প্রফেসর শঙ্কু ও কারপেথীয় আতঙ্ক
লেখক: শুভাগত বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর) ও সুমিত রায়
ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সত্যের সঙ্গে কল্পনার রঙ মিশিয়ে রচিত এই কাহিনি উৎসর্গিত হল সত্যজিৎ রায়ের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
৩০শে নভেম্বর, গিরিডি
আজ আমার বৈজ্ঞানিক জীবনের এক স্মরণীয় দিন। বোধহয় স্মরণীয়তমও বলা চলে। আমার বিজ্ঞানচর্চার এই সুদীর্ঘ কাল ধরে অসংখ্য সম্মান আর পুরষ্কার আমি পেয়েছি সারা বিশ্ব থেকে। কিন্তু আজ আমার নিজের দেশ থেকে আমাকে যে সম্মান দেওয়া হল তাতে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। মনে হচ্ছে, আজ আমার বিজ্ঞান সাধনা সার্থক।
আমার জীবনে বহু দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীর কাজ গভীর রেখাপাত করেছে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তাঁদের অন্যতম। আমি যখন কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনা করছি, তখন প্রেসিডেন্সী কলেজে এক বক্তৃতা শুনতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। বস্তুতঃ আমার মাইক্রোসোনোগ্রাফ যন্ত্রের অনুপ্রেরণা আসে জগদীশচন্দ্রের উদ্ভিদের প্রাণ নিয়ে গবেষণা প্রকাশিত হবার পর। গাছের পাতা ছিঁড়লে তার যে যন্ত্রণা হয়, তা আমার এই যন্ত্রে ধরা পড়ে।
আজ জগদীশচন্দ্রের জন্মদিন। তিনি শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন এই গিরিডিতেই। বারগান্ডায় তাঁর বাড়ি শান্তিনিবাস এখন তাঁরই নামাঙ্কিত একটি বিজ্ঞান কেন্দ্র। সেখান থেকে আজ আমাকে দুটি কারণে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো – প্রথমতঃ, আমাকে তাঁরা জগদীশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারে সন্মানিত করলেন। দ্বিতীয় কারণটিই প্রধান – এই বাড়িতে জগদীশচন্দ্রের একটি বন্ধ সিন্দুক পাওয়া গেছে। তিন ফুট বাই দুই ফুটের এই সিন্দুকে সম্ভবতঃ জগদীশচন্দ্রের মূল্যবান গবেষণাপত্র আছে। বিজ্ঞান কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ চান এই সিন্দুক আমিই খুলি এবং এর ভেতরে যা আছে, তাঁর মর্মার্থ আমি-ই উদ্ধার করি। এই দায়িত্ব পেয়ে সত্যিই আমি আপ্লুত হয়ে পড়েছি। কর্তৃপক্ষ সিন্দুকটি দিন কয়েকের মধ্যেই আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।
বারগান্ডা থেকে ফেরার পথে যখন বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি, দেখি অবিনাশবাবু হন্তদন্ত হয়ে আমার বাড়ির দিক থেকেই আসছেন। আমায় দেখে বললেন – “ও মশাই, আপনার খোঁজেই গিয়েছিলুম। একবারটি আমার বাড়িতে চলুন না।” কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় ভদ্রলোক বললেন তাঁর ভাগ্নে কার্ত্তিক ছুটিতে মামার বাড়ি এসে অসুখ বাঁধিয়েছে। ঝাঝা থেকে ডাক্তার প্রতুলবাবুও দেখে গেছেন। কোনও ওষুধেই সারছে না। “আপনার ঐ আশ্চর্য বটিকায় যদি কাজ হয় –”; বুঝলাম অবিনাশবাবু মিরাকিউরলের কথা বলছেন। তাঁকে বললাম বাড়ি যেতে, আমি ওষুধ নিয়ে যাচ্ছি।
কার্ত্তিককে ওষুধ খাইয়ে বেরোতে যাচ্ছি, অবিনাশবাবু বললেন – “মশাই, ঐ কুলুঙ্গিটা দেখছেন? কদিন ধরে ঐটে এসে আস্তানা গেড়েছে। কিছুতেই যাচ্ছেনা, তাড়াতে যেতেও ভয় করছে, যদি টুঁটি কামড়ে ধরে!” ভদ্রলোকের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি একটা অন্ধকার কুলুঙ্গি থেকে একটা বাদুড় ঝুলছে। বাদুড় আমি আগে অনেক দেখেছি, ও নিয়ে ভাবার কিছু নেই, কিন্তু এই বাদুড়টার একটা বিশেষত্ব আছে। এ অঞ্চলে এত বড় বাদুড় থাকতে পারে জানা ছিলো না। সত্যিই অস্বস্তিকর।
“এটা নির্ঘাত রক্তচোষা বাদুড় মশায়।” – বললেন অবিনাশবাবু। আমি ভদ্রলোককে আস্বস্ত করলাম – “বাদুড়টা অস্বাভাবিক বড় ঠিকই, তবে রক্তচোষা নয়। সে বাদুড় আমাদের দেশে পাওয়া যায়না। আর, গপ্পে যে ভ্যাম্পায়ারের কথা পড়েছেন, সেসব বাদুড় আদৌ হয়না। সুতরাং আপনার এমনি কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই।” অবিনাশবাবু বললেন, “আপনার ঐ ভ্যানিশগান দিয়ে ওটার কিছু ব্যবস্থা করা যায় না?”
অ্যানাইহিলিন পিস্তলটা আমার পকেটে সব সময়েই থাকে, এখনো আছে। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে প্রাণী হত্যা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তবে অবিনাশবাবুর অসহায় অবস্থা দেখে আমার মায়া হচ্ছিল, তাছাড়া ঘরে অসুস্থ কার্ত্তিক রয়েছে, তাই বাদুড়টার দিকে তাক করে ঘোড়া টিপতেই একটা তীক্ষ্ণ তরলের ধারা বাদুড়টার ওপর গিয়ে পড়তেই সেটা বেমালুম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
অবিনাশবাবু বললেন – “বাঁচলাম মশাই। বেড়ে কল আপনার। ওটা কি ছিটোলেন বলুন তো বাদুড়টার গায়ে?”
মনে মনে বললাম, সেটা কি যদি আপনি বুঝতেন, তাহলে কি আর এখানে বসে থাকতেন? আমার এই বন্দুকের ভেতর একটা ভায়ালে ভরা থাকে আমারই আবিষ্কৃত অ্যানাইহিলিন অ্যাসিড। ঘোড়া টিপলেই তীর বেগে সেই অ্যাসিড গিয়ে পড়ে লক্ষ্যবস্তুর ওপর। তাতেই কার্য সিদ্ধি। আজ পর্যন্ত কোনও লক্ষ্যই ব্যর্থ হয়নি।
“কার্ত্তিক কেমন থাকে কাল সকালে জানাবেন।চলি।”, বলেই হাঁটা দিলুম বাড়ির দিকে।
১লা ডিসেম্বর
অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা। গতকালই অবিনাশবাবুর বাড়িতে বাদুড় মারলাম, আর আজ আমার জার্মান বন্ধু উইলহেলম ক্রোলের এই চিঠি। ক্রোল লিখেছে, রোমানিয়ার সিবিউ অঞ্চলের বিয়েরটান, ভ্যালিয়াভিলোর এরকম কয়েকটি গ্রামে গত দিন পনেরো ধরে গ্রামবাসীদের গরু, শূয়োর, ভেড়া এদের গলায় ফুটো করে কেউ রাত্রে রক্ত চুষে খাচ্ছে। কেউ কোনও কিনারা করতে পারছে না। কোনও মানুষের ওপর যদিও আক্রমণ হয়নি। স্থানীয় পুলিশও কিছু করতে পারেনি। আরো অদ্ভুত ঘটনা, ঐ সব মৃত পশুগুলোর গলায় যেমন পাশাপাশি দুটি ফুটো দেখা গেছে, তেমনি তাদের গায়ে ধারালো আঁচড় দিয়ে চামড়ার ওপর একটা অদ্ভুত নক্সা কেটে দিয়ে গেছে কেউ। ক্রোল নক্সাটা চিঠিতে এঁকেও দিয়েছে –
দেখে কতকটা বিদ্যুৎ চমকের মত লাগছে। ক্রোলের মতে এসব রক্তচোষা বাদুড় বা ভ্যাম্পায়ারের কাজ। ভ্যাম্পায়ার ব্যাট এভাবে রক্ত চুষে খেতে পারে বটে, তবে সেই ধরনের বাদুড় তো দক্ষিণ আমেরিকায় দেখা যায়। রোমানিয়ায় আসার কথা নয়। তাছাড়াও বাদুড় এভাবে কোনও পশুর গায়ে নক্সা আঁকতে পারে কিনা তার ব্যাখ্যা ক্রোল দিতে পারেনি।
তবে ব্যাপারটা চিত্তাকর্ষক সন্দেহ নেই। ক্রোল চাইছে আমি তার সঙ্গে রোমানিয়ায় যাই। সে আমাদের ইংরেজ বন্ধু জেরেমি সন্ডার্সকেও আলাদা চিঠি দিয়েছে যাবার জন্যে।
যদিও ভেবেছিলাম জগদীশচন্দ্রের সিন্দুক নিয়ে কাজ করব, কিন্তু ক্রোলের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারলাম না। বছরে একবার আমার এই দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। তাছাড়া রোমানিয়ায় আমি আগে কখনো যাইনি। তাই একটা এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম লিখে প্রহ্লাদকে পোস্ট অফিসে পাঠিয়ে দিলাম।
১১ই ডিসেম্বর, সকাল আটটা
একটু আগে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট এসে পৌঁছেছি। অটোপেনি বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকে যেতে হবে শহরের প্রধান রেল স্টেশন নর্থ-এ। ক্রোল ও সন্ডার্স গতকাল এসে পড়েছে, তারা আমার জন্য নর্থ স্টেশনে অপেক্ষা করবে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে যাব সিবিউ, যেখানকার গ্রামে ভ্যাম্পায়ারের উৎপাত হয়েছে।
১১ই ডিসেম্বর, বিকেল পাঁচটা, বিয়েরটান
সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ট্রেন সফর শেষে সিবিউ স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে আরো ঘন্টা খানেক পর আমরা পৌঁছলাম বিয়েরটান গ্রামে। থাকার জায়গা হল স্থানীয় সরাইখানায়। বেশ বড় গ্রাম এই বিয়েরটান। হাজার খানেক লোকের বাস এখানে। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল পাহাড়ের ওপর দূর্গের মত প্রাচীর ঘেরা এক প্রাচীন গীর্জা। বাইরে ঠান্ডা বাড়ছে, বাড়ছে অন্ধকারও। আজ আর কিছু করা যাবে না। কাল সকালে যা করার।
১২ই ডিসেম্বর
ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি গথিক স্থাপত্যের সাক্ষী ছটি মিনার দিয়ে ঘেরা চার্চের এই দূর্গটি। গোটা চার্চটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। তাতে এমন ১৯টি তালার ব্যবস্থা আছে, যা একসঙ্গে একটি মাত্র চাবির সাহায্যে খোলে। আমরা আজ সকালে এসেছি এই চার্চে। ফাদার সজ্জন ব্যক্তি। ক্রোল এসেই তাঁর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। একথা সেকথার পর সে ভ্যাম্পায়ারের প্রসঙ্গ তুলল। হাসিখুশী ফাদার গম্ভীর হয়ে বুকে ক্রশ আঁকলেন, কিছুই এ ব্যাপারে বলতে চাইলেন না। সন্ডার্স বলল, “লেটস গো টু দ্য ভিলেজ পিপল। তারা যদি কিছু বলে।”
চার্চ থেকে বেরিয়ে নানান লোককে জিজ্ঞেস করে করে যা জানা গেল, ক্রোলের চিঠিতে যা জেনেছি সেই রকমই। শেষ ঘটনাটি ঘটে দিন আষ্টেক আগে। তারপর এই গ্রামে আর কিছু হয়নি। কিন্তু তারপর থেকে ভ্যালিয়াভিলোর গ্রামে এই উৎপাত শুরু হয়েছে। বুঝলাম, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ভ্যালিয়াভিলোর।
১২ই ডিসেম্বর, দুপুর দুটো, ভ্যালিয়াভিলোর
বিয়েরটান থেকে ঘন্টা দেড়েকের পথ ভ্যালিয়াভিলোর। এখানেও প্রায় একই ধরনের একটি চার্চ আছে। এখানে এসে কাজের কাজ হল। গতকালই এক গ্রামবাসীর একটি গরু ভ্যাম্পায়ারের আক্রমণে মারা গেছে, এবং আমরা তার বাড়ি গেলে এখনো মৃত গরুটিকে দেখতে পেতে পারি।
তিনজনে যথাস্থানে গিয়ে হাজির হলাম। গ্রামবাসীদের চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। গরুটার গলায় দুটো বড় ছিদ্র, আর সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ার মত, সেটা হল তার পেটের ওপর বড় বড় আঁচড় দিয়ে সেই বিদ্যুতের মত নক্সা করা। বাড়িতে লোকের ভীড়। তারমধ্যে বিদেশী লোক দেখে যিনি এগিয়ে এলেন তিনি স্থানীয় চার্চের ফাদার। আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য শুনে তাঁরও মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, এসবই অশুভ আত্মার কাজ। “তোমরা জান তোমরা কোথায় এসেছ? ঐ যে পর্বতমালা দেখছ ঐ হল ট্রান্সিলভানিয়ার কারপেথিয়ান পর্বতমালা। তোমরা কাউন্ট ড্রাকুলার নাম শোননি?”
ব্রাম স্টোকারের কাউন্ট ড্রাকুলার গল্প কে না জানে? ট্রান্সিলভানিয়ার এক কেল্লায় এই কাউন্ট আর তার ভ্যাম্পায়ার সাঙ্গোপাঙ্গোদের গা হিম করা কাহিনি ছেলেবেলায় পড়েছি। কিন্তু সে তো গল্প মাত্র। ফাদারকে সে কথা বলতেই তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। “কে বলল গল্প? অতৃপ্ত আত্মা কখনো মুক্তিলাভ করেনা। তাছাড়া কাউন্টের ঘটনা ইতিহাস সম্মত। কেবল গল্পগাথাই নয়। তোমরা এই রহস্যের সমাধান করতে এসেছ? বুকের পাটা আছে তো? তাহলে আজ সন্ধ্যেতে চার্চে আমার ঘরে এস। আমি তোমাদের কিছু সাহায্য করতেও পারি।”
১২ই ডিসেম্বর, সন্ধ্যে ছটা
চার্চের ভেতর ফাদারের ঘরে নিভু নিভু মোমবাতির আলোয় একটা গোল টেবিলকে ঘিরে বসে আছি আমরা তিনজন আর ফাদার সরিন। সামনে চার কাপ ধূমায়মান চা। বাইরে শোঁ শোঁ শব্দে হিমেল বাতাস বইছে। ভূতের গল্প শোনার আদর্শ পরিবেশ বৈকি! ফাদার বলতে লাগলেন –
“ড্রাকুলা মোটেও নিছক বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা কল্পনার চরিত্র নয়। কাউন্ট ড্রাকুলা ছিলো এক অত্যাচারী রাজা। তার আসল নাম ভ্ল্যাড দ্য ইম্পেলার। ওয়ালাচিয়ার রাজা ভ্ল্যাডের মৃত্যু হয় টার্ক জাতিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে। বুখারেস্টের চল্লিশ কিলোমিটার উত্তরে স্ন্যাগভ লেকের মাঝখানে এক দ্বীপে এক মনাস্টেরি তৈরি করে ছিলেন ভ্ল্যাডের ঠাকুরদা। যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন ভ্ল্যাডের ধড় আর মুন্ড মনাস্টেরির সাধুরা কাছের জঙ্গলে খুঁজে পান। সেগুলি নিয়ে এসে মনাস্টেরিতে তা সমাধিস্থ করা হয়। স্ন্যাগভ মনাস্টেরি ভ্ল্যাডের অত্যাচারের সাক্ষী। এখানে একটা ছোট কুঠুরি আছে। শাস্তি দেবার জন্য অভিযুক্তকে রাজা এখানে নিয়ে আসতেন।তারপর সেখানে রাখা মা মেরির মূর্তির সামনে তাকে নতজানু হতে বলতেন। যেই সে নতজানু হত, তখনই একটা ফাঁদ দরজা খুলে যেত, আর বেচারীর দেহটা নীচে পড়ে গিয়ে সার সার তীক্ষ্ণ শলাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। ঐ ঘরে এরকম অনেক নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে। ১৯৩৩ সালে ডিনু রসেটি নামে এক প্রত্নতত্ববিদ স্ন্যাগভ মনাস্টেরিতে ভ্ল্যাডের সমাধি খনন করেন। কিন্তু আশ্চর্য, কফিন খুলে দেখেন সেটি ফাঁকা! তাই বলছিলাম, অতৃপ্ত ড্রাকুলার আত্মা সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবার তোমরা স্ন্যাগভ যাবে কিনা সেটা নিজেরাই ঠিক কর। কিন্তু প্রাণের মায়া থাকলে না যাওয়াই শ্রেয়। এই বোতলে চার্চের পবিত্র জল আছে। সঙ্গে রেখে দাও, কাজে লাগতে পারে। ঈশ্বর তোমাদের রক্ষা করুন।” – এই বলে ফাদার একটা বোতল ক্রোলের হাতে দিলেন।
চার্চ থেকে বেরিয়ে সন্ডার্স বলল – “বুজরুকির আর জায়গা পায়না। ড্রাকুলা নাকি সত্যি ঘটনা! তোমরা কি চাইছ?”
ক্রোল বরাবরই অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী। সে বলল, “স্ন্যাগভ যাওয়াই ভালো। কিছু না পেলে ফিরে যাব। তাছাড়া এরকম একটা ভৌতিক জায়গার প্রতি আমার যে দুর্বলতা আছে সেতো জানোই। শঙ্কু কি বলো?”
আমি বললাম, “ড্রাকুলা সত্যি না মিথ্যে জানি না, কিন্তু গল্পটা আকর্ষণীয়। আর, এতদূর যখন এসেছি, শেষটাও দেখা যাক।” সন্ডার্স গজগজ করতে লাগলো। আমি তাকে শান্ত করে বললাম, “চল, এখন মাথা ঠান্ডা করে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমোও, কালকের কথা কাল ভাবা যাবে।”
সরাইখানায় মাঝরাতে টের পেলাম তখনো বাইরে ঠান্ডা হাওয়ার পাগলামী চলছে। তার মধ্যে হঠাৎ গ্রামের দূর কোনও বাড়ি থেকে একটি গরুর মরণ চিৎকার শিরদাঁড়ার মধ্যে ঠান্ডা স্রোত চালিয়ে দিলো।
১৩ই ডিসেম্বর, সন্ধ্যে সাতটা, স্ন্যাগভ
ভ্যালিয়া ভিলোর থেকে সাড়ে তিনশ কিলোমিটার পথ প্রায় ঘন্টা পাঁচেকে পাড়ি দিয়ে বেলা তিনটে নাগাদ পৌঁছেছি স্ন্যাগভে। রোমানিয়ার ইলফভ অঞ্চলের এক অরণ্যময় গ্রাম স্ন্যাগভ। জনসংখ্যা খুবই কম। স্থানীয় এক মেষপালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল গ্রাম থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দু কিলোমিটার উত্তরে গেলে পড়বে এক সুবিশাল লেক। উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে প্রায় ১২ কিলোমিটার বিস্তৃত এই লেক স্ন্যাগভ। এই লেকেরই উত্তর পূর্ব প্রান্তে এক দ্বীপে রয়েছে স্ন্যাগভ মনাস্টেরি।
পরিত্যক্ত এই মনাস্টেরিতে গ্রামবাসীরা কেউই যায়নি এবং জঙ্গল পেরিয়ে ওমুখো যাবার নামও কেউ করেনা। জঙ্গলে কেউ কাঠ কাটতে গেলেও বেলা থাকতে থাকতে ফিরে আসে। বুঝলাম যা করার নিজেদেরই করতে হবে। সন্ডার্স জিজ্ঞেস করলো কোনও নৌকা পাওয়া যাবে কিনা। জানা গেল যেহেতু কেউই লেকের দিকে যায়না, তাই নৌকারও কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে একেবারে উল্টো দিকে, অর্থাৎ স্ন্যাগভের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে ১২ কিলোমিটার গেলে সেখানে কিছু জেলেদের বস্তি আছে, তাদের কাছে নৌকা আছে। অর্থাৎ, আমাদের পুরো উল্টো দিকে গিয়ে জলপথে আবার স্ন্যাগভ গ্রামের দিকে, অর্থাৎ ফের ১০ কিলোমিটার ফিরতে হবে। বিকেল হয়ে আসছে, সুতরাং কালকের জন্য অপেক্ষা। একটা সস্তা সরাইয়েঠাঁই হয়েছে আমাদের। গরম সুপের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করছি, স্থানীয় লোকজন সন্দেহের চোখে বারবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো পাগলই ভাবছে।
১৪ই ডিসেম্বর, বেলা তিনটে
স্ন্যাগভ থেকে এক ভাড়া করা ঘোড়ার গাড়িতে এসে পৌঁছেছি লেকের উল্টো দিকে। ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে দশটা। এই রাস্তা গ্রামের অন্য দিক দিয়ে, ফলে পথে জঙ্গলও পড়েনা। যাবার পথে লেকও চোখে পড়ল না। সেটা চোখে পড়ল একদম শেষে গিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই। বিশাল সীমাহীন বিস্তার। মধ্যে মধ্যে কোথাও চর জেগেছে, তাতে পাখির ঝাঁক। লেকের ধারে ছোট এক ধীবর পল্লী। লেকের মাছ ধরাই তাদের জীবিকা। আমাদের নামিয়ে দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চলে গেল। জেলেদের আস্তানার কাছে যাবার আগেই দেখি তারাই দল বেঁধে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ক্রোল তাদের জিজ্ঞেস করল তারা নৌকা ভাড়া দেবে কিনা। কোথায় যাব জিজ্ঞেস করতে আমি বললাম আমরা স্ন্যাগভ মনাস্টেরিতে যেতে চাই। এই কথা যেই না বলা, তাদের মধ্যে ভীষণ একটা শোরগোল পড়ে গেলো। এরকম অদ্ভূত আর মারাত্মক শখ যে কারোর হতে পারে তারা ভাবতেই পারেনি। শেষে একজন বয়স্ক মাতব্বর গোছের লোক এসে আমাদের নানান ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো, ওই দ্বীপ অত্যন্ত অশুভ। আমাদের কি প্রাণের মায়া নেই? কিন্তু আমরা অনড় দেখে শেষ অবধি তারা হাল ছেড়ে দিলো, কিন্তু এটাও স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে নৌকা পাওয়া যাবেনা।
তাহলে আমাদের সাঁতার কেটে যেতে হবে নাকি? সাঁতার আমরা তিনজনেই জানি। কিন্তু এই ঠান্ডা লেকের জলে দশ কিলোমিটার সাঁতরানো? নাহ, অন্য কিছু ভাবতে হবে। অনেকক্ষণ থেকে দেখি এক যুবক ঝুপড়ির এক ধারে বসে আমাদের কথা শুনছিল আর চুরুট খাচ্ছিল। এবার সে উঠে এসে আমাদের কাছে প্রস্তাব দিলো যে সে এখানেই থাকে, নাম গেভরিল, তাকে সময় আর টাকা দিলে সে একটা ভেলা বানিয়ে দিতে পারে। কত সময় লাগবে জিজ্ঞেস করায় সে বলল তার কাছে ভেলা বানাবার কাঠ নেই, পাশের গ্রাম থেকে কাঠ জোগাড় করে ভেলা বানাতে বিকেল হয়ে যাবে। আর খরচ পড়বে ৩০০ লেউ, মানে প্রায় ৫০০০ টাকা! অর্থাৎ, ঝোপ বুঝে কোপ মারা। কিন্তু আমাদের কাছে দ্বিতীয় কোনও উপায়ও নেই, তাই রাজী হয়ে যেতে হল। টাকা নিয়ে সে বলল –“তোমরা এখানে বিশ্রাম কর, আমি কাঠ যোগাড় করতে যাচ্ছি।”
আমরা বসেই আছি, বসেই আছি। সন্ডার্স বলল – “দেখো, আদৌ আসে কিনা।” ক্রোল তার ভাষায় একটা মোক্ষম গালাগালি দিয়ে অধৈর্য ভাবে পায়চারী শুরু করল। শেষ পর্যন্ত যখন গেভরিল কাঠের বোঝা নিয়ে ফিরল, তখন ঘড়িতে বেলা তিনটে। মেঘলা আকাশ, যে কোন সময়ে ঝড়জল হতে পারে। এখন শুধু অপেক্ষা।
১৫ই ডিসেম্বর, বেলা ১১টা
স্ন্যাগভের সরাইখানায় বসে ডায়রী লিখছি। গতকালের অভিজ্ঞতা। ভেলা তৈরি যখন শেষ হল, তখন সন্ধ্যে। আকাশ কালো হয়ে গেছে মেঘে। ভেলা লেকের জলে ভাসিয়ে তিনজনে চড়ে বসলাম। দুটো দাঁড় আছে। ক্রোল আর সন্ডার্স দাঁড় টেনে ভেলা চালাতে লাগলো। এখানে ওখানে চর জেগে আছে, তাতে যাতে ধাক্কা না লাগে তার জন্য মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে দেখে নিতে হচ্ছে। দশ কিলোমিটার ভেলা বেয়ে যখন দ্বীপে পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে রাত প্রায় বারোটা। চারিদিক নিস্তব্ধ। সাবধানে ভেলা থেকে নেমে আগে সন্ডার্স সেটাকে একটা গাছের গুঁড়িতে শক্ত করে বাঁধল। তারপর আমরা দ্বীপের ভেতরে ঢুকলাম। মানুষের পা বোধহয় বহুকাল এই দ্বীপে পড়েনি। কোনও জীবজন্তুও চোখে পড়লনা।
দ্বীপের ঠিক মাঝখানে অনেকখানি জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন পরিত্যক্ত স্ন্যাগভ মনাস্টেরি। ভেতরে ঢোকার কাঠের ফটক ভগ্নপ্রায়। সামনে একটা ফোয়ারা, আজ আর তার কোনও ভূমিকা নেই। বাইজানস্টাইন স্টাইলে তৈরি মনাস্টেরির চারটে টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। ফটক সরিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। নিকষ অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকতে হল। ঢুকতে প্রথমেই পড়ল প্রধান হল। অজস্র ফ্রেসকো আর ম্যুরাল দিয়ে সাজানো উপাসনা গৃহ। ঝুল আর মাকড়সার জালে ঢেকে আছে প্রাচীন সব আসবাবপত্র, পেন্টিং। ঘরের ঠিক মাঝখানে দেখি একটি সমাধি। ফলকের গায়ে ল্যাটিনে নাম লেখা –Vlad Tepes III – অর্থাৎ এই সেই ড্রাকুলা ভ্ল্যাড দ্য ইমপেলারের সমাধি, যার কথা ভ্যালিয়া ভিলোরের ফাদার বলেছিলেন। এই সমাধি খনন করে কিন্তু দেখা গেছিল কফিন শূণ্য। তাহলে কোথায় গেল ভ্ল্যাডের মৃতদেহ?
ঘরের কোণে কাঠের তৈরী তিনটে বন্ধ দরজা। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে করে এঁটে বসে গেছে। ক্রোল বলল – “লেটস ব্রেক দ্য ডোরস”। ভাঙতে হল না। তিনজনের সম্মিলিত ধাক্কায় প্রথম দরজাটা খুলে গেল। টর্চের আলোয় ভেতরে ঢুকলাম তিনজনে। বিশ্রী গন্ধ হয়ে গেছে ঘরে। আলো ফেলতেই দেখা গেল একটা পুরোন ছাপার ট্রেডল মেশিন! কি ছাপা হত এই মেশিনে? সন্ডার্স বলল – “মে বি রিলিজিয়াস বুকস, অনেক চার্চে দেখেছি প্রেস ছিল”। হবেও বা। ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
এবার দ্বিতীয় ঘরের পালা। দরজা খুলতেই একটা সোঁদা গন্ধ নাকে এল, আর তার সঙ্গে বহুদূর থেকে আসা একটা একটানা শব্দ। টর্চের আলো ফেলে দেখা গেল সেটা ঘর নয়, একটা সুড়ঙ্গ, ক্রমশ ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। কি আছে এই সুড়ঙ্গের শেষে? আমি বললাম, গিয়ে দেখা যেতে পারে, কিন্তু নামা যত সহজ হবে, ওঠাটা তত মুশকিলের। সন্ডার্সের সঙ্গে কাঁধে ঝোলানো দড়ির গোছা ছিল। সে সেটাকে ঘরের একটা থামের সঙ্গে বেঁধে আমাদের হাতে ধরিয়ে বলল – “এটা ধরে নামব, এটা ধরেই উঠব। চলো”। যত ভেতরে ঢুকছি, তত শুনি সেই আওয়াজটা জোর আর স্পষ্ট হচ্ছে। জলের বয়ে চলার শব্দ। তাহলে কি এই সুড়ঙ্গ স্ন্যাগভ লেকের তলা দিয়ে গেছে? এর শেষ কোথায় মিশেছে? আরো কিছুটা যাবার পর দেখা গেল পথ বন্ধ। পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গের মুখ গাঁথা। হয়তো একসময় এই সুড়ঙ্গ কাজে লাগানো হত, তারপর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পণ্ডশ্রম। ক্রোল বলল – “চলো, ওপরে ওঠা যাক”।
তৃতীয় দরজাটা খুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল। অতিকষ্টে যখন দরজাটা কিছুটা ফাঁক হল দেখি ওধারে একটা কিছু দরজার গায়ে লাগান আছে, যার জন্য দরজাটা নড়ানো যাচ্ছিলো না। ঐ ফাঁক দিয়েই একে একে তিনজনে ভিতরে ঢুকলাম। টর্চের আলো ফেলতেই দুটো জিনিস চোখে পড়ল – এক, দেওয়ালে টাঙ্গানো দুটি অয়েল পেন্টিং – একটিতে মুক্তোর মুকুট মাথায়, চওড়া গোঁফ ওয়ালা এক রাজপুরুষ, চোখে মুখে নিষ্ঠুরতা। ছবির নিচে ভ্ল্যাডের নাম লেখা। বুঝলাম এই হলেন কুখ্যাত ভ্ল্যাড দ্য ইমপেলার, যিনি হাজার মানুষকে শূলবিদ্ধ বা ইমপেল করেছিলেন। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে যীশুখ্রীস্টকে হাত বাঁধা অবস্থায় সিংহাসনে বসা ভ্ল্যাডের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে। এই ছবিটা দেখে সন্ডার্স চেঁচিয়ে উঠলো – “এতো যীশাসের ক্রুশিফিকেশনের আগে বিচারের ছবি। এই ছবি আমি আগে ইতালীর মিউজিয়ামে দেখেছি – কিন্তু সেখানে ভ্ল্যাডের বদলে ছিলো যীশাসের বিচারক পন্টিয়াস পিলেট। কি ভয়ানক, নিজেকে স্বয়ং যীশাসের বিচারক ভাবার ধৃষ্টতা ছিল এই ভ্ল্যাডের।”
এবার চোখ গেল দ্বিতীয় বস্তুটিতে, যা এতক্ষণ দরজার পিছনে থেকে দরজাটা খুলতে বাঁধা সৃষ্টি করছিল – একটা সিন্দুক! ডালা বন্ধ, ডালার ওপর একটা বাদুড়ের অবয়ব আঁকা, আর নীচে ল্যাটিনে ভ্ল্যাডের নাম। তাহলে এতেই কি ভ্ল্যাডের প্রকৃত কফিন আছে? নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ নিজে শুনতে পাচ্ছি। তিনজনের কারুর মুখেই কথা নেই।এক সময় ক্রোল বলল- “ডালাটা খোলা যাক”। সন্ডার্স আর আমি মৃদু আপত্তি করলেও তা ধোপে টিকলো না। এইসব কফিন ঘাঁটাঘাঁটির ফল যে কি হয় তার হাড়ে হাড়ে অভিজ্ঞতা আমার আগে হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ক্রোলই কফিনের ডালায় হাত লাগালো এবং অতি সহজেই সিন্দুকের ডালাটা খুলে গেল।
সিন্দুকের ভেতর ছিল সিল্কের শতচ্ছিন্ন কাপড়ে মোড়া একটি কঙ্কাল। তার ডান হাতে একটি সোনার আংটি, আর বাঁ হাতে সোনার বালা। ক্রোল আর সন্ডার্স দুজনে মিলে কঙ্কালটা সিন্দুকের বাইরে মাটিতে শুইয়ে যেই কাপড়ের আবরণটা খুলেছে, আমাদের চোখের সামনে এক আশ্চর্য অতিপ্রাকৃতিকঘটনা ঘটে গেল। আমরা দেখলাম দেখতে দেখতে কঙ্কালটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, কেবল পড়ে রইল আংটি আর বালাটা! এই ঘটনার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। কাজেই এই অবস্থাটা কাটতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো।
ক্রোল বলল, “তাহলে কি ড্রাকুলা এখান থেকে অন্তর্হিত হয়ে অন্য কোথাও আবির্ভূত হবে? এর হাত থেকে কি কোনও পরিত্রাণ নেই?” এ প্রশ্নের উত্তর আপাততঃ আমাদের কারুর কাছেই নেই। ভবিষ্যতই এর জবাব দেবে।
সন্ডার্স শেষ পর্যন্ত যখন বলল – “শঙ্কু, আমার ভালো লাগছে না, চলো বাইরে যাওয়া যাক”, তখন সম্বিত ফিরে পেলাম। সত্যি বলতে কি, ভালো আমারও লাগছিলনা। তিনজনে তাড়াতাড়ি সেইভাবেই বাইরে বেরিয়ে এলাম। মনাস্টেরির বাইরে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি নেমে গেছে। কিন্তু এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না। বৃষ্টি মাথায় করেই ফিরব ঠিক করলাম। শনশনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির ফোঁটাগুলোযেন তীক্ষ্ণ শলাকার মতো গায়ে মাথায় ফুটছে। কিন্তু এই আবহাওয়ায় ভেলা চালানোই তো মুস্কিল। আমি বললাম, জলে ডুবে অপঘাতে মরার চেয়ে একটু অপেক্ষা কর। বৃষ্টির প্রকোপ একটু কমলেই বেরিয়ে যাব।
একেকটা মুহূর্ত যেন একেকটা প্রহর। সময় আর কাটতেই চাইছেনা। একটা সময় বৃষ্টি থামতে সন্ডার্স বলল – “শঙ্কু, এসেছি যখন, দ্বীপটার চারপাশটা লেক বরাবর একবার টহল দিয়ে নেওয়া যাক”। সেই মত হাঁটতে হাঁটতে যখন আমরা উত্তর-পূর্ব অর্থাৎ স্ন্যাগভ ভিলেজের দিকটায় গেছি, তখন হঠাৎ টর্চের আলোয় চোখে পড়ল জলের ধারে একটা গাছের গুঁড়ির ছাল উঠে গেছে – ঠিক যেন এখানে জোরে দড়ি বাঁধা হয়েছিল। ক্রোল বলল – “অদ্ভূত তো!” সন্ডার্স তখনই বলে উঠল – “লুক হিয়ার”। দেখি ঝোপের মধ্যে একটা ভাঙ্গা নৌকার দাঁড় পড়ে আছে। তার মানে কি এই দ্বীপে কারুর আনাগোনা আছে, যে কিনা গ্রামের দিক থেকে নৌকায় আসা যাওয়া করে, আর ঐ গাছে নৌকাটা বাঁধে? কে সে? আপাতত এ প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছে নেই।
এবার ফেরার পালা। বৃষ্টি ধরেছে। ভেলা ছেড়ে দেওয়া হল। ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে স্ন্যাগভ দ্বীপ। হঠাৎ তখন চোখে পড়ল একটা বাদুড় মনাস্টেরির ছাদের থেকে উড়তে উড়তে লেকের ওপর দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল। বিশাল বাদুড়, অবিনাশবাবুর বাড়ি যেটা দেখেছিলাম, তার চেয়েও বড়। আবার দশ কিলোমিটার যাত্রা। তবে এবার হাওয়া থাকায় প্রায় অর্ধেক সময়ে আমরা যখন তীরে এসে নামলাম, তখন রাত চারটে। ভেলাটাকে ডাঙ্গায় তুলে ক্রোল বলল – “ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। নইলে গ্রামে ফেরার গাড়ি পাবনা। চলো,গেভরিলের আস্তানায় মাথা গোঁজা যাক”।
সকাল হলে বেরিয়ে দেখি আকাশ পরিষ্কার হয়েছে, রোদ-ও উঠেছে। গেভরিলকে বলতে সে একটা দু’ঘোড়ায় টানা গাড়ি জোগাড় করে দিল, গাড়িটার ভিতরটা অনেকটা আমাদের দেশের গরুর গাড়ির মতো – ছই দেওয়া। গাড়িটায় আমরা তিনজন ওঠার পরেও অনেকটা জায়গা রয়েছে দেখে আমার মনে হল ভেলাটা তো আমরা দাম দিয়ে কিনেছি। ওটা সঙ্গে করে নিয়ে নিলে কেমন হয়? যদি ঐ দ্বীপে আবার যেতে হয়, এভাবে ঘুর পথে না গিয়ে গ্রামের দিক থেকে যাওয়াই সহজ হবে। ক্রোল আর সন্ডার্সও আমার সঙ্গে একমত হল। অতঃপর সবাই মিলে রওনা হলাম গ্রামের দিকে।
লেখা বন্ধ করি। বাইরে চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে কিসের।
১৫ই ডিসেম্বর, বিকেল চারটে
ঘটনার নাটকীয় মোড়। স্ন্যাগভের সরাইখানা। এখানে একটা ঘরে ক্রোল আর সন্ডার্স, আর আরেকটা ঘরে আমি একা ছিলাম। এই মূহুর্তে আমার ঘরে দ্বিতীয় এক ব্যক্তি আপাতত বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
সকালে শোরগোল শুনে সরাই-এর বাইরে গিয়ে দেখি গ্রামের যত লোক সব বোধহয় জড়ো হয়েছে, সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল এই গ্রামে গত রাত্রে গ্রামবাসীদের একজনের খোঁয়াড়ের দুটি শূয়োর মারা গেছে – দুটিরই গলায় ছিদ্র করে রক্ত চোষা হয়েছে। জায়গাটা দেখতে চাইলে ওরা সঙ্গে করে আমাদের নিয়ে গেল। অবিকল ভ্যালিয়া ভিলোরের মত ঘটনা – এবারেও শূয়োর দুটোর গায়ে সেই একইরকম আঁচড়ের চিহ্ন।
হঠাৎ আমার মনে একটা সন্দেহ উঁকি মারল। গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করলাম গতকাল আমরা ছাড়া আর কোনও বাইরের লোক গ্রামে এসেছিল কিনা। সবাই একবাক্যে জানালো আসেনি। ততক্ষণে আমি ঠিক করে ফেলেছি কি করণীয়। ক্রোল আর সন্ডার্সকে আলাদা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমার মতলব বললাম। শুনে ওরাও রাজী। যে ঘোড়ায় টানা গাড়িটায় সকালে আমরা এসেছি সেই গাড়িটা এখানেই রয়েছে এখনো। তার মালিককে বলতেই সে জঙ্গলের পথে দু কিলোমিটার গিয়ে ভেলা সমেত আমাদের লেকের ধারে পৌঁছে দিতে রাজী হয়ে গেল।
লেকের এপ্রান্ত থেকে দূরে দ্বীপটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভেলাটা সঙ্গে করে নিয়ে আসার উপকারিতাটা এখন বুঝতে পারছি। জলের ধারে একটু এদিক ওদিক খুঁজতেই যা চাইছিলাম পেয়ে গেলাম। এখানেও গাছের গুঁড়িতে নৌকা বাঁধার দাগ, আর তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা কালকের বৃষ্টিতে ভেজা নরম মাটিতে জুতো পরা পায়ের ছাপ। মন বলছে, সব রহস্যের সমাধান আছে ঐ দ্বীপে।
তিনজনে বিপুল উৎসাহে আধঘন্টার মধ্যে দ্বীপে পৌঁছে প্রথমেই ভেলাটা কালকের দেখা গাছের গুঁড়িতে বাঁধলাম। এখানেও দেখি স্পষ্ট জুতোর ছাপ, এবং সেই ছাপ চলে গেছে সোজা মনাস্টেরির দিকে। কাল রাত্রে যে পরিবেশে এসেছিলাম, আজ রোদ ঝলমল দিনে সেই গা ছমছমে আতঙ্কের ভাবটা কেটে গেছে। পায়ের ছাপ মনাস্টেরির মধ্যে ঢুকে সোজা চলে গেছে আমাদের কালকের তিন নম্বর দরজা পর্যন্ত। কাল আমরা এই দরজাটা বন্ধ করে আসিনি। আলতো করে ভেজানো রয়েছে। টেনে খুলতে যাব, ক্রোল আমার হাতটা চেপে ধরল। সন্ডার্স ঘরের কোণ থেকে একটা বড় পিতলের দণ্ডতুলে নিল, আমি পকেট থেকে বের করলাম আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী অ্যানাইহিলিন পিস্তল।
ঘরে ঢুকে দেখি সামনে সেই খোলা সিন্দুক। তারমধ্যে যা দেখলাম তা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। দেখি সিন্দুকটার মধ্যে গুটিসুটি মেরে একটা মাঝারি হাইটের লোক ঘুমিয়ে আছে! ঝাঁকড়া চুল, এক মুখ দাড়ি, পরনে সার্ট প্যান্ট, জ্যাকেট, পায়ে কাদামাখা জুতো। সন্ডার্স “স্কাউন্ড্রেল” বলে লোকটার জামার কলার ধরে তাকে টেনে তুলল। হঠাৎ এই আক্রমণে ঘুম ভেঙ্গে লোকটা হাউমাউ করে উঠেই সামনে আমাদের দেখে চুপ করে গেল। দেখলাম ভীতু প্রকৃতির লোক। সন্ডার্স তাকে টেনে সিন্দুকের বাইরে বের করে জিজ্ঞেস করল – “কে তুই? এখানে কি করছিস?”
লোকটা ভয়ে ভয়ে বলল তার নাম যোশেফ। সন্ডার্স বলল – “ইংরেজ। তুই এখানে কি করছিস? এলি-ই বা কি করে?” যোশেফ যা বলল, আমিও ঠিক তাই স্পন্দেহ করেছিলাম। জঙ্গলের দিকে লেকের ধারে যে নৌকা বাঁধার দাগ দেখেছিলাম, সেই দিকেই ঠিক আমাদের মতো ভেলা নিয়ে যোশেফ কাল রাত্রে গ্রামে যায়। সেখানে গিয়ে সে দুটি শূয়োরের রক্ত পান করে। তারপর রাত থাকতেই আবার এখানে এসে সিন্দুকে গা ঢাকা দেয়।
“আর কঙ্কাল? সেটা কার, যেটা এই সিন্দুকে ছিল?”, আমি জিজ্ঞেস করলাম। এবার যোশেফ অবাক। কঙ্কালের কথা সে নাকি কিছুই জানেনা। আশ্চর্য তো! সন্ডার্স তাকে জিজ্ঞেস করল – “তুমি রক্ত খাও কেন?” ততক্ষণে যোশেফ একদম ভেঙ্গে পড়েছে। হাত জোড় করে সে বলল –“দোহাই তোমাদের, আমি খুব ক্লান্ত। আমাকে একটু খাবার জল দাও আর ঘুমোতে দাও। আমি সব বলব”। ক্রোল আমাকে বলল – “শঙ্কু, এই লোকটাকে গ্রামে নিয়ে চলো। ওর কাছ থেকে সব শুনলে তবেই এই রহস্যের সমাধান হবে”। আমারও তাই মত। যোশেফ কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। বলছিলো সে দিনের আলোয় তাকাতে পারেনা।অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজী করানো হল। কাজেই তাকে সঙ্গে নিয়ে যখন আমরা লেক পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে সরাইখানায় পৌঁছলাম, তখন দুপুর।
যোশেফের জায়গা হল আমারই ঘরে। ক্রোল আর সন্ডার্স দুজনেই প্রবল আপত্তি তুলেছিল ওর সঙ্গে এক ঘরে আমাকে থাকতে দিতে। আমি ওদের বোঝালাম, আমি যথেষ্ট সাবধানেই থাকব। তাছাড়া, যোশেফ যে কোনও মানুষের রক্ত খেয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাজেই আমার চিন্তার অত কারণ এই মুহূর্তে নেই। রাত্রে দরকার হলে ভাবা যাবে।
সে ঘরে এসেই প্রচুর জল খেয়ে সেই যে ঘুমোল, মনে হয়না সন্ধ্যের আগে সেই ঘুম ভাঙবে। এদিকে আমরা তিনজনে অধীর আগ্রহে, কৌতূহলে ফেটে পড়ছি। অনেক প্রশ্ন রয়েছে যোশেফের কাছে – কেন সে রক্ত খেল? সেই কি আগের ঘটনাগুলোর জন্যে দায়ী? যোশেফ তো সাধারণ একটা মানুষ, তাহলে এই কাজ সে করছেই বা কেন? তার চেয়েও আশ্চর্য সেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া নরকঙ্কাল। নাঃ। যোশেফ না ওঠা পর্যন্ত এর উত্তর পাওয়া যাবে না।
১৫ই ডিসেম্বর, রাত ন’টা
যোশেফের ঘুম ভাঙ্গলো সন্ধ্যে ছটা নাগাদ। ইতিমধ্যে সন্ডার্স তার জন্যে গরম সুরুয়ার বাটি নিয়ে এসেছে। তার সামনে আমরা তিন ডাকসাইটে বৈজ্ঞানিক। সুরুয়ায় চুমুক দিতে দিতে শুরু হল আমাদের কৌতূহল নিবারনের পালা। যোশেফ তখনো ক্লান্ত, বড় বড় হাই তুলছে। হঠাৎ তার হাই তোলা দেখে সন্ডার্স বলল – “বড় করে হাঁ করো তো”। তারপর সে যোশেফের মুখের ভেতর ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলো। আমি জানি সে কি দেখছে। আমাদের মুখে ক্যানাইন নামের যে দাঁত থাকে, ভ্যাম্পায়ার বা ড্রাকুলাদের সেটাই হয় অনেক বড়, আর ছুঁচালো, যাকে বলে ফ্যাং। যোশেফের মুখে এধরনের কোনও দাঁতই নেই। এতে আমাদের সন্দেহ হল। সে সত্যি কথা বলছে তো? ক্রোল চাপ দিতে শেষে যোশেফ তার কোটের ভেতরের পকেট থেকে বের করল বাঁশ দিয়ে তৈরি নকল ফ্যাং। সেটা দিয়ে সে শুয়োর গুলোর গায়ে ফুটিয়ে গর্ত করত, তারপর সেই ক্ষতস্থানে চুমুক দিয়ে রক্ত পান করত।
“কিন্তু কেন?” – আমি জিজ্ঞেস করলাম।যোশেফ বলল – “আমায় তো তা করতেই হবে, আমিই তো ড্রাকুলা”। মানে? এসব কি বলছে যোশেফ? “আমরা সাত ভাই। আমি ছোট। আমার বাবারও ছয় দাদা। তাই আমি ড্রাকুলা”।
ক্রোল ফিসফিস করে বলল – “সেভেন্থ সন অফ এ সেভেন্থ সন! ইউরোপের লোককথায় আছে, যদি কোনও ব্যক্তির পরপর সাতটি ছেলে হয়, এবং সেই সাত নম্বর ছেলেরও যদি এরকম পরপর অন্তত সাতটি ছেলে হয়, তাহলে সেই সপ্তম ছেলে নানান অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। কখনো তা শুভ – সব রোগ নিরাময় করতে পারে, কখনো তা অশুভ – তারা ভ্যাম্পায়ার বা ড্রাকুলা হয়।”
হঠাৎ বিদ্যুতের মত আমার মাথায় একটা চমক খেলে গেল। মনে পড়ল, যতগুলো প্রাণী প্রাণ হারিয়েছে, তাদের গায়ে সেই আঁচড় –
আমি ভেবেছিলাম বিদ্যুতের রেখার ছবি, এতো তলায় তলায় লেখা দুটো সাত, সেভেন্থ সন অফ এ সেভেন্থ সন! যোশেফ স্বীকার করল, এটাও তার কাজ।
কিন্তু এতো গল্পকথা। যোশেফ কি সত্যিই ড্রাকুলা? ড্রাকুলা কি আদৌ আছে? তাছাড়া এই রকম একজন দুর্বল, রুগ্ন, ভীতু লোকের চরিত্রের সঙ্গে ড্রাকুলার চরিত্র কখনই খাপ খায়না। কিন্তু যোশেফের এক কথা। শেষে রেগে গিয়ে বলল – “আমি ক্রিস্টোফার ব্যাথোরির ছেলে। আমি মিথ্যে বলিনা”।
“দাঁড়াও, দাঁড়াও”।– যোশেফকে থামাল সন্ডার্স। “ব্যাথোরি ? মানে, তুমি কি এলিজাবেথ ব্যাথোরির বংশধর?”
যোশেফের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো – “তোমরা এলিজাবেথের কথা জানো? এলিজাবেথের এক ছেলে মিকলস আমার দাদুর বাবা। যদিও এর নাম তোমরা ইতিহাসে নাও পেতে পারো”। এলিজাবেথ ব্যাথোরির ব্যাপারটা আমার জানা ছিলো না। সন্ডার্সকে জিজ্ঞেস করতে সে এক চমকপ্রদ তথ্য পেশ করল।
এই এলিজাবেথ ব্যাথোরি সপ্তদশ শতাব্দীতে কার্পেথিয়ান অঞ্চলে সেজটি ক্যাসল শাসন করতো। এই কুখ্যাত মহিলাকে বলা হয় সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার। কাউন্ট ড্রাকুলা, অর্থাৎ ভ্ল্যাড দ্য ইমপেলারের সঙ্গেই এর তুলনা করা হত। সে মনে করত কম বয়সী মেয়েদের রক্তে স্নান করলে সে তার যৌবন চিরকাল ধরে রাখতে পারবে। তাই সে তার ক্যাসলের পরিচারিকা, তারপর স্থানীয় কৃষক পরিবারের মেয়েদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করত। মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে সে অন্তত ৬৪০টি নরহত্যা করেছিলো। তারপর ১৬১১ সালে বিচারে তাকে সেজটি ক্যাসলেই এক অবরুদ্ধ কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়, আর ১৬১৪ সালে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
“ঠিক” – যোশেফ বলে উঠলো। “তাই আমিও রক্ত ছাড়া বাঁচতে পারিনা। আমার মধ্যে রয়েছে সেই রক্তের তৃষ্ণা”।
“তোমার মাথা খারাপ হয়েছে” – আমি না বলে থাকতে পারলাম না।
“কে বলে আমি পাগল ? তোমরা পাগল। তোমরা আমার কথা শুনছো না। আমিই ড্রাকুলা”।
বুঝলাম যোশেফকে বোঝানো নিরর্থক। এই পাগলামিটা এর মধ্যে এলো কি করে? আমি একদৃষ্টে মোমবাতির আলোয় যোশেফের দিকে চেয়েছিলাম। দেখলাম, তার সারা গায়ে মুখে কালচে ছোপ, যেন চড়া সূর্যের তাপে ঝলসে গেছে। মনে পড়ল, সে সকালে সূর্যের আলোয় বেরোতে চাইছিলো না। তার আলোর প্রতি অনীহা, চুলের বাড়বাড়ন্ত, পাগলামির লক্ষণ – সব মিলিয়ে আমার মাথায় একটা কথা খেলে গেল – পরফিরিয়া, যাকে বলে ভ্যাম্পায়ার ব্যারাম। এক বংশগত রোগ, যা মানুষকে এই ধরনের পাগল করে তোলে। মানুষের রক্তের প্রধান উপাদান হিমোগ্লোবিন তৈরিতে যেসব এনজাইম কাজ করে, তাদের অস্বাভাবিক ক্ষরণের ফলেই এই ব্যারামের উৎপত্তি। ঠিকঠাক এই রোগ শনাক্ত করাও যায় না, কাজেই চিকিৎসাও হয় না।
পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে এবার পরিষ্কার হয়ে গেল। ক্রোল ও সন্ডার্সকে সব খুলে বলতে সন্ডার্স বলল – “প্যুওর ফেলো। আমাদের উচিৎ ওকে সাহায্য করা”। আমারও মন তাই বলছিলো। কোটের পকেট থেকে বের করলাম আমার সেই সর্বরোগহারক বটিকা, স্বর্ণপর্ণী গাছের পাতা থেকে তৈরি মিরাকিউরল। দুটো বড়ি যোশেফকে খাইয়ে তাকে আবার ঘুমিয়ে পড়তে বললাম। মন বলছে আমার ওষুধ যোশেফকে কাল সকালেই সুস্থ করে তুলবে। আমরাও শোব। প্রচুর ধকল গেছে।
১৬ই ডিসেম্বর, সকাল ১০টা
দুঃসংবাদ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি পাশের বিছানা খালি, ঘরের দরজা খোলা, যোশেফ উধাও। সেই সঙ্গে উধাও আমার কোটের পকেটে রাখা পার্স। যদিও পার্সে খুব বেশি কিছু টাকাপয়সা ছিলোনা, আর পাসপোর্ট, দরকারী কাগজপত্র সেসব আমি সুটকেসেই রাখি। পাশের ঘর থেকে ক্রোল আর সন্ডার্সকে ডেকে তুললাম। নীচে নেমে সরাইখানার লোকজনকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানা গেল না। কেউ-ই ঠিক করে কিছু বলতে পারলো না যোশেফকে যেতে দেখা গেছে কিনা। তারপর গ্রামের পোস্টঅফিসের সামনে এক ছোকরা বলল ঐ রকম দেখতে একটা লোককে সে দেখেছে হনহনিয়ে গ্রামের বাইরে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু যোশেফ পালাল কেন ?
ক্রোল বলল – “ভেবোনা, দিনের আলো সহ্য করতে পারেনা, কত দূরই বা ও যেতে পারবে ?”
আমি বললাম, আমার মনে হচ্ছে ওর রোগ সেরে গেছে। কাল মিরাকিউরল খাওয়ার ফল। তাহলে তো দিনের আলোয় ওর আর কোনও সমস্যাই হবেনা। তাহলে ও কি চায়?
১৬ই ডিসেম্বর, রাত ৮টা
এখনো যোশেফের কোনও খবর নেই। ক্রোল বলল – “যোশেফ যে চুলোয় গেছে যাক, রহস্যের সমাধান যখন হয়েই গেছে, তখন আর এখানে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। কাজেই এবার ঘরে ফেরার পালা”।
সন্ডার্স বলল – “এক কাজ করা যাক, যাবার পথে রোমানিয়ার ল্যাসি শহরে বিখ্যাত প্যালেস অফ কালচার-টা দেখে তারপর ফেরা যাক।” ১৯২৫ সালে তৈরি এই প্যালেসে রয়েছে রোমানিয়ার চার-চারটে বিখ্যাত মিউজিয়াম – একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির, একটি নৃতত্ববিদ্যার, একটি শিল্পকলার ও একটি ইতিহাসের।
সেই মতই ঠিক হল – কাল সকালে রওনা হয়ে আমরা পূর্ব রোমানিয়ার ল্যাসি শহরে পৌঁছবো। সেখানে দিন দুয়েক কাটিয়ে বুখারেস্ট হয়ে যে যার দেশে পাড়ি।
২২শে ডিসেম্বর, ল্যাসি
রাজধানী বুখারেস্টের পরই রোমানিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এই ল্যাসি। প্যালেস অফ কালচার-এর চারটে মিউজিয়াম কখনোই একদিনে দেখা সম্ভব নয়। তাই আমরা ১৮ই পৌঁছে গত তিনদিন ধরে তিনটি মিউজিয়াম দেখলাম। আজ শেষ মিউজিয়ামটি দেখে প্যালেস থেকে বেরিয়ে সবে হোটেলে ফেরার জন্য ট্রাম ধরব বলে স্টপেজে দাঁড়িয়েছি, ক্রোল হঠাৎ আমার কোটের আস্তিন চেপে ধরল। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, পাশেই একটা নিউজস্ট্যান্ডে আজকের গেজেটা ডি ট্রানসিলভ্যানিয়া-র হেডলাইন। আমরা তিন জনেই স্তম্ভিত সেই হেডলাইন দেখে –din nou vampir , অর্থাৎ, আবার ভ্যাম্পায়ার! ক্রোল রোমানিয়ান ভাষা ভালো পড়তে পারে। সে একটা কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে লাগল-
“ট্রানসিলভ্যানিয়ায় আবার ভ্যাম্পায়ারের আবির্ভাব হয়েছে, এবার আরেফু গ্রামে”। আমরা তো ভেবেছিলাম যোশেফ সুস্থ হবার সঙ্গে সঙ্গে এই রহস্যের যবনিকা পতন হয়ে গেছে – তাহলে কি আমার মিরাকিউরল ব্যর্থ হল? যোশেফকে রোগমুক্ত করতে পারল না? তার কাজ বলেই তো মনে হচ্ছে।
ক্রোল বলল – “আসল খবরটা শোনো এবার। এতদিন গরু শুয়োর ঘোড়া এরা মরছিল। এবার মানুষ! গতকাল ভোররাতে আরেফু গ্রামে এক নদীর ধারে এক অজ্ঞাত পরিচয় যুবকের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রামের লোকেরা পুলিশে খবর দেয়। থানা থেকে লোক এসে মৃতদেহ পরীক্ষা করলে দেখা যায় তার দেহ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, গলায় পাশাপাশি দুটো দাঁতের ফুটো”।
“তাহলে?”- জিজ্ঞেস করলাম আমি, “কি করণীয়?”
সন্ডার্স বললো – “ফেরার টিকিট ক্যানসেল কর। ব্যাপারটা সরেজমিনে তদন্ত করা দরকার। চলো আরেফু গ্রামে”।
২৩শে ডিসেম্বর, আরেফু
গতকাল-ই রাত্রে আমরা আরেফু গ্রামে এসে পৌঁছেছি। এবারেও উঠেছি গ্রামের সরাইখানায়। জঙ্গলপ্রধান গ্রাম, একধার দিয়ে বয়ে চলেছে আরগাস নদী, যার ধারে পাওয়া গেছিল মৃত যুবকের দেহ। আজ আমরা সকালে গিয়েছিলাম স্থানীয় থানায় রোমানিয়ান পুলিশ অর্থাৎ পোলিসিয়ার কতৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে যা দেখলাম, যা শুনলাম, তাতে মনে হচ্ছে সমস্ত ঘটনা নাটকীয় ভাবে অন্য দিকে মোড় নিলো। থানার কর্তা আমাদের তিন বিদেশীকে যথেষ্টই খাতির করে বসালেন। ক্রোল রোমানিয়ান ভাষায় সড়গড় হওয়ায় সে-ই কথাবার্তা চালালো।
মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করে জানা গেছে গলার ফুটো দিয়ে শরীরের অনেকটা রক্ত বের করে নেওয়ায় লোকটির মৃত্যু হয়েছে। মৃতদেহ কবরস্থ হয়ে গেছে, তবে লোকটির একাধিক ছবি পুলিশ তুলে রেখেছে, আমরা ইচ্ছে করলে দেখতে পারি। একটা খাম আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন পোলিসিয়া কর্তা। ভেতরে তিনটে ছবি – সেগুলো চোখের সামনে ধরতেই আমাদের তিনজনের চোখ কপালে উঠে গেল। এতো যোশেফ! এ কি করে সম্ভব? যোশেফ, যে কিনা এতদিন নানান গ্রামে পশুদের আক্রমণ করে তাদের রক্তপান করত, সে-ই শেষে এভাবে মারা গেল? তাকে কে মারল এভাবে? নাহ, আর কিছু ভাবতে পারছি না।
থানা থেকে বেরিয়ে নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছি আমরা, কারুর মুখে কথাটি নেই। এ আবার কি নতুন রহস্য শুরু হল? এর শেষ কোথায়?
সন্ডার্স বলল – “উঁহু, এবার তো ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে – মানা গেল যোশেফ স্ন্যাগভ থেকে পালিয়ে এখানে এসেছিল, কিন্তু তারপর? তাকে কে আক্রমণ করল? চল, গ্রামের লোকেদের সঙ্গে কথা বলা যাক”।
গ্রামের লোকজন বিশেষ কিছুই বলতে পারলনা। স্বাভাবিক, তারা তো আর যোশেফকে চেনে না। তার পূর্ব ইতিহাসও জানেনা। এখন জানা দরকার, যে যোশেফকে মারল, সে কে, আর এলোই বা কোথা থেকে। ক্রোল বলল – “দেখো শঙ্কু, যোশেফের দেহ যখন নদীর ধারে পাওয়া গেছে, একটা সম্ভাবনা আছে, যে আক্রমণ করেছিলো, সে নদীপথেও আসতে পারে”।
যথার্থ যুক্তি। সন্ডার্স গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করে জানলো এই আরগাস নদী উৎপন্ন হয়েছে দক্ষিণ কার্পেথিয়ানের ফ্যাগারাস পর্বতমালা থেকে, আর গিয়ে পড়েছে ড্যানিয়ুব নদীতে। ট্রানসিলভ্যানিয়ার উত্তর-পূর্বে এই নদী বরাবর গেলে পড়বে পয়েনারি কাসল। কিন্তু গ্রামের লোকেরা এর বেশী আর কিছুই বলতে পারলনা। ক্রোল জিজ্ঞেস করল – তোমাদের গ্রামে কোনও লাইব্রেরি আছে?” জানা গেল চার্চের নিজস্ব একটি লাইব্রেরি আছে, সেটি ব্যবহার করতে হলে চার্চের ফাদারের অনুমতি প্রয়োজন। সে অনুমতি সহজেই পাওয়া গেল। ক্রোল একাই লাইব্রেরি থেকে যখন ঘুরে এল, তখন তার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করছে।
“জানো তোমরা, ঐ পয়েনারি কাসল কার তৈরি? ভ্ল্যাড দ্য ইমপেলার অর্থাৎ কাউন্ট ড্রাকুলা। এই নদী ধরে ২০০ কিলোমিটার স্রোতের উল্টো দিকে, অর্থাৎ উৎসের দিকে গেলে২০৩৩ মিঃ উঁচু এক টিলার ওপর এই পরিত্যক্ত কাসল। ভ্ল্যাডের প্রথমা স্ত্রী নাকি এই কাসল থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। আমাদের গন্তব্য হবে ঐ কাসল। চলো, নৌকার সন্ধান করা যাক। ২০০ কিলোমিটার যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। এবেলা রওনা হলে সারারাত নৌকা চালিয়েও কাল সন্ধ্যের আগে আমরা পৌঁছব না”।
২৪শে ডিসেম্বর, সন্ধ্যে ৭টা
কাল দুপুরে রওনা দিয়ে আরগাস নদীতে সারাদিন সারারাত নৌকা চালিয়ে আজ একটু আগে চোখে পড়ল নদীর বাঁ দিকে একটা টিলা, যার অনেক ওপরে দেখা যাচ্ছে পরিত্যক্ত পয়েনারি কাসল। পাথরের ওপর ধাপে ধাপে খাঁজ কাটা। ক্রোল বলেছিল ১৪৮০টি ধাপ আছে। নীচেও গভীর জঙ্গল। শরীর আর দিচ্ছিল না। একটা গাছের গুঁড়িতে নৌকাটাকে বেঁধে আমরা একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে গুছিয়ে বসেছি। আমারই তৈরি অত্যন্ত হালকা শ্যাঙ্কোপ্ল্যাস্টের একটা তাঁবু খাটানো হয়েছে। সন্ডার্স কাঠকুটো জোগাড় করছে কফি বানাবে বলে। খাবারদাবার আমরা সঙ্গে করে নিয়েই এসেছি। ঠিক হল আজ আর এই অবস্থায় কাসলে ঢোকা হবেনা, এখানেই রাতটা কোনও রকমে কাটিয়ে কাল সে কাজটা করা যাবে।
* * *
রাত সাড়ে এগারোটা। তাঁবুর চারপাশে আগুন জ্বেলে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎই কিসের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ক্রোল আর সন্ডার্সকে ডেকে তুললাম। কাঠের আগুন প্রায় নিভতে বসেছে। জঙ্গলের মধ্যে খসখস শব্দ, কারা চলাফেরা করছে। তাঁবু থেকে বেরিয়ে হঠাৎ দেখি সামনে খানিক দূরে জ্বলন্ত চোখ – বেশ কয়েক জোড়া! অন্ধকার সয়ে আসতে বুঝলাম নেকড়ের পাল, অন্ততঃ সাত আটটা তো হবেই। সর্বনাশ! এত কাছ থেকে এরা যদি আক্রমণ করে, বাঁচার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাদের গা হিম করা গর্জন শরীরে শিহরণ তুলে দিচ্ছে। সন্ডার্স পকেট থেকে তার কোল্ট পাইথন .৩৫৭ রিভলবার বের করে ঘোড়া টিপে দিলো সামনের দিকে তাক করে। একটা নেকড়ে মরল। কিন্তু আশ্চর্য, অন্য নেকড়েগুলো প্রথমে একটু থমকে দাঁড়ালেও দাঁত বের করে আবার সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমার পকেটে আমার অ্যানাইহিলিনটা নেই। সেটা ব্যাগের মধ্যে রাখা। কিন্তু সময় বড় অল্প – উল্টো দিকে ঘুরে তাঁবু থেকে ব্যাগ নিয়ে সেটা বের করব কি করে এত কম সময়ে ?
হঠাৎ কিসের শব্দ শুনে ওপরে তাকিয়ে দেখি একটা বিশাল আকৃতির বাদুড় এতক্ষণ আমাদের মাথার ওপর চক্কর কাটছিলো, আমরা খেয়াল করিনি। হঠৎ সেটা চক্কর থামিয়ে সটান কাসলের দিকে উড়ে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর, তারপরেই কাসল থেকে শোনা গেল জোরালো এক তীক্ষ্ণ শিষের আওয়াজ। আর অবাক কান্ড, শিষের শব্দ শুনেই বাধ্য পোষা কুকুরের মত নেকড়েগুলো উল্টো দিকে ঘুরে জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু শিষ দিলো কে?
হঠাৎ সন্ডার্স বলে উঠলো – “লুক এট দ্য ক্লিফ”! দেখি টিলার ধাপ বেয়ে নেমে আসছে এক দীর্ঘদেহী। লম্বায় প্রায় সাত ফুট, কালো ওভারকোট টুপিতে শরীর ঢেকে আছে। এ কে? এই কি যোশেফকে মেরেছে? এই কি ড্রাকুলা ভ্ল্যাড দ্য ইমপেলার? স্ন্যাগভ মনাস্টেরিতে উধাও হওয়া কঙ্কালই কি আবার এখানে মানুষের শরীরে উদয় হল? ক্রোলের অনুমান তাহলে তো অভ্রান্ত!
ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিক। আগন্তুক ক্রমশ টিলার নিচে নামতে নামতে এক সময় কুয়াশায় মিলিয়ে গেল। আমরা তিনজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। ক্রোল বলল – “শঙ্কু, তোমার গানটা এইবেলা বের করে রাখো, কখন দরকার লাগে বলা যায়না”। ঠিক। এরপর কি ঘটবে কে জানে।
পাশ থেকে ক্রোলের ফিসফিসানি শোনা গেল – “আজ কত তারিখ জানতো শঙ্কু? ২৪শে ডিসেম্বর – আজ গ্র্যান্ড হাই ক্লাইম্যাক্স নাইট – সব অপদেবতা পিশাচ এদের মোচ্ছব হয় আজ রাতে। কাজেই আজ আমরা ড্রাকুলার দেখা পাব এতে আর আশ্চর্য কি?”
সামনের জঙ্গলে আবার খসখস শব্দ। পাইন গাছের জঙ্গলের মধ্যে থেকে দূরে দৃশ্যমান হল সেই দীর্ঘদেহী। একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝলক তিনজনের শরীরে যেন কাঁপন লাগিয়ে দিল। সেই সঙ্গে সারা জঙ্গল জুড়ে চতুর্দিকে শুরু হল নেকড়ের গর্জন। আগন্তুক ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। স্ন্যাগভের মনাস্টেরি থেকে মুক্তি পেয়ে বহু যুগ বাদে যোশেফের রক্তে তার রক্ততৃষ্ণা আবার জেগে উঠেছে। কাজেই আমাদের তিনজনের মধ্যেই কেউ তার পরের শিকার হতে চলেছে। একে এখনই থামানো দরকার।
হঠাৎ সন্ডার্স সামনের দিকে বন্দুক তুলে টিপে দিল ঘোড়া। এবং, আশ্চর্যের পর আশ্চর্য, গুলি সেই দীর্ঘদেহী অবয়বের মধ্যে দিয়ে ভেদ করে চলে গেলো! তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে এগিয়ে আসতে লাগল ধীর পদক্ষেপে। সন্ডার্স উপর্যুপরি আরো তিনবার ফায়ার করল। নাঃ, কিছুই হলনা। এই রকম পরিস্থিতিতে আমরা আগে কখনো পড়িনি।
“অ্যানাইহিলিন শঙ্কু, অ্যানাইহিলিন” – ক্রোল চিৎকার করে উঠলো। অবিশ্যি তার আগেই সেটা আমার হাতে চলে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ শিষের শব্দ করে আমার বন্দুকের মধ্যে থেকে অ্যানাইহিলিন অ্যাসিডের ধারা গিয়ে আছড়ে পড়লো আগন্তুকের গায়ে। এর পরের ঘটনার জন্য আমি বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না। এতকাল ধরে এত জায়গায় যে বন্দুক বিপদে আমায় উদ্ধার করেছে, সেই অ্যানাইহিলিন পিস্তল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল আজ। আমি জানি এই বন্দুক কেবল নির্জীব বস্তুর ওপর কাজ করেনা – যেমন সেই কঙ্গোর জঙ্গলে রোবট মোকেলে মবেম্বের ওপরেও কাজ করেনি, কিন্তু সামনে যাকে দেখছি, সে তো অন্তত জড় পদার্থ নয়। তাহলে?
কিন্তু এই পরপর আক্রমণে একটা জিনিস হল। হঠাৎই নেকড়ের গর্জন থেমে গেলো। সামনে অগ্রসরমান আগন্তুক পিছনে হঠতে শুরু করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তারপর দেখি আবার সেই বিশাল বাদুড়টা উড়তে উড়তে পয়েনারি কাসলের দিকে উধাও হয়ে গেল। রাতের জঙ্গলে আবার ফিরে এলো পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতা।
২৫শে ডিসেম্বর
বড়দিন। তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি ঝলমলে রোদে চারদিক ভরে গেছে। পরস্পরকে মেরি ক্রিসমাস জানিয়ে কফির মগ হাতে রোদে বসে আছি তিনজন। গতরাতের অভিজ্ঞতা এখনো ধাক্কা মেরে যাচ্ছে মনের মধ্যে। কেন অ্যানাইহিলিন কাজ করল না, কি করে এই ড্রাকুলার মোকাবিলা করা যাবে – এইসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে খালি।
আমার হাতে অ্যানাইহিলিন বন্দুকটা। নিজের মনে সেটার কলকব্জাগুলো নাড়াচাড়া করে যাচ্ছি। একসময় ভায়ালটা খুলে ফেললাম – ভেতরে হালকা বেগুনী রঙের অ্যানাইহিলিন অ্যাসিড। এই মারাত্মক অ্যাসিডের ছোঁয়ায় বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের সব সজীব বস্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অথচ — !
হঠাৎ আমার মনে হল ড্রাকুলা তো সেই অর্থে জীবিত প্রাণী নয়, জীবের দেহে অশরীরী আত্মা। তার নিধন নিশ্চয় অন্যভাবে অন্য কিছুতে। ক্রোলকে জিজ্ঞেস করলাম এইসব অপদেবতাদের সঙ্গে কিভাবে মোকাবিলা করা যায়? ক্রোল বলল, প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী রসুনের রস, অ্যাসপার গাছের রস, গীর্জার পবিত্র জল এগুলোই ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ারের মারণ অস্ত্র। গীর্জার জল তো সঙ্গেই আছে। কিন্তু বাকিগুলো কোথায় পাব এই জঙ্গলের মধ্যে? সন্ডার্স বলল – “চলো না, জঙ্গলের পথ ধরেই যাই, যদি কোনও গ্রামটামের সন্ধান মেলে”।
ঘন্টাখানেক হাঁটার পর আমরা এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের সন্ধান পেলাম। ফার গাছ, সান্টাক্লজ, আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে সারা গ্রাম। চার্চে প্রার্থনার ঘন্টা শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক আনন্দদায়ক পরিবেশ। মন ভালো হয়ে গেলো।মনে হল, আজ যীশুর জন্মদিনেই সব রহস্যের অবসান হবে।
ক্রোল ইতিমধ্যেই গ্রাম থেকে কিছু রসুন জোগাড় করেছে। আর জোগাড় করেছে অনেকটা পোস্তর দানা। এটার কি কাজ জিজ্ঞেস করতে ক্রোল বলল – “এই ধরনের বিদেহী আত্মারা পোস্তদানার গন্ডি ভেদ করে যেতে পারেনা”। সন্ডার্স বলল এখানকার জঙ্গলে প্রচুর অ্যাসপার অর্থাৎ সরলগাছ রয়েছে সে আসার পথে দেখেছে। ফেরার সময়ে তার কিছু পাতা তুলে নিলেই হবে।
সব কিছু নিয়ে আমরা আবার এসে উপস্থিত হলাম তাঁবুর কাছে। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল – আচ্ছা, রসুন আর অ্যাসপার গাছের রস যদি চার্চের জলের সঙ্গে মিশিয়ে অ্যানাইহিলিনের ভায়ালে ভরে রাখা যায় তাহলে কি কার্যসিদ্ধি হতে পারে না ? ক্রোল আর সন্ডার্স শুনেই বলল – “ব্র্যাভো, এক কাজ করো, ভায়ালে ভরার আগে গরম লোহা ঠেকিয়ে নিও। তাতে এর কার্যকারিতা বেড়ে যাবে”।
ব্যাগ থেকে একটা লোহার চামচ বের করে লাইটারের আগুনে পুড়িয়ে সেটা রসের মিশ্রনে ঠেকানো হল। তারপর সেই কালচে তরল মিশ্রন ঢেলে দিলাম অ্যানাইহিলিনের ভায়ালে।
সন্ডার্স বলল – “দ্যাখো, রাতের আগে কিছু হবে বলে মনে হয় না। চলো না, দিনের আলোয় একবার পয়েনারি কাসলের ভেতরটা দেখে আসা যাক”।ভালো প্রস্তাব।
১৪৮০ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে সময় লাগলো প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। মাঝে মাঝে অবিশ্যি বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল। একদিকে গ্রে-স্টোনের খাড়া প্রাচীর নেমে গেছে আরগাস নদী পর্যন্ত, এখান থেকেই কি তাহলে ভ্ল্যাডের স্ত্রী ঝাঁপ দিয়েছিলো? হবেও বা। কাসলের অন্যদিক জঙ্গলমুখী – যেদিক দিয়ে আমরা উঠে এসেছি। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা শুঁড়িপথ, দুদিকে দেওয়াল। সেই পথে খানিকটা ভেতরে ঢুকে আমরা পৌঁছলাম পরিত্যক্ত এই কাসলের মূল প্রবেশদ্বারে। বিশাল কাঠের দরজা। দরজার সামনে এক খোলা জায়গায় পোঁতা রয়েছে কয়েকটা মরচে ধরা উঁচু বল্লমের ফলা। সন্ডার্স বলল – “এই বল্লমের খোঁচা দিয়েই ভ্ল্যাড লোকজনকে শূলে চড়াতো মনে হচ্ছে”।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম তিনজনে। একটা বুনো উগ্র গন্ধ নাকে এসে ঠেকল। কেল্লার ভেতরে একটা বড় ঘর – সম্ভবতঃ এটাই ছিল ভ্ল্যাডের দরবার কক্ষ। সেই ঘরের মাঝখানে চোখে পড়ল একটা কফিন। ক্রোল আর সন্ডার্স হাত লাগিয়ে কফিনের ডালাটা তুলতেই যা চোখে পড়ল তা আশ্চর্য হলেও অস্বাভাবিক হয়তো না। বিদেহী আত্মার নির্জীব শরীর দিনের বেলায় এই রকম জায়গায় থাকাটাই তো স্বাভাবিক – অন্ততঃ ড্রাকুলার গল্প পড়ে সেই রকমই তো জেনেছি। কফিনের মধ্যে যাকে দেখলাম সে গতরাতের সেই দীর্ঘদেহীর শরীর। চোখ বন্ধ, হাতদুটো বুকের ওপর, ঠোঁটের গোড়ায় যে দাগটা শুকিয়ে রয়েছে, সেটা রক্ত ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারেনা। ক্রোল বলল – “শ্যুড উই কিল হিম?” আমি বললাম – লাভ নেই। একে মারলে এই শরীরটা ধ্বংশ হবে। কিন্তু এর আত্মাটাকে তো মারা যাবে না। সে তখন অন্য কোনও দেহে আশ্রয় নেবে। কাজেই রাত্রে ও যখন জীবন্ত হবে, তখনই ওকে মারতে হবে।
কফিনের ডালা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। তিনজনে আলোচনা করে ঠিক করা হল এরপর কি করণীয়। ঠিক হল আমরা এখন আর নীচে নামব না। রাত্রে আবার ঐ অতগুলো ধাপ পেরিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আমাদের সঙ্গে রুকস্যাকে কিছু খাবার আর টুকটাক জিনিসপত্র আছে, কাজেই রাত নামা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা।
২৫শে ডিসেম্বর, রাত ১০টা
চারদিক নিস্তব্ধ। শোঁ শোঁ করে ঠান্ডা বাতাস ছুটে আসছে কারপেথিয়ান পর্বতমালার দিক থেকে। কাসলের সামনে আমরা তিন মূর্তি গরম পোশাকে আপাদমস্তক ঢেকে বসে কফি খাচ্ছি। সময় আর কাটতে চাইছে না। এর আগে ক্রোলের পরামর্শে আমরা আরেকটা কাজ সেরে নিয়েছি। মূল কেল্লাটার চারপাশে আমরা পোস্তদানা দিয়ে একটা গন্ডি কেটে রেখেছি, নিজেরা বসেছি গণ্ডির বাইরে। অর্থাৎ, এই লক্ষণরেখা যদি ঠিকঠাক কাজ করে, তাহলে ড্রাকুলা গন্ডির বাইরে বেরিয়ে আমাদের আক্রমণ করতে পারবেনা।
হাতের রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়িতে দেখলাম রাত এখন ১১টা ২০ মিনিট। এক একটা সেকেন্ড মনে হচ্ছে যেন এক একটা ঘন্টা। আরো খানিকক্ষণ পর হঠাৎ একটা ক্যাঁচ শব্দে কাসলের দিকে তাকিয়ে দেখি আস্তে আস্তে দরজা খুলে তার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘদেহী ড্রাকুলা। সঙ্গেসঙ্গে দূরে নীচের জঙ্গলে জেগে উঠলো নেকড়ের গর্জন। আমরা তৈরি। আমার হাতে সেই বিশেষ ভায়াল ভরা অ্যানাইহিলিন পিস্তল।
ড্রাকুলা এবার এগিয়ে আসছে সিঁড়ির দিকে। কিন্তু যেই সে পোস্তর গণ্ডির কাছে এসেছে, ছিটকে পিছিয়ে গেল অন্যদিকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে এবার যেদিকেই যায়, সেদিকেই বাধা। ব্যর্থ হুঙ্কারে চিৎকার করে ওঠে সে। তার সামনে এগোবার সব পথ বন্ধ।
ক্রোল ফিসফিস করে বলে উঠল – “দিস ইস দ্য টাইম”। আর দেরি করা চলেনা। এলোমেলো হাওয়ায় পোস্তর দানাগুলো উড়ে যেতে কতক্ষণ? আর, একবার যদি সে বাইরে বেরোয়, কারুর নিস্তার নেই। রাত প্রায় বারোটা। বড়দিনের রাত শেষ হতে আর বেশী সময় নেই। অ্যানাইহিলিন বন্দুক সোজা সামনের দিকে তুলে যা থাকে কপালে ভেবে টিপে দিলাম ঘোড়া। তীব্র বেগে তরলের ধারা গিয়ে লাগলো ড্রাকুলার বুকে। মূহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো সে। তারপর —-
তারপর চোখের সামনে ঘটে গেল তিনটে ঘটনা – এক, জঙ্গলে নেকড়ের গর্জন থেমে গেল; দুই, ড্রাকুলার শরীর চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আর তিন, একটা বিশাল বাদুড় ঝটপটিয়ে লাট খেতে খেতে নীচে নদীর দিকে পড়ে গেল।
ক্রোল দেখি পশ্চিম আকাশে তাকিয়েছে। সেখানে খসে পড়ছে একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড – উল্কাপাত। সেইদিকে তাকিয়ে ক্রোল বুকে ক্রশ এঁকে বলল – “আমেন”। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল – ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি।
=========== সমাপ্ত ===========
কৈফিয়ত
এই শঙ্কু কাহিনির বীজ প্রথম পোঁতা হয়েছিল এক বছরেরও আগে, যখন নীচের খবরটা Times of India এ দেখেছিলাম –
তখনই মনে হয়েছিল, গিরিডি মানেই শঙ্কু। কাজেই এখান থেকেই গপ্পটা শুরু করা যায়। তারপর ড্রাকুলা আর ভ্যাম্পায়ার নিয়ে বিস্তৃত পড়াশুনো করার ফলশ্রুতি এই কাহিনি। এই গল্পে যেসব জায়গার কথা বলা হয়েছে, প্রতিটিই বাস্তব – হয়তো আজকের দিনে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রোমানিয়ার এইসব জায়গাকে ঘিরে এখন গড়ে উঠেছে ড্রাকুলা ট্যুরিজম। ভ্ল্যাড দ্য ইমপেলার আর এলিজাবেথ ব্যাথোরি – দু জনেই ঐতিহাসিক চরিত্র। স্বয়ং ব্রাম স্টোকার এখান থেকেই তাঁর গল্পের অনুপ্রেরণা পান। জোনাথন হার্কারের সঙ্গে জড়িত ট্রানসিল্ভ্যানিয়ার সেই দূর্গ আসলে পয়েনারি কাসল, অন্ততঃ ইতিহাস তাই বলে। কাজেই আমার গল্পের ক্লাইম্যাক্স এখানেই রেখেছি। পরফিরিয়া বা ভ্যাম্পায়ার ব্যারামের অস্তিত্ব সত্যিই আছে – উৎসাহীরা নেট ঘেঁটে দেখতে পারেন। বাদবাকিটা কল্পনার পাগলা ঘোড়া। এই কাহিনি কার কেমন লাগল, গঠনমূলক সমালোচনা শুনতে চাইছি।
সবার ভালো লাগলেই এই লেখার সার্থকতা। সবাই চাইলে তবেই প্রফেসর শঙ্কু আবার ফিরে আসতে পারেন। আজ এই পর্যন্তই।
Tags: তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, বড় গল্প, শুভাগত বন্দ্যোপাধ্যায়
Perfect and a great tribute to Satyajit Ray.
অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের ভালো লাগাই আমার পাথেয়। ভালো থাকুন।
শুভাগত বাবু আপনার প্রফেসর শঙ্কু গল্পটি সত্যিই আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে ।আপনি যদি রাইট দেন আমরা আপনার গল্পটি আমাদের ছোট্ট চ্যানেল এ পরিবেশন করতে চাই।
We are from Mystery of the Dark ©
contact- alimamsheikh007@gmail.com
“খাসা লিখেছেন মশাই|”
পাদটিকা অনুযায়ী গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারলাম না – তবে ফ্যান ফিকশন নিয়ে গতকালই এক বন্ধুর সাথে যেমন কথা হচ্ছিলো, সেই অনুসারে – এরকম প্রজেক্ট আরও হওয়া দরকার, যাতে করে পরবর্তী পাঠকেরা মূল লেখা ও চরিত্রগুলি নিয়ে আরও কৌতুহলী হয় আর পূর্ববর্তী পাঠকরা তত্কালীন যে আনন্দ উপভোগ করেছিলেন, সেটা সময়ের সাথে সাথে বজায় থাকে|
প্রশংসার সাথে সাথে প্রচুর ধন্যবাদ জানাই|
অনেক ধন্যবাদ।
শুভাগতদা, vlad-এর সঙ্গে শঙ্কুর মিশেল একদম খাসা হয়েছে। এরকম আরও চাই কিন্তু।
আপনাদের ভালো লাগলে তবেই তো সাহস করে পরের গল্পের দিকে এগোতে পারব। অনেক ধন্যবাদ।
গল্পটা সত্যিই অসাধারণ,লেখককে সাধুবাদ জানাই। পড়তে পড়তে তথ্যের ভারে যদিও একটু ক্লান্ত লেগেছে, তবু মনে মনে বহুবার অসা, অসা(awsome-আন্য) বলে চেঁচিয়ে উঠেছি। একটা বিষয়ে একটু খটকা লাগল। শঙ্কুর তৈরি হালকা প্লাস্টিকের নাম কি শ্যাঙ্কলন নাকি শ্যাঙ্কোপ্ল্যাস্ট?
আরো বলি অলঙ্করণ দুর্দান্ত হয়েছে, বিশেষত গল্পের শেষে ক্লান্ত, বিধস্ত শঙ্কুর ছবিটার কোনো তুলনা হয় না। জয়তু চিত্রচোর, জয়তু সুমিত রায়।
এই রে, আমারই খটকা লেগে গেল , শ্যাঙ্ক প্ল্যাস্ট নাকি শ্যাঙ্কলন ! এই মুহূর্তে মনেও পড়ছে না, কোন গল্পে এর প্রথম উল্লেখ। ভুল হয়ে থাকলে ত্রুটি মার্জনীয়। গল্পটা ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশী হলাম। ভালো থাকুন।
খুব ই ভাল লাগল প্রফেসর শঙ্কুর স্রষ্টার প্রতি আপনার এই উৎসর্গীকৃত লেখা টি। যদিও, যোশেফের মৃত্যু অব্দি, লেখা টি সাবলীল হলেও সেইভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারেনি বলেই আমার ব্যাক্তিগত মত, কিন্তু, পরবর্তী অংশ তা বেশ কিছুটা পুরণ করেছে। যদিও প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে, অলৌকিক বিষয় গুলি খুব একটা যায়না কারন সত্যজিৎ রায়ের শঙ্কু কে নিয়ে সব কাহিনীতেই আমরা কল্প বিজ্ঞান এরই অতিমাত্রায় ব্যাবহার দেখতে পেয়েছি, কিন্তু সব মিলিয়ে এই নব্য শঙ্কু রচনা ও বেশ ভাল লাগা সৃষ্টিকরল এটা বলাই যায়। লেখক কে শুভেচ্ছা
পেয়েছি দাদা। মূল উপাদান শ্যাঙ্কপ্ল্যাস্ট। ওটার একটা ভেরিয়েশন হল শ্যাঙ্কলন।
কোথায় পেলেন একটু জানাবেন প্লিজ? কোন গল্পটায়? আমি আবার শঙ্কুর ফ্যান।
নিজের করা কমেন্ট এডিট করার অপশন থাকলে ভালো হত।
গল্পটায় দ্বিতীয়বার চোখ বুলিয়ে মনে হল তথ্য যেটুকু আছে সেটুকুর প্রয়োজন।
গল্পের প্রতিটি পাদটিকা ও গঠনশৈলী অসাধারণ। কিছু কিছু জায়গায় মাঝে মাঝে খেই হারালেও শেষ ভালো যার সব ভালো তার। খুব সুন্দর লেখা। আরো চাই।
অনেক ধন্যবাদ।
শুভাগতদার এই লেখা আগেও পড়েছিলাম। এবারো পড়ে দেখলাম কিছু পরিমার্জনা করা হয়েছে। গল্পের প্লট বা তথ্যের উপস্থাপন নিয়ে আমার বলার কিছুই নেই, সেগুলো যথার্থ মনে হয়েছে। কিন্তু শঙ্কুর গল্পে বাস্তব চরিত্রের উল্লেখ মনে করতে পারি না, তাই জগদীশচন্দ্র বা ব্রাম স্টোকারের উল্লেখে একটু খটকা লাগছে। আর গল্পে ব্যবহৃত ফটোগ্রাফগুলির পরিবর্তে যদি সেগুলো অবলম্বনে হাতে আঁকা অলঙ্করণ ব্যবহার করা যেত তাহলে খুব ভাল হত। যেহেতু আমি শঙ্কুর একটি অসমাপ্ত গল্প নিয়ে কাজ করেছিলাম, তখন সত্যজিতের ভাষা নিয়ে বেশ চর্চা করেছিলাম, তাই এক্ষেত্রে কয়েকটি জায়গায় একটু হোঁচট খেয়েছি। প্যাস্টিশ লিখতে মূল লেখকের ভাষাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার আমি পক্ষপাতী। আর শঙ্কুর অ্যানাইহিলিন পিস্তলে অ্যানাইহিলিন অ্যাসিড ব্যবহার করার ব্যাপারটা একদম প্রথম দিকের শঙ্কু কাহিনীতে পাওয়া যায়, পরের দিকে সত্যজিৎ রায় যখন শঙ্কুকে আরও সিরিয়াস বিজ্ঞানী করলেন তখন এই ব্যাপারটা উনি আর ব্যাখ্যাতে যান নি, বরং পরের দিকের শঙ্কু কাহিনীতে অ্যানাইহিলিন ব্যবহারের বর্ণনা শুনে মনে হয় কোন অদৃশ্য রশ্মি টার্গেটকে নিশ্চিহ্ন করছে, কারণ টার্গেট অনেক ক্ষেত্রে এতটাই দূরে আছে যে তরল অ্যাসিড নিক্ষেপ করার কোন সুযোগ থাকছে না।
আমি শুধু খটকাগুলোই এখানে বললাম। তবে সব মিলিয়ে নিঃসন্দেহে শঙ্কুর প্যাস্টিশ হিসেবে এত জমজমাট লেখা আমি আর পড়ি নি। বাংলা প্যাস্টিশ সাহিত্যে এটি একটি উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকবে।
হিটলার বা হিম্লার এসেছে তো 🙂 আনাইহিলিনকে সত্যজিৎ কখনো অ্যাসিড, কারেন্ট আবার রে – সবের মতই বলেছেন। ফটোগ্রাফের জায়গায় ছবি ব্যাবহার করতে পারলে সত্যিই বেটার হত। আমি দেখছি, ওগুলো পালটে দেওয়া যায় কিনা।
আমি ফটো ব্যবহার করেছিলাম কল্পনা আর বাস্তবের মেল বন্ধনের জন্য। তবে হাতে আঁকা ছবি সব সময়েই বেশী কাম্য।
আমিও কিন্তু সজ্ঞানে সত্যজিতীয় ভাষা অনুকরন করার চেষ্টা করেছি। প্যাস্টিস অবশ্যই মূল লেখা অনুসারী হওয়া উচিৎ।
খুব ভাল লেগেছে। বাংলায় প্যাস্টিশে চর্চা কমই হয়। তবে প্যাস্টিশে লেখা খুবই কঠিন, এটা আমি হাড়েহাড়ে জানি। তবে প্যাস্টিশে লেখার ক্ষেত্রে আমি ওল্ড স্কুলের রক্ষণশীলতা থেকে একটু ভিন্ন মতই পোষণ করি। মূল লেখকের জীবনের বিভিন্ন সময়ে একাধিক শঙ্কু পড়েও আমার মনে হয়েছে লেখকের প্রথমের দিকের শঙ্কুর থেকে পরের শঙ্কুর অনেক গ্রোথ হয়েছিল। ভাষাগত ও প্লট নির্মাণেও। সেটাই স্বাভাবিক। মূল লেখকের থেকে যখন অন্য কোনো লেখক প্যাস্টিশে লিখবেন সেখানেও তার নিজস্ব কিছু ইনপুট থাকবেই। সেটা মোটেও গর্হিত নয় বরং প্রোটাগনিস্টের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নতুন কোনো গ্যাজেট প্যাস্টিশে লেখক তার লেখায় নতুনত্ব হিসেবে আনেন সেটাকেও আমি স্বাগত জানাব। শুভাগতবাবুর এই লেখাটি আমার বেশ মনে ধরেছে। কল্পবিশ্বে আগের কোনো সংখ্যায় সুদীপ দেবের যে শঙ্কু-প্যাস্টিশে প্রকাশিত হয়েছিল সেটিও খুব ভাল ছিল। শেষ করার আগে আবার বলব প্যাস্টিশে লেখার সময় মূল চরিত্রের ফ্লেভারটি রেখে প্যাস্টিশে লেখক যদি নিজস্ব কোনো ইনপুট দেন তাতে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয় না বা কোনো ভাল প্যাস্টিশেও মামুলি ফ্যান ফিকশনে পরিণত হয় না। পরিশেষে শুভাগতবাবু এমন একটা দুরন্ত লেখার সাহস দেখানোর জন্য আপনাকে সেলাম।
অনেক ধন্যবাদ পার্থ বাবু। আমিও অপেক্ষায় থাকলাম শংকরকে নিয়ে আরো প্যাস্টিশের জন্য।
প্রথমেই লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ প্রফেসর শঙ্কুকে নতুন রূপে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনার জন্য। বিদেশে এই ধরনের ব্যপার অনেক ঘটেছে যেখানে একজন লেখকের সৃষ্ট চরিত্রকে পরবর্তীতে অন্য লেখকেরা এগিয়ে নিএ গেছেন। লেখকের কাছে ভবিষ্যতে আরোও শঙ্কু কাহিনীর আশা রইল আমাদের মত শঙ্কু প্রেমিক দের। গল্পটির বিষয়ে কয়েকটি কথা আমার মনে হয়েছে সেটি হল প্রফেসর শঙ্কুর গল্পে বিজ্ঞান, ও অলৌকিকতার সে মেলবন্ধন দেখা যায়, সেইটি কিছুটা হলে এখানে অনুপস্থিত বলে আমার মনে হয়েছে। গল্পটি শেষ পর্যন্ত সেই কারনে একটি ভুতের গল্প হিসাবেই সার্থকতা লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত গল্পের প্রথমে বর্নিত জগদীশ চন্দ্র বসুর সিন্দুকটির বিষয়ে আর কোন আলোকপাত দেখা গেলনা। তৃতীয়ত গল্পটি কোথাও কোথাও তথ্যের ভারে কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়েছে। চতুর্থত শঙ্কুর গল্পের শেষে সাধারনত যে ধরনের চমক দেখা যায় সেটি এই গল্পে অনুপস্থিত বলে আমার মনে হয়েছে। সবশেষে আপনাকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাই প্রফেসর শঙ্কুকে নবজীবন দান করার জন্য। বাংলা সাহিত্যতে ফেলুদা সুলভ চরিত্র বেশ কিছু পাওয়া গেছে কিন্তু শঙ্কু চরিত্রটি এক এবং অদ্বিতীয়। আপনার থেকে ভবিষত্যে আরো অনেক শঙ্কু কাহিনী আশা করবো।
Hats off to you… Well done
shonku chirokal e priyo choritro,khub bhalo laglo,ekdom sesh er shonkur illustration ta mon kara
আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না যে সত্যজিৎ রায় নিজে লেখেননি গ্রেট এচিভমেন্ট
💕💕