প্রমোদ কন্যা
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ
গাছ নিয়ে আমি গবেষণা করি না— কিন্তু গাছেদের আমি ভালবাসি।
ছেলেবেলা থেকেই গাছেরা আমাকে টানে। পাতা আর ডাল দুলিয়ে দুলিয়ে যেন আমাকে ডাকে। ওরা তো কথা বলতে জানে না। কিন্তু আমার বেশ মনে আছে, ওরা যেন কথাই বলত আমার সঙ্গে। সেই কথা কিন্তু একদিক থেকে আসত না— সবদিক থেকে যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে একই কথা নানা সুরে নেচেনেচে আমার দুকানে ঢুকে যেত। আমি তখন এতই ছোট্ট যে আমার কথা শুনে সববাই হেসে গড়িয়ে পড়ত। বলত, মেয়েটার মাথা খারাপ। আমাকে বলত, দূর বোকা, গাছেরা কথা বলতে জানে না। ওরা বোবা। সব তোর মনের ভুল।
বললেই হল আমার মনের ভুল? আমি তো চারদিক থেকে একই ডাক শুনেছি— ওরে আয়, ওরে আয়, আমাদের কাছে আয়। ওই ডাক বড়রা শুনতে পায় না জেনে অবাক হয়েছি। তারপর নিজেই যখন বড় হলাম—আমার মগজের এই অদ্ভুত ক্ষমতাটা নিয়ে কথা বলাই ছেড়ে দিলাম। বললেই তো লোকে হাসবে, টিটকিরি দেবে, বলবে এ মেয়েটার মাথায় মস্ত ছিট আছে। গাছেরা তো নড়াচড়াও করতে পারে না, কথা বলবে কি করে? আমার শ্বশুরের বন্ধু এক মনের ডাক্তার এই সব শুনে-টুনে স্রেফ বলে দিলেন—মেয়েটা সপ্লিট্ পারসোনালিটিতে ভুগছে৷দ্বৈতচরিত্র। সিজোফ্রেনিয়া কেস। দেখছ, গাছেরা কথা বলতে জানে না শুনলেই কী রকম উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে? বা চোখের মণি সরে যাচ্ছে? তখন তো ওকে অন্য মেয়ে বলে মনে হয়—এ যেন সেই ত্রিশিরা নয়।
আমার জন্মের পর নামকরণ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা গবেষণাটবেষণা হয়েছিল। আমার দাদু বলেছিলেন, ঝট করে নাম দিতে যেও না। নাম আসে ভগবানের কাছ থেকে। বাপ-মা মনে করে—আমরা নামকরণ করলাম। ভুল, ভুল। নামটা জুগিয়ে দেন নিয়তি—ওই নামের মধ্যেই জাতকের গোটা নিয়তিটা লেখা হয়ে যায়। এসব মিসটিসিজম তোমাদের মাথায় ঢুকবে না—দু’পাতা বিজ্ঞান পড়ে ভাবো মস্ত বিজ্ঞানী হয়েছ। বিশ্বজ্ঞানের কতটুকু খবর রাখে দুদিনের বিজ্ঞান? রাখে বটে অকাল্ট-সায়ান্স। যাকে তোমরা অপবিজ্ঞান অথবা পরাবিজ্ঞান বলে নাক সিটকোঁও। যারা নিজেদের বাহাদুরি দেখাতে যায়, তারাই কানা ছেলের পদ্মলোচন নাম দিয়ে বসে। আমার এই নাতনির কপালটা দেখেছ? হ্যা, হ্যা, একটু উটকপালি। ময়দানের মতন চওড়া কপাল বলেই দাগ তিনটে অত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দুই ভুরুর মাঝখান থেকে ঠিক যেন একটা গাছের গুড়ি উঠেছে। উঠেই তিনদিকে তিনটে ডাল মেলে ধরেছে। গাছেদের আশীর্বাদ নিয়ে জন্মেছে এই মেয়ে—নাম রাখতে হয়, গাছেদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখবে।
দাদুর কথায় সবাই নাকি হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ধরেছে তো বটেই। নইলে নাতনির মাথায় গাছের গুড়ি আর তিনটে ডাল কল্পনা করতে যাবে কেন?
দাদু নাকি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে আমার কপাল পরীক্ষা করতেন। বলতেন, উটকপালির নিয়তিটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এ মেয়ে সহ্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দেবে বড় হয়ে। মুখ বুজে সহ্যই করে যাবে। অনেক ঝড়-ঝাপটা যাবে এর জীবনের ওপর দিয়ে। এ কিন্তু বাংলার বধূ, মুখে তার মধু, নয়নে নীরব ভাষা নিয়ে তাক লাগিয়ে দেবে দুনিয়াকে।
আমার মুখরা দিদিমা তখন নাকি বলেছিলেন—“সাধন ভজন করে অনেকদিন আগেই তোমার মাথাটা বিগড়েছে। নাতনি নিয়ে আহ্বাদে আটখানা হয়ে আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছ। কপালের ওই দাগগুলো শিরা—বয়স হলেই দেখা যায়— তোমার যেমন রয়েছে—তোমার নাতনির কপালে আঁতুড়ে অবস্থাতেই ফুটে উঠেছে। তবে তুমি যখন গাছ-গাছ করে লাফাচ্ছে—নিজের বয়সের তো গাছ-পাথর নেই— বুড়ো হাবড়া কোথাকার—তখন নাতনির নাম তোমার কথার মতনই থাকুক।”
“কী নাম?” প্রশ্ন ছিল দাদুর।
“ত্রিশিরা।”
“ত্রিশিরা নামে কোনও গাছ আছে?”
“তোমার মুণ্ডু আছে। ওর মাথায় যখন শিরা ফুটে রয়েছে গাছের ডালপালার মতন—তখন ওর নাম হোক ত্রিশিরা।”
দাদু কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকবার পর বলেছিলেন—“এ মেয়ে নিশ্চয় আগের জন্মে গাছ ছিল।”
হেসে গড়িয়ে পড়েছিলেন দিদিমা—“শুনেছি পাথর থেকে গাছ হয়েছে, গাছ থেকে জীব-জন্তু-পাখি হয়েছে, জীব-জন্তু-পাখিরা অনেক যোনি ঘুরে অনেক পুণ্য সঞ্চয় করে তবে মানুষ হয়েছে। তোমার পুণ্যের ফলে তোমার নাতনি ঝট করে গাছ থেকে নতুন জন্মে মানুষ হয়ে জন্মে গেল। পুণ্যবান বুড়ো, আর মুখ খুলো না।”
না, দাদু আর মুখ খোলেননি। আমার এক বছর বয়সেই দাদু মারা যান অদ্ভুতভাবে। মস্ত বাগানে বড় বড় গাছের তলায় বসে উনি ধ্যান করতেন। গাছেদের ভেতর থেকে নাকি শক্তি আহরণ করতেন। তার ফলেই নাকি ওঁর মধ্যে আশ্চর্য অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা এসে গেছিল। যা বলতেন, তা সত্যি হতই। আমার সম্বন্ধেও নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে গেছিলেন—আমাকে কোলে নিয়ে গাছতলায় বসে থাকতেন—বলতেন— ত্রিশিরা অসাধারণ মিডিয়াম। বৃক্ষ জগতের সঙ্গে ওর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ওর মুখে কথা ফুটুক—গাছেরা ওর মুখ দিয়েই গাছেদের গুপ্ত জীবন-রহস্য ব্যক্ত করে যাবে।
কিন্তু সে সুযোগ উনি পাননি। ওঁর প্রিয় বটগাছতলাতেই তাকে বটের ঝুরিতে ঝুলতে দেখা গেছিল। আমি ওঁর ঝুলন্ত শরীরের পায়ের তলায় হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম। আর ওপরে তাকিয়ে তাকিয়ে ডেডবডি দেখছিলাম। কাঁদিনি। চেঁচাইনি। কথা তো বলতেই পারতাম না। কথা ফুটেছিল দাদুর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঠিক তিনদিন পরে।
থ হয়ে গেছিলেন দিদিমা। তড়বড় করে যখন কথা বলতে আরম্ভ করেছিলাম, তখন এই দিদিমাই ছিলেন আমার অষ্টপ্রহরের সাথী। আগডুম বাগডুম কত রূপকথাই শোনাতেন আমাকে। প্রায় সব গল্পের মধ্যেই ঘুরে ফিরে আসত একটা বিশাল বটগাছের গল্প। সে বটগাছটা নাকি জ্যান্ত গাছ ছিল। তার বয়সের ঠিক-ঠিকানা ছিল না। অনেক ঝুরি নামিয়ে মাটির মধ্যে চালান করে দিয়ে মাটির রস শুষে নিয়ে হাওয়ায় ডালপালা দোলাত। বেশ কিছু ঝুরি মাটি ছুঁলেও মাটির ভেতরে ঢুকতে চাইত না। সাপের মতন হেলেদুলে নাচত। কেউ কাছে গিয়ে গাছেদের দূর ছাই করলে সঙ্গে সঙ্গে কিলবিলিয়ে উঠে তাকে পেঁচিয়ে ধরত। গাছ আমার বাপ, গাছ আমার মা— গালমন্দ আর করব না—এবার ছেড়ে দে না”—এই মন্তরটা আউড়ে গেলেই লতার বাঁধন খসে যেত। কিন্তু একটা থুথথুরে বুড়োকে এই বটগাছটা খুব সমীহ করত। বুড়োটা সেই গাছের তলায় বসে জপতপ করত। বটগাছের একটা ডাল নুয়ে পড়ে চামর দোলানোর মতন দুলে দুলে তাকে হাওয়া করত। অথচ একদিন এই মহাবট মহাপাগলা হয়ে গেছিল। বুড়োর গলায় ঝুরির ফাঁস লাগিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে দমবন্ধ করে মেরেছিল। পায়ের তলায় বুড়োটার নাতনি খেলা করছিল। মহাবট তাকে কিছু বলেনি। এমন কি বুড়োর মড়া শরীরটা মাটিতে ফেলেও দেয়নি—যদি নাতনি চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়। নাতনিকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতেই বটের ঝুরি আপনা থেকেই নেমে এসেছিল। বুড়োটার মড়া মাটিতে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিয়েছিল। গলার ফাঁস আস্তে আস্তে খুলে নিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত বুলিয়ে বুলিয়ে যেন আদর করছিল। শিউরে শিউরে উঠেছিল আশপাশের সবাই। সেই থেকে মহাবটের নাম দিয়েছিল মৃত্যুবট। বছরে একবার তাকে পুজো করত দূর থেকে—যেদিন বুড়োকে ফাঁসিতে লটকেছিল— সেইদিন।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা ছাঁদে ফেলে একই উদ্ভট কাহিনী আমাকে শুনিয়ে যেতেন দিদিমা আর প্রতিবারেই গল্প শেষ হলেই ভীষণ উৎকণ্ঠায় ফাটো-ফাটো হয়ে আমি জিজ্ঞেস করতাম—“বুড়োকে ফঁাসিতে লটকালো কেন, দিদা?”
অমনি দিদিমার মুখটা শুকিয়ে আমসি হয়ে যেত। আমতা আমতা করে বলতেন— তিনদিন পরেই মেয়েটার মুখে বোল ফুটবে জেনে গেছিল যে।’
“বোল ফুটলে বটের কী?”
“গাছেদের গোপন রহস্য তাহলে যে বলে দিত মেয়েটা।”
“গাছেদের আবার রহস্য কী ?”
“আছে… আছে… বড় হলে বুঝবি।”
সমস্ত অণু-পরমাণু দিয়ে বুঝেছি সেই রহস্য। দিদিমা রোজ একই গল্প ফর্ম পালটে পালটে আমাকে শুনিয়ে গেছেন আমাকে মনে মনে তৈরি করার জন্যে। একবারও বলেননি, সেই বুড়োটা আমারই দাদু। মহাবট তাঁকে ভালবাসত, তাই ডাল নেড়ে ব্যজন করেছে। কিন্তু তার গভীর গোপন রহস্য পাছে ফাঁস করে ফেলি আমি মুখে খই ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে—তাই বুড়ো দাদুর মুখ বন্ধ করে দিয়েছে গলায় ফাঁস দিয়ে। আবার, মড়ার ওপর ঝুড়ি বুলিয়ে বুলিয়ে গভীর শোকে বিহুল হয়ে থেকেছে৷
হ্যাঁ, আমি সেই মহাবটের সন্ধান পেয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির কয়েক বিঘে জোড়া বিশাল বাগানে রয়েছে সেই বৃক্ষ। আমি যখন হাঁটতে শিখেছি, দৌড়তে শিখেছি—ছুটে ছুটে চলে যেতাম তার কাছে। সে যেন আমাকে চুম্বকের মত টানত। বাড়ির মধ্যে থেকেই তার গভীর গম্ভীর গোপন ডাক শুনতে পেতাম নানা দিক দিয়ে—‘আয়.আয়…কাছে আয়!” এর বেশি আর কথা শুনতাম না! অবোধ বালিকা ছিলাম—যা শুনতাম, তাই বলতাম। লোকে হাসত। শুধু দিদিমা ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। আমাকে বাড়ি থেকে বেরতে দিত না। আমি কিন্তু ঠিকই চলে যেতাম, বিশেষ করে যেতে চাইতাম যখন খুব জোরে বৃষ্টি হত—আমি যেন পাগল হয়ে যেতাম। ঝড়ো হাওয়া আর দামাল বৃষ্টিতে ধূসর আকাশের নীচে বিরাট বিরাট মহীরুহগুলো যেন প্রাণবন্ত হয়ে দুলে দুলে হেলে হেলে ডালপালা পাতা ঘষে ঘষে সুগভীর নিনাদ সৃষ্টি করে আমাকে দশদিক থেকে ডাকত..ডাকত..ডাকত..নানা কথায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটাই কথা অন্যের কাছে অশ্রুত শব্দলহরীর মধ্যে দিয়ে বলে যেত—‘ওরে আয়.ওরে আয়..আমাদের কাছে আয়…তুই তো আমাদেরই একজন…খেলবি আয়…’ আমি যেন কীরকম হয়ে যেতাম। চমকে চমকে উঠতাম—কিন্তু একদম ভয় পেতাম না। বরং আহ্বাদে চৌচির হয়ে ছুটে যেতে চাইতাম ঝমাঝম বৃষ্টির মধ্যে। দিদিমা আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখত আর আমার কানের কাছে বিড়বিড় করে গাল পেড়ে যেত—“ঘাটের মড়া মহাবট, ছেড়ে দে..আমার নাতনিকে ছেড়ে দে..আমার সোয়ামিকে খেয়েছিস….তোর কি এখনও খিদে মেটেনি ? খা.খা…আমাকে খা।”
বাড়ির সবাই থ হয়ে থাকত। গোটা বাগান হু-হুঙ্কারে যেন তাণ্ডব নাচ নেচে যেত দিদিমার গালমন্দে—মাটি থেকে শেকড় তো তুলতে পারে না ওরা…কিন্তু মহাকায় শরীরগুলো দানবিক ভঙ্গিমায় মোচড় দিয়ে দিয়ে, হাওয়া যেদিক থেকে কানফাটা আওয়াজে ধেয়ে আসছে—ঠিক সেই দিকেই ডালপালা সমেত নিজেদের ঝুঁকিয়ে দিয়ে যেন অট্ট অট্ট হেসে রক্ত হিম করা গজরানি ছেড়ে ছেড়ে বলে যেত— ‘দ্যাখ.দ্যাখ..আমাদের শক্তি দ্যাখ…পবনকেও তোয়াক্কা রাখি না…ছেড়ে দে…আমাদের মেয়েকে ছেড়ে দে..নইলে অনর্থ ঘটাব।’
এই হুমকি স্পষ্ট শুনতে পেতাম আমি—বাড়ির সবাই শুধু কাঠ হয়ে শুনত আর দেখত অসম্ভব অবিশ্বাস্য সেই দৃশ্য—ঝোড়ো হাওয়ার দিকেই হেলে পড়ে লক্ষ লক্ষ হায়নার মতন অমানবিক হাসি হেসে চলেছে মহীরুহরা। আমি সব বুঝতে পারতাম…কেঁদে কেঁদে বলতাম—“ওগো, আমাকে ছেড়ে দাও..ওরা আমাকে খেলতে ডাকছে…আমাকে যেতে দাও।”
দিদিমা ততই আঁকড়ে ধরত আমাকে। এইভাবে অনেকগুলো কালবৈশাখীর মধ্যে দিয়ে আমি একটু একটু করে বড় হয়ে গেলাম। আমার শরীরে ফুল ফুটল। আর আমাকে ধরে রাখা যেত না। ফুডুক ফুডুক করে পালিয়ে গিয়ে বিশাল বাগানের গাছেদের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকতাম। আমার নখের ডগা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত আশ্চর্য শিহরণের ঢেউ বয়ে যেত। সে যে কি শিহরণের ঢেউ, তা আমি মুখ ফুটে বলতে পারব না। সব মেয়েরই শরীর মনে একটা অনাস্বাদিতপূর্ব আকাঙক্ষা জেগে ওঠে বয়সের বিশেষ একটা সোপানে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আমার মনে ঠিক সেই আকাঙক্ষা তীব্র হয়ে উঠত জানলা দিয়ে বাগানের গাছপালার দিকে চেয়ে থাকলেই। তখন নাকি আমার চোখের একটা তারা একটু সরে যেত..আমার কপালের তিনটে শিরা ফুলে উঠত…আমি যেন অন্যরকম হয়ে যেতাম।
আমার সেই দিদিমা তখন মাজা ভেঙে মেঝের বিছানা আশ্রয় করেছেন। ওঠবার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু কান্না জড়ানো গলায় বিছানা থেকেই আমার মাথা খেতেন— “যাসনি, তোকে নষ্ট করে দেবে… তোর দাদুকে মেরেছে… তোকেও শুষে খাবে। আবাগীর বেটি… আমার কথা শোন— ”
শুনিনি, দিদিমার কথা শুনিনি। কেন শুনব ? গাছেরা যখন ডাকে, গাছেদের সেই ডাক যখন কেউ শুনতে পায়না—উল্টে হাসাহসি করে—তখন ওরা আমার কে ? আমার আপনজন তো ওই গাছেরা…
ঝড় যখন উঠত, প্রলয় বৃষ্টি যখন নামত, ঠিক তখন ওই বাগানটাকেই যেন চাঁদমারি বানিয়ে আকাশের বাজ লকলকিয়ে নেমে আসত—কিন্তু কী আশ্চর্য! গাছেদের মাথার ওপর থেকে ঠিকরে গিয়ে লোহার ল্যাম্পপোস্ট বেয়ে মাটিতে সেধিয়ে যেত। যেন অদৃশ্য বর্ম দিয়ে নিজেদের মুড়ে রেখে দিত মহাবৃক্ষরা…অতীন্দ্রিয় শক্তিধর গাছেরা…
একদিন…শুধু একদিন প্রলয়ঙ্কর কালবৈশাখী লোমহর্ষক আর্তনাদে সদর দরজার ওপর আছড়ে পড়ে হুড়কো ভেঙে দুহাট করে দিয়েছিল দুটো কপাট…
দড়াম দড়াম শব্দ ধাত ছাড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ির সকলের। ওই একটা আওয়াজেই যথেষ্ট। কেননা, কানের পর্দা ফটানো হুকুমটা যে শুনেছিলাম ঠিক তখুনি—‘বেরিয়ে আয়..আমার কাছে আয়!’
আমি ছুটে বেরিয়ে গেছিলাম। আমার নাইটি জলে ভিজে গায়ে লেপটে থেকেও গা থেকে যেন ছিড়ে উড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছিল। আমার প্রতিটি রক্তকণিকায় অকস্মাৎ উদাম হয়ে উঠেছিল আতীব্র সেই আকাঙক্ষা…চরমানন্দ লাভের সঙ্গলিন্সা!
জ্যামুক্ত শায়কের মতন বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, ঝড়ের দামালির মধ্যে দিয়ে ধেয়ে গিয়ে আছড়ে পড়েছিলাম মহাবটের ওপর। মৃত্যুবট তৎক্ষণাৎ অজস্র ঝুরি এগিয়ে দিয়ে জাপটে ধরেছিল আমাকে তার প্রকাণ্ড গুড়ি-শরীরে। ঝড় নুইয়ে দিতে পারেনি তার প্রকাণ্ড ডালপালা—ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি ঝুরি-লতাদের—তারা যে আমাকে পেয়েছিল.আকাঙক্ষা-মদির আমার শরীরটাকে পরম আদরে জাপটে ধরে আমার অণু-পরমাণুর জ্বালা জুড়িয়ে দিচ্ছিল। পরমা সুখাবেশে আমি প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়ছিলাম। অর্ধ-চেতনার মধ্যে এইটুকুই শুধু উপলব্ধি করেছিলাম—আমি এই গাছেদেরই একজন..আমার শরীরে চাহিদা জাগাতে পারে শুধু এরা…সেই চাহিদা মেটাতেও পারে শুধু এরা…অনল জ্বালাতে পারে…অনল নেভাতে পারে…অনল জ্বালাতে পারে…অনল নেভাতে পারে…
আমি নাকি পাগল হয়ে গেছিলাম ভয়ঙ্কর সেই ফুলশয্যা’র পরের মুহুর্ত থেকেই। সবরকমের চিকিৎসাই যখন হয়ে গেল—আমার উন্মনাভাব এক মুহুর্তের জন্যেও তিরোহিত হল না—তখন দিদিমার প্ররোচনায় আমার বিয়ে দেওয়া হল অনেক দূরে.বিশাল বাগান থেকে অনেক…অনেক মাইল দূরে..বরের সঙ্গে যখন বিদায় নিচ্ছি, তখন দিদিমা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল কানের গোড়ায়—“ভূতুড়ে বাগান তোকে যে সুখ দিয়েছে, তার চাইতেও বেশি সুখ দেবে এই নাতজামাই। ওকে জাগাবি—নিজেও জাগবি—রোজ রাতে।’
জাগতে কিন্তু আমি পারিনি। জাগাতেও পারিনি। আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল কলকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলের পাহাড়ের মতন একটা অ্যাপার্টমেন্ট-হাউসের চোদ্দতলায়। সেখানকার বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হত যেন দাৰ্জিলিং-এর ম্যালে-তে দাঁড়িয়ে অনেক নিচে ছোট ছোট বাড়ি দেখছি। কিন্তু সেই আকাশী ফ্ল্যাটে মাটি ছিল না…গাছ ছিল না…আমি একটু একটু করে মরে যাচ্ছিলাম। ফুলশয্যা বৃথা গেছে। আমার বর বুঝে ফেলেছিল, নামেই আমি নারী..নারীত্ব আমার মধ্যে নেই। রাতের পর রাত একটা জড় পদার্থের সঙ্গে নাকি ঘর করা যায় না।
তাই বছর ঘুরতেই হল ডিভোর্স। থারটিন-বি সেকশন অনুযায়ী মিউচুয়াল ডিভোর্স। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ। আমার বর আমাকে ভালবাসত— আমি তাকে সুখ দিতে না পারলেও ভালবাসত। তাই আমাকে এই বালিগঞ্জেই একটা বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট উপহার দিয়েছিল। বলেছিল—“সুখে থাকো, ত্রিশিরা। আর কি চাও?’
আমার মুখ দিয়ে চাহিদাটা তীরের মতন বেরিয়ে গেছিল—“গাছ।”
হতভম্ব চোখে চেয়ে থেকে এক্স-বর বলেছিল—“গাছ এত ভালবাস ?…”
‘ওরাও যে আমাকে ভালবাসে।”
“আমার চেয়েও ?”
“তোমার চেয়েও। ”
গাছ ভর্তি অ্যাপার্টমেন্টে আমি জেগেছিলাম। আমার যৌবন উত্তপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই অনল প্রশমিত করবার ক্ষমতা এই খুদে গাছেদের ক্ষমতার মধ্যে ছিল না। ওরা কিন্তু বিষগ্ন গলায় আমাকে বলে যেত—“তুমি আমাদেরই একজন। তাই বুঝতে পারছি তোমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। যাও, মহাবটের কাছে যাও—সে পারবে তোমায় সুখী করতে। তোমার আগুন নেভাতে গিয়ে আমরা নিজেরাই যে নিভে যাব।’
যখন কালবৈশাখীর ঝড়ে আকাশচুম্বী অ্যাপার্টমেন্ট-হাউস থরথর করে কাপত, তখন অনেক…অনেক মাইল দূর থেকে ভেসে আসত মহাবটের ডাক—‘ওরে আয়, কাছে আয়, তুই যে আমাদের প্রমোদ-কন্যা। তোকে জাগাতে পারি আমরা—নেভাতেও পারি আমরা। আয়, আমার কাছে আয়—সেই সেদিনের মতন প্রলয় বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ছুটে ছুটে চলে আয়।
ছুটে ছুটে চলে গেছিলাম। একটানা তিনদিন ধরে আকাশ ভেঙে ভেঙে পড়ছিল। দীঘার জল ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। সমুদ্র আর নদীরা ক্ষেপে গিয়ে ফুলে ফুসে প্লাবন এনেছিল। আমি ছুটে ছুটে যেতে যেতে একটাই কথা শুধু ভেবেছিলাম—মহাবট আমাকে প্রমোদ-কন্যা বলল কেন? দাদুর ভবিষ্যৎবাণী তো অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়ে দিলাম। বাংলার বধূ, মুখে আমার মধু, নয়নে নীরব ভাষা। মূর্তিমতী সহনশীলতা আমি। এত ঝড়ঝাপটার মধ্যেও আমি ফেটে পড়িনি কোথাও। ভালবাসা পেয়েছি সব্বার—এমন কি আমার প্রাক্তন বরেরও—এখনও—তবে কেন আমি প্রমোদকন্যা ?
ছুটে ছুটে গেছিলাম বললাম বটে, আক্ষরিক অর্থে তা তো নয়। ঝড়ের মতন উড়ে গেছিলাম। মোটর গাড়িতে। আমার প্রাক্তন বরের গাড়িতে। ডিভোর্সি বউকে সে কখনো ঘেন্না করেনি। আমার ফোন পেয়েই সেই ঝড় জল মাথায় করে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল। আমি ওর পাশেই বসেছিলাম। একটা কথাও বলিনি। বাগানের বাইরে, গাড়ি দাঁড় করিয়ে, গাড়ির মধ্যে ওকে বসিয়ে রেখে দৌড়ে চলে গেছিলাম ঝড় জলে নুয়ে পড়া অভ্যর্থনা জানানোর ভঙ্গিমায় মহীরুহদের তলা দিয়ে। মাথার মধ্যে দামামা-ধ্বনির মতন বেজে যাচ্ছিল ওদের আহ্বান—‘কাছে আয়…কাছে আয়.একটু সুখ দিয়ে যা..তুই আমাদের প্রমোদ-কন্যা..আগে তো ছিলি…এখনও আছিস.আয়! আয়! আয়!’
দামামা-আহ্বান ছাপিয়ে কানে ভেসে এসেছিল লক্ষ করতালি বাজিয়ে বটের ঝুরির শূন্য-আস্ফালন—খবরদার! শুধু এখানে আয়.ফুলশয্যা তৈরি এখানেই।
মহাবটের চেহারা দূর থেকে অন্য কেউ দেখলে নিৰ্ঘাৎ শিউরে উঠত। সব কটা আলগা ঝুরি লকলকিয়ে বাড়িয়ে ধরেছিল আমার দিকে হাওয়ার ঝাপটাকে উপেক্ষা করে। আমি অদম্য অবর্ণনীয় কামনায় অধীর—কাণ্ড জ্ঞান শূন্য—ঝাপিয়ে পড়েছিলাম লতাদের জটা জালের মধ্যে।
সস্নেহে জড়িয়ে জাপটে ধরে ওরা আমাকে টেনে নিয়ে সাপটে ধরেছিল বিশাল চওড়া ডুমোড়মো গুড়ির গায়ে…মুহ্যমান অবস্থায় উপলব্ধি করেছিলাম সুখাবেশের সপ্তম স্বর্গে আরোহণ করছি আমি…আমার সমস্ত শরীর মুচড়ে দুমড়ে থেতলে ক্ষতবিক্ষত রুধির ঝরা হয়ে যাচ্ছে…কিন্তু সেই আমার আনন্দ…এই নিপীড়নই আমার কাম্য…এমন আলিঙ্গন মহাবট ছাড়া কেউ তো দিতে পারবে না…প্রমোদ-কন্যার অভিসার সার্থক এই রাত্রি নিশীথে…
ভোরের আলো ফুটতেই, ঝড় জলের হানা বন্ধ হতেই খরগোশের মতন বাগানের মধ্যে দৌড়ে ঢুকেছিল আমার এক্স-হাজব্যান্ড—মহাবটের গল্প আমার কাছে শুনেছিল বলেই সটান দৌড়ে এসেছিল উন্নতশির মহাবৃক্ষকে লক্ষ্য করে…
দূরেই দাড়িয়ে গেছিল পাথরের মূর্তির মতন।
লতাদের চোখ দিয়ে আমি মজাসে দেখছিলাম তার চোখমুখের চেহারা.আতঙ্ক আর বিস্ময় একাকার হয়ে গেছে চোখের তারায়, মুখের পরতে…
আমি তো হিলহিলে লতাদের চোখ দিয়ে নিজেকেও দেখতে পাচ্ছিলাম। সে দৃশ্য ভাষায় ফোটানোর ক্ষমতা আমার নেই। না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আমার আধখানা আমি দেখছিলাম—বাকি আধখানা মহাবট শুষে গুড়িয়ে টেনে নিয়েছে কপাটের মতন চওড়া বিশাল গুড়ি-বুকের মধ্যে…
পেছন দিকটা চলে গেছে গুড়ির ভেতরে.মাথার পেছন দিক…পিঠ, … নিতম্ব …
সামনের দিকটা বেরিয়ে আছে গুড়ির বাইরে…উটকপালি মুখ..নাক…চিবুক…বুক…নাভি…
সম্পূর্ণ নিরাবরণা..লতারা বসন নিয়েই সন্তুষ্ট…
আমি যে প্রমোদ-কন্যা.গাছেদের সববাইকে প্রমোদ বিতরণ করেই যাব… এখনও যাচ্ছি…পরমানন্দে…সেই গুহ্য তত্ত্ব অনুদঘাটিতই থাক।
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, গল্প, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রমোদ কন্যা
gach e der niye ei concept ta,puro bepar tai,sharirik beparta shudhu noy,ei concept ta adrish babur lekha theke humayun ahmed onupranito hoechen.unar kichu uponyas o galpo ache.
bhebe obak laglo kato kato din age adrish babu eto odbhut concept nie kaj korechen.
motamot ekantoi amar,karor mone hotei pare humayun ahmed er gach er lekha guli moulik.
kalpobiswa patrika ke dhaynobaad
prosenjit