প্রলয়
লেখক: পিয়াল চক্রবর্তী
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
প্রলয় উপস্থিত।
এভারেস্ট এর মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরের মতো বিল্ডিং ও তার পাশের রকেটের দিকে তাকিয়ে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল রাজের।
দুইদিন আগেই মা মারা গিয়েছেন। তারপর অন্যরাও একে একে, এখন শুধু ওই বেঁচে আছে।
আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েই খুশি হল রাজ। বাঃ, মায়ের কাছে যাওয়ার সময় এসে গিয়েছে।
আকাশে জমাট বাধা কালচে লাল রক্তের মতো মেঘ করেছে। অন্যন্য সময় যে লাল মেঘ দেখা যায়, এটা তার থেকে একেবারেই আলাদা।
রাজ জানে, এর থেকে অ্যাসিড বৃষ্টি হয়, আর বেশিরভাগ সময় অ্যাসিডের ফোঁটা বাতাসে ভাসমান অবস্থায় বিভিন্ন রাসায়নিক গ্যাসের সংস্পর্শে এসে জ্বলে ওঠে, তার ফলে অগ্নিবৃষ্টি হয়। দিন পনেরো আগেই একবার এরকম হয়েছিল। তাতে আটজন মানুষ জীবন্ত পুড়ে মারা গিয়েছে।
ঠাকুরদা বলেছিলেন, একটা সময় ছিল, যখন নাকি নীল আকাশ দেখা যেত দিনের বেলা, আর রাতের আকাশে ফুটে উঠত অসংখ্য নক্ষত্র।
আকাশ কোনওদিন দেখেনি রাজ। শুধুই লালচে মেঘ দেখেছে, আকাশ তার আড়ালেই ঢাকা পড়ে থাকে। জন্ম থেকে এটাই দেখছে ও। আর নক্ষত্র শুধুই স্যাটেলাইট এর সিগনাল এ দেখা যায়।
কালো পাথরের খাঁজে একটু জল জমে রয়েছে। কীভাবে কে জানে, এই জলটুকু এখনও পরিস্কার, সমুদ্রের জলের মতো নয়।
আঁজলা ভরে জল তুলে চোখে মুখে দিয়ে রাজ মুখ তুলে তাকাল সমুদ্রের দিকে।
পুরো সমুদ্রের জল ঘন কালো। জায়গায় জায়গায় জলের থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। কিন্তু তার মধ্যেও এখনও বেঁচে আছে কিছু সার্ক। ওগুলো কোনও সাধারণ সার্ক নয়, ডার্কস্পেস কোম্পানির বানানো অর্ধেক প্রাণী অর্ধেক যন্ত্র। এদের কাজ ছিল সমুদ্রে নামা মানুষদের খেয়ে শেষ করা।
অবাক চোখে রাজ দেখল সেই সমুদ্রের জলের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছেন কোট প্যান্ট পরিহিত একজন বৃদ্ধ, সার্কগুলো যেন তার অস্তিত্ব বুঝতেই পারছে না।
ভদ্রলোক কাছে এগিয়ে এলেন, রাজ তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
“এটা কি পৃথিবী?”
রাজ এতটাই অবাক হয়েছিল, যে কথাটা প্রথমে শুনতেই পায়নি, বৃদ্ধ আরেকবার বলতেই সে চমকে গিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ”
“আর্থ তো?”
“হ্যাঁ, আমাদের ধরণি”
“কত তারিখ?”
“২৩৪৫ সালের ১২ই জুন”
বৃদ্ধ অবাক চোখে চারিদিকে তাকালেন “বিশ্বাস হয় না, এতক্ষণ ঘুরে শুধু বিষাক্ত অ্যাসিডের সমুদ্র, কোথাও একটু স্থলভাগ নেই…..আচ্ছা, এটা কোন জায়গা?”
রাজ হাসল, “হিমালয়, ওটা মাউন্ট এভারেস্ট।”
সে আঙুল তুলে পিছনের পাহাড়ের দিকে দেখাল।
“মাই গড, এটা কোন সমুদ্র?”
“মহাসাগর, অন্য কোনও নাম নেই। শুনেছি এক সময় নাকি অনেক সাগর, সাতটা মহাসাগর ছিল, তাদের আলাদা আলাদা নাম ছিল, কিন্তু দেখিনি”
“আমি ভাবতে পারছি না, আচ্ছা, আর কী কোনও স্থলভাগ জলের ওপরে নেই?”
“না, সারা বিশ্বে শুধুই এইটুকু বেঁচে আছে।”
“অদ্ভুত, আচ্ছা, বরফ? বরফ কোথায়?”
“বরফ? রাজ অবাক হয়ে বলল “শুনেছি এক সময় এই পাহাড়ে বরফ ছিলে, কিন্তু আমি দেখিনি।”
“সব মানুষ কোথায় গেল?”
“পৃথিবীতে এখন জীবিত মানুষ বলতে দশ জন। ওই যে পাহাড়ের ওপরে গম্বুজ দেখছেন, ওটা একটা রকেট, ওর ভিতর রয়েছে প্রজেক্ট ডার্কস্পেস-এর মধ্যমণি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী পাঁচজন ব্যক্তি, দুইজন বিজ্ঞানী ও এদের রক্ষক একটি মানবরূপী দানব, নাম ডেডআই। তবে আর বেশিক্ষণ না, একটু পরেই এরাও উড়ে যাবে আর্থ-২০১২ গ্রহের উদ্দেশ্যে। এখানে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করব আপনি আর আমি।”
“কিন্তু ওরা ওই আর্থ-২০১২ গ্রহে চলে যাচ্ছে কেন?”
“ওরা জেনেছে আমাদের এই পৃথিবী আর পাঁচ ঘন্টার মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই ওরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে…”
“কিন্তু অন্যান্য মানুষ?”
“তারা মৃত। ওই ধনী ব্যক্তিদের এই ডার্কস্পেস প্রজেক্ট এর ফলশ্রুতি সবার মৃত্যু।”
“সে কী?”
“হ্যাঁ”
“কিন্তু ওরা এসব করল কেন?”
“আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এরা বুঝেছিল এই ধ্বংসের কথা, তাই এভারেস্ট এর পাথরের নিচে খনন শুরু করে দেয়, কারণ এখানেই আছে স্ট্রকরিয়ম নামের এক তেজস্ক্রিয় পদার্থ, যায় থেকে প্রস্তুত জ্বালানি ব্যবহার করে এরা তিনশ তেত্রিশ আলোকবর্ষ মাত্র এক ঘন্টায় উড়ে যেতে পারবে। কিন্তু এরা নিজেরা থাকে সুরক্ষিত জায়গায়, আর এই স্ট্রকরিয়মের তেজস্ক্রিয়তা এই অঞ্চলের সমস্ত মানুষকে শেষ করে দিয়েছে, বাকি আছি শুধু আমি আর আপনি? কিন্তু আপনি কোথা থেকে এলেন?”
সমুদ্রের মধ্যেই কোনও আগ্নেয়গিরির বিস্ফারণ হল, অগ্নিবর্ণ পাহাড় প্রমাণ ঢেউ উঠে আবার আছড়ে পড়ল সমুদ্রেই, তারপর আবার শুরু হল বিস্ফোরণ।
“তিন-শ-তেত্রি-শ আলোকবর্ষ, সেখানে কী আছে?” ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।
“আর্থ-২০১২ গ্রহ, পুরোপুরি আমাদের এই বিশ্বের মতোই সেই গ্রহ, আবহাওয়া, পরিবেশ, আয়তন, সবই, বর্তমান বিশ্ব না, প্রায় দুশো তিনশো বছর আগের দুনিয়ার মতো।”
“এখানে গাছ নেই?”
ছিল। একটা, বিশ্বের শেষ গাছ, কিন্তু ওরা কাল ওটাও কেটে নিয়েছে, কী কাজে লাগবে ওদের।”
ভদ্রলোক রেগে উঠলেন, “ব্লাডি ফুল, নিজেদের কল্পনা নিয়ে মেতে আছে।”
রাজ অবাক হল, “মানে?”
মানুষ নিজের ধ্বংসকে নিজেই ডেকে এনেছে, অরণ্যনিধন, পরমাণু বিস্ফারণ, CFC, আরও কতো কী…”
“মা বলতেন, এই কথাটাই”
“একটা গল্প শুনবে?”
রাজ মনে মনে হাসল। বাতাসে অক্সিজেন ক্রমশ কমে আসছে। শ্বাস নিতেও অসুবিধে হচ্ছে। এরই মধ্যে ইনি চাইছেন গল্প শোনাতে?
“বলুন, জীবনের শেষ গল্প শুনে নিই।”
ভদ্রলোক হাসলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন “২০৪৫ সালে এক ভয়ানক সোলার স্টর্ম এর ফলে সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশের সমস্ত স্যাটেলাইট খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু তখনও একটাই স্যাটেলাইট ঠিক ছিল, তার নাম জি-৮১।
এই জি-৮১ স্যাটেলাইট এর সিগনাল বিশ্বের একটি মাত্র ল্যাপটপ-এ ধরা পড়ত ও। ডিকোড হত, সেই ল্যাপটপ এর নাম স্কাইপ্যাড।
ওই স্যাটেলাইট ও ল্যাপটপ, দুটিরই আবিষ্কারক ছিলেন ডক্টর গুপ্ত নামে একজন বিজ্ঞানী।
কিন্তু এক সময় কিছু গুপ্ত শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে ডক্টর গুপ্ত আত্মগোপন করেন, কিন্তু তাঁর স্যাটেলাইট ও ল্যাপটপ থেকে যায়। এরপরশুরু হয় আরেক বিপদ, সেই সোলার স্ট্রর্ম এর পরে সৌরজগৎ এ এক অদ্ভুত চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়, ফলে অন্য কোনও স্যাটেলাইট স্থাপন করা যায় না। তখন জি-১৮ ও স্কাইপ্যাডই মহাকাশ গবেষণার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়।”
বৃদ্ধ থামলেন।
দক্ষিণের সমুদ্রে আলোড়ন উঠল। একটা বিশাল জলস্তম্ভ, আচমকা মাথা তুলেছে। সেই কালো ভয়ানক জলস্তম্ভের ভিতর থেকে একটা লাল বিদ্যুতের রেখা বেরিয়ে এসে সমুদ্রের জল ছুঁতেই একটা বিস্ফোরণ হল।
চোখ ফিরিয়ে নিল রাজ।
“তারপর?”
“তারপর আর কী, ডক্টর গুপ্তর মেশিন দুটি খুব ভালো কাজ করতে শুরু করে, তারপর একদিন সেই স্যাটেলাইট আসন্ন প্রলয়ের সংকেত পাঠায়, তার সঙ্গেই জানিয়ে দেয় পরিত্রাণের উপায়, তিনশো তেত্রিশ আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ আর্থ-২০১২।”
বৃদ্ধ থামলেন।
রাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি এত কিছু জানলেন কীভাবে?”
“কারণ আমিই ওই স্যাটেলাইট ও ল্যাপটপ বানিয়েছি, আমিই ডক্টর গুপ্ত।”
রাজের হার্টবিট বেড়ে গেল। সে প্রায় লাফিয়ে উঠল, “আপনি!!”
“হ্যাঁ, আমিই।”
“কিন্তু আপনি কিভাবে এত বছর…”
“আমি নিজেকে সময়ের আওতার বাইরে রেখেছিলাম, তাই আজ আমি এখানে এসেছি।”
“মানে?”
ডক্টর গুপ্ত নামের ওই ব্যক্তি উত্তেজিতভাবে বললেন “পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব, কিন্তু তার জন্যে তোমায় দরকার।”
“কীভাবে?” রাজ অবাক হয়ে বলল।
“আমি আত্মগোপন করার আগে, স্কাইপ্যাড এর সেটিংস কিছু চেঞ্জ করেছিলাম। আজকে যে আর্থ-২০১২ দেখাচ্ছে, সেটা আর কিছুই না, সেটা ২০১২ সালের পৃথিবী, সেখানে যেতে হলে তিনশ তেত্রিশ আলোকবর্ষ দূরে যেতে হবে না, তিনশ তেত্রিশ বছর পিছিয়ে নিয়ে যেতে হবে বর্তমান সময়কে।”
“কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?” রাজের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে।
“স্কাইপ্যাডের সাহায্যে টাইম ট্র্যাভেল করা সম্ভব। ছোট্ট কাজ, কিন্তু ওরা সংকেতের ভুল ব্যাখ্যা করছে তাই বুঝতে পারছে না।”
“আপনি কেন করছেন না?”
“আমি অতীতের মানুষ, একমাত্র বর্তমানের কোনও মানুষ ওটা করতে পারবে।”
ডক্টর গুপ্ত তাঁর কোটের পকেট থেকে একটা ছোট হেলমেট বের করে রাজের হাতে দিলেন।
“এটা পরো।”
হেলমেটটা পরতেই ও দেখতে পেল, সারা শরীর একটা অদ্ভুত নীল পোশাকে ঢেকে গিয়েছে।
মাটির কাছে নেমে আসা একটা কার্বনের মেঘের খণ্ড ফেটে গিয়ে চারিদিক কালো ধোঁয়ায় ঢেকে দিল। তার ভিতরেই ডক্টর গুপ্তর গলা শুনতে পাওয়া গেল।
“ওই মন্দিরের বারান্দায় স্কাইপ্যাড বসানো আছে। তোমার কাজ ওর “৩” বোতামটা তিনবার টিপে এন্টার বাটন টিপে দেওয়া। এতে হয়ত তুমি মারা যাবে, কারণ আজ থেকে তিনশ তেত্রিশ বছর আগে তোমার অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু পৃথিবী বেঁচে যাবে। বিশ্ব আবার ফিরে যাবে ২০১২ সালে, তখনকার মানুষ আবার নতুন করে সভ্যতা এগিয়ে নিয়ে যাবে, হয়ত তারা এই ভুল আর করবে না।”
রাজ চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ভদ্রলোকের সব কথা তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু একবার চেষ্টা করলেই বা ক্ষতি কী? মরতে তো হবেই।
“আমি করব। পৃথিবীকে বাঁচাতেই হবে। আমায় এই পোশাকের ব্যবহার শিখিয়ে দিন।”
“তেমন কিছুই না, জাস্ট পায়ের নিচে ফায়ার স্টর্ম তোমায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে ওই মন্দিরের ওপর। সেখানে তোমার কাজ শুধু স্কাইপ্যাড এর বোতাম টিপে দেওয়া।”
“বুঝেছি, কিন্তু ওদের রক্ষক দানবের মতো সেই ডেডআই যদি বাধা দিতে আসে?”
“যদি ডেডআই তোমায় বাধা দিতে চেষ্টা করে, তবে তোমার হাতের গ্লাভস, যেটার নাম আর্মস্টর্ম, সেটা অ্যাক্টিভ হয়ে যাবে ও সেটাই তোমায় সাহায্য করবে ডেডআইকে প্রতিহত করতে।”
দূরে সমুদ্রের ওপর আগুন জ্বলে উঠল। ওখানে অগ্নিবৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
রাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “ফায়ার স্টর্ম অ্যাক্টিভ করে দিন।”
কয়েক মুহূর্ত পরেই একটা বিরাট আগুণের গোলা রাজকে নিয়ে সোজা উড়ে গেল মন্দির লক্ষ করে।
মিনিট তিনেক পরে মন্দিরের দরজার সামনে এসে নামল সেই আগুনপাখি রূপী রাজ।
মন্দিরের মূল দরজায় এসে দাঁড়াতেই একটা মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এল।
যে হাসল, তাকে দেখা গেল না, কিন্তু তার হাসির আওয়াজ যেন মন্দিরের থামের গায়ে গায়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
রাজ বাইরের দিকে তাকাল। আকাশ এখন সম্পূর্ণ মেঘাচ্ছন্ন। সেই কালচে লাল কিউমূলো নিম্বাস এর মতো মেঘের বুক চিরে হলদে চাবুকের মতো বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। একটা অদ্ভুত কমলা আলোয় চারিদিক ভরে উঠেছে। তার মধ্যেও ঘন কুয়াশার মতো কালচে কার্বনের মেঘ ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বাতাসে ভাসমান অবস্থায় ঘোরাঘুরি করছে। কখনও কখনও তার ভিতর থেকে ধোয়াঁর মতো একটা নীলচে আলো বেরিয়ে আসে।
রাজ বুঝতে পারল, বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। তার আলট্রা আর্মারের ফিল্টার ও অক্সিজেনের জোগান দিতে পারছে না।
মাথা অল্প অল্প ঘুরছে। তবুও কোনওক্রমে এগিয়ে গেল।
আর একটু, মাত্র হাতপাঁচেক দূরে সেই স্কাইপ্যাডের স্ক্রিন। একবার ওখানে পৌঁছে যেতে পারলেই….
“ব্রিলিয়ান্ট”
একটা ছায়ামূর্তি সামনে এসে দাড়াল।
“ডেডআই”
“প্লিজ” বলে উঠল রাজ, “আমায় এটা করতে দাও, পৃথিবী রক্ষা পাবে।”
প্রলয় আসন্ন, আমরা কয়েকজন মানুষ শুধু জীবিত রয়েছি। আর তিন ঘন্টা পরে আমাদের স্পেসশিপ আমাদের নিয়ে পাড়ি দেবে আর্থ-২০১২ গ্রহের উদ্দেশ্যে। সেখানে আমরা শুরু করব নতুন জীবন, আর তুমি এখানে দাঁড়িয়ে বলছ পৃথিবী রক্ষা করবে?”
“আমি সত্যি বলছি, আর্থ-২০১২ কোনও গ্রহ নয়, ওটা আমাদের অতীত, আমায় একবার…..”
রাজ কথা শেষ করতে পারল না। ডেডআই বলে উঠল “আমরা ছাড়া সারা বিশ্বে জীবিত মানুষ শুধু তুমিই আছ, কিন্তু মৃত্যুর জন্যে খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠেছ। তোমায় মরতেই হবে।”
ডেডআই পিঠ থেকে একটা তলোয়ার জাতীয় অস্ত্র খুলে হাতে নিয়ে স্কাইপ্যাডটা আড়াল করে দাঁড়াল।
বাইরে প্রচণ্ড শব্দ করে একটা ঘুর্ণিঝড় আছড়ে পড়ল ডানদিকের একটু উঁচু পাহাড়টার গায়ে, মুহূর্তের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে গেল পাহাড়টি।
রাজ আর দাঁড়াল না। কিন্তু এগোনোর চেষ্টা করতেই ডেডআই এর তলোয়ার থেকে একটা সবুজ আগুনের রেখা ছিটকে এল ওর দিকে।
রাজ অবাক হয়ে দেখল, ওর হাতের আর্মস্টর্ম আপনা আপনি অ্যাক্টিভ হয়ে গেল। একটা বিদ্যুতের রেখা চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল হাত ঘিরে।
ডেডআই এর প্রথম আঘাত কোনক্রমে এড়িয়েছিল। এবার দ্বিতিয়বার আঘাত আসতেই হাত দুটো উচুঁ করে এগিয়ে গেল। আগুনের রেখা আর্মস্টর্ম এর বিদ্যুতের সামনে পড়ে ঘুরে গিয়ে লাগল মন্দিরের একটা থামের গায়ে, একটা দিক ভেঙে পড়ল।
আর্মস্টর্ম জিনিসটা দেখে ডেডআই একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, সেই সুযোগ কাজে লাগাল রাজ। সর্বশক্তি দিয়ে ডেডআইকে একটা ঘুঁসি মেরে ছিটকে সরিয়ে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই স্কাইপ্যাড এর “3” বোতামটা তিনবার টিপে দিল।
ঠিক তক্ষুনি একটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা পিঠ থেকে বুক ফুঁড়ে নেমে এল। রাজের কান্না পেয়ে গেল, কিন্তু সেই কান্না আনন্দের কান্না, সে হো হো করে হেসে উঠল।
তার পিছনেই দাঁড়িয়ে ডেডআই, তার তলোয়ার ফুঁড়ে দিয়েছে রাজ এর বুক। তবুও রাজ হাসছে।
ডেডআই অবাক হয়ে তাকাল ওর দিকে পরক্ষণেই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল!
“নো নো…..না রাজ না….”
রাজ আবার হেসে উঠল। বুকের যন্ত্রণাটা অসহ্য, কিন্তু সেটা। আর ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে না, কারণ, ডেডআই এর চোখের আতঙ্ক ও দেখতে পেয়েছে…
“নো….!”
ডেডআই আর কিছু বলতে পারল না, মুহূর্তের মধ্যে এন্টার বাটন টিপে দিল রাজ। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিদ্যুতের শিখা নেমে এসে ঝলসে দিল ডেডআই এর শরীর। রাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল একটা অপূর্ব নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছে লাল মেঘের ফাঁক দিয়ে, যে রকম আকাশ ও কখনও দেখেনি।
ঠিক তখনি সমুদ্রের তীব্র গর্জন কানে এল ওর। জ্ঞান হারানোর আগে বুঝতে পারল, আকাশের মেঘ সরে গিয়ে শতবর্ষ ধরে না দেখা সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে পৃথিবীর বুকে।
তারপর ওর চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।
*****
“মিস্টার সেন, আমায় দেখতে পাচ্ছেন?”
ধড়মড় করে বেডের ওপর উঠে বসল রাজ।
এ কী? ও হসপিট্যালে কীভাবে এল?
আপনি দেখতে পাচ্ছেন?
ঘরে দাঁড়িয়ে দুজন ডাক্তার। তাদের একজন জিজ্ঞাসা করে উঠলেন,
“হ্যাঁ”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন ডাক্তার এসে ঢুকলেন। এরা দুজন বেরিয়ে গেল
যিনি এলেন, তাকে রাজ চেনে?
“ডক্টর গুপ্ত?” সে বিড়বিড় করে বলল।
ডাক্তার হাসলেন।
রাজ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে বেশ কিছু সবুজ গাছপালা দেখা যাচ্ছে। আর নীল আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ।
“আজ কত তারিখ?”
“১২ই জুন, ২০১২” ডাক্তার বললেন।
কিন্তু আমি তো ২৩৪৫ সালের ১২ই জুন…”
ডাক্তার হাসলেন, “স্কাইপ্যাড ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবহারকারী সময়ের বাইরে চলে যায়… কাজেই…”
তাহলে আমি এখন কী করব?
“অনেক কাজ আছে রাজ, তোমার অনেক কাজ আছে, মানুষকে আর একই ভুল করতে দেওয়া যাবে না, কাজেই সামনে অনেক কাজ, প্রস্তুত হও।”
রাজ বুঝল, তার হার্টবিট আবার বেড়ে গিয়েছে।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, পিয়াল চক্রবর্তী, প্রলয়, সুপ্রিয় দাস
দারুন