প্রহরণ
লেখক: পার্থ দে
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
১২ মার্চ , ২০১৭, কলকাতা
বাইপাসের মুখটায় একটা স্পিড ব্রেকারের সামনে লোকটা মোটরবাইকে আচমকা ব্রেক কষল। সুহানির নরম বুকটা লোকটার পিঠে লেপটে গেল। মনে মনে হাসল সুহানি। হেবি হারামি লোক তো! তবে লোকটাকে মনে ধরেছে তার। শট নেওয়ার আগেই তাকে দু হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছে! কাজ শেষ হলে বলেছে আরও তিন হাজার টাকা দেবে। বাইকের পিছনে বসে সুহানি লোকটাকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে। এভাবেই সে তার খদ্দেরদের রক্তে বিদ্যুতের ছোঁয়া দেয়। সোনাকমলের যত মেয়ে আছে তার মধ্যে সুহানির কাছে এলেই স্যাটিসফ্যাকশন গ্যারান্টেড। তবে আজ সে এই শাঁসালো খদ্দেরটাকে রাস্তা থেকেই ধরেছে। গনেশ টকিজের কাছে সে দাঁড়িয়েছিল। লাল নুডল স্ট্র্যাপ টপ আর হট প্যান্টে। বর্ষা, দিব্যারা বলে এই ড্রেসটায় তাকে আলিয়া ভাটের মতো লাগে। লোকটা আচমকা মোটরবাইকটা সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, “যাবে?”
“পাঁচ নেব। সঙ্গে একটা বিয়ার, দুটো ব্লাডি মেরী আর রাতের ডিনার। ভাল জায়গায়।”, সুহানি চুইংগাম চিবোতে চিবোতে বলেছিল।
পার্স থেকে একটা পার্পল দু হাজারি গান্ধী এগিয়ে দিয়ে লোকটা গম্ভীরমুখে বলেছিল, “উঠে এস।”
সুহানি তখনই বুঝেছিল লোকটা কম কথা বলে।
বাইপাস দিয়ে রাতের অন্ধকারে বাইক চলছে। নির্জনতার মধ্যে শুধু বাইকের ভটভট শব্দ। লোকটার কানের কাছে মুখ এনে সুহানি জড়ানো গলায় বলল, “এ বাবু অউর কিতনা দূর? ন’টা বাজে। গ্যারাহ বাজনে সে পহেলে মুঝে রামবাগান লওটনা হ্যায়। নেহি তো মওসি বহুত ডাঁটেগি।”
“বস্ আ গয়া”, লোকটা ফের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে মোটরবাইকটাকে হাইরোড ছেড়ে হঠাৎ নয়ানজুলির পাশ দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে আনল। কাঁচা রাস্তাটার পাশে ছড়ানো মাছের ভেড়ি। বাতাসে ভেসে আসছে জলজ গন্ধ। মাথার ওপর আধফালি মলিন চাঁদ। সুহানির বেশ ভাল লাগছে। সে মোটরবাইকের পিছনে বসে দুহাত দুপাশে পাখির মতো মেলে মাতাল গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “ইয়েএএএ”
“সসস্”, লোকটা মৃদু ভর্ৎসনা করে ডানদিকে একটা টার্ন নিয়ে বলল,“এসে গেছি।”
সুহানি চারদিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল, “ইয়াহা! খুল্লে মেঁ?”
বাইক দাঁড় করিয়ে লোকটা অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, শুধু বলল, “হ্যাঁ, এখানে।”
সুহানি চারপাশে ফের তাকাল। খোলা মাঠ, সবুজ ঘাসের বিছানা। মাথার ওপর নাইটল্যাম্পের মতো শুক্লা নবমীর চাঁদ।
“আজিব আদমী হ্যায়!” স্বগতোক্তি করল সুহানি। হেসে ফেলে বলল,“ডগি মারনা হ্যায় কেয়া? দেখ তোমার এমন ইচ্ছা থাকলে কিন্তু, ম্যায় অউর হাজার রূপিয়া জ্যাদা লুঙ্গি।”
লোকটা অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একটা হেঁয়ালির মতো।
“ঠিক হ্যায় বেটা শুরু হো যা”, হাসতে হাসতে সুহানি কাঁধের ব্যাগটা খুলে কন্ডোমের স্ট্রিপটা বের করতে যায়।
সেই মুহূর্তে এক টুকরো মেঘ এসে চাঁদের মুখ ঢেকে দেয়। সুহানি মুখ তুলে তাকানোর আগেই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে একখন্ড কাপড় গুঁজে দেয় তার মুখে। তার নরম দুটো প্রতিরোধী হাত ব্যাগ ছেড়ে উঠে আসার আগেই দুটো কঠিন হাতের সাঁড়াশি যেন তার হাত দুটোকে দুমড়ে মুচড়ে শরীরের পিছনদিকে নিয়ে একখন্ড নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। গোটা ঘটনাটা ঘটতে একমিনিটেরও কম সময় লাগে। মুখের গ্যাগ-টার পিছনে সুহানির তালু, জিভ আর দাঁত কয়েকবার নড়াচড়ার বৃথা চেষ্টা করে থমকে গেল। বিহ্বল দু-চোখ ফেটে নেমে আসছে অশ্রুধারা। সে বুঝতে পারে না এমন অভূতপূর্ব ঘটনার কার্যকারণ।
একবার হাঁটু তুলে লোকটাকে আঘাত করার শেষ চেষ্টা করে সুহানি। সঙ্গে সঙ্গে বজ্রকঠিন হাতে হাতুড়ির মতো ঘুঁষি নেমে এসে তার পা-টাকে অবশ করে দেয়, সুহানি ছিটকে পড়ে ঘাসের ওপর। মুখ তুলে দেখে চাঁদের ওপর থেকে মেঘ সরে যাচ্ছে। একটা ভয়ংকর ছায়ামূর্তি তার শরীরের ওপর নেমে আসছে। নেকড়ের মতো ধক ধক করে জ্বলছে তার চোখদুটো। লোকটার হিংস্র দুটো হাত তখন মেয়েটার নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস ছিঁড়ে নিচ্ছে। সুহানির দু চোখ জলে ভরে ওঠে। কি হচ্ছে তার সঙ্গে! সে তার ভারী উরু দুটো শক্ত করে চেপে রাখে। নেকড়ের মতো হিংস্র থাবায় লোকটা আঁচড়ায় কোমল উরুদুটো, মেয়েটাকে তার শরীরের তলায় পেড়ে ফেলে। ধারালো নখ বসে যায় শরীরে, যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে সুহানি। বুঝতে পারে অসম শক্তির লড়াইয়ে সে ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। তার শিথিল উরু দুটো দুহাতে ফাঁক করে লোকটা প্রবল শক্তিতে উপগত হচ্ছে। এক অগ্নিতপ্ত লৌহশলাকা যেন প্রবল আক্রোশে তার যোনির ভেতর ওঠানামা শুরু করেছে। লোকটার লালাঝরা মুখ নেমে এসেছে সুহানির মুখের কাছে। একটা হাত ইতিমধ্যে উঠে এসে তার গলায় চেপে বসেছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে, একটা জান্তব গন্ধ টের পাচ্ছে মেয়েটা। হঠাৎ বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে সুহানি দেখে তার ধর্ষকের হাতে উঠে এসেছে একটা স্মার্টফোন। ফোন-ক্যামেরায় লোকটা ভিডিও রেকর্ডিং করছে এ ধর্ষণদৃশ্য।
ক্রমে লোকটার শরীরের নিষ্পেষণ আর পেলভিক থ্রাস্ট বাড়তে থাকে। সুহানির মনে হয় তার শরীরের হাড় মড়মড় করে ভেঙে যাবে। তার সমস্ত শরীর এক চিৎকৃত যন্ত্রণায় ফেটে পড়তে চায় কিন্তু মুখের গ্যাগটার জন্য টুঁ শব্দ বেরোয় না। ঝাপসা হয়ে আসা চোখে সুহানি সেলফি মোডে রাখা স্মার্টফোনের ক্যামেরায় দেখতে থাকে নিজের ধর্ষিত হওয়ার ছবি। লোকটা ঝোড়ো গতিতে ওঠানামা করছে, নেকড়ের মতো ফুঁসছে, কখনও আনন্দের লহরীতে ভাসতে ভাসতে সমুদ্রের মতো গর্জে উঠছে। লোকটা যত আনন্দের শিখরের উঠতে থাকে তত তার হাত সাঁড়াশির মতো চেপে বসে মেয়েটার গলায়। হাঁসফাঁস করে সুহানি, চোখদুটো তার অক্ষিগোলক থেকে ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। কয়েক সেকেন্ড পর খোলা প্রকৃতির বুকে ঝিঁঝিঁর শব্দ ছাপিয়ে যখন এক উল্লসিত গোঙানির শব্দে লোকটা শীর্ষসুখ থেকে নেমে আসছে তখন তার স্খলিত স্মার্টফোনের ফ্রেমে ফুটে ওঠে এই নাটকের শেষদৃশ্য। একটি বেশ্যার চোখের মণিদুটো অনেক লড়াই আর যন্ত্রণার পর পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়।
লোকটা উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সুহানি নামের মেয়েটার হাতব্যাগটা খুঁজে নেয়। চেন খুলে ভেতর থেকে আলগোছে একটা দু-হাজারী গান্ধী বের করে নেয়। হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির দিকে এগোয়। দাঁড় করানো মোটরবাইকের পিলিয়নে বসে একটা সিগারেট ধরায়। হাতের স্মার্টফোনের গ্যাল্যারি খুঁজে সদ্য সেভ হওয়া ভিডিওটা ওপেন করে শেয়ার অপশনে যায়। তারপর দ্রুত একটা দশ সংখ্যার ফোন নম্বর টাইপ করে ভিডিওটা উদ্দিষ্ট নম্বরে সেন্ড করে দেয়।
১৯ মার্চ, ২০১৭, কলকাতার উপকন্ঠ
ডোরবেলের ডিংডং শোনামাত্র তৃষার বুকের ভেতরে প্রজাপতির ওড়াউড়ি শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তটার জন্য সে আজ সারাদিন অপেক্ষা করেছে। তার স্বামী অরিত্র অফিস ট্যুরে নর্থ-ইস্টে গেছে। ফিরতে ফিরতে কাল দুপুর গড়িয়ে যাবে। আজ রোববার। অনেকদিন পর এমন রোববারের সন্ধ্যে। তার একমাত্র পুত্র পিকু গেছে ওর পিসির বাড়ি, ওর অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুদিন আগে। আজ সকালেই অরিত্রর বোন সহেলী ওকে নিয়ে গেছে, দিনকয়েক ওখানেই থাকবে।
সহেলী তাকেও যাবার জন্য খুব করে ধরেছিল। সে হেসে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সহেলী তো জানে না এমন একটা স্বপ্নের দিনের জন্য কতদিন সে অধীর অপেক্ষায় আছে!
আবার ডিংডং। অন্যমনস্কতা কাটিয়ে চপল পায়ে তৃষা সোজা দরজার সামনে। এক মুহূর্ত একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে দরজা খোলে সে। খোলা দরজার ফ্রেমে যে দাঁড়িয়ে তাকে এক পলক দেখে যেন একটা হার্টবিট মিস করে তৃষা। এই কি সেই ‘প্রমেথিয়ুস আনবাউন্ড’! বিশ্বাস হতে চায় না! এই ফরসা ঝকঝকে নব্য তরুণ, ছিপছিপে, লম্বায় ছ’ ফুট তার ফেসবুকের বন্ধু! গভীর দুটো চোখ, ডিম্পলড চিন,গালে নরম পিচ ফাজ দাড়ি। আরও দুটো হার্টবিট মিস করে তৃষা, বোকার মতো অপলক তাকিয়ে থাকে দরজায় দাঁড়ানো বছর ছাব্বিশ-সাতাশের এক দুরন্ত তরুণের দিকে।
ছেলেটা ‘মে আই?’ বলতেই তৃষা সলজ্জ ভঙ্গিতে সরে দাঁড়িয়ে বলে,“আয়াম রিয়েলি সরি। তোমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি, ভেতরে এসো।”
পিঠে গিটার ঝুলিয়ে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে আসে প্রমেথিয়ুস। তৃষা পিছন থেকে ছেলেটাকে দেখে। চওড়া কাঁধ, টাইট জিনসের তলায় একজোড়া লম্বা আকর্ষক পা। যাকে বলে আই ফিস্ট! বয়সে তার চেয়ে আন্দাজ বছর ছয়েকের ছোট তো হবেই। দিয়া, রনিতা সহ তৃষার যত বন্ধু আছে সবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিন্তু ব্যাপক খারাপ। ‘ফানি বোনস’ নামে এক ফেসবুক বন্ধু যখন দিয়ার বাড়িতে হাজির হয়েছিল তখন দিয়া সেই নামের আড়ালে এক গোমড়ামুখো মধ্যবয়স্ক কোম্পানি একজিকিটিভকে দেখে রীতিমতো হতাশ হয়েছিল।
সোফায় শরীর হেলিয়ে আরাম করে বসেছে প্রমেথিয়ুস। এক গ্লাস কোল্ড ড্রিংক এগিয়ে দিয়ে তৃষা হাসে,“তুমি বোসো আমি একটু আসছি।”
ত্বরিত গতিতে কিচেনে গিয়ে একটু বড় করে দম নেয়, খোলা জানলাটার বাইরে তাকায়। ওদের বাড়িটা কলকাতার গা-ঘেঁষা স্যাটেলাইট টাউনশিপে। ছোট ছোট প্লটে ছাড়া ছাড়া সব বাড়ি,তবু মানুষের কৌতুহল তো অসীম! তৃষা কিচেনের জানলাদুটো বন্ধ করে দেয়। বেডরুমে ফিরে আসে, জানলা এঁটে ঘরে রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে, তারপর এসি-টা চালিয়ে লিভিং রুমে ফিরে আসে। ততক্ষণে তার স্বপ্নের প্রমেথিয়ুস সোফায় বসে গিটারে সুর সংযোগ করতে শুরু করেছে। অনুপম রায়ের একটা জনপ্রিয় বাংলা গান ধরেছে। তৃষা সোফার হাতলটায় আলতো করে ঠেস দিয়ে বসে, গাঢ় চোখে তাকায় ছেলেটার দিকে। সে জানে স্বর্গ থেকে প্রমেথিয়ুস যে ভালবাসার আগুন চুরি করে এনেছে তার ছোঁয়ায় আজ সে আবার জেগে উঠবে। গত ছ’বছরে অরিত্রের থোড়-বড়ি-খাড়া প্রাত্যহিকতায় যে তৃষা নিভে এসেছিল সে আবার জেগে উঠবে। প্রমেথিয়ুস জাগাবে!
ঘন্টা দেড়েক পর বেডরুমের স্তব্ধতার ভেতর এক বুক ভারী দীর্ঘশ্বাসের মতো ভেসে আসে এসি মেশিনের শব্দ। দুটো কাঁচের বীয়ার বোতল আচমকা মৃদু শব্দ তুলে গড়িয়ে যায় খাটের তলায়।
প্রমেথিয়ুস বিছানা থেকে উঠে এসে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখটা দেখে আয়নায়। বাঁদিকের চোয়াল থেকে ঘাড় পর্যন্ত একটা গভীর আঁচড়ের দাগ, রক্ত ঝরছে এখনও। দাঁতে দাঁত চেপে প্রমেথিয়ুস স্বগতোক্তি করে,‘বিচ!’ শেষ মুহূর্তে হাতের বাঁধন খুলে মেয়েটা একটা অন্তিম আঁচড়ের দাগ কেটে গেছে। বেডরুম থেকে অ্যাটাচড বাথরুমে আসে প্রমেথিয়ুস। ছোট ওয়ার্ডরোব খুলে একটা আফটার শেভ লোশনের বোতল থেকে হাতে তরল ঢেলে চেপে ধরে চোয়ালের কাটা জায়গাটায়। সামান্য স্বস্তি পায়। খোলা দরজা দিয়ে সে ফের শোওয়ার ঘরটায় দৃষ্টি বোলায়। বিছানার ওপর আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে তৃষার নিস্পন্দ দেহটা। বিছানার চাদরটায় প্রবল ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন। মেয়েটার হাইলাইট করা একঢাল রেশমের মতো চুল ছড়িয়ে পড়ে ঢেকে দিয়েছে মুখখানি। নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস উড়ে গেছে কোন নিরুদ্দেশে। আর গলায় কোনও ধাতব তারের কেটে বসার চিহ্ন।
চুলের ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছে তৃষার দুটি নিথর অবিশ্বাসী চোখ। যে চোখ প্রমেথিয়ুসের আগুন দেখতে চেয়েছিল।
নিষ্পলক প্রাণহীন চোখদুটো ছেলেটার মধ্যে খুব অস্বস্তি জাগাচ্ছে। ছেলেটা খাটের কাছে ফিরে আসে। তারপর ঝুঁকে পড়ে তৃষার মৃতদেহটার দিকে। হাত দিয়ে বুঁজিয়ে দেয় ওর চোখদুটো, রেশমী চুলের গাছি মুখের ওপর থেকে সরিয়ে কানের ওপর রাখে। বিছানার পাশে বেডসাইড টেবিলে পড়ে থাকা তৃষার মোবাইলটা তুলে নেয়। খুঁজে খুঁজে তৃষার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ‘প্রমেথিয়ুস’-কে আনফ্রেন্ড করে ফোনটা রাখতে এক মুহূর্ত থমকায় তারপর ফের মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক অ্যাপসটা আনইনস্টল করে দেয়। রাত দশটা। দশমিনিট পর স্যাটেলাইট টাউনশিপের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে ‘প্রমেথিয়ুস আনবাউন্ড’। নিজের মোবাইল থেকে একটা নির্দিষ্ট নম্বরে ৯ এমবি-র একটা ভিডিও ক্লিপিং পাঠিয়ে দেয়।
তিনটে কুকুর অন্ধকার রাস্তা দিয়ে রাতের প্রহরে এক আগন্তুককে হাঁটতে দেখে পিছু নেয়। আক্রোশে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গরগর করে ওরা চেঁচায়। ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়ায় ‘প্রমেথিয়ুস আনবাউন্ড।’ তার চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। তিনটে কুকুর ভয়ে লেজ গুটিয়ে পিছোতে থাকে।
৪ এপ্রিল, ২০১৭,লালবাজার, কলকাতা
স্বরাষ্ট্র সচিব, এডিজি আর কমিশনার সাহেবের জয়েন্ট ভিডিও কনফারেন্সটা শেষ হওয়া ইস্তক ডিসি ডিডি মনন শীলের মুখটা তোম্বা হয়ে আছে। এটাই বোধহয় তার কেরিয়ারের সবচেয়ে কালো দিন!
“কলকাতা আর বিধাননগর পুলিশের আজ চূড়ান্ত লজ্জার দিন”— এই বাক্যটা দিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব ভিডিও কনফারেন্সটা শুরু করেছিলেন। তারপরের একঘন্টা ছিল হাইট অফ হিউমিলিয়েশন। কমিশনার সাহেব বলেছিলেন, “বাঙালি গোয়েন্দা পুলিশের নাম যদি মনন শীল হয় তবে কেসগুলো সলভ না হয়ে তো কবিতা হয়ে যাবে! রাইট মনন? এবার আকাশকুসুম চিন্তন-মনন বাদ দিয়ে লেটস ডু সাম রিয়েল অ্যাকশন। তবে তো হ্যাশট্যাগ মনন শীল সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হবে, নয় কি?”
খোঁচাটা গিলে নিয়েছিল মনন। তার সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকার প্রতি হোম সেক্রেটারির কটাক্ষ হজম করে নিতে হয়েছিল। তখনই আবার কমিশনার সাহেব বলতে শুরু করেছিলেন,“সুহানি পান্ডে, তৃষা সরকার, ইভা স্যান্ডার্স এবং ঈশিতা সেন। এরা সবাই গত দেড় মাসে রেপড অ্যান্ড মার্ডার্ড। সবগুলো খুন কলকাতা মেট্রোপলিটন সিটি ও বিধাননগর, রাজারহাটের ভেতর ঘটেছে। অথচ এই চারটে কেসেই খুনীকে চিহ্নিত করা তো দূরের কথা এখনও পর্যন্ত লালবাজার পুলিশ অথবা বিধাননগর কমিশনারেট একটা সিঙ্গল লিডও পায়নি।”
কমিশনারকে থামিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব গম্ভীর গলায় তখন বলতে শুরু করেছিলেন,“মিডিয়া বিষয়টা কোন লেভেলে নিয়ে গেছে দেখতেই পাচ্ছেন। কালকেই সন্ধ্যেবেলায় একটা চ্যানেলে আলোচনার শীর্ষক দেখলাম— ‘কলকাতার নরকে নারী!’ সিএম এই বিষয়টায় অত্যন্ত বিচলিত এবং বিরক্ত। উনি জানিয়েছেন চারটে কেসই সলভ হওয়া চাই বিশেষত মার্কিন নাগরিক ইভা স্যান্ডার্সের কেসটা। আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেল ইতিমধ্যে সিএম-কে চিঠি দিয়ে বিষয়টা দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করতে বলেছেন। ছ‘মাসের মধ্যে আততায়ী ধরা না পড়লে ওরা কেসটা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন জানাবে। মনন, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য গ্র্যাভিটি অফ সিচ্যুয়েশন? ন্যাচারালি মুখ্যমন্ত্রী চান না তদন্তের ভার কোনও সেন্ট্রাল এজেন্সির হাতে গিয়ে পড়ুক। সিএমও থেকে বলা হয়েছে এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স রাখা হবে, কাজে কোনও শিথিলতা বরদাস্ত করা হবে না। কেসটা সলভ করো, না হলে ইউ হ্যাভ টু ফেস দ্য মিউজিক।”
নিজের অফিস চেম্বারে বসেছিল মনন। তার সুদীর্ঘ ঋজু শরীরটা যেন হঠাৎ উপরওয়ালার বাক্যবাণে ঈষৎ অবনত। মাথার মধ্যে হোম সেক্রেটারি আর কমিশনারের বলা কথাগুলো বোলতার মতো একটানা বোঁ বোঁ করছিল। সামনের চেয়ারে সিনিয়র ইনস্পেকটর জাভেদ আলি। কেস ফাইলটা সামনের টেবিলে খোলা পড়ে আছে। ঠান্ডা মেরে যাওয়া লিকার চায়ে চুমুক মেরে মনন শীল বলল,“ক্যারি অন।”
জাভেদ আলি মাথা নেড়ে পড়তে শুরু করল—
কেস নম্বর-২১, পূর্ব যাদবপুর থানা, তারিখ-১৩/৩/২০১৭
ভিকটিমের নাম— সুহানি পান্ডে
বয়স—২৭ বছর
পেশা— প্রস্টিটিউশন
মৃত্যুর কারণ—স্ট্র্যাঙ্গুলেশন
ইনকোয়েস্ট রিপোর্টে বলেছে ভিকটিমকে খুন করার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। পেনিট্রেশন হয়েছে নৃশংসভাবে, শরীরে এবং যোনিতে প্রচুর কাটাছেঁড়া ছিল। ভ্যাজাইনাল ফ্লুইডের সঙ্গে সিমেন পাওয়া গেছে।”
মনন মাঝপথে জাভেদকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “আচ্ছা, রেপড অ্যান্ড মার্ডার বাই স্ট্র্যাঙ্গুলেশন— এটা তো সবগুলো কেসেই কমন। জাভেদ, তুমি একটা জিনিস বল তো আর কোনও কমন এলিমেন্ট পাচ্ছো কিনা। আমি ভুলও হতে পারি তবু দেড়মাসের মধ্যে ঘটা এই চারটে কেস যেন আমার ঠিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। ঘটনার আগে ভিকটিমদের লাস্ট লোকেশন কি ছিল বল তো। লোকাল থানার কেস ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের রিপোর্ট থেকে বল।”
“সুহানি শর্মার একজন এজেন্ট ছিল, মানে দালাল। সীবন সিং। কমিশন নিয়ে ইদানীং দুজনের মধ্যে একটু ঝামেলা চলছিল। তবে সীবন জানিয়েছে, সেদিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ নিজের এলাকা থেকে একটু এগিয়ে গনেশ টকিজের কাছে সুহানি দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয় ভিকটিম তৃষা সরকারের বাড়ি রাজারহাট অ্যাকশন এরিয়া টু। স্বামী একটা বড় মোবাইল কোম্পানির রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার। ট্যুরে গিয়েছিল নর্থ-ইস্টে। একটিমাত্র ছেলে বছর ছয়েকের, সে পিসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। ওই পিসি সহেলি মিত্র জানিয়েছেন, সেদিন ১৯ মার্চ যখন তিনি তৃষা সরকারের বাড়ি যান তার ভাইপোটিকে আনতে তখন তিনি তৃষাদেবীকে তার বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি রাজী হন না। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে যান। সহেলিদেবীর ধারণা, তৃষাদেবী একাধিক পুরুষবন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করতেন, তার দাদা অরিত্রর সঙ্গেও ইদানীং সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল বৌদির। সহেলির ধারণা সেদিন উনি ফিরে আসার পর বাড়িতে তৃষার কোনও পুরুষবন্ধুর আগমন ঘটেছিল।”
“তৃষা সরকারের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, উইচ্যাট, হোয়াটস্যাপ চেক করা হয়েছে? এনি লিড?”
“না স্যার, তৃষার মোবাইলে ফেসবুক নেই”, জাভেদ মাথা নাড়ে।
“দ্যাটস ওয়েয়ার্ড! হতে পারে তৃষা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ থেকে ফেসবুক করতেন। আবার এমনও হতে পারে আততায়ী খুন করার পর প্রমাণ লোপাটের জন্য তৃষার মোবাইল থেকে ফেসবুক আনইনস্টল করেছে। তবে তৃষার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ট্রেস করা তেমন সমস্যা হবে না। তুমি বাকি কেসগুলো বল।“
“ইভা স্যান্ডার্স, বয়স ৩৫, মার্কিন নাগরিক। তিন মাসের ভিসা নিয়ে ঘুরতে এসেছিল ভারতে। জয়পুর থেকে গত সপ্তাহেই কলকাতায় এসে পৌঁছেছিল। উঠেছিল সদর স্ট্রিটের হোটেল অ্যাস্টরে। একাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল ভারতে, দিনচারেক আগে বেদ মালিক নামে একটা অবাঙালি ভারতীয় বয়ফ্রেন্ড জুটেছিল। অ্যাস্টর হোটেলের ম্যানেজার বলেছে এই ক’দিন ওই পাঞ্জাবী ছেলেটাই সঙ্গ দিচ্ছিল। তবে সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত দুজনেই একটা নাইট ক্লাবে ছিল। রাত দুটো নাগাদ ওরা ‘তন্ত্রা’ থেকে বেরিয়েছিল, সিসিটিভি ক্যামেরায় রেকর্ডেড আছে। তারপর ভোর পাঁচটা নাগাদ ময়দান থানার পুলিশ প্যাট্রোলিং জিপ রেড রোডের ধারে ইভার ডেডবডি দেখতে পায়। রেপড অ্যান্ড মার্ডার্ড বাই স্ট্র্যঙ্গুলেশন।”
“বেদ মালিককে ইন্টারোগেট করা হয়েছে?”
“হ্যাঁ, ময়দান থানার আইও ইন্টারোগেট করেছে। বড়লোকের লালটু ছেলে, ভীতুর ডিম। ওর বক্তব্য হল— ইভা এবং বেদ দুজনে রাত দুটো নাগাদ তন্ত্রা নাইট ক্লাব বন্ধ হওয়ার সময় বেরিয়ে আসে। সদর স্ট্রিটের হোটেল অ্যাস্টর ইভার হাঁটাপথ। বেদ চেয়েছিল গাড়ি করে ওকে হোটেলে ড্রপ করে দিতে কিন্তু ইভা রাজী হয়নি। ও নাকি হেসে বলেছিল,‘আই নিড সাম ফ্রেশ এয়ার।’ তখন বেদ মালিক বাধ্য হয়ে একাই গাড়ি চালিয়ে তাদের বেলভেডিয়ার রোডের বাড়িতে ফিরে আসে।”
“শেষ ভিকটিম মানে ঈশিতা সেনের ব্যাপারটা?”
“ঈশিতা সেন কলেজ ছাত্রী, শোভাবাজারে বাড়ি। টিউশন পড়তে গিয়েছিল বাগুইআটি। আর ফেরেনি। বাগজোলা খালের পাশে সকালবেলা ওর মৃতদেহ পাওয়া যায়। মেয়েটা মৃত্যুর আগে ধর্ষিত হয়েছিল শুধু নয় পেনিট্রেশনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে জেনিটালিয়া ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর কারণ সেই একই— গলা টিপে অথবা গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন।”
শুনতে শুনতে মনন একটু অন্যমনস্ক হয়ে তার সামনে রাখা প্যাডে কালানুক্রমে কেসগুলোর ভিকটিমদের নামগুলো লিখে ফেলে পর পর।
সুহানি পান্ডে
তৃষা সরকার
ইভা স্যান্ডার্স
ঈশিতা সেন
কোনও প্যাটার্ন পাওয়া যাচ্ছে কি? নামগুলোর দিকে ফের তাকায় মনন। সবার বয়স ১৮ থেকে ৩৬ বছরের মধ্যে। ধর্ষণের তারিখগুলোর মধ্যে সাত-আট দিনের গ্যাপ। ধর্ষণ এবং খুনের ধরণ সব একই রকমের। ধর্ষণের তীব্রতা বেশি। কখনও পেনিট্রেশনের চোটে যোনি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে কিন্তু পাঁচটা খুনের ক্ষেত্রেই কোনও রক্তপাত নেই। কেন? নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে গভীর চিন্তায় ডুব দেয় মনন। হাত বাড়িয়ে জাভেদের সামনে থেকে ফাইলটা ফের টেনে নেয়। পাতা উল্টে উল্টে ক্রাইমসিন থেকে তুলে আনা ভিকটিমদের ফটোগ্রাফগুলো দেখতে থাকে মন দিয়ে। কপালে ভাঁজ পড়ে মননের। প্রতিটা মৃতদেহ দেখে মনে হচ্ছে যেন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে মেয়েগুলো। চোখ বোঁজা, পা আর হাত সুন্দর পরিপাটি করে রাখা। কোথাও কোনও অসঙ্গতি নেই। মুখচোখের ওপর থেকে অবিন্যস্ত চুল সরিয়ে কেউ যেন কানের ওপর গুছিয়ে রেখেছে। মুখচোখ যেন স্পষ্ট দেখা যায়। ধর্ষণের পর খুনের ক্ষেত্রে মননের অতীত অভিজ্ঞতা ঠিক এর বিপরীত। চুল মুখের ওপর পড়ে থাকে, ভিকটিমের শরীরও বেঁকে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে থাকে।
তবে কি খুনী ধর্ষণ এবং খুনগুলো করার পর শরীরগুলোকে সোজা করে শুইয়ে দিয়েছে নিজে থেকেই! কিন্তু এরকমটা কেন সে করতে যাবে? সাধারণত ধর্ষণ করে খুনের পর আততায়ী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্রাইম স্পট থেকে চলে যায়। তবে কি আততায়ী সরাসরি পুলিশকে কোনও বার্তা দিতে চাইছে অথবা…অথবা… ধর্ষণ আর খুনের পর খুনী ভিকটিমদের মৃতদেহগুলোকে সাজিয়ে কোনও ছবি তুলেছে! ছবি যাতে স্পষ্ট আসে তাই…
ভাবতে ভাবতে মনন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। চোয়ালের পেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে তার। সামনে বসা জাভেদ আলি সে উত্তেজনা টের পায়।
বেডফোর্ড হিলস, নিউ ইয়র্ক স্টেট, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
ঝকঝকে নীল রঙের নিসান আল্টিমা গাড়িটা হ্যারিস রোড ধরে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বেডফোর্ড হিলসের দিকে। গাড়ির চালকের আসনে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ডিটেকটিভ ব্যুরোর হোমিসাইড অ্যানালিসিস ইউনিটের অভিজ্ঞ মাঝবয়সী ইনস্পেকটর ব্রুস পেন। ডানহাত স্টিয়ারিঙে রেখে বাঁহাতে অধৈর্যভাবে তার নুন-মরিচ রঙা চুলে বারবার আঙুল চালাচ্ছিল ব্রুস। তার অসহিষ্ণু ভাবটা বারবার ফুটে উঠছিল। প্রিজন ওয়ার্ডেন ডানা মর্গ্যান তাকে সকালে ফোন করে জলদি চলে আসতে বলেছিল। কারণটা ফোনে জানায়নি, তবু ওর গলার স্বরে আপৎকালীন সমস্যাটার গুরুত্ব ধরা পড়েছিল। লোয়ার ম্যানহাটনের হেড কোয়ার্টার থেকে দুঘন্টা আগে রওনা দিয়ে ব্রুস পেনের এতক্ষণে বেডফোর্ড হিলস কারেকশনাল ফেসিলিটির সংশোধনাগারে পৌঁছে যাওয়ার কথা কিন্তু প্লেজান্টভিলের কাছেই স’ মিল রিভার পার্কওয়েতে গতরাতে এক ভয়ংকর পথদুর্ঘটনার পর রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি আটকে গিয়েছিল। ওয়ার্ডেন ডানা তার বিলম্ব দেখে বারবার ফোন করছে। এবার ফোনটা ধরে ব্রুস জানাল, “পৌঁছে গেছি। জাস্ট দু মিনিট।”
প্রায় ৪০ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বেডফোর্ড হিলস কারেকশনাল ফেসিলিটি সংশোধনাগার। বহু কুখ্যাত কয়েদী এখানে কারাবাস করছে। কাঁটাতারের উঁচু বেড়াটার পাশ দিয়ে হেঁটে ইনস্পেক্টর পেন সরাসরি প্রিজন ওয়ার্ডেনের ঘরে এসে ঢুকল। ওয়ার্ডেন ডানা মর্গ্যান যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। পেন এসে সামনের চেয়ারটায় বসতেই ডানা বলতে শুরু করল,“গতকাল আমাদের এখানকার একজন মহিলা প্রিজন গার্ডের ওপর দুজন কয়েদী হামলা করেছিল। ওরা প্রিজন গার্ড ভেরা রডরিগেজকে যৌন হেনস্থা করছিল। সময় মতো অন্য পুরুষ কারারক্ষীরা এসে না বাঁচালে হয়ত ওরা ভেরাকে ধর্ষণ করত।”
ব্রুস পেন নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ওয়ার্ডেন মর্গ্যানের দিকে। মনে মনে ভাবছিল, এ এমন কি নতুন কথা! দাগী আসামীরা সুযোগ পেলে জেলের রক্ষীদের আক্রমণ করে, পালাবার চেষ্টা করে।
“আপনি হয়ত ভাবছেন এতে নতুনত্ব কি!” পেনের মনের কথা আঁচ করে ডানা বলে,“কিন্তু এই দুজন কয়েদী হল ব্রংক্স এবং কুইনসের কুখ্যাত ‘রোজা ব্রমবার্গ ও ফ্যানি ওয়াটসন’ ধর্ষণ ও খুনের আসামী।”
ব্রুস পেন এবার নড়েচড়ে বসে। তার থ্যাবড়া নাক আর কঠিন চোয়ালে জেগে ওঠে অনুসন্ধিৎসা। এই কয়েদী দুজন ছ’মাস আগের সেই কুখ্যাত ধর্ষণ ও খুনের মামলার আসামী! দারিয়াস ওয়াশিংটন এবং ওর হাফ ব্রাদার জামাল ওয়াশিংটন। এই কেসটা ছ’মাস আগে ইনস্পেকটর ব্রুসের হাতেই এসেছিল। দুই ভাই দুটো ভিন্ন ঘটনায় যুক্ত ছিল। দারিয়াস একদিন রাতে কুইন্সের এক নির্জন ঘিঞ্জি গলির ভেতর রোজা ব্রমবার্গ নামে ইহুদী-আমেরিকান মেয়েটাকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল। অন্যদিকে জামাল ব্রংক্সের ফোর্ডহ্যাম স্টেশনের কাছে ফ্যানি ওয়াটসন নামের কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটাকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল।
“সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল”, প্রিজন ওয়ার্ডেন ডানা মর্গ্যান কোনও রহস্য ফাঁস করার ভঙ্গিতে বলতে থাকেন,“আমি ওয়াশিংটন ভাইদের ফাইল ঘেঁটে দেখেছি ওদের মা এক হলেও বাবা আলাদা। বড় ভাই দারিয়াসের জন্মদাতা পিতা হল বেন পাওয়েল আর ছোট ভাই জামালের পিতা টাইরন ওয়াশিংটন। ইনস্পেকটর পেন, আপনি জানলে অবাক হবেন যে এদের বাবারাও একসময় সাজাপ্রাপ্ত যৌন অপরাধী বা সেক্সুয়াল অফেন্ডার ছিলেন।”
এন ওয়াই পি ডি-র ডিটেকটিভ ইনস্পেক্টর ব্রুস পেন সত্যিই চমকে ওঠে। তার মনে পড়ে যায় দিনকয়েক আগেই সে ‘মলিকিউলার সাইকিয়াট্রি’ পত্রিকায় একটা নিবন্ধ পড়েছিল— ‘রেপ জিন : দি মিথ অ্যান্ড দ্য ফ্যাক্ট’। লেখিকা ন্যান্সি হোয়াইট।
ততক্ষণে তার অফিসের দেরাজ থেকে পুরোনো রেকর্ড ঘেঁটে ডানা দুটো ফাইল বের করে এনে খুলে ধরেছে। তথ্য বলছে বেন পাওয়েল প্রায় কুড়ি বছর আগে একটা কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেল খেটেছিল। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে টাইরন ওয়াশিংটন ঠিক আঠারো বছর আগে একটা শ্বেতাঙ্গ মেয়ের শ্লীলতাহানির দায়ে জেল খেটেছিল। সবচেয়ে কাকতালীয় বিষয় হল ওরা দুজনেই এই বেডফোর্ড হিলস সংশোধনাগারেই তাদের শাস্তির মেয়াদ কাটিয়েছিল।
“মিঃ পেন, আপনাকে আমি আজকে এই জন্যই ডেকে পাঠিয়েছি যে কাল যখন দারিয়াস আর জামাল প্রিজন গার্ড ভেরার ওপর চড়াও হতে গিয়ে ধরা পড়ে তখন আমি ওদের স্পেশ্যাল সেলে বদলি করার আগে আমার ঘরে ডেকে পাঠাই। ওদের প্রশ্ন করেছিলাম যে নারীদের যৌন নির্যাতন করাটা কি তোমরা তোমাদের বাবার কাছ থেকে শিখেছ? প্রশ্ন শুনে ওরা অবোধের মতো তাকিয়েছিল। একটুও রাগেনি। ওদের দেখে কাল মনে হয়েছিল ওরা যেন অপ্রকৃতিস্থ। জামাল চুপ করেছিল, শুধু দারিয়াস বলেছিল,‘দ্যাট ডে উই ওয়্যার ড্রাগড!’ তখন কথাটায় গুরুত্ব দিইনি, মনে হয়েছিল তরুণ ছেলেমেয়েগুলো তো ড্রাগ নিয়েই যৌন অপরাধে লিপ্ত হয়, এতে নতুন আর কি! কিন্তু ওদের দুজনকে পৃথক সেলে স্থানান্তরিত করার পর মনে হয়েছিল, আমি ঠিক শুনেছি তো! ওরা তো ‘উই টুক ড্রাগস’ বলেনি, বলেছিল ‘উই ওয়্যার ড্রাগড!’
“ওয়ার্ডেন মর্গ্যান”, ইনস্পেকটর পেন উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে,“আমি ইনমেটস দারিয়াস আর জামালের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।”
মিনিট দশেক পর তিনদিক নিরেট দেয়াল এবং একদিক আয়না-দেয়াল ঘেরা ইন্টারোগেশন রুমে এন ওয়াই পি ডি-র ডিটেকটিভ ব্রুস পেন বসেছেন। আসলে আয়নাটা পিছন থেকে বিলকুল স্বচ্ছ। সেটার পিছন থেকে জেরার ঘটনাক্রম দেখছে ডানা মর্গ্যান। জেরা করার টেবিলের উল্টোদিকে কমলা রঙের কয়েদিদের পোশাকে বসেছে ওয়াশিংটন ভাইয়েরা— দারিয়াস আর জামাল। দুজনেই বেশ শক্তপোক্ত চেহারার, উচ্চতা ছ’ফুটের ওপর। দারিয়াস একটু কম কথা বলে, জামালের আচরণ বন্ধুত্বপূর্ণ।
“গতরাতের অপ্রীতিকর ঘটনাটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে আমি আসিনি”, শুরুতেই পেন ওদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, “আমি আরেকবার ছ’মাস আগের ব্রংক্স আর কুইনসের ঘটনাটায় ফিরে যাব। আরেকবার বলবে সেদিন তোমরা কেন মেয়েদুটোকে ধর্ষণ করে খুন করেছিলে? তোমাদের কোনও অতীত অপরাধের রেকর্ড ছিল না, অথচ আচমকা তোমরা ওই গুরুতর অপরাধটা ঘটালে কেন?”
“এখন এসব কথার কি মানে আছে? ফেডারেল জাজ হ্যাজ গিভেন আস সেন্টেন্স”, বিরক্তির সুরে দারিয়াস বলে।
“তোমাদের কোনওরকম প্যারোলের শর্ত ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। আমি কিন্তু আপিল করে তোমাদের শাস্তির মেয়াদ কমাতে পারি।”
জামাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু দারিয়াস তাকে বাধা দিয়ে ব্রুস পেনকে তার বাঁহাতের মধ্যমা তুলে দেখিয়ে বলল, “কেটে পড়ো হে টিকটিকি, আমরা কিচ্ছু বলব না।”
জামালের দিকে তাকিয়ে ইনস্পেক্টর পেন তার হাতের শেষ তাসটা ফেলল, “আমি আপাতত তোমাদের তিনদিনের প্যারোলে মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারি।”
জামালের চোখে একটা আশার আলো ফুটে উঠল। সে তড়িঘড়ি বলে বসল, “ইনস্পেক্টর পেন, উই ওয়্যার ড্রাগড দ্যাট নাইট।”
নড়েচড়ে বসল ব্রুস পেন, “জামাল একটু বিস্তারিতভাবে ঘটনাটা বলবে?”
জামাল বলতে শুরু করে, “আমাদের ওই দিন একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। আমরা দুজনেই আসলে একটা বড় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অংশ ছিলাম। তিনমাস ধরে আমাদের নানারকমের ডায়েট দেওয়া হত, ওষুধ খাওয়ানো হত আর ইঞ্জেকশন দেওয়া হত। সেই ওষুধ আর ইঞ্জেকশনের মাঝে আমাদের নানারকমের পর্নোগ্রাফিক ফটো ও ভিডিও দেখানো হত। তখন আমাদের রক্তচাপ, হৃদস্পন্দনের গতি ইত্যাদি মাপা তো হতই সঙ্গে রক্তের নানারকমের পরীক্ষাও চলত। একটা বড় বাগানবাড়িতে রেখে আমাদের ওপর এই পরীক্ষাগুলো চালানো হত। পরীক্ষার সাবজেক্ট হিসেবে আমরা মোট বারোজন ছিলাম। ওই পরীক্ষার কথা গোপন রাখার জন্য আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত টাকা ট্রান্সফার করা হত। আমাদের পরিবারের কাছ থেকেও বিষয়টা গোপন রাখার শর্ত ছিল। আমাদের দরিদ্র সংসারের খরচপাতি ওই টাকাতেই মিটত। ফলে আমরাও গোপনীয়তার শর্ত অটুট রেখেছিলাম। আমরা জানতাম কোনও বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার ট্রায়ালের সাবজেক্ট ছিলাম আমরা।”
“কিন্তু সেই ট্রায়ালটা চালাচ্ছিল কে? কোনও নাম তোমরা জানো না?”, উদগ্রীব গলায় প্রশ্ন করে ডিটেকটিভ পেন।
হতাশভাবে মাথা নাড়ে জামাল। অনেকক্ষণ ভেবে বলল, “সেই বাগানবাড়ির বাইরে বেরোনো নিষেধ ছিল। আমাদের যখন বাইরে নিয়ে যাওয়া হত তখন গাড়িতে চোখ বাঁধা অবস্থায় রাখা হত। গন্তব্যে পৌঁছে চোখ খুলে দেওয়া হত। খুব বেশি হলে সপ্তাহে একদিন আমাদের বাইরে নিয়ে যাওয়া হত, প্রায় একবছর আগেকার ঘটনা এখন সব কিছু মনেও পড়ছে না। শুধু মনে আছে হাওয়া বদলের জন্য আমাদের মাঝেমধ্যেই একটা পার্কে নিয়ে যাওয়া হত যার দক্ষিণদিকে একটা গোলাপের বাগান ছিল। সেই গোলাপের বাগানের পাশেই বাউন্ডারি দেওয়া একটা কলেজ ছিল। আর কিছু মনে নেই।”
হতাশ চোখে জামাল তাকাচ্ছিল। ব্রুস পেন বলল, “ঘটনার দিন কি হয়েছিল?”
“আমি বলছি”, এতক্ষণে কথা বলার ঘোর অনীহা কাটিয়ে গম্ভীর গলায় দারিয়াস বলতে শুরু করল, “সেদিন শনিবার ছিল। সকালে আমাদের ব্রেকফাস্ট টেবিলে সারাদিনের রুটিন বলা হত। দু-চারজন লোক আমাদের খাওয়াদাওয়া, ওষুধপত্র দেওয়া আর পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য থাকলেও তারা মনে হয় তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিল না। কারণ ঘরের স্পীকারে একটা গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসত। ওই কন্ঠস্বরের মালিকই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন, নির্দেশ দিতেন। তাকে আমরা কখনও দেখিনি। শেষদিন সেই কন্ঠস্বর জানাল, ‘আজ এখানে দারিয়াস আর জামালের শেষদিন, তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। তোমাদের দুজনের অ্যাকাউন্টেই পঞ্চাশ হাজার ডলার করে ট্রান্সফার করা হবে, এখানকার সব কথা গোপন রাখার জন্য প্রতিমাসের টাকাটাও তোমরা আগের মতোই পাবে তবে শর্ত শুধু একটাই তোমাদের প্রত্যেককে একজন করে নারীকে ধর্ষণ করতে হবে। এই কাজটি করার সময় প্রমাণস্বরূপ ধর্ষণের একটি ভিডিও তুলে নির্দিষ্ট মোবাইল নম্বরে পাঠাতে হবে। সেই হোয়্যাটস্যাপ নম্বরে ভিডিওটির প্রাপ্তিস্বীকার হলেই তার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে পঞ্চাশ হাজার ডলার ট্রান্সফার হবে। কাজ শেষ হলে ফোনের সিমকার্ড খুলে ফেলে দিতে হবে।’ এরকম নির্দেশ শুনে প্রথমে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি, কিন্তু টাকার লোভ সামলানো কঠিন ছিল।
“সেদিন ব্রেকফাস্টের পর আমাদের দুজনকে একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। তারপরেই আমরা জ্ঞান হারাই। যখন আমার জ্ঞান আসে তখন দেখি আমি কুইন্সের এক পরিত্যক্ত পার্কের বেঞ্চিতে পড়ে আছি। উঠে বসে জ্যাকেটের পকেট হাতড়াতেই একটা মোটা খাম পাই। খুলতেই দেখি ভেতরে একটা স্মার্টফোন আর দুটো ওষুধের পিল। একটা ছোট চিরকুটও ছিল যাতে লেখা ছিল— ‘R’ আদ্যক্ষরের নামের একটি মেয়েকে খুঁজে নিয়ে ধর্ষণ করতে হবে। ধর্ষণের দশ মিনিট আগে খামের ভেতরের পিলদুটো খেয়ে নিও।’ ওই কাগজটায় নির্দিষ্ট ফোন নম্বরটা লেখা ছিল।
আমি হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় একটা পাব-এ ঢুকি। সন্ধ্যের পর এখানে যৌন ব্যবসায় লিপ্ত মেয়েরা আসে। তখনই ঠিক করে নিই, ওদের মধ্যেই কাউকে বেছে নিতে হবে যার নামের আদ্যক্ষর ‘R’ হবে। বারে বসে পরপর তিনখানা বীয়ার শেষ করে ফেলি কিন্তু আমার অভীষ্ট লক্ষ্য সিদ্ধ হয় না। রাত দশটা নাগাদ যখন হতাশ হয়ে বার থেকে বেরিয়ে আসছি তখনই শুনতে পাই একটি মেয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো সতেরো-আঠারো বছরের অন্য একটি মেয়েকে হাত নেড়ে বলছে,’গুডনাইট রোজা’।
আমি সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হয়ে উঠি, রোজা নামের এই ইহুদী-আমেরিকান মেয়েটার পিছু নিই। তখনই আমি পকেটের ভেতর খামে রাখা ওষুধের বড়িটা বের করে মুখে পুরে ফেলি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ টের পাই, যৌনাঙ্গের দিকে রক্তের সঞ্চালন যেন দশগুণ বেড়ে যায়, মস্তিষ্ক যেন আমার হাত-পা আর সমস্ত প্রত্যঙ্গের ভেতর এক ভয়ঙ্কর আগ্রাসী যৌনক্ষুধা সঞ্চারিত করে। বুদ্ধি-চেতনা সব লোপ পেয়ে যায়।
অন্ধকার গলির ভেতর মেয়েটা হঠাৎ বুঝি টের পায় তাকে কেউ ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। সে ঘুরে দাঁড়ায়। মেয়েটি নিজে গণিকা হলেও সেদিন আর কোনও খদ্দেরের সঙ্গে সে যেতে নারাজ, সরাসরি সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করে কিন্তু ততক্ষণে আমার রক্তে এক ভয়ঙ্কর নেশা চেপে গেছে। আমি মেয়েটার মুখ চেপে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাই সেই পরিত্যক্ত পার্কটায়। তারপর উপর্যুপরি দু-বার ধর্ষণ করে আমি যখন তৃতীয়বার ধর্ষণের সময় ভিডিও করছিলাম তখন মেয়েটা হঠাৎ মড়াকান্না কেঁদে ওঠে। রাতের অন্ধকারে ওর কান্না আমাকে সচকিত করে তোলে, আমি ঘাবড়ে গিয়ে ওর গলা টিপে ধরি। বিশ্বাস করুন ডিটেকটিভ পেন, আমার ওকে খুন করা উদ্দেশ্য ছিল না। নিজেকে বাঁচাতেই…”
স্বীকারোক্তি করে দারিয়াস যেন কিছুটা হালকা হল। তার চোখমুখে বিকেলের গাছের ছায়ার মতো বিষন্নতা নেমে এল। পাশে এতক্ষণ নীরব হয়ে বসেছিল জামাল, সে মাথা নিচু করে অনুতপ্ত গলায় বলে উঠল, “আমার গল্পটাও অনেকটা দারিয়াসের মতোই। সেই মেয়েটার নাম ছিল ফ্যানি ওয়াটসন। মেয়েটা ফোর্ডহ্যাম স্টেশনের কাছে হটডগ বিক্রি করছিল। ওর খাবারের খদ্দেররা ওর নাম ধরে ডাকছিল বলে আমি শুনতে পাই। ওর সঙ্গে ছদ্ম বন্ধুত্ব পাতিয়ে স্টেশনের বাইরে রেল ইয়ার্ডের পিছনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করি। খুনটা করি জানাজানির ভয়ে।”
বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ব্রুস পেন জেনে নিয়েছে ওয়াশিংটন ভাইদের কাছ থেকে। সিল্ডেনাফিল সাইট্রেটের চেয়েও ভয়ঙ্কর কোনও যৌনতাবর্ধক ড্রাগ বাজারে এনেছে কোনও কোম্পানি। তারা ট্রায়াল দিয়ে কয়েকটা ভয়ঙ্কর যৌনক্ষুধার্ত হিংস্র মানুষকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আসল কালপ্রিটদের খুঁজে বের করা মুশকিল। ব্রুসের হাতে লিড বলতে শুধু ওয়াশিংটন ভাইদের কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি। একটা পার্ক, পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিমদিক ঘেঁষে গোলাপের বাগান আর সেই বাগানের পাশেই একটা কলেজের বাউন্ডারি ওয়াল। তবে সম্ভবত এই জায়গাটা নিউ ইয়র্ক স্টেটের মধ্যেই কোথাও হবে, কারণ সেখান থেকে কুইন্স কিম্বা ব্রংক্স ঘন্টা দু-তিনেকের মধ্যেই পোঁছনো যায়। ব্রুস পেন আবার অধৈর্যভাবে তার নুন-মরিচ চুলে হাত বোলায়। এবার তাকে এখান থেকে বেরোতে হবে। নতুন করে আবার ওয়াশিংটন ভাইদের কেস ফাইলটা খুলতে হবে। আরো কিছু তথ্য চাই। দারিয়াসের বয়ান অনুযায়ী ছ’মাস আগে দারিয়াস ভাইদের পরেই আরো দশজন লোককে ছাড়া হয়েছে যারা ওই ট্রায়াল দেওয়া ওষুধের প্রভাবে সম্ভবত আরো যৌন অপরাধ করে থাকতে পারে। তবে সব অপরাধ নিউ ইয়র্ক প্রদেশে নাও হতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনও প্রদেশেও ঘটতে পারে। সেদিক থেকে দেখলে এই কেসটার ব্যাপ্তি আরো বেড়ে গেল।
গোয়েন্দা পেন উঠে দাঁড়ায়, “দারিয়াস, জামাল আমি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করব তোমাদের স্বল্পদিনের প্যারোলে মুক্ত করার। তাছাড়া আপিল করে তোমাদের শাস্তির মেয়াদ কমানোর চেষ্টাও করব। তবে তোমাদের উল্লেখযোগ্য কিছু মনে পড়লে অবশ্যই জানাতে ভুলো না। দ্যাট উইল হেল্প আ লট।”
“ডিটেকটিভ পেন, আমার একটা ব্যাপার মনে পড়ল”, জামাল মাথা চুলকে বলল, “একটা নাম আমি সেই বাগানবাড়িতে থাকার সময় শুনেছিলাম। হাউসকীপার, রাঁধুনি আর যারা সেই বাড়িটায় কাজ করত তারা একটা নাম বলাবলি করত— ডঃ বোর! আমরা কোনওদিন সচক্ষে তাকে দেখিনি, কিন্তু সব কাজের পিছনে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রধান মস্তিষ্ক। হতে পারে আমরা তখন স্পীকারে ডঃ বোরের কন্ঠস্বরই শুনতে পেতাম।”
১ পুলিশ প্লাজা, লোয়ার ম্যানহাটন, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
টেবিলভর্তি ডাঁই করা কাগজ আর কয়েক দিস্তা কম্পিউটার প্রিন্ট আউটের পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছিল নুন-মরিচ চুল। পঞ্চাশছোঁয়া ব্রুস পেনের চোখদুটো কম্পিউটার স্ক্রিনে সেঁটে আছে। নাকের ডগায় চশমা। টেবিলে রাখা ডিশে পড়ে আছে ঠান্ডা এগস বেনেডিক্ট আর এক কাপ কালো কফি। সকাল আটটায় অফিসে ঢুকে ব্রুস প্রথমেই ‘মলিকুলার সাইকায়াট্রি-তে ছাপা ন্যান্সি হোয়াইটের ‘ধর্ষণের জিন : রূপকথা এবং বাস্তব’ শীর্ষক নিবন্ধটা খুলে বসেছিল।
অত্যন্ত পরিশ্রমী ও মেধাবী লেখা, লেখিকা দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন পেনিটেনশিয়ারি বা কারেকশনাল ফেসিলিটি ঘুরে, আদালতের পুরোনো মামলার নথি যোগাড় করে, বহু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই সমৃদ্ধ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। ব্রুস পেন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল যে বাস্তবজীবন থেকে নেওয়া বহু কেসস্টাডির মধ্যে বেডফোর্ড হিলস সংশোধনাগারের ওয়াশিংটন ভাইদের পিতাদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাদের কথাই নয় ওয়াশিংটন ভাইদের ঠাকুরদাদের কথাও লেখা আছে, অর্থাৎ তারাও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন।
লেখাটা পড়তে পড়তে ব্রুসের চোখ কপালে ওঠার যোগাড়! হঠাৎ তার মনে পড়ল প্রায় এক বছর আগে দারিয়াস আর জামালেরা যে ভয়ঙ্কর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে গিনিপিগে পরিণত হয় সেখানে তাদের সঙ্গে আরো দশজন ছিল। অর্থাৎ আরো দশটা ধর্ষণের মামলা রেকর্ডেড থাকার কথা। নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টের ইন্টারনেট সংস্করণের আর্কাইভে ঢুকে পড়ল গোয়েন্দা ব্রুস পেন। ২০১৬ সালের আঠারোই জুন ওয়াশিংটন ভাইদের অপরাধের ঘটনাটা নথিভুক্ত হয়েছিল। তারপরের খবর সার্চ করলে হিসেব মতো আরো দশটা ধর্ষণের খবর পাওয়া যাবে।
ঘন্টাখানেক সার্চ করার পর নিউ ইয়র্ক, ভারমন্ট, ম্যাসাচুসেটস, নিউ জার্সি এবং পেনসিলভানিয়া মিলিয়ে আঠারোই জুনের পর থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দশখানা নয় তবে আরো পাঁচখানা ধর্ষণসহ খুনের সংবাদ পাওয়া গেল। এরপর অনেকদিন ধরে ধর্ষণের খবর আর নেই। দুটো কেসে ডোয়েন ‘বাবালু’ জ্যাকসন এবং গাই স্টিওয়ার্ট নামে দুজন ধর্ষককে গ্রেপ্তার করাও হয়েছে। বাকি তিনটে কেসে এখনও পর্যন্ত পুলিশ কোনও সাফল্য পায়নি।
ডিটেকটিভ ব্রুস পেন টেবিলের ওপর থেকে একটা প্যাড টেনে নিয়ে ধর্ষিতা মেয়েগুলোর নাম এবং অপরাধগুলো ঘটার তারিখ এবং যে ক্ষেত্রে আততায়ী গ্রেপ্তার হয়েছে তার নামসহ একটা সংক্ষিপ্তসার লিখে ফেলল।
ভিকটিমের নাম অপরাধের তারিখ অভিযুক্তের নাম
রোজা ব্রমবার্গ ১৮ জুন, ২০১৬ দারিয়াস ওয়াশিংটন
ফ্যানি ওয়াটসন ১৮ জুন, ২০১৬ জামাল ওয়াশিংটন
অ্যানা পার্কার ৩০ জুন, ২০১৬ কোনও গ্রেপ্তার হয়নি
নিনা পুলম্যান ১২ জুলাই, ২০১৬ ডোয়েন ‘বাবালু’ জ্যাকসন
কাইলি একহার্ট ২৬ জুলাই, ২০১৬ কোনও গ্রেপ্তার হয়নি
এস্থার সাঞ্চেজ ১৭ আগস্ট, ২০১৬ কোনও গ্রেপ্তার হয়নি
নাতালিয়া লুবিচ ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ গাই স্টিওয়ার্ট
নামগুলোর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ব্রুস। না কোনও প্যাটার্ন পাচ্ছে না সে, কোনও ষড়যন্ত্রের ছকও খুঁজে পাচ্ছে না সে। ঢক ঢক করে কফি খেল দু-কাপ। তবু তার মাথায় কিছু খেলছে না। তবে বাকি দুজন গ্রেপ্তার হওয়া আততায়ীর বিষয়টা খুঁজতে গিয়ে প্রত্যাশা মতো ডঃ ন্যান্সি হোয়াইটের নিবন্ধে ‘জ্যাকসন’ এবং ‘স্টিওয়ার্ট’ পরিবারের পূর্বপুরুষদের রেফারেন্সটা খুঁজে পেল। এর থেকে একটা জিনিস জলের মতো পরিষ্কার হল যে এই ভয়ঙ্কর পরীক্ষা নিরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত যে বা যারা তারা শুধু ন্যান্সি হোয়াইটের প্রবন্ধটাই পড়েনি, বিভিন্ন ডেটাও সংগ্রহ করেছে এখান থেকে। তবে খুব সম্ভবত গোটা বিষয়টা ঘটেছে ডঃ হোয়াইটের অগোচরে এবং অজ্ঞাতে। হঠাৎ জামাল ওয়াশিংটনের বর্ণনা অনুযায়ী ডঃ বোরের অস্তিত্বের কথা মনে পড়ে যায় ব্রুসের। কে এই ডঃ বোর?
তখনই গুগল করে দেড়শো জন ডঃ বোর পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে পেশাদার ডাক্তার হলেন একশো দশজন যারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ঠিক কোন বায়োডাটা ধরে খুঁজলে অভীষ্ট ডঃ বোর-এর নাগাল পাওয়া যাবে বলা মুশকিল। তার চেয়ে নিউ ইয়র্কে গোলাপ উদ্যান সম্বলিত পার্ক খুঁজে বের করা সোজা। প্রায় আড়াই ঘন্টা পরে পেনের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। কম্পিউটারের পর্দায় গুগল ম্যাপে ফুটে উঠেছে সিরাকিউজের থর্নডেন পার্কের স্থানাঙ্ক যার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ই এম মিলস গোলাপের বাগান। বাগানের পশ্চিমেই সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা। ব্রুস পেনের মাথায় আলোর মতো জ্বলে উঠল একটা চিন্তা। সে গুগলে ডঃ বোর সার্চ করে পাওয়া রেজাল্টগুলোকে ফিলটার করতেই মিনিট তিনেকের মধ্যেই তার সামনের স্ক্রিনে ফুটে উঠল ডঃ বোরের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত—
ডঃ এফ এন বোর (পুরো নাম : ফণীন্দ্রনাথ ভড়), বয়স ৬১ বছর, প্রাক্তন অধ্যাপক, মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগ, সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়
বাড়ির ঠিকানা : ১৬ ক্লারেন্ডেল এভিনিউ, থর্নডেন, সিরাকিউজ, নিউ ইয়র্ক।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ব্রুস পেন। তার মুখে ঈষৎ স্বস্তির হাসি। এখন শুধু তার একটা সার্চ ওয়ারেন্ট দরকার। সিরাকিউজের একটা বাড়ি তাকে অবিলম্বে সার্চ করতে হবে। কম্পিউটার থেকে বের করা প্রিন্টআউট গুলো একটা ফাইলে ভরে ব্রুস তার কিউবিক্যাল ছেড়ে চলল তার উপরওয়ালা অ্যাসিস্টেন্ট চিফ সার্জনের ঘরের দিকে।
ফণীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল : এন্ট্রি নং– ১
১২ মার্চ, ২০১১, সিরাকিউজ, নিউ ইয়র্ক
“করি কেমনে শুদ্ধ প্রেম রসের সাধন
প্রেম সাধিতে কেঁপে ওঠে কাম নদীর তুফান…।
বলব কি হইল প্রেমের কথা
কাম হইল প্রেমের লতা
কাম ছাড়া প্রেম যথা, তথা নাইরে আগমন।”
আমার সকল যন্ত্রণার প্রলেপ লালনের গান বাজছে। ল্যাবের চার দেয়ালের ভেতর অনুরণিত গানের চরণগুলি কিছুতেই আমার যন্ত্রণাকে সমবেদনায় মুড়ে দিতে পারছে না। যেন ভেতরের যন্ত্রণাটাকেই কোথাও উসকে দিচ্ছে। মার্চের রাত ন’টা। ইউনিভারসিটি হিলের ওপর সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবের নির্জন ঘরটা যেন লালন ফকিরের গানের চরণগুলির উচ্চারণে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে উঠছে।
আজ দুপুরে ক্রিস্টিনা ফেন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমারই এক পোস্ট ডক্টরাল মার্কিন ছাত্র নাইজেলের সঙ্গে। নাহ্ ক্রিস্টিনা আমাকে কোনও আগাম সংকেত দেয়নি, আমি কোনও দুঃস্বপ্নেও ওদের সম্পর্কের কথা অনুমান করতে পারিনি।
ক্রিস্টিনা ছিল আমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, বয়সে আমার চেয়ে সতেরো বছরের ছোট। জন্মসূত্রে ক্রিস্টিনা ফেন ছিল জার্মান-আমেরিকান, এক সময়ে আমার পোস্ট ডক্টরালের ছাত্রী ছিল সে। পরে আমার ল্যাবের প্রোজেক্টেই রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে যোগ দেয়। আমার প্রথম স্ত্রী মানসীর অকালমৃত্যুর পর আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ক্রিস্টিনা। তখন আমার একমাত্র পুত্র উজান হার্ভার্ড ল’ স্কুল থেকে পাস করে ওকালতির প্র্যাকটিস শুরু করেছে, সেও আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের প্ররোচনায় ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য আমাকেই দায়ী করে। আমি তখন একা। সম্পূর্ণ একা। বিধ্বস্ত এক মানুষ।
একদিন দুপুরবেলা ল্যাবে আমি মানসীর স্মৃতির ভেতর ডুবে ছিলাম। ওর স্মৃতি আমাকে কষ্ট দিত, আঁচড়াত। ক্রিস্টিনা এসে আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়াল। আমার মাথাটা ওর বুকে টেনে নিল। আবেগরুদ্ধ কন্ঠে বলল,”স্টপ ক্রাইং ফণী। আই’ল অলোয়েজ বী দেয়ার ফর ইউ।“
ধীরে ধীরে ক্রিস্টিনার গন্ধটা আমার সমস্ত চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে তুলল। বেদনা উপশমকারি মলমের মতো আমার ভেতরের যন্ত্রণাটাকে অবশ করে ফেলল। তার মাসছয়েক পর আমি ক্রিস্টিনাকে বিয়ে করে ফেললাম। আমি মানে ডঃ এফ এন বোর ওরফে ডঃ ফণীন্দ্রনাথ ভড়। সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনু জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক। তখন আমার বয়স ছাপ্পান্ন। শরীরে ভাটার টান। ক্রিস্টিনাকে বিয়ে করে পারিবারিকভাবে আমি একঘরে হয়ে পড়লাম। আমার ছেলে বিয়েটা মেনে নিল না, ওর ফোন আসা বন্ধ হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজন পরিবার সবাই যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। ফলে আমার জগতটা ক্রিস্টিনা আর গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল।
আমার ল্যাবে তখন অনেকগুলো প্রজেক্ট চলছে। রিসার্চ স্কলার, পোস্ট-ডক্টরাল ছাত্রছাত্রী মিলে প্রায় আটজন কাজ করে। তিনটি ভারতীয় মেয়ে, দুটি মার্কিন ছেলে, একটি শ্রীলঙ্কান আর শেষজন পুয়ের্তোরিকান মেয়ে। মূলত বার্ধক্যনিরোধী বিভিন্ন যৌগ ও কোষের ওপর তাদের ব্যবহার নিয়ে আমার ল্যাবের কাজ হত। আমার কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘অ্যাপোপ্টোসিস’ অর্থাৎ ‘প্রোগ্রামড সেল ডেথ’। ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে কোষের মৃত্যুকে বিলম্বিত করা এবং বার্ধক্যজনিত কোষের ক্ষয়রোধ করা আমার ল্যাবের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল। ‘আমেরিকান একাডেমি অফ অ্যান্টি-এজিং মেডিসিন’-এর সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল আমার গবেষণার সুবাদে। কিন্তু ক্রিস্টিনাকে নিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ থেকে মধুচন্দ্রিমা সেরে ফিরতেই একটা দুঃসংবাদ পেলাম।
শ্রীলঙ্কার ছাত্র মুরুগান এসে জানাল আমার বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছে। দেশের বোটক্স উৎপাদক কোম্পানীগুলোকে আক্রমণ করে আমি জার্নাল অফ বায়োকেমিস্ট্রিতে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেই নিবন্ধের উপজীব্য ছিল বোটক্সের যন্ত্রণাদায়ক ইঞ্জেকশন, অবাঞ্ছিত অ্যালার্জিক র্যাশসহ আরো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে বার্ধক্যনিরোধী কাজের সুবাদে আমি দেশের মধ্যে একটি পরিচিত নাম। ফেসবুক, টুইটারে আমার অনুগামীর সংখ্যা কয়েক হাজার। তাই আমার নিবন্ধ পরে অনেকেই প্রভাবিত হল। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই বোটক্স উৎপাদক কোম্পানিগুলোর বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেল। আসলে আমি বার্ধক্যনিরোধী হিসেবে রেসভেরাট্রল যৌগটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছিলাম।
ডার্ক চকোলেট আর রেড ওয়াইনে রেসভেরাট্রল থাকে। এর পরিমাণটা লাল মদ আর চকোলেটে ঠিক মতো টাইট্রেট করতে পারলে দারুণ বার্ধক্যনিরোধী ফলাফল পাওয়া যায়। রেসভেরাট্রল কোষে জমতে থাকা ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিক্যালকে সরিয়ে দিয়ে ত্বকে নতুন স্বাস্থ্যের জোয়ার আনে। এতো গেল জ্ঞানের কথা, আসল কথাটা হল আমার সঙ্গে মোটা টাকার বিনিময়ে দেশের কয়েকটা বড় বড় চকোলেট এবং রেড ওয়াইন প্রস্তুতকারক সংস্থার গোপন ডিল হয়েছিল। ওরা চেয়েছিল আমার প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক তকমাটা কাজে লাগিয়ে ওদের ব্যবসা বাড়াতে। আমিও রাজি হয়েছিলাম।
আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলাটা করেছিল ‘গ্ল্যামফেস কর্প’-এর সিইও পিটার রুফালো। আমি নিবন্ধে সরাসরি ওকেই আক্রমণ করেছিলাম। আবার দুশ্চিন্তা আমাকে চেপে ধরল। সারাক্ষণ বড় জরিমানার ভয়, আমিও জানতাম বোটক্স নিয়ে আমি যা লিখেছিলাম তা অত্যুক্তি। যে কোনও বড় বিজ্ঞানী সেটা প্রমাণ করে দিতে পারে। এদিকে ক্রিস্টিনার সঙ্গে দাম্পত্যের সম্পর্কটাও বছর ঘোরার আগেই ঝিমিয়ে পড়েছিল। আসলে আমার বয়স ছাপ্পান্ন, শরীরে ভাটার টান। ভেতরে ভেতরে একটা তীব্র সাইরেন বাজত—আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি। ক্রিস্টিনাও একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছিল।
কারণটা স্পষ্ট জানতাম। অ্যান্ড্রোপজ! তখনই সম্ভবত আমার ল্যাবের আনাচে কানাচে ক্রিস্টিনার সঙ্গে নাইজেলের প্রেম শুরু হয়। আমার এই ফুরিয়ে-আসা বৃদ্ধ শরীরটাকে ছেড়ে ক্রিস্টিনা কখন যে নাইজেলের উদ্দাম তরুণ পুরুষ শরীরটার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল টের পাইনি।
মেয়েদের ফুরিয়ে যাওয়াটা হঠাৎ করেই হয় প্রায়। কিন্তু ছেলেরা ধীরে ধীরে ফুরোতে থাকে। বুঝতে পারে ভাঁড়ার শূণ্য হয়ে আসছে। তাই অনেকদিন ধরেই লালনের গানটা বাজত মাথার মধ্যে। লালন বলেছেন, দেহ থেকেই দেহাতীতের খোঁজ মেলে।
ল্যাবের ভেতর ঢিমে তালে চলা লালনের গানটা পালটে গেছে।
“মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশের
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।“
ঝরঝর করে কাঁদতে থাকি। মানসী চলে গেছে। আমার একমাত্র ছেলে দূরে সরে গেছে। একমাত্র পাশে ছিল ক্রিস্টিনা। আমার শরীর-মনের সবটুকু ঢেলে তাকে ভালবেসেছিলাম, সেও আমাকে ছেড়ে অন্য শরীরের টানে চলে গেল আজ।
“…আট কুঠুরি নয়
দরজা আঁটা মধ্যে মধ্যে
ঝরকা কাটা…”
মাথার মধ্যে অস্থির ভাব। চেয়ার ছেড়ে উঠে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করলাম। লস এঞ্জেলেসের লাইন। আমার বন্ধু জেমস নর্থকাট। ইউনিভার্সিটি অফ লস এঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া। জেমস বায়োফিজিক্সের লোক, ওর মূল কাজটাও অ্যান্টি-এজিং নিয়ে। ওর ল্যাব থেকে একটা নতুন অ্যাপ তৈরি করেছে, পেটেন্ট এখনও পায়নি। সেটা আমার দরকার।
“হ্যালো, জিম। মে আই হ্যাভ ইওর ‘কাউন্টডাউন অ্যাপ’…নো নো…জাস্ট ফর আ ট্রায়াল।
ফোনের ওপাশে জিম ভাবছে। সময় নিচ্ছে। আমিও অপেক্ষা করছি। ওর বানানো নতুন অ্যাপ সম্পর্কে আমার মতো বৈজ্ঞানিকের মতামত ওর কাছে খুব মূল্যবান।
“…ওকে ওকে। আমি তাহলে কাল মর্নিং ফ্লাইট ধরেই লস এঞ্জেলেস পৌঁছচ্ছি। তোমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতেই দেখা হচ্ছে। টুয়েলভ নুন শার্প।“
ফনীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল : এন্ট্রি নং–২
১৪ মার্চ, ২০১১, লস অ্যাঞ্জেলেস
জেমস নর্থকাট একটা নতুন সফটওয়্যার তৈরি করেছে। এই অ্যাপটায় সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাপ্রার্থীর কিছু তথ্য ফিড করালে সেটা অ্যানালিসিস করে পর্দায় তার যৌনক্ষমতার সক্রিয়তার একটা লেখচিত্র তৈরি করে। সেই লেখচিত্রকে এক্সট্রাপোলেট করে ভবিষ্যতের একটা তারিখ পাওয়া যায় যেদিন সম্পূর্ণভাবে অ্যান্ড্রোপজ হয়ে যাবে। এই অ্যাপটা অবশ্য ইউনিসেক্স। পুরুষ–নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই তার যৌন সক্ষমতার অন্তিম দিনটি সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যাবে। আমি গতকাল লস এঞ্জেলেসে ডঃ নর্থকাটের গবেষণাগারে আসার পর থেকেই ওরা আমার রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। আমার রক্তচাপ, আমার কার্ডিয়োগ্রাফ, এনসেফালোগ্রাফ ছাড়াও রক্তে টেস্টোস্টেরনের মতো যৌন হর্মোনগুলোর পরিমাণ পরীক্ষা করল ওরা।
আজ রিপোর্টগুলো এসে গেছে। লাঞ্চের টেবিলে বসে জেমস আমাকে আগাম সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,”ডঃ বোর, পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক। লাইফ ডাজন্ট এন্ড হিয়ার, ইটস নাইস গ্রোয়িং গ্রেসফুলি ওল্ড।“
আমার মাথার মধ্যে তখন অস্ফুটস্বরে যেন লালন বেজে চলেছে—
“বলব কি হইল প্রেমের কথা
কাম হইল প্রেমের লতা
কাম ছাড়া প্রেম যথা, তথা নাইরে আগমন।”
লাঞ্চ সেরে জেমস আমাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল। কম্পিউটারে ‘বায়োলজিক্যাল কাউন্টডাউন’ নামের অ্যাপটা অন করল। এরপর গত চব্বিশ ঘন্টায় পরীক্ষা করে পাওয়া আমার তথ্যগুলো একটার পর একটা করে ওতে ফিড করতে শুরু করল। আমি দেখতে পেলাম ডেটাগুলো কম্পিউটারে ঢোকানো হচ্ছে। রক্তচাপ ১৫০/৯২…পালস ৭০…হিমোগ্লোবিন ১২.৫…ব্লাডসুগার ১২৬…টেস্টোস্টেরন ৩৭২ ন্যানোগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার…
সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনটা রান করানোর পর আমার ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করতে মিনিট পাঁচেক সময় নিল। তারপর পর্দায় একটা লেখচিত্র ভেসে উঠল। দেখতে পেলাম অনেকগুলো শৃঙ্গ, সমতল, উপত্যকা ছাড়িয়ে লেখচিত্রটা ক্রমশ নিম্নমুখী। পাশে বসা জেমস সেই শৃঙ্গ, সমতল আর উপত্যকার সংশ্লিষ্ট মানগুলো একটা সারণীতে বসিয়ে বোতাম টিপতেই কম্পিউটারের পর্দা জুড়ে বড় বড় লাল অক্ষরে একটা বার্তা ভেসে উঠল—“হেই বাডি, ইউ আর গোয়িং টু বী ‘স্পার্ম ব্যাঙ্করাপ্ট’ অন ২৫.১২.২০১১… সরি ফর দ্য ক্রিসমাস। নাউ পুট এ স্মাইল অন ইওর ফেস অ্যান্ড গ্রো গ্রেসফুলি ওল্ড।“
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তার মানে আমার হাতে আর মাত্র ন’মাস আছে। তারপর আমার অন্ডকোষের ভেতর আর শুক্রানু তৈরি হবে না। কিন্তু তাতে কি হল? আমি জেমস নর্থকাটকে প্রশ্ন করলাম, “শুক্রানু তৈরি হওয়ার সঙ্গে পুরুষের উর্বরতার সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু যৌন উদ্দীপনা কিংবা যৌন আচরণের কি সম্পর্ক? সেটা তো মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত। সুস্থ তরুণ পুরুষের অন্ডকোষে প্রচুর শুক্রাণু থাকতে পারে, রক্তেও টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ সর্বোচ্চ প্রায় ১০০০ ন্যানোগ্রাম হতে পারে, কিন্তু তাই বলেই কি সে কোনও নারীর সঙ্গে সঙ্গম করতে সমর্থ হবে যতক্ষণ না মস্তিষ্ক থেকে পাঠানো সংকেতে তার যৌন উদ্দীপনা তৈরি হবে? উত্তর দাও জেমস!”
আমার দিকে অবাক চোখে তাকায় জেমস। তারপর আমার কাঁধটা চেপে ধরে খুব মৃদুস্বরে বলে,”ট্রাই টু অ্যাক্সেপ্ট ইট, ডঃ এফ এন বোর।”
ফনীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল : এন্ট্রি নং–৩
১৪ এপ্রিল, ২০১১, সিরাকিউজ
আমার নিজের পছন্দের বিষয় হল মলিকিউলার বায়োলজি। ভারত থেকে এদেশে আসার পর গত বত্রিশ বছর ধরে আমি এই অনু জীববিদ্যা নিয়েই কাজ করে গেছি। কিন্তু আজ থেকে আমার গবেষণার পথ নিউরো-এন্ডোক্রাইনোলজির দিকে বেঁকে গেল।
মানসীর মৃত্যুর পর আমি শরীর-মনে সতেরো বছরের ছোট ক্রিস্টিনাকে ভালবেসেছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারি সেই ভালবাসায় শুধু শরীর ছিল, মন ছিল না। আমার এ শরীর ব্যর্থ বলে আজ ক্রিস্টিনা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ক্রিস্টিনা আর নাইজেল আমাকে যে আঘাত দিয়ে গেছে আমি তার প্রতিশোধ নেবই। আমি আজ প্রতিজ্ঞা করলাম, মানব শরীরকে আমি এক অপ্রতিরোধ্য যৌনাস্ত্র করে গড়ে তুলব। সেই প্রহরণ দিয়ে আমি মানবসভ্যতাকে রক্তাক্ত করে তুলব।
ডঃ এবস্টাইনের গবেষণাপত্র পড়ে আমি রীতিমতো মুগ্ধ। ইজরায়েলে এত ভাল কাজ হয়েছে! তার মতে মানুষের DRD4 জিন মানবসভ্যতার ইতিহাসটাকেই বদলে দিয়েছে। আমাদের এগারো নম্বর ক্রোমোজোমে এই জিন আছে। এই বিশেষ ডোপামিন রিসেপ্টর জিন ডি-ফোর, যাকে মানুষ আজ wanderlust gene বলে জানে, তার জন্যই ২০% মানুষ জীবনে ঝুঁকি নিয়েও দুর্গম স্থানে চলে যায়, গোটা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়, নানা কাজে ঝুঁকি নেয় এমনকি যৌন অপরাধের মতো কাজেও এগিয়ে যেতে পারে।
এবস্টাইন লিখছেন, আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স কোষের ভেতরকার এই জিনের জন্যই, বলা যায়, প্রায় ৬০,০০০ বছর আগে আফ্রিকার আস্তানা ছেড়ে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেটাই ছিল ‘গ্রেট হিউম্যান মাইগ্রেশন’। সম্ভবত তখনই DRD4 জিনের মধ্যে মিউটেশন ঘটে যায়। যার ফলে এমন কিছু জিন-পার্থক্যের মানুষ তৈরি হয় যারা জীবনের সব ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে নির্ভয় হয়, দুর্গমস্থানে ঘুরে বেড়ায়, বৈচিত্রপূর্ণ জীবন খোঁজে এবং ঝুঁকিপূর্ণ যৌনতায়ও লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করে। তবে এই জিন ভ্যারাইটিটা গোটা পৃথিবীতে মাত্র ২০% মানুষের।
ডঃ এবস্টাইনের সঙ্গে আমার ফোনেও কথা হল। উনিও আমার কাজের কথা শুনেছেন, শুভেচ্ছা জানালেন। তবে আমি যে ওর DRD4 জিন নিয়েই কাজ করতে চাই সেটা জানাইনি। সেটা জানালে আমার কাজের উদ্দেশ্যটাও যে ওকে জানাতে হয়। সেটা তো আর সম্ভব নয়।
আমি যে এক অপ্রতিরোধ্য মানব যৌনাস্ত্রবাহিনী বানাতে চাই! ক্রিস্টিনাকে আমি দেখিয়ে দেব আমি কী করতে পারি! ওহ্ ক্রিস্টিনা, ইটস পে-ব্যাক টাইম!
ফনীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল : এন্ট্রি নং–৪
৯ মে, ২০১১, সিরাকিউজ
ন্যান্সি হোয়াইট ইজ অ্যামেজিং! ওর মলিকুলার সাইকায়াট্রি-তে প্রকাশিত গবেষণাপত্র ‘রেপ জিন : দি মিথ অ্যান্ড দ্য ফ্যাক্ট’ নিবন্ধটা পড়লাম। ভেবে বেশ মজা লাগছে যে ভদ্রমহিলা এত খেটে আমার জন্য আগাম অনেকটা কাজ এগিয়ে রেখেছেন। ওর কেসস্টাডিগুলো খুব তথ্যবহুল এবং আমার জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয়। এখানে বর্ণিত পরিবারগুলো থেকেই আমার যৌনাস্ত্র তৈরির কাঁচামাল দিব্যি পাওয়া যাবে। রেপ জিন হয়ত একটা কাল্পনিক গল্প কিন্তু আমি নিশ্চিত যে এই পরিবারগুলোর পুরুষদের শরীরে DRD4 জিনের মিউটেটেড ভ্যারিয়্যান্ট আছে। এই সমস্ত পরিবারের পুরুষেরাই জীবনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পিছপা হবে না, আমি জানি। এখান থেকেই আমাকে কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু গোটা আমেরিকা জুড়ে এতগুলো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজটা মোটেই সহজ নয়। তাছাড়া কাজটা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষও বটে। এসব কাজে মন দিলে DRD4 নিয়ে আমার গবেষণার কাজটাই হবে না। কিছু বিশ্বস্ত লোক রিক্রুট করা দরকার যারা এই কাজটা গোপনে করবে। পরিবারগুলোর ওপর নিয়মিত নজর রাখবে, যোগাযোগ করবে, প্রয়োজনে আর্থিক লাভের টোপ দেবে।
ফনীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল : এন্ট্রি নং–৫
১১ মার্চ, ২০১২
আজ আমার সামনে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের জাল উন্মোচিত হল। এই ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড গ্ল্যামফেস কর্পের সিইও পিটার রুফালো। সে আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলাটা আগেই করেছিল, তারপর আমার পিছনে গোপনে কর্পোরেট সার্ভিল্যান্স লাগিয়ে আমার গবেষণাগার থেকে আমারই গবেষণালব্ধ তথ্য দিনের পর দিন চুরি করাচ্ছিল। আর সেই তথ্য পাচারের কাজটা করছিল আমারই পোস্ট ডক্টরালের ছাত্র নাইজেল ব্যানিস্টার এবং আমার দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী ক্রিস্টিনা ফেন। আজ বুঝতে পারছি আমার ল্যাবে নাইজেল কাজ করতে আসার পিছনে ওর আসল উদ্দেশ্য কি ছিল। শুধু তাই নয়, বোটক্স নির্মাতা কোম্পানীগুলোর পণ্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিম্নমানের প্রমাণ করার জন্য এবং ডার্ক চকোলেট ও রেড ওয়াইন নির্মাতা কোম্পানীগুলোর সঙ্গে বহু অর্থের বিনিময়ে গোপন আঁতাত করে আমি যে রেসভেরাট্রলকে প্রোমোট করার কাজ শুরু করেছিলাম— সেই খবরও তথ্যসহযোগে ক্রিস্টিন ফাঁস করে দিয়েছিল পিটার রুফালোর কাছে। ক্রিস্টিন-নাইজেলের এই নেক্সাস কর্পোরেট সার্ভিলেন্সের কাজটাও করেছিল রুফালোর কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু রুফালো ওদের কাজে লাগাতে যত টাকা খরচ করেছে তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমার কাছ থেকে তুলে নেবে আমার বিরুদ্ধে মামলা করে। অথবা এসব কিছু না করে রুফালো আমার বিরুদ্ধে যোগাড় করা সমস্ত প্রমাণ নিউ ইয়র্ক টাইমস কিংবা ওয়াশিংটন পোস্টের মতো মিডিয়ার হাতে তুলে দিয়ে আমার এত বছরের অর্জিত সম্মান ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে।
তবে আমি জানি বোটক্স ইন্ডাস্ট্রি শেষ হয়ে যাবে যেদিন আমি আমার আবিষ্কারের ব্যবহারিক প্রয়োগ করব এই পচা-গলা সমাজটার ওপর। বোটক্স তো শুধু মুখের কুঞ্চিত চামড়া মসৃন করে কিন্তু আমার এই নতুন লাইনের গবেষণালব্ধ ফলাফল মানুষকে আজীবন আগ্রাসী যৌন ক্ষমতা দেবে। আমার সামনে আমার স্বাক্ষর নিয়ে ঘুরে বেড়াবে আমার তৈরি যৌনাস্ত্রেরা, আর আমি এক ভয়্যারিস্ট ঈশ্বর হয়ে বেঁচে থাকব মানুষের মধ্যিখানে।
ক্রিস্টিনা আমাকে আর্থিকভাবে আর মানসিকভাবেও শেষ করে দিয়ে গেছে। বিয়ের আগে জাল করে একটা প্রি-নাপশিয়াল এগ্রিমেন্টে সই করে নিয়েছিল। আমি জানতামও না। এখন আমার কাছ থেকে তিন মিলিয়ন ডলার খোরপোষ চাইছে, আমাকে কোর্টেও টেনেছে ক্রিস্টিনা। এত সমস্যার জন্য আমার গবেষণার কাজ দীর্ঘদিন ব্যাহত হয়েছে। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ করার যে ডেডলাইন ছিল আমি তার থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে আবার নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে হবে।
নিউরোবায়োকেমিস্ট্রির আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবের অন্তঃস্থ অ্যামিগডালা। যৌনক্ষমতা এবং যৌন আচরণে অ্যামিগডালার ভূমিকা অসীম। ব্রেনের অ্যামিগডালায় ডোপামিন-4 রিসেপ্টরের সংখ্যা বেশি। এটা নিয়েও একটু এগোতে হবে।
ফনীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল : এন্ট্রি নং–৬
২১ জুলাই, ২০১৫
সব কিছু গুছিয়ে উঠতে দীর্ঘ তিনবছর কেটে গেল। এই সময়টায় শুধু মাথা গুঁজে কাজ করে গেছি। ইতিমধ্যে আমি সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করায় আমার জীবনের উদ্দেশ্য সাধনে আরো সময় দিতে পেরেছি। কাজ এখন পূর্ব-পরিকল্পনা মতো অনেকটা এগিয়েছে। ন্যান্সি হোয়াইটের নিবন্ধে বর্ণিত পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে আমার বিশ্বস্ত লোকেরা। আপাতত ওরা বারোজন ডি-ফোর ভ্যারিয়ান্টকে শর্টলিস্ট করেছে। ওদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু হয়েছে। বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ পরিবার। ওদের টাকাপয়সার খুব দরকার, ফলে সহজেই ওরা মাসিক অর্থলাভের টোপটা গিলেছে। তবে ওদের জানানো হয়নি এই বৈজ্ঞানিক ট্রায়ালের মূল উদ্দেশ্য, শুধু বলা হয়েছে ওরা একটা বহুজাতিক সংস্থার ওষুধের ট্রায়ালের ভলান্টিয়ার হয়ে আসছে। বানিজ্যিক কারণেই বিষয়টা গোপন রাখতে হবে, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও জানানো চলবে না। তাছাড়া এই বিষয়ে কিছু প্রকাশ করা হলে পরিবারপিছু মাসিক প্রাপ্য টাকাটাও চুক্তিভঙ্গের দায়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আমার গবেষণার কাজটাও অনেকটা সাফল্যের পথে। আমার তৈরি একটা বিশেষ যৌগ একশোটা ইঁদুরের শরীরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে দেখেছি তিনমাস পর ওদের মধ্যে প্রায় আশিটার মধ্যমস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবে বিনাইন টিউমার তৈরি হচ্ছে যা ব্রেনের অ্যামিগডালা অঞ্চলের D4 ডোপামিন রিসেপ্টরের অ্যাগোনিস্টিক সক্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার আবিষ্কৃত যৌগটার নাম রেখেছি আমার নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে FNB4, ইদানীং লক্ষ্য করছি ইঁদুরগুলোর যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার মনে হচ্ছে আমি তৈরি, আসল হিউম্যান ট্রায়ালের সময় আসন্ন।
ক্রিস্টিনা ফেন তৈরি থাকো। আমার সব অপমানের প্রতিশোধ নিতে আসছি। যে প্রতিশোধের কথা গোটা দুনিয়া মনে রাখবে, আয়াম কামিং!
ফনীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল : এন্ট্রি নং–৭
১৮ জুন, ২০১৬, রাত ১২.০০ টা
গত মার্চমাসে আমার বেছে নেওয়া যুদ্ধের বারোজন সেনানীকে থর্নডেনের ক্লারেন্ডেন এভিনিউয়ের বাড়িটায় এনে তুলেছিলাম। বাড়িটা বিশাল স্পেনীয় ঔপনিবেশিক ভিলাগুলোর মতো হওয়ায় তেমন অসুবিধা হয়নি ওদের থাকার বন্দোবস্ত করতে। তাছাড়া বাড়িতে চাকরবাকর ও ভাড়া করা কিছু অস্ত্রধারী লোক রেখে ওদের ওপর সব সময় নজরদারি চালিয়েছি। মূলত বারোজনকে ঘরেই অন্তরিন রাখা হত। কোনও কারণে ওরা বাইরে বেরোলে ওদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হত, যাতে কোথায় রয়েছে বা কোথায় যাচ্ছে বুঝতে না পারে। ওদের সামনে আমিও কোনওদিন যাইনি, ফলে ওরা কখনও আমার পরিচয় জানতে পারেনি।
গত তিনমাস ধরে ওদের প্রতিদিন আমার লোকেরা দুবেলা করে FNB4 ইঞ্জেকশন দিত। প্রতি সপ্তাহে ব্রেন এমআরআই করে দেখা হত মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবে টিউমার কতটা বেড়েছে। রক্তচাপ ও রক্তের পরীক্ষাও নিয়মিত কর হত। আমি ইঁদুরের পরীক্ষার সময়ই পরীক্ষা করে দেখেছিলাম ব্রেনের টিউমার গঠনের পর ডোপামিন রিসেপ্টরের লাইগ্যান্ড হিসেবে ABT 724- ট্রাইহাইড্রোক্লোরাইড দিলে যৌন আকাঙ্ক্ষা বহুগুণ বেড়ে যায়। মানুষ নিয়ে পরীক্ষার সময়ও আমি এই যৌগটা দিয়ে দেখতাম অল্প অল্প করে। মূলত ABT 724 যৌগটি যৌনাঙ্গের দৃঢ়তা বাড়িয়ে ইরেক্টাইল ডিসফাংশনের নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়।
আজ আমার পরীক্ষার ব্যবহারিক ফলাফল জানা যাবে। যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম সকাল থেকে। আজ ওয়াশিংটন ভাইদের দুজনকে একসঙ্গে ছাড়া হল। আমার লোকেরা ওদের জামার পকেটে একটা খামে দুটো ওষুধের বড়ি দিয়ে দিয়েছিল। প্রথম বড়িটা ছিল ABT 724 আর দ্বিতীয় বড়িটা হল সিল্ডেনাফিল সাইট্রেট অর্থাৎ ভায়াগ্রা। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই ওষুধ দুটোর কম্বাইন্ড এফেক্ট দুই ওয়াশিংটন ভাইকে আমার কাংখিত ভয়ঙ্কর সেই যৌনাস্ত্র করে তুলবেই।
এখন রাত বারোটা বাজে, একটু আগে আমার মোবাইলের হোয়াটস্যাপে দারিয়াস রোজা ব্রমবার্গ নামে এক ইহুদি-আমেরিকান মেয়েকে ধর্ষণের ছবি পাঠিয়েছে। এতদিনে আমার পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল দেখছি চোখের সামনে। মনে হচ্ছে আমার উদ্দেশ্য অবশেষে সফল হল। ক্রিস্টিনা আমাকে কোনওদিনও হারাতে পারবে না। আমি কোনওদিন ফুরিয়ে যাব না, এক ভয়্যারিস্ট ঈশ্বর হয়ে আমি এদের মধ্যেই বেঁচে থাকব। আমি অমর। কিন্তু জামাল ওয়াশিংটনের ভিডিও এখনও এল না কেন? আহ্ এই তো টুং শব্দ করে জামালের পাঠানো ভিডিও মেসেজ ঢুকল আমার মোবাইলে। কি শান্তি!
ফনীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল : এন্ট্রি নং–৮
১২ অক্টোবর, ২০১৬
আমার উদ্দেশ্য বুঝি সফল হল না। ওয়শিংটন ভাই দুজন আজ নিউ ইয়র্ক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। গাধা দুটো ভয়ে মুখ খুললে সব ভেস্তে যাবে। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। আমার সাত নম্বর সৈনিক গাই স্টিওয়ার্ট গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতেও কার্যসিদ্ধি করেছে। কাগজে লিখে দেওয়া আমার নির্দেশ অনুযায়ী ‘N’ আদ্যক্ষরের নাতালিয়া লুবিচ নামে একটি ক্রোয়েশিয়ান-আমেরিকান মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করেছে। আবার চারদিন পর আমার অষ্টম সৈনিককেও যুদ্ধে পাঠানোর কথা ছিল। সব মনে হচ্ছে আপাতত বাতিল করতে হবে।
একটু আগে ফক্স নিউজে দেখাল ব্রংক্সের একটা জায়গা থেকে পুলিশ দারিয়াস আর জামালকে প্রিজন ভ্যানে তুলছে। জামাল নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিককে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু দারিয়াস ওকে ইশারায় থামিয়ে দিচ্ছে। হয়ত জামাল পুলিশ হেফাজতেই ভয়ে সব কিছু ফাঁস করে ফেলবে। না এদেশে থাকা আর নিরাপদ নয়। আমাকে এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে হবে।
ইন্ডিয়া ইজ কলিং…
১ পুলিশ প্লাজা, লোয়ার ম্যানহাটন, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭
এফ এন বোরের লেখা দিনলিপির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ব্রুস পেন উত্তেজনায় দুপুরের লাঞ্চটা সারতেই ভুলে গিয়েছিল। প্লেটের ওপর একটা পিনাট বাটার অ্যান্ড জেলি স্যান্ডউইচ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন ডায়েরিটা বন্ধ করে পাশে রেখে ব্রুস পেন তার মোটাসোটা ঘুমন্ত স্যান্ডউইচটায় বড়সড় কামড় বসালো। তারপর জুড়িয়ে যাওয়া কফিমগে একটা চুমুক দিয়ে তার চেয়ারটায় হেলান দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। গত দশদিন ধরে তার কপালের ওপর খোদাই করা যে চিন্তার ভাঁজটা ছিল তা এখন অনেকটা সরল আর মসৃন হয়ে এসেছে। এখন ছবির মতো সবটা সে দেখতে পাচ্ছে। একটা অর্ধোন্মাদ প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক তার ঘর-ছেড়ে-যাওয়া স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ নিতে এবং অ্যান্ড্রোপজের মতো একটা স্বাভাবিক জৈবিক ব্যাপার মেনে নিতে না পেরে সে ভয়ঙ্কর এক খেলায় মেতেছে। এমন কয়েকজন মানুষকে তাদের জিনের গঠন অনুযায়ী বেছে নিয়েছে যারা বেপরোয়া, ঝুঁকিপ্রবণ এবং অতিরিক্ত যৌনতৎপর বা বলা যায় যৌন অপরাধপ্রবণ। এরকম ভয়ঙ্কর একজন অপরাধীকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। লোকটা এভাবে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যেতে পারে না। জন্মসূত্রে লোকটা ভারতীয় হলেও গত বত্রিশ বছর ধরে আমেরিকাপ্রবাসী এবং বর্তমানে আমেরিকার নাগরিক। লোকটার থর্নডেনের পরিত্যক্ত বাসভবন থেকে তার হাউজকীপারকে ধরে জেরা করে ভারতের ঠিকানা জানা গেছে। ফণীন্দ্রনাথ ভড় ওরফে ডঃ এফ এন বোর কলকাতায় থাকতেন একসময়। খুব সম্ভবত এখন লোকটা সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। তাকে খুঁজে পাওয়া গেলে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে যাতে তাকে ফেডারেল ল’ অনুযায়ী আমেরিকার হাতে হস্তান্তর করা হয়।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ডিটেকটিভ ব্রুস পেন। এখন তাকে অনেকগুলো ফোন করতে হবে। ভারতীয় দূতাবাস, অভিবাসন দপ্তর, বিদেশমন্ত্রক ইত্যাদি। এখনও তার জানা নেই সিআইএ কিংবা এফবিআই এই বিষয়টায় নাক গলাবে কিনা। ব্যাপারটা এখন আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন উচ্চস্তরের অনুমতি ছাড়া তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একেবারেই সম্ভব নয়।
তার নুন-মরিচ চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে মধ্যবয়সী ব্রুস পেন অ্যাসিস্টেন্ট চিফ সার্জনের অফিসের দিকে হনহন করে হাঁটা লাগাল।
১৩ এপ্রিল, ২০১৭, কলকাতা
স্বরাষ্ট্র সচিবের ভিডিও কনফারেন্সের পর দিন দশেক কেটে গেছে এখনও চারজন ধর্ষক ও খুনীর একজনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। কলকাতা পুলিশ ও বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনস্থ সবগুলো থানাকে অ্যালার্ট করা সত্ত্বেও কোনও লাভ হয়নি। নিজের চেম্বারে ডিসি ডিডি মনন শীল মুখ ভার করে বসেছিল, উল্টোদিকের চেয়ারে জাভেদ আলিও অপ্রতিভ ভঙ্গিতে বসে। দুদিন পর বাংলা নববর্ষ। কমিশনার সাহেব বলেছেন কলকাতা আর বিধাননগর পুলিশের সমস্ত কর্মচারীদের ছুটি বাতিল। তৃষা সরকারের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখা গেছে ফ্রেন্ড লিস্টে খান চল্লিশেক ফেক অ্যাকাউন্টধারী আছে। ঠগ বাছতে ফেসবুক উজাড়! ওদিকে ঈশিতা সেনের কলেজের তিনজন বন্ধুকে বেআইনিভাবে তুলে এনে জেরা করতে গিয়ে জাভেদ আলি নিজেই কেস খেয়ে বসে আছে। তিনটি ছেলের মধ্যে একজনের বাবা হাইকোর্টের সম্মানীয় বিচারপতি! সবদিক মিলিয়ে মনন আর জাভেদ আলির ল্যাজেগোবরে অবস্থা।
টেবিলে রাখা মননের মোবাইলটা বাজছে। হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই মননের মুখে উদ্বেগের চিহ্ন। হোম সেক্রেটারি কলিং! জাভেদ আলি বলল, “কার ফোন স্যার?”
‘বাঘের ফোন’ বলে মনন ফোনটা কানে দিয়ে বলল,”হ্যালো স্যার।“
“কোথায় আছ? অফিসে না রেপিস্টের পিছনে? এনিওয়ে, যেখানেই থাকো, যে অবস্থাতেই থাকো, আধঘন্টার মধ্যে নবান্নে আমার চেম্বারে চলে এসো”, ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এল।
ফোনটা কান থেকে নামাতেই জাভেদ আলি জিজ্ঞেস করল, “কী বলল স্যার?”
বিরসবদনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মনন বলল, “আমার খাঁচায় এসো। তোমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাব!”
আঠাশ মিনিট আটান্ন সেকেন্ড পর হোম সেক্রেটারির ঘরে ঢুকে মনন বুঝল সকালে খবরের কাগজের রাশিফলটা দেখে এলে অন্তত একটা মেন্টাল প্রিপারেশন থাকত, জবাব টবাবও তৈরি করে আসা যেত। স্বরাষ্ট্র সচিব আজ একটা হলুদ কালো ডোরাকাটা শার্ট পরেছেন। উল্টোদিকে কমিশনার সাহেব অধোবদন হয়ে বসে আছেন। কিন্তু এই সাহেবটা কে? মুখটা অবশ্য চেনা চেনা লাগছে।
মননকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বোধহয় করুণাবশত হোম সেক্রেটারি সাহেব বসতে বললেন। সামনের চেয়ারে বসা সাহেবকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ইনি আমাদের ইউএস কনসাল জেনারেল।”
মনন প্রমাদ গুনল। প্রায় যেচেই বলে ফেলেছিল, “স্যার, ভেরি সরি, আমরা এখনও ইভা স্যান্ডার্সের ধর্ষক ও খুনীকে ধরতে পারিনি, তবে খুব শিগগির ধরে ফেলব।”
“কনসাল জেনারেল নিউ ইয়র্ক পুলিশের একজন ইনস্পেক্টরের সঙ্গে তোমায় কথা বলাতে চান। ইটস ইম্পর্ট্যান্ট।”
একটু ঘাবড়েই গেল মনন। বাঘ আজ নিজে না খেয়ে অন্য কাউকে দিয়ে খাওয়াবে নাকি!
কনসাল জেনারেল তার চেয়ারটা একটু মননের দিকে ঘেঁষে আইফোন সেভেনে ভিডিও কল শুরু করল। রিং হচ্ছে, ওখানে এখন রাত। বারদুয়েক রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ভেসে এল, “হেই, ইনস্পেক্টর ব্রুস পেন হিয়ার ফ্রম এন ওয়াই পি ডি।”
আইফোন স্ক্রিনে নুন-মরিচ চুলের এক মাঝবয়সী লোকের ছবি ফুটে উঠল।
কনসাল জেনারেল বলল, “ব্রুস আমার সঙ্গে আছে কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার মনন শীল, তোমার সমস্যায় ইনি সাহায্য করতে পারবেন।”
“হাই মনন, আয়াম গনা’ ব্রিফ ইউ দিস। নিউ ইয়র্ক, ভারমন্ট, ম্যাসাচুসেটস, পেনসিলভানিয়া, নিউ জার্সি প্রদেশগুলোয় সব মিলিয়ে গত এক বছরে সাতজন নারী ধর্ষণসহ খুন হয়েছে। এখনও পর্যন্ত চারজন গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু এর পিছনে আছেন একজন বিজ্ঞানী। সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এফ এন বোর। আসলে ভয়ঙ্কর এক ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ধর্ষণ হওয়ার কথা ছিল বারোটি মেয়ের। শুনে হয়ত অবাক লাগছে, কিন্তু এটাই সত্যি।
উনি একজন বাঙালি, কলকাতায় পৈতৃকবাড়ি। পূর্ব পুরুষদের মধ্যে যৌন অপরাধ করার ইতিহাস আছে এমন পরিবারের বারোজন আমেরিকান পুরুষকে বেছে নিয়ে উনি তাদের জিনঘটিত বিষয় নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন তিনমাস ধরে। পরীক্ষা চলাকালীন নানা রকমের ওষুধ প্রয়োগের ফলে ওই বারোজনের প্রত্যেকে দাগী ধর্ষক ও খুনী হয়ে ওঠে। তিনমাস পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বলা হয় ডঃ বোরের নির্দেশমতো যদি তারা প্রত্যেকে একজন করে মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করার পর সেই যৌন অপরাধের ভিডিও তুলে পাঠায় তবে তাদের প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে পঞ্চাশ হাজার ডলার ট্রান্সফার করা হবে।
সব কিছুই ডঃ বোরের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিকঠাক চলছিল। ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাতজন লোক সাতটি মেয়েকে ধর্ষণ করার পর অক্টোবর মাস নাগাদ হঠাৎ দুজন ধর্ষক-আততায়ী নিউ ইয়র্ক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। তখন সমস্ত ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিজ্ঞানী বোর তার পরিকল্পনার বাকি অংশ মুলতুবি রেখে ভারতে পালিয়ে আসে। যেহেতু এফ এন বোর নিজে একজন অনাবাসী ভারতীয় এবং মার্কিন নাগরিক, তাই ভারত তাকে ধরে অবিলম্বে আমেরিকার হাতে প্রত্যার্পণ করুক। আমি আপনাদের সুবিধার জন্য সমস্ত তথ্য— ধর্ষিত ও খুন হয়ে যাওয়া মেয়েদের নাম, ডঃ বোরের ছবি, তার লেখা ডায়েরির পাতার ফটোকপি এবং তার কলকাতার বাড়ির ঠিকানাসহ সবকিছু ইমেল করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
ওপাশ থেকে একটানা বলে যাচ্ছিল ব্রুস পেন। পুরো ঘটনাটা শুনে মনন রীতিমতো হতভম্ব। এরকম অর্গানাইজড রেপ অ্যান্ড মার্ডার করাও সম্ভব! কিন্তু এন ওয়াই পি ডি-র দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ইতিমধ্যে সাতজন আততায়ীর মধ্যে চারজনকেই গ্রেপ্তার করতে পেরেছে! দারুণ হীনমন্যতায় ক্ষীণ হয়ে যাওয়া গলা সামান্য তুলে মনন স্কাইপ-কলে-থাকা ব্রুস পেনকে আশ্বস্ত করতে চাইল। কিন্তু বুঝতে পারল তার আশ্বাসে যেন সেই জোরটা খুঁজে পাচ্ছে না।
মনন চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে কনসাল জেনারেল বললেন, “ডিটেকটিভ শীল, ফ্রম দিস মোমেন্ট এন্টায়ার মুভ উইল বি রিগার্ডেড অ্যাজ জয়েন্ট অ্যাকশন অফ এনওয়াইপিডি অ্যান্ড কলকাতা পুলিশ।”
কনসাল জেনারেলের কথায় হোম সেক্রেটারি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। মননের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে হাসলেন, “দিস টাইম আই ওয়ান্ট সাকসেস”
ঘর ছেড়ে বেরোনোর আগে মননের মনে হল আজ বাঘ স্রেফ গন্ধ শুঁকে ছেড়ে দিল!
আরও আধঘন্টা পরে ডেপুটি কমিশনার মনন শীল লালবাজারে তার অফিসে ফিরে এসে ল্যাপটপ খুলে তার ইমেল অ্যাকাউন্ট চেক করতে গিয়ে দেখল ব্রুস পেনের একটা ইমেল এসেছে। সঙ্গে তিনটে অ্যাটাচমেন্ট। প্রথমটা ফনীন্দ্রনাথ ভড় ওরফে এফ এন বোরের জার্নালের পাতার পিডিএফ। দ্বিতীয়টা ধর্ষিত ও খুন হয়ে যাওয়া মেয়েদের নামের তালিকা। সঙ্গে ধর্ষণের তারিখ ও গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের নাম। তিন নম্বর অ্যাটাচমেন্টে অভিযুক্ত ডঃ এফ এন বোরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, তার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ডিটেল এবং কলকাতার বাসভবনের ঠিকানা।
মনন এমনিতেই নিজের কেসগুলো নিয়ে একটু ঘেঁটে আছে, তার ওপর এন ওয়াই পি ডি-র পাঠানো ইমেল অনুযায়ী নতুন এক দায়িত্ব কাঁধে চাপল। কে জানে কোন বুনোহাঁস না বুড়ো খ্যাঁকশিয়ালের পেছনে দৌড় করাবে। ইমেলের তথ্য অনুযায়ী ফণীন্দ্রনাথ ভড় একজন অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক অধ্যাপক। তার ঠিকানা লেখা আছে—২৮/২এইচ অ্যালেনবাই রোড। ঠিকানাটা মনন গুগল ম্যাপে যাচাই করতে গিয়ে দেখতে পেল ভবানীপুর অঞ্চলে নর্দার্ন পার্কের কাছে। সম্ভবত পুরোনো দোতলা বাড়ি। এটায় পুলিশ রেড করার অনেক ঝামেলা। কাজটায় যথেষ্ট লোক লাগবে। লোকাল থানা থেকে পুলিশ ট্যাগ করতে হবে, তার আগে ইনফর্মার লাগিয়ে খোঁজখবর করতে হবে, একটা রেকি করতে হবে। লোকটা কখন বাড়ি থাকে, কখন বের হয়, বাড়িতে আর কেউ থাকে কিনা জানা দরকার। কনসাল জেনারেলের মতো ভিআইপি যেখানে ব্যাপারটায় ইনভলভ সেখানে খুব তাড়াতাড়ি কাজটা সারা দরকার। কিন্তু সবার প্রথমে দরকার স্বরাষ্ট্র সচিবের লিখিত অনুমতি। অনেক ডিপ্লোম্যাটিক প্রোটোকলের ব্যাপার। তবু এই কাজটা ফেলে রাখা যাবে না। স্বরাষ্ট্র সচিবের শেষ বচনখানা তার মনে পড়ল। ইয়েস হি নিডস এ সাকসেস ভেরি ব্যাডলি!
ইনস্পেক্টর জাভেদ আলি ইমেলের ফাইল অ্যাটাচমেন্টগুলোর প্রিন্ট আউটগুলো বের করে এনে সামনের চেয়ারে বসল। কিছুটা অনীহা সত্ত্বেও মনন হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিল। তার নিজের কাজের মধ্যে এরকম একটা উটকো কাজ এসে পড়ায় মনন কিছুটা হতাশ! মনে হচ্ছে আজকের রাশিফলটা তার ব্যাপক খারাপ। সবে দুপুর বারোটা, গোটা দিনটা এখনও বাকি পড়ে আছে। না জানি কপালে আরো কি কি লেখা আছে! সন্দেহবশত ঈশিতা সেনের কলেজের সেই বন্ধুকে তুলে এনে জেরা করার পর ছেলেটার ‘হাইকোর্টের জজসাহেব বাবা’-র কড়কানি খেয়ে জাভেদ আলি একটু ব্যাকফুটে চলে গেছে।
“দিস ইজ ইন্টারেস্টিং,” জাভেদ আলি তার দিকে কয়েকটা প্রিন্ট আউটের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “স্যার, এটা পড়ুন, ফণীন্দ্রনাথ ভড়ের জার্নাল।”
হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে মনন ক্যাজুয়ালি পড়তে শুরু করল। দু মিনিট পর তার ক্যাজুয়াল ভাবটা কেটে গিয়ে সে মনোযোগী হয়ে উঠল। আরো পাঁচ মিনিট বাদে তার শিরদাঁড়া টান টান হয়ে উঠল। আরো তিন মিনিট পর তার রক্তে অ্যাড্রিনালিন রাশ। এতো এক উন্মাদ মানুষের কল্পকথার মতো লাগছে। এ বৈজ্ঞানিক তো মানববোমা তৈরি করেছেন! এই রেপিস্টরা যে আসলে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি এক একটা ভয়ঙ্কর যৌনাস্ত্র!
“জাভেদ, আমাকে আমেরিকায় ধর্ষিত ও খুন-হয়ে-যাওয়া মেয়েগুলোর লিস্টটা একটু দাও তো!” জার্নালটা পড়া শেষ করেই মনন বলে উঠল।
তালিকাটা এগিয়ে দিল জাভেদ আলি। মনন তাকাল। মেয়েগুলোর নাম তাদের ধর্ষণের তারিখের কালানুক্রমে পর পর সাজানো আছে। সাত সাতটা অভাগিনী মেয়ে। যারা জানতও না যে মানবতার কলঙ্ক এক উন্মাদ বুড়ো অধ্যাপকের অসম্ভব এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে তারা। মনন নামগুলো পর পর পড়তে শুরু করল। রোজা ব্রমবার্গ, ফ্যানি ওয়াটসন, অ্যানা পার্কার, নিনা পুলম্যান, কাইলি একহার্ট, এস্থার সাঞ্চেজ, নাতালিয়া লুবিচ।
টেবিলে রাখা রাইটিং প্যাডটা টেনে নিয়ে মনন খসখস করে নামগুলো লিখে ফেলল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল নামগুলোর দিকে। জাভেদ আলি দেখল তার বসের মসৃণ কপালে ফুটে উঠছে কয়েকটা ভাঁজ। তার বাঁহাতের আঙুল দিয়ে নাকের ডগা ঘষার মুদ্রাদোষ জাভেদ বিলক্ষণ চেনে। মাথায় এখন কোনও রহস্যের প্যাঁচ খুলছে। মনন এবার খোলা প্যাডে ইংরেজির কয়েকটি হরফ লিখে ফেলল। জাভেদ দেখল লেখা আছে— ‘R F A N K E N’
“এটা কী স্যার?”
কোনও উত্তর না দিয়ে প্যাডের পাতা উল্টে মনন ফের লিখে ফেলল— ‘S T E I’
হঠাৎ মনন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার চোখদুটো উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে দপ করে জ্বলে উঠল। তারপরেই মনন শূন্যে দুহাত ছুঁড়ে চাপাস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “ইয়েস!”
“কি হল স্যার?” অপ্রতিভ গলায় জাভেদ আলি প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।
“জাভেদ, তোমার মোবাইলে সুইগি ডট কমের অ্যাপটা আছে? থাকলে এখুনি আমাদের দুজনের জন্য দুটো আরসালানের বিরিয়ানি অর্ডার করে দাও”, মনন রহস্যময় হাসি হেসে ওঠে, “আমাদের কলকাতার চারটে ধর্ষণসহ খুনের কেসগুলো সলভ করে ফেললাম।”
বোকার মতো তাকিয়ে থাকে জাভেদ আলি, “বুঝলাম না স্যার।”
“দেখ জাভেদ, পর পর কালানুক্রমে আমাদের কলকাতার ধর্ষণের কেসে মৃত মেয়েদের নামগুলো ইংরেজিতে লিখে সাজালে দাঁড়ায়— সুহানি শর্মা, তৃষা সরকার, ইভা স্যান্ডার্স এবং ঈশিতা সেন। এদের নামের আদ্যক্ষরগুলো খেয়াল করো— ‘S T E I’
“এবার আমেরিকার এন ওয়াই পি ডি-র ধর্ষণের কেসগুলো তাকিয়ে দেখ আগের পাতায় লিখেছি”, পাতা উল্টে আগের পাতায় ফিরে যায় মনন, “এখানে সব মেয়েগুলোর নাম তাদের ঘটনাক্রম অনুযায়ী পর পর লিখেছি। তাদের নামের আদ্যক্ষর পর পর সাজিয়ে হয়েছে— ‘R F A N K E N’
“কম্পিউটারের প্রিন্টআউটটা ভাল করে খেয়াল করে দেখ এখানে। নিউ ইয়র্কের প্রথম দুটি মেয়ে রোজা ব্রমবার্গ এবং ফ্যানি ওয়াটসন দুজনেই একই তারিখে ধর্ষিত হয়ে খুন হন। বাকিদের ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ঘটেছে। তাই কালানুক্রমে সাজিয়ে রোজা আর ফ্যানির নামের আদ্যক্ষরের স্থান পরিবর্তন করে এভাবেও লেখা যায়— F R A N K E N
“এবার আমাদের হতভাগ্য মেয়েগুলোর আদ্যক্ষর এটার পাশে রাখলে দাঁড়ায়– F R A N K E N S T E I
ভুলে যেও না ব্রুস পেনের রিপোর্ট অনুযায়ী ফণীন্দ্রনাথ বারোজন মেয়েকে ধর্ষণ ও খুনের পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু দারিয়াস এবং জামাল ওয়াশিংটনের গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে মার্কিনদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসে। তবে ফণীন্দ্রনাথ কোনওদিনও তার উদ্দেশ্য ত্যাগ করেনি সে কলকাতা ফিরে এসেও তার পরিত্যক্ত পরিকল্পনার কাজ আবার শুরু করে দেয় যার ফলস্বরূপ কলকাতার বুকে আরো চারটে ধর্ষণসহ খুন হয়ে যায়। ফণীন্দ্রনাথ ভড় গোটা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছে যে সে এক ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ তৈরি করেছে। মেরী শেলীর লেখা সেই বিখ্যাত বইটা লেখার দুশো বছর পর সে গোটা পৃথিবীর সামনে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে বাস্তবের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। তার তৈরি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হল ডঃ ভড়ের নিজস্ব সিগনেচার, এক অপ্রতিরোধ্য যৌনাস্ত্র যা গোটা সমাজের যা কিছু সুন্দর, যা কিছু নির্মল তাকে ধ্বংস করতে চায়।”
জাভেদ আলি হাঁ করে চেয়ে থাকে তার বসের দিকে। সে কথা বলতেও ভুলে যায়। হঠাৎ জাভেদের মনে হয় বসের কাছে তার একটা পার্টিনেন্ট প্রশ্ন করা বাকি রয়ে গেছে।
“কিন্তু একটা বিষয় ক্লিয়ার হল না স্যার। কেয়া ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনওয়ালা’ সিগনেচার জরুরি থা? আখির ডঃ ভড় কো ইনমেঁ সে কেয়া মিলা?”
“কেয়া জাভেদ তুম ভি হদ করতে হো”, মনন ঘুরে তাকায় তার সহকর্মীর জিজ্ঞাসু চোখের দিকে, “ডঃ ভড়ের সেকেন্ড ওয়াইফের নামটা কী ছিল?”
ডঃ ফনীন্দ্রনাথ ভড়ের দিনলিপির প্রিন্ট আউটটায় একবার চোখ বুলিয়ে জাভেদ বলে,”যদ্দুর মনে পড়ছে ক্রিস্টিনা।“
“ইয়েস, ক্রিস্টিনা। ক্রিস্টিনা ফেন। নাউ লুক অ্যাট দিস”, মনন টেবিলে রাখা রাইটিং প্যাডটা টেনে সাদা পাতায় বড় বড় করে লিখতে শুরু করে— ‘KRISTENA FENN’
জাভেদের দৃষ্টিতে তখনও একটা বড়সড় জিজ্ঞাসা চিহ্ন ঝুলে আছে। সেটা খেয়াল করে মনন বলে,”KRISTENA FENN নামটা আসলে FRANKENSTEIN শব্দটার অ্যানাগ্রাম। বর্ণমালাগুলো একটু স্থান পরিবর্তন করলেই তার স্ত্রীর নামটা বেরিয়ে আসবে। অতএব বুঝতেই পারছ যে ডঃ ভড় কখনও তার প্রতিশোধ স্পৃহার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি।”
তাজ্জব বনে যাওয়া জাভেদকে দেখে ফের মনন তার মৃদু হেসে বলে ওঠে, “উঠে পড়ো জাভেদ। ইটস অ্যাকশন টাইম! ভুলে যেও না বারোজন নয়, এখনও পর্যন্ত এগারোজন খুন হয়েছে। তাছাড়া ফণীন্দ্রনাথের সিগনেচার ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ লেখাটাও সম্পুর্ণ হয়নি।”
১৩ এপ্রিল, ২০১৭, রাত ৮টা, কলকাতা
ঘরের ভেতরটায় মিষ্টি ফ্লোরাল ডিওর গন্ধ। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। আবছায়া জানালার কাচ। তার যৌবন বয়সের চেনা গানের মতো শোনাচ্ছে। তবু আজকের সন্ধ্যেটা সে এভাবেই সাজাতে চেয়েছে। আজ তার পোস্ট-ডক্টরাল ছাত্রী ভ্রমর আসছে। নামের মতোই ভ্রমরকৃষ্ণ চুল ওর। ভ্রূযুগল উড়ন্ত বকপাঁতি। বেদনা জাগায়, ভালবাসা জাগায়।
সে একটু সাবধানে থাকতে চায় তার পোষা জন্তুগুলো নিয়ে। তার একটা নেকড়ে আছে, একটা বাঁদর আর একটা কুকুর। ওদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে একটা অ্যান্টিডোট ইঞ্জেকশন দিতে হয়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে তবে কখন জেগে উঠবে ঠিক নেই। আর জাগলেই শুরু হবে উশখুশানি। সে বড় অস্বস্তিকর। ভ্রমরের সামনে জেগে উঠলে রক্ষা নেই!
ডোরবেল বাজছে। ওই বুঝি ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে। আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে!’ দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। খুলতেই দেখে সুন্দরী শ্যামাঙ্গিনী দরজার ফ্রেমে। কালো ব্রাসো শাড়ি, প্যাস্টেল প্রিন্ট। কমলা ব্লাউজ। বাঁধনখোলা ঈষৎ আলুলায়িত কুন্তল। কপালের মাঝখানে সূর্যোদয় হচ্ছে যেন। ভ্রমরকে এভাবেই দেখে সে। সব সময়। কল্পনায়।
কোথায় যেন একটা সাইরেন বাজল। চমকে ওঠে সে। এমন শব্দে তার পেটসগুলো না জেগে ওঠে!
“দেরি হয়ে গেল স্যার। ল্যাব থেকে সোজা এলাম। ডেটাগুলো আপনার কথা মতো গুছিয়ে আনতে একটু দেরি হল। ভ্রমর হাসে। আলো গড়িয়ে পড়ে ঘরের মেঝেয়। ও ল্যাপটপের ব্যাগটা রাখে টেবিলে। পায়ে পায়ে সামনে এগিয়ে আসে। বলে, স্যার আজ আপনাকে বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছে।“
ভ্রমরের স্তুতিতে সে একটু অপ্রতিভ হয়ে তার কুঁচকে যাওয়া ত্বক আর চোখের তলার মেদভরা পাউচে হাত বোলায়। উত্তর দেয় না, শুধু ওকে আপাদমাথা মেপে নেয়। ফ্লোরাল ডিওর গন্ধটা একটু জোরালো হয়ে তার নাকে ধাক্কা মারে। ফের কোথাও সাইরেনটা বেজে ওঠে। মেয়েটিকে এড়িয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে বলে, “তুমি বোসো, আমি কফি নিয়ে আসছি। ক্যাপুচিনো উইথ কুকিজ।”
আবার হাসে ভ্রমর। উদ্বায়ী অ্যাফ্রোডিসিয়াকের মতো হাসিটা তার দিকে প্রজাপতির মতো উড়ে আসে। দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। দরজার আড়াল থেকে লুকিয়ে লিভিংরুমে উঁকি দেয়। ল্যাপটপ খুলে ভ্রমর নিজের গবেষণার ডেটাগুলো চেক করছে। সে ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে থাকে। আবার সাইরেন বাজতে শুরু করেছে। একটা গররর গরর ডাক শুনতে পায় সে। খুব মৃদু অবশ্য। নেকড়েটা জেগে ওঠার আগে সব কিছু সারতে হবে। দ্রুত হাতে কফি বানাতে থাকে সে। কুকিজগুলো যেন কোথায় আছে, খুঁজতে থাকে। বেশ ফেনায়িত হয়ে উঠেছে ক্যাপুচিনো। আবার আড়চোখে বসার ঘরের দিকে তাকায় সে। শরীরটাকে ধনুকের ছিলার মতো বাঁকিয়ে ভ্রমর আড়মোড়া ভাঙল, তারপর লেইড ব্যাক স্টাইলে সোফার পেলবতায় নিজেকে ডুবিয়ে নিল। বড় সুন্দর তার এই ছাত্রী নাজমা হাসান ভ্রমর! বাংলাদেশ থেকে আসা তার এই ছাত্রীটিকে বারবার দেখেও মন ভরে না তার।
ভ্রমরকে অপলক দেখতে দেখতে তার ভেতরে অস্বস্তিটা আবার ফিরে আসছে। উডেন কাবার্ডটা খুলে একটা ছোট কৌটো বের করে আনল সে। ভেতরে ছোট ছোট সাদা রোহিপনলের বড়ি। বেঞ্জোডায়াজেপিনের ডেরিভেটিভ। এগুলো ডেট-রেপ ড্রাগ। মেয়েটার চিন্তা-চেতনা অবশ করে দেবে। সেও অনেকটা স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। তিনখানা বড়ি নিয়ে ভ্রমরের কফির কাপে মেশাতে শুরু করে। নিজের কফি কাপটাও টেনে নেয় সে, তার বরাদ্দ বড়ি দুখানা মিশিয়ে নেয়। তখনই তীব্রশব্দে ফের সাইরেনটা একটানা বাজতে শুরু করল। সে দু কান চেপে ধরে যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠল। খুব কাছেই নেকড়েটা গর্জন করতে শুরু করেছে। একটা ধ্বস্তাধ্বস্তি আর প্রতিরোধের শব্দ টের পাচ্ছে সে। নেকড়েটা লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেটাকে আটকাতে সে নিজের বুকের ওপর মৃদু চাপড় মেরে বলে, “স্টে কাম, স্টে কাম, এখনও সময় হয়নি।“
ট্রে-তে কফির কাপ দুটো আর কুকিজের প্লেট সাজিয়ে সে ফিরে আসে বসার ঘরে। তাকে আসতে দেখে গালে টোল ফেলে ভ্রমর হাসে। হাসিতে একরাশ সাদা কুন্দফুল ফুটিয়ে ভ্রমর হাতে তুলে নেয় কফির কাপ, মৃদু মৃদু চুমুক দেয়। সে দমবন্ধ করে তাকিয়ে দেখে আর ফুলের লুটিয়ে পড়ার প্রতীক্ষায় থাকে। নিজের কাপেও সে চুমুক দিয়েছে আগেই। ভ্রমর একটা ছোট্ট হাই তুলল। হঠাৎ ভুক ভুক শব্দ করে কুকুরটা ডাকতে শুরু করেছে। সে কুকুরের মতো নাক উঁচিয়ে কিছু শোঁকার চেষ্টা করে। ঘরের ভেতর একটা যৌনগন্ধী হাওয়া পাক মারছে।
জড়ানো গলায় ভ্রমর বলছে, “স্যার, মাথাটা আমার ঝিমঝিম করছে কেন? দিস কফি ইজ ফানি, হি হি হি!” তার ভ্রমরকৃষ্ণ একঢাল কালো চুল খোঁপা ভেঙ্গে মুখের ওপর পড়ল। শাড়ির স্খলিত আঁচলের তলায় ভ্রমরের অনাবৃত ফরসা কাঁধ আর গলায় পিছলে নেমে আসছে এক সম্মোহনী অদৃশ্য জ্যোৎস্না। এমন জ্যোৎস্নায় সে ডুব দিতে চায় কিন্তু তার বুকের ভেতর জন্তুগুলো জেগে উঠছে। কুকুরটা গরগর করে গজরাচ্ছে। একটা কামাসক্ত বোনোবো বাঁদর অস্থিরভাবে হুপহাপ শুরু করেছে।
ভ্রমর অচেতন হয়ে সোফাটায় এলিয়ে পড়েছে। সে তাকায় তার শিকারের দিকে, ভেতরের জন্তুগুলো প্রবল দাপাদাপি শুরু করেছে। এখন সে তার শরীরের গভীর থেকে নেকড়েটার ডাক শুনতে পাচ্ছে। রক্ত-জল-করা সে ডাক শুনে সে জেগে উঠছে। অনেকদিন পর তার শরীরটা ভয়ঙ্করভাবে জেগে উঠছে। তার রক্তের উন্মাদনা কিছুতেই শান্ত হবে না আজ। তার ভেতরে সমস্বরে গজরাচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর কুকুর, একটা কামাসক্ত বোনোবো আর এক অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা নেকড়ে। তার বৃদ্ধ অমসৃণ ত্বকের তলায় রক্তকণিকারা ছোটাছুটি করে।
নাকটা কুঁচকে উঠেছে। শরীরটা বাঁকিয়ে ছিলা ছেড়ে বেরোনো তীরের মতো সে ঝাঁপিয়ে পড়ে অচেতন ভ্রমরের শরীরের ওপর। তার মুখের কষ বেয়ে লালা ঝরে, ঘন ঘন উত্তপ্ত শ্বাস পড়ে। এখনও উন্মাদ সাইরেনটা কোথাও পাগলাটে শব্দ তুলে বেজে চলেছে। তার ঘরের সদর দরজায় আচমকা করাঘাতের শব্দ। বাইরে বহু মানুষের কোলাহল আর হুইসিলের শব্দ। নেকড়েটা আর অপেক্ষা করতে চাইছে না। লালাঝরা মুখ নামিয়ে আনে সেই অভীষ্ট নারীর সুগন্ধী শরীরে। নেকড়ের জেগে ওঠা শ্বদন্ত নেমে আসে ধবধবে জ্যোৎস্নাধোয়া সুন্দর গ্রীবায়।
কারা যেন সশব্দ পদাঘাতে দরজাটা ভেঙে ফেলেছে। খাদ্য থেকে মুখ তুলে নেকড়েটা চমকে তাকায়…
১৩ এপ্রিল, ২০১৭, রাত ১০টা, কলকাতা
ভবানীপুরের নর্দার্ন পার্কের পাশে দাঁড় করানো পুলিশ ভ্যানটার চারপাশে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়ানো প্রতিবেশীদের চোখে অসীম কৌতূহল। দীর্ঘদিন অনাবাসী প্রৌঢ় প্রফেসরসাহেব দেশে ফিরেছেন মাত্র ৭-৮ মাস আগে। কি এমন ঘটল যে পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। দু-চারজন মৃদু প্রতিবাদ জানাচ্ছে পুলিশি সক্রিয়তার। ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন সুবেশ ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বলল, “এক্সকিউজ মী স্যার, আপনাদের মনে হয় কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। ফণীবাবু সম্মানীয় অধ্যাপক, অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি…”
“নাহ্ আমাদের কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে না। আপনার কিছু জানার থাকলে কাল লালবাজারে আসুন, তবে দয়া করে এখন আমাদের কাজ করতে দিন”, বলে মনন শীল মোবাইলফোনে একটা নম্বর টিপে রিং করে। ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরতে সে বলে ওঠে, “হ্যাঁ স্যার…ওকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে…না স্যার তেমন রেজিস্ট্যান্স ছিল না…বৃদ্ধ মানুষ…হ্যাঁ স্যার ওর ঘর থেকে কিছু কাগজপত্র আর ওর মোবাইল ফোনটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে…হ্যাঁ ফোনটা আমার হাতেই আছে, আশা করি এটার সিমকার্ড আর ফোন মেমরি থেকে অনেক তথ্য পাব… দেরি হবে না স্যার এখনই আমরা লালবাজারের দিকে মুভ করছি…রাখি স্যার।”
মনন কমিশনারসাহেবের কলটা শেষ করে ফোনটা পকেটে রাখতেই ওর শার্টের বুক পকেটে রাখা ফণীন্দ্রনাথের বাজেয়াপ্ত করা ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে বের করে বুঝল শব্দটা মেসেজ টোন ছিল। একটা মেসেজ ঢুকেছে হোয়াটস্যাপে, ভিডিও মেসেজ।
৫ এমবি-র ভিডিও মেসেজটা ওপেন করল মনন। কিন্তু এটা কি? কি দেখছে সে চোখের সামনে! একটা অন্ধকার কানাগলিতে ভিডিওটা তোলা হয়েছে অস্পষ্ট মার্কারি ভেপার ল্যাম্পপোস্টের আলোয়। ছবিতে একটা পুরুষ শরীর তার শরীরের তলায় একটা নারীর শরীরকে পিষছে, নির্মমভাবে ধর্ষণ করছে। মেয়েটার গলায় চেপে বসছে জন্তুটার কর্কশ হাত। মেয়েটা শ্বাসরোধ হয়ে ছটফট করছে, চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে…আচমকা ভিডিও ক্লিপটা শেষ হয়ে গেল।
মননের সারা শরীর কাঁপছে ভয়ে আর প্রবল আক্রোশে। সে পুলিশ ভ্যানটার দিকে ঘুরে তাকায়। ঠিক সেই সময় ভ্যানের খোলা দরজা দিয়ে ফণীন্দ্রনাথকেও তোলা হচ্ছে। বৃদ্ধ অধ্যাপকও সেই মুহূর্তে ঘুরে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে ঝুলছে এক নৃশংস হাসি। মনন দেখে ফণীন্দ্রের ঠোঁট দুটিও যেন নড়ে উঠে দুটি শব্দের জন্ম দিল।
এত দূর থেকে মনন শুনতে পায় না কিছু তবু তার পুলিশি শিক্ষায় লিপ রিডিংটা সে জানে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে ফণীন্দ্রনাথ ভড় বলছেন, “প্ল্যান বি!”
Tags: উপন্যাস, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পার্থ দে, প্রহরণ, সুপ্রিয় দাস
সাংঘাতিক! স্রেফ দম আটকে পড়লাম পুরো লেখাটা।
অনন্য লেখনশৈলী! লেখাটা নিজেই টেনে নিয়ে গেলো! একটা অন্যরকম ঘোরলাগা কাজ করেছে
অসাধারণ একটা শ্বাসরুদ্ধকর গল্প পড়লাম।
অসাধারণ পার্থদা। মাইন্ডব্লোয়িং!!!
রুদ্ধশ্বাসে শেষ করলাম। অসাধারণ। hats off
যারা পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাদের সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।
My God, superb
এমন থ্রিলার বহুদিন বাদে পড়লাম.. বিষয় নির্বাচন, গবেষণা, নিটোল বুনোট এবং অদম্য গতি এই লেখা কে অতি উন্নত আধুনিক সাহিত্যের এক অন্যতম দলিল করবে.. এই বিশ্বাস রাখি.. আপনার কলম অমর হোক পার্থ দা.. আরও লেখা পাওয়ার অনুরোধ রইলো. প্রণাম.
পার্থ, অসাধারণ লেখা । খুব ভালো লাগল…টানটান উত্তেজনায় ভরা…শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত…বেশ ভালোরকম পড়াশুনা এবং পরিশ্রম যে রয়েছে এই অপূর্ব লেখার পিছনে তা ভালই বোঝা যাচ্ছে । অনেক বড় হ আর এইরকম আরো ভালো ভালো লেখা উপহার দে ভবিষ্যতে এই কামনা করি ।
অসাধারণ !
বহুদিন বাদে এরকম দমবন্ধ করা একখানা লেখা পড়লাম !
❤❤❤
অসাধারন!লিখতে থাকুন পার্থদা।
গতিময় এবং অত্যন্ত সুখ পাঠ্য। একরাশ মুগ্ধতা। ভালো থাকুন। আরও লিখুন। অনেক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা রইল ।
দম বন্ধ করে সবটা পড়লাম একটানা। মাইন্ড ব্লোয়িং!
Very much thrilling. Awsome story
durdanto lekha…apnar FB te etar kotha bolchhilen…aaj pore fellam ek niswas e………..
রোমহর্ষক!
antorjatik thiriller man er chitro natyo.darun.
কী ভীষণ ভয়ের ! দারুণ লেখা ! টানটান । শ্বাসরোধ হয়ে আসে ।