক্ষুদ্রান্ত্রটিকে শাকসব্জীর সাথে স্টু বানাবে বলে সেদ্ধ করতে দিল এবং পাকস্থলীর ঠিক নিচের অংশ ডিওডেনামটিকে সসেজ বানাবে বলে সরিয়ে রাখল। কিডনি আর যকৃৎটাকে কৃত্রিম প্রত্যঙ্গের দ্বারা প্রতিস্থাপন করল, তারপর সে আসল অঙ্গগুলোকে ভালো করে ভেজে খেয়ে নিল। অন্যান্য অঙ্গগুলো খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে পাকস্থলীটা সরিয়ে একটা প্লাস্টিকের পাত্রে পুষ্টিকর অম্লতরল দিয়ে জারিয়ে রাখল।
তৃতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে সে হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুসটা প্রতিস্থাপন করল। শেষমেশ মানুষটা নিজের ধক ধক করা হৃদয়টা খেল, পাতলা পাতলা করে কেটে, ভেজে; এই কাজটা অ্যাজটেকদের সেই ভয়ংকর হৃৎপিন্ড বলিদান নীতি প্রচলনকারী পুরোহিতদেরও চিন্তার বাইরে।
এরমধ্যেই সে তার নিজের পাকস্থলীটাকে একদিন রান্না করল। সোয়া সসে চুবিয়ে, রসুন আর লাল লঙ্কা দিয়ে একটা চাইনীজ প্রিপারেশন- সে এখন ভালোই বুঝতে পারছে মানুষ দিব্যি খেয়ে যেতে পারে যখন খাদ্যের কোন চাহিদা থাকে না তখনও।
মানুষ যে এত অসংখ্য ও নানা ধরনের রান্নার প্রণালী আবিষ্কার করেছে; তারমধ্যে কতগুলো সত্যিকারের ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য তৈরি হয়েছে, আর কতগুলো শুধু আরও কি কি স্বাদের খাবার বানানো যায় সেই কৌতুহলের ফলাফল হিসাবে, তাতে ঘোর সন্দেহ আছে। এমনকি যখন সমস্ত কৌতুহল মিটে যায় তখন মানুষ তার সবথেকে কল্পনাতীত জিনিসগুলো খেতে শুরু করে, অন্ততঃ যতক্ষণ রাগ থাকে। প্রচন্ড রাগের মাথায় নিজের স্বজাতির মাংস ছিঁড়ে খাওয়া, অনেকটা কাঁচের গ্লাস কড়মড় করে চিবানোর মত।
একটা খিদে সবসময় ঘুমিয়ে থাকে এক বর্বর আগ্রাসন তাড়নার অন্তরে; শিকার করা আর খাওয়া, ছেঁড়া আর চিবানো, গেলা আর চুষে নেওয়া – এটাই হচ্ছে পৈশাচিক খিদের আসল রূপ।
এখন, কন্ঠনালীর শেষ অংশটা শুধু একটা ডিসপোজেবল টিউবের সাথে জোড়া। বাঁচিয়ে রাখা জন্য বাকি থাকা দেহকোষগুলিকে সরাসরি রক্তে চুবিয়ে রাখা হয়েছে একটা পুষ্টিকর তরল ভর্তি পাত্রের মধ্যে, আর কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির দ্বারা অন্তঃস্রাবী ক্রিয়াটা চলছে।
মাসের শেষের দিকে, হাতদুটোও খাওয়া হয়ে গেছে, শুধু পড়ে আছে গলা থেকে উপরের অংশটা।
চল্লিশতম দিন, মুখের সমস্ত পেশীগুলো খেয়ে শেষ করেছে মানুষটা; বাকি রেখেছে শুধু ঠোঁট দুটো। একগাদা যান্ত্রিক স্প্রিং পেশীর সাহায্যে চিবানোর কাজটা সম্পাদন করছে তারা। শুধুমাত্র একটা চোখ বেঁচে আছে। অন্যটাকে চুষে চিবিয়ে খাওয়া হয়ে গেছে।
কি বসে আছে ওখানে ওটা? একগাদা পাইপ আর টিউবের গোলকধাঁধার স্তুপের উপরে আরূঢ় একটা মুখসর্বস্ব খুলি, আর ওই খুলির মধ্যে টিকে রয়েছে একটা জ্যান্ত মস্তিষ্ক।
না…
এবার অপারেশন মেশিনের একটা যান্ত্রিক হাত এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে করোটীর ছালটা ছাড়াতে লাগল, একটা ছোট্ট করাত বেরিয়ে এল হাতটা থেকে, সেটার সাহায্য করোটিটা পরিষ্কারভাবে কাটা হল।
কেটে ফেলা করোটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শিরঃস্থিত মজ্জাটা স্পন্দিত হচ্ছে। তার উপরে নুন, লঙ্কা আর লেবুর রস ছড়াতে ছড়াতে, খুলির ভিতরের মজ্জাটা ভাবল – আমার মস্তিষ্ক, আমি কিভাবে এমন একটা জিনিস খেতে পারি? একটা মানুষ কিভাবে তার নিজের মাথার ঘুলির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে?
একটা চামচে ধূসরবর্নের ঘিলুর মধ্যে ডুবল। ব্যাথা নেই – কোন অনুভুতিই নেই করোটিতে। যান্ত্রিক হাতটা ইতিমধ্যে ঘিলুর মধ্যে থেকে এক চামচ ছাইরঙা নরম মন্ড তুলে এনেছে, মুখের সামনে। আর জিহ্বা সেটাকে লেহন করে গিলতে শুরু করল, “স্বাদ” আর বোঝা গেল না।
“খুন”!!!
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাছির মত ছেঁকে ধরা রিপোর্টারগুলোর উদ্দেশ্যে শব্দটা ছুঁড়ে দিলেন ইনস্পেক্টর। “সঠিকভাবে বলতে গেলে, এটা এক নজিরবিহীন রকমের নৃশংস আর পাশবিক একটা খুন। খুব সম্ভবত খুনী এক বদ্ধ উন্মাদ ডাক্তার। হত্যার রকম দেখে মনে হচ্ছে একটা বিকৃত গবেষণা। শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে টুকরো টুকরো করে কেটে বের করে এনে, সেখানে কৃত্রিম অঙ্গ স্থাপন করেছে…”
ইনস্পেক্টর প্রেসের লোকদের বিদায় করে আবার ঘরটায় এসে ঢুকলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন, এবার তাঁর নিজেকে অত্যন্ত ক্লান্ত লাগছে।
চুল্লীর সামনে থেকে গোয়েন্দা এগিয়ে এলেন ইন্সপেক্টরের কাছে, তার চোখে প্রশ্ন। “টেপগুলো পোড়ানো হয়ে গেছে।” গোয়েন্দা মন্তব্য করলেন, “কিন্তু… আপনি এটাকে খুন বললেন কেন?”
“শান্তি আর শৃঙ্খলা বজার রাখার জন্য”, ইন্সপেক্টার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “খুন বলেই ঘোষণা করে দাও – একটা অফিসিয়াল তদন্ত শুরু কর – আর যাহোক একটা হাবিজাবি লিখে দিয়ে কেসফাইল বন্ধ করে ফেল। যদি সমস্ত ঘটনাকে একসাথে করা হয় – তাহলে এই কেসটা কোনো যুক্তির ধার ধারে না। তোমার কোনো অধিকার নেই, সাধারণ তথাকথিত ভদ্রমানুষদের এরকম একটা চরম উন্মাদের অন্তঃকরণে উঁকি দেওয়াতে। এরকম আত্মবিধ্বংসী চিন্তা হয়ত অনেকেরই মনের গহ্বরে লুকিয়ে আছে। আমরা যদি অসাবধানতা বশতঃ মানুষদের দেখিয়ে ফেলি তাদের মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা নরখাদক পশুটার ঝলক – তাহলে, তুমি নিশ্চিত থাক কেউ না কেউ, কখনো না কখনো এই লোকটার উদাহরণ ঠিক অনুসরন করবে। আর এই ধরনের লোক – তারা যে কি করতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না…”
“সাধারণ মানুষ যদি হঠাৎ করে এরকম একটা ঘটনার কথা জানতে পারে, তাহলে মানুষের নিজের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে যাবে – তারা নিজেদের ভেতরের অন্ধকার দিকটা ছিঁড়ে ফুড়ে দেখতে চাইবে। তারপর সেই অন্ধকারেই নিমজ্জিত হয়ে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
“মানুষ মানুষকে খুন করছে, ছিঁড়ে খাচ্ছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ধ্বংস করছে – এসব উপসর্গরা ইতিমধ্যেই ফুটে উঠেছে। এই একজন জ্বলন্ত ডিনামাইট খেয়ে আত্মহত্যা করল – কেউ নিজের গায়ে গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিল – আর একজন দিনেরবেলা শহরের মাঝখানে রাস্তা ভরা লোকের সামনে ধর্ষণ করতে শুরু করল একটা মেয়েকে!!! যখন আর হাতে কোন কারণ থাকে না আক্রমণ করার, তখন খাঁচায় বন্দী পশুর মত সে নিজেকেই নিজে ছিঁড়ে খায়।”
“আঁআঁআঁআঁ”
তীব্র আর্তনাদ করে, তরুণ গোয়েন্দাটি চেঁচিয়ে ছিটকে সরে এল পচা মুন্ডুটার কাছ থেকে। নাড়িভুঁড়ি ওলটানো গন্ধওলা চামচটা সে সবে ঠোঁটদুটো থেকে সরানো চেষ্টা করছিল, খুলিটা হঠাৎ তার হাতে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে, খুবলে নিয়েছে একটু মাংস।
“সাবধান।” ইনস্পেক্টর চেঁচিয়ে উঠলেন। “সমস্ত জীবের মূল ভিত্তিই হল এই প্রচন্ড আগ্রাসী নিষ্ঠুর পৈশাচিক খিদে … ”
খুলিটার ঘিলু বেরিয়ে এসেছে, একমাত্র চোখটা কোটর থেকে ঝুলছে আর মাংসপেশীর বদলে বসানো শক্ত স্প্রিংগুলো এবার ধীরে ধীরে কোঁচকাতে শুরু করল আর সদ্য ছিঁড়ে নেওয়া মাংসের টুকরোটা চিবোতে শুরু করল পচে যাওয়া জিভ আর কঠিন দাঁতে।
লেখক পরিচিতিঃ সাকিয়ো কোমাৎসু – (১৯৩১ – ২০১১)
জাপানের অন্যতম বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান গল্পকার। ভদ্রলোক জাপানের ওসাকাতে জন্মগ্রহন করেন, এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতালিয়ান সাহিত্যে স্নাতক হন। তাঁর লেখালেখি মূলত শুরু হয় ১৯৬০ এর দশক থেকে কোবো আবে- এর রচনা এবং ইতালিয়ান সাহিত্য পড়াশোনা করে। ক্রমশ কোমাৎসুর ধারণা জন্মায়, যে আধুনিক সাহিত্য এবং কল্পবিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক। কোমাৎসু সারা জীবন লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু তাঁর লেখার মধ্যে বার বার ফিরে ফিরে এসেছে জাপানের ওপর পারমাণবিক আক্রমণের অভিশাপ। তিনি নৈরাশ্যবাদী ছিলেন না, ঐ ধ্বংসের পরে লুটিয়ে পড়া জাপান যে একসময় উন্নতির মহাশিখরে উঠবে তাই নিয়ে তিনি লিখে গেছেন তাঁর কল্পবিজ্ঞান। জীবনে বহু সম্মান তিনি পেয়েছেন, তার মধ্যে ১৯৮৫ সালে Nihon SF Taisho Award তাছাড়া ২০০৭ সালে ইয়োকোহমাতে অনুষ্ঠিত ৬৫ তম বিশ্ব কল্পবিজ্ঞান সম্মেলনে তিনি জাপানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১১ সালে, আশি বছর বয়সে, নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
ইংরেজি অনুবাদ – জুডিথ মেরিল
বাংলা অনুবাদ – অঙ্কিতা
Tags: অঙ্কিতা, অনুবাদ গল্প, জাপানি গল্পের অনুবাদ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পৈশাচিক খিদে, সাকিয়ো কোমাৎসু, সুমন দাস
অসাধারণ ভাবানুবাদ। বলে না দিলে বোঝা দায় যে এটা অনুবাদ।