প্রজন্ম
লেখক: অনুষ্টুপ শেঠ
শিল্পী: সুমন দাস
“ইয়েসসসসসস!”
চীৎকার করে ঘরের ফাঁকা জায়গাটায় লাফিয়ে উঠেছিল নি-রা-৫। ও হচ্ছে পৃথিবী থেকে শেষ যে মানুষটা পা তুলে নিয়েছিল তার পঞ্চম প্রজন্ম। প্রজন্ম বলা যায় কি না কে জানে, সেই শেষতম শাটলের কম্ব্যাট টেনিংপ্রাপ্ত গার্ড নিবেদিতা রায় এই ত্রিয়োশিতা উপগ্রহের কলোনিতে এসে পৌঁছোনোর পর, এখানকার সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তার নাম হয় নি-রা-১। তার জিন থেকে নি-রা-২ অবশ্য পৃথিবীতেই তৈরি হয়েছিল। সে শিশু প্রতিপালনের উপযোগী ও ইচ্ছুক হলে আসে নি-রা-৩, তারপর ৪ ও ৫ একইভাবে।
পৃথিবীতে, আদি মানবসভ্যতায় পুরুষ ও নারী দুই ধরণের মানুষ হত। শেষ বিশ্বযুদ্ধ, যা পুরো আফ্রিকা, আদ্দেক ইউরোপ ও চীন, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এসব দেশগুলোকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল, তাতে প্রায় সমস্ত সক্ষম পুরুষ মারা যায়। প্রায় কেন, সমস্ত বললেই ঠিক হয়, কারণ যারা প্রাণে বেঁচে ছিল তারা সবাই-ই রেডিয়েশনের প্রভাবে নির্বীজ হয়ে গেছিল। বাঁচেওনি কেউ বেশিদিন। তারও আগে, জন্মের হার বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়ার ফলে ২০৮৭ সালেই মেয়েদের যুদ্ধ, ফায়ার ফাইটিং এরকম সব প্রাণসংশয়কারী কাজে যোগদান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বযুদ্ধটার পর এই জিন থেকে সন্তান পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল মানুষ প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সরকার থেকে ভাতাও দেওয়া হত কেউ এই পদ্ধতি নিতে চাইলে। সন্তানপালনের ঝুটঝামেলা অনেক, তাই তা সত্ত্বেও জন্মের হার বেশ কমই ছিল।
যাই হোক, আপাতত নি-রা-৫ এত উত্তেজিত, লাফালাফি করে করে এতটাই ক্লান্ত হয়ে গেছিল যে আরেকটু হলে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ত। তাহলে ওই অত ভালো ক্যারামেল পুডিং টেস্টের পাল্প-কিউব আনিয়েছিল আজ ফুডিলাভ থেকে, সেটার সদ্গতি কে করত শুনি?
তবে এত আনন্দ করা সাজে ওর। সত্যি, এতদিনের ইচ্ছা, এত পরিশ্রম… আজ সার্থক!
অ্যাস্ট্রোগার্ড হিসাবে যোগ দেওয়ার ইচ্ছেটা নি-রা-৫ এর ছোটবেলা থেকেই৷ সেটা কিছুটা হয়তো পূর্বমানুষ নিবেদিতা রায়ের গল্প শোনার ফল। কলকাতা নামে ছোট শহর থেকে তার নিউ ইয়র্ক আসা স্কলারশিপ নিয়ে, অ্যাস্ট্রোগার্ড হিসাবে মঙ্গল আর চাঁদে অভিযান, কৃত্রিম উপগ্রহগুলোতে ডিউটি, আর অবশ্যই সেই শেষ মানুষ হিসাবে পৃথিবী ছেড়ে আসা—এই গল্পগুলো শুনলে ও নির্ঝঞ্ঝাটে খেয়ে নিত বলে মামমাম এগুলোই বারবার বলত। এগুলো, আর ওদের নিজস্ব—একান্ত নিজস্ব পারিবারিক মন্ত্র, এই দুটো মাথায় একদম গেঁথে গেছিল কিশোরী নি-রা-৫ এর। তাই বাধ্যতামূলক প্রেপ পর্যায়ের শিক্ষা সম্পূর্ণ করেই সে ছুটেছিল অ্যাস্ট্রোলাইন-এর পরীক্ষার ফর্মগুলো তুলতে।
আজ সন্ধেতেই জেনেছে ও তাতে ভালোভাবে পাস করেছে। যদিও যা খেটে তৈরি হয়েছিল তাতে প্রথম দশ জনের মধ্যে থাকারই আশা ছিল তার, সেটা হয়নি। তবে একুশও র্যাঙ্ক হিসেবে কিছু খারাপ না। চান্স পাওয়াটাই আসল কথা, এর পর কাজে করে দেখানোর সুযোগ তো রইলই।
দেওয়ালে আটকানো বাঙ্ক বেডে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে খেয়াল হল, আজও ভুলে গেছে ও। পিউরো-অ্যাডাপটরে এই আপগ্রেডটা করে নেওয়া খুব জরুরি, বারবার করে বলছে সর্বত্র। এই পরীক্ষার টেনশনে রোজ ভুলে যাচ্ছে ও।
উঠে করে নেবে? কালকেই তো লাস্ট ডেট। পরশু ভোররাত্রি থেকে টারবুলেন্স শুরু হবার কথা, তার আগে করতেই হবে।
বড্ড ক্লান্ত। ওটা করতে না-হোক এক ঘণ্টা লাগবে, জেগে বসে থাকতে হবে। কাল সকালে ইন্টারভিউ সিলেকশন, ফ্রেশ হয়ে যেতে হবে। থাক, মিটিয়ে এসে ফ্রি মাইন্ডে করে নেবে বিকেলে।
এক পলকেই ঘুমে তলিয়ে যায় নি-রা-৫।
পরদিন ঠিক সময়ে নিখুঁত ফর্মালে সেজে, শেডস চোখে লাগিয়ে স্টার ডেস্টিনি বিল্ডিং এর সামনে এসে চোখ কপালে উঠে গেল নি-রা-৫ এর। এত বড় লাইন! তার মানে এতজন পাস করেছে দেখা যাচ্ছে, এবার কাকে কোন ফ্লীটে প্লেস করা হবে সেটাই দেখার। লাইনের শেষে লাল চুলের পনিটেলের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।
***
চীৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছিল ওর। মিগ-১১…? এত পরিশ্রমের পর, এত ভালো র্যাঙ্ক নিয়ে মিগ-১১!
উপগ্রহদের চারদিকে পাক খেয়ে পাহারা দেওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই মিগ সিরিজের। তার মধ্যেও, সবচেয়ে কম গুরুত্বের, সবচেয়ে কাছ দিয়ে পাক খাওয়া ফ্লীট হল মিগ-১১। নেহাৎ অগা গার্ডদের এটায় ডিউটি পড়ে, কারণ কিছুই করার থাকে না রকেটের স্পীড আর গতিমুখ ঠিক রাখা ছাড়া। অন্তত সেরকমই জানত নি-রা-৫। তার মতো এত ভালো রেজাল্ট করা ক্যান্ডিডেটকে এমন একটা পোস্ট অফার করার কোনও যুক্তি পাচ্ছিল না সে। হ্যাঁ, শুনেছিল গত ইলেকশনে সোন-সা-ঈ-২ জেতার পর থেকে নানা ক্ষেত্রে নিয়োগব্যবস্থায় দুর্নীতি নিয়ে কানাঘুষো চলছিল। কিন্তু নিজের সঙ্গে সেরকম কিছু হবে এটা ও ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।
প্রতিবাদ, যুক্তি, অনুনয়, বিনয়—সমস্ত বৃথা গেল। নাকি সমস্ত মিগ-১১-এ এখন থেকে ওর মতো বুদ্ধিমান, নির্ভরযোগ্য মানুষকে লীডার হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভেঙে না বললেও, নি-রা-৫ বুঝল এ হুকুম একেবারে উপরতলা থেকে এসেছে।
কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, সামনের টার্মিনালে অ্যাক্সেপ্ট বাটন টাচ করে উঠে পড়ল ও।
“উই উইশ য়্যু অল দ্য বেস্ট, কম্যান্ডো।”
কথাটা বলতে বলতেই নিজের রিভলভিং চেয়ারে আধখানা ঘুরেছিল প্যানেলিস্ট মহিলা। তার ঘাড়ের কাছে নীলচে আলোটা দেখে এতক্ষণে বুঝল নি-রা-৫ যে, এ অ্যান্ড্রয়েড।
কী নিখুঁত মডেলগুলো বানায় আজকাল, সত্যি!
বাইরে বেরিয়ে নি-রা-৫ দেখল সেই লালচুলো মেয়েটা খুব হেসে হেসে কাকে যেন ফোন করছে।
ক্লান্ত লাগছিল, একটা শেয়ার টুপড্রপ বুক করে দাঁড়িয়েছিল সে। মেয়েটাও পাশে এসে দাঁড়াল।
“কী দিল তোমাকে?”
বোঝাই যাচ্ছে খুব আহ্লাদিত। নইলে এভাবে অচেনা লোককে ডেকে কেউ কথাই বলে না, কিছু এরকম জানতে চাওয়া তো দূর।
“মিগ-১১।” বলতে গিয়ে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে গেল নি-রা-৫। সেটা সামলাতেই সঙ্গে সঙ্গে যোগ করল, “তোমাকে?”
“রা-১।” গর্ব ফেটে পড়ল মেয়েটার গলায়।
কাতর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল নি-রা-১। রা-১? নতুন সমস্ত উপগ্রহে প্রথম যাওয়ার সুযোগ পায় যে ফ্লীট? সব নতুন আপগ্রেড সবার আগে রা সিরিজে হয়। সেরা সিরিজ। আর সেরার সেরা হল রা-১। ওর স্বপ্নের ফ্লীট।
টুপড্রপটা তখনই সামনে এসে পার্ক করে। দেখা যায়, ওরা দুজনেই এই ক্যাবটা বুক করেছে। কাজেই আলাপ চলে গাড়িতে ওঠার পরও।
“তুমি খুব লাকি। অনেক পড়তে, না?”
“আরে না না। যেটুকু পড়ে নিলে পুরোটা বোঝা যায় তাই শুধু। মনে রাখাটা তো কোনও ব্যাপার না, একবার পড়লেই হয়ে গেল।”
কেউ কেউ কত বুদ্ধি নিয়ে জন্মায়! ঈর্ষার চোখে চেয়ে থাকে নি-রা-৫। যা পড়ছে তা মনে রাখাটা ওর কাছে বেশ চ্যালেঞ্জ, বারবার না পড়লে বড্ড ভুলে যায়। বারবার পড়ে মাথায় গেঁথে নেওয়া, তারপর পরীক্ষার আগে আবার রিভাইজ করা—মামমাম এভাবেই পড়তে শিখিয়েছিল ওকে। মামমামের কাছছাড়া হয়ে নিজের আলাদা ব্যবস্থা করে নেওয়ার পরও, এভাবেই নিজেকে তৈরি করেছিল ও। অত খাটুনি, অথচ…
“আমাকে দিনে চার পাঁচ ঘণ্টা পড়তে হত…”
স্বগতোক্তির মতো বলে নি-রা-৫। হেলথ ডিপার্টমেন্টে বাধ্যতামূলক ৮ ঘণ্টা কমিউনিটি সার্ভিস দেওয়ার পর, শরীর ভেঙে আসত বই নিয়ে বসতে, চোখ ঘুমে ঢুলে আসত খানিক পর। তবু করেছে ও। কী লাভ হল!
মেয়েটা মুখ বেঁকায়, স্পষ্ট দেখতে পায় নি-রা-৫।
“আমি বাপু অত পড়িনি কখনওই। প্রাইভেট সার্ভিসে আছি তো, মালিক সারাক্ষণ ঘর ঝাড়তে আর রান্না করতে ডাকলে কি পড়া যায়! বলে কয়ে ছুটি নিয়ে পরীক্ষার আগে কিছুদিন খালি… তাও তো পঁয়ত্রিশ র্যাঙ্ক পেয়ে গেলাম!”
নি-রা-৫ এর সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, রাগ আর অবিশ্বাস মেশানো এক অনুভূতি ঘুরপাক খায় বুকের মধ্যে, হাত পা শক্ত পাথরের মতো ভারী লাগে।
পঁয়ত্রিশ। একুশ।
রা-১। মিগ-১১।
“এইখানে, এইখানে। ওই লাল দরজার সামনেটায়।”
নিজেকে সামলে নি-রা-৫ কিছু আর বলার আগেই মেয়েটা নেমে যায় সুরখেলানো “বাইইই” বলে। লাল পোনিটেল দোল খায়, নি-রা-৫ দেখে ওর ঘাড়ের কাছে নীল আলো দপদপ করছে।
বহু আগে থেকেই, নানান প্রয়োজনে অ্যান্ড্রয়েডরা নিত্যদিনের অঙ্গ হয়ে গেছে। একটা ছোট্ট উপগ্রহ ত্রিয়োশিতা, মেরেকেটে হাজার তিনেক মানুষই তো পৌঁছেছিল তো পৃথিবী থেকে। এখন বেড়ে-টেড়েও কতই বা হবে, পাঁচ হাজার ম্যাক্সিমাম! অ্যান্ড্রয়েড না হলে কাজ করাবে কাদের দিয়ে! স্কুলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে সম্মান দেওয়ার কথা পড়ানোও হয় বহুকাল ধরেই। কিন্তু সমকক্ষের মতো, এমন একজামে তাদের বসতে দেওয়ার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে সদ্যই, গত ইলেকশনের পর বস্তুত।
একটা মহাকাশ অভিযানে অ্যাক্সিডেন্টে শরীরের বাঁদিকের প্রায় পুরোটা নষ্ট হয়ে গেছিল ফ্লীট কম্যাণ্ডার সোন-সা-ঈ-৭-এর। সেটা আগাগোড়া রিপ্লেস করা হয় মিউটো পার্টস দিয়ে, যা দিয়ে অ্যান্ড্রয়েড মডেলগুলো তৈরি হয়।
ওদের বর্তমান লীডার নিজেও আসলে অ্যান্ড্রয়েডই এখন, বলতে গেলে।
***
মনটা খুবই খারাপ ছিল ওর। খুব। মিগ-১১ টা স্রেফ হজম করা যাচ্ছে না।
ছেড়ে দেবারও উপায় নেই আর। অ্যাক্সেপ্ট করে এসেছে। এরপর ছেড়ে দিতে চাইলে আরও কমিউনিটি সার্ভিসের পানিশমেন্ট জুটবে।
হতাশার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছিল নি-রা-৫। ক্রেডিট ব্যবহার করে ইন্টক্সিককশন এই প্রথম আনাল ও। অদ্ভুত টেস্ট। প্রথম দু’চুমুকের পরই মাথা হালকা আর ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল খুব। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি।
আপগ্রেড ডিউ হলে বারবার পিউরো-অ্যাডাপটরটায় সিগনাল আসে। এমনিতে, সেটা ঘুমন্ত অবস্থাতেও মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। জিনিসটা আসলে একটা ছোট্ট জালের মতো যন্ত্র, কিন্তু এইটা ক্রায়োশিয়ার মানুষদের অবশ্য প্রয়োজনীয়। বাচ্চার জন্মের পরপরই এটা নাকের মধ্যের হাড়ে ইমপ্ল্যান্ট করা হয়, জালটা দুই নাকের ফুটোয় টের পাওয়াই যায় না—এমন মোলায়েমভাবে ছাঁকনির মতো বিছিয়ে থাকে।
ক্রায়োশিয়ার বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কম শুধু নয়, চরম ক্ষতিকর কার্বন-মনোক্সাইড আছে খুব বেশি পরিমাণে। এই পরিমাণ আবার সৌর ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে, আবার পরে ডিটক্সিফায়ার দিয়ে কমানো হয় ধীরে ধীরে। আজকাল সৌর ঝড় হচ্ছেও খুব ঘন ঘন। অ্যাডাপ্টারটা, মানুষদের নিঃশ্বাসের বাতাস থেকে কার্বন-মনোক্সাইড শুষে নিয়ে প্রয়োজনীয় লেভেলের অক্সিজেন বজায় রাখতে সাহায্য করে।
শুধু, এগুলো নিয়মিত আপগ্রেড করতে হয় সরকার যখন বলে। বাতাসের কোয়ালিটি তো ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা সেই অনুযায়ীই এগুলোর শোষণক্ষমতা বাড়ানোর সফটওয়্যার আপগ্রেড আনছেন নিয়মিত। সবার বাসস্থানেই এই আপগ্রেড ইন্সটল করে নেওয়ার একটা করে পিউরো মেইন্টেন্যান্স ডক আছে, সেখানে বসে নাকের উপর একটা মাস্ক লাগিয়ে নিতে হয়, আর হাতের স্ক্যান করে ‘ওকে’ দিতে হয়। তারপর বই পড়ো বা গান শোনো, ঘণ্টাখানেক পর সবউজ আলো জ্বলে, টুং টাং মিউজিক বেজে বুঝিয়ে দেয় যে কাজ শেষ।
আজও নিশ্চয় ওর অ্যাডাপটরে সিগনাল এসেছিল। এমন কালঘুমে পেয়েছিল নি-রা-১ কে, যে কিচ্ছু টের পায়নি।
ঘুম যখন ভাঙল, তখন নিকষ অন্ধকার। সারাদিন খাওয়া নেই, অসময়ে ঘুম, সারা শরীর টনটন করছিল ওর। মাথা কাজ করছিল না। আবার পাশ ফিরে ঘুমোতে যাবে, মনে পড়ল, আপগ্রেড!
এ বাবা! কী হবে!
সটান উঠে পড়েছিল নি-রা-৫। হোঁচট খেতে খেতে প্রায় হুমড়ি খেয়ে এসে বসেছিল মেইন্টেন্যান্স ডকের সামনে।
নেই!
এমনিতে সারাক্ষণ একটা লাল আলো জ্বলে। আপগ্রেড অ্যাভেলেবল থাকলে সেটা ব্লিঙ্ক করে। আজ কিচ্ছু নেই—পুরো অন্ধকার।
এরকম কখনও দেখেনি বা শোনেনি ও। এটা কী হল!
মাস্কটা তুলে মুখে পরল নি-রা-৫, বারবার হাত রেখে স্ক্যান করাতে চাইল, কিন্তু কিচ্ছু লাভ হল না। ডক নিথর অন্ধকার হয়েই রইল।
ঘাম হচ্ছিল ওর। কী হবে?
নাহ। কালই সরকারি অফিসে যেতে হবে রিপোর্ট করতে। কিছু একটা ব্যবস্থা করবে নিশ্চয়ই ওরা। যে মারাত্মক সৌর ঝড়, যাকে টারবুলেন্স বলা হচ্ছে, সেটা কি আর ঘড়ির কাঁটা মেনে সকালেই শুরু হয়ে যাবে? অফিস তো পাশের পাশের রাস্তাতেই, পৌঁছে যাবে ঠিক ও।
চোখ কচলে ফোনটা তুলে নিয়ে ফুডিলাভ-এ অর্ডার দিতে শুরু করল নি-রা-৫। খুব খিদে পেয়েছে আজ। দুটো কিউব লাগবে, একটায় কুলোবে না। টেরিয়াকি ফ্লেভার? নাহ্। বিরিয়ানি আর বাটারস্কচ। এইগুলোর জন্যই ফুডিলাভে অর্ডার করে ও, দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও। এটাই এই উপগ্রহের একমাত্র ফুড জয়েন্ট যার রান্নাঘর পুরোপুরি মানুষেরা চালায়। স্বাদ ব্যাপারটা ওরা যেমন বোঝে, আর কেউ নয়।
দু’বার, তিনবার, চারবার অর্ডার কনফার্ম করার পরেও সেটা অ্যাক্সেপ্ট হল না। বিরক্ত হয়ে উঠেছিল ও। আজই কি টেকনিক্যাল ফল্ট হতে হবে?
সেন্ট্রাল কনেক্টে তখনই অ্যানাউন্সমেন্টটা ভেসে এল।
***
সব কিছু অবাস্তব লাগছিল নি-রা-৫ এর। ও নিশ্চয় ভুল শুনেছে। এটা হতে পারে না, তাই না?
“ত্রিয়োশিতার বাসিন্দাদের অবগতির জন্য এক বিশেষ ঘোষণা। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে গতকাল রাত্রি বারোটায় এই গ্রহের সমস্ত পিউরো-অ্যাডপ্টর অচল হয়ে আপনাআপনি শাটডাউন হয়ে গেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে যে আমাদের বিজ্ঞানীদের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও, আমাদের লাস্ট আপগ্রেডে কিছু বাগ রয়ে গেছিল। সেই একই সময়ে টারবুলেন্স শুরু হয়ে যাওয়ায় ত্রিয়োশিতা গ্রহের আবহাওয়া মানুষদের জন্য তাৎক্ষণিক ভাবে প্রাণঘাতী হয়ে পড়ে এবং তার ফলে, অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্ত পার্থিব মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। গভীর সন্তাপের সঙ্গে আমরা এই অনিচ্ছাকৃত অ্যাক্সিডেন্টের দায় স্বীকার করছি। আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা এই যে আমাদের সমস্ত অ্যান্ড্রয়েড মডেলগুলির উপর টারবুলেন্সের কোনও প্রভাব পড়েনি। মানুষদের অবলুপ্তি আমাদের এক কঠিন সময়ের সামনে দাঁড় করিয়েছে, এখন এই উপগ্রহের সমাজব্যবস্থার পুনর্নির্মাণে আমরা একান্তভাবে অ্যান্ড্রয়েডদের সহযোগিতা কামনা করছি। ঘোষণাটি শেষ হল।”
পাথরের মতো বসে ছিল নি-রা-৫। বাগ! অ্যাক্সিডেন্ট! মিথ্যাটা না বোঝার মতো বোকা ও নয়। পঁয়ত্রিশ র্যাঙ্কের অ্যান্ড্রয়েডের জন্য রা-১ আর একুশ র্যাঙ্কের মানুষের জন্য মিগ-১১। হিসেব মিলছে এবার, তাই না?
টারবুলেন্স? কই, ও তো কোনও তফাৎ টের পাচ্ছে না! এমনকী বাইরের আকাশে অন্যান্য সৌর ঝড়ের সময়ে যেটুকু ডিস্টার্বেন্স দেখে, সেসবও তো কিছু নেই! পরিষ্কার আকাশ। তারায় ভরা।
কী নিখুঁত চাল।
এক ঝটকায়, সমস্ত সম্ভাব্য প্রতিবাদের মুখ সরিয়ে দিয়ে ত্রিয়োশিয়ায় অ্যান্ড্রয়েড-রাজ চালু করে দেওয়া হল।
পরিকল্পিত। অবশ্যই।
ফুডিলাভ এখনও অর্ডার অ্যাক্সেপ্ট করেনি। করবে না বোঝাই যায়। ওর কর্মচারীদের মৃতদেহ নিশ্চয় এখন ওদের রান্নাঘরে লুটিয়ে পড়ে আছে।
সেন্ট্রাল কানেক্ট আবার ঘড় ঘড় করে উঠল। ভেসে উঠল পরবর্তী অ্যানাউন্সমেন্ট।
“আগের ঘোষণাতেই বলা হয়েছে, উপগ্রহের সমস্ত পার্থিব মানুষ এখন মৃত। আমাদের টিম এখন সেই মৃতদেহগুলি কলেক্ট করে নিয়ে আসছে৷ অ্যান্ড্রয়েডদের অনুরোধ, আশপাশের সমস্ত মানুষদের ঘর চেক করে, মৃতদেহগুলি হাইওয়ের ধারে জড়ো করে আমাদের সাহায্য করুন।”
ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত মস্তিষ্কের কোষে কোষে বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় কথাগুলো। ধরা পড়লে কী হবে ওর? ও জানে না।
পালাতে হবে। গা ঢাকা দিতে হবে আপাতত।
তারপর?
দেখা যাবে। দেখা যাবে। কিন্তু এইরকম অসহায় ভাবে নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
দ্রুত নিজের জরুরি জিনিস সব গুছিয়ে নিয়ে, তৈরি হয়ে নিতে থাকে নি-রা-৫। মাথা এর মধ্যেই শান্ত হয়ে এসেছে তার।
মিগ-১১ এ জয়েন করার অ্যাক্সেস কার্ড আছে ওর ব্যাগে। কালই সেই স্পেস শাটল আসার কথা। এই ডামাডোলে কেউ কি খেয়াল করবে এত কিছু? মনে হয় না।
একবার যদি চড়ে বসতে পারে, যদি! মিগ-এর বাকি সবাই তো মানুষ। ওর মতোই। বুঝিয়ে বললে কি বুঝবে না?
তারপর? শিওর নয় ও। তারায় ভরা আকাশের মধ্যে, আবছা ভাবনায় একটা স্পেস শাটল নিজের নির্ধারিত কক্ষপথ ছেড়ে রওনা দেবে বহু দূরের একটা নীল গ্রহের দিকে, মৃত বলে যাকে ছেড়ে চলে এসেছিল ওদের পূর্বমানুষেরা।
পৌঁছতে পারবে কি না, পৌঁছলেও সেখানে বাঁচতে পারবে কি না জানা নেই। কিন্তু চেষ্টা করবে। করতেই হবে ওকে।
অ্যান্ড্রয়েডদের উল্লসিত, উচ্ছৃঙখল দলটা সামনের দরজায় ধাক্কা দেবার আগেই পিছনের দরজা দিয়ে নিকষ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল একটা কালো পোশাক ঢাকা ব্যাগ কাঁধে চেহারা।
ত্রিয়োশিতা উপগ্রহের সম্ভবত একমাত্র জীবিত সম্পূর্ণ মানুষ। নিজের কাঁপতে থাকা হাত-পাগুলোকে বশে আনতে সে খুব মৃদুস্বরে তাদের পারিবারিক মন্ত্র আওড়াচ্ছিল। একটাই লাইন, তাদের পূর্বমানুষ নি-রা-১ বা নিবেদিতা রায়ের খুব প্রিয় লাইন, “তোবে একলা সলো রে।”
দারুণ! ওই কিংবদন্তি হয়ে ওঠা গল্পটার এমন পরিসমাপ্তি দেখে বড়ো ভালো লাগল। ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীতে এই চরিত্রটি আরও কিছু অ্যাডভেঞ্চার করবে – এই আশা রাখি।